মোঃ খালিদ উমর এর সকল পোস্ট

মোঃ খালিদ উমর সম্পর্কে

কুয়াশা ঢাকা মানুষের মন বুঝতে চেষ্টা করি কিন্তু পারিনা!

নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৯

১৯।
সিনেমা আর কতক্ষণ চলতো জানিনা, কোচ ফকিরাপুল বাসস্ট্যান্ডে এসে থেমে গেলো। কোচের সুপারভাইজার শেখানো তোতা পাখির মত মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের সাথে ভ্রমণ করার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাজধানী ঢাকা

শহরে এসে তাদের যাত্রা পথের সমাপ্তি ঘোষণা করলো। যাত্রীরা সবাই একে একে নেমে গেলো রাশেদ সাহেবও তার ব্যাগটা খুঁজে নিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে কোচ থেকে নেমে গাবতলি গামী একটা লোকাল বাসে কল্যাণপুর নেমে ভোর হবার বেশ অনেক আগে রিকশা না পেয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার বাবার তৈরি বাড়িতে যেখানে তাকে তার স্ত্রী সহ সন্তানদের আশ্রয় দিয়েছে, যেখানে তার মনি সহ তিন মেয়ে রয়েছে সেই বাড়ির সামনে এসে দেখলো এখনও কেও ওঠেনি।
কলিং বেলের সুইচ টিপে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতেই কলাপসিবল গেটের ফাঁকে মনির সদ্য ঘুম ভাঙ্গা হাসিতে উজ্জ্বল মুখটা দেখতে পেলেন। চাবি নিয়ে এসে গেটটি খুলে দিলে রাশেদ সাহেব ভিতরে ঢুকতেই মনিরা রাশেদ সাহেবকে জড়িয়ে ধরল, যেন কত যুগ ধরে সঞ্চিত কত বিরহের অবসান হয়ে মহা মিলন হলো।
-কি করছ? চলো ভিতরে যেয়ে নিই, মানুষে দেখবে তো!
-দেখুক।
-এই তো মাত্র দুই রাত আর এক দিন গেছে এর মধ্যেই এতো!
-হু, আমার মনে হচ্ছে কতকাল তোমাকে দেখি না, কেমন আছ তুমি?
-কাল সন্ধ্যায় না কথা হলো, ভালো না হলে রাত জেগে এলাম কি করে? তুমি, তোমার মেয়েরা কেমন আছ?
-সবাই ভালো, চলো তুমি কাপড় বদলে নাও আমি গোসলের পানি গরম দিয়ে আসছি, তারপরে তুমি গোসল কর আর আমি নাশতা বানাই।

২০।
চিটাগাং থেকে ফিরে আসার পর কি করবেন ভেবে কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলেন না। এমন সময় একদিন ছোট ভাই বললো-
-দাদা, আপনি যদি লন্ডন যেতে চান তাহলে চলে যান। আজ মেঝ ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে, আপনি ওখানে যেতে চাইলে যেতে বলেছেন। তবে কথা হচ্ছে উনি যে শহরে থাকে সেখানে থাকতে পারবেন না এবং যাবার ভাড়া আপনাকে ব্যবস্থা করতে হবে। আর আমি বলছি যদি যান তাহলে অন্তত চার বছর থাকবেন এমন মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে যাবেন। এখন ভেবে দেখেন কি করবেন, চার বছর কিন্তু একেবারে কম না। যাওয়া হলে এখানে এখন যেমন রেখে যাবেন এসে তেমন পাবেন না। হয়ত এসে দেখবেন আপনার অবর্তমানেই মেয়ের বিয়ে দেয়া হয়েছে, ছোট মেয়ে স্কুল কলেজ সেরে ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে বা আরও কত পরিবর্তন হতে পারে যা এখন ভাবা যাচ্ছে না। এর আগে যেমন গিয়েছিলাম এবার কিন্তু তেমন নয়। যদিও একবার ভিসা পেলে পরের বার ভিসার জন্য সমস্যা হয় না। ভেবে দেখেন কি করবেন।
মনি পাশেই বসে ছিলো। রাশেদ সাহেব মনির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।
মনি বললো-
-তাই কর, অনেকেই এমন কত প্রয়োজনে কত কি করছে কত জায়গায় যাচ্ছে, চেষ্টা তো কম করা হলো না।
-যেতে বলছ কিন্তু যাবার ভাড়ার টাকা পাব কোথায়?
-সে দেখা যাবে, তুমি মত দিলেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
-ঠিক আছে তাহলে ভাড়ার টাকা জোগাড় করে নিই পরে ভিসার জন্য এপ্লাই করি, এটাই তাহলে ফাইনাল।

রাতে শুয়ে মনিরাকে জড়িয়ে ধরে ভাবছে একা একা এভাবে চারটা বৎসর মনিকে না দেখে থাকবো কি করে আর মনিই বা থাকবে কি করে, সিদ্ধান্ত তো নিয়ে ফেললাম!
সিদ্ধান্ত নেয়া আর তা বাস্তবায়ন করা এক নয়। তাদের বিয়ে হয়েছে আজ ছাব্বিশ বছর, বিয়ের পর থেকে বিগত ছাব্বিশ বত্সরের নানা স্মৃতি ভেসে এলো মাথায়। ঘরে তিন মেয়ে, মেয়েদের স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে যাতায়াত। তাদের পোষাক আসাক, চিকিৎসা, বই পত্র কত কি! মেয়েদের হাতে কোন রকম দশটা টাকা দিয়ে বলা যায় না যে বাসে করে ঝুলে গিয়ে ক্লাস করে এসো, ঢাকা শহরে বাসে চেপে মেয়েদের স্কুল কলেজে যাতায়াত ভাবাই যায় না।
দেশের জন্য, দশের জন্য বড় কিছু করার স্বপ্ন তার ধুলায় মিলিয়ে কোথায় চলে গেছে এখন বাঁচবে কি করে এই চিন্তায় অস্থির। শেষ পর্যন্ত ভাবল অনেকেই তো নানা রকম অপরাধ করে জেলে বা হাজতে বাস করছে, তাদেরও তো দিন চলে যাচ্ছে, না হয় সে ভেবে নিবে সেও এমন কোন অপরাধ করেছে যার শাস্তি হিসেবে তাকে অজ্ঞাত বাসে বা নির্বাসনে যেতে হবে, সে তো এমনই অপরাধ করেছে।

ওই তো, তার সহকর্মী নির্বাহী প্রকৌশলী শফিক সাহেবের কি হলো? আহা বেচারা নির্দোষী সহজ সরল মানুষটা! অফিস থেকে ট্রেনিং এর জন্য বাইরে পাঠাল আর ফিরে আসতে না আসতেই তেল চুরির অপরাধে চাকরিটাই চলে গেলো। তারও তার মেয়েদের বয়সী তিন মেয়ে। মেয়েগুলোর দিকে তাকান যায় না। বিভাগীয় চূড়ান্ত নির্দেশের প্রেক্ষিতে তা মকুফের আবেদন নাকচ হবার পর শফিক সাহেব আদালতে মামলা করলো, আপীল করলো কোন লাভ হলো না।
তার স্টোর কিপার পঁয়ত্রিশ লিটার তেলের ইন্ডেন্ট বানিয়ে শফিক সাহেবের স্বাক্ষর নিয়ে সেটাকে তিন শত পঁয়ত্রিশ করে তেল উঠিয়ে বিক্রি করে দিত। যে জাহাজ ডকে রয়েছে তার নামে ভুয়া ইন্ডেন্টে শফিক সাহেবের স্বাক্ষর জাল করে দশ হাজার লিটার ডিজেল উঠিয়ে বিক্রি করে দিত এই ভাবে নানা ফন্দি ফিকির করে টাকা কামিয়ে এক দিনেই তিনটা হিনো বাস কিনে রাস্তায় চালু করে দিয়েছে তার আয় দিয়েই সে চলছে, তারও চাকরি গেছে, কিন্তু সে তো বাসের আয় দিয়ে চলে যাবে।
শফিক সাহেবের যে সে উপায় নেই! সে তো চুরি করেনি বা চুরির ভাগও পায় নি। ওহ! কি কষ্টে যে তার দিন যাচ্ছে সে না দেখলে বোঝার উপায় নেই! মেয়েদের মামা বাড়ি থেকে কিছু দেয়, চাচারা কিছু দেয় এই দিয়েই মেয়েদের লেখাপড়া চলছে। কোন ভাবে দিন যাচ্ছে।
[চলবে]

নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৮

১৭।
সেদিন অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো বলে আর কিছু করার ছিলো না তবে রাশেদ সাহেব বাবাকে বলে রাখলেন সে যেন কালই মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। মনিকে বলে রাখলেন কাল যেন সময় মত তাদের পাঠিয়ে দেয়। পর দিন
ডাক্তার দেখেই বলে দিল যে ‘ব্রেস্ট ক্যান্সার’, বি লেভেলে চলে গেছে আপনি এতো দিন আসেননি কেন? এ তো এখনই অপারেশন করতে হবে। আপনারা টাকা পয়সা আর সবার অনুমতি নিয়ে কালই চলে আসুন। বাড়িতে ফিরে সবার সাথে আলাপ হলো।
রাশেদ আর তার ছোট ভাইয়ের বক্তব্য,
-না, অপারেশন করতে হলে কিছুতেই এখানে না, কোলকাতা গিয়ে করাতে হবে।
এখন প্রশ্ন হলো সাথে কে যাবে? বাবা সিদ্ধান্ত দিলেন সেঝ বৌ আর রাশেদ যাবে। মা বেঁকে বসলেন।
-না, যেতে হলে বড় বৌকে ছাড়া আমি যাবো না।
এ বাড়ির সবারই পাসপোর্ট আছে কাজেই দেরী করতে হয়নি। মার কথা মত পর দিনই ভিসার জন্য সবার পাসপোর্ট পাঠিয়ে দেয়া হলো। তার পরের দিন ছোট ভাই গিয়ে পাসপোর্ট ভিসা সহ তিনটা টিকেট নিয়ে এলো। ওই দিনই রাতের কোচ। তার পর দিন কোলকাতার বেহালায় ঠাকুর পুকুর ক্যান্সার হাসপাতালে। ওরা সারা দিন এটা সেটা নানান টেস্ট ফেস্ট করে জানাল আগামী দশ দিন পূজার বন্ধ আপনারা এর পরে আসুন। রাশেদ সাহেবের পিলে চমকে গেলো, বলে কি? এটা তো আর নিজের দেশ না, এখানে কী করতে পারবে সে?
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে পাশেই একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে উঠে গেলো। মা আর মনিকে রেখে রাশেদ বের হয়ে গেলো বেহালা বাজারে। বাজার থেকে মায়ের পছন্দের বাজার এনে দেখে এর মধ্যেই মনিরা ফ্ল্যাটের পাশের দোকান থেকে হাড়ি পাতিল কিনেছে আর গ্যাস সিলিন্ডার সহ একটা সিঙ্গেল বার্নার চুলা ভাড়া করে এনে মৃত্যু পথ যাত্রী শাশুড়ির জন্য রান্নার যোগাড় করে নিয়েছে।

রাশেদ বাজার নামিয়ে দিয়ে আবার বের হলো ফোন বুথ খোঁজার জন্য। বিলাতে মেঝ ভাইকে জানাতে হবে। তাকে বিস্তারিত জানিয়ে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কোথায় আছে খুঁজতে বের হলো। আশে পাশের দোকান, লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে সন্ধান পাচ্ছে না এমন সময় একজনের সাথে আলাপ হলো যার পূর্ব পুরুষ বাংলাদেশ থেকে এ দেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশের মানুষ শুনে নিজেই এগিয়ে এসেছেন, পেশায় ডাক্তার। সব শুনে সে সল্ট লেকের এক ডাক্তারের ঠিকানা ফোন নম্বর দিয়ে বলে দিলেন উনি আমার শিক্ষক।
আপনি এখনি ফোন করে দেখুন উনি কি বলে। রাশেদ সাহেব দেরি না করে একটু আগে যে বুথ থেকে ফোন করেছিলেন আবার সেখানে গিয়ে ফোন করলেন। ডাক্তার সাহেব নিজেই ধরেছেন, শুনে বললেন হ্যাঁ ঠিক আছে আপনি সন্ধ্যা সাতটায় আসুন। ফোন রেখে মার ক্ষুধা লেগেছে ভেবে তার প্রিয় দৈ চিড়া নিয়ে এসে দেখে মনিরার রান্না প্রায় শেষের দিকে। মা দৈ খেতে চাইল না, বললো এই তো রান্না প্রায় হয়ে গেছে। একটু পরেই মনি খেতে দিল। রূপচান্দা মাছ ভাজা, ডাল আর ভাত। ভাত মুখে দিয়ে মা বৌকে কাছে টেনে নিলেন। নিজের দেশ ছেড়ে এসে তার নিজের হাতে ছাব্বিশ বছর ধরে গড়া বৌয়ের হাতের রান্না তার কাছে অমৃতের মত লাগছে তাই কান্না থামাতে পারেননি,
-তুমি তো আসতে চাইছিলে না, তুমি না এলে আমাকে কে এই রান্না করে দিত?
-না মা, আমি তো নিষেধ করিনি, আব্বাই তো রেখার নাম বলেছে।
খাবার শেষ করতেই বিকেল হয়ে গেলো। অচেনা জায়গা, এখান থেকে সল্ট লেক যেতে কতক্ষণ লাগে জানা নেই বলে একটু আগেই বের হলো। একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা সল্ট লেক ডাক্তার ঘোষের চেম্বার। ডাক্তার ঢাকার প্রেসক্রিপশন দেখলেন, রুগী দেখে রোগীকে পাশের ঘরে নিয়ে বসিয়ে আসতে বললেন। মনি মাকে নিয়ে পাশের ঘরে বসিয়ে এলো। ডাক্তার জানতে চাইলেন,
-ইনি আপনার কি হয়?
-মা।
-তাহলে এতো দেরী করেছেন কেন, এখন বি স্টেজে চলে গেছে, এই লেভেলে চলে গেলে মাস ছয়েকের বেশি রাখা যায় না। আপনারা চাইলে আমি অপারেশন করতে পারি এতে আমার লাভ হলেও আপনাদের কোন লাভ হবে না
শুনে রাশেদ মনি দুই জনেরই মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। উদ্বিগ্ন হয়ে মনি জিজ্ঞেস করলো তাহলে এখন কি করা যায়? আপনি বলে দিন কোথায় গেলে ভাল হবে সে যেখানেই হোক তা নিয়ে ভাববেন না, যত টাকা লাগে লাগবে।
-দেখুন কার কাছে পাঠাবো বলুন, যদি অন্য কারো কাছে কোন ব্যবস্থা থাকতো তাহলে সেটা আমার কাছেও থাকতো।
রাশেদ সাহেব কিছু বলতে পারছে না, শুধু একবার মনির দিকে আবার ডাক্তারের দিকে চেয়ে দেখছে।
মনি আবার বললো, -তা হলে?
-তা হলে এখন ওই কেমো থেরাপি, রেডিও থেরাপি এই সব দিয়ে যত দিন থাকে। আর দেরী করবেন না। আপনারা একটু বসুন আমি কেমো থেরাপি দিয়ে নিই।
কেমো দেয়ার পর বললেন একটু বসুন দেখি কি অবস্থা হয়। আধা ঘণ্টা পর বললেন এখন নিয়ে যান। তবে আপনারা কালই চলে যাবেন না। অন্তত তিন দিন এখানে থাকুন, কেমোর কোন সাইড এফেক্ট দেখা দেয় কিনা সেটা দেখতে হবে। তিন দিন পর এখানে আসার দরকার নেই যেখানে আছেন ওখান থেকে আমাকে ফোনে জানাবেন, যদি ঠিক থাকে তাহলে চলে যেতে পারবেন। এর পরে আর রোগীকে কষ্ট দিয়ে এখানে আসতে হবে না আপনাদের ঢাকাতেই আমার চেনা ডাক্তার আছে আমি ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি তাকে আমার এই প্রেসক্রিপশন দেখাবেন, আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি উনি সেভাবে ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
রাশেদ সাহেব ঠিকানা দেখল, -এতো আমাদের বাড়ির কাছেই।
দেশে ফিরে এসে কোলকাতার ডাক্তারের দেয়া ঠিকানা খুঁজে ডাক্তারের সাথে দেখা করে প্রেসক্রিপশন আর তার চিঠি দেখালেন। ডাক্তার হিসেব করে তারিখ দিয়ে বলে দিলেন সেদিন নিয়ে আসার জন্য, এখানেই কেমোথেরাপি দেয়া যাবে। সব ভাই বোন, বৌ, জামাই, মেয়েদের ডেকে একত্র করে সবাইকে কঠিন মর্মান্তিক সংবাদটা জানিয়ে বলে দিলেন তোমরা মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকো। যে যে ভাবে পার তার সেবা করার চেষ্টা কর আর সে যেন ঘুণাক্ষরেও কিছু বুঝতে না পারে এরকম অভিনয় করে যেও। বিলাতে ফোন করে ভাইকেও জানিয়ে দিল।
কয়েকদিন পর স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে এসে সেও শেষ দেখা দেখে গেলো। কেমোথেরাপি শেষ হলে চলল রেডিও থেরাপি। এক সময় এটাও শেষ হবার পর কি যেন কি একটা দামী ওষুধ দেয়া হলো। আত্মীয় স্বজনেরা নানা রকম খাবার এনে খাইয়ে দিয়ে শেষ দেখা করে গেলো। বডি স্ক্যানের ছবিতে দেখেছে শরীরের প্রায় সব হাড় ঝাঁজরা হয়ে গেছে। মা তার ব্যথা আর যন্ত্রণা যতটা সম্ভব চেপে রাখতে চাইতেন কিন্তু রাশেদ সাহেব তার মুখ দেখেই বুঝতে পারতেন কি যন্ত্রণা মা সহ্য করছেন। সারাক্ষণ বাড়িতে মায়ের কাছেই থাকতেন আর ভাবতেন হায়রে অর্থ! তুমি আমাকে ধরা দিলে না, আমি কি এতই ঘৃণ্য? তোমার জন্যই আমার মায়ের এই যন্ত্রণা আমাকে নিরুপায় হয়ে দেখতে হচ্ছে। বাড়িতে সারাক্ষণ ভিড় লেগেই আছে।

