একটু আগে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছিল। এখন ঝিরঝির বাতাস বইছে। কোথাও কেউ জেগে নেই; শুধু রিভার নাইল ছাড়া। অদ্ভুত এক অনভূতি কাজ করছে। কোন কিছুর জন্য নয়; কারো জন্য নয়! তার জন্যও নয়!
এমন রাতে আমি নিজেকে চিনি!
একটু আগে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছিল। এখন ঝিরঝির বাতাস বইছে। কোথাও কেউ জেগে নেই; শুধু রিভার নাইল ছাড়া। অদ্ভুত এক অনভূতি কাজ করছে। কোন কিছুর জন্য নয়; কারো জন্য নয়! তার জন্যও নয়!
এমন রাতে আমি নিজেকে চিনি!
তিনঃ
– আমি আসছি।
ছোট দুই ভাইবোনকে বসতে বলে প্রমিতি ওর মার খোঁজ নিতে গেল। তিন কক্ষ পরেই। আলতো করে দরজা খুলে সে ভিতরে প্রবেশ করলো। তিনি গভীর ঘুমে। এসির রিডিং ১৮ থেকে ২১ করে প্রমিতি দরজার দিকে পা বাড়াচ্ছিল। মায়ের মুখমণ্ডলে তার চোখ আটকে গেল। সফেদ চুলগুলি এলোমেলোভাবে তাঁর কপাল দখল করে নিয়েছে। নিজের মায়ের এই অপার সৌন্দর্য সে মন ভরে দেখল। “ঈশ্বরও বুঝি এমন রুপে মুগ্ধ থাকেন” -প্রমিতি মনে মনে বললো।
মিনিট সাতেক পর প্রমিতি বৈঠকে ফিরলো।
আটশ বছর আগে ডায়েরিতে মার লেখা কথাগুলি সে তার ভাইবোনকে পড়ে শোনাচ্ছে। কোনটা শোনাবে কোনটা শোনাবেনা তা সে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল।
-বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সমাজ এবং শ্রেণিতে এই প্রেম ও বিয়ের বিষয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি হয়ত ভিন্ন ছিল। কিন্তু সর্বকালেই নারীরা তাদের মাতৃত্বকে সব কিছুর ওপরে রেখেছে। প্রায় আটশ বছর আগে আমাদের মা যখন রাণী ছিলেন তখনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সেজন্যই হয়তো তাঁর এই আটশ বছরের অপেক্ষা!
প্রমিতির ডায়েরি পড়া শেষ হলে মিতি মন্তব্যটা করে।
দ্বিতীয় ডায়েরিটা খুলতে যাচ্ছিল। দরজায় মৃদু নক শুনে প্রমিতি থামল। আরিয়ান দরজা খুলে দিয়েছে। বাইরে তারামন দাঁড়িয়ে। চা বা কফি লাগবে কিনা জানতে এসেছে। সে ঘুমিয়ে পড়বে।
অতঃপর প্রমিতি দ্বিতীয় ডায়েরিটা খুললো; সাথে ওটার জন্য কার্বন ডেটিং এর সনদও। প্রথম ডায়েরিটার মতো একই হাতের লেখা। তবে এটা আড়াইশ বছর আগের।
“আঠারোশ আটষট্টি সালের কথা”।
প্রমিতি তার মায়ের দ্বিতীয় জন্মের কাহিনি বলা শুরু করলো।
“তিনি ময়মনসিংহ এলাকায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন। টমটমে করে মহাবিদ্যালয়ে যেতেন। মধ্যবয়সী এক লোক সেই টমটম চালক ছিল। লোকটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে গ্রাম থেকে তারই আপন ভাতিজা নতুন চালক হয়।“
এটুকু বলে প্রমিতি থামে। জল খেয়ে নেয়।
-আমি বরং ডায়েরিটা তোদের পড়ে শোনাই
-আচ্ছা দিদিয়া।
মিতি সায় দেয়।
সাইড টেবিল থেকে চশমাটা নিয়ে প্রমিতি দ্বিতীয় ডায়েরি পড়া শুরু করে।
“নতুন চালককে দেখিয়াই আমার ভিতরটা যেন কেমন করিয়া উঠিল! পরে অবশ্য ইহার হেতু বুঝিয়াছি। তাঁহাকে চিনিতে আমার বেগ পাইতে হয়নাই। বেশ কয়েকদিন আমি তাঁহাকে হাবেভাবে বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছি যে, গত জন্মে আমরা দুইজন দুইজনের ছিলাম। কিন্তু সে কিছুই মনে করিতে পারিতেছিলনা। যখন কোন ভাবেই কাজ হইলোনা; তখন বিষয়টা লইয়া তাঁহার সহিত আরও গভীরভাবে আলাপ করিবার প্রয়োজন বোধ করিলাম। একদিন নিরলে বসিয়া নিকট অতীতে দেখা আমার একটা স্বপ্নের কথা তাঁহাকে বলিলাম, যেখানে এই জন্মে তাঁহার সাক্ষাৎ পাইবার ঘটনা ছিল। সেই ঘটনার সহিত তাঁহার এই চাকরিতে যোগদান কাহিনির সম্পূর্ণ মিল রহিয়াছে। যাহা হউক, আমি তাঁহাকে বলিলাম যে, সেই স্বপ্ন অনুযায়ী তাঁহার ডান হাটুর ভিতরের দিকে বোতামের সমান ভ্রমরকালো উঁচু ত্বক থাকিবার কথা যেখানে অস্বাভাবিক কিছু চুলও রহিয়াছে। ইহা তাঁহার আগের জন্মে ছিলনা। অবিকল একই জিনিস একই জায়গায় আমার এই জন্মে আছে; আগের জন্মেও ছিল। ইহা বলিয়াই আমি এদিক সেদিক তাকাইলাম এবং আমার ভ্রমর-কালো ত্বকটা তাঁহাকে দেখাইলাম। সে বিস্মিত হইল এবং হঠাৎ যেন তাঁহার মাথা খুলিয়া গেল। সে বলিল, মনে পড়িতেছে সেই জন্মে আপনি রাণী ছিলেন এবং আপনার সাড়ে চার বছরের একজন কন্যা ছিল। ইহাতে আমি খুব আনন্দিত হইলাম এবং মৃদু স্বরে বলিলাম, পাইয়াছি”!
ওইটুকু পড়ে প্রমিতি দম নিল। হাত থেকে ডায়েরি রেখে সে বললো,
– বাকি অংশ সংক্ষেপে বলি। ঘটনাটার এক পক্ষকাল পর সেই যুবক চালক অজানা কারণে নিখোঁজ হয়ে যায় এবং কোথাও তাকে আর পাওয়া যায়না।
এরপর প্রমিতি তৃতীয় ডায়েরিটা হাতে নিল। ওতে মূলত গত তিন বছরের কথা লেখা আছে। জুন ২০১৬ থেকে।
-এই ডায়েরিটা আমাদেরকে পড়ে শোনানোর দরকার নাই। আরিয়ান মন্তব্য করলো।
তবে একটা প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরছে দিদিয়া
-কি ভাই?
-বিশাল বড় টাইম পিরিয়ডে তিন জন্মের তিনটা ডায়েরি মার কাছে কেমনে এলো?
-এটা আমার অনেক পুরান একটা প্রশ্ন। মাকে করতে পারিনি। পাছে স্পর্শকাতর কোন ভুল হয়ে যায়। যাহোক কার্বন ডেটিং এর পর আমার প্রশ্নটা নাল এন্ড ভয়েড হয়ে যায় এই জন্য যে, বিজ্ঞান নিশ্চিত করেছে একই হাতের লেখা আটশ বছরব্যপি ছিল! তাই অন্যসব বিস্ময় নস্যি হয়ে গেছে!
-দিদিয়া, তুমি কি পুনর্জন্ম বিশ্বাস কর? মিতি প্রশ্ন করে
-আবারও একই কথা বলি, যা প্রত্যক্ষ করেছি তা অস্বীকার করি কেমনে? তবে তোর প্রশ্নটা আমি বুঝতে পেরেছি। আমি ধারণা করি, প্রত্যেকটা মানুষেরই পুনর্জন্মের ইতিহাস বা স্মৃতি আছে। আমার, তোর, সবার। অধিকাংশ মানুষের সেই স্মৃতি শতভাগ ঢাকা পড়ে থাকে। মিতি, হয়তো তোরটাও তাই। কেউ কেউ আবছা আবছা কিছু ঘটনা চোখে ভাসাতে পারে; কিন্তু সেটা নিছক ভ্রম কিনা তা রুল আউট করতে পারেনা। তবে এই মনুষ্যকুলের অতি ক্ষুদ্র একটা অংশ হয়তো আগের জন্মের কিছু স্মৃতি স্পষ্ট করতে পারে! আমাদের মা সেটাই করছেন।
চারঃ
বাংলো বাড়িটাতে ওরা সাধারণত আনন্দ করতে আসে। আজ ভরা পূর্ণিমা। অথচ ছাদে বসে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইবার বদলে ওরা ক্লোজড ডোর বৈঠক করছে।
প্রমিতির মোবাইল বেজে ওঠলো।
-তোরা বস; আমি আসছি
প্রমিতির স্বামী ফোন দিয়েছে। স্বামীস্ত্রীর প্রেম নিয়ে ছোট দুই ভাই বোন সুযোগ পেলেই মজা করে। এই ফাঁকে মিতি ওঠে গিয়ে তিন কাপ চা করে নিয়ে এলো। প্রমিতি ফিরে এলে শুকনা মুড়ি দিয়ে তিন ভাই বোন চা খেল।
-যে লোকটার কথা দিদিয়া তুমি এবং মা জানো সেইই যে আটশ এবং আড়াইশ বছর আগের সেই লোক এটা নিশ্চিত করলে কেমনে? চা খেতে খেতে আরিয়ান প্রশ্ন করলো।
-তোদেরকে আমি অবিশ্বাস্য যে কটি প্রমাণ দেখিয়েছি ওরকম কিছু সেই লোকটার কাছেও আছে। প্রায় বছর তিনেক আগে কাকতালীয়ভাবে লোকটার সাথে মার অনলাইনে যোগাযোগ হয়। তখন দুজনের ভিতর অদ্ভুত কিছু অনুভুতি কাজ করে। সেই সময় থেকে উনারা কথা বলেন এবং একে অপরের সাথে সবকিছু মিলিয়ে নেন।
-উনি এখন কোথায়?
-সেটা এখন অনুল্লেখ থাক আরিয়ান। বিষয়টা নিয়ে আমরা পজেটিভ্লি আগাবো কিনা সেই সিদ্ধান্ত নেয়া এখন জরুরি। প্রমিতি জবাব দেয়।
-সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমরা পজেটিভ না হওয়া মানে প্রকারান্তরে গত আটশ বছরের যন্ত্রণার বোঝা মায়ের কাঁধেই রেখে দেওয়া। আরিয়ান মন্তব্য করে।
-হুমম। মিতি সায় দেয়।
পাঁচঃ
ভোর হতে বেশি বাকি নেই। বৈঠক আপাতত শেষ। প্রমিতি মনে করছে, প্রাথমিকভাবে একটা কার্যকর সিদ্ধান্তে পৌঁছা গেছে। এরপর সময় নিয়ে পরবর্তী পরিকল্পনা করতে হবে। একই সাথে প্রমিতির এই আশংকাও হচ্ছে যে, মিতি যে রকম মা-ভক্ত এবং আবেগপ্রবন মেয়ে; শেষে সে আবার বেঁকে না বসে। যাহোক, যে যার কক্ষে চলে যাচ্ছিল। ওদেরকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে প্রমিতি আবার মায়ের কক্ষে গেল। সে জানে, এইসময় তার মা লোকটার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলেন এবং তারপর নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে যান।
প্রমিতিকে দেখে সুতনুকা হেড ফোন খুললো। তার আগে অবশ্য তিনি অন্যপাশকে একটু লাইনে থাকতে বলেছেন।
-তোমার অনুমতি ছাড়াই আটশ বছরের কিছু কথা মিতি এবং আরিয়ানের সাথে শেয়ার করেছি। প্রমিতি খুব নিচু স্বরে ওর মাকে বলে।
-আচ্ছা। মা সুতনুকা নিহিয়াল মুচকি হেসে জবাব দেন।
-ওদেরকে ডাকি মা?
-ডাকো। খুব শান্ত কন্ঠে সুতনুকা সম্মতি জানান।
মিনিট খানেকের মধ্যে মিতি এবং আরিয়ান তাদের মায়ের কক্ষে প্রবেশ করে। তিনি নীল সুতি শাড়ি এবং খোঁপায় হাস্নাহেনার মালা পরে ল্যাপ্টপের সামনে বসে আছেন। কপালে বড় লাল টিপ। মায়ের এমন স্বর্গীয় রুপ তারা যেন আগে কখনো দেখেনি।
অন্যপাশে সাদাকালো পাঞ্জাবি পরা একজন বয়স্ক লোক। হাত নেড়ে দুপাশ দুপাশকে গ্রিট করলো। দুইভাই বোন খেয়াল করল, লোকটার কপাল বেশ প্রশস্ত; ফিনফিনে চুল হাওয়ায় উড়ছে। তাঁর গলার বাম পাশে জীবন্ত নীল প্রজাপতির মত অদ্ভুত একটা জন্মদাগ যা প্রথম এবং দ্বিতীয় ডায়েরিতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে!
