অর্ক এর সকল পোস্ট

উগ্র ধর্মান্ধতা বিকারগ্রস্ততার আরেক রূপ

ওপার বাংলার কলেজ স্কোয়ারে সড়কের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। বেশ রাত। আনুমানিক এগারোটা বাজে। এ সময় একজন মধ্যবয়স্ক দীর্ঘকায় লোক কোনও বিশেষ ঠিকানা বা কোনওকিছু জানতে চাইলে, আমি আমার আয়ত্তের মধ্যে তাকে যথাসম্ভব সাহায্য করি। লোকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গা’য়ে পড়ে আমার সঙ্গে আলাপ জমাতে লাগলো। এব্যাপারে আমার মোটেও কোনও আগ্রহ ছিলো না। তারপরও সমাজ রক্ষার্থে কথোপকথনে অনিচ্ছাসত্ত্বেও জড়িয়ে পড়ি। বয়সে বড় কাওকে সরাসরি বলতেও পারি না যে, আমি এখন বেশি কথা বলতে চাচ্ছি না! এক পর্যায়ে আমার ভাষা শুনে সে বুঝতে পারে, আমি বাংলাদেশী। আমিও কথায় কথায় তাকে দ্বিধাহীন জানিয়ে দেই, বাংলাদেশ থেকে এসেছি, ট্যুরিস্ট, অমুকদিন এসেছি, তমুকদিন যাবো ইত্যাদি। তারপর এক পর্যায়ে সেই ভদ্রলোক তার পরিচিত আরও কোনও বাংলাদেশীর কথা বলতে লাগলো আমাকে; ভারতে পরিচয়, হিন্দু, বাংলাদেশের বিশেষ জায়গায় বাড়ি, নাম ইত্যাদি। যে কোনও কারণেই হোক লোকটা অনেকটা নিশ্চিত ছিলো যে, আমি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। এ পর্যায়ে আমি সেখান থেকে যেতে উদ্যত হই। লোকটা আসলে চাইছিল যে, আমার সাথে পথ চলতে চলতে কিঞ্চিত এই পরিচয়টাকে আরও স্থায়ী করতে। বেশ হাসিখুশি উজ্জ্বল মুখে তখন আমাকে সে আচানক জিজ্ঞেস করে বসলো, “আপনি তো হিন্দু তাই না?” এমনিতেই বিরক্তির পারদ উপরে চড়া ছিলো, তারপর আবার এরকম অপ্রয়োজনীয়, অনাকাঙ্ক্ষিত, অর্থহীন ব্যক্তিগত প্রশ্ন! আমি উত্তরে বেশ খানিকটা কঠিন স্বরে সোজাসাপ্টা বললাম যে, “আমি হিন্দু কিনা সেটা জেনে তার কি হবে? চেনা নেই জানা নেই অকস্মাৎ এভাবে অপরিচিত কাওকে সে হিন্দু কিনা জিজ্ঞেস করার কোনও অর্থই হয় না!” খুবই বিরক্ত হয়েছিলাম হঠাৎ এরকম প্রশ্নে।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

অনুবাদ কবিতা: উত্তর

উত্তর
মহাদেবী ভার্মা

এই এক বিন্দু অশ্রুতে,
চাইলে সাম্রাজ্য লুটিয়ে দাও,
আশীর্বাদের বৃষ্টিতে,
এই শূন্যতা ভরিয়ে দাও;

কামনার স্পন্দন থেকে,
ঘুমোনো একান্ত জায়গা দাও,
আশার কোমল হাসিতে
আমার নৈরাশ্য লুটিয়ে দাও।

চাইলে জর্জর তারের মাঝে,
নিজের মানস বিজড়িত কর,
এই পলকের পেয়ালাতে,
সুখের প্রেরণা ছলকে দাও;

আমার ছন্নছাড়া প্রাণে,
সমস্ত করুণা ঢেলে দাও,
আমার ক্ষুদ্র সীমার মাঝে,
নিজের অস্তিত্ব বিলীন কর!

কিন্তু শেষ হবে না এই,
আমার প্রাণের খেলা,
তোমাকে খুঁজেছি বেদনায়,
তোমাতে খুঁজবো বেদনা!

কিছু গল্প কিছু স্বগোতক্তি

দীর্ঘজীবী হও হে প্রিয় সৈনিক

২০১২ সালের ডিসেম্বরের কনকনে শীতের এক রাত। ওপার বাংলার শিয়ালদহ স্টেশনের জন আহার রেস্টুরেন্টে বসে আছি, সম্ভবত এক কাপ চা ছিল টেবিলে। ন’টা সারে ন’টা বেজে থাকবে। রেস্টুরেন্টটিতে তখন আমার ঠিক পাশে, জানালা সংলগ্ন টেবিলের দু’প্রান্তে বসেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর দুজন বা একজন তরুণ সদস্য (একজনের গা’য়ে ইউনিফর্ম দেখে নিশ্চিত হই, আরেকজনের ব্যাপারে আজ আর কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারছি না যে, তার গা’য়ে সৈনিকের পোশাক ছিল কিনা)। উভয়েরই বয়স সর্বোচ্চ পচিশ। ওরা জন আহারের দশ রুপী মূল্যের পুরি সবজী খাচ্ছিল। ছয়টা সাতটা পুরি আলুর তরকারি চাটনি’র প্যাকেজ। মূল্য দশ রুপি ছিল তখন। এ সময় দেখলাম, আনুমানিক এগারো বারো বছর বয়সী নোংরা আলুথালু কুচকুচে কালো বর্ণের জনৈক স্থানীয় পথশিশু ঠিক জানালার সামনে, জানালার শার্শিতে মুখ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ওদের পুরি সবজী খাওয়া দেখছে লোভাতুর চোখে।

এভাবে বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হলো। দুজনের পুরি সবজী খাওয়া তখন প্রায় শেষ প্রান্তে। এ সময় দেখলাম, ইউনিফর্ম পরিহিত তরুণ সৈনিকটি তার অবশিষ্ট দু’টি বা তিনটি পুরি আর খানিকটা আলুর তরকারি নিয়ে যেয়ে দরজার কাছে শিশুটিকে ডেকে ওর হাতে তুলে দিলো। শিশুটির মুখ নিটোল হাসিতে ভরে উঠলো। হাসতে হাসতে সে সৈনিকের সেই অবশিষ্ট পুরি সবজী নিয়ে একপ্রকার নাচতে নাচতে প্লাটফর্মের কোনও এক দিকে হেঁটে চলে গেল দ্রুত পা’য়ে। তারপর তরুণ সৈনিকটি আবার ফিরে এসে বসলো আগের জায়গায়। আমি রেস্টুরেন্টের ভিতরে বসে দৃশ্যগুলো দেখলাম সুখ দুঃখের মিশ্র অনুভূতি নিয়ে। সেই সৈনিকের প্রতি অপার শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুয়ে এসেছিল উপস্থিত মুহূর্তে। ঠিক যেমন এখন এ মুহূর্তেও ঘটনাটি লিখতে যেয়ে একইরকম মিশ্র অনুভূতিতে ভরে উঠছে মন, একইভাবে শ্রদ্ধায় নতমস্তক হয়ে উঠছি।

আজ আমার এই অত্যন্ত ক্ষুদ্র লেখার মাধ্যমে গভীর শ্রদ্ধা ভালবাসা জানাচ্ছি, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সেই তরুণ সদস্যকে। বিশেষ একটি বিষয়ে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলবারও সৌভাগ্য হয়েছিল। বেঁচে থাকো হে প্রিয় সৈনিক। দীর্ঘজীবী হও। পৃথিবীর সকল সৈনিক তোমার মতো সুকুমার আলোকিত মনের অধিকারী হয়ে উঠুক।

***
চলন্ত বাসে একটি ব্যার্থ ছিনতাইয়ের স্মৃতি

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। ঢাকায় তখন ভলভো নামের দ্বিতল বাস চলতো। উত্তরা মতিঝিল ও মিরপুর মতিঝিল এই দুই রুটে প্রচুর বাস ছিল। ‘ভলভো’ নাম আসলে যাত্রীদেরই দেয়া, বাসগুলোর আদৌ কোনও নাম ছিল না। বিআরটিসি’র লাল রঙের সরকারী দ্বিতল বাস। খুব সম্ভবত সুইডিশ অটোমোবাইল কোম্পানি ভলভো’র তৈরিকৃত ছিল বাসগুলো। বাসের গা’য়ে ইংরাজিতে গোটা গোটা হরফে ভলভো লেখা, যা লোকমুখে পরবর্তীতে বাসের নামে পরিণত হয়। ওই বাসে করেই একদিন সন্ধ্যাবেলা পল্টন যাচ্ছিলাম। নিচতালায় বেরোনোর দরজার কাছে বসেছিলাম। আমার মুখোমুখি চেয়ারে বসা এক প্রবীণ দম্পতি। আনুমানিক সাতটা সারে সাতটা বেজে থাকবে।

যাই হোক বাস চলছে। এসময় ফার্মগেট পেরিয়ে কাওরান বাজারে চলে এলো বাসটা। ট্রাফিক জ্যাম, সিগনাল ইত্যাদির জন্য অনিয়মিত হয়ে পড়েছিল গতি। এভাবে যেতে যেতে এক পর্যায়ে কাওরান বাজারে দেখলাম, চলন্ত বাসে বাইরে থেকে কে যেন হাত বাড়িয়ে ছো মেরে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করলো আমার সম্মুখে বসে থাকা প্রবীণ ভদ্রমহিলার কানের দুল জোড়ার একটি। খুব সম্ভবত সোনার ছিল ওগুলো। এখনও চোখে ভাসছে উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের চকচকে দুল জোড়া। শুরুতে একটুও বুঝতে পারিনি, ব্যাপারটা ঠিক কী ঘটলো, কয়েক মুহূর্ত লেগে গিয়েছিল পুরোপুরিভাবে আত্মস্থকরণে। ঠিক একেবারে আমার মুখোমুখি বসেছিল দুজন। সেই ভদ্রমহিলার চটজলদি সজাগ হয়ে নিজেকে সরিয়ে নেবার দক্ষতা ছিল বিস্ময়কর। বাইরে থেকে ছিনতাইকারী ছো-ও দিয়েছে, আর সেও তৎক্ষণাৎ তার মাথা ততোধিক দ্রুতবেগে সরিয়ে নিয়েছে জানালার কাছ থেকে। আনুমানিক ষাট ছুঁইছুঁই ছিল প্রবীণার বয়স। যাই হোক কোনও বিপদ হলো না। ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটে গিয়েছিল যে বাসে অবস্থিত অন্য যাত্রীদের কেউই বিন্দুমাত্র কিছু আঁচ করতে পারেনি। পনেরো থেকে বিশ সেকেন্ডর একটি ব্যর্থ ছিনতাই চেষ্টা। আমি মুখোমুখি বসে থেকে দেখলাম সব। সে সময় সদ্য সিগনাল থেকে বেরিয়ে বেশ দ্রুত গতিতে চলতে লাগলো বাসটি। ঘটনার পর জানালা দিয়ে সামনে (ওই বাসের সামনের কয়েকটি সিট ছিল উল্টোদিকে) তাকিয়ে দেখলাম, ছিপছিপে গড়নের লুঙ্গি শার্ট পরা আনুমানিক বছর পচিশের এক যুবক রাতের আলোআঁধারি নির্জন সড়কে ধীর পা’য়ে হেঁটে চলেছে আপনমনে।