স্থানীয় ডাক্তারের দেয়া সব ধরনের চিকিৎসা শেষ হবার পর কোলকাতার সেই ডাক্তারের কাছে ফোন করে জানতে চাইলেন এখন কি করতে হবে। উনি সব শুনে বলে দিলেন সবই তো হয়ে গেছে এখন দেবার মত আর কিছু নেই।
এর দিন দুয়েক পরেই মায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে গেলো। এই অবস্থায়ও নামাজ ছাড়েননি। সেদিন মাগরিবের নামাজের পর থেকেই শ্বাস কষ্ট দেখা দিল, বড় মেয়ে প্রেশার মেপে দেখল অসম্ভব রকম লো প্রেশার দেখা যাচ্ছে। ডাক্তারের সাথে ফোনে কথা বলে মনির শ্বাস কষ্টের ওষুধ নেয়ার মেশিন নেবুলাইজার দিয়ে ওষুধ দিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই শিয়রে বসা মনির কাছে পানি চাইলেন। কে যেন এক গ্লাস পানি মনির হাতে এগিয়ে দিলে মনি এক হাতে মাথাটা একটু উঁচু করে ধরে পানি খাইয়ে দিল। পানি খেয়ে মনিকে জোরে চেপে ধরে তার কোলে মাথা রেখে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। প্রাণ বায়ু উড়ে গেলো, নির্বাক রাশেদ সাহেব পলকহীন চোখে তাকিয়ে দেখলেন।

১৮।
মনি রাশেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে হাতের পাখা নামিয়ে নিশ্চল পাথরের মত মার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ঘরে ফুল স্পিডে ফ্যান চলছিলো এ ফ্যানের বাতাস মায়ের যন্ত্রণা মুছে দিয়ে বা উড়িয়ে না নিয়ে প্রাণ বায়ুটাই উড়িয়ে নিয়ে গেলো। বাবা, মনি সবাই হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছিলো। রাশেদ সাহেব বাবাকে বললেন ‘আব্বা হয়েছে আর বাতাস করতে হবে না’ বলেই হাত থেকে পাখাটি নিয়ে পাশে রেখে মায়ের মুখ চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন -কি করছিস?
মনি অনেক কষ্ট করে শুধু এটুকুই বলতে পারলো তার আর বাতাসের প্রয়োজন নেই আব্বা।
ঘর ভর্তি আত্মীয় স্বজনদের কেও কেও ডুকরে কেঁদে ফেললেন।
রাশেদ সাহেব বাবাকে বললেন আমি একটা অন্যায় করেছি আব্বা আমাকে ক্ষমা করবেন, সব কিছু আমি জানতাম, সবাইকে বলেছি কিন্তু আপনাকে বলতে পারিনি। বাবা বললেন আমি বুঝতে পেরেছিলাম। সেঝ ভাই অফিসে, ছোট ভাই বাইরে গেছে। তাদের সবাইকে ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বললেন। বোনকে ফোনে জানালেন ওরা সবাই যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখানে চলে আসে। টেলিফোন এক্সচেঞ্জের অপারেটরকে মৃত্যু সংবাদ দেয়ার কথা বলে জরুরী ভাবে কল বুক করলেন, প্রায় সাথে সাথেই লাইন পাওয়া গেলে বিলাতে মেঝ ভাইকে বললেন তোরা এখন কোথায় কি করছিস?
শুনে বললো -আম্মা তো আর নেই।
-কখন?
-এইতো চার মিনিট আগে।
-ও, আচ্ছা তাহলে আপনারা সব ব্যবস্থা করে ফেলেন, আমি এখনই টিকেট বুকিং দিচ্ছি, পেলে সাথে সাথেই আসছি, তবে আমার জন্য দেরী করবেন না।
আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সবাইকে ফোনে জানিয়ে দিলেন। ছোট ভাইদের বন্ধুরা সবাই এলো, তারাই সব ব্যবস্থা করে ফেললো। সবাইকে ভাগাভাগি করে কোরান খতম করার কথা বলে দিলেন। পরদিন মিরপুর বুদ্ধি জীবী গোরস্তানে রেখে আসার আগ পর্যন্ত রাশেদ সাহেব অবিচল ছিলেন। যা যা করতে হবে তা যাকে দিয়ে যা করা যায় সবই ঠিক ভাবে করেছেন। যাকে যাকে সংবাদ দেবার তা তিনি নিজেই দিয়েছেন। গোরস্তান থেকে ফিরে এসে সবার অলক্ষ্যে গ্যারেজের এক কোণায় গিয়ে একা বসে পড়লেন। হঠাৎ করেই কান্না, সে কি কান্না! কোন পুরুষ মানুষ এভাবে কাঁদতে পারে এ এক বিস্ময়!
হঠাৎ ছোট মেয়ে দেখতে পেয়ে মাকে ডেকে নিয়ে এলো। মনি এসে মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে কোন ভাবে ওখান থেকে ঘরে নিয়ে এলো। মায়ের মৃত্যুর পরেই শুরু হলো রাশেদ সাহেবের অনন্ত পতন, একেবারে পৃথিবীর অতলে তলিয়ে যাবার যাত্রা আরম্ভ হলো তার।
[চলবে]

নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৭

১৫।
দাউদকান্দি ব্রিজের কাছে এসে একটা ঝাঁকুনি খেয়ে ফিল্মের ফিতা ছিঁড়ে গিয়ে রাশেদ সাহেবের সিনেমা দেখা থেমে গেলো। রাশেদ সাহেব চমকে উঠলেন। সুপারভাইজারকে জিজ্ঞেস করলেন-

-কি ব্যাপার ভাই কি হয়েছে?
-না কিছু হয়নি সামনে বিরাট কিউ তাই থেমেছে।
মিনিট পনের পর আবার গাড়ি চলতে শুরু করলেই সিনেমার ফিতা আবার জোড়া লেগে যায়।
একটা পরিবার, একটা সংসার, একটা বংশের উন্নতি ঘটানো কারো একার পক্ষে বা এক পুরুষের পক্ষে সম্ভব নয়। ওরা চার ভাইয়ের মধ্যে রাশেদ সাহেব বাদে সবাই উচ্চ শিক্ষিত। রাশেদ সাহেব পড়াশুনার সুযোগ পেলেন কোথায়? তবুও তার সাথে কথা বলে, তার আচার আচরণ, পোষাক পরিচ্ছদ, চলাফেরা, মানুষের সাথে মেলামেশা দেখে বোঝার উপায় নেই। চমৎকার এক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ব্যক্তি। তাদের বাড়ির একটা সুনাম আছে, পড়ালেখা বাড়ি। নিজেদের বাড়ির একটা নামও ঠিক করে রেখেছেন কিন্তু বাড়িটা উপরে উঠার আগে এই নাম বেমানান তাই আর পয়সা খরচ করে নাম লেখা হয়নি। তিনি ভেবেছিলেন তার ব্যবসার উন্নতি হলে আস্তে আস্তে দোতলা, তিন তলা, চারতলা, পাঁচ তলা করে আকাশের একটু কাছে গিয়ে চার ভাই আর এক বোন মিলে এক বাড়িতেই সুখে দুঃখে মিলে মিশে থাকবে, যাতে করে সবাই সবাইকে কাছে পায় এরকম একটা ইচ্ছে ছিলো। সে ইচ্ছে ইচ্ছে পর্যন্তই রয়ে গেলো, এ আর কোন দিন বাস্তব হবে বলে মনে হয় না। আরও কত আশা ছিলো। মনিরা এবং তার নিজের বাগান করার বেশ ঝোঁক।

চাকরির উপলক্ষে যেখানে থেকেছে সেখানেই একটা অস্থায়ী বাগান করে নিয়েছে। তা এই ঢাকা শহরে এতো জায়গা কোথায় পাবে যেখানে দালানকোঠার মাথা উঠে আকাশ ঢেকে ফেলেছে সেখানে বাগানের জায়গা কোথায় তাই ছাদের উপরে টব সাজিয়ে বাগান করবে। দুজনে মিলে এক সাথে পানি দিবে, গাছের যত্ন করবে, টব পরিষ্কার করে নতুন মাটি সার মিশিয়ে আবার নতুন গাছ লাগাবে।

মনিরা এর মধ্যেই ছাদের উপরে একটা ছোট বাগান করেছে যেখানে প্রতিদিন তার নিজের সন্তানদের মত করে ফুল গাছের যত্ন করে। যতক্ষণ বাগানে কাজ করা যায় ততক্ষণ মনে সুন্দর একটা প্রফুল্ল ভাব থাকে। একটা স্বর্গীয় সুবাতাস এসে মনে জমা কালিমাগুলি ঝড়ের মত উড়িয়ে নিয়ে যায়। গাছ গুলি যেন কথা বলে আর ফুল গুলি তো হাসতেই থাকে। আজে বাজে দুশ্চিন্তাগুলি মনে ঢোকার দরজা খুঁজে পায় না। তার আরও স্বপ্ন ছিলো বাড়িটাকে লতায় পাতায় ঘেরা কুঞ্জবন বানাবে। যেখানে থাকবে নানা রঙের বাহার আর মৌ মৌ করা ফুলের গন্ধ। সেবার লন্ডন থেকে দেখে এসেছে কারুকাজ করা অক্ষরে বাড়ির নম্বর লেখা রয়েছে প্রায় বাড়িতে, তেমন করে নক্সা আঁকা বোর্ডের উপর কারুকাজ করা নম্বর প্লেট লাগাবে বাড়ির গেটে।

বিকেলে বা বৃষ্টির সময় সবাই মিলে বারান্দায় বসে চা পিঁয়াজু খেতে খেতে বৃষ্টি দেখবে, নয়তো জোসনা দেখবে, গল্প করবে। এর মধ্যেই সাভার হর্টাস নার্সারি থেকে ওয়াল কার্পেটের চাড়া এনে বাড়ির সীমানা দেয়ালে লাগিয়েছে, একটা বকুল গাছ লাগিয়েছে বাড়ির পিছনে দক্ষিণ পশ্চিম কোনায়, সামনের উত্তর পূর্ব কোনায় লাগিয়েছে একটা স্বর্ণ চাঁপা গাছ। বাড়ির নির্মাণ কাজ শেষ হলে সিঁড়ির এক পাশে একটা মাধবী লতা আর অন্য পাশে হলুদ আলমন্ডা গাছ লাগিয়ে একেবারে ছাঁদ পর্যন্ত উঠিয়ে দিতে চেয়েছিলো।
সামনের দিকে পূর্ব দক্ষিণ কোনায় যে বারান্দায় সবাই মিলে বসবে বলে ভেবে রেখেছে সেই বারান্দার নিচে গ্যারেজের পাশে একটা চামেলি গাছ থাকবে এটাও ছাঁদ পর্যন্ত উঠিয়ে নিতে চেয়েছিলো যাতে সবাই বসলে সারা বছরেই চামেলি বা মাধবী লতার পাগল করা গন্ধে মনে কোন কলুষতা আসতে না পারে। নানা ফুলের গন্ধে পুরো বাড়িটা হয়ে উঠবে একটা স্বপ্নপুরী বা মায়াকুঞ্জ কিংবা কুঞ্জবন।

নাম যেটা ঠিক করে রেখেছে তা হচ্ছে ‘পান্থনীড়’ বাড়িটা তো কয়েক পুরুষ ধরে টিকে থাকবে কিন্তু এ বাড়িতে যারা বাস করবে তারা আর বাড়ির মত ইট বা লোহার তৈরি নয় যে বাড়ির সমান বয়স পাবে। বাড়ির বাসিন্দারা পুরুষানুক্রমে যখন এক এক করে আসবে তখন আনন্দের মেলা বসবে আবার যখন প্রকৃতির ডাকে চলে যাবে তখন তেমনি তার উলটো কান্না কাটির ঝড় বয়ে যাবে। এই যে আসা যাওয়া এই নিয়েই তো সংসার। এই পৃথিবীতে সবাই সংসারের পথিক। ক্ষণকালের জন্য আসবে আবার চলেও যাবে।
যারা এই বাড়িতে থাকবে তারা না জানি কে কি পেশা নিয়ে থাকবে। হয়ত কেও শিক্ষক হবে, কেও ডাক্তার হবে, কেওবা উঁকিল ব্যারিস্টার বা কেও হয়ত নিতান্ত সাধারণ জীবন যাপনই করবে। এরাই হয়ত পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে আবার কোন বিশেষ দিনে প্রিয় জনের সাথে মিলিত হবার আগ্রহে আধির প্রতীক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করবে। ও আসছে কে কি পছন্দ করে আহা বিদেশে থাকে কি খায় না খায় তার কি কোন ঠিক আছে? কি কি বাজার করতে হবে, কে কে এয়ারপোর্টে যাবে এই আয়োজনে ব্যস্ত থাকবে। যারা আসবে তারাও কার জন্য কি নিয়ে যাবে তাই নিয়ে মাস ধরে কেনা কাটার ধুম চলবে। সবাই এসে একত্র হবে।
বিশাল হৈ চৈ আনন্দ উৎসবে মেতে উঠবে ক্ষণিকের জন্য, আবার সবাই সুখের একটা স্মৃতি নিয়ে আবার তাড়াতাড়ি ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মন ভার করে যার যার কর্মস্থলে ফিরে যাবে। যারা থাকবে তাদের কাছে কিছু দিন বাড়িটা ফাঁকা মনে হবে। এক সময় আবার তা সয়ে যাবে। সবাই তো পথিক, এটা তো পথিকের ঘর, ক্ষণিকের জন্য আসা আর যাওয়া তাই এর নাম ‘পান্থনীড়’। রাশেদ সাহেবের এই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। এখনও যে তা বাস্তবায়নের কোন আভাস সে খুঁজে পায়নি, আজ চট্টগ্রাম থেকেও তেমন কোন আশার বাণী শুনে আসতে পারেনি।

