বিভাগের আর্কাইভঃ গল্প

আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

আঠাশ (ক)
বাবার ঘরে ঢুকতেই হাতে একখানা থিন বিস্কুট আর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ থাকার ইশারা। চাঁদ দেখল, তর্জনীর সমান্তরালে বাবার দু’গালে জলের দুটো সোঁতা। মা গাইছে “যে জানে না পথ কাঁদাও তারে”। কোন পথ? ফস ক’রে মনে পড়ে, গত বছর রেশনবাড়ির রথের মেলাতে সে দু’ থেকে আড়াই মিনিট হারিয়ে গেছিল।

রাস্তা ভিড়ের মধ্যে ব্যক্তির পা থেকে মাথায় উঠে আসে, অথবা যে-কোনও জমায়েতই প্রথমে আহার করে সড়কটিকে। মানুষ মূলত অচেনা ব’লে মানুষের ভেতর দিয়ে খুঁজতে গেলে নিজের বাড়ির দিশা আর পাওয়া হয় না। তখন কান্না আসে শিথিলতার মতো। একটু কেঁদে নিই, পরে নয় আবার খুঁজব। বাবার রোদনও গানের সঙ্গে ওই রকম একটা সমঝোতায় এসেছে মনে হল। নইলে, তার তো এতবড় হাঁ ক’রে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে ছিরকুট্টি করার কথা। নাকি বাবাদের হৃদয়ব্যথা এরকমই হয়! চাঁদ বিস্কুট হাতে ব’সে থাকল কিশমিশের জন্যে, যদিও ধূপের ধোঁয়ার মতো ময়ানের মাখন-গন্ধটা তাকে অবশ ক’রে দিচ্ছে। ঝুঁকে বাবার মুখ পড়তে গেল “অংকবই নিয়ে আসব?” প্রশ্নসহ; কিন্তু মুড বদ্‌লে নির্মল এখন স্যাঁতসেতে চোখেই মুচকি হাসি দিচ্ছে। মায়ের নতুন গানে অনেক দুখদরদের কথা থাকার পরেও বাবার এত পুলক কীসের!

চাঁদ তো দ্যাখেনি, ভটচাজরা ছিল খুলনার ‘ধানি-পানি গিরোস্তো’, দক্ষিণ-এ মানে সুন্দরবনে তাদের বেশ কিছু ঘর প্রজা ও আবাদ। রানী রাসমণিরও জমি-জিরেত সে-আবাদের পাশে। এ-হেন ফ্যামিলিতে মেধাবী, সুপুরুষ কিন্তু অনভিলাষী ছোট ছেলেটা কাব্যতীর্থ পাশ ক’রে দৌলতপুর স্কুলে মাস্টারি জোটাতেই বাড়ির লোকজন তাকে সংসারী করতে ব্যস্ত হল। ঘটক খবর নিয়ে আসে — পালটি ঘর, সম্পন্ন পরিবার, সুন্দরী পাত্রী; কিন্তু নির্মলের এক কথা, পড়াশুনোর বাইরে অন্য কোনও ঝক্কিতে সে ঘাড় পাতবে না।

এর মধ্যে এক বর্ষাভোরে সেনহাটির লাগোয়া গ্রাম মহেশ্বরবাসা থেকে ননীবালা নামের বিধবা মহিলাটি এসে খুব করে ধরে বসলেন নির্মলের ঠাকুরদাকে। তার দুই মেয়ের বড়কে যদি একটিবার দেখে আসা হয়। মেয়ের বাবা ঝালকাঠির জমিদার ঘোষালের আসর-ম্যায়ফিলে বাঁশি বাজাত, হঠাৎ করে কালাজ্বরে মারা গেছে গতবছর। তারা নিতান্ত গরীব, দেওয়া-থোয়ার সামর্থ্য নেই, মেয়ে যে রূপবতী এমন দাবীও করছেন না, তবু…।

টালির চাল ফুটো হয়ে বৃষ্টিতে বিছানা ভেসে যাচ্ছে, এদিকে ঘরে ডুগি-তবলা, ফ্লুটবাঁশি… এক কোণে ছেঁড়া চাদরে জড়ানো একটা এস্রাজও। গান জানো, মা?

শ্যামরঙা রোগাসোগা মেয়েটা গেয়েছিল ‘দুঃখের বরষায় চক্ষের জল যেই নামল’। শেষ হতে সে মুখ-নিচু ব’সে, আর চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে পাত্রের বাবা, ঠাকুরদা, দুই পিসি…গোটা শ্বশুরবাড়ি টিম। এরপর থেকে প্রতিদিন সন্ধেবেলা সেনহাটির সেই ভদ্রাসনে হাঁক পড়ত, কি ছোটবৌমা, আজ রবি ঘটকের গান শুনতি পাবো না বুঝি!

এ-বঙ্গে আসার পর নির্মল কাউকে না ব’লেক’য়ে একটা পুরোনো সিঙ্গল-রিড হারমোনিয়াম কিনে আনল। নয়ত কবেই তার বউ কলতলায় খ্যানখেনে চোপা করা মাথায় বড়িখোঁপা বাঙালি সামুরাই হয়ে যায়! পাত্রীদেখার দিনের মতো চায়ে অতটা চিনি মায়া এখন দেয় না, তেমনি তার সেই প্রথম শোনানো গানের লিকার, দুধ, খুশবু আরও টনকো হয়েছে গত তিরিশ বছরে।

নির্মল হাসবে না কেন?

আঠাশ (খ)
আসলে বাসুরই ভুল; শুরুতেই যাওয়া উচিত ছিল চাষিপাড়ার ডিরেকশানে, ধরো, ইসুবাটি কি কালিয়ানই। ওদিককার লোকজন সন্ধে একটু ডাগর হলেই খাওয়া-দাওয়া সারে, খুব ভোরে উঠে মাঠ নিড়োতে যেতে হবে না? অনেকটা হেঁটে যশোর রোড, তেঁতুলতলার ব্রিজ পার হয়ে বাসু এসে ঢুকল ইসুবাটির মুখে। তারপর একটা ঘনমতো বাঁশবাগান দেখে থলে উপুড়।

ফিরে আসার রাস্তায় নিজের পাদুটো আর টানতে পারছিল না তাকে। কিশমিশ কী করছে এখন ভরপুর ভয়ে স্ট্যাচু হয়ে থাকা গাছপালার অন্ধকারে? মিউ-মিউ ডেকে বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়, গা ঘেঁষে হর্নের ধমক বাজিয়ে ছুটে যাচ্ছে টেম্পো বা সাইকেল? হয়ত কুকুরের দল সারারাত ওকে তাড়া করে মেরে ফেলতে চাইবে আর রেহাই পেলে কাল সকালে স্কুলের বাচ্চাদের হাতের টিপ-প্র্যাকটিস! কেন সে কিশমিশের জন্যে ভাইবোনের সঙ্গে গলা মেলাল না? নয় ঘরে ঢুকতে দিত না, ছুঁতোই না, শুধু খাবার বেড়ে দেওয়া কলতলার চাতালে। তবু চোখের সামনে থাকত তো বেড়ালটা! কত বড় জহ্লাদের মতো সে তাকে যমের মুখে ফেলে দিয়ে এসেছে।

মৈত্রী সংঘ পেরিয়ে আর একটা বাঁক, তার পরই নিজের পাড়ায় ঢুকে যাবে। মায়ের গলা প্রজাপতির মতো বাতাস সাঁতরে আসছে — ধন্য এ জাগরণ, ধন্য এ ক্রন্দন, ধন্য রে ধন্য। হঠাৎ…আরে, সামনে ওটা কী…কে ওটা…কিশমিশ না! বাসু ছুট্টে গিয়ে কোলে তুলে নিয়েছে—কীভাবে চিনে এলি এতদূর থেকে, আমি তো খেয়ালই করিনি… চল চল, মাকে সব বুঝিয়ে বলব। কিন্তু কিশমিশ কেমন ছটফট করছে কোলের মধ্যে; ওহ নামবি, হিসু করবি বুঝি? বাসুদেব ওকে রেখে দিচ্ছে মাটিতে। আর তখুনি সেই বেড়াল লাফ দিয়ে উঠে গেল চণ্ডীবাবুস্যারের বাগানঘেরা বাড়ির ছ’ফুট পাঁচিলে। তখন অর্ধেক চাঁদ মাথার ওপর বিচারকের আসনে, জ্যোৎস্নায় গোটা পৃথিবী ধোয়ামোছা পুজোমণ্ডপ। আর পাঁচিল থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে ভীষণ এক অচেনা চোখে তাকিয়ে আছে কিশমিশ! ঘাবড়ে গিয়ে যেই অল্প একটু হাত বাড়াবে, চটাং ক’রে লাফ দিল ওই অতোটা উঁচু থেকে, বাগানের ভেতর। কিচ্ছু বুঝতে পারছিল না বাসু। অপেক্ষা করল… অপেক্ষা করল, তারপর “কোথায় গেলি, ফিরে আয় লক্ষ্মীটি, তোকে আর কোনওদিন ফেলে আসব না, মা ষষ্ঠীর দিব্যি”। ডাকতে ডাকতে তার গলা থ’কে যাচ্ছে, বাতাসে নামা কদমরেণুর মতো হিমে ভিজে যাচ্ছে কথাগুলো।

চাঁদের আলো ঠিকরোনো বাগানের কলাপাতা শুধু মাথা নাড়ছিল — না, না, না…।

.
(শেষ)

কানের ভেতরে আঙুল

আরশি কদম আলীর ছোট মেয়ে। তিনজনের মধ্যে তৃতীয়। বয়স মাত্র পাঁচ বছর। বলা চলে একটি সুবাসিত ফুলের কুঁড়ি। মুখে গুটিকয়েক দাঁত উঁকি দিয়েছে। সেই দাঁত মেলে যখন হাসে তখন কদমের ঘর আলোকিত হয়ে উঠে। আর যখন কাঁদে তখন আষাঢ়ে বৃষ্টির মতো আঁধার নেমে আসে। আরশির মুখে কাবুলিওয়ালার মিনির মতোন অনর্গল কথার খৈ ফুটে। সে ভুতেদের জ্যান্ত ছবি আঁকতে পারে। পুতুলের বিয়েতে কান্নাকাটিও করতে পারে। এভাবেই কদমের কুঁড়েঘরে রোদ-বৃষ্টির খেলা চলে। ওর হাসি, অভিমানী কান্না, হাঁটা-চলা, কথা বলা সবকিছুতে এতো আলো যে, কদম মেঝেতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দিয়ে উড়তে থাকে। মেঘের সাথে কিছুক্ষণ ভাসার পর আরশির আকস্মিক ডাকে মাটিতে ফিরে আসে।

রোজকার মতো আজও আরশি আর কদম একসাথে ঘুমিয়েছে। এই ঘুম যেমন-তেমন ঘুম নয়। রীতিমতো বারো-তেরো হাত লম্বা ঘুম। এই ঘুমের আবার কয়েকটি বিশেষ স্টাইল আছে। এই যেমনঃ প্রথমেই আরশি কদমের বুকের উপর বুক রেখে শুইতে হবে। অতঃপর যতক্ষণ না আরশি ঘুমের রাজ্যে বেড়াতে না যায়, ততক্ষণ চলতে থাকবে কদমের গল্প বলা। অবশ্য এখানেই শেষ নয়, গল্পের বাঁকে বাঁকে চলতে থাকে প্রশ্নের উপর প্রশ্ন। আর এসব প্রশ্নও যেন-তেন প্রশ্ন নয়। ধারালো তলোয়ারের মতো সুতীক্ষ্ম সেসব প্রশ্ন। কোনোরকম গড়-পরতা উত্তর দেওয়ার জো নেই। তাহলে জরিমানাসহ এর মাসুল গোনতে হয়।

ঘুম ভাঙতেই কদম বুঝতে পারে, সে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। একটি বিশেষ অবস্থা নিজের অজান্তেই অতিক্রম করে চলেছে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই রহস্যের জাল ছিঁড়ে যায়। কদম বুঝতে পারে, তার দুই কানের ভেতর দুটি মিহি আঙুল ঢুকানো আছে। চোখ না মেলেই বুঝতে পারল এ এ নিশ্চয়ই আরশি কাজ। আরও বুঝতে পারল নিশ্চয়ই এর কোনো জবরদস্ত কারণ আছে। কারণ আরশি উদ্দেশ্যহীন কোনো কিছু করে না। কদম কিছুক্ষণ চুপচাপ অপেক্ষা করল। আরশি একইভাবে দুই কানে দুই আঙুল ঢুকিয়ে কদমের মাথার পাশে বসে আছে। অবশেষে আরশির ধৈর্যের কছে কদম আলী পরাজিত হল। জিজ্ঞেস করল, আমার কানে আঙুল ঢুকিয়েছ কেন মা?

আরশি বলল, মাম্মা সেলাই মেশিন চালাচ্ছে তো। তাই অনেক শব্দ হচ্ছে। তোমার যাতে ঘুৃৃম ভেঙে না যায়, এজন্য আমি তোমার কানে আঙুল ঢুকিয়ে অনেকক্ষণ যাবৎ বসে আছি বাবা। বাবা, আমি কি ভালো কাজ করিনি?
আরশির কথা শুনে কদম খুব খুশি হল। এইটুকু মেয়ের এতোটা সুতীক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি! দেখে তার বুক সাত আকাশের সমান বড় হয়ে গেলো আর কেবলই হযরত বায়েজিদ বোস্তামীর নাম মনে হতে লাগল। কদম আলী আরশির প্রশ্নের কোন জবাব দিল না আরশিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো।

আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

আঠাশ (ক)
আকাশ থেকে টাঙানো ছায়ার কুচি দেওয়া ফুল সাইজ বিকেল, সেই চাঁদোয়ার নীচে হারমোনিয়াম বেজে উঠল। কলোনির বাচ্চারা ডিঙি পেড়ে জানলা দিয়ে তাকিয়ে খিকখিক ক’রে হেসে পালাচ্ছে — এমা এত বড় কাকিমা গান গায়! মায়ের মুখোমুখি বিভোর শিউলি; পাশে চাঁদ বেলোর ফুটোয় পায়ের আঙুল ঢুকিয়ে দিচ্ছে আর ততবার মাথায় হালকা চাঁটি সঞ্জুর। ননীবালা ঘরে ঢুকে চৌকাঠের কাছে করজোড়ে বসে পড়ল। তাই দেখে নাতিনাতনির হাসি — হিন্দি সিনেমার গান শুনলেও দিদ্‌মা হাতজোড় ক’রে দেয়।

সংগীত, ঈশ্বর, মৃত স্বামী — তিনটির ‘পরে ভক্তি ননীবালা এই প্রার্থনাভঙ্গির ভেতর দিয়ে একজোটে প্রকাশ করে। পাশের ঘরে চায়ে চুমুক দিতে দিতে নির্মল ভাবছিল শ্বশুর জানকী চাটুজ্জের কথা। যত রকম সুষিরযন্ত্র, সবই নাকি বাজাতে পারতেন ভদ্রলোক। বাঁশিজানকীর বাজনা শুনে কেঁদেছে এমন মানুষ পূর্ববঙ্গে অবিরল। আর তার মেয়ের ঠোঁটের বদলে গলায় লেগেছে সুর।

‘প্রভু আমার প্রিয় আমার’ দিয়ে মায়ার শুভ মহরত, হারমোনিয়ামে কন্ঠ মিশে কাঠের উনুনের ধোঁয়ার মতো ভরিয়ে দিল ঘর। কথাসুরের চাপ বাড়তে বাড়তে ‘মুক্তি আমার বন্ধনডোর’-এ বাড়ির দেয়াল ধপাধপ মাটিতে লুটোচ্ছে, সন্ধের বাতাসপথে নির্মল হাঁটতে লাগল ‘দুঃখসুখের চরম’-এর ভেতর দিয়ে। ‘চরম’ শব্দে ধানিধা-র তিরতিরিয়ে কেঁপে ওঠা এই সংগীতপরিধির শ্রেষ্ঠ বক্রতল, অন্তরার পরে গান থেমে গেলেও ক্ষতি ছিল না।

নির্মল রবীন্দ্রসংগীতের কোল ঘেঁষে বসেনি কোনও দিন। অল্প বয়েসে জমিদারবাড়িতে ওস্তাদের কাছে তালবাদনে দীক্ষার পর অপরিসীম ঝালমশলা-পছন্দ মানুষের মতো সুর আর লয় যত গুরুপাক, ততই ফুর্তি তার। অথচ রবি ঠাকুরের খেয়ালআশ্রিত গানে তানালাপ নেই, ধ্রুপদাঙ্গের গানে বাঁটের কৌশল মার গেছে। রাগসংগীতের পর নির্মলের চরাবরা ছিল কাঙাল ফিকিরচাঁদের বাউল, কালী মির্জার টপ্পা, গোবিন্দ অধিকারীর পদাবলী, মধু কান-এর ঢপ কীর্তন বা মনোমোহন বসুর পাঁচালীগানে। গীতিকবিদের ঘনিষ্ঠ সেই জনসংখ্যাও দিন দিন ক্ষয়ে আসছে।

মায়া গাইতে গাইতে আবার ঘুরল পূজাপর্যায়ে — চারিদিকে দেখ চাহি হৃদয় প্রসারি। স্থায়ীটুকু শুনেই নির্মল বুঝেছে, মালকোষে ‘লাগি মোরে ঠুমক পলঙ্গনা, রীন নদিয়া ধরতী রণমোহি’ ভেঙে তৈরি এ-গান। শুধু রবীন্দ্রনাথ কোমল রে আর কড়ি মা লাগানোয় ‘আনন্দধারা’ মিশ্র-মালকোষে গিয়ে দাঁড়াল। মায়া পণ্ডিতি জানে না, তার গলা এক দীর্ঘ কবিতা যার মর্মকথা বীভৎস ভালো টোনাল কোয়ালিটি; এমন ওজনদার অথচ মিছরি অথচ জিভে লেগে থাকা ইনোসেন্স তুমি কোনও তালিমে হাসিল করতে পারো না। গায়কের বৈশিষ্ট্য বলতে গিয়ে শার্ঙ্গদেবের সংগীতরত্নাকর লিখছে, ‘হৃদ্যশব্দঃ সুশারীরো গ্রহমোক্ষবিচক্ষণঃ’; গায়কের প্রথম গুণটাই হতে হবে হৃদ্যশব্দ — মনোহর কন্ঠের অধিকার। আর সব শেষে লাগবে ‘সুসম্প্রদায়ো গীতজ্ঞৈর্গীয়তে গায়নাগ্রণীঃ’, মানে উত্তম গুরুপরম্পরা। আজকাল যতই গুরু আর ঘরানা নিয়ে মাতামাতি হোক, দেখা যাচ্ছে সাতশো বছর আগে শিল্পীর স্বশিক্ষা আর প্রতিভার ওপরেই ভরসা রাখা হতো বেশি। কিন্তু কলকাতার লোকজন কাঁচা, জ্যান্ত, এখনও-লাফাচ্ছে অনুভূতি গানে বসায় না; শিল্পীরা রবীন্দ্রসংগীত গায় হাঁমুখ না খুলে। নির্মলের আবার সংগীতরত্নাকর মনে পড়ল — গায়কের প্রথম দোষ হল ‘সংদষ্ট’, দাঁত চেপে গান।

আঠাশ (খ)
ফাঁকা রেলস্টেশনে একটা হৃদপিণ্ড-বসানো থলে হাতে দাঁড়িয়েছিল বাসু।

— তোমাগো বিড়েল অ্যাক্কেবারে তোমাগো মতোই হইছে, সেই রকম পাকা চোর আর নেমোখারাম!
এটা মা।
কিশমিশ আগে থেকেই কর্তৃপক্ষের কুনজরে ছিল, শিকে লুটপাট ক’রে দু’পিস মাংস খেয়ে নেওয়াটা তার খুব কৌশলগত ভুল হয়ে গেছে।

বাসু হয়ত শিউলি-চাঁদের মতো বিল্লিপাগল নয়, তবু একটা দুপুর বেড়াল দেখেই কাটিয়ে দিতে পারে। চান না করেও ওরা কেমন ডালিয়া ফুলের মতো ঝকঝকে আর পিঠে একটু হাত ছুঁইয়েছ কি গলায় গার্গল করার শব্দ। মুখের দিকে ঠায় তাকিয়ে এমন বসে থাকবে, এতবার মিউ মিউ ডাকবে যে সন্দেহই থাকে না তোমার দেওয়া মাছের কাঁটাটা, পাঁউরুটির টুকরোটা, এমনকি সকালের মুড়ির বাটি থেকে মেঝেয় ছড়ানো মুড়িগুলো তাড়া করে খেতে পারছে বলেই ও বেঁচে আছে। আশ্রিতকে ত্যাগ করা ঘোর অন্যায় — এটা বাবার উক্তি।
আর কিশমিশই তো তাদের একমাত্র আশ্রিত।

ব্যাগের হ্যান্ডেল একটু ফাঁক ক’রে তাকায় বাসু — নিশ্চিন্তে শুয়ে থাবা চেটে যাচ্ছে! এবার সে ডাউন বনগাঁ-য় উঠে পরের স্টেশন বামনগাছি আসতেই ব্যাগ থেকে বার ক’রে কোলে নেবে কিশমিশকে। ট্রেন স্টেশান যেই ছেড়েছে, আস্তে করে নামিয়ে দেবে প্ল্যাটফর্মে। “কী হল বাসুদাদা, তুমি নামবে না” — কিশমিশ ছুটছে ট্রেনের পাশে-পাশে। তারপর যখন টের পেল সামথিং ইজ মেছো, মারল একটা প্রাণপণ ঝপাং। কিন্তু রানিং করা তো শেখেনি, উঠেই ডিগবাজি খেল, মাথা ঠুকে গেল গাড়ির লোহার দেয়ালে। তক্ষুনি কোলে তুলে নিয়েছে বাসু। কিশমিশ গোল শুঁয়োপোকার মতো চার হাতপায়ে বাসুর ডান কবজি পেঁচিয়ে ধরে আছে — “আবার ফেলে দেবে না তো”!

