বিভাগের আর্কাইভঃ ভ্রমণ

উই উইল ওভারকাম সাম ডে….

লাগেজ গুটিয়ে বের হতে হচ্ছে। স্যুটকেসটা রেখে যাবো হোটেলের লবিতে। কথা দিয়েছে ফিরে না আসা পর্যন্ত ওরা আগলে রাখবে। দামাস্কাস গেইট হতে রামাল্লার বাস ধরবো। এবং প্রবেশ করবো প্যালেষ্টাইনের মূল ভুখণ্ডে। এক ঘণ্টার বাস জার্নি। চেক পয়েন্ট পার হতেই যত ঝামেলা। অবশ্য একজন মার্কিন নাগরিক হিসাবে তেমন কোন অসুবিধা আশা করছিনা।

পশ্চিম তীরের রামাল্লা, জেরিকো অথবা বেথেলহেমে না ঢুকলে গোটা ইসরাইয়েল সফরটাই অসম্পূর্ণ থেকে যেতো। আলোর নীচেই অন্ধকারের বাস, আমাদের ইউনিভার্সটা নিজের কক্ষপথে আপন নিয়মেই আবর্তিত হয়। মেনে চলেই বরণ করে নেয় এ বাস্তবতা। কিন্তু প্যালেষ্টাইনিদের ভাগ্য তাদের নিজেদের বরণ করতে হয়েনি, বরং জাতিসংঘ নামক ঠুঁটো জগন্নাথ ও পশ্চিমা দুনিয়ার বন্দুকের নল তা চাপিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হিটলারের হাতে নির্যাতিত ইহুদিদের সেইফ হ্যাভেন হিসাবে প্যালেষ্টাইনকে বেছে নিয়েছিল ইঙ্গ-মার্কিন সরকার। অযুহাত হিসাবে দাঁড় করিয়েছিল ধর্মীয় উপকথা। কোন এক রৌদ্রজ্বল সকালে ফিলিস্তিনিদের ঘুম ভাঙ্গে আঙ্গিনায় অচেনা মানুষের ভীড়ে। সেই যে শুরু তা আর শেষ হয়নি। কালের চক্রে বদলে গেছে অবাক হওয়ার পালা। এখন ইউরোপীয় উদ্বাস্তূরা অবাক হয়ে তাদের আঙ্গিনায় ফিলিস্তিনিদের দেখে। দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় কুকুরের মত।

আবু আল নাসেরের সাথে পরিচয় রামাল্লার বাসস্ট্যান্ডে। জেরুজালেম হতে ছেড়ে আসা বাসটা থেমেছে কেবল। সাথের ব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। কোথা হতে শুরু করা যায় ভাবছি। অচেনা জায়গায় এর আগেও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। কোথাও থমকে যাইনি। তালিকার প্রথমেই ছিল চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাতের কবর ও যাদুঘর। তারপর বর্তমান প্যালেষ্টাইন সরকারের হেডকোয়ার্টার। আবু নাসের এমন একজনের সন্ধানেই রাস্তায় ঘুর ঘুর করছিল। স্থায়ী পেশা বলতে কিছু নেই। যখন যা পায় তাই আকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে। ট্যুরিষ্টদের গাইড হিসাবে কাজ করাও তার পেশা্র অংশ। চালানোর মত ৫/৬টা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে। ইংরেজি তার অন্যতম। আমার সামনেই স্প্যানিশ, ইতালিয়ান ও রুশ ভাষায় অনেকের সাথে কথা বললো। ইমপ্রেসড না হয়ে উপায় নেই। প্রস্তাবটা নিজেই দিল; পাঁয়ে হেটে রামাল্লা শহর দেখ। দরাদরি শেষে ৮০ সেকল (ইসরায়েলী মুদ্রা) ঠিক হল। এছাড়া ভাল কোন উপায় ছিলনা শহরটা দেখার। চেয়ারম্যান আরাফাতের কবরস্থান শেষ করে মাহমুদ আব্বাসের অফিসে অপেক্ষা করছি। ধীরে ধীরে মুখ খুলতে শুরু করল নাসের।

থাকে উদ্বাস্তু শিবিরে। ৬ ছেলেমেয়ে। স্ত্রী কঠিন রোগে আক্রান্ত। ভাল চিকিৎসা দূরে থাক, টেবিলে তিন বেলা খাবার যোগাতে তার কষ্ট হয়। আয়-রোজগার বলতে যা হয় তার অর্ধেকটাই চলে যায় স্ত্রীর চিকিৎসায়। প্রতিবেশী দেশ মিশর হতে গোপনে স্মাগল করে আনতে হয় তার ঔষধ। অথচ প্যালেষ্টাইনকে আলাদা করার দেয়াল উঠানোর আগে ভালই কাটছিল তার জীবন। কাজের সন্ধানে প্রায়ই চলে যেত জেরুজালেম, তেল আবিব অথবা হাইফায়। ওসব জায়গায় কাজের অভাব নেই। দেয়াল সম্পূর্ণ হওয়ার পর তার মত হাজার হাজার ফিলস্তিনির জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। অনোন্যপায় হয়ে একরাতে দেয়াল টপকে ওপারে চলে যায়। এভাবে নিয়মিত টপকাতে থাকে। যদিও জানা ছিল ধরা পরলে নির্ঘাত জেল। এবং একদিন ধরা পরে। ইসিরায়েলি সৈন্যদের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। কোন রকমে পালিয়ে জান বাঁচায়। কিন্তু তা বেশি দিনের জন্যে না।

এক রাতে সৈন্যদের বুটের আঘাতে এলোমেলো হয়ে যায় তার দরজা। পালানোর সব রাস্তা বন্ধ করেই ওরা অপারেশনে নেমেছে। গ্রেফতারে বাধা দেয়নি আবু নাসের। তার মতে এমন কোন ফিলিস্তিনি পুরুষ নেই যে জেল খাটেনি। তাদের বয়সের পুরুষদের জন্যে অনেকটা বাধ্যতামূলক এ জেলটার্ম। ওরা জানে এটাই তাদের ভাগ্য।

জেলখানায় হার্ট এট্যাকের কারণে মুক্তি দেয় আবু নাসেরকে। একজন ফিলিস্তিনির চিকিৎসা মানে সরকারের অতিরিক্ত খরচ। তাই কোন এক সুন্দর সকালে দেয়ালের ওপারে এনে লাথি মেরে ফেলে দেয় ট্রাক হতে। বন্ধ হয়ে যায় তার আয় রোজগারের সব পথ। যেহেতু পুলিশের খাতায় নাম উঠে গেছে তাই বৈধভাবে ইসরায়েলে প্রবেশ করার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে তার জন্যে।

দৃশ্যত কোন কাজই নেই আবু নাসেরের মত লাখ লাখ ফিলিস্তিনিদের জন্যে। ওরা দরিদ্র হতে স্থায়ী দারিদ্রের খাতায় নাম লেখায়। একবেলা খেলে দু’বেলা ঊপোস করে। নিজের বাড়িঘর ত্যাগ করে নাম লেখায় উদ্বাস্তূ শিবিরে। মাহমুদ আব্বাসের সাথে দেখা করার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আবু নাসের আমাকে নিয়ে যায় তার নিজস্ব শিবিরে। প্রায় কান্নাভেজা চোখে ঠোঁট কামড়ে বলল, – দেখে যাও মানুষ নামের কিছু সবজি।

রিফিউজি ক্যাম্প মানেই অস্থায়ী কোন তাবু নয়। দেখতে স্বাভাবিক দালান-কোঠার মত। কিন্তু রানিং ওয়াটার বলতে কিছু নেই, বিদ্যুৎ আসে আর যায়। বাড়িঘর শ্রীহীন, দারিদ্রের ছোঁয়া সব জায়গায়। আবু নাসেরের একটাই ক্ষোভ, আমার নিজঘরে আজ আমি উদ্বাস্তু। একজন অর্থডক্স ইহুদির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে রাগে ক্ষোভে বলে ফেলল, – এই ভিনদেশী দখলদাররা এখন আমার অন্নদাতা। তাদের দয়া দাক্ষিণ্যের উপর বেঁচে থাকি আমরা। অথচ পাহাড়ের উপর যে অলিভ গাছগুলো দেখছো একসময় আমাদের ছিল।

রামাল্লার পর জেরিকো নামের একটা শহরের দিকে রওয়ানা দেই আমরা। বাস বসে চারদিক দেখাচ্ছে আমাকে। পাহাড়ের চূড়ায় অনেকগুলো বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে যা ফিলিস্তিনিদের বাড়ি-ঘরের সাথে কেমন যেন বেমানান। আবু নাসের হর হর করে বলে গেল ঐ বাড়িঘরের ইতিহাস। ওগুলোই নাকি গুই সাপের মত দখল করছে ইহুদিরা। ওরা সুঁই হয়ে ঢুকে ফিলিস্তিনিদের এলাকায় এবং কিছুদিনের মধ্যে পরিণত হয় বিশাল এক সাপে। কোন এক সুন্দর সকালে ফিলিস্তিনিদের ঘুম ভাঙ্গে কাছের ভূমিতে নতুন কিছু মানুষের পদচারণায়। ওরা বুঝতে পারে নতুন কোন বসতভুমি স্থাপন করতে যাচ্ছে স্যাটেলাররা। প্রথমে তাঁবুর মত কিছু একটা খাটায়, অথবা নিয়ে আসে নড়বড়ে একটা কনস্ট্রাকশন ট্রেইলার। জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়, আমরা ভূমির জরীপ করতে এসেছি। খণিজ পদার্থ লুকিয়ে আছে এখানে। তারই সন্ধান করবো। ফিলিস্তিনিরা জানে এ মিথ্যে।

কিছুদিন পর শুরু হয় নির্মাণ কাজ। তা বাড়তে বাড়তে রূপ নেয় মেগা প্রজেক্টে। ওরা আসে পূর্ব ইউরোপের রাশিয়া, ইউক্রেইন, রুমানিয়ার মত দেশ হতে। আচার ব্যবহারে একেবারেই কুৎসিত এবং দু’দিন না যেতে ওখানে হাজির হয় বেদুইনরা। বেদুইনরা নাকি ইসিরায়েলিদের বিশ্বস্ত বডিগার্ড। আপন মা-বাবা, ভাই-বোনদের চাইতেও নাকি এরা বেশী বিশ্বস্ত। পশ্চিম তীরের গেরিলা বাহিনীর যে সব সদস্যদের মোসাদ বাহিনী রাতের অন্ধকারে হত্যা করে তার পেছনেও নাকি থাকে বেদুইনদের হাত। অনেকটা বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, – তোমাদের রেজিসটেন্ট পাওয়ার কি তাহলে মরে গেছে? কোথাও কোন প্রতিবাদ প্রতিরোধ দেখছিনা! আবু নাসের চোখ মুখ লাল হয়ে গেল। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে শুরু করল অনেকটা বিষাক্ত সাপের মত। আমি বললাম, ছোট ছোটে শিশুদের বুকে আত্মঘাতী বোমা বেধে তোমরা যা করেছ তাতে পশ্চিম দুনিয়ার সমর্থন হারিয়েছ। তাদের মত আমিও এ হত্যার সমর্থক নই। কিছুটা সময় নিয়ে উত্তর দিল আবু নাসের।

প্রতিটা ফিলিস্তিনি পরিবারে এখন হতাশা। এক কথায় নিজদেশে বন্দী। ঘরে ঘরে অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, আর ভবিষৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা, না পাওয়ার হাহাকার। এ সুযোগটাই নাকি নেয় সৌদি আরবের ধনী শেখরা। অর্থ আসে মিশর সীমান্ত দিয়ে। প্রতিটা আত্মঘাতী শিশুর জন্যে বরাদ্দ থাকে পাঁচ হাজার ডলার। স্বপ্নহীন অনেক শিশু পরিবারের কথা ভেবে যোগ দেয় সৌদিদের এ মিশনে। ওরা মরে গিয়ে নিশ্চিত করে পরিবারের বেঁচে থাকা। আবু নাসেরের মতে, এ মুহূর্তে তাদের মুল সমস্যা ইসরায়েলিরা না, বরং সৌদি ও আমিরাতী ধনকুবের দল। ওরা আমুদ আহলাদের বিপদজনক খেলা খেলতে আসে প্যালেষ্টাইনের মাটিতে। ইচ্ছা করে বাতাস ভারী করে তোলে। সুযোগ করে দেয় ইসরায়েলিদের এখানে ঢুকার। অস্থির করে ফেলে তেলের বাজার। ওখান হতে কামিয়ে নেয় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। আবু নাসেরের মতে শেখরা এখন আর আরব সাগর পাড়ি দিয়ে ভারতে যায়না নিজেদের যৌনলিপ্সা চরিতার্থ করতে। ওদের বর্তমান টার্গেট ইসরায়েলের তেল আবিব ও হাইফা শহর। রুশ মহিলারা এখন তাদের প্লেটের খাবার। অনেকে এসে রুশ পতিতাদের মাথায় ডলারের বৃষ্টি নামায়।

আবু নাসের গড় গড় করে বলে গেল সৌদি আরবে বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর অনেক দেশের গৃহকর্মীদের কথা। বাড়ির কর্তা তার ভাই, বাবা, চাচা এমনকি আপন সন্তান নিয়ে নাকি ভোগ করে এসব গরীব মহিলাদের। মনুষ্যত্বের ন্যূন্যতম লেশ মাত্র দেখায় না। সৌদি আর আমিরাতীদের কাছ জীবন মানেই অর্থ, নারী আর মদ।

বেথেলহেম পর্যন্ত আসতে সূর্য ডোবা শুরু হয়ে গেল। জেরিকোর ৫০ ডিগ্রী তাপমাত্রায় ৫ কিলোমিটার হাঁটায় আমি ছিলাম ক্লান্ত। কিন্তু শেষ বিকেলে বেথেলহেমের মৃদুমন্দ ঠাণ্ডা বাতাস দূর করে দিল সে ক্লান্তি। আমাকে জেরুজালেমগামী বাসে উঠিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে রইল যে পর্যন্ত না বাসটা ছেড়ে যায়। খোলা জানালার সামনে এসে আবারও কথা বলতে শুরু করল… ব্রাদার, আমাদের প্রতিটা শিশু পর্যন্ত বিশ্বাস করে we’ll overcome someday… আমাদের মত তোমরাও বিশ্বাস রেখ এ অন্যায় একদিন দুর হবে… আমরা স্বাধীন হব… তোমার মত আমিও দেয়াল পেরিয়ে জেরুজালেমের ওপারে যেতে পারবো। সেদিন আবার ফিরে এসো এ পবিত্র মাটিতে… আমরা অলিভ ব্রাঞ্চ দিয়ে তোমাকে বরণ করে নেব।

