সাখাওয়াতুল আলম এর সকল পোস্ট

সাখাওয়াতুল আলম সম্পর্কে

আমি সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী জন্ম চট্টগ্রামে। জীবিকার প্রয়োজনে একসময় প্রবাসী ছিলাম।প্রবাসের সেই কঠিন সময়ে লেখেলেখির হাতেখড়ি। গল্প, কবিতা, সাহিত্যের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলা পত্রিকায়ও নিয়মিত কলামও লিখেছি। বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক "দেশের খবরে " নিয়মিত কলাম প্রকাশিত হতো। প্রবাসের সেই চাকচিক্যের মায়া ত্যাগ করে মানুষের ভালোবাসার টানে দেশে এখন স্থায়ী বসবাস। বর্তমানে বেসরকারি চাকুরিজীবী। ভালোলাগে বই পড়তে এবং পরিবারকে সময় দিতে। জীবনের এই পর্যায়ে এসে খুব সাধারণ ভাবেই বাঁচার চেষ্টা করছি। আল্লাহ্ যেন তাঁর রাস্তায় সালেহীনদের পথে আমাকে পরিচালিত করেন। আমিন।

আশুরার ফজিলত, করণীয় এবং বর্জনীয়

Add

আরবি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাসের নাম হচ্ছে “মহররম”। মহররম মাসের দশম দিনকে বলা হয় “আশুরা”। আরবি “আশারা ” হচ্ছে দশ। সেই “আশারা ” থেকেই এসেছে “আশুরা ” তথা মহররম মাসের দশ তারিখ।

পৃথিবীতে মহরমের দশ তারিখে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী ঘটেছে। যেকারণে এই তারিখটি ইহুদী, নাসারা, মুসলিম সকলের কাছে খুবই সম্মানিত। আজ আমরা কুরআন হাদিসের আলোকে আশুরা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

ইসলামে আশুরার গুরুত্ব
আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে চারটি মাসকে সম্মানিত করেছেন। সেই চার মাসের একটি হলো মহররম।

আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গননায় মাস বারটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না। আর মুশরিকদের সাথে তোমরা যুদ্ধ কর সমবেতভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেতভাবে। আর মনে রেখো, আল্লাহ মুত্তাকীনদের সাথে রয়েছেন।” (সূরা: আত তাওবাহ, আয়াত: ৩৬)

উপর্যুক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে বলেন, ‘তিনটি মাস ধারাবাহিক; আর তাহলো জিলকদ, জিলহজ এবং মহররম। আর অপরটি হলো রজব। যা জমাদিউস সানি ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস।’ (বুখারি)

সুতরাং কুরআন হাদিসের আলোকে ইসলামে মুহররম একটি সম্মানিত মাস। আর এই মাসের দশম দিন তথা আশুরার গুরুত্বও অপরিসীম।

মুহররমের ফজিলত
পবিত্র হাদিস থেকে জানা যায় মুহররম এবং আশুরার দিনে ইবাদত বন্দেগীর অপরিসীম ফজিলত রয়েছে।

আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, রমাদান মাসের পর সর্বোত্তম সাওম হল মুহররম মাসের সাওম (আশুরার সাওম) এবং ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাত্রের সালাত।” (সুনানে আন-নাসায়ী ১৬১৩, ইবনু মা-জাহ ১৭৪২)

আবূ কাতাদাহ আল-আনসারী (রা.) থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আরাফাহর দিনে সওম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হয়ে বললেন-এর দ্বারা বিগত ও আগত এক বছরের গোনাহ (পাপ) মোচন হয়। “আশুরাহর দিনের সওম পালন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হয়ে বললেন-বিগত এক বছরের পাপ মোচন হয়।” (বুলুগুল মারাম ৬৮০, মুসলিম ১১৬২, তিরমিযী ৬৭৬, নাসায়ী ২৩৮২, আবু দাউদ ২৪২৫, ইবনু মাজাহ ১৭১৩, আহমাদ ২২০২৪)

আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন- “রমাদান মাসের সাওমের পরে আল্লাহ্‌ তা’আলার মাস মুহররমের সাওমই সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ।” (তিরমিজি ৭৪০)

উপর্যুক্ত হাদিস থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, রমাদানের পরে মুহররম মাস এবং এই মাসে পালন কৃত সাওমের ফজিলত ও গুরুত্ব অনেক বেশী। কেননা এই মাসের সাওমের বিনিময়ে আল্লাহ পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেন। আর মুহররম মাসের দশম দিন তথা আশুরা হচ্ছে ফজিলতপূর্ণ দিন। যেদিনে সাওম পালনের কথা হাদিসে এসেছে।

আশুরা এতো গুরুত্বপূর্ণ কেন?
আমরা ইসলামী ইতিহাস, হাদিস পর্যালোচনা এবং বিভিন্ন ইসরাইলী সূত্র থেকে আশুরার বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারি। যেগুলো আল্লাহর প্রেরিত বিভিন্ন নবী রাসূলের সাথে সম্পর্কিত। পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম পর্যন্ত অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী হচ্ছে এই আশুরা। যেকারণে এই দিনটি সকল আহলে কিতাবিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা বুখারি ৩৩৯৭, ও মুসলিম ১১৩৯ নং হাদিস থেকে এই দিনে ঘটিত দুটি ঘটনা সম্পর্কে স্পষ্ট জানতে পারি।

যার একটি হলো ফেরাউনের নির্যাতনের কবল থেকে- হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের মুক্তি। যখন আল্লাহ সাগরে রাস্তা সৃষ্টি করে তাঁদের নিরাপত্তা দিয়ে নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

অন্যটি হলো ফেরাউনের মৃত্যু। যখন আল্লাহ কতৃক সাগরের রাস্তা দিয়ে মুসা (আ.) ও তাঁর সাথীরা চলে যাচ্ছিলেন, তখন ফেরাউনও তার সৈন্যদল নিয়ে সেই রাস্তা দিয়ে তাদের ধরতে যাচ্ছিল। কিন্তু মাঝ পথে রাস্তা পানিতে একাকার হয়ে ফেরাউনের মৃত্যু হয়।

উপর্যুক্ত দুটি ঘটনার পরিপূর্ণ সত্যতা পাওয়া গেলেও- আরো কিছু ঘটনা সম্পর্কে বিভিন্ন কিতাবে বিক্ষিপ্তাবে এসেছে। যার অধিকাংশেরই সূত্র হচ্ছে ইসরাইলী কাহিনী।

এইসব কাহিনী সুদীর্ঘকাল থেকে আমাদের উপমহাদেশের ইসলামে প্রচলিত আছে। সুন্নী বিশ্বকোষ ওয়েবসাইটসহ উপমহাদেশের অসংখ্য আলেম ওলামাদের বর্নণায় অসংখ্য কাহিনী প্রচারিত হয়। যার কোনো সঠিক তথ্যসূত্র সহিহ হাদিস থেকে পাওয়া যায় না। এমনসব কাহিনী গুলো হচ্ছে-

১) মহান আল্লাহ এই দিনে প্রথম মানব আদম (আ.) কে সৃষ্টি করেন এবং জান্নাতে স্থান দেন। পরবর্তীতে এই দিনেই আদম-হাওয়া (আ.) কে দুনিয়ায় পাঠানো হয়। একইসাথে এই দিনেই তাঁরা আল্লাহর ক্ষমা লাভ করেন।

২) মহান আল্লাহ পাক এই মুহররমের ১০ তারিখে সৃষ্টির সূচনা করেন।

৩) এই দিনে হযরত নূহ (আ.) এবং তাঁর সাথীরা বন্যা-প্লাবন থেকে মুক্তি পান।

৪) আশুরার দিন শুক্রবার ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে।

৫) এ দিনই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র ওজুদ (সৃষ্টি) মুবারক হয় এবং ইছমত, সম্মান ও খুছূছিয়ত এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয়।

৬) এই দিনে হযরত আদম আলাইহিস সালামের দোয়া কবুল করা হয়।

৭) এই দিনে হযরত ইদ্রিস (আ.) কে সম্মানিতস্থানে তথা আকাশে তুলে নেয়া হয়।

৮) আল্লাহ পাক এদিনে হযরত মূসা (আ.) এর সাথে কথা বলেন এবং তাঁর উপর তাওরাত শরীফ নাযিল করেন।

৯) মহররমের দশ তারিখ হযরত ইউনুস (আ.) ৪০ দিন মাছের পেটে থাকার পর মুক্তি লাভ করেন।

১০) এই দিনে হযরত মরিয়ম (আ.) এর গর্ভ হতে হযরত ঈসা (আ.) পৃথিবীতে আগমন করেন।

১১) হযরত আইয়ুব (আ.) দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর সুস্থতা লাভ করেন।

১২) এদিনে দীর্ঘ দিন বিচ্ছেদের পর হযরত ইউসূফ (আ.) তাঁর পিতা হযরত ইয়াকুব (আ.) এর সাথে মিলিত হন।

১৩) আল্লাহ পাক এ দিনে হযরত ঈসা (আ.) কে আসমানে তুলে নেন।

১৪) এদিনে হযরত ইবরাহীম (আ.) খলীল উপাধি লাভ এবং নমরূদের অগ্নিকু- থেকে মুক্তিলাভ করেছিলেন।

১৫) এ দিনে হযরত দাঊদ (আ.) এর দোয়া কবুল এবং তাঁর পুত্র হযরত সুলায়মান (আ.) কে বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে।

উপর্যুক্ত এইসব ঘটনাবলী ছাড়াও আরো অসংখ্য কাহিনী আমাদের সমাজে চালু আছে। যার কোনো সঠিক তথ্যপ্রমাণ নেই। উপর্যুক্ত কাহিনী গুলোর- কিছু কিছু বর্নণা বিভিন্ন কিতাবে দুর্বল সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।

বিশেষকরে এই দিনে হজরত আদম (আ.) এর তাওবা কবুল হয়েছে বলে আবুল কাসিম ইস্পাহানী (রাহ.) কর্তৃক সংকলিত “আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব ” কিতাবে ১৮৬৮ নং রেওয়ায়েতে একটি হাদিস এসেছে। তবে সনদ দুর্বলতার কারণে মুহাদ্দিসগণের বিশুদ্ধতার মানদন্ডে তা উত্তীর্ণ হতে পারেনি।

অবশ্য ইমাম ইবনে রজব (রাহ.) কৃত “লাতাইফুল মাআরিফ” এবং আবদুল্লাহ ইবনে ইমাম আহমাদ (রাহ.) কৃত “আল-ইলাল ওয়া মারিফাতির রিজাল” গ্রন্থে কোনো কোনো তাবেয়ীর উদ্ধৃতি দিয়ে আদম (আ.) এর তাওবা কবুল হওয়ার কথা এসেছে।

হাদিস গ্রন্থ মুসনাদে আহমাদে, এই দিনে হযরত নুহ (আ.) এর নৌকা নোঙর সম্পর্কিত একটি হাদিস এসেছে যার সূত্র মুসনাদে আহমাদ ১৪/৩৩৫, হাদীস ৮৭১৭। যা শায়েখ শুয়াইব আরনাউতকৃত হাশিয়াযুক্ত নুসখা। যদিও তা মুহাদ্দিসগণের বিবেচনায় দুর্বল বলা হয়েছে।

“আত-তারগিব ওয়াত-তারহিবে” কিতাবে হজরত ঈসা (আ.) এর জন্ম আশুরার দিন হয়েছে বলে একটি সনদে এসেছে। এবং যথারীতি এই সনদও দুর্বল বলে প্রমাণিত হয়েছে।

উপর্যুক্ত ঘটনাবলী ইসলামী ভিত্তি না থাকলেও বিভিন্ন ইসরাইলী বর্নণায় উপমহাদেশের ইসলামে প্রবেশ করেছে। আর তা বিভিন্ন আলেম ওলামাদের দ্বারা সর্বব্যাপী প্রচারিত হয়ে আসছে।

আশুরার সুন্নাহ
পবিত্র আশুরার সুন্নাহ হলো সাওম পালন করা। রাসূল (সা.) হিজরতের আগে থেকেই আশুরার দিনে সাওম পালন করতেন এবং অন্যান্যদেরও তাগিদ দিতেন। পরবর্তীতে রমাদানের সাওম ফরজ হলেও আশুরা সাওম পালনের উৎসাহ দিতেন। শুধু তাইনয়, হিজরতের পরে যখন তিনি জানতে পারলেন- ইহুদী নাসারাও এই দিনে সাওম পালন করে। তখন তিনি দুটি সাওম পালনের নির্দেশ দিলেন যাতে তাদের সাথে সাদৃশ্য না হয়।

আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন ‘আশুরার দিন সিয়াম পালন করেন এবং লোকদের সিয়াম পালনের নির্দেশ দেন, তখন সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! ইয়াহুদ এবং নাসারা এই দিনের প্রতি সন্মান প্রদর্শন করে থাকে। এ কথা শুনে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ইনশাআল্লাহ আগামী বছর আমরা নবম তারিখেও সিয়াম পালন করব। বর্ণনাকারী বললেন, এখনো আগামী বছর আসেনি, এমতাবস্থায় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ইন্তেকাল হয়ে যায়। (সহিহ মুসলিম ২৫৫৬)

উপর্যুক্ত হাদিসের আলোকে বুঝা যায় যে, আশুরার দিনে গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ হলো সাওম পালন করা। এবং তা দুটি। একটি ৯ তারিখে এবং ১০ তারিখ। অথবা ১০ তারিখ এবং ১১ তারিখ।

সৃষ্টির শুরু থেকেই আশুরা সম্মানিত
পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই আশুরার গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয়। বিশেষকরে আহলে কিতাবের অনুসারীদের বিভিন্ন নবী রাসূলদের অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী হচ্ছে আশুরা। যেকারণে ইহুদী, নাসারা, মুসলিম এমনকি মক্কার কুরাইশরাও সুদীর্ঘ কাল থেকে এই দিনকে সম্মান করে আসছে। শুধু তাইনয় রাসূলুল্লাহও (সা.) নবুওয়াত পাওয়ার আগে থেকেই এই দিনের সম্মানে সাওম পালন করে এসেছেন।

রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহধর্মিনী আয়েশা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহুম থেকে বর্ণিত: “আশুরা দিবস এমন একটি দিবস ছিল, যে দিবসে জাহিলিয়া যুগে কুরাইশগণ রোযা রাখত। জাহিলিয়া যুগে রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও সে দিবসে রোযা রাখতেন। অতঃপর রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মদীনায় এলে পরে তিনি সেই রোযা রাখলেন এবং লোকদেরকেও সেই দিনের রোযা রাখতে হুকুম করলেন। অতঃপর যখন রমযানের রোযা ফরয হল, উহাই ফরয হিসেবে রইল। আশুরা দিবসের রোযা ছেড়ে দেয়া হল। অতঃপর যে ইচ্ছা করত ঐ দিবসে রোযা রাখত, আর যে ইচ্ছা করত না সে তা ছেড়ে দিত।” (বুখারী ২০০২, মুসলিম ১১২৫, মুয়াত্তা ইমাম মালিক ৬৪৯)

উপর্যুক্ত হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, আশুরার দিনটি সকলের কাছেই পরিচিত এবং ফজিলতপূর্ণ ছিলো। যে কারণে মক্কার কাফের মুশরিকরাও এই দিনের সম্মানে সাওম পালন করতো।

আশুরার ইসলামিক ট্র্যাজেডি
সুদীর্ঘকাল থেকে আশুরা সুসংবাদের বার্তা বহন করলেও- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকালের প্রায় ৫০ বছর পর ইসলামে যোগ হয় এক মর্মান্তিক বিয়োগগাঁথা।

হিজরী সাল ৬১, যখন পৃথিবীর চারদিকে ইসলামের জয়জয়কার। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর বিদায়ের পরে যখন ইসলামে নেমে এসেছিল দূর্যোগের ঘোর ঘনঘটা। সেই অস্থিরতা থেকে সবেমাত্র সবকিছু থিতু হয়ে আসছে। ঠিক সেই সময়েই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পৃথিবীর মানুষ কারবালার প্রান্তের দেখে নির্মম পাশবিক ঘটনা।

ক্ষমতালোভী ইয়াজিদের নির্মমতার শিকার হয় রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হযরত হুসাইন (রা.)। বিশ্বের মানুষ অবাক নিস্তব্ধ! কীভাবে সম্ভব? একজন মুসলিম হয়ে কী করে সম্ভব হলো রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রাণভোমরার গলায় ছুরি দিতে?

৬১ হিজরির মুহররমের দশ তারিখ আশুরার পড়ন্ত বেলায় দিনে হত্যা করা হয় পিপাসার্ত হুসাইন (রা.) কে। পৃথিবীর ইতিহাসে যোগ হয় নতুন একটি অধ্যায়। যেখানে আশুরার আনন্দ উৎসবের সাথে রচিত হয় নির্মম শোকগাথা। আজও পৃথিবীর মানুষ সেই নির্মমতার চিত্র ভেবে শিউরে উঠে।

কারবালা এবং শিয়া সম্প্রদায়
ইসলামে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পরবর্তীতে, হযরত আলী (রা.) কে কেন্দ্র করে একটি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। যারা আমাদের কাছে শিয়া নামে পরিচিত। এই শিয়ারা আলী (রা.) কে প্রধান করে নতুন একটি বিশ্বাস নিয়ে সরাসরি প্রকৃত ইসলাম থেকে বেরিয়ে যায়। যদিও তারা নিজেদের প্রকৃত মুসলিম এবং তাদের ধর্মই প্রকৃত ইসলাম বলে দাবি করে।

এই শিয়ারাই কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন ঈমান আকিদার জন্ম দেয়। কারবালার ইতিহাস দেখলে জানা যায়- এই শিয়ারাই হযরত হুসাইন (রা.) কে বারবার চিঠি দিয়ে তাঁকে কুফায় যেতে বাধ্য করে।

তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে হুসাইন (রা.) তাঁর পরিবার পরিজন নিয়ে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আর পথিমধ্যে কারবালার প্রান্তেরে ইয়াজিদের সেনাবাহিনী তাঁকে আটকে দেয়। কেননা সেইসময় হযরত হুসাইন (রা.) ছিলেন প্রকৃত খিলাফতের অধিকারী। যদিও মুয়াবিয়া (রা.) তার ছেলে ইয়াজিদকেই খিলাফতের দায়িত্ব দিয়ে দেয়।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার এইসব টানাপোড়েনে ইয়াজিদ কতৃক হুসাইন (রা.) কে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেদিন কারবালার প্রান্তেরে হাজারো শিয়া মুসলিম থাকার পরও তারা হুসাইন (রা.) কে সাহায্য করার জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি।

আর এইসব শিয়ারাই পরবর্তীতে হুসাইন (রা.) জন্য মায়াকান্না করতে থাকে। তারা প্রতিবছর আশুরার দিনে তাদের কৃতকর্মের জন্য শোক প্রকাশ করতে থাকে। তাদের শোক প্রকাশ আজ বিশ্ব বিবৃত। যদিও তারা নিজেদের ইসলামের অনুসারী দাবি করে। অথচ তারা আজও আশুরার দিনে শোক প্রকাশ করে ইসলামের বিরোধিতা করে। কেননা ইসলামে চারদিনের বেশী শোক প্রকাশ হারাম।

হুসাইন (রা.) হত্যাকাণ্ডের পরে ইসলামে আশুরার ব্যাখ্যা পরিবর্তিত হতে থাকে। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্রের নির্মম হত্যাকাণ্ড কখনোই স্বাভাবিক এবং ছোটখাটো বিষয় হতে পারে না। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে পরবর্তীতে সাধারণ মুসলমানেরাও আশুরার প্রকৃত উদ্দেশ্য ভুলে শোকে নিমজ্জিত হয়ে যায়।

আশুরা বনাম কারবালা
আমরা ইতিমধ্যে কুরআন হাদিসের বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে জানতে পেরেছি যে, আশুরার ইতিহাস সৃষ্টির শুরু থেকেই। বিভিন্ন নবী রাসূলগণ (আ.) এই দিনকে গুরুত্বের সাথে শুকরিয়া স্বরূপ আনন্দ উৎসব এবং সম্মান দিয়ে এসেছে।

একইসাথে আমাদের নবী মুহাম্মদও (সা.) এই দিনে মুসলিমের করণীয় কী তাও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। রাসূল (সা.) এর পরবর্তীতে নতুন করে কোনো কিছু ইসলামী শরিয়তে সংযোজন বিয়োজন করা সম্ভব নয়। কেননা শরিয়ত প্রতিষ্ঠার মালিক ছিলেন একমাত্র রাসূলুল্লাহ (সা.)।

সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ওফাতের ৫০ বছর পরে সংঘটিত ঘটনা কখনোই শরিয়ত হতে পারে না। অর্থাৎ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন কোনো আমল সৃষ্টি করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) আশুরার জন্য যেসব আমলের কথা বলে গেছেন, শুধুমাত্র সেই আমল ব্যতিরেকে নতুন কোনো আমল এই আশুরা উপলক্ষে করা যাবে না।

যদি কেউ আশুরা উপলক্ষে নতুন কোনো আমল চালু করে, যা রাসূলুল্লাহ (সা.) সৃষ্টি করেননি কিংবা নির্দেশও দেননি। তাহলে তা হবে “বিদআত”। আর ইসলামে বিদআত একটি জঘন্য অপরাধ।

সুতরাং আশুরা উপলক্ষে শোক প্রকাশ কিংবা আরও যেসব নতুন নতুন আমল আমরা করে থাকি তা থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে হ্যাঁ এটা অনস্বীকার্য যে, কারবালা ঘটনা খুবই মর্মান্তিক এবং বেদনাদায়ক। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে যে, সত্যের জন্য আমাদের জীবন দিয়ে হলেও মিথ্যাকে প্রতিহত করতে হবে।

আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় রাসূলের (সা.) প্রিয় নাতিকে কেন সত্যের জন্য এই দিনেই তাঁর জীবন দানকে বেছে নিলেন? তার কারণ পৃথিবীবাসীকে এটাই জানাতে যে, আশুরার দিনে আল্লাহ তোমাদের সবাইকে দয়া করেছেন। আর আশুরার দিনেই আমি আমার বন্ধুর বন্ধুকে সত্যের জন্য কুরবানি দিলাম।

এই কুরবানীর কথা সকল ধর্মের সকল মানুষ কিয়ামত পর্যন্ত স্বরণ রাখুক। যাতে তারাও সত্যের জন্য কখনোই পিছপা না হয়। এই ঘটনা আমাদের জন্য একটি শিক্ষা। তাই এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়াটাই হচ্ছে প্রকৃত ইসলাম।

আশুরার করণীয় আমল
আমরা হাদিস থেকে আগেই জেনেছি যে এই দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হচ্ছে সাওম পালন করা। এবং তা শুধু একটি নয় বরং দুটি। আর এই সাওমের দ্বারা আল্লাহ আমাদের পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করবেন ইনশা আল্লাহ।

আশুরাসহ মুহররমের পুরো মাস বেশী বেশী তাওবা-ইসতেগফার করা। কেননা অতীতের সকল নবী এবং নবীর উম্মতকে এই দিনেই ক্ষমা করা হয়। সুতরাং আশাকরা যায় যে, আল্লাহও এইদিনে আমাদের সাগর পরিমাণ গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন ইনশা আল্লাহ।

এই বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মহররম হলো আল্লাহ তাআলার (কাছে একটি মর্যাদার) মাস। এই মাসে এমন একটি দিন আছে, যাতে তিনি অতিতে একটি সম্প্রদায়কে ক্ষমা করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অপরাপর সম্প্রদায়কে ক্ষমা করবেন।’ (তিরমিজি)

সুতরাং আশুরা উপলক্ষে আমাদের বেশী দোয়া দরুদ পড়া এবং তাওবা-ইসতেগফার করা উচিত।

এইদিনে যেহেতু ইসলামী ইতিহাসে একটি চরম হৃদয়বিদারক ঘটনার অবতারণা হয়েছে- সেহেতু সেই ঘটনা থেকেও আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। এই ঘটনা আমাদের ঈমানকে জাগ্রত করে। সত্যের জন্য প্রয়োজনে জান দিয়ে দিতে হবে। তবুও মিথ্যার কাছে শয়তানের কাছে জালিম শাসকগোষ্ঠীর কাছে কখনোই মাথানত করা যাবে না।

