নীল সঞ্চিতা এর সকল পোস্ট

‘ট্রু কলার’ কাহিনি!

ট্রু কলার’ জিনিসটা ইন্টারেস্টিং। মাঝে মাঝে চমৎকার সব নাম আসে। আজ সকালে উবারে কল করলাম। কথা শেষ করে দেখি ট্রু কলারে নাম দেখাচ্ছে “শয়তান ড্রাইভার উবার”। আমিতো নাম দেখে ঢোক গিললাম। মনে পড়ে গেল ফেসবুকে উবার ইউজার গ্রুপে যাত্রী হয়রানির নানা কাহিনি। অফিসে সকাল সকাল মিটিং তাই ক্যান্সেল করে আরেকটার চেষ্টা করব সে সুযোগও নাই। ভাবতে ভাবতেই হাতের কাজ শেষ করছিলাম। এর মাঝেই ‘শয়তান ড্রাইভার উবার কলিং’ লিখে আবার ফোন, সে বাসার নিচে।

আমি গাড়িতে বসেই তাকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করলাম। এক হাতে মেটালের চেইন আরেক হাতে ঘড়ি, বাম হাতের মধ্যমা আর অনামিকায় সোনালী রঙ এর দুইটা বড় আংটি, ডান হাতের মধ্যমাতেও একই আংটি, মেরুন রঙা ফ্রেমের চশমা চোখে সে গাড়ি স্টার্ট দিল অফিসের উদ্দেশ্যে।দেখে একটু ভীতই হলাম। অন্যদিন তো গাড়িতে উঠেই ঘুম দেই কিংবা বই পড়ি। আজ আর কিছুই করলাম না। ড্রাইভারের দিকে নজর রাখতে রাখতেই অফিস পৌঁছালাম। ভেবেছিলাম ট্রিপ শেষে ভাড়ার টাকা ভাংতি দেন বলে খ্যাচ খ্যাচ করবে কিংবা আদেশের সুরে ‘ফাইভ স্টার দিয়ে দিয়েন’ বলবে। কিছুই করল না সে। একটা তটস্থ ভ্রমণ শেষে নেমে আমিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম!

অদ্ভুত ইচ্ছেরা

ভরা পূর্ণিমার রাত, খোলা হাওয়ায় নদীর বুকে ভেসে চলা নৌকায় পানিতে পা ডুবিয়ে মাঝির বৈঠার ছলাত-ছলাত শব্দের মাঝে চোখ বন্ধ করে গুনগুন “ঝড়কে আমি করব মিতে, ডরব না তার ভ্রুকুটি তে।দাও ছেড়ে দাও, ওগো, আমি তুফান পেলে বাঁচি…. !”

ইচ্ছে গুলো বড় অদ্ভুত। ট্যাক্স দিতে হয়ে না বলে এ দুর্বিষহ জ্যামেও চোখ বন্ধ করে ইচ্ছের কথা ভাবা যায়!

নতুন দিনের শুরু…

প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছি। নতুন চাকরি তে যোগদান তাই এই শনিবারের সকালে ছেলেটা যখন ঘুমে কাদা তখন আমি বের হয়ে আসলাম। আমি জানি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমের মধ্যে সে আমাকে খুঁজবে, না পেলে কান্না করতে থাকবে। চাকুরীজীবী মায়েদের জীবনটা কষ্টের। না এগুতে পারে না পিছাতে। এই দোটানার মধ্যে থাকতে থাকতে এরা এক সময় কঠিন মনের অধিকারী হয়ে যায়। না হয়ে উপায়ও নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় এত পড়ালেখা না করলেও পারতাম। কোন রকম দায়বদ্ধতার বাইরে থেকে আরাম করে জীবনটা উপভোগ করতে পারতাম!। কিন্তু এখন দেশের মানুষের টাকায় পড়ালেখা করার পর ঘরে বসে থাকাটাকে রীতিমতো অন্যায় মনে হয়।

