মোঃ সুমন মিয়া এর সকল পোস্ট

মোঃ সুমন মিয়া সম্পর্কে

মো: সুমন মিয়া ১৯৮৮ সালের ১২ অক্টোবর কুমিল্লা জেলার চান্দিনা থানার শুহিলপুর গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা: মৃত মকবুল হোসেন, মাতা: আনোয়ারা বেগম। ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতক , ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (আইবিএ) থেকে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনায় উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেন। শিক্ষাজীবন থেকেই লেখালেখির হাতেখড়ি। ২০১৬ সালে ঢাকাস্থ চান্দিনা ছাত্রকল্যাণ সমিতির সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ‘চান্দিনা দর্পণ‘ নামক বাৎসরিক সাহিত্য ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেন। তার লেখা ‘হিমালয় কন্যার দর্শনে’ ও ‘অতিথি বেশে পূণ্যভূমি চায়ের দেশে’ ভ্রমন কাহিনী বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। একাধিক দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকায় ভ্রমন কাহিনী, লাইফ স্টাইল, ফিচার, ছোট গল্প এবং কবিতা প্রকাশিত হয়। ‘গহীনে শব্দ’ তার লেখা প্রথম কাব্যগ্রন্থ এবং কয়েকটি উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে।

নিষ্ফলা লজিং মাস্টার

gtry

রাত বাড়ছে, বিদঘুটে অন্ধকার, আলোর চুকেছে পাঠ;
মাস্টার, ও মাস্টার—
তোমার উপরে ফিটফাট, ভিতরে সদরঘাট।
হা হা হা …
বাতাসে আসে বিদ্রুপের ধ্বনি,
অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে; চারদিকে শব্দের খিল খিলানি।

ভেসে উঠে এক নারীর ছায়া
পিছনে তাড়া করে বেড়ায় অতীত স্মৃতি,
কণ্ঠটি বড়ই চেনা
হাতছানি দেয় নিষ্ঠুর নিয়তি।
সেই যে, পড়ার টেবিলে—
ছাত্রীটি— বীজ গণিত, পাটি গণিতের ফাঁকে,
অংক কষে সংসার জীবনের, রঙিন স্বপ্ন আঁকে।
‘যেখানে শোভা পাবে— একটা ছোট ঘর, সন্তানাদি
বাড়ির আঙিনা জুড়ে শিউলি ফুল আর মেঝেতে শীতল পাটি,
যাতে আসন পেতে মধ্যমণি হবে সামনে বসে থাকা মানুষটি।

হাতে হাত, মননে, প্রণয়ে, সঙ্গমের স্বপ্ন করে যতন,
জ্যামিতির কাটায় দৈর্ঘ্য—প্রস্থে মাপে সংসারের আয়তন।

এটা বয়সের আবেদন, আবেগী মনের বাসনা
নয়ন যুগল হয় স্বপ্নভাসি,
বইয়ের পাতায় বড় বড় অক্ষরে ভাসে
মাষ্টার ‘তোমায় ভালবাসি’।

টেবিলে শব্দ হয় ঠকঠক করে, সম্বিত ফিরে পায়—
‘মনযোগ দাও হে’ বইয়ের পাতায়,
সে যে বুঝে না, যাকে ঘিরে এত সব আয়োজন
সে কি না ব্যস্ত নিয়ে অন্যকিছু; মেকি যা তা’য়।

এত পানসে কেন? রঙ রস কিছুই কি স্পর্শ করে না!
মনে মনে আওড়ায়— ‘বড়ই বেরসিক! কিছুই বুঝে না,’
যাও, যাও আজ ছুটি!
সমাধান করে দিব অন্য কোনদিন, শরীরটা আজ ভাল যাচ্ছে না।

ছাত্রীর মাঝেও যে কিছু চলছে; সেটি বুঝতে হয় না বাকি,
শারীরিক অক্ষমতা; সেটা প্রকাশ করার নয়
ভালভাল কেটে পড়ি; মায়ার বন্ধন দিয়ে ফাঁকি।

কিছুদিন পর খবরে আসে ‘সুইসাইড’
দাগ কেটে যায়; এতসব খবরের ভীড়ে,
চাওয়া ছিল— ‘তাতে কি আসে যায়, সে সুখী হউক
অন্য কোথাও, অন্য কোন নীড়ে।’

এই মৃত্যুর জন্য কি আমি দায়ী? নিছক ছেলে মানুষি বৈকি!
শূন্যতাকে করে আপন,
বুকে খা খা করে একাকিত্ব, বড়ই পীড়া দেয় যাযাবর জীবন যাপন।

হৃদয় পোড়া আঘাত
আজ হয়েছে ভীষন ক্ষত,
কামনা বাসনা ছাড়া নিরাশ এই জীবন সংসার
নিষ্ফলা, অকেজো বৃক্ষের মত।

Untitled-1

অস্তিত্ব সংকটে মানব জাতি

Untitled-1

একটি জীবনের গোড়াপত্তন অবাধ মেলামেশায়,
জন্মের প্রথম প্রহর ডাস্টবিন, ফুটপাতে
রাস্তায় পড়ে থাকা শিশুর অবয়ব,
বিবেকহীন নর-নারীর অপরিপক্ক নেশায়।

ফেলে রেখে মা উধাও, বাপ লাপাত্তা জন্মের আগেই,
পরকীয়া, লিভ টুগেদার, কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ, মেতে থাকা বারবনিতা পেশায়।

সংসারে অশান্তির দাবানল, নিত্য কোলাহল
জীবন হয়ে উঠে উশৃঙ্খল।

স্বপ্ন বোনা শুরু হয় শুধু টাকা; অর্থ সম্পদের মোহে,
খ্যাতি অর্জনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা,
ক্ষমতার লোভ, প্রতিহিংসা, ক্ষোভ, অসাধুতা ।