ছেড়ে দিল বাসটা। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। শেষ বাঁকটায় এসে লক্ষ্য করলাম তখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে আবু নাসের।

ব্রেকফাস্ট ইন জেরুজালেম, ইসরায়েল

ব্রেকফাস্ট ইন জেরুজালেম।
কেবল জেরুজালেম কেন, গোটা ইসরায়েলই জীবনযাত্রা খুব কস্টলি। এখানে আসার আগে অনলাইনে হোটেল খুঁজতে গিয়ে তার ধারণা পেয়েছি। একটু ভাল হোটেলে থাকতে গেলে দৈনিক ১৫০ হতে ২০০ ডলার পে করতে হয়। অবশ্য অনেক হোস্টেল আছে নাম মাত্র মূল্যে। কিন্তু আমার মত প্রথমবার ঘুরতে আসা পর্যটকদের জন্যে ওগুলো নিরাপদ নয়। তবে এখন পর্যন্ত এমন কাউকে দেখিনি বা মোকাবেলা করিনি যার দরুন এ দেশে চলাফেরায় নিরাপত্তা নিয়ে অভিযোগ করা যাবে। বিশেষকরে পশ্চিম তীরের আরব প্যালেষ্টাইনিরা খুবই ফ্রেন্ডলি। পথ খুঁজতে তাদের সাহায্য চাইলে কেবল দু’হাত না, বরং বুক বাড়িয়ে এগিয়ে আসে।

ব্রেকফাস্টের জন্য গতকাল দামাস্ক গেইট পেরিয়ে জেরুজালেমের ওপাশে গিয়েছিলাম। রাতে কিছু খাইনি। পেটের তাগাদাটা ছিল অনেকটা অ্যাম্বুলেন্সের জরুরি সিগন্যালের মত। চত্বরের গোড়াতেই মিলল হোটেলটা। দেখতে অনেকটা মগবাজার মোড়ের ব্যস্ত হোটেলের মত। ঘড়িতে ঠিক কটা বাজে তা নির্ধারণ করার উপায় ছিলনা। আমার স্মার্ট ফোনে তখনও নিউ মেক্সিকোর টাইম। মেনু আরবী ও হিব্রু ভাষায়। বুঝার উপায় নেই। তেল আবিবের মত এখানেও মেনুর ছবির সাহায্য নিলাম। ডিমের অমলেটের সাথে লবনাক্ত শসা ও জলপাই। সাথে তাদের ট্রাডিশনাল রুটি। এ পর্যন্ত এ রুটি খাওয়ার প্রক্রিয়া আবিস্কার করতে পারিনি। তবে তা করার ইচ্ছাটা তব সময়ই ছিল। পাশের টেবিলে একটা আরব পরিবার প্রায় একই রকম খাবার নিয়ে খেতে শুরু করল। চোখটা ওদিকেই খোলা রাখলাম। রহস্যটা আবিস্কার করতে সময় লাগল না। রুটির ভেতরটা খোলা। এবং শসা ও জলপাইয়ের ওখানে ঢুকিয়ে অনেকটা স্যান্ডউইচ বানিয়ে খেতে হয়। এবং রুটির কোন লিমিট নেই। যত খাওয়া যায়!

সকালের কফিটা খাওয়া হয়নি। তাই ওয়েটারকে প্রথমে কফিটা দিতে অনুরোধ করলাম। কিন্তু তা সে করতে গেলনা। অনেকটা শুনেও না শোনার ভান করে পাশ কাটিয়ে গেল। সময় মত নাস্তা এলো। ডিমের ওমলেট। খেতে বেশ সুস্বাদু। খাবার অপচয়ের অভ্যাসটা আরবদের বোধহয় জন্মগত। একজনের পক্ষে সকালের নাস্তা এতটা খাওয়া কি করে সম্ভব তার অংক মেলাতে পারলাম না। খাবার শেষের দিকে কফি দিয়ে গেল। প্রথম চুমুকে মুখ বিকৃত করে টেবিলের নীচে লুকানোর চেষ্টা করলাম। মানুষের পক্ষে এ ধরণের কফি খাওয়া সম্ভব বুঝতে পারলাম না। মনে হল এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ সহ হরেক রকম হার্ব রীতিমত রান্না করে এনেছে। সাথে চিনির নামগন্ধ নেই। হতাশাটা লুকানোর চেষ্টা করলাম না। ওয়াটারকে চিনি দিতে অনুরোধ করলাম। চিনিতে কাজ না হওয়ায় বিরক্ত মনে বেরিয়ে এলাম। বলাই বাহুল্য নাস্তাটা খুব একটা সস্তা ছিলনা।

রাস্তায় বেরুতেই দেখলাম ইতিমধ্যে বদলে গেছে জেরুজালেমের চেহারা। মানুষ কিলবিল করছে। পাশের বাস ষ্টেশনটা লোকে লোকারণ্য। পর্যটকরাও বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। দামাস্ক গেইট পেরিয়ে পূর্ব জেরুজালেমের আরব সেক্টরে প্রবেশ করতেই জীবনের স্পন্দন পেতে সময় লাগলো না। দোকানীদের দল পসরা সাজাচ্ছে। এক ইঞ্জিনের ছোট ছোট ট্রাকগুলো মালামাল নিয়ে সরু গলিতে ঢুকে পরছে। ওরা সবাই কথা বলছে। এবং উচ্চস্বরে। উঁচু গলায় কথা বলা আরবদের বোধহয় জন্মগত অভ্যাস। বিরক্তবোধ না করলে খারাপ লাগে না। অন্তত জীবন বলতে যে একটা চলমান গাড়ি আছে তা টের পাওয়া যায়।

হোটেলে ঢুকতেই রিসেপশন ডেস্কের মহিলা জিজ্ঞেস করল নাস্তা খেয়েছি কিনা। হ্যাঁ বলতে একটু অবাক হল। বলল, আমি তো তোমাকে ব্রেকফাস্ট রুমে যেতে দেখিনি! ব্রেকফাস্ট রুম! আকাশ হতে পড়লাম। আঙ্গুল উচিয়ে ইঙ্গিত করল গ্রাউণ্ড ফ্লোরের দিকে। ওখানে একটা এরো সাইন সহ লেখাটা জ্বলজ্বল করছে; BREAKFAST ROOM। এবং তা ফ্রী।

.
২৫শে জুলাই। পূর্ব জেরুজালেম। ইসরায়েল।

ডেশটিনেশন রামাল্লা, পশ্চিম তীর, প্যালেষ্টাইনঃ

ডেশটিনেশন রামাল্লা, পশ্চিম তীর, প্যালেষ্টাইনঃ


পশ্চিম তীরে ঢুকার ইসরায়লী চেক পয়েন্ট।


এই সেই নটরিয়াস দেয়াল যা নিরাপত্তার অজুহাতে ইসরাইল নির্মাণ করেছে।

আজকের সময়টা রাখা ছিল প্যালেষ্টাইনের জন্যে। দু’এক জায়গায় বিছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটলেও সফরটা ছিল নিরাপদ ও ঘটনাবহুল। গুছিয়ে লিখলে দশপর্বেও শেষ হবেনা। তাছাড়া উত্তপ্ত হয়ে উঠছে জেরুজালেমের বাতাস। আমি যেখানে আছি সেখান হতে আধা মাইল দূরে ঘটেছে ঘটনাটা। বোধহয় রোববার রাতে ইসরায়েলি বুলডজার গুড়িয়ে দিয়েছে প্যালেষ্টাইনিদের ১০০’র মত বাড়ি। ওদের ভাষ্য বাড়িগুলো নিরাপত্তা দেয়ালের খুব কাছে হওয়ায় ইসরায়েলের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য তা হুমকি স্বরূপ। কোন পূর্বনোটিশ ছাড়া ১০০ পরিবারকে পথে বসিয়েছে। ফুঁসছে গোটা প্যালেষ্টাইন। রামাল্লায় গিয়ে তার উত্তাপ কিছুটা হলেও অনুভব করেছি।

আগামীকাল বিক্ষোভ করবে গোটা প্যালেষ্টাইন। পূর্ব জেরুজালেম হতে ঢুকার মূল ফটক দামাস্কাস গেইট বন্ধ করে দিবে সৈন্যরা। মারাত্মক কিছু না হলে তার স্থায়ীত্ব হতে পারে ৩/৪ ঘণ্টা। আর রক্তারক্তি হলে তা বাঁক নেবে বিপদজনক পথে। স্বভাবতই কয়েক ঘণ্টার জন্যে আগামীকাল বন্দী হয়ে পরবো হোটেলে। কারণ দামাস্কাস গেইট হচ্ছে পূর্ব জেরুজালেম হতে বের হওয়ার অন্যতম পথ। দিনের প্ল্যান চেঞ্জ করতে হবে ঘটনার সাথে সামঞ্জস্যে রেখে। হোটেল রিসিপসনিষ্টের মতে, এমনটাই প্যালেষ্টাইন ইসরায়েলের সম্পর্ক। দুদিন ভাল তো তৃতীয়দিন খারাপ। টেইক ইট অর লীভ ইট!


চেয়ারাম্যান ও প্রেসিডেন্ট আরাফাতের অফিস কক্ষ। এখানে বসেই মোকাবেলা করতেন ইসরায়েলীদের অল-আউট আক্রমণ।


চেয়ারম্যান আরাফাতের রান্নাঘর। একাধারে ৩৪ মাস ইসরায়েলী অবরোধের সময় এটাই ছিল তার মূল আশ্রয়স্থল।


এখানেই ঘুমিয়ে আছেন প্যালেষ্টাইনিদের প্রাণপ্রিয় পুরুষ ইয়াসির আরাফাত।


রামাল্লাহ শহরের কেন্দ্রে।

প্যালেষ্টাইনের রাজধানী রামাল্লায় পৌঁছে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সাথে দেখা করার অনুরোধ পাঠাই। অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখে তার সেক্রেটারী জানাল, বাংলাদেশ হতে আসা একজনের সাথে প্রেসিডেন্ট দেখা করতে খুবই উৎসুক, কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণ তিনি এখন সময় সময় দিতে পারবেন না। দুঃখ প্রকাশ করে জানালেন চাইলে পরের সপ্তাহে এমন একটা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করিয়ে দিতে পারেন। ধন্যবাদ দিয়ে জানালাম একসপ্তাহ পর আমি আর এখানে থাকবোনা। চেয়ারম্যান আরাফাতের কবরের সাথে দেখা প্রশাসন ভবনের প্রবেশের মুখে। দুজন সৈনিক পাহারা দিচ্ছে ২৪/৭। দেখলাম আরাফাতের অফিস, যেখানে বসে একনাগাড়ে ৩৪ মাস ইসরায়েলিদের অবরোধ মোকাবেলা করেছেন।


ঐতিহাসিক শহর জেরিকো।


১০,০০০ বছর বয়সের এই শহরই আজকের বিশ্বের সবচাইতে পুরানো শহর।

রামাল্লাহ হতে বেরিয়ে পরবর্তী ষ্টপেজ ছিল জেরকো নামের একটা ঐতিহাসিক শহর। বলা হয় সী-লেভেল হতে পৃথিবীর সবচাইতে নীচুতে অবস্থিত এই শহরের বয়স ১০,০০০ বছরের উপর।


ছোট এই জায়গাটাতেই জন্ম হয়েছিল যীশু খ্রীষ্টের।

খ্রীষ্ট ধর্মের জনক যিশু খৃষ্টের জন্মস্থান বেথলেহেম ছিল আজকের শেষ ষ্টপেজ।

প্রতিটা শহর ভ্রমণের সাথে জড়িয়ে আছে অনেক ঘটনা। লুকানো আছে প্যালেষ্টাইনিদের লম্বা দীর্ঘশ্বাস। নিজ দেশে শরনার্থী হওয়ার চাপা ক্ষোভ ফুঁসে উঠে অনেক কথাই প্রকাশ করেছিলেন আমার ট্যুর গাইড আবু আল নাসের। ৪৭ বছর বয়স্ক প্যালেষ্টানিয়ান, যিনি একসাথে জেল খেটেছেন ইসরায়েলি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইসহাক রবিনের খুনির সাথ, বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন নিজেদের অসহায়ত্বের কথা। নিয়ে গিয়েছিলেন আপন বাসস্থান পশ্চিমতীরের এক রিফিউজ্যি ক্যাম্পে। এসব কথা পূর্ব জেরুজালিমে বসে লেখা নিরাপদ না, পরিচিত অপরিচিত অনেকেই লিখতে মানা করে দিয়েছেন।

বাড়ির ফিরে এর উপর বিস্তারিত লিখার ইচ্ছা।

পূর্ব জেরুজালেম : আল আকসা মসজিদ- পর্ব-২

পূর্ব জেরুজালেম। আল আকসা মসজিদ। পর্ব-২।

ঘণ্টা-খানেক কষে একটা ঘুম দিলাম। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি দুটো কবুতর বসে আছে ব্যালকনিতে। ওরা ভালবাসায় ব্যস্ত আর ঘো ঘো করে চীৎকার করছে। অনেক জাতির কাছে কবুতর দেখা নাকি শুভ লক্ষণ। এসবে আমার বিশ্বাস না থাকলেও মনটা ভাল হয়ে গেল। ছবি তুলতে চাইলাম কপোত কপোতীর। কিন্তু কোত্থেকে একটা বিড়াল এসে সব পালটে দিল। কবুতর-দ্বয় ডানার পত পত আওয়াজ তুলে মিলিয়ে গেল শূন্য দিগন্তে।

সূর্যের তেজ খুব একটা কমেছে বলে মনে হল না। রুমে এসির কারণে প্রচণ্ড শীত। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পরলাম রুম হতে। উদ্দেশ্য দামাস্কাস গেইট।
মানুষ কিলবিল করছে ওখানে। ক্লান্ত টুরিস্টদের দল গেইটের সামনে গ্যালারিতে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। অনেকে ছবি তোলায় ব্যস্ত। মূল এন্ট্রিতেই চোখে পরল চার জনের গ্রুপটা। ইসরায়েলি পুলিশ। সেমাই অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে বসে আছে। খুব একটা সিরিয়াস তা বলে যাবেনা। নিজেদের ভেতর হাসাহাসি করছে। একজন মোবাইল ফোনে কি যেন একটা করছে। নিজকে ইনসিগ্নেফিকেন্ট রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই করলাম। খুব দ্রুত গেইট হতে বেরিয়ে চলে গেলাম সামনের স্কয়ারে।