১৬।
রাশেদ সাহেবের মা হঠাৎ করেই মারা গেলেন। হঠাৎ করেই বলা যায়। বুকে এক ঘা হয়েছিলো যা তিনি নিজে অনুভব করছিলেন কিন্তু কাউকে কিছু বলছিলেন না। যখন ব্যথা সহ্য করতে পারছিলেন না তখন এক দিন বড় বৌকে বললেন। মনিরা দেখে এসে তার স্বামীকে জানালেন। রাশেদ সাহেব শুনেই মায়ের কাছে এসে দেখতে চাইলেন। মা নিরুপায় হয়ে দেখালেন। দেখেই রাশেদ সাহেব বুঝলেন ‘ক্যান্সার’, তার মাথায় যেন বজ্রপাত হলো। মাকে বললেন-
-একি! আপনি কেন একথা এতদিন জানাননি?
মা নির্বাক। কোন কথা বলছেন না।
-কেন চেপে রেখেছেন বলেন।
-কি বলবো, তোর এই অবস্থা দেখছি ভাবলাম দেখি এমনিই হয় তো সেরে যাবে তাই বলিনি।
-আমার অবস্থা দেখে আপনি বলেননি বেশ কিন্তু আপনার তো আরও ছেলে আছে তাদের অবস্থা তো আমার মত নয়।
-ওদের কাছে কি আমি কখনো কিছু বলি?
-তাই বলে এই সর্বনাশ করবেন? জানেন এর ফল কত ভয়ঙ্কর?
মা নিরুত্তর। পরিবেশ নিস্তব্ধ।
রাশেদ সাহেব জানেন মা এক তাকে ছাড়া আর কারো কাছে কিছু চাইতে পারে না, তাই বলে এর কি কিছুই মা বুঝতে পারেনি? তাকে বললে কি সে কিছুই করতে পারতো না? মায়ের জন্য কি তার কিছুই করার ছিলো না? সে নিজে না পারলেও অন্তত তার ভাইদেরকে তো জানাতে পারত এবং সে জানে ভাইয়েরা চুপ করে বসে থাকতে পারতো না, অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে ত্রুটি করত না।

সব নিয়তি, আজ যদি আমার এ অবস্থা না হোত তা হলে মা কিছুতেই এটা চেপে রাখতে পারতেন না। হায়রে অর্থ! হে মহান অর্থ! ওহে মহান, তুমি এতই উচ্চ শিখরে উঠে বসে আছ? হে সর্ব সমস্যার সমাধান, তোমার কাছে কি আমি এতই তুচ্ছ? তুমি আমাকে ধরা দিলে না, তোমার অভাবে যে আমার মা নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে চলে যাচ্ছে আর আমাদেরকে তাই বসে বসে দেখতে হবে। সময় মত তার চিকিৎসা করাতে পারলাম না। একি তুমি দেখতে পাচ্ছ না? তবুও তোমার এতো অহংকার কেন? হায়রে পলাতক অর্থ, তুমি আমার মায়ের এই সময়েও পালিয়ে রইলে? আমি তোমার সাথে কোন অন্যায় করিনি, কোন অমর্যাদা করিনি, আমি তোমায় দিয়ে জুয়া খেলিনি, আমিতো কোন নেশা করার জন্য তোমায় ব্যবহার করিনি, তোমার কোন অপব্যবহার করিনি। তাহলে কেন আমার থেকে দূরে রইলে? কেন আমার সাথে এই বঞ্চনা?
[চলবে]

নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৬

১২।
ছোট ছোট ভাই বোনদের সুখের জন্য, তাদের লেখাপড়া করে মানুষ করার জন্য, তদের সুনাম হবার জন্য, সুখ সমৃদ্ধিতে জীবন যাপনের জন্য, সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য আনার জন্য এক জন নিতান্ত যে বয়সে মন দিয়ে পড়া শুনা করার কথা তা না করে বাড়ি ছেড়ে, ঢাকা শহর ছেড়ে, অবশেষে দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন। শিক্ষা, শান্তি, সুখ সচ্ছলতা কুড়িয়ে আনতে। কিছুটা এনেছিলেন যার উপযুক্ত ব্যবহার হলে আজ তাকে এভাবে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হোত না। যা পেয়েছিলেন তা দিয়ে সব পাওয়া হয়নি তবে তখনকার মত কিছু সামাল দেয়া গেছে। ভাই বোনেরা আজ সবাই উচ্চ শিক্ষিত হয়েছে, কিছু দিন সংসার চলেছে কিন্তু সাথে আর একটি প্রাপ্তি যা বাড়ির সবার অলক্ষ্যে, একান্ত নীরবে সে একাই পেয়েছে বাড়ির আর কেও তা বুঝতে পারেনি। দীর্ঘ দিন বাড়ির বাইরে থাকার ফলে অতি ধীরে ধীরে বাড়ির সাথে তার একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে।

প্রথম দিকে দুই তিন মাস পর পর তিন চার দিনের জন্য বাড়ি আসার পথে ভাই বোনেরা কে কি পছন্দ করে সে অনুযায়ী ফলমুল, কাপড় চোপর নিয়ে আসতেন, এসে মাকে সংসারের কিছু বাজার করে দিতেন, রান্না ঘরে বা বাড়ির যা যা প্রয়োজন তা কিনে দিয়ে যেতেন বা মনে করে মাথায় করে একটা ফর্দ তৈরি করে নিয়ে যেতেন আবার আসার সময় নিয়ে আসতেন। ভাই বোনেরা নিতান্ত ছোট ছিলো বলে তারা অনেক দিন পর পর বড় ভাইকে দেখত বলে তাদের মনে একটা ধারনা জন্মেছিলো যে এতো আমাদের মেহমান। পরে যখন দেশ ছেড়ে চলে গেলেন তখন তো বৎসরে একবার আসা হতো।

বাড়ির মানুষ কি আর এতো দিন পরে আসে, এমন ধারনা জন্মান অস্বাভাবিক কিছু নয়। নিয়ম করে টাকা পাঠাত। যে অভাবের যন্ত্রণা সে দেখেছে, সে অভাবের ছোঁয়া যেন ছোট ভাই বোনদের গায়ে না লাগে। প্রতি মাসে একটা করে বিরাট চিঠি লিখত মায়ের কাছে, বাবার কাছে। তাতে ওই এক কথাই বারবার লিখত ওদের যেন কোন অসুবিধা না হয়, বিশেষ খেয়াল রাখবেন। ছুটিতে আসার সময় পছন্দ মত খেলনা, পোষাক আসাক সবার জন্য যা মনে হতো নিয়ে আসতো।

কখন যে এই সব টাকা আর জিনিষ পত্রের সম্পর্কটা টিকে গেলো আর রক্তের সম্পর্কটা ম্লান হতে হতে এক সময় মুছে গেছে তা হঠাৎ করেই একদিন লক্ষ্য করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিন্তু তরী তখন কূল ছেড়ে উত্তাল বাতাস আর স্রোতের টানে মাঝ গাঙ্গে চলে গেছে। আর সে তরী পাড়ে ফিরিয়ে আনার কোন উপায় নেই। থাক, তবুও আমার মা, আমার বাবা, আমারই ভাই বোন। ওদের জন্যেই সব ছেড়েছি, ওরা সুখী হলেই যথেষ্ট। সময়ের স্রোত আমাকে দূরে টেনে নিয়ে গেছে। যাক, আমি তো দূরে যেতে পারি না। আমার হৃদয়ের গভীর কুঠরি ওদের জন্যই পূর্ণ হয়ে আছে ওরা আমাকে আর কত দূরে ঠেলে দিবে? আবার ভাবে, না তা কি করে হয়? আমি এ বাড়ির বড় ছেলে, আমার ইচ্ছা অনিচ্ছা, সিদ্ধান্ত, মতামত অনেক মূল্যবান। আবার ভাবে কিন্তু বাস্তব যে এর বিপরীত!
তাহলে? নিজেকেই প্রশ্ন করে মনে মনে আহত হলেও মন কিছুতেই তা মেনে নিতে পারে না। ভাবে, যাক ওরা যা খুশি করুক আমি আমার কাজ করে যাব তাতে যা হয় হবে।

১৩।
মনিরাও এই মুছে যাওয়া সম্পর্কের জের টের পেয়েছে কিন্তু স্বামীর কাছে প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পায়নি। এমনিই দুজনে দুজনের মত ভিন্ন ভাবে লক্ষ করে কিন্তু কেও কারো কাছে প্রকাশ করতে পারে না। মনিরা নিজেও বিশাল একান্নবর্তী পরিবার থেকে স্কুল শেষ না হতেই বালিকা বধূ সেজে এ বাড়ির বড় বৌ হয়ে এসেছে। দৈনন্দিন কাজে যখন রাশেদ সাহেব বাড়িতে থাকে না তখন বাড়ির এক রূপ আবার যখন সে বাড়িতে থাকে তখন আর এক রূপ।

এই দুই রূপের তারতম্য মনিরার বালিকা মাথায় কিছুতেই ঢুকতে চায় না, কোন অবস্থাতেই সে মেলাতে পারে না। ছোট বেলা থেকে দেখে আসছে সবাইকে কিন্তু সেই আগের দেখা আর বিয়ের পর এই দেখার মধ্যে এই তফাত কেন সে কথা মনিরা তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করতে পারে না, মেনে নিতে পারেনা, সহ্য করতেও পারে না। বিয়ের পর প্রথম দিকে মনিরার বাবা একবার মনিকে নিতে এলে শাশুড়ি তাকে আড়ালে ডেকে বললো তোমার বাবা যখন আমাকে তোমাকে নিয়ে যাবার কথা বলবে তখন আমি বলবো নিয়ে যান, কিন্তু তুমি বলবে না বাবা আমি আর ক’দিন পরে যাই। এই কথার কোন মানে খুঁজে পায় না। কেন এমন কথার কি এমন প্রয়োজন? সেই তো সরাসরি নিষেধ করে দিতে পারে। এই লুকোচুরি কেন? তার স্বামীর প্রতি উদাসীনতা, অবহেলা, অবজ্ঞা, অমর্যাদা কেন? তার ইচ্ছার কোন মূল্যায়ন নেই, তার মতামতের কোন গুরুত্ব নেই। যে সন্তান নিজের ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিয়ে সংসারের হাল ধরতে সাঁতার না জেনে সাগর পাড়ি দিয়েছে তার প্রতি এই মনোভাব কেন?

এই এত গুলি চেপে রাখা কেন তার বুকের ভিতর বাসা বাঁধতে থাকে, ক্ষত বিক্ষত হয়ে অসহ্য যন্ত্রণার কামড়ে সে দগ্ধ হতে থাকে। কেমন যেন একটা শূন্যতা, একটা বিষাদ, একটা হাহাকার, কিছু অব্যক্ত বেদনায় দগ্ধ মনিরা নিজেকে স্বামীর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। কি জানি আবার কখনো যদি ভুল করে এর কিছু স্বামীর কাছে বলে ফেলে তা হলে যে সে মনে ব্যথা পাবে, আঘাত পাবে এই মনে করে। এ কি মনি! আমার মা, বাবা, ভাই বোনদের সম্পর্কে এই ধারনা পোষণ কর? তখন সে কি জবাব দিবে? সে নিজেই তো এর কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না।
কাছের রাশেদ আর দূরের রাশেদের মধ্যে এই পার্থক্যের বোঝা সব গিয়ে পরে মনিরার মাথায়। যে স্বামীর জন্য জীবনের সঞ্চিত সমস্ত শ্রদ্ধা, ভালবাসা, সমস্ত মমতা উজাড় করে দিয়েছে তার প্রতি এই আচরণ কি করে মেনে নিতে পারে? কিছু না বুঝে ক্রমান্বয়ে তার বুকে চাপা পাথর জমে জমে এখন শ্বাস নিতেও কষ্ট বোধ করে। শ্বাস নেয়ার জন্য শ্বাসনালী সংকুচিত হতে হতে এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তবুও তার প্রিয় স্বামীকে কিছু বুঝতে দিতে চায় না। সমস্ত যন্ত্রণা তার একার উপর দিয়েই যাক। যে তার সংসারের প্রতি অন্ধ ভালোবাসা নিয়ে বিভোর রয়েছে সে থাকুক তার আপন মনে, যা হবার আমারই হোক। আভাসে ইঙ্গিতেও যাকে বোঝানো যায় না, বুঝতে চায়না সে তার ধারনা নিয়ে সুখে থাক।

একদিন যেদিন প্রথম মনিরার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তখন স্বামীকে বললো-
-আমার এমন লাগছে কেন?
-কি হয়েছে মনি?
-আমি যে শ্বাস নিতে পারছিনা।
-বল কি?
রাশেদ সাহেব তাড়াতাড়ি মাকে ডেকে এনে দেখাল,
-আম্মা দেখেন মনি এমন করছে কেন?
-কি হয়েছে?
ইশারায় দেখাল শ্বাস নিতে পারছি না।
-আম্মা ডাক্তার ডাকবো?
-না থাক এমনিই শুয়ে থাক ঠিক হয়ে যাবে।
-থাকবে কেন? তুমি থাক, আমি আসছি!
বলেই সার্টটা কোন মতে গায়ে দিয়ে বের হয়ে গেলো ডাক্তারের সন্ধানে। বাড়ির কাছে তাদের চেনা ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে ডাক্তারকে পেয়ে সাথে সাথে ধরে নিয়ে আসার মত করে নিয়ে এলো। ডাক্তার রুগী দেখে জানালো অনেক দিন থেকেই এমন চলছে মনে হচ্ছে, প্রচণ্ড মানসিক চাপ থেকে এমন হয়। রাশেদ সাহেব মেনে নিতে চাইলেন না।
-না, ওর কেন মানসিক চাপ থাকবে?
-তুমি পুরুষ মানুষ তুমি কি বুঝবে? মেয়েদের অনেক কারণে মানসিক চাপ হতে পারে।
প্রেসক্রিপশন লিখে দিল আর বলে দিল মানসিক চাপ কমাতে হবে, না হলে এ রোগ কিন্তু জটিল আকার ধারণ করতে পারে। শোন, তোমার স্ত্রীর এই অবস্থা তুমি কিছু জান না এটা কিন্তু মেনে নেয়া যায় না বাবা! ওষুধ গুলি এনে সময় মত খাওয়াবে আর কোন মানসিক চাপের কারণ হয় এমন কিছু করবে না।
এ কথা শুনে রাশেদ সাহেব কিছু বলতে পারলো না মাথা নিচু করে ভাবতে লাগলেন।
ডাক্তারের সাথে রাশেদ সাহেব বের হলেন ওষুধ আনার জন্য। ওষুধ এনে মনিকে খাইয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
-মনি বলতো তোমার কি এমন চাপ, প্রায়ই লক্ষ করি তুমি যেন কোথায় হারিয়ে যাও। আমার পাশে শুয়ে থাক তবুও মনে হয় তুমি আমার নাগালের বাইরে। কি এমন ব্যাপার বলতো মনি!
মনি নিরুত্তর।
-কী, কথা বলছ না যে!
-না কিছু না।
-কিছু না আবার কি? তাহলে এমন হয় কেন? বল, আজ তোমাকে বলতেই হবে, ডাক্তার কি এমনি এমনিই বলেছে? কি হয়েছে তোমার বল।
মনি নিরুত্তর।
-কথা বলছ না কেন?
-কি বলবো, বললাম না কিছু না।
-তাহলে এমন হলো কেন?
-কিছু হয়েছে তা বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই, আর তুমি তা চেষ্টাও করনি কখনো।
-হ্যাঁ তোমার একথা আমি মেনে নিচ্ছি, আমিতো তোমাকেই সব ভার দিয়ে দিয়েছি কাজেই আমাকে আলাদা করে কিছু ভাবতে হবে তা কি আমাকে বলেছ কখনো? না কি আমি সে ভাবে ভেবেছি? আমি জানি আমার মনি আছে, ব্যাস আর কি? কি হয়েছে সে কথা তুমি আমাকে বল না কেন?

