-বনলতা, এই বনলতা…
-বল!
-একটা খবর আছে।
– কী খবর সুরঞ্জনা?
বনলতা আর সুরঞ্জনা। ছোট্ট দুটো বাড়ি। পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকে। ওদের মধ্যে ভারি মিতালী। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে যখন আর ভাল লাগেনা তখন দু’জনে সুখদুঃখের গল্পে মেতে ওঠে।
সেই দশ বারো বছর আগে বুড়োকত্তা তৈরি করেছিলেন ওদের। তাঁর দুই ছেলের জন্য। কবিতাপাগল কত্তামশায় ভালবেসে নাম রেখেছিলেন সুরঞ্জনা আর বনলতা। জীবনানন্দের কবিতার দুই নারীচরিত্র। সুন্দর ছোট্টছোট্ট দুটো একতলা বাড়ি। হালকা সবুজরঙে ভরে দিয়েছিলেন সারা শরীর।
সুরঞ্জনা বলে – কাল রাতে আমার কত্তা তার গিন্নিকে বলছিল- আমাকে নাকি ভেঙে নতুন করে ত্রিতল করবে।
-তাই নাকি? তাহলে তো তোর ভারি আনন্দ।
-সে তো একটু হচ্ছেই।
– তোর কত্তা ভাল চাকরি করে। শুনেছি উপরিও আছে। তোকে যত্নআত্তি করা ক্ষমতা আছে। আমার কত্তা তো আর চাকরি-বাকরি করে না। ওই ছোট্ট একটু দোকান। – বনলতা থামে।
সুরঞ্জনাও কোনো প্রতিউত্তর করে না।
বনলতা আবার বলে- তা তোর তো নবজন্ম হবে। পূর্বজন্মের প্রিয় সাথিকে তখন মনে থাকবে তোর?
– কী যে বলিস না তুই! মনে থাকবে না? আমরা দুইজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে একসাথে কত ঝড়-বৃষ্টি-খরা সহ্য করলাম। কত সুখ-দুঃখের দিন পার করলাম। সেসব কি ভোলা যায়? বড় হলে কি হবে। তুই আমার প্রাণের সাথি ছিলি, আছিস, থাকবি চিরকাল।
সুরঞ্জনাকে ভাঙা হলো। খুব কষ্ট হল তার। তবু বড় হবার স্বপ্নে সব সয়ে নিল দাঁতে দাঁত চেপে।
বনলতাও বিমর্ষ মনে দেখল তার সাথির নিঃচিহ্ন হয়ে যাওয়ার দৃশ্য।
দেখল সুরঞ্জনার ধীরে ধীরে পূনর্জন্ম প্রাপ্তির দৃশ্যও। সে এখন বিশাল এক সুরম্য অট্টালিকা। দিনক্ষণ দেখে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল প্রাসাদের। পার্টি চলল গভীর রাত পর্যন্ত। গর্বভরা চোখে সুরঞ্জনা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করল নাচ-গান।
নতুন নামকরণও হল। তার কপালের উপর খোদাই করে বড়বড় ইংরেজি অক্ষরে লেখা হল-সানভিলা।
বনলতা চুপচাপ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল, শুনল সবকিছু। সুরঞ্জনা কি ভুলে গেল তার প্রিয় সঙ্গীকে?
রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়। বনলতার চোখে তবুও ঘুম আসেনা।
পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়েছে। সুরঞ্জনাও কি ঘুমিয়েছে? না কি…
বনলতা কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকে – সুরঞ্জনা!
সুরঞ্জনা নয় সানভিলার চোখ এখন শুধু আকাশের দিকে। নীচে তাকানোর ইচ্ছে, সময় – কিছুই তার নেই।
-সুরঞ্জনা!
বনলতার ডাক সানভিলার কঠিন কংক্রিট দেহে ধাক্কা ফিরে ফিরে আসে তার কাছে।