পাশাপাশি দুটো বাস ষ্টেশন। একটা বেথলেহেম ও অন্যটা রামাল্লা গামী। পাশেই কাঁচাবাজার। ক্রেতা-বিক্রেতার দরাদরি শেষ। বিক্রেতাদের সবাই ঘরে ফেরার আয়োজন করছে। ফিলিস্তিনি ছেলেরাও দেখতে খুব হ্যান্ডসাম। দেখলেই মনে হয় পরিশ্রম করছে বাঁচার জন্যে। গায়ে আধুনিক পোশাক হলেও মুখের হাল্কা হাসিটা বলে দেয় ওর ভেতরটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্ণবাদী সাদাদের মত নয়। বেশ কজনকে মাথা নুইয়ে সালাম দিলাম। উত্তরে ওরাও দিল এবং জানতে চাইল কোন উপকার করতে পারে কিনা। অনেকক্ষণ উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটাহাঁটির পর হোটেলের দিক রওয়ানা দিলাম।

পবিত্র শহর জেরুজালেমে সূর্য তখন শেষ রশ্মি ছড়িয়ে ডুবি ডুবি করছে। চারদিকে আরও একবার ভাল করে তাকালাম। পৃথিবীর এ প্রান্তে হয়ত আর কোনদিন আসা হবেনা। কিন্তু আজকের এই অভিজ্ঞতা আজীবন বয়ে বেড়াবো। গল্প করবো যতদিন বেঁচে থাকবো।
হঠাৎ করে নিজকে খুব ভাগ্যবান মনে হল।
১৬ কোটি বাংলাদেশির ঠিক কতজন ইতিপূর্বে এ শহর ঘুর যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে সমীকরণ মেলাতে গিয়ে মনে হল এ সংখ্যা নিশ্চয় খুব একটা বেশী না।

হোটেলে ফিরে এসে লবির কফি ভাণ্ডার হতে এক কাপ গরম কফি বানিয়ে গল্প করতে শুরু করলাম রিসিপশনিষ্ট ইয়াসিনের সাথে। ও প্রতিদিন রামাল্লা হতে বাস ধরে জেরুজালেমে আসে এবং কাজ শেষে ফিরে যায়। চেক পয়েন্টের ঝামেলা নিয়ে অনেকক্ষণ আলাপ হল। হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলো আল আকসায় ঢুকতে পেরেছি কিনা। না বলতেই কিছু টিপস দিল। রাত নেমে এসেছে। অন্ধকারের চাদরে ডুবে আছে জেরুজালেম। আল আকসাও এক অর্থে বন্ধ। তবে তা মুসলমানদের জন্যে খোলা। সিকিউরিটি চেকপয়েন্টে লম্বা একটা সালাম দিলেই নাকি ওরা ধরে নেবে আমি মুসলমান এবং ঢুকতে ঝামেলা করবেনা।

খুব দ্রুতই বেরিয়ে পরলাম কালকের কথা ভেবে। আজ এ অভিযান শেষ করতে পারলে দিনটা খালি থাকবে এবং শহরের পশ্চিম দিকে খ্রিষ্টান এলাকায় ঘুরে বেড়াতে পারবো। বিকেলে বাস ধরে রামাল্লা যাওয়ার প্লানেও বাঁধা থাকবেনা।

দিনের আলো থাকায় আগের চেষ্টায় নিরাপত্তার ভয়টা মাথায় চাপেনি। কিন্তু এখন ব্যপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অন্ধকার চিপা রাস্তা। আলোও নেই তেমন। চাইলে যে কেউ আমাকে ঠেক দিতে পারে। ছিনতাই কাজে আমাদের উপদেশের জন্যে এ হতো আদর্শ লোকেশন। সাহস করে এগুতে থাকলাম। মানুষের চলাচলও কম। অনেকে তখনো দোকানপাট বন্ধ করছে। পুলিশ উপস্থিতিও বেড়েছে অনেক জায়গায়। দুপুরে যেখান হতে আমাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল সেখানে আবারও থামতে হল।
পুলিশ!

প্লান-মত লম্বা সালাম দেয়ার পরও জানতে চাইলো মুসলমান কিনা। ওরা সবাই ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি পুলিশ। এ সময়টায় কেবল মুসলমানদের জন্যে উন্মুক্ত থাকে এ পবিত্র মসজিদ। হাসি দিয়ে নিজের পুরো নাম বললাম। ওরা বোধহয় বিশ্বাস করলো না আমার পোশাকের কারণ। শর্টস ও টি শার্ট। মসজিদে প্রবেশের আদর্শ পোশাক না নিশ্চয়। একজন জিজ্ঞেস করলো কোরানের আয়াত জানি কিনা। অন্যজন জানতে চাইল কালিমা মুখস্থ আছে কিনা। এসবের সাথে যোগাযোগ নেই অনেক বছর। আমি ধার্মিক নই। এর চর্চাও করিনা স্কুল জীবন হতে।

ভড়কে না গিয়ে নিজকে সামলে নিলাম। প্রতিবাদ অথবা তর্ক করার জায়গা এটা না। চোখ বুজে সূরা ফাতেহা মনে করার চেষ্টা করলাম। গড় গড় করে বেরিয়ে এলো.. বিসমিল্লাহে রহমানের রাহিম…। আলহামদুলিল্লাহ রাব্বুল আলামিন। বেশ ক’লাইন বলার পর একজন থামিয়ে দিল। বলল, আমার উচ্চারণ নাকি যথেষ্ট কনভিনসিং না। এবার হতাশ হলাম। সাথে থাকা মার্কিন ড্রাইভিং লাইসেন্সটা এগিয়ে দিলাম। নিজকে মুসলমান হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার এই চেষ্টা নিজের কাছে বড় ধরণের হিপোক্রেসি মনে হল। কিন্তু উপায় ছিলনা। ওদের একজন বলে উঠল, ‘সবকিছু দেখে তো মনে হচ্ছে মুসলমান, ছেড়ে দাও’। এবং ছেড়ে দিল।

একটু আগাতেই পথরোধ করে দাঁড়াল সিভিলিয়ান কেউ। গায়ে গতরে বিশাল। বিনয়ের সাথে জানতে চাইল মুসলমান কিনা। এবার মাশায়াল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ জাতীয় দুয়েকটা শব্দ ঝেড়ে দিলাম। মনে-হল সন্তুষ্ট করতে পেরেছি।
বাড়তি কোন ঝামেলা ছাড়াই পা বাড়ালাম সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আল আকসা মসজিদের দিকে।

মসজিদ প্রাঙ্গণে অনেক ফিলিস্তিনিরা ঘোরাফেরা করছে। বাইরেটা ভাল করে দেখার পর পা বাড়ালাম ভেতরের দিকে। জুতা খুলে ভেতর ঢুকতে ঠাণ্ডা একটা বাতাস এসে সমস্ত শরীর জুড়িয়ে দিল। আমার মত অনেকে দেখতে এসেছে। ছবি তুলছে। দু’একজন নামাজও পড়ছে। অনেকটা সময় হতবাক হয়ে চিন্তা করলাম, এই সে আল আকসা মসজিদ যার অস্তিত্ব ছোটকাল হতে জেনে এসেছি। জেনে এসেছি এর ইতিহাস, এর বিবর্তন এবং সমসাময়িক পরিস্থিতিতে এর ভাগ্য। অবাক লাগলো এই ভেবে, চাইলেই তো এখানে আসা যায়। আগে আসেনি কেন!

বেশকটা ছবি তুললাম। একজন মহিলা আমার একটা ছবি তুলে দিল। বেশকিছুটা সময় কাটিয়ে দিলাম কিছু না করে। একদম নীরবে। স্মৃতির গলি হাতড়ে ফিরে গেলাম অনেক বছর পিছনে। আব্বা তখনো বেঁচে। দাদা বাড়ির ঘোড়া মাওলানা ওয়াজ শেষে মোনাজাত ধরেছেন… হে আল্লাহ, আল আকসা মসজিদের পবিত্রতা তুমি রক্ষ করো…”

জানিনা কি লেখা আছে ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে। তবে তা যাই হোক, তাদের এ সম্পদ, তথা বিলিয়ন মানুষের বিশ্বাস, সন্মান ও শ্রদ্ধার এ স্থান যেন আসল মালিকদের হাতে থাকে এই কামনা করেই বেরিয়ে এলাম আল আকসা মসজিদ হতে। ততক্ষণে রাতের অন্ধকার আরও ঘন হয়ে চেপে বসেছে জেরুজালেমের বুকে। দুপুরের তপ্ত বাতাসের জায়গা করে নিয়েছে হাল্কা ঠাণ্ডা বাতাস। ফেরার পথটা মনে হল ঘোরের মধ্যে হেঁটেছি। মনে হচ্ছিল এ সত্য নয়, নেহাতই স্বপ্ন অথবা কল্পনা। হাজার রজনীর আরব্য উপন্যাসের পুরানো পাতা উলটাচ্ছি আমি…

.
জেরুজালেম। ২২শে জুলাই, ২০১৯।

পূর্ব জেরুজালেম : আল আকসা মসজিদ পর্ব-১

পূর্ব জেরুজালেম। আল আকসা মসজিদ। পর্ব-১।

প্রচণ্ড গরম থাকায় মধ্যদিনে আর ঘরের বাইর হইনি। লাঞ্চ খাবার পর চোখ এমনিতেই ঢুলু ঢুলু করছিল। ভেতর হতে ঘুম বার বার তাগাদা দিচ্ছিল। গেল দুই রাত ভাল ঘুম হয়নি ঘন ঘন সময় ও স্থান বদলের কারণে। তাতে ছক আঁকা ভ্রমণ পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে বার বার। সুখনিদ্রায় যাওয়ার আগে মনে হল একটু হেঁটে আসা উচিৎ। বিগ এন্ড ফ্যাট লাঞ্চ গলা পর্যন্ত উঠে নিজের অস্তিত্বের কথা জানান দিচ্ছিল সগৌরবে। গ্রীলড চিকেন সাথে তন্দুরে ভাজা প্যালেষ্টানিয়ান রুটি। স্বাদে গন্ধে এক কথায় অতুলনীয়।

হোটেল কাউন্টারে পরিচয় ইয়াসিনের সাথে। জন্ম প্যলাষ্টাইনে হলেও বড় হয়েছে ইংল্যান্ডে। ছেলে-মেয়ে সহ স্যাটলড রামাল্লায়। তার কাছে নির্দেশনা নিয়ে রওয়ানা দিলাম মসজিদে আল আকসার দিকে।

পায়ে হাঁটার দশ মিনিটের পথ। আঁকা বাঁকা এবং উঁচু নিচু। ব্যস্ত ও গিঞ্জি প্যালেষ্টানিয়ান মার্কেটের বুকে চিড়ে চলে যাওয়া এ রাস্তায় কিছুক্ষণ হাঁটলে কিছুটা হলেও ধারণা পাওয়া যাবে এদের জীবনের উপর। সন্দেহ নেই এদের জীবন অন্যরকম। কিন্তু মানুষ হিসাবে ওরা আমাদের মতই রক্ত মাংসের মানুষ। হাসিখুশি উচ্ছল। হাঁটার পথে কাউকে সালাম দিলে খুশিতে গদ গদ হয়ে জানতে চায় মুসলমান কিনা। ইসরায়েলিদের মত এদেরও মূল পরিচয় এখন ধর্ম। ধর্মের প্রভাব সবকিছুতে। কথায়, কাজে, পোশাকে এবং ব্যবহারে। মার্কেটে টুরিস্টদের ঢল। সাদা, কালো, বাদামি, মিনি স্কার্ট পরিহিতা ইসরায়েলি যুবতীদের পাশেই হাঁটছে আপাদমস্তক হিজাবে ঢাকা প্যালেষ্টানিয়ান তরুণী। দেখলে মনে হবে জীবন নিয়ে ওদের কোন অভিযোগ অথবা আক্ষেপ নেই। কিন্তু কিছুক্ষণ কথা বললেই বেরিয়ে আসে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস। এবং এ শ্বাসের সাথেই মিশে থাকে তাদের না বলা কথা।

কম করে হলেও দশটা বাঁক নিয়ে হয় খুবই সরু ও ঘিঞ্জি এ রাস্তায়। প্রতিটা বাঁক নেয়ার আগে কাউকে না কাউকে জিজ্ঞেস করে নিলাম পথ হারানোর ভয়ে। তরুণরা দোকানে পশরা সাজিয়ে অপেক্ষা করছে ক্রেতার। পাশেই হুঁকা হাতে তামাক টানছে বৃদ্ধের দল। অনেককেই সালাম দিলাম। দুয়েকজন ডেকে কাছে বসাল। খুঁটিয়ে জানতে চাইল কোথা হতে এবং কেন এসেছি। মার্কিন পরিচয় এখানে মূল্যহীন। বরং বাংলাদেশের কথা শুনলে জানতে চায় অনেক কিছু।

আড্ডা জমিয়ে তোলা সম্ভব হয়নি সময়ের কারণে। সময়ের সাথে আমার লড়াই চলছে গত দুদিন ধরে।

একটা জিনিষ খুব ভাল লাগলো জেরুজালেমের এ অংশে। ছেলে বুড়ো হতে শুরু করে প্যালেষ্টাইনিদের প্রায় সবাই ইংরেজি জানে। কম্যুনিকেশনে অসুবিধা হয়না।
আল আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে ঢুকার প্রথম গেইটেই আটকে দিল ইসরায়েলি পুলিশ। জানালো বন্ধ হয়ে গেছে! জানানোর ভাষাটা ছিল খুবই কর্কশ। এই প্রথমবার অনুভব করলাম হলিল্যান্ডের সবকিছুই ছবির হলি নয়।

মন খারাপ করে ফিরে এলাম। উলটো রাস্তায় কারও সাথে কথা বললাম না। মনে মনে অংক কষে টাইট মেনুতে নতুন করে ঢুকাতে চাইলাম ফিরে আসার প্লান।

হোটেল কাউন্টারে ইয়াসিনকে খুলে বলতেই সে হেসে দিল। জানালো ওটা ছিল নামাজের ব্রেইক। চাইলে এখুনি আবার ফিরে যেতে পারি। শরীর আর চলছিল না। নতুন করে বাইরে বের হওয়ার আগে একটু ঘুমিয়ে নেয়া দরকার। কোন রকমে রুমের দরজা খুলে লুটিয়ে পরলাম বিছানায়।