মানুষের অবমূল্যায়ন, লোক চক্ষুর অন্তরাল দৃষ্টি
অহমিকা, কাঁদা ছোড়াছুড়ি, মিথ্যা, গীবত-পরচর্চা,
লোক ঠকানো, বানোয়াট, অপমান অপদস্ত, অশালীন অপসংস্কৃতির চর্চা
নীতিবোধ হারিয়ে হয়ে উঠে হায়েনা,
সত্য মিথ্যার মাপকাঠি যাচে না।

মানুষের জীবন, সম্পদ, সম্মান হয়ে উঠে চক্ষুশূল
মূল্যবোধের চর্চা অতি সামান্য তথাপি করিয়া ভুল।
ভালো মানুষ বনে যায় নির্বোধ, চাটুকারের জয়
ধর্ম, বর্ণ, ধনী গরীব, সবল দুর্বল বিপরীত মেরুতে রয়।
মন্দের সাথে হয়ে উঠে জ্ঞাতি, অস্থিত্ব সংকটে মানব জাতি।

বাজ পড়ে মানুষ মরে, এক্সিডেন্ট, আগুনে পুড়ে, পানিতে ডুবে, বন্যা জলোচ্ছাস
মানুষে মানুষ খুন, আত্মহত্যা, স্ট্রোক, অপমৃত্যু, গুম,
বাতাসে ভাসে লাশের গন্ধ, ডোবা নালায় বস্তা বন্দি,
মহামারীতে মানুষের মৃত্যুর ঢল, মৃত্যুর হিসাব উঠছে ওয়াল্ডো মিটারে
ভাসছে জলে, স্থলে, অন্তরিক্ষে, জ্বলছে চিতায়,
ভাবুকদের ভাঁজ পড়েছে কপালে, ঘামছে চিন্তায়।

ভারি হয়ে গেছে বিষাক্ত বাতাস, বাক্সে বন্দি হয়েছে বিবেক,
শক্ত হয়ে গেছে হৃদয় নামক বস্তুটি, শুকিয়ে গেছে চোখের জল।
মনুষ্যত্বের ক্ষয়, যতটুকু আছে অবশিষ্ট শুধু ধোঁকা আর অভিনয়।

@গহীনে শব্দ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া@

বাবার শূন্যস্থান মর্মে বাজে

012

মা, কোথায় আছে বাবা?

সেই যে কবে মাথায় হাত রেখে বলেছিল
ভাল থাকিস বাপ, মাকে কাঁদাস নে।
আমি কি একবারও তোমাকে কাঁদিয়েছি? বল মা।

তুমিইতো দেখি গোপনে কাঁদ;
আমাকে দেখে লুকানোর চেষ্টা কর,
আমার কি দোষ বল?

কত দিন হলো বাবা নেই, ঘরটা খালি,
এখনও আসে না কেন?
আমাদের ছেড়েতো কখনও কোথাও যায় না,
এত দিন দূরে থাকে না।

তুমি বল বাবা উপরে চলে গেছে,
তাঁরার দেশে, দূর-বহুদুরে;
আমি দেখলাম সবাই নিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে;
পাশের জঙ্গলে।

দিনে কত বার খবর নিতো,
বলতো, এটা করিসনে, ওটা ধরিস নে
ওখানে যাসনে, আজ তো কেউ বলে না।

আব্বু চলে যাওয়ার পর
কেউ আর আগের মত ডাকে না,
আদর করে না, কেন মা?

এই যে আবার তুমি কেঁদে উঠলে!
আর বলব না মা, আর বলব না,
তোমার মনে দুঃখ দিব না।

@’গহীনে শব্দ’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া@

না বলা কথা

Unti

যে কথাটি হয়নি বলা;
তা রেখেই দিতে সংগোপনে,
এত দিন পর কেন সুপ্তাগ্নিকে জাগালে প্রজ্জলনে?

সে দিন জ্বালিয়েছ নিরবতায়
আজ জ্বলছি ব্যাকুলতায়,
সেটা কি শুধুই ভুল ছিল, নাকি অন্য কিছু;
ছুটে ছিলে কোন আলেয়ার পিছু পিছু?
এই ভুলের মাশুল কি আজও গুনে যাবে?
বেলা অবেলা সারা বেলায়!

পাষাণে বেঁধেছিলে হৃদয় সেদিন,
আজ এই পরিণতির দায় সহা বড়ই কঠিন।
অভিমানগুলো দহনে দহনে ছাঁই হয়ে
পরিণত হয়েছে নিদারুণ অন্তর জ্বালায়,
ছুড়ে ফেলেছিলে যে ফুল অবজ্ঞার মত্ত খেলায়;
মালা হয়ে দুলছে এখন অন্য কারো গলায়।

সেদিনের লেখা বিরহের অক্ষরে পদ্য
আজ গদ্যে হলো প্রতীয়মান,
তাতে জীবনের কি লাভ, কিসে হলো মহীয়ান ?
আর কি ফিরে পাওয়া হবে সে সময়, ফুটবে সেই ফুলে বৃতি,
সে চৈত্র দুপুরের হাহাকার, শীতের সকালের বুনা স্বপ্নস্মৃতি!

সেদিনের সেই ঘ্রাণ সুভিত ঝরা ফুল
পূণঃঅঙ্কুরিত হয়ে সেজেছে নতুন বাগিচায়,
ঈষৎ পুষ্পরস যে সঞ্চিত হয়ে মধুকুঞ্জে পরিণত হবে
তাতো ছিল না কারো জানায়।

আজই এই বেলায়,
ক্লান্ত তুমি!
জীবনের কাছে কেন করলে পরাজয়,
কেন করে যাচ্ছ ভাল থাকার মিছে অভিনয়?