হঠাৎ কী মনে করে যেন প্রমিতি আটশ বছর আগের ডায়েরিটা আবার খুললো। এরপর ওটার একটা পাতা বের করে তার দুই ভাইবোনকে পড়তে দিল। সেখানে সবিস্তারে এক শিশু কন্যার বিবরণ লেখা যার সাথে মিতির বিস্ময়কর সব মিল আছে!
“আ—বা—রো?!”,
এক অজানা আশংকায় আরিয়ান বিড়বিড় করলো!
————————
প্রথম পর্বের লিঙ্কঃ পরাবাস্তব কাহিনি নিয়ে লেখা দুই পর্বের গল্পঃ তিন জন্মে (১)
একঃ
-আট–শ– বছর ধরে মা কারো অপেক্ষায় আছেন?!
মিতি অবাক কন্ঠে টেনে টেনে প্রশ্নটা করলো। ওর ছোটভাই আরিয়ান অবশ্য কিছু বলছেনা; সে বিস্ময়ে থ মেরে গিয়েছে।
-হ্যাঁ। আটশ বছর ধরে!
প্রমিতি তার আগের কথাটাই রিপিট করলো।
প্রমিতি অর্থাৎ প্রমিতি নিহিয়াল দেশের নামকরা বিজ্ঞানি। সে অক্সফোর্ড থেকে এস্ট্রোফিজিক্সে পিএইচ ডি করেছে। একজন মানুষের আটশ বছর মানেই সেখানে নিশ্চিতভাবে পুনর্জন্মের বিষয় আছে। প্রমিতির মতো একজন বিজ্ঞানীর মুখে কথাটা শুনে তাই বাকি দুই ভাইবোন খুব অবাক হয়েছে।
প্রমিতি তার মায়ের প্রথম সন্তান। একচল্লিশ ছুঁই ছুঁই। মায়ের উনিশ বছর বয়সে তার জন্ম হয়। মা মেয়ের বন্ধুত্ব খুব গভীর এবং বেশ খোলামেলা।
-আটশ বছরের অপেক্ষা আমার কাছেও বিস্ময়কর এবং অবিশ্বাস্য বিষয়। কিন্তু যে সত্যের পক্ষে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি তা মেনে না নিয়ে উপায় কী?
প্রমিতি মন্তব্য করল।
হঠাৎ পাশের কক্ষে একটা শব্দ হলো। তিনভাই বোনের ধারণা, তারামন ওখানে আড়ি পেতে আছে। আরিয়ান নিঃশব্দে ওখানে গিয়ে দেখলো, আসলেই তাই। কক্ষটা খালি করে সে বাইরে থেকে লক করে দিল।
প্রমিতি আবার আলোচনা শুরু করলো।
-আমরা কী কিছু করতে পারিনা?
প্রমিতির প্রশ্নে ছোট দুই জন এবার হতভম্ব হল। এই “কিছু করা” মানে যে নিছক কিছু করা না তা সবাই জানে।
-ঠিক আছে, তোরা সময় নিয়ে জবাব দে। প্রমিতি যোগ করলো।
-সোশ্যাল ডিসএপ্রোভালের বিষয় কী মাথায় রেখছো দিদিয়া?
মিতি মুখ খুললো।
আরিয়ান মাথা নেড়ে মিতিকে সমর্থন জানালো।
ছোট দুই ভাইবোন সোশ্যাল ডিসএপ্রোভালকে সবচে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছে। কিন্তু প্রমিতি জানে, তার ভাই বোনদের সাইকোলজিক্যাল ডিসএপ্রোভালই সবচে বড় সমস্যা! যা থেকে সে নিজে; এমনকি তার মাও মুক্ত নয়!
-আরো সময় নে। দরকার হলে দুজন আলাদা করে কথা বল। প্রমিতি পরামর্শ দিল।
দুইঃ
যে যেখানেই থাকুক না কেন বছরের মধ্যসময় অর্থাৎ প্রতিবছর জুন মাসের শুরুতে ভাই বোনেরা এই বাগান বাড়িতে আসে। তাদের স্ত্রী অথবা স্বামীদের কেউই সাধারণত সাথে থাকেনা। একান্তই ভাই বোনদের মিলন মেলা এটা। বরাবরের মত এবার ওদের মা সুতনুকা নিহিয়ালও সাথে আছেন। জয়দেবপুরে প্রায় দশ একর জায়গার ওপর নিজস্ব বাংলো বাড়ি এটা। ওদের নানা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। তিনি তাঁর শেষ জীবনে মেয়ের নামে এই বাংলোটা করে দিয়ে গেছেন।
ওরা আজ দুপুরেই বাংলোটাতে এসেছে। আরও দুদিন থাকবে। পাঁচ জুন সকাল সকাল চলে যাবে। শেষের দেড় দুইদিন খুব আনন্দ করার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু তার আগে জরুরি বিষয়টা নিয়ে আলোচনা সেরে নিতে চায়। তাই এই ক্লোজড ডোর বৈঠক।
রাতের খাবার শেষে সুতনুকা নিহিয়াল সাধারণত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন। আজ তার ব্যতিক্রম হয়নি। এই সুযোগে তিন ভাইবোন আবার বৈঠকে বসেছে। প্রমিতির হাতে তিনটা ডায়েরি। প্রথমটা খুবই পুরান; জীর্ণ অবস্থায় আছে। কিন্তু যত্ন করে মোড়ানো।
এক ঢোক লেবুর শরবত খেয়ে প্রমিতি কথা শুরু করলো।
-উত্তর বঙ্গে প্রতাপশালী এক রাজা ছিলেন। বারোশ পাঁচ থেকে বারশো নয় শতাব্দীর কথা। হঠাৎ সেই রাজার অকাল মৃত্যু হলে রাণী রাজ্যের দায়িত্ব নেন। তখন তার বয়স একুশ মাত্র; এক শিশু কন্যার জননী । রাণীর সিংহাসনে আরোহের দুই বছরের মাথায় শিক্ষা বিভাগে নতুন এক অধ্যক্ষ যোগ দেন এবং একদিন তিনি রাণীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করতে আসেন। সেদিনকার সেই রাণীই আজ আমাদের মা; সুতনুকা নিহিয়াল। ওটা তাঁর প্রথম জন্ম ছিল। আর সেই অধ্যক্ষের জন্যই তিনি অপেক্ষা করছেন! আটশ বছর ধরে।
সবচে পুরান ডায়েরিটার পাতা খুলে প্রমিতি তার ভাই বোনদেরকে লেখাগুলি ভালো করে দেখতে বলে।
-তোমরা ডায়েরিতে হাতের লেখা দেখেছ?
-হ্যাঁ। ওটা মার হাতের লেখা। ছোট দুই ভাইবোন দ্বিধাহীন জবাব দেয়।
-পাতায় পাতায় সন তারিখ উল্লেখ আছে; দেখেছ?
-হ্যাঁ, তারিখগুলি বারোশ এগারো থেকে কয়েক বছরের।
-ডায়েরিতে লেখা কথাগুলি থেকে কিছু তোমাদের পড়ে শুনাব। তার আগে একটা কথা বলি। পিএইচডি করার সময় মার অনুমতি নিয়ে আমি একটা কাজ করেছি। ওখানে একটা বড় ল্যাবে ডায়েরিগুলি পরীক্ষা করে দুটো বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি। একঃ মার বর্তমান হাতের লেখা এবং ডায়েরিগুলিতে লেখা একই ব্যাক্তির। দুইঃ ডায়েরিগুলিতে উল্লেখিত সন তারিখ সব নির্ভুল। কার্বন ডেটিং পরীক্ষায় লেখার এই বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রমিতি প্রথম ডায়েরির কার্বন ডেটিং পরীক্ষার সনদ সবাইকে দেখাল।
মিতি এবং আরিয়ান ভীষণ অবাক হলো। কয়েক মিনিট কারো মুখে কোন কথা এলোনা।
———–
একনলেজমেন্টঃ কবি সৌমিত্রের “তোমাকে সুতনুকা” কবিতা থেকে সুতনুকা নামটা নিয়েছি
একঃ
জবা চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিলো। চিঠি পড়ে তার চোখ ভিজে গেছে। গলাটাও কেমন ধরে আসছিল!
-কবে আইছে চিঠি? আরিফকে চিঠিটা ফেরত দিতে দিতে জবা জানতে চাইল।
সে আরিফের দূর সম্পর্কের বোন!
-আজই আইছে। নরেন চাচা কাল আমার নানার গ্রামে ফেরি করতে যাইয়া মার দেখা পাইছিল। তখনই মা দিয়া দিছে। চিঠির সাথে একটা গেঞ্জিও দিছে। মা হাতে বুনছে। তোমারে দেখামুনি। আরিফ জবাব দিল।
গত অক্টোবরে আরিফের নয় বছর পূর্ণ হয়েছে! বয়সে জবার চেয়ে সে বছর পাঁচেকের ছোট। বুবু বলে ডাকলেও জবা তার সবচে কাছের বন্ধু।
-আমি মার সাথে দেখা করতে যামুনা বুবু
-কেন রে পাগলা? জবা জানতে চাইলো
-আমার কিছু ভালা লাগেনা !
জবা মুখে কিছু বলেনা। সে আরিফের মাথার চুলে আঙ্গুল চালিয়ে ভরসা দেবার চেষ্টা করে, “আমিতো আছি”।
ঘাটে বাঁধা একটা নৌকায় বসে বসে ওরা এতক্ষণ কথা বলছিল। আরিফ ওঠে দাঁড়াল। তারপর একটা ভ্যাকেন্ট লুক দিয়ে সে বাড়ির পথে হাঁটা ধরল। কিন্তু কি জানি কী মনে করে সে আবার ফিরে এলো।
-তুই বয় আমি আইতাছি। যাবিনা কিন্তু কইলাম
-আচ্ছা বুবু; তাড়াতাড়ি আইসো। আরিফ জবাব দিল।
আগামিকাল আরিফের মায়ের বিয়ে। দুই সপ্তাহ আগে ওর নানী এসে মেয়েকে নিয়ে গেছে; দ্বিতীয়বার বিয়ে দেবে। জবা চাইছে এই অবস্থায় যতোটা সম্ভব আরিফকে স্বাভাবিক রাখতে।
পনের বিশ মিনিট পর জবা ফিরে এলো।
-তোর জন্য একটা জিনিস আনছি
-কী আনছ বুবু?
-চল পাড়ে গিয়া বসি। ওইখানে দেখামু।
জবা গুড় আর কাঁচা মরিচ মেখে কাঁচা আম ভর্তা করে এনেছে। কাগজের মুঠ থেকে বের করে এক টুকরা আরিফের মুখে দিয়ে বললো,
-নে, সবটুকু খা
-বুবু, তুমি খাবানা? তোমার তো খুব পছন্দ
-পরে আবার বানামু। এখন তুই খা।
এরপর একটা লাড্ডু হাতে দিয়ে জবা বলে,
-এটাও খা
-সব খালি আমারেই দিতাছ?
জবা উত্তর দেয়না। দক্ষিণ দিকে একমনে তাকিয়ে থাকে। একজন লোক আসছে।
-এই পাগলা, দেখ দেখ নরেন চাচা আইতাছে।
বানিজ্য শেষ করে নরেন ফেরিওয়ালা তখন ঘরে ফিরছিল। কাছে এসে সে তার হাঁটার গতি কমিয়ে দিলো।
-আরিফ বাবাজি, মাকে দেখতে যাবানা? সে আমারে খুব অনুনয় কইরা কইছে যেন তোমারে যাইতে বলি। সে তোমার কেবল মা না গো বাবাজি, মন্দিরও! মন্দির ভাঙ্গলে আসমানও ভাইঙ্গা পড়ে ! নরেন ফেরিওয়ানা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে চলে যায়।
প্রতিউত্তরে আরিফ কিছু বলেনা। সে আম ভর্তা খেতে খেতে ফেরিওয়ালা চাচার চলে যাওয়া দেখে।
-চল কাল তোর মার কাছে যাই। আরিফের মাথায় টোকা দিয়ে জবা বলে
-তুমি আমার সাথে যাইবা বুবু?
-হ্যাঁ। সকালে সকালে রওনা দিতে অইব। বেলা থাকতে ফিরা আসা লাগবে।
-কালই তো নানী বাড়ি থেইকা আমার মা চইলা যাইবে, তাইনা বুবু?