হুসাইন (রা.) আত্মত্যাগ আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, নিজেদের ঈমান আমল ঠিক রাখার জন্য যথাসাধ্য আত্মনিয়োগ করতে হবে। কখনোই দুনিয়াবী লোভে, প্রবৃত্তির তাড়নায়, শাসকগোষ্ঠীর চাপে নিজেদের ঈমান বিলিয়ে দেওয়া যাবে না।

আশুরা সম্পর্কে ভুল ধারণা
ইসলাম সম্পর্কে বিশদ না জনার কারণে এবং জানার চেষ্টা না করার কারণেও উপমহাদেশে আশুরাসহ বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে অসংখ্য ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। যা কখনোই ইসলাম সমর্থন করে না। এইসব ধারণা সমূহ হলো:

১) এই মাসে বিয়েশাদি না করা।

২) নতুন ঘরবাড়ি নির্মাণ না করা।

৩) কোনো শুভ কাজ বা ভালো কাজের সূচনা না করা।

৪) গোশত না খাওয়া ও নিরামিষ আহার করা।

৫) পান না খাওয়া, নতুন কাপড় ও সুন্দর পোশাক পরিধান না করা, সাদা কাপড় বা কালো কাপড় তথা শোকের পোশাক পরা।

৬) সব ধরনের আনন্দ উৎসব পরিহার করা ইত্যাদি।

উপর্যুক্ত কাজগুলো হচ্ছে কুসংস্কার। এইসব কখনোই ইসলাতী রীতিনীতি নয়। ইসলামের সাথে এইসবের কোনো সম্পর্ক নেই।

আশুরার বিদআতী আমল
রাসূলুল্লাহ (সা.) কতৃক আশুরার আমল থেকে সরে গিয়ে আমরা দিনদিন নিত্যনতুন বিদআতে জড়িত হয়ে গেছি। বিশেষকরে হুসাইন (রা.) কে নিয়ে শিয়াদের বাড়াবাড়ির কারণে- সুন্নীদের মাঝেও এইসবের প্রচলন শুরু হয়েছে। যেমন:

১) হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) এর স্মরণে কাল্পনিক তাযিয়া বা নকল কবর নিয়ে মিছিল করা।

২) এইসব নকল তাযিয়ার সামনে হাতজোড় করে দাড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করা।

৩) এইসব নকল তাযিয়ায় বা কবরে নজরানা স্বরূপ অর্থ প্রদান করা।

৪) কারবালার শোক প্রকাশ করতে গিয়ে নিজেদের দেহে ছুরি ব্লেড ইত্যাদি দ্বারা আঘাত বা রক্তাক্ত করা।

৫) হুসাইন (রা.) শাহাদাতের স্বরণে হায় হুসেন, হায় আলি ইত্যাদি বলে শোক, মাতম কিংবা বিলাপ ইত্যাদি করা।

৬) যুদ্ধ সরঞ্জামে সজ্জিত হয়ে ঘোড়া নিয়ে প্রদর্শনী করা।

৭) বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে ফুল দিয়ে সাজানো এসব নকল তাযিয়া বা কবরের প্রদর্শনী করা।

হুসাইনের (রা.) নামে শোকগাথার প্রচলন
আজ বিশ্বের শিয়াসহ সুন্নীদের কিছু অংশ আশুরার দিনে হুসাইন (রা.) কে নিয়ে শোক প্রকাশের যে পদ্ধতির প্রচলন হয়েছে, তা হুসেইন (রা.) শাহাদাতের তিনশ বছরেও ছিলো না। আমরা ইবনুল আসীর কর্তৃক রচিত ‘আল-কামেল ফিত তারীখ’ ৭/২৭৯, ইবনে কাসীর (রাহ.) কর্তৃক রচিত ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ ‘১৫/২৬১ (৩৫২ হিজরীর ঘটনাবলী) ও হযরত মাওলানা হাবীবুর রহমান আযমী (রাহ.) কৃত ‘ইবতালে আযাদারী’ কিতাব থেকে জানতে পারি- আশুরা উপলক্ষে শিয়াদের এইসব তাযিয়া মিছিল, কান্নাকাটি, আহাজারি, বুক পিঠ চাপড়ানো, ছুরি বা ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিজেদের আঘাত করা ইত্যাদির সূচনা করেন “মুঈযযুদ দাওলা দাইলামী” নামে একজন শিয়া।

এই ব্যক্তি সর্বপ্রথম ৩৫২ হিজরীতে এইসব শোক তাযিয়া মিছিল করার হুকুম জারি করেন। যা পরবর্তীতে ৩৬৩ হিজরীতে আল-মুঈযযু লিদীনিল্লাহি ফাতিমী (বেদ্বীন কট্টর শিয়া) মিশরেও এই হুকুম জারি হয়।

সুতরাং এইসব শোক মিছিল কখনোই ইসলামের অংশ ছিলো না এবং নেই। যদি কেউ এইসব করে এবং সমর্থন করে তাহলে তার ঈমান সন্দেহে পতিত হবে।

সুতরাং আসুন পবিত্র এবং সম্মানিত মাস মহররমের দশ তারিখ আশুরার দিনকে আমরা ইবাদতের দিন হিসাবে পালন করি। সাওম পালনের পাশাপাশি যথাসাধ্য তাওবা-ইসতেগফারের মাধ্যমে নিজের পাপ সমূহের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই। একইসাথে আশুরার দিনে সত্যের জন্য হুসাইন (রা.) আত্মত্যাগের কথা চিন্তা করে নিজেদের ঈমানকে উজ্জীবিত করি।

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
৩ আগস্ট, ২০২২
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।

ঈমান ভঙ্গের কারণ সমূহ

639581

ঈমান ভঙ্গের কারণ
ঈমান হচ্ছে আল্লাহ্‌র উপর বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাস বিভিন্ন কারণে বিভিন্নভাবে নষ্ট হয়ে যায়। আর ঈমান নষ্ট হওয়া মানেই ঈমান ভঙ্গ হওয়া। আজ আমরা কী কী কারণে ঈমান নষ্ট হয়ে যেতে পারে তা জানার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

প্রাককথাঃ
ঈমান ভঙ্গের কারণ জানতে হলে আগে পরিপূর্ণ ঈমান” কী সেটা জানত হবে। আর পরিপূর্ণ ঈমান কী জানার আগে “ইসলাম”কী সেটা জানা উচিত।

ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর পরিপূর্ণ বিধানে আনুগত্য করা। এই পরিপূর্ণ বিধানকে মুখে স্বীকৃতি, অন্তরে বিশ্বাস এবং কাজে পূর্ণ করাই হচ্ছে ঈমান। যার সহজ অর্থ হলো ইসলামের বিধানকে মুখে স্বীকার করা, অন্তরে বিশ্বাস করা এবং সেইমতে কাজ (আমল) করাই হচ্ছে ঈমান। যে এই কাজ অর্থাৎ ঈমান এনে ইসলামের প্রতি আনুগত্যশীল হয় তাকে বলা হয় মুসলিম।

সুতরাং ঈমানের অর্থ হলো আল্লাহ্ এবং আল্লাহ্ সম্পর্কিত সকল বিষয়ের উপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস। এই বিশ্বাস মূলত তিন ভাবে তথা বিশ্বাসগত, কর্মগত এবং উক্তিগত ভাবে ভঙ্গ হয়ে থাকে। এখন আমরা পবিত্র কুরআন এবং হাদিসের আলোকে প্রধানত কী কী কারণে ঈমান ভঙ্গ তথা বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায় তা জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

১) শির্ক করাঃ

আল্লাহ্‌র সাথে শির্ক করার কারণে যেকোনো ঈমানদার তার ঈমান হারিয়ে ফেলে। শির্ক অর্থ হলো আল্লাহ্‌র সাথে অন্যান্য ইলাহ বা উপাস্য সাব্যস্ত করা। অর্থাৎ আল্লাহ্‌র সমকক্ষ অন্য কাউকে মনে করা স্বীকার করা বা কাজে প্রমাণিত করা।

বিভিন্নভাবে শির্ক হয়ে থাকে।

ক) ইবাদতের শির্কঃ

আল্লাহ্‌র সাথে অন্য কাউকে আল্লাহ্‌র সমকক্ষ মনে করে তার ইবাদত করা হচ্ছে ইবাদতের শির্ক। অর্থাৎ আল্লাহ্‌র জন্য যেমন সিজদা, সিয়াম, কুরবানি, তাওয়াফ ইত্যাদি করা হয়। ঠিক তেমনি অন্য কোনো উপাস্যকে যেমনঃ দেবদেবী, আল্লাহ্‌র কোনো বান্দার (পীরের) জন্য বা অন্য কারো (অলি, আউলিয়ার) উদ্দেশ্যে একইভাবে ভাবে জীবিত বা কবরের ব্যক্তির জন্য সিজদা, সিয়াম, মান্নত, কুরবানি, তাওয়াফ ইত্যাদি করা হচ্ছে সুস্পষ্ট শির্ক।

আল্লাহ্ বলেন,
” আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য স্থির কর না। তাহ’লে নিন্দিত ও (আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে) বিতাড়িত অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে ” (বানী ইসরাঈল ৩৯)।

অন্য আয়াতে রাসুল সাঃকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ্ বলেন,

“(হে নবী!) আপনি আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যকে ডাকবেন না। তাহ’লে আপনি শাস্তিতে নিপতিত হবেন ” (শু‘আরা ২১৩)।

আল্লাহ্ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন আল্লাহর সাথে শরিক করা যাবে না। শুধু তাইনয় আল্লাহ্ সরাসরি তাঁর রাসুলকেও নির্দেশ দিয়েছেন শরিক না করার জন্য। অথচ সকল নবী রাসুলগন হচ্ছেন নিষ্পাপ।

আল্লাহ্ এটা এইজন্যই বললেন যাতে মানুষ শির্কের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে। অথচ অনেকে শির্কের সম্পর্কে না জানার কারণে বিভিন্ন পীর অলি আউলিয়াদের দরবারে গিয়ে সিজদা, মান্নত, তাওয়াফ, কুরবানি ইত্যাদি করছে। যদিও এইসব ইবাদত শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য।

খ) আল্লাহর সিফাতের সাথে শির্কঃ

আল্লাহ্‌র গুণাবলীতে অন্য কাউকে গুণান্বিত করা। অর্থাৎ আল্লাহ্‌র যা করার ক্ষমতা আছে তা তাঁর অন্য কোনো বান্দা বা অন্য কেউ করতে পারে এমন বিশ্বাস রাখা হচ্ছে আল্লাহর সিফাতের সাথে শির্ক। অর্থাৎ আল্লাহর ক্ষমতা হচ্ছে কাউকে জীবন দেওয়া, নেওয়া, সুখ দুঃখ , সন্তান, বিপদে উদ্ধার ইত্যাদি। এখন কেউ যদি আল্লাহর কোনো বান্দার বা অন্য কারো এমন ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করে তাহলে তা হবে শির্ক।

আল্লাহ্ বলেন,
“(হে নবী!) বলুন, তবে কি তোমরা আল্লাহ ব্যতীত এমন অভিভাবক স্থির করেছ, যারা ভাল ও মন্দের মালিকও নয়” (রা‘দ ১৬)

“আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা চান সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা দান করেন পুত্র-কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা তাকে বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান।” [ আশ শূরা ৪২:৪৯, ৫০ ]

“আর যদি আল্লাহ তোমাকে কোন দুর্দশা (দুঃখ কষ্ট) দ্বারা স্পর্শ করেন, তবে তিনি ছাড়া তা দূরকারী কেউ নেই। আর যদি কোন কল্যাণ (সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য) দ্বারা স্পর্শ করেন তবে তিনিই তো সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।” (সূরা আনআম ৬:১৭)

উপরোক্ত আয়াত গুলো দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, সবকিছুর উপরই আল্লাহর ক্ষমতা। তিনিই একক এবং একমাত্র ক্ষমতাবান। তিনিই মানুষকে দুঃখ, দূর্দশা, সুখ, শান্তি, সন্তান ইত্যাদি প্রদান করেন।

তিনি তাঁর ক্ষমতা কাউকে প্রদান করেননি যে অন্য কেউ তা দিতে পারবেন যেমন আল্লাহ্ দেওয়ার ক্ষমতা আছে। সুতরাং কোনো বান্দা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো নিকট আল্লাহর ক্ষমতাসীন কিছু চাইলে তাহলে তার ঈমান চলে যাবে।

গ) আল্লাহর রাজত্বের সাথে শির্কঃ

আল্লাহ্‌ মানুষ সৃষ্টির সাথে তাদের জীবনযাপন করার জন্য বিভিন্ন বিধিবিধানও তৈরি করে দিয়েছেন। ইসলাম হচ্ছে একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান। যে বিধান বা সংবিধান দিয়ে মুসলমানগণ তাদের সকল সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় কাজ কর্ম পরিচালনা করবে।

এখন যদি কেউ আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে নতুন কোনো দুনিয়াবী বিধান (বাধ্যতামূলক না হলে আপোষে) মেনে নেয় বা প্রতিষ্ঠা করে বা করার জন্য সাহায্য করে তাহলে তা হবে আল্লাহর রাজত্বের সাথে শির্ক।

আল্লাহ্ বলেন,
“জেনে রেখো সৃষ্টি যেহেতু তার (আল্লাহর) সুতরাং সমগ্র সৃষ্টির উপর ক্ষমতা ও একমাত্র (আল্লাহর) তার”( সূরা আরাফ ৫৪”)।
অন্য আয়াতে বলেন,

“আল্লাহ ব্যতীত বিচার ফায়সালা ও শাসন করার ক্ষমতা কারো নেই”। (সূরা নাম আনাম ৫৭)

উপরোক্ত আয়াত দ্বারা আল্লাহ্ সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য এহ ঘোষণা দিচ্ছেন যে, সবকিছুর মালিক হচ্ছেন আল্লাহ্। এবং তাঁর সৃষ্টির উপর তাঁর বিধিবিধানেরই ক্ষমতা চলবে। দুনিয়ার কারো কোনো বিধান বা সংবিধান এখানে প্রযোজ্য নয়। যদি আল্লাহর পরিবর্তে অন্য কিছু তালাশ করে তবে তা হবে শির্ক।

২) কারো মাধ্যমে আল্লাহর কাছে চাওয়াঃ

আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে ঘোষণা দেন যে তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি তাঁর বান্দাদের শোনেন এবং দেখেন। তাঁর বান্দাদের যেকোনো প্রয়োজনে তিনি সাড়া দেন। তারপরও কেউ যদি আল্লাহর কাছে কিছু চাইতে বা বিপদে উদ্ধার হতে আল্লাহর কোনো বান্দাকে মাধ্যম ধরে বা উছিলা মনে করে, তবে তা হবে শির্ক।

আল্লাহ্ বলেন,
“যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক তবে আল্লাহর উপর ভরসা কর” (মায়েদাহ ২৩)।

” বলুন, (হে নবী!) আমার পক্ষে আল্লাহই যথেষ্ট। নির্ভরকারীরা তাঁরই উপর নির্ভর করে ” (যুমার ৩৮)।

অর্থাৎ যারা ঈমানদার তারা সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করবে। যারা সরাসরি আল্লাহ্কে ছাড়া অন্য কাউকে আল্লাহর কাছে মাধ্যম বানাবে তারা গোমরাহীতে লিপ্ত হয়ে ঈমানহারা হয়ে যাবে।

আল্লাহ্ বলেন,
“তারা আল্লাহকে ব্যতিত যার ইবাদাত করে তা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না,উপকারও করতে পারে না। তারা বলে, ‘এইগুলি আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী।’ বল, ‘তোমরা কি আল্লাহকে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর এমন কিছুর সংবাদ দিবে যা তিনি জানেন না?তিনি মহান, পবিত্র’ এবং তারা যাকে শরীক করে তা হতে তিনি উর্দ্ধে।”(সূরা ইউনুস ১০: আয়াত ১৮)

অন্য আয়াতে আল্লাহ্ বলেন,
“জেনে রেখ, আল্লাহর জন্যই বিশুদ্ধ ইবাদাত-আনুগত্য। আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে তারা বলে, ‘আমরা কেবল এজন্যই তাদের ‘ইবাদাত করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে।’ যে বিষয়ে তারা মতভেদ করছে আল্লাহ নিশ্চয় সে ব্যাপারে তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবেন। যে মিথ্যাবাদী কাফির, নিশ্চয় আল্লাহ তাকে হিদায়াত দেন না।” (সূরা যুমার : ৩)

উপরোক্ত আয়াত দ্বারা এটা সুস্পষ্ট প্রমাণিত যে, যারা আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া বা পাওয়ার জন্য অন্য কাউকে মিডিয়া বা মাধ্যম লাগাবে বা প্রয়োজন মনে করবে। তাহলে তা হবে আল্লাহর সাথে শির্ক। অর্থাৎ যিনি আল্লাহর কাছে সুপারিশকারী হিসাবে কাউকে মাধ্যম মানবেন তার ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে।

অর্থাৎ আল্লাহর কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশায় তথাকথিত পীর অলি আউলিয়া ইত্যাদির দরবারে গিয়ে তাদের নাম করে সিজদা মান্নাত কুরবানি করা হচ্ছে শির্ক। যা ঈমানদারের ঈমান নষ্ট করে শির্কে লিপ্ত করে।

৩) মুশরিক কাফিরদের কাফির মনে না করাঃ

কেউ যদি স্বীকৃত মুশরিক কাফিরদের কাফির মনে না করে তাদের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে তাদের খারাপ মনে না করে, তাহলে ঐ ব্যক্তির ঈমান চলে যাবে।

আল্লাহ সুস্পষ্ট বলেন,
‘নিশ্চয়ই মুশরিকরা অপবিত্র’ (তওবা ২৮)।

“নিশ্চয়ই আহলে কিতাবদের(ইহুদী, খ্রিস্টানদের) মধ্যে যারা কুফরী করেছে এবং শিরক করে তারা চিরস্থায়ী জাহান্নামী এবং এরাই সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্ট সৃষ্টি” (বায়্যিনাহ ৬)।

অতএব আল্লাহর ঘোষণা চূড়ান্ত যে, ইহুদী, নাসারা, মুশরিক (যারা আল্লাহর সাথে শির্ক করে) তারা চিরস্থায়ী জাহান্নামী। তাদের ব্যাপারে কখনোই কাফির নয় (তারাও আল্লাহর বান্দা তারাও ভালো কাজে নাজাত পাবে) এমন সন্দেহ করা যাবে না। কেউ এমন করলে তার ঈমান থাকবে না।

৪) ইসলামের বিধানকে অচল মনে করাঃ

আল্লাহর দেওয়া বিধিবিধানকে প্রাগৈতিহাসিক পুরোনো অচল ইত্যাদি মনে করে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা। অর্থাৎ আল্লাহ্ এবং আল্লাহর রাসুলের দেওয়া বিধিবিধান না মেনে অন্য কোনো দুনিয়াবী বিধি বিধান সংবিধান মেনে চলা এবং ঐটাকেই যথার্থ মনে করা।

সোজা কথায় বর্তমান দুনিয়ায় ইসলামী শাসনতন্ত্রের প‌রিবর্তে মানব সৃষ্ট গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদি মেনে চলা হচ্ছে ঈমান বিধ্বংসী কাজ। যারা আপোষে কোনো বাধ্যবাধকতা ছাড়াই ইসলামী বিধি বিধান মানবে না এবং দুনিয়াবী বিধি বিধান প্রতিষ্ঠা করবে এবং মানবে তাদের ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে।

আল্লাহ্ বলেন,
“আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার নারী-পুরুষের সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার নেই। যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হবে ” (আহযাব ৩৬)।

অন্য আয়াতে আল্লাহ্ বলেন,
“যে কেউ রসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে, তার কাছে সরল পথ (ইসলাম) প্রকাশিত হওয়ার পর এবং সব মুসলমানের অনুসৃত পথের (রাসুলের সুন্নাহর) বিরুদ্ধে চলে, আমি তাকে ঐ দিকেই ফেরাব যে দিক সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর তা নিকৃষ্টতর গন্তব্যস্থান”। (সূরাঃ আন নিসা, আয়াতঃ ১১৫)

উপরোক্ত আয়াত দ্বারা এটা সুস্পষ্ট যে, আল্লাহর কাছে ইসলাম ব্যতীত কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই কেউ যদি ইসলাম ব্যতীত অন্য কিছু মানে, ভালো লাগে বা মানানোর জন্য অন্যকে উৎসাহিত বা চাপ দেয়, তাহলে তার ঈমান বাতিল হয়ে যাবে। যেমন বর্তমান যুগের গনতন্ত্রের রাজনীতি। যেখানে প্রতিনিয়ত ইসলামী আইন বাতিল করে ইসলাম বিরোধী আইন হচ্ছে।

৫) ইসলামের কোনো বিধানকে অপছন্দ করলেঃ

যদি কোনো ঈমানদার ইসলামের কোনো একটি বিধান অপছন্দ করলে সাথে সাথে তার ঈমান চলে যাবে। কোনো অবস্থাতেই কেউ ই ইসলামের কোনো বিধানকে অপছন্দ করতে পারবে না।

আল্লাহ্ বলেন,
“আর মানুষের মধ্যে কিছু এমন আছে, যারা বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি এবং শেষ দিনের প্রতি’, অথচ তারা মুমিন নয়।” [ আল বাকারা ২ :৮]

“আর যারা কাফির তাদের জন্য রয়েছে দুর্গতি এবং তিনি তাদের কর্ম বিনষ্ট করে দিবেন। এটা এজন্য যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তারা তা পসন্দ করে না। অতএব তাদের কর্মসমূহ আল্লাহ ব্যর্থ করে দিবেন’ (মুহাম্মাদ ৮-৯)।

এ আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, ঈমান এনে বা না এনে আমল সমূহ বাতিল হওয়ার অন্যতম কারণ আল্লাহর নাযিলকৃত বিষয় অপছন্দ করা। উক্ত বিষয়ে ঈমানদার হয়ে আমল করলেও অপছন্দ করার কারণে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে। অর্থাৎ কারো পর্দার বিধান ভালো লাগে না যদিও সে পর্দা করে। অথবা কারো জিহাদের কথা ভালো লাগে না অথবা পুরুষদের একাধিক বিয়ের অনুমতিও ভালো লাগে না। যদি কারো বিশ্বাস এমন হয় তাহলে তার ঈমান চলে যাবে।

৬) দ্বীনের কোনো বিধান নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করাঃ

কোনো ঈমানদার ইসলামকে নিয়ে বা ইসলামের কোনো বিধি বিধান কাজ আমল নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করলে তার ঈমান চলে যাবে।

আল্লাহ্ বলেন,
“আর যদি তুমি তাদেরকে প্রশ্ন কর, অবশ্যই তারা বলবে, ‘আমরা আলাপচারিতা ও খেল-তামাশা করছিলাম। বল, ‘আল্লাহ, তাঁর আয়াতসমূহ ও তাঁর রাসূলের সাথে তোমরা বিদ্রূপ করছিলে’?”[ আত তাওবাহ্ ৯:৬৫]

“তোমরা ওযর পেশ করো না। তোমরা তোমাদের ঈমানের পর অবশ্যই কুফরী করেছ। যদি আমি তোমাদের থেকে একটি দলকে ক্ষমা করে দেই, তবে অপর দলকে আযাব দেব। কারণ, তারা হচ্ছে অপরাধী।[ আত তাওবাহ্ ৯:৬৬ ]

উপরোক্ত আয়াত দ্বারা আল্লাহ্ স্পষ্ট করে দিলেন যে, আল্লাহ্, আল্লাহর রাসুল ও তাঁর আয়াত নিয়ে কেউ যদি খেল, তামাশা, বিদ্রুপ, মজা ইত্যাদি করে তাহলে তার ঈমান চলে যাবে। যেমনঃ অনেকে দাড়ি রাখা, টাকনুর উপর প্যান্ট পড়া, বিভিন্ন বিদআতী কর্মকাণ্ডে জড়িত না হওয়া নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে। যা কখনোই উচিত।

আল্লাহ্ আরো বলেন,
“সুতরাং যারা আমার সাথে সাক্ষাতের আশা রাখে না, আমি তাদেরকে তাদের দুষ্টামীতে ব্যতিব্যস্ত করে রাখি” (ইউনুস ১১)।