আঠাশ (ক)
মায়ার গলায় ব’সে থাকা দীর্ঘ কবিতার দ্বিতীয় গুণ তার অসহ্য নরমতা। সারাক্ষণ সংসার দাবড়ে রাখা মহিলা একটা সুর উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে ধানের ছড়ার মতো নুয়ে পড়ে কীভাবে? নির্মল ভাবে, রমণে আর সংগীতে ফনফনে লম্বা মায়া যেন কুঞ্জরাস্য — পেশিময় অথচ তুলতুলে! যেভাবে রেওয়াজ চাও, এক-ডাকে সাড়া দেবে।

শিউলির স্কুলে অ্যানুয়াল ফাংশান আছে, তার বায়না মেনে মায়া ধরল ‘ওরা অকারণে চঞ্চল’। ওমনি চাঁদের “আমিও এই গানটা পারি” ব’লে বেসুরো বেহেড চিৎকার। ভটচাজবাড়ির সবার গলায় সুর আছে, শুধু এ-ছেলেটা হল “রাজু পোড়া বাজু”। শ্লোকের মানে বোঝে না চাঁদ; যেমন ওকে ছোঁড়া আর একটা ঢিল “গলা নেই গান গায় মনের আনন্দে, বউ নেই শ্বশুরবাড়ি যায় পূর্বের সম্বন্ধে”-র দ্বিতীয় অংশ রহস্যগল্পের মতো ঠ্যাকে। পুব দিকের সঙ্গে সূর্য ওঠার সম্বন্ধ আছে, কিন্তু বউ কোথায় গেল? কলোনিতে বিভাসকাকুর বউ বিন্দুকাকিমা পালিয়ে গেছে, সে সারাদিন মদ খেয়ে টাকাপয়সা এদিকসেদিক হারিয়ে ফেলে। তাছাড়া এই কলোনির কেউ শ্বশুরবাড়ি যায় চাঁদ শোনেনি, সবার শ্বশুরই নিরুদ্দেশ।

তখন মায়া গলা তুলে নির্মলকে বলল, শুনতিছেন, শয়তানডারে এট্টু আপনার কাছে ডাকেন না! গাতি দেচ্ছে না যে। এবং তখুনি ছেলের দিকে ফিরে: ওই যে বাবা ডাকিছে, ওঘরে যাও।
— কই, আমি তো শুনতি পালাম না!
— তুই শুনতি পাস? তুই কানপচা কালা না? ব’লে শিউলি তার বাঁকানের কাছে নাক নিয়ে যাওয়ার উপক্রম করেই মুখ সরিয়ে আনে :
— বাবা রে, কী গন্দো!
এইভাবে সাজানো চিত্রনাট্যের শিকার চাঁদ নির্মলের ঘরে উঠে যেতেই মায়া আবার জলে খেলা করা মাছের মতো পেছল, প্রশমিত, রহস্যবর্ণ। সঞ্জুর মনে হয় মনোহারি জিনিস বেচা ফেরিওলার হাতে যেমন কাচ লাগানো সুটকেস থাকে, মায়ের হারমোনিয়ামও ঢাকনা খুলে এক-একটা গয়না বের করে আনছে। এবার ছাই রঙের কারুকাজ করা আংটিটা তোলা হল : ‘আমার জ্বলেনি আলো অন্ধকারে’।

আঠাশ (খ)
‘মিশন পণ্ডশ্রম’ সেরে উলটো দিকের ট্রেন ধরে ফিরে এল বাসু। স্টেশানে নেমে হাঁটা দিল নিবাধুই স্কুল ছাড়িয়ে চড়কপাড়ার ওপাশটায়। মা কাল রাতে বুঝিয়েছে, চাঁদের সর্দিকাশির অসুখ বেড়াল ঘাঁটলে কোনওদিন সারবে না। তাছাড়া কিশমিশ তো মেনি, একটু বড় হলেই ছ’মাস অন্তর সংসার বাড়াতে থাকবে। তার চেয়ে এখন পার কর।
শুনে চাঁদের সে কী রাগ! বাবার সিগারেটের ধোঁয়াতেও তো আমার টান বেড়ে যায়, তাহলে বাবাকে পার করছ না কেন? ছ’বছরের ছেলের আস্পদ্দা দেখলে ভয় লাগে। বড় হয়ে খুনি-ডাকাত হবে, কুষ্ঠি কি আর ভুল লেখে কখনও!
—- বাবারে তাড়ালি খাবি কী? তাছাড়া, মানুষ আর বিড়েলের বাচ্চা এক হলো!
— ইশকুলে লেখাদিদিমনি বলেছে, বিজ্ঞানী জগদীশ বসু আবিষ্কার করেন, উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। তার মানে মানুষ-বেড়াল-গাছপালা সব এক।

এদেশিদের পাড়া জোড়াবটতলা পৌঁছে দেখা গেল, মোড়ের মাথায় চায়ের দোকান জমজমাট, কিন্তু সামনের কাঁচা রাস্তার অনেকখানি অন্ধকারে ডুবুডুবু। সেই ভুতুড়ে ঘুপচিতে ঢুকে বাসু যেই ব্যাগ থেকে নামিয়েছে কিশমিশকে, কোত্থেকে টর্চের আলো — “কী হচ্ছে এখানে?” পেটমোটা লোকটার গায়ে কঠিন সেন্টের গন্ধ: “এ-পাড়ায় অলরেডি ছত্রিশটি ষষ্ঠীর বাহন। আমি নয়ন মুখার্জি, নাট্যকার, পাক্কা খবর রেখেছি, সামনের ফাল্গুনেই আমরা হাফ সেঞ্চুরি ক্রস করে যাব। কিন্তু বে-আইনি ভাবে তো জনসংখ্যা বাড়াতে দেওয়া যায় না, বাবুসোনা! পাসপোর্ট নেই, ভিসা নেই, মানে পিয়োর অনুপ্রবেশ। সোজা তুলে নিয়ে চলে যাও।“

.
(পরের বার শেষ)

কুকুর চক্রে

আপনারা হয়ত অনেকেই জানেন না আমাদের খেজুরতলার লোকজন বেশ কুকুরভক্ত। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অঞ্চলে কুকুর সংখ্যা লক্ষনীয় এবং রাস্তার পাশে তাদের বিষ্ঠাও সমান দর্শনীয়। মানুষের আদরে এরা খেয়ে-দেয়ে বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট, চমৎকার লম্ফ-ঝম্প দিতে পারে। দিনের বেলা আরামসে ঘুমায় আর রাতের বেলা গলা ছেড়ে ঘেউ ঘেউ করে। এইসব নিয়ে আমাদের কারোরই মাথা-ব্যথা নাই। পথের ককুর পথে আছে, আমরা আছি আমাদের কাজে। নিজেদের চিন্তারই কুল করতে পারি না, কুত্তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কই।

কিন্তু মাথা ঘামাতে হল। মহল্লার সকলকে কুকুর নিয়েই ভাবিত হতে হল। কুকুরদের সাম্প্রতিক কার্যক্রম যথেষ্ট ভাবনার উদ্রেক করে। রাতে এরা সবাই দল বেঁধে ৭৪ নাম্বার বাসার সামনে হাজির হয় এবং সেই বাসার সামনে এরা ঠ্যাং উচিয়ে হিসু করে। এলাকার সমস্ত কুকুর একজোট হয়ে কাজটি করছে। এর আগে কুকুরের বিষ্ঠা নিয়ে নিয়ে কেউ কেউ ভাবিত হলেও কুকুরের মুত্র নিয়ে ঠিক কাউকে ওভাবে চিন্তিত হতে দেখা যায় নি। সারাদিন কুকুরেরা যে যার মত ঘুরছে-ফিরছে খাচ্ছে দাচ্ছে যেখানে সেখানে প্রয়োজনমত প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারছে। ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা রাত দুটোয়। দুটার পরে সবাই চুয়াত্তর নম্বরধারী নাইটকুইন নামের বাসাটার সামনে হাজির হয়ে দলবেঁধে কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে, শুয়ে বসে থাকে। যেন তাদের নৈশ বিলাস। তারপর তারা ওখানে একসাথে ঠ্যাঙ উচিয়ে হিসু মেরে যে যার মত চলে আসে। দেখে মনে হয় চুয়াত্তর নম্বরের সাথে ওদের চরম শত্রুতা।

এটা নিত্যদিনের ঘটনা। প্রথমটায় কেউ খেয়াল করেনি। সবাই বিষয়টাকে ক্যাজুয়ালি নিয়েছিল। পরে সিরিয়াসলি না নিয়ে উপায় নাই। দরকারে বেদরকারে রাত্রিকালে কেউ ভয়ে বের হয় না। দারোয়ানরা দরজা বন্ধ করে চুপ মেরে বসে থাকে। দৈনিক মূত্রবিসর্জনের ফলে বাড়ির সামনে বিকট দুর্গন্ধ তৈরি হয়েছে। সে বাড়ি পার হতে গেলে নাকে হাত দিয়ে তবে পার হতে হয়। ৭৪ নম্বরের অনেক ভাড়াটিয়া বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিয়ে দিয়েছে।
সমস্যা আরো গুরুতর, মহল্লার মুখেই চুয়াত্তর নম্বর বাড়িটি। সুতরাং আসা যাওয়ার পথে কুত্তার মুতের গন্ধ গায়ে না মেখে উপায় কম। ঢাকা শহরে থাকতে গেলে নানা রকমের দূর্গন্ধ না খেয়ে কেউ থাকতে পারে না। পথে ঘাটতে এখানে সেখানে নানান গন্ধ-দূর্গন্ধ লেগেই আছে। তাই কুকুরের গন্ধ নিয়ে এত মাথা ব্যাথার কিছু ছিল না। কিন্তু কুকুরের দলবেঁধে প্রস্রাব করার বিষয়টা জনমনে সহজে আগ্রহ তৈরি করে। এর আগে কবে কুকুরেরা কখন ঠিক এই রকম কাজ কোথায় করেছে সেটা আমাদের কারোরই জানা নেই।

সিকিউরিটিরা কুকুরদের ছত্রভঙ্গ করতে গেলে তাদেরকে তাড়া খেতে হয়। এমনিতেই এলাকার কুকুরগুলো বেশ শান্ত নিরীহ প্রকৃতির। কাউকে তাড়া করে না, কামড়ায় না, কেউ শুধু হাত জাগালেই বরং দৌড়ে পালায়। কিন্তু রাতের বেলা দলবদ্ধ মূত্র বিসর্জনের সময় তারা বেশ মারমুখি ভঙ্গীতে নাকি থাকে। রাতের বেলা আশেপাশের কৌতূহলী লোকজন জানালাখুলে এই কুকুরকান্ড প্রত্যক্ষ করে।

শক্তি প্রয়োগে যখন ছত্রভঙ্গ করা গেল না তখন আসে কৌশলের কথা। তখন আমাদের হারিস ভাই আমদের বুদ্ধি দিল বাঁশের বেড়া দিয়ে দাও কুকুরেরা সেখানে যেতেই পারবে না। বিষয়টা নিয়ে হারিস ভাইয়ের উৎসাহ লক্ষ্যনীয়। চুয়াত্তর নম্বরের বাড়িওয়ালা রাসেল মিয়া নাকে তেল দিয়ে ঘুমালেও হারিস ভাই সেটা পারছেন না। তাঁর মতে খেজুরতলা সোসাইটির কমিটির মুরুব্বীরা কোন কাজের না। তাদের পক্ষে দুনিয়ার কোন সমস্যার সমাধান সম্ভব না। তারা তো মানুষের গু-মুতের সমস্যারই সমাধান করতে পারে না, কুকুরের গু-মতের সমস্যা কিভাবে দূর করবে! আমাদেরই বরই এই কমিটি পালটানো দরকার। এবং পরিবর্তিত কমিটিতে তাঁকে সেক্রেটারী করা দরকার। তার উৎসাহ দেখে নিন্দুকেরা বলল, ঘটনার পেছনে তাঁর হাত আছে, অর্থাৎ তার নির্দেশেই কুকুরেরা এই অপকর্ম সাধন করছে। হারিস ভাই চতুর মানুষ হলেও তাঁর কথায় কুকুরেরা কারো বাসার সামনে গিয়ে দলবেঁধে মূত্র বিসর্জন করবে, এটা আমার বিশ্বাস হয় না। শুধুমাত্র চতুরতা দিয়ে দুনিয়াসুদ্ধ কুকুরদের বশ করা যায় না।

নিন্দুকের কথায় দমে যাওয়ার লোক হারিস ভাই না। তার মতে দুনিয়াতে একটা জিনিসের কোন অভাব নাই, আর তা হল নিন্দুক। সুতরাং চুয়াত্তরের বাড়িওয়ালা রাসেল মিয়াকে সকাল বিকাল দুটো করে গালি দিয়ে তিনি আমাদের মত উৎসাহী ছেলেদেরকে দিয়ে দুইটা অস্থায়ী বাঁশের বেড়া তৈরি করিয়ে নিলেন। আমরা রাতে বেলা সেগুলো দিয়ে দুদিকে দুইটা ব্যারিকেড দিয়ে দিলাম। কিন্তু রাতের বেলা দেখা গেল নানা চিপাচাপা দিয়ে ফাঁকফোকর গলিয়ে তারা ঠিকই জায়গামত মিলিত হচ্ছে।

চুয়াত্তর নম্বরের বাড়িওয়ালাকে বলেকয়ে সব ফাঁকফোকর বন্ধ করানো হল। এবার কুকুরদের আর আসার কোন উপায় রইল না। কিন্তু রাতের বেলা কুকুরেরা বাঁশের বেড়ার সাথে রীতিমত যুদ্ধ শুরু করে দিল। ওরা সবাই দলবেঁধে ছুটে এসে বাঁশের বেড়ার উপর আছড়ে পড়তে লাগল। এভাবে পড়ে পড়ে তারা সেই বেড়া ভেঙ্গে ফেলল। সে এক দেখার মত দৃশ্য। কেউ যেন ওদেরকে শিখিয়ে দিয়েছে, এক একটা কুকুর দূর থেকে ছুটে আসছে আর বেড়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ওদের উপর যেন জালিম ভর করেছে। সবগুলো যে পাগলা কুকুর। আর ঠিক এই জায়গায় এসে হিসু করতে না পারলে ওরা বোধহয় মরে যাবে এমন একটা বিষয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকে ভয় পেয়ে গেল। অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে লাগল। সমস্যাটা এখন আর শুধু চুয়াত্তর নম্বরের নাই। সার্বজনীন হয়ে উঠল।

আমাদের খেজুরতলার শত বছরের ইতিহাসে এই ধরনের জটিলতার জন্ম কখনো হয় নাই। অন্যভাবে ভেবে দেখলে জিনিসটা হয়তো ভালই। আমরা সকলেই এই জটিলতায় জড়িয়ে যাচ্ছি। কমবেশি সবাই এই নিয়ে কথা বলছি, মতামত দিচ্ছি। আগে যেমন একজন আরেকজনকে দেখলে হনহন করে ছুটে চলে যেতাম এখন আর সে অবস্থা নাই। সবাই সবার সাথে দুটো কথা বেশি খরচ করছি। হোক না তা রাস্তার কুকুর নিয়ে তবু তো সবাই কথা বলছে। আমাদের পঁচা মবিলের মত একঘেয়ে নাগরিক জীবনে হঠাৎ একটা মৌমাছি এসে পাখা নাড়তে শুরু করল।

সুতরাং আমরা সবাই হারিস ভাইয়ের নেতৃত্বে দলবেঁধে খেজুরতলা সোসাইটির অফিসে গেলাম। সোসাইটির সভাপতি সেক্রেটারীও এলেন। নানা ধরনের ব্যাখা বিশ্লেষণ চলল। সাইন্টিফিক, শরীরী, অশরীরী নানামুখী আলোচনা চলল। কুকুরদের কোন অসুখ-বিসুখ থাকতে পারে। সুতরাং সেটা ডায়াগনসিস করা দরকার। বায়োলজির অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর আজমল স্যার এক অচিন্ত্যনীয় এক উপায় বের করলেন। তিনি বললেন, ভিনেগার এবং পেপারমিন্টের সংমিশ্রণ কুকুরের পক্ষে অসহ্য। চুয়াত্তর নম্বরের সামনে ভিনেগার ও পুদিনার মিশ্রণ প্রয়োগ করা দরকার।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জয়েন্ট সেক্রেটারী রফিক সাহেবের বৃদ্ধ বাবা ফরিদ আংকেল বললেন, কুকুরদের উপর অশরীরী ভর করতে পারে। ভালো কোন তদবীর-টদবীর করা দরকার। পুরান ঢাকায় একজন কবিরাজ আছে। নজীর শাহ। বেশ কামেল লোক। আমাদের গ্রামের আজমল পাটোয়ারীর উপর একবার বদজ্বীনের নজর পড়ছিল। খুবই খারাপ অবস্থা। গায়ে কাপড়-চোপড় রাখত না। সবাইকে থুতু মারত। তখন নজীর শাহকে খবর দেয়া হয়। নজীর শাহ একরাতের মধ্যেই সেই জ্বীন বোতলে ঢুকায়ে মাটির নিচে পুঁতে ফেলল। পরদিন থেকে আজমল পাটোয়ারী সুস্থ। যেন কিছু হয় নাই। সবাই চাইলে আমি নজীর শার সাথে যোগাযোগ করতে পারি।
কেউ কেউ বললো, কুকুরদের সমস্যা থাকতে পারে। শারীরিক সমস্যা হতে পারে। মানসিক সমস্যাও হতে পারে। কুকুরদের প্রতি আমাদের আরো সহানুভূতিশীল হওয়া দরকার।

ইত্যাদি নানা মুখরোচক আলোচনা হল বটে তবে কোন সমাধান ও সিদ্ধান্ত ছাড়াই সভা শেষ হল। হারিস ভাই বললেন আমি আগেই কইছিলাম ছাগল দিয়ে কখনো হাল চাষ করা যায় না। এরা কিছুই করতে পারবে না। সবই কমিটির মুরুব্বিদের গাফিলতি। তারা চাইলে একটা সমাধান দিতে পারত। তবে তিনি হাল ছাড়লেন না। তাঁর ধারনা হল আজমল স্যারের সলিউশনটা বেশ কাজের হবে। তাঁর নির্দেশে কয়েকজন সিকিউরিটি গার্ড মিলে ড্রামভর্তি সিরকা আর পুদিনার রস মিক্স করল। রাতের বেলা সেইটা চুয়াত্তর নম্বরের সামনে স্প্রে করল। কুকুরেরা এটাকে পাত্তাই দিল না। রেগেমেগে পুরো ভিনেগার আর পুদিনার ড্রাম ছেড়ে দিয়ে বন্যা বইয়ে দেয়া হল। কুত্তারা মনের আনন্দে সেই ভিনেগারের উপরেই হিসু মেরে দিল।

হারিস ভাই তবু হাল ছাড়লেন না। এমনকি দিনের বেলা দুয়েকটা কুকুর ধরে নিয়ে মিটফোর্ডের কুকুর-বিড়াল হাসপাতালে নিয়ে টেস্ট করালেন। কুকুরেরা সম্পূর্ণ সুস্থ। কোন শারীরীক গোলযোগ নাই। কুকুরের মানসিক স্বাস্থ্য দেখার যেহেতু কেউ নাই সেহেতু সে লাইনে আর চেষ্টা করা গেল না। আর কুকুরের জ্বীন তাড়াতে পারে এমন কোন কবিরাজও পাওয়া গেল না। ফরিদ আংকেল বললেন, নজীর শাহ কুকুরের তদবির করে না। কুকুরের তদবির করা বহত দিকদারি ব্যাপার।

তবে এই সমস্ত কিছুর মধ্যে সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিক হচ্ছে চুয়াত্তর নম্বর বাড়ির মালিক রাসেল সাহেব এখনো নির্বিকার। এমনকি সেদিনের সে মিটিংয়ে খেজুরতলার প্রায় সকলেই উপস্থিত থাকলেও তিনি ছিলেন না। অতি ব্যস্ত মানুষ তাঁর নাকি সময় হয় না। হাসির ভাই তার ব্যস্ততার বাপ-মাকে কিছুক্ষণ গালিগালাজ করে আমাদের ছোট একটা দল নিয়ে চুয়াত্তর নম্বরে গেলেন। রাসেল সাহেব আমাদেরকে চা-পানি খাইয়ে হাসি হাসি মুখে বললেন, ভাই, আমার কি করার আছে? আমি কি কম বিপদে আছি। কুত্তার গুষ্টিকে কি দাওয়াত দিয়ে এনেছি আমার বাড়ী নোংরা করতে? তা কেউ কখনো করে বলেন? আপনারা যদি কিছু করতে পারেন তো ভালই। আমি আপনাদের সাথে আছি।

ঘটনা আগের মতই চলতে থাকল। আমরাও প্রায় অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি। বরং রাতের বেলা অনেকে শখ করে কুকুরের দলবদ্ধ মুত্রকান্ড দেখতে আসে। রিকশাওয়ালারা এই গলি পার হওয়ার সময় হাসতে হাসতে প্যাসেঞ্জারকে গল্প শোনায়। এলাকার নামই চেঞ্জ হয়ে যায় কিনা আমরা এই নিয়ে ভয়ে আছি। কিন্তু হারিস ভাই এখনো লেগে আছেন। এই গুরুতর সমস্যা নিয়ে তিনি ছাড়া আর কারো কোন মাথাব্যথ্যা নাই এই নিয়ে কিছুটা অভিমান করেছিলেন। তবে অভিমান নিয়ে বসে থাকলে তো আর তাঁর নেতৃত্বের বিকাশ হবে না। সুতরাং আবারো নতুন উদ্যমে লেগে পড়লেন। এবার তিনি আবার সবাইকে সোসাইটির অফিসে একত্র করলেন।

খেজুরতলার প্রায় সব বাড়ীওয়ালা উপস্থিত হল, শুধু রাসেল মিয়া আসেনি। লোকটা হারিস ভাইকে কোন পাত্তাই দেয় না। হারিস ভাইও উপস্থিত জনতাকে বললেন, কুকুরদের এই আচরণের জন্য চুয়াত্তর নম্বরের মালিক রাসেল মিয়াই দায়ী। চুয়াত্তর নম্বর বাড়িটা অভিশপ্ত এই বিষয়ে তাঁর কোন সন্দেহ নাই। রাসেল মিয়া নিজে চরম কুকুর বিদ্বেষী লোক। এর আগে নাকি সে একবার দু-তিনটা কুকুর মেরে ফেলেছিল। তারই প্রেক্ষিতে কুকুরেরা দলবদ্ধ প্রতিশোধ নিচ্ছে। আমরা উপস্থিত জনতার প্রায় সকলেই হারিস ভাইয়ের সাথে একমত হলাম। একমত না হয়েও উপায় নাই। হারিস ভাই ছাড়া তো আর কেউ তো কিছু ভাবনা-চিন্তাও করে না। আর কুকুর মারার ঘটনাও সত্য। সে ঘটনার দু-চারজন সাক্ষীও আছে।

সোসাইটির বর্তমান কমিটি যেন রাসেল মিয়ার উপর শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয় তার দাবীও তিনি উত্থাপন করলেন। এতেও আমরা ভোট দিলাম। সিদ্ধান্ত হল, আগামী কাল থেকে এলাকার সমস্ত কুকুরে খাবারের আয়োজনে দায়িত্ব রাসেল মিয়ার। আর রাসেল মিয়া যেহেতু সভায় উপস্থিত নাই, হারিস ভাই কমিটির পক্ষ থেকে এই আদেশ রাসেল মিয়াকে পৌঁছে দেবেন।

আমাদের কেন যেন মনে হল এইবার হয়ত কুকুরদের এই আকাম বন্ধ হয়ে যাবে।
এবং সত্যি সত্যি তারা সেই দিন রাতেই কুকুরেরা চুয়াত্তর নম্বর বাড়ির সামনে মূত্র বিসর্জন বন্ধ করে দিল।
আর তারা নতুন জায়গা বেচে নিল মূত্রবিসর্জনের জন্য। সেটা ছাব্বিশ নম্বর বাড়ি। বাড়িটার মালিক আমাদের প্রিয় হারিস ভাই।

আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

পঁচিশ
অনেক শেয়াল ডেকে উঠল এই প্রজনন-ঋতুতে। তাদেরই কয়েকজন রাতের নির্বাক রেললাইন ঘেঁষে, গোরুখাটালের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে পাখির ডিম, ইঁদুর অথবা বেড়ালবাচ্চা খাবে ব’লে।

শব্দ পেয়েই ভোর অবতরণ শুরু করল আকাশ থেকে, তিন ঘন্টা পরে শেষবার বাঁশি বাজিয়ে শেয়ালরা তাদের বাড়ি-বাড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে যাবে। “প্রহরে প্রহরে আমি গান গেয়ে জাগি” হয়ত এক গিধড়সংগীতই! এবং সকালবেলা আদাড়ে পড়ে থাকা রক্তমাখা ফর্দাফাঁই মার্জারশিশুদের কোনও কররেখা নেই, গ্রহশান্তিকবচ নেই…।