ব্যাপারটা শুধু কানের একটি এমিটিশন বা সোনার দুল ছিনতাইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। যেভাবে ওরকম একটি দ্রতগতির বাসের জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে চিলের মতো ছোঁ মেরে ছিনতাইকারী সেই প্রবীণার দুল ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেছিল, এতে ভদ্রমহিলার কানও ছিড়ে যেতে পারতো, ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো। সৌভাগ্যক্রমে শেষমেশ অবশ্য খারাপ কিছুই ঘটেনি। এটা সম্ভব হয়েছিল কেবলমাত্র সেই ভদ্রমহিলার তৎক্ষণাৎ দ্রুতবেগে মাথা আরেকদিকে সরিয়ে নেবার দক্ষতার জন্য। এমনকি পাশে বসে থাকা তার স্বামীও বিন্দুমাত্র কিছু আঁচ করতে পারেনি। ভদ্রমহিলা ক্ষণকাল পরে তাকে বলেছিল। আর এদিকে দ্বিতল ভলভো বাস চলছে তো চলছেই।

স্মৃতিতে গত ফুটবল বিশ্বকাপ ২০১৮ রাশিয়া

আসছে বিশ্বকাপ ফুটবল

বিশ্বকাপ ফুটবল আসন্ন। এবারের বিশ্বকাপ হবে রাশিয়ায়। বিশ্বকাপ ফুটবলকে বলা হয়ে থাকে, ‘বিগেস্ট শো অন দ্যা আর্থ’। সারা পৃথিবীকেই এই পুরো একটি মাস মোহাবিষ্ট করে রাখবে ফুটবল। একটি মাস শুধুই ফুটবলের। আমাদের দেশেও বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা মোটেও কম নয়, বরং অনেকক্ষেত্রে তা অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর থেকেও বেশি। বিভিন্ন দেশের রঙবেরঙের জাতীয় পতাকা এসময় উড়তে দেখা যায় দেশের সবখানে- গ্রাম গঞ্জ, শহর বন্দর সর্বত্রই। লোকজন দল বেধে সড়কের মোরে মোরে ভিড় ক’রে লাইভ ম্যাচ টিভিতে উপভোগ করে। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে জায়ান্ট স্ক্রিন বসানো হয় শুধুমাত্র বিশ্বকাপ উপলক্ষেই। চায়ের দোকান, লোকাল বাস, অফিস আদালত, রোয়াক, পার্কের বেঞ্চ সবখানে শুধু ফুটবল ফুটবল আর ফুটবল। সত্যি, আমাদের দেশের আপামর মানুষের জন্যে দারুণ আনন্দের একটি মাস, বিশ্বকাপ ফুটবলের এই একটি মাস।

মনে পড়ছে, বিগত কোনও এক বিশ্বকাপে একবার সেলুনে চুল কাটতে গিয়েছিলাম, এসময় নরসুন্দর মহাশয় সেখানে উপস্থিত জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে ফুটবল নিয়ে এমন সিরিয়াস আড্ডা দেয়া শুরু করলো যে, আমার মনে হচ্ছিল, কোনও ফুটবল বিশ্লেষক গবেষক যেন আমার চুল কাটছে! চুল কাটায় তার আদতে কোনও মনোযোগই ছিল না, সব মনোযোগ ফুটবল নিয়ে আড্ডায়। কোনওরকম আর্মিদের মতো চুল ছোট ক’রে ছেটে দিয়েই বিদেয় করেছিল। হা হা হা।

ব্রাজিল আর্জেন্টিনা- দুভাগে পুরো দেশ বিভক্ত হয়ে যাবে। এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা সমালোচনা, তর্কবিতর্ক, বাদানুবাদ হবে দেশের সর্বত্রই। দুয়েক জায়গায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ভক্ত সমর্থকদের মাঝে তপ্ত বাক্য বিনিময় ও মৃদু হাতাহাতিও হবে কোথাও কোথাও।

***
এরিয়েল ওরতেগার জন্য ভালবাসা

আর্জেন্টিনা’র এরিয়েল ওরতেগা আমার অত্যন্ত পছন্দের একজন ফুটবলার। এ শুধুই তাঁর ক্রীড়া নৈপুণ্যের জন্য। সত্যি বলতে কি, বল ড্রিবলিং কাটানোতে তাঁর মতো দক্ষ খেলোয়াড় আমি আমার এযাবতকালের জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখিনি! এ কাজটা খুব ভালোই পারতেন তিনি। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে দেখেছিলাম তাঁর অতিমানবীয় ফুটবলের জাদু। দিব্যি পাঁচ ছয় জন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে, ইচ্ছেমতো ডস দিয়ে দিয়ে বল নিয়ে বারবার টুপ করে ঢুকে পড়তেন প্রতিপক্ষের ডি বক্সে। একবার দুবার তিনবার- বারবার। বল পেলেই প্রতিপক্ষের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠতেন তিনি। সহযে আর বল পা ছাড়া করতেন না, যেন বুটে অদৃশ্য কোনও আঠা লেগে আছে, তাতে লেপটে আছে বল। প্রতিপক্ষকে কাটানো ডালভাতের মতো সহজ ব্যাপার ছিল এরিয়েল ওরতেগার জন্য। চার পাঁচ জন একত্রে ঘিরে ধরেও বল ছিনিয়ে নিতে পারতো না তাঁর পা থেকে। এক পর্যায়ে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা বুঝে যেতো, এঁকে বৈধভাবে কিছুতেই থামানো সম্ভব নয়। তাই বারবার অবৈধভাবে থামিয়ে দেয়া হতো। বেশিরভাগ সময় দেখতাম প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা জামা টেনে ধরতো, ধাক্কা দিতো, পা’য়ে ল্যাঙ মারতো- এভাবে একের পর এক ফাউল করে বলতে গেলে তাঁকে তাঁর স্বাভাবিক খেলাটাইই খেলতে দেয়া হয়নি; আমি ১৯৯৮ ফ্রান্স বিশ্বকাপের কথা বলছি। সেবার নেদারল্যান্ডের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে রেফারি নেদারল্যান্ডের পক্ষে উলঙ্গ পক্ষপাতিত্ব করে অবৈধভাবে লাল কার্ড দেখিয়েছিল ওর্তেগাকে। সে ম্যাচে ড্যানিস বার্গক্যাম্পের শেষ মুহূর্তের গোলে হেরে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। মনে পড়ছে, ওরতেগার অশ্রুসিক্ত চোখে হতাশ হয়ে মাথা নিচু করে শ্লথ পা’য়ে হেটে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়া। তখন বুঝিনি, সেটাই হতে চলেছে আমার দেখা তাঁর শেষ পূর্ণ আন্তর্জাতিক ম্যাচ! সেসময় সেভাবে ক্লাব ফুটবলের সাথে পরিচিত ছিলাম না। তাঁর পরের ২০০২ কোরিয়া জাপান যৌথ রাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে সম্ভবত এরিয়েল ওর্তেগা আর খেলার সুযোগ পাননি। পেলেও পুরো সময় খেলতে পারেননি। সম্ভবত বদলি খেলোয়াড় হিসেবেই খেলেছিলেন দুয়েকটি ম্যাচে। এরকম কিছু হয়েছিল।
জানি না এখনও তিনি খেলেন কিনা। আমি তাঁর চমকপ্রদ অতিমানবীয় ক্রীড়া নৈপুণ্যের সাক্ষী। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে আমি হাই স্কুলে অধ্যায়ণরত কিশোর ছিলাম। খেলাধুলা দারুণ পছন্দ করতাম। বিশেষ করে ফুটবল, ভলিবল ও সবরকমের মারপিটের খেলা- রেসলিং, বক্সিং, জুডো, তায়কোয়ান্দো ইত্যাদি। ক্রিকেট অতোটা নয়। সব থেকে প্রিয় ছিল ফুটবল। সেবার বিশ্বকাপে একমাত্র এই এরিয়েল ওর্তেগা’র কারণেই কিছুতেই চাইতাম না, জুর্গেন ক্লিন্সম্যান, অলিভার কান, লোথার ম্যাথিউস, মাইকেল বালাক’র মতো দক্ষ খেলোয়াড়ে পূর্ণ প্রিয় জার্মানি ফাইনালের আগে আর্জেন্টিনা’র মুখোমুখি হোক।
সে সব দিন ধূসর অতীত আজ। নিটোল সুখের একগুচ্ছ স্মৃতি। অনেককিছুই ভুলে গেছি সময়ের সাথে সাথে, যেটুকু মনে আছে, তাও বিস্তারিত বা পুঙ্খানুপুঙ্খ নয়। কিন্তু আমার পরিষ্কার মনে আছে এরিয়েল ওর্তেগাকে, তাঁর অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন ক্রীড়া নৈপুণ্য- খেলার যে কোনও পর্যায়ে বল পেলেই প্রতিপক্ষের একাধিক খেলোয়াড়কে ইচ্ছে মতো নাচিয়ে কাটিয়ে ডি বক্সে বারবার ক্ষিপ্রগতিতে ঢুকে পড়া। এঁকেই বোধহয় জন্ম ফুটবলার বা জাত ফুটবলার বলা হয়ে থাকে! বেশ নস্টালজিক হয়ে উঠছি তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে। তাঁর সাথে সাথে আরও মনে পড়ছে, আমার ছেলেবেলার শহর- রাত জেগে বিশ্বকাপের ম্যাচ দেখা, বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে আনন্দ ফুর্তিতে মেতে ওঠা, বাড়ির ছাদে পতাকা ওড়ানো, খেলার পর বিজয়ী প্রিয় দলের পক্ষে মিছিলে শরীক হওয়া… আহ, কতো যে প্রাণোচ্ছল সুমধুর ছিল সেসব দিন! যাই হোক প্রিয় ফুটবলার এরিয়েল ওর্তেগা’র জন্য হৃদয় নিংড়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি, আজ আমার এ সামান্য লেখার মাধ্যমে। যেখানে যেভাবেই থাকুক তিনি, সুখদায়ক ফল্গুপ্রবাহে ভরা থাক তাঁর অনাগত প্রতিটি দিন।