জবা নিরুত্তর থাকে। আরিফের ভিতর যে ভাংচুর হচ্ছে্ তা কান পেতে শুনে। আরিফের যখন সাড়ে ছয় বছর বয়স তখন ওর বাবার মৃত্যু হয়। সেই সময় সে বাবাকে অতোটা অনুভব করেনি। কিন্তু বছর দেড়েক পর থেকে তার অসহনীয় কষ্ট হতে থাকে! তখন সে ভাবতো, নদির গভীর থেকে জাহাজে করে একদিন হঠাৎ তার বাবা ভেসে ওঠবেন।
আজ মায়ের জন্যও আরিফের একই রকম কষ্ট হচ্ছে। একই রকম অলৌকিক কিছু মায়ের প্রত্যাবর্তনের জন্য সে কামনা করছে।
-বুবু তোমার কাছে টাকা আছে?
-মায়ের জন্য কিছু কিনবি?
-হ্যাঁ
-দাঁড়া। এখনি নিয়া আসতাছি
মিনিট দশেক পর জবা চল্লিশ টাকা এনে আরিফের হাতে দিল।
-তোমার সব টাকা দিয়া দিলা?
-হ্যাঁ
-কেন বুবু?
-আজ থেইকা ৮-১০ বছর পর হইলে কইতাম, কেন দিলাম?
-এখনই কও
-নারে পাগলা, এখন কইলে তোর ভালা লাগবেনা। সময়েরটা অসময়ে তিতা লাগতে পারে।
-কি কও তুমি? বুঝিনা
-পুঘল দীঘা বিল থেইকা ফিরার সময় বট গাছের নিচে যখন বইসা ছিলাম তখনও তুই বুঝছ নাই। তোর নানী তোর মায়েরে কেন বিয়া দিতাছে হেইডাও তুই বুঝছনাই! না বুঝার মধ্যে একটা “ভালা” লুকাইয়া থাকে। আমারে যখন বিয়া দিছিল হেইডা আমি তখন বুঝিনাই। স্বামীর বাড়ি যাইয়া সব বুঝবার পর থেইকা আমার খালি খারাপই হইছে!
জবার শেষ কথাটায় আরিফের মন আরও ভার হলো।
দুইঃ
পরদিন সকালে জবাকে সঙ্গে নিয়ে আরিফ তার মাকে দেখতে রওনা হয়। বেশ দূরের পথ।
ধান ক্ষেতের আইল দিয়ে হাঁটার সময় মাঝে মধ্যে আরিফের পা পিছলে যাচ্ছিল। ভীষণ গরম; গা জ্বলছিল। আইলপথ শেষে একটা বাড়িতে টিউবওয়েল দেখে ওরা থামে। প্রথমে জবা টিউবওয়েল চাপল আরিফ জল খেল; পরে জবা খেল। জল খাওয়া শেষে ওদের চলে যাওয়া দেখে মধ্যবয়সী এক মহিলা বাড়ির ভিতর থেকে বের হয়ে এলো। দুজনের হাতে দুমুঠো চাল ভাজি দিলো।
-তোমরা কোন গাওয়ের ছাওয়াল গো?
জবা মহিলার প্রশ্নের উত্তর দেয়। এরপর কথায় কথায় আরিফের প্রসঙ্গ ওঠে। মহিলা আরিফকে জড়িয়ে ধরে বলে, “ফেরার সময় আমার এইখানে আবার আইসো। আমি কিন্তু আশায় থাকমু বাপজান”।
আবার ওরা হাটা ধরে। এবার বেশ দীর্ঘ খোলা মেঠো পথ। খুব বেশি লোকের চলাচল নাই। মাঝে মধ্যে দু একজন সাইকেলের বেল বাজিয়ে পাশ কেটে চলে যাচ্ছে। প্রায় আধা ঘণ্টা পর পথে বড় একটা বট গাছের দেখা মিললো। পূঘল দীঘা বিলে সেই বট গাছটার কথা জবার মনে পড়লো। আশেপাশে কোথাও কেউ নাই। দূরে মরীচিকাগুলি যেন নদি হয়ে আছে। মিছা নদি। আরিফের মাতৃস্নেহ পাবার আশার মত। জবার স্বপ্নের মত।
-গাছতলায় একটু জিরাইবি আরিফ?
-হ্যাঁ বুবু
বেশ শীতল বটছায়া। মিষ্টি বাতাস বইছিল। ঘন ঘাস দেখে ওরা এক জায়গায় বসে।
-আর একটু কাছে আয়; পিঠে হাত বুলাইয়া দেই।
আরিফ জবার গা ঘেষে বসে। ওড়না দিয়ে ওর মুখ মুছে দিয়ে সে আরিফের পিঠে হাত বুলাতে থাকে।
-বুবু
-বল
-আমার জন্য মার কী খুব কষ্ট হইতাছে?
জবা উত্তর দেয়না। সে আরিফের পিঠে মুখ রেখে দুহাতে জড়িয়ে ধরে। তার চোখ গড়িয়ে জলে আরিফের পিঠ ভিজে যাচ্ছে। জবা নিজের ভিতর আরিফের জন্য দুটি সত্ত্বার অস্তিত্ব টের পায়। একটা আরিফ বুঝে; দ্বিতীয়টা কেবল সে একাই ।
কিছুক্ষণ পর সামনে দিয়ে একটা ঠেলা গাড়ি যায়। এক বৃদ্ধ ঠেলছিল। বয়স খুব বেশি না হলেও জবা জীবনের অনেক কিছুই বুঝে। ছয় মাসের বিবাহিত জীবনটা আসলে তার জন্য একটা ট্রেনিং ছিল। কানা মানুষের জীবন পড়ার ট্রেনিং। জবা চোখ বন্ধ করে দেখে, একটা ঠেলা গাড়ি আসলে একটা জীবনের সমার্থকঃ তার, আরিফের, আরিফের মার, বৃদ্ধটার; সবার জীবনের। ইচ্ছে না থাকলেও ঠেলতে হয়। নইলে চলেনা।
ওরা বটছায়া থেকে ওঠে দাঁড়ায়। হাতে সময় নাই। আরও বেশ কিছু পথ যেতে হবে। আরিফের একটা হাত জবা মুঠোয় ভরে নিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় ওরা পথটার মাথায় যায়। একটা নদিতে গিয়ে ঠেকেছে। দুখাই নদি। ওটা পার হয়ে ওরা ঝাওতলি গ্রামে মল্লিক বাড়িতে যায়। আরিফের নানা বাড়ি।
তিনঃ
তখন দুপুর বেলা। বরপক্ষ চলে এসেছে। তারা চটজলদি বিয়ে সম্পন্ন করে চলে যেতে চায়। নদিপথে বহুদূর যেতে হবে। অন্ধকার হলে পথে জলদস্যুর ভয় আছে। বিয়ের যাত্রী তাই ভয় আরও বেশি!
জবা আরিফকে হাত ধরে টেনে ওর মায়ের সামনে নিয়ে যায়। লাল শাড়ি পরে বসে আছে! অল্প দূরে দাঁড়িয়ে আরিফ ওর মাকে দেখে। কী যে সুন্দর লাগছে লাল শাড়িতে!
সম্মুখে দন্ডায়মান ছেলেকে আরিফের মা খেয়াল করেনি। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ যখন সে ছেলেকে দেখতে পায় তার ভিতর সুনামি শুরু হয়। সে ওঠে আরিফের কাছে যেতে চাইলে এক মুরুব্বি মহিলা তাকে কাঁধে চাপ দিয়ে বসিয়ে দেয়। কারণ কাজি সাহেব এসে গেছে! এখনই বিয়ে হবে।
আরিফের দিকে ওর মা অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে! কতক্ষণ তাকিয়ে ছিল সে বুঝতে পারেনি। ওদিকে একজন বারবার তাড়া দিতে থাকে, “বল, কবুল”!
আরিফের দিকে তাকিয়ে থেকে বেখেয়ালীভাবে সে কবুল বলে।
চারঃ
সবকিছু দ্রুততার সাথে করা হচ্ছিল। সবার খাওয়া শেষ! বিদায়ের পালা। আরিফকে জবা ওর মায়ের কছে ঠেলে দেয়। মাকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁদতে ইচ্ছে করে; কিন্তু পারেনা। পাছে নতুন বর রাগ করে। সে নিশ্চিত নয়, আপন মার প্রতি তার অধিকার আজ দুপুরের পর থেকে কতোটা আছে!
বিদায় পর্বও শেষ। লাল রঙের শাড়ি পরে আরিফের মা বরের হাত ধরে নৌকায় ওঠে। গলুইয়ের কাছে দাঁড়ায়ে সে ছেলেকে ডাকে। কাছে গিয়ে আরিফ মাথা নিচু করে থাকে। মাঝি নৌকা ছেড়ে দিচ্ছে। তবুও সে কোন কথা বলেনা।
-আমারে মাফ কইরা দিস বাবা। আরিফের মা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।
আরিফ একটা বক্স ওর মায়ের হাতে দেয়।
-এটা কি বাপ?
আরিফ তার অতি প্রয়োজনীয় কথাটাই কেবল বলে,
-প্রেসারের ওষুধ খাইতে ভুইলোনা।
নৌকা ছেড়ে দেয়। বড় একটা ঢেউ পাড়ে এসে আছড়ে পড়ে। তাতে নদী ভাঙ্গেনা; একজন আরিফ ভাঙ্গে কেবল!
—————————
ছোটগল্পঃ লালরঙা শাড়ি (এক) এর লিংক নিচে :
ছোটগল্পঃ লালরঙা শাড়ি …
সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলাম ড্রাইভার বললো,
“একটু ডানে তাকান”।
একজন তিরিশোর্ধ মহিলা তাকিয়ে ছিলেন।
জানতে চাইলাম,
“কে উনি?”
“কয়েক মাস ধরে যে আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছে।”
পোস্তুন ড্রাইভার জবাব দিলো।
আমার বাঙালি বাবুর্চি খাবার পরিবেশনের সময় বেশ কবার মহিলাটির অনুরোধের কথা জানিয়েছিলো। সে ইউএস প্রবাসী; রহস্যময় কারণে পাকিস্তানে অবস্থান করছিলো। বাবুর্চি ছাড়া আরো কেউ বিষয়টা জানতো ধারণা করিনি।
যে বিশ্বাস নিয়ে তাঁর সাথে দেখা করিনি তখন সেটাকে ভুল মনে হলো।
হয়তো সেই “ভুল মনে হওয়াটা”ও ভুল ছিলো।
কে জানে?!
————–
(পাকিস্তান; জুন ২০১৩)
“এখানকার জমিদার বাবুর নাম থেকে এই গাওয়ের নাম হয়েছে”, চা দিতে দিতে বৃদ্ধ ফেরিওয়ালা রাশেদুলকে জানালো। স্টেশনটার নামও তাই অবনীপুর রেলস্টেশন।
পরের স্টপেজের জন্য ট্রেন ছেড়ে দিলো। একটু নড়ে বসে মেহেরুন নেছার চিঠির খামটা রাশেদুল আবার দেখলো; ৯ মার্চ ১৯৫৯ এ পাঠানো চিঠি। সে ভাবলো, হয়তো ইতোমধ্যে আরও কয়েকটা দীঘির জল নোনা হয়েছে। চিঠির পরের অংশ রাশেদুল পড়তে লাগলো।
“আমার তো মরিবার বয়স হইয়াছে। কিন্তু এখনো সে আমার গায়ের তাপমাত্রা আন্দাজ করিয়া এমন ইঙ্গিত করে যে, মন ভার হইয়া যায়। এই পঞ্চাশে গায়ে বেশি তাপ থাকিবার তো কতো কারণই থাকে ! তাহার ধারণা সঠিক হইলেও স্ত্রী হিসাবে আমি কী বলিবার অধিকার রাখিনা, পুরুষ তুমি নপুংসক হইলেই কেন আমাকে সব সক্ষমতা হারাইতে হইবে?
ইদানিং শরীরটা ভালো যাইতেছেনা। তুমি আসিলে বিষদ জানাইব। কয়দিন হইলো নতুন একটা বিষয় যোগ হইয়াছে। সে আমার অন্তর-সিন্দুকের চাবি চাহিতেছে। মনেতে কোন পুরুষের বসত রহিয়াছে কিনা সম্ভবত তাহা জানিতে চায়। তুমিই বলো, গোপন সিন্দুকের চাবি কি অন্য কাহারও হাতে কাজ করে?
আমার শরীর কেমন আচরণ করিবে এই জীবনে তাহা না হয় উনার কাছেই বন্ধক রাখিলাম; কিন্তু আত্মা? ইহা কিভাবে বন্ধক রাখিব? উনি তো আমার ঈশ্বর নহেন !
আচ্ছা রাশেদুল, আমাকে যদি সাথে লইয়া যাও; তুমি কি আমার ঈশ্বর হইবে?”
চিঠিতে আবার একটু গ্যাপ দিয়ে মেহেরুন নেছা প্রশ্ন করেছে;
“ঈশ্বর না হয় পুরুষই হইলেন; কিন্তু স্বাধীনতার কী কোন লিঙ্গ আছে?”
প্রশ্নটা রাশেদুল বুক পকেটে ভাজ করে রেখে দিলো। সে জানে, যে সমান্তরাল লাইন দুটোতে ভর করে সে নীরাপুর যাচ্ছে মিলনের চেষ্টা হলে রেলগাড়িটা নীরাপুর যাবেনা!