জ্যোতিষ নিয়ে বরুণের খোঁটা শুনে অন্য টিচাররা হাসে, তবু দুর্গরক্ষার দায়িত্বে আছে বলেই নির্মল স্বীকার করতে পারেনি, খনার বচনও প্রমাণের অভাবে ভুগেছে বহুবার। অনেক যুগ আগে তার বাবা বাণীনাথ বড় ছেলের কোষ্ঠী প্রস্তুত ক’রে দেখেছিলেন, জাতকের অতিপ্রবল সন্ন্যাসযোগ। কাজেই, আঠেরো বয়েস হতেই দাও বিশ্বদেবের বিয়ে, তিনটে বাচ্চা রেখে বউ মারা গেলে তৎক্ষণাৎ দ্বিতীয় পরিবার ঘরে আনো। তারপর খুলনার বাতনাই নৌকোর মতো সংসার সুকলেবর হতে হতে শেষে পরেশান স্বামীস্ত্রীর মধ্যে খটরমটর লাগলে বিশ্বদেব ঠোঁট ওলটাতো : আমার তো সংসার করার কথাই না! গিন্নির ঝটাকসে উত্তর, হ্যাঁ সন্নিসি হবেন বলেই তো দুই বিয়ে আর ন’টা ছেলেমেয়ে। ব্যাস, জোঁকের মুখে একথোকা নুন।

বাণীনাথ কখনও মানেননি জ্যোতিষশাস্ত্র ভুল; গণকেরই ত্রুটি হয়ে থাকবে দণ্ড-পলের হিসেবে। তেমনি যদি কোনও বেদপন্থীকে জিগ্যেস করো, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ অনুযায়ী আয়ুস্তোম যজ্ঞ করেও কেন যজমান দীর্ঘজীবন পেল না — নিশ্চয়ই যাগের নিয়মপালনে গন্ডগোল হয়েছিল। যুক্তিটা এমনভাবে সাজানো আছে যে বৈদিক যজ্ঞ ফল দিক বা না দিক, মিথ্যে প্রমাণিত হবে না। একই প্যাটার্ন নির্মল লক্ষ করে বরুণের মধ্যেও। অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার পানমুখো গান্ধিবাদী মহাদেব সেনগুপ্ত সারাদিনে তিনটে খবরের কাগজ মুখস্থ করে। বাড়ির রেডিয়োয় সারাক্ষণ বিবিসি নিউজ। সে বরুণকে পেলেই — ১/ সোভিয়েত রাশিয়ায় স্টালিন ইহুদিদের ওপরে যে অত্যাচারটা করেছে তারপর সে হিটলারের চেয়ে ভালো হয় কী করে? ২/ বিপ্লবের পরে সোভিয়েত চেয়ারম্যান কুলাক চাষি আর কবিসাহিত্যিকদের মারল কিম্বা নির্বাসনে পাঠালই বা কোন দর্শন মেনে? ৩/ বুলগেরিয়ার জার ব্রিটেন-আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায়নি ব’লে সীমান্ত পেরিয়ে রাশিয়ার রেড আর্মি ঢুকে সে-দেশে বিপ্লব ঘটিয়ে দিল, এটা কি মার্ক্সবাদ সম্মত? কিছুক্ষণ তাচ্ছিল্যভরে ‘বুর্জোয়া সংবাদপত্র’, ‘আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ’ বলাটলার পরে বরুণ ঘোষণা করত, মার্ক্সবাদের প্রয়োগে নেতৃত্বের ছোটখাটো বিচ্যুতি হতে পারে, কিন্তু সাম্যবাদী আদর্শে কোনও ভুল নেই।

— কী ক’রে বুঝলে?
— স্যার, এটা আপনাদের ভাববাদী দর্শন নয়, বিজ্ঞান। তাই সত্য।
টিচার্স রুমের জানলা দিয়ে পানের পিক ফেলে মহাদেববাবু :
— বিজ্ঞান সত্য তোমায় কে বলেছে? সে হল সত্যের খোঁজ, সত্যের জন্যে অভিযাত্রা।

ছাব্বিশ
জীববিদ্যার মাস্টার অশোক, যার পদবি মণ্ডল থেকে মেন্ডেল হয়ে গেছে বংশগতি সূত্রের অত্যাচারে, চেয়ার থেকে বাঁদিকে কাত হয়ে নির্মলের মুখের কাছে মুখ নেয় :
জ্যোতিষ নয়, জিন, বুঝেছ পণ্ডিত? মানে পূর্বপুরুষ যেমন জাতের হবে… আম গাছে তো বাতাবি লেবু ফলতে পারে না! আমাদের মা-মাসিরা জানত এসব — “আগের হাল যেদিকে যায়, পাছের হালও সেদিকে যায়” শোনোনি?
দুজনের মাঝখানে ব’সে আছে অতি-ফক্কড় বাংলা টিচার সচক্রবর্তী (কারণ সন্তোষ সারা জীবন এভাবেই নাম লেখে)। মেন্ডেল এবং মণ্ডলকে সে সমর্থন দিল ঘটা ক’রে মাথা নাড়িয়ে।
— হুঁ, বংশগতি খুব মারাত্মক জিনিস। বাবা যদি অপুত্রক হয়, ছেলেও অপুত্রক হবে!

মায়ার এক দাদামশাই হরিশংকর মাঝেমাঝেই বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে ঘরের সব টাকাপয়সা গয়নাগাঁটি হাতিয়ে নিয়ে দু’এক মাসের জন্যে বেরিয়ে পড়ত। নিজের ধুতিচাদরগুলো কাতার দড়ি দিয়ে বেঁধে নিত কোমরে, হাতে একখানি বদ্‌না। এবার বেগ চাপলে জঙ্গলে কাজটাজ সেরে বদ্‌নায় জল নিয়ে উবু হয়ে বসেছে, কিন্তু কটিদেশ হোল্ডঅলে পরিণত হওয়ায় বাঁ হাত কিছুতেই যথাস্থানে পৌঁছচ্ছে না। তখন খুব অবাক হয়ে বিড়বিড় করত — আমার হাত খাটো হইছে, না পাছা দূরি গেছে? বৌয়ের হাড়-জ্বালানো কড়িচণ্ডাল লোকটার ধাত হয়ত এখন চাঁদের রক্তে!

নির্মলের ছোটঠাকুর্দা পিনাকপাণি কুৎসিত দেখতে হেতুক বিয়ে করেনি। তার ভয় ছিল, বউ সৌম্যদর্শন ভাসুরদের অঙ্কশায়িনী হবে। সারা জীবন আত্মীয়-পড়শি যে-মেয়েই পাণিদাদুর পায়ে গড় করেছে, তাকে দুটো স্তন খামচে ধ’রে তুলত সে। শেষে মেয়েরা দূর থেকে জোড়হাতে প্রণাম সারত, বুড়ো করত মুখখিস্তি। বংশ-ধারামতে সেই লোচ্চামিও কি চাঁদের পিছু নিল?

প্রথম দেশলাইকাঠিতে আঙুল পুড়িয়ে দ্বিতীয়টায় মোমবাতি খুঁজে পায় নির্মল, ছেলের জন্মকুণ্ডলী টেনে নিয়ে আর একবার আয়ুর্গণনাসহ মারক-বিচারে বসে। দেখা যায় জৈমিনী, পরাশর, পারিজাত একই দৈব পরামর্শ পেয়ে নিধনভাব-বিবেকঃ অধ্যায়টি লিখে গেছেন — আয়ুর্দাতা যোগত্রয়ের সবক’টিই দুর্বল হওয়াতে অনধিক ত্রিশ বর্ষাদি বয়সে কেতুর দশায়, বৃহস্পতির অন্তরে, শনির প্রত্যন্তরে, বুধের সূক্ষ্ম দশায় এবং শুক্রের প্রাণদশায় জাতকের দফারফা নির্ধারিত আছে।

বুদ্ধিরহিত নির্মল পরাশরসংহিতাপথ ধ’রে ছুটতে থাকে যতক্ষণ না রেড সিগন্যালের মতো “পিতামাতার পাপে বিনষ্ট হয় সন্তান” — এই পরোক্ষ বংশগতি-নিয়মের মুখে পড়ছে! চোখে ফুটে ওঠে দৌলতপুর স্কুল, ভূগোলশিক্ষিকা ঢাকার মেয়ে পারমিতা শূর… তার শাড়ির ভাঁজ-কুশলতা, সহবতবুদ্ধি, সুরের জোয়ারিখেলা রূপ, উদাস কবিতাপাঠ, আশ্চর্য হাতের রান্না…! এক ছুটির দিনে দুজনেরই ভুল ক’রে স্কুলে চলে আসা আর বেলা গড়াতেই হঠাৎ শরীরের শিরাধমনী উপড়ে ফেলা ঝড়জলে একমাত্র ছাতার নীচে পেছল আলপথে হেঁটে ফিরতে ফিরতে টবের দুই ফুলগাছের মতো ঠোঁটে-ঠোঁটে অনিশ্চিত পাপড়িসংযোগ। নিজের অন্যায়ের আঙারে ঝলসে যাওয়া নির্মল মাঝরাস্তা থেকে ছুটে পালিয়ে আসে। এখন ভাবে, সেদিন কোনটা বেশি অপরাধ ছিল, ঐ পাপচুম্বন নাকি পারমিতাকে বৃষ্টিপ্রলয়ে মাঠের মধ্যে একা ছেড়ে যাওয়া!

সাতাশ
এক অক্ষর শব্দও না ক’রে দরজা খুলে উঠোনে নামে নির্মল। শুক্লাতিথির জ্যোৎস্না আমডালের ফাঁক দিয়ে বায়োস্কোপের আলোর মতো তার গায়ে-মাথায় ঘুরে বেড়ায়। ভটচাজবাড়ির কর্তা যদি নির্মল হয়, তবে নির্মলেরও অভিভাবক এই সুরোট বোম্বাই আমগাছখানা। দুটো ডাল চাঁদের বাড়ির দুটো ঘরের মাথায় এমন চাপিয়ে রেখেছে, ভূভারতে কোনও কালবোশেখির ক্ষমতা নেই টিনের চাল উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তার এক এক শাখায় এক এক জাতের আম আর এমন মিষ্টি, পেটে কৃমি থাকলে তোমার গা ঘুলিয়ে বমি হয়ে যাবে।
তখন চরাচরে একা নড়বড়ে পায়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে যাচ্ছে অবিরাম সাইকেলচালক। বাঁ কানে পৈতে জড়িয়ে বাথরুমে উবু হয়ে পেছছাপ সারে নির্মল, তারপর ছাদহীন বাথরুম থেকে রঘুনাথের মাঠে তাকিয়ে থ’ হয়ে যায়।

গোল ঘুরতে ঘুরতে বাবলু গিরি সাইকেল নিয়ে তাঁবুর পেছনে চলে এসেছে। সেখানে মাকে সোয়েটার খুলে দিয়ে ত্রিপলের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে, আর ফুলপ্যান্ট-পরা মা ছেলের ঢলঢলে পুলওভার গায়ে গলিয়ে সাইকেলে চেপে বসল। আমতলার ছায়া-আবডালে দাঁড়িয়ে নির্মল দ্যাখে, মাথায়-টুপি বাবলুর মা ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে শুরু করল মাঠচক্কর, হাতের শাঁখাজোড়া জলজ্যোৎস্না মেখে চকচক করে।

গোটা রাতের রাগী শোক কেটে গেল নির্মলের। জীবনের এর চেয়ে দিলখুশ সংজ্ঞা হতে পারে না। শুধু চাঁদ তো নয়, প্রত্যেক রিফিউজির ভবিষ্যতের একটা এক্স-রে নিলে দেখা যাবে প্লেটটা সাদা হয়ে আছে মৃত্যুভয়ের ফুলকপি-মেঘে। তাহলে নৈতিকতা চুলোয় দিয়ে শেষ নিঃশ্বাসবিন্দু পর্যন্ত ভালোবাসো। মহৎ স্নেহের মতো ভালোবাসো। শুরুতে সেই ভিখারিমাসি আর এখন বাবলুর মা তাকে হাত ধ’রে শাস্ত্রবিধির বাইরে এনে আকাশ দেখাল।

শেষ সাতাশ
ফিরে আসা খড়মের খুটখুট কানে আসছে মায়ার। তাদের দু’ঘরের মাঝে ঘুমন্ত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকল অন্যমনস্ক পাদুটো। তারপর দীর্ঘস্থায়ী কাগজ ছেঁড়ার শব্দ পেল মায়া। শুধু কাগজ নয়, ফরফর ক’রে কালিঅক্ষর ছিঁড়েকুটে যাচ্ছে, প্রজন্মগড়ানো রেওয়াজ আস্ত থাকল না, অলুক্ষুনে ঐতিহ্য হারিয়ে মুছে যাক — বেড়ার গায়ে আঁকা ভোটের ছবিতে সাপটে চুনকাম ক’রে দেওয়ার মতো। আহ, উথাল সমুদ্রে পিপেভর্তি তেল ঢেলে দিয়ে অবধারিত জলডুবি থেকে বাঁচা গেল। নমো শ্রীহরি!

.
(আর একটু লিখতে পারি?)

আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

তেইশ
“হৌত লেখা কপালে আর মৌত লেখা পা’য়
যার যেখানে মৃত্যু আছে, পায়ে হেঁটে যায়

ধরো, এখুনি আমার মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে মিত্তু হল। আমি তো নিজিই পায়ে হেঁটে এয়েছিলাম তোমার বাড়ি। আসিনিকো?
এবার ধরো, প’ড়ে যেতে দেখে তুমি ছুট্টে এসে আমার মাথাটা কোলে তুলে নিলে। হাঁ করলাম, এট্টু জল দিলে গেলাস থেকেন। জলঢোঁক খেয়েই আমি চোখ মুদিছি। শেষ বেলায় এই কাজ কে করে, ছেলে তো? তাহলে তুমি আমার সন্তান হলে কি না!”

কারও কারও সঙ্গে আচমকা পরিচয় হয়, তারপর মাথা খুঁড়লেও জনমভ’র আর খোঁজ নেই। সেই গোবিন্দভক্ত ভিখারিবুড়িও তাকে কথাক’টা বলে অন্তর্ধান হয়ে গেছে।

একটু আগে ঘরের দেয়ালে নিজের ফুল-ফ্রেম ছায়া দেখে চমকে উঠেছিল নির্মল। যেন অতিকায় যম কাঁধে চেপে ব’সে এইসব বিনাশবার্তা লিখিয়ে নিচ্ছেন! মনে হয়েছিল, চাঁদের সর্বোচ্চ আয়ু উনত্রিশ, আর বাবা বাণীনাথের তৈরি তার নিজের জন্মপত্র বলছে, ‘নবতি বর্ষানী জীবতি’। সন্তানশোকে পুড়ে আঙরা হতে না চাইলে এখনই পালানো উচিত জীবনের দরজায় তালা ঝুলিয়ে।

তারপর ভিখারিমাসির কথা মনে প’ড়ে ভূমিকম্পের পর নিজেকে নিজের ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে বার করছিল সে। ক’বছর আগে হলেও নিরক্ষর জনতার এমন হাবিজাবি বিশ্বাসের ধারই ধারত না, হয়রান হয়ে যেত উপনিষদের পাতা ছানতে ছানতে। এই নাও বৃহদারণ্যক আর ছান্দোগ্য থেকে মায়াবাদের তারাকুচি — সুষুপ্তির অবস্থাই আত্মার স্বরূপ, ব্রহ্মাবস্থা। আত্মা যখন স্বধর্ম পায়, তখন জগৎ বর্তমান থাকে না। তাই আত্মা বা ব্রহ্মের কাছে মহাবিশ্বের কোনও অস্তিত্ব নেই। নাও কঠোপনিষদের শ্লোক : পুত্র ইত্যাদি প্রিয় মানুষও অনিত্য, অসার; না কোনও কিছু থেকে ব্রহ্ম উৎপন্ন হয়, না ব্রহ্ম থেকে তৈরি হয় কোনও বস্তু… নায়ং কুতশ্চিন্ন বভূব কশ্চিৎ। এই মিথ্যে বিশ্বপ্রপঞ্চ মায়াশক্তির খেলা মাত্র।

কিন্তু কলোনিতে নীড়বাঁধা নির্মল, যার মনের একপিঠ থমথমে ভিটে হারানোর কষ্টে, আর একপিঠ কালকীখাবো-র তরাসে অস্থির, এক সময় আবিষ্কার করল, দর্শনের স্বতঃপ্রমাণ মীমাংসাগুলোয় তার সন্দেহ জাগছে। শংকরের ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্যের ২।৩।১৬ নম্বর শ্লোকটা ধরা যাক : এক জন্মের কর্মের ফল যখন সেই জন্মে সম্পূর্ণ ভোগ করা যায় না, তখন পুনর্জন্মে ওই একই আত্মা উপস্থিত থাকবে।

কর্মফল আছে এবং কর্মীকে ফল ভোগ করতেই হয় — এমন বিশ্বাস এই শ্লোকের পূর্বগামী; শঙ্করাচার্যের মতে ব্যাপারটা নীতি আর যুক্তিসম্মতও। হয়ত তিনি কোনও অত্যাচারী রাজাকে ঠ্যাংয়ের ওপর ঠ্যাং তুলে জীবন কাটাতে দেখে ভেবেছেন ব্যাটা এ-জন্মে পার পেয়ে গেলি, কিন্তু এক মাঘে শীত যায় না; পরের বার ভগবান ঠিক মজা বুঝিয়ে ছাড়বে। এভাবে কর্মবাদের মোমবাতির মাথায় জ্ব’লে উঠেছে জন্মান্তরবাদের আলেয়া।

কিন্তু মানুষের অভিজ্ঞতা বলে, জীবন নীতিবুদ্ধি মেনে চলবে, আবার চলবেও না। বাস্তবতার এলাকা আসলে ক্ষমতাঘেঁষা, সুবিধেনির্ভর। নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্রের মতো কাজ আর কাজের ফলের মধ্যে কান টানলে মাথা আসার মতো কোনও শারীরিক আত্মীয়তা নেই। তাই দার্শনিক চারপাশের বাস্তবকে তার পছন্দসই ধারণার সঙ্গে মেলাতে চাইলে রূপকথারই জন্ম হবে শুধু।

চব্বিশ
হারিকেনের আলো কেরোসিন ফুরিয়ে দপদপ করছে, সেটি নিভিয়ে রাত দুটোর গ্রামীন অন্ধকারে পদ্মাসনে শিরদাঁড়া সোজা ক’রে বসে থাকল নির্মল। ঘর জুড়ে চাঁদ-সঞ্জু-বাসুর নিদ্রিত আ-নাভি নিঃশ্বাসের ঝড় বইছে। নির্মলের ঘুম এখনও কোন দূর কাওরাপাড়া দিয়ে আসছে-যাচ্ছে কে জানে!

বিছানায় ব’সে সে ভাবছিল বরুণের কথা। বনমালীপুর প্রিয়নাথ ইনস্টিটিউশানের ইতিহাস টিচার, গোটা বারাসাতে টুকাইদা-ডাকে বিখ্যাত বরুণ মিত্র ছিল সিপিআই পার্টির সদস্য। তারপর দলে রাশিয়া-লাইন আর চায়না-লাইনের ঝামেলা বাড়তে বাড়তে গত বছর জুলাইয়ে ডাঙ্গে-বিরোধী চিনপন্থী নেতারা তেনালি কনভেনশান ডেকে দেয়। মাস তিনেক হল, কলকাতার ত্যাগরাজ হলে মিটিং ক’রে নতুন দলের নাম ঘোষণা হয়েছে — কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্ক্সসিস্ট)। আর সঙ্গে সঙ্গে সিপিআইএম নেতাকর্মীদের একধারসে ধরছে-পাকড়াচ্ছে পুলিশ। এখন সেভেনের ক্লাসটিচারের পিরিয়ডটা বেশির ভাগ দিন অন্য কেউ নেয়, মাঝেমাঝে টুকাই কলোনিমোড়ের বাড়ি থেকেও বেপাত্তা, কিন্তু যেদিন স্কুলে এসেছে, টিচার্স রুম জমিয়ে রেখে দেবে। গতকাল যেমন তার সঙ্গে ভারতীয় ধর্মনীতি নিয়ে তর্ক বাধাল। নির্মলের সংশয় বরুণের অনেক সমালোচনাকেই ধ্বনিভোটে জিতিয়ে দিতে চায়, কিন্তু পণ্ডিতমশাই হিসেবে হিন্দুধর্ম তারই দুর্গ, যাকে বাঁচানোর দায়িত্বও তার। নিজের কালাপাহাড়ি ভাবনাগুলো সে ভুলেও লোকনজরে আনে না।

বরুণ বলছিল, ধর্মের হিসেবে যা স্বর্গলোক,
সেটা ধরাছোঁয়ার জিনিস নয়। কিন্তু গরীব মানুষ জেগে উঠলে এই ধরাতলেই স্বর্গ বানিয়ে নেবে। নচিকেতার কথা আছে না, দিব্যলোকে কোনও ভয় নেই, যম নেই, জরাও না; খিদে-তেষ্টা পার ক’রে শুধু শোকাতীত আনন্দের অনুভব? তাহলে দেবপুরী একটা উন্নত মর্ত্যই তো; সব পেটে ভাতের ব্যবস্থা, সবার জন্যে শিক্ষা আর চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে পারলে দেখবে স্বর্গ আমাদের হাতের মুঠোয় এসে গেছে।

স্কুলবাড়ির মাথায় দুধ-মরিচ রঙ শঙখচিলের ডানাবিস্তার দেখছিল নির্মল : শস্যমিব মর্ত্যঃ পচ্যতে শস্যমিবাজায়তে পুনঃ। মরঃ শব্দটা থেকেই মর্ত্য এসেছে। এই দীনদুনিয়ায় পা রাখলে শস্যের মতো পচে মরতে হবে, পরক্ষণে জন্মাতেও হবে, আবার মরো… জীবনমৃত্যুর এই ক্রমচক্কর দুঃখময় এবং কোনও মানুষই দুঃখিত হতে চায় না। তাই উপনিষদের উপদেশ : পুনর্জন্ম এড়াতে নরলোকে কামনাবাসনা চেপেচুপে ব্রহ্মের সাধনা ক’রে যাও, আর জন্ম নিতে হবে না — গ্যারান্টি; তোমার জীবাত্মা মিশে যাবে পরমাত্মা মানে পরব্রহ্মে; স্বর্গে গিয়ে ভোগ করবে কাম্য যা কিছু, অমরতা, পার্মানেন্ট পুলক।

বাচ্চাদের আমরা খানিকটা এরকম কথাই বলি না? এখন বেশি খেলো না, সিনেমা দেখো না, পড়াশুনো ক’রে চাকরি পাও, তারপর নিজের উপার্জনে যতখুশি আনন্দ ক’রো, কেউ মানা করবে না। চাকরি পাওয়া একটা ছোট স্বর্গ। আবার যে রিটায়ার করেছে, তার কাছে ছেলের নিজের পায়ে দাঁড়ানো আর মেয়ের বিয়ে হল অমরাবতীর দুই সিঁড়ি। পৃথিবীতেই আমাদের টুকরো টুকরো ব্যক্তিগত স্বর্গবাস চলতে থাকে। নিজ-মালিকানার দিব্যলোকটাকে সামাজিক স্বর্গের চেহারা দিতে চাইছে বরুণদের মার্ক্সবাদ।

— কিন্তু ঈশ্বরের স্বর্গে তো বুড়ো বয়েস, যমের দক্ষিণ দুয়োর এসব কিচ্ছু নেই; শর্ত পুরোবে কী ক’রে?

— সাইন্টিস্টরা চেষ্টা করছেন। পেনিসিলিন আবিষ্কারের পর চিকিৎসাবিজ্ঞান কীভাবে এগিয়ে গেছে দেখেছ? বুকে পেসমেকার বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কিডনি খারাপ হলেও ডায়ালিসিস নিয়ে বেঁচে থাকছে রোগি।
— বিজ্ঞান মানুষকে অমরত্ব দেবে? অ্যালকেমি সত্যি হবে বলতে চাও!