ব্রেকফাস্ট ইন তেল আবিব …. ইসরাইল

প্যালেষ্টাইনে প্রথম প্রহর…

তেল আবিব হতে শেষ মুহুর্তে হোটেল বুক করার সময় ইচ্ছে করেই পুরানো জেরুজালেমের একটা হোটেল বুক করেছিলাম। নাম হোটেল হাশেমি। এক শহর হতে অন্য শহরে আসতে একঘণ্টার বাস জার্নি। বাসে উঠে ঠিকমত বসার আগেই ড্রাইভার জানালো চলে এসেছি। জেরুজালেমের সেন্ট্রাল বাস ষ্টেশন। লোকে লোকারন্য। দলে দল পর্যটকরা আসছে। তিন ধর্মের পূণ্যভূমি এই শহরকে ঘিরে আছে অনেক ইতিহাস। এ ইতিহাস আমাদের যেমন নিয়ে যায় হাজার বছর আগে, তেমনি সমসাময়িক পটভূমিতে। এ মুহূর্তে ইতিহাস এবং তাকে ঘিরে স্থানীয়দের কনফ্লিক্ট নিয়ে লিখতে চাইনা নিরাপত্তার কথা ভেবে। তবে এখন আমি প্যালেষ্টাইনে। দামাস্কাস গেইটে ট্যাক্সি ছেড়ে পায়ে হেঁটে চলে এসেছি হোটেলে। বুঝতেই পারিনি নীরবে অতিক্রম করেছি এমন একটা সীমানা যাকে দেখার স্বপ্ন আজীবন লালন করেছি…

ছবির ব্যাকগ্রাউণ্ডে এই সেই দেয়াল যা ইসরাইল ও প্যালেষ্টাইনকে আলাদা করে। দরজাটাই দামস্কাস গেইট। পাশেই দুটো বাস ষ্টেশন। একটা যাত্রীদের নিয়ে যায় বেথেলহেম এবং অন্যটা প্যালেষ্টাইনের অলিখিত অস্থায়ী রাজধানী রামাল্লায়।

ঘড়ির কাটায় স্থানীয় সময় ঠিক কটায় ঘুম ভাঙ্গলও আন্দাজ করতে পারলাম না। স্মার্ট ফোন, স্মার্ট ঘড়ি দু’টোর একটাও স্থানীয় সময় দেখাচ্ছে না। একটাতে ক্যালিফোর্নিয়া অন্যটাতে এখনো নিজ অঙ্গরাজ্য নিউমেক্সিকোর সময়। অথচ আমার দরকার স্থানীয় সময় এবং সাথে বাংলাদেশ ও পেরুর। ১৪ ঘণ্টা বিরামহীন জার্নির পর এমনিতেই ক্লান্ত। তার উপর ক্ষুধা। ডিনার করা হয়নি এই ভেবে বিকাল ৬টায় দেয়া ফ্লাইটের ডিনারই হয়ত রাত কাটিয়ে দেবার জন্যে যথেষ্ট। কিন্তু লম্বা একটা গোসল দিয়ে বিছানায় লুটিয়ে পরতেই পেট আওয়াজ দিতে শুরু করল। ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে।

ঘুম খুব একটা লম্বা হয়নি। পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি ঘোর অন্ধকার। হঠাৎ করেই অংকটা মাথায় এলো; এয়ারপোর্টে নেমে কষে নিয়েছিলাম। আমার শহরের চাইতে ৯ ঘণ্টা এগিয়ে ইসরাইলের সময়। সে হিসাবে এখন ভোর প্রায় ৪টা। দুয়েকটা গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে বাইরে। রাস্তা পরিষ্কার করার ট্রাকটাকে দেখলাম বেশ সময় নিয়ে পরিষ্কার করছে।

বাইরে তাকালে মনে হবে ঢাকার কোন গলির কার্বন কপি। জরাজীর্ণ দালানের অনেক জায়গায় পলিস্তরা খসে খসে পরছে। ছাদের উপর পুরানো দিনের এন্টেনা। জানালার পর্দাগুলোও স্যাঁতস্যাঁতে। শুধু বাকি ছিল মসজিদ হতে আজানের ধ্বনি ভেসে আসার।

ভোরের আলো ফুটতেই পেটের খিদা জ্যামিতিক হারে বাড়তে শুরু করল। অপেক্ষা করার সময় ছিলনা। নীচে নামতেই দেখি হোটেলের মুল ফটক তখনো তালা দেয়া। রেসিপশনে কেউ নেই। অজান্তেই মুখ হতে অশ্রাব্য একটা গালি বেরিয়ে এলো। লবিতে ফ্রি কফির ব্যবস্থা ছিল। এক কাপ কফি হাতে নিয়ে ফিরে এলাম রুমে।

৮টার দিকে দ্বিতীয় চেষ্টাতে বেরিয়ে পরলাম। তেল আবিব। আধুনিক একটা শহর। চারদিক চকচক করছে। রুম হতে দেখা পুরানো বাড়িটা মনে হল একটা যাদুঘর। মানুষের কোলাহল বাড়ছে রাস্তায়। সাথে গাড়ি। হাঁটছি অলস গতিতে। উদ্দেশ্যবিহীন। একটু এগুতেই চোখে পরল দৃশ্যটা। সমুদ্র! রাশি রাশি ঢেউ আছড়ে পরছে কূলে। সাত পাঁচ না ভেবে দ্রুত রওয়ানা দিলাম ওদিকটায়। ১১টার দিকে রওয়ানা দেব জেরুজালেমের দিকে। সময় কম। এ শহরে যা দেখার অল্প সময়ের ভেতরই দেখে নিতে হবে।

বীচের কাছাকাছি আসতেই দেখলাম অসংখ্য মানুষ দৌড়চ্ছে। মেয়েদের মিছিলটা একটু লম্বা। অনেকের পরনের কাপড় একবারেই সংক্ষিপ্ত। ২৪ ঘণ্টারও কম সময় এ দেশে। এরই ভেতর একটা উপসংহার টানলে বোধহয় ভুল হবেনা। এ দেশের মেয়েরা বিপদজনক সুন্দরী। কেবল গায়ের রঙ আর চেহারাই নয়, শরীর সঠিক রাখার মাপকাঠিতেও ওরা এগিয়ে। ছেলেদের সৌন্দর্য বিচার করার দায়িত্ব আমার নয়। কিন্তু এদের দিকে তাকালেও মনে হবে ঈশ্বর হয়ত নিজ হাতে তৈরি করেছেন। অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর পেটের ক্ষুধাটা চরম পর্যায়ে চলে গেল। আর অপেক্ষা নয়।

বীচের পাশেই দেখা মিলল মাকডোনাল্ডের। পরিচিত দোকানের গন্ধ পেয়ে ওদিকে রওয়ানা দিতে দেরী করলাম না। কিন্তু হতাশ হলাম। ভেতরে কোন আলো নেই। একেবারেই অন্ধকার। দেখে মনে হল হয়ত মেরামত চলছে।

এবার হোটেলের ফেরার রাস্তা ধরলাম। ওখানে বেশকটা খাবার দোকান রাতেই দেখেছি। দরদাম অথবা প্রকারভেদ খুঁজে দেখার মত অবস্থা ছিলনা। ঢুকে পরলাম ছিমছাম একটা ক্যাফেতে। মেনু হিব্রু ভাষায়, তাই কিছু বুঝতে পারলাম না। তবে মেনুতে ছবি থাকায় আঙ্গুল তুলে ঐদিকটায় ইঙ্গিত করলাম।
সাজগোজে পরিপক্ব সুপার আবেদনময়ী মেয়েটা ভুবন-জুড়ানো হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এদিকটায় এই প্রথম বুঝি?’

আমিও সহজ ভাবে উত্তর দিলাম। ‘একেবারে ব্রান্ড নিউ। চব্বিশ ঘণ্টারও কম।
সময় নিয়ে রান্না করলো। প্লেট যখন টেবিলে রেখে গেল আমার চোখ ছানাবড়া। বিশাল আয়োজন। চার টুকরো পাউরুটি। টমেটো সসে ডুবানো দুটো ডিম ভাজি। শসা ও টমেটোর সালাদ। সাথে অলিভ ওয়েল। এবং ফ্রেশ এক গ্লাস অরেঞ্জ জুস। তেল আবিবের প্রথম ব্রেকফাস্ট। এক কথায় ইসরায়েলে আমার প্রথম খাবার।

আমার চোখে চেন্নাইঃ রিভিউ ০৩

ভেবেছিলাম চেন্নাই নিয়ে রিভিউ লেখা দ্বিতীয় পর্বেই শেষ করে ফেলেছি। কিন্তু নতুন কিছু জানার আনন্দে আর লেখক মনের উৎসাহে তৃতীয় পর্বও লিখতে বাধ্য হলাম…।

১) তামিল ভাষা আমার জন্যে দুর্ভেদ্য, এক শব্দও এখনো বুঝিনি। পুরাসাওয়াকাম হাই রোডের যেখানে আছি, সেখানকার ম্যানেজার বাবু অমায়িক লোক। খুব ভালো ইংরেজী বলতে পারেন, তাই রক্ষে। তার সাথে আমার আড্ডা জমে ভিনদেশী ভাষায়, ইংরেজীতে। আমি অবশ্য তেমন ভালো ইংরেজী বলতে পারি না। শুধু বিগেনার লেভেলে বলতে পারি, মাঝে মাঝে আটকেও যাই। যেমন অনেক চেষ্টা করেও ‘ঝিম ঝিম করা’ শব্দের ইংরেজী বোঝাতে পারি নি, হা হা…। ও হ্যাঁ, এখানে আরও তিনটে নেপালিও আছে। ছোটটা দু’এক শব্দ বাংলাও বোঝে। নেপালে নাকি প্রচুর বাঙালি ভ্রমণে যায়। এই নেপালিরা দেখলাম ইন্ডিয়ায় ভিসা ছাড়াই চলে এসেছে এবং এখানে কাজ করছে।

২) ম্যানেজার বাবুর সাথে চেন্নাই ও তামিল নাডু রাজ্য নিয়ে টুকটাক আলাপ হলো। এই রাজ্যের অনেক মানুষ নাকি হিন্দি ভাষা জানেই না! এখানে আমাদের দেশের মতোই সরকারি চাকরির অনেক ডিমান্ড। মানুষ সরকারি চাকুরির পেছনে অবিরাম ছুটছে। এখানেও সরকারি চাকুরি পেতে ঘুষ দেয়া লাগে, এমনকি বেসরকারি চাকরিতেও ৪-৫ লাখ রুপি ঘুষ নেয়। ভদ্রলোকের সাথে বাংলা ভাষা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও আলোচনা হলো। ভাষার জন্যে আমাদের অবদান, স্বাধীনতা প্রসঙ্গ নিয়েও বললাম। তিনি ভেবেছিলেন আমরা বাংলার পাশাপাশি উর্দুও বলি! বললাম, আমাদের দেশের মানুষ উর্দু ভাষা জানেনা বলতে গেলেই চলে, বরং হিন্দি কিছুটা জানে। এছাড়াও তাকে সারা বিশ্বের মুসলিমদের সংখ্যা সম্পর্কে বললাম, একই রকম সালাত পড়ি জানালাম। গর্বের সাথে বললাম, তোমাদের দেশের কিছু রাজ্যের সাম্প্রদায়িক অবস্থার চেয়ে আমাদের দেশের সাম্প্রদায়িক সম্পৃতি অনেক ভালো। তোমাদের দেশের মুসলিমদের চেয়ে আমাদের দেশের হিন্দুরা বরং বেশী সুখে আছে। তিনিও বোধহয় ব্যপারটা জানেন।

৩) চেন্নাইতে বাঙালি এরিয়া বলে খ্যাত- গ্রিমস রোড। এই রোডেই রয়েছে এ্যাপোলো হসপিটাল ও শংকর নেত্রালয়। তাই চিকিৎসার জন্যে ৯৫% বাঙালিই এখানে এসে উঠে। আমি অবশ্য মানি এক্সেঞ্জের জন্যে এই পর্যন্ত দু’বার গিয়েছিলাম গ্রিমস রোডে। এখানে কোলকাতার বাঙালি ও বাংলাদেশীদের দেখা পাবেন। প্রচুর মানি এক্সেঞ্জ, ট্রাভেল এজেন্সি, বাঙালি রেস্টুরেন্ট, হোটেল, লজে এ এলাকা ঠাসা। প্রায় হোটেল-লজের মালিকগন বাঙালি লোক রাখে, যাতে বাঙালি কাষ্টমারদের সাথে সহজে কমিউনিকেট করা যায়। তবে হোটেল-লজ এরিয়া একটু গিঞ্জি মনে হলো, যদিও থাকার ব্যবস্থা যথেষ্ট ভালো, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে পুরাসাওয়াকাম থেকেও। এখানকার সব বাঙালি রেঁস্তোরার খাবার সুস্বাদু নয়। তবে হোটেলে উঠলে নিজেরা বাজার করে বাসার মত রান্না করার মত সুব্যবস্থাও রয়েছে।

৪) গ্রিমস রোড যেহেতু বাঙালি দিয়ে ঠাসা এবং পরিবেশটাও বাঙালি, সেহেতু সেখানে থাকলে চেন্নাইয়ের তামিলদের প্রকৃত পরিবেশ-সংস্কৃতি-খাবার-পোষাক ইত্যাদি সম্পর্কে তেমন জানা হবে না বলে ধারনা করছি। হয়তো বিদেশে এসে কুয়োর ব্যাঙই থাকা হয়ে যেতো, যদি গ্রিমস রোডে থাকতে হতো! পুরাসাওয়াকাম এ থাকায় চেন্নাইয়ের প্রকৃত পরিবেশটা বেশ পেয়েছি।

৫) বাঙালি এবং চিটিং, এই দুই শব্দের খাতিরটা বেশ, এমনকি বিদেশের মাটিতেও! চেন্নাই শহরের বিভিন্ন এরিয়া দাপিয়ে এলাম, কোথাও কোন চিটার-বাটপার দেখলাম না। কালো মানুষগুলোকে পেলাম সৎ ও আন্তরিক। যেখানে থাকি, সেখানে একবার আমার মানিব্যাগ বেখেয়ালে ড্রপ হয়। পরে ম্যানেজার বাবু মানিব্যাগে আমার ন্যাশনাল আইডির কপি দেখে, আমাকে খুঁজে তা ফিরিয়ে দেন। এক পয়সাও নড়চড় হয় নি। কিন্তু কোলকাতা ও গ্রিমস রোডের বাঙালি এরিয়া, দু’জায়গাই বাঙালি চিটিংবাজের খপ্পরে পড়েছি কিংবা চিটিংবাজি দেখেছি। মন খারাপ হয়েছিলো এদের চিটিং দেখে।

৬) একদিন গুগল ম্যাপে আবিস্কার করলাম, আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে ৩-৪ মিনিটের দুরুত্বে মসজিদ। এতদিন আযানের শব্দ কেন যে টের পাই নি, আল্লাহই মা’লুম! সেদিন আসরের সালাত পড়তে গিয়েছিলাম মসজিদে। অচেনা পরিবেশে মসজিদ পেলে আমার আবেগ বেড়ে যায়, খুব করে কান্না এসেছিলো সেদিন। জানিনা, কেনো! হয়তো একাকী থাকতে থাকতে আপন একটা পরিবেশ পাওয়ায়! বিদেশের মাটিতে মসজিদের পরিবেশটা কতোটা আপন মনে হয়, সেটা হয়তো পরবাসীরাই বেশ বুঝবেন।