(GBV বা জেন্ডার বেজড ভায়োলেন্স লেখাটার মূল বিষয়। কাল্পনিক।)
“পরে অবশ্য ভাবিয়াছি, আমি তাহার কাছে বন্ধক রাখা কোন সম্পত্তি নহি যে তাহাকে কেন্দ্র করিয়া আমার মরিবার বা বাঁচিয়া থাকিবার সব আয়োজন করিতে হইবে ! তাই আড়াইকুড়ি বছর পার করিবার পরও আজ স্বপ্ন দেখিতেছি, যদি আমার চোখে তুমি একটা ঝলমলে রাতের আকাশ আঁকিয়া দাও——!”
এইটুকু পড়ে রাশেদুল ইসলাম চিঠির খাম হাতে নিলো। নীরাপুর থেকে মেহেরুন নেছা লিখেছে। কালো কালির সীলমোহরে পোষ্ট করার তারিখ উল্লেখ আছে; ৯ই মার্চ ১৯৫৯। তার হাতে পৌঁছতে প্রায় তিন মাস সময় লেগেছে। সে ঝটপট গোছগাছ করে নীরাপুরের ট্রেন ধরলো। তেমন প্রস্তুতি নেই। মেহেরুনের ঝলমলে আকাশটা আঁকার জন্য অবশ্য সে অন্তর ভরে জোছনা নিয়েছে।
ইতোমধ্যে নানান যাত্রীতে বগি ভরে গেছে। পুরুষ আছে, মহিলা যাত্রীও কম না। বগির মাঝখানের আইলপথে হঠাৎ কোন অচেনা মহিলাকে দেখে রাশেদুলের ভুল হয়ে যাচ্ছে মেহেরুন মনে করে। দুইযুগ হল দেখা নাই।
খোলা মাঠ, বন-পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ট্রেনটা ছুটে চলেছে। ট্রেনের হুইশেলের সাথে রাশেদুলের বুকটা মেহেরুনের জন্য হুহু করতে লাগলো। ব্যাগে রাখা পানের বাক্স থেকে এক খিলি পান মুখে নিয়ে চিবাতে লাগলো। কি জানি কী মনে করে সে মেহেরুন নেছার বর্তমান ঠিকানা আবার দেখে নিলো। বর্তমান ঠিকানাটা আদৌ বর্তমান আছে কিনা কে জানে? চিঠির একটা অংশে তার চোখ আটকে গেলো।
“মধুরাতে নরনারীর সুখ খুঁজিবার চিরন্তন আকুলতার বদলে সে কিছু একটা বুঝিয়া লইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিল। যখন একটুকরা সফেদ কাপড় বিছানোর প্রস্তুতি লইতেছিল আমার বুঝিতে বাকি রহিলোনা যে, আদতে সে একটা ভোগ্য পণ্য যাঁচাই করিতে যাইতেছে। খুব বিষন্ন হইয়া পড়িলাম। জানালা খুলিয়া দেখিলাম, আকাশে কোথাও কোন তারা নাই”।
চিঠিতে এরপর একটু গ্যাপ দিয়ে মেহেরুন নেছা প্রশ্ন করেছে, “রাশেদুল তুমিই বলো, আত্মা কি বন্দীত্ব মানে?”
প্রশ্নটার জবাব রাশেদুল খুঁজলোনা। সে তার চোখের গহীনে একটা সমুদ্রের অস্তিত্ব অনুভব করলো। সেটার তীরভাঙ্গা জল ছিটকে গিয়ে চিঠির খামে পড়লো; ঠিক ওখানটায় যেখানে নীরাপুর লেখা আছে।
একঃ
বেশ আগেই সুতপা ঘুমের বড়ি খেয়েছে; ঘুম আসছেনা। বাইরে বৃষ্টি। শোয়া অবস্থা থেকে ওঠে বসে সে হাটুতে থুতনি রেখে কিছুক্ষণ এটাসেটা ভাবলো। তারপর বিছানা থেকে নেমে কি জানি কী মনে করে বারান্দায় গেলো। বৃষ্টির ঝাপটায় তার গা ভিজে গেছে। কাপড় বদলিয়ে সুতপা আবার বিছানায় গেলো।
নাভিদের কথা মনে পড়েছে।
-এই মাঝরাতে তোমার মেয়ের যন্ত্রণা আমি কেন সইবো?
“আমি” এবং “কেন”র ওপর সুতপা এমন জোর দিয়ে উচ্চারণ করেছে যে, মনে হবে চান সত্যি সত্যি নাভিদের মেয়ে; সুতপার কেউ না। ফোনে সুতপার এই রকম কথায় নাভিদ আগে খুব লজ্জা পেতো। এখন সে উল্টো তাল মিলায়।
-আমার মেয়ে কার পাকা ধানে মই দিয়েছে শুনি? নাভিদ পাল্টা প্রশ্ন করে।
-কাল সার্জারি। ঘুমাতে হবে; ওষুধ খেয়ে শুয়েছি। চোখ লেগেও এসেছিলো; তোমার মেয়ে বিছানায় বসে আমার পা দুটো কোলে নিয়েছে। কেন নিয়েছে সেটা বলতে পারবে?
-না। প্রশ্ন কমন পড়েনাই!
-ওই মাথা নিয়ে কেমনে যে ডাক্তার হয়েছিলে ?! এমন বৃষ্টির রাতে আমাকে ওর সাজাতে ইচ্ছে হয়েছে। চান এখন আমার পায়ে আলতা পরায়।
দুইঃ
বেশ আগের কথা! তাও প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেছে !
ওদের প্রথম কথা হয় চিঠিতে। দুজনই তখন প্রথমবর্ষ উচ্চ মাধ্যমিকের স্টুডেন্ট; দুটি ভিন্ন শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তারপর উচ্চ শিক্ষার জন্য দুজনই নিজ নিজ শহরের বাইরে চলে যায়। নাভিদ মেডিসিনে এবং সুতপা ইকোনমিক্সে। প্রতিদিন বিকেলে দুজনই চিঠির অপেক্ষায় থাকতো। চিঠিতে চিঠিতে প্রায় সাত বছর কেটে যায়; ওরা একবারও দেখা করেনি! দেখা করা অতোটা সহজও ছিলনা।
নাভিদ যখন পঞ্চম বর্ষে ওঠে; সুতপা মাস্টার্স ফাইনাল দিচ্ছিলো। পরীক্ষার মাঝামাঝি সময় সুতপা লিখেছিলে, “কিছুদিন পর থেকে এই ক্যাম্পাস আর সেইভাবে আমার ক্যাম্পাস থাকবেনা। যদি আসতে; তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেখতাম!” সুতপার কথাগুলি সেদিন নাভিদের বুকের ভিতর ঝড় তুলেছিল। কিন্তু জবাব দেয়নি। এরপর যখন বিয়ের কথা পাকা হয় সুতপা তখনও নাভিদকে লিখেছিলো। সেবারও নাভিদ জবাব দেয়নি। অসহায়ত্ববোধ থেকে নাভিদের এক ধরণের অভিমান ছিল; আত্ম-অভিমান! তাই জবাব দেয়নি। তারপর অনিবার্যভাবে সুতপার বিয়ে হয়ে যায়। অচেনা একজনের সাথে।
বিয়ের প্রথম রাতে অনেক হাজবেন্ডের মনের মধ্যে কিছু স্টেরিয়োটিপিক্যাল ভাবনা প্রবল প্রতাপ চালায়। সেজন্য তাদের কমন কিছু প্রশ্ন থাকে; সেই রকম কিছুর মুখোমুখি সুতপাও হয়েছিল। “প্রেম করোনি?” এর উত্তরে স্ট্রেইট “না” বলে স্বামীকে সুতপা নাভিদ সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছিল। কোন রাখঢাক করেনি।
তবুও সুতপার সংসার-জীবন ভালো যায়নি। নাভিদকে নিয়ে স্বামীর সাথে টানাপোড়েন চলে এবং এক সময় সে বাবার বাড়ি চলে যায়। তারপর সংসারটা আর জোড়া লাগেনি। ওদিকে নাভিদ বিয়ে “করে করবে” করে আর করেনি। এরই মধ্যে সুতপা যখন তার স্বামী থেকে আলাদা থাকা শুরু করে তখন ওরা দুজন আরও একটু ঘনিষ্ট হয়। দূর থেকে প্রতিদিন দুজন কথা বলে। তবে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, ওদের কেউ কখনোই একান্ত ব্যাক্তিগত কিছু নিয়ে প্রশ্ন করেনাই। বৈষয়িক কোন কথা ওদের মধ্যে হয়না বললেই চলে। নাভিদ সম্প্রতি একটা স্পেশালাইজড হাসপাতালের শেয়ার কিনেছে-এটাও সুতপা জানেনা। বেশ কবছর ধরে দুজনের ঠিকানা একই শহরে হলেও সামনা সামনি হওয়াকে সুতপা তার হাবভাবের মাধ্যমে নিষিদ্ধ রেখেছে। যে মিষ্টি সময়ে দেখা হতে পারতো সেটার আক্ষেপ তার ভিতর এখনো তীব্রভাবে রয়েছে।
তিনঃ
চান সুতপার একমাত্র সন্তান। ওকে নিয়ে নাভিদের সাথে প্রায়ই সে ফান করে। আজ এখন এই মাঝরাতে যেমন করছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সুতপা আসলে একা; চানের পায়ে আলতা পরানোর কাহিনিটাও সত্য নয়! নিজের অস্থিরতা কাটানোর জন্য নাভিদের সাথে কথা বলার বাহানা ছিল ওটা।
-হ্যালো সুতপা
সুতপার প্রান্ত থেকে জবাব আসেনা। চানকে নিয়ে কথা বলার পর দুজনই কিছুক্ষণ চুপ ছিল। হয়ত সেই ফাঁকে সে ঘুমিয়ে পড়েছে।
রাত বাড়ছিল। শহর জুড়ে তখনো বৃষ্টি। নাভিদ ভাবছিল, ঘুমের বড়ি আর বৃষ্টির ছন্দ এই দুয়ের মিশেলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই সুতপার ঘুম গভীর হয়েছে। টিভি অন করে পরক্ষণেই সে অফ করে দিল। ঘুমের পোশাক পরেছে; বিছানায় যাবে। ঠিক তখনই সুতপা আবার কল দিলো।
-ঘুমের বড়িটা কাজ শুরু করেছে। একটা পুস্তকীয় কথার উত্তর দাও। শুনেই ঘুমিয়ে পড়বো
-বল
-এই মধ্য জীবনকে কিভাবে দেখো? সেখানে আমার অবস্থান কি? অনেস্ট জবাব দিয়ো প্লিজ
এ্যাজ ইউজুয়াল নাভিদ কোন জবাব দেয়না। কোনদিনই সে এমন প্রশ্নের জবাব দেয়নি।
অতঃপর “শুভরাত্রি” বলে সুতপা ঘুমিয়ে পড়ে।
চারঃ
সকালে ওঠে সুতপা দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নেয়। হাসপাতালে যেতে হবে। সে নাস্তা করেনা। “নাথিং বাই মাউথ” থাকার চিকিৎসা পরামর্শ রয়েছে।
সুতপা যখন হাসপাতালে পৌঁছে তখন সকাল নয়টা।প্রেপারেশন চলছে। বিকেল তিনটা থেকে সার্জারি হবে। গলব্লাডার স্টোন অপারেশন। ফরটির পর ফেয়ার ফ্যাটি ফিমেলদের নাকি এই রোগ তুলনামূলক বেশি হয়। সুতপা অবশ্য ফ্যাটি নয়! স্বর্ণলতার মতো দারুণ দেখতে! নাভিদের চোখে সাত আসমানের সবচে বেশি সুন্দর!
মধ্যদুপুরে এক ফাঁকে সুতপা নাভিদের ইনবক্সে নক করে;
-আছো?
পাঁচ মিনিট পর নাভিদ রেস্পন্স করে
-হ্যাঁ। কেমন আছো এখন?
-মনটা কেমন করছে!
-স্থির হও। তুমি খুব ভালো থাকবে। এক কুড়ি আয়ু তোমার বুকের বামে আমি জমা রেখেছি; যদি আমার আগে তোমার সন্ধ্যা নামে—-!
নাভিদের কথায় সুতপা নিজের অন্তরে একটা গভীর সমুদ্রের অস্তিত্ব টের পায়। সেখান থেকে কিছু নোনা ঢেউ এসে তাঁর চোখের দুই দীঘিতে আছড়ে পড়ে।
– জীবনে আজ প্রথম অজ্ঞান হবো। তারপর কি হবে জানিনা। নাভিদ, তোমার আমার তিরিশ বছর মনে রেখো!
