শংকর দেবনাথ এর সকল পোস্ট

শংকর দেবনাথ সম্পর্কে

শংকর দেবনাথ জন্মঃ ২১ অক্টোবর, ১৯৭৪ প্রকাশিত গ্রন্থ - কবিতার বইঃ ১) আত্মহনন অথবা মৈথুন ২) শিয়রে নীলাভ জ্বর ৩) পরকীয়া ঘুম ছড়ার বইঃ ১) দুধমাখা ভাত ২) টক ঝাল তেতো কড়া ৩) ফাটকা কথার টাটকা ছড়া ৪) লাগ ভেল্কি লাগ ৫) রসে কষে ভরা প্রবাদের ছড়া গল্পগ্রন্থঃ ১) দুই শালিকের গল্প ২) গাছের জন্মদিন পিডিএফ ছড়ার বই: ১. ফাটকা কথার টাটকা ছড়া ২. সুজন পাখির কূজন ৩. অথৈ প্রাণের ধারা ৪. ছন্দ মাতে বন্দনাতে ৫. কিম্ভুতকিমাকার ৬. অপ্রচলিত ছড়া ৭. আমার সুকুমার ৮. প্রাণের ঠাকুর ৯. গাছপাগলের পদ্য ১০. ছড়ায় পড়া ১১. শব্দ নিয়ে মজা ১২. ভূত আছে ভূত নেই ১৩) ঠাকুরদাদার বউ ১৪) তাই রে না না ১৫) খুশি মনে পুষি ছড়া ১৬) স্বরবর্ণের ঘর সম্পাদিত পত্রিকাঃ ছোটদের ভোরের পাখি ভেল্কি ছড়াপত্র ঠোঁটকাটা মাসিক ছড়াপত্রিকা পুরষ্কার ও সম্মাননাঃ ১। নিখিলবঙ্গ শিশুসাহিত্য সংসদ প্রদত্ত " কবি কৃত্তিবাস সম্মাননা" -২০১৮ ২। দীনবন্ধু রাখালদাস বিভূতি বিনয় একাডেমি প্রদত্ত " কবি যোগীন্দ্রনাথ সরকার সাহিত্য সম্মান -২০১৯

কুকুরছানা

তপু, ও তপু…
ডাকতে ডাকতে বাবা বাড়িতে ঢোকেন।
মা-ও তপুকে ডাকেন। বলেন- দেখ্, বাবা তোর জন্য কী নিয়ে এসেছেন! তপু—

কিন্তু তপুর কোনো সাড়া নেই।
গতকাল রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা কুকুরছানাটিকে নিয়েই সে ব্যস্ত। তার পড়ার ঘরের সামনের ছোট্ট ঝুল বারান্দায় বসে ছানাটিকে বিস্কুট খাওয়াচ্ছে তপু।

গতকাল বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল তপু। হঠাৎ রাস্তার পাশে কুকুরছানাটিকে কেঁউকেঁউ করতে দেখে খুব মায়া হয় তার। আদর করে কোলে তুলে বাড়ি নিয়ে আসে।

কিন্তু বাড়িতে আসতেই বাবা-মা’র বাধার মুখে পড়তে হয়। কেউই রাস্তার কুকুরকে ঘরে তুলতে রাজি নয়।
– ওটা এনেছিস কেন? যা আবার রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আয়। – বিরক্তির সাথে মা বলেন।

বাবা বলেন- ওসব দেশি কুকুর ঘরে তুলতে নেই বাবা। তোমার কুকুর পোষার শখ? তো ভাল দেখে একটা বিদেশি কুকুর এনে দেব। তুমি ওটাকে বাইরে রেখে এসো গে যাও।

কিন্তু কে শোনে কার কথা। তপু ছানাটিকে কোলে করে সোজা চলে গিয়েছিল তার দোতলার পড়ার ঘরে। আদর করে বিস্কুট খাইয়েছিল। ভাতও দিয়েছিল খেতে। রাতে হার্ডবোর্ডের একটা বড় বাক্সের মধ্যে শুইয়ে রেখেছিল।