৫) আসরের সালাত শেষ করে ইচ্ছে করেই পরিচিত হলাম স্থানীয় ক’জন মুসল্লিদের সাথে। ভালোলাগার ব্যপার হলো, চেন্নাইতে মোটামুটি সবাই ইংরেজী বোঝে। শিক্ষিতরা ভালো ইংরেজী বলতেও পারে। তাদের থেকে জানলাম যে, পুরাসাওয়াকাম এরিয়ায় ২৫০ টি মুসলিম পরিবার বাস করে, আলহামদুলিল্লাহ। এরা হানাফী মাজহাব অনুসরন করেন, আবার পুরো মসজিদ জুড়ে সবাই জোরে আমীন বলেন। আমাদের দেশের মত ‘জোরে আমীন বলা নিয়ে’ হাঙ্গামা ও মাযহাবী গোঁড়ামী দেখলাম না এখানে। আমার আগ্রহের কেন্দ্রে ছিলো- সাম্প্রদায়িক সম্পৃতি। কেমন আছে আমার ভাইয়েরা! উনারা বললেন, চেন্নাইতে সাম্প্রদায়িক পরিবেশ অনেক ভালো। মুসলিম-হিন্দুরা মিলেমিশে থাকে। তবে গোলমাল রয়েছে অন্যান্য কিছু রাজ্যে। তাদের থেকে জানলাম বাচ্চাদের দ্বীনী জ্ঞান শেখার জন্যে মক্তব হিসেবে এই মসজিদ-ই ব্যবহৃত হয়। এখানেও তাবলীগ আছে (ব্যক্তিগতভাবে আমি তাবলীগ সাপোর্ট করি না)। এদের মাঝে একজন মুরুব্বী পেলাম, যিনি আবার বাংলাদেশে থেকেও ঘুরে এসেছেন।

৬) মসজিদের গলিটা সুনসান, পরিচ্ছন্ন এবং চমৎকার পরিবেশ। এই গলিতে দেখলাম একজন পূর্ণ হিজাবী বোন তার দুই কন্যা সন্তানকে নিয়ে স্কুটি চালিয়ে যাচ্ছেন। আরেক হিজাবী বোনকেও দেখলাম স্কুটি চালাচ্ছে। আসলে ইচ্ছে থাকলে প্রয়োজনের খাতিরে পর্দার ভেতর থেকেও কাজ করা যায়, এই পরিবেশে সেটাও শিখলাম। এদেশের হিন্দু পুরুষদের চেয়ে প্রায় সব মুসলিমদের চেহারাই সুন্দর, পরিস্কার ও উজ্জ্বল। সম্ভবত এটি অযুর স্নিগ্ধ এক মায়াময়ী উপহার। মুসলিমদের সাথে আর কতটুকু মিশতে পারবো জানি না..। তবে সময় ও সুযোগ পেলে ভালোভাবে মেশার ইচ্ছে আছে। আমার ছোট বোনের সাথে আমার সম্পর্ক যতোটা না শ্রদ্ধার ও স্নেহের, তারচেয়েও বেশী বন্ধুতার। আমার মুখে এই শহরের পরিবেশ ও সহজ সরল মানুষের কথা শুনে, তারও নাকি এখানে এসে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে!

আচ্ছা কি হয়,
যদি ছোট্ট এই মুসলিম সমাজের মাঝে একেবারে থেকেই যাই? যদি আর না ফিরি..!
২৫১ তম ঘরটি আমার হলে মন্দ কি..!!

জানুয়ারী ২০১৯,
পুরাসাওয়াকাম, চেন্নাই, তামিল নাডু।

আমার চোখে চেন্নাই শহরঃ রিভিউ- ০২


[প্রতিটা গল্পের পেছনে, না বলা অনেক গল্প থাকে…।]

ভারতের তামিল নাডু রাজ্যের চেন্নাই শহর নিয়ে কয়েকদিন আগে প্রাথমিক একটা রিভিউ লিখেছিলাম। কিন্তু চেন্নাইকে ভালো করে জানতে হলে আজকের বিশদ রিভিউটি আপনাকে পড়তেই হবে….।

১) চেন্নাই শহর মুসলিম অধ্যুষিত শহর নয়, বরং হিন্দু অধ্যুষিত শহর। তবে জুমুআ’র নামাজ পড়ার মত চমৎকার মসজিদ রয়েছে। ধারনা করি তিন-চার কিলো অন্তর অন্তর মসজিদ রয়েছে। সাধারনত স্থানীয় সময় দেড়টায় খুতবা শুরু হয়, তাই জুমুআ’র নামাজের জন্যে আপনাকে আগে ভাগেই প্রস্তুতি নিতে হবে। গুগল ম্যাপে সার্চ করে মসজিদ খুঁজতে পারেন, বা স্থানীয়দের সহায়তাও নিতে পারেন।

২) চেন্নাই শহরে চোখে পড়ার মত ব্যাপার হলো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। এই শহরে প্রচুর পাবলিক বাস রয়েছে। বাসগুলো একই রঙের, একই গঠনের এবং একই কোম্পানির, শুধু বাসের নাম্বার আলাদা। যেমন- 29A, 21G, 23C, 23D ইত্যাদি। সাধারণত তিন ধরনের বাস রয়েছে- লোকাল, ডিলাক্স এবং এসি। বাসগুলোর মডেল আধুনিক নয়, তবে সীটগুলো বাংলাদেশের বিআরটিসি’র মতোই। কোন বাসেই ফ্যান দেখলাম না। ভালোলাগার ব্যপার হলো, নারী-পুরুষের সীট নিয়ে কোন বিবাদ নেই। বাসের এক সাইড জুড়ে পুরুষরা বসবে, অন্য সাইড জুড়ে নারীরা বসবে। কন্ডাক্টরের জন্যে রয়েছে আলাদা সীট। ভাড়া দেবার পর সে তার হাতে থাকা অনলাইন পে যন্ত্রের মাধ্যমে টিকেট কেটে দিবে। স্টপিজ আসলে বাঁশিতে হুঁইসেল দিয়ে বাস থামাবে। এমনকি এক টাকা বাকী থাকলেও আপনাকে ফেরত দিবে। বাস ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, অটো ড্রাইভার সবাই নির্দিষ্ট ড্রেস পড়ে। বাসের ভাড়া অনেকটা সহনীয়। বাসগুলো চক্রাকারে পুরো শহর ক্রমাগত প্রদক্ষিণ করতে থাকে। এই শহরের বাস ব্যবস্থাপনা চমৎকার। এমনকি একই রোডে পরপর ৪-৫ টা স্টপিজ এবং যাত্রী ছাউনিও থাকে। যাত্রীরা ধীরস্থির ভাবে ছাউনিতে অপেক্ষা করে। তারপর একেক বাস একেক স্টপিজে দাঁড়ায়। এতে করে সব বাস একই স্টপিজে এসে জ্যাম বাধায় না।

৩) জ্যামের রাজ্য ঢাকা শহরে থাকতে থাকতে প্রায় জ্যামহীন এই চেন্নাই শহরকে একদম অচেনা লাগে। মাঝে মাঝে সিগন্যালের হালকা দু’এক মিনিট জ্যাম ছাড়া এখানে আর কোন বাঁধা নেই। গাড়িগুলো যেন একটা নির্দিষ্ট রিদমে স্রোতের টানে ভেসে চলছে। রাস্তায় প্রচুর গাড়ি, কিন্তু বেহুদা ওভারটেকিং নেই, বা নেই গাড়ি নিয়ে কোন কুস্তি খেলা। অবৈধ পার্কিং নেই। প্রচুর ওয়ানওয়ে রোড রয়েছে। কোন রিকশা নেই। এখানে প্রায় সব গাড়িরই দাম কম বলে, প্রচুর মানুষ বাইক এবং স্কুটি ব্যবহার করে। স্কুটির দাম ৪০-৫০ হাজারের ভেতর। নারী-পুরুষ সবাই দেদারসে স্কুটি চালায়। পুরো শহরটাই যেন একটা বাইক-স্কুটির নগরী। হুটহাট দু’একটা সাইকেলও দেখতে পাবেন। রাস্তায় প্রচুর অটো (বেবিট্যাক্সি) রয়েছে আপনার জন্যে। আরেকটু বিলাসিতার জন্যে রয়েছে উবার এবং ওলার প্রাইভেট কার, তবে ভাড়া সহনীয়। এদের উন্নয়ন মাটির নীচেও চলে, তাইতো রয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেইল। কোথাও কোন ফুটওভার ব্রীজ দেখলাম না। সিগন্যাল পড়লে মানুষ ধীরে সুস্থে রাস্তা পেরুচ্ছে। ফুটপাথ অবৈধ দোকানে ভর্তি নয়, ফুটপাথ বেশিরভাগই পরিস্কার। ফুটপাথে যেন ‘নবাবী বাইকারগন’ না উঠতে পারে তার জন্যে মাঝে মাঝে হাঁটু সমান পিলার দেয়া। খুব বেশী ফ্লাইওভার নেই, নেই ফ্লাইওভারের উপর দ্বিতল জ্যাম। পুরো শহরটাই যেন স্মুথলি রিদম সহকারে একটা ফ্লো মেনটেইন করে চলছে।

৪) সখি! তোমার সাথে দেবো পাড়ি শহর ছেড়ে শহর, রাজ্য ছেড়ে রাজ্য… দূর বহুদূর। আন্তঃশহর, আন্তঃরাজ্য ও দূরের যেকোন যাত্রায় ভারতের ৯৫% মানুষই ট্রেনে পাড়ি দেয়। যেমন কোলকাতা থেকে চেন্নাই ২৮ ঘন্টার জার্নি। ‘এ জার্নি বাই ট্রেন রচনা’ লিখে ফেলার আদর্শ যায়গা। নির্দিষ্ট টাইমে ট্রেন ছেড়ে যায়। তবে ফরেনারদের জন্যে ট্রেনের টিকেট পাওয়া দুস্কর। অনলাইনেই বেশিরভাগ টিকেট বিক্রি হয়। সে জন্যে আপনাকে কোন এজেন্সির মাধ্যমে অতিরিক্ত খরচসহ টিকেট কাটতে হবে। স্টেশনে যেয়ে টিকেট পাওয়াটা সম্ভবত একটু কঠিনই (শিউর না)। ট্রেনের পরিবেশ আমাদের চেয়ে ভালো, তবে খাবার জঘণ্য। ট্রেনে আপনার সাথে নানা বর্ণের, নানা ভাষার মানুষের পরিচয় হবে। তবে ভারতে এত পরিমান ভাষা যে, এই ভাষার কারনে পুরোপুরি ভাব বিনিময়টা আটকে যেতে পারে বন্ধু! ইশারায়ই কাজ চালিয়ে যেতে হবে।

৫) চেন্নাইতে ফলের দাম আমাদের দেশের চেয়ে অনেক সস্তা। ছোট সাইজের তরমুজ ১২ রুপি, বড়টা ২৪ রুপি। আঙুরের কেজি ১১০ রুপি, আনারের দাম কম-বেশী ১০০ রুপি। আপেলের দাম ১৫০ এর উপরে হবে। তবে শুনেছি হায়াদারাবাদে ফলের দাম আরো সস্তা।

৬) এই শহরে সুলভ মূল্যে ভালো মানের পোষাক পাওয়া যায়। আমাদের দেশের মিডিয়াম কোয়ালিটির ১০০০/- টাকার শার্ট পিস এখানে ২০০ রুপি (মিটার প্রতি ৮০/ ১০০ রুপি)। আর দুই-আড়াই হাজার টাকার শার্ট পিস ৭৫০ রুপি। থ্রি পিস বা ফোর পিস তিন হাজারেরটা এখানে ৭৫০ রুপি। নরমাল থ্রি পিস ৫০০ রুপির নীচে। সাড়ে তিন থেকে চার হাজারেরগুলো এখানে ১৫০০ এর উপরে। বিভিন্ন দোকান ও মেগাশপগুলোতে প্রচুর ডিসকাউন্ট অফার পাওয়া যায়। যেমন- ভালো কোয়ালিটির দুটো জিন্স প্যান্ট ৮৫০ রুপি, ৩টি মিডিয়াম মানের হাফ শার্ট/ টি-শার্ট ৬৯৯ রুপি। আড়াই হাজারের ব্রান্ড শার্ট ৮৫০ রুপি। মিডিয়াম মানের শাড়ি ৫০০ রুপিতেও পাওয়া যায়। এখানকার ২ হাজার রুপির শাড়ির দাম বাংলাদেশে ৫-৬ হাজার টাকা পড়বে। তবে ছেলেদের শর্টসের দাম অন্যান্য পোশাকের তুলনায় বেশী। এই শহরের বিখ্যাত সিল্কের নাম- মাদার শাহ (কেউ বলে মাদারসা) সিল্ক, মুসলিম মেগাশপ। এক নামে এই বিশাল শপ সবাই চেনে। এরা নিজেরা নারী-পুরুষ সবার জন্যে কাপড় উৎপাদন করে, নিজেরাই বিক্রি করে। তবে যতটুকু জানি হায়দারাবাদ শহরে পোষাকের দাম আরো অনেক অনেক কম।

৭) তামিলরা খাবারে প্রচুর মশলা খায়। এ যেন আপনার পাতে মশলার এক জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে। কিছুটা ঝালও খায় এরা। প্রায় সব খাবারের সাথেই আপনাকে টকের একটা পদ আলাদাভাবে দেবে। ভেজিটেরিয়ান ও নন-ভেজিটেরিয়ান হোটেল রয়েছে। তবে খাবারের ক্ষেত্রে আমাদের রুচির সাথে প্রায় যাবেই না, মানিয়ে নিতে হবে।

৮) বলা হয়ে থাকে যে, পুরো ভারতের সেরা চিকিৎসা হয় চেন্নাইতে, ভারতীয়রাই বলে। বাংলাদেশের অনেকেই এই শহরে চিকিৎসা নিতে আসেন, তবে খরচ পড়ে প্রচুর। আমাদের দেশের মতোই চিকিৎসা শেষে এক্সট্রা বিল চার্জ করবে, অনেক হিডেন চার্জ থাকবে। তবে চেন্নাইতে চিকিৎসা করাতে হলে, আপনাকে হয় তামিল জানতে হবে, নয়তো ইংরেজীতে মোটামুটি কথা বলতে পারে এমন কাউকে লাগবে। আর আপনি নিজে ইংরেজী বলতে পারলে তো কথাই নেই।