জবাবে নাভিদ একটা স্যাড ইমো দেয়।
সুতপা লগ আউট হয়।
পাঁচঃ
আত্মীয় স্বজনদের কেউ কেউ হাসপাতালে এসেছে। হাতে বেশি সময় নাই। মুরুব্বীরা দোয়া পড়ে “ফু” দিচ্ছে। বন্ধুরা কেউ কেউ হাত ধরে বসে আছে।
নাভিদের কথা তাঁর খুব মনে পড়ছে।ওয়ার্ডবয় ট্রলি নিয়ে এসেছে। এখনি যেতে হবে। তার বুকটা হু হু করতে লাগলো। অন্তরে এখন এক নাদেখা আপন; সম্মুখে নাই!
ওয়ার্ডবয় ট্রলি ঠেলছে। সে জানে, এখন নাভিদের দেখা পাওয়ার ভাবনা একেবারেই অবাস্তব! তবুও নিজেকে বুঝ দিতে পারছেনা। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছে, কতো ডাক্তারই তো যাচ্ছে আসছে; যদি সে আসে !?
সবুজ গাউন এবং মাস্ক পরে একজন ওটির দরজা থেকে সুতপার ট্রলি রিসিভ করে ভিতরে নিয়ে গেলো।
সুতপাকে ওটি টেবিলে ওঠানো হয়েছে।
কেউ একজন সুতপাকে বিশেষ মাস্কটা পরিয়ে দেয়।
এনেস্থেটিস্ট হাতের চ্যানেল দিয়ে ড্রাগ পুশ করছে।
সুতপা ক্রমশ জ্ঞান হারাচ্ছে। কিন্তু বুঝতে ভুল হয়নি কেউ একজন পরম নির্ভরতা দিয়ে তার হাতটাকে হাতের ভিতরে নিয়ে নিচ্ছে।
-কে এ এ এ ? প্রায় অজ্ঞান সুতপা টেনে টেনে উচ্চারণ করলো!
-আমি
-তি য়ি.. ব ছ .. প..
(তিরিশ বছর পর)
অদ্ভুত চেহারার এক লোক এগিয়ে এসে বললো,
“সামনে গেলেই রেলস্টেশন; ওইখানে কিছু না কিছু পাইয়া যাবেন!”
ঘড়ি ধরে পাঁচ মিনিট হাঁটলাম;
দেখি স্টেশনে এক বৃদ্ধ ট্রেনচালক পায়ে পা তুলে বেকার বসে আছে।
তাকে বললাম,
“এই ট্রেন, যাবে?”
“কোথায়?”
“অন্তরপুর জংশন।”
সে কিছুক্ষণ মাথা চুলকালো এবং একটু কেশে নিয়ে বললো,
“সোয়া তিন আনা ভাড়া”।
বিরক্ত হয়ে বললাম,‘তিনে না পোষালে চার আনা নাও;
সোয়া তিন কই পাবো বলো?”
আমার কথা শুনে একটা লালদালান থেকে চিৎকার করতে করতে
স্টেশন মাস্টার বের হয়ে বললো, “হবিনে হবিনে; সোয়া তিন আনাই লাগিবে!”
তখন বহির্গমণের কাছে এক রিক্সাওয়ালা চেঁচিয়ে ওঠলো,
“চার আনাতেই যদি যাবেন বাহে হামার রিক্সায় কেন নহে?”
ভেবে দেখলাম, “ঠিকই তো! চার আনাই যদি হয় তবে রিক্সাতে কেন নয়”?
তার কাছে গিয়ে মুচকি হেসে বললাম,
“চলো ভাই রিক্সা, জলদি প্যাডেল মারো”
জবাবে সে বললো,
“ভোর থেকে ডাউন স্টেশনে একটা মালবাহীরিক্সা সিগনালের অপেক্ষায় আছে
ওটা না ছাড়া পর্যন্ত আপনাকে যে দাঁড়াতি হবে”।
রিক্সাচালকের কথায় আমার অস্থিরতা বেড়েছে দেখে
পাশ থেকে অশীতিপর এক বৃদ্ধা বললো, “জন্ম থেইক্যা আমিও দৌঁড়াইতাছি
অন্তরপুর জংশনে যাবো; কিন্তু কিছুতেই কোন কিছু মিলেনা।
এখন নদীরঘাটে যাবো- জলপথে যদি কোন শর্টকাট পাই”!
অতঃপর আমিও ঘাটের পথে রওনা দিলাম;
তার পিছে আমি
তার পিছে শত শত লোক
অযুত লক্ষ লোক
নিযুত কোটি লোক;
গন্তব্য অন্তরপুর জংশন!
ঘাটে পৌঁছেই দরদাম করে একটা নৌকায় উঠলাম;
একজোড়া শালিক নৌকাটার দাড় টানছিল!
শেষ পর্যন্ত অন্তরপুর জংশনে যাচ্ছি- এই ভেবে যখন নিঃশ্বাস ছাড়লাম
হঠাৎ মাথার ওপর কিছু একটা পড়লো অনুভূত হলো!
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, আলোর গতিতে একটা বোয়িং বিমান-
ভিতরে সব বিজনেসম্যান; দল বেঁধে দূরের হাটে মুরগী বেচতে যাচ্ছে।
টকটকে লাল দাঁত বের করে পাইলট আমাকে বললো,
“জনাব মাফ কইরা দিয়েন; পানের পিকটা মিসপ্লেসড হইয়া গেছে”!
পাইলটকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম
কানের কাছে এক ঝাঁঝালো আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলো, “এই চা ইইই গরম”।
চোখ খুলে অবাক হয়ে দেখি, “ট্রেন থেকে শত শত লোক নেমে যাচ্ছে
অযুত লক্ষ লোক নেমে যাচ্ছে
নিযুত কোটি লোক নেমে যাচ্ছে;
এবং যারা নেমে যাচ্ছে
এই স্টেশনেই যে নামবে এক নিঃশ্বাস আগেও তারা তা জানতো না”!
মন অস্থির, মন কাঁদছে, মন বলছে তুমি ভালো নেই !
কিছু কি শেষ হয়ে গেলো? কিছু গেলে তো কিছু থাকে-সেইটুকু নিয়ে ভালো থেকো;
নীলটুকু নিয়ে ভালো থেকো, জলটুকু নিয়ে ভালো থেকো, ভালোটুকু নিয়ে ভালো থেকো
যতোটুকু পারো ভালো থেকো !
মেঘ ডাকছে, আকাশ কাঁদছে, মন বলছে তুমি ভালো নেই !
যেটুকু পড়ে গেছে যাক পড়ে, বাকিটুকু তুলে রেখো-সেইটুকু নিয়ে ভালো থেকো;
বুনোফুল নিয়ে ভালো থেকো, শিশির নিয়ে ভালো থেকো, মরাগাঙ নিয়ে ভালো থেকো
যতোটুকু পারো ভালো থেকো !
নদী কাঁদছে, সুর থামছে, মন বলছে তুমি ভালো নেই !
যেটুকু নিয়ে গেছে যাক নিয়ে, কিছু তো রয়ে গেছে! সেইটুকু নিয়ে ভালো থেকো;
ঘাস ফড়িং নিয়ে ভালো থেকো, মেঘ নিয়ে ভালো থেকো, দু:খ নিয়ে ভালো থেকো
যতোটুকু পারো ভালো থেকো ।
চোখের ভিতর জ্যোৎস্নাছায়ায়
এক ফোটা জল পড়লো যেই
দেখি জ্যোৎস্নাটা নেই !
জ্যোৎস্নাটা কই?
জ্যোৎস্না গেছে মেঘের বাড়ি আকাশ দূরে
মেঘছেড়া জল ফসকে গিয়ে সূর্য পুড়ে !
অণুগল্প বিষয়ে আমি যা জানি বা যা বুঝি আজ সেটা নিয়ে কথা বলবো। তবে তার আগে আধুনিক গল্প নিয়ে একটু বলতে চাই।
আধুনিক গল্পের মূলকথা হলো, “how people respond to life”; অর্থাৎ জীবনের গল্পই আধুনিক গল্প (বড়গল্প, ছোটগল্প, অণুগল্প) যেখানে কোন ভূমিকা বা উপসংহার থাকেনা। কারণ জীবনের কোন ঘটনা ভূমিকা দিয়ে শুরু হয়না এবং তাতে উপসংহার সাধারণত অনুপস্থিত থাকে।
একটা উদাহরণ দেই। দুদিন আগে এক রিক্সাচালক এবং আরোহীর মধ্যের একটা ঘটনা সোশাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়েছে। ওটার অনুকরণে আবার অন্য কাহিনি বানিয়ে সেটা ইউটিউবে আপলোড করা হয়েছে। কাহিনিটা বলি।
“বেশ পথ ট্রাভেল করার পর কম বয়সী এক মহিলা আরোহী রিক্সাচালককে কুড়ি টাকার একটা নোট দেয় এবং দশটাকা ফেরত চায়। চালক বলে, ভাড়া কুড়ি টাকাই। এক পর্যায়ে মহিলাটি উত্তেজিত হয়ে চালকের গায়ে হাত তুলে। রাজধানীর ব্যস্ত এলাকায় দুপুরের দিকের কাহিনি। পথচারীদের কেউ পাশ দিয়ে যেতে যেতে; আবার কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘটনাটা দেখছিল কিন্তু কেউ কিছু বলছিলনা। একপর্যায়ে এক ফেরিওয়ালা এবং তার দেখাদেখি আরও একজন রিক্সাচালকের পক্ষে এগিয়ে আসে।”
ভাইরাল ঘটনা বা অনুকরণে বানানো ঘটনাটার কোন ভূমিকা বা উপসংহার ছিলনা এবং নাথাকাটাই বাস্তব। ওটা নিয়ে লেখা গল্পই আধুনিক ছোটগল্প হতে পারে। এই বিষয়ে একটু বিস্তারিত বলি-
ক) ওটা একক ঘটনা ছিল এবং ঢাকা শহরের একটা রাস্তায় সীমিত সময়ব্যপি ঘটেছে
খ) তিন চারটা চরিত্র থাকলেও রিক্সার আরোহীই মূল চরিত্র যাকে কেন্দ্র করে মূলত ঘটনাটা আবর্তিত হয়েছে। মূল চরিত্র নায়োকিচিত হতে হবে এমন কোন কথা নেই এবং এখানেও সেটাই হয়েছে। মূল চরিত্রটার বাইরে চালক ব্যতিত বাকি চরিত্রগুলি বৈশিষ্টপূর্ণ ছিলনা
গ) সুস্পষ্ট কনফ্লিক্ট (রিক্সার ভাড়া নিয়ে মতদ্বৈততা) আছে যা মূলত আরোহী এবং চালকের মধ্যে (অন্য ঘটনায় মূল চরিত্রের নিজের সাথে নিজের, মূল চরিত্রের সাথে সমাজের বা পরিবেশের সাথেও হতে পারে)
ঘ) ভাইরাল ঘটনাটা নানান জন নানান ভাবে ফেইসবুকে/ইউটিউবে উপস্থাপন করেছে এবং উপস্থাপক তার দর্শন বা ভাবনা (থিম) পাঠকদের মনোজগতে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে।
অতএব, একটা আধুনিক ছোট গল্প লিখার মতো সবগুলি মৌলিক উপাদান (চরিত্র, সেটিং, প্লট, কনফ্লিক্ট এবং থিম) কাহিনিটিতে রয়েছে।
ওপরের ঘটনাটা নিয়ে যে নভেল লেখা যাবেনা এটা যেকেউ মানবে। তবে ওটা আধুনিক ছোটগল্পের জন্য পারফেক্ট যা আগেই বলেছি।
অনেকেই হয়তো বলবে, ওটা অণুগল্পের জন্য সবচে বেশি উপযোগী ঘটনা। কেউ যদি তাই মনে করে আমি তার মতের ঠিক ১৮০ ডিগ্রী বিপরীতে অবস্থান নেব। কেন নেব তার একটা গ্রহণযোগ্য জবাব অণুগল্প নিয়ে আলোচনায় দেয়ার চেষ্টা করবো।
অণুগল্প নিয়ে আলোচনার শুরুতে এর দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার ইচ্ছে ছিল। একটা হল বহুস্বর; দ্বিতীয়টা অণুগল্পের না লিখা অংশ যা পাঠক লেখা অংশের চেয়ে বেশি দীর্ঘসময় ব্যপি পড়ে । দুটি উদাহরণই এই ব্লগে পোস্ট করা “মিডলাইফ ক্রাইসিস” অণুগল্প থেকে নেয়া। যাহোক, উদাহরণ দুটি এনেক্সে দিলাম।
এবার অণুগল্পের মূলকথাগুলি বলে লেখাটা শেষ করি।
বাংলা অভিধানে অণুর প্রতিশব্দ খুঁজলে অ্যাটম, কণা, ছোট ইত্যাদি পাওয়া যায়। এখান থেকে “ছোট” শব্দটা বেছে নিলে অণুগল্প এবং ছোটগল্পের অর্থ একই হয়ে যায়। আসলে অ্যাটম বা পরমাণুর “অণু”ই অণুগল্পের এই অণু। পাহাড় সমান পদার্থকেও ভেঙ্গে ভেঙ্গে সবশেষে যখন অণু (পরমাণু) পাওয়া যায় পদার্থটিকে তখন আর ভেঙ্গে ছোট করা যায়না। একইভাবে বিশাল বড় গল্পকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে যখন আর কোন ভাবেই ছোট করা যায়না তখনই সেটা অণুগল্প হয়। এর মানে দাঁড়ালো, অণুগল্প আসলে বিশাল বড় গল্প যা গতরের সকল মেদ পুড়িয়ে স্বল্পায়তন পায়। আরেকভাবে বললে, গল্পটা অনেক বড় কিন্তু আয়তন খুব ছোট !