***
এক কাপ ক্যাপুচিনোতে খেলা শেষ ও আরও কিছু প্রাসঙ্গিক এলোমেলো কথা

গেল বিশ্বকাপের কোনও একটি ম্যাচ (ঠিক কোন খেলা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না, সম্ভবত আর্জেন্টিনার কোনও একটা গ্রুপ পর্বের খেলা ছিল সেটা) ঢাকার গুলশানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিজাত রেস্টুরেন্টে বসে দেখেছিলাম। চিনি ছাড়া ভীষণ কড়া এক কাপ গরমাগরম ক্যাপুচিনো খেতে খেতে। এক কাপ ক্যাপুচিনোতেই আমার খেলা শেষ! হা হা হা। রাত দেড়টা পর্যন্ত সেদিন ছিলাম সেখানে। আমার খুব প্রিয় ছিল সেই রেস্টুরেন্টটি সে সময়। তখন নিয়মিতই যেতাম। খুব ভালো বিভিন্ন কফি পাওয়া যেতো। ছিল, যেতো বলছি, কারণ দীর্ঘদিন সেখানে আর যাই না। ঠিক আজকে থেকে চার বছর আগের কথা এগুলো। এখনও রেস্টুরেন্টটা আছে সেখানে, সম্ভবত সবই তেমনি চার বছর আগের মতোই আছে, যেমন দেখেছিলাম। কিন্তু আমি এর মাঝে আর বহুদিন সেখানে যাইনি। রেস্টুরেন্টটির নাম সঙ্গত কারণেই উল্লেখ করলাম না। ছোট্ট এক কাপ ক্যাপুচিনোর দাম তখন ছিল, একশত পঞ্চাশ টাকার মতো। এখন নির্ঘাত আরও বেড়ে গেছে। তবুও তুলনামূলক সস্তাই বলা যায়। ওর পাশে হোটেল ওয়েস্টিন’এ একবার একজন ক্যাফে লাত্তে খাইয়েছিল। আলোআঁধারিতে বিলটা এক ঝলক দেখেছিলাম, লাত্তে ছয়শত + টাকা!

যাই হোক রাত দেড়টা পর্যন্ত ছিলাম সে রাতে, সেই রেস্টুরেন্টে। আগেই বলেছি গুলশানের একটি অভিজাত রেস্টুরেন্ট ছিল সেটা। ওখানে নিত্য বড় বড় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আসা যাওয়া করতো। অনেককে দেখেছিলাম। মাঝেমাঝে খুব ইচ্ছে করতো, ওদের দুয়েকজনকে ধরে গুলশান দুইয়ের মোড়ে নিয়ে যেয়ে ইচ্ছে মতো পেটাই। তখন বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের আগুন সন্ত্রাসের দগদগে ক্ষত আমার বুকে। তাই মাঝেমাঝে এই ইচ্ছা বড্ড মাথাচাড়া দিতো।

এ ব্যাপারে আর তেমন কিছু বলার নেই আমার। শুধু আবারও বলছি, এক কাপ ক্যাপুচিনোতেই আমার সেই খেলা শেষ হয়ে গিয়েছিল! হা হা হা। রাত দেড়টায় ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে বাড়ি ফিরেছিলাম। কিন্তু কীভাবে ফিরেছিলাম, তা আজ আর মনে নেই। বাসে নাকি হেঁটে হেঁটেই- এখন কিছুতেই মনে পড়ছে না। তখন অবশ্য গুলশানের খুব কাছে উত্তর বাড্ডায় থাকতাম। আরও অনেক এলোমেলো স্মৃতি এসে ভিড় জমিয়েছে সেই সময়ের। আহা, চারটি বছর চলে গেছে মাঝখানে। এখন আমি আর্জেন্টিনা’র ঘোর সমর্থক। আর্জেন্টিনা’র খুব ভালো একজন পত্র মিতা ছিল আমার, এন্টোনেলা পিনেডা নাম ছিল ওর। ২০১৩ সালে পরিচয় হয়েছিল। অত্যন্ত ভালো ও উদার মনের মেয়ে ছিল। ও তখন অষ্টাদশী। বেচারি ওর বাবাকে কোনওদিন দেখেনি। ওর জন্মের পরপরই ওর বাবা মা’র ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ওর বাবা ওদের ছেড়ে চলে যায়। তারপর আর কোনও যোগাযোগ ছিল না তাদের মধ্যে।

আর্জেন্টিনা’র টেনিস খেলোয়াড় ডেভিড নালবান্দিয়ান আমার অত্যন্ত প্রিয় খেলোয়াড় ছিল। বেশ ক’বছর হলো অবসর নিয়েছেন। কের্টে কখনও হাসি ছাড়া তাঁর মুখ দেখিনি। খেলায় অনেককেই দেখতাম আম্পায়ার লাইনম্যান’র সিদ্ধান্ত নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করতে, অনেকে তো রীতিমতো মারমুখী হয়ে উঠতো এসব নিয়ে। ডেভিড নালবান্দিয়ানকে কখনওই এরকম করতে দেখিনি। এক্কেবারে একজন মাটির মানুষ যাকে বলে, নিরহংকার, ক্রোধহীন, জলের মতো সহজ সরল। সবকিছু হাসি মুখে সহজভাবে গ্রহণ করতো। বেশ ক’বার আম্পায়ার লাইনম্যান’র পরিষ্কার ভুল সিদ্ধান্তেও সামান্য খেদ প্রকাশ করতে দেখিনি তাঁকে। একই কথা মেসিসহ সকল আর্জেন্টাইনদের ব্যাপারেই সম্ভবত প্রযোজ্য। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বাস্কেটবল, রাগবি, টেনিস সবখানেই আর্জেন্টাইনদের মতো সুসভ্যা জাতি আমি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। তাই আমি এখন পুরোপুরিভাবে ঘোর আর্জেন্টাইন সমর্থক। এই বিশ্বকাপেও প্রত্যাশা আর্জেন্টিনার ঘরে যাক বিশ্বকাপ ট্রফিটি, নাহলে আবার জার্মানিই শিরোপা জয়লাভ করুক। তা নাহলে ইংল্যান্ড বা পর্তুগাল। পর্তুগালের ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো’র মতো তুখোড় ফুটবলারের হাতে বিশ্বকাপ ট্রফিটি ওঠা উচিৎও বৈকি। একই কথা লিওনেল মেসি’র ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সবই অবশ্য কথার কথা। আমার কথায় তো আর কিছুই নির্ধারণ হবে না। আমি তান্ত্রিক বা জ্যোতিষীও নই। তবে আর সবার মতো মেসি, রোনালদো’র ক্রীড়া নৈপুণ্য দেখার জন্যে মুখিয়ে আছি। উঠুক না হয় দুজনের একজনের হাতে দারুণ শৈল্পিক দৃষ্টিনন্দন ট্রফিটি।

***
স্মৃতিতে ৯৪’র ফুটবল বিশ্বকাপ

৯৪ সালে আমি খুব ছোটো ছিলাম, মাত্র সাত আট বছর বয়স। তবুও ফুটবল বিশ্বকাপের কথা মোটামুটি একটু আধটু ভালোই মনে করতে পারি। বিটিভি’র যুগ সেটা। স্যাটেলাইট তখনও আসেনি। টিভিসেটই ছিল হাতে গোনা! যাই হোক খেলা শুরুর আগে এ্যান্ড্রু কিশোর’র গান হতো, দিতি ইলিয়াস কাঞ্চন টিভি পর্দায় নাচতো; ‘রূপসী দেখেছি আমি কতো/ দেখিনি তোমার মতো’, ‘বেলি ফুলের মালা গেঁথে এক প্রেমিক তার প্রিয়াকে ঘরে তুলেছে/ যৌতুক টাকাকড়ি পা’য়ে দলেছে/ যারা পুরুষকে মন্দ বলে/ তারা এমন পুরুষ কি দেখেছে…’। এইসব সিনেমার গান খুব ভালো লাগতো আমার। ঢাকাই সিনেমায় তখন ইলিয়াস কাঞ্চনের দারুণ জয়জয়কার। পাশাপাশি রুবেলও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। আমাদের বাড়ির কাছেই একটা সিনেমা হল ছিল। মাঝে মাঝে বন্ধু বান্ধবদের সাথে সিনেমা দেখতামও বৈকি। বিশ্বকাপের খেলাও দেখতাম, কিন্তু বোঝার মতো পরিণত ছিলাম না। ফুটবল খেলার মোটেই কিছু বুঝতাম না, শুধু দেখতাম একদল হাফ প্যান্ট ও সাদা কালো জামা পরিহিত মানুষ ফুটবল নিয়ে এলোমেলো দৌড়াদৌড়ি করছে। খুব সম্ভবত খেলাটাকে তখন বিরক্তিকরই মনে হতো! সেবার ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন ও ইতালি রানার্স আপ হয়েছিল। চারিদিকে তখন ‘রোমারিও রোমারিও’ তোলাপার। এছাড়া খুব ভালো মনে করতে পারছি, বিশ্বকাপ শুরুর প্রাক্কালে ম্যারাডোনা’র ড্রাগ কেলেঙ্কারি, খেলা না খেলার দোলাচল নিয়ে সারা শহরজুড়ে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। হ্যা পরিষ্কারই মনে করতে পারছি ঘটনাগুলো, সমস্ত শহর তখন ম্যারাডোনাময়। সে কী উত্তেজনা ম্যারডোনা’কে নিয়ে। আমার ফুটবল পাগল পিতাও যারপরনাই উদ্বিগ্ন, সঙ্গে পরিবারের অন্য সদস্যরাও। স্থানীয় অনেককেই ফুটবল নিয়ে আলোচনায় ফিফা, রেফারি, আমেরিকা (৯৪’র আয়োজক রাষ্ট্র) এর ওর গুষ্ঠি উদ্ধার করতে দেখেছি। অনেকের তো রীতিমতো শোকে জর্জর হয়ে কেঁদে ফেলবার মতো পরিস্থিতি। যাই হোক সেই প্রথম শৈশবে আমার বাবা ও পরিবারের সদস্যদের ম্যারাডোনাকে নিয়ে এই উদ্বিগ্নতা দেখে, মনে মনে ধরেই নিয়েছিলাম যে, ম্যারডোনা খুব সম্ভবত সম্পর্কে আমার চাচা। বিশ্বকাপ শেষ হলেই আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসবেন। আত্মীয় না হলে কী আর আমার বাবার মতো এহেন কাঠখোট্টা মানুষও তাকে নিয়ে এমন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে! বেচারা সর্বত্র অস্থিরতা নিয়ে ঘোরাফেরা করছে, চেহারা যারপরনাই বিষণ্ণ, জীবনের প্রতি হঠাৎই যেন বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে। কারণ আর কি- ভাই বলে কথা। মায়ের পেটের না হলেও কোনওরকমের রক্তের সম্পর্ক নিশ্চয়ই আছে দুজনার মাঝে! আমি অনেকটা নিশ্চিতই ছিলাম এ ব্যাপারে যে, ম্যারাডোনা নির্ঘাত বাবার দিকের কোনও আত্মীয় আমার! হা হা হা।

ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘Show must go on…’(অনুষ্ঠান নিশ্চয় চলতে থাকবে)। কথাটা এই মানবজীবন’রই অত্যন্ত সার সত্য। কারও জন্যেই কিছু থেমে থাকে না। ৯৪’র বিশ্বকাপও ম্যারাডোনার জন্য থেমে থাকেনি। পরবর্তীতে দেখেছি, একই ক্রীড়া প্রেমিক মানুষগুলো মেতে উঠেছে ব্রাজিলীয় রোমারিও’কে নিয়ে। চারিদিকে ‘রোমারিও রোমারিও’ হৈ চৈ। এর মাঝে আরও অন্যান্য বেশ কিছু খেলোয়াড়ের নামের সাথেও এর ওর মুখে শুনে ভালো পরিচিত হয়ে উঠেছিলাম। যেমন- বেবেতো (ব্রাজিল), ক্যানিজিয়া, বাতিস্তুতা (আর্জেন্টিনা), রজার মিলা (ক্যামেরুন), রবার্টো ব্যাজিয়ো (ইতালি) ইত্যাদি। সেবার ব্রাজিল’র হাতে চতুর্থ বারের মতো বিশ্বকাপ ট্রফি ওঠে। রানার্স আপ হয়েছিল ইতালি। খেলার ফলাফল এক্সট্রা টাইমসহ সম্পূর্ণ ম্যাচ গোলশূন্য, টাইব্রেকারে ব্রাজিল ৩ – ২ ইতালি। সেই বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল পাওয়া সেরা ফুটবলার রবার্টো ব্যাজিয়ো পেনাল্টি মিস করেছিল ফাইনালে। খুব সম্ভবত সেটাই এযাবতকালের একমাত্র গোলশূন্য বিশ্বকাপ ফাইনাল ম্যাচ।

এই তো মনে পড়ছে, শহরজুড়ে হৈ চৈ, ইতিউতি ব্যস্তসমস্ত আলোচনা মানুষের, বাবার চেহারায় উদ্বিগ্নতা; খেলা চলছে, ফুটবল… বিশ্বকাপ ফুটবল। শেষের কয়েকটি তথ্য ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করে টুকে দিয়েছি। আগেই বলেছি, খেলা বোঝার মতো পরিণত তখন ছিলাম না আমি, মাত্র সাত আট বছর বয়স। অনেকটা এমনি এমনিই বসে থাকতাম টিভিসেটের সামনে, কিন্তু উল্লেখিত ঘটনাগুলো দারুণভাবে মনে আছে। আর মনে আছে দিতি, ইলিয়াস কাঞ্চনের সিনেমার গানগুলো, ‘বেলি ফুলের মালা গেঁথে এক প্রেমিক তার প্রিয়াকে ঘরে তুলেছে/ যৌতুক টাকাকড়ি পা’য়ে দলেছে/ যারা পুরুষকে মন্দ বলে/ তারা এমন পুরুষ কি দেখেছে…’। খেলার থেকে তখন এই গানগুলোই বেশি আকর্ষক ছিল আমার কাছে।

আহ্ ৯৪! আহ্ দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা! সময় যেন বহতা পানি। ২৪ বছর চলে গেছে মাঝখান, দু’ দুটি যুগ, অথচ মনে হচ্ছে যেন এই তো সেদিনেরই কথা!

***
স্পেনের জন্য শুভকামনা

স্পেন মরক্কো’র খেলা দেখছি। এই সেন্টার হলো বলে। স্পেন’র প্রতি আমার বিশেষ ভালো লাগা, শুভকামনা আছে। আমি স্পেনীয় টেনিস খেলোয়াড় কার্লোস ময়া’র খেলা ও ব্যক্তিত্বের একজন অনুরাগী ছিলাম। ছিলাম নয়, বরং বলি, এখনও আছি, কিন্তু তিনি অবসর নিয়েছেন বেশ ক’বছর আগে, আর টেনিসও সেভাবে ইদানীং দেখা হয় না। বিশ্ব ফুটবলে স্পেন ভীষণ রহস্যময় একটা দল। নিয়মিত অংশগ্রহণ যেমন আছে তাদের বিশ্বকাপে, তেমনি ফুটবল বোদ্ধারাও বরাবরই ফেভারিটদের তালিকায় রেখে আসছে স্পেনকে। সেটাই স্বাভাবিক। স্পেনিশ লা লিগা পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ব্যয়বহুল ফুটবল টুর্নামেন্ট। সেখানকার রিয়েল মাদ্রিদ ক্লাবটি যেমন অভিজাত, ঐতিহ্যবাহী, তেমনি সবচেয়ে ধনী ক্লাব। বিশ্বের সবচেয়ে পরীক্ষিত, শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়দের সংগ্রহ করে থাকে দলটি বেশুমার অর্থের বিনিময়ে। এছাড়া অলিম্পিক, কনফেডারেশন কাপ, ইউরো ইত্যাদি অন্যান্য আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে বেশ ভালো ফলাফল করে আসছে তারা। কিন্তু বিশ্বকাপে বরাবরই হতাশাজনকভাবে কোয়ার্টার ফাইনালের পর আর যেতেই পারতো না! অনেক পরে ২০১০ এই শেষমেশ শিকে ছিড়লো স্পেনীয়দের। প্রথমবারের মতো শিরোপা জয় করলো। আমার শৈশব, কৈশোরে স্পেনিশ স্ট্রাইকার রউল গনজালেস একজন প্রিয় ও আদর্শ ফুটবলার ছিলেন। ৯৮, ০২, ০৬- ববিশ্বকাপ মাতিয়েছিলেন তিনি, যে পর্যন্ত স্পেন ছিল। মাঠে ভালো খেলার পাশাপাশি সবসময় সহাস্যমুখ দেখেছি তাকে। ভীষণ অমায়িক, উদার মনমানসিকতায় সমৃদ্ধ চমৎকার একজন মানুষ তিনি, একজন ভালো খেলোয়াড় হবার পাশাপাশি। ক্লাব ফুটবলে স্বদেশী ক্লাব রিয়েল মাদ্রিদের হয়েও দৃষ্টিনন্দন ফুটবল শৈলী দিয়ে মন কেড়ে নিয়েছিলেন আমার মতো আরও কোটি কোটি ক্রীড়ামোদী দর্শকদের। গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণ করছি রউল গনজালেসকে।

এবারের স্পেনিশ দলটিও দারুণ খেলছে। ভরপুর শুভকামনা তাদের জন্য। স্পেনের হাতে আবার উঠুক বিশ্বকাপ।

মরক্কো দুটো ম্যাচ হেরে রেস থেকে আগেই বাদ পড়েছে। কিন্তু পর্তুগাল, ইরানের সাথে দুটো পরাজিত ম্যাচেই তারা প্রতিপক্ষের থেকে ভালো ফুটবল খেলেছিল, কিন্তু গেলটাই শুধু দিতে পারেনি (না দিয়েছে ইরানের জালে নিজের জালে নিজেই হেতে বল জালে জড়িয়েছিল একজন মরক্কান খেলোয়াড়) হা হা হা।