তারা আল্লাহ্ না চাইলে কখনোই হিদায়াত পাবে না। দুষ্টুমিতেই জীবন পার হবে। সুতরাং তাদের সাথে চলাফেরা যোগাযোগ রাখা যাবে না। এব্যাপারে আল্লাহ্ক বলেন,

“আর (আল্লাহ্) কুরআনের মাধ্যমে তোমাদের প্রতি এই হুকুম জারী করে দিয়েছেন যে, যখন আল্লাহর আয়াত সমূহের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন ও বিদ্রূপ করতে শুনবে, তখন তোমরা তাদের সাথে বসবে না, যতক্ষণ না তারা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে। অন্যথা তোমরাও তাদেরই মত হয়ে যাবে। আল্লাহ মুনাফিক ও কাফিরদেরকে জাহান্নামে একই জায়গায় সমবেত করবেন’ (নিসা ১৪০)।

তাদের বন্ধু রূপেও গ্রহণ করা যাবেনা। তাদের থেকে সবসময় দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

আল্লাহ্ বলেন,
‘হে মুমিনগণ! আহলে কিতাবদের মধ্য থেকে যারা তোমাদের ধর্মকে উপহাস ও খেলা মনে করে, তাদেরকে এবং অন্যান্য কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ কর না। আল্লাহকে ভয় কর, যদি তোমরা মুমিন হও। আর যখন তোমরা ছালাতের জন্য আহবান কর, তখন তারা একে উপহাস ও খেলা মনে করে। কারণ তারা নির্বোধ’ (মায়েদাহ ৫৭-৫৮)।

সুতরাং দ্বীন নিয়ে যারাই হাসি ঠাট্টা করবে তাদের থেকে তৎক্ষণাৎ দূরত্ব সৃষ্টি করতে হবে। কেননা দ্বীন নিয়ে তামাশাকারীরা হচ্ছে মুনাফিক। আর মুনাফিকদের জায়গা হচ্ছে জাহান্নামে।

৭) জাদু টোনা বা কুফরী কালাম করাঃ

আল্লাহর উপর বিশ্বাসের পরিবর্তে কেউ যদি জাদু টোনা বা শয়তানী কুফরি কাজের মাধ্যমে কিছু পেতে চায় বা কারো ক্ষতি করতে চায় তাহলে তা হবে সম্পূর্ণ ঈামান খারিজের কাজ। কুফরি কাজের দ্বারা যত ভালো কাজই হোক না কেন। ইসলামে সকল প্রকার জাদু টোনা করা হারাম।

আল্লাহ্ সূরা বাকারার ১০২ নংং আয়াাতে বলেন,

“আর তারা অনুসরণ করেছে, যা শয়তানরা সুলাইমানের রাজত্বে পাঠ করত। আর সুলাইমান কুফরী করেনি; বরং শয়তানরা কুফরী করেছে। তারা মানুষকে যাদু শেখাত এবং (তারা অনুসরণ করেছে) যা নাযিল করা হয়েছিল বাবেলের দুই ফেরেশতা হারূত ও মারূতের উপর। আর তারা কাউকে শেখাত না যে পর্যন্ত না বলত যে, ‘আমরা তো পরীক্ষা, সুতরাং তোমরা কুফরী করো না। এরপরও তারা এদের কাছ থেকে শিখত, যার মাধ্যমে তারা পুরুষ ও তার স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাত। অথচ তারা তার মাধ্যমে কারো কোন ক্ষতি করতে পারত না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া। আর তারা শিখত যা তাদের ক্ষতি করত, তাদের উপকার করত না এবং তারা অবশ্যই জানত যে, যে ব্যক্তি তা ক্রয় করবে, আখিরাতে তার কোন অংশ থাকবে না। আর তা নিশ্চিতরূপে কতই-না মন্দ, যার বিনিময়ে তারা নিজদেরকে বিক্রয় করেছে। যদি তারা জানত।”

অতএব যারাই এইসব করে তাদের আর ঈমানের অস্তিত্ব থাকেনা। আজ উপমহাদেশের অধিকাংশ মানুষই কুফরি কালামে লিপ্ত।

৮) ইসলামের বিপক্ষে কাফিরদের সাহায্য করাঃ

কোনো ঈামানের দাবিদার যদি ইসলামের বিপক্ষে কাফির মুশরিকদের সাহায্য সহযোগিতা করে তাহলে তার ঈমান চলে যাবে।

আল্লাহ্ সূরা আত তাওবাহ্ ২৩ নং আয়াতে বলেন,

“হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজদের পিতা ও ভাইদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরীকে প্রিয় মনে করে। তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারাই যালিম। ”

অন্য আয়াতে বলেন,

“তোমাদের মধ্যে যে তাদের (বিধর্মীদের) সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে। আল্লাহ তা‘আলা যালিমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না ” (মায়েদাহ ৫১)।

অতএব কখনোই বিধর্মীদের আন্তরিকভাবে বন্ধু করা যাবে না যতটুকু দুনিয়ায় প্রয়োজন। সেইসাথে যারা ইসলামের বিপক্ষে বা কোনো মুসলিমের বিপক্ষে বিধর্মীদের সাহায্য সহযোগিতা করবে তাদের ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে।

৯) কাউকে দ্বীন ইসলাম এবং শরীয়তের ঊর্ধ্বে মনে করাঃ

কেউ যদি রাসুলুল্লাহ সাঃএর আনীত শরীয়তের বিধি বিধান মানার চাইতে অন্য কোনো পীর বুজুর্গের দেওয়া (শরীয়ত বহির্ভূত) কাজ করে বা করাকে জায়েজ মনে করে তাহ‌লে তাঁর ঈমান থাকবে না। কেননা শরীয়তের ঊর্ধ্বে কেউ নেই। ইসলামে যা কিছু চলবে সবই রাসুলুল্লাহর নির্দেশ এবং সম্মতিতে।

এখন কেউ যদি পীর অলি আউলিয়াকে শরীয়তের উৎস ধরে (স্বপ্নের বার্তা, কাশফ) সেইমতো বিভিন্ন বিধি বিধান চালু এবং পালন করে তাহ‌লে তার ঈমান থাকবে না। কেননা ইসলামে একমাত্র অনুসরণ হচ্ছে রাসুলুল্লাহ।

আল্লাহ্ বলেন,

“(হে রাসুল! আপনি) বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তবে আমার অনুসরণ কর; তাহলেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাশীল দয়ালু।” (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৩১)

অন্য আয়াতে আল্লাহ্ আরো বলেন,

“তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকের(শরীয়ত বহির্ভূত কারোর) অনুসরণ করো না। তোমরা সামান্যই উপদেশ গ্রহণ কর”। ( আল আরাফ : ৩)

অর্থাৎ আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাইলে একমাত্র রাসুলের অনুসরণ করতে হবে। রাসুলের প্রদর্শিত পথ ছাড়া অন্য কারো অনুসরণ করা যাবে না।

১০) শরীয়তের বিধিবিধানে কম বেশী বা নতুনত্ব সৃষ্টি করাঃ

কেউ যদি মনে করে আল্লাহ্ এবং আল্লাহর রাসুল কতৃক আনীত ইসলামের বিধানে নতুন করে কিছু সংযোজন বা বিয়োজন করলে ভালো হবে। অথবা কেউ যদি রাসুলুল্লাহর দেওয়া শরীয়তের নির্ধারিত বিধি বিধানে (ঈমান, আকিদা, আমলে) কম বেশী বা নতুনত্ব ( বিদআত) সৃষ্টি করে বা জায়েজ মনে করে এবং সেইমতো আমলেও করে তাহলে তার ঈমান চলে যাবে।

নতুনত্ব আনা বা বাদ দেওয়ার মধ্যে তারা রাসুলুল্লাহ রিসালাতকে অস্বীকার করে। এর দ্বারা আল্লাহ্ যে তাঁর রাসুল সাঃ দ্বারা ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সেটা মিথ্যা হয়ে যাওয়া। অথচ আল্লাহ্ বলেন,

‘যে কেউ রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তার কাছে সরল পথ প্রকাশিত হওয়ার পর এবং সব মুসলমানের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলে, আমি তাকে ঐ দিকেই ফেরাব যে দিকে সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর তা নিকৃষ্টতর গন্তব্যস্থান’ (নিসা ১১৫)।

এটা দ্বারা সুস্পষ্ট যে কিয়ামত পর্যন্ত প্রতিটি মানুষকে একমাত্র রাসুলুল্লাহ সাঃএর অনুসরণে দ্বীন ইসলামে জীবনযাপন করতে হবে।

কেননা আল্লাহ্ বলেন,

” আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম” (সূরা মায়িদা ৫ : ৩)।

১১) ইসলাম ব্যতীত অন্য ধর্ম তালাশঃ

কেউ যদি আল্লাহর দ্বীন ইসলামকে ছেড়ে অন্য কোনো ধর্ম তালাশ করে তাদেরও ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে।

আল্লাহ্ বলেন,
“যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য ধর্মকে গ্রহণ করবে তার কোন আমল গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে”। (আলে ইমরান ৮৫)।

অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম ছাড়া আর কোনো ধর্মই আল্লাহর কাছে গ্রহনযোগ্য নয়। সুতরাং ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম কেউ পালন করলে তাকে অবশ্যই জাহান্নামের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।

১২) দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াঃ

কেউ যদি দ্বীন ইসলামের বিধি বিধান বা আমল সমূহকে বোঝা মনে করে তা থেকে বিরত থাকে তাহলে তার ঈমান থাকবে না।

আল্লাহ্ বলেন,

“আর তার চেয়ে বড় যালিম আর কে, যাকে স্বীয় রবের আয়াতসমূহের মাধ্যমে উপদেশ দেয়ার পর তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। নিশ্চয় আমি অপরাধীদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণকারী।।[ আস সেজদাহ্‌ :২২ ]

অর্থাৎ যেসব ঈমাদারদের আল্লাহর বিভিন্ন বিষয়ের উপর ঈমান এবং আমল করতে বলা হয় তখন তাদের দ্বীনের হুকুম আহকামকে বোঝা মনে করে। তখন তারা দ্বীনের বিভিন্ন বিধি নিষেধ এবং আমল থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখে। এইসব ব্যক্তিদের ঈমান আর অবশিষ্ট থাকে না।

আল্লাহ্ আরো বলেন,

“আমার স্মরণ (ঈমান, আমল, জিকির ) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবিকা সংকীর্ণ (কষ্টে পতিত) হবে এবং আমি তাকে ক্বিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? আমিতো চক্ষুষ্মান ছিলাম। আল্লাহ বলবেন, এমনিভাবে তোমার কাছে আমার আয়াত সমূহ এসেছিল। অতঃপর তুমি সেগুলো ভুলে গিয়েছিলে। তেমনিভাবে আজ তোমাকে ভুলে যাব’ (ত্ব-হা ১২৪-১২৬)।

অতএব দ্বীন ইসলাম থেকে আল্লাহ্ থেকে কেউ যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে তার ঈমান বিনষ্ট হবে।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামী আক্বীদাহ ও তাওহীদ গ্রহণের পর যদি কেউ উপরোল্লিখিত বিষয়গুলিতে নিপতিত হয়, তবে সে ঈমান হারা হবে বা মুরতাদ হয়ে যাবে। তার উপর মুরতাদের হুকুম (মৃত্যুদন্ড) ওয়াজিব হবে। যা কার্যকর করার মালিক হচ্ছেন দেশের সরকার। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এই দন্ড কার্যকর করার অধিকার রাখে না।

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।

আর কত রক্ত লাগবে

395

আজো কেন কানে আসে নির্যাতিত শ্রমিকের বার্তা?
আজো কেন কাঁধে নিয়ে চলে শ্রমিকদের শব যাত্রা?

আজো কেন আকাশে বাতাসে উদ্বেলিত অসহায়ের কান্না?
আজো কেন দালানে রাজপথে দেখি শ্রমিকদের রক্ত বন্যা?

কেন এখনো দেশে দেশে লাঞ্চিত মোর শ্রমিক ভাই?
কেন এখনো হয়নি মানবতার তরে মানব সমাজে ঠাঁই?

হে শহীদ স্পীজ এখনো কি হয়নি তোমার রক্তের শোধ?
কত রক্ত আর ঘামে সভ্যতাকে করতে হবে পরিশোধ?

আর কত প্রাণ গেলে এই ধরণীতে হবে শ্রমিকের দাম?
আর কতকাল রক্তের বিনিময়ে গড়বো এই ধরাধাম?

কতটুকু রক্ত হলে এই সভ্যতাতে জাগবে মানবতা?
কতটি প্রাণ গেলে পাবো নিরাপদ মৃত্যুর নিশ্চয়তা?

.
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।

সাদকাতুল ফিতরের আদ্যোপান্ত

165076

ইসলাম আমাদের সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার শিক্ষা দেয়। রমাদানের এক মাস সিয়াম সাধনার পর আসে পবিত্র ঈদ-উল -ফিতর। ধনী-গরিব সকলে মিলে যেন সমানভাবে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে তার জন্য ইসলাম ব্যবস্থা করেছে সাদাকাতুল ফিতর নামে একটি দানের খাত। এই দানকে বলা হয় সাওমের কাফফারা বা যাকাত। আজ আমরা ফিতরা নামে যে দানের পদ্ধতি ইসলামে রয়েছে তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো ইনশা-আল্লাহ।

সাদকাতুল ফিতর কী

ফেতরা আরবী শব্দ, যা ইসলামে যাকাতুল ফিতর (ফিতরের যাকাত) বা সাদাকাতুল ফিতর (ফিতরের সদকা) ইত্যাদি নামে পরিচিত। সদকা মানে দান, ফিতর মানে রোজার সমাপন বা শেষ। ফিতর বা ফাতুর বলতে সকালের খাদ্যদ্রব্যকেও বোঝানো হয় যা দ্বারা সাওম পালনকারীরা তাদের সাওম ভঙ্গ করেন।

সুতরাং সাদকাতুল ফিতরা হলো ঐ সব খাদ্যবস্তু দান করা যা দ্বারা সিয়াম পালনকারী তাদের সাওম ভঙ্গ করতেন। সোজা কথায় ফিতরা হলো এমন খাদ্যসামগ্রী দান করা যা দ্বারা গরীব দুঃখীরা ঈদের দিনে খেয়ে খুশী হয়। আর এই দান প্রতিটি সাওম পালনকারীকেই প্রদান করতে হবে।

সাদকাতুল ফিতর কেন দিতে হয়

ইসলামে সম্পদের পবিত্রতার জন্য যেমন যাকাত (দান) দিতে হয়, ঠিক তেমনি রমাদানের সিয়ামের পবিত্রতার জন্য সাদকাতুল ফিতর (দান) দিতে হয়। আরও সহজ করে বললে বলতে হয়, পবিত্র রমাদানে সিয়াম পালন করতে গিয়ে প্রতিটি মানুষেরই অবচেতনমনে কোনো না কোনো ভাবে সিয়ামের অনেক সাধারণ ভুলত্রুটি (যেমনঃ সাওমে অবাঞ্ছনীয় অসারতা, গীবত করা, অশ্লীল কথাবার্তা, গালাগালি করাসহ নানান ছোটখাটো সগিরা গুনাহ) হয়ে থাকে। সিয়াম পালন করতে গিয়ে সেই ত্রুটি-বিচ্যুতিরই ক্ষতিপূরণ ও সংশোধনী হচ্ছে সাদকাতুল ফিতর। যা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে নির্ধারিত দানের একটি ইবাদত। যাকাত যেমন অর্থ-সম্পদকে পবিত্র করে, ঠিক তেমনি ফিতরাও সাওমকে পবিত্র করে।

হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে,
“সদকাতুল ফিতর দ্বারা সাওম পালনের সকল দোষত্রুটি দূরীভূত হয়, গরিবের পানাহারের ব্যবস্থা হয়।” -আবু দাউদ

উপরোক্ত হাদিস থেকে বুঝা যাচ্ছে সদকাতুল ফিতরের উদ্দেশ্য শুধু ‘গরিবদের ঈদের খুশিতে শরিক করা’ বলে যে ধারণা প্রচলিত রয়েছে সেটা মিথ্যা। বরং এই দানের ফলে আমাদের সিয়াম সমূহের কাফফারা আদায় হয়। যা আল্লাহর পক্ষ থেকে উপহার স্বরূপ হিজরীর দ্বিতীয় সালে শা’বান মাসে বিধিবদ্ধ হয়।

কাদের উপর ফিতরা ওয়াজিব

ফিতরা সেই মুসলিমের উপর ফরয যে ব্যক্তির ঈদের রাত ও দিনে নিজের এবং পরিবারের আহারের প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত খাদ্য মজুদ থাকে। আর এই সাদকা হিসাবের ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষকেই হিসাবে রাখতে হবে।

একটি পরিবারে স্বাধীন ও ক্রীতদাস, পুরুষ ও নারী, ছোট, বড়, বাচ্চা, ধনী ও গরীব, শহরবাসী ও মরুবাসী সিয়াম পালনকারী, ভঙ্গকারী ইত্যাদির মাঝে কোন পার্থক্য নেই। এক কথায় এ দান পরিবারের সকল সদস্যকে হিসাবে রেখে, পরিবারে যতজন সদস্য আছে ততজনের ফিতরা আদায় করতে হবে। সাদকাতুল ফিতর ফরয হওয়ার জন্য যাকাতের সমপরিমাণ নিসাব হওয়া শর্ত নয়। যেহেতু তা ব্যক্তির উপর ফরয, সম্পদের উপর নয়।

সদকায়ে ফিতর আদায়ের সময়

সাদকাতুল ফিতর আদায়ের ফজিলতপূর্ণ সময় হলো ঈদের দিন সূর্যোদয়ের পর থেকে ঈদের সালাতের পূর্ব পর্যন্ত। ঈদের দু একদিন পূর্বেও ফিতরা আদায় করা জায়েয। কেননা সাহাবায়ে কেরাম এরূপ করেছেন। ঈদের নামাজের পর সদকায়ে ফিতর আদায় করা শুদ্ধ নয়।

ইবনু উমার (রাঃ) বলেন,
“নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) লোকেদের ঈদের নামাযের জন্য বের হওয়ার পূর্বে ফিতরার যাকাত আদায় দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন।”(বুখারী ১৫০৯)

সুতরাং ঈদের দিন ফিতরা আদায় করা সর্বোত্তম।

ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত এক হাদীসে এসেছে,

‘যে ব্যক্তি নামাজের আগে তা আদায় করে দেবে তবে তার সদকা গ্রহণযোগ্য হবে, আর যে নামাজের পর আদায় করবে তার সদকা সাধারণ দান বলে গণ্য হবে।’ (বর্ণনায় আবু দাউদ)
অর্থাৎ কেউ ঈদের জামাতের পর ফিতরা আদায় করলে তা সাধারণ দানে পরিনত হবে। সাদকাতুল ফিতরের যে নেকী, সেই নেকী আর পাওয়া যাবে না।

তাই ফিতরার খাদ্য ঈদের সালাতের আগেই বন্টন করা ওয়াজিব। ঈদের সালাত পর্যন্ত দেরি করা উত্তম নয়। বরঞ্চ ঈদের এক বা দুই দিন আগে আদায় করলেও অসুবিধা নেই। আলেমদের বিশুদ্ধ অভিমত হলো, ফিতরা আদায় করার সময় শুরু হয় ২৮ শে রমাদান থেকে। কারণ রমাদান মাস ২৯ দিনও হতে পারে। আবার ৩০ দিনও হতে পারে। তাই ঈদের আগে দিলে গরিব দুঃখীরা আগে থেকেই ঈদের আনন্দে শরীক হতে পারে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ ফিতরা ঈদের একদিন বা দুই দিন আগে আদায় করতেন। এছাড়া ফিতরা আদায়ের সময় যাতে সংকীর্ণ না হয়, সেইজন্য ঈদুল ফিতরের সালাত সামান্য দেরীতে পড়া উত্তম। এতেকরে ফিতরা আদায়ের যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়।

কে ফিতরা পাবে
কারা ফিতরা পাওয়ার যোগ্য বা কোন কোন প্রকারের লোক ফিতরা নিতে পারবে? এ বিষয়ে আলেমদের মধ্যে কিছু মতভেদ রয়েছে।

একদল আলেম মনে করেন, যারা সাধারণ সম্পদের জাকাতের হকদার তারাই সাদকাতুল ফিতরার হকদার। তাদের দলিল হলো, ফিতরাকে রাসুল সাঃ যাকাত ও সাদাকা বলেছেন। তাই যেটা সম্পদের যাকাতের খাত হবে, সেটা ফিতরারও খাত হবে। সাদাকার যেই খাত আল্লাহ সূরা তওবায় উল্লেখ করেছেন সেই খাদ সাদাকাতুল ফিতরের জন্যও হবে।

সুতরাং সেই হিসাবে আট প্রকারের লোক হলো, আল্লাহ্ বলেন,
“যাকাত হল কেবল ফকির, মিসকীন, যাকাত আদায় কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক এবং তা দাস-মুক্তির জন্যে-ঋণ গ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের জন্যে এবং মুসাফিরদের জন্যে, এই হল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (সূরাঃ আত তাওবাহ, আয়াতঃ ৬০)

অন্য এক দল আলেম মনে করেন, সাদাকাতুল ফিতর বা ফিতরা কেবল ফকির মিসকিনদের হক, অন্যান্যদের নয়। তাদের দলিল হলো,

ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর হাদিস, তিনি বলেন,
“আল্লাহর রাসূল ফিতরের যাকাত (ফিতরা) ফরজ করেছেন রোজাদারের অশ্লীলতা ও বাজে কথা-বার্তা হতে পবিত্রতা এবং মিসকিনদের আহার স্বরূপ .. ’ (আবু দাউদ, যাকাতুল ফিতর নম্বর ১৬০৬/ হাদিস হাসান, ইরওয়াউল গালীল নম্বর ৮৪৩)

সুতরাং উপরোক্ত হাদিসেই স্পষ্ট আছে যে, মিসকিনদের তথা,গরীব, দুঃস্থ, অসহায়, অভাবগ্রস্থকেই ফিতরা প্রদান করা যাবে।

উপরোক্ত মতকে সমর্থন জানিয়েছেন ইবনে তাইমিয়্যাহ, ইবনুল ক্বাইয়্যূম, শাওকানী, আযীমাবাদী, ইবনু উসাইমীনসহ আরো অনেকে। ( মাজমুউ ফাতাওয়া ২৫/৭৩,যাদুল মাআদ ২/২২, নায়লুল আউত্বার ৩-৪/৬৫৭, আওনুল মা’বূদ ৫-৬/৩, শারহুল মুমতি ৬/১৮৪)

অধিকাংশ আলেম উলামাদের মতে এই মতটিই অধিক সহীহ কারণ,

এই মতের পক্ষে স্পষ্ট দলিল বিদ্যমান। আর প্রথম মতটি একটি কিয়াস (অনুমান) মাত্র। আর দলিলের বিপরীতে কিয়াস বৈধ নয়।

ফিতরাকে যাকাত সম্বোধন করলেও উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। যেমনঃ ফিতরা এমন ব্যক্তির উপরও ওয়াজিব যার বাড়িতে সামান্য কিছু খাবার আছে মাত্র। কিন্তু যাকাত কেবল তার উপর ফরজ যার নিসাব পরিমাণ অর্থ- সম্পদ রয়েছে। যাকাত বাৎসরিক জমাকৃত ধন-সম্পদের কারণে দিতে হয়।আর ফিতরা সাওমের ত্রুটি বিচ্যুতির কারণে দিতে হয়। এসব কারণে ফিতরা ও যাকাতকে কখনোই এক মনে করা যাবে না।

এছাড়া সাদাকা শব্দটি দানের ব্যাপক অর্থ ব্যহৃত হয়। যেকারণে ফিতরাকে সাদাকা বলা হয়েছে। তাছাড়া যাকাত, ফিতরা এবং সাধারণ দানকেও সাদাকা বলা হয়। সুতরাং সাদাকা বললেই যে তা যাকাতকে বুঝাবে তা নয়।

যেমন রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন, ‘কুল্লু মা’রুফিন সাদাকা’ অর্থাৎ প্রত্যেক ভালো কাজ সদকা। তবে নি:সন্দেহে প্রত্যেক ভালো কাজ যাকাত নয়। তবুও রাসুলুল্লাহ সাঃ তা সাদাকা বলেছেন। তাই ফিতরাকে সাদাকা বলার কারণে তা যাকাতের অন্তর্ভুক্ত হবে না।