সে যাই হোক, ঢাকা শহরের রাস্তার কথাতো বলা যায় না তাই প্রায় ৪৫মিনিট আগে বাসা থেকে বের হলাম। কে জানতো ১৫মিনিট এর মাথায় পৌঁছে যাব। অফিস এর তালা খোলার আগেই দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয়না। তাই পথের পাশে একটা পার্ক পেলাম আর নেমে পড়লাম।ব্যস্ত রাস্তার পাশে পার্কের ভেতর অন্য জগত। আমিই সবচেয়ে অলস বসে আছি এখানে। আমার বয়সী মানুষ খুব একটা নেই।ভাবছি আমার বয়সী মানুষগুলো যখন সকালে আরেকটু আরাম করতে ব্যস্ত তখন মধ্যবয়সী মানুষগুলো কিভাবে নিজের যত্ন নিচ্ছে। অথচ যত্নটা আমার বয়স থেকেই হওয়া উচিত। পাশেই আন্টিরা বিশাম জটলা করে গল্প করছে, আর খাচ্ছে। গল্প শুনে আর খাওয়ার বহর দেখে হাসি আটকে রাখা মুশকিল। হাসবো কি হাসবো না করে হেসেই ফেললাম কারন একটু দূরে দাঁড়ানো আংকেলদের দল হাতে হাত রেখে হো হো করে হেসে উঠছেন কিছুক্ষণ পর পর। সে হাসি আমাকেও সংক্রমণ করেছে। মন খারাপ ভাবটা হালকা করে আবার অফিসের পথে বের হয়ে পড়লাম।

মুভি রিভিউ: প্রাক্তন

‘তুমি যাকে ভালবাসো তার সবটা নিয়ে ভালবাসবে। তার ভালটাকে ভালবাসবে আর খারাপটাকে বাসবে না তাতো হয় না। আমি অতীতটাকে যেমন নেব, বর্তমানকেও নেব, ভবিষ্যতটাকেও ভালবাসবো। আমার কাছে এডজাস্টমেন্ট মানে হেরে যাওয়া নয় দিদিভাই। আমার কাছে এডজাস্টমেন্ট মানে হল সুন্দর করে বাঁচা। তুমি কিছু দাও জীবন তোমাকে দু’গুন করে ফিরিয়ে দেবে।’

পুরো সিনেমার সারমর্ম এই ক’টা লাইন দিয়েই বলা যায়। এক সাথে চলতে চলতে, বাস্তবতা সামনে এসে দাঁড়ালে আমাদের ইগো, আমাদের জেদ, মানিয়ে বা মেনে না নেয়ার মানসিকতা যে বিশুদ্ধ ভালোবাসার মাঝেও ধীরে ধীরে ফাটল ধরায় ‘প্রাক্তন’ সে গল্পই বলে।

২৪ঘন্টার ট্রেন জার্নিতে কথার ফাঁকেফাঁকে দেখা মেলে ফাটল ধরার টুকরো দৃশ্যগুলোর। সে দৃশ্যগুলো অচেনা কিছু নয়। মিলে যাবে আমাদের অনেকের জীবনের সাথে। দেখা যাবে ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও বিয়ের আগের জীবনের সাথে বিয়ের পরের জীবনের এক্সপেক্টেশান গ্যাপ, চাকরিজীবি স্ত্রী এর সামনে উপযুক্ত শিক্ষিত হবার পরও কখনো কখনো স্বামীর হীনমন্যতায় ভোগা, জীবনের কঠিন সময়ে ব্যস্ততার অজুহাতে আপনজনকে কাছে না পাওয়ার হাহাকার – আর্তনাদ আর আস্তে আস্তে দুরত্ব বেড়ে চলার দৃশ্যের।তাই দেখতে গিয়ে কেউ হয়ত আনমনা হয়ে ভাবতে পারে ‘আমাদের সম্পর্কে আমি ঠিক আছি তো! কিংবা আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে কিছুই কি নেই বাকি!’

সুন্দর দাম্পত্যে ভালবাসার সাথে থাকা চাই দু’জনের প্রতি শ্রদ্ধা, চাই ছাড় দেবার মানসিকতা, অপরকে বুঝতে চাওয়া, অন্যের জীবনবোধ সম্পর্কে পরিস্কার ধারনা। ব্যস্ততার মাঝে চাই নিজেদের জন্য আলাদা কিছু সময়, কিছু পরিকল্পনা। কখনো তাই মিটিং ক্যান্সেল করতে হয়, মোবাইল ফোনের সুইচ অফ রাখতে হয়, সব কিছু এড়িয়ে পাশে থাকতে হয়। সব সম্পর্কের যত্ন নিতে হয় তা না হলে একসময় তা ভেঙ্গে পড়ে।

‘বেলাশেষে’র মত অতটা না হলেও সময়টা একেবারে মন্দ কাটেনি ‘প্রাক্তন’ এর সাথে। আর কিছু না হোক নিশ্চিত ভাবে বলা যায় গানগুলো মনে গুনগুন করবে অনেকদিন!