@’গহীনে শব্দ’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া@

am

রঙিন আমে মধুর স্বপ্ন

am

রাত তখন গভীর,
কিচির মিচির ঝিঁঝিঁর
টুপটুপ শব্দ পাঁকা আমে,
প্রদীপ হাতে ছুটল দু’জন দেখে ডানে বামে।

চুপ চুপ… আলতো পায়ে
কুড়িয়েছি চারেক,
পাশের বাড়ীর টিনের চালায়
পড়ল বুঝি আরেক।

চল, এগিয়ে,
না দেখে ফেলবে, করবে তাড়া দিবে গালাগাল,
ভিতুর ডিম, এই বুঝি তোর হাল?
আমার পিছু ধর
একটা দু’টো, ওমা কত্তগুলো!
চুপ, চুপ কর।

চল ভয় করছে, পাতা নড়ছে,
মা খুঁজবে, তখন বুঝবে।
নিঝুম রাত ভরেছে দুই হাত।
ফিরব ঘরে, দ্রুত পায়ে মৃদু শব্দ করে।

কে যেন ডাকছে পাছে, মনে হয় নাম ধরে,
না না কেউ দেখেনি, চিনবে কেমন করে।
হাঁটতে হবে অন্য পথে নিজের ঘর ফেলে,
ভ্রান্ত ভাববে, হয়তো কোন অন্য পাড়ার ছেলে।

আলোটুকু নিভিয়ে শেষে,
ফেরা হলো ঘরে নিমিষে।
ঘরের মেঝে
বুক কাঁপছে দুরুদুরু নিরাপদে আসি,
চোখে ঝিলিক, ওমা এত্তগুলো!
তাকিয়ে হাঁসছে দিব্যি মনে, বিজয়ের হাঁসি।

এখনই খাব
না না দিন সকালে,
গাছের ফলে এখনও বদ নজর আছে।

ঘুম ভেঙ্গে যায়
এ যে শৈশব,
দুরন্তপনা শরীর জ্বলছে, ভাসছে চোখে স্মৃতির আনাগোনা।

আজ ভাইটি অনেক বড়
বোনটি প্রায় বুড়ো
দু’জনের দুই জগতে বাসা,
গভীর রাতে উৎলে উঠা দরদ-ভালবাসা।

@’গহীনে শব্দ’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া@

প্রাকৃতিক ও পার্বত্য সৌন্দর্যের শহর তায়েফ

2809a

মরুভূমি ও পাহাড় পর্বতের দেশে এক খণ্ড প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য মণ্ডিত নগরী তায়েফ। ফুল, ফল ও ফসলের সমারোহ সেখানে। ভ্রমণপিপাসু মানুষের মনের খোরাক ইতিহাস-ঐতিহ্যের নগরীও বটে। পবিত্র মক্কা থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর স্মৃতিবিজড়িত শহর তায়েফ। এ শহর ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। চমৎকার সাজানো গোছানো একটি শহর। মক্কা থেকে তায়েফের রাস্তাগুলো পাহাড়ের বুক চিরে তৈরি করা। এক পাশে উঁচু পাহাড় অন্য পাশে শরীর হিম করা গভীর খাদ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ এ শহর দেখতে হাজিরা কিছুটা সময় বরাদ্দ রাখেন।

পাহাড় কেটে বানানো রাস্তাটি একমুখী। অনেক উপরে ওঠার প্রতিক্রিয়ায় গাড়ির ভেতরে নিঃশ্বাস নিতে কিছুটা কষ্ট হওয়ার পাশাপাশি, কান বন্ধ হয়ে যায় আপনা-আপনি। তায়েফের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা যায়, ঝক্‌ঝকে নীল আকাশ। মরুর দেশে এমন নীল আকাশের কথা চিন্তা করা যায়? পাহাড় দেখে মানুষ কেন আপ্লুত হয়, সেটা তায়েফের পাহাড় না দেখলে জানা হত না। পাহাড়ের সৌন্দর্য আর আকাশের সত্যিকারের নীল এক সাথে দেখতে হলে তায়েফের আকাশ দেখতে হবে।

ওমরার হাজীগন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এখানে আসতে হয়। তাই আমরা সেভাবেই মাইক্রো ভাড়া করে মক্কা নগরের মিসফালাহর হিজরা মসজিদ এর সামনে থেকে রওয়ানা দিলাম। মক্কা নগরের নানান প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও আধুনিক স্থাপত্য অতিক্রম করে আমাদের গাড়ি চলছে। বিশাল উচ্চতার পাহাড়, তবুও সে সব জায়গায় পাথরের পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে প্রশস্ত সড়ক ও টানেল। আরো রয়েছে দীর্ঘতম উড়াল সড়ক। সত্যিই অবাক করার মতো দূরদর্শী পরিকল্পনা। কোথাও কোথাও এমনও আছে, কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বসতি নেই। শুধুই ধু ধু মরুভূমি। প্রাণীকুলের মধ্যে উট আর দুম্বা। বৃক্ষ বলতে শুধুই বাবলা গাছ। একটা সময় আবহাওয়ার তারতম্যেই বুঝা গেল আমরা তায়েফের কাছাকাছি।