তবে অণুগল্প ঈশপের স্বল্পায়তন গল্পের (চূর্ণক) মতো সাধারণ কোন আখ্যান নয়। কারণ আদর্শ অণুগল্পের ক্ষেত্রে স্বল্পায়তন, মেদহীনতা এবং বহুস্বর মুখ্য উপাদান। এছাড়াও গল্প শুরুর চমকের সাথে গল্পজুড়ে রহস্যময়ীতা, মোচড়, বিস্ময়কর পরিণতি অণুগল্পের জন্য জরুরি বিষয়।
অণুগল্পের উপাদানগুলির লিস্ট দেয়ার আগে প্রাসঙ্গিকভাবে আসা একটা শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়নি। ছোট কোন কাহিনি নিয়ে লেখা গল্প কোনভাবেই অণুগল্প নয়। অণুগল্পের পরতে পরতে গল্প থাকে; লেখা অংশের চেয়ে লেখকের নালেখা অংশে পাঠক বেশি গল্প পায় এবং সেই নালেখা অংশটা মুগ্ধ পাঠক সুদীর্ঘ সময়ব্যপি পড়ে।
উপস্থাপনায় একমুখিতা বজায় রাখা অণুগল্পের জন্য খুব জরুরি। নদের মতো একমুখি যা ডান বাম থেকে ধার করে জল নেয়না; একমুখি প্রবাহের সময় ঢেউয়ে ঢেউয়ে জল সম্ভারের কথা জানান দিয়ে যায়। কথায় কথায় নানান ইঙ্গিত দিয়ে লেখক আদতে তার নালেখা গল্পই রেখে যায়।
প্রাসঙ্গিকভাবে কিছু কথা বলিঃ
ক) আগেই বলেছি, ছোট কাহিনি নিয়ে লেখা গল্প অণুগল্প নয়
খ) মেদভরা গল্প অণুগল্প নয় অথবা সেটা লাইফ সাপোর্টে থাকা অণুগল্প
গ) সাধারণ কোন আখ্যান অণুগল্পের মর্যদা পায়না
ঘ) পড়া শেষে পাঠক যদি ক্ষণিক স্তব্ধ নাহয় তাইলে সেটা অতি দরিদ্র একটা অণুগল্প
ঙ) লেখা অংশের চেয়ে লেখকের নালেখা অংশে যদি কম গল্প থাকে তাইলে সেই অণুগল্প রক্ত স্বল্পতায় ভুগতে ভুগতে স্বল্পায়ু হয়ে যায়
চ) কাব্যিক উপস্থাপনা অণুগল্পের মর্যদা মারাত্মকভাবে কমিয়ে দেয়!
বিগ ব্যাঙ্গের আগে বিশ্বটা একটা গোলমরিচের সমান না হলেও তারচে খুব বেশি বড় ছিলনা। অণুগল্পও আসলে বিগ ব্যাঙ্গের আগের রুপ যার ভিতরে এই বিশ্বের সমান একটা গল্প থাকে।
বিশ্বের সমান বলে বোধকরি একটু বেশিই বলে ফেললাম। তবে খুববেশি “বেশি” বলিনাই।
——————-
এনেক্সঃ বহুস্বর এবং অণুগল্পের নালিখা গল্পের উদাহরণ
উদাহরণ একঃ
“-আমি স্কুলটার ওইখানে থাকমুনি; তুমি আইসো। আসবা তো সিতারা বেগম? মোত্তালেব মিয়া ফিস ফিস করে জানতে চায়।
-পুরা সাতশ টাকা লাগবো! ঠোঁটের কোণে হাসি মেখে সিতারা বেগম জবাব দেয়।
অল্প দূরে থাকা ছেলেগুলোর দলনেতা খুব নিচুস্বরে বলে,
-জানস তোরা ওই বেটি কেডা?
-তিন নাম্বার দাদি? ছেলেগুলির একজন উল্টা প্রশ্ন করে।
-ওই রকমই। আগের মরা দাদিটা লাল পরী হইয়া ফিরা আইছে। দাদারে আদরও করতে পারে; আবার ঘাড় মটকাইয়াও দিতে পারে।
দলনেতার শেষ মন্তব্যে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে এবং একসাথে উল্টা পথে দৌড় দেয়”।
ব্যাখ্যাঃ
মূলগল্পে মোত্তালেব মিয়াকে ছেলেগুলির দাদা হিসেবে দেখানো হয়েছে। দলনেতার নিচুস্বরের প্রশ্ন বহুস্বরের সূচনা করেছে। একপর্যায়ে দলনেতার কথায় ছেলেগুলির সবাই “হো হো করে হেসে ওঠে”। দলনেতা যা ভেবেছে দলের অন্যদের কেউ হয়তো সেটাই; আবার কেউ হয়তো ভিন্ন কিছু ভেবে হেসেছে। “জানস তোরা ওই বেটি কেডা?”এই জানাটার বহুমুখিতাই হলো বহুস্বর। যেমন- সম্ভাব্য তিন নাম্বার দাদি, মৃত প্রথম দাদির পরী হয়ে ফিরে আসা, নিষিদ্ধ নারী, অন্য যেকোন নারী যে ছেলেগুলির দাদার জন্য ভয়ংকর হতে জেনেও তাদের দাদা (মোত্তালেব)মহিলাটার কাছ ছাড়ছেনা। ভাবনার এইসব বহুমুখিতা এই গল্পের বালক চরিত্রগুলোর বহুস্বরের একটা উদাহরণ হতে পারে।
ওপরের উদাহরণটার একাংশ রিপিট করে আরো একটু বলি,
“-তিন নাম্বার দাদি? ছেলেগুলির একজন উল্টা প্রশ্ন করে।
-ওই রকমই। আগের মরা দাদিটা লাল পরী হইয়া ফিরা আইছে” ।
মিডলাইফে একজন মোত্তালেবের পরিবর্তিত মনোজগতের বড়সর একটা গল্পের ইঙ্গিত আছে দ্বিতীয় লাইনে। গল্পটা হলো, অভ্যস্ত নারীর (স্ত্রী) প্রতি অনাসক্তি এবং নিষিদ্ধ নারীকে লাল পরীর মত লাগার সাইকোলজি যা মিডলাইফ ক্রাইসিসের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ।
উদাহরণ দুইঃ
“সিতারা বেগম বেশ অনুভব করে, যতদিন শরীর আছে তার নিজের ভিতর হেমিলনের বাঁশিওলার একটা অস্তিত্ব আছে যা মোত্তালিব মিয়ার রক্তস্বল্পতায় ভোগা কিশোরী বউটার মধ্যেও নাই! তাই তার পেছনে শিমুলিয়া গ্রামের এই মধ্যবয়সী পুরুষটা দৌড়াচ্ছে আর হাঁফাচ্ছে; হাঁফাচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে”!
ব্যাখ্যাঃ
গল্পের এই অংশটা নিয়ে নানান পাঠকের নানান কিছু ভাববার সুযোগ আছে। ঘরের কিশোরী স্ত্রী নয় বরং অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সী এক নিষিদ্ধ নারীর হাতে মোত্তালেব মিয়া হেমিলনের যাদুর বাঁশীটা দেখে। কেন? উত্তর হয়তো অনেকগুলি; একেকজনের একেক রকমের ভাবনা। সেই ভাবনাগুলি এইরকমঃ এটা নয়, ঐটা; না ঠিক ঐটাও নয় ভিন্ন কোন কিছু। এই অণুগল্পে বিষয় ভিত্তিক বহুস্বরের একটা উদাহরণ হিসেবে এটাকে বিবেচনা করা যেতে পারে।
এছাড়া শেষ লাইনেই মিডলাইফ ক্রাইসিসের কোটি মানুষের হাজারো গল্প আছে।
“দৌড়াচ্ছে আর হাঁফাচ্ছে”; কেন দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁফাচ্ছে?
“হাঁফাচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে”; কেন হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়াচ্ছে?
মোত্তালেব মিয়া তার অভ্যস্ত স্ত্রীতে ক্লান্ত হয়ে দৌড়াচ্ছে? অভ্যস্ত স্ত্রী থেকে পালাতে পালাতে হাঁফাচ্ছে? যাইই হোকনা কেন এসবই নালেখা গল্পের ইঙ্গিত। কারণ এই ক্রাইসিসে যতো উপসর্গ হয় সেগুলো নিয়ে লেখা হাজারো গল্প ধারণ করতে পারে শেষ লাইনটা।
ইসমাইল চাচা পুঁথি পাঠ শুরু করলেন,
“তারপর কিনা কাজ করিয়া তো হান্না,
আশি মন পেশাব করে বিবি সোনাভান্না”।
বন্ধু শফিকের মিরপুরের বাড়িতে পুঁথি পাঠ হচ্ছিল। গ্রাম থেকে আসা ওর ইসমাইল চাচা যখন তার কন্ঠে একটা ঝাঁকি মেরে পাঠ ধরলেন কী যে দারুণ একটা চমক অনুভব করলাম তা বলে বুঝাতে পারবোনা! এখন বুঝি, চমক দিয়ে এই শুরু করাটা সাহিত্যের কোন কোন শাখার জন্য একটা জরুরি অনুষঙ্গ। যদি কোনদিন আবার পুঁথিপাঠ শুনতে পাই তখন আমি উত্তর খুঁজবো, পুঁথি কী সাদামাটা আখ্যান?
আখ্যান কি? এটা সম্পর্কে আমি যা জানি বলা দরকার। তবে তার আগে অন্য একটা বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলি। এটা শফিকের বাড়িতে পুঁথিপাঠ উপভোগের বেশ পরের কথা। তখন টিফিন এবং অন্যান্য খরচের জন্য বড় ভাই আমাকে প্রতিদিন পাঁচ টাকা করে দিতেন। সেখান থেকে দেড় দুই টাকা করে বাঁচিয়ে পঞ্চাশ ষাট টাকা জমলে তা দিয়ে নানান কিছু করতাম। ফুটপাথ থেকে সস্তায় বই কেনা এর অন্যতম। একটু বেশি টাকা জমলে সমরেশ মজুমদারের সাতকাহনের মতো নভেল, মাঝে মধ্যে হূমায়ুন আহমেদ, এমনকি দিব্যি মনে আছে একদিন মিরপুরের ফুটপাথ থেকে ঈশপের গল্পের বইও কিনেছিলাম। ওসবে অন্যরকম আনন্দ পেতাম। তবে বলে নেই, ঈশপের গল্প পড়ে আমি হতাশ হয়েছিলাম। অল্প কয়েক লাইনের একেকটি গল্প; পুঁথি পাঠে যে চমক ইসমাইল চাচা দিয়েছিলেন তাও ঈশপে খুঁজে পাইনাই।
যাহোক, নিচের কয়েকটা বিষয়ের ওপর অল্প করে কিছু কথা বলে নিতে চাই-
ক) ইসমাইল চাচার পুঁথি পাঠে শুরুর চমক
খ) হূমায়ুন আহমেদ এবং
গ) ঈশপের গল্প।
উল্লেখিত বিষয়গুলি আমার এই লেখার পরের অংশে আসবে। দ্বিতীয় পর্বে ফোকাস থাকবেঃ অণুগল্প!