এবার নির্মলের অনাস্থায় ভেজাল নেই।
— তোমার জ্যোতিষবিদ্যে যদি ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে, অ্যালকেমিও সবাইকে এলিক্সার অফ লাইফ রেঁধে খাওয়াবে একদিন।

.
(আরও আছে)

আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

একুশ
ওঁ আদিত্যাদি গ্রহাঃসর্ব্বে নক্ষত্রাণি রাশয়ঃ।
দীর্ঘমায়ুঃ প্রকুর্বন্তু যস্যেয়ং জন্মপত্রিকা।।

ফালি কাগজের মাথায় চটপট শ্লোকটা লিখে নির্মল স্কেল দিয়ে কালিদাগ টানল। তার নীচে ধীর হস্তাক্ষরে একটা ক’রে বসাতে লাগল শব্দ :

শুভমস্তু শকনরগতে রতীতাব্দাদয়ঃ ১৮৮২ সন ১৩৬৭ ইং ১৯৬০ এতচ্ছকীয় সৌর শ্রাবণস্য সপ্তম দিবসে ইং জুলাই মাসস্য চতুর্বিশতি দিবসাৎ পরং রাত্রৌ সার্দ্ধেক ঘটিকায়াং ঘঃ ১-৩০ মিনিট সময়ে সেনহাটী গ্রাম নিবাসিনঃ শ্রীনির্ম্মলচন্দ্র দেবশর্ম্মণো কাব্যতীর্থোপাধিকস্য শুভ কুমারোহ জায়ত ভারতে…।

এবার ঠোঁটের ওপর বাঁহাতের তেলোর উল্টোপিঠ রেখে ভাবতে লাগল সে। ভারতে কোথায় ভূমিষ্ঠ, উদ্বাস্তু শিবিরে! সেটা কি প্রাণে ধ’রে লেখা যায় — সূতকমুহূর্তে ছিন্নমূল? নির্মলের কলম আবার চলতে লাগে, “…জায়ত ভারতে তস্য মাতামহীগৃহে। তস্যেয়ং লিখ্যতে সংবৃত্তিপত্রিকা”।

মায়া অনেকবার বিরক্ত হয়েছে : চাঁদের কুষ্টিটা বানাচ্ছেন না কেন? এত রোগবালাই লেগে থাকে ছেলেটার! হ্যাঁ, জ্যোতিষশাস্ত্রও বলে, “জন্মপত্রিকা যিনি প্রস্তুত করান নাই তাহার নিকট জীবন নিশাকালীন দীপবিহীন মন্দিরের ন্যায়”। তাছাড়া এসব দু’ঘন্টার মামলা, নিজের পরিবার বাদেও আত্মীয়-প্রতিবেশী এত লোকের জাতপত্র নির্মলের হাতে গড়া, ছকটা কষে ফেললে আর কী করার থাকে, পঞ্জিকা দেখে দেখে বসিয়ে যাও মাসফল, ঋতুফল, হোরাফল, নক্ষত্রফলম্‌…।

স্কেলে আরও একটা দাগ কেটে তার নীচে সে লিখতে লাগল, রাত্রি ঘন্টা ৯/৪৫ গতে মীনরাশি, বিপ্রবর্ণ, নরগণ, অষ্টোত্তরী শুক্রের ও বিংশোত্তরী শনৈশ্চর দশায়াং…।

মীনের অন্য নাম অস্ত্যভ। এটি সৌম্য ও জলজ রাশি। মীনের শেষার্ধ কীট নামে খ্যাত। তার দিবা ও রাত্রিতে সমান বল (অন্য রাশিরা দিবাভাগে বলী)। মীনের বর্ণবিবেক মলিন। এই রাশি অনুযায়ী জাতকের নাম চ বা দ অক্ষরে শুরু হবে। নির্মল লিখছে : প্রকাশ্য নাম শ্রীমান্‌ চন্দন কুমার দেবশর্ম্মা ভট্টাচার্য্য। রাশিনাম… একেবারে গোপনীয় হতে হবে… শ্রীমান্‌ দিগন্ত।

এবার সমান্তরাল দুটো রেখা টেনে খানিক দূরত্ব রেখে এঁকে ফেলল জন্মনকশা, তারপর বারো অর্ধে গ্রহের অবস্থান সাজাতে সাজাতে ভুরু কুঁচকে উঠল তার। মুখ দিয়ে দুবার অসহিষ্ণু শব্দ করল, মশারি থেকে নেমে যতদূর সম্ভব নিঃশব্দে খাটের নীচে রাখা টিনের সুটকেস খুলে নামাল বাঁধানো খাতা আর তিনটে জুস-আলগা মলাটছেঁড়া বই।

এবার প্রতিটা পর্যবেক্ষণ সে কোষ্ঠীতে তুলবে গুনেগেঁথে, শাস্ত্র মিলিয়ে। প্রথমে সংস্কৃতে লিখে নীচে তার বাংলা, কিন্তু ডাক্তারের লেখা প্রেসক্রিপশান আর রোগিকে বলা সংলাপে যেমন সময়-সময় মিল থাকে না, নির্মলও অনুবাদ করছিল শুধু বাছাই অংশের। লগ্নফলে “পীন ললাট ঘোণ গণ্ডৌষ্ঠ” বা “শূরঃ ক্লেশসহিষ্ণু সুখী রিপুহন্তা” পর্যন্ত সুন্দর চলছে, কিন্তু হোরারত্নে “পরদারকঃ” শব্দে এসে তার মুখ লাল। পরের বিশেষণ “তেজস্বী”, সন্ধি ক’রে লিখল “পরদারকস্তেজস্বী এষু”। বাংলায় ভাঙলই না কথাটা।

এভাবে কত ধামাচাপা দেওয়া যায়? দ্রেক্‌কাণফল, শুক্রের দ্বাদশাংশফল একের পর এক লজ্জাজনক মার্কশীট খুলে ধরছে সামনে; প্রত্যেক সাবজেক্টেই লাল কালির দাগ — দাম্ভিক, রতিবশ্য, লোভী, স্ত্রীপ্রিয়, বিলাসী, পানভোজনপটু, কুটিল, কলহমত্ত, চপল, কৃতঘ্ন, ক্রোধী, স্থূলতনুসম্পন্ন!

বিছানায় তার দুহাত দূরে নিরপরাধ ঘুম দিচ্ছে সেই চরিত্রহীন মুজরিম — চোখের পলক এত টানা, কর্ণকুহর ছুঁয়ে দেবে যেন। আর মন? বিজয়া দশমীর দিন চুপিচুপি এসে বাবাকে বলেছিল, রাত্তিরে মা দুর্গা স্বপ্ন দেখিয়েছে : আমাকে তোরা ভাসান দিস না, জলে সব মাটি ধুয়ে হাড়ে ঠান্ডা লেগে জ্বর আসে, আমি ঠাকুর থেকে ভূত হয়ে যাই। বরং প্যান্ডেলের পাশে একটা বাড়ি বানিয়ে আমাদের রেখে দে। আশীর্বাদ করে দেব, সবাই পরীক্ষায় পাশ। কাজেই, “আপনি আজাদ হিন্দ কেলাবে যেয়ে একবার ব’লে দেন — বিসজ্জোন হবে না, দুগ্‌গাঠাকুরের ইচ্ছে নেই”!

ছেলের অজাগর মুখ থেকে নির্মল আবার চোখ ফেরাল গণনায়, ত্রিশাংশ ফলের দিকে :
ধাতুবাদী ক্রিয়াযুক্তঃ ধন-দার বিবর্জিতঃ। তস্করো মলিনো ধূর্ত্ত ভৌমত্রিশাংশসম্ভবঃ।।

তার ফলিত জ্ঞান ভেঙে পড়ছিল, বুকের ধকাস-ধকাস নিশ্চয়ই স্কুলের দেয়ালঘড়ির চেয়েও জোরে। গণনার এই ক্ষমাহীন ধ্রুপদী ভাষা আসলে কোনও ভয়ানক পরিণতির ইশারা — সন্তান আঁতুড়ে থাকতেই ঠিকুজী বানাতে গিয়ে নির্মল জাতকের যে দগ্ধভাগ্য দেখে হাত গুটিয়ে নিয়েছিল।

চন্দ্র মনের কারক। কেউ তার বৈরী নয় — চন্দ্রমসো চন্দ্রস্য ন কশ্চিৎ শত্রু ইতি ভবঃ। মানুষের শরীরে বিন্দুচক্রে শশাঙ্কের অবস্থান, সে নতুন অথচ সুদৃশ্য বস্ত্রের অধিপতি। কিন্তু চন্দ্র হীনবল ও নীচস্থ হলে মানব দোলাচলচিত্ত হয়। যদি শনি দ্বারা যুক্ত বা পূর্ণদৃষ্ট হয় তবে সর্বদা চিন্তাযুক্ত, অল্প দুঃখে অধিক ম্রিয়মান, সন্দেহস্বভাবী ও ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ডুবে থাকবে; আর শুক্রের সঙ্গে মিলিত হলে বা শুক্র দ্বারা পূর্ণদৃষ্ট হলে জাতক সারাক্ষণ কামাদি চিন্তায় রত। চন্দ্র দুর্বল ও শনিদ্বারা পীড়িত হলে মানব আক্রান্ত হবে উন্মাদ রোগে।

নামটা রেখেছিল শিউলি। বাসে যেতে যেতে মহিলা-গলায় “চাঁদ, শিগগিরি নেমে এসো” ডাকের সঙ্গে এক মিষ্টিমুখ বালকের ঝনাৎ ক’রে লাফ দিয়ে অবতরণ দেখা মেয়ে বাড়ি ফিরে সবার আগে পৌঁছোয় উদরিণী মায়ের কাছে — “যদি ভাই হয়, আমি কিন্তু নাম রাখব চাঁদ”। এভাবে সন্তান হাজির হওয়ার আগেই তার ডাকনাম উপস্থিত হয়ে অপেক্ষারত, যেন মালিককে গর্ভযান থেকে এক-লাফে নেমে আসার অনুরোধ পাঠাচ্ছে। শিউলি যদি তখন জানত, চাঁদই হবে চাঁদের অপৌরুষ; তার পরিপন্থী, তার অসমীচীনতা, তার বিপর্যয়…!

বৈদ্যকুলতিলক প্রজাপতি দাস বলে গেছেন, “শিশু ভূমিষ্ঠ হলে যোগজ শিশুরিষ্টি বা পতাকী শিশুরিষ্টি আছে কিনা তা সবার আগে নিরূপণ করে পশ্চাৎ ভাগ্য ফলাফল বিচার করবে। যেহেতু প্রবল রিষ্টি থাকলে শিশুগণ প্রায়ই মানবলীলা সংবরণ করে থাকে”। সেদিকে যাওয়ার আগে… ক্ষীণ চন্দ্রের ওপর বুধের প্রভাবটা কোথায় লিখেছে, ভয়চকিত নির্মল ‘জাতক পারিজাত’ হাতড়াতে থাকে… হা ঈশ্বর :

“বুধ ক্ষীণ চন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হলে পাপ সংজ্ঞায় অভিহিত হয়েন। পঞ্চ-ত্রিংশ বর্ষ পরমায়ু”।

বাইশ
“ঘুমোবেন না? বারোটা তো বাজে… ও কী, মুখ ওর’ম কেন! খারাপ কিছু দেখিছেন চাঁদের কুষ্টিতি?”

হারিকেনের কাচের একদিকে কাগজ আঁটা, ঘুমন্ত বাচ্চাদের চোখে আলো না পড়ে। মায়া পাশের ঘর থেকে ওই প্রচ্ছায়ার ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে ব’লে তাকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু সে বরের মুখ পড়তে পারছে স্পষ্ট।
অবস্থা সামাল দিতে মিথ্যে যুগিয়েও গেল নির্মলের মুখে:
— ভাবছিলাম, কাজল কেন যে এমন একটা কীর্তি ক’রে গেল!
— সেসব আমি ভুলে গেছি। আপনি সুন্দর ক’রে বুঝিয়ে বললেন যে।

বরাহাচার্য্যের সূত্র মেনে সে দ্রুত হাতে নতুন কুণ্ডলী গড়ছিল পতাকীরিষ্টির। পুব-পশ্চিমে লম্বা পতাকালাগানো তিনটে লাইন টেনে তার ওপর উত্তর-দক্ষিণে আরও তিন লাইন বিন্যাস করলে কুণ্ডলী দ্বাদশ ভাগে বিভক্ত হল। নিয়ম মেনে দুই-দুই রাশির মধ্যে তির্যক রেখা এঁকে তাদের বেধ বা যোগ নির্ণয় করল নির্মল। তৈরি হল পতাকী-চক্র। চাঁদের জন্মছকে গ্রহেরা যে-যে রাশিতে আছে, তাদের পতাকীচক্রের ঠিক ওই জায়গায় বসাল। এবার বেধ অনুযায়ী শুভাশুভ ফল-বিচারটা শুধু বাকি।

— জানেন, বাসু বলছিল কাজল-কৃষ্ণেন্দু এখান থেকে বাড়ি যায়নি, স্টেশানে গিয়ে উল্টোদিকের ট্রেন ধরেছে। তার মানে ছোট্‌ঠাকুরপো-র কাছে যাচ্ছে, নিমতায়। আমাদের এখানেও তো এসেছিল চারঘাট-এ নারায়ণদার বাড়ি থেকে। পোয়াতি মেয়ে এইভাবে নিজের ভিটে ছেড়ে অন্যের বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে দুটো পেটের ভাতের জন্যে!

ঠিকুজী থেকে জন্মের দণ্ডকাল ১৭।৫৪।১৪ তুলে বিড়বিড় করতে করতে নির্মল দণ্ডাধিপতি কষতে বসল এবার। দেখল, সম্ভাবনার মধ্যে সবচেয়ে মন্দটাই ঘটে ব’সে আছে। অশুভ দণ্ডাধিপতি গ্রহের সঙ্গে লগ্নের যোগ, এমনকি চারটেই পাপগ্রহ বেধচতুষ্টয়ে। সমস্ত ফাঁড়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় রাক্ষস এই ‘নিয়ত পতাকীরিষ্টি’। গণ্ডযোগ নয় যে নবগ্রহের পুজো দিলে পরিত্রাণ আছে, রাহু-ফাঁড়া কেতু-ফাঁড়া নয় যে পাথর পরাবে। মীন রাশির পতাকীরিষ্টিকাল (নির্মল পরাশর-সংহিতা ঘাঁটছে)… মানে জাতকের সর্বোচ্চ আয়ু… হ্যাঁ পঁয়ত্রিশও না, উনত্রিশ বছর!

চাঁদের মা তখনও বলে যাচ্ছে, “আপনার বুনঝি গোপার কানের দুলজোড়া নেয়ায় পেত্থোমে আমার খুব রাগ হইছিল। পরে চিন্তা কল্লাম, ঠাকুরির ইচ্ছেয় কাজ্‌লার মেয়ে হোক, মুখদ্যাখানি সোনা তো কিনতিই হতো মামা-মামির, নয় আগাম দিয়ে রাখলাম”।

যেন দুই নেশাড়ুর দুটো সমান্তরাল গল্প একে অন্যের কাছে। তবু মায়ার গলা থেকে কোনওভাবে কি ‘কানের দুল’ খুলে কানে গিয়েছিল নির্মলের? ভিজিয়ে রাখা চা-পাতার মতো অপেক্ষায় ছিল তার স্মৃতি : “দিয়ে তোমার রতনমণি আমায় করলে ধনী”… আর তারপর মনে পড়েছে, “আমায় তুমি করবে দাতা, আপনি ভিক্ষু হবে”। আর্তের মতো উৎকন্ঠায় সে মায়াকে জিগ্যেস করল, তুমি কাল একটু রবি ঠাকুরের গান শোনাবে আমাকে?

.
(আরও আছে)

বিশ্রাম

ক’দিন ধরেই মা’র জ্বর। সারাদিন জ্বরকে সামাল দেন, রাতে হেরে যান। শরীরের তাপ বাড়ে। বিছনায় নির্জীব হয়ে পড়ে থাকেন। চোখ সামান্য খোলা, চোখের মণি মাঝে মাঝে চঞ্চল হয়ে ওঠে। কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোন। না, ঘুমোন না। মা ঘুম আর জাগরণের মাঝে পেণ্ডুলামের মত দোল খান। দোল খেতে খেতে মাঝে মাঝে কুঁকড়ে ওঠেন, অস্ফুট স্বরে বলেন,
– মাহমুদা, পা’টা একটু টিপে দেরে মা..

মাহমুদা নেই। জ্বরের ঘোরে মা ভুলে যান। অভাবের সংসারে কেইবা থাকে! যতদিন সে ছিল মেয়ের মত হয়েই ছিল। মায়ের ভুল ভাঙাই না। মাহমুদা হয়ে পা টিপে দেই। মাথায় বিলি কাটি। ফিডিং কাপে করে পানি খাওয়াই। ওষুধ খাওয়াই। জ্বরের ঘোরেই তিনি জানতে চান,
– রোকন ফিরেছে! খেয়েছিস তোরা!

মাহমুদা হয়েই ছোট করে উত্তর দেই,
– হু।

ভোর হয়। মা জেগে ওঠেন, কিছুটা অপরাধীর মত করে বলেন,
– আজও জেগে ছিলি!
– হ্যা, তুমি আরেকটু ঘুমাও না হয়।

ঘুমের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে মা বলেন,
– রোকন, মাহমুদাকে কোনোভাবে ফিরিয়ে আনা যায় না!

কোনো উত্তর দেই না। মা জেগে উঠেন, আমার চোখে ঘুম নেমে আসে। রাতজাগার কারণে ঘুম গাঢ় হয়ে আসার কথা, আসেনা। ঘোর ঘোর ঘুমে শুধু চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে, মন জেগে থাকে। ওই ঘুমের মাঝেই ক’দিন ধরে একটা গল্প আসছে। লাইনের পর লাইন লিখছি, কাটাছেড়া করছি প্যারাগ্রাফ ঠিক করছি। কিন্তু ঘুম ভাঙার পর গল্পটা আর মনে থাকে না।

দুপুরে মায়ের সাথে খেতে বসি। মা জিজ্ঞেস করেন,
– ছুটি শেষ হতে আর ক’দিন বাকী?
– ১১ দিনের মত।
– ও।

আমার পাতে একটুকরো তেলেপিয়া মাছ তুলে দিতে দিতে অনুনয়ের স্বরে বলেন,
– আমাকে ক’দিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবি! ক’টা দিন থাকবো, বিশ্রাম নিবো। মনটা খুব টানছে।
– এই বর্ষায় যাবে? চারদিকে পানি আর পানি…

মা কিছু বলেন না। হঠাৎ করেই মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়, স্বপ্নে লেখা গল্পটার প্রথম লাইন ছিলো ‘চারদিকে পানি আর পানি..।’ প্রতিটা লাইন এখন একের পর এক মনে পড়ছে। দ্রুত খেয়ে উঠে পরি। টেবিলে বসে লিখতে শুরু করি, ‘চারদিকে পানি আর পানি। অথৈ স্রোতের ঘূর্ণি…।’ লেখা চলছে তরতরিয়ে।

মা টেবিলে চা রেখে গিয়েছিলেন। খেয়াল করিনি। চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মাথার ভেতর গল্পের অলিখিত অংশটা ভরে নিয়ে রান্নাঘরে যাই। নতুন করে চা রান্না করি। দুটো কাপে ঢালি। মা’র ঘরে যাই। মা ঘুমোচ্ছেন। শেষ বিকেলের নরম আলোর আভায় মা’র চেহারায় কোমল জ্যোতি, মায়ামায়া। চা খাওয়ার জন্য মা’র ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে করেনা।

কোনো শব্দ না করেই কিছুক্ষণ পা টিপি। এরপর চুলে বিলি কাটতে কাটতে বুঝতে পারি গল্পটা আর লেখা হবেনা। মাকে নিয়ে গ্রামে যেতে হবে। চারদিকে পানি আর পানি, এর মাঝে একখণ্ড শুকনো জমিতে মা’কে রেখে আসতে হবে, মা থাকবেন, মায়ের এখন অথৈ বিশ্রাম।

.
#বিশ্রাম
১০০৮২০২০

আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

কুড়ি
রাইটার্স বিল্ডিংয়ে হইচই, আলোড়ন, তোলপাড়। একে তো সরকারি অস্ত্র খোয়া গেল, তারপর বাঘের হাতে বন্দুক, সে গুলিও চালাচ্ছে। রোবটরা যদি রাইফেলের জোরে একটা বিদ্রোহমতো ক’রে গোসাবা বা কুলতলির দখল নিয়ে বসে? যুদ্ধের বাজারে তখন এক্সট্রা গৃহযুদ্ধের চাপ; জিনিসটায় রাজনৈতিক রঙও লেগে যাবে, পশ্চিমবঙ্গে বাঘ-পতাকাওলা পার্টি আছে না!

মিটিংয়ের আহবায়ক বন দপ্তরের প্রধান সাত্যকি জোয়ারদার সাহিত্যিক মানুষ; বললেন, আমরা যদি গঠনমূলক দিক থেকে দেখি — বাঘের হাতে রাইফেল মানে জঙ্গল চোরাশিকারি-মুক্ত। তার এই চূড়ান্ত এগিয়ে থাকা অরণ্য-বাঁচাও ফর্মুলা বিক্কিরি হল না। দু’বছর এলএলবি প’ড়ে ছেড়ে দেওয়া ডেপুটি সেক্রেটারি (গৃহ) বিদ্যে ফলালেন, স্যার বাঘ গুলি ছুঁড়ছে কোর্টে প্রমাণ করবেন কী ক’রে? কার্তুজের খোল তো উদ্ধার করা যায়নি! ডিআইজি সাহেবের প্রথম থেকেই আলোচনায় ইন্টারেস্ট নেই। তিনি কাছাকাছির মধ্যে নদী ও জলসেচ দপ্তরের সচিবের কান পেয়ে সেখানেই ফিসফিসোলেন : পেটের ভেতর যেমন গ্যাস আর অ্যান্টাসিড নিজেরা নিজেরা মারামারি করে, আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমোই; তেমনি এখন জন্তু-জানোয়ারে যুদ্ধ চলুক; পুলিশের নাক গলানোর কী আছে! পর্যটন দপ্তরের এক বাচ্চা বিসিএস অফিসার মহা উত্তেজিত — বাঘের একটা রাইফেল-হাতে ছবি পাওয়া যায় না?

— দূর বাবা, ঘটনার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না! শিউলি বলল। মাথা ঝাঁকাল চাঁদ।

— বড় বড় মাতব্বরই ঠাওর করতে পারছে না, তার তোরা! এট্টু সবুর কর। কাকিমা কোথায়?
কাকিমা বারাসাতে গেছে, দিদিমা পাড়ায় শুনে টিপুদা একটা বিড়ি ধরাল।

আমলাদের দৌড় বুঝে নিয়ে বনমন্ত্রী শশধর চ্যাটার্জি গলা চড়িয়েছেন : ধূলিভাসানি বিটের ফরেস্ট অফিসারকে ডাকা হয়নি? সে কোথায়? রঞ্জিত সমাদ্দার উঠে দাঁড়াতেই — কী ব্যাপার, রাইফেলটা বাঘের হাতে তুলে দিয়ে নাকে তেল লাগিয়ে ঘুমোচ্ছেন?
স্যার, আমার একটা শান্তি-পরিকল্পনা আছে। আমরা বাঘদের কাছে আবেদন রাখতে পারি ওয়েপন ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে।
সরি টু সে, সবাই গাঁজা খেয়ে আসেননি তো মিটিংয়ে!
স্যার, রোবট আমাদের ঘোষণা না বুঝলেও নন্দরাক্ষস বুঝবে।
হু ইজ নন্দ? পোষা বাঘ নাকি আপনাদের? কুনকে হাতির মতো জঙ্গলে ছেড়ে রেখেছেন?