শুরু হলো পাহাড়ি আঁকাবাঁকা সড়ক। গাড়ি চকচকে পিচঢালা পথ ঘুরে ঘুরে শুধু উপরের দিকেই উঠছে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ছয় হাজার ৬৯ ফুট উচ্চতায় আমাদের উঠতে হচ্ছে। সড়কের পাশে নানা কারুকার্যময় স্থাপনা। আরো রয়েছে বিভিন্ন কটেজ, রিসোর্ট ও শিষাবার। গাড়ির জানালা দিয়ে নিচে ও উপরে তাকালে বেশ রোমাঞ্চকর অনুভূতি। এটিকে তায়েফের রিং রোড বলা হয়ে থাকে। সড়ক দ্বীপে বানরের দল নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে বেড়ায়। চারপাশে নির্মল সবুজের হাতছানি। যা আমাদের জন্য মায়াবী পথে চমৎকার এক যাত্রা। অপার্থিব ঘোরের মাঝে মাত্র দেড় ঘণ্টার মধ্যেই তায়েফ শহরে পৌঁছে যাই।

তায়েফ সৌদি আরবের মক্কা প্রদেশের একটি শহর এবং গভর্নরেট। ১,৮৭৯ মি (৬,১৬৫ ফু) উচ্চতায় হেজাজ পর্বতমালার ঢালে অবস্থিত। যেটি নিজেই সারাওয়াত পর্বতমালার অংশ। ২০২০ সালের হিসাব মতে আনুমানিক শহরটির জনসংখ্যা ৬৮৮,৬৯৩ জন যা এটিকে রাজ্যের ৬ষ্ঠ জনবহুল শহর করে তুলেছে।

কুরআনে সূরা আয্‌-যুখরুফ (৪৩) এর ৩১ নং আয়াতে তায়েফকে পরোক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। শহরটি ৭ম শতাব্দীর প্রথম দিকে কোন এক সময়ে নবী মুহাম্মদ (সা.) পরিদর্শন করেছিলেন এবং বনু ছাকিফ গোত্র বসবাস করেছিল এবং এখনও তাদের বংশধরদেরেরা বসবাস করা হয়েছে। হেজাজের একটি অংশ হিসেবে। শহরটি তার ইতিহাস জুড়ে অনেক ক্ষমতার হস্তান্তর দেখেছে। সর্বশেষটি ১৯২৫ সালে হেজাজের সৌদি বিজয়ের সময় হয়েছিল।

শহরটিকে সৌদি আরবের অনানুষ্ঠানিক গ্রীষ্মকালীন রাজধানী বলা হয়। কারণ এখানে গ্রীষ্মকালে একটি মাঝারি আবহাওয়া বিরাজ করে। আরব উপদ্বীপের বেশিরভাগ অঞ্চল থেকে এখানে ভিন্ন। শহরটির অনেক পাহাড়ি রিসর্ট এবং মাঝারি জলবায়ুর কারণে পর্যটকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা রয়েছে। আইকনিক হাইওয়ে ১৫ (তাইফ-আল-হাদা রোড) এর মাধ্যমে নিকটবর্তী অবলম্বন শহর আল-হাদার সাথে শহরটি সংযুক্ত। এটি হেজাজ অঞ্চলের বাকি অংশ থেকে আলাদা কারণ এটি একটি শহর যা সৌদি আরবের কৃষি উৎপাদনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এবং আঙ্গুর, ডালিম, ডুমুর, গোলাপ এবং মধু চাষের জন্য পরিচিত একটি কৃষি অঞ্চলের কেন্দ্রস্থল। ঐতিহ্যবাহী ‘ ইত্তার ‘ তৈরিতেও খুব সক্রিয় এবং স্থানীয়ভাবে তায়েফ গোলাপের শহর নামে পরিচিত। তায়েফ ঐতিহাসিক সওক ওকাজও আয়োজন করে। রাস্তার পাশেই বিশাল ফলের মার্কেট আমাদের নজরে পড়ল।
তায়েফ গভর্নরেট ১৫টি ছোট পৌরসভায় বিভক্ত যার রাজধানী তায়েফ। শহরের প্রশাসন উত্তর তায়েফ, পশ্চিম তায়েফ, পূর্ব তায়েফ, দক্ষিণ তায়েফ এবং নিউ তায়েফ নামে ৫টি পৌরসভা দ্বারা পরিচালিত হয়।
তায়েফ আরবি শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ পরিভ্রমণকারী, বিচরণকারী বা প্রদক্ষিণ এবং তা কাবার প্রদক্ষিণ প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়। বনু সাকিফ গোত্রের দ্বারা নির্মিত প্রাচীর যা শহরটি প্রদক্ষিণ করে আছে। সংক্ষেপে তায়েফ নগরীর আক্ষরিক অর্থ হল ঘেরা শহর।

দেখতে দেখতে গভীর অনুভূতিতে চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল। কোলাহলহীন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর। সড়কের পাশেই পার্ক, যেখানে সবুজের সমারোহ। আমাদের গাড়ি থামায় একটি বিশাল আকারের গেইটের সামনে। এটা হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: মসজিদ। এটিই তায়েফের কেন্দ্রীয় মসজিদ। খুবই দৃষ্টিনন্দন একটি মসজিদ। এর পাশেই প্রসিদ্ধ সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: চির শায়িত অছেন। এখানে আমরা দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করি। মসজিদের ভিতরে ঠান্ডা পানি ও খেজুর খেলাম। বাহিরে এসে ফটো তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই।

প্রাচীনকাল থেকে মক্কা ও তায়েফবাসীর মাঝে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। হজরত আব্বাস (রা.) তায়েফের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। পরে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)ও তায়েফের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যান। এখানে আরও অনেক সাহাবির কবর রয়েছে। মসজিদ সংলগ্ন একটি লাইব্রেরি আছে। সেটা অবশ্য জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। তবে সেখানে প্রাচীন অনেক কিতাবের সংগ্রহ আছে। রয়েছে হজরত আব্বাস (রা.)-এর হাতের লেখা কোরআনের কপিসহ বিভিন্ন সময়ে পাথর ও কাগজে লিখিত কোরআনের প্রাচীন কপি।