মা ছেলের পাগলামি দেখে বাবাকে বলেছিলেন- কালই তুমি ওর জন্য একটা বুলডগ এনে দিও। নয়তো ওই রাস্তার কুকুরকে ও কিছুতেই ছাড়বে না।

আজ রবিবার। স্কুল নেই। তাই সকাল হতেই তপু কুকুরছানাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

বাবা মা তপুকে ডাকতে ডাকতে তার পড়ার ঘরের দিকে এগিয়ে যান। বাবার হাতে গলায় শেকল পরানো ছোট্ট একটা বুলডগ।

মা বলেন- দেখ্ তপু, বাবা তোর জন্য কি সুন্দর একটা কুকুর এনেছেন।

তপু দেখে। সত্যি তো খুব সুন্দর দেখতে। ধবধবে সাদা বড়বড় লোমে ভরা সারাশরীর। গায়ে হাত দেয়। বাহ্, কি নরম!
বাবা বলেন- দাও ওটাকে। রাস্তায় ফেলে আসি। এটাই এখন তোমার।

তপু একবার কুড়িয়ে আনা কুকুরছানাটির দিকে তাকায়। দেখে- ভয়ে যেন কুঁকড়ে আছে ও। বারবার সভয়ে তাকিয়ে দেখছে শেকলপরা বিদেশি ডগটির দিকে। আর বুলডগটিছানাটিও সরোষে তাকাচ্ছে দেশি ছানাটির দিকে।

তপু বলে- এটাও থাক না বাবা।
মা বলেন- পাগল নাকি তুই? ওইসব দেশি কুকুর কেউ পোষে নাকি? ওকে ঘরে দেখলে লোকে খারাপ বলবে।
বাবাকে উদ্দেশ্য করে মা বলেন- যাও তো, ওটাকে বাইরে রেখে এসো।

তপুুর বাবা পথের কুকুরছানাটিকে ঘৃণাভরে হাতে তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।
খারাপ লাগলেও বাঁধা দিতে পারে না তপু । শুধু একবার বুলডগ, আর একবার কুড়িয়ে আনা কুকুরছানার দিকে তাকায়।

কিছুক্ষণ চুপ মেরে বসে থাকে তপু। তারপর কি ভেবে বুলডগটির শেকল ধরে। উঠে দাঁড়ায়।

হঠাৎ তার কানে ভেসে আসে সেই কেঁউকেঁউ শব্দ। তাকিয়ে দেখে – কুকুরছানাটি গেটের বাইরে রাস্তার পাশে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে অসহায় করুণ চোখে তপুদের বাড়ির দিকে চেয়ে বসে আছে।

ভূত-দশকিয়া

এক ভূতে দেখ্ যায় শুতে ওই তেঁতুলগাছে ঝুলে-
দুই ভূতে রুই মাছের মুড়ো চিবোয় হেলেদুলে।
তিন ভূতে ধিন্ তাধিন নাচে গাবের তলায় খোশে-
চার ভূতে হাড়- মালা গলায় গল্প করে বসে।

পাঁচ ভূতে কাজ বাজ ভূলে সব কন্ঠ সাধে সা রে-
ছয় ভূতে ভয় দেখায় শুধু রাত্রে যারে তারে।
সাত ভূতে দাঁত বেরিয়ে হাসে -ভাসে হাওয়ার সাথে-
আট ভূতে হাট জমায় মাঠে- অমার কালো রাতে।

নয় ভূতে রয় দাঁড়িয়ে সোজা একপায়ে ভর করে-
দশ ভূতে বস্ সেজেই ঘোরে মুণ্ডু হাতে ধরে।
ভূত নিয়ে ভাই খুঁতখুঁতানির জ্বালায় সবাই মো’লো-
এক থেকে দশ দেখ্ চেয়ে বশ ছড়ায় কেমন হো’লো।