৯) কালো মানুষের মন ভালো। চেন্নাইতে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ পেয়েছি। এই শহরের মানুষগুলোর ব্যবহার অমায়িক। যেমন আপনি কোথাও যেতে চাইছেন, কিন্তু কোন বাসে যাবেন খুঁজে পাচ্ছেন না? এরা নিজে না জানলেও আরেকজনের সাথে আলোচনা করে বাসে উঠিয়ে দেবে। এমনও হয়েছে যে, আমরা যে বাসে উঠেছি সেটা আমাদের গন্তব্যের পুরোটা যায় না। তখন কন্ডাক্টর সেই গন্তব্যে ফোন করে, শিউর হয়ে, বিস্তারিত জেনে সহজ পথ খুঁজে দিয়েছে। তামিলরা খুব সাধারণভাবে চলাফেরা করে, অহেতুক দেমাগ বা ‘আমি কি হনু রে’- এই ভাবটা এদের মাঝে দেখিনি। কোন কোন আংকেলকে লুঙি পরেও শহরের মাঝে ড্যা ড্যা করে বাইক চালাতে দেখেছি। আরো দেখেছি বুড়ি কে পেছনে বসিয়ে বুড়ো দাদু মহানন্দে স্কুটি চালাচ্ছে। আমরা মুসলিম- এটা জেনে এখানকার মুসলিমদেরকে খুশি হতে দেখেছি, সালাম দিতে দেখেছি। একটু হাসিমুখে কথা বললে বড়োই খুশি হয় এই শহরের সাধারণ লোকেরা।

♣ শেষ কথাঃ ছিমছাম এই শহরটা আমার ভালো লেগেছে, শুধু তামিল মেয়েদের ওরনাবিহীন চলাফেরা ও তরুন-তরুনীদের ফ্রি মিক্সিং ছাড়া। হয়তো এই পরিবেশে, এই সংস্কৃিতেই ওরা বেড়ে উঠেছে। তবে এই শহরেও আমি পূর্ণ হিজাবী-নিক্বাবী দেখেছি। এটা প্রমান করে দেয় যে, ইচ্ছে থাকলে সবই সম্ভব। যদি সত্যিই আপনার মনে আল্লাহর বিধান মেনে চলার ইচ্ছে থাকে, Allah will make a way for you.

♥ শেষের পরের কথা…
কে জানে, একদিন হয়তো কোন এক তামিল কালো মায়াবতী নিক্বাবীর বাঁধনে নিজেকে বেঁধে এই শহরেই থেকে যাবো…! তবে নিজ দেশের প্রতি, নিজ মাতৃভূমির প্রতি আলাদা একটা টান সবসময় থেকেই যায়, দেশটা যেমনই হোক না কেনো।

জানুয়ারী ২০১৯,
পুরাসাওয়াকাম, চেন্নাই, তামিল নাডু।

আমার চোখে চেন্নাই শহরঃ রিভিউ- ০১

আমি পথের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি, সামনে সীমাহীন জল-সমুদ্দুর, এখানেই পথের শেষ…। অনেকটা পথ হেঁটে এসেও, হয় নি দেখা তোমার সাথে।

ভারতের তামিল নাডু রাজ্যের চেন্নাই শহরে এসেছি গত কয়েক দিন হলো। এই কয় দিনে যেসব অভিজ্ঞতা পেলামঃ

১) স্থানীয়রা সাধারণত তামিল ভাষায় কথা বলে, হিন্দিতে না। হিন্দি ওরা বলতেই চায় না। বেশীরভাগকেই হিন্দি/ ইংরেজীতে প্রশ্ন করলে উত্তরে তামিল বলে। তবে উচ্চ শিক্ষিত/ তরুণদের ইংরেজী ভাষায় প্রশ্ন করলে সুন্দর করে জবাব দেয়।

২) ড্রাইভারদেরকে ভাষা বোঝানো কষ্টকর। কখনো কখনো এরা বিদেশী পেলে আকাশ-পাতাল ভাড়া চেয়ে ঠকায় না, আবার মাঝে মাঝে অনেক বেশীও চায়।

৩) কোলকাতা, চেন্নাই সব জায়গায় শতকরা ৮০% নারীই বুকে ওরনা পরে না, হোক সে বুড়ি বা ছুড়ি। সে জন্যে রাস্তায় দৃষ্টি সংযত রেখে হাটা মুশকিল। প্রচুর মেয়েরা স্কুটি চালায়। তবে স্কুটি চালানোর সময় এরা প্রচন্ড রোদের প্রকোপ থেকে বাঁচতে ওরনা দিয়ে মুখ ও হাত ঢেকে রাখে (নিকাবের মত)।

৪) খাবার বাংলাদেশের সাথে ৯০% ই অমিল। বিরিয়ানির চেয়ে ভাতের দাম বেশী। যেখানে বিফ বিরিয়ানি ৭৫ রুপি, সেখানে খালি সাদা ভাত (মাছ/ গোশত ছাড়া) ই ৬৫ থেকে ৯০ রুপি (দোকানের মানভেদে ৪০ রুপিও রয়েছে)। তবে ভাতের সাথে তিন-চার পদের সবজি ফ্রি। চিকেন বিরিয়ানি ১০০ রুপি। গোশতের চেয়ে মাছের দাম বেশী। হোটেলে দেখলাম মানুষ বিরিয়ানি, ভেজিটেবল, চিকেন এগুলোই বেশী খায়। শতকরা ৯৯% হোটেলে কলাপাতায় করে খাবার দেয়া হয় এবং নীচে স্টীলের প্লেট দেয়। থালা-বাটি, বাসন-কোসন সব স্টীলের, মেলামাইন বা কাঁচের কিছুই দেখলাম না।

৫) কলরেট সুলভ মূল্যে ও ইন্টারনেট সহজলভ্য। উচ্চগতির ইন্টারনেট। ভোডাফোনে ২৫০ টাকায় ২৮ দিনের পাওয়ার প্যাক কিনলে, পুরো ইন্ডিয়া জুড়ে যত মিনিট কথা বলতে চান, কল চার্জ ফ্রি+ প্রতিদিন দেড় জিবি করে ডাটা। এয়ারটেলেও এরকম সুলভ পাওয়ার প্যাক রয়েছে।

৬) চেন্নাই শহরটি ছিমছাম। চমৎকার বাড়িঘর, ওল্ড টাউনে তিন চার তলার বেশী উঁচু বাড়িঘর একদম কম। রাস্তাঘাট বেশ পরিস্কার। প্রচুর গাড়ির ফ্লো আছে, বাট জ্যাম নেই বললেই চলে। সবাই ট্রাফিক সিগনাল মেনে চলে, কারন সিসি ক্যামেরা ফিট করা থাকে।

৭) বেশীরভাগ মানুষের গায়ের রঙ বাংলাদেশীদের চেয়ে কালো। মুসলিমরা বাদে আর সব পুরুষরা বিশাল গোঁফ রাখে ও কপালে তিল-চন্দন দেয়। গোঁফে এদেরকে বিশ্রি লাগে আমার কাছে। কিন্তু এটাই হয়তো ওদের কাছে ভালো লাগে।

৮) চেন্নাই সমুদ্র তীরবর্তী শহর। শহরের কোল ঘেঁষে বিশাল মেরিনা সী বীচ। কিন্তু বীচে প্রচুর মানুষ যায় এবং আমাদের কক্সবাজারের মতই বীচ অতটা পরিস্কার নয়। তবে সিকিউরিটির সমস্যা তেমন নেই বলে ধারনা করছি।

________________________
জানুয়ারী, ২০১৯
পুরাসাওয়াকাম, চেন্নাই, তামিল নাডু।

পর্যটকের ডায়েরীঃ ইন্ডিয়াতে ট্রেনে ভ্রমণ (শেষ পর্ব)

দ্বিতীয় পর্বের পর…
সকাল হয়েছে। ধীরে ধীরে জেগে উঠলো সবাই। ট্রেনেই বেসিনে হাত মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা ছিলো। একটু সকাল হতেই ট্রেনের বিশেষ বেয়ারা আসলো নাস্তার অর্ডার নিতে। অবশ্য আমরা সকালবেলার নাস্তা আমাদের সাথে থাকা সুস্বাদু বিস্কেট, পাওরুটি, শুকনো খাবার, চিপস, কলা ইত্যাদি দিয়েই সেরে ফেললাম, এবেলা আর ট্রেনের খাবার খাই নি। নাস্তার সময় ভারতীয় দিদিমনিকে খাবার সাধলাম। উনি প্রথম বারেই নিঃসংকোচে খাবার নিলেন। একটুপর উনিও শুকনো খাবার বের করলেন। পিঠে জাতীয় এক ধরনের প্যাঁচানো শুকনো খাবার আমাকে সাধলেন। এবার আমি বিপদে পড়লাম। গতরাতে তার দেয়া খাবার নেই নি, অথচ সকালে উনি আমারটা নিয়েছেন। এবার না নিলে খুব দৃষ্টিকটু হয়ে যায়, তাই নিলাম। বন্ধুবর তো রেগে গিয়ে মাতৃভাষায় বলেই ফেললো- কেন নিলি? যদি কিছু মিশিয়ে দেয়? আমি শুকনো পিঠে চিবুতে চিবুতে বোঝালাম- এবার আর না করাটা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তাকেও শুকনো পিঠে দিলাম। বাহ! এবার দেখি বন্ধুবরও পিঠে চিবুচ্ছে।


পাহাড়ি এলাকায় ট্রেন থেকে মোবাইলে তোলা ছবি।

ওদিকে মাঠ-ঘাট-জনপদ-প্রান্তর বেয়ে ট্রেন অবিরাম ছুটে চলছে। এ ছোটার যেন শেষ নেই। রেললাইনের দু’পাশে বিস্তৃত খালি প্রান্তর পড়ে রয়েছে। খালি প্রান্তের মাঝে ফসলি জমি আর কৃষকের বাড়িও রয়েছে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম এবং শহরতলী পেরিয়ে যাচ্ছি। বার কয়েক ট্রেনের দরজা খুলে দাঁড়ালাম। কিন্তু এত জোরে ট্রেন চলছে যে, দাঁড়ানোটা বেশ বিপদসংকুল মনে হলো। মাঝে মাঝে কোন কোন ইস্টিশনে মাত্র দুই-এক মিনিটের জন্যে ট্রেন থামছে। নানান ভাষার মানুষ উঠছে, আবার অনেকেই নামছে। পুরো কামরা জুড়ে ভারতীয়রা নিজ নিজ প্রদেশের ভাষায় গল্প করছে। মজার ব্যপার হলো ভারতের এক প্রদেশের মানুষ আরেক প্রদেশের ভাষা তেমন একটা বোঝে না। তাই খুব প্রয়োজন না হলে, তাদেরকে অপরিচিতদের সাথে কথা বলতে দেখলাম না। হয়তো এক দেশে থেকেও এদের কাছে অপর প্রদেশের মানুষকে ভিনদেশী অনুভব হয়। অপরিচিতদের সাথে পারস্পারিক যোগাযোগের সময় এরা সাধারণত হিন্দি ব্যবহার করে। একসময় বড় একটি স্টেশনে ট্রেনটি থামলো। সে সময় আমাদের পানির খালি বোতল স্টেশন থেকে ভরে নিলাম।

দুপুর বেলায় ট্রেনের বেয়ারা খাবারের অর্ডার নিতে আসলো। এই ট্রেনে ভাত, মুরগি, ডিম, ডাল সহ বিভিন্ন পদের খাবার পাওয়া যায়। যেহেতু আল্লাহর নামে জবাই না করা পশুর গোশত খাওয়া মুসলিমদের জন্যে নিষিদ্ধ, তাই আমাদেরকে ‘ডিম-ভাত’ এর প্যাকেজই অর্ডার করতে হলো। প্রায় দেড়-ঘন্টা পর বেয়ারা একে একে সবার খাবার দিয়ে গেলো। খাবার দেয়া হয়েছে ওয়ানটাইম ট্রে তে করে। ট্রে টা মূলত খোপ খোপ সিস্টেমের। দেখলাম এক খোপে সাদা ভাত, আরেক খোপে ডাবল ডিমের তরকারি, একটাতে ডাল, একটাতে ছোট কালো মিস্টি রয়েছে। খাবারের সাথে ওয়ানটাইম চামচ এবং এক প্যাকেট পিকল দিলো। খাবার দেখতে ভালো হলেও খেতে হোস্টেলের খাবারের বিস্বাদই লাগলো। দম চেপে খেয়ে নিলাম। বাঙালি খাবারের সেই চিরচেনা স্বাদের জন্যে জিহ্বাটা যেন হাহাকার করে উঠলো।

মাঝখানের এক জংশনে ট্রেনের এঞ্জিন বদল করা হলো। দুপুর পেরিয়ে সূর্য্যি মামা বিকেলের দিকে এগুচ্ছে। ঝিক ঝিক করে ট্রেন চলেছে পাহাড়ী পথ ধরে। দু’পাশ জুড়ে বিশাল পাহাড় এবং উপত্যকা শুয়ে রয়েছে। মাঝে মাঝে পাহাড়ের পাদদেশে চমৎকার সব জনপদ দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের কোল ঘেষে নানা রঙের ছোট ছোট বিল্ডিং ছড়িয়ে রয়েছে। পশ্চিম দিগন্ত হতে সূর্য্যি মামা তার নরম-কোমল রোদ ঢেলে দিচ্ছে জনপদের উপর। আমার মন চাচ্ছিলো সব ছেড়ে নেমে যাই এই ছোট্ট জনপদে। ছোট্ট একটি ঘরে ঠাঁই নেই এবং এখানেই পাহাড়ের কোলে থেকে যাই।

দিন গড়িয়ে রাত নেমেছে, চিরচেনা একরাশ আঁধার নিয়ে। বাইরের কালো আঁধারের দিকে তাকালে বুকের মাঝে যেন এক বিশাল শূণ্যতা হাহাকার করে উঠে। একেলা আমি, আর এই আমার ছুটে চলা, জীবনের টানে।