এরপর গাড়ি আবারো এগিয়ে যায়। ড্রাইভার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো দক্ষ গাইডের মতোই আন্তরিকতার সাথে পরিচিতি করাতে লাগলেন।

একে একে দেখলাম হজরত আলী রা: মসজিদ। প্যাঁচানো সিঁড়ির দেয়ালের কারুকার্য, যা দেখে পর্যটকেরা অবাক না হয়ে পারে না। শত শত বছর আগের নীর্মাণশৈলী মনকে ভাবুক করে তোলে। তারপর মসজিদে আদম (আ.)। আঙ্গুরের বাগানের পাশেই মসজিদটি। এরপর কথিত বুড়ির বাড়ি। জায়গাটি পাথর দিয়ে ঘেরা। তার পাশেই বড় বড় দু’টি পাথর। ছোট্ট পাথর দ্বারা আটকে আছে। হুজুর সা:-কে হত্যার উদ্দেশ্যে পাহাড় থেকে এই পাথরগুলো বুড়ি ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ পাকের কুদরতের মাধ্যমে তা প্রতিহত হয়। যা আজো সেভাবেই রয়েছে। পাহাড়ের পাদশেই রয়েছে হুজুর সা: মসজিদ। সঙ্গীরা কেউ কেউ মসজিদে দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করল।

ইতিহাসের পাতায় তায়েফ আরও নানা কারণে আলোচিত। এই তায়েফের বনি সাকিফ গোত্রে নবী করিম (সা.) দুধমাতা হজরত হালিমা সাদিয়ার ঘরে লালিত-পালিত হয়েছিলেন। এখন সেই বাড়ি-ঘরের কোনো চিহ্ন নেই। তারপরও একটি পাহাড়ের পাদদেশকে অনেকে হালিমার বাড়ি বলে সেখানে যেয়ে নামাজ পড়েন। পাশের পাহাড়টিতে নবী করিম (সা.) বকরি চড়িয়েছেন বলে মনে করে সেখান থেকে মাটি আনা, সেখানে যেয়ে গড়াগড়ি খাওয়া শুরু করেন লোকজন। সাম্প্রতিত বছরগুলোতে খুব বেশি ভিড় বেড়ে যাওয়ায় গত দুই বছর ধরে সেখানে যাওয়া বন্ধ।

তায়েফবাসী ইসলাম গ্রহণের পরিবর্তে নবীকে অত্যাচার ও নিগ্রহ করেছে। রক্তাক্ত অবস্থায় নবী করিম (সা.) যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে নাম মসজিদে আদ্দাস। আমাদের গাড়ি আরো সামনে আগাতে থাকে। ড্রাইভার গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে কথাও চালিয়ে যাচ্ছে। ‘এখানের মরুভূমি যেন মরূদ্যানে রূপান্তরিত হয়েছে। ‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা’রাই সেই পাহাড়ের উপত্যকায় খণ্ড খণ্ড বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। মরু উপত্যকার বিভিন্ন এলাকা আজ সবুজে সবুজময়। কোথাও উপত্যকার সমতলে, কোথাও আবার একেবারে পাহাড়ের চূড়ায় চাষাবাদ হচ্ছে বাংলাদেশের শাকসবজি এবং ফলমূল। ফুলকপি, বাঁধাকপি, শসা, গাজর, মূলা, বেগুন, পটল, খিরা আর ধনেপাতা। মাচার নিচে ঝুলে আছে চালকুমড়া, লাউ, ঝিঙার মতো লতানো সবজি। বাংলাদেশি কৃষকের উৎপাদিত শাক-সবজি চলে যাচ্ছে মক্কা থেকে জেদ্দা পর্যন্ত নানান শহরে।’ ড্রাইভার যে বিভিন্ন সময় এখানে আসে তার এক ভাইও এখানে থাকে সেই গল্পের গতিতে ঘুরতে থাকে গাড়ির চাকা ও তার হাতের স্টেয়ারিং।

তাপমাত্রা মক্কায় যখন ৪০-৪২ তখন তায়েফে মাত্র ২৫-২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তায়েফ শহরে রয়েছে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে তৈরি করা চমৎকার সব রিসোর্ট, পার্ক আর অবকাশ যাপন কেন্দ্র। পর্যটকদের আনন্দ দিতে রয়েছে পাহাড়ে ক্যাবল কারের ব্যবস্থা।

যে দিকে চোখ যায় দু’পাশে সবুজ বনানী, ফসলের ক্ষেত আর নানা আধুনিক দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা।

তায়েফের ঐতিহাসিক স্থাপত্যে মুগ্ধ হয়ে ইতিহাসবিষয়ক স্কলার মোনা উসাইরি বলেছেন, ‘তায়েফের এ পাথুরে স্থাপত্যগুলোর ভেতরে ও বাইরের রঙিন নকশাগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পুরুষরা যখন দুর্গের নির্মাণ কাজে ব্যস্ত থাকত, নারীরা দুর্গের ভেতরে ও বাইরে তখন নকশার কাজগুলো করত। দুর্গগুলোর দেয়ালে বিভিন্ন রঙিন নকশা তাদের কারু কর্মেরই প্রতিচ্ছবি। তায়েফের এ দুর্গগুলো আমার মন শীতল করেছে। ইতিহাসপ্রেমী যে কোনো পর্যটকের জন্যই তায়েফের এ ঐতিহাসিক প্রাচীন দুর্গ গুলো দর্শন করা উচিত বলে আমি মনে করছি।