প্রিয় কবিতারা….

গত কিছুদিনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যস্ততা শেষে অবশেষে মিলেছে মুক্তি। অফিস থেকে শুভকামনা সহ বিদায় নিয়ে আসলাম পড়ন্ত বিকালে। আগামী কয়েকদিনের জন্য বেকার জীবন। কত পরিকল্পনা ছিল কয়েকদিনের বেকার জীবন নিয়ে। কিন্তু টিপটিপ বৃষ্টিতে ভিজে ঘরে ফিরতে ফিরতে মনটা উদাস হল। সন্ধ্যার পর দেখলাম আমার কিছু ভাল লাগছে না, অনেক কিছুই করার আছে তবু কিছু যেন করার নেই। উদাস ভাব দূর করতে চা বানালাম সাথে কবিতায় মন দিলাম। জানি এ কবিতা পড়লে মন আরো উদাস হবে তবুও পড়ি। চা টা ভাগ করতে না পারলেও কবিতাতো ভাগ করতেই পারি সবার সাথে। প্রয়াত কবি সৈয়দ শামসুল হক এর ‘পরানের গহীন ভিতর’ আমার খুব প্রিয় একটা সিরিজ। সেখান থেকেই কিছু কবিতা সবার জন্য।

জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,
চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,
মানুষ বেবাক চুপ, হাটবারে সকলে দেখুক
কেমন মোচর দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর।
চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও,
বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পুন্নিমার চান,
নিজেই তাজ্জব তুমি একদিকে যাইবার চাও
অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান।
সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না,
খেলা যে দেখায় তার দ্যাখানের ইচ্ছায় দেখায়,
ডাহুক উড়াইয়া দিয়া তারপর আবার ধরে না,
সোনার মোহর তার পড়ে থাকে পথের ধুলায়।
এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর
যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর।।

– পরানের গহীন ভিতর – ১

আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় ক্যান,
ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়,
ঘরের বিছান নিয়া ক্যান অন্য ধানখ্যাত রোয়?
অথচ বিয়ার আগে আমি তার আছিলাম ধ্যান।
আছিলাম ঘুমের ভিতরে তার য্যান জলপিপি,
বাঁশির লহরে ডোবা পরানের ঘাসের ভিতরে,
এখন শুকনা পাতা উঠানের পরে খেলা করে,
এখন সংসার ভরা ইন্দুরের বড় বড় ঢিপি।
মানুষ এমন ভাবে বদলায়া যায়, ক্যান যায়?
পুন্নিমার চান হয় অমাবস্যা কিভাবে আবার?
সাধের পিনিস ক্যান রঙচটা রদ্দুরে শুকায়?
সিন্দুরমতির মেলা হয় ক্যান বিরান পাথার?
মানুষ এমন তয়, একবার পাইবার পর
নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর।।

– পরানের গহীন ভিতর – ৪

আমারে তলব দিও দ্যাখো যদি দুঃখের কাফন
তোমারে পিন্ধায়া কেউ অন্যখানে যাইবার চায়
মানুষ কি জানে ক্যান মোচড়ায় মানুষের মন,
অহেতুক দুঃখ দিয়া কেউ ক্যান এত সুখ পায়?
নদীরে জীবন কই, সেই নদী জল্লাদের মতো
ক্যান শস্য বাড়িঘর জননীর শিশুরে ডুবায়?
যে তারে পরান কই, সেই ব্যাক্তি পাইকের মতো
আমার উঠানে ক্যান নিলামের ঢোলে বাড়ি দ্যায়?
যে পারে উত্তর দিতে তার খোঁজে দিছি এ জীবন,
দ্যাখা তার পাই নাই, জানা নাই কি এর উত্তর।
জানে কেউ? যে তুমি আমার সুখ, তুমিই কি পারো
আমারে না দুঃখ দিয়া? একবার দেখি না কেমন?
কেমন না যায়া তুমি পারো দেখি অপরের ঘর?-
অপর সন্ধান করে চিরকাল অন্য ঘর কারো।।