ভালোবাসার ফোঁটা

ছোট্ট সোনা বোনটি আমার
মনটি ফুলের মত-
মিষ্টি হাসির বৃষ্টিতে সে
ভিজায় অবিরত।

হৃদয়টা তার ভালোবাসার
আলো-আশার খনি-
কথায় ঝরায় ছন্দ-ছড়ায়
প্রাণের সুরধনী।

ছোট্ট সোনা বোনটি আমার
মনটি ভরা প্রীতি-
ভালবাসার ফোঁটায় আমায়
সাজায় নিতিনিতি।

কুকুরছানা

– তপু, তপু…
ডাকতে ডাকতে বাবা বাড়িতে ঢোকেন।
মা-ও তপুকে ডাকেন। বলেন- দেখ্, বাবা তোর জন্য কী নিয়ে এসেছেন! তপু—

কিন্তু তপুর কোনো সাড়া নেই।
গতকাল রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা কুকুরছানাটিকে নিয়েই সে ব্যস্ত। তার পড়ার ঘরের সামনের ছোট্ট বারান্দায় বসে ছানাটিকে বিস্কুট খাওয়াচ্ছে তপু।

গতকাল বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল তপু। হঠাৎ রাস্তার পাশে কুকুরছানাটিকে কেঁউকেঁউ করতে দেখে খুব মায়া হয় তার। আদর করে কোলে তুলে নেয়। বাড়ি নিয়ে আসে।
কিন্তু বাড়িতে আসতেই বাবা-মা’র বাধার মুখে পড়তে হয়। কেউই রাস্তার কুকুরকে ঘরে তুলতে রাজি নয়।
– ওটা আবার এনেছিস কেন? যা আবার রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আয়।
বিরক্তির সাথে মা বলেন।
বাবা বলেন- ওসব দেশি কুকুর ঘরে তুলতে নেই বাবা। তোমার কুকুর পোষার শখ? তো ভাল দেখে একটা বিদেশি কুকুর এনে দেব। তুমি ওটাকে বাইরে রেখে এসো। যাও।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। তপু কুকুরছানাকে কোলে করে সোজা চলে গিয়েছিল তার পড়ার ঘরে। আদর করে বিস্কুট খাইয়েছিল। ভাতও দিয়েছিল খেতে। রাতে হার্ডবোর্ডের একটা বড় বাক্সে মধ্যে শুইয়ে রেখেছিল।
মা ছেলের পাগলামি দেখে বাবাকে বলেছিলেন- কালই তুমি ওর জন্য একটা বুলডগ এনে দিও। নয়তো ওই রাস্তার কুত্তাকে ও কিছুতেই ছাড়বে না।

আজ রবিবার। স্কুল নেই। তাই সকাল হতেই সে কুকুরছানাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
বাবা মা তপুকে ডাকতে ডাকতে দোতলায় তার পড়ার ঘরের দিকে এগিয়ে যান। বাবার হাতে গলায় শেকল পরানো ছোট্ট একটা বুলডগ।
মা বলেন- দেখ্ তপু, বাবা তোর জন্য কি সুন্দর একটা বুলডগ এনেছেন।
তপু দেখে। সত্যি তো খুব সুন্দর দেখতে। ধবধবে সাদা বড়বড় লোমে ভরা সারাশরীর। গায়ে হাত দেয়। বাহ্, কি নরম ওর শরীর।
বাবা বলেন- দাও ওটাকে। রাস্তায় ফেলে আসি। এটাই এখন তোমার।
তপু একবার রাস্তার কুকুরছানাটির দিকে তাকায়। দেখে- ভয়ে যেন কুঁকড়ে আছে ও। বারবার সভয়ে তাকিয়ে দেখছে বিদেশি ডগটির দিকে। আর ডগটিও সরোষে তাকাচ্ছে ছানাটির দিকে।
তপু বলে- এটাও থাক না বাবা।
মা বলেন- পাগল নাকি তুই? ওইসব দেশি কুকুর কেউ পোষে নাকি? ঘরে ওকে দেখলে লোকে খারাপ বলবে।
বাবাকে উদ্দেশ্য করে মা বলেন- যাও তো, কুত্তাটাকে বাইরে ফেলে এসো।
তপুুর বাবা কুকুরছানাটিকে ঘৃণাভরে হাতে তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।
খারাপ লাগলেও বাঁধা দিতে পারলো না তপু। একবার বুলডগ, একবার কুকুরছানার দিকে তাকায়।
বুলডগটির শেকল হাতে ধরে। হঠাৎ তপুর কানে ভেসে আসে সেই কেঁউকেঁউ শব্দ।
তাকিয়ে দেখে – কুকুরছানাটি গেটের বাইরে রাস্তার পাশে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে অসহায় চোখে তপুদের বাড়ির দিকে চেয়ে আছে।