আমরা মিকাত জিল মাহরাম থেকে উমরার নিয়ত করে দ্বিতীয় বারের মত ইহরাম পরিধান করে মক্কায় ফিরলাম । সেই সঙ্গে মনে আফসোস থেকে গেল, যদি আরো কিছুটা সময় থাকা যেত! এক দেখাতে কি আর মন ভরে। শুধু স্মৃতিপটে ভাল লাগার দাগ কেটে যায় আর কল্পনায় শ্রদ্ধাভরে ভেসে আসে প্রিয় নবী (স.) এর ত্যাগ ও কষ্টের দিনগুলোর কথা।

মোঃ সুমন মিয়া,
লেখক: গহীনে শব্দ (কাব্যগ্রন্থ)
সম্পাদক, চান্দিনা দর্পণ।

আল কোরআন

01a

সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ
প্রজ্ঞাময় আল কোরআন,
আলোয় রাঙিয়েছে কত জীবন
দিয়েছে পথের সন্ধান।

দেশ, ভাষা, বর্ণ গোত্রে
ছড়িয়েছে সুমহান জ্যোতি,
দিশারী হয়েছে আঁধার জীবনের
সুরভিত পরশের জ্ঞাতি।

অবতরণ করেন বিশ্বস্ত আত্মা
নূরানী হৃদয়ে,
ছড়িয়ে দিলেন গোটা মানবে
এক নব পরিচয়ে।

সেতু বন্ধন করেছেন যুগ-যুগ
শতাব্দীর সাথে শতাব্দী,
পাথেয় হয়েছে মানুষের জীবনের
জন্ম থেকে প্রলয় অবধি।

আল কোরআন জ্ঞানের ভাণ্ডার
কারো জন্য শিফা,
কুড়িয়েছে কেউ জগত খ্যাতি
কেউ রবের কৃপা।

নবীর উপদেশ আঁকড়ে ধরতে
পাক কালাম ও নবীর সিরাত,
লক্ষ প্রাণ সাজিয়েছে ভূষণ
কলবে ধরেছে কিরাত।

কেউ হয়েছে পথের পথিক
ছেড়েছে ঘর সংসার,
রবের ধ্যানে হয়েছেন দেশান্তর
তাওহীদ করেছেন প্রচার।

মর্মবাণী তাহার,
সুললিত সুর মুমিনের
হৃদয় ছুঁয়ে গেল,
পরশে তাহার সোনা হল খাঁটি
আঁধার হলো আলো।

আরব সাগরের শুভ্র ঢেউয়ে কিছু সময়

ala

সৌদি আরবের পশ্চিমাঞ্চলে লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত তিহামাহ অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর জেদ্দা। এটি মক্কা প্রদেশের সর্ববৃহৎ ও সৌদি আরবের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। লোহিত সাগরের উপর অবস্থিত সর্ববৃহৎ সমুদ্রবন্দর এই শহরেই অবস্থিত। ৪৩ লক্ষ জনসংখ্যা নিয়ে শহরটি সৌদি আরবের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র।

জেদ্দা হল মুসলিম উম্মাহর জন্য পবিত্রতম নগরী মক্কা ও মদিনা শহরের অন্যতম প্রবেশদ্বার। অর্থনৈতিক ভাবে জেদ্দা সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে তথ্য প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সবচেয়ে বেশি অর্থ বিনিয়োগের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। প্রাচ্যের লোকদের বিশ্বাস অনুসারে, ইভের সমাধি অর্থাৎ মা হাওয়া (আঃ) এর কবর, যাকে মানবতার আদি মাতা বলে মনে করা হয়। ১৯৭৫ সালে কিছু মুসলমান সেখানে প্রার্থনা করার কারণে সমাধিটি কংক্রিট দিয়ে সিল করে দেওয়া হয়েছিল।

বিশ্ব বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ১৩৩০ সালের দিকে তার বিশ্ব ভ্রমণের সময় জেদ্দা পরিদর্শন করেন। তিনি তার ডায়রিতে শহরের নাম “জিদ্দা” লিখেছিলেন। ব্রিটিশ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস এবং ব্রিটিশ সরকারের অন্যান্য শাখাগুলি পূর্বে “জেদ্দা” এর পুরানো বানান ব্যবহার করত, অন্যান্য ইংরেজি-ভাষী ব্যবহারের বিপরীতে, কিন্তু ২০০৭ সালে, এটি “জেদ্দা” বানান পরিবর্তিত হয়। টি.ই. লরেন্স মনে করেছিলেন যে ইংরেজিতে আরবি নামের যে কোনো প্রতিলিপি ইচ্ছাকৃত। তার বই, রেভল্ট ইন দ্য ডেজার্ট, জেদ্দা প্রথম পৃষ্ঠায় তিনটি ভিন্ন উপায়ে বানান করা হয়েছে। সরকারী সৌদি মানচিত্র এবং নথিতে, শহরের নাম “জেদ্দা” প্রতিলিপি করা হয়।