এছাড়া উল্লেখ্য যে, ফিতরার খাদ্যসমূহের মধ্যে মসজিদ, মাদ্রাসা অন্তর্ভূক্ত নয়। তবে মাদরাসার ছাত্র, শিক্ষক এবং মসজিদের ইমাম যদি ফকীর মিসকিনদের অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে তারা ফিতরার হকদার হবেন। বরং তারা অন্যান্য ফকীর মিসকীনদের থেকেও বেশি হকদার হবেন। কেননা এরা দ্বীনের শিক্ষা অর্জনে ও অন্যকে শিক্ষা দানে নিয়োজিত, যে গুণটি অন্যান্য ফকীর মিসকিনদের নেই।

কী দিয়ে ফিতরা দিতে হয়
আমাদের উপমহাদেশে টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করা হলেও হাদিসে খাদ্য দ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায়ের কথা এসেছে।

আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

“রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের মাঝে বর্তমান থাকা অবস্থায় আমরা সাদকাতুল ফিতর বাবদ এক সা‘ খাদ্য (গম) বা এক সা‘ খেজুর বা এক সা‘ যব বা এক সা‘ পনির অথবা এক সা‘ কিসমিস দান করতাম। আমরা অব্যাহতভাবে এ নিয়মই পালন করে আসছিলাম। অবশেষে মুআবিয়াহ (রাঃ) মদিনায় আমাদের নিকট আসেন এবং লোকেদের সাথে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, আমি শাম দেশের উত্তম গমের দু’ মুদ্দ পরিমাণকে এখানকার এক সা‘র সমান মনে করি। তখন থেকে লোকেরা এ কথাটিকেই গ্রহণ করে নিলো। আবূ সাঈদ (রাঃ) বলেন, আমি কিন্তু সারা জীবন ঐ হিসাবেই সদকাতুল ফিতর পরিশোধ করে যাবো, যে হিসাবে আমি রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে তা পরিশোধ করতাম।(সুনানে ইবনে মাজাহ-১৮২৯, বুখারী ১৫০৫, ১৫০৬, ১৫০৮, ১৫১০, মুসলিম ৯৮৫, তিরমিযী ৬৭৩, নাসায়ী ২৫১১, ২৫১২, ২৫১৩, ২৫১৪, ২৫১৭, ২৫১৮, আবূ দাউদ ১৬১৬, ১৬১৮, আহমাদ ১০৭৯৮, ১১৩০১, ১১৫২২, দারেমী ১৬৬৩, ১৬৬৪, সহীহ আবী দাউদ ১৪৩৩, ইরওয়াহ ৩/৩৩৭, তাহকীক আলবানীঃ সহীহ্।)

উপরোক্ত হাদিস দ্বারা সুস্পষ্ট যে, রাসুলুল্লাহ সাঃ থেকে ফিতরা আদায়ের নির্দেশ হচ্ছে, খাদ্যদ্রব্য (যেমনঃ গম), খেজুর, যব, পনির, কিসমিস। এই পাঁচটি নিয়মিত খাদ্য দ্বারাই রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সময়ে ফিতরা আদায় করা হতো। আর খাদ্যদ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায় হচ্ছে সুন্নাহ পদ্ধতি।

ফিতরার পরিমাণ
আমাদের দেশ ও উপমহাদেশে খাদ্যদ্রব্য গমকে হিসাবে ধরে ফিতরার টাকা নির্ধারণ করা হয়। উপরের উল্লেখিত হাদিসেও এসেছে কী পরিমাণ খাদ্য দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাঃ ফিতরা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং প্রত্যেকের জন্য মাথাপিছু এক “সা” খাদ্যশস্য সাদকাতুল ফিতর হিসাবে দিতে হবে। “সা” হচ্ছে তৎকালীন সময়ের এক ধরনের ওজনের পরিমাপক।

মাঝারি দেহের অধিকারী মানুষের হাতের চার “মুদে” এক ‘সা’ হয়। (অর্থাৎ দুই হাতের কব্জি একত্র করে মুনাজাতের মতো একত্রিত করে তাতে যতটুকু ফসল নেয়া যায়, ততটুকুকে বলা এক “মুদ “। মুদ দ্বারাই আরবে দানা জাতীয় শস্য মাপা হয়।একাধিক শস্য যদি এক-‘সা’ এক-‘সা’ মেপে কেজি দিয়ে ওজন করা হয়, তাহলে এক শস্যের ওজন অপর শস্যের ওজন থেকে কম-বেশী হবে। তাই কোনো নির্দিষ্ট ওজন দ্বারা সা নির্ধারিত করা সম্ভব নয়।

রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সুন্নাহ হচ্ছে তৎকালীন প্রচলিত খাদ্যদ্রব্যের এক সা দ্বারা একজনের ফিতরা আদায় করা। সেই হিসাবে আমাদের উপমহাদেশে প্রচলিত খাদ্যদ্রব্য হচ্ছে চাউল এবং আটা। সুতরাং সুন্নাহ হলো চাউল বা আটা দ্বারা এক সা করে একজনের ফিতরা আদায় করা। বর্তমানে আমাদের দেশে এক “সা”তে আড়াই কেজি চাউল হয়।

সা নিয়ে মতভেদ
আমাদের উপমহাদেশে অর্ধ সা গম বা আটার পরিমাপের অর্থ দ্বারা ফিতরা নির্ধারন করা হয়। যদিও হাদিসে পাঁচটি খাদ্যদ্রব্যের এক সা দেওয়ার কথা এসেছে। অর্ধ সা ফিতরা দেওয়ার ফতোয়াটি মুয়াবিয়ার রাঃ। যা আগের উল্লেখিত হাদিস থেকে বুঝা যায়। একইসাথে গম দ্বারা এই সা এর পরিমাণ হলো ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম যা ইরাকের প্রচলিত সা। আর মদিনার সা দিয়ে গমের পরিমাণ হলো ২ কেজি ৪০০ গ্রাম। সুতরাং মদিনা এবং ইরাকের সা এর পার্থক্য রয়েছে।

একইসাথে হাদিসে এসেছে এক সা দেওয়ার কথা। যা রাসুলুল্লাহ সাঃ এবং ইসলামের চার খলিফা পর্যন্ত বলবৎ ছিলো। পরে মুআবিয়া ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফা নির্বাচিত হন এবং ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী মদিনা থেকে দামেস্কে প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপরে দামেস্ক থেকে মদিনায় গম আমদানি হতে থাকে। সে সময় সিরিয়ার গমের মূল্য খেঁজুরের দ্বিগুণ ছিল। তাই খলিফা মুয়াবিয়া কোনো এক হজ্জ বা উমরা করার সময় মদীনায় আসলে মিম্বরে বলেন, আমি অর্ধ সা গমকে এক সা খেজুরের সমতুল্য মনে করি। লোকেরা তার এই কথা মেনে নেয়। এর পর থেকে মুসলিম জনগনের মধ্যে অর্ধ সা ফিতরার প্রচলন শুরু হয়।

উপরোক্ত কারণ গুলো থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, এক সা মদিনার পরিমাপেই একটি ফিতরা আদায় করতে হবে। কেউ যদি ইরাকের সা এর পরিমাপ ধরে মুয়াবিয়ার ফতোয়া অনুযায়ী অর্ধ সা দিয়ে ফিতরা দেয়, তাহলে তা সুন্নাহ সম্মত হবেনা। কেননা উপরের উল্লেখিত হাদিসে সাহাবী আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাঃ)সহ তৎকালীন অনেকে মুয়াবিয়ার ফতোয়াকে মেনে নেয়নি।

টাকা দিয়ে ফিতরা
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ফিতরা আদায় করা বিভিন্ন কারণে সমস্যাযুক্ত। যারফলে বিভিন্ন আলেম উলামারা খাদ্যদ্রব্যের হিসাব করে টাকা দিয়ে ফিতরা আদায়ে ঐক্যমত্য পোষণ করেন। আমাদের উপমহাদেশে গমের এক সা ৩ কেজি ৩০০ কে দুই ভাগ তথা অর্ধ সা হিসাব ধরে ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম গমের বা আটার মূল্য ধরে সর্বনিম্ন ফিতরা দেওয়া হয়। একইভাবে খেজুর, কিশমিশ, পনির, যব দ্বারাও টাকার পরিমান করা হয়।

যদিও এক পক্ষ এই টাকা দিয়ে ফিতরা আদায়কে জায়েজ নয় বলে সম্বোধন করেন। তাদের যুক্তি হলো, রাসুলুল্লাহ সাঃ সময়েও মুদ্রার প্রচলন ছিলো। মুদ্রা দিয়ে ফিতরা আদায় জায়েজ হলে তিনি তা মুদ্রা দিয়েই দেওয়ার নির্দেশ দিতেন। যেমন যাকাতের ক্ষেত্রে দিয়েছেন। একইসাথে ফিতরা আদায়ে লক্ষ্য উদ্দেশ্য হলো মিসকিনদের ভালো খাওয়া দাওয়া করানো। সেই কারণে টাকা নয় বরং খাদ্য দ্বারাই ফিতরা আদায় করতে হবে। যেমন হাদিসে সুস্পষ্টভাবে এসেছে।

অন্য পক্ষের যুক্তি হলো, বর্তমান পরিস্থিতি একজন মিসকিন তার ফিতরা সংগ্রহ করতে গেলে দু চারজনের বেশি সংগ্রহ করতে পারবে না ওজনের কারণে। একইসাথে শুধু খাদ্য দিয়েই একজন মিসকিন জীবনযাপন করতে পারেন না। তার প্রয়োজনীয় সবকিছু পূরণ করতে হলে টাকার প্রয়োজন। একইসাথে টাকা বহন করতে সুবিধাজনক। টাকা দিয়ে ঐ মিসকিন তার পছন্দের খাদ্য কিনে খেতে পারবে।

একজন মিসকিন যদি খাদ্য ফিতরা সংগ্রহ করে, তাহলে তার অতিরিক্ত খাদ্য জমা হয়ে যাবে। যা তাকে কম দামে দোকানে বিক্রি করতে হবে। এটা তারজন্য লোকসান। সুতরাং খাদ্যদ্রব্য নয় সময়ের পরিস্থিতির কারণে অর্থ দিয়ে ফিতরা আদায় করা যুক্তিযুক্ত। যা অধিকাংশ মুসলিমের ঐক্যমত্যের কারণে ইনশা- আল্লাহ্ তা কবুল হবে।

শুভংকরের ফাঁকি
আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি পাঁচ প্রকার খাদ্য দ্বারা ফিতরা আদায় করা যাবে। যা তৎকালীন আরবের প্রধান খাদ্য ছিলো। সেই হিসাবে যে অঞ্চলের যে খাদ্য প্রধান সেই খাদ্য দিয়েই ফিতরা দেওয়া সুন্নাহ। যদিও আমাদের উপমহাদেশে হাদিসে বর্ণিত পাঁচ প্রকারের খাদ্য (যব, খেজুর, পনির, কিসমিস ও গম) এর পরিমাপ করে ফিতরার টাকা নির্ধারিত হয়।

সেই হিসাবে উন্নত মানের খেজুরের দাম বর্তমান সময়ে সবসময়ই বেশী হয়। এরপরের স্থান রয়েছে পনির যার মূল্য খেজুরের চাইতে কিছু কম। এভাবে কিসমিস, যব এবং গম। যা হাদিসে উল্লেখিত খাদ্যদ্রব্য।

আমাদের উপমহাদেশে গমের অর্ধ সা ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম ধরে সর্বনিম্ন ফিতরা নির্ধারন করা হয়। যে হিসাব দিয়েই ধনী গরিব, সচ্ছল, অসচ্ছল, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত সবাই ফিতরা আদায় করে। যা যৌক্তিক কারণে কখনোই সঠিক নয়। কেননা সামর্থ্য অনুযায়ী ফিতরা দিতে হবে।

প্রতিবছর গমের হিসাব ধরে ফিতরা টাকা প্রকাশিত হওয়ার কারণে অধিকাংশ মুসলমানই জানেনা যে তাকে আসলেই কত টাকা ফিতরা দেওয়া উচিত। যদিও ইসলামিক ফাউন্ডেশন সকল খাদ্যদ্রব্যের টাকা নির্ধারিত করে দিলেও, প্রচারিত হয় শুধুমাত্র সর্ব নিম্ন ফিতরা টাকা ৬০/৭০/৮০ টাকার মতো। যা একজন রিকশাওয়ালা, দিনমজুরসহ খুবই সামান্য আয়ে চলে এমন ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য।

রাসুল সাঃ এর সুন্নাহ থেকে সরে এসে টাকা দিয়ে ফিতরা আদায়ের কারণে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। যিনি ফিতরা দিচ্ছেন তিনি সুন্নাহ মানছেন না। কারণ যিনি নিচ্ছেন তিনি খাদ্য না নিয়ে টাকা নিতে আগ্রহী। যারফলে যারা ফিতরা নিচ্ছেন তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অনেকভাবে।

যদি রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সুন্নাহ অনুযায়ী খাদ্য দিয়ে যেমনঃ নূন্যতম চাউল দিয়ে ফিতরা আদায় করতে হলে, যিনি ফিতরা দিবেন তিনি নিজেই খুঁজে খুঁজে তা দিয়ে আসবেন। এবং এটাই সুন্নাহ। এক্ষেত্রে ফিতরা গ্রহীতাকে কষ্ট করে মানুষের দুয়ারে যেতে হবে না।

এছাড়াও একজন ফিতরা গ্রহীতা যখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য পাবে, সেই খাদ্য সে এমন কারো কাছে বিক্রি করবে যে কম আয়ের মানুষ। এতেকরে দুই শ্রেণীই উপকৃত হতে পারে। তাছাড়া সারা উপমহাদেশে গমের দামে ফিতরা দেওয়ার কারণে একজন দানকারী খুবই সামান্য টাকাই ফিতরা দিচ্ছে। যা অন্যান্য খাদ্য দিয়ে দিতে হলে আরো অনেক বেশীই দিতে হতো। একইভাবে কম দেওয়ার কারণে ফিতরা গ্রহীতাও কম টাকা পাচ্ছে।

একজন মিসকিন যদি পুরো একটি ফিতরা পেতো তাহলে সে নূন্যতম ২০/৩০ টির চাইতেও বেশী ফিতরা পেতো। যা চাউল দিয়ে হিসাব করলেও (২কেজি৫০০ গ্রাম ধরে) ৫০ /৭৫ কেজি হতো। যার মূল্য ৩০০০/৪৫০০ টাকা হতো। অথচ এখন ঘরে ঘরে গিয়ে ফিতরা আদায় করতে গিয়ে ১০ /২০ টাকার বেশী পায় না। যার সর্বমোট হিসাব করলে ১০০০ /১৫০০ টাকার বেশী কখনোই সম্ভব নয়।

নূন্যতম হিসাব ধরে যদি একজন গ্রহীতা তিন থেকে চার হাজার টাকা পেতে পারে। তাহলে বেশী হিসাব ধরে ফিতরা দিলে কত টাকা হতে পারে। আর আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে অবশ্যই অর্ধাংশ লোক বেশী মূল্যের ফিতরা দেওয়ার উপযোগী।

এই কারণে দাতা এবং গ্রহীতা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দাতা সঠিক নিয়মে ফিতরা না দেওয়ার কারণে পরিপূর্ণ নেকী পাচ্ছে না। আর গ্রহীতা কম পাওয়ার কারণে আর্থিকভাবে লোকসানে পড়ছে। এভাবেই দ্বীন পালন করতে গিয়ে আমরা শুভংকরের ফাঁকিতে পড়ে গেছি। সুতরাং আমাদের উচিত সুন্নাহ পদ্ধতিতে ফিতরা আদায় করা যাতে আল্লাহ্ থেকে পরিপূর্ণ নেকী পাওয়া যায় এবং গরিব দুঃখীদেরও অসচ্ছলতা দূর হয়।

সাদকাতুল ফিতরের উপকারিতা
ক) এই দান যেহেতু সাওম পালনের ভুল- ত্রুটির জন্য, সেহেতু এই দানের বিনিময়ে আল্লাহ্ আমাদের গোনাহ গুলোকে মিটিয়ে দেন।

খ) রাসুলুল্লাহ সাঃ হচ্ছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। তিনি সমাজে সাম্যাবস্থা তৈরি করার জন্য এই সাদকার প্রচলন করেছেন। যাতে ধনী গরিব দুঃস্থ অসহায় সকলে মিলে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন।

গ) এছাড়াও আল্লাহ আমাদের শারিরীক সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু দান করেছেন। যার কারণে আমরা বেঁচে থেকে সুস্থ শরীরে এক মাস সিয়াম পালন করতে পারলাম। সুস্থতা এবং আমল করতে পারার কারণে আল্লাহ্ নিকট শুকরিয়া স্বরুপ হলো এই ফিতরা। যা দেহের যাকাত নামেও পরিচিত।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, প্রতিটি ব্যক্তিকে ঘরের সকল সদস্যদের ফিতরা দিতে হবে, যার ঘরে দুই তিন বেলার পর্যাপ্ত খাবার রয়েছে। একইসাথে খাদ্যদ্রব্য দ্বারাই ফিতরা আদায় সুন্নাহ। তবে পরিস্থিতির কারণে টাকা দিয়েও ফিতরা আদায় করা যাবে। তবে তা অবশ্যই সামর্থ্য অনুযায়ী দিতে হবে। সুতরাং আমাদের সকলের উচিত সামর্থ্য অনুযায়ী সুন্নাহ পদ্ধতিতে ফিতরা আদায় করা।

তথ্য ইন্টারনেট থেকে

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী

১৬ এপ্রিল, ২০২২
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।
[email protected]

“টিপে” এতো সমস্যা কেন?

images

গরমের নাভিশ্বাস, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, রমজানের সাওম, সবকিছুকে পেছনে ফেলে গত কয়েকদিন ধরে যে বিষয়টা টক অব দ্যা কান্ট্রি তা হলো “টিপ”। টিপ দেওয়াকে কেন্দ্র করে একজন শিক্ষিকার সাথে যে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটে গেলো তা খুবই দুঃখজনক। এই ঘটনা আজ আমাদের মানবিকতা, ধার্মিকতা এবং অসাম্প্র্রদায়িক চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

টিপ পরাকে কেন্দ্র করে যে মৌলবাদী সুড়সুড়ি সারা দেশকে উসকে দিচ্ছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা এই টিপ আজ দেশকে দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। তাই টিপ পরা এবং না পরা নিয়ে কোথায় কার কী সম্মতি এবং আপত্তি আছে তা আমাদের সকলের দৃষ্টিগোচর হওয়া উচিত।

শুরুতেই বলতে হচ্ছে, শ্রদ্ধেয় শিক্ষিকার সাথে যা ঘটেছে তার জন্য জাতি হিসাবে আমরা লজ্জিত। তিনি একজন মা এবং একজন শিক্ষাগুরু। তাঁর সাথে এমন আচরণ কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা ঐ পুলিশ যে দৃষ্টিকোণ থেকে ঐ শিক্ষিকার সাথে এমন আচরণ করেছেন, সেই আচরণের অধিকার কেউ তাকে দেয়নি। আমাদের রাষ্ট্র কিংবা ধর্ম কোনো অবস্থান থেকেই কোনো সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু কারো সাথেই এভাবে লাঞ্চিত করার কোনো অনুমতি নেই।

অভিযুক্ত পুলিশ যে দৃষ্টিভঙ্গিতে এই আচরণ করেছে, সেই একই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের মুসলিম সমাজের অনেকেই পোষণ করে। যা আপাত ধর্মীয় দৃষ্টিতে অপরাধ না হলেও অযৌক্তিক জায়গায় প্রয়োগে ধর্মীয় যথেষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কেননা ইসলাম কাউকেই (হোক মুসলিম বা বিধর্মী) সরাসরি হেনস্তা করার অধিকার কাউকে দেয়নি। সুতরাং টিপ নিয়ে যা ঘটেছে তা অবশ্যই অযৌক্তিক এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

আমরা জাতিগতভাবে বাঙ্গালী। তাই আমাদের সংস্কৃতিতে বাঙ্গালিয়ানা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এই সংস্কৃতির উপর কোনো বাঁধাই আমরা মেনে নিতে পারি না। যে নিজেকে বাঙ্গালী বলে পরিচয় দিতে চায় তাকে কেউই তার সংস্কৃতি থেকে আলাদা করতে পারবে না। এমনকি ইসলামও তাকে বাঁধা দেওয়ার কথা বলে না। তাহলে এই অধিকাংশ মৌলবাদীদের সমস্যা কোথায়?

যেসব মুসলিম নিজেদের বাঙ্গালি পরিচয়ের চাইতে মুসলিম পরিচয়কে বড় করতে চায়, তাদের জন্য তখন সংস্কৃতির চাইতে ধর্মটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আর তখনি মুসলিম জাতীয়তাবাদের সাথে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সংঘর্ষ বাঁধে। কেননা ইসলাম বিজাতীয় সংস্কৃতি ধারণ কারার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্ট আয়াতে আল্লাহ্ বলেন,

“তোমরা কাফির ও মুনাফিকদের অনুসরণ করবে না।” ( সূরা আহযাব: ৪৮)
অর্থাৎ যে নিজেকে মুমিন মুসলিম দাবি করবে সে কখনোই কাফির-মুশরিক, ইহুদী-নাছারা, বৌদ্ধ-মজুসী, বেদ্বীন-বদদ্বীন ইত্যাদি বিভিন্ন কোনো ধর্মাবলম্বীদেরই অনুসরণ করতে পারবে না। তার জন্য বিজাতীয় ধর্মীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করা হারামের অন্তর্ভুক্ত।

অনুসরণ অনুকরণ বিষয়ে হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর বাণী হলো,

হযরত ইবনে উমার রাঃ হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের অনুরূপ অবলম্বন করে,সে তাঁদেরই দলভুক্ত। (সুনানে আবূ দাঊদঃ ৪০৩১)

অর্থাৎ কেউ ইসলামের আদর্শের বাইরে গিয়ে অন্য কোনো আদর্শ বা সংস্কৃতিকে পছন্দ করে লালন করতে পারবে না। যদি কেউ এমন করে তাহলে সে ঐ দলের বা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে। উপরোক্ত কুরআন এবং হাদিসের আলোকে ইসলামে কোনো মুমিন মুসলিম এমন কোনো বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুসরণ করতে পারে না। যেসব সংস্কৃতি বিধর্মীদের ধর্মীয় আচার কিংবা তাদেরকে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের থেকে আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দেয়।

উপমহাদেশে টিপের ইতিহাস যদি আমরা জানার চেষ্টা করি, তাহলে জানতে পারবো যে, টিপ সনাতন ধর্মাবলম্বী তথা হিন্দুদের ধর্মীয় একটি আচার এবং প্রথা। যা বাঙ্গালী হিন্দুরা যুগ যুগ ধরে মেনে আসছে। টিপের সম্পর্ক হিন্দু নারীদের সিঁদুরের সাথে। যে সিঁদুর হিন্দু বিবাহিত নারীরা তাদের স্বামীদের মঙ্গল কামনায় কপালে ধারণ করেন। শুধু নারী নয় সনাতনী পুরুষরাও তাদের বিভিন্ন পূজার্চনায় টিপ বা তিলক পরিধান করে থাকেন। অনেক সনাতনী গোষ্ঠীর নারী পুরুষ উভয়ই লম্বা তিলক দিয়ে থাকেন। যা উপমহাদেশে ইসলাম আবির্ভাবের পূর্ব থেকেই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পালন করে আসছে।

ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় উপমহাদেশে ইসলাম আবির্ভাবের পরে যারা ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলামে প্রবেশ করে তারাও তাদের আগের সংস্কৃতি থেকে সরে আসেনি। সেই সাথে কুরআন হাদিসের সঠিক চর্চা এবং ধর্মীয় জ্ঞানের সংকীর্ণতার কারণেও অধিকাংশ মুসলমান জানতে পারেনি বিজাতীয় সংস্কৃতি ইসলামে ধারণ করা নিষিদ্ধ। যার ফলে এখনো মুসলিম বাঙ্গালীরা জানে না- টিপসহ আরও অন্যান্য যেসব সংস্কৃতি আছে, যা সরাসরি বিধর্মীদের নিদর্শন তা ইসলামে নিষিদ্ধ।