যাই হোক, ভালো পরিচ্ছন্ন উপভোগ্য উত্তেজনাপূর্ণ একটি ম্যাচ দেখার অপেক্ষা…

***
গতকালকের খেলা দেখার অভিজ্ঞতা

গতকাল রাতে ঢাকার একটি বিশেষ স্থানে জায়ান্ট স্ক্রিনে আর্জেন্টিনা নাইজেরিয়া খেলা দেখছিলাম। কোনও স্টেডিয়ামের ফুল প্যাকড গ্যালারীর মতো ভিড় বেশ বড়সড় একটি মাঠে। তিল ধারণের জায়গাও নেই বলতে গেলে। সত্যি, আর্জেন্টিনাতেও এভাবে তাদের খেলা দেখবার জন্য খোলা মাঠ ভর্তি দর্শক মাঝরাত অবধি থাকবে কিনা এব্যাপারে আমি সন্দিহান! গতকাল রাতের খেলা দেখার অভিজ্ঞতা আমি কোনওদিন ভুলবো না। এক্কেবারে যেন স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে চাক্ষুষ দেখছি খেলাটি। সিংহভাগ দর্শক আর্জেন্টিনার ঘোর সমর্থক। খেলা চলাকালীন মেসি, ম্যারাডোনা পর্দায় এলেই, চিৎকার চেঁচামিচি করে ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে লাগলো তারা। অনেকেই ভুডুজেলা, বাঁশী, আর্জেন্টিনার পতাকা নিয়ে এসেছিল খেলা দেখতে। অনেকের গা’য়ে আর্জেন্টিনার নীল সাদা জার্সি। একেবারে মেলার মতো উৎসবমূখর পরিবেশ। আমিও হাফ প্যান্ট, টি শার্ট পড়ে হাজির। বড় দলের খেলা হলে আমি সাধারণত মিস করি না, খেলা দেখতে চলে আসি এই মাঠে। যা হোক খেলা শুরু হলো। প্রি কোয়ার্টার ফাইনালে যেতে হলে এ ম্যাচে আর্জেন্টিনার জয়ের কোনও বিকল্প ছিল না। মনে মনে অনেকটা নিশ্চিতই ছিলাম, বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে আর্জেন্টিনা আফ্রিকান বা এশিয়ান কোনও দলের কাছে পরাজিত হবে না (এর আগে কখনও এরকম ঘটেনি)। প্রথম অর্ধের শুরুতেই মেসি জ্বলে উঠলো। ১৪ মিনিটে দারুণ এক গোল করে এগিয়ে দিলো আর্জেন্টিনাকে। আর অমনি অনাবিল উল্লাসে মেতে উঠলো সেই মাঠে জায়ান্ট স্ক্রিনে খেলা দেখতে আগত উপস্থিত দর্শকবৃন্দ। হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে গেল চারিদিকে। ভুডুজেলা, পটকা ফোটানোর শব্দে কান ঝালাপালা একেবারে। ‘মেসি মেসি’ চিৎকার উল্লাস সর্বত্র। ‘আর্জেন্টিনা আর্জেন্টিনা’ কলরব। এর খানিক পর শুরু হলো গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। কী যে বিড়ম্বনা। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই খেলা দেখছিলাম, আরও অনেকের সঙ্গে। অনুমিত ছিল, এই বৃষ্টি দীর্ঘস্থায়ী হবে না। থেমে গেলে টি শার্ট খুলে মাথা ও শরীর যথাসম্ভব মুছে নেবো। এভাবেই ঝঞ্ঝাটে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ খেলা দেখলাম।

খেলা চলতে লাগলো। আর্জেন্টিনা ১-০ গোলের লীড নিয়ে খেলছিল। এভাবেই শেষ হলো প্রথমার্ধ।

***
শুরু হতে যাচ্ছে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ও আরও দুয়েকটি ছন্নছাড়া কথা

বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল শুরু হতে যাচ্ছে আজ। এ পর্যন্ত ভালো, সফল, নির্ঝঞ্ঝাট একটি বিশ্বকাপ সমাপ্তির দিকে চলেছে। আর্জেন্টিনা, জার্মানি, স্পেন, পর্তুগাল, যাদের শিরোপা জয়ের দৌড়ে এগিয়ে রেখেছিল ফুটবল বোদ্ধা বিশেষজ্ঞরা, তারা কেউ প্রথম কেউ দ্বিতীয় রাউন্ডের গণ্ডিও পেরোতে পারেনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে ব্যথিত হয়েছি, দ্বিতীয় রাউন্ডে মেক্সিকোর পরাজয়ে। খুব আশা করেছিলাম, ব্রাজিলকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে যাবে তারা। কিন্তু তা হয়নি। পরের দিকে খেলাই আর দেখিনি। ব্রাজিল প্রথম রাউন্ডের তৃতীয় ম্যাচ থেকে ছন্দময় ফুটবল খেলছে। আমার এই ব্রাজিল দলের সবচেয়ে প্রিয় খেলোয়াড় গ্যাব্রিয়েল জেসুস। খুবই ভালো লাগে ওকে। প্রচুর পরিশ্রমী ও পরিচ্ছন্ন ফুটবল খেলে থাকে, ফাউল টাউল একেবারেই করে না, আর নেইমারের মতো ন্যাকামো ট্যাকামো তো নয়ই। ওর জন্য বিশেষ শুভকামনা। বড় ক্লাব দলে দেখতে চাই জেসুসকে।

রাশিয়ার উথ্থান চমকে দিয়েছে সারা বিশ্বকে। প্রথম রাউন্ডে দারুণ খেলেছে তারা, তবে সাবেক এক চ্যাম্পিয়ন দল স্পেনকে ২য় রাউন্ডে টাইব্রেকারে হারানোটা সবচেয়ে চমকপ্রদ। এই বিশ্বকাপের মাঠ থেকেই পুতিন আমেরিকার দীর্ঘ একক আধিপত্য ভেঙে আবার বিশ্বের (সোভিয়েত ইউনিয়ন যেমন ছিল) সমান্তরাল আরেকটি প্রধান পরাশক্তি হবার মিশনে নামবেন, বা ইতিমধ্যেই নেমেছেন বলে মনে হচ্ছে। ইদানীং রাশিয়াকে প্রায়শই আন্তর্জাতিক নানান বিষয়ে মত ভিন্নতা থেকে সরাসরি যুদ্ধ, আক্রমণ, সামরিক পদক্ষেপ ইত্যাদির ভয় দেখাতে দেখা যায় সারা বিশ্বকে। রাশিয়ানরা জাতি হিসেবে অত্যন্ত উন্নাসিক, বেপরোয়া, জেদি আর উগ্র স্বভাবের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ান সৈন্যরা জার্মানিতে পৌছে অত্যন্ত বর্বরতা ও স্থানীয় নারীদের ওপর ভয়াবহ পৈশাচিক শারীরিক অত্যাচার করেছিল। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসক যোসেফ স্ট্যালিনকে এ ব্যাপারে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে, তিনি সরাসরি কোনওরকমের ভণিতা ছাড়াই বেমালুম বলে বসেন, “পাঁচ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে যুদ্ধ করে জার্মানিতে গেছে আমার ছেলেরা। তারা স্বভাবতই এখন ক্লান্ত, এ সময় তাদের একটু আনন্দ ফুর্তির দরকার আছে বৈকি!”

যাই হোক, আজকে প্রথম খেলা উরুগুয়ে বনাম ফ্রান্স। দারুণ একটি ম্যাচ দেখার অপেক্ষা করছি। দুটো দলই সমমানের শক্তিশালী দল। তবে উরুগুয়ের রক্ষণভাগ আর্জেন্টিনার তুলনায় ঢের শক্তিশালী। ফ্রান্সকে গোল পেতে হলে প্রচুর ঘাম ঝরাতে হবে। বিগত খেলাগুলো দেখে আমি এই ম্যাচে উরুগুয়েকেই এগিয়ে রাখবো। ফ্রান্সের রক্ষণভাগ ত্রুটিপূর্ণ। আর্জেন্টিনা প্রচুর সুযোগ তৈরি করেছিল গত ম্যাচে। তবে আবারও বলছি, আমার কথায় বা ভাবনায় তো আর কিছু হবে না, হয়ও না! নইলে ৯৪ সাল থেকে মেক্সিকো কেন কোয়ার্টার ফাইনালের গণ্ডিই পেরোতে পারে না! হা হা হা। আমার তো প্রতিবারই মনে হয়, ব্রাজিল, ইতালি, জার্মানিকে হারিয়ে দেবে তারা, শ্রেয়তর দল হিসেবেই। কিন্তু কোনওবারই তো তা হয় না!

পরের খেলা ব্রাজিল বনাম বেলজিয়াম। এটাও খুব বড় একটা ম্যাচ হতে চলেছে। উভয়ই ফিফা রেটিংয়ের শীর্ষস্থানীয় দুটো দল। ব্রাজিল ১, বেলজিয়াম ৩। এখানেও আমি এগিয়ে রাখবো বেলজিয়ামকে। এ পর্যন্ত বেলজিয়ামকেই আমার ব্রাজিলের থেকে পরিণত, সুগঠিত, শ্রেয়তর দল মনে হয়েছে। মনে পড়ছে ২০০২ সালের বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ড বা কোয়ার্টারে ফাইনালেই উভয় দল খেলেছিল, দারুণ লড়াই হয়েছিল সেই ম্যাচে। সেখানে তখনকার বেলজিয়াম অধিনায়ক উইলমোস্ট’র শুরুর একটি গোল অফসাইড বা অন্য কোনও কারণে রেফারি কর্তৃক বাতিল করা হয়, পরবর্তীতে এটা নিয়ে অনেকের সাথে, কিংবদন্তী আর্জেন্টাইন ফুটবলার দিয়েগো ম্যারাডোনাও রেফারির সমালোচনা করেছিল। এই বিশ্বকাপেও রেফারিং নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হচ্ছে, হবেও। এটাসহ আসন্ন প্রতিটি বিশ্বকাপেই হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, “মানুষ মাত্রই ভুল করে”। আর রেফারিরাও তো মানুষই, রোবট কিংবা ফেরেশতা নয়!