ওমরাহ্ শেষ করে আমরা আরব সাগর দেখার উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে জেদ্দা রওয়ানা দিলাম। একটি ট্যাক্সি ভাড়া নিলাম বাঙালী ড্রাইভার দেখে। বাড়ি কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম। পাঁচ বছর হলো এখানে সে এই পেশায় নিয়োজিত। এখানকার রাস্তাঘাট তার পরিচিত এবং এদেশের ভাষা ও আইন কানুন সম্পর্কেও ভাল অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছে। এখনও বিয়ে করেনি। এবার ছুটিতে গেলে বিয়ে করবে। আমরা তার ও তার পরিবারের গল্প শুনতে শুনতে সুউচ্চ দালান কোঠা, ঐতিহ্যবাহী ভাস্কর্য, সুদৃশ্য মনোরম আইল্যান্ড দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। একসময় দেখতে পেলাম ‘হাওয়া গেট’। তেমন কোন কারুকার্য নেই অথচ হালকা হলুদ রঙের হাওয়া গেট দেখতে অপরূপ। আদি মাতা হাওয়া (আঃ) এখান দিয়েই নাকি প্রবেশ করেছিলেন মক্কা নগরে। সেই স্মৃতিতে হাওয়া গেট। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে পাওয়া গেল মা হাওয়া (আঃ) এর কবরস্থান। মা হাওয়া (আঃ) এর কবর জিয়ারত করলাম।

হাল্কা বিরতি নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। ড্রাইভার বয়সে নবীন হলেও তার চিন্তা ভাবনায় গভীরতা আছে। নানা বিষয়ে সে কথা বলছে। বিভিন্ন পর্যটন এলাকা, এই দেশে ইসলামী রীতিনীতি, বিভিন্ন দেশ থেকে আগত হাজীদের ইতিকথা সহ অভিজ্ঞতার ভান্ডার থেকে বাংলা ভাষাভাষী লোকজন পেলেই প্রাণ উজার করে গল্প করে। এই দেশে বাংলাদেশীদের অবস্থান, সৌদিদের বাংলাদেশীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, মাইগ্রেশন ও এ্যাম্বাসীর কার্যক্রম, এদেশে শ্রমিকদের অবস্থা সহ নানা বিষয়ে আমাদের সাথে গল্প আড্ডায় যোগ দিল। সে ভাল একজন গাইড হিসাবেও কাজ করছে। এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে বিভিন্ন হোটেল, পার্ক, হেরেম শরীফ, রাস্তায় পরিচ্ছন্ন কর্মী ও এই গরম উচ্চ তাপমাত্রায় কনস্ট্রাকশন থেকে শুরু করে সকল প্রকার নিচু পোষ্টে এমন কোন কাজ নেই যে বাঙালিরা করে না। কথার ফাঁকে এক সময় বললো বাংলাদেশ থেকে মেয়েরা যাতে এদেশে গৃহকর্মী হয়ে না আসে সেজন্য তারা মিটিং-মিছিল করেছে। কারণ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিরিয়া, মিসরের অবস্থা হলে বাংলাদেশের মান থাকবে না।

কারুকার্যময় সব স্থাপনা আরবদের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন আমলের দ্রব্যাদি সড়কদ্বীপের মাঝখানে সুদৃশ্যভাবে সাজানো আছে। সুরাই, চিকন কাঁধ যুক্ত মোটা পেটের হাঁড়ি কাত হয়ে শুয়ে যেন আরাম করছে। মহাসড়কের দু’দিকেই মনোরম দৃশ্যরাজি। কোনটার চেয়ে কোনটা কম নয়। একটি টানেল পাড় হতে হলো। ইসলামিক ঐতিহ্যের কৌনিক আর্টে সাজানো দু’পাশের দেয়াল। ওভার ব্রীজ গুলোতে আলো জমকালো আরবি অক্ষরে বিভিন্ন বাণী লেখা থাকে।

সাজানো গোছানো প্রশস্ত রাস্তাঘাট, ওভারপাস ও রাসুল (সঃ) এর স্মৃতি বিজড়িত এই পবিত্রভূমি; ভাবতেই অবারিত মুগ্ধতায় চোখে আনন্দের ঝিলিক ফুটে উঠছে। গাড়ি থেকে দৃষ্টি বাহিরে যেতেই একটি দৃশ্য খুবই অপূর্ব লাগলো। সৌদি আরবের বিশাল আকৃতির জাতীয় পতাকা বাতাসে ঢেউ খেলে উড়ছে। মধ্যখানে যে তরবারি ওটি বাতাসের দোলে এমন দেখাচ্ছ যেন সাগরের কোন অচেনা প্রাণী সাঁতার কেটে এগিয়ে চলেছে। কানে এলো সাগরের গর্জন আর বাতাসের শাঁ শাঁ শব্দ। মক্কার তুলনায় এখানের তাপমাত্রা অনেকটা কম। জানালার গ্লাসটা নামিয়ে দিলাম।

চলতে চলতে সামনে যেতে হাতের বামে চোখে পড়লো সাগর। এটিই সেই আরব সাগর। যার কথা শুনেছি গানে, গল্পে, কবিতায়। মরমী কবি লিখেছেন ‘আরব-সাগর-পাড়ি-দেব-নাইকো-আমার-কড়ি, পাখি-নইক-উড়ে-যাবো-ডানাতে-ভর-করি।’ কাজী নজরুল ইসলাম আরব সাগরের মনোহরণ বর্ণনা দিয়েছেন ‘বাঁধন হারা’ পত্রউপন্যাসে। ‘তোমার পানির সাথে লইয়া যাও রে আমার চোখের পানি, লইয়া যাওরে এই নিরাশার দীর্ঘ নিশ্বাস খানি।’ অনুরোধ কবিতা – কাজী নজরুল ইসলাম ।