চমক দিয়ে শুরু করা এবং পাঠককে স্তব্ধ করে দিয়ে ঠিক সময়ে থামতে জানা সাহিত্যের অনেক শাখার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তা সে কবিতা হোক, ছোটগল্প হোক; অণুগল্পের জন্য তো এটা অতি অবশ্যই প্রযোজ্য।
সাতকাহন কয়শ পাতার নভেল? মূল চরিত্রের নাম কী দীপাবলি? এসব কিছুই আর তেমন ভালো করে স্মরণে নেই। তবে নভেলটার আবছা আবছা স্বাদ মনে লেগে আছে। সম্পূর্ণ জীবনের ছবি আছে ওই সাতকাহনে। হূমায়ুন আহমেদেও সেই ছবি থাকে; কিন্তু যে কয়টি হূমায়ুন আহমেদ তখন পড়েছিলাম তাতে সাতকাহনের সেই “মনে লেগে থাকা স্বাদটা” আমি পাইনি। আমার মনে হয়েছে সাতকাহনে বানানো জগৎটা যেকোন পাঠকের নিজেকে হারিয়ে ফেলার জন্য পরিপূর্ণ একটা জগৎ।
সম্ভবত কমবেশি একশ পাতার কয়েকটা হূমায়ুন পড়েছিলাম আমি। ওপরে আমি তাই “হূমায়ুন আহমেদের নভেল” বলিনি; শুধু “হূমায়ুন আহমেদ” বলেছি। কারণ সাতকাহন যে একটা নভেল এটা নিশ্চিত হলেও হূমায়ুন আহমেদের সেই লেখাগুলি (আমি যেগুলি পড়েছিলাম; নাম মনে নেই) নভেল নাকি নভেলা আমি নিশ্চিত হতে পারিনাই; পারছিনা অথবা আমার সেই জ্ঞান নাই।
যাহোক, নভেল বা নভেলা আমার লেখার মূল বিষয় নয়। মূল লেখায় যেতে আমার একটু সময় লাগবে। কালকে? জানিনা! পরশু বা অন্য কোনদিনও হতে পারে।লেখার জন্য একটা ডিভাইস হাতে পেলে কালই হবে হয়ত।
এই ফাঁকে আখ্যান বা আখ্যানক সম্পর্কে একটু বলি। আখ্যান হলো গল্পের প্লট, কাহিনি বা বিষয়বস্তু। এটাকে কোনও একটি ঘটনার বা সম্পর্কযুক্ত একাধিক ঘটনার সমন্বিত বর্ণনা বলা যেতে পারে। এতে সাহিত্যের নানান মশলা যেমন এলাচ, জিরে, তেজপাতা, পাঁচফোঁড়ন মিশিয়েই তবে গল্প বা অণুগল্প করা যায়। সহজ করে বললে, আখ্যান হল ছোটগল্প এবং অণুগল্পের ইমিডিয়েট আগের রুপ।
ওপরে আমি ঈশপের গল্পের কথাও বলেছি। কয়েকশ বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে বেঁচে থাকা ছোট ছোট কাহিনি এই ইশপের গল্প। মুখে মুখে বেঁচে থাকা সাহিত্যের এই ভাগটাকে চূর্ণক বলে।
যেহেতু এই লেখার ফোকাস অণুগল্প; তাই চূর্ণক সম্পর্কে একটু বলে নিলাম। কারণ আধুনিক অণুগল্পের আদিরূপের সন্ধান পাওয়া যায় এই চূর্ণক-আখ্যানকের ভাজে ভাজে।
প্রশ্ন ওঠতেই পারে, অণুগল্প নিয়ে কেন মাতামাতি করছি? স্ট্রেইট-কাট উত্তর দেই, স্বল্পায়তনের সাধারণ আখ্যানকে ভুলে অণুগল্প ভেবে আমরা অহরহ ঠকি!
হুসেইন জালালী নিজেও জানতেননা, কেন তিনি এঘর-ওঘর পায়াচারি করছিলেন! একটু পর তার মনে হল, গত দুই দুইটা শুক্রবার মুরগীর ফেরিওয়ালা আসেনি এবং অবিশ্বাস্য হলেও সেটাই সম্ভাব্য কারণ। এই ফেরিওয়ালা নিয়ম করে প্রতি শুক্রবার সাড়ে ৮ টা থেকে সাড়ে ৯ টার মধ্যে আসে। দুজনে ফেরি করে; নানার সাথে নাতি। নানা হাঁকছাড়ে, “মুর—গী–ইই—-“। নানা যখন “মুর-গী-ইই”র “ইই”তে আসে তখন তার নাতি সেটা ক্রিকেট খেলায় বল ক্যাচের মতো করে ধরে ফেলে এবং চিকন কণ্ঠে সুর তুলে, “এই-ই মুর-গী– ইই…”।
এটা সত্য যে, হুসেইন জালালী নিজেও বুঝে ওঠতে পারছেননা ওদের জন্য আজ তাঁর অস্থির লাগছে কেন! এইতো তিন চার মাস আগেও ওদের হাঁক শুনে যখন শুক্রবারের সকালের ঘুম ভেঙ্গে যেত তাঁর ইচ্ছে হতো পুলিশে খবর দিতে। তারপর এক শুক্রবার বারান্দায় গিয়ে ওদেরকে দেখে জালালীর ভিতর এক ধরনের অদ্ভূত অনুভুতি হয়। দোতলা থেকে সে নিচে নেমে গিয়ে ওদের সাথে রীতিমত গপসপ শুরু করে দেয়। প্রয়োজন ছিলনা তবুও সেদিন সে এক হালি মুরগি কিনে। সেই থেকে গত তিন চার মাস হল প্রতি শুক্রবারেই এটা হচ্ছে; গপসপ এবং মুরগী কেনা। আজব কিসিমের লোক এই জালালী। অতি মেধাবিদের কেউ কেউ নাকি এমন হয়!
ইতোমধ্যে হুসেইন জালালীর সাথে ওদের বেশ সম্পর্ক হয়ে গেছে। অনেক কিছুই শেয়ার করা হয়েছে। লোকটার নাম সুরুজ আলী। বাসা বেশি দূরে নয়। সে মূলত একজন স্যানিটারি মিস্ত্রী। টুকটাক ইলেক্ট্রিক যন্ত্রপাতি মেরামতও জানে। এসবের বাইরে বাড়তি রোজগারের জন্য এটা সেটা করে। প্রতি শুক্রবারে মুরগী ফেরি এর মধ্যে একটা।
হুসেইন জালালী ভাবলো, “বেশি দূরে তো নয়; ওদের খোঁজ নিয়ে আসি”। যেই ভাবা সেই কাজ। একটু বাড়াবাড়ি মনে হলেও সে সুরুজ আলীর খোঁজ নিতে বের হয়ে গেলো। বের হবার আগে দরজার কাছে একটু থেমে গালে হাত দিয়ে ভাবলো, “শেইভ করে যাই”। পরে কোনকিছু না করেই যে অবস্থায় ছিল সেভাবেই বের হল।
সুরুজ আলীর বাসা খুঁজে পেতে তেমন বেগ পেতে হলোনা। আসলে সুরুজের অন্যরকম জীবন যাপন সম্ভবত অনেকের চোখে পড়ে। দরজায় কড়া নাড়তেই কমবেশি চল্লিশ বছরের এক মহিলা কপাট খুলে দাঁড়ালো।
-এটা তো সুরুজ আলীর বাসা, তাইনা?
-জী। আপনি?
-আমি হুসেইন জালালী; উনার বন্ধু! সুরুজ বাসায় আছেন?
জালালীর নাম শুনে মহিলাটার চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো। “মনোমা, ও-ও- মনোমা, জলদি এসো” বলে সে চিৎকার করে তার মাকে ডাকলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ষাটোর্ধ এক মহিলা এলেন। পরনে পরিপাটি নীলরঙা সুতি শাড়ি, খোঁপায় সাদা ফুলের মালা এবং কপালে বড় লাল টিপ। সালাম দিয়ে জালালী নিজের নাম বলতেই মহিলা খুব বিনয়ের সাথে ভিতরে প্রবেশের জন্য অনুরোধ করলো। জালালীকে বসতে দিয়ে সে তাঁর স্বামীকে মোবাইলে কল দিলো।
-এই চানের বাপ, অধ্যাপক জালালী এসেছেন। তোমার ফিরতে আর কতোক্ষণ?
জালালী সহজেই বুঝতে পারলেন তাকে নিয়ে ওদের মধ্যে কথা হয়। নইলে সুরুজের স্ত্রী তাঁর নামের আগে “অধ্যাপক” কথাটা যোগ করতোনা।
-উনাকে বসতে অনুরোধ কর। আমি বাসার কাছে চলে এসেছি।
সুরুজ ওর স্ত্রীকে জবাব দিল।
কয়েক মিনিটের মধ্যে চল্লিশ বছরের মেয়েটা এক গ্লাস সরবত নিয়ে এসে জালালীর পাশে বসলো। সরবতের গ্লাস উনার হাতে দিয়ে সে নিজের পরিচয় দিল।
-আমি জেবুন্নাহার চান। বাবা মা আমাকে চান নামেই ডাকে। বাবার সাথে যে বালকটা শুক্রবার দিন আপনাদের ওদিকে যায় সে আমার ছেলে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। ওর বাবা নেই। আমি একটা কিন্ডারগার্টেনে পড়াই এবং টিউশনি করি। বাবা আপনার কথা খুব বলেন। শুনেছি আপনি দেশি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান।
এরপর এক বাটি কুলি পিঠা নিয়ে চানের মা এলেন।
-সুরুজ শীতের পিঠা বেচতে সংসদ ভবন এলাকায় গিয়েছিল। এখন ফিরছে; আর কয়েক মিনিট লাগবে
-সমস্যা নেই; আসুক। বলে জালালী পিঠা খেতে শুরু করলেন।
পিঠা খাচ্ছিলেন আর ভিন্ন এক দৃষ্টি নিয়ে সুরুজের বউকে জালালী খেয়াল করছিলেন। আফ্রিকার কিছু নৃগোষ্ঠী নিয়ে জালালীর কয়েকটি রিসার্চ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। তাকে এথনোগ্রাফি স্টাডির পাইয়োনিয়ার বলেন অনেকেই। চানের মার চলন, বলন, হাসি, অন্যান্য এক্সপ্রেশন এবং সামগ্রিক ব্যাক্তিত্ব জালালীর কাছে ভীষণ ভিন্ন এবং উচ্চমার্জিত মনে হয়েছে। এসব খেয়াল করার সাথে আফ্রিকার নৃগোষ্ঠীর মানুষদেরকে জালালীর পর্যবেক্ষণের মধ্যে উদ্দেশ্যগত একটা মিল আছে।
পিঠা খাওয়া শেষ না হতেই সুরুজ আলী ঘরে প্রবেশ করলো। এমন বিশাল মানুষ তার বাসায় আসবেন সুরুজ আলী ভাবতেই পারেনি। টুকটাক কিছু কথা বলে সে ওয়াশরুমে ঢুকলো। বের হয়ে এসে গামছায় হাত মুখ মুছতে মুছতে সে জালালীর কাছে এলো।
-দুপুরের খাবারের দাওয়াত দিলে গ্রহণ করবেন? সুরুজ জানতে চাইলো
-খুব গ্রহণ করব।
মিষ্টি হেসে হুসেইন জালালী জবাব দিলেন।
সুরুজের গোটা পরিবারকে একটু গভীরভাবে দেখার অদ্ভূত উদ্দেশ্য জালালীর মধ্যে এখন নতুন করে ঢুকেছে। তাই সানন্দে দুপুরের খাবারের দাওয়াত সে গ্রহণ করলো।
বেশ পেছনের কিছু কথা। চানের মা এবং সুরুজ একই স্কুলে পড়তো। সুরুজ নিচের ক্লাসে। ঠিক প্রেম নয় কিন্তু খুব ভালোলাগা কাজ করতো দুজনের মধ্যে। মেট্রিক পাশ করার পরপরই মেয়েটার (চানের মা) বিয়ে হয়ে যায়। এতে সুরুজ খুব ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতে পারেনি। সামাজিকভাবে সেটা তখন গ্রহণযোগ্যও ছিলনা। যাহোক, বিয়ের আড়াই বছরের মাথায় তার জমজ মেয়ে বাচ্চা হয়। এতে তার শ্বশুর, শাশুড়ি এমনকি স্বামীও অসন্তুষ্ট হয়। ওরা বাঁচেনি। এরপর যখন জেবুন্নাহার জন্ম নেয়, ওরা খুবই নাখোশ হয়। এর ছয় মাসের মাথায় তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে। তাদের ছেলে সন্তান চাইই চাই। সতীনের ঘর করতে চানের মা সব কিছুই সয়ে যাচ্ছিল।কিন্তু একটা পর্যায়ে যখন আর পেরে ওঠা সম্ভব হচ্ছিলনা তখন ডিভোর্স নিয়ে সে তার বাবার বাড়িতে চলে যায়। ততোদিনে সুরুজ আইএ পাশ করে স্যানেটারী মিস্ত্রী হিসেবে বেশ ভালো রোজগার করছিল। চানের মায়ের সাথে সুরুজ মাঝে মধ্যে দেখা করতো। বিয়ের প্রস্তাবও দেয়। চানের মা রাজি হয়না। সে ভাবে জীবিত-মৃত মিলিয়ে তিন সন্তানের মায়ের প্রতি এটা সুরুজের আবেগ; প্রেম নয়। তার বদ্ধ ধারণা ছিল, সুরুজের এই ভালোলাগা বেশিদিন থাকবেনা।
যাহোক, এক পর্যায়ে ওদের বিয়ে হয়। সেই থেকে আজ প্রায় তেত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে। ওদের টিনশেড বাড়িতে এখন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপক হুসেইন জালালী!
ইতোমধ্যে দুপুরের খাবার প্রস্তুত হয়ে গেছে। ভাতের সাথে ডাল ভর্তা এবং ডিম ভাজি। তার আগে জমিয়ে আড্ডা হয়েছে। এতে চান বেশ স্বতঃস্ফূর্ত ছিল। কথায় কথায় তাদের মধ্যে অনেক কথা হয়েছে। বাবা মার অনুপস্থিতিতে এক ফাঁকে চান একান্ত কিছু কথা অধ্যাপক হুসেইন জালালীর সাথে শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারেনাই।
-উনি আমার জন্মদাতা পিতা নন সেটা কী আপনি জানেন স্যার?