***
সেমি ফাইনাল লাইনআপ চূড়ান্ত, সমাপ্তির কাছে বিশ্বকাপ

বিশ্বকাপের সেমি ফাইনাল লাইন আপ চূড়ান্ত হয়ে গেছে। ফ্রান্স বনাম বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড বনাম ক্রোয়েশিয়া। দুটো সেমি ও পরবর্তীতে ফাইনাল ছাড়াও, ফাইনালের আগে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ খেলা হবে। সবমিলিয়ে শেষ চারটি ম্যাচের অপেক্ষা এখন সবার। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচটা কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিক একটি ম্যাচ ছাড়া আর কোনও গুরুত্ব বহন করে না- সাধারণ দর্শকের জন্যে যেমন, তেমনি সেমি ফাইনালে পরাজিত দেশ দুটির জন্যেও। আমি খুব খুশি হবো, বেলজিয়াম ও ক্রোয়েশিয়া’র মধ্যে ফাইনাল অনুষ্ঠিত হলে। নতুন এক চ্যাম্পিয়ন দেখার জন্যে মুখিয়ে আছি। নতুন একটি দেশ চ্যাম্পিয়ন মানেই শিরোপাধারী দেশের কুলীন ক্লাবে আরেকটি নতুন নাম যুক্ত হওয়া। সেই কবে ১৯৬৬ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইংল্যান্ড। সেই থেকে চির ফেভারিট হয়ে আছে তারা বিশ্বকাপ আসরে। এবার এই তালিকা আরও স্ফীত হোক।

বেলজিয়ামের সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি মনে হচ্ছে চার দলের মধ্যে। ফ্রান্স’র খেলোয়াড়রা রাফ, পাওয়ার ফুটবল খেলছে। উরুগুয়ের সাথে ম্যাচে প্রচুর ফাউল, নাটক, টাইম কিলিং ইত্যাদি অসাধুতা করেছে তারা। আমি কিছুতেই চাই না, ফ্রান্স ফাইনাল খেলুক। এছাড়া বিগত খেলাগুলো দেখে সার্বিকভাবে আমি বেলজিয়ামকেই শ্রেয়তর দল হিসেবে এগিয়ে রাখবো। তবে এটা যে মোটেও সহয হবে না, তা তো বলাই বাহুল্য। ২য় রাউন্ডের খেলায় আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে ২-১ গোলে পিছিয়ে থেকেও পরপর তিন গোল করে ফ্রান্সের এগিয়ে যাওয়া ছিল বিস্ময়কর। যে কোনও সময় গোল করার দক্ষতা রয়েছে ফ্রান্স দলের। বেলজিয়ামকে জিততে হলে ডিফেন্স খুব শক্ত রাখতে হবে, প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে খেলোয়াড়দের। আর আমার মনে হয়, বেলজিয়ামের ডিফেন্স ফ্রান্সকে রুখে দিতে সক্ষমও বৈকি। দেখা যাক, কী হয়। খেলা তো আর অঙ্ক নয় যে, সূত্রানুযায়ী সব করলেই সঠিক সমাধান পাওয়া যাবে। ফলাফল যে কোনও কিছুই হতে পারে। দেখা গেল, আমার সব হিসাব নিকাশ পাল্টে দিয়ে বেলজিয়ামকে সেমি ফাইনালে ৫-০ গোলে হারিয়ে দিল ফ্রান্স! হা হা হা।

ইংল্যান্ড ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে আমি ক্রোয়েশিয়াকে এগিয়ে রাখবো। ক্রোয়েশিয়া ইংল্যান্ডের থেকে ঢের শ্রেয় দল। ইংল্যান্ড দলটা অনেকটা ভাগ্যের সহায়তা পেয়ে সেমিফাইনালে এসেছে। তুলনামূলক তরুণ ও সাধারণ মানের একটি দল। এ পর্যন্ত তেমন কোনও শক্ত প্রতিপক্ষের সামনে পড়েনি তারা। কলম্বিয়া, সুইডেন দুটো দলই তুলনামূলক দুর্বল প্রতিপক্ষ ছিল। এবার সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়া দুটো দলের থেকে অনেকটাই দক্ষ, সুগঠিত দল। শতাংশের হিসেবে আমি আমি উক্ত ম্যাচে ক্রোয়েশিয়াকে ৭০% বনাম ৩০% জয়ের সম্ভাবনায় এগিয়ে রাখবো। ক্রোয়েশিয়া চমৎকার দল। ওদের খেলা বরাবরই উপভোগ্য। মনে পড়ছে ১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো খেলতে এসেই তৃতীয় স্থান অর্জন করেছিল তারা। ডেভর সুকার নামের একজন দারুণ ফুটবলার ছিল সেই দলে। ক্রোয়েটদের খেলার একটা দিক আমার খুব ভালো লাগে, তারা কখনওই সেভাবে ডিফেন্সিভ খেলে না। একাধিক গোলে এগিয়ে থাকলেও তারা সবসময় চেষ্টা করে গোল ব্যবধান আরও বাড়ানোর। শুভকামনা তাদের জন্য। পক্ষান্তরে ইংল্যান্ড, আগেই যেমন বলেছি, তুলনামূলক তরুণ অনভিজ্ঞ, সাধারণ দল। এই ইংল্যান্ড দল কিছুতেই গুণে মানে ক্রোয়েশিয়া’র সমকক্ষ নয়। তাদের জয় মানে নেহাতই বিশ্বকাপে আরেকটা অঘটনের জন্ম দেয়া।

ক্রোয়েশিয়া বা বেলজিয়াম’কে এই বিশ্বকাপের সম্ভব্য শিরোপা জয়ী দল হিসেবে অগ্রিম শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখছি।

সবমিলিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে দারুণ উপভোগ করেছি এই বিশ্বকাপ। প্রচুর গোল হয়েছে, প্রত্যেক ম্যাচেই গোল হয়েছে, আর এবারের বিশ্বকাপেই খুব সম্ভবত প্রথমবার কোনও গোলশূন্য ম্যাচ দেখতে হয়নি আমাদের। রাশিয়াকে আন্তরিক ধন্যবাদ দুর্দান্ত একটি বিশ্বকাপ উপহার দেবার জন্য। গতকাল রাতে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে ট্রাইবেকারে দুঃখজনকভাবে হেরে গেছে তারা। তবে তাদের খেলা দারুণ উপভোগ্য ছিল। রাশিয়ানরা খেলোধূলায় বরাবরই ভালো। অলিম্পিক গেমসে প্রচুর পদক পায় তারা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গড়া অন্যান্য দেশও বিভিন্ন খেলাধূলায় ভালো করে আসছে নিয়মিতভাবে।

যাই হোক এখন অপেক্ষা সেমি ফাইনালের…

(সংগ্রহ)

একদিন কোলকাতায়

২০১২ সালের ডিসেম্বরের এক কনকনে শীতের রাত। স্থান, ভারতের কোলকাতাস্থ নন্দন। প্রধান ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশে সাজ সাজ রব। উপলক্ষটা ছিল ‘চিলড্রেন ফিল্ম ফ্যাস্টিভাল’। নানা রঙে সেজেছে নন্দন। চারিদিকে উজ্জ্বল আলোকসজ্জা, বিভিন্ন রকমের অলঙ্করণ। শিশুদের উৎসব বলে কথা, কোথাও মিকি মাউসের প্রতিকৃতি কোথাও টম এন্ড জেরি চার্লি চ্যাপলিন তো কোথাও আবার বাঙালির গুপী বাঘা ফেলুদা তো আছেই! সাথে শিশুকিশোরদের চিত্তাকর্ষক ছোট বড় নানান অস্থায়ী ভাস্কর্য। আমরা বড়রাও দিব্যি উপভোগ করছিলাম। আরেকটু পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী আসবেন। অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে সবাই। সেদিনই মুখ্যমন্ত্রী উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন সপ্তাহব্যাপী উৎসবটি। সাদা ইউনিফর্ম পরা পুলিশে ভরে গেছে চারপাশ।

এ সময় সেখানে পশ্চিম বাংলার বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্র এলেন (নিশ্চয়ই তিনি আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে এসেছিলেন)। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালেন দরজার সামনে। কিছু আনুষ্ঠানিক কারণে তার অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশে বিলম্ব হচ্ছিল। বোধহয় খানিকটা আগেই এসে পড়েছিলেন। সে যাই হোক লোকজন বেশ কৌতূহলভরে দেখছিল লোপামুদ্রা মিত্রকে। আমিও ছিলাম সেই কৌতূহলীদের দলে। হা হা হা। লোপামুদ্রা মিত্রকে টিভিতে অনেকবার দেখেছি, কিন্তু কখনওই তেমন সুন্দরি বা আকর্ষণীয়াও মনে হয়নি বরং বেশ সাধরণ চেহারা; তেমন সাজগোজও তাকে কখনও করতে দেখিনি। তিনি আসলে ঠিক অমন স্বভাবের নন। মানে খুব অনাড়ম্বর সাদামাটাভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করে থাকেন ক্যামেরার সামনে। যারা তাঁকে চেনেন, তারা জানেন ব্যাপারটা। কিন্তু সেদিন সরাসরি দেখে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে, আমার কেন যেন খুব ভাল লাগছে তাঁকে দেখতে। কী এক আশ্চর্য মাধুরীময়তা, লাবণ্যতা লুকিয়ে আছে তাঁর চেহারায়। তন্ময় হয়ে দেখছিলাম। বলা বাহুল্য তখনও তেমন কোনও সাজগোজ করেননি, বেশ সাধারণভাবেই এসেছিলেন। পরনে রঙিন ঝলমলে একটি শাড়ি, তার উপরে একটা কার্ডিগান। মুখে খুব হালকা কিছু প্রসাধন থাকলেও থাকতে পারে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে সময় তিনি স্থানীয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিভিন্ন পরিচিত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছিলেন। তাঁর থেকে মাত্র দুতিনহাত দূরে দাঁড়িয়ে দারুণ শীতে মুখ দিয়ে শো শো শব্দ করতে করতে হা করে মুগ্ধ চোখে দেখছিলাম আমার খুব প্রিয় এই গায়িকাকে।

এ সময় একজন ইয়া লম্বা, মোটাসোটা যুবককে ঘটনাস্থলে আবিষ্কার করলাম। ওকে যুবক বলাটাও বোধকরি ঠিক হচ্ছে না। আকার আকৃতিতে অমন দৈত্যাকার হয়ে উঠলেও সে সময় ওর বয়স আঠার’র বেশি হয়তো ছিল না। ছেলেই বলি ওকে, নিতান্তই কিশোর, মুখে চিকন গোফের রেখা, মাথাভর্তী দীর্ঘ এলোমেলো চুল। বেশ মোটা ছিল ছেলেটি, কিন্তু উচ্চতার কারণে স্বাস্থ্যটা স্বাভাবিকই দেখাচ্ছিল। সবার থেকে উঁচুতে মাথা নিয়ে এদিক ওদিক লটরপটর করে বেড়াচ্ছে। লোপামুদ্রা মিত্রকেও বারবার ঘুরে ঘুরে দেখছিল।