রাতে ভারতীয় দিদিমনি আমাকে তার ভাষায় কি যেন জিজ্ঞেস করলেন। ইশারায় বোঝালাম- বুঝি নি। তারপর দিদিমনি বললেন- মাম্মি, ড্যাডি? বুঝলাম আমার সাথে বাবা-মা কেন নেই, তারা কোথায়- সেটা জানতে চাচ্ছে। তখন চেন্নাইতে কেন যাচ্ছি, সেটা ইশারা ইংগিতে বোঝালাম। কতটুকু বুঝলো আল্লাহ মা’লুম। সন্ধ্যা পেরুতেই বেয়ারা রাতের খাবারের অর্ডার নিতে এলো। এবার ডিম আর চাপাতি (পরোটা) অর্ডার দিলাম। কিন্তু রাতের খাবারের এই প্যাকেজে চাপাতি, ভাত, ডিমের তরকারি, ডাল, পিকল ও মিস্টান্ন ছিলো। একটা জিনিস বুঝলাম, খাবারের পর মিস্টান্ন খাওয়াটা ভারতীয় ঐতিহ্যেরর অংশ। রাত ক্রমশ বেড়েই চলছে। গত রাতের মত সবাই তৈরি হচ্ছে ঘুমানোর জন্যে। একসময় আমরাও বিছানা করে নিলাম। খুব ভোরে ট্রেন পৌঁছবে চেন্নাইতে, তাই বেশী রাত না করে শুয়ে পড়লাম।

তবে গত রাতের মতোই ট্রেনে খুব একটা ঘুম হলো না। ভোররাতে বন্ধুবর আমাকে ডেকে তুললো। চোখ মেলে দেখি চেন্নাইয়ের কাছাকাছি চলে এসেছি প্রায়। ট্রেন গতি কমিয়ে দুলকি চালে এগিয়ে চলছে। দাঁত ব্রাশ করে হাত মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে বসলাম। প্রায় ঘন্টাখানেক পর ভোর চারটার দিকে আমাদের ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি ‘চেন্নাই সেন্ট্রাল রেল স্টেশনে’ প্রবেশ করলো। দীর্ঘ ২৮/ ২৯ ঘন্টার ট্রেন যাত্রা শেষ হলো। এটিই ছিলো ট্রেনটির শেষ স্টেশন। ধীরে সুস্থে ট্রেন থেকে নামলাম। এরপর প্ল্যাটফর্মে বসে রইলাম আরো এক ঘন্টা। অচেনা দেশ, তাই আলো ফোটার আগে হুট করেই স্টেশনের বাইরে বের হলাম না। ভোরের অপেক্ষায় ঘুম জড়ানো চোখে বসে আছি আমরা দু’জন। অপেক্ষায় আছি এক অচেনা শহরের সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে। (সমাপ্ত)

পরবর্তীতে আসছে: আমার চোখে চেন্নাই শহর

পর্যটকের ডায়েরীঃ ইন্ডিয়াতে টেনে ভ্রমণ (পর্ব ০২)

প্রথম পর্বের পর…
রাতে শোয়ার জন্যে ট্রেন কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে বালিশ, ধবধবে সাদা চাঁদর আর কম্বল দিয়েছিলো। বিছানাও ইতিমধ্যে তৈরি করে ফেলেছি। সবাই শোয়ার জন্যে তোড় জোড় করছে। অন্ধ্র প্রদেশের যে গ্রামীন দম্পত্তি (দেখে গ্রামীনই মনে হয়েছিলো) আমাদের সহযাত্রী ছিলেন, তারা দেখলাম নিজেদের ভাষায় জোরে জোরেই কথা বলছেন। কিন্তু এক বর্ণও বুঝি নি। একটু পর দিদিমনি (ভদ্রলোকের স্ত্রী) শুকনো খাবার বের করলেন। আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন বললেন আর খাবার সাধলেন। বারবার অনুরোধ করতে লাগলেন, খাবার নিতে। কিন্তু নিলাম না। বন্ধুবরও উপরের টায়ার থেকে ইশারা দিচ্ছে- নিস না, নিস না, খবরদার নিস না। যাইহোক পেটে ইশারা করে ভদ্রমহিলাকে বোঝালাম আমরা ঠেসে খাবার খেয়ে এসেছি। ইংরেজীতে বললেও তারা তেমন একটা বুঝেই না বলতে গেলে।

ভাব বিনিময়ের মাধ্যম ভাষা এক না হলে কি যে সমস্যা, তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। তারা তাদের ভাষায় বিভিন্ন কথা জিজ্ঞেস করে। আমি কখনো ইংরেজীতে বলি যে, তোমাদের কথা বুঝি না, কখনোবা ঠোঁট উল্টিয়ে হাতের ইশারায় বোঝাই- কি যে বুঝি না, তাও বুঝি না। যাইহোক ট্রেন ছাড়ার প্রায় দেড় ঘন্টার মধ্যেই সবাই শুয়ে পড়লো। কিন্তু ট্রেনের প্রচন্ড দুলুনিতে আমার তেমন একটা ঘুম হলো না। বারবারই মনে হচ্ছিলো যে, উপরের টায়ারের (শোবার সীট) শেকল ভেঙ্গে যাত্রী দুজন আমার ঘাড়ে এসে পড়বে অথবা প্রচন্ড দুলুনির চোটে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে যাবে। সারা রাতে মনে হয় ২ ঘন্টার মত ঘুম এসেছিলো। অথচ প্রচন্ড দুলুনিতেও ইন্ডিয়ানরা দেখলাম চোখ বুজে আরামে ঘুমুচ্ছে।

পরদিন খুব সকালে ঘুম জড়ানো আধো আধো চোখ মেলে দেখলাম- দিদিমনি মাঝের টায়ার (শোবার সীট) থেকে নেমে নীচের টায়ারে স্বামীর কম্বলের নীচে ঢুকলেন। হয়তো পরম আদরের স্বামীর উষ্ণ বুকে আশ্রয় খুঁজে নিলেন। বুঝলাম দু’জনেই দুটো পাখির ছানার মতো গলাগলি করে উষ্ণতা নিচ্ছেন। কি ঘটছে টের পাওয়া মাত্রই আমি লজ্জ্বায় চাঁদরের নীচে মাথা ঢুকিয়ে চুপচাপ পড়ে রইলাম….

♥ “তুই কাছে আয় দেখি, আয় একবার,
মুখ তোর রাখ্ দেখি বুকেতে আমার!
দেখি তাহে এ হৃদয় শান্তি পায় যদি!
কে জানে উচ্ছ্বসি কেন উঠিতেছে হৃদি!
দেখি তোর মুখ খানি, সখি তোর মুখখানি,
বুকে তোর মুখ চাপি, কেন, সখি, কেন
সহসা উচ্ছ্বসি কাঁদি উঠিলিরে হেন?” ♥
(-ভগ্নহৃদয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

আরো কিছুক্ষন পর বিছানা থেকে উঠে দেখি ট্রেন দুলকি চালে ধীরে ধীরে চলছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাইরে ভালোই কুয়াশা পড়েছে। কোন প্রদেশে আছি ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না। বাইরে ঠান্ডা আর ভেতরের এসির কারনে বেশ শীত করছিলো। পুরো কামরাকে মনে হচ্ছিলো যেন এক লাশের ঘর। সবাই সাদা চাদর মুড়ে দিয়ে ঘুমুচ্ছে। এ যেন ডিপ ফ্রিজের তাকে তাকে সাজানো লাশের সারি। বেশ ভুতূড়ে লাগছে দৃশ্যটা। অবশ্য লেখক মন নাকি সবকিছুকেই খুঁটিয়ে দেখে। খুব সাধারণ দৃশ্যও তাদের কাছে অসাধারণ লাগে। আমি ভালো লেখক নই, তবে ছোট্ট একটি লেখক মন আছে, এই যা…।

(চলবে… )

পর্যটকের ডায়েরীঃ ইন্ডিয়াতে ট্রেনে ভ্রমন (পর্ব ০১)

গত জানুয়ারী মাসে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছিল জীবনের দীর্ঘতম ট্রেন ভ্রমনের। ব্যক্তিগত জরুরী একটি কাজে ঢাকা থেকে কোলকাতা হয়ে চেন্নাই যেতে হয়েছিল। ট্রেন ভ্রমনের সেই অভিজ্ঞতাই তুলে ধরছিঃ
ভারতের শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষই দূরের যাত্রায় ট্রেনে চলাচল করে। বিস্তৃত এই দেশের রেলওয়ে ব্যবস্থাপনাও ব্যাপক পরিসরের। ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক বাসে কোলকাতার মারকুইস স্ট্রীটে পৌঁছানোর পর, চেন্নাই যাবার জন্যে রেলওয়েই বেছে নিলাম। অবশ্য কিভাবে যাবো তার প্ল্যান দেশ থেকেই করা ছিল। প্ল্যান ছিল কোলকাতায় একদিন থাকবো, কারন ভারতে দিনের টিকেট দিনে পাওয়া খুব কঠিন। কিন্তু আল্লাহ সহায় ছিলেন বলে, সেদিন রাতের “চেন্নাই এক্সপ্রেস” ট্রেনের টিকেট পেয়ে গেলাম। সময় লাগবে ২৮ ঘন্টা, পথের দুরুত্ব ১৭০০ মাইল। আমার ভ্রমন সাথী ছিলো আমারই এক বন্ধুবর।

দুপুর একটায় কোলকাতায় পৌছেছিলাম, আর ট্রেন ছাড়ার সময় ছিলো রাত সোয়া এগারোটায়। মাঝের এই সময়টুকু কোলকাতা শহরে ঘুরে ফিরেই কাটালাম। ভারতীয় ট্রেনের টিকেট সাধারণত ৩ ধরনের হয়। কিছু টিকেট আগে থেকেই ছাড়া হয়। কিছু টিকেট যেদিন ট্রেন যাবেন, সেদিন সকালে ছাড়া হয়- এ টাইপ টিকেটের নাম- তৎকাল টিকেট। আর কিছু টিকেট ‘রিজার্ভড/ সংরক্ষিত’ (সৈনিক, বিদেশী ইত্যাদি কোটার)। অনলাইন ও রেলওয়ে স্টেশন থেকে- দুই ভাবেই টিকেট কাটা যায়। স্টেশনে টিকেট পাওয়া কঠিন, তাই অনলাইনেই টিকেট কিনেছিলাম। যেহেতু আমাদের ইন্ডিয়ান বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট কার্ড নেই, তাই একটা ট্র্যাভেল এজেন্সির মাধ্যমে টিকেট কেটেছিলাম। ওরা নির্দিস্ট রেটের চেয়ে ৩০০/ ৫০০ রুপি বেশী রাখে। তবে কোলকাতা হলো চিটারদের শহর। এই শহরের মানুষ যে কি পরিমান চিটার, তা আপনার ধারনারও বাইরে। তাই আপনাকে কয়েকটা ট্রাভেল এজেন্সি ঘুরে, টিকেটের আসল দাম জেনে, দরদাম করে টিকেট কাটতে হবে।

গরুর গোশত দিয়ে পেট পুরে রাতের খাবার খাওয়ার পর (গরুর গোশতের কেজি ১৫০ রুপি মাত্র), ট্যাক্সিতে করে হাওড়া স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। স্টেশনে পৌঁছে দেখি- সে এক এলাহি কারবার! সুবিশাল স্টেশন, হাজার হাজার মানুষে ঠাসা। বিভিন্ন ভাষাভাষির মানুষ (ভারতে প্রায় ৫০টির মত ভাষা আছে, অফিসিয়ালি সম্ভবত ১৮ টার মত)। কেউ বসে আছে, কেউবা পরিবারসহ বিছানা বিছিয়ে শুয়ে আছে। ট্রেন আসছে-যাচ্ছে, মানুষ বিভিন্ন ভাষায় কোলাহল করছে, গমগম করছে পুরো স্টেশন। ভারতের অনেক স্টেশনেই দেখলাম গুগল হাই স্পীডের ফ্রি ওয়াইফাই সেবা দিয়ে রেখেছে। স্টেশনে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা আছে। আমরা প্রায় এক ঘন্টা আগে পৌছেছি।

স্টেশনে বসে যখন আড্ডা দিচ্ছিলাম, তখন ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর একজন যাত্রীর সাথে আলাপ হলো। সে বাংলা বোঝে না, আমি আবার হিন্দি বুঝি না। তাই আলাপটা ইংরেজীতেই করতে হলো। তবে আলাপ খুব বেশি জমলো না, কারন সে ইংরেজী বুঝলেও খুব বেশি বলতে পারে না। তবে সে ছিল একদম অল্প বয়েসের। আমি বিদেশী এটা জানার পরও বোকার মত, অথবা নিজেকে জাহির করতে গিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলো- আমার পাসপোর্ট আছে কিনা? আমি পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম- পাসপোর্ট না থাকলে সীমান্ত পেরিয়ে আমি এখানে কিভাবে এলাম (তোমাদের কাস্টমস-বিএসএফ কি আমার খালু)? বেচারা সেখানেই লা-জবাব।

ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢোকার বেশ আগেই দেখলাম প্ল্যাটফর্মের একটা বিশাল নোটিশবোর্ডে যাত্রীদের তালিকা আটকে দেয়া হলো। অনেক খুঁজে আমাদের নাম বের করে নিশ্চিত হলাম- আমরা যাচ্ছি। নির্দিস্ট সময়ের আগেই ট্রেন প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করলো। দুপুর থেকে এ পর্যন্ত কয়েক জন বাংলাদেশীর সাথে পরিচয় হয়েছিলো, তারা যাবে ভেলোরে (চেন্নাই থেকে প্রায় ৫০০ কি.মি পরে)। একই সাথে টিকেট কেটেছিলাম আমরা। যাহোক ট্রেন ও বগি নাম্বার মিলিয়ে উঠে পড়লাম সবাই।

চেন্নাইতে যাবার সময় আমরা ‘থ্রি টায়ার’ টিকেট কেটেছিলুম। ‘থ্রি টায়ার’ মানে কামরার প্রতি সাইডে ৩টি করে শোবার বিছানা। নীচে একটি, মাঝে একটি এবং উপরে একটি। আমার সীট পড়েছে ডানপাশের নীচের টায়ারে আর বন্ধুবরের বাম পাশের নীচের টায়ারে। কিন্তু আমাদের সহযাত্রী ছিলো অন্ধ্র রাজ্যের এক দম্পত্তি। স্বামী ভদ্রলোকটি বন্ধুবরকে অনুরোধ করলো যাতে সে নীচের সীট ছেড়ে একদম উপরের সীটে যায়। এতে করে উনারা স্বামী-স্ত্রীর নীচের ও মাঝের- এই দুটোতে শুতে পারবেন। উনার ভাষা তেমন বুঝি নি, তবে ইশারা ইঙ্গিতে বুঝেছি। ভদ্রলোকের অনুরোধ রাখা হলো।

একদম নির্দিষ্ট টাইমে ট্রেন ছেড়ে দিলে, নো লেট। দেখলাম বাংলাদেশী ট্রেনের তুলনায় প্রায় তিনগুন স্পীডে চলছিল ট্রেনটি। যতটুকু জানি, ভারতের বেশীরভাগ ট্রেনই ইলেক্ট্রিসিটিতে চলে। রেল লাইনের পাশ দিয়ে শত শত মাইল জুড়ে ইলেক্ট্রিসিটির লোহার থাম। রেললাইনের উপরে ঝুলে থাকা তার হতে বিদ্যুত আহরন করে সজোরে চলছে ট্রেনটি। রাতের আঁধারে জানালার কাঁচ দিয়ে বাইরের দৃশ্য অস্পষ্ট লাগছে। অচেনা প্রান্তর বেয়ে ছুটে চলছি…। (স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ছেলে বেলার সেই ছড়াটা মনে পড়ছে… )

ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে অই।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই ?