-পরানের গহীন ভিতর – ৮

কি কামে মানুষ দ্যাখে মানুষের বুকের ভিতরে
নীল এক আসমান- তার তলে যমুনার ঢল,
যখন সে দেখে তার পরানের গহীন শিকড়ে
এমন কঠিন টান আচানক পড়ে সে চঞ্চল?
কিসের সন্ধান করে মানুষের ভিতরে মানুষ?
এমন কি কথা আছে কারো কাছে না কইলে নাই?
সুখের সকল দানা কি কামে যে হইয়া যায় তুষ?
জানি নাই, বুঝি নাই, যমুনারও বুঝি তল নাই।
তয় কি বৃক্ষের কাছে যামু আমি? তাই যাই তয়?
বনের পশুর কাছে জোড়া জোড়া আছে যে গহীনে?
যা পারে জবাব দিতে, গিয়া দেখি শূণ্য তার পাড়া,
একবার নিয়া আসে আকালের কঠিন সময়,
আবার ভাসায় ঢলে খ্যাতমাঠ শুকনার দিনে,
আমার আন্ধার নিয়া দেয় না সে একটাও তারা।

– পরানের গহীন ভিতর – ১৪

তোমারে যে ভালোবাসে এর থিকা আরো পাঁচগুন
আল্লার কসম আমি দিমু তারে এই জামাখান,
আমার কলম আমি দিমু তারে, শরীলের খুন
দোয়াত ভরায়া দিমু, অনুরোধ খালি একখান-
সে য্যান আমার থিকা আরো ভালো পদ্য লেখে আর
যাদুমন্ত্রে রূপার শিকল হাতে দিতে পারে তার।
তোমারে যে ভালোবাসে এর থিকা আরো দশগুন
আল্লার কসম আমি দিমু তারে এই বাড়িখান,
আমার উঠান আমি দিমু তারে, শীতের আগুন-
নিজেই সাজায়া দিমু, অনুরোধ খালি একখান-
সে য্যান আমার থিকা আরো ভালো নিদ্রা যায় আর
তারেই নিকটে পায় কথা যার নিকটে থাকার।
নচেৎ নষ্টামি জানি, যদি পাছ না ছাড়ে আমার,
গাঙ্গেতে চুবান দিয়া তারে আমি শুকাবো আবার।।

– পরানের গহীন ভিতর – ২৯

চলতি পথের মজা!

ছোট ভাই মিলিটারি ট্রেনিং এ দুর্দান্ত ভাল ফলাফল করেছে তাই জেনে মন ফুরফুরা করে অফিস থেকে বের হয়েছি। ভাবলাম উড়তে উড়তে বাসায় চলে যাই ছেলেটার কাছে। কিন্তু ঝামেলা পাকিয়েছে বিচ্ছিরি জ্যাম। রিক্সায় বসে আছিতো আছিই। এর মাঝে চোখ পড়ল উল্টো দিক থেকে আসা এক রিক্সায়। সেখানে এক জোড়া কপোত কপোতী তাবত দুনিয়াকে উপেক্ষা করে কঠিন আহ্লাদে ব্যস্ত। অন্যদিন হলে চোখ ফিরিয়ে নিতাম কিন্তু যেহেতু আজ আমার মন ফুরফুরা তাই আমি তাকিয়ে থাকলাম মজা দেখার জন্য। তাকিয়ে থাকলাম তো তাকিয়েই থাকলাম। অনেকক্ষণ পর মেয়েটার চোখ পড়ল আমার দিকে। সে চোখ সরিয়ে নিল। কিছুক্ষণ পর আবার তাকাল, তারপর আবার, তারপর আবার। এরপর ছেলেটাও কয়েকবার তাকিয়ে নড়েচড়ে বসল। তারপর কি হল জানিনা তারা দুইজন হঠাৎ করে ভদ্র হয়ে আকাশ বাতাস দেখতে লাগল।
আফসোস, আমারও মজা ফুরালো!!

‘আমি তোমারি নাম গাই’

কিছু গানের মধ্যে অদ্ভুত মাদকতা থাকে। শুরুতে প্রভাব না পড়লেও ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে হয়। ‘আমি তোমারি নাম গাই’ ঠিক সেরকমই একটা গান আমার জন্য। গত দুই সপ্তাহ ধরে এ মাদকতায় আসক্ত আমি। সকালের রোদে রিক্সায় প্রিয় মানুষের পাশে চলতে চলতে যে গুনগুন করছিলাম তা অফিসের বস্‌ এর সামনেও অজান্তে চলে আসছিল। সহজ সাধারণ কথা, সুর এবং অসম্ভব দরদী কন্ঠের এ গান যে কোন ধীর লয়ের গান পছন্দ করা মানুষের ভাল লাগবে নিশ্চিত ভাবে।