সব শুনে চাটুজ্জেবাবুর মুখ উজ্জ্বল হল। রূপান্তরিত শিলা পড়েছিলাম ক্লাস এইটের ভূগোলে, তারপর এই রূপান্তরিত বেড়াল! বেশ লেগে পড়ুন, আমার বেস্ট অফ লাক থাকল।

সারাদিন ধরে মাইকিং হচ্ছে কৈকলমারি-শুইয়া-ধূলিভাসানি বিটের নদীবক্ষে এবং বন-ঘেরা রাস্তায় : মাননীয় বাঘগণ ও বিশেষভাবে প্রিয় নন্দ, আপোনাদের চুরি করা, সরি ছিনতাই করা রাইফেলের অভাবে বন দপ্তরের ডে-টু-ডে কাজ খুবই হ্যাম্পার হচ্ছে। তাছাড়া প্রশিক্ষণ নেই ব’লে আপোনাদের হাতের টিপ খুবই খারাপ। একটা বাঁদর-সাইজের ঈগল পর্যন্ত মারতে পারলেন না। তাই বেশি ফুটুনি না ক’রে, সরি, জটিলতা বৃদ্ধি না ক’রে রাইফেল জমা দিয়ে দায়িত্বশীল নাগরিকের পরিচয় প্রদান করুন। শুইয়া নদীর খাঁড়িকে হাতিয়ার সমর্পণের ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে, সময় আগামি কাল সকাল দশ ঘটিকা। সরকার কথা দিচ্ছে, চার হাতপায়ে চালানো বন্দুক আবিষ্কার হলে সবার আগে এই জঙ্গলেই সাপ্লাই দেওয়া হবে।

মাঝ-মাতলায় দাঁড়িয়ে থাকা লঞ্চে ঠাসাঠাসি গ্রামের কিছু মাতব্বর, পুলিশ, রেসকিউ টিম, ব্যান্ডপার্টি আর ‘সুন্দরবন বার্তা’ পত্রিকার একই দেহে মালিক-সম্পাদক-সাংবাদিক-ক্যামেরাম্যান বিকাশ সাঁপুই। বাঘের হাতে ঘড়ি নেই ব’লে দশটা বাজতে পাঁচ থেকে ব্যান্ডপার্টির কনসার্ট চালু : “কর চলে হম ফিদা জান-ও-তন সাথিয়োঁ”… কিন্তু কোনও সাড়া নেই। তারপর “অ্যায় বতন অ্যায় বতন হমকো তেরী কসম” সুর ওঠা মাত্র নদীর পাড়ে কালোহলুদ মাথাও ফুটে উঠতে লাগল। বাজিয়েরা ভয়ে থেমে গেছে, সমাদ্দার চেঁচালেন : চালিয়ে যাও; তিনি খেয়াল করেছেন বাঘদল গানের তালে তালে পা ফেলে এগিয়ে আসছে —- ঝম্পু ঝম্পু ঝম ঝম, ঝম্পর ঝম্পর ঝম। মিছিলের নেতৃত্বে এক বাদামি বুনো শুয়োর, আরে না না, ও তো আচ্ছাসে বডি বানানো আমাদের নন্দরাক্ষস! পিঠে তার রাইফেল, মুখে কামড়ে আছে স্লিংয়ের কাপড়। শুইয়া খালের মুখে নৌকো বেঁধে রেখে এসেছিল ফরেস্ট গার্ডরা, তার গলুইতে রেশন দোকানের মুটে যেমন পিঠ ঝাঁকিয়ে চালের বস্তা ফ্যালে, তেমনি এক ঝটকায় রাইফেলটা নামিয়ে দিল নন্দ। তারপর লোহার গজালে বাঁধা কাছির ফাঁস দাঁত দিয়ে খোলার চেষ্টা করতে লাগল। পেছনে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে দুশো রোবট, সময় লাগছে দেখে একটা মুশকো বাঘ কামড়ে উপড়ে দিল লোহার খোঁটা। ওমনি ফরফর ক’রে ভাসতে ভাসতে নৌকো লঞ্চের গায়ের কাছে! এদিকে হাফ-সেঞ্চুরি মানুষ হাততালি দিচ্ছে, ওপাশ থেকে ডবল সেঞ্চুরি বাঘের একজোট গর্জন! সেই শব্দে লঞ্চ থেকে ক্যামেরাসুদ্ধু নদীতে পড়ে গেল বিকাশ সাঁপুই।

বাসু মুখে হাতচাপা দিয়েছে : আমি জানতাম লাস্টে ক্যামেরাম্যান জলে পড়ে যাবে।
— কেন রে মনিদা?
— যদি কেউ অস্ত্র জমা দেওয়ার ছবি দেখতে চায়!

টিপুদা বাসুর চোখদুটো পুনরাবিষ্কার করছিল। সেখানে বুদ্ধি, সতর্কতা আর আত্মবিশ্বাস দিয়ে সীমাহীন এক মোকাম থেকে দেয়াল-তোলা ঘরে স’রে যাওয়ার রাস্তা আঁকা হচ্ছে। ছেলেটা ভুলে যাচ্ছে কল্পনার মাটিতে আলপনা আরও সুন্দর ফোটে, স্বপ্নের টিকিট কাটলেই জীবনের ট্রেনে চাপা যায়। আসলে পাঠক জন্ম নেয় কাহিনির সামনে বুঁদ হয়ে বসে থাকবে ব’লে — প্রতিমাকে পুজো দেওয়া মানুষ যেন; আর সমালোচক পা টিপে-টিপে মূর্তির পেছনে গিয়ে দেখতে থাকে কাদা-মাখানো বিচালি, কাঠের শলাগুলো। ছোটরা নতুন জামার ভাঁজভাঙা গন্ধেই মাত; বড়রা রঙ বোতাম কিচ্ছু না, পরখ করে সেলাই কতটা অপলকা।

বাসুদেবও অসহায়ভাবে বড় হয়ে যাচ্ছে!

(আরও আছে)

আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

সতেরো
নারকোলগাছের গাব্‌ড়ো দিয়ে ব্যাট বানিয়ে ক্রিকেট চলছিল উঠোনে, হঠাৎ খেলা ভেঙে শুরু শিশুকিশোর নাচ। সঙ্গে গান এক লাইনের — আজ মাংসো খাবো। আআজ মাংসো খাবো। তখন নির্মল স্তব্ধ ও সুচিন্তিতভাবে বাজারের ব্যাগ তুলে দিচ্ছে মায়ার হাতে।

কলোনির কোনও ঘরে মাংস রান্না হলে আশপাশের বাড়িগুলোর চাল নাক আকাশে তুলে গন্ধ নেয়। পাড়ার বাতাসে যখন ভাসছে কৌতূহল আর বিষণ্ণতার মৌরিফুল, ভটচাজবাড়ির হেঁসেলের দরজায় ভিড় অধিকারসচেতন মানুষের।

সঞ্জু — মা, এবারে আমারে চারটে মাংস দেবা।
(বেড়াতে আসা ছোটছোট ভাগনেদের কথা ভুলে গেলি, মামা!)
শিউলি — আমি পায়ের হাড়টা চুষে চুষে খাবো। গতবার মনিদা পাইছে।
(গতবার = সাড়ে তিন মাস আগে দুর্গাপুজোর মহাষ্টমী।)
— মা, আমারে দুটো আলু দেবা কিন্তু৷
(অন্তত এক পিস মেটের দাবি তোলার জন্যে চাঁদকে উসকেছিল ননীবালা। কিন্তু রামকৃষ্ণ যতই বিবেকানন্দকে ভবতারিণীর কাছে টাকাপয়সা চাইতে পাঠাক, সে শুধু জ্ঞান-ভক্তি প্রার্থনা করেই ফিরে আসবে।)

আজ দুপুরের নায়ক পাঁঠার মাংস, আর নায়িকা চালের গুঁড়ো মাখিয়ে ভাজা কুমড়োর ফুল। বাচ্চারা খেতে বসেছে রান্নাঘরে, একটু ফাঁক রেখে দিদিমার আসন। দরজার বাইরে কিশমিশ চোখ বুজে কিন্তু মনশ্চক্ষু খুলে বসে আছে। আর হয়ত একুশ দিন, ঋতুট্রেনে ড্রাইভারের কেবিন থেকে শীত নেমে গিয়ে চেপে বসবে বসন্ত। এখন কিশোরের সদ্য গোঁফ ওঠার মতো আমের বোল গজাচ্ছে, রোদ বাবলু গিরির মতো লিকলিকে, রঘুনাথের মাঠে সাইকেলে সে এক পাক ঘুরে এলে একদলা ক’রে ভাত মুখে তুলে দিচ্ছে মা।

এদিকে মায়া যেই পেছন ফিরল, ননীবালা নিজের পাতের একখানি কুমড়োফুলভাজা ছুঁড়ে নিখুঁত অবতরণ করিয়েছে চাঁদের থালায়। ভাজায় অনাগ্রহী চাঁদ তক্ষুনি ফেরত পাঠাল পালটা থ্রো-তে, আর চেলে দিয়েই বুঝেছে — কেলেঙ্কারি ঘটালাম! ননীবালা স্মিত মুখে বাঁহাতে ঘটি উঁচু ক’রে গলায় জল ঢেলে খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়ছে।

— গাধা ছেলে, দিলি তো দিদিমার পাত ছুঁয়ে! সেই কাল দুফোরের আগে আর ভাত মুখি তোলবে না। তোমারেও মা বলিহারি, ছেলেটার স্বভাব খারাপ করেই ছাড়বা!
— ওরে, আমার খাওয়া হয়ে গিছিলো। তুমি শুদুশুদু চাঁদরে বকাবকি কোরে না, মনি।

আঠেরো
বাটিতে-বাটিতে মাংসের তেলভাসা নিফুটি ঝোলে বারোর এগারো ভাগ মাথা গুঁজে আছে দু’টুকরো ছোট মাংস আর এক পিস আলু।

শুধু একটা জামবাটি ছেলেমেয়েদের থেকে সরিয়ে রেখেছে মায়া। ওতে ‘বাবার মাংস’। নির্মল পাঁচ দানা অন্ন থালার বাঁ পাশে মাটিতে শ্রীবিষ্ণুকে উৎসর্গ ক’রে তার ওপর জল ছিটিয়ে ওই গণ্ডূষেরই অবশিষ্ট মুখে সুড়ুৎ করে টেনে নিয়ে ভাত ভাঙে। তারপর বাটির চার থেকে এক টুকরো মাংস পাতে তুলে নিলে “সবটুক খাতি হবে, নয়ত আমার মাথা খান” ব’লে জেদ ধ’রে উবু হয়ে বসে তার স্ত্রী। তখন সে দ্বিতীয় টুকরোটা নেয়। মায়ার দিব্যি কাটা থামছে না দেখে শেষ ভাতের দলা গিলে নিয়েই বলে “পেট ভ’রে গেছে”। আর কিছু করার নেই, নির্মল খেতে ব’সে কথা বলেছে মানে তার আহারে ইতি।

চার দিনের দিন ভোরেই মামা-মামিকে ঢপাঢপ প্রণাম ক’রে কাজল-কৃষ্ণেন্দু বিদায় নিয়েছিল। অবাক মায়া দোষী ঠাওরায় নির্মলকে। আপনাকে কতবার সাবধান করেছি, “তোমরা কি আজ থাকপা, না যাবা? থাকতি হলি থাকো, আর যদি যাতি চাও, রোদ থাকতি বেরোয় পড়ো সকাল সকাল” কথাটা অতিথি ভালো মনে নেয় না। জামাই নিশ্চয়ই কিছু মনে করেছিল…।

প্রায় তক্ষুনি বাসু চেঁচাল, জ্যামিতিবাক্স থেকে আমার পেনসিল আর রবার কে নিয়েছে? ক্রমশ দেখা যাবে শিউলির জরির কাজ করা ব্লাউজ, সিঁদুর কৌটোয় রাখা গোপার অন্নপ্রাশনে পাওয়া কানের দুল, পঞ্জিকার ভাঁজে নির্মলের চারমিনারের খরচ সাড়ে দশ টাকা — এমন বস্তুসমূহের হদিশ নেই। সবাই অনুসন্ধানে ডুবে আছে, রান্নাঘরে খ্যানখেনিয়ে বাসন পড়ার শব্দ হল। গোয়েন্দা কিশমিশ বেড়া বেয়ে উঠে শিকে থেকে বাটি ফেলে দিয়েছে। মেঝেয় গড়াচ্ছে সেই দু’টুকরো নির্মল মাংস।

উনিশ
— অপরাধ কে করে? যে মানসিকভাবে দুর্বল। তুমি কাজলদের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখতে চাইছ না। কিন্তু দুর্বলকে ত্যাগ করাও কি অপরাধ নয়?

— অপরাধীদের তো মেরেই ফেলা হল মহাভারতে। ভায়েরাই মারল ভায়েদের। কৃষ্ণ সমর্থন করলেন। আমি শুধু বাড়িতে আসতে দেব না বলেছি। আপনি সারাদিন গীতা প’ড়ে এখন উলটো কথা বলেন কেন?

— যা পড়ি তার সবটুকু মানি এমন তো নয়।

— না মানলে কৃষ্ণনাম উচ্চারণ করামাত্র চোখে জল ভ’রে যায়, গলা বুজে আসে?

— ভক্তি মানুষের সংস্কারে থাকে, খুঁজে বেড়াতে হয় না। কিন্তু স্পৃহা তার নিজের অর্জন। অভিলাষ থেকেই আসে জ্ঞান।

বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়লে বউ এসেছে তার পাশটিতে। আজকের ঘটনা আপন-পর সবার জন্যে ‌মন-কাঁদা মহিলার ভেতরটা থরথরিয়ে দিয়েছে। কথার শুশ্রূষা চাইছে সে। স্বভাবে দ্বিধাগ্রস্ত নির্মল কিছুক্ষণ চুপ ক’রে বিষয় আর কথনভঙ্গি হাতড়াতে থাকে। তারপর তার কিশোরপ্রতিম পাতলা গলা শোনা যায়।

— কুরুক্ষেত্রে অর্জুন তার ঠাকুরদা, জ্যাঠা-কাকা, শ্বশুর, মামা, ভাই, ছেলে, নাতি, শিক্ষক, বন্ধু — সবার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে ভেবে শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন। রক্তের সম্পর্কের টান আর মানবতার শিক্ষা থেকে তিনি সমরে অংশ নিতে পারবেন না ব’লে শ্রীকৃষ্ণকে জানান। এখানে অর্জুনের মনোভাব দয়া, ক্ষমা আর স্যাক্রিফাইসের। তিনি প্রশ্ন তুলছেন, আমার পূজনীয়কে আমি মারব কীভাবে? বোঝা যায়, অর্জুন কৃষ্ণের তুলনায় অনেক আধুনিক মানুষ। গীতার শুরুতে যদুনাথ তাকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করতে দুটো লোভ দেখিয়েছেন, পৃথিবীতে রাজ্যভোগ আর মৃত্যুর পরে স্বর্গলাভ, কিন্তু কিরীটির লক্ষ্য জীবনে নৈতিকভাবে সুখী হওয়া। “স্বজনং হি কথং হত্বা সুখিনঃ স্যাম মাধব” — স্বজনদের বধ ক’রে আমি কীরূপে সুখী হব, মাধব? বলছেন, ভিক্ষে করে খাব, কিন্তু রক্তমাখা অর্থ ও কাম চাই না। তিনি সামাজিক নৈতিকতার বোধে সুরক্ষিত। উত্তরে কৃষ্ণ প্রচুর উপদেশ দিলেন, যার প্রথম দুটো — মানুষের মূল হচ্ছে আত্মা, সে অনশ্বর, এক শরীর ছেড়ে অন্যতে যায়। তাই প্রকৃত অর্থে কাউকে মারা যায় না, তুমিও মারছ না। দ্বিতীয়ত, নিষ্কাম কর্ম করলে পাপ স্পর্শ করবে না।

ব’লে নির্মল থামে।
— ঘুমোলে?
— শুনছি।
— বোঝা যাচ্ছে?
— দিব্যি সুন্দর।

— অর্জুনের জ্ঞান বাস্তব ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া। কিন্তু বাসুদেব যা বলছেন, সেটা দার্শনিক বিবেচনা যার কোনও বাস্তব প্রমাণ নেই। আমরা কেউই জানি না আত্মার ধারণা কতদূর সত্যি বা কামনাহীন কর্ম করলে তজ্জনিত পাপ ছোঁবে কিনা। এই স্তরের কল্পবিশ্বাস দিয়ে পার্থিক সংকটের মোকাবিলা করতে গেলে স্ববিরোধিতার জালে জড়িয়ে পড়তে হয়। শ্রীকৃষ্ণও পড়েছেন।

জীবনের নৈতিক সমস্যার সমাধান জীবনের বৃত্তেই খোঁজা উচিত। আয়ুর প্রাক-এ বা আয়ুর অন্তিমে কী আছে, আমরা অবগত নই, কিন্তু এটুকু টের পেয়েছি যে ব্যক্তির জন্মমৃত্যুর আগেপারে এই পৃথিবী ও তার প্রাণপ্রবাহ থেকে যায়। কাজেই মানুষের অভিজ্ঞতায় অনশ্বরতার সবচেয়ে কাছাকাছি জিনিস হল মানবসমাজ, আত্মা বা অন্য কিছু না। এই জীবনস্রোতকে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র উপায় ক্ষমা আর ভালোবাসা।

— আমাকে গীতা পড়াবেন?

— তাহলে তুমি আমার মতোই ভাবতে থাকবে। গীতার বাংলা অনুবাদ কিনে আনব, নিজে প’ড়ো। আর জানো তো, স্কুলে পাঠ্যবইয়ের মানেবই মুখস্থ করতে নেই? গীতারও পণ্ডিতদের লেখা হাজারটা ব্যাখ্যা আছে, একটাও ছোঁবে না।

.
(আরও আছে)

আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

পনেরো
— ক্রেস্টেড সারপেন্ট ঈগল সম্পর্কে কিছু জানা আছে?
— কেষ্টর শালা কি পাগল? না, বলতে পারব না।

— বাদ দে, বাংলাই ভালো। মোট একুশ জাতের কেশরওলা সাপখেকো ঈগল হয়। এদের মুন্ডুটা বড়, মাথায় পেছনে ব্যাকব্রাশ করা চুলের মতো একগোছা ঘন পালক আর চোখে কালো মণির চারপাশে হলুদ বর্ডার দেওয়া। এছাড়া বাদামি গলা আর পেটের পাখনা জুড়ে সাদা ছিটছিট দাগ থাকছে। এই জাতের ঈগল সাপ খেয়ে বাঁচে; তবে পাখি, মাছ বা ছোটখাটো জন্তু পেলেও ছাড়ে না। ঘন জঙ্গলের ভেতর জলের কাছাকাছি কোনও বয়ড়া গাছের মাথায় চুপ ক’রে ব’সে শিকারের দিকে নজর রাখা কাজ, আর বিপদের লক্ষণ দেখলে কানফাটানো ডাক ছাড়ে — ঈলুইই…কী-কী-কী-কীলুইইই।

টিপুদার দেখাদেখি বাসু ডাকল, চাঁদও চেষ্টা করল একবার। তারা পাঁচজন রঘুনাথের পাশের মাঠে বাতিল রেল লাইনের স্তূপের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। আঙুলে দোকানের চাবির রিং ঘোরাতে ঘোরাতে টিপুদা একটা দামি হাসি দিল : এই ক্রেস্টেড সারপেন্ট ঈগল বা সংক্ষেপে কসাই-এর বিরুদ্ধে স্টেপ না নিলে সুন্দরবনের অনেকগুলো বাঘ হয়ত প্রাণে বাঁচত না।

কসাইয়ের চোখ হল এক্স-রে মেশিনের ঠাকুরদা; মাতলা-র পশ্চিমে কৈকলমারি-ধূলিভাসানিতে উড়ে-চ’রে বেড়ায়, আর যেই দ্যাখে বাঘ গুঁড়ি মেরে কোনও হরিণ বা বুনো শুয়োরের দিকে এগোচ্ছে, ওর মার্কামারা চিল… সরি ঈগলচিৎকার পেড়ে পশুটাকে দেয় ভাগিয়ে। সারাদিন পেটে মাংসপানি পড়ে না বাঘের। জঙ্গলে যারা মধুর চাক ভাঙতে যায় তাদের অনেককেও কসাই এভাবে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

এমন একটা পরিস্থিতিতে নন্দরাক্ষস সুন্দরবনে এসে পড়ল। প্রথম কিছুদিন নন্দর লেগেছিল ও-যে সামান্য মেছোবেড়াল নয়, কনসেন্ট্রেটেড বাঘ — এটা সবাইকে বোঝাতে। তারপর দশটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা রোবট আচমকা চিল্লিয়ে কসাইকে ওপর থেকে ফেলে দিয়ে ঘেঁটি কামড়ে ধরবে কিম্বা রাতে সে ঘুমোলে চুপিচুপি চ’ড়ে যাবে গাছে — শার্দূলজাতির এসব ডিজাইন ব্যর্থ হওয়ার পরে নন্দ পেশ করল তার মাস্টার প্ল্যান, যে-গল্প আগেই করেছি।

শিউলি হাঁদার মতো জিগ্যেস করল, কোন প্ল্যান? বাসু ওর বিখ্যাত চিন্তামণি পোজে দু-আঙুলে নীচের ঠোঁট টেনে ধরল : নন্দরাক্ষসই তাহলে রোবট পাঠিয়েছিল লঞ্চ থেকে রাইফেল চুরি করতে? কসাইকে গুলি করবে ব’লে!
চাঁদের স্বপ্ন-স্বপ্ন মুখ আরও করুণ : পাখিটাকে মেরে ফেলছে? ও যে কত মানুষের প্রাণ বাঁচাল?
টিপুদা থমকে গিয়ে তার কাঁধ জড়িয়ে ধ’রে পা দোলালো একটু।

— লক্ষ্যভেদ হলেই লক্ষ্যপূরণ হবে, নাহলে নয়, এমনটা ভাবছিস কেন? নন্দ দুটো বুদ্ধিমান রোবট বেছে তাদের শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছিল। পরের দিনই সুযোগ এসে গেল — কসাই দুপুরবেলা গাছের মগডালে ব’সে আপনমনে একটা সাপের নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে খাচ্ছে। শীতকাল ব’লে গাছে পাতা নেই, ঝোপের আড়াল থেকে নন্দ আরামসে তাক করল রাইফেল, একটা বাঘ শক্ত ক’রে ধ’রে রাখল রাইফেলের বাঁট, আর একজন ট্রিগার টিপে দিল।

পায়ের নীচের ডালটা ভ্যানিশ; কসাই ডানা ঝাপটিয়ে যেই আকাশে উড়েছে, সন্ত্রাসবাদীরা যেমন প্রথম কার্যক্রম না খাটলে দ্বিতীয়টা কাজে লাগায়, ব্যাগড়া মাস্টারকে ফের তাক করল নন্দ, দুই বাঘ মিলে আবার গুলি চালাল। নীল আকাশে সূর্যের দিকে ছুটে গেল বুলেট।

চারদিক থেকে অনেক রোবট দৌড়ে এসেছে, তিন বাঘ লজ্জায় তাদের দিকে তাকাতে পারছে না। শেষে নন্দরাক্ষসের কথাই জনতার মনোবল ফিরিয়ে আনল, যেটা টিপুদা একটু আগে বলেছে:

— বন্ধুগণ, লক্ষ্যভেদ হলে তবেই লক্ষ্যপূরণ হবে, এমন নয়। গুলি যেভাবে কসাইয়ের কান ঘেঁষে শিস কেটে বেরিয়ে গেল, তাতে আগামি কিছুদিন ওর নিজের মুখ দিয়ে আর শিস বেরোবে না। আমি লিখে দিতে পারি, সুন্দরবন ছেড়ে পালিয়েছে পাখিটা।

ষোল
নির্মলের তিন বোনের বুদ্ধিমান শ্বশুরবাড়িরা পার্টিশানের সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরনগরের বড়া গ্রামে তিন মুসলিম পরিবারের সঙ্গে সম্পত্তি বিনিময় ক’রে নিয়েছিল। ইঁটসুরকিতে গাঁথা বাস্তুভিটের বদলে তারা পেয়েছে বেড়ার তৈরি, মানুষসমান উঁচু মাটির বারান্দাওলা এবং গতকাল পর্যন্ত ঝাঁট-পড়া নিকোনো বাসস্থান। এছাড়া চাষজমির বদলে চাষজমি, বিশেষ ক’রে ছোট বোনের ভাগে ঝিলের মতো নিঃসীম পুকুর যার জলজোড়া পানিফলের লতা আর পাশের জঙ্গলে হায়না-দম্পতি।

একফোঁটা চেহারা ব’লে মায়ার ছোট ননদের নাম কুট্টি; শয়তান ঘটকের পাল্লায় প’ড়ে তার মেয়ে কাজলের বিয়ে হল এ-বঙ্গে এসেই; জামাই কৃষ্ণেন্দু নাকি শেয়ার বাজারে লেনদেন করে, প্রচুর কামাই। পরে দেখা যাচ্ছে তার রোজগারপাতি শূন্য; যে কাজেই যায়, দুদিন পরে ছেড়ে চলে আসে।

— অনেকদিন মামা-মামিরে দেহি না, তাই ভাবলাম…।
আত্মীয়ের অপরাধী-মুখ দেখে গৃহকর্ত্রীর ভয়ে এসে ভালোবাসা মেশে। সজনের ডাঁটা দেওয়া মুগের ডাল, আলুভাতে, মানকচুর তরকারি (জামাই নিল না, ওর গলা ধরে) আর বারোমাসি আমড়ার টক দিয়ে চারজনে ভাত খেয়ে উঠতে উঠতে বিকেল চারটে বেজে যায়। কৃষ্ণেন্দু বটতলার দিকে বেরলো বিড়ি ফুঁকতে। ওদিকে বড়ঘরে ছোটমামির কড়া জেরার মুখে কাজল।
— কয় মাস, দুই?
— কী কও বুঝি না!
— ন্যাকা সাজিসনে, কাজ্‌লা। ছোট্‌টারে কোলে নিচ্ছিস না, আবার ঠ্যাং মেলে খাতি বসলি। ব’লে সে নিজের নাভির নীচে বাঁহাতে চাপড় মারে।
— এই কোঁখে নয়ডা ধরিছি, তিনডে হয়েও বাঁচেনি।
— আজকে নিয়ে পেরায় আড়াই মাস।
— সংসারের এই অবস্থা, কৃষ্ণেন্দুরে মানা করিসনি?
— করি তো ছিলাম… তোমার জামাইয়ের যে বড্ডো মেয়ের শখ!