-হ্যাঁ, অধ্যাপক জালালী মৃদু স্বরে জবাব দেন
-উনার, উনাদের একান্ত কিছু কথা আমার লিখতে খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু আমার লেখার হাত ভালো নয়। কথাগুলি আপনাকে বলি?
-খুব বেশি একান্ত না হলে বল
-বিরক্ত করবোনা। খুব সংক্ষেপে কিছু কথা বলছি স্যার। বাবা প্রতিদিন সকালে মাকে বিছানা থেকে পিঠে করে নিয়ে ওয়াশ রুমে যায়। ব্যাকরাইড আর কি। সেখানে মাকে গোসল করিয়ে গা মুছে দেয়। তারপর মা যখন নীল সুতির শাড়ি পরে তখন বাবা শাড়ির ভাজ ধরে থাকে। চুল শুকিয়ে গেলে সে নিজ হাতে মার খোঁপায় সাদা ফুলের মালা এবং কপালে বড় একটা লাল টিপ পরিয়ে দেয়। মাকে এখন যেভাবে আপনি দেখছেন আসলে এভাবে না রেখে বাবা কোনদিনই বাইরে কাজে যায় না। গত তেত্রিশ বছর যায়নি। সন্ধ্যা হলে আমার মায়ের পা দুটো কোলে নিয়ে বাবা যখন আলতা পরিয়ে দেয় তখন আমার এই বাষোট্টি বছরের মায়ের চোখ ভিজে যায়। তেত্রিশ বছর ধরেই তার চোখে এই জলের নিত্য আসা যাওয়া; একদিনের জন্যও সেই জলের ভাটা হয়না।
কথাগুলি বলে চান ওর চোখ মুছে। অধ্যাপক জালালী কনফিউজড হয়ে যান, বাস্তবে কী এমন রোমান্টিক মানুষ আছে?! কিন্তু চানের কথা এবং এক্সপ্রেশনে জালালী অতিরঞ্জিত কিছু খুঁজে পাননা। তিনি বিশ্বাস করেন এবং মুগ্ধতা নিয়ে চানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
ইতোমধ্যে সুরুজ আড্ডায় যোগ দিয়েছে।
-পর পর দুই শুক্রবার দেখিনাই তাই আপনার খোঁজ নিতে এসেছিলাম। এসে ভালোই হয়েছে। স্বর্গের বাড়ি যে আসলে টিনশেড দুইকক্ষের সেটা নিজ চোখে দেখে গেলাম। অধ্যাপক জালালী মন্তব্য করলেন!
প্রতি জবাবে সুরুজ কিছু বললোনা। কিন্তু অমন বিশাল ব্যাক্তির স্বীকৃতি পেয়ে ভিতরে ভিতরে সে খুব আনন্দিত হল।
-স্যার, মনলতা পড়েছেন? কবিতা, গল্প সব মিলিয়ে এপর্যন্ত শতাধিক লেখা প্রকাশিত হয়েছে যেসবের কেন্দ্রে মনলতা চরিত্র।
চান অধ্যাপক হুসেইন জালালীকে প্রশ্ন করলো।
-কয়েকটা পড়েছি। জালালী জবাব দিলেন।
-ছদ্মনামের ঐ লেখক আমার এই ফেরিওয়ালা বাবা। ওসবই আমার মনোমাকে নিয়ে লেখা।
কথাটা বলেই সুরুজের বুকে মাথা রেখে স্টেপ ডটার চান চোখ বন্ধ করলো।
“আজ আসি” বলে হুসেইন জালালী দ্রুত বের হয়ে গেলেন; ফেরিওয়ালার পরিবারের জন্য তাঁর চোখের রংধনু-জল পাছে কোন ঈশ্বর দেখে ফেলেন!
-বাচ্চারা কথা বলোনা। এক বাবা ছেলের গল্প বলি; মন দিয়ে শুনো। ছেলেকে তার বাবা খোকা বলে ডাকতো। খোকা দেশের বাইরে থাকতো আর বাবা তার ছেলের বউ এবং নাতীদের সাথে দেশে।
রফিক নিয়াজ ড্রয়িং রুমে তার পরের দুই প্রজন্মকে গল্পটা শুনাচ্ছিলেন। সপ্তাহে কয়েকবার পরিবারের ছোট বড় সবাইকে নিয়ে তিনি এই রকম আড্ডার আসর বসান। কখনো কখনো সেটা সিরিয়াস হয়ে যায়। তখন তা পারিবারিক পাঠশালায় রুপ নেয়।
“বাবার নাম আহমেদ সুরুজ”; রফিক নিয়াজ আবার গল্পটা শুরু করলেন;
-কিছু কথা বাচ্চারা তোমাদের জন্য কঠিন লাগবে। তবুও শুনো। মানুষে মানুষে চিন্তার ভিন্নতা থাকে । কিন্তু নৈতিক কিছু বিষয় আছে যা মূল্যদিয়ে বোধের ভিতর রাখতে হয়; যাকে সবাই মূল্যবোধ বলে ! সেখানে সম্ভবত খুব বেশি ভিন্নতা থাকতে নেই ! আহমেদ সুরুজ সব সময় সেই মূল্যবোধগুলো মেনে চলার চেষ্টা করেছেন এবং আদরের খোকাকেও তা আজীবন বলে এসেছেন ! গল্পটার মোরাল আসলে মূল্যবোধ এবং কাল-পাত্রভেদে এর উপলদ্ধি নিয়ে !
কথাগুলি বলে রফিক নিয়াজ একটু দম নিলেন। ইতোমধ্যে ফজলের মা চা নিয়ে এসেছে। এক কাপ হাতে নিয়ে তিনি আবার গল্প শুরু করলেন।
-নিজ ঘরের লোকদের মুখোশের আড়ালে অশোভন আচরণ সুরুজকে বিষন্ন করতো ! ঘর মানে ছেলের এবং নাতিদের নিয়ে সংসার। তার মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক অশোভন আচরণ নিয়ে তিনি তেমন উচ্চবাচ্য করেননি ! কিন্তু তার এই বিষন্ন অভিব্যাক্তিতে ছেলের বউ খুব অসন্তুষ্ট হলো ! অতঃপর সুরুজ ঘর ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে চলে গেলেন !
পরদিন খোকার ফোন এলো ।
-বাপু, তুমি ঘর ছেড়ে চলে গেছো?
-হ্যাঁ রে, একটু একা থাকি
-তুমি ঘর ছেড়েছো তাতে কার কী ? তোমার নিজেরই কষ্ট !
খোকার এমন অনাকাঙ্খিত কথার কোন জবাব তিনি দিলেন না ! খোকা ফোন রেখে দিলো ! খোকার অজ্ঞতাকে তুচ্ছ করে তিনি মৃদু হাসলেন !
কথা শেষ করে সুরুজ বৃদ্ধাশ্রমে তার বিছানায় ফিরে গেলেন ! অ্যালবাম খুলে খোকার সাথে তার ছবি গুলোতে হাত বুলিয়ে দিলেন ! অ্যালবামটা তার কাছে শুধু দুজন মানুষের ছবির নয়; দুজনের একটা বিশাল জগৎ যেনো !
সুরুজ মাঝে মাঝে ডায়েরি লিখেন ! চশমটা চোখে নিলেন ! ওতে তেমন পরিষ্কার দেখেননা ! প্লাস ১.৫; বেশ লম্বা সময় হলো বদলানো হয়নি ! ডায়েরিতে তিনি কিছু লিখলেন !
-ওটা শুধু পুরুষদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম ছিল? রফিকের ছোট ছেলের বউ জানতে চাইলো
-না, মহিলাদের জন্যও। মহিলাদের অংশটা বি-ব্লকে। এ এবং বি ব্লকের মাঝখানে বাগান। মূলত ফুলের বাগান; তবে কিছু সবজিরও। সুরুজ বিশেষ করে বিকেল বেলায় ওখানে যেতো। ফুল গাছের যত্ন করতো; এতে তার ভালোই সময় কেটে যেতো। মাঝে মধ্যে অবশ্য খোকার কথা মনে করে তার মন ভার হতো।
-পুরুষ এবং মহিলাদের মধ্যে বিশেষ কোন রেস্ট্রিকশন ছিল? ছোট ছেলের বউ ফলোআপ প্রশ্ন করলো
-প্রায় সব মহিলার সাথেই সুরুজ কমবেশি কথা বলতো। তাদের একজন মনোরমা নাভিদ। তিনি মিতভাষী এবং প্লিজেন্ট পারসোনালিটির অধিকারী। তাঁকে দেখলেই সুরুজের জানতে ইচ্ছে করতো, তিনি দিলারা জামানের বোন কিনা? অদ্ভুত মিল; বয়স সত্তুর প্লাস। কিন্তু কেন জানি জিজ্ঞাসা করা হয়নি। তবে ইতোমধ্যে দুজন দুজন সম্পর্কে বেশ কিছু কথা জেনে গেছে। খোকা তার বাপের খোঁজ নিতে ভুলে গিয়েছিল বটে। তবে সুরুজ বিকেলে বাগানে গেলেই মনোরমা বের হয়ে আসতো। রাতে ঘুম হয়েছে কিনা, সকালে ব্লাড প্রেসারের ওষুধ খেয়েছেন কিনা জিজ্ঞাসা করতেন এবং একটা ছোট কাগজে বড় করে “রাতের ওষুধ খাবার সময়ঃ সাড়ে ৯টা” লিখে দিতেন। যাতে ওষুধ খেতে ভুলে না জান।
-তারপর? দু’তিন জন একসাথে প্রশ্ন করলো
-তারপর বিশেষ কিছু নেই। একদিন হঠাৎ করে আহমেদ সুরুজ মারা গেলেন । সবাইকে খবর দেয়া হলো । স্বজন-বন্ধুরা এলো ! খোকা আসতে পারেনি ! পুরনো চশমা এবং ডায়েরিটা সুরুজের ঘনিষ্ট এক বন্ধু বৃদ্ধাশ্রমের কর্তৃপক্ষ থেকে গ্রহণ করলেন !
-চশমা এবং ডায়েরিটা সুরুজের বন্ধু কেন গ্রহণ করলেন? ছোট ছেলের বউ জানতে চাইল
.-উত্তরটা আমার জানা নেই।কেবল ধারণা করতে পারি।
-তারপর? সুরুজের ছোট ছেলে প্রশ্ন করল
-প্রায় দেড় দশক পরের ঘটনা ! খোকা দেশে ফিরে এসেছে । এখন সেও তেমন ভালো নেই ! বয়স হয়েছে ! ঘরে শান্তি নেই ! সে এখন না ঘরের; না পরের ! বাপুর কথা তার খুব মনে পড়ে ! খোকা একদিন একটা ফোন কল পেয়ে বাপুর সেই ঘনিষ্ট বন্ধুর কাছে গেলো ! তিনি ডায়েরি এবং চশমাটা খোকার কাছে হস্তান্তর করলেন ! ঘরে এসে খোকা ডায়েরিটা পড়তে শুরু করলো ! তুমি তুই মেশানো শেষ নোটটায় লেখা আছে, “বুকের ধন আজ তোর ফোন পেলাম ! বললে, তুমি ঘর ছেড়েছো তাতে কার কী, তোমার নিজেরই কষ্ট “! নারে খোকা ঘর ছাড়তে আমার কোন কষ্ট হয়নি ! এটাকে আমার প্রতি তোর তাচ্ছিল্য না বলে তোর বোধের ঘাটতি বলতে চাই । যেদিন জন্ম নিয়েছি সেদিনই তো দুনিয়া ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি ! ঘরতো দুনিয়ার তুলনায় অতি ছোট্ট একটা জায়গা! তবে যা ছেড়ে এসেছি তা উপলদ্ধি করার তোমার ক্ষমতা তোমারই ঘরের মানুষের হাতে বন্দি হয়ে আছে।
ডায়েরি পড়া শেষ করে খোকা অ্যালবামের পাতা উল্টাতে লাগলো ! বাপুর সাথে ঘটনাবহুল ছবিগুলো আগে কখনো দেখেছে কিনা খোকা মনে করতে পারলোনা ! প্রতিটা পাতায় তার চোখের জল টপটপ করে পড়লো! বাপুর চশমাটা খোকা চোখে নিলো ! পাওয়ার মিলছেনা । তবু সে কিছুক্ষণ রাখলো! চশমাটা দিয়ে সে অশোভন স্বভাবের অশ্লীল মনুষগুলোকে স্পষ্ট দেখতে পেলো ! আর সেই বিশাল জগৎটা যা তার বাপু তার জন্য নিজের জীবন বেচে কিনে দিয়েছিলেন !
কিছুক্ষণ থেমে রফিক নিয়াজ জলের গ্লাস হাতে নিলেন। কয়েক ঢোক গিলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন, “জগৎটা হারিয়ে সেদিন বাপু কেঁদেছিলো; আজ খোকা নিজে” !