১৪।
তার বুকটা চিরে তো আর তার স্বপ্ন গুলো দেখাতে পারে না, তাকে কে বিশ্বাস করবে, সবার কাছেই যে সে আজ এক চলমান রাহু, তার ছায়া দেখা বা সকালে উঠে তার মুখ দেখাও যে আজ সবার কাছে অশুভ দিনের পূর্বাভাস। এ না বোঝার মত খোকা সে নয়। জীবনের অনেকটা পথ সে পেড়িয়ে এসেছে, অনেক আলো ছায়া, বাতাসের স্পর্শ, জলের তরঙ্গ সে দেখেছে, অনুভব করেছে প্রকৃতির কঠিন কোমল নিস্তব্ধ মুহূর্ত গুলি, পান করেছে নানা ঘাটের জল। আজ তার একমাত্র আশ্রয় মনিরার বিশাল হৃদয় নামক শান্ত নীড়, যেখানে একমাত্র তারই প্রবেশাধিকার। সেখানে তার জন্য সাজানো রয়েছে এক বিশাল কুঞ্জবন, পাতা রয়েছে বরফ নীল রঙের কোমল গালিচা, যেখানে রয়েছে তার স্বর্গ বিশ্ব যার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত যতদূর দৃষ্টি যায় সবটাই তার একার। যেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা এমন কঠিন যে আর কোন প্রাণীর প্রবেশ সম্ভব নয়।

যে মনিকে সে অকৃত্রিম ভাবে ভালোবাসে, মনিও তাকে ভালবাসে। মনিকে ছাড়া রাশেদ সাহেব কিছুই ভাবতে পারে না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সমস্ত পৃথিবীকে চিৎকার করে বলে দেয় আমি মনিকে খুব বেশি ভালোবাসি, মনিই আমার জীবন, মনি শুধুই আমার, ওই আমার বেঁচে থাকা, ওই আমার সব, আমার জীয়ন কাঠি মরণ কাঠি সবই মনি। কখনো আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে নিমন্ত্রণে গেলে ওদের জন্য ভিন্ন বিছানা দেয়া যাবে না তা সবাই জেনে গেছে।

বিয়ের পর মনির বড় বোনের ছেলের মুসলমানির অনুষ্ঠান গ্রামের বাড়িতে করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ওদের যখন নিমন্ত্রণ করতে এলো তখন রাশেদ সাহেব কোন লাজ লজ্জার বালাই না রেখে বলেই ফেললো যে,
-ওখানে যেতে বলছ বেশ যাব কিন্তু এতো মানুষ দাওয়াত দিয়েছ তারা সবাই এলে আমাদের থাকতে দিবে কোথায়? আমি কিন্তু মনিকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
এ কথা শুনে ওর বোন বলেছিলো-
-আমি সে ব্যবস্থা করে রেখেছি, তোমরা সে চিন্তা করবে না। তোমরা ওই দক্ষিণ ঘরে থাকবে, হয়েছে?
-হ্যাঁ এবার যেতে আপত্তি নেই।
সেই ছাব্বিশ বছর আগে বিয়ের দিনেই রাশেদ সাহেব তার মনির কাছে সব বুঝিয়ে দিয়ে বলেছিলেন আজ থেকে আমি বলে আর কিছু নেই যা আছে সবই তোমার, তুমি তোমার মত করে গড়ে নিও।
[চলবে]

নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৫

১০।
ভোরের দিকে জাহাজ চিটাগাং পৌছার পর পতেঙ্গায় তেল কোম্পানির জেটি গুলির কাছে কর্ণফুলী নদীর এক পাশে নোঙ্গর করে রেখে সবাই কিছুক্ষণের জন্য শুয়ে পড়লো। সারা রাতই প্রায় গল্প করে চা খেতে খেতে এসেছে। সকাল
নয়টায় অফিস খোলার পর রফিক অফিসে গিয়ে লোডিং অর্ডার নিয়ে এলে জাহাজ নোঙ্গর তুলে জেটিতে এসে ভিড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাইপ কানেকশন করে লোড শুরু করে রফিক আর মহিউদ্দিন চলে এলো। বিকেল নাগাদ লোড শেষ হলে রাতের জোয়ার নিয়ে খুলনা যাবে।
-দেখলেন রাশেদ ভাই, কিছু চন্দন কাঠ পুরিয়ে এই যে এই লোডিং অর্ডার আনলাম ওই দেখেন ময়ূরপঙ্খী আমাদের আগে এসে বসে আছে। সারা বছরই এই ভাবে চলে। কাঠ খর না পোড়ালে লোডিং অর্ডার দিবে না, এক সপ্তাহ বসে থাকলে কোম্পানিই বা বাঁচে কি ভাবে আর আমরাই বা বাঁচি কি ভাবে। কোম্পানিও জানে তাই চন্দনের যোগাড় দিয়ে দেয়, মাথা ঘামায় না। এদিকে বেতনও কমিয়ে দিয়েছে কাজেই এই ভাবে নানান কলা কৌশল ফন্দি ফিকির করে আমরাও টিকে আছি আবার কোম্পানিকেও টিকিয়ে রেখেছি। নতুবা কোম্পানির লাল বাতি জ্বলে যেত অনেক আগে। এই অবস্থায় আমার মনে হয়না, আপনার যে আদর্শ দেখে এসেছি এতোদিন তা বিসর্জন দিয়ে এখানে টিকতে পারবেন।
-ঠিকই বলেছ মহিউদ্দিন। এসব আমি করতে পারবো না। দেখি শেষ পর্যন্ত মনে হচ্ছে বিলাতেই যেতে হবে। আমি যেতে চাই না। বিদেশে যারা থাকে তাদের কয়জন মান সম্মত কাজ করতে পারে তা দেখেছ। যে দেশে থাকে তারাই বা কী রকম ঘৃণার চোখে দেখে তাও জান, এই সব নানা কিছু ভেবে আমি বিদেশে যেতে চাই না। অথচ এদেশে আমি প্রথম শ্রেণীর নাগরিক আর ওখানে গেলে কি হব, সাধারণ দিন মজুর তাই না? কারণ পরিচয় দেবার মত কাজ পাওয়া আমার সম্ভব নয়, আমার যে যোগ্যতা তাতে তা পাবো না, এটাও একটা কারণ তার পর যাদের দেশে থাকবো তারা যদি আন্তরিক হতো তাহলেও একটা কথা ছিলো, কিন্তু সে কি আর সম্ভব? ওরা জানে যে এই সব তৃতীয় বিশ্বের আধা কাল মানুষ গুলি আমাদের দেশ থেকে রোজগার করে নিজ দেশে ধনী সাজতে এখানে এসেছে। এই তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা আমি কোন দিন সহ্য করতে পারিনি মহিউদ্দিন। আমার নিয়তি যদি তাই লিখে থাকে আমার ভাগ্যে তাহলে তা খণ্ডাবার কোন উপায় নেই। এই বয়সে স্ত্রী সন্তান ছেড়ে থাকা যে কি কঠিন কাজ সে তো আর তোমাদের বলতে হবে না নিজেরাই এখন বুঝতে পার। তবুও যেতেই হবে।
কথার ফাঁকে স্টুয়ার্ড এসে দুপুরের খাবার রেডি হয়েছে কখন খাবে জানতে চাইল।
-চলেন ভাই খেয়ে নিই।
-চলো।
টেবিলে বসার পর মহিউদ্দিন বিরাট একটা ভাজা কৈ মাছ তুলে দিল রাশেদ সাহেবের পাতে, প্লেটের প্রায় এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত।
-একি মহিউদ্দিন, এতো বড় কৈ কোথায় পেলে?
-আপনার জন্য জোগাড় করেছি, কথা বলবেন না খেয়ে নেন।
বিকেলে লোড হবার পর হিসেব নিকেশ করে জেটি ছেড়ে আবার বাইরে গিয়ে জোয়ারের অপেক্ষা করবে। জেটি ছাড়ার আগে রফিক রাশেদ সাহেবকে নিয়ে লাল খাঁ বাজারের কাছে কোচ স্টেশনে এলো। রফিক স্কুটার থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে কাউন্টার থেকে কোচের টিকেট কিনে রাশেদ সাহেবের হাতে দিল। রাস্তায় খাবার জন্য কিছু কমলা, দু’টা স্যান্ডউইচ আর এক বোতল পানি কিনে দিল।
-রাশেদ ভাই কিছু মনে করবেন না, ভীষণ নির্দয় ভাবেই কথাটা বলছি, মহিউদ্দিন যা বলেছে আমার মনে হয় তাই ভাল হবে, আপনি শুধু শুধু এখানে আর কিছু খোজা খুঁজির চেষ্টা না করে পারলে ওখানেই চলে যান, আপনার তো আর ভিসার সমস্যা হবে না। কি করবেন, আপনার কাছেই শিখেছি, জীবন যেখানে যেমন তেমন করেই চলতে দিও’ কথাটা আপনি বলতেন কিন্তু তখন এর মানে বুঝিনি এখন বুঝি। মাঝে মাঝে মানুষের জীবনে এমন সব জটিল মুহূর্ত এসে পড়ে যে কি করবে, কোথায় যাবে হিতাহিত বিচার করার কোন সুযোগ থাকে না। কষ্ট হলেও কিছু করার নেই, ভাগ্যকে মেনে নিতেই হবে। নয়তো কে ভেবেছে যে সারা জীবন এমন ন্যায় নীতি আর আদর্শ নিয়ে চলে আপনার আজ এই পরিণতি হবে। আমার কষ্ট হচ্ছে যে আপনার এই দুর্যোগের মধ্যে আমি কিছু করতে পারলাম না, আমার ক্ষমতাই বা কতটুক, আমাকে ভুল বুঝবেন না, আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আগেও আপনাকে যেমন শ্রদ্ধা করতাম এখনও তেমনি করি। এ কদিন ভেবে আমি এ ছাড়া আর কোন সহজ সমাধান পাইনি।
ওদের কথা বলতে বলতে ড্রাইভার এসে গাড়ি স্টার্ট দিল।
-যান গাড়িতে বসুন গিয়ে, আসি তাহলে।
রাশেদ সাহেব রফিককে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রায় কেঁদে ফেললেন।
-তাহলে আসি, তোমরা সাবধানে থাকবে, ভালো থাকবে।
বলে গাড়িতে উঠে পরলেন। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলেন রফিক কোচ অফিসের সামনের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে, কোচ ছেড়ে দিল।

১১।
রাশেদ সাহেব আর একটা ব্যর্থ মিশন শেষ করে এগিয়ে চললেন রাজধানী ঢাকা শহরের দিকে। যে শহর আজ তার জন্য বিভীষিকার মত। যে শহরের নাম মনে হলে তিনি চমকে উঠেন, যে শহর তার আর তার স্ত্রী সন্তানের জন্য দুমুঠো অন্যের সংস্থান করেনি। যে শহর তাকে ঠাঁই দিতে রাজী নয়, যে শহর তাকে তার স্ত্রী সন্তানদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। যে শহরে তার প্রিয় স্ত্রী সন্তানদের একা অসহায় ভাবে রেখে তাকে চলে যেতে হবে ভিন্ন কোন শহরে যেখানে তার পথ চেয়ে কেও বসে থাকবে না। বারবার ফোন করে কেও তার তদারকি করবে না। অসুস্থ হলে বা অসহনীয় ক্লান্তির পর কেও কপালে একটু মমতা ভেজা হাতের পরশ বুলিয়ে দিবে না।
যতক্ষণ দেখা গেলো দেখলেন রফিক দাঁড়িয়েই আছে তার কোচের দিকে তাকিয়ে। সন্ধ্যার ট্রাফিক জ্যামের জন্য কোচ স্পিডে চালাতে পারছে না বলে অনেকক্ষণ দেখলেন এ ভাবে। এক সময় চোখের সীমানার বাইরে চলে গেলো রফিক।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোচের আরামদায়ক সিটে বসে পিছনে হেলান দিলেন। চোখ বন্ধ হয়ে এলো। গাড়ির ভিতরের আলো নিভিয়ে বিলাস বহুল কোচের সৌখিন যাত্রীদের আয়েশের জন্য মৃদু এক টুকরো নীল আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে ড্রাইভার। চোখ বন্ধ হবার সাথে সাথে চোখের পাতার পর্দায় একটা সিনেমা দেখতে পেলেন।
[চলবে]

নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৪

৮।
ওখান থেকে সোজা নারায়ণগঞ্জ চলে এলেন। এখানে যাদের চিনতেন তাদের খুঁজে বের করলেন।
-আরে রাশেদ, কি ব্যাপার? হঠাৎ দেখলাম তোমাকে!
-হ্যাঁ এইতো তোমাদের দেখতে এলাম।
কিছু আবোল তাবোল বলে শেষ পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলেন-
-আচ্ছা রফিক কোথায় জান?
-হ্যাঁ জানি। কেন কোন কাজ আছে?
-না, তেমন কিছু না, এখানে এলাম যখন একটু দেখা করে যাই।
-ওঃ আচ্ছা, ঠিকানা তো বলতে পারবো না তবে ও চাষাড়ায় থাকে, এমনি বাসা চিনি। ওর ফোন নম্বর আছে ফোন করে জেনে নাও। বলে নম্বরটা দিয়ে দিল।
-তাহলে আজ উঠি কি বল?
-আচ্ছা আবার এসো।
আরও কয়েক জনের সাথে দেখা হলো। যাদের কাছে বলতে পারে এমন দুই এক জনের সাথে আলাপ করলো। সবারই এক কথা। না রাশেদ, তুমি এই এতো দিন সরকারি চাকরি করে এখন আর এই সব চাকরি করতে পারবে না। আগের সে পরিবেশ আর নেই অনেক বদলে গেছে, এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়েই রফিকের কাছে ফোন করলেন।
ও প্রান্ত থেকে রফিকের কণ্ঠ ভেসে এলো।
-ও, রাশেদ ভাই? আপনি কোথা থেকে, কেমন আছেন?
-বলছি, তুমি এখন কোথায়? বাসায়! আচ্ছা তাহলে আমি আসছি।
-আমার ঠিকানা জানেন?
-না বল।
ঠিকানা নিয়ে বললো-
-আমি এখন নারায়ণগঞ্জে আছি, তুমি আছ তো বাসায়?
-হ্যাঁ আছি আপনি আসেন।
একটা রিকশা নিয়ে চাষাড়া চলে এলেন। বাসা খুঁজে পেতে কোন অসুবিধা হলো না, রফিক দোতলা বাসা ছেড়ে নিচে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো। রফিক রাশেদ সাহেবের জুনিয়র হলেও অনেক দিন আগে একই জাহাজে এক সাথে প্রায় দুই বৎসর কাজ করেছে। রাশেদ সাহেবকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করে, মাঝে কয়েকবার খুলনা গিয়েছিলো তখন দেখা করে এসেছে। উপরে যেতে যেতে রফিক বললো-
-মহিউদ্দিনকে ফোন করি ও আসুক।
-ও কোথায়?
-ওই তো ওই বিল্ডিংয়ে থাকে।
-ডাক তাহলে দেখি অনেক দিন যাবত দেখি না।
একটু পরেই মহিউদ্দিন এলো।
-কেমন আছেন রাশেদ ভাই?
-ভালো, তুমি কেমন আছ? তোমাকে তো চিনতেই পারতাম না যদি রফিক আগে না বলতো।
-চিনবেন কি ভাবে আজ কতদিন পরে দেখা, প্রায় বিশ বছর তাই না?
-হ্যাঁ তা হবে।
চা নাস্তার সাথে নানান ধরনের কথা বার্তা। এর মধ্যে রফিকের স্ত্রী এসে সালাম করে গেলো। রফিকের স্ত্রীকে এই প্রথম দেখা। রফিকের ছেলে মেয়েরাও স্কুল থেকে এলো। ওদিকে রফিকের স্ত্রী রান্না বান্নার বিশাল আয়োজন সেরে ডাকল খেয়ে আসার জন্য। রাশেদ সাহেব টেবিলে এসে দেখে অবাক।
-এসব কি করেছ? এতো কিছু, কেন?
-ভাই, আপনি আমাদের বাসায় এই প্রথম এলেন তাই, আপনার কথা ওর কাছে অনেক শুনেছি, শুনতে শুনতে আমারও মনে হোত আমিও যেন আপনাকে খুব চিনি।
-তাই বলে এই অসময়ে এতো ঝামেলা করতে হবে? যাক যা করেছ বেশ করেছ।
খাবার পর আবার এক দফা চা। এই বার রাশেদ সাহেব তার এখানে আসার আসল কথা খুলে বললেন। রফিক এবং মহিউদ্দিন বেশ মনোযোগ দিয়েই তার সব কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলো।
-রাশেদ ভাই আপনি এ কি বলছেন! আপনি আবার জাহাজে চাকরি করবেন?
-বাঁচতে তো হবে, না কি?
-আপনাকে কি ভাবে বলবো বুঝতে পারছি না, না রাশেদ ভাই এখন আপনার দ্বারা এ কাজ করা আর সম্ভব নয়। আমি আর রফিক তো এক জাহাজে আছি আপনি একদিন চলেন, আমাদের সাথে। জাহাজে করে চিটাগাং যাই, এতে আপনার একটু বেড়ানোও হবে আর সেই সাথে নিজ চোখে বাস্তব অবস্থাটাও দেখে আসতে পারবেন। আপনি কি পরশু যেতে পারবেন? আমরা পরশু সন্ধ্যায় সেইল করবো।
-এখন বলতে পারছি না, বাসায় গিয়ে তোমার ভাবীর সাথে আলাপ করে দেখি, যদি যেতে পারি কাল বিকেলের মধ্যে ফোন করে জানাবো। তাহলে আজ উঠি?

৯।
বাসায় এসে সারা দিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে মনিরার সাথে আলাপ করলেন। মনিরা বললো-
-তা হলে ওদের সাথে যেয়ে দেখে আস, কাল রফিক ভাইকে জানিয়ে দাও।
পর দিন কিছু কাপড় চোপড় আর কয়েকদিন থাকতে হলে যা যা প্রয়োজন তা একটা ব্যাগে গুছিয়ে মনিরা রাশেদ সাহেবের হাতে দিয়ে বললো-
-দেখ কি হয়, যতদূর সম্ভব সহ্য করার মত মন মানসিকতা নিয়ে দেখে আস যদি কিছু হয়।
রাশেদ সাহেব মনির হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার পাড়ে একটা তেলের ডিপোতে ভেড়ান রফিকদের তেল বাহী কোস্টার জাহাজে এসে উঠলেন।
মহিউদ্দিন জাহাজে ছিলো। রাশেদ সাহেবকে আসতে দেখে নেমে এসে হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে তার এক স্টাফের কাছে দিয়ে বললো-
-ইনি আমার সিনিয়র ভাই, ব্যাগটা আমার পাশের যে রুমটা রেডি করেছ সেখানে রেখে এসো।
রফিক তাদের ডিসচার্জ করা তেলের হিসেব নিকেশ করার জন্য অফিসে গেছে, ও ফিরে এলেই জাহাজ ছেড়ে দিবে। অনেক দিন পর এই পথে চিটাগাং যাবার জন্য এসেছেন, মনের মধ্যে একটা কেমন যেন তোলপাড় করা ভাব এসে উদয় হলো। আবার সেই পথে! যে পথ ছেড়ে দিয়েছি প্রায় আটাশ বছর আগে। মানুষের নিয়তি কখন কোথায় নিয়ে যায় কে জানে! কয়েক মিনিটের মধ্যেই রফিক ফিরে এলো।
মহিউদ্দিন উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
-কি খবর?
-আর বলো না, আজ ছয় দিন যাবত পানির নিচে থেকে জাহাজের ট্যাঙ্কে তেলের টেম্পারেচার দুই ডিগ্রী কমেছে বলে তেলের ভলিউম কমবে না? তা ডিপো ম্যানেজার কিছুতেই মানবে না। উনি চিটাগাং থেকে লোড করার পর যে টেম্পারেচার ছিলো সেই টেম্পারেচার ধরেই হিসেব করছে, স্বাভাবিক ভাবেই সাত আট শ লিটার ঘাটতি দেখাচ্ছে। বারবার তাকে বোঝাচ্ছি ডিসচার্জ করার সময় যে টেম্পারেচার পেয়েছেন সেই হিসাব করুন, না তিনি তা মানবেন না। আধা ঘণ্টা ধরে এই ঝামেলা। আজকের টেম্পারেচার দিয়ে হিসেব করে দেখালাম তাতে ওই পরিমাণ গেইন হয় কিন্তু হলে হবে কি, সে কিছুতেই তা মানতে রাজী না। দেখলেন রাশেদ ভাই, শেষ পর্যন্ত তার হিসেবেই মেনে নিয়ে আসলাম। কি করবো মেনে নিলাম, না হলে হয়ত দেখা যাবে সামনের এক মাসেও কোন ট্রিপ দিবে না। আর একটা ট্রিপ যদি মিস করি তাহলে কোম্পানির কত লস হবে বুঝতে পারছেন। এই হচ্ছে এখনকার অবস্থা।
-তাহলে তোমরা এর কোন প্রতিবাদ কর না কেন? সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানিকে ডাকতে, তারা এসে দেখত বাস্তবে কি পরিমাণ লস বা গেইন হয়েছে।
-বলছি কি, বুঝতে পারছেন না? কোম্পানির খোদ এমডি এলেও তো ফলাফল একই দাঁড়াবে। আগামী এক মাসেও একটা ট্রিপ দিবে না। কোম্পানি এটা জানে আর জানে বলেই আমাদের কিছু বলে না। এর আগে আপনি যখন ছিলেন তখন সুইপিং ছিলো ৫% আর এখন কত জানেন? মাত্র ২%, তার পরেও এই অবস্থা।
-তাহলে এরা এটা দিয়ে করে কি? কি আর করবে, বিক্রি করে দালান বানায়, ব্যবসা করে।
-কার কাছে বিক্রি করে?
-কি যে বলেন রাশেদ ভাই আপনি এত দিন বিদেশে থেকে আর সরকারি চাকরি করে দেশের এই সব নোংরামির খবর রাখতে পারেননি। যাক এ নিয়ে আর মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। চলো মহিউদ্দিন জাহাজ ছেড়ে দাও নয়তো আবার সারা পথ উজান ঠেলে যেতে গিয়ে জ্বালানী খরচ বেড়ে যাবে।
এতক্ষণ জাহাজ স্ট্যান্ডবাই করা ছিলো, যে কোন সময় বন্দর ছেড়ে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলো।
-চলেন ব্রিজে যাই।
-চলো।
ব্রিজে এসে জাহাজ ছেড়ে দিল। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে শীতলক্ষ্যা নদীর কূল বেয়ে নারায়ণগঞ্জ শহর ছাড়িয়ে খোলা জায়গায় আসতেই মহিউদ্দিন কলিং বেল টিপে তার স্টুয়ার্ডকে ডেকে চা নাস্তা দেবার জন্য বলে দিল।
বর্তমান চাকরির এই সব আরও ঘটনা নিয়ে, রাশেদ সাহেবের পরিণতি নিয়ে আলাপ। রফিক, মহিউদ্দিন এবং রাশেদ সাহেব সবাই সবার কথা মন দিয়ে শুনলেন।
মহিউদ্দিন বললো-
-রাশেদ ভাই, আপনি কি পারবেন এই অনাচার অবিচার মেনে নিতে? ট্রেনিং সেন্টারে আমরা যে আপনাকে কী ভয় পেতাম তা আমাদের ব্যাচের প্রতিটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন। শুধু ভয় না ঠিক তার সাথে আপনাকে সব সিনিয়রের চেয়ে বেশি সমীহ করে চলতাম। আপনার নীতি বোধ, ব্যক্তিত্ব সব কিছু আমরা ফলো করার চেষ্টা করতাম। আপনি জানেন না, আপনার অবর্তমানে ইকবাল আর সেলিম আপনার ভয়েস নকল করে আপনার মত হেঁটে অভিনয় করে দেখাত। আর আজ সেই আপনাকে এই সামান্য চাকরি খুঁজে বেড়াতে হচ্ছে। এটা কি ধরনের পরিহাস ঠিক বুঝতে পারছি না।
রফিক সাথে সাথে বললো-
-আমি কিছুতেই এই অংক মিলাতে পারছি না। আপনি সেদিন যাবার পর থেকেই আমি ভাবছি কিন্তু কোন কূল কিনারা পাচ্ছি না। আচ্ছা ভাই এ দেশে কিছু খোঁজার চেয়ে ইংল্যান্ডে চলে যান। আপনার সব ভয়েজ তো ব্রিটিশ কোম্পানিতে আর গত বার না আপনি ওখানে গিয়েছিলেন, কাজেই আমার মনে হয় আপনার ভিসা পেতে কোন সমস্যা হবে না।
মহিউদ্দিনও বললো-
-হ্যাঁ ভাই আমারও তাই মনে হচ্ছে এটাই ভাল হবে।
-তোমরা ঠিক বলেছ, তবে নিজ দেশ ছেড়ে কে বিদেশে যেতে চায় বল? তোমরা বা আমি সবাই তো বিদেশে থেকে এসেছি তাই না? কাজেই বিদেশের কি সুখ তা যেমন আমি জানি তেমনি তোমরাও জান। আমাদের এই দেশের মত আর কোথায় এতো সুখ এতো শান্তি আছে বলতে পারবে? হ্যাঁ মানি যে চাকচিক্য বা জৌলুশ আছে চোখ ধাঁধানো রঙের বাহার আছে, প্রাচুর্য আছে কিন্তু শান্তি আছে? দেখি শেষ পর্যন্ত হয়ত তাই যেতে হবে।
ঢাকা শহর বল বা এই আমার নিজ দেশ বল এখানে আমার জায়গা নেই। হিসেব করে দেখ কত দিন আমি এদেশে থাকতে পেরেছি? তোমাদের সাথে তো আজকের সম্পর্ক নয়, গত প্রায় ত্রিশটা বৎসর যাবত আমাকে দেখে আসছ, মাঝখানে একটু দেখা সাক্ষাত না হলেও আমরা প্রত্যেকেই কিন্তু সবার খোঁজ খবর জানতাম। সত্যিই এ দেশ আমার জন্য নয়। এদেশের মাটিতে আমার মত হতভাগার ঠাঁই নেই। দেশকে আমি যত ভালোবাসি, এ দেশের আকাশ, বাতাস, মাটি, পানি সবই আমার কত প্রিয়। দেশের মায়ায় বিদেশে থেকে যাবার মত কোন চিন্তা ভাবনা করিনি, চেষ্টা তো দূরের কথা। তোমরা জান না, মিজান জানে, আবুধাবিতে এডনক রিফাইনারিতে ভালো একটা চাকরি পেয়েছিলাম। পুরো ফ্যামিলি নিয়ে ওখানে থাকতে পারতাম। ক্যাপ্টেন বার্কি কত বলেছে চলো আমাদের ইউকেতে চলো, আমি তোমাকে নিয়ে যাব, গেলে হয় তো এতো দিনে ব্রিটিশ নাগরিক হয়ে যেতাম, তবুও যাইনি শুধু দেশের মায়ায়। আর দেশ বারবার নানা ছল ছুতা ধরে আমাকে দেশের বাইরে পাঠাবেই। আমার ভাগ্য যদি এমনই হয় তাহলে যেতে হবে। এখানে যখন আমার একটু খানি জায়গা হবে না তাহলে আর কি করবো চলেই যাই।
এ পর্যন্ত বলে রাশেদ সাহেব হেসে ফেললেন।
তার মনে পরে গেলো লিটনের বাবার কথা। রাশেদ সাহেব যখন মংলায় চাকরি করতেন তখন সেখানকার এক গানের শিল্পী তার সাথে অপরূপা তিলোত্তমা ঢাকা শহর দেখার জন্য বেড়াতে এসেছিলো। তাদের এক প্রতিবেশী ছিলেন যিনি রেডিও বাংলাদেশে একজন পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। রাশেদ সাহেবের অতিথি গান গায় জেনে তার গান শোনার জন্য ডেকে পাঠালেন। গান শুনে আলাপের সময় বললেন এতো বড় ঢাকা শহরে আমাদের রাশেদের একটু জায়গা হলো না!
রফিককে কথাটা বলেই রাশেদ সাহেব আরও জোড়ে হাসতে লাগলেন। এই হাসির আড়ালে যে কত কষ্ট লুকিয়ে ছিলো তা এক মাত্র রফিক আর মহিউদ্দিন ছাড়া আর কেও জানতে পারেনি।
হাসি থামার পর বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা, কারো মুখে কোন কথা নেই। এমন সময় স্টুয়ার্ড এসে নীরবতা ভেঙ্গে দিল,
-স্যার ডিনার টেবিল কি রেডি করব?
মহিউদ্দিন হাতের ঘড়ি দেখে রাশেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-রেডি করতে বলি?
-বল।
একটু পরে নিচে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে রাশেদ সাহেব অবাক।
-একি মহিউদ্দিন, এ কি করেছ? এ তো রাজকীয় ভোজের আয়োজন!
-রাশেদ ভাই যে কি বলেন, ভেবেছেন আপনার কথা ভুলে গেছি? তবুও আমার মন বলছে আপনার মন মত কিছুই হয়নি। আপনার মনে আছে সেই পিকনিকের কথা?
-কোন পিকনিক?
-ওই যে আহসান স্যার যেবার গিয়েছিলেন।
-সে আর মনে থাকবে না? এ কি ভোলা যায়? সেগুলি তো এখন স্মৃতি। তবে কি জান মহিউদ্দিন এখন আর আমার সে দিন নেই।
-কেন ভাবী বুঝি রাঁধতে পারে না?
রফিক বললো-
-না মহিউদ্দিন তোমার অনুমান সঠিক নয়, ভাবীর রান্নার তুলনা নেই।
-তাহলে?
-আমার যে ডায়াবেটিস।
-ও, তাই নাকি?
-তোমার ভাবী আর কি দিয়েছে জানি না তবে ওষুধ গুলি দিতে ভুল করে নাই সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, ব্যাগ খুলে দেখতে পার।
এমন সময় মহিউদ্দিনের মোবাইল বেজে উঠলো। পকেট থেকে বাম হাতে ফোন বের করে কানে নিয়েই বললো -ভাবী আপনার আয়ু অনেক দিনের, এই মাত্র আপনার কথাই হচ্ছিল, না ভাই বলছিলো যে তোমার ভাবী ওষুধ দিতে ভুল করার কথা নয়। নেন ভাবী ভাইয়ের সাথে কথা বলেন।
-হ্যালো!
ও পাশ থেকে মনিরার কণ্ঠ ভেসে এলো।
-কি করছ?
-এইতো রাজকীয় ভোজের সামনে বসেছি এখনই শুরু করবো, তোমরা কি করছ?
-আমরাও খেতে বসবো, ওষুধ গুলি খেও সময় মত।
-হ্যাঁ সেই কথাই বলছিলাম, খাবো চিন্তা করো না।
রাশেদ সাহেব যাবার পর থেকেই মনিরার মনটা ছটফট করছিলো একটু কথা শোনার জন্য, কোথায় আছে, কি করছে জানার জন্য।
[চলবে]

নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৩

৬।
রাশেদ সাহেব আর মনিরা কল্যাণপুর থেকে রাতের খাবার খেয়ে রাত প্রায় দশটায় ফিরলেন। ওদের দেখে আপা মুরগির মাংস আর খিচুড়ি রান্না করলেন।

রাশেদ সাহেব মনিকে ডেকে আড়ালে নিয়ে বললেন-
-কেন, তুমি নিষেধ করলে না কেন?
নিজের পকেটের স্বাস্থ্য ভাল না থাকলে কারো বাড়িতে খেতে মন চায় না তা মনি জানে কিন্তু আপার খিচুড়ি রাশেদ সাহেবের খুব প্রিয় বলে আর অমত করেনি।
রাতে শোবার পর বললেন-
-আচ্ছা মনি বলত এভাবে আর কত দিন চলতে পারে? এভাবে তো জীবন চলে না! মেয়েদের লেখা পড়া কি বন্ধ হয়ে যাবে?
-তুমি যে রিজাইন করেছ ওখানে একটু খোঁজ নিয়ে দেখ।
মনি তার স্বামীর আত্মসম্মান বোধ সম্পর্কে ভালো করেই জানে। তবুও বললো-
-জানি তুমি রাজী হবে না তবে আমার মনে হয় তোমার সাবেক বসরা তো তোমাকে আসতে নিষেধ করেছিলো, দেখ না একবার একটু জিজ্ঞেস করে। না হলে বল আমিই ফোন করে বলি।
-না মনি তা হয় না। এই বেকারের দেশে অমন চাকরি কি আর এতো দিন খালি পরে রয়েছে? শুধু শুধু ফোন করে খারাপ কিছু শোনার চেয়ে না করাই ভালো। আমি যতটা শুনে এসেছিলাম তাতে মনে হয় ওখানে হাসান সাহেবকে প্রমোশন দেবার কথা ছিলো
-কোন হাসান সাহেব?
-তুমি চেন না, ওই জাকিরদের সাথে ছিলো।
-তুমি একটু বলেই দেখ না!
-আচ্ছা ঠিক আছে কাল মনে করে দিও।
পরদিন সকালে ফোন করলেন তার সাবেক বসের কাছে।
-আরে রাশেদ সাহেব আমি তো আপনাকে কতবার নিষেধ করেছিলাম তবুও আপনি চলে গেলেন। আমি তো জানি এদেশের ব্যবসার কি অবস্থা তখন তো আপনি আমার কথা শুনলেন না। আমরা তো এই মাত্র মাস দুয়েক আগে হাসানকে প্রমোশন দিয়ে ওখানে নিয়ে নিয়েছি। আর দুইটা মাস আগে খোঁজ নিলে অবশ্যই আপনাকে নিয়ে নিতাম।

-তাহলে তোমার তো জাহাজে চাকরি করার সার্টিফিকেট আছে, সেখানে একটু দেখবে?
-হ্যাঁ এটা করা যায়। দেখি রফিকের কাছে একটু আলাপ করে দেখি এখানে কি অবস্থা। কিন্তু ওর তো কোন ঠিকানা বা ফোন নম্বর জানি না তবে নারায়ণগঞ্জে থাকে এই জানি। আমাকে একবার ওখানে যেয়ে খুঁজে বের করতে হবে।
-তাহলে যাও দেখ পাও কি না।
-পাব, ওখানে গেলে অবশ্যই খুঁজে পাব। হঠাৎ একটা কথা মনে হলো, তোমার শরীফ স্যারের কথা মনে আছে?
-হ্যাঁ।
-উনি এখন ওখানে নেই, ঢাকায়ই আছে এখানে অন্য একটা অফিসের হেড, তার সাথে একবার দেখা করে আসি।
-তাই যাও উনিও তোমাকে খুব পছন্দ করতেন।
-তাহলে এখনই যাই।

৭।
অফিস খুঁজে পেতে কোন অসুবিধা হলো না, কারওয়ান বাজারে একটা বিল্ডিং এর চার তলায় উঠে অফিসে ঢুকেই দেখলেন তার পুরনো সহকর্মী সিভিল ইঞ্জিনিয়ার মকসুদ সাহেব এক টেবিলে বসে ড্রইং দেখছে। পায়ের শব্দ পেয়ে তাকিয়েই-
-আরে রাশেদ সাহেব আপনি এখানে? কি ব্যাপার? বসেন।
বসে রাশেদ সাহেবও অবাক।
-তাহলে আপনি রিজাইন করে এখানে এসেছেন?
-হ্যাঁ।
-ও আচ্ছা, শরীফ স্যার এখানে না?
-হ্যাঁ এখানেই, দেখা করবেন? তাহলে যান স্যার রুমেই আছে। আসেন পরে চা খাই।
-হ্যাঁ তাই।
স্যারের রুমে ঢুকতে যাবার আগে কে যেন পিছন থেকে ‘স্যার বলে ডেকে সালাম দিল, পিছনে ঘুরে দেখে তাদের অফিসের এক পিওন।
-বারেক মিয়া তুমি এখানে?
-হ্যাঁ স্যার আমি একা না ওই তো বাসার সাহেব সহ আরও কয়েক জন চলে এসেছিলাম।
স্যারের পিএ বাসার সাহেবের রুমে উঁকি দিলেন। বাসার সাহেব উঠে সালাম দিয়ে বললো
-স্যার আপনি?
-এইতো আপনাদের দেখতে এলাম, আমি জানতাম কেও কেও এখানে এসেছেন তবে কে কে এসেছেন তা জানতাম না। যাক কেমন আছেন সবাই?
-হ্যাঁ স্যার ভালই আছি। স্যারের সাথে দেখা করবেন?
-হ্যাঁ আসলাম যখন একটু দেখেই যাই।
-যান স্যার আছেন।
পর্দা সরিয়ে উঁকি দিতেই স্যার হাসি মুখে উঠা দাঁড়ালেন,
-আরে রাশেদ! এসো এসো বস। তারপর বল কি খবর, কি করছ, কেমন আছ সব বল।
রাশেদ সাহেব কোথা থেকে শুরু করবেন ঠিক বুঝতে পারছিলেন না। এদিকে চুপ করে কতক্ষণই থাকা যায়? যা বলতে এসেছেন তা যে তাকে বলতে হবে। ভাবছেন।
এমন সময় স্যার নিজেই প্রশ্ন করলেন-
-তুমি ব্যবসা করবে বলে রিজাইন দিয়ে এসেছিলে না?
-হ্যাঁ স্যার।
-তা কি অবস্থা?
-না স্যার সুবিধা করতে পারলাম না, বলে এবার আস্তে আস্তে সব কিছু গুছিয়ে বলে সর্ব শেষে তার আসল কথাটা বললেন। এখন কি করি, আপনার এখানে কোন ব্যবস্থা করে দেন স্যার, আর কিছু করার দেখছি না।
-হু বুঝলাম, কিন্তু তুমি এমন সময় এসেছ তোমাকে আমি এখন কোথায় প্রোভাইড করি, আমি নিজেই আর মাত্র দেড় মাস আছি এর পরেই এলপিআর এ চলে যাচ্ছি। এই সময়ের মধ্যে কিছু করতে পারব বলে মনে হয় না।
এর পর আর কিছুক্ষণ থেকে টুকিটাকি কিছু কথা বার্তা বলে বেরিয়ে এলেন।
[চলবে]

নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-২

পূর্ব সূত্রঃ নক্ষত্রের গোধুলি – ১ (১২৫)

বিগত দশ বছর ধরে বিলাতে থাকা মেঝ ভাইয়ের টাকা দিয়ে এই জমি কিনেছিলেন। সেখানেও এক কথা হয়েছিলো। বাবা চেয়েছিলেন তার নামে দলিল করতে কিন্তু রাশেদ সাহেব তা বাঁধা দিয়েছিলেন। না আব্বা এটা করবেন না। সে
জানে বিদেশে থেকে টাকা উপার্জন করা কত কঠিন। নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে, সমস্ত সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়ে, দিন রাত অমানুষিক পরিশ্রম করে উপার্জন করতে হয়। কত রাত কেটে যায় ঘুমহীন, কত কি খেতে ইচ্ছে হয়, কত কি অনিচ্ছা সত্যেও পেট ভরার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য খেতে হয়, কত জনের অশ্রাব্য কথা হজম করতে হয়। সেই রোজগারের টাকা কেন তার নামে করবেন না? ওর নামে করুন, এখানে আপনার নামে দলিল করার পক্ষে কোন যুক্তি নেই। এই জমি কেনার পর থেকেই পড়েছিলো, এখান থেকে কোন আয় ছিলো না বা আয় করার কোন পথও ছিলো না। ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করে ওকে দিয়ে বাবাকে রাজী করিয়ে বাবা এবং ভাইএর দেয়া কিছু আর কিছু টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এটা গড়ে তুলেছিলেন। সে ছিলো শুধু পরিচালক, কোন মালিকানা তার নেই। ভেবেছিলেন একবার ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে তখন এটা পারিবারিক ব্যবসা হবে কাজেই তার নিজের আর কি দরকার?

সব ব্যবসায়ীরা মিলে প্রধান মন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাল, ভারতীয় আমদানির বিরুদ্ধে মিছিলও করলো। সারা দেশ জুরে চিৎকার করলো মাননীয় প্রধান মন্ত্রী এর বিহিত করুন, দেশের শিল্প বাঁচান, দেশের উৎপাদন ব্যবহার করুন। খবরের কাগজে লেখালেখি হলো কিন্তু প্রধান মন্ত্রীর কানে সে চিৎকার পৌঁছল না। সে তার গদি বাঁচাবার ধ্যানে পূর্ণ উদ্যমে মশগুল রইলো। ফলে যা হবার তাই হলো।

রাশেদ সাহেব নিশ্চিত এগিয়ে চললেন ধ্বংসের দিকে। প্রাণান্তকর চেষ্টা করলেন। কর্মচারীরাও বসে থাকেনি তারাও কোথা থেকে ধার কর্জ করে টাকা এনে রাশেদ সাহেবের হাতে তুলে দিয়ে বললো ভাই দেখেন চেষ্টা করেন। ডুবন্ত প্রায় মানুষ যেমন তার কোলের শিশুর উপর দাঁড়িয়ে নাক উঁচু করে শ্বাস নেয়ার জন্য বেঁচে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা করে ঠিক তেমনি মনিরা তার গহনা গুলি এনে দিল। নাও দেখ কদিন চলে। গহনা বলতে আর কি মনিরা যা নিয়ে এসেছিলো তাই, সে নিজে কিছু দিতে পারেনি। কিছু অদরকারি জিনিষ পত্র বিক্রি করে কিছু দিন চালালেন এতেও হলো না। শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে বেড় হলেন ধার করার জন্য। কিন্তু তাকে কে ধার দিবে? সবার একই কথা তোমার হাতি পোষার খরচ আমরা কি ভাবে জোটাবো? তোমার দরকার অনেক তা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
কতজনের কাছে কাকুতি মিনতি করে বোঝালেন, এরকম থাকবে না অবশ্যই পরিবর্তন হবে। মনে কর তোমরা চালান খাটাচ্ছ। দিনের পরিবর্তন হলেই আমি তোমাদের লাভ সহ ফেরত দিব। কিন্তু এতে কোন লাভ হয়নি। সবাই তাকে দেখলেই ভাবতো এইতো টাকা চাইতে এসেছে। আগেই বলে নিত টাকা চাওয়া ছাড়া আর কোন কাজ থাকলে বল। বিভিন্ন দোকানে বাকীর খাতা বেশ ঊর্ধ্ব গতিতেই বাড়তে থাকল, দোকানদাররাও আর মাল দিতে চায় না। তাদেরও একই কথা আগের কিছু শোধ করে মাল নিন এভাবে আমি আর কত বাকী দিতে পারি বলুন আমার ক্ষমতাই বা কতটুকু। আমি তো আমার ব্যবসার চালান এক জায়গায় ফেলে রেখে আমার ব্যবসা বন্ধ করে দিতে পারি না। রাশেদ সাহেব দেনার দায়ে জর্জরিত, কি করবেন তিনি? রাতে ঘুম নেই। এই দুর্দিনে তার একমাত্র সঙ্গী স্ত্রী মনিরা। দুজনে হাজার পরামর্শ করেও কোন কূল কিনারা পায় নি।

রাশেদ সাহেব মনিরাকে না জানিয়ে ভাবছেন, অনেকেই তো নষ্ট হয়ে যাওয়া কিডনি বা চোখের কর্নিয়া সংগ্রহ করার জন্য খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়। দেখি না তেমন কিছু পেলে একটা কিডনি বা একটা কর্নিয়া বিক্রি করে। এক কিডনি বা এক চোখ দিয়ে চলা যাবে। প্রতিদিন খবরের কাগজে এমন বিজ্ঞাপন খুঁজেন, তন্ন তন্ন করে খুঁজেন। যাও বা দুই একটা পাওয়া যায় তা তার রক্তের গ্রুপের সাথে মিলে না। অবশেষে যখন হতাশ হতে বসেছেন তখন একদিন যেন একটু আশার আলো দেখতে পেলেন। জার্মানি থেকে এক ভদ্র লোক কিডনি চেয়ে একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছেন যাতে তার রক্তের গ্রুপের সাথে মিলে যায় কিন্তু যোগাযোগের জন্য স্থানীয় বা ঢাকার ফোন নম্বর না দিয়ে জার্মানির ফোন নম্বর দিয়েছেন। সমস্যায় পড়লেন। বাড়ির ফোন থেকে ওভার সিজ কল করা যায়না। বাইরের ফোনের দোকান থেকে ফোন করতে হবে এবং এ জন্য তিন চারশো টাকার দরকার। কোথায় পাই এই টাকা? ভেবে না পেয়ে মনিরাকেই বললেন, -কিছু টাকার যোগাড় করা যাবে?
-কি করবে টাকা দিয়ে?
-দেখ না একটু কাজ আছে।
-কি কাজ শুনি!
-আছে, তুমি দেখ।
-বলই না কি কাজ, কী আমাকে বলা যাবে না?
-না।
-তাহলে টাকাও যোগাড় করা যাবে না।
ব্যাস ঐ পর্যন্তই, আর এগুতে পারেননি, ওখানেই সমাপ্তি। সেদিন দুপুরে খাবার পর এই সবই ভাবছিলো।