আরব সাগরের জেদ্দা পাড়ও গাছপালা শূন্য। ভেবেছিলাম আমাদের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এর মত বালুকাময় হবে কিংবা বিস্তৃত কোন খোলা জায়গায় ঢেউ এসে আচড়ে পড়বে পায়ের কাছে। আবেগে নেমে পড়ব ঢেউয়ের মোহনায় আর উল্লাসে মাতব। আসলে তা নয়। হয়তো ভঙ্গুর সাগর তীরে সেজন্যই বড় বড় পাথর ফেলে আছড়ে পড়া ঢেউ আটকে রাখা হয়েছে। যেখানে সাগর এগিয়ে, পিছিয়ে গেছে সেখানে পাথুরে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। সাধারণ ছিমছাম সাগর তীর দেখতে ভালই লাগে। পাশেই পায়ে হাঁটার পাকা রাস্তা। মাঝে মাঝে আফ্রিকান মহিলারা নানারকম খেলনা সামগ্রী নিয়ে বসে আছেন। পর্যটকরা হেঁটে হেঁটে পথ পেরিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার পাশে সারিবদ্ধ গাড়ি।

মনে হয় সাগর ভরা মাছ। আঁশটে গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। পানি কিছুটা কালচে মনে হলেও দুধের মত শুভ্রতা মাথায় মেখে ঢেউ ছুটে এসে তীরে আঘাত করে। ঢেউ-এর সাথে আসে ছোট মাছ, পাথরের উপর উঠে যেন নাচতে থাকে। অপূর্ব যে ঢেউ-এর নাচন-জলকণা উড়ে এসে বৃষ্টির মত ভিজিয়ে দেয় পাথরের উপরে বসে থাকা কাকড়া গুলোকে। পাথরগুলো কালো ও বেশ শেওলা জমে আছে।

এই অনবদ্য দৃশ্য আরো কাছ থেকে অনুভব করতে তীর থেকে সাগরের পানির মধ্যে পিলার দিয়ে রাস্তার মত করা হয়েছে। অনেকে সেখানে দাঁড়িয়ে গায়ে মাখছে সাগর জলের ঝাপটা বাতাস। আমরা নিজেদেরকে উজার করে ভাসিয়ে দিলাম বাতাসে। ফটো সেশন করলাম ফাঁকে ফাঁকে।

কক্সবাজারে সাগরে নেমে আমরা যেমন জলকেলিতে বিভোর হই এখানে তেমন দৃশ্য নেই। যে যার মত বসে বসে আড্ডায় মগ্ন।

সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমরা সাগর তীরে হাঁটছি। সামনে একটি মসজিদ দেখা যাচ্ছে। এ মসজিদও অর্ধেক মাটিতে অর্থাৎ সাগর তীরে বাকি অর্ধেক সাগর বক্ষে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। দেখলাম বঙ্গোপসাগরে যেমন রং ছড়াতে ছড়াতে সূর্য ডিমের আকার ধারণ করে সহসা ঝুপ করে ডুব দেয় সাগরে। এখানে রঙের ছড়াছড়ি তেমন নেই। সামান্য হলুদ আভা পানিতে দোল খেলে যায়। জাহাজ নেই, নৌকা নেই, কিছু নেই। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। ঢেউয়ের প্রতিফলন। সাগরপাড়ে এমন চমৎকার সুউচ্চ বিল্ডিং তৈরি করা হয়েছে যে, তার উপরে হেলিকপ্টার পর্যন্ত নামতে পারে। মাঝে মাঝে সাগরের পানি আটকে কৃত্রিম জলাধার বানানো হয়েছে, সৌন্দর্য বাড়াতে দেয়া হয়েছে বাদশাহজাদির সাজ।

সাগর পাড়ের মসজিদে নামাজ পড়ে বাইরে এসে দেখি আরব সাগর আলোক সজ্জায় সজ্জিত হয়ে রানীর গরিমায় দাঁড়িয়ে আছে। মনে হলো দিনের চেয়েও তার রাতের রূপ কম না। একেক সাজে একেক সৌন্দর্য্য।
সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে একেবারে ঢালুতে সাগরের কাছাকাছি এক পর্যটক পরিবার বসে আছে, মুগ্ধ নয়নে দেখছে আরব সাগরের অপরূপ রূপ।

রাস্তার পাশেই আল-বাইক; সেখানকার জনপ্রিয় খাবারের রেস্তরা। আমরা সেখান থেকে খাবার মেন্যু দেখে কিছু খাবার নিয়ে পাশেই শানে বাঁধানো টুলে বসলাম। আমাদের সাথে আছে ড্রাইভারও। সে বল্ল আমাদের দেশের মত এখানে পানিতে কেউ নামতে পারে না। আর চারপাশে রেলিং দেওয়ার কারন; এখানে মেয়ে ছেলেরাও পানিতে নেমে পড়বে। উলঙ্গ হবে। তাই পানিতে নামা নিষেধ। ইদানিং ওয়েস্টার্ন কালচারে বেড়ে উঠা সৌদি মেয়েরা আপত্তিকর পোশাকে এখানে আসে। সরকার নারীদের জন্য অনেক আইন শীতিল করে দিয়েছে। ভবিষ্যতে আরো কি যে হয়! আস্তাগ ফিরুল্লাহ্। আল্লাহ ভাল জানেন।

সন্ধা ঘনিয়ে আসছে। এবার ফেরার পালা। নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে মুগ্ধ দেহ ও মন নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলাম এবং ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করলো মক্কার উদ্দেশ্যে। কিসে যেন সুক্ষ্ন পিছুটান অনুভব হলো বুকের কোণে। গাড়ি চলছে দ্রুত গতিতে। যেতে যেতে দূর থেকে চোখে পড়ল মক্কা টাওয়ারের মায়াবি সবুজ আলো । ধ্রুবতারার মত হাতছানি দিয়ে যেন কাছে ডাকছে। কন্ঠে আনমনেই বেজে উঠছে সেই ধ্বনি- লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক।

2822a

মোঃ সুমন মিয়া, লেখক- গহীনে শব্দ (কাব্যগ্রন্থ)
সম্পাদক- চান্দিনা দর্পণ।