পরদিন সকালে কৃষ্ণেন্দু গামছা প’রে (“আহ, করো কি বাবাজি”) শালিমার নারকেল তেলের খালি কৌটো দিয়ে কলতলার ছ্যাদলা ঘষতে লেগে গেল। তারপর বেলা বাড়তে মামিশাশুড়ির চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে ফেলল মাথায় চাল না থাকা বাথরুমে। তিতপোল্লার খোসা দিয়ে হাতেপায়েপিঠে কাপড়কাচা বল সাবান ঘ’ষে দু-দু বালতি জল এক-এক জনের ঘাড়ে ঢেলে যখন বাইরে বের করছিল, যেন বইয়ের নতুন সংস্করণ ছাপা হয়ে বাজারে এসেছে। এবার কাজল রসুন-নিমপাতা-পেঁয়াজ বেঁটে তাতে লেবুর রস মিশিয়ে শিউলির মাথায় ঘষতে লেগে পড়ল, মেয়ের কেশবনস্থলী থেকে উকুন নিব্বংশ করতে হবে। অবশেষে বাড়ির মেয়েদের যার যেটুকু হাতে-কানে-গলায় আছে, তেঁতুলজলে ডুবিয়ে ধুয়ে দিতেই দোকান থেকে এক্ষুনি গড়িয়ে আনার মতো হেম আবার হেসে উঠল হেমবর্ণে! বাচ্চাদের “উপোরে তাকাবি না, চোখ বন্ধ কর” ব’লে কঞ্চির ডগায় ন্যাকড়া জড়িয়ে তিন ঘরের ছাদের সব ঝুল ঝেড়ে ফেলল শ্যামাঙ্গী। ওদিকে কৃষ্ণেন্দু জং-পড়া কোদালেই পেয়ারাগাছের পাশ থেকে মাটি তুলে রান্নাঘরের ছাঁচতলায় ঢেলে ফলার উল্টোপিঠ দিয়ে বসিয়ে দিতে দিতে বলছে : বর্ষাতে আর জল জমবে না, দ্যাখবেন মামি। পরের দিন সে কাতা-র দড়ি দিয়ে বড়ঘরের দরজায় ঝুঁকে আসা কাঁঠালগাছটাকে সোজা ক’রে দক্ষিণ কোণের সুপুরিগাছের সঙ্গে বেঁধে দিল। খোপের ঘরের খাটের তলা থেকে কবেকার আটটা নারকোল বের ক’রে দা দিয়ে ছাড়ানোর পর বাঁশের লগা-র মাথায় কঞ্চি বেঁধে সেই কোটা দিয়ে পায়খানার পাশের হ্যাচ্চাই উঁচু লেবুগাছ থেকে পেড়ে ফেলল ছাব্বিশটা লেবু। তার ইচ্ছে নারকোল আর পাতিলেবুক’টা নিয়ে বাজারে গিয়ে বসে।
— ওমা, কাজল তোর বররে ঠ্যাকা। কয় কী ও! আমাদের মানসম্মান ব’লে কিছু থাকবেনে নাকি!

সুতরাং, নারকেল-কুরুনির মাথা উপচে পড়ে কাঠটগরে, কাঁসার থালায় যেন পুষ্পভোগ চুড়ো হচ্ছে। বড় বড় শ্বাস টানতে টানতে শাঁখাপলা বাজিয়ে কুরুনির মাথায় হাত ঘোরাচ্ছে কাজল, তার ঘামেসিঁদুরেখোঁপায়হাসিতে-মাখা মুখের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে গোপা শিউলি দুই বোন। নারকোল-ফাটানো ঘোলা ঝাঁঝালো জল গামলায় ঢেলে বাচ্চাদের হাওয়ালে করা হয়েছে, প্রত্যেকে দুই ঢোঁক ক’রে খাবে। সঞ্জু নীচু হয়ে সবার গলার হাড়ের ওঠানামা গুনছে — ওমা, ভাই তিন ঢোঁক খেয়ে নিল!

.
(আরও আছে)

নব টোনাটুনি

index

এক ছিলো টোনা আর এক ছিলো টুনি। একদিন টোনা আহ্লাদ করে টুনিকে বলে,
— টুনি, ও টুনিইই..

টুনি হাই তুলে,
— হ্যা, বলো।
— আমার খুব ভাপা পিঠা খেতে ইচ্ছে করছে। খুব ইচ্ছে করছে।

টুনি রাগে চোখ পাকায়,
— তোমার কি খেতে ইচ্ছে করছে!
— পিঠা, ভাপা পিঠা।
— তোমার সুগার লেভেল হাই। শরীরে চর্বি জমছে। ফ্যাটি লিভার। আর ডায়েট না করে তুমি ভাপা পিঠা খেতে চাইছো! হাও সিলি!!

টোনার মন খুব খারাপ হলো। চোখে পানি চলে এলো। টুনিকে কান্নাভেজা স্বরে বলে,
— তোমার চটপটি খেতে ইচ্ছে হলো, বৃষ্টির মধ্যে আমি গিয়ে ননভেজ চটপটি কিনে আনিনি! তোমার ফুচকা খেতে ইচ্ছে হলো, তোমাকে কানিবগের ফাইভস্টার রেস্টুরেন্টে নিয়ে চিকেন ফুচকা খাওয়াইনি! আর আজ আমি সামান্য দুটো ভাপা পিঠা খেতে চেয়েছি বলে.. তুমি এভাবে..

“এক্কেবারে ঢং করবে না” বলে টুনি ধমকে উঠে। এরপর ঠোঁটে পায়ের নোখ কাটতে কাটতে বলে,
— জানু, ভাপা পিঠা খাবে বললেই তো বানানো যায়না। এর জন্য জিনিসপত্র লাগে। তুমি ঢং না করে জিনিসপত্র এনে দাও, ভাপা পিঠা বানিয়ে দিচ্ছি।

টোনার মনে খুব আনন্দ হয়। পাখায় চোখ মুছে বলে,
— কি কি জিনিসিপত্র লাগবে, সোনামনু?
— চালের গুড়ি লাগবে। গুড় লাগবে, মাওয়া লাগবে, নারকেল লাগবে। মাটির ঢাকনা লাগবে, ওই ঢাকনা বসানোর জন্য হাড়ি লাগবে, গ্যাস সিলিন্ডার লাগবে আর আমার মোবাইলে পাঁচ জিবি ডাটা লাগবে।

টোনা অবাক,
— ভাপা পিঠা বানাতে ৫জিবি ইন্টারনেট ডাটাও লাগবে!
— হ্যা, লাগবে। বেশী কথা না বলে এখনি বাজারে যাও।

টোনা বাজারে গিয়ে চালের গুড়ি, গুড়, মাওয়া, নারকেল, মাঝখানে ফুটো করা মাটির ঢাকনা, ঢাকনা বসানোর হাড়ি কিনে। বাজারের বাইরে এসে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার কিনে। টুনির মোবাইলে ৫জিবি ডাটা ভরে, সব নিয়ে বাসায় ফিরে।

টোনার মনে খুব সুখ — আজ ভাপা পিঠা খাবে। ওইদিকে টুনি ইউটিউবে ঢুকে ভাপা পিঠা বানানোর রেসিপি খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না। বারবার আসছে শুধু নুডলসের রেসিপি। নুডলসের খিচুরি, নুডলসের চাটনি, নুডলসের পুড় দেওয়া বেগুনের স্যান্ডুউচ। স্ক্রল করতে করতে নুডুলস দিয়ে ভাপা পিঠা বানানোর একটা রেসিপিও পেয়ে গেলো। ভিডিওটা খুলতেই মনে পড়লো ঘরে নুডলস নেই। এখন টোনাকে নুডুলস আনার কথাও বলা যাবে না। খুব রাগ করবে। ভাববে টুনি ভাপা পিঠা না বানানোর বাহানা করছে। টুনি আবার চালের গুড়ি দিয়ে ভাপা পিঠা বানানোর রেসিপি খুঁজতে শুরু করে। কথায় বলে, যেখানে মাহফুজের ভয় সেখানে হিরো আলম হয়, আসল রেসিপি খুঁজতে যেতেই বাফারিং শুরু হয়। ইটারনেটের গতি এক্কেবারে স্লো হয়ে আসে।

টুনি বারবার চেষ্টা করছে। বারবার রিফ্রেশ দিচ্ছে। রিলোড অপশনে ক্লিক করছে। কিন্তু নেট গাল ফুলিয়ে বসে আছে। কাজই করছে না। এমন সময় পাশের গাছের বাসা থেকে চড়ুই গিন্নি মাথা উঁচিয়ে চিৎকার করে বলে ,
— টুনি ভাবীইইই, টুনি ভাবীইইই আপনার ইন্টারনেট কি কাজ করছে!
— কি যে বলেন ভাবী, ইউটিউবের ভিডিওটা এক ঘণ্টায়ও ওপেন করতে পারলাম না।
— আমি ‘নাজুক দিল’ সিরিয়ালটা দেখছিলাম। নায়িকা সবে শ্বাশুড়ির সাথে ঝগড়া শুরু করেছে, গেলো হ্যাং হয়ে। সিরিয়ালের ফ্রিজ শট মনে করে তাকিয়ে আছি। পরে দেখি ইন্টারনেট স্লো। নায়িকার জন্য খুব টেনশন ফিল করছি ভাবী..
— ওহ, তাই! এদিকে আমি খুঁজছিলাম ভাপা পিঠার রেসিপি।

এ কথা শুনেই চড়ুই গিন্নি অভিমানী স্বর,
— হায় খোদাআআ! ভাবীইইই আপনারা একা একা ভাপা পিঠা খাবেএএএএন! আমাদের কথা মনেই পড়লো না ভাবীইইই, আজ চড়ুই না হয়ে বুলবুলি হলে ঠিকই দাওয়াত দিতেন ভাবীইইইই..

টুনি বিব্রত হলেও নিজেকে সামলে নেয়,
— কি যে বলেন, ভাবী! আপনাকে দাওয়াত দিতে হবে কেনো! আপনি তো ঘরের মানুষ, সবাইকে নিয়ে চলে আসবেন।
— থ্যাঙ্কু ভাবীইইই। আপনার হাতে বানানো ভাপা পিঠা খেতে আমরা তো আসবোই ভাবীইইইই। আমাদের উপরের ডালে কাজিন থাকে, ওর ফ্যামিলিকেও সাথে নিয়ে আসবো, ভাবীইইইইই।

টুনি রেগে মনে মনে “ঢং দেখলে শরীরটা জ্বইল্যা যায়” বললেও, মুখে হাসি মেখে উত্তর দেয়,
– অবশ্যই নিয়ে আসবেন। খুব খুশি হবো।

চড়ুই গিন্নী বাড়ির ভেতর ঢুকে যেতেই টুনি ধমকের সুরে টোনাকে বললো,
— চড়ুই ভাবী এলে এক্কেবারে রংঢং করবে না। যদি করো তবে চালের গুড়ির ভেতর তোমার মাথা পুরে সিদ্ধ করে মাসালা ভাপা পিঠা বানাবো, মনে থাকে যেনো, হু।

কোকিল পাখির গাওয়া কাকসংগীতের একটা সিডি লো ভলিউমে টোনা আয়েশ করে শুনছে আর ভাবছে কখন বানানো হবে ভাপা পিঠা। এদিকে বাফারিং হতে হতে টুনির মোবাইলের চার্জ শেষ। মোবাইল সেটটা চার্জে দিয়ে টুনি নারকেল কুড়ালো। গুড় মিহি করে টুকরো টুকরো করলো। চালের গুড়ির সাথে মাওয়া মিশালো। হাড়িতে পানি ভরে চুলোয় বসালো।

সবকিছু ঠিকঠাক করে টুনি মোবাইল অন করে। মোবাইল অন করে মন খারাপ হয়ে যায়, দেখে ইন্টারনেট স্পিড এক্কেবারে কম। মাত্র ভাবতে শুরু করেছে ইউটিউব না খুললে ভাপা পিঠা বানাবে কিভাবে, তখনই বটগাছের পূব পাশের মগডালের ওপেন এয়ার ডুপ্লেক্সে বাস করা ব্যাচেলর চিলটা উপরের ডালে উড়ে এসে বসে,
— হ্যালো টুনি ভাবী, বাসায় আছেন?

চিলের কথা শুনে উচ্ছসিত টুনি বলে,
— কি আশ্চর্য! ভাইয়াআআআ, এদ্দিন পর আমাকে মনে পড়লো!
— না, ঠিক তা না। রোজই আপনার কথা মনে হয়, কিন্তু..

কথা শেষ করতে না দিয়েই টুনি কপট রাগ দেখায়,
— থাক.. থাক। বানিয়ে বানিয়ে আর মিথ্যে বলতে হবে না, ভাইয়ায়ায়ায়া। আপনার তো শুধু ডাহুক ভাবী, পায়রা ভাবীর কথা মনে পড়ে, ভাইয়ায়ায়া। আমার মত ছোট্ট টুনির কথা কি আর মনে পড়বে, ভাইয়ায়ায়ায়া।

চিল প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলে,
— টুনি ভাবী, ইন্টারনেটের স্পিড কি ঠিক আছে?
— না, ভাইয়ায়ায়া, ঠিক নেই। খুব স্লো, ভাইয়ায়ায়া।

টুনির এমন বিগলিত অবস্থা দেখে ঘরের ভেতরে টোনা রাগে দু’বার পাখা ঝাপটালো। বিষয়টা বুঝতে পেরে চিল টিটকারি মারে,
— কত স্লো, ভাবী! টোনার মত? প্রতি মৌসুমেই তো আপনার ডিম পাড়তে দেরী হয়ে যায়।

লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে টুনি। চিল প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে,
— এত আয়োজন কার জন্য?
— আপনার ভায়ের ভাপা পিঠা খেতে খুব ইচ্ছে হয়েছে, ভাইয়ায়ায়া। সব রেডি কিন্তু ইন্টারনেট স্পিড কম বলে পিঠা বানাতে পারছি না, ভাইয়ায়ায়ায়ায়।

চিল ভিরমি খেয়ে দুটো ঢোক গিলে বিস্ময় প্রকাশ করে,
— ভাপা পিঠা বানাতেও আজকাল ইন্টারনেট লাগে না কি!
— হ্যা, ভাইয়ায়ায়া। ইন্টারনেট না থাকলে ইউটিউবে রেসিপি দেখে পিঠা বানাবো কিভাবে!
— ও আচ্ছা।

টুনি আন্তরিক স্বরে বলে,
— ভাইয়ায়ায়ায়া, আজ কিন্তু আপনার দাওয়াত, না বলতে পারবেন না।

ঘরের ভেতর টোনা রাগে আবার পাখা ঝাপটায়। পাখা ঝাপটানোর শব্দ কানে যেতেই মুচকি হেসে চিল বলে,
— ঠিক আছে টুনি ভাবী। আপনি দাওয়াত দিচ্ছেন, এ দাওয়াত কি মিস করা যায়! আপনার হাতের পিঠা বলে কথা..

টোনা আগেই রেগে ছিল। ইন্টারনেট স্পিড ঠিক হচ্ছে না দেখে টোনার রাগ খুব বাড়লো। কখন ইন্টারনেট স্পিড ঠিক হবে তা জানাতে কাস্টমার কেয়ারে ফোন করতেই শালিকের লাস্যময়ী কণ্ঠ,
— সম্মানিত গ্রাহক, আমাদের সার্ভিসে আপনাকে স্বাগতম। মোবাইল রিচার্জের জন্য এক চাপুন। কল রেট জানতে দুই চাপুন। ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনতে তিন চাপুন। দশটাকায় পাঁচটা ফ্রি এসএমএস পেতে চার চাপুন। যে কোনো অভিযোগ জানাতে ডিসকানেক্ট বাটন চাপুন।

টোনা ডিসকানেক্ট বাটনে চাপাতে লাইন কেটে গেলো। দ্বিতীয়বার কল সেন্টারে ফোন করতেই ভেসে এলো ফিঙের কণ্ঠ,
— সম্মানীত গ্রাহক, আপনার একাউন্টে পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্যালেন্স নেই। কথা বলতে হলে রিচার্জ করুন। দ্রুত ডিম পাড়াতে হলে সঠিক পদ্ধতিতে টুনিকে আদর করুন। কল অপারেটরকে গালাগাল করার জন্য মোবাইল সেটের ‘পাওয়ার অফ’ অপশনে ক্লিক করুন এবং ইন্টারনেট স্পিড ছাড়া ভাপা পিঠা খেতে চাইলে মা’কে অনুরোধ করুন।

.
নব টোনাটুনি।
সাঈদের গল্প বইয়ের একমাত্র রম্যগল্প।

আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

বারো
মাঠের নাম রঘুনাথ। রেল কোম্পানির জমি, রঘুনাথ নামের ঝাড়েবংশে একা এক বিহারি গ্যাংম্যান তার কোণে ঝুপড়ি তুলেছিল। সকালে উঠে লোটা হাতে চলে যেত বাতিল কেবিনের কাছে গরুভাগাড়ের দিকে। তারপর প্রান্তরের পাশের ডোবায় ডুবকি লাগিয়ে স্টেশান-লাগোয়া হোটেলে রুটিতরকারি খেয়ে ডিউটিতে। রাতে তার তাঁবুর হারিকেন-আলো অন্ধকারের সমুদ্রে কম্পাসের মতো দেখা যেত কলোনি থেকে। এভাবে চলতে চলতে একদিন সকালে ঝুপড়ির ঝাঁপ ঠেলে আর বেরলো না রঘুনাথ। গরীব মানুষ ঠিক বেড়ালের মতো, মৃত্যুর সমীপবর্তিতা কাউকে টের পেতে দেয় না। অথবা গরীবকে সবাই বেড়াল ভাবে ব’লে তার ক্রমপতন চোখ এড়িয়ে যায়। যাই হোক, গ্রামের মানুষ এক স্থায়ী উত্তরের ঠিকানা হারিয়ে রেলের মাঠটাই লিখে দিয়েছিল বিহারির নামে।

আজ প্রচুর ভিড় জমেছে রঘুনাথে — পাঁচ দিন ব্যাপী অবিরাম সাইকেল চালনা এইমাত্র শুরু হল। এখন থেকে গুনে গুনে একশো কুড়ি ঘন্টা বাবলু গিরি নামে ওই কালো প্যাত্‌পেতে ছেলেটার মাটির সঙ্গে আড়ি, হাগু-হিসু বন্ধ, দুচোখের পাতা এক করবে না, মাডগার্ডহীন সাইকেলে ব’সেই স্নান সেরে মায়ের হাতে দুটো খেয়ে আবার গোলচক্কর কাটবে ঘাসের ওপর। হ্যাঁ, সেই চন্দ্রকোণা মেদিনীপুর থেকে মা এসেছে ছেলের সঙ্গে। রঘুনাথের এক কোণে ত্রিপল খাটিয়ে পাশেই মাটি খুঁড়ে উনুন সাজিয়েছে।

বাবলুর জামায় পোষা পাখির মতো দুটো এক টাকার নোট গাঁথা। বিকেলে ব্যালান্সের খেলা দেখাবে যখন, পালিত কবুতরের টানে অনেক শালিক-চড়াই-ময়না ওর শরীরে ব’সে ডানা ঝাপটাবে। আর মাইকে মুহুর্মুহু ঘোষণা : কলোনির শ্রী সবুজ বিশ্বাস এইমাত্র বাবলু গিরির খেলা দেখিয়া…, মান্নাপাড়া নিবাসী শ্রীমতি বিলাসী দেবী বাবলু গিরিকে আশীর্বাদ স্বরূপ…, কাশিমপুরের শ্রী অনাদি বসু বাবলু গিরির সাহসিকতায় মুগ্ধ হইয়া…।

খবর না দিয়ে যেমন হঠাৎ ক’রে বাড়িতে অতিথি চলে আসে, বিনোদনও গ্রামের নিরুপায় মেহমান। অঘ্রানের এক ভোরে উঠে শোনা গেল গ্রামে রামযাত্রা এসেছে, আবার মাঘের এক দুপুরে সে সহসা গায়েব। ততদিন অধিকারীসমেত রাম, সীতা, মন্দোদরী, লক্ষণ, শূর্পনখা…নানা ডিজাইনের আটন’টা ছেলেকে ক্লাবঘরের দরজাহীন প্রবেশপথে রঙিন শাড়ি টাঙিয়ে ‘প্রতি বছরের ন্যায়’ রাখার ব্যবস্থা। প্রথম এক মাস তারা দুতিনটে গ্রুপে ভাগ হয়ে গ্রামের এ-বাড়ি ও-বাড়ি অন্নসেবা করবে, খাতির পাবে ফিল্মস্টারের মতো। তখন রাতে অভিনয় হচ্ছে রামায়ণের ছোট ছোট টুকরো, মালা-ডাকে পয়সাও মন্দ না।

কিন্তু যত দিন যায়, গরীব ফতুয়ার পকেটে টান পড়ে, বেস প্রাইস লজ্জাজনক ভাবে নামিয়ে আনলেও জানকীকন্যার স্পঞ্জলাঞ্ছিত বুকে ঘসটানিখাওয়া মালা ডেকে নিতে কোনও আধাবুড়ো উঠে দাঁড়ায় না! আস্তে আস্তে অতিথিসেবা বন্ধ হয়ে ক্লাবঘরেই শিল্পীদের স্বপাক আহার চালু। এই অবস্থায় রামায়ণ ইউএসপি ধরে রাখতে পারছে না বুঝে অধিকারী সামাজিক পালায় সরে আসে। নিমতিতার মতোই কোনও গ্রামের গল্প, পাড়ার দুটো ছেলেমেয়ে ভালোবাসা করেছে — শিবনাথ (ডাকনাম শিবে, ভূমিকায় রাম) আর পার্বতী (অভিনয়ে সীতা)।

ততদিনে শীতের খোলা আকাশের নিচে নেহা-কুয়াশা লেগে অভিনেতাদের নাকে পুরোদস্তুর গোদরেজের তালা। কাজেই, রামযাত্রার দল গ্রাম ছাড়ার পর পাড়ার দাদাবৌদিরা রগুড়ে সন্তুকে পেলেই ধ’রে বসে, সেই সিনটা কর না, মনা। সন্তু কানু মালাকারের নিষ্কর্মা ছেলে, শিস দিয়ে গান, নাটক-থিয়েটার দেখা আর মাঝেমাঝে বাড়ি থেকে হাওয়া হয়ে যাওয়া তার সাধারণ গুণাবলী।
— কোন সিন?
সেই যে শিবনাথ পার্বতীকে কানে কানে কী একটা প্রস্তাব দিল, শোনামাত্র নায়িকা উত্তেজনায় থরো-থরো।

সন্তু ওমনি ঘাড় একদিকে বেঁকিয়ে কাঁধে ঝটকা দেয় :
(পার্বতী) : টা টা টা, আমি পাপোটা, আমি পাআপোটা। তুমি আমায় অপোন কথা পোলপে না, শিপেটা! তুমি যডি অপোন করো, আমি সপাইকে পোলে টেপো।
(শিবনাথ) : (গলায় হাসিমাখা প্রশ্রয়) কী পোলপি?
(পার্বতী) : আমি পোলপো, আমি পোলপোও… (সন্তু দুহাতে মুখ ঢেকে পেছন ঘুরে যায়) টাআআ, আমার লট্টা করে!