৫।
মনিরা ডাকল,
-একটু শুয়ে বিশ্রাম নাও, ওখানে বসে কি করছ?
-একটু চা দিতে পার?
-আচ্ছা দিচ্ছি।
কিন্তু ঘরে চা পাতা বা দুধ নেই সে কথা মনিরা জানে, তবুও বললো দিচ্ছি। একটু পরে পরদিন মেয়েদের স্কুলে যাবার ভাড়া থেকে টাকা নিয়ে বাসার কাজের মেয়ে মমতাজকে পাশের দোকানে পাঠাল। রাশেদ সাহেব বুঝতে পারলেন মমতাজ কোথায় গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যে মমতাজ চা পাতা আর গুড়া দুধের একটা ছোট প্যাকেট নিয়ে যখন এলো তা দেখে রাশেদ সাহেব মনিরাকে বললেন-
-তাহলে আর কি দরকার ছিলো? ঘরে যখন ছিলো না তখন নাই দিতে!
-তুমি একটু চা চেয়েছ তা কি করে না দিই বল!
-টাকা কোথায় পেলে?
-সে থাক তোমার অত কিছু জানার দরকার নেই, একটু বস আমি চা নিয়ে আসছি।
মমতাজকে দিয়ে চা বানিয়ে সে চা মনিরা তার স্বামীকে দিতে পারে না। নিজেই চা বানিয়ে এনে স্বামীর হাতে কাপটা দিয়ে আস্তে করে বললেন নাও। চায়ে এক চুমুক দিয়ে নামিয়ে রেখে পাশে দাঁড়ানো মনিরাকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রেখে বললেন-
-তুমি এতো ভাল কেন মনি? এই অপদার্থ স্বামীকে তুমি এখনও এতো ভালবাস? যার কোন রোজগার নেই স্ত্রী সন্তানকে খাওয়াবার যোগ্যতা নেই তার জন্য এতো মায়া কোথায় লুকিয়ে রেখেছ?
মনিরার চোখ বেয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে এলো, স্বামী দেখে ফেলে তাই তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে মুছে নিয়ে বললো-
-কে বলেছে তুমি অপদার্থ, তুমি অপদার্থ বা অযোগ্য হবে কেন? তোমাকে কি আজ নতুন দেখছি? বুদ্ধি হবার পর থেকেই তো তোমাকে দেখে আসছি, তুমি কোন দিন অযোগ্য বা অলস ছিলেও না এখনও নেই। মানুষের জীবনেই এমন দুর্যোগ আসে আবার তা কেটেও যায়। তুমি এতো ভেঙ্গে পরো না একটু ধৈর্য ধর দেখবে সময় এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, আবার নতুন সূর্য উঠবে। মন খারাপ করো না, চা টা খেয়ে শেভ হও তারপর চলো কোথাও থেকে একটু ঘুরে আসি। সেই সকাল থেকেই এই যে এক ভাবে কেমন মন মরা হয়ে বসে আছ।

এমন সময় ও পাশের ঘর থেকে সেঝ বৌ রেখা ডাকল ভাবী একটু এদিকে আসবেন! সঙ্গে সঙ্গে রাশেদ সাহেবকে ছাড়িয়ে ওদিকে চলে গেলো। রাশেদ সাহেবের সামনে চায়ের কাপ হাতে ধরা কিন্তু আর চুমুক দিচ্ছেন না ভুলে গেছেন।

রান্না ঘরের জানালা দিয়ে ওই নারকেল গাছের মাথায় দুটা কাক বসে ছিলো। মনে হচ্ছিল যেন কাক দুটিকে দেখছে। বৃষ্টিতে ভেজা কাক। এক মনে ওই দিকেই তাকিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। সব ছবি গুলি মনে হচ্ছে একে একে নারকেল গাছের মাথায় কোন স্ক্রিনে ভেসে ভেসে আসছে আর যাচ্ছে। ওই ভেজা কাক দুটি যেন প্রজেক্টর চালাচ্ছে। কতক্ষণ এ ছবি দেখছিলেন তা খেয়াল নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর মনিরা এসে এই দৃশ্য দেখেই বললো-
-কি ব্যাপার চা খাও নি? এ কি! চা তো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, কি ভাবছ এমন করে?

রেখা কি যেন সেলাই করছিলো তাই দেখিয়ে দেবার জন্য বড় জাকে ডেকেছিলো। মনিরার ডাকে রাশেদ সাহেবের সিনেমা দেখা থেমে গেলো। হঠাৎ চমকে উঠলেন। মনিরা জানে রাশেদ সাহেব ঠাণ্ডা চা খেতে পারে না। কাপটা নিয়ে রান্না ঘরে এলো। এই ঠাণ্ডা চা আবার গরম করে স্বামীর জন্য নিয়ে যেতে পারবে না। তা কি করে হয়? সেই যে তার সব, সে ছাড়া আর কি আছে মনিরার? অগাধ ভালোবাসা। বলতে গেলে বাল্য বিবাহই তাদের, আজকাল এতো কম বয়সে সাধারণত বিয়ে হয় না। মনিরা মাত্র স্কুল ফাইনাল দেয়ার পরই এ বাড়িতে বড় বৌ হয়ে এসেছে। সেই ছোট বেলা থেকেই যাকে দেখে আসছে সে মানুষটাকে আজ পঁচিশটা বছর ধরে বুকে করে রেখেছে তাকে এই ঠাণ্ডা চা আবার গরম করে দেয়া যায়? আবার নতুন করে আর এক কাপ বানিয়ে এনে স্বামীর হাতে দিলেন আর পুরনো কাপের চা গরম করে নিজের জন্য নিয়ে এসে স্বামীর পাশে বসে কথা বলতে বলতে দুজনেই একসাথে চা খেলেন। এর মধ্যেই মনিরা প্ল্যান করে ফেলেছে,
-চলো কল্যাণপুর বড় আপার বাসায় যাই। তুমি ওঠ শেভ হয়ে নাও।
-আচ্ছা উঠছি, চলো যাই একটু ঘুরেই আসি, কাছে আর কোথায় বা যাব? এই, চলো না হেঁটে যাই!
-হেঁটে যাওয়া যেত কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে যে, থাক রিকশায়ই চলো
রাশেদ সাহেব স্ত্রীর তাগিদে উঠে শেভ করে, ওজু করে নামাজ পরে কাপড় বদলে দেখে মনিরা রেডি হয়ে রেখাকে বলছে,
-তোর দাদাকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি, খেয়াল রাখবি আর বড় মেয়ে এলে খেতে দিস
[চলবে]

নক্ষত্রের গোধুলি – ১ (১২৫)


১।
রাশেদ সাহেব খাবার টেবিলে বসে ভাবছিলেন। সামনে চায়ের কাপ দিয়ে গেছে একটু আগে। তিনি ভাবছিলেন তার জীবনের কথা, অতীতের কথা, কি পেলাম আর কি পেলাম না সেইসব কথা, সংসারের কথা, তার তিন মেয়ের পড়া লেখা এবং ভবিষ্যতের কথা। কি হবার ছিলো আর কি হলো, কি হতে পারতো, কি হলো না, কেন হলো না, কোন সূক্ষ্ম কারুকাজ তার জীবনে এই সব ঘটাল সেই সব কথা। বাবা মার কথা, ভাই বোনের কথা, সমাজের কথা, তার সেই সব সোনালী দিন গুলির সেই সব স্বপ্নের কথা যার মিছে আশায় পথ চেয়ে আজো বসে আছে।

বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে, ভ্যাপসা গরম, মাথার উপর ফুল স্পিডে ফ্যান চলছে। চা কখন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। ডাইনিং টেবিলে বসে রান্না ঘরের ওপাশের জানালা দিয়ে পাশের বাড়ির একটা নারকেল গাছ দেখা যায়। গাছটার মাথার দিকে তাকিয়ে আনমনে ভাবছেন। ঠাণ্ডা চা সে মোটেই সহ্য করতে পারে না কিন্তু আজ তার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। এই যে একটু আগে চায়ের কাপটা দিয়ে গেলো সে চা কোথা থেকে এসেছে তা সে জানে।

মনিরা হাসান, রাশেদুল হাসানের স্ত্রী। কয়েক দিন থেকেই রাশেদ সাহেবের মনটা খারাপ। আজ সকালে আরও খারাপ হলো যখন সে দেখলো মনিরা তার কাজের মেয়েটাকে দিয়ে পাশের দোকান থেকে বাকিতে ঠোঙ্গায় করে কিছু চাল আনাল। রাশেদ সাহেব তাকিয়ে শুধু দেখলেন। কিছু বললেন না। কীই বা বলবেন? শুধু চাল কেন ঘরে কিছুই নেই। আসবে কোথা থেকে? আজ কত গুলি দিন যাবত তার কোন রোজগার নেই। লোকসান দিয়ে আর কত দিন ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যায়? সোনার হরিণের আশায় অনেক আগেই চাকরিটা ছেড়েছেন।

ব্যবসা করে সংসারের টানাটানির ঝামেলা কিছুটা কমিয়ে আনবেন। অভাবের দুয়ার বন্ধ করে সুখের দুয়ার খুলে দিবেন। দেশের উপকার করবেন, বেকারত্বের বোঝা কমিয়ে আনবেন। এমন একটা আশা নিয়ে সরকারি প্রথম শ্রেণীর চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু ‘অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়’ এই প্রবাদ শুধু তার একার জন্য নয়, এতো অনেক পুরনো কথা। সুখ যার নিয়তির পছন্দ নয়। চির অভাব যাকে আলিঙ্গন করে রেখেছে সে কেন এই প্রবাদের বিরুদ্ধে জয়ী হবে? তিনিও চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করলেন আর নদীতেও চর পড়লো। তিনি আবার যেমন তেমন ব্যবসা দাঁড় করাননি! অনেক দিন ভেবে, নানা রকম প্রযুক্তি সংগ্রহ করে, চতুর্দিক বিবেচনা করে, নক্সা করিয়ে সেই অনুযায়ী ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন। দোকানদারি নয়, ঠিকাদারি নয়, দালালি নয় কিংবা শেয়ার বাজারের শেয়ার কেনা বেচা নয় একেবারে উৎপাদন মুখী ব্যবসা। যাকে বলে মরা হাতিরও লাখ টাকা দাম। এই রকম একটা স্বপ্ন নিয়ে একেবারে শিল্প পতি হতে চেয়েছিলেন। বাবার নাম ছড়াতে চেয়েছিলেন, বংশের হারান গৌরব উদ্ধার করে নিভে যাওয়া প্রদীপ আবার জ্বালাতে চেয়েছিলেন, হৃত ঐতিহ্য উদ্ধার করে আবার কৌলীন্য বহাল করতে চেয়েছিলেন। নিজের উপর যথেষ্ট আস্থা ছিলো। সুন্দর স্বাস্থ্য, কর্মঠ, কাজের প্রতি একাগ্রতা, ধৈর্য, দূরদৃষ্টি, জন সংযোগের ক্ষমতা অর্থাৎ সফল ব্যবসায়ীর যে সব যোগ্যতা থাকা উচিত তা তার মধ্যে সবই ছিলো। তাহলে আর বাঁধা কোথায়? ব্যবসা শুরু করলেন।

ক্লান্তি হীন ভাবে দিন রাত কাজ করে যাচ্ছেন এদিক ওদিক দৌড়া দৌড়ী করছেন। কিসে উৎপাদন খরচ কম হবে, উৎপাদন কেমন হচ্ছে, তার মান কোন পর্যায়ের, কর্মচারীরা কে কি করছে সমস্ত কিছুর দিকে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। কর্মচারীদের যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা দিতেন, তাদের যে কোন সমস্যা খুব মনোযোগ দিয়ে দূর করার চেষ্টা করতেন। কর্মচারীরাও মন দিয়ে মালিকের জন্য কাজ করতো। কিন্তু হলে কি হবে বিধি যার বাম তারে রুধিবে কে? স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলেই কাজ করতেন। ব্যবসার কারিগরি দিক সামাল দিতেন এবং তার সাথে ফার্মের আশে পাশে শাক সবজি, ফুল, ফল ফলানো নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন রাশেদ সাহেবের স্ত্রী মনিরা হাসান আর বাইরে তাদের উৎপাদিত মালামাল বাজার জাত করা, কর্মচারীদের সুবিধা অসুবিধা ও অন্যান্য যাবতীয় প্রশাসনিক বিষয় সহ জন সংযোগ পরিচালন করতেন রাশেদ সাহেব স্বয়ং।

এছাড়া বাইরে বিভিন্ন সভা সমিতি বা সেমিনারে দুজনে এক সাথেই যেতেন। ফিরে এসে কে কি নিয়ে ফিরেছেন তাই নিয়ে দুজনে আলাপ আলোচনা করে নিজেদের জন্য তা কোথায় কি ভাবে প্রয়োগ করা যায় তা সিদ্ধান্ত নিতেন বা তারা কোথায় কি ভুল করছেন তা সংশোধন করে নিতেন। যত পরিশ্রমই হোক না কেন তাদেরকে যে উন্নতি করতেই হবে, সফল হতেই হবে এমন একটা প্রবল ইচ্ছা তাদের মনে ছিলো। বাইরে বেশ যথেষ্ট সুনাম বা গুড উইল যাকে বলে তাও পেয়েছিলেন। খুবই অল্প সময়ে তাদের এক নামে সবাই চিনে ফেলত। কিন্তু এই সব দেখে উপর থেকে যিনি রিমোট কন্ট্রোল পরিচালন করতেন তিনি বোধ হয় হাসছিলেন। রাশেদ, তুমি যতই কর না কেন সুখ আমি তোমার জন্য বরাদ্দ করিনি, এর নাগাল তুমি কোন দিনই পাবে না।

২।
তাদের তিন মেয়ে। যাদের জন্য এই সব সেই মেয়েদের শিক্ষা, যত্ন আত্তি বা অসুখ বিসুখের দিকে আপাতত কোন দৃষ্টি দেবার মত সময় ছিলো না। আগে যে ভাবেই হোক দাঁড়াতে হবে, টিকে থাকা নিশ্চিত করতে হবে তারপর অন্য কিছু। মোবাইল ফোনে ছোট মেয়ে জানাল যে আব্বু বা আম্মু বড় আপুর ভীষণ জ্বর। ওরা বলে দিত এখন কিছু খাইয়ে দিয়ে দুইটা প্যারাসিটামল খাইয়ে শুয়ে থাকতে বল কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেও। তার বিনিময়ে কি এই? এমন কেন হলো? এ যে ভাবাই যায় না!