একটি অন্ত্য-অমিল ছড়া

খোকা মোটে বোকা নয় ওঠে রোজ ভোরে-
দাঁত মেজে মুখ ধুঁয়ে সুখসুখ মনে
হইচই নয় বই পড়ে ঘরে বসে।
ভুল করে না সে রোজ ইসকুল যেতে।

বৈকালে ওই মাঠে খেলা করে কাটে-
সাথিদের সাথে খুব মাতামাতি করে।
আরবার পড়া তার শেষ ক’রে রাতে
বেশ খুশি মনে টিভিটাকে খুলে নিয়ে-
দুলে দুলে কার্টুন দেখে আর খায়।
তারপরে চুপচাপ রূপকথাদেরই
দেশে যায় ঘুমঘুম বেশে অবশেষে।

কথা শোনে মা বাবার – রাখে মনে সেটা ।
নকল তো নয় কিছু সকলকে খুব
ভালবাসে। আলো হাসে চোখে সারাক্ষণ।
মারামারি- বাড়াবাড়ি করে না কখনও।

খোকাবাবু বোকা নয় থোকাথোকা ফুল-
হয়ে ঠিক ফিকফিক একদিন হেসে
উঠবেই- লুটবেই কাঙ্খিত ফল।

ঘুড়ি-লাটাই

– কি রে, অমন মন মরা হয়ে আছিস কেন? কি হয়েছে?
– কিছু না।
– চল, একটু ঘুরে আসবি।

কথা হচ্ছে ঘুড়ি আর লাটাইয়ের মধ্যে। ঘুড়ির মনে সবসময় একটা পরাধীনতার যন্ত্রনা। স্বাধীনভাবে উড়তে না পারার কষ্ট। যেই সে পাখা মেলে মুক্তির আনন্দে আকাশের নীলে নিজেকে বিলিয়ে দেয়, ভেসে যেতে চায় অজানার সীমানায়, অমনি লাটাইয়ের টান। বাধ্য হয়েই ফিরে আসতে হয় লাটাইয়ের কাছে।
দুঃখ-ক্ষোভ আর অভিমানে ঘুড়ির মনটা বড্ড বিমর্ষ হয়ে যায়। কিন্ত তার তো কিছু করারও নেই। সুতো যে বাঁধা ওই লাটায়ের সাথে।

সেদিন সবে উড়াল দিয়েছে ঘুড়ি। ভাবছে আজ অনেকদূর যাবে। উড়ে উড়ে দেখবে অনেককিছুই। সুতো ছাড়তেও শুরু করেছে লাটাই। হঠাৎ কি যে হয় লাটাইয়ের। গুটাতে থাকে সুতো। ঘুড়িকে ধীরে ধীরে নিচের দিকে আসতেই হচ্ছিল। প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিল ঘুড়ি। মনের ভিতরে একটা জিদ চেপে গিয়েছিল ঘুড়ির। আর না। সুযোগ পেলেই ভোকাট্টা হয়ে যাবে সে । লাটাইয়ের সমস্ত বাঁধন ছিঁড়ে ও চলে যাবে অনেক অনেক দুরে। মুক্তির সুখে ভেসে বেড়াবে ইচ্ছেমত।