কিছুক্ষণ পর দানবটা আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘দাদা দাদা, উনি কে?’ আমার উচ্চতা পাঁচ ফিট নয় ইঞ্চি; বাংলাদেশ বা ভারতের মানুষের গড় উচ্চতা অনুযায়ী সাধরণভাবে লম্বাই বলা যেতে পারে। এহেন আমাকেও কাছাকাছি হওয়াতে মাথা বেশ উঁচুতে তুলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হচ্ছিল। ও নির্ঘাত ছয় ফিট ছেড়েও আরও দু’তিন ইঞ্চি বেশি হয়ে থাকবে। পরে আরও বেড়েছে কিনা কে জানে! আশা করি, আবার কোনওদিন কোলকাতায় গেলে ওকে দেখবো।

‘উনি বিখ্যাত গায়িকা লোপামুদ্রা মিত্র।’ উত্তরে জানালাম আমি। আমার কথায় কোনও ভাবান্তরই হলো না ওর। অত্যন্ত স্বাভাবিক। লোপামুদ্রা মিত্রকে চিনলে তো আর আরেকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে বসতো না যে তিনি কে। কে জানে বিদেশ থেকে এসেছিল কিনা, কোলকাতার স্থানীয় কেউ লোপামুদ্রা মিত্রকে চিনবে না, তাও কি সম্ভব! নাকি আমার মতোই একজন বাংলাদেশী ছিল! হা হা হা।

যাই হোক আমার কাছ থেকে লোপামুদ্রা মিত্রের পরিচয় পেয়ে দেখলাম, ওর লটরপটর আরও বেড়ে গেল। দৈত্যাকার শরীরটা একবার এখানে তো আরেকবার ওখানে। বুঝলাম না এতো উসখুস করছে কেন! ওর উদ্দেশ্য কি! আসলে বিশালাকার শরীরের কারণে খুব চোখে পড়ে যাচ্ছিল।

একপর্যায়ে দেখলাম কয়েকজনকে ‘এই সর এই সর’ বলে বেশ সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে লোপামুদ্রা মিত্রের একদম প্রায় শরীর স্পর্শ করার মতো কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। আরে… দানবটা কি উল্টাপাল্টা কিছু করে বসবে নাকি, লোপামুদ্রা মিত্রের ঘাড়ে চড়ার মতো অবস্থা! মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম গায়িকার কোনওরকমের অসম্মান হলে আমিও মাঠে নামবো। মরলেও পর্বতটাকে কিছুটা হলেও নড়াচড়া করিয়েই ছাড়বো। উপস্থিত এই দুতিনজন কঙ্কালসার লিলিপুট পুলিশ এর কিছুই করতে পারবে না। ওর পাঁচ কেজি ওজনের হাতির হাতের একটি থাবাই যথেষ্ট এই রূগ্ন শীর্ণকায় মাঝবয়সী পুলিশগুলোকে এই কনকনে শীতের রাতে সর্ষেফুল দেখাতে। চেহারা দেখলে মনে হয় ওরা ডায়েট কন্ট্রোল করছে। এই দুতিনজন অভুক্ত, পুষ্টিহীনতার শিকার মাঝবয়সী পুলিশ এই হাতিটাকে কিছুতেই সামলাতে পারবে না! সুতরাং আমাকে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে হলেও এগিয়ে যেতে হবে ওরকম কোনও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির উদ্ভব হলে। আমি তৈরি।

এরপর দেখলাম পাহাড়টা লোপামুদ্রা মিত্রের মুখের কাছে মুখ নিয়ে এলো! আরে… শালা কি পাগল হয়ে গেছে নাকি! ওর উদ্দেশ্য কি! গায়িকার মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেছে কেন! জোর করে কি চুমুটুমু খেয়ে বসবে নাকি আবার মা’র বয়সী একজন ভদ্রমহিলার গালে! হাত মুষ্টিবদ্ধ করলাম। আমার প্রিয় গায়িকা, একটু চিৎকার দিলেই এলোপাথাড়ি মারা শুরু করবো এই দুষ্ট দৈত্যটাকে, পরে যা হয় হোক পরোয়া করি না। জানি, ওর সাথে শক্তিতে পেরে উঠবো না। ঐরাবতসম শরীরটা দিয়ে আমাকে কোনওরকম একবার চেপে ধরতে পারলেই আমার ভাবলীলা সাঙ্গ হওয়া অনিবার্য হয়ে দাঁড়াবে! যাক কি আর করা! তবু স্বান্তনা এই যে, একজন বীর হিসেবে পৃথিবীকে টাটা বাই বলে চলে যাবো।

এমতাবস্থায় দেখলাম দানবটা একেবারে গায়িকার কানের কাছে মুখ নিয়ে যেয়ে ফিসফিস করে কথা বলতে লাগলো। না, আর তো সহ্য করা যায় না! আরও এক কদম মুষ্টি বাগিয়ে এগিয়ে গেলাম। যা হয় হোক আজ এর একটা এসপার ওসপার করেই ছাড়বো। গায়ের জোরে শালা যা খুশি তাই করে বেড়াবি, আর সবাই চুপচাপ দেখে যাবো! না, তা হয় না। এর আগেও কয়েকজনকে ইচ্ছেমতো ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে গায়িকার কাছে গিয়েছিলি! আমার তখনই প্রতিবাদ করা উচিৎ ছিল। যা হোক প্রিয় গায়িকার প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় আছি। আমি আমার দিক থেকে সম্পূর্ণরুপে প্রস্তুত। আমার প্রিয় গায়িকা, সামান্য আহা উহু করলেই সর্ব শক্তিতে ঝাপিয়ে পড়বো দৈত্যটার ওপর। জানি, বড়জোর একটু নড়েচড়ে উঠবে, আর তেমন কিছুই হবে না। ওকে সুবিধামতো নাগালেই পাবো না। পরবর্তীতে নির্ঘাত আমাকে ইচ্ছেমতো তুলোধোনা করে ছাড়বে। আর এইসব পাবলিক তখন কেবল দর্শক হয়ে মজা লুটবে দূর থেকে, কেউ এগিয়ে আসবে না। এই এক ব্যাপারে দুই বাংলার মানুষের মাঝে একচুল পরিমাণও কমবেশি নেই। প্রভাবশালী, বলশালীরা যা খুশি তাই করুক, তাদের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করা যাবে না। পুলিশ নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবে। কিন্তু ততক্ষণ আমি বাঁচি কিনা কে জানে! আমার ঘাড় মটকে দিতে এই পাহাড়সম দানবটার মাত্র দুমিনিটই যথেষ্ট।

এমতাবস্থায় দেখলাম লোপামুদ্রা মিত্র ওকে খানিকটা উষ্মাভরে বললো, ‘আরে দাঁড়াও না। আগে অনুষ্ঠান থেকে ফিরে আসি, তারপর।’ হুমম মানে, অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসে কি হবে! ঐরাবতটা কি প্রস্তাব দিয়েছে, যেটা অনুষ্ঠান থেকে ফিরে আসার পর হবে! ভাবলাম। লোপামুদ্রা মিত্র কি ওর ধর্ম মা হতে যাচ্ছে নাকি! বুঝলাম না কিছুই। তবে হাতের মুষ্ঠি খুলে দিলাম। না, সিরিয়াস কিছু নয়। পর্বতটাও একটু তফাতে চলে গেল। বিপর্যয়কর কিছুই হলো না শেষমেশ।

এ সময় আমি কৌতূহলী হয়ে দানবটার কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা ভাই, তুমি লোপামুদ্রা মিত্রের কানেকানে ফিসফাস করে কি বলছিলে?’
আমাকে চিনতে পারলো ও। মিনিট পাঁচেক আগে আমার কাছেই জানতে চেয়েছিল, লোপামুদ্রা মিত্র কে। আমার আচম্বিত প্রশ্নে ভীষণ অপ্রস্তুত হতে দেখলাম ওকে। বেশ লজ্জিতও দেখাচ্ছিল। পারলে উত্তর না দিয়ে ছুটে পালায় সেখান থেকে। আমিও মাথা উঁচুতে তুলে মুখ কঠোর করে ওর দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছি উত্তরের। জবাব না দিয়ে যাবে কোথায় বাছাধন! আমিই তোমাকে চিনিয়েছি শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্রকে। এখন আমার কৌতূহল তুমি মেটাও, কি ফিসফাস করছিলে কানেকানে?

এদিক ওদিক তাকিয়ে চেহারায় চরম বিরক্তিভাব ফুটিয়ে তুলে পাহাড়টা আমাকে তখন উত্তরে বললো, ‘এই, কিছু না দাদা, একটা সই চেয়েছিলাম।’ এই উত্তর শুনে আমি তো একেবারে থ। থ মানে থ… এক্কেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, আরেকটু হলেই মূর্ছা যেতাম।

শিরোনামহীন

সে সব বিকেলের কথা মনে পড়ে গেলে আজ আমি আকাশ হয়ে উঠি। আমার বুক থেকে যে অর্বাচীন তারারা অহর্নিশ খসে পড়ে, তাদের জন্যে আমি বিশেষ কোনও শোক করি না, শুধু করুণ চোখে তাকিয়ে থাকি। কাকতাড়ুয়ার দীর্ঘ কালো আলখাল্লায় ঢাকা আমার আপাদমস্তক। যার আস্তিনে সুঘ্রাণ কবিতার। তুমি তখন আমাকে সম্বোধন কর ‘শিল্পী’ বলে।

এখানে রুক্ষ পাথরও অমল ফুল হয়ে ওঠে তোমার চোখে। আলগোছে কুড়িয়ে নাও ভালবেসে, পরমাদরে জড়াও বুকে। এখানে অবলীলায় তুমি পা’য়ে দলে যাও সমস্ত রাখির বকুল। অস্তাচলগামী সূর্যের লালিমাকে সাক্ষী রেখে কী সহযেই বলতে পারো, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি।’

এখানে অরিত্রিকা, তুমি হয়ে ওঠো সেই আরাধ্য সঙ্গীত আমার, যা জীবনব্যাপী কখনওই গাওয়া হবে না।