সরকারের অদূরদর্শিতার ফলে পাশের বিশাল দেশ থেকে সদর বা অন্দর পথে যখন কম দামে বিস্কুট পর্যন্ত এদেশে আমদানি হতে শুরু হলো তখন তাদের উৎপাদিত মালের দাম উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে অর্ধেকে নেমে এলো তখন রাশেদ সাহেবের স্বপ্ন সৌধ ভেঙ্গে চুরমার। শুধু রাশেদ সাহেব নন তার মত সবারই এক অবস্থা। এই ধরনের উৎপাদন মুখি ব্যবসা গুলি একে একে সবই প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অথচ সরকারের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। এমনও হচ্ছে যে কারো উৎপাদিত মাল বিক্রিও হচ্ছে না। লোকসান থেকে দেনায় চলে যাচ্ছে, কত সামাল দেয়া যায়? কতক্ষণ টিকে থাকা যায় টাকার মাল ষাট সত্তর পয়সায় বিক্রি করে? সবাই ভাবে এইতো আজ না হলে কাল ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু দিনকে দিন তা আরও ভয়াবহ হচ্ছে। ক্রমে শুধু ফুল এক্সিলারেশনে অবনতির দিকেই যাচ্ছে। সাভারের এক বন্ধু অ্যাডভোকেট রফিক সাহেবেরও একই অবস্থা। তারা দুজনেই এক সাথে একই মাপের ফার্ম শুরু করেছিলেন, তবে রফিক সাহেব যেহেতু তার এলাকার একজন ধনি পরিবারের সন্তান যাদের প্রায় ষাট একর জমির উপর বাঁশ বাগান থেকে দৈনিক চার হাজার টাকার বাঁশ কেটে বিক্রি না করলে বাঁশ ঝাঁর নষ্ট হয়ে যাবার ভয় থাকে সে যে ভাবেই হোক সামাল দিয়ে নিতে পারে তার সাথে রাশেদ সাহেবের তুলনা নেই। রাশেদ সাহেবের যে দিন আনতে পানতা ফুরায় এমন অবস্থা এমনকি তাকে সামাল দেবার মত অন্য কেও নেই।

নিরুপায় হয়ে ব্যাংক এর সাথে আলাপ করলেন। তারা সিসি লোণ দিতে রাজী হলেন। বাবাকে এসে জানালেন যে এই অবস্থা চলছে আপাতত কিছু সিসি লোণ নিয়ে এই দুর্যোগ মোকাবিলা করি। বাবা শুনলেন কিন্তু কোন মন্তব্য করলেন না। রাশেদ সাহেব ভাবলেন বাবা বুঝি সম্মত আছে তাই লোণের আবেদন পত্র এনে দিলেন স্বাক্ষর করে দেবার জন্য। কিন্তু বাবা সম্মত হলেন না। তার কথা আমি লোণ রেখে মরতে পারবো না। রাশেদ সাহেব হতাশ হয়ে ভেঙ্গে পরলেন। সে যে নিরুপায়, সব যে বাবার হাতে তার কিছুই করার নেই। এই দুর্দিনে উচ্চ শিক্ষিত সব ভাই বোন কারো কাছেই কোন নৈতিক সহযোগিতা পেলেন না। তারা কেওই এগিয়ে আসার কোন তাগিদ অনুভব করেনি।

৩।
এমনিতে ছোট ভাইয়েরা এই ব্যবসায় সম্মত ছিলো না, এতে নাকি পরিবারের মান মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে। ওদিকে বাবা হয়ত ভেবেছিলেন এর আগে জাহাজে চাকরি করেছে, ষোল বছর ধরে সরকারি চাকরি করেছে সেখান থেকে টাকার পাহাড় না হোক অন্তত টিলা তো সঞ্চয় করেছে। তাই দিয়ে রক্ষা করুক, শুধু শুধু আমি কেন ঋণের বোঝা নিতে যাই? রাশেদ সাহেব জানে সে তো কোন দিন ঘুষ খায় নি, পরের টাকা দিয়ে সৌধ গড়ার স্বপ্ন দেখেনি। দেশের একজন সরকারি চাকুরে কত টাকাই বা বেতন পায়? এ দিয়ে সংসার চালানো যেখানে সামাল সামাল অবস্থা সেখানে তার সঞ্চয় আসবে কোথা থেকে? নিজেরা দুজনে কত কঠিন হিসেব নিকেশ করে আজে বাজে অহেতুক ব্যয় না করে মোটামুটি চতুর্দিক রক্ষা করে সুন্দর সংসার চালিয়েছে।

মেয়েদের পোষাক বানাতে দর্জির টাকা বাঁচিয়ে মনিরা নিজে হাতে তা সেলাই করে দিয়েছে আর ওই দর্জির মজুরী বাবদ যে টাকা প্রয়োজন হতো তার সাথে কিছু যোগ করে একটু ভালো কাপড় পরিয়েছে। নিজেরা নানা রকম হাতের কারু কাজ দিয়ে ঘর দোর সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতেন আর এই সব উপকরণ সংগ্রহ করতেন মনিরা কাপড়ে ফ্যাব্রিক পেইন্ট করে যা পেত তাই দিয়ে। একটা শাড়িতে পেইন্ট করলেই ডিজাইন অনুযায়ী দেড় থেকে দুশ টাকা পর্যন্ত পেত অথচ একটা শাড়ি পেইন্ট করতে সংসারের সব কাজ সেরেও তার ৩/৪ দিনের বেশি লাগে না, টিভির সামনে বসে না থেকে বা ফালতু আড্ডা না দিয়ে একটা কিছু করে যদি কিছু বাড়তি আয় করা যায় তাহলে ক্ষতি কি? এই হচ্ছে তার প্রতি সন্দেহের উৎপত্তি। এতো সুন্দর ভাবে চলছে তাহলে নিশ্চয়ই দু হাতে টাকা কামাচ্ছে। এই হচ্ছে তার প্রতি অনেকের ঈর্ষার কারণ।

রাশেদ সাহেব জানেন যখন তিনি জাহাজে চাকরি করতেন তখন প্রতিটি ভয়েজের শেষে যা পেতেন রাশেদ সাহেবের বাবা নির্দ্বিধায় তা একটা খাতায় টুকে রেখে তুলে দিতেন তার এক শ্যালকের হাতে তার ব্যবসার জন্য, যা আর কোন দিন ফেরত পান নি। হয় তো তিনি একথা ভুলেই গেছেন। তিনি যদি তখন একটু দূর দৃষ্টি কাজে লাগিয়ে ওই টাকা তার শ্যালককে না দিয়ে কোথাও একটু জমি কিনে রাখতেন বা অগত্যা ব্যাঙ্কে জমা রাখতেন তা হলে আজ রাশেদ সাহেব কোথায় থাকত? রাশেদ সাহেবের অনেক বন্ধুই এরকম করেছে এবং তারা প্রায় প্রত্যেকেই আজ ঢাকা শহরে বাড়ির মালিক। এদিকে রাশেদ সাহেব আজ নিঃস্ব কপর্দক হীন। এর জন্য দায়ী কে? প্রায় বিশ বছর আগের কথা এই সব। সেই সব টাকা আজও ফেরত দেবার প্রয়োজন মনে করেননি বা দেননি, সে টাকা ফেরত পাবার কোন আশাও নেই। বাবার সেই শ্যালক বা রাশেদ সাহেবের মামা মারা গেছেন। তার ছেলেরা আজ মস্ত ব্যবসা করছে এবং উঁচু দরের চাকরি করছে কিন্তু বাবার নেয়া ঋণ শোধ করার কোন তাগিদ তাদের নেই।

আজ রাশেদ সাহেবের বড়ই দুর্দিন। অসহায়ত্বের চরম সীমায় অবস্থান করছেন, এখান থেকে পরিত্রাণের কোন উপায় পাচ্ছেন না। কি করে ক্ষতি দিয়ে হলেও এই এতো কষ্ট করে গড়ে তোলা ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যায় এটাই তার এক মাত্র ভাবনা। সে জানে এই অবস্থা চিরদিন থাকবে না এর একদিন পরিবর্তন হবে। কতদিন আর এভাবে একটা দেশ চলতে পারে? সে যে নিজে হাতে গড়ে তুলেছে এই ব্যবসা, এর প্রতিটি ইট কাঠ সব তার নিজের হাতে কেনা। সারা বাজার ঘুরে ঘুরে কোথায় কম দামে কোন জিনিষ পাবেন তাই খুঁজেছেন। সারা দিন রাত ভেবেছেন, হিসেব করেছেন কি ভাবে নির্মাণ খরচ কমিয়ে আনা যায়। এখানে শেড গুলি তৈরির সময় দেশে বন্যা হলো সেই বন্যায় চারিদিকে পানি এসে গেলো এই পানির মধ্যে দিয়ে জুতা হাতে নিয়ে পরনের প্যান্ট ভিজিয়ে এসে তদারকি করতেন, অথচ সে সাঁতার জানে না বলে এরকম খোলা পানিতে তার ভীষণ ভয়, সে ভয়ও তুচ্ছ করে নিয়েছিলেন। তিনি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন, কত তাড়াতাড়ি এবং কম খরচে কাজ শেষ করা যায়। কোন কোন কাজের জন্য কোন ঠিকাদার নিয়োগ না করে সে কাজ সে নিজ হাতে করেছে। এটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য তার যে কি যন্ত্রণা তা একমাত্র সে নিজেই জানে। এক মাত্র মা ই জানে সন্তান হারাবার যন্ত্রণা কি। যে সৃষ্টি করে সেই বুঝে তার বিনাশের কি জ্বালা, কি যন্ত্রণা, কি ব্যথা! প্রকৃত মা কোন দিনই তার গর্ভের সন্তানকে কেটে দু ভাগের এক ভাগ নিতে চাইতে পারে না। আমার সন্তান আমাকে ফিরিয়ে না দাও তবুও সে বেঁচে থাকুক।
[চলবে]

বসন্ত যে এলো আজ মধু ফাল্গুনে

রাধা শুনছ!
শুনছি, কি বলবে বল-
আজ যে বসন্ত এসেছে!
কী যে বল কৃষ্ণ, তা কি আর আমি জানি না ভেবেছ সখা?
কি করে জানলে সখী?
কেন? আমার মনে রঙ ধরেছে, তোমাকে দেখতে ভাল লাগছে, কত সুন্দর করে তুমি সেজেছ, টকটকে লালে লালে একাকার হচ্ছে তোমার রূপ তাইতো শুধু তোমাকে বুকে চেপে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে আর চেয়ে দেখ আমার কলিগুলিও ফুটতে শুরু করেছে, আশে পাশে চেয়ে দেখ ওই যে শিমুল পলাশ ওরাও কেমন ফুটি ফুটি ভাব ধরেছে। মনে হচ্ছে এখনই ফুটবে। গাছে গাছে কেমন নতুন পাতা উকি দিচ্ছে, নতুন আলোর বাহার দেখতে চাইছে।
ঠিক বলেছ রাধা, পঞ্জিকার হিসাবে আজকে বসন্তের শুরু হলো। সবাই এখনও ফুটে ওঠেনি কিন্তু সবার মনে রঙ লেগেছে দেখবে কয়েক দিনের মধ্যেই রূপে রঙ্গে গন্ধে ভরিয়ে দেবে এই ধরনী। এরই নাম বসন্ত। একটা গান করনা সখী!

গান শুনবে? তাহলে শোন-

ঝরা পাতার নূপুর পায়ে
দুরন্ত ওই পলাশ বনে কোকিলের ডাকে
এলো বসন্ত এলো আজ মৌ বনে।।

আকাশে গোধূলি রঙের মেলা
তুমি আর আমি শুধু বলব কথা
কানে কানে বাঁশরীর গানে গানে।।

সুরে সুরে মন হবে মধুময়
আখির স্বপনে দুজনা হব যে তন্ময়
এ সময় কেন থাক দূরে দূরে
এসো না কাছে এই মধু ক্ষণে।।


কাঠ ফাটা এই রোদ্দুরে বসন্ত আসেনি কিন্তু কেন যেন হঠাত করেই মনে এলো তাই লিখে ফেললাম, দয়া করে কেও পাগল ভাববেন না প্লিজ!

আলহামদুলিলাহ!

আলহামদুলিল্লাহ!
আল্লাহ তা’আলার অশেষ রহমত এবং মেহেরবানিতে হটাত করে আমার ছোট রাজকন্যা তাসমিনা খালিদ এশার গায়ে হলুদ এবং বিয়ে গতকাল ১৪ই জুন শুক্রবারে অত্যন্ত সুন্দর ভাবে সুসম্পন্ন হয়ে গেল। সময়ের স্বল্পতার জন্য কাওকে জানাতে পারিনি বলে সবার নিকট ক্ষমা প্রার্থী। আশা করছি আত্মীয় স্বজন, বন্ধু মহল এবং সকল শুভাকাঙ্ক্ষী তাদের জন্য দোয়া করবেন।

নিচে আমার ও রাজকন্যার এবং তার গায়ে হলুদের ছবি, বিয়ের ছবি এখনও এডিট করা হয়নি বলে দিতে পারলামনা।

নিত্য পথে প্রান্তরে-৪

আমরা কতটা সভ্য হয়েছি কেউ বলতে পারেন? যেখানে মেয়েদেরকে এই ভাবে যাতায়াত করতে হচ্ছে। ছবিটি বেশ কয়েক দিন আগে ঢাকার ঠাটারি বাজারের পাশের রাস্তা থেকে নেয়া। চলন্ত গাড়িতে বসে তারা হুড়ো করে নেয়া বলে ছবিটি ঝাপসা এসেছে কিন্তু এটা কোন ব্যাপার নয় ইহারা মেয়ে নয় ইহারা গার্মেন আফা। কাজেই কোন অসুবিধা নাই।

নিত্য পথে প্রান্তরে-৩

সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে শাহবাগ ফুল বাজারের কাছে সিগনালে গাড়ি দাড়িয়েছে আর দেখলাম আমার জানালার পাশে দিয়ে মলিন মুখে এই ছেলেটা মুখে ব্যান্ডেজ আর হাতে ফুল নিয়ে চলে যাচ্ছে। আপনারা যারা ওই পথে যাতায়াত করেন তাদের কেউ হয়ত ওকে দেখে থাকবেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ির দরজা খুলে ওকে ডাকলাম।

নামঃ কালাম, বাবা রিকশা চালায় এবং আরেক মাকে নিয়ে থাকে। ও কখনও গেলে তাড়িয়ে দেয়। ঘরে ঢুকতে দেয় না। নিজের মা নেই। কয়েক দিন আগে এই রাস্তায় ফুল বিক্রির সময় এক গাড়ির ধাক্কায় ছিটকে পরে গিয়ে এই অবস্থা। গায়ের জামা খুলে আরো কিছু ব্যান্ডেজ দেখাল। দেখাবার সময় ব্যাথায় মুখ বিকৃত হয়ে গেল। চেয়ে চেয়ে দেখলাম। মায়ের সোহাগ পায়নি। বাবার স্নেহ বঞ্চিত এই কালাম কি অপরাধে এই জীবন বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে?

নিত্য পথে প্রান্তরে-২

প্রায়ই দেখি মায়ের কোলে বা পাশে বসে এমনি করেই জীবনের সাথে যুদ্ধ করার কৌশল শিখে নিচ্ছে এই ক্ষুদে ভবিষ্যত যোদ্ধারা। আজ তাদের থাকার কথা ছিল নরম কোন বিছানায় এবং স্কুলে কিন্তু নিয়তি তাদের দিয়ে কি সুন্দর করে আমার এই লেখার বিষয় জুটিয়ে দিয়েছে-

নিত্য পথে প্রান্তরে-১

এই সোনার বাংলার আনাচে কানাচে অলিতে গলিতে দিবারাত্র কত কি ঘটে যাচ্ছে কে কার খবর রাখে। আমি সেদিন ভাবছিলাম ব্রিটেনের আর্থিক দিনকাল খুব খারাপ যাচ্ছে। তাই ওরা যদি ওদের BBC বিক্রি করে দিত তাহলে আমি সারে চার স্টারলিং পাউন্ড দিয়ে কিনে এই সব খবর পাবলিক এবং জনগনকে জানাতাম। কিন্তু ওদের দুর্মতি দেখা দিল, ওরা বিবিসি বিক্রি করবে না। সে যাক বিক্রি করুক বা না করুক ওতে আমার কিছু যায় আসেনা।

১। নিচে দেখুন যে ঢাকা শহরে একজনের ঘুমের জন্য তৈরী হচ্ছে বৃক্ষ বিছানা সেই ঢাকা শহরে আর এক জন ঘুমাচ্ছে ফুটপাথে। ছবিটি রেল ভবনের সামনে থেকে নেয়া। এখন বলুন কার ঘুম গভীর? কে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে আর কে ঘুমের ওষুধ চিনেই না? জীবন পুষ্প শয্যা নয় বলে কি জীবনকে ফুটপাথ শয্যা হতে হবে?-


[উপরের ছবিগুলি উপরে উল্লেখিত ঘুমের এবং আয়েশ করে বসে আড্ডা দেয়ার বিছানা, ধনীদের জন্য আর নিচের ছবি দেখেই বুঝতে পারছেন কার জন্য।