একটু জিরোয়, ফের ছুটে যায়
মাঠ পেরুলেই বন।
পুলের ওপর বাজনা বাজে
ঝন ঝনাঝন ঝন।

দেশ-বিদেশে বেড়ায় ঘুরে
নেইকো ঘোরার শেষ।
ইচ্ছে হলেই বাজায় বাঁশি,
দিন কেটে যায় বেশ।

থামবে হঠাৎ মজার গাড়ি
একটু কেশে খক।
আমায় নিয়ে ছুটবে আবার
ঝক ঝকাঝক ঝক।

(চলবে… )

পাহাড়ের রহস্য

পাহাড়ের রহস্য আর নারীর রহস্য একেবারেই এক রকম মনে হয়। প্রতিজন নারী একই মাটির তৈরী কিন্তু প্রতি জনকেই নতুন রকম রহস্যময় মনে হয়। দশ মিনিট নিঝুমভাবে উঁচু পাহাড়ের এক কোণায় গিয়ে বসে সমীকরণ মেলাবার চেষ্টা করেছি ! মহান আল্লাহর অপার সৃষ্টি এক এই প্রকৃতি !

উপর থেকে দাড়িয়ে নীচের দিকে তাকালে সব গাছ, ফুল, লতা, প্রেম কাঁটা, পাখি, বাতাসের বিচরণ, মেঘ সব একই রকম দেখাবে কিন্তু ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ সারাদিন তীব্র রোদেও একই স্বরে বাজার সময় যেমন শব্দে তারতম্য হয় তেমনি পাহাড়ের রহস্যেও ঢেউটি লাগে খুব প্রগাঢ়ভাবে। নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে কুমারী মেয়েদের মত শারিরীক কার্ভ দেখানো প্রতিটি বৃক্ষই আমাকে বলেছে মাটির মায়া লাগানো গন্ধের কথা। খেয়াল করলাম ওদের বন্ধনে যাতে ভাগ না বসাতে পারে সেজন্য ওরা খাড়া হয়ে নীচে নেমে ভেতরের দিকে খাঁজ করে নিতেই বেশী পছন্দ করে আর এ কারণেই পাহাড় আরও খাড়া হতে থাকে। বিস্ময়কর এক ভয় কাজ করে আমার মধ্যে নীচের দিকে নামার সময়। পাহাড়ের নাভীমূলের কম্পনের সাথে নারীর নাভীমূলের কম্পনের কোন দূরুত্ব নেই। সরল রৈখিক প্রতিটি সম্পর্ক যেমন একে অপরকে আবৃত করে রাখে তেমনি পাহাড়ও তার পুরো শরীর জুরে জড়িয়ে রেখেছে নানান জাতের বৃক্ষ আর বৃক্ষের বন্দনা।

এখানে বৃক্ষের বন্দনা হল কচি ফুল আর লতানো গাছ। পাহাড়ে যারা গিয়েছেন তারা দেখে থাকবেন পাহাড়ের খুব উঁচুতে তা।

কি সরল ! আমরা যত উপরে উঠি তত গরল হই কিন্তু এখানে মানুষের সাথে পাহাড়ের বড় পার্থক্য। একেবারে মাথায় পাহাড়গুলো কখনই সমতল হয়না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা চায় প্রতিটি বিন্দুই উপরে উঠে যাক, প্রতিটি বিন্দুই আকাশ ছুঁয়ে দেখুক, মেঘ ছুঁয়ে দেখুক ! এই নমনীয়তাই পাহাড়কে জলের ঝিড়ি দেয়, এই সার‌ল্যতাই পাহাড়কে জলপ্রপাত দিয়ে নারীর মত মমতার আশ্রয় হিসেবে প্রদর্শিত করে !

দশ মিনিটের পাহাড় দেখায় আরেকটি বড় উপলব্ধি ছিলো পাহাড়ে সবসময়ই জীবন্ত জল বিচরণ করে। মেঘ আর কুয়াশার পাশাপাশি এ জীবন্ত জলগুলো যে বাতাস সৃষ্টি করে তাতে আপনার মন নিশ্চিত নরম হয়ে উঠবে কারণ এ বাতাসটুকুই হচ্ছে ভূপৃষ্ঠ থেকে উড়ে আসা সেই প্রেমিকের কান্নার বাতাস যে প্রেমিক চাতক পাখির মত বসে আছে তীব্র খড়ার পর বৃষ্টির মত হয়ে তার ভালোবাসার মানুষ তার কাছে ফিরবে এই অপেক্ষায়…

পাহাড় আর নারীর রহস্য কোনদিন উন্মোচিত হবে না তাই নদী ও নারীর যে সম্পর্ক ছিলো সে সম্পর্কে ভাগ বসানোর জন্য এখন পাহাড়কে আমন্ত্রন জানাতেই হবে আপনার !
বান্দরবানের নীলগিরি থেকে ফিরে…

একদিন জুহুতে নিনা গুপ্তা

উপরের ছবিতে টি শার্ট শর্টস পরিহিতা, এক হাতে পানির লম্বা একটি ফ্লাস্ক নিয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে হেঁটে চলেছেন যে ভদ্রমহিলা, তিনি সত্তর আশির দশকের হিন্দি সিনেমার নায়িকা নিনা গুপ্তা। না, খুব বিখ্যাত বা জনপ্রিয় নায়িকা ছিলেন না। চলচিত্রে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনও সাফল্য পাননি। এখন হয়তো টিভি নাটকে টুকটাক অভিনয় করেন, ঠিক জানা নেই। তিনি মূলত সে সময়ের বিখ্যাত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার ভিভ রিচার্ডসের সাথে বিশেষ একটি ঘটনার জন্য দুনিয়াজুড়ে ব্যাপক চর্চিত হন। উহু, থাক সেসব কথা। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ঘাটাঘাটি করা আমার লেখায় বিন্দুমাত্র প্রাসঙ্গিক নয়।

যাই হোক, সেদিন জুহু বিচ থেকে ফেরার পথে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম নিনা গুপ্তাকে, হাঁটছেন একাকী। নির্ঘাত সে সময় তিনি ব্যায়াম করতে যাচ্ছিলেন। হাতে পানির ফ্লাস্ক, পায়ে কেডস, পরনে শর্টস টি শার্ট দেখে অনেকটাই নিশ্চিত হই। সত্যি বলতে কি তাঁকে দেখে আমি দারুণ মুগ্ধ হয়েছিলাম। এখনও, এ বয়সেও তিনি অবিশ্বাস্য তারুণ্য ধরে রেখেছেন। মধ্য ষাটেও তাকে ঢের কমবয়সী দেখাচ্ছিল। বিস্মিত হয়েছিলাম। নির্ঘাত তিনি নিয়মিত শরীর চর্চা করে থাকেন নিজেকে এরকম ফিট রাখার জন্য। এখনও হালফিল বলিউড নায়িকাদের মতো জিরো সাইজের লিনথিন ফিগার, একবিন্দুও মেদ জমেনি শরীরের কোথাও। টানটান ক্ষুরধার শরীরে তাঁকে লাগছিল ঠিক যেন বছর পঁয়ত্রিশের কোনও তরুণী। যৌবন ঠিকরে বেরোচ্ছে শরীর থেকে। কে বলবে তাঁর বয়স পয়ষট্টি! যাই হোক তখন পড়ন্ত বিকেলে জুহুর সেই সুনির্জন সড়কে সামান্য কয়েকজন পথচারী ছিলো। ভাবলাম, মুখোমুখি তাঁর কিছু ছবি তুলে রাখি স্মার্টফোনে, কিন্তু সাহস হলো না। কে জানে, কি থেকে আবার কি হয়ে যায়, পাছে তিনি আবার না সিনক্রিয়েট করে বসেন, লাঞ্ছিত না হতে হয়! হা হা হা। সামনে থেকে না হলেও আমাকে অতিক্রম করার পর শখ করে তাঁর কয়েকটি ছবি তুলে রেখেছিলাম স্মার্টফোনের ক্যামেরায়। তারই একটি উপরে দেখতে পাচ্ছেন। আর এই নিনা গুপ্তাই একমাত্র সেলেব্রিটি যাকে আমি আমার পনেরো দিনের মুম্বাই ভ্রমণে দেখেছিলাম।

মুম্বাইয়ে ঝুম বৃষ্টির এক বিকেলে

মুম্বাইয়ে আন্ধেরির একটি হোটেলে বৃষ্টিতে আটকা পড়েছি। বিকেলবেলা। ঝুম বৃষ্টি। থামবার আর নাম নেই। কী বিড়ম্বনা! দুই গ্লাস কোকোম জুস খাওয়া হলো। মুম্বাইয়ে যেয়ে এই একটি জিনিসের প্রেমে পড়েছিলাম বললে ভুল হবে না, কোকোম জুস। খেয়েছিও প্রাণভরে। ওই বিশেষ হোটেলটা তো আছেই। এছাড়াও স্টেশনের প্লাটফর্ম, বিভিন্ন ছোটো রেস্টুরেন্ট, ফুটপাতের ভ্রাম্যমাণ দোকান যখন যেখানে পেয়েছি, প্রাণভরে পান করেছি। প্রতিদিন গড়ে আনুমানিক দুই লিটার কোকোম জুস খেতাম। ওখানে খুব প্রচলিত এই জুস। সর্বত্র পাওয়া যায়। খেতে কেমন যেন ঝাল ঝাল, দারুণ ভালো লাগে। ওই হোটেলে বিশ রুপি ছিলো দাম। অল্প কদিনেই হোটেলটা আমার খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল। আন্ধেরি রেল স্টেশনের পাশেই। খুব সম্ভবত বাড়ির উঠোনকে হোটেল বানানো হয়েছে। একেবারেই নিরিবিলি শান্ত ঘরোয়া পরিবেশ। অনেকটা ছোটো একটি খোলা মাঠের মতো। মুম্বাই থাকাকালীন খুব গিয়েছিলাম। প্রত্যেকদিন একবার হলেও যেতাম। জুস, কফি, পোহা, বড়া পাও ইত্যাদি খেতাম। সুন্দর কিছু সময় কেটেছে। আর সে সব আজ আনন্দদায়ক স্মৃতি হয়ে আছে। থাকবেও জীবনভর।

যাই হোক প্রায় ঘন্টা খানেকের মতো বৃষ্টি চললো একটানা। তারপর কিছুটা কমে এলে বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে। এ সময় আন্ধেরি স্টেশনে যাবার পথে কিছুক্ষণ হেঁটেছি মাত্র, আবার বৃষ্টি শুরু হলো। ঝুম বৃষ্টি। কী যে বিড়ম্বনা! কয়েকজন মানুষের সাথে পাশের একটি দোকানের ছাদের নিচে কোনও রকমে দাঁড়ালাম। কিছুকাল কেটে গেলো। বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই। থামবার আর নাম নেই। বিরক্তি চরমে পৌছেছে। এ সময় পাশের একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোককে দেখলাম, কনুই দিয়ে আমার কোমরে গুতো দিল।
‘কী ব্যাপার?’ বিরক্তির সাথে জিজ্ঞেস করলাম। ‘ওরকম করলেন কেন?’
‘ওই যে দেখুন।’ জবাবে বললো সে।

তার ইশারার নির্দেশীত স্থানে দেখলাম, একজন মধ্যবয়স্ক লোক ডান্ডা বিহীন অদ্ভুত একটি ছাতা হাতে নিয়ে বেশ বেকায়দায় ছোটাছুটি করছে সড়কে। হয়তো সুনির্দিষ্ট কিছু খুঁজছিল। হা হা হা। সশব্দে হেসে উঠলাম দৃশ্যটা দেখে। লোকটার ছাতায় ছাতা ধরার লম্বা যে ডান্ডা থাকে, সেটা নেই। বৃষ্টিতে মেলে দেয়া ছাতার একেবারে গোড়ায়, সামান্য অবলম্বন কোনও রকমে কষ্টেসৃষ্টে ধরে আছে। ওতেই বেশ কাজ চলে যাচ্ছে। ছাতাটা দিব্যি কাজ করছে। বৃষ্টি পড়ছে না গা’য়ে। কিন্তু ছাতাটা সামলাতে তাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিলো। বাতাসের তোড়ে উড়ে যাবার মতো অবস্থা। ওরকম একটা নষ্ট ছাতা নিয়ে ভদ্রলোক রাস্তায় নেমেছে কেন, মাথায় এলো না কিছু। হতে পারে, চলার পথে হঠাৎ এভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, বিপদে পড়েছিল বেচারা।

হা হা হা। আমাদের হাসির সাথে আরও কয়কেজন যোগ দিল উদ্ভূত মজাদার পরিস্থিতি দেখে। যে লোকটি আমাকে দৃশ্যটি দেখিয়েছিল, তার তো দেখলাম তর্জনী নাচিয়ে হাসতে হাসতে একেবারে সেখানে গড়াগড়ি খাবার মতো অবস্থা! সত্যি, দারুণ মজা পেয়েছিলাম দৃশ্যটা দেখে (ব্যাপারটা কিছুতেই মজাদার নয় যদিও)। আমি নিজেও নিজেকে সংবরণ করতে পারিনি, সশব্দে হেসেছিলাম। কী করবো, মানুষ তো! চেয়ার থেকে কাউকে ‘ধপাস’ চিৎপটাং পড়তে দেখলে আমরা যেমন আনন্দ পাই, কিছুতেই না হেসে পারি না, মুখ টিপে হলেও হাসি। অনেকটাই সেখানে ওরকম পরিস্থিতি আমাদের সবার। সবাই যে যার মতো হাসছি।
সত্যি, দারুণ মজার একটি স্মৃতি। আজ মনে পড়লে নির্মল আনন্দে প্রাণ ভরে ওঠে। ভালো থাক মুম্বাইয়ের বৃষ্টিস্নাত সেই বিকেলের সেই হাসি খুশি সহজ সরল মানুষগুলো। মুম্বাইয়ে এরকম আরও বহু মধুর স্মৃতি আছে। অনেক ভালো সজ্জন মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছি, তাদের সান্নিধ্য পেয়েছি। আগামীতে সেগুলোও কখনও লিখবো এই আশা ব্যক্ত করছি।

(ছবি: সংগ্রহ)