হা হা ক’রে হাসতে হাসতে নির্মলকে এসে সেই খবর দিচ্ছিল সুধা।
— মামনিদের বাড়িতি ব’সে সন্তুমামা রামযাত্রার নকোল কোত্তিছে। না-না-নারে বলতিছে টা-টা-টা। শোনবা?
মায়া চেঁচায় : ওরে দামড়ি মেয়ে, জ্যাঠারে এসব কোতি হয় নাকি!

নির্মল মজা পায় খুব।
— শোন, আমি যখন খুলনার দৌলতপুর স্কুলে মাস্টেরি করতাম, আমাদের এক বাংলা টিচার ছিল, কমলেশবাবু নাম। খুব নস্যি নিত নাকে, কিন্তু সবাইরে সাবধান করত, খবরদার এই নেশা ক’রো না। কারণটা কী?

“লিয়মিত লাকে লস্য লইলে দোলতোল ল-গুলি ল-বৎ উচ্চারল হয়। যেমল, অরুলববরুলকিরলমালা পরিলত হয় অরুলবরুলকিরলমালা-য়। যদি জিজ্ঞাসা করো, আপোলার ক্যালো এরূপ হয় লা? আমি বলিব, ইহা অভ্যাসের গুল!”

খিলখিল খলখল হাসির ওপর দিয়ে দুটো কুড়ির বনগাঁ লোকাল পাস ক’রে গেল। মায়া জানে, সাত কথার এক উত্তর দেওয়া ভটচাজমশাই আসলে একটি মিচকে শয়তান। স্কুল থেকে ফিরে কাল সে সঞ্জুকে ইংরাজি পড়াতে বসেছিল। মায়ার কানে এল বাবা ছেলেকে বলছে, আমি যে তোমারে এত বোঝাই, তা যে তুমি বোঝ না, তা যে আমি বুঝি, তা কি তুমি বোঝ!

এসব মস্করার মধ্যে ট্রেন থেকে নামা লোকজন আমতলাবাড়ি পার হয়ে যাচ্ছে। তাদের পেছনে এক পরিবার হেঁটে আসে আস্তে, দোনোমনা পায়ে — বৌ আগে, সঙ্গে বছর বারোর ছেলে, কিছু পেছনে তার স্বামী, হাতে ধরা পাঁচ-ছ’বছরের বাচ্চাটা হাঁটছে না, লাফাচ্ছে। সেদিকে চোখ পড়তে মায়া কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে গাঢ় চাপা স্বরে বলে উঠল, সারিছে!

ননীবালাও দেখেছে যা দেখার।
— আজ দু’দিন আমার বাঁ-চোখ নাচা বন্ধ হোতিছে না। তখনই ভাবিছি…।
মায়া একটা হালকা গর্জন ছাড়ল মায়ের দিকে।
— একদম মুখি তালা মেরে থাকো। তোমার মেয়ের শ্বশুরবাড়ির কুটুম।
তারপর হাঁক পাড়ল শিউলিকে।
— যা তো মা, বলরামকাকার বাড়িত্থে শিগ্‌গির এক খুচি চাল নিয়ে আয়। বলবি, সামনের সপ্তায় ফেরত দেব।

তেরো
প্রত্যেক পাড়ায় একটা পাগল, একটা মদখোর থাকে; আর আজন্ম মুখ-খারাপ একজন। এদের অস্পৃশ্যজ্ঞানে এক হাত দূরে রাখবে বাকিরা, কিন্তু সমাজ থেকে সরাতে তো পারবে না। আজ অবিরাম সাইকেলচালনার প্রথম বিকেলে কানাই তফাদারকে দেখা গেল রঘুনাথে। কানাইবুড়োর বয়েস আশি-পঁচাশি, বারাসাত কোর্টে মুহুরির কাজ করত, ভিড়ের মধ্যে কখন সে চাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
— দাদু, তুমি শোনলাম ইশকুলি ভোত্তি হইছ? আ-কার ই-কার শিখিছ নাকি?
— হ্যাঁ
— তালি বলো দেহি, ক-য় আ-কার ল কী হয়?
— কাল
— বেশ। ত-য় আ-কার ল?
— তাল
— এবার কও, ব-য় আ-কার ল কী?
এপাশ-ওপাশ থেকে লোকে খ্যা-খ্যা ক’রে হাসে। চাঁদ থমকে যায়।
— ব-য় আ-কার ল হল তালশাঁস, বুঝিছ? বাড়ি যেয়ে দিদিমারে ক’বা, কানাইদাদু শিকোয় দেছে।
বাসু এসে চাঁদের হাত ধ’রে টেনে নিয়ে যেতে যেতে রাগি গলায় বলে, দাদু, তুমি কিন্তু আমার ভাইটারে খারাপ ক’রে দেচ্ছো।
— বন্নোপরিচয়ে যে শব্দডা নেই, পড়ায় দিলাম। তোদের দেহি ‘ভালো কোল্লি মোন্দো হয় কলিকালের ফলে’!

চোদ্দ
তখন মাইকে ‘অজীব দাস্তাঁ হ্যায় ইয়ে’ বাজছিল, বাবলু আকাশে টুপি ছুঁড়ে দিয়ে সাইকেলে এক পাক ঘুরে নিলে উড়ন্ত টুপি বাজপাখির মতো নেমে আসছে মাথায়। সিটে উপুড় শুয়ে দুহাতে প্যাডেল করছে, যেন চাকার প্রতিটা স্পোক তার কথা শোনে। এবার সুতোয় বাঁধা কুড়িটা ব্লেড গিলে ফেলছে বাবলু, এই দৃশ্যে তার মা প্যাঁচা-সাদা মুখ ঘুরিয়ে আছে উল্টোদিকে। পাঁচ দিন সাইকেল চালাতে চালাতে অর্ধেক হয়ে যাবে ছেলেটা, কিন্তু এক সেকেন্ডের জন্যে পায়ের টো-ও মাটি ছোঁবে না, কথা ইজ কথা! ধুঁকে ধুঁকে একশো উনিশ ঘন্টা পঞ্চান্ন মিনিট শেষ করার পর হঠাৎ বুনো ঘোড়া হয়ে যাবে সে, হঠাৎ হেলিকপ্টার। শাঁই শাঁই করে দশ-পনেরো পাক দিতে দিতে চোঙামাইকে যেই সময় সমাপ্তির ঘোষণা, মাটিতে নেমেই দড়াম ক’রে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। তখন ছেলেরা জোরসে হাততালি আর মেয়েরা মুখে আঁচল-চাপা। মাইকের গানও পালটে গেছে — সও সাল প্যাহলে, মুঝে তুমসে প্যার থা।

এমনটাই নিয়ম; আগের বছর মছলন্দপুর থেকে বিজু মল্লিক এসেছিল, তার আগের বার গাইঘাটার বিশ্বজিৎ পরামানিক, সবাই লাস্টে জ্ঞান হারায়। এর পরেও দম থাকলে মাঠের এক পাশে যে কবর খোঁড়া হয়েছে, বস্তায় শরীর পুরে তার মধ্যে ঢুকে যায় অবিরাম সাইকেলচালক। চার ঘন্টা মাটিচাপা থাকার পরে যখন তোলা হল, দর্শকেরা মোটামুটি নিশ্চিত — টেঁসে গেছে। পাখার বাতাস, হাতপায়ের তেলো ঘষা এবং ‘সংঘের পক্ষ হইতে একুশ টাকা পুরস্কার ঘোষণা’র পর সে চোখ খোলে।

সন্ধে হয়ে আসছে, খেলা ভেঙে আবার একঘেয়ে চক্রগতিতে ফিরে গেছে কাঙাল জাদুকর। মাঠে ঘাসের তরোয়ালে শিশিরমুন্ডু বিঁধিয়ে আস্ফালন করছে শীতঋতু। ছড়িয়ে পড়া ভিড়ের মধ্যে টিপুদাকে দেখে দৌড়ে গিয়ে ধরে শিউলি।
— তারপরে নন্দরাক্ষসের কী হল বললে না তো?
— বলবানে। এখন দোকান খুলতি হবে, বুন্‌ডি।
— জানো, নন্দু সুন্দরবনেত্থে পালায় একা-একা বাড়ি আসতিছে। আমি স্বপ্নে দ্যাখলাম।

(আরও আছে)

আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

সাত
ননীবালা উঠোনে ব’সে খেজুরপাতার পাটি বুনতে বুনতে ঘরের দিকে মুখ বাড়াল : ও ভাই, ও দিদি, গলার আওয়াজ পাচ্ছি না যে? না পড়লি কিন্তু চাকরি পাবা না, বাকরি পাবা না, শেষে মস্‌সোবাসার মুখ্যু জামাই হয়ে থাকতি হবে।

শুধু মহেশ্বরবাসা কেন, ননীবালার আমলে পুব-পাকিস্তানে অনেক পুরুষই স্কুল কী বস্তু চিনত না। তো, এক বিয়েবাড়ির বাসররাতে কনের বান্ধবীরা বরের পড়াশুনোর পরীক্ষা নেবে ঠিক করল। একটা পোস্টকার্ড এনে তার হাতে দিয়ে বলল, সইয়ের কাকা বিয়েতে আসতে না পেরে এই চিঠিখানা লিখেছে। আমরা মুখ্যু অবলা নারী, একটু যদি পড়ে শোনান।

জামাইয়ের বিদ্যে না থাক, বুদ্ধিতে সে মহামতি আকবর। পোস্টকার্ডটা নেড়ে-চেড়ে আবার মেয়েদের হাতে ফেরত দিয়ে বলল, কী আর পড়ব, সবই মায়াদয়ার কথা!

চাঁদের মা এমন হাসিয়ে গল্প ক’রে শাসনবার্তা দিতে পারে না। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোয় ঢিলে ভাব আসে — স্কুলের ছুটি, সরস্বতীপুজো, নতুন ক্লাসে ওঠা, রামযাত্রা, সার্কাস… আর ততই সে “না পড়লি খাবি কী? জোন-খাটার মুরোদও তো নেই” ব’লে বাচ্চাদের আত্মায় আতঙ্ক গুঁজে দেয়। যেন পণ্ডিতবাড়িতে একটা যজ্ঞই চালু থাকবে — পুস্তকহোম; স্কুলের মার্কশিটই মানুষের আত্মপরিচয় হবে।

পাঁচ ভাইবোনের শরীরে তাই স্মৃতি ছাড়া কোনও শক্তি নেই; এমন সব ছত্রপতি চেহারা, ইলশেগুঁড়ির সঙ্গেও লড়ে জিততে পারে না। তাদের বাবা জানলা থেকে এসব লক্ষ করে পরীক্ষার খাতা দেখতে দেখতে। এর মধ্যেই তুড়ুক ক’রে কিশমিশ ঘরে ঢুকলে থিন বিস্কুট চারভাগ ক’রে এক টুকরো ছুঁড়ে দিল। ছেলেমেয়ের বেড়ালপ্রীতি নির্মলকে খুশি রেখেছে। কুকুরপোষা মানুষের অনেক দাবী পোষ্যের কাছে — বশম্বদ হও, নিরাপত্তা দাও, চোরডাকাত ধরো; কিন্তু যে বেড়ালকে বুকে টেনে নেয়, তার তাকত আছে কিছু পাওয়ার আশা না ক’রেই ভালোবাসার।

এসব ঘটনার মাঝখানে তর্‌বোরে-কে দেখা গেল — ফোকলা দাঁতে তড়বড় ক’রে কথা বলা সদাবিরক্ত এক ভগ্নদূত। হাড়-সম্বল শরীরে শায়াব্লাউজহীন একখানা কোরা কাপড় জড়িয়ে খালি পায়ে খরখর ক’রে পাড়া টহল দিয়ে বেড়ায়। নিমতিতা কলোনির সমস্ত ভালো খবর তুমি যেমন সুধার মুখে পাও, দুঃসংবাদপত্র এই তর্‌বোরে।

— চারপেয়ে নিয়ে আর আদিখ্যেতা করবেন না, মাস্টারমশাই। অ্যাহোনি দেহে আসলাম বিড়েলের হাঁচোড় খায়ে মোন্‌সাবাড়ির ছোটো ছেলেডা অজ্ঞান!

আট
চার বছরের বাচ্চা দুলুকে শুইয়ে রাখা হয়েছে মনসাভিটের বারান্দায়। তর্‌বোরের বাসি খবরে দুটো ভুল — অজ্ঞান নয়, সে মারা গেছে। বেড়ালদংশিতও হয়নি, বোড়া সাপের কামড় খেয়েছে মানিক দাসের ছেলে।

ঘটনার পুনর্নির্মাণ এভাবে করা যায় :
মানিকের বাড়ির পেছনে দাঁতনগাছ আর জার্মানিলতার ঘন ঝোপ; সকালে বাড়ির মেয়েরা সংসারে ব্যস্ত হলে দুলু তার ম্যাও বেড়ালকে নিয়ে সেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে শুকনো ডোবা পেরিয়ে অশথের থানের দিকে যাচ্ছে। গাছটার কোটরে বৌদ্ধ সময়ের কষ্টিপাথরে গড়া এক যক্ষমূর্তি এমনভাবে ঝুরি আর শেকড়ের গরাদে আটকানো যে মূর্তিচোর আজও তুলে নিয়ে যেতে পারেনি। গ্রামের লোক তাতে শিবজ্ঞানে ফুল বেলপাতা চড়িয়ে থাকে। তো, এই রাস্তাতেই এক তাল গোবরের মতো পড়ে থাকা চন্দ্রবোড়ার ঘাড়ে দুলুর পা পড়ল, দুলুকে ছোবল মেরে গোড়ালি পেঁচিয়ে ধরল সাপটা, ম্যাও হাঁচড়ে-কামড়ে সরাল তাকে। অবোধ শিশু সেই অবস্থায় ঘুরতে থাকল জঙ্গলে, কুল কুড়িয়ে খেল। তারপর যখন স্নায়ু বিকল হয়ে আসছে, বাড়ি ফিরে গড়িয়ে পড়ল উঠোনে।

মনসাতলার সামনের রাস্তায় ভিড়ে মিশে দাঁড়িয়েছিল সঞ্জু, আর শক্ত ক’রে দাদার হাত ধ’রে চাঁদ। বাঁশের চটায় ঘেরা ছোট গরীব মন্দিরে চারটে আবছা নাগেশ্বরী প্রতিমা দেখা যায়, মূর্তির চেয়েও ভয়ানক লাগে মাথা ঘিরে জ্যোতিশ্চক্রের মতো সাপের ফণাগুলো। মানিক দাসের বাড়িতে দুটো ভিন্ন স্রোত পাশাপাশি বইছিল — দুলুর মা মৃতদেহের পাশে উপুড়, বাড়ির মেয়েদের কুক দিয়ে মরনকান্না; এদিকে দুই ছেলে উঠোনে আসন গোছাচ্ছে, বাজারে ছুটছে; শোক কম, প্রতিজ্ঞা বেশি তাদের চোখেমুখে। আর পাড়ার মহিলাদের মাথায় চাঁদ সদাগরের আখ্যান — সাপে কাটলে ছ’দিন পর্যন্ত প্রাণ থাকে। স্বয়ং মায়ের জাগ্রত থান যে-বাড়িতে, পদ্মাবতী তাদের সন্তানেরই প্রাণ হরণ করবেন, হয় নাকি? এ-সবই দেবীর লীলা, তিনি ভক্তের পরিক্ষে নিচ্ছেন।

তখন মানিকের বড় ছেলে শিবুর সঙ্গে ঝোলা কাঁধে দুজন বেঁটে বলশালী মানুষ ঢুকল বাড়িতে। জুতো খুলে উঠে গেল মনসামণ্ডপে, ওসমান নামের লোকটা মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলল জমায়েতকে, আর সুলেমান দুলুর শরীরের ওপর ঝুঁকে পড়ে তার বুকে চাপ দিল হাতের তালু দিয়ে। ফুস ক’রে শ্বাস বেরিয়ে এল কি নাক থেকে, গলায় হালকা গোঙানি শোনা গেল? দুলুর মা “আমার দুলদুল বাঁইচে আছে! আমি কোইছিলাম না” ব’লে শিশুর শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গেলে তাকে একহাতে আটকে গলা চড়াল সুলেমান, “বাচ্চাকে সুস্‌তু ক’রে দেব, তিন দিন টাইম লাগবে”। প্রচুর হৈচৈ শুরু হল এর ফলে, দেবীকৃপাধন্য মানিক দাস ফেরেশতাজ্ঞানে ওঝার পা জড়িয়ে ধরল। এগিয়ে এল নিমতিতা কলোনির আপনি-মাতব্বর বলরাম, “সাওয়ালডারে যদি বাঁচাতি পারেন, আপনাগো নামে বেদী বানায় দেয়া হবে”।

ধূপধুনো, এক বালতি জল, ভাঙা নিমডাল, কাচের বাটিতে পাতিলেবু আর হাতপাখা — ছয় পদে সাজানো উঠোন। দুলুর শরীর নামিয়ে পূর্বাস্য ক’রে শোয়ানো হলে শীতের সন্ধেয় ঝপঝপিয়ে বালতির জল বাচ্চার গায়ে ঢেলে দিল সুলেমান। গা মুছিয়ে পায়ের ক্ষতয় ভালো ক’রে মলমপট্টি করল দুই ওঝা; মা পদ্মাবতীর নাম নিয়ে হাঁটুর ওপরে ধুলো-বাঁধন দিল। এবার আসনে ব’সে হাতে তুলল নিমডাল :

তিরপুনিয়ে তিরপুনিয়ে সঙ্গে ব’সে কান্দে রে
আও সখী বাও বন চৌষতি যাব না…

সঞ্জু বুঝতে পারে না এটা কোন ভাষা। একটা লাইন ধরতে গিয়ে পরেরটা মিস হয় :

উরবোড়া উরবোড়া, আরেক জায়গায় খাইয়ে মরা
চৌসবা মারবো লাত্থি, গায়ে হবে শব্দ, মুখে বিষ পাতাল ধায়…

মানিক দাস ওসমান-সুলেমানের ঠিক মুখোমুখি উবু হয়ে হাতজোড় ব’সে, যেন তারই বিষ ঝাড়ানো চলছে :

গ্যাল ফেলতে গেল নিয়া খেড়কা নদীর পার
গ্যাল ফেলতে গ্যাল ফেলতে ছিঁড়ল গলার হার

ওসমান এবার জিগ্যেস করছে :

ওরে ওরে ডোংকোর শোংকোর ভাই
কী সে সাপ কামড়াইল কও দেখি মোর ঠাঁই?

সুলেমান উত্তর দিল :

বিদ্যাপতি মরোলা পাইট্যা আছে যার
চল্লিশ কোটি বোড়ার বিষ শিব দিল সে

আবার দুজনে একসঙ্গে :

কোন কোন বোড়া, এর বোড়া শিব বোড়া
কোইয়া জিকুরিয়া চক্করিয়া কাদুরিয়া মান্ডলিয়া
সদাই উড়ে পড়ে রক্তে তোলপাড় করে
মানুষ-গোরু যে যেখানে পায়
ফুঁ দিয়া উড়িয়া তার গা’য়

দুজনে হামাগুড়ি দিয়ে দুলুর কাছে পৌঁছে নিমডালের ঝাপটা মারে তাকে :

ছাপ্পান্ন কোটি বোড়া বিষ যে নালে আসিয়াছিস
সেই নালে যা-গা রে বিষ
বিষে বিষহরি আইগ্যা
নাই বিষ মা পদ্মা, নাই

ভিড় থেকে নাগমাতার নামে জোকার উঠলে মানিক ও তার বউ আভূমি প্রণাম করে।

এবার হাতে তালি দিয়ে গান শুরু। কপালে অ্যাত্তো বড় গোলা সিঁদুরের টিপ একটা বউ কুলোর ওপর মনসার ঘট বসিয়ে কলোনির বাড়ি-বাড়ি সিধে তুলে বেড়াত। সঞ্জুর তাই চেনা লাগল কথাগুলো :

বন্দিলাম বন্দিলাম মাগো যন্ত্রে দিয়া ঘা
অবধান করো মা গো জগৎগৌরী মা
হংস বাহনে বন্দম দেবী পদ্মাবতী
অষ্টনাগ সহিত মা এসো শীঘ্রগতি

এবার “ওগো মা, পুরাও মনের বাসনা” ব’লে ধুয়ো টানল দুই ওঝা, গলা মেলাল পাড়ার সবাই।

নয়
বাকি পদ লিখতে পারছি না, মায়া এসে সঞ্জু-চাঁদকে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে গেছে। কিন্তু খবর তো ঘনত্বহীন তরল, অণুছিদ্র পেলেই চুঁইয়ে পড়ে। শোনা গেল, রাতে কলকাতায় ফিরে পরের দিন দুপুর-দুপুর এসে দুই ওঝা আবার লেগেছে বিষ নামানোর কাজে। কী আশ্চর্য, আস্তে আস্তে শুকনো কাঠ হয়ে যাওয়া শরীর নরম হচ্ছে, চোখের পাতা অল্প ফাঁক হল দুলুর, হাতের মুঠো খুলে গেল তার একটু পরে — ততক্ষণে চোঁয়ানো জলে ভিজে গোটা নিবাধুই গ্রাম ভেঙে পড়েছে মনসাবাড়িতে। শেষে দুলু পেছছাপ ক’রে দিতেই আত্মবিশ্বাসী জনতা জয়ধ্বনি দিল বিষহরার নামে।

ছেলেটাকে মণ্ডপের ভেতরে রেখে গায়ে কাঁথা চাপা দিয়ে দুই ওঝা বিদায় নিচ্ছে আজকের মতো — কাল ভোরে রোগি চোখ মেলবে, এক কাপ গরম দুধ যেন প্রস্তুত থাকে। কিন্তু পরের দিন থেকে আর মুখ দেখাল না ওসমান-সুলেমান, না জাগল দুলদুল। উলটে তার ছোট্ট উদর ফুলে ঢোল, সারা গায়ে চাকা-চাকা কালো দাগ, ভক করে দুর্গন্ধ নাকে আসছে মন্দিরের দরজা খুললেই। তর্‌বোরে আবার “ও দিদি, শুনিছেন” ডাক দিয়ে চাঁদের বাড়িতে।

— সত্য, তেতা, দ্বাপর পার হয়ে কলিতি আইছি। চাদ্দিক পাপে পরিপুন্নো। এ-যুগি জ্যান্ত মানুষ মরে যায়, তার মরা বাঁচবে কী ক’রে!
তারপর গলা নামিয়ে — মান্‌কে মনে হয় পাগোল হয়ে যাবেনে।

এগারো
“শালার মোনোশা” বলতে বলতে মন্দিরের মধ্যে একবার ক’রে ঢুকছে মানিক দাস আর এক একটা প্রতিমা তুলে এনে উঠোনে আছাড় মারছে। মূর্তির মুকুট খুলে গড়াচ্ছে মাটিতে, ধড় থেকে মুন্ডু খ’সে গোঁজের লাঠি বেরিয়ে পড়ছে। কখনও পতনের ধাক্কায় দেবীর বুক দুই স্তনের মাঝখান দিয়ে ফেটে গিয়ে হাঁ ক’রে পড়ল ভেতরের খড়মাটি। শোনা গেল, ওঝাদের খোঁজ নিতে শিবু কলকাতার রাজাবাজারে গিয়েছিল, সেখানে দুই জোচ্চোর তাকে মেরেধ’রে টাকাপয়সা কেড়ে নিয়ে ভাগিয়ে দিয়েছে।

কাঁচাখেগো দেব্‌তাদের পুজো করতে যারা ডরায় — পাছে আচারবিচারে ভুল হয়ে দেবীর কোপদৃষ্টিতে পড়ে — ঈশ্বরহত্যায় মেতে ওঠা লোকটাকে দেখে তারা সরে যাচ্ছিল। হঠাৎ মানিকের হাত থেকে পাকা কলার মতো সাপের ফণার এক সজ্জা মাটিতে সবেগে প’ড়ে এদিক-ওদিক ঠিকরে গেল, আর পেছনে কাঠি গোঁজা একটা ফণা, যার মুখে দুটো লোহার তার চেরা-জিভের অনুকরণে বসানো, ছিটকে এসে অবিকল ছোবলের মতো ফুটে গেল চাঁদের পায়ের আঙুলে। মুহূর্তের ঘবরাহট আর ব্যাথায় কেঁদে উঠেছে সে। তখনই পেছন থেকে কারও রোগা উষ্ণ করতল “কিচ্ছু হয়নি” শব্দের সঙ্গে মিশে তার পায়ের পাতাটা মুঠোয় তুলে নিল, যেন সোনার গয়না মুড়ে রাখা হল সিল্কের কাপড়ে। আহ, যে বাবা সর্বত্র অনুপস্থিত, ফতুয়ার ওপর ধুতির খুঁট জড়িয়ে কখন কলোনির রাস্তায় ছেলের গা ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়েছে!