কিন্তু শেষপর্যন্ত নেমে আসতেই হল তাকে লাটাইয়ের কাছে। আর তখন ক্ষোভ সামলাতে না পেরে ঘুড়ি লাটাইকে বলেই ফেলেছিল- তোমার এই বাঁধন আমার আর ভাল লাগে না। যখন ইচ্ছে আমাকে নিয়ে যা খুশি করবে। ভাল্লাগে না আর।
– রাগ করিস নে ঘুড়ি। আমার এ টান তো ভালবাসার।
– ছাই ভালবাসার। আমাকে সবসময় তুমি তোমার অধীনেই রাখতে চাও। সে আমি ভালভাবেই বুঝেছি।
– না রে পাগল না। আমাদের এ সুতো সম্পর্কের। সম্পর্ক ছিন্ন করে ভাল থাকা যায় না।
– ছাড়ো তোমার সম্পর্ক। এমন পরাধীনভাবে আমি আর বাঁচতে চাই না। একদিন ঠিক তোমার সুতো ছিঁড়ে চলে যাব। স্বাধীনতার সুখে গা ভাসাব আকাশে। উড়ে বেড়াব বাতাসে। যেখানে খুশি সেখানে চলে যাব।
– না, অমন কাজ কখনও করিস নে ঘুড়ি। টানহীন বেঁচে থাকা যায় না। সে জীবন বড় বিপদের।

লাটাই সুতো ছাড়তে ছাড়তে ঘুড়িকে বলে – যা, একটু উড়ে আয়। মন ভাল হয়ে যাবে দেখবি ‘খন।

ঘুড়ি কোনো উত্তর দেয় না। ওর মনের ভেতর একটা গোপন অভিসন্ধি দানা বাঁধতে থাকে। আজ যেভাবেই হোক সে ভোকাট্টা হবে।

ঘুড়ি উড়ছে। উড়ছে। উড়ছে—
হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া। আর সাথে সাথে ঘুড়িটি পাশের ঘুড়িটির সুতোয় নিজেকে জড়িয়ে নেয়। হেচকা টান দিয়ে সুতো ছিঁড়ে ফেলে ঘুড়ি। আর সাথেসাথে মুক্তির আনন্দে হো হো করে হেসে ওঠে। চিৎকার করে লাটাইকে বলে- আমি চললাম। তোমার দাসত্ব থেকে আজ আমি মুক্ত। চললাম আমার ইচ্ছেমত —-
লাটাইয়ের বুক একটা অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠল। – যাস নে ঘুড়ি। বিপদে পড়ে যাবি। যাস নে।

কিন্তু কে শোনে কার কথা। ঘুড়ি এখন মুক্তিপাগল। ফুরফুরে তার মন। উড়ছে। শুধু উড়ছে। অসীম যেন তাকে ডাকছে। বন্ধনহীনতার আনন্দদমকায় পাক খেতে খেতে ভাসতে থাকে ঘুড়ি। হা হা হা। কি আনন্দ! কি আনন্দ! এই জীবনই তো সে চেয়ে এসেছে এতদিন ধরে।
উচ্ছল বাতাসের ধাক্কায় ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে ঘুড়ির রঙিন কাগুজে দেহ। তবু ঘুড়ি আপ্রাণ উড়তে চায়।

হঠাৎ দমকা হাওয়ার মত্ততা থেমে যায়। ঘুড়ি আর বাতাসের ভালবাসায় ভর দিয়ে যেন ভেসে থাকে পারছে না। বৈরী হাওয়া তাকে জোর করে ঠেলে দিতে চাইছে নিচের দিকে। শত চেষ্টা করেও ঘুড়ি আর ভেসে থাকতে পারছে না। ছেঁড়া ছেঁড়া দেহের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সমস্ত ভাস-শক্তি।

নিচের দিকে তাকায়। আসন্ন বিপদের আশংকায় কেঁপে ঘুড়ির বুক। দেখে – সে যেখানে পড়তে চলেছে সেখানে অথই কালো জলরাশি। বিশাল বাঁওড়। বড্ড অসহায় বোধ করে ঘুড়ি। ভয়ে বুকের জল যেন শুকিয়ে আসছে তার। এতক্ষণে ঘুড়ি বুঝতে পারে লাটাইয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে সে খুব ভুল করেছে। চিৎকার করে বলে – লাটাই, আমাকে বাঁচাও। আমি বাঁচতে চাই…