আমি তোমারই, তোমারই, তোমারই নাম গাই
আমার নাম গাও তুমি,
আমি আকাশ ও রোদের দেশে ভেসে ভেসে বেড়াই
মেঘের পাহাড়ে চড় তুমি,
আমি তোমারই, তোমারই, তোমারই নাম গাই
আমার নাম গাও তুমি ।।

ভালবাসা করে আশা তোমার অতল জল
শীতল করবে মরুভূমি,
জলে কেন ডাঙ্গায় আমি ডুবতেও রাজি আছি
যদি ভাসিয়ে তোল তুমি,
আমি তোমারই, তোমারই, তোমারই নাম গাই
আমার নাম গাও তুমি ।।

তুমি এসো ফসলের ডাকে বটের ঝুরির ফাকে
আর এসো স্বপ্ন ঘুমে,
এই স্বপ্ন দুচোখ খুলে জেগে দেখা যায়
যদি নয়ন তারায় বসো তুমি,
আমি তোমারই, তোমারই তোমারই নাম গাই
আমার নাম গাও তুমি ।।

কবিতা গেল মিছিলে মিছিল নিয়েছে চিলে
অসহায় জন্মভূমি,
আজ একতারার চিলা তোমার স্পর্শ চায়
যদি টংকার দেও তুমি,
আমি তোমারই, তোমারই, তোমারই নাম গাই
আমার নাম গাও তুমি ।।

পুনশ্চঃ মন আকুল করা এ গানের শিল্পী কালিকা প্রসাদ ভট্টাচার্য গত ৭ মার্চ ২০১৭ এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। যতবার শুনি ততবার মন খারাপ হয়। এ সড়ক আর কত মানুষকে কেড়ে নিবে জানা নাই!

www.youtube.com/watch?v=mAhBg65a5FE

কিসের অপেক্ষায়!

সেই সম্বোধনহীন চিঠি অনেকদিন পর আজ আবার লিখতে বসলাম তোমাকে। অসময়ের হঠাৎ বৃষ্টির এই সকালে টেবিলে ছড়িয়ে থাকা কাগজ কলমে চোখ পড়তেই মনে হল তোমাকে লিখি।

চারদিকে কেমন উদাস হাওয়ার ছুটাছুটি। ইট কাঠের শহরের উঁচু দালানের ফাঁকে দেখতে পাওয়া এক চিলতে আকাশের গায়ে কালো মেঘেদের উড়াউড়ি। তাকিয়ে থাকতে গিয়ে গুনগুন করি…

“মেঘ পিয়নের ব্যাগের ভেতর মন খারাপের দিস্তা
মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়, ব্যাকুল হলে তিস্তা।”

মন খারাপ ভাব দূর করার জন্য কফি বানিয়ে আনলাম আর তোমাকে লিখতে বসলাম তাতে চুমুক দেয়ার ফাঁকে। তুমিতো জানোই তোমাকে লেখার সময়টুকু কতটা উপভোগ করি আমি।

চারপাশটা বড্ড অদ্ভুত লাগে, জানো? এই যে দেখ আমার বারান্দায় টবের গাছের নতুন গজানো পাতাগুলো এই অপ্রত্যাশিত বৃষ্টিতে ভিজে কেমন আনন্দে ঝলমল করছে। অথচ ঠিক তার উপরে কার্নিশে বসা একটা আধভেজা চড়ুইপাখি জড়সড় হয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় আছে। একটা রোদ ঝলমল দিনের অপেক্ষায় আছে।

“মেঘের দেশে রোদের বাড়ী পাহাড় কিনারায়
যদি মেঘ পিয়নের ডাকে সেই ছায়ার হদিস থাকে
রোদের ফালি তাকিয়ে থাকে আকুল আকাঙ্খায়
কবে মেঘের পিঠে আসবে খবর বাড়ীর বারান্দায়, ছোট্ট বাগানটায়।”

আমি কিসের অপেক্ষায় আছি বলতে পারো?