অতএব, যারা নিজেদেরকে মুসলিম ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচয় দিতে চায় তাদের জন্য ইসলামী সংস্কৃতির বাইরে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় সংস্কৃতি নিষিদ্ধ। আর যারা নিজেদের বাঙ্গালী পরিচয় দিয়ে চলতে চায়, তাদেরকে কেউ ধর্মের ধোঁয়া তুলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যাবে না। কেননা ইসলাম কখনোই কারো টুঁটি চেপে ধরার শিক্ষা দেয় না। অতএব উপরোক্ত ঘটনার মতো ইসলামকে ব্যবহার করে ধর্মকে কলঙ্কিত করা যাবে না।

যেসব মুসলমানরা এই ঘটনায় ঐ পুলিশের ইসলামী দৃষ্টিকোণ খোঁজার চেষ্টা করছেন। তাদের জন্য সত্য হলো, দ্বীন প্রচার প্রথমে নিজ ঘর থেকেই শুরু করতে হয়। যারাই আজ টিপ বিরোধী তাদের উচিত নিজ নিজ মা বোনসহ সকল মুসলিম আত্মীয়স্বজনদের সামনে টিপের ব্যাপারে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা। সেই সাথে যারাই টিপের পক্ষপাতি তাদেরকে এড়িয়ে চলা। কেননা ইসলাম জোর করে ধর্ম পালনে বাধ্য করে না। সেই সাথে কোনো বিধর্মীকে জোর করে লাঞ্চিত অপদস্থ করার অধিকার ইসলাম কখনোই কাউকে দেয় নি

আর যারা নিজেদের মুসলিম এবং বাঙ্গালী উভয়ই দাবি করতে চান। তাদের জন্য নীতি বাক্য হলো, কখনোই দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা যায় না। আপনি ততক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে বাঙ্গালী বলে পরিচয় দিতে পারেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার বাঙ্গালিয়ানা আপনার ইসলামে আঘাত না আনে। যদি বাঙ্গালিয়ানার কোনো কিছু ইসলামে আঘাত আনে তাহলে তা আপনার ঈমানে আঘাত আনবে। আর আপনার ঈমান আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া মানেই আপনি ইসলাম থেকে বেরিয়ে হয়ে যাওয়া।

সুতরাং আমাদের সকলেরই উচিত সঠিক ইসলাম জানার চেষ্টা করা। অহেতুক বিচ্ছিন্ন ঘটা ঘটিয়ে ইসলামকে কলুষিত করা কখনোই কারো উচিত নয়। সবারই উচিত আগে নিজের পরিবার পরিজনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। তারপর সুন্দর আচরণের দ্বারা অন্যান্যদেরও ইসলামের দাওআত দেওয়া। যাতে আমরা সত্যিকারের প্রকৃত মানুষ এবং মুমিন হতে পারি।

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।

অটিজমঃ বিকশিত হোক সব প্রতিভা

16489

অটিজম হচ্ছে স্নায়ুর বিকাশজনিত মানসিক ও শারিরীক একটি রোগ। যা শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশকে বাঁধাগ্রস্থ করে। অটিজম সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিবছর ২ এপ্রিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হয়। ২০২২ সালের অটিজম দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, “এমন বিশ্ব গড়ি, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির প্রতিভা বিকশিত করি। অর্থাৎ অটিস্টিক ব্যক্তিদের জন্য আমাদের এমন পরিবেশ তৈরি করা উচিত, যেন তারা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিয়ে সমাজের আর দশজনের মতো তাদের প্রতিভা বিকশিত করতে পারে। বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই এই রোগ সম্পর্কে অসচেতন। তাই এই রোগ সম্পর্কে আমাদের জানা খুবই জরুরী।

অটিজম সমস্যা কীঃ
অটিজম হচ্ছে শিশুদের স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যা সম্পর্কিত একটি রোগ। যে রোগে আক্রান্ত হলে একটি শিশু তার সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হয়। তার চারপাশের পরিবেশ ও ব্যক্তির সাথে স্বাভাবিক কথাবার্তা বা ইশারা ইংগিতের মাধ্যমেও যোগাযোগ করতে পারে না। মোটকথা যে সমস্যা একটি শিশুকে শারীরিক এবং মানসিক দিক থেকে অপূর্ণ করে তাকে অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার বলে। যদিও অটিজমকে অনেকে মানসিক রোগ মনে করে কিন্তু এটা মানসিক রোগ নয়।

কী কারণে অটিজম হতে পারেঃ
অটিজম স্নায়ুবিকাশ জনিত রোগ হলেও এই রোগের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট কোনো কারণকে দায়ী করা যায় না। তবে গর্ভাবস্থার কিছু কিছু বিষয়কে অটিজমের কারণ হিসেবে দেখা হয়। গর্ভাবস্থায় অধিক দুশ্চিন্তা করা, পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, অতিরিক্ত ঔষধ সেবন, মায়ের ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস। গর্ভকালীন সংক্রমণ যেমনঃ মাম্পস, রুবেলা, মিসেলস ইত্যাদি হওয়া।

এছাড়াও গর্ভাবস্থায় মায়ের সাথে পরিবারের সম্পর্কের ঘাটতি থাকা, দুশ্চিন্তা করা, বিষণ্ণতায় থাকা, মৃগীরোগ, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার, বাইপোলার ডিসঅর্ডার সিজোফ্রেনিয়া, হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার ইত্যাদিকেও অটিজমের কারণ হিসাবে দেখা হয়।

অটিজমের লক্ষণ সমূহঃ
খুব ছোট থেকেই অটিজমের লক্ষণ গুলো শিশুদের মধ্যে প্রকাশ পায়। বিশেষকরে শিশু তার এক বছর বয়সের মধ্যে আধো আধো কথা বা বোল উচ্চারণ করতে না পারা। দেড় বছরের মধ্যে একটি শব্দও বলতে না পারা। দুই বছরের মধ্যে দুই বা তিন শব্দের অর্থবোধক বাক্য না বলা। কিংবা কিছু শেখার পর আবার ভুলে যাওয়া। কিংবা বাচ্চা যদি তার পছন্দের বস্তুর দিকে ইশারা ইংগিত করতে না পারা। বাচ্চার বয়স অনুযায়ী সামাজিক আচরণ করতে না পারা ইত্যাদি হচ্ছে অটিজমের খুবই প্রাথমিক কিছু লক্ষণ।

উপরোক্ত প্রাথমিক লক্ষণ গুলোর পাশাপাশি যদি দেখা যায় আসলেই শিশুর ভাষা শিখতে সমস্যা হচ্ছে, বা একেবারেই মা–মা, বা–বা, চা–চা, ইত্যাদি এই জাতীয় শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না। সেইসাথে কারো চোখের দিকে চোখ রাখতে পারছে না। বা নাম ধরে ডাকলে সাড়া দিচ্ছে না। কিংবা সমবয়সী কারো সাথে মিশতে পারছে না বা মিশতে চাইছে না। কেউ আদর করতে চাইলে তা নিতে না পারা। হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া। অন্যের শোনা কথা বারবার বলা। বা যেকোনো বিষয়ে একই আচরণ বার বার করা হচ্ছে অটিজমের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। এইসব লক্ষণ প্রকাশের সাথে সাথে শিশুকে অতিদ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

পারিবারিক ভূমিকাঃ
অটিজম আক্রান্ত শিশু ও ব্যক্তির সুস্থতার জন্য পরিবার ও সমাজের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। অটিস্টিক শিশুদের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন পরিবারের অকৃত্রিম ভালোবাসা। তাই রোগ নির্ণয়ের সাথে সাথে পরিবারকে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে। এই রোগ থেকে একমাত্র বাবা-মাই তার সন্তানকে যতটুকু সম্ভব সুস্থ করতে পারে। তাই বাবা-মাকে অটিজমের উপর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিতে হবে যাতে শিশুর অস্বাভাবিক আচরণ পরিবর্তনের জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।

একইসাথে স্কুলে ও বাড়িতে শিশুকে যাবতীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দিতে হবে। যাতে করে শিশুটি সামাজিক ও পারিবারিক রীতিনীতি শেখার চেষ্টা করতে পারে। বিশেষকরে সামাজিক ও পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিশুকে সবার সাথে মেলামেশার সুযোগ করে দিতে হবে।

এছাড়াও যে কাজ গুলো শিশু করতে আগ্রহী এবং যা সে ভালো করে করতে পারে, তাকে সেই কাজ বেশী বেশী করার জন্য উৎসাহ দিতে হবে। বিশেষ করে ছবি আঁকা, গান গাওয়া, খেলাধুলা ইত্যাদির প্রতি তার আকর্ষণ বাড়াতে হবে। সেইসাথে শুরু থেকেই শিশুকে মূলধারার স্কুলে পাঠাতে হবে। যাতে সে নিজেকে সকলের সাথে মিশতে উপযোগী করতে পারে। একইভা‌বে স্কুলের শিক্ষক, চিকিৎসক এবং থেরাপিস্ট সকলকে একযোগে চিকিৎসার জন্য কাজ করতে হবে।

সামাজিক ভূমিকাঃ
পরিবারের পাশাপাশি অটিস্টিক শিশুদের জন্য সামাজিক দায়বদ্ধতা ও কর্মকাণ্ড তাদের সুস্থ করে তোলার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেশে সামাজিক লাঞ্চনা এবং অবহেলার কারণে পরিবার থেকেই অটিস্টিকদের সবার থেকে আড়াল রাখে। যা শিশুদের সুস্থ হওয়ার অন্তরায়। তাই আড়াল না করে সামাজিকভাবে এই রোগীদের প্রতি ভালোবাসা ও আস্থা দেওয়া উচিত। যাতে তারা সামাজিকভাবে সকলের সাথে মেলামেশার সুযোগ পায়।

সেইসাথে তাদের নিয়ে ঠাট্টা মশকরা, হেয় প্রতিপন্ন বা অবাঞ্ছিত করা কখনোই উচিত নয়। সামাজিকভাবে তাদের অযোগ্যতাকে কখনোই প্রকাশ করা উচিত নয়। বরং তাদের নূন্যতম কাজেরও প্রসংশা এবং বাহবা দিতে হবে। যাতে সমাজের প্রতিটি স্তরে তাদের গ্রহনযোগ্যতা সৃষ্টি হয়। এতে করে তারাও সমাজের একটি অংশ হয়ে উঠতে পারবে। আর এভাবেই সকলের ভালোবাসা ও আন্তরিকতা পেলে একটি অটিস্টিক শিশু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।

রাষ্ট্রীয় ভূমিকাঃ
অটিস্টিক শিশুদের উন্নতির জন্য রাষ্ট্রের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হলো জনগণের মধ্যে অটিজম নিয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা। যাতে দেশের প্রতিটি মানুষ অটিজম সম্পর্কে ধারণা পায়। সাধারণ মানুষেরা যখন অটিজম সম্পর্কে জানতে পারবে, তখন তারা রোগের শুরুতেই শিশুদের চিকিৎসা দিতে পারবে।

সচেতনতার পাশাপাশি অটিজমের চিকিৎসার জন্য সুনির্দিষ্ট হাসপাতাল গড়ে তুলতে হবে। একইসাথে প্রতিটি হাসপাতালে অটিজম কর্ণার তৈরি করে চিকিৎসা দিতে হবে। ডাক্তারি চিকিৎসার চাইতে প্রশিক্ষণই এই রোগের মূল চিকিৎসা, তাই প্রতিটি শহরে অটিস্টিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।

যদিও ইতিমধ্যে সরকারি পর্যায়ে অটিজম নিয়ে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে৷ যেমনঃ সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে মিরপুরে চালু হয়েছে ‘অটিজম রিসোর্স সেন্টার’৷ সেই সাথে যারা অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে কাজ করেন তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া, অটিস্টিক শিশুদের অবস্থা পরিমাপ সহ আরও অন্যান্য প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠন করা হয়েছে ‘সেন্টার ফর নিউরোডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অটিজম ইন চিলড্রেন’৷ এছাড়া ঢাকা শিশু হাসপাতালে রয়েছে ‘শিশু বিকাশ কেন্দ্র’ ইত্যাদি।

বিকশিত হোক সব প্রতিভাঃ
২০২২ সালের অটিজম দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, “এমন বিশ্ব গড়ি, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির প্রতিভা বিকশিত করি।” অর্থাৎ অটিস্টিকদের জন্য এমন পরিবেশ পরিস্থিতি আমাদের দেওয়া উচিত, যাতে তারাও তাদের সুপ্ত প্রতিভা গুলো জনসমক্ষে নির্ভয়ে প্রকাশ করতে পারে। আর এভাবেই অটিজম আক্রান্তরা যাতে ধীরে ধীরে সুস্থ জীবনে ফিরে এসে কর্মক্ষেত্রেও প্রবেশ করতে পারবে। অটিস্টিকরা সমাজ এবং পরিবারের বোঝা নয়। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের সহযোগিতায় পরিপূর্ণ প্রশিক্ষণ পেলে একজন অটিস্টিকও হয়ে উঠতে পারে সমাজ এবং দেশের সম্পদ। অটিস্টিকরা প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিভার উন্নতি করে চাইলে কর্মক্ষেত্রেও যোগদান করতে পারে।

প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে তাদের নিষ্প্রভ প্রতিভাকে বিকশিত করে সুস্থ সবল মানুষে রূপান্তরিত করাই হচ্ছে এই বছরের অটিজম দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। আর এভাবেই একজন অটিস্টিক যদি তার প্রতিভা বিকশিত করে সমাজের মূল ধারার সাথে মিশে উপার্জনক্ষম ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে সেটাই হচ্ছে বড় পাওয়া। সেই সাথে সকলের সার্বিক সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে ধীরে ধীরে অটিস্টিকরা সুস্থ হয়ে কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতে পারলে, তা পরিবার, সমাজ এবং দেশের জন্য হবে বড় পাওয়া

তাই আমাদের উচিত অটিস্টিকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে সমাজের উপযোগী করে গড়ে তোলা। যদিও এই কাজে প্রচুর বাঁধা এবং প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তবুও সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা থাকলে এক সময় না এক সময় অবশ্যই সফলতা আসবে। সকলের সহযোগিতা আছে বলেই এখন অটিস্টিকরা পরিবার সমাজ এবং রাষ্ট্রের যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। যদি এই সুযোগ সুবিধা অব্যাহত রাখা যায় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এই অটিস্টিকরাই হয়ে উঠবে দেশের সম্পদ।

অটিজম কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের একক সমস্যা নয়। অটিজম একটি জাতীয় সমস্যা। তাই এই সম্পর্কে সর্বস্তরের সচেতনতা খুবই জরুরী। সেই সাথে অনেক ক্ষেত্রে অনেক শিশু অটিজমের প্রাথমিক লক্ষণ নিয়ে জন্ম নিলেও সময়ের সাথে সাথে তা দূর হয়ে যায়। তাই কোন শিশু স্বভাবগতভাবে একটু বেশি অস্থির, চঞ্চল, রাগী ও জেদী প্রকৃতির হয়ে থাকলে তাকে অটিস্টিক মনে করা উচিত হবেনা। তাই প্রতিটি শিশুর প্রতি পরিপূর্ণ যত্নবান হওয়া উচিত। যাতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ শিশুর মধ্যে প্রকাশ পেলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যায়।

তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
২৮ মার্চ, ২০২২
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।

বিশ্ব পানি দিবসঃ চাই জনসচেতনতা সর্বস্তরের

gfty

২২ মার্চ, বিশ্ব পানি দিবস। পৃথিবী ব্যাপী পানির প্রয়োজনীয়তা, নিরাপদ পানির সংস্থান ও সুপেয় পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ১৯৯৩ সাল থেকে সারাবিশ্বে একযোগে ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস পালিত হয়ে আসছে। সেইসাথে প্রতিবছর বিভিন্ন বিষয়কে প্রতিপাদ্য করে এই দিবস পালিত হয়।

প্রতিবছরের ন্যায় ২০২২ সালের বিশ্ব পানি দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছেঃ- “Groundwater: Making the Invisible Visible” অর্থাৎ “ভূগর্ভস্থ পানিঃ অদৃশ্য দৃশ্যমান করা”। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে পানিকে কেউ গুরুত্ব সহকারে দেখে না। এর কারণ ঝড় বৃষ্টি বন্যার পানি আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক চিত্র। তাই আমাদের কাছে পানি বিষয়টি সবসময়ই গুরুত্বহীন। অথচ সুপেয় পানির অভাব দিনদিন বাড়ছেই। তাই আমাদের সুপেয় পানির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, পানি দূষণের কারণ ও প্রতিকার, পানির অপচয় রোধ এবং পানির উৎসের যথাযথ সংরক্ষণ নিয়ে জানার উচিত।

মানব জীবনে পানির গুরুত্বঃ
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য পানি একটি অপরিহার্য উপাদান। বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমাদের শরীরের ৬০-৭০ ভাগেরও বেশি হচ্ছে পানি, এজন্য সারা বছরই পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। খাদ্যে উপাদানের মধ্যে পানি হচ্ছে একমাত্র ক্যালোরি বিহীন উপাদান যা মানুষের শরীরে ক্যালোরির মাত্রা ও পুষ্টি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।

পানি যে শুধু পিপাসা মেটায় তা নয়। পানি মানুষের শরীরে পানিশূন্যতা ও ক্লান্তি দূর করে তাকে শক্তি যোগাতে সাহায্য করে। সেইসাথে শরীরে তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষা, হজমশক্তি বৃদ্ধি, কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণ, পরিপাকতন্ত্রকে সবল করা, কিডনিতে পাথর হতে প্রতিহত করা, রক্ত সঞ্চালন সঠিক রেখে রক্তচাপ ঠিক রাখা ইত্যাদি নানাবিধ কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

পানিশূন্যতার কুফলঃ

পানি মানব শরীরে অতীব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিধায়, শরীর পানিশূন্য হয়ে গেলে অনেক ধরণের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমনঃ শরীরে ইলেক্ট্রোলাইট এর ইমব্যালেন্স হতে পারে। যারফলে তীব্র মাথাব্যথা হয়ে থাকে অনেকেরই। তাই জ্বরের সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করা উচিৎ। যারা পানিশূন্যতায় ভোগেন তারা সবসময় তৃষ্ণাবোধ করেন। তাদের মুখ, ঠোঁট, জিহ্বা এবং ত্বক অনেক শুষ্ক হয়ে যায়। অবস্থা যখন চরমে পৌঁছায় তখন তারা গাঢ় রংয়ের প্রসাব, মাথা ঘোরা এবং বুকে ব্যথা ইত্যাদি অনুভব করে।

কম পানি পানে হজমে সমস্যা হয়। ফলে কোষ্ঠকাঠিন্যতা দেখা দেয়। পানিশূন্যতায় শরীরের তাপমাত্রার ভারসাম্য হারিয়ে যায়। ফলে ঝিমুনি লাগে, দুর্বলতা বাড়ে এবং সবসময় খুব গরম এবং খুব ঠাণ্ডা অনুভূত হয়। পর্যাপ্ত পানির অভাবে শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন সরবরাহ বাধা প্রাপ্ত হয়। যে কারণে শরীরের বর্জ্যগুলো বের হতে পারে না। এছাড়া হাড় এবং জয়েন্টেরও ক্ষতি হয়। ফলে শরীরের ভিটামিন এবং খনিজ উপাদানগুলোর মধ্যে ব্যাপক ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। পরবর্তীতে কিডনি সমস্যা, জ্ঞান হারানো, রক্তচাপ নিচে নেমে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। তাই যারা শারীরিক পরিশ্রমের কাজ যেমনঃ খেলাধুলা, ব্যায়াম, কায়িক শ্রম ইত্যাদি করেন তাদের প্রচুর পরিমাণ পানি পান করা উচিত।

পানি প্রাপ্তির অনিশ্চয়তাঃ
মানব জীবনে পানি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদান হলেও আমাদের দেশে সুপেয় পানি প্রাপ্তির যথেষ্ট অনিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছে। আমাদের দেশে সুপেয় পানির সংস্থান হয় ভূ-উপরিস্থ এবং ভূ-গর্ভস্থ এই দুই উৎস থেকে। বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে সুপেয় পানির ব্যাপক অভাব রয়েছে। যার ফলে শহরে ও গ্রামে অধিকাংশ মানুষ বিশুদ্ধ পানি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ব্যাপক পানি দূষণ, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস এবং পানিতে ক্ষতিকর রাসায়নিক বর্জ্য থাকার কারণে বাংলাদেশে বিশুদ্ধ পানির প্রচুর অভাব সৃষ্টি হয়েছে। যা থেকে সহজে উত্তোরণের কোনো পথ নেই।

যেভাবে পানি দূষিত হচ্ছেঃ
ভূ-উপরিস্থ পানির দূষণ দৃশ্যমান হলেও, ভূ-গর্ভস্থ পানির দূষণ এবং পানির স্তর হ্রাস হওয়ার জন্য ভূ-উপরিস্থ পানি দূষণই দায়ী।পানি দূষণের প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে নদনদী, খাল-বিল পুকুর ইত্যাদি। পানি দূষণের প্রধান কারণ শিল্প কারখানার দূষিত রসায়নিক পদার্থ, যেমনঃ অ্যামোনিয়া, ক্লোরাইড, সায়ানাইড এবং বিভিন্ন ধাতুর জিঙ্ক, পারদ, সীসা ইত্যাদি পানির সাথে মিশে পানিকে দূষিত করে। সেই সাথে গৃহস্থালির আবর্জনা নদীনালা, খালবিল, হ্রদ, সমুদ্র ইত্যাদির পানির সাথে মিশে পানি দূষণ করে। নদীনালা, পুকুরে গোসল করা, গরু ধোয়া, কাপড় চোপড় ধোয়ার মাধ্যমেও পানি দূষিত হয়। জমিতে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদি দেওয়ার ফলে সেগুলো বৃষ্টির সাথে মিশে নদীনালা, পুকুরে পড়ে পানিকে দূষিত করে।

বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগারে ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলো সমুদ্র বা পানিতে ফেলা হয় যার ফলে পানি দূষণ ঘটে। মাটির নিচের স্তর থেকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে অতিরিক্ত পানি তুলে নেওয়ার ফলে মাটির নিচে ফাঁকা জায়গায় আর্সেনিক বাতাসের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ধাতব যৌগ তৈরি করে পানিকে দূষিত করে।

এছাড়াও দেশের বিভিন্ন নদীর তীরে রয়েছে হাজার রকমের জাহাজভাঙা ও লঞ্চ-স্টিমার মেরামত শিল্প। জলযানের ভাঙা অংশ, তেল, মবিল, তেল জাতীয় সামগ্রী সরাসরি ফেলা হচ্ছে নদীতে। সেই সাথে ছোটবড় কলকারখানার তৈলাক্ত বর্জ্য, ছাপাখানা, টেক্সটাইল, কাপড় ডাইংয়ের বিষাক্ত রাসায়নিক রঙ, ট্যানারির মারাত্মক পানিদূষণকারী রাসায়নিক বর্জ্য ইত্যাদি প্রতিনিয়ত নদীর পানিতে মিশে পানি দূষিত করছে।

শুধু তাই নয় বড় বড় শহরের ড্রেনের লিংক রয়েছে নদীর সাথে। আর এসব ড্রেন দিয়ে প্রতিদিন শহর অঞ্চলের বিভিন্ন হাসপাতালের বর্জ্য এবং সমগ্র শহরের মানব বর্জ্য সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ছে। যা ভূ-উপরিস্থ পানিকে ব্যাপকভাবে দূষিত করছে। এই ভূ-উপরিস্থ দূষিত পানি বিভিন্ন উপায়ে ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ভূ-গর্ভস্থ পানিকেও নষ্ট করে তুলছে।

যেভাবে পানি দূষণ রোধ করা যায়ঃ
মিঠাপানির সহজ ব্যবহারের সর্বোচ্চ মজুদ হচ্ছে নদনদী। যে পানি রিসাইকেল করে সুপেয় বিশুদ্ধ পানি তৈরি করা যায়। আমাদের দেশের বড় বড় শহর গুলো বিশুদ্ধ পানি যোগান দেয় নদনদীর পানিকে রিসাইকেল করে এবং ভূ-গর্ভে গভীর নলকূপের মাধ্যমে। আর পানি দূষণের প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে নদনদী। তাই নদ-নদীকে পানিদূষণের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সমস্ত ওয়াসার সিউয়েজ নিগর্মন সহ নদনদীতে সব ধরনের কঠিন, গৃহস্থালি ও সেনিটারি বর্জ্যের বর্জ্যের মিশ্রণ রোধ করা অত্যাবশ্যক।