লাটাইও বুঝতে পারে তার প্রিয় ঘুড়ির পরিণতী কোনদিকে যেতে চলেছে। কিন্তু কিছুই যে তার করার নেই আর।

– আমি জলে পড়ে যাচ্ছি লাটাই। আমাকে বাঁ..চাও…

নিরুপায় লাটাই কুয়াশাভরা চোখে তাকিয়ে তার ভালবাসার ঘুড়ির দিকে।

হৃদয়পুরের জংশনে

আসছে গাড়ি যাচ্ছে ছাড়ি
একটুখানি থামছে তো-
প্যাসেেঞ্জারে সারে সারে
উঠছে এবং নামছে তো।

নানান পথের জানান দিয়ে
ছুটছে গাড়ি ছুটছে রে-
যার যেটি চাই সেইটিতে ভাই
জলদি গিয়ে উঠছে রে।

সময় তো নাই ব্যস্ত সবাই
ও’ মন তুইও অংশ নে-
আসছে গাড়ি যাচ্ছে ছাড়ি
হৃদয়পুরের জংশনে।

অমিত কুমার বিশ্বাসের উপন্যাস “ঙ বৃত্তান্ত” এর পাঠ-প্রতিক্রিয়া

অমিত কুমার বিশ্বাস-এর “ঙ বৃত্তান্ত ” উপন্যাসের পাঠ-প্রতিক্রিয়া
#শংকর_দেবনাথ

১৪২৫ শারদ সংখ্যা কবিতা আশ্রম পত্রিকায় কাব্যকথাকার অমিত কুমার বিশ্বাস একটি উপন্যাস লিখেছেন। নাম- “ঙ বৃত্তান্ত “।

আমি একজন অতিসাধারণ পাঠক। তাই দু’দুবার পড়তে হলো উপন্যাসটির হৃদয়কে স্পর্শ করার জন্য। তবুও ছুঁতে পারিনি তার অতলান্ত অনুভূতি। তবে পড়ার শুরুতেই আমাকে নামকরণটা ভাবিত করেছে। ব্যতিক্রমী নাম। ঙ বৃত্তান্ত।

ঙ হলো বাংলা বর্ণমালার এমন একটি বর্ণ যা মাত্রাহীন এবং যার উচ্চারণ স্থান হলো নাসিকা মাত্রাহীনতা আসলে মাথার উপরের ছাদহীনতা বা উদ্বাস্তুতা। ঙ নাসিক্যবর্ণ। নাক হলো প্রাণবায়ু নির্গমন বহির্গমন পথ। অর্থাৎ বেঁচে থাকার প্রমাণ। আবার মাত্রাহীনতা বলতে ছন্দ-তালহীনতাও বোঝাতে পারে।

আমার মনে হয় লেখক মাত্রা-লয়হীন বেঁচে থাকা জীবনের বৃত্তান্ত বা কাহিনিচিত্র আঁকতে চেয়েছেন। তাই ৪৮ টি শিরোনামযুক্ত পর্বে সাজানো উপন্যাসটির ভেতরের কাহিনিও মাত্রাহীন। আর কাহিনির শরীরগঠনে যেসব চরিত্র উঠে এসেছে, তারাও ওই মাত্রা-লয়হীন ঙ-এর মত নাসিক্য-ব্যাঞ্জণে প্রকটিত।

বস্তুত “চরে বসে রাধে ঙ/ চোখে তার লাগে ধোঁয়া”- সহজপাঠের এই জীবনসংকট ‘ঙ বৃত্তান্ত’র বিমূর্তসুর। চিরকাল বাস্তুহীন ঙ-রা জীবননদীর চরে যন্ত্রণার আগুনে বাঁচার রসদ জ্বালায় আর বিরুদ্ধ বাতাসে ধোঁয়ারা এসে চোখের জল ঝরায়।