ভাল থেক।

নীল…

স্বপ্নকথা…

গিয়েছিলাম পড়ন্ত বিকালে ব্যস্তমুখর এক রেল স্টেশানে। মনে নেই কোথায় যাওয়ার কথা ছিল, সাথে কে ছিল । শুধু মনে আছে ঘরে ফেরা কিংবা ঘর ছেড়ে যাওয়া ব্যস্ত সব মুখের ভীড়ে হঠাৎ করে আমি উস্কখুস্ক চুলের উদাস মানুষটাকে দেখেছিলাম। আর দেখে মনে হয়েছে এ আমার অনেক দিনের চেনা। যদিও তাকে চেনার কোন কারন ছিল না। তবুও তার দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে এই সেই যে আমার বেহালার সুর পছন্দ জেনে আমাকে বেহালা বাজিয়ে শোনানোর কথা দিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। এ মানুষটাই সে মানুষ যার লেখা গান পড়ে আমি বহুদিন নিজ মনে গুনগুন করে বলেছি – “ও গানওয়ালা, আরেকটা গান গাও। আমার আর কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করার নেই…।” কিন্তু তাকে বলা হয়নি কখনো।

তাকে চেনার কথা না থাকলেও সে আমার বিস্ময়ে ভরা অচেনা দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে কাছে এসে পরিচিত কন্ঠে বলেছিল, “আমার যে তারাগুলো তোমার কাছে, ওরা ভালো আছে?”

কি জবাব দিয়েছিলাম মনে নেই। তাকিয়ে দেখি বই হাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, যার রেশ ধরে এ অদ্ভুত স্বপ্ন। খোলা দরজা দিয়ে আসা শেষ বিকালের উত্তরের বাতাসে এখনো শীতের রেশ। ঘুম ভাংগা চোখে চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে পাশ ফিরে সাদা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে অকারনে কবিতা মনে পড়ে…

“আমি ভালো আছি অথবা ভালো নেই !
হলুদ সবুজ সব স্বপ্ন গুলোকে বিক্রি করে একটা স্ব্প্ন উপহার হিসেবে দিয়েছিলাম ,
লাল মিহি এক একটা অনুভূতির নিরেট বুনন।
প্রচুর ক্ষত উপক্ষত উপেক্ষা সহ ;
ফেরত এসেছে আজ দুপুরের ডাকবাক্সে।
কি অসহ্য ফ্যাকাশে তার রঙ !
আমি ভালো আছি অথবা ভালো নেই অভ্রনীল।
পরিচিত নাম ছিঁড়েখুঁড়ে গেছে ঘরোয়া ছেলেটা।
আমার চশমার বাস্প কাঁচে এখন শুধুই জলের দাগ।
তুমি কি এখনও স্বপ্ন বেচো ?
লাল তুবড়ি অথবা মোম মোম রোদ্দুর ?
তোমার আস্তিনে এখনও কি লেগে থাকে, গোধূলির ডোরাকাটা রঙ ?” – রুদ্র গোস্বামী

আয়েশা ফয়েজ এর ‘শেষ চিঠি’

‘আমার এত আদরের বাচ্চাটি আমাকে ছেড়ে তুমি কোথায় গেলে? বাবা, তোমার কি একবারও মনে হয় নাই যে তোমার একটা দুঃখী মা আছে …।’
ঠিক এভাবেই শুরু এক মায়ের আত্মকথনের। যদিও লেখাটা ছেলেকে উদ্দেশ্য করে এক মমতাময়ী মা এর চিঠি কিন্তু মৃত ছেলেকে লেখা এই চিঠিকে আমি আত্মকথনই বলবো। সবার প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ এর মা আয়েশা ফয়েজ এর লেখা শেষ চিঠি। মূহুর্তে মনকে আর্দ্র করে ফেলবে এই লেখা। অনেক জায়গায় চোখ ছলছল করে উঠবে আপনার, নিশ্চুপ হয়ে একজন মা এর কষ্ট, হাহাকার, অস্থিরতা, যন্ত্রনা, একাকীত্বকে উপলব্ধি করতে চাইবেন আপনি। ভাববেন এত ভালোবাসা, এত মায়া বুকে চাপা দিয়ে একজন মানুষ কিভাবে বেঁচে ছিল।

ছাই রঙ্গের ঝাপসা পাতার উপর হলুদ খামের ছবি আঁকা প্রচ্ছদের বইটার ভেতর জুড়ে শুধু স্মৃতি কাতরতা। সবচেয়ে ক্ষ্যাপাটে, বুদ্ধিমান, গুণবান, সৌভাগ্যবান সন্তান যখন বৃদ্ধ মাকে রেখে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় তখন সে মা এর কাছে তার জীবনকে মনে হয় শাস্তি, পৃথিবীকে মনে হয় নিষ্ঠুর আর মা হিসেবে নিজেকে মনে হয় ব্যর্থ। তাইতো তিনি বারবার বলেছেন, ‘আমি মনে হয় সত্যিকারের মা হয়ে উঠতে পারিনি, তাই আমার দোয়া কাজে লাগেনি, ‘আমার জীবনটা এত জটিল কেন? এই জীবন নিয়ে আমাকে আর কতকাল বেঁচে থাকতে হবে?