পরমব্রহ্ম কারও দায়িত্ব নেন না, আগে থেকেই হাত তুলে দিয়েছেন, তাই নির্বিষ তাত্ত্বিক ছাড়া তিনি শত্রুহীন। কিন্তু লৌকিক দেবতার বেলায় যদি ভক্ত মরে, তবে ভগবানেরও ছাড়ানকাটান নেই। সাপ ঘুরছে বনেবাদাড়ে, বেড়াল পাবে রাস্তায়, জঙ্গল নিশ্চিত বাঘস্থান, তাছাড়া গরমে ঘরে ঘরে ভেদবমি আর মারু বেহাগ তো নয়, মারী বসন্ত। মানুষের সঙ্গে একই সংসারে একই প্রকৃতিতে বাস করছেন দেবতারা, দুধটা-কলাটা নিচ্ছেন গরীবের, তাই বিশ্বাসঘাতকতা করলে ফল ভুগতে তো হবেই। ছেলে নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে নির্মল এসব ভাবে। ব্রহ্মের সাধনা হল অর্থনীতির মূলসূত্র মুখস্থ করার মতো, তাতে চাকরিতে মাইনে বাড়বে না। কলকাতায় খাদ্য আন্দোলনের মিছিলে পা মেলানো মানুষ যেমন সরকারকে ভোট দিয়েও অভুক্ত থাকে, মানিক দাসও সেভাবে নিজেকে প্রতারিত মনে করছে। এটা কবিতার বিষয় হতে পারে, না প্রবন্ধের — নির্মল সহসা ঠিক করে উঠতে পারল না।

(আরও আছে)

আকাশ বলতে কিছু নেই

অনেক হয়েছে। আর না।
সেই পরশু রাত থেকে। এক-দুই-পাঁচ-দশবার নয়। তিরাশি বার ! হ্যাঁ, তিরাশিবার ঈশিতার নাম্বারে ডায়াল করেও কোনো রেসপন্স পায় নি অলক।
ওপাশ থেকে একটা নারীকণ্ঠ শোনার অপেক্ষায় এপাশে একটা যান্ত্রিক শব্দ বেজেই যাচ্ছে। সেই পরশু রাত থেকে। বাজছে তো বাজছেই।
ওপাশে কেউ ফোন তুলছে না।
এটাই শেষবারের মত। রিসিভ না করলে সব চুকেবুকে যাবে। সব…
চুরাশি বারের মত ঈশিতাকে ডায়াল করে অলক। সাথে সাথে একটা নারী কণ্ঠও ভেসে আসে কানে— আপনি যে নাম্বারে ফোন করেছেন, তা এই মুহূর্তে…
ঈশিতার ফোন অফ।

অনেক হয়েছে, অনেক। আর না।
পেয়েছিটা কী ও ! চুপচাপ সব সহ্য করতে হবে, সব মেনে নিতে হবে ?
না, না। এভাবে চলে না। এভাবে চলতে পারে না।
ফ্লোরে ফোন ছুঁড়ে মারে অলক।
একটা জোরালো ভাঙনের আওয়াজ।
সঙ্গে সঙ্গেই চৌচির !
হাঁপাতে হাঁপাতে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয় অলক। চোখ বুজে নিঃশ্বাস নেয়। ভারী ভারী নিঃশ্বাস। নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে ভিতরে একটা আর্তনাদ ফুলেফেঁপে উঠছে ! সেটাকে চেপে ধরা চাই।
কিছুক্ষণ বুকে বালিশ চেপে দম মেরে থাকার পর দেয়ালে দৃষ্টি মেলে অলক।

সদ্য চুনকাম করা দেয়ালের ঝলমলে নতুন গোলাপী রঙটা কেমন যেন ক্রমশ স্বচ্ছ থেকে আরো স্বচ্ছ হয়ে উঠছে। এতটাই স্বচ্ছ যে মনে হচ্ছে ওখানে ইট-বালি-সিমেন্ট-পেইন্ট এসবের বিন্দুমাত্র স্পর্শ লাগে নি কখনো, যেন পুরোটাই স্বচ্ছ কাঁচ। স্বচ্ছ কাঁচের দেয়াল। না, না, একেবারি যেন আয়না। কিন্তু এ কী ! আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব ভেসে ওঠার বদলে এটা কার মুখচ্ছবি ! চোখ বিস্ফোরিত করে লাফিয়ে উঠে অলক। মাথার ভিতরে একটা অপ্রতিরোধ্য ক্রোধের ঘূর্ণি নেচে ওঠে। জেগে ওঠে এক অসম্ভব জান্তব জিঘাংসা। ‘স্বার্থপর’ বলে সজোরে প্রতিবিম্বের মুখ বরাবর একটা ঘুষি বসিয়ে দেয় অলক ! নারীকণ্ঠের চিৎকার কিংবা আয়না ভাঙার ঝনঝন শব্দ, কোনোটাই শুনতে না পেয়ে দ্বিতীয় আঘাতের জন্য হাত ওঠাতেই বেদনাটা যেন মাথা থেকে হাতে নেমে এল ! চোখ মেলে হাতটাকে উল্টেপাল্টে ঘুরিয়ে-টুরিয়ে ভালো করে দেখে নেয় অলক— না, ফাটে নি। শুধু দেয়াল থেকে কিছুটা রঙ উঠে গিয়ে ব্যর্থ আঘাতের স্মারক হয়ে আঙুলগুলোর গোড়ায় লেগে আছে ! হাত থেকে এবার দৃষ্টি নামে ফ্লোরে। ফ্লোরজুড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়ে আছে মোবাইল ফোনটা।

এতক্ষণ মগজে ঘাপটি মেরে বসে থাকা জিদটা হুট করে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে, যেন বৈদ্যুতিক অনুতাপে অবশ হয়ে আসছে শারীরিক স্পন্দন, হু হু করে উঠছে মন ! ভাঙা ফোনের টুকরোগুলো একত্রিত করে জোড়া লাগানোর চেষ্টা চালায় অলক। ব্যর্থ চেষ্টা শেষে আবার বিছানায় ফিরে যায়। আর আটকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। জমাট বেদনাগুচ্ছ গলে গলে অশ্রু হয়ে অঝরে ঝরে পড়ছে !

জল শুকিয়ে যায়। বেদনাও নিশ্চিহ্ন হতে থাকে। শুধু স্মৃতিপটে লেগে থাকে কিছু দাগ, কিছু ক্ষত ! শুকনো চোখ মেলে এখন কেন জানি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেই খুব ভালো লাগে অলকের। অথচ… এইতো। মাত্র সপ্তা দুয়েক আগে। শেষ বিকেলের আলো তখনো নিভু নিভু জ্বলছিল। সিনেমাহলে গিয়ে একটা ফিল্ম দেখা শেষে ওরা একসঙ্গে বিআরটিসির দু’তলা বাসে করে হোস্টেলে ফিরছিল। ঈশিতার কাঁধে মাথা রেখে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়তে খুব ইচ্ছে হয়েছিল অলকের। কিন্তু যতবারই ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটাতে গেছে ততবারই লক্ষ করেছে— বাসের জানলা দিয়ে ঈশিতা দু’চোখ উর্ধ্বে তুলে আকাশ দেখছে। কেমন আনমনা নিশ্চুপ নিস্তেজ ওই দৃষ্টি।
বিরক্তিতে অস্বস্তিতে রেগে উঠেছিল অলক।
‘ওখানে এমন করে কী দেখছো ?’
‘কেন, আকাশ দেখছি।’
‘আকাশ ! আকাশ বলতে কিছু আছে ?’
ঈশিতা উত্তর দেয় না। শুধু আকাশ থেকে চোখ ফিরিয়ে অলকের ঘামে ভেজা ক্লান্ত মুখের দিকে নিরাসক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
‘চলো অন্যকিছু নিয়ে কথা বলি।’এই বলে ঈশিতার কাঁধে মাথা রাখে অলক।

এরকম টুকরো টুকরো স্মৃতি আরো অনেক আছে। ক্ষণে ক্ষণে মনের অন্দরে সেসব উঁকি মারে, আবার মিলিয়ে যায়…

স্মৃতির অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানো ছাড়া আর কিছুতেই যেন স্বস্তি পায় না অলক। এই স্বস্তিতে আবার যেন একগুঁয়েমি এসে না পড়ে তার জন্য এই কয়দিনের মধ্যে সে একটা নতুন একটা অভ্যাস আয়ত্ত করেছে, সিগারেটের অভ্যাস। গভীর রাত পর্যন্ত নির্ঘুম জেগে জেগে সিগারেট টানে অলক। সিগারেট ফুরিয়ে এলে ঘুমোতে যায়। চোখ বুজে থাকে, প্রথমে শান্ত ভঙ্গিতে তারপর দাঁত মুখ খিঁচিয়ে একরকম জোর করে চোখ বুজে থাকে ! কিন্তু ঘুম যেন রূপকথার সেই আলাদিনের চেরাগের চেয়েও দুর্লভ, না বন্ধ চোখে, না অন্ধকার মস্তিষ্কে— কোথাও ঘুম ধরা দেয় না।
এমনই এক নির্ঘুম মধ্যরাতে অলকের সামনে সব খোলাসা হয়ে গেল !

চোখে ঘুম নামানোর পণ্ডশ্রম শেষে সিম কার্ডটা রুমমেট আতিকের মোবাইলে লাগিয়ে ওপেন করতেই ঈশিতার মেসেজগুলো অলকের চোখে পড়ে—
‘না অলক। আজ আর মিথ্যে বলছি না। সত্যি বলছি, ওসব আমার মধ্যে আর কাজ করছে না। হ্যাঁ, আমিই সে, সকাল-দুপুর-রাত যেকোনো সময়ে তোমার ফোনকল পেয়ে যে মেয়েটি অদ্ভুত রোমাঞ্চে নেচে উঠত; ক্লাসে টিচার আসার অপেক্ষায় যার ক্লান্তি ছিল, রাস্তায় বাসের অপেক্ষায় যার ক্লান্তি ছিল, পড়ার টেবিলে দুম করে চলে যাওয়া ইলেকট্রিসিটি ফিরে আসার অপেক্ষায় যার ক্লান্তি ছিল— অথচ তোমার ফোনকলের অপেক্ষায় যার কোনো ক্লান্তি ছিল না…

বরং উচ্ছ্বাস ছিল, এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ ছিল…
এখন তোমার প্রতিটা ফোনকল যেন এক একটা মর্মান্তিক বিভীষিকা ! হাতে তুলে নিই, কিন্তু রিসিভ বাটন ক্লিক করতে গেলে আঙুল অবশ হয়ে আসে, ভিতর থেকে কে যেন তীব্র স্বরে ধমক মারে, বাঁধা দেয়, ঝাপটে ধরে ! ভয় পেয়ো না। নতুন কোনো বয়ফ্রেন্ড-টয়ফ্রেন্ড না। মৃত্যু ! হ্যাঁ, মৃত্যু আমাকে আলিঙ্গনের প্রতিক্ষায় দুই হাত প্রসারিত করে আছে….
আর লুকোচুরিতে কাজ নেই। তোমাকে ব্যাপারটা খুলেই বলি।

দুই বছর আগে আমার কিডনিতে প্রথম পাথর ধরা পড়ে। মেডিসিনের মাধ্যমেই ব্যাপারটা সেরে যাবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন ডাক্তার। কিন্তু এক বছর গড়াতেই মেডিকেল রিপোর্ট হাতে পেয়ে জানতি পারি, আমার একটা কিডনি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে ! বাকিটার অবস্থাও খুব শোচনীয় ! ইমার্জেন্সি কিডনি প্রতিস্থাপনের অপারেশন করাতে না পারলে…
বাবার পক্ষে এই মুহূর্তে এই প্রেশার মোকাবেলা করাটা প্রায় অসম্ভব। জনে জনে হাত পাতলে হয়ত অপারেশনের খরচটা ওঠে যাবে। কিন্তু কেন জানি অন্যের করুণা নিয়ে বাঁচতে ইচ্ছে হয় না !
যাক। তোমাকে এইসব বলার অর্থ একটাই— আমাকে ঘিরে তোমার অনেক স্বপ্ন ছিল ! আমারও ছিল। কত কত স্বপ্ন আমাদের…
হল না, আর হল না। বরং স্বপ্নগুলো আমার কাছে এখন চিতার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া শবদেহের মতই মূল্যবান, অথবা মূল্যহীন। যাকে জলের স্রোতে ভাসিয়ে দিলেই স্বস্তি…
মনে পড়ে সেদিনের কথা ? ওই যে, সিনেমা হল থেকে একসঙ্গে ফিরছিলাম। আমাকে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তুমি জিজ্ঞেস করেছিল, আকাশ বলতে কি কিছু আছে ?
না, নেই। আকাশ অস্তিত্বহীন, শূন্য। হ্যাঁ, শূন্য বলেই তাকিয়েছিলাম। তাকিয়ে তাকিয়ে অনুভব করতে চেয়েছিলাম, শূন্যতায় ঘেরা আমার অনাগত মুহূর্তগুলি।

আজো দেখি, রোজ রোজ বেলা-অবেলায় শুধু আকাশ দেখি। ওই যে সেদিন যেমন দেখেছিলাম, তেমনিভাবে। আর ভাবি, আমার অনাগত নতুন ঠিকানার কথা ভাবি; অনন্ত শূন্যতা ছাড়া যেখানে আর কিছুই নেই, সেখানে সময়গুলো কেমনে কাটাবো তাও ভাবি বার বার…

ভাবছ— এতসব আগে জানাই নি কেন ? জানালে কীই-বা করতে পারতে তুমি ? কাঁদতে পারতে, করুণা দেখাতে পারতে, সান্ত্বনার সঙ্গীত শোনাতে পারতে ! শুনো, আজ আর ওসবে কাজ নেই….
না, অলক, তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আক্ষেপও নেই। শুধু একটা ছোট্ট অনুরোধ। যখনই আমাকে তোমার মনে পড়বে। তুমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকো।’


বিস্তৃত নীল আকাশ ! কোথাও কোথাও টুকরো টুকরো মেঘের আনাগোনা। যেন শৈশবের মাঠে মেঘগুলো সব জড়ো হয়ে আবার গোল্লাছুট খেলায় মেতে উঠেছে ! আচ্ছা, মানুষ মরে গেলে কোথায় যায় ? নিশ্চয়ই ওখানে, আকাশে। মাটির নীচে তার শরীর পোতা হয় ঠিকই কিন্তু তার আগেই প্রাণ পাখিটাকে আযরাইল এসে পিঞ্জর বন্দি করে কই উড়াল মারে ? ওই সুদূর আকাশেই তো।
ঈশিতা ইদানিং আকাশে দৃষ্টি মেলে এসব ভাবে, আর অপেক্ষার প্রহর গুনতে থেকে সেই চরম মুহূর্তেটির জন্য, যেই মুহূর্তে বিশাল ডানাওয়ালা আযরাইল এসে তার প্রাণপাখিটাকে পিঞ্জরবন্দি করে উড়াল মেরে চলে যাবে…
ভয়ানক বীভৎস রব তুলে গমগম শব্দে হাওয়াকে কাঁপাতে কাঁপাতে আযরাইল আসছে ! আগমনী বার্তা, মৃত্যুর আগমনী বার্তা আগেই পাঠিয়ে দিয়ে এবার সশরীরে নেমে আসছে সে !
বার্তাটা যেদিন তার কাছে প্রথম পৌঁছায়, সে একটুও দেরি করে নি, সোজাসুজি স্বপ্নটার গলা টিপে ধরেছে !
স্বপ্ন ! স্বপ্ন না ছাই !
শহরের কোনো এক অচেনা গলিতে ওদের একটা ছোট্ট সংসার হবে। সস্তায় দুই রুমের একটা বাসা হলেই চলবে। ছাদটা টিনের হলেও সমস্যা নেই। দুজনেই খেয়ে-পরে বাঁচার মত দুটো চাকরি করবে। ধীরে ধীরে ডালপালা মেলতে মেলতে ওদের সংসারটা একটু একটু করে বেড়ে উঠবে…

ছাই হয়ে গেছে, স্বপ্নটা তার জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেছে !


হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কি এত সহজে থামে ? কিন্তু থামে, কিছু সময়ের জন্য থামে, আবার শুরু হয়।
এক-দুবার করে এ পর্যন্ত বহুবার ঈশিতার পাঠানো মেসেজটা পড়ে ফেলেছে অলক।
প্রতিবারই ঈশিতার উপর জিদ চাপে অলকের ! সবাইকেই মরতে হবে, তাই বলে গোটা জীবনটাকে অস্বীকার করে এইভাবে নৈরাশ্যের অন্ধকারে নিজেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে ? যে ঈশিতা নিজের জীবনকেই ঠিকঠাক ভালোবাসতে পারে নি, সে কীসের জোরে বলে অলককে সে ভালোবেসেছিল?
সে যাই হোক। অলক কিন্তু ঈশিতার পাঠানো মেইলের সেই ছোট্ট অনুরোধটা কেন জানি ফেলতে পারে না।
শোবার খাটটা জানলার পাশে নিয়ে এসেছে। সারারাত সারাদিন রুমের জানালাটা খুলে রাখে। যখনই ঈশিতার কথা মনে পড়ে— আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর নিঃশব্দে ঠোঁট নেড়ে কত কী যেন বিড় বিড় করে বলতে থাকে।

হঠাৎ একরাতে অলকের আধো ঘুমন্ত কানে একটা আওয়াজ ভেসে আসে। না, আযরাইলের কণ্ঠনালি থেকে কোনো ভয়ানক রোমহর্ষক আওয়াজ নয়। এ আওয়াজ মানবী কণ্ঠের মোহনীয় আওয়াজ। এ আওয়াজ তার চেনা। কে ডাকছে তাকে ? কে আবার ! ঈশিতাই ! রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে অলক ! হ্যাঁ, আকাশ থেকেই ভেসে আসছে ডাকটা ! ঈশিতা ! ঈশিতা ডাকছে তাকে !
শোবার খাট থেকে উঠে পড়ে অলক। দুয়ারের সিটকানি খোলে, সিঁড়িতে পা ফেলে, এক’পা দু’পা করে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। একেকটা সিঁড়ি অতিক্রমের সাথে সাথে আওয়াজটা নিকটবর্তী হচ্ছে।
সব ফ্লোর শেষে ছাদে পা ফেলতেই— না, কোনো ক্লান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে থমকে দাঁড়ানো নয়— দুর্বার মোহে সামনে এগিয়ে যাওয়া। এগিয়ে যাচ্ছে অলক। মোহনীয় ডাকে সাড়া দিতে দিতে একটু একটু করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। ও ডাকছে তাকে ! বহুদিন পরে ! ঈশিতা ডাকছে ! এই ডাকে যতই সে সামনে এগুচ্ছে, ততই এক ছন্দময় নৃত্যের তালে তালে সমস্ত শরীরের রক্তকণা যেন এক নতুন উন্মাদনা নিয়ে নেচে উঠছে।
এই ডাকে সাড়া দেয়াই যায়।
উড়ে চলে যাবে সে। আকাশে ঈশিতার কাছে উড়ে উড়ে চলে যাবে সে।
ছাদের রেলিংয়ের উপর দাঁড়িয়ে হাত দুটি মেলে আকাশের দিকে দৃষ্টি তুলে হাওয়ার তরঙ্গে শরীরটাকে ভাসিয়ে দেয় অলক। কিন্তু একী ! সে উড়ছে ঠিকই, কিন্তু আকাশে ওঠার বদলে সে যে কেবল মাটির দিকে তলিয়ে যাচ্ছে !
অলকের মৃত্যুটাকে সবাই সুইসাইড বলেই সনাক্ত করে।


কিন্তু ? কিন্তু ঈশিতা ? ঈশিতার কী হল ?
ঈশিতার অপারেশনটা হয়ে গেছে !
ঈশিতার বাবা না পারলেও ঈশিতার হবু বরের বাবার করুণায় সে অল্প ক’দিনের মধ্যেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরার কথা।
অলকের মৃত্যু সংবাদটা এখনো ঈশিতার কানে আসে নি। হয়ত কিছুক্ষণের মধ্যে, কিংবা কিছু দিনের মধ্যে, কিংবা কিছু মাসের মধ্যে ঈশিতা সব জানতে পারবে। জানার পর ঈশিতার কী প্রতিক্রিয়া ঘটবে তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল ! কিন্তু যা আমরা কোনোরকম মুশকিল ছাড়াই নির্দ্বিধায় বলতে পারি, তা হচ্ছে— আকাশ বলতে কিছু নেই, বাস্তব ভূমিতে দাঁড়িয়ে ঊর্ধ্বে চোখ মেলে আমরা রোজ যা দেখি, যা কল্পনা করি, তা এক অনর্থক অন্তহীন মায়া !