এ উপন্যাস গতানুগতিক উপন্যাসের মত সামঞ্জস্যপুর্ণ কাহিনির বাঁধুনিতে বাঁধা থাকেনি। বাঁধনছেঁড়া জীবনের আকুলতা বারবার গ্রন্থিত হতে হতে গ্রন্থিমোচিত হয়েছে। আর সেই কাহিনির হৃদয়ে বারবার জেগে উঠেছে কবিতার ভালবাসা।

শব্দকে দ্বগ্ধ করতে করতে লেখক শুদ্ধতায় পৌঁছে যান আর নির্মিত হয় এক মগ্নগদ্য। যা পাঠককে একদিকে যেমন টেনে নিয়ে যেতে চায় কবিতার ঘরে, অন্যদিকে রূপক-বিশেষণাশ্রয়ি গদ্যচলন এক ভাব-মায়ালোকের সন্ধান দিতে চায়।

গতানুগতিক উপন্যাস-ভাবনার বিপ্রতীপে উদ্বাস্তু জীবন-কাহিনির সুত্র যেমন ছিন্নতায় সমাকীর্ণ, কাব্যকথাকার অমিত কুমার বিশ্বাসের ‘ঙ বৃত্তান্ত’র কাহিনিসূত্রও তেমনি ছেঁড়াছেঁড়া জীবনের খণ্ডখণ্ড আবেগ-আশা আর স্বপ্নভঙ্গের যাপনচিত্র হয়ে উঠেছে- যা পড়তে পড়তে পাঠক কেবলই দেখতে পাবেন গদ্যের মধ্যে বিমূর্ত কবিতামুর্তি, যে কেবলই হাতছানি দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে চায় এক অনাস্বাদিত রসের ভাবসাগরে। আর মনে হবে -” তৃতীয় নয়ন আগুন ঝরাচ্ছে খুব…”

পুজোর গান

দুর্বাঘাসে শিশির হাসে
আজ শরতের ভোরে।
মা এসেছেন মা এসেছেন
মা এসেছেন ওরে।।

গন্ধ মেখে শিউলিবালা
সাজায় খুশির বরণডালা
পল্লিবালা গাঁথছে মালা
গরদখানি পরে।
মা এসেছেন মা এসেছেন
মা এসেছেন ওরে।।

মেঘবালারা শ্বেত বলাকার
সঙ্গে খেলায় মাতে-
কাশ নাচে রে শুভ্র সাজে
শাপলামেয়ের সাথে।

অল্প হিমের পরশ মেখে
উৎসবেরই হরষ এঁকে
সরস সুরে বেড়ায় ডেকে
বাতাস দোরে দোরে।
মা এসেছেন মা এসেছেন
মা এসেছেন ওরে।।

পানা-পুকুর

– আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
-কেন?
-দম আটকে আটকে আসছে, পানা।

পুকুর পানাকে তার কষ্টের কথা বলছে।

বছর দু’য়েক আগে এক বর্ষার রাতে জলের ধারায় ভাসতে ভাসতে একটা পানা এসেছিল পুকুরে। অসহায়ভাবে আশ্রয় চেয়েছিল।
-পুকুর, তোমার বুকের এক কোণায় আমাকে একটু থাকতে দাও। আমি ঘুরে ঘুরে খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি। আর পারছি না।
পুকুরের তরল হৃদয় বাষ্পায়িত হয়।
-ঠিক আছে। থাক না।
ভালবেসে পানাকে বুকে ঠাঁই দিয়েছিল পুকুর। আদরে-সোহাগে সবুজ সতেজ করেছিল তার দেহ-মন।