বইটা শেষ হয়েছে ঠিক এভাবে –
‘এখন আমি লিখতে বসেছি। লিখে যাচ্ছি, শুধু তোমাকে লিখে যাচ্ছি। আহারে! যদি এটা সত্যি হতো আসলেই তোমাকে আমি লিখতে পারতাম, তাহলে এই পৃথিবীতে আমার তো এর চাইতে বড় কিছু চাওয়ার ছিল না। আহা! কেন এটা সত্যি হয় না?
বেঁচে থাকা বড় কষ্ট বাবা। বড় কষ্ট।‘

পড়া শেষ করে মনে হবে এভাবে বেঁচে থাকা বড় কষ্টের। একজন মা তার সমস্তটুকু দিয়ে তাঁর সন্তানকে বড় করে, এই দুঃসহনীয় কষ্ট তাঁর প্রাপ্য হতে পারেনা। কোন মা যেন এ কষ্টের মধ্যে দিয়ে না যায়। এবারের বইমেলায় কেনা বইগুলোর মধ্যে ‘তাম্রলিপি’ থেকে বের হওয়া এই বইটা সবার আগে হাতে নিয়েছিলাম পড়তে।একটা হাহাকার নিয়ে বইটা শেষ করতে গিয়ে নিচের লাইনগুলো মনে পড়ে গেল –

“আমার প্রাণের ‘পরে চলে গেল কে
বসন্তের বাতাসটুকুর মতো…
সে চলে গেল, বলে গেল না
সে কোথায় গেল ফিরে এল না
সে যেতে যেতে চেয়ে গেল, কী যেন গেয়ে গেল
তাই আপন-মনে বসে আছি কুসুমবনেতে”

sesh-chitthi

দিনপঞ্জি…

প্রতিদিন একই ব্যস্ততা আর ভাল লাগছিল না বলেই ঝিম মেরে পড়ে থাকার জন্য আজ বাসায়। কিন্তু বাইরের গনগনে রোদের তেজ ঘরে এসেও ঝিম মেরে থাকতে দিচ্ছেনা। তাই গুটগুট করে ঘরময় ঘুরছি আর ভাবছি, হাতে এক গ্লাস ঠান্ডা লেবু পানি। ভাবছিলাম ‘চিঠি’ নিয়ে। ‘সবিনয় নিবেদন’ শেষ করে চিঠি নিয়েই ভাবছি, পড়ছি। নিজের চিঠির বাক্সটা হাতের কাছে না থাকায় অন্যদের গুলোতেই ঘুরে বেড়াচ্ছি, মনেমনে নেড়েচেড়ে নিচ্ছি। কিছু আগে আবার পড়লাম ‘বুদ্ধদেব গুহ’র এই চিঠিটা। ভাবছি পুরো বইটাই আবার শুরু করে দিব :-)

“কুর্চি,

তোমার চিঠি হঠাৎ এই শীতের সকালে এক রাশ উষ্ণতা বয়ে আনলো। পাতা ঝরে যাচ্ছে সামনের শালবনে। বিবাগী হচ্ছে ভোগী। রিক্ততার দিন আসছে সামনে। এরই মধ্যে তোমার চিঠি যৌবনের দুতীর মতো; এলো এক ঝাঁক টিয়ার উল্লাসী সমবেত সবুজ চিৎকারের মতো। দুর্বোধ্য আপাত। কর্কশ শব্দমঞ্জরীও কী দারুন মুগ্ধতা বয়ে আনে কখনো কখনো, কী দারুন ভাবে সঞ্জীবিত করতে পারে অন্যকে।
তাই নয়?
তার মানে এই নয় যে- তোমার চিঠি দুর্বোধ্য। উপমার খুঁত ক্ষমা করে দিও।
কেমন আছ তুমি? জানতে চাইলেও জানতে পাই কই?