নদী তীরে শিল্প-কারখানা নির্মাণ বন্ধ, সেই সাথে দেশের বড় বড় শিল্প জোনের শিল্প-কারখানার রাসায়নিক ও ট্যানারি বর্জ্য পরিশোধন বাধ্যতামূলক করা এবং এর নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পে ব্যবহৃত পানির পরিশোধন অতীব জরুরী। কেননা বর্তমানে এই শিল্পে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার এবং দূষণ উভয়ই ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে।

নদী ও সমুদ্রের পাড়ে জাহাজভাঙা শিল্প, লঞ্চ, স্টিমার নির্মাণসহ মেরামত কালে নদী ও সমুদ্রের পানিতে কারখানার তৈলাক্ত বর্জ্যের মিশ্রণ প্রতিহত করতে হবে। কৃষি জমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মিশ্রিত পানি যাতে খাল-বিল-নদীতে মিশতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতসহ পানি দূষণকারীদের আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। নদনদী দূষণ রোধে দেশের আপামর জনগণকে সম্পৃক্ত করে তাদের মাঝে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

পানির অপচয় রোধে করনীয়ঃ
শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বব্যাপী আজ বিশুদ্ধ পানির হাহাকার। তাই আমাদের উচিত যথাসম্ভব পানির অপচয় রোধ করা। পানির অপচয় রোধে যেসব পদক্ষেপ আমরা নিতে পারি তা হচ্ছে, বিশুদ্ধ খাবার পানি শুধুমাত্র পান করার জন্য ব্যবহার করা এবং নষ্ট না করা। ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানো এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের পাশাপাশি পানি সাশ্রয়ী কল ব্যবহার করা। অটো সেন্সর ফ্লাশযুক্ত টয়লেট, পানির ট্যাপ, যেখানে পানির ফ্লো রেটমাত্র ১.৫ লিটার/ঘন্টা থাকবে।

ব্যবহৃত পানি পরিশোধন করার মাধ্যমে পূণঃ ব্যবহার করা। প্রাকৃতিক পানির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে সকল পর্যায়ে পানির অপচয় রোধ করতে হবে। পানি ব্যবহারের কার্যকারিতা বাড়াতে যেকোন লিক দ্রুত সারানো, যন্ত্রপাতি মেরামত, সরু ধারার কল ব্যবহার করা। যদি বাথরুমের শাওয়ার ২০ সেকেন্ড’র কম সময়ে একটি বালতি ভরতে পারে তবে শাওয়ার হেডটি বদলানো।

শাকসবজি পরিষ্কারের জন্য প্রবাহিত পানি ব্যবহার না করা। এর পরিবর্তে কিছুক্ষণের জন্য একটি বাটি পানিতে শাকসবজি ভিজিয়ে রেখে পরে ধুয়ে ফেলা। রান্নাঘরের জিনিসপত্র ধোয়ার সময় কল ছেড়ে না রাখা। কোনও ডিশ ওয়াশার কেনার সময়, ‘হালকা-ধোয়া’ যায় এমন দেখে কেনা। দাঁত ব্রাশ করার বা শেভ করার সময় পানি বন্ধ করুন। সেচকাজে এবং শিল্পকারখানায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ব্যবহার না করা। সেই সাথে শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত পানি রিসাইকেল করে পূনঃব্যবহার করা।

হুমকিতে ভূ-গর্ভস্থ পানিঃ
ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যাপক দূষণ এবং মিঠা পানির সহজ প্রাপ্যতা না হওয়ার কারণে সারা বিশ্বসহ আমাদের দেশেও দিনদিন ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী বিশুদ্ধ পানির প্রায় অর্ধেক, সেচের জন্য প্রায় ৪০ ভাগ এবং শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় এক তৃতীয়াংশ পানি ব্যবহৃত হয় ভূ-গর্ভস্থ পানি থেকে। যা ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর ব্যাপক একটি হুমকি।

তাই ২০২২ সালের পানি দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ধরা হয়েছে ” ভূ-গর্ভস্থ পানিঃ অদৃশ্যকে দৃশ্যমান”। অর্থাৎ ভূ-গর্ভস্থ পানি যেহেতু আমাদের চোখের আড়ালে রয়েছে সেহেতু এই পানি সম্পর্কে আমরা কেউ তেমন ওয়াকিবহাল নই। অথচ সারাবিশ্বে ব্যাপকহারে ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহারের কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির মজুদ আজ হুমকির মুখে। তাই এই বছরের পানি দিবসের লক্ষ্য হলো ভূ-গর্ভস্থ পানি সম্পর্কে সারা বিশ্বের মানুষকে আরও বেশী সচেতন করা। যাতে বিশুদ্ধ পানির এই উৎস সম্পর্কে মানুষ আরও বেশী সজাগ হয়।

বিশেষকরে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমা‌নো, দূষণ রোধ এবং এর বিকল্প উৎসের সংস্থান করা। যাতে করে পৃথিবী আরো বেশিদিন এই উৎস থেকে পানি আহরণ করতে পারে। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক পানি দূষণের কারণে পৃথিবীতে আজ বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ চরম হুমকিতে। এই অবস্থায় প্রাকৃতিক ভূ-গর্ভস্থ পানিও যদি নিঃশেষ হয়ে যায়, তাহলে বিশ্ব জীববৈচিত্র্য ব্যাপক হুমকির মুখে পড়বে। তাই ২০২২ সালের পানির প্রতিপাদ্য, “ভূ-গর্ভস্থ পানিঃ অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করা” একটি যুগোপযোগী বিষয়। আমাদের সকলের উচিত এই বিষয়ে যথাযথ সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারলাম, পানির প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা এবং পানিশূন্যতার ক্ষতিকর দিক। সেই সাথে পানি দূষণ এবং পানি দূষণ রোধ ও পানির অপচয়ে করণীয় কী। আরো জানতে পারলাম বিশ্বব্যাপী ভূ-গর্ভস্থ পানির বর্তমান অবস্থা। তাই পানির এই বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের উচিত পানি ব্যবহারে বেশী বেশী সচেতন হওয়া। যাতে আমাদের দ্বারা পানি অপচয় না হয়। কেননা পানি একটি অমূল্য সম্পদ। বিশেষ করে ভূ-গর্ভস্থ পানি সম্পর্কে আমাদের আরো বেশী সচেতন এবং এর পরিমিত ব্যবহার করা উচিত। যাতে পৃথিবীতে এই অমূল্য সম্পদ ধ্বংস বা নষ্ট না হয়ে যায়।

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।

ঈমান কী?

1646757

“ঈমান” কী? এটা জানতে হলে আগে “ইসলাম” কী জানতে হবে। ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর পরিপূর্ণ বিধানে আনুগত্য করা। এই পরিপূর্ণ বিধানকে মুখে স্বীকৃতি, অন্তরে বিশ্বাস এবং কাজে পূর্ণ করাই হচ্ছে ঈমান। যার সহজ অর্থ হলো ইসলামের বিধানকে মুখে স্বীকার করা, অন্তরে বিশ্বাস করা এবং সেইমতে কাজ করাই হচ্ছে ঈমান। যে এই কাজ অর্থাৎ ঈমান এনে ইসলামের প্রতি আনুগত্যশীল হয় তাকে বলা হয় মুসলিম।

ঈমানের ব্যাখ্যাঃ
ঈমান একটি গাছের তিনটি অংশের মতো অর্থাৎ শেখড়, মূল বৃক্ষ আর অসংখ্য শাখাপ্রশখা, ফুল-ফলে ইত্যাদিতে বিভক্ত। ঈমানের একটি অংশ হলো অন্তরের বিশ্বাস মাটির নীচে মূলের মতো। যা কেউ দেখে না। দ্বিতীয় অংশ মুখের স্বীকৃতি মূল কান্ডের মতো যা বাইরে থেকে দেখা যায়। তৃতীয় অংশ হলো আমল যা গাছের শাখাপ্রশখা মতো। যা দেখে গাছকে পরিপূর্ণ ও সৌন্দর্যমণ্ডিত দেখায়।

কিছু কিছু বিশ্বাসের সমষ্টিকে ঈমান ধরা হয়। যেমন আল্লাহ্, মালাইকা বা ফিরিশতা, নবী রাসুল, সমস্ত আসমানী কিতাব, তকদীর, এবং মৃত্যুর পর উত্থান ও কিয়ামত ইত্যাদির সামগ্রিক বিশ্বাসই হচ্ছে ঈমান। একমাত্র আল্লাহকে পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করা, তাঁর বিভিন্ন কাজে লিপ্ত মালাইকাদের বিশ্বাস, আল্লাহ্ এই পর্যন্ত যত কিতাব পাঠিয়েছেন তাতে বিশ্বাস, এইপর্যন্ত যত নবী রাসুল (আঃ) পাঠিয়েছেন তাদের প্রতি বিশ্বাস, তকদীর তথা ভাগ্যে বিশ্বাস, মৃত্যুর পর উত্থান এবং কিয়ামতের হিসাব নিকাশের বিশ্বাসের সাথে মুখের স্বীকৃতি দেওয়াই হলো ঈমান।

ঈমানের মূলে কালেমাঃ
ঈমানের মূল ভিত্তি হলো কালেমা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” যে এই কালেমা পরিপূর্ণভাবে বুঝে বিশ্বাস এবং আমল করে তবেই তার ঈমান পূর্ণ হবে। সুতরাং ঈমান হলো বিশ্বাসের সাথে আল্লাহর পরিপূর্ণ বিধানের আমল। কালেমাতে আল্লাহকে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ হলো আল্লাহর জাত, সিফাত এবং ইবাদতে কারো অংশীদার গ্রহণযোগ্য নয়। অর্থাৎ আল্লাহ্‌র সাথে কাউকে কোনো কিছুতেই শরীক করা যাবে না। এটাই হচ্ছে মূল ঈমান। যা আমরা অনেকেই জানি বা বুঝি না। শুধু মুখে ও অন্তরে স্বীকার করে সালাত সিয়াম হজ্জ্ব যাকাত পালন করলেই ঈমানদার নয়।

বরং আল্লাহকে এবং তাঁর বিধানকে এমনভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে, তিনি ছাড়া দুনিয়ায় আর কেউ তাঁর মতো নয়। অর্থাৎ তিনি যা পারেন তা কেউ পারেন না। এবং তাঁর বিধান ছাড়া আর কোনো বিধানে মাথা নত করা নয়। তিনি যা প্রাপ্য (ইবাদত) তা আর কেউ পেতে পারে না। এটাই হচ্ছে ঈমানের মূল বিষয়।

সুতরাং ঈমান হচ্ছে অবিচল বিশ্বাসের নাম। ওহীর মাধ্যমে জানা সকল সত্যকে সত্য বলে বিশ্বাস করা। যেকোনো বিষয়কে শুধু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আস্থার ভিত্তিতে মেনে নেওয়া। সত্যের সাক্ষ্যদান এবং আরকানে ইসলাম পালন। নিজেকে পরিপূর্ণভাবে ইসলামে সমর্পণ করে শরিয়ত ও উসওয়ায়ে হাসানাকে গ্রহণ করা। ইসলামের বিধিবিধানের প্রতি আস্থা, ভালোবাসা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা করা, পরিপূর্ণ তাওহীদ এবং শিরক বর্জিত বিশ্বাস করাই ঈমান। ঈমান শুধু গ্রহণ নয়, বর্জনও বটে। সত্যকে গ্রহণকরা আর বাতিলকে বর্জন করা। বিদ্রূপ ও অবজ্ঞা অস্বীকারের চেয়েও কুফরকে ঘৃণা এবং এর পরিনামকে ভয় করা ইত্যাদি।

ঈমানের ফল হচ্ছে আমলঃ
যারা কালেমা পড়ে নিজেদের ঈমানদার ঘোষণা দিবে। তাদের ঈমান পরিলক্ষিত হবে আমলের মাধ্যমে। গাছ যেমন শাখাপ্রশাখা পত্রপল্লব ছাড়া শুধু মূল এবং কান্ড দ্বারা পরিপূর্ণ হয় না। ঠিক তেমনি আমল ছাড়া মুখে স্বীকৃতি এবং অন্তরে বিশ্বাস দিয়ে ঈমানদার দাবি করা যায় না।

কারণ যারা মুনাফিক তাদের আমল নেই। তারা বাহিরে দেখায় আল্লাহকে স্বীকার করে কিন্তু সেই বিধান অনুযায়ী চলে না বা আমল করে না। অধিকাংশ মুসলমান আল্লাহকে স্বীকার করে। সালাত আদায় করতে হবে তাও জানে। কিন্তু কখনো সালাত আদায় করে না । তাহলে তারা কীভাবে ঈমানদার থাকলো? সুতরাং তারা কখনোই পরিপূর্ণ ঈমানদার নয়। প্রকৃত ঈমানদার হলো তারাই যারা আল্লাহকে পরিপূর্ণভাবে মানে বিশ্বাস করে এবং আমল করে।

ঈমানের স্বাদঃ
হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ইরশাদ করেন, যার মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য থাকবে সে ঐ বৈশিষ্ট্যগুলো কারণে ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে। সে বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে- (ক) যার নিকট আল্লাহ্‌ ও তার রাসূল (সাঃ) অন্য সবকিছু হতে সর্বাধিক প্রিয় হবে। (খ) যে ব্যক্তি কোনো বান্দাকে কেবল আল্লাহ্‌ তা‘আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ভালোবাসবে। (গ) যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র অনুগ্রহে কুফরি হতে মুক্তি লাভের পর পুনরায় কুফরিতে ফিরে যাওয়াকে এভাবে অপছন্দ করে, যেভাবে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অপছন্দ করে। (সহীহ্ বুখারী: ২০, সহীহ্‌ মুসলিম:৪৩)

সুতরাং তারাই ঈমানের স্বাদ পাবে যারা সত্যিকারে আল্লাহ্ এবং রাসুলের (সাঃ) প্রতিষ্ঠিত বিধানের উপর পরিপূর্ণ অবিচল থাকতে পারবে মৃত্যু পর্যন্ত। সুতরাং মুখে বা অন্তরের স্বীকৃতি দিয়ে ঈমানদার হওয়া যাবে না। যে পর্যন্ত না সেই ঈমানকে আমল দ্বারা পরিপূর্ণ করা না হবে।

ঈমান বাড়ে কমেঃ
আল্লাহ বলেন,
“যারা ঈমানদার, তারা এমন যে, যখন আল্লাহর নাম নেয়া হয় তখন ভীত হয়ে পড়ে তাদের অন্তর। আর যখন তাদের সামনে পাঠ করা হয় (আল্লাহর) কালাম, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা স্বীয় পরওয়ার দেগারের প্রতি ভরসা পোষণ করে। “[ সুরা আনফাল ৮:২]

উপরোক্ত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত যে, আল্লাহ্‌র কিতাব ঈমানদারদের সামনে পড়া হলে তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। এটা খুবই স্বাভাবিক। যখন কেউ ঈমান আমল ইহকাল পরকালের কথা শোনে তখন তাদের অন্তরে আল্লাহর প্রশান্তি এবং ভয় এসে আমলের ইচ্ছা জাগ্রত হয়। আবার যখন দুনিয়ার বিভিন্ন কাজে লিপ্ত হয়ে যায় তখন সেই ইচ্ছায় ভাটা পরে যায়। সুতরাং মানবিক কারণেই মানুষের মধ্যে ঈমানের এই হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে।

ঈমান কীভাবে কমেঃ
বিভিন্ন কারণে মানুষের ঈমান কমে যায় বা যেতে পারে। যেমনঃ

১) আল্লাহর গুণাবলী নিয়ে চিন্তা চেতনা গবেষণা ইত্যাদি না করা। আমরা প্রতিনিয়ত শত হাজার পাপ করছি। এই পাপের কারণে তিনি আমাদের পাকড়াও না করে ছেড়ে দিচ্ছেন। এই যে ছেড়ে দিচ্ছেন বলে আমাদের একটি ধারণা হয়ে গেছে যে, আল্লাহ্ বোধহয় মানুষকে শাস্তি দিতে পারেন না। মনে হয় তাঁর সেই ক্ষমতা নেই (নাউযুবিল্লাহ)। এই ধরনের উদাসীনতা, তাঁর ক্ষমতার প্রতি চিন্তাহীনতা ইত্যাদি আমাদের ঈমান কমিয়ে দেয়।

২) আল্লাহর বিধান নিয়ে গবেষণা না করার কারণেও ঈমান কমে যায়। আমাদের কী কী পাপের জন্য কী কী শাস্তি হতে পারে। আল্লাহ আমাদের জন্য কী কী বিধান দিয়েছেন। কী কী বিধান মেনে চলা উচিত, কী কী অবাধ্যতার কারণে দুনিয়া আখিরাতে কী কী শাস্তি হতে পারে ইত্যাদি চিন্তা ভাবনা না করার কারণেও আমাদের ঈমান কমে যায়।

৩) অতিমাত্রায় পাপ কাজে লিপ্ত হওয়া ঈমান কমে যাওয়ার লক্ষণ। জেনে না জেনে আল্লাহর বিধিবিধান তোয়াক্কা না করে যে পাপ গুলো আমরা করি, সেইসব পাপের কারণেও আমাদের ঈমান কমে যাচ্ছে। এই ঈমান কমে যাওয়ার ফল হচ্ছে আমাদের আমলের কমতি। আর আমল ছাড়া ঈমান কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা যে আল্লাহকে মানি এবং ভয় করি তার প্রমাণ হচ্ছে তাঁর বিধি -বিধান মেনে চলে তাঁর ভালোবাসার জন্য আশা করা।

ঈমান বৃদ্ধির উপায়ঃ
পবিত্র কুরআনের আলোকে আমরা জানি যে, ঈমানের হ্রাস বৃদ্ধি হয়। সুতরাং ঈমান বৃদ্ধির বিভিন্ন উপায় উপকরণ রয়েছে। যেমনঃ

১) আল্লাহর বিভিন্ন গুণাবলী নিয়ে গবেষণা করা। আমরা যদি সত্যিকারে বুঝতে পারি আল্লাহ্ কত অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন। তাহলে অবশ্যই আমাদের ঈমান বৃদ্ধি পাবে। আল্লাহ্‌র বিভিন্ন গুণ ক্ষমতা ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করলে আমাদের বিশ্বাস মজবুত হবে এবং ঈমান বৃদ্ধি পাবে।

২) আল্লাহর নিদর্শন দেখে গবেষণা করে ঈমান বৃদ্ধি করা। আমরা যদি আল্লাহর বিবি বিধান, আল্লাহর সৃষ্টি জগৎ ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা বা চিন্তা-ভাবনা করি তাহলেও আমাদের ঈমান বাড়বে। এইসব গবেষণা করলে আল্লাহকে আরও জানতে তথা ইসলামকে জানতে আগ্রহ সৃষ্টি হবে। সেই আগ্রহ আমাদের ঈমান বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।

৩) সৎ আমল করা। আল্লাহকে ভয় এবং সন্তুষ্টি লাভের আশায় বেশী বেশী নেক আমল করলে ঈমান বৃদ্ধি পায়। যার ভিতরে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সৎ আমল বা ভালো কাজ করার প্রবণতা থাকবে, নিঃসন্দেহে তার ঈমান অন্যদের চেয়ে বেশী হবে।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট বুঝা গেলো যে, ঈমান কখনোই শুধুমাত্র স্বীকৃতির বিষয় নয়। যদি স্বীকৃতির বিষয় হতো তাহলে সকল নামধারী মুসলিম এবং মুনাফিকরাও ঈমাদার বলে গণ্য হবে। অথচ আল্লাহ বলেন –

“নিঃসন্দেহে মুনাফেকরা রয়েছে দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে। আর তোমরা তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী কখনও পাবে না।” [ সুরা নিসা ৪:১৪৫ ]

অর্থাৎ শুধু মুখে ঈমান আনলেই মুমিন হওয়া যাবে না। যতক্ষণ না তা কাজে কর্মে পরিলক্ষিত না হবে। কেননা আল্লাহ্ বলেন,

“অধিকাংশ মানুষ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, কিন্তু সাথে সাথে শিরক ও করে। ” (সূরাঃ ইউসূফ, আয়াতঃ ১০৬)

অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষ আল্লাহ্‌র উপর বিশ্বাস রেখে তাঁর সাথে শিরক করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্কে স্বীকার করে আবার শিরকও করে তাহলে আল্লাহ্ তাকে ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ্ বলেন,

“নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে লোক তাঁর সাথে শরীক করে। “(সূরাঃ আন নিসা, আয়াতঃ ৪৮)

অতএব আমাদের কালেমার প্রকৃত অর্থ এবং ব্যাখ্যা (তাওহীদ, শিরক, বিদআত ইত্যাদি) জেনে পরিপূর্ণভাবে বুঝে বিশ্বাস এবং সেই অনুযায়ী আমল করেই ঈমানদার হওয়া লাগবে।

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
৩ মে, ২০২১
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।

শবেবরাত এবং আমাদের করণীয় বর্জনীয়

1646229857252

শবেবরাত এবং আমাদের করণীয় বর্জনীয়

পবিত্র “শবেবরাত” যা উপমহাদেশের সুন্নীরা যুগ যুগ ধরে খুব ধুমধামের সাথে পালন করে আসছে। যা পালন করা নিয়ে ইসলামে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। আজ আমরা তথ্য উপাত্তের সাহায্যে জানার চেষ্টা করব শবেবরাত আসলে কী? শবেবরাতের দালিলিক পর্যালোচনা। এই রাতকে ঘিরে আমাদের ভুল গুলো কী এবং আমাদের করনীয় কী?

শবেবরাত কী?