পানা নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেয়ে সংসার সাজাতে মেতে ওঠে। বংশ বিস্তার করতে থাকে। ফুল ফোটায়। তাদের বেগুনি হাসিতে পুকুর মুগ্ধ হয়। পাড়ে দাঁড়িয়ে যখন কোনো মানুষ বলে – বাহ্ কি সুন্দর লাগছে পুকুরটাকে। ফুলে ফুলে যেন সেজে আছে । তখন পুকুরটি ভারি আহ্লাদিত হয়। পানাকে ডেকে বলে – তোর ফুলের জন্য আমাকে কত মানুষ প্রশংসা করছে দেখ।
পানা হাসে।
পুকুর আবার বলে- হ্যাঁ রে পানা, তোর ফুলের রঙ তো ভারি সুন্দর। দেখে দু’চোখ ভরে যায়।
পানা সহাস্যে বলে- তোমাকে আনন্দ দিতে পেরে আমি ধন্য।
– তাই? কিন্তু কেন রে ?
-হ্যাঁ গো পুকুর। তুমি যে আমার আশ্রয়দাত্রী। মায়ের মত। তোমার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
পুকুর বিনয়ের সাথে বলে- না না। ওভাবে বলিস না। এটা তো আমার কর্তব্য।
পানা সানন্দে বলে- তোমাকে আমার ফুল আনন্দ দিতে পারছে জেনে আমার কী যে ভাল লাগছে। এছাড়া তোমাকে আর কীই বা আমি দিতে পারি। তোমার অতবড়ো বুকে আমার বংশধরদের নিরাপদ ঠাঁই দিয়েছো। আগলে রেখেছো মায়ের মমতায়। তোমার এ ঋণ শোধ করার কোনো সাধ্য তো আমার নেই। শুধু —
পুকুর পানাকে থামিয়ে বলে- ছাড় ওসব। দেখ তোর ছানাপোনারা কেমন সবুজ হয়ে উঠেছে।
– সে সবই তো তোমার ভালবাসায় আর দয়ায় পুকুর।

রাতে যখন চারপাশ নীরব হয়ে যায় তখন পানা আর পুকুর নানা গল্পে মেতে ওঠে।

এভাবেই ওদের দিন যায়। রাত আসে। সময় গড়াতে থাকে জলের মত। আর পানার ছানাপোনা বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে ছানাদের ছানাপোনা। আর দখল করতে থাকে পুকুরের বিশাল বুকটাকে।

পুকুরের একটু কষ্ট হলেও সব মেনে নেয় সে। কারণ সে-ই তো একদিন ঘর দিয়েছিল পানাকে। বুকের পরে রেখে অাপন করে নিয়েছিল। খুশি হয়েছিল তার একাকীত্বের ফাঁকা বুকে একজন ছোট্ট সাথি পেয়ে। আশ্রয়হীনকে আশ্রয় দিয়ে।

কিন্তু আজ? পুকুরের সারাবুক পানায় পানায় ভর্তি। যেন পাষাণের মত চেপে বসে আছে। এতটুকু ফাঁকা জায়গা নেই তার জলীয় বুকের কোথাও।

পুকুর আগের মত আর আকাশ দেখতে পায় না। রাতে চাঁদের সাথে লুকোচুরি খেলায় মাততে পারে না। বাতাস তার গায়ে হালকা ঢেউয়ের পরশ বোলাতে আসে না। মাছেরা-হাঁসেরা- দামাল ছেলেমেয়েরা হইচই করে সাঁতার কাঁটতে আসে না। তার সমস্ত বুকই যে আজ পানাদের অধিকারে। পুকুরের মাঝেমধ্যে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। ভাবে- পানাকে ঠাঁই দিয়ে কি তবে ভুল করেছে পুকুর?

– আমি আর পারছি না পানা। তুই একটা কিছু কর। আমার বুকের তলটা যে তোদের মরা শেকড়-বাকড়ে ভরাট হয়ে আসছে। আমি দিনদিন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি তো। পানা, তুই একটা কিছু কর। নইলে – ভয়ার্ত হতাশার সুর পুকুরের গলায়।
– কি করি বলো তো?
– শ্বাস নিতে পারছি না। তুই তোর বংশ আর বাড়াস নে পানা।
– সে কি করে হয় পুকুর!
-তোর আশ্রয়দাত্রীকে এভাবে তোর বংশধররা গলা টিপে মেরে ফেলছে দেখেও চুপ থাকবি?

পানা উত্তর দেয় না।