সকাল থেকেই তোমাকে আজ খুব সুন্দর একটা চিঠি লিখতে ইচ্ছে করছিল। ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই তোমার কথা মনে পড়ছিল খুবই। আজকে ঘুম ভাঙ্গলো বড় এক চমকে। এক জোড়া পাখির ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। যে পাখিদের ডাক বড় একটা শুনিনি এদিকে। কম্বল ছেড়ে দৌড়ে বাইরে গিয়ে দেখি- এক জোড়া স্কারলেট মিনি-ভেট এসে বসেছে আম গাছের মাথায়। আমার ঘুম ভাঙ্গা নিয়ে পাখিরা। আহা! রোজই যদি আসতো। আর তারপরই তোমার এই চিঠি। দিন আজকে ভালো যাবে আমার।
বলছিলাম যে, সকাল থেকেই তোমাকে সুন্দর একটি চিঠি লিখবো ভাবছিলাম। কিন্তু সুন্দর সুখের যা কিছু ইচ্ছা তা দমন করার মধ্যেও বোধহয় এক ধরনের গভীরতর সুখ নিহীত থাকে। থাকে না?

আজ চিঠি লিখবোনা তোমাকে। তার বদলে একটি স্বপ্নহার পাঠাচ্ছি, লেখক কবি না। তবুও তার নাম গোপন থাক। কল্পনা করেই খুব লাগছে যে, তুমি আমার চিঠি কোলে নিয়ে বসে আছ, জানালার পাশে। যে মানুষটি তোমার মিষ্টি-গন্ধ কোলের গন্ধ পায়নি কখনও, পাবেও না কোনদিন, তার চিঠি সেই পরশে গর্বিত হয়ে উঠেছে যে, এই ভেবেই কত সুখ।

কি যে দেখেছিলাম তোমার ঐ মুখটিতে কুর্চি। এত যুগ ধরে কত মুখইতো দেখলো এই পোড়া চোখ দু’টি। কিন্তু, কিন্তু এমন করে আর কোনো মুখ’এইতো আমার সর্বস্বকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করেনি। ভালো না বাসলেই ছিল ভালো। বড় কষ্টগো ভালোবাসায়। ভালো তো কাউকে পরিকল্পনা করে বাসা যায় না। ভালোবাসা হয়ে যায়, ঘটে যায়। এই ঘটনার ঘটার অনেক আগের থেকেই মনের মধ্যে প্রেম পোকা কুরতে থাকে। তারপর হঠাত’ই এক সকালে এই দুঃখ সুখের ব্যাধি দূরারোগ্য ক্যান্সারের মতই ধরা পড়ে। তখন আর কিছুই করার থাকে না। অমোঘ পরিণতির জন্যে অশেষ যন্ত্রনার সংগে শুধু নীরব অপেক্ষা তখন।

কেউই যেনো কাউকে ভালো না বাসে। জীবনের সব প্রাপ্তিকে এ যে অপ্রাপ্তিতেই গড়িয়ে দেয়। তার সব কিছুই হঠাৎ মূল্যহীন হয়ে পরে। যাকে ভালবাসে তাকে নইলে তার আমিত্বই অনস্তিত্বে পৌঁছায়। হুঁশ থাকলে এমন মুর্খামি কেউ কি করে? বল? সেই জন্যই বোধহয় হুঁশিয়ারি মানুষদের কপালে ভালবাসা জোটে না। যারা হারাবার ভয় করে না কিছুতেই, একমাত্র তারাই ভালবেসে সব হারাতে পারে। অথবা, অন্য দিক দিয়ে দেখলে মনে হয়, যা-কিছুই সে পেয়েছিল বা তার ছিল; সেই সমস্ত কিছুকেই অর্থবাহী করে তোলে ভালবাসা। যে ভালবাসেনি, তার জীবনও বৃথা!
তবুও… বড় কষ্ট ভালবাসায়!

কুর্চি দেখি কি করতে পারি তোমাদের সাথে বেড়াতে যাবার। ইচ্ছে তো কত কিছুই করে। এই জীবনে ক’টি ইচ্ছে পূর্ণ হলো বলো? কারই’বা হয়? এমনিতে আমার অনেক কষ্ট। এমন করে ডাক পাঠিয়ে আর কষ্ট বাড়িওনা। একা একা মজা করতেও বিবেকে লাগে। যার বিবেক বেঁচে থাকে, তার সুখ মরে যায়। সুখী হবার সহজ উপায় বিবেকহীন হওয়া। বিবেক বিবশ হলেই বাঁচি।
ভালো থেকো,

তোমার পৃথু দা”