সুফি সুন্নীরা শাবান মাসের পনেরতম রাত্রিকে বলে শবেবরাত। “শবে” ও “বরাত ” এখানে দুটি শব্দ। এই শব্দ দুটি সরাসরি এসেছে ফার্সি তথা ইরান থেকে। ‘শব’ শব্দের এর অর্থ রাত। ” বরাত” শব্দের অর্থ বলা হয় যে “সৌভাগ্য”। দুটো কে মিলিয়ে হচ্ছে সৌভাগ্য রাত বা রজনী। উপমহাদেশের সুফি সুন্নীরা এই রাতকে বিশেষ মর্যাদায় পালন করে। যদিও কুরআন এবং হাদীসে শাবান মাসের কোনো রাতকে সৌভাগ্যের রাত বলে ঘোষণা করা হয়নি। ইসলামে সৌভাগ্যের রাত বলা লাইলাতুল কদরকে। তাই ইসলামে সুফিদের শবেবরাত নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

শবেবরাতের দালিলিক পর্যালোচনাঃ

শবেবরাত নিয়ে বিভিন্ন কিতাবে এবং অসংখ্য জাল, যইফ এবং সনদবিহীন হাদীস রয়েছে। সেইসাথে হাসান হাদীসও রয়েছে। আমরা খুব সংক্ষেপে তা নিয়ে আলোচনা করব।

তিরমিযী হাদীসে একটি হাদীস এসেছে যা মা আয়েশা রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি জানান, এক মধ্য শাবানের রাতে রাসুলুল্লাহ সাঃ কবর যিয়ারত করেছেন। এবং জানান যে, এই রাতে আল্লাহ্ নিকট আসমানে নেমে এসে অসংখ্য মানুষকে ক্ষমা করেন। (দুর্বল হাদীস)

মা আয়েশা রাঃ থেকে অন্য হাদীসে এসেছে, এই রাতে আল্লাহ্ ক্ষমা প্রার্থনাকারীকে ক্ষমা করে এবং রহমত প্রদান করেন। হিংসুকদের তাদের অবস্থায় ছেড়ে দেন। (বাইহাকী তার শুয়াবুল ঈমান কিতাবে বর্ণনা করেছেন। হাদিসটি মুরসাল)

হযরত আলী রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ বলেন, এই রাতে তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় কর এবং সিয়াম পালন কর। কেননা সূর্যাস্তের পরে আল্লাহ্ নিকট আসমানে নেমে আসেন। এবং বলেন, যে আমাকে ডাকবে তাকে আমি সাড়া দিবো। যে প্রার্থনা করবে তাকে দান করা হবে। যে ক্ষমা চাইবে তাকে ক্ষমা করা হবে। (ইবনে মাজাহ ও বাইহাকী। দুর্বল এবং সহীহ্ হাদিস বিরোধী)

উসমান ইবনে আবিল আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসটি আলী রাঃ হাদিসের অনুরূপ। তবে এখানে এসেছে মুশরিক এবং ব্যবিচারী ব্যতীত সকলের প্রার্থনা কবুল করা হবে। (বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান। দুর্বল হাদিস)

কথিত শবেবরাত নিয়ে হাসান পর্যায়ের হাদীস রয়েছে। আবূ মূসা আল-আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে আত্মপ্রকাশ করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত তাঁর সৃষ্টির সকলকে ক্ষমা করেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৩৯০)

উপরোক্ত জাল ও দূর্বল এবং হাসান হাদিস থেকে আমরা পাই, এই দিনের মধ্য রাতে আল্লাহ্ নিকট আসমানে নেমে আসেন। তিনি বান্দার প্রার্থনা কবুল করেন তবে মুশরিক এবং হিংসুকদের ছাড়া।

এইসব হাদিসের কোথাও শবেবরাত নামে কিছুই নেই। যা উপমহাদেশে ভাগ্যরজনী নামে পরিচিত। এই রাতের জন্য স্পেশাল কোনো সালাত নেই। কেননা এই রাতের যে ফজিলতের কথা এসেছে তা অন্যান্য দিনের মতোই। বিশেষকরে আল্লাহ্ প্রতি রাতে নিকট আসমানে নেমে আসেন এবং প্রার্থনা কবুল করেন (বুখারী ও মুসলিম)। সুতরাং যে ব্যক্তি নিয়মিত তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে তার জন্য এইদিন কখনোই স্পেশাল নয়।

সেইসাথে এই রাতে যদি স্পেশাল সালাত থাকতো তাহলে তা রাসুলুল্লাহ সাঃ তার স্ত্রীদেরও আদায়ের নির্দেশ দিতেন। কিন্তু কোনো হাদীসেই এমনটা আসেনি। তাহলে এই রাত সম্পর্কে হাদীস থেকে আমরা যা পাচ্ছি তা হলো আল্লাহ্ এই রাতে নিকট আসমানে নেমে এসে প্রার্থনা কবুল করেন যা অন্যান্য রাতের মতো। সেইসাথে তিনি তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করেন।

সুতরাং এই রাতকে ঘিরে নতুন নতুন বিদআতী আমল সৃষ্টি করা অযৌক্তিক। অনেকেই বলে মানুষ এমনিতেই সালাত কালাম করে না। সেখানে এই দিনেও কেন আমরা সালাত আদায়ে নিরুৎসাহিত করি। যেখানে মানুষ এই রাতে খুশি মনেতে সালাত আদায় করতে চায়।

তাদের কাছে জিজ্ঞাস্য হলো, কোনো ব্যক্তি সারাবছর সালাত আদায় না করে বিশেষ বিশেষ রাতে সালাত আদায় করলে কি আল্লাহ্ তাকে মেনে নিবেন? তাও আবার এমন সালাত যা রাসুলুল্লাহ সাঃ থেকে স্বীকৃত এবং যা বিদআত।

সুফি সুন্নীদের শবেবরাতের বিশ্বাসঃ

যারা শবেবরাতের দলিল দেয়, তাদের দলিল বিশ্লেষণে আমরা যা পেয়েছি তার সাথে সুফি সুন্নীরা যে শবেবরাত পালন করে তার কোনো মিল নেই। আসুন দেখি সুফি সুন্নীরা এই রাতে কী বিশ্বাস করে এবং কী কী পালন করে।

১. শবে বরাত মানে ভাগ্য রজনী এই রাতে সবার ভাগ্য নতুন করে লেখা হয়।
২. এই রাতের সকালে দিনে অধিক সওয়াবের আশায় রোজা রাখা।
৩. এই রাতে আল্লাহ সাধারণ ক্ষমা করেন।
৪. এই রাতে বয়স ও রিজিক নির্ধারণ করা হয়।
৫. কবরবাসীকে আলোকিত করতে কবরে মোমবাতি আগরবাতি জ্বালানো।
৬. অধিক সওয়াবের আশায় এই দিনেই বেশি পরিমাণে দান খয়রাত এবং কাঙ্গালী ভোজের আয়োজন করা।

৭. এই রাত লাইলাতুল কদরের চাইতেও বেশি মর্যাদাবান।
৮. এই রাতে বিশেষ মর্যাদায় কবর জিয়ারত এবং সওয়াবের নিয়তে বিভিন্ন মাজারে মাজারে গিয়ে জিয়ারত করা।

৯. এই রাতে নির্দিষ্ট করে মৃতদের নামে বিশেষভাবে দান-খয়রাত করা।
১০. এই রাতে হালুয়া, রুটি ও মাংস পাকানো এবং তা পড়া প্রতিবেশীদের বিলানো।
১১. এই রাতে আগরবাতি, মোমবাতি জ্বালানো, আলোকসজ্জা এবং আনন্দ উৎসবের মতো পটকা ফুটানো।

১২. এই দিনে সন্ধ্যায় গোসল করে নতুন কাপড় পরে সারারাত নামাজ পড়া সেই সাথে অধিক সওয়াবের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মসজিদে গমন করা।

১৩. এই রাতে সূরা ইয়াসীন তিনবার পাঠ করা। প্রথমবার বয়স বৃদ্ধির জন্য, দ্বিতীয়বার বালা-মসিবত দূর করার জন্য এবং তৃতীয়বার কোন মানুষেরমুখাপেক্ষীর না হওয়ার জন্য।

১৪. এই রাতে বিভিন্ন ধরনের বিদআতী অনুষ্ঠান করা।
১৫. এই রাতে বিধবাদের স্বামীর প্রিয় খাবার পাকিয়ে তার সাথে রুহানী সাক্ষাতের আশা করা।
১৬. গত এক বছরে মৃত মানুষের রুহগুলোর আগের রুহের সাথে জমিনে নেমে আসে।
১৭. এই রাতে সূরা দুখান পাঠকারীর জন্য সারা দিন ৭০ হাজার ফেরেশতা দোয়া করবে মনে করে তা পাঠ করা।
১৮. এই দিনে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে হালুয়া রুটি মুরগি পোলাও রান্না করে পাঠানো।
১৯. এই রাতে জমজমের পানি অন্যান্য দিনের চেয়ে বৃদ্ধি পায় ধারণা করা।
২০. এই রাতে শিয়া-রাফেযীদের মিথ্যা কল্পিত ইমাম মাহদীর জন্ম দিবস পালন করা।
২১. মনে করা হয় এই দিনে ওহুদের যুদ্ধে কাফেররা নবী [সা:]-এর দাঁত মোবারক ভেঙ্গে দিয়েছে।

উপরের উল্লেখিত বিশ্বাস গুলো অঞ্চল ভেধে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। সুতরাং উপরোক্ত বিষয় থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, সুফিরা শবেবরাতের নাম দিয়ে যা করে তা কখনোই কুরআন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। সেইসাথে উপরের উল্লেখিত সকল আকিদা ও কর্মকান্ড উভয়ই বিদআত। যা ইসলাম সমর্থন করে না।

উপমহাদেশে শবেবরাত পালনের কারণঃ

শবেবরাত নিয়ে সুস্পষ্ট দলিল না থাকার পরও, অধিকাংশ মানুষ এই রাতে ও দিনে অতিরিক্ত বিদআতী আমল ইবাদত করতে উৎসাহী। বিশেষ করে সুফি সুন্নীরা। যাদের শরীয়তের ইবাদতের প্রতি অনীহা । যাদের ঈমান আকিদা কখনোই রাসুলের ত্বরিকায় নয়।

সুফি সুন্নীরা এই দিনকে ইবাদতের বিশেষ দিন মনে করে। যারা সারাবছর পীর আউলিয়ার দরবারে খানকায় পড়ে থেকে জীবিত মৃত পিতামাতার খবর নেয় না। মাতাপিতার জন্য সালাত দোয়া নেই। কবর যিয়ারত নেই, দান সদকা ইত্যাদি কিছুই নেই। এই একদিনে সব করে সারাবছর করার সুযোগ নিতে চায়।

সেইসাথে সুফি সুন্নীরা হলো খুব উৎসব প্রিয়। তাদের সারা বছরই হাজার পীরের ওরস লেগে থাকে। তাই তারা শবেবরাতকে ঘিরে মসজিদ, কবরে, মাজারে ঘরে বাইরে নানারকম আলোকসজ্জা, বাজি, পটকা, খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি আনন্দ উৎসবে মেতে উঠে। প্রতিটি দরবার খানকায় ব্যাপক আয়োজন হয়। যাতে দরবার গুলো হাদিয়া তোফা নজর মানতে আর্থিক লাভবান হতে পারে। এটা হিন্দুদের দীপাবলির মুসলিম সংস্করণ। যেহেতু আমাদের পূর্বপুরুষ সনাতন ধর্মীয় ছিলেন, সেহেতু এটা আমাদের জন্য খুবই সহজ হয়েছে ইসলামে প্রবেশ করার।

এছাড়াও উপমহাদেশের মুসলমানরা ভোজনপ্রিয় জাতি। কোনো না কোন উদ্দেশ্যে পেলেই আমরা খাওয়ায় মেতে উঠি। তাই এই রাতের দোহাই দিয়ে সবাই ব্যাপক খানাপিনার আয়োজন করে। যা পরবর্তীতে সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে এখনো চলমান।

উপমহাদেশে শবেবরাতের প্রভাবের আরেকটি কারণ হলো, শিয়াদের প্রভাব। রাজনৈতিকভাবে উপমহাদেশে শিয়াদের ব্যাপক প্রভাবে সুফি সুন্নীদের আকিদায় শিয়াদের আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়। শিয়ারা শবেবরাত পালন করে তাদের ঈমাম মাহাদীর জন্মদিন উপলক্ষে। যা তারা কৌশলে সুফি সুন্নীদের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে।

উপমহাদেশে শবেবরাত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত কারণ হলো কুরআন হাদিসের জ্ঞান না থাকা। অতীত থেকেই সুফি দরবেশ দ্বারা সুফিবাদী ইসলাম প্রচার প্রসার হওয়ার কারণে এই অঞ্চল কুরআন হাদিসের সঠিক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত। ফলে অধিকাংশ পূর্বপুরুষদের অনুসরণে এখানে সঠিক ইসলামের প্রচার প্রসারতা লাভ করেনি।

শবেবরাতে যা বর্জনীয় করণীয়ঃ

ইসলামে শবেবরাত না থাকলেও মধ্য শাবানের কথা এসেছে। সুতরাং শবেবরাতের নামে সুফি সুন্নীরা যা করছে এবং তাদের অনুসরণে অধিকাংশ মুসলমান যা করে তা সম্পূর্ণ বর্জন করতে হবে। পূর্বপুরুষদের সকল রীতিনীতি বাদ দিতে হবে।

সেইসাথে ইসলামের নিয়মিত আমল ইবাদতের পাশাপাশি এই রাতেও নফল ইবাদত ও নফল সিয়াম পালনে কোনো বাঁধা নেই। তবে সারাবছর ইবাদত বন্দেগী না করে এক রাতের ইবাদত কখনোই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারেন না। তাই ইবাদত বন্দেগী ছাড়া উপরের উল্লেখিত বাদবাকি সকল বিদআতী কর্মকাণ্ডকে বর্জন করতে হবে।

শেষকথাঃ

উপরোক্ত সকল তথ্য প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত যে, শবেবরাত নামে বা সমর্থনে কোনো কিছুই কুরআন হাদীসে নেই। বিশেষ করে এই রাত সৌভাগ্যের রাত। এই রাতে মানুষের হায়াৎ, মউত, রিজিক, ধন, দৌলত ইত্যাদি বন্টন করা হয় মনে করা।

এই রাতে যা করার নির্দেশ এবং ফজিলতের কথা সুফি সুন্নীদের দলিলে এসেছে, তা কখনোই এক দিন বা এক রাতের জন্য নয়। একই নির্দেশ এবং ফজিলত অসংখ্য সহীহ্ দ্বারা প্রতিটি রাতের জন্যও প্রমাণিত। সুতরাং এই রাতে সালাত সিয়ামে কোনো সমস্যা নেই। তবে শুধু এই রাতকেই ফজিলত মনে করে বছরের বাকি দিনগুলিতে ইবাদতের ধারেকাছে না থাকা হচ্ছে গোমরাহী।

সুতরাং আসুন আগে চেষ্টা করি ফরজ সালাত প্রতিনিয়ত আদায় করার। সেইসাথে শুধু এই রাত বরং সারাবছর যতটুকু সম্ভব তাহাজ্জুদের সালাত নিজ ঘরে আদায় করার। নিজ আত্মীয় স্বজনদের কবরে গিয়ে তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করার। সিয়াম পালনের উদ্দেশ্যে প্রতি মাসের চাঁদের ১৪,১৫,১৬ তারিখে সিয়াম পালন করা। যা সহীহ্ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। ইনশাআল্লাহ পরম করুণাময় অবশ্যই আমাদের ক্ষমা এবং রহমত দান করবেন।

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
২ মার্চ, ২০২২
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।

ধর্ষিত বারংবার

images-39

দাড়িয়ে আছি মৃত্যুর মুখোমুখি,
বলা যেতে পারে জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
নষ্ট সমাজের নগ্নতার কদার্য্যে,
মৃত্যু হয়না আমাদের এখানে সহজে।

সোনালি স্বপ্নীল রঙিন ফানুসে,
হয়না আমাদের জীবন রাঙা।
কলুষিত এই কদাকার সমাজে,
বারেবারেই আমাদের স্বপ্ন ভাঙে।

দিগন্তের বিশাল আকাশের মতো,
আমাদের রয়েছে কত স্বপ্ন।
কিন্তু এই পুরুষ শাসিত নাঙ্গা সমাজে,
স্বপ্ন দেখা কি আমাদের সাজে।

কতই আশা ছিলো মনের গহীনে,
রাঙাব জীবন হেসে খেলে।
সেই মন গহীনের সুপ্ত স্বপ্ন,
আজ জর্জরিত ক্ষত বিক্ষত রক্তাক্ত।

যৌবনের কঠিন নগ্ন অভিশাপে,
কুলাঙ্গারেরা দৃষ্টি দেয় সঁপে।
হিংস্রতা আর বাহুবলে,
তারা জয়ী হয় খুব সহজে।

সমাজ তাদের পারে না আটকাতে,
শত দোষ লাঞ্ছনা অপবাদ ললাটে।
নরখাদকের মত ঝাঁপিয়ে তারা,
নষ্ট করে তারা আমাকে।

প্রথম আমি ধর্ষিত হয় সমাজের অন্ধকারে,
সবাই তখন বলে উঠে ঐ মেয়েটা আহারে!
ক্রোধে আমি ফেটে উঠি বদলা নিব আমি ঠিকই।
ছুটে যায় পুলিশ ফাঁড়ি বলি তাদের ঘটনা খুলি।

তারা খুবই উৎসাহী শুনতে নারীর কিচ্ছা কাহিনী,
আমায় করে জর্জরিত প্রশ্ন বানে অতি নগ্ন।
আমি হই আবার ধর্ষিত সমাজ এই পুরুষ শাসিত,
তাদের আচার অতি নিকৃষ্ট মানবতা বিবর্জিত।

তবুও আমি দমে যায় না,
দেখতে চায় এর শেষ ঠিকানা।
তারা করে কত তামশা,
তবুও আমি রাখি ভরসা।

রুটিন কিছু কাজ সেরে,
আমায় পাঠায় হাসপাতালে।
সেখানেও জমে রঙ্গশালা আমাকে ঘিরে,
তবুও আমি পিছপা নই অধিকার আদায়ে।

কিছু ডাক্তার পুরুষ আমায় করে উলঙ্গ,
তারা দেখতে চায় কি করে পুরুষকে দিয়েছি সঙ্গ।
আমি আবার ধর্ষিত হই পিশাচ এই সমাজে,
পুরুষের এই চক্রে আজ নারীর সম্ভ্রম ধূলোতে।

শেষে পূরণ ডাক্তারের লালসা,
আসলো এগিয়ে মিডিয়াগো অলা।
নানান প্রশ্নে তারা জানতে চায় খুটিনাটি,
যেন তারা লিখতে চায় গোপন বইয়ের চটি।

সত্যিকারের ভালবাসা দেখাতে কেউ চায় না,
সবাই মিলে করে আশা একটু ভাল ব্যবসা।
এই মেয়েটিকে কভার করে ধর্ষণের কথা দাও ফলিয়ে,
মুখরোচক গল্প ফেদে আমজনতাকে দাও ভাসিয়ে।

যে নষ্ট কথা জানত কজনে, তা এখন মুখে মুখে,
আমায় আবার নষ্ট করে সমাজের এই বিবেক জনে।
এইভাবে আমি পদে পদে নষ্ট হই লোকমুখে,
আমায় সবাই ধর্ষন করে সুযোগ করে সময় বুঝে।

তবুও আমি লড়ে যায় সমাজকে আমি দেখাতে চাই,
নারীরাও তো বাঁচতে চায় দাও তোমারা ঠাঁই।
লড়ি আমি আদালতে প্রাণপণে,
সেখানেও আঘাত হানা হয় আমার সম্মানে।

অতিরঞ্জিত কদার্য্য নগ্ন ভাষনে,
তারা আমায় চায় বেকায়দায় ফেলতে।
আমি নারী বলে সেখানে নেই কোন দাম,
পুরুষ গুলো সাধু আর আমি ই করেছি আকাম।

নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে আমি চালায় শত প্রচেষ্টা,
আমার মতো সাধারণেরা বুঝে না আইনের মারপ্যাঁচটা।
শত বাঁধা পেরিয়ে আমি অবশেষে,
আসি সকলের সামনে বিজয়ী বেশে।

আমি বিজয়ী হয়েছি কাগজে কলমে,
পরাজিত আমি আজ কলঙ্ক লেপনে।
সমাজে নেই আজ আমার নারী মর্যাদা,
আমি সমাজে হয়ে গেছি এক নষ্টা বেশ্যা।

বিচার চাইতে গিয়ে আজ আমি বারেবারে ধর্ষিত,
পুরুষের এই সমাজে নারীরা আজ ক্ষতবিক্ষত ।
আমার আজ নেই সমাজে দাঁড়াবার মত স্থান,
সকলে আমাকে তাচ্ছিল্য করে পাইনা কোন সম্মান।

তাই বারংবার ধর্ষিত আমি লোক মুখে,
আমার কপালে সুখ আর নাহি জোটে।
আমাকে নামতে হচ্ছে আজ অন্ধকার গলিতে,
সমাজের বিবেকরা আসে না এখানে আমাকে খুঁজিতে।

আজ আমি নষ্টা কদাকার বেশ্যা মেয়ে,
অপেক্ষায় আছি ধূলোয় মিশে যেতে।
কখন হবে আমার এই নষ্টা জীবনের ইতি,
আমি আছি অপেক্ষায় সেই করুণ সমাপ্তির।

1/10/13

টিনএজঃ চক্ষুর অন্তরালে নিঃশেষিত জীবন

টিনএজঃ চক্ষুর অন্তরালে নিঃশেষিত জীবন
FB_IMG_1645119692485

টিনএজ কীঃ
ইংরেজি থার্টিন থেকে নাইন্টিন অর্থাৎ তেরো থেকে উনিশ বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের টিনএজার বা বয়ঃসন্ধিকাল বলা হয়। যদিও টিনএজারদের কিছু বিষয় থাকে যা আরও দু চার বছর পর্যন্ত চলতে থাকে। এই তেরো থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষের। বিশেষ করে একটি ছেলের জন্য।

টিনএজের চরিত্রঃ
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তার ছুটি গল্পে টিনএজারদের ব্যাপারে বলেছিলেন “তেরো চৌদ্দ বয়সের ছেলের বালাই আর নাই”। অর্থাৎ এই বয়সটি এতোই দুরন্ত উদ্দীপক উশৃঙ্খল যে তাদের চরিত্রের নির্দিষ্ট কোনো ছবি আঁকা যায়না। এই বয়সে কখন কার কেন মন খারাপ হবে কেউ জানেনা। কার কখন কী ভালো লাগে সেটা সে নিজেও ভাবতে পারেনা। এই সময়টাতে প্রতিটি ছেলে তাদের শারীরিক এবং মানসিক নিত্যনতুন পরিবর্তন লক্ষ্য করে। সেসব পরিবর্তনের কথা সে কাউকে না বলতে পারে, না কেউ বুঝতে চেষ্টা করে। যার ফলে ছেলেরা যথেষ্ট সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে।

সঠিক পরামর্শ এবং সিদ্ধান্তের কারণে এই বয়সের সিংহভাগ ছেলে ভুল পথে পরিচালিত হয়ে যায়। কেননা তারা তাদের প্রয়োজন সঠিকভাবে সবার কাছে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়। এই চঞ্চল উদ্যমী বাঁধনহারা সময়টা হচ্ছে বয়ঃসন্ধীকাল। এটা হচ্ছে চরম অস্থির একটি সময়। এই সময়ের ছেলেদের মানসিক অবস্থা কেউ বুঝতে পারে না।

বয়ঃসন্ধিকালের যে দিকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে একটি ছেলের জৈবিক চরিত্র। এই জৈবিকতা একটি ছেলেকে হয় ধ্বংস করে দেয় নয়তো পারিপার্শ্বিক সাপোর্ট পেয়ে নিজেকে সুদৃঢ় রাখে। কেননা এই বয়সটা হচ্ছে খুবই স্পর্শকাতর বিশেষকরে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ। এই বয়সে জৈবিক চাহিদার যে ঝড়ের সূচনা হয় তা নিজের অনুকূলে নিতে অধিকাংশ ছেলেই ব্যর্থ হয়। তাই এই বয়সের চরিত্র বলতে যে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে জৈবিক চাহিদার নিয়ন্ত্রণের চরিত্র।

টিনএজ কীভাবে পথহারাঃ
এই বয়সটি যেকোনো ছেলেদের জন্য খুবই বেদনাদায়ক। এই ছেলেরা কখনোই নিজের প্রয়োজন কাউকে সঠিকভাবে বোঝাতে সমর্থ হয়না। একটি বালাক হঠাৎ করেই যখন পুরুষালি চরিত্রে চলে আসে তখন স্বাভাবিক ভাবেই তার আশেপাশের লোকজন তাকে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারে না। তার আশেপাশের লোকজন তাকে বয়স্ক কাতারে ফেলে দেয় আর নিজে চিন্তা করে সেতো এখনো ছোট! পরিবেশ মনে করছে ছেলেটি বড় হয়ে গেছে। কিন্তু সে বুঝতে পারে না কীভাবে সে বড় হয়ে গেলো। এই দ্বিমুখী সংঘর্ষের কারণে ছেলেটির মানসিক অবস্থার চরম অবনতি হয়। এই অবনতির ধারা অব্যাহত হলে ছেলেটি পথ হারিয়ে ফেলে। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে এই বয়সের পথহারা হওয়ার।

ক) বন্ধুমহলঃ
বয়ঃসন্ধির এই চরম মর্মান্তিক অবস্থায় তার পাশে দাঁড়ায় তার বন্ধুরা। সে বড়দের চরিত্রে ঢুকার সাথে সাথে শারীরিক যে কৌতূহল গুলো চোখে পড়ে, তা বিস্তারিত জানার একমাত্র উৎস হয়ে উঠে তার চেয়ে দু চার বছরের বড় বন্ধুমহল। যারা ইতিমধ্যে এই পর্বটি পার করেছে বা করছে। যেহেতু এই বয়সটি হলো চরম কৌতূহলী আকাঙ্ক্ষার সময়। প্রতিটি বিষয়ই এখন তার কাছে নতুন। যা দেখে যা করছে তার কাছে সবই নতুন। খুব কম সংখ্যক ছেলেরা এই শারিরীক সাংঘর্ষিক মনস্তাত্বিক সময়টাতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যার ফলে যারা কৌতূহলী তারা বন্ধুদের খপ্পরে পড়ে অনিয়ন্ত্রিত জৈবিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে নতুন শারিরীক যে পরিবর্তন তারা অনুভব করে, তার স্বাদ আস্বাদন করতে গিয়ে নিজেদের উপর অনৈতিক জৈবিক চর্চায় জড়িত হয়ে যায়। যা তাদের শারিরীক এবং মানসিক একটি বিরাট ক্ষতির মুখে ফেলে দেয়।