শিরোনামহীন

তোমাদের মনে পড়ছে; তোমরা এখানে ছিলে
তোমরা ভালবাসতে রূপোর নূপুর, সবসময় পরতে
তোমরা প্রজাপতির মতো উড়তে, নাচতে
কিন্তু তোমাদের নূপুরগুলোতে শব্দ হ’তো না
আর আজও অজ্ঞাত ও রহস্যাবৃতই তা;
তোমরা ভালবাসতে শিশিরভেজা সবুজ পাতা
চাইতে, বারোমাসই এরকম শীত থাক শহরে
আসন্ন বসন্তের জন্য আমরা উদগ্রীব থাকি
(কী যে ছেলেমানুষী চাওয়া তোমাদের)

আমি দাঁড়িয়ে আছি নীল রেইনকোট পরে
সেই নিয়ন বাতির প্রাচীন ল্যাম্পপোস্টের নিচে
মুখোমুখি পরিপাটি কাঁচদালান, সুরম্য বিপনিবিতান
কিন্তু মনেমনে ঠিক জানি যে বৃষ্টি নামবে না, উঁহু
ভুল প্রমাণিত হবে গতরাতের বৃষ্টি সম্ভাবনার আবহাওয়া বার্তা
এভাবেই কালো মেঘে ঢেকে থাকবে সারা আকাশ, সারাদিন
(তবুও দাঁড়িয়ে আছি নীল রেইনকোট পরে)…
তারপর রাতভর ভাববো তোমাদের, তোমাদের নাম
আর যথারীতি গুলিয়েও ফেলবো
বৃষ্টি নিলা স্নিগ্ধা মাহমুদা শিল্পী রুমা

ঈশ্বর

জীবনভর আমি বিশ্বাস করেছি তোমাকে, কিম্বা হয়তো করিনি। হয়তো একদিন সত্যি সত্যি আমি তোমার অন্তরীক্ষ থেকে নেমে আসবার অপেক্ষায় ছিলাম, কিম্বা হয়তো ছিলাম না। হয়তো সবসময় তুমি পাশেই ছিলে, হয়তো ছিলে না। আমি দ্বিধাগ্রস্থ।

একদিন শহরের একটি কোলাহলময় সড়ক পেরোতে গিয়ে, অকস্মাৎ লাঠি হাতে জনৈক অন্ধ পথচারীর পাশে আমি তোমাকে গুটিসুটি বসে থাকতে দেখেছিলাম, ব্যথিত লজ্জাবনত মুখে। কিন্তু তুমি হাঁটছিলে না, শূন্যে ভেসে যাচ্ছিলে। আর এক পর্যায়ে খুব সম্ভবত সেই একই অজ্ঞাত কারণে যারপরনাই লজ্জায় দুহাতে মুখ লুকিয়েছিলে।

আমি তোমাকে আরও একদিন দেখেছিলাম, ভীষণ ঝর শেষে আলো নিভে যাওয়া থমথমে কালো রাতে, শহরের কোনও এক সুনির্জন সড়কে ঘুমন্ত শিশু কোলে নিয়ে একাকী হাঁটছিল জনৈকা তরুণী মা; ভীত অবিন্যস্ত মুখ। আর আমি আচানক তোমাকে আবিষ্কার করলাম, সেই দেবশিশুর পাশে শুয়ে থাকতে পরম নির্ভরতায়।

হয়তো সত্যিই তুমি ছিলে, কিম্বা হয়তো সবটাই নিছকই আমার ভ্রম, তুমি আদৌ ছিলে না কোথাও।

কোনও এক ক্ষণিকাকে

কতো কথা হলো বলা
কিন্তু বলাই হলো না আর
যে কথা বলবার ছিল আয়োজন দুজনার
উচ্চ রক্তচাপ কালোরাত নিয়ে এলো রোদ্দুরের দুপুরে
আমি সুচালো কাটাওয়ালা একটা সজারু দেখলাম
সহসা তোমার চোখে
প্রাণপণ ছুটে পালাচ্ছিল
লোকালয় ছেড়ে হয়তো কোনও গহীন অরণ্যে
হয়তো যেখানে ওর ঘর
অনিকেত কারই বা ভালো লাগে বলো
কী ভয়ঙ্কর
(হয়তো তুমিও তাই দেখেছিলে)
তারপর অনেক কথা হলো বলা
অনেক গল্প হাসি ছন্নছাড়া বাচাল প্রলাপ
আর এক পর্যায়ে যে যার পথে পা’ বাড়ালাম
অর্থহীন এক দীর্ঘশ্বাস পরেছিল যেতে যেতে শুধু
মরুময় ধূধূ বুক চিরে
(হয়তো তোমারও)

শিরোনামহীন

সড়কের পাশে ওখানে ছোটো একটি খেলার মাঠ ছিলো, টেনিস কোর্ট আকৃতির বা আরেকটু বৃহদায়তন। ইতিউতি ছড়ানো মলিন হলদেটে ঘাশ, এক প্রান্তে লাল ইটের পলেস্তারা খসা খর্বাকায় দেয়াল। ওতে ক্রিকেট খেলতো স্থানীয় শিশু কিশোররা। বর্ষা মৌসুমে এঁদো কাদায় ভরে যেতো। তখন ক্রিকেটের পরিবর্তে ফুটবল খেলতো তারা। কাদায় মাখামাখি টিশার্ট হাফ প্যান্ট গা’য়ে সে কী হুলস্থূল বল নিয়ে! হ্যা, দিব্যি মনে করতে পারছি, (ইত্যবসরে প্রায় এক যুগ কেটে গেছে যদিও) ওখানেই ছিলো মাঠটি, আজ বহুতল আবাসিক ভবন দাঁড়িয়ে আছে। অনেকদিন পর এলাম। মাঝেও দুয়েকবার এসেছিলাম সম্ভবত কিন্তু ইতিপূর্বে সেভাবে লক্ষ্য করিনি। আদতেই কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় এটা। এভাবেই মানুষের নগর বন্দর গড়ে ওঠে, উঠে আসছে। কিন্তু কেন জানি না, এ মুহূর্তে আমার বড্ড অনুতাপ হচ্ছে মাঠটির জন্য। মনে হচ্ছে, মাঠটিকে যেনো জীবন্ত কবর দেয়া হয়েছে ইট কাঠ পাথরের ওই অতিকায় দালানের নিচে। আহা, সত্যিই আমি দারুণভাবে চাই যে, আবার বহুদিন পর এলে দেখবো, সেই মাঠটিই আছে। ওতে ক্রিকেট খেলছে ঘেমেনেয়ে একাকার প্রাণোচ্ছল একদল শিশু। আর যদি বর্ষায় আসি তবে এঁদো কাদায় ধুন্ধুমার ফুটবল… আরও এক যুগ পর!

সেই দুটি চোখ আজ কার জন্য কাঁদে

সেই দুটি চোখ আজ কার জন্য কাঁদে
ক্যাফেটেরিয়ার ম্রিয়মাণ আলো আঁধারিতে
কখনও আমার জন্য যা ভরে এসেছিল নীল অশ্রুজলে;
সহসা নিকষকালো মেঘে ঢেকে গিয়েছিল সারা আকাশ
অবিরাম ঝর বৃষ্টিতে প্লাবন এসেছিল শহরে
ভিজে চুপেচুপে কাকগুলো সেদিন বসেনি আর ইউক্যালিপটাসের ডালে

বলো, সেই দুটি চোখ আজ কার জন্য কাঁদে
আমি তো দাঁড়িয়ে নেই কোথাও সম্মুখে তোমার
তবু কেন আজও কালো মেঘে ঢেকে যায় আকাশ
বৃষ্টি নামে মুষলধারে- আসে ঝড়, ভয়াল প্লাবন
ভিজে চুপেচুপে কাকগুলো- আজও মাঝেমাঝে
এক মাথা বৃষ্টি নিয়ে এলোমেলো উড়ে চলে দিক্বিদিক
কিন্তু বসে না এসে ইউক্যালিপটাসের নিরাপদ আশ্রয়ে

গোলাপ ফোটার কাল

গোলাপ ফোটার কাল আবার এসেছে পৃথিবীতে
গাঢ়তম মদিরায় পানপাত্র ভরে দাও আমার
আকণ্ঠ করাও পান
মিটিয়ে দাও এই কালো নীল তৃষ্ণা সাকি
আজ কিছু কর তুমি এর;
যদি পারো প্রিয় সখা সাকি
আজীবন তোমার ক্রীতদাস হয়ে র’বো
তার জন্য একটি কড়িও গুণতে হবে না তোমাকে
সম্পূর্ণ নিখরচার স্থায়ী এক গোলাম তুমি পাবে
যা ইচ্ছে তাই করিয়ো আমাকে দিয়ে
কুকুরের লাগামই না হয় পরিয়ে দিয়ো গলায়;
রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে তোমার সেবা করে যাবো,
শুধু এই রাতে তুমি মিটিয়ে দাও সবটুকু তৃষ্ণা আমার
তারপর যদি বলো, পাখি হয়ে উড়েই যাবো দূরের কোনও দেশে
চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবো, আর ফিরবো না কোনওদিন
তোমাদের শহরে, পানশালায়
যা কিছু স্থাবর আমার সব নিজের করে নিয়ো
অথবা এই এক স্থায়ী ক্রীতদাস তোমার
দাও সাকি, পান পাত্র ভরে দাও গাঢ়তম মদিরায়…
আহ্, শেষ পর্যন্ত দাও

এখানে তোমাদের চোখ

দ্বিধা নেই এখানে কোনও আর
এখানে তোমাদের চোখ
কোমল বসন্ত ফিরিয়ে এনেছে আবার
বায়ূ দূষণের এই প্রখর গ্রীষ্মে ।
সমস্ত সহজ অঙ্ক ভুলে যাই আমি
দুই দুগুণে চারের নামতা
হয়ে পড়ে ছয় ।

তবে এই ভুলে যাওয়া অনেক সুখের
কারণ এখানে তোমাদের চোখ
আমার চোখে জেগে রয় ।

অনুবাদ: নববর্ষ

নববর্ষ
হরিবন্শ রায় বাচ্চন

বর্ষ নতুন,
হর্ষ নতুন,
জীবনের উৎকর্ষ নতুন।

নতুন স্বপন,
নতুন স্পন্দন,
জীবনের নতুন আয়োজন।

নতুন আশা,
নতুন রাস্তা,
জীবনের নতুন পথ চলা।

গান নতুন,
প্রেম নতুন,
জীবনের রীতি নতুন,
জীবনের নীতি নতুন,
জীবনের জয় নতুন!