খ) সহজ পর্নোগ্রাফীঃ
বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলেদের ধ্বংসের মূল কারণ হচ্ছে সহজ পর্নোগ্রাফী। যেহেতু এই বয়সের ছেলেদের শারীরিক সঠিক জ্ঞান থাকে না। যার ফলে বন্ধুদের খপ্পরে পরে তারা প্রথম পর্নোগ্রাফীতে যুক্ত হয়। পরবর্তীতে সমাজ এবং রাষ্ট্রের বদৌলতে সহজ পর্নোগ্রাফীতে তারা জড়িয়ে পড়ে। বর্তমান সহজলভ্য তথ্যপ্রযুক্তির কারণে টিনএজারদের এই ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।

গ) নিষিদ্ধ কৌতূহলঃ
মানবিক গুণাবলীর একটি একটি গুণ হচ্ছে সহজাত কৌতূহল। এই বয়সে নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি অতিমাত্রায় কৌতূহল কাজ করে। যেকারণে বড়রা যা করতে নিষেধ করে তার প্রতি তাদের কৌতূহল কাজ করে। নারীপুরুষের গোপন বিষয় গুলো নিয়ে এই বয়সে তুমুল আগ্রহ জন্ম নেয়। এই আগ্রহ থেকেই কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। সেই কৌতূহল নিবারণ করতে গিয়ে তারা ভয়ংকর এক ফাঁদে পা দিয়ে ফেলে। যে ফাঁদ থেকে সহজে তারা বেরিয়ে আসতে পারেনা।

ঘ) পারিবারিক ছিন্ন বন্ধনঃ
আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সামাজিক শিক্ষিত লোক খুবই কম। পরিবার গুলোতে জীবন এবং জীবিকাই প্রাধান্য পায় বেশী। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মাথা ঘানোর মতো সময় এখানে থাকে না। তাই বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে কোনো ছেলেই সঠিক স্নেহ ভালোবাসা পায় না। যেকারণে এই উন্মাদনার উদ্দাম সময়গুলোতে ছেলেরা পরিবার থেকে দূরে সরে যায় ধীরে ধীরে। পারিবারিক এই দূরত্ব একটি ছেলেকে তার পরিবার থেকে তাকে অনেক দূরে ঠেলে দেয়। যে দূরত্ব আর কখনোই হয়তো ঠিক হয় না।

পারিবারিক ভালোবাসা সহমর্মিতার অভাবে একটি ছেলে খারাপ পরিবেশে জড়িয়ে পড়ে। তার কাছে সুন্দর সম্পর্কের আর কোনো মূল্য থাকে না। নিষিদ্ধ জৈবিক আকৃষ্টতা তার মানবিক বোধ শক্তিকে নষ্ট করে ফেলে। সে উদ্দাম উত্তাল সময়ে ভুলে যায় সামাজিক সম্পর্ক গুলোর কথা। এই নিষিদ্ধ আকৃষ্টতা তাকে টেনে নিয়ে যায় পৈশাচিক জৈবিক তাড়নার দিকে। এবং এক সময় সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সমাজে নানান জায়গায় অপকর্মে পারদর্শী হয়ে উঠে। তাই পারিবারিক সুন্দর সামাজিক বন্ধন এই বয়সের ছেলেদের খুবই প্রয়োজন।

ঙ) সহজলভ্য পতিতাবৃত্তিঃ
সামাজিক বিভিন্ন কারণে নারীদের একটি শ্রেণী পতিতায় পরিনত হয়। জীবিকার জন্য তারা সস্তা পতিতাবৃত্তিতে লিপ্ত হয়। এই সস্তা পতিতাবৃত্তির কারণে বয়ঃসন্ধি ছেলেদের একটি বড় অংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। যারা এই ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়ে যায় তারা সহজে সেই পথ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না।

চ) ধর্মীয় অনুশাসন না থাকাঃ
একটি ছেলে জৈবিক তাড়নায় ধ্বংসের মূলে রয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনহীন জীবন যাপন। যে পরিবার ধর্মীয় অনুশাসনের চর্চা করে সেই পরিবারের ছেলেরা সহজে এইসব অশ্লীল বিষয় মেনে নেয় না। তারা গোপন বিষয় গোপনে রাখতে শিক্ষা পায়। যার কারণে ধার্মিক পরিবারের সন্তানেরা নিজেদেরকে পাপ থেকে দূরে রাখতে সচেষ্ট হয়। কেননা তারা ছোট থেকেই একটি সুন্দর ধর্মীয় ব্যবস্থাপনায় বড় হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে অশ্লীলতা কম কাজ করে। যে পরিবারে সঠিক ইসলামী অনুশাসনের চর্চা হয় সেইসব পরিবারের ছেলেরা এইসব কর্মকাণ্ডকে পাপ মনে করে দূরে থাকার চেষ্টা করে। তাই যে পরিবারে ধর্মীয় অনুশাসন নেই সেইসব পরিবারের সদস্যরা এই বয়সে অনৈতিক কাজে বেশী জড়িয়ে পড়ে।

ছ) রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যঃ
বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যের কারণে বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলেদের বিভিন্ন অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে থাকার কারণে তাদের মধ্যে বেপরোয়া ভাব কাজ করে। এই বেপরোয়া ভাবের কারণে তারা বাঁধাহীনভাবে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে জড়িয়ে পড়ে। এই খারাপ সময়টিতে তারা অশ্লীলতার চরম শিখরে পৌঁছে যায়। যেহেতু পরিবার থেকে বন্ধনহীন এবং সামাজিক ভাবে শক্তি প্রাপ্ত, সেহেতু তারা নিষিদ্ধ জগতে নিঃসংকোচে দাপিয়ে বেড়ায়। এই নষ্ট জীবনযাপন তাদের এক ধ্বংসাত্মক জীবনের মুখোমুখী করে দেয়। যা তারা পরবর্তী জীবনে অনুধাবন করতে পারে।

জ) গুরুত্বহীন জৈবিকতাঃ
আমাদের সমাজে ছেলেরা বালেগ হলে যে, তাদের ভিতরে একটি জৈবিক চাহিদা কাজ করে সেটা সমাজ এবং পরিবার উপেক্ষা করে। সমাজ এবং পরিবার কখনোই এইসব বুঝতে চেষ্টা করে না। তাদের অজ্ঞতার কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয় আমাদের দেশে। অথচ এই জৈবিক চাহিদা আর দশটি মানবিক চাহিদার মতোই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি মানুষ প্রচন্ড রোদে হেটে গেলে যেমন পানির জন্য তৃষ্ণার্ত হয়। ঠিক তেমনি যৌবনের প্রথম দিকে ছেলেদের এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। যা তাদের গোপন দরজার পাশে নয়তো ভাঙা বাড়ির অন্দরে নিজের নিকৃষ্ট যৌনাচারে লিপ্ত করে। সুতরাং এই জৈবিক চাহিদার কথা আমাদের উপেক্ষা করা উচিত নয়।

পরিবারের করণীয়ঃ
একটি ছেলের এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে সেটি হচ্ছে পরিবার। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সুন্দর একটি বন্ধুত্বপূর্ণ বন্ধন সবচেয়ে বেশী কাজ করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে খুব কম পরিবারই এমন পাওয়া যায় যারা তাদের সন্তানদের রক্ষা করতে পারে। আমাদের সামাজিক কিছু সীমাবদ্ধতা এখনো রয়েছে। এখানে সন্তানের সাথে গোপন বিষয় গুলো খোলামেলা আলোচনা হয় না। এই সময়টিতে একটি মেয়ে পরিবারের অন্য মেয়ে সদস্য থেকে কিছু না কিছু সাপোর্ট পেয়ে থাকে। কিন্তু সেই জায়গায় একটি ছেলে কখনোই সেই সাপোর্টটি পায় না। হতে পারে ধর্মীয় গোঁড়ামি অথবা অজ্ঞতা। তাই পরিবারের বিভিন্ন করণীয় রয়েছে ছেলেদের এই ধ্বংসাত্মক জীবন থেকে রক্ষা করার জন্য।

ক) বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কঃ
পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক একটি ছেলেকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। একটি ছেলে যখন নিষিদ্ধ বিষয় গুলো সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা পায়, তখন সে তার কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। যখন তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে কী ভালো আর কী খারাপ তখন সে নিজে নিজেই ভালো থাকতে চেষ্টা করবে যতটুকু পারা যায়। তাই সবসময়ের মতো প্রতিটি পরিবারকে আগে এগিয়ে আসতে হবে এইসব ছেলেদের রক্ষা করতে। যখন একটি ছেলেকে বুঝানো হবে কী করলে কী ক্ষতি হতে পারে এবং কখন কী করার সঠিক সময়। তখন এইসব বিষয়ে অজ্ঞ ছেলেরা সঠিক বিষয় গুলো বুঝার চেষ্টা করবে। তাই পরিবারের উচিত তাদের বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলেদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করে তাদের বিষয়গুলো সহজভাবে উপস্থাপন করে সমাধান দেওয়া।

খ) ধর্মীয় চর্চাঃ
প্রতিটি পরিবারের উচিত সঠিক ধর্মীয় চর্চা গুলো নিয়মিত করা। প্রতিটি সন্তানকে সঠিক নৈতিক জ্ঞান দেওয়া। সেই সাথে ধর্মীয় বিষয় গুলো সামনে এনে অশ্লীল পাপাচার থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করা।

গ) সঠিক নজরদারিঃ
এই বয়সের ছেলেদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করলে ফলাফল খুবই খারাপ হয়। তাই পরিবারের উচিত সন্তানের প্রতি সঠিক নজরদারি। ছেলে কখন কোথায় যায়। কার কার সাথে মেলামেশা করছে। যাদের সাথে মিশছে তাদের পারিবারিক চরিত্র এবং ইতিহাস জানা জরুরী। যদি কোন খারাপ পরিবেশ বা বন্ধুর সংস্পর্শে চলে আসে তবে তাকে সাথে সাথে সাবধান করে দিতে হবে। তাও জোরপূর্বক নয়। সুন্দর এবং চমৎকার উপস্থাপনার মাধ্যমে তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে, সে যার সাথে মিশছে সে কেন খারাপ। তার সাথে মেশার ফলে কী কী ক্ষতি হতে পারে ভবিষ্যতে। যদি পরিবারের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তাদের সাথে মিশে তাহলে ভবিষ্যতে সে কী কী সুবিধাবঞ্চিত হবে সে ব্যাপারে সঠিক ধারণা দেওয়া। এই ক্ষেত্রে বিভিন্ন দৃষ্টান্ত তার সামনে তুলে ধরতে হবে।

বর্তমান সময়ে ছেলেরা অনেক এগিয়ে আছে। এই বয়স সম্পর্কিত তাদের বিভিন্ন বই পড়তে দেওয়া যেতে পারে। এই বয়সের ক্ষতিকর দিক গুলো তুলে ধরে বিভিন্ন ডকুমেন্টারী দেখানো যেতে পারে। সেই সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখতে হবে। কখনোই তাদের একাকীত্বে থাকতে দেওয়া যাবে না। এই বয়সের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো নারী ঘটিত সমস্যা।

বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ের প্রথম চার পাঁচ বছরে ছেলেরা প্রচন্ড রকম আবেগী হয়। এই সময়টিতে তাদেরকে সঠিক পরিচর্যা করা না গেলে অনেক সময় ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যায়। আমাদের দেশে এই বয়সের ছেলেমেয়েদের অপ্রাপ্তবয়স্ক প্রেমের হাজার হাজার ঘটনা ঘটছে। যা পরিবারের অজান্তে বিয়ে পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। পরে পরিবারের হস্তক্ষেপেও এইসব সম্পর্ক টিকিয়েও রাখা যায় না। কেননা চরম উত্তেজনার সময়ে তারা যে ভুল করে। কিছুদিন যাওয়ার পর তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। তাই পরিবারের উচিত হবে তাদের সাথে সবসময় সার্বিক যোগাযোগ রাখা।

ঘ) কঠোর না হওয়াঃ
বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলেদের সাথে কখনোই কঠোর আচরণ করা যাবেনা। প্রতিটি পরিবারের উচিত এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য রাখা। অধিকাংশ ছেলেই বয়ঃসন্ধির মানসিক চাপ নিতে পারে না। কোনো ভুলের কারণে যদি ছেলেদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা হিতে বিপরীত হয়। হঠাৎ কোনো শারিরীক ও মানসিক আঘাত পেলে ছেলেরা তা আজীবন মনে পুষিয়ে রাখে। পরিবারের যে সদস্য দ্বারা সে হেনস্তা হয় তাকে সে জীবনের তরে ভালো চোখে দেখে না। যারফলে একটি সুন্দর সম্পর্কের মৃত্যুর হয়। বয়ঃসন্ধিকালীন আঘাত ছেলেদের বিপথে যেতে ত্বরান্বিত করে। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতে কখনোই ছেলেদের সাথে কঠোর হওয়া যাবেনা। সুন্দর সুদীপ্ত উপস্থাপনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। তাকে এটা বোঝাতে হবে যে আপনি তার ভবিষ্যৎ ভালোর জন্যই পরামর্শ দিচ্ছেন। আপনি যে তার হিতাকাঙ্ক্ষী সেটা তাকে বুঝতে দিতে হবে।

ঙ) সঠিক সময়ে বিয়েঃ
আমাদের দেশে সঠিক সময়ে ছেলেদের বিয়ে দেওয়া হয়না। যার কারণে ছেলেরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে খারাপ পথে জৈবিক প্রয়োজন মিটায়। সেটা হতে পারে নিজের শরীরের উপর অত্যাচার করে। অথবা অনৈতিক শারীরিক সম্পর্ক করে। তাই প্রতিটি পরিবারের উচিত ছেলেদের খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনে বিয়ে দিয়ে তাদের সঠিক পথে আনা।

চ) অবাধ তথ্যপ্রযুক্তি রোধঃ
বর্তমান সময়ের ছেলেরা যে উৎস থেকে সবচাইতে বেশী ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে, তা হচ্ছে অবাধ তথ্যপ্রযুক্তি। আমাদের বর্তমান পিতামাতারা ছেলেদের ১৩ /১৪ বছর হওয়ার আগেই হাতে হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিচ্ছেন। এই বাধা সর্বোচ্চ এসএসসি পর্যন্ত। প্রতিটি ছেলে কলেজে যাওয়ার সাথে সাথে মোবাইল পেয়ে যাচ্ছে। আর বাবা মায়েরাও ছেলেদের কাছে ওয়াদাবদ্ধ হয়ে যান মোবাইল দেওয়ার। কিন্তু এটা খুবই মারাত্মক একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এই মোবাইল প্রতিটি ছেলের চরম উন্মাদনার যৌবন জ্বালার দাহ্য বস্তুর মতো। ছেলেদের এই অস্থির মুহূর্তে মোবাইলটি জ্বলন্ত উনুনে কেরোসিনের মতো। যা তাদের জ্বলে পুড়ে শেষ করার জন্য যথেষ্ট। এই মোবাইলের দ্বারা আজ আমাদের সমাজে অপকর্মের ছাড়াছাড়ি। সহজ ইন্টারনেটের কারণে ঘরে দরজা বন্ধ করেই ছেলেরা ডুব দেই নষ্ট দুনিয়ার নীল পর্নোগ্রাফীতে। কোনো মা বাবাই জানতে পারে না তাদের সোনার টুকরো ছেলের তারা কী ক্ষতি করে ফেলেছে। তাই ভার্সিটির আগে কখনোই ছেলেদের এনড্রয়েড ফোন দেওয়া যাবে না। যদি দিতেই হয় তবে স্কুল জীবনে নয়। আর তখনই দিতে পারবেন যখন আপনি নিজেই এই মোবাইলে পারদর্শী হবেন। কেননা আপনাকে অবশ্যই তার উপর নজরদারি রাখতে হবে। কেননা ছেলেকে নজরদারিতে না রাখলে ভবিষ্যতে আপনারই ক্ষতি।

সমাজের করণীয়ঃ
এই বয়সের ছেলেরা সবচেয়ে বেশী যে সাপোর্ট বর্তমানে পাচ্ছে সেটা হচ্ছে সমাজ। সমাজের কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের কারণে এইসব ছেলেরা দিনদিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের কিশোর সমাজকে সঠিক পথে টিকিয়ে রাখতে হলে সমাজের বিশেষ ভূমিকা পালন করা দরকার।

ক) সহজ পতিতাবৃত্তি বন্ধঃ
সমাজের আনাচে কানাচে সহজলভ্য যে পতিতাবৃত্তি চলে তা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। যাতে করে কোনো কিশোর হাত বাড়ালেই নষ্ট জায়গার খোঁজ না পায়।

খ) কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণঃ
রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে সমাজে বিভিন্ন কিশোর গ্যাংস্টার সৃষ্টি করে এক শ্রেণীর স্বার্থবাদী মানুষ। তাদের প্রশ্রয়ে এইসব উঠতি বয়সের ছেলেরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে যখন তারা পরিবার থেকে বাঁধাহীন হয়ে যায়। এবং সেই সাথে সমাজের বড়ভাইয়ের আশ্রয় পায়। তখন তারা সহজেই যেকোনো পাপে জড়িয়ে পড়ে। এই জৈবিক পাপ যে কত ভয়ংকর তারা সেই সময় কখনোই টের পায় না। তাই সমাজ থেকে কিশোর গ্যাংস্টার সৃষ্টি বন্ধ করতে হবে।

গ) মুরুব্বীদের শাসনঃ
গত দশ পনেরো বছর ধরে আমাদের সমাজে মুরুব্বীদের শাসন উঠে গেছে। যদিও এর অনেক গুলো কারণ রয়েছে। কিন্তু এটা একটি সমাজে খুবই প্রয়োজন। আগে এক সময় রাস্তাঘাটে ছেলেরা যেমন তেমন ভাবে পোশাক পড়তে বা চুলের ফ্যাশন করে কাটিং দিতো পারতো না। সমাজে ইভটিজিং ছিলো না। কিন্তু এখন রাজনৈতিক পেশিশক্তির কারণে সমাজে রাজনৈতিক নেতার দাপটে সমাজের মুরুব্বীদের ক্ষমতা কমে গেছে। যার ফলে সামাজিক শাসনের যে শিকল ছিলো তা ছিঁড়ে গেছে। এই শাসন শৃঙ্খলা ধ্বংস হওয়ার কারণে সমাজে উঠতি বয়সের ছেলেরা বিভিন্ন অপকর্মের পাশাপাশি অনৈতিক শারীরিক সম্পর্কের জন্য যথেষ্ট সুযোগ এবং সুবিধা নিচ্ছে। এইসব খবর অনেকক্ষেত্রে তাদের পরিবারও জানে না।

ঘ) সৃজনশীলতার বিকাশঃ
আমাদের দেশে একটি সময় ছিলো যখন ছেলেরা দল বেধে বিভিন্ন সামাজিক সংঘটনে কাজ করত। বিশেষ করে প্রতিটি পাড়া মহল্লায় ক্লাব ছিলো। ক্লাবের উদ্যোগে খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ হতো। যা গত দশ পনেরো বছরে স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এইসব সুষ্ঠু সৃজনশীল চর্চা একটি সমাজের ছেলেমেয়েদেরকে সুন্দর পথে চলতে সাহায্য করে। তারা যখন এই জাতীয় বিভিন্ন ভালো কাজে নিমগ্ন থাকে তখন তারা খারাপ পরিবেশ এবং নষ্ট সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে পারে। তাই যদি সুন্দর এক‌টি কিশোর সমাজ চাইলে আমাদের অবশ্যই খেলাধুলাসহ ইসলামী সংস্কৃতির সৃজনশীল সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করতে হবে।

মুক্তির পথঃ
ক) ধর্মীয় অনুশাসনঃ
বয়ঃসন্ধিকালীন এইসব ছেলেদের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে একমাত্র মুক্তির পথ হচ্ছে ধর্মীয় অনুশাসন। সমাজ এবং পরিবারে যদি সঠিক ধর্মীয় অনুশাসনের চর্চা করা হয় তাহলে আমরা খুব সহজেই এই খারাপ পরিস্থিতি থেকে কিশোর সমাজকে উদ্ধার করতে পারি। যদি ছোট থেকেই ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হয় তবে তাদের মধ্যে অশ্লীলতা নিয়ে ধর্মীয় ভীতি কাজ করবে। আর যে পরিবারে ধর্মীয় সঠিক জ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হয় সেই পরিবারের ছেলেরা সর্বদা আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে। আল্লাহর সত্যিকারের ভয় থাকার ফলে তারা দুনিয়াবী পাপ থেকে সবসময় দূরে থাকার চেষ্টা করে। যার ভিতর আল্লাহর ভয় কাজ করে তাকে আল্লাহ নিজেই সাহায্য করে। সুতরাং প্রতিটি পরিবারের উচিত ছেলেদের সঠিক ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া।

খ) সঠিক সময়ে বিয়েঃ
আমাদের সমাজে এক‌টি ভুল রীতি চালু আছে। তা হচ্ছে ছেলেদের বয়স হয়ে গেলেও সঠিক সময়ে বিয়ে না করানো। একটি ছেলে বালেগ হয় চৌদ্দ পনেরো বছরে। এই বসয় থেকেই ছেলেদের ভিতরে তীব্র জৈবিক চাহিদা কাজ করে। এই তীব্রতা কোনো বাঁধা বা কথা মানে না। এই জৈবিক জোয়ারে ছেলেরা প্রায় পথহারা হয়ে যায়। তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে হলে বা পাপ থেকে দূরে রাখতে হলে অবশ্যই সঠিক সময়ে বিয়ে দিতে হবে। আমাদের দেশে ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে করতে পারে না। অথবা বোনের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত ছেলেদের বিয়ে করতে দেওয়া হয় না। এই দীর্ঘ একটি সময় ছেলেরা কীভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করবে পাপ না করে? এই পাপের দায়িত্ব প্রতিটি মা বাবাকে নিতে হবে। আগের দিনে ছেলেরা বিয়ে করেও পড়াশোনা করতো। এখন পড়াশোনা শেষ করার পরও আরো দু চার বছর পর চাকরি, এরপর আরো চার বছর পর বিয়ের চিন্তা করে পরিবার। যা মোটেই সঠিক নয়। ছেলেদের আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত হতে জোর দিতে হবে। সেই সাথে পরিবারকেও সাহায্য করতে হবে ছেলেদের সঠিক পথে আসার।

অনেক সময় দেখা যায় ছেলেরা একেবারে খারাপ হয়ে গেলে তারপরে বিয়ে করায়। কিন্তু ততদিনে সব শেষ হয়ে যায়। এইসব ছেলেরা যে বিয়ে করার পরও সঠিক পথে এসেছে তার কোনো প্রমাণ নেই। তাই আমাদের উচিত সঠিক সময়ে ছেলেদের বিয়ে দিয়ে তাদেরকে খারাপ পথ থেকে ফিরে আসতে সাহায্য করা।

সর্বশেষ কথাঃ
বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে একটি ছেলে যে কী পরিমাণ কষ্টে থাকে তা ঐ বয়সী একটি ছেলে ছাড়া আর কেউ বর্ণনা করতে পারবে না। এই ক্ষুদ্র বয়সে হঠাৎ করে বড় হয়ে যাওয়া সে সহজে মেনে নিতে পারে না। এর কারণ পরিবার এবং সমাজ তাকে মানসিক ভাবে বড় না করে শারীরিক ভাবে বড় ভেবে ফেলে আচরণ করতে থাকে। যার কারণে সে বুঝে উঠতে পারে না আসলেই সে ছোট না কি বড়।

সেই সাথে নিজের শারীরিক কৌতূহল থেকে নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা নিতে সে পা বাড়ায় খারাপ পথে। একান্ত গোপনে এমন সব কিছু করে যা তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। এই ধ্বংস হতে পারে শারীরিক হতে পারে নৈতিক, হতে পারে ধর্মীয়। তাই এদের সাহায্য করতে আমাদের প্রতিটি পরিবার এবং সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।

সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী