বিভাগের আর্কাইভঃ গল্প

আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

চার
উঠোনে কঞ্চি দিয়ে মাটি খুঁড়ে তাতে গোড়ালি বসিয়ে এক ঘুর, দুই ঘুর, তিন ঘুর… ব্যাস ব্যাস, পিল তৈরি। হেল্লাস, সেকেন লাস, থাড় লাস। আঁটে না টোক্কায়, আগে বলবি তো!

তারক ডাক্তারের ছেলে ব্যাঁকার মতো যারা বড় গুলিশিল্পী, তাদের সহকারীর হাতে টিনের গ্ল্যাকসো কৌটোয় ঝম্পর-ঝম্পর টল, মাত্তিশ আর এমনি-গুলি। কলোনিতে ব্যাঁকার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বলরাম দাসের ছেলে সেই ফুটবলার পিকু; ব্যাঁকার টিপ বেশি আর পিকুর চোট্টামি বুদ্ধি। খেলার শেষে সবাই জানে মারামারি বাধবে, আজাদ হিন্দ ক্লাবে কাঠের প্যারালাল বারে বুক-ডন আর বেঞ্চে চিৎ হয়ে বারবেল ভাঁজা ব্যাঁকা পিকুকে এমন জাপটে ধরে যে নড়াই মুশকিল! তার মধ্যেও সে হাঁটু তুলে শত্রুর দুই থাইয়ের মাঝখানে মারে বা মাথা দিয়ে থুতনিতে ঢুঁসো লাগিয়ে জিভ কেটে দেয়।

কিন্তু কভি-কভি উদ্বাস্তু-সীমা ছাড়িয়ে গুলিখেলা আন্তর্জাতিক চেহারা নিতে পারে। আজ যেমন মান্নাপাড়া থেকে বর্মন, চালতাবেড়িয়ার ক্ষুদে, এমন অনেক বহিরাগত আর্টিস্ট কলোনির জনার্দন ভক্তের দোআঁশ মাটির টানটান বেডকাভারের মতো সেই প্রাঙ্গনে। কলাকারদের খ্যাতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে খেলতে খেলতে বিড়ি টানার অধিকার। আর ওই শিল্পীসমন্বয়ে হাঁটুঝুল স্কার্ট পরা স্কুলপাড়ার পলি মিত্র যোগ দেওয়ায় সাড়া পড়ে গেছে শরণার্থী তরুণদের হাড়পাঁজরে। আজাদ ক্লাবের বটের ঝুরি ধ’রে যারা দোল খাচ্ছিল, খোয়ারাস্তায় লাফিয়ে প’ড়ে; যারা পড়া মুখস্থ করছিল, জানলায় নিরক্ষীয় জলবায়ুকে হাট ক’রে খুলে, যারা ডোবায় ছিপ পেতেছিল, ছিপ ল্যাটামাছের জিম্মায় রেখে ছুটে এল। যেন মৈত্রী সংঘের পাশে নাগকেশর ফুলের গন্ধমাখা রেশন দোকানে আজ মাইলো দেবে!

তারপর দুই-দুই, চার-চার, আট-আট, ষোল-ষোল গুলির জিত্তাল খেলায় শ্বাসরোধ হয়ে আসে দর্শকের; প্রত্যেকবার টিপ শানানোর আগে জিভে টল ছুঁইয়ে নিচ্ছে ক্ষুদে, যেন সাপের মাথার মণি; স্কার্টের দুটো ফুলে থাকা পকেট নিয়ে পলি উঠোনে হাঁটলে “ঝুমুর-ঝুমুর নুপূর বাজে, নয়নে নয়ন মিলিয়া গেল…”! চকচকে রবিশস্যের মতো এই কাচের ফসল। বড় হয়ে বাসু হিন্দি সিনেমায় দেখেছে এমনই মূল্যবান ডায়মন্ড সাদা কোটপ্যান্টের অজিত অ্যাটাচিকেসে পুরে জোর বাতাসে টাই উড়িয়ে হেলিকপ্টারে উঠে যায়। তারপর সমুদ্রতীরে গিয়ে নামলে সেখানে সুধীর বিদেশি জাহাজে হিরে তুলে দেবে লালমুখো সাহেবের হাতে। পরের সিনে গ্রামের মেলায় নীল ঘাঘরা প’রে নাচছে হেমামালিনী। হেমামালিনীর নাভি দেখে বাসুর ভক্তবাড়ির মসৃণ পিল মনে পড়ে।

যত খেলা গড়াচ্ছিল, চটাং-চটাং আঘাতে গুলির চল্‌টি খ’সে মাটিতে অভ্রর ওয়াগন ওলটানো। এই পথিক-থামানো আনন্দের চারপাশে সদাচারী ব্রতচারী সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিয়ালদা থেকে ফেরা ফলের ব্যাপারি, মাথার পেছনে খালি ঝাঁকার ঘোমটা, লুঙির খুঁট উত্তেজনায় তার মুখে উঠে গিয়ে কোঁচকানো হাফপ্যান্ট প্রকাশিত। উলু হয়ে গিয়ে এক এক ক’রে সরে দাঁড়াচ্ছে খেলোয়াড়, গ্ল্যাকসোর কৌটো প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে উলটে দিয়ে দুঃখিত দর্শক হয়ে যাচ্ছে। যেন নায়ক ব্যাঁকার উড়ন্ত লাথি খেয়ে অজিতের হাত থেকে অ্যাটাচি ছিটকে পড়ল, আর মাটিতে গড়াচ্ছে অসংখ্য উজ্জ্বল গুলির সাঁজোয়া।

লাস্ট ডিলে শেষ শত্রু বর্মনের গুলির দিকে তেরো হাত দূর থেকে টিপ শানাবে ব্যাঁকা। মাথায় ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে বাঁহাতের মধ্যমা আকর্ণ ধনুরাসনে পেছনে বেঁকে, গোটা পৃথিবীর শ্বাস বন্ধ, গাছ থেকে ঝুঁকে দেখছে পেঁপেফুল, বাবুইবাসার দোল থেমে গেছে। আমরা জানি না বুলেট লাগবে কি লাগবে না, শ্রীকৃষ্ণের কী অভিপ্রায়, এবং বেদব্যাসও লেখা থামিয়ে দিচ্ছেন কাকে জেতাবেন ঠিক করতে না পেরে।

পাঁচ
দু’বছর আগে গুলিখেলার বিরল প্রতিভা ব্যাঁকা-চ্যাম্পিয়ানের জীবনের অন্তিম ম্যাচের কথা বললাম এত সময়। ব্যাঁকা আর নেই, অথবা আছে স্বপন হয়ে। ম্যাচের পরের দিন তেরটা কৌটো ভর্তি কম-বেশি দুহাজার গুলি সে বাচ্চাদের বিলিয়ে দেবে। এবার থেকে তাকে কেউ ব্যাঁকা ডাকলেই তেড়ে যাবে — স্বপন বলতে পারিস না! সকালের ব্যায়াম আরও বাড়িয়ে (ভালো কথা, পাজামা প’রে ক্লাবে যাচ্ছে, লুঙি ছেড়েই দিল) দুপুর-দুপুর বালিশা-র চেম্বারে বাবার পাশে একটা ছোট্ট টেবিল পেতে বসা চালু করবে। এই পরিবর্তনে কেউ খুশি হয়, কেউ হয় না, কিন্তু কলোনি আর একজন ডাক্তার পায়, বেশি রাতে ডাকলেও গলায় উত্তরীয়র মতো স্টেথো ঝুলিয়ে খুব গম্ভীর মুখে স্বপন পেশেন্টের ঘরে ঢুকে পড়ছে। শুধু সুধার ছুটোছুটি বেড়ে গেল। সে ময়নার মতো ময়নাতদন্তের খবর মুখে বাড়ি-বাড়ি উড়তে থাকে। “ও কাকি, শুনিছো”? তারপর ঘরের বাচ্চাদের “এই, তোগো এহেনে কী রে? যা, খেলতি যা!” ব’লে তাড়িয়ে চাঁদের মা’র কানের কাছে হাস্যমুখ নিয়ে যায়।

চড়কপাড়ার উকিলের মেয়ে শীলার প্রেমে পড়েছে স্বপন। এঁড়ে বাছুর থেকে বৃষ হয়ে উঠছে তাই। এভাবে দুবছর কেটে গেলে ব্যাঁকা যখন স্বপন থেকে স্বপনডাক্তার ডাক শোনার অপেক্ষায়, তখন আচমকা সবাই খেয়াল করে সে আবার ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জি পরে বাজারে চলে যাচ্ছে, বিকেলে ঘুমিয়ে উঠে বটতলায় বসে আগের মতো গুড়াকু ডলছে দাঁতে। তবে গুলিখেলায় ব্যাঁকা আর ফিরে আসেনি, তার আঙুল ওই আশ্চর্য টিপ করার ক্ষমতা ভুলে গিয়েছিল। যেভাবে শীলা ভুলে গিয়েছিল স্বপনকে।

অন্যদিকে ব্যাঁকার বন্ধুর আচম্বিতে বিয়ে হয়ে গেল অচেনা নাক-খ্যাঁদা মেয়েটার সঙ্গে, সঙ্গে অপবাদ জুটল গোপন প্রেমের। টিপু তবু ভোল পালটায়নি। সকালে ভক্তিভরে স্টেশানের গায়ে তার বইয়ের দোকানে গিয়ে বসে। সারাদিনে একটা দুনম্বর খাতা কিম্বা একজোড়া স্লেট পেনসিল বিক্রি হয়। বাড়িতে ছ’জনের কীভাবে দুটো ভাত জুটছে তাকে রহস্য রেখেই ছেলেটা পান খায়, চা খায়, গুলতানি মারে পাশের ওষুধ বা সাইকেল সারানোর দোকানের সঙ্গে। প্রায় দশ বছর হল নন্দ চলে গেছে আমতলাবাড়ি ছেড়ে, শিউলির ক্লাস সেভন, কিন্তু নন্দরাক্ষসকে নিয়ে মেয়েটার সঙ্গে তার গল্পও হয়ত সারা জীবন চলবে।

— টিপুদা, তুমি কী করে খোঁজ পাও নন্দুর? সুন্দরবনে তো যাতি দেখি না!
— নিবাধুইয়ের গোয়ালারা ভিজিট করে যে, জঙ্গলের মধু কিনতি যায় ঝড়খালি সুধন্যখালি। ওরা কালকে খবর দিল, একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটিছে মাতলা নদীতি।

ছয়
জলযান ছুটছে দক্ষিণের নদী দিয়ে। সকাল সাড়ে দশটা, তবু এখনও ধুঁধলা চারপাশ, মাথার ওপর উড়ে বেড়ানো সারসগুলোকে শামুকখোলের মতো লাগছে (সাহিত্যিকদের মতো পরিবেশ তৈরি করছে টিপু)। মাতলার ডানে-বাঁয়ে আস্তে আস্তে পার হয়ে যায় বেলাডোনা নদী, পিয়ালি-নবীপুকুর নদী। লঞ্চের ভেতর ফরেস্ট অফিসার আর গ্রামোন্নয়ন বোর্ডের সভাপতি বসে চা খাচ্ছেন। একজন নদী-বিশেষজ্ঞ, কুক, তার হেল্পার, দুই পাইলট বা সারেং — এই সাত জন নীচে আর লঞ্চের ডেকে বন দপ্তরের চার জন রক্ষী। ওপরে খুব হাওয়া, তারা কানে মাফলার জড়িয়ে রোদ্দুরে পিঠ ক’রে বসেছে, দুজনের রাইফেল ডেকের বাউন্ডারিতে হেলান দেওয়া। অফিস থেকে এভাবেই টহলে বেরনো হয়, কোথায় ম্যানগ্রোভ ভেঙে নদীর জলে মাটিসুদ্ধু তলিয়ে যাচ্ছে, কোথায় কাঠচোর বন উজাড় করে দিচ্ছে বা স্পটেড ডিয়ার মেরে নিয়ে যাচ্ছে কারা… দেখতে দেখতে বোইনচাপি খাল পার হয়ে ধূলিভাসানি গাঙের মুখে দাঁড়াল বন দপ্তরের জলযান। এখানে নদীর মুখ চেপে ছোট হয়ে এসেছে, জঙ্গলও গভীরতর সবুজ, পাখিদের হইচইতে গলা তুলে কথা বলতে হয়। রেঞ্জারবাবু কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ডেকে উঠে আসছিলেন, পেছনে সভাপতি, হঠাৎ কানে এল জলের খলবল আওয়াজ, পরক্ষণেই বাঁদিকে টলে কাত হয়ে গেল লঞ্চ। গার্ডদের স্নায়ু সজাগ, তারা ঝটপট ডেকের ডানদিকে লাফিয়ে এসে রাইফেল কাঁধে নিয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে রেলিংয়ের ফাঁকে বাঘ! প্রথমে শুধু মাথা; সেটা হাঁ হল, হলুদ দাঁত আর লালামাখা জিভের ভেতর দিয়ে মেঘডাকা গর্জন, তারপর এক লাফে রেলিং টপকে ডেকের মেঝেয় পড়ল আস্ত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। একজন গার্ড ফায়ার করেছে, লক্ষ্য পেরিয়ে সেটা গিঁথে গেল ধূলিভাসানির স্রোতে। বাঘ ফিরেও দেখল না, রেলিংয়ে থিয়ে ক’রে রাখা যে দুটো লোডেড রাইফেল, তার একটার হাতল কামড়ে ধরে বারো ফুট ওপর থেকে ঝাঁপাল জলে। গোটা অপারেশান সেরে সাঁতরে ওপারে উঠে জঙ্গলের ভেতর মিশে যেতে তার লাগল আড়াই মিনিট।

স্কুলে দিদিমনিরা যেমন বলে, তেমনি পিন-ড্রপ নীরবতায় শুনছিল চাঁদের বাড়ি। কিন্তু বাঘ তো মরল না, কাউকে মারলও না, সবচেয়ে বড় কথা কাহিনিতে নন্দরাক্ষস কোথায়?

— তোদের বলা হয়নি, নন্দকে ছেড়ে আসা হয়েছিল শুইয়া নদীর পাশে, ওই স্পটের কাছাকাছি।
— তো?
— আজ পর্যন্ত শুনেছিস বাঘ বন্দুক চুরি করে? এই বুদ্ধি তার মাথায় ঢোকাল কে! মনে রাখবি, নন্দবাবু তোদের কাছে, মানে মনুষ্যসমাজে এক বছর ছিল। আমাদের এক মানে বেড়ালের সাত বছর; এই সময়ের মধ্যে মানুষের ভাষা, তার বুদ্ধি সবই সে খুব কাছ থেকে খেয়াল করেছে। তাছাড়া, নন্দকে বন্দুক দেখিয়েই তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

সবাই স্তম্ভিত, চিন্তিত, শিহরিত। শিউলি কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, নন্দুকে আবার পুলিশে ধরবে না তো? বাসু বলল, নন্দর মতলব তাহলে কী? মা রান্নাঘরে উঠে যেতে যেতে বলল, আজুড়ে গল্প না দিয়ে টিপু বাড়ি যা। নতুন বউডা না খেয়ে বসে আছে।

টিপু সামান্য গলা চড়ায় — আগামি সপ্তাহের যুগান্তর কাগজে খবরটা পাবে, মিলিয়ে নিয়ো। তারপর বাসুর দিকে ঘুরে — ঘটনা এখনও পর্যন্ত এটুকুই। এর পরে কী হবে, বাঘেরাই ঠিক করবে।

(আরও আছে)

আমাদের বেড়াল আমাদের মতো হয়নি

এক
যদি একাকিত্বের দিকে তাকিয়ে থাকো, থুতনি ধ’রে মুখ এদিকে ফেরানোর জন্যে বেড়াল রয়েছে। সবচেয়ে ভয়ানকের সবচেয়ে মিষ্টি ভোলবদল সে। শীতের দুপুরে দ্যাখো বেড়াল ফাঁকা রাস্তার বাঁদিক ধ’রে… ও দাদা, কোথায় যাচ্ছেন? — নলেন গুড়ের সন্দেশ কিনতে। দোতলার আলসেয় গা এলিয়ে অবলোকন করছে পৃথিবী, আর চাইছে প্রজাপতি বা লাল পিঁপড়ের মতো নুড়িপাথর গাছের মরা পাতা টিপকলের হ্যান্ডেল অল্প নড়ে উঠুক। তার ঝাঁপাতে সুবিধে হতো। মানুষ পায়েস খেতে চায়, বেড়াল পাখি রোজগার করতে। ঝুপসি, বাঁজা, তাই কুঠার-শাসনের ভয়ে থাকা লিচুগাছটার নীচে একদিন একটা ফিঙে পাখি পাকড়েও ফ্যালে! দৌড়ে গিয়ে বাসুদেব দুহাতে বেড়ালের হাঁমুখ টেনে ধরেছিল ব’লে সেই মোস্ট ফরচুনেট ফিঙে গানের মিড়ের মতো উড়ে উঁচু সজনে গাছে বসে, তার দু’সেকেন্ড পরে নীলাকাশ হয়ে যায়।

বেড়ালদের বৈচিত্র এতদূর ছড়ানো যে ছোটবেলা থেকে কেউ মাথা নীচু শাঁ-শাঁ করে হাঁটে আর সামনে যা থাকবে গিয়ে ধাক্কা খায়; একজন সারাক্ষণ হিন্দিতে কিঁউ-কিঁউ; একজন মাইমশিল্পী; কেউ রূপে তোমায় ভোলাবে বলে নিজের গা চেটেই যাচ্ছে; কেউ কোলে উঠলে আর নামবে না, পা ঝিঁ-ঝিঁ লেগে হস্তীপদ হয়ে গেলেও কী যায় আসে?

এ-বাড়িতে স্বর্গীয় বাহার, পুঁচকু, মহীয়সী, ইমরান, সুন্দরী, নন্দবাবু, সিঙাড়া, ট্যাঙোশ, বোকা-বোকা-লম্বা বা আজকের পাখিধরা কিশমিশ — এমন সব বেড়ালের গুচ্ছে যারা নিশ্বাস নিয়েছে, তাদের ফুসফুসে কি অ্যাজমা আর রক্তে মাইক্রোবসের ঘাঁটি? নাহলে ডাক্তার কেন বলে কুকুর থাকুক, বেড়ালটা কাউকে গিফট করে দিন?

উপহার দিতে লাগবে না, একটু ধৈর্য ধরলে সে মরেই যাবে। এক ড্রপার ঘুম, এক চামচ পাড়াবেড়ানো আর এক খুঁচি মৃত্যু দিয়ে বিল্লিজাতি গড়া। ন’টা নহে, সিকিখানা জীবনবিশিষ্ট মার্জার মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত ডিগবাজি খেয়ে যাবে। বেঁচে থাকা নিয়ে তার কোনও সত্তর এমএম অভিমান আছে নিশ্চয়ই। বেড়ালের মা ভালো হয় না, বাবা তো হয়ই না, শীতে জামা হয় না, বৃষ্টিতে ছাতা হয় না, উলটে পুজোয় বাজি মানে বাজে হয়, বাড়িতে অতিথি এলে লুকিয়ে বেড়ানোর জায়গা খোঁজো (অতিথ এসে গিরোস্তো খেদায় — চাঁদের মায়ের সংলাপ)। তবু বিভিন্ন বোঁটায় বিভিন্ন বেড়াল সাজিয়ে একটা টবে বসালেই স্পাইডার ক্রিসানথেমাম।

দুই
মায়া প্রায়ই বলে, ব্রাম্মোনবাড়ির বিড়েলটাও দুপাতা সঙোস্‌কিতো পড়তি পারে। এটা বেড়ালের প্রশংসা নয়, ব্রাহ্মণের আত্মশ্লাঘা। সে কলোনিতে বাস ক’রে মোটেই খুশি নয়; দারিদ্রের চেয়ে অনেক বড় সমস্যা হল, চারিদিকে নীচু জাতের ভিড়। পাকিস্তানে তাদের সিদ্ধান্তপাড়ায় বারো ঘর বাসিন্দার মধ্যে আট ঘরই বামুন ছিল, তিন ঘর কায়েত আর মোটে এক বাড়ি মণ্ডল — নোমোশুদ্দুর। সেই তুলনায় কলোনিতে উঠতে বসতে মালাকার, বিশ্বাস, ভক্ত, হালদারের সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেষি।

ঘটিবাটি হারিয়ে একবার মাথা একবার বুক চাপড়াতে চাপড়াতে যারা একসঙ্গে চালডালশাকমাছমাখা একদলা বমির মতো ভিনদেশে এসে সরকারের দয়ায় দরমার বেড়া দেওয়া ঘরে উঠল, যাদের দুপুরে উনুন জ্বলে তো রাত্তিরে জ্বলে না, তাদের আবার জাত-অজাত কী রে! পণ্ডিতমশাইয়ের বউ এমনিতে জ্যান্ত পঞ্জিকা; মুখে মুখে অমাবস্যা-পূর্ণিমা ব্রত-ষষ্ঠী বিয়ে-শ্রাদ্ধের হিসেব রাখে, কিন্তু বামুন ব’লে বড্ড বাড়াবাড়ি! মাঝমাঝে সরকারবাড়ির বাসন্তীমণ্ডপে ব’সে আর এক সরকার সাধু-র মা এসব ক্ষোভের কথা বলে। “পাকিস্তান থে’ পাছার কাপোড়ডাও আনতি পারেনি, কিন্তু গুমোরডা ঠিক নিয়ে আইছে। কালো কুষ্টি গা’র রঙ নিজির, আবার জাত তুলে কথা কয়। আমার বাবায় ক’তো, কালো বামোন আর ধলা চাঁড়াল, এদের কোনও কালে বিশ্বেস কোত্তি নেই”। কথার ঝোঁকে বুড়ি খেয়াল রাখতে পারে না, মণ্ডপে ফকির বিশ্বাসের ছেলেও বসে আছে, তার গায়ের রঙ শুধু কংসাবতী নদীর বালির মতো চিকচিকে নয়, চোখদুটোও বেড়ালাক্ষি।

এভাবে কাহিনিতে আবার বেড়াল ফিরে আসে, থেকে যায়। মানুষের ছেলেমেয়ে বেড়ে ওঠে সুপুরিবৃক্ষ, আর বেড়াল বড় হয় পেয়ারাগাছ — গোড়া থেকেই চারদিকে সন্তানসন্ততির ডাল ছড়াতে ছড়াতে। এই রকম অমিলের মধ্যে প’ড়ে মায়ার অহংকারও মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে। শিউলি ব্যাজার মুখ ক’রে বলে, জানো মা, আমাদের বিড়েল কিন্তু আমাদের মতো হয়নি।
— কেন রে!
— ধুর, পড়াশুনো ভালোই বাসে না, এখনি জীববিজ্ঞানের বইয়ের উপোরে বমি ক’রে দিচ্ছিল।
— তোগোও যেমন! আপনি মা খাতি পায় না, শঙ্করারে ডাকে। কালই বাসুরে কয়ে পার ক’রে দেবানে ওটারে। এহ, আবার সোয়াগ ক’রে নাম রাখা হইছে কিস্মিস!

একটা কান কালো, সারা গা চকলেট, শুধু ধবধবে সাদা পেছনের ডান পা, দেখলে মনে হবে ভেঙে গেছে তাই প্লাস্টার করা। কলোনির বাড়িতে তো কোনও পাঁচিল, গেট বা মে আই কামিন স্যার থাকে না, একদিন বাজার করে ফেরা নির্মলের পেছন পেছন এসে কিশমিশ ঢুকে পড়ল। তাকে শিউলি অনেক ট্রেনিং দিয়েছে, কিন্তু লক্ষ্মীর আসনে জল আর বাতাসা দেওয়া থাকলেই সে ফাঁকমতো গ্লাসে মুখ ডুবিয়ে জল খেয়ে নেবে।
শিউলি আবার তেঁতুল দিয়ে গেলাস মাজে।
— ও ভাই, গেলাস তো সকালেই পরিষ্কার কল্লাম।
গলা নামিয়ে তাতে এক ছটাক বিষণ্ণতা মেশায় শিউলি।
— জানো তো দিদ্‌মা, কাল সারা রাত্তির কিস্মিস বাড়ির বাইরি ছিল। এদিকে মা হারমোনিয়াম নিয়ে বসলিই চিৎকার পাড়া শুরু করে। আমাদের বিড়েল এট্টুও আমাদের মতো হয়নি!

তিন
শিউলি তখন খুব ছোট, একটা হুলোর বাচ্চা নিয়ে এসেছিল সেজদা গৌরকিশোর। নাক নেই চোখ নেই বড় তুম্বোপানা মুখ, লেজটা গুলে মাছের মতো ছটফট করে, কিছুটা মুদিখানার দোকানদারের ভাবসাব দেখে মা তার নাম দিয়েছিল নন্দবাবু। কিছুদিনের মধ্যে বাবু পালটে রাক্ষস হয়ে গেল। রান্না মাছে মুখ ঘুরিয়ে নিত, কাঁচা দিলে ঠিক আছে। এদিকে আপনমনে তোমার আঙুল চাটতে চাটতে কচ ক’রে দাঁত বসিয়ে দেবে। এভাবে যখন বাড়ির অর্ধেক লোকের হাতে-পায়ে ন্যাকড়ার ব্যান্ডেজ, অদৃশ্য হয়ে গেল নন্দরাক্ষস। বাড়ির লোকই তাকে বিদেয় ক’রে দিয়েছে সন্দেহে শিউলি সবাইকে ঘুষি পাকিয়ে মারতে লাগল; তার পরও যখন তার কান্না আর হিক্কা ওঠা থামছে না, তখন সত্যি খবরটা দিল টিপুদা :

সেদিন শেষ রাত্তিরে আমি পেচ্ছাপ করতে উঠে দেখি তোদের আমতলা-বাড়ির সামনে একটা বড় গাড়ি এসে থেমেছে। তারপর চারজন পুলিশ, চারজন মিলিটারি আর একজন বেড়ালের ডাক্তার নেমে এল।
— বিড়েলের আবার ডাক্তার হয় নাকি!
— বিড়েল, কুকুর, ছারপোকা, আরশোলা, নিমগাছ, মৌরলা মাছ সবার ডাক্তার হয়।

নন্দরাক্ষস তোদের দিদিমার বিছানায় ঘুমত না? একটা পুলিশ জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ফ্যাঁস করে গ্যাস ছেড়ে দিল ঘরের মধ্যে, নাহলে বুড়ির যা পাতলা ঘুম, আমের সময় কলোনির কেউ একটা আমও চুরি করতে পারে? এদিকে চার পুলিশ নন্দর দুই হাত ধ’রে বাইরে আনল চুপিসাড়ে। ডাক্তারের নির্দেশমতো চারজন মিলিটারি ধরল বেড়ালের দুই পা। ডাক্তার ইঞ্জেকশানের সিরিঞ্জটা একজন মিলিটারির দিকে বাড়িয়ে দিল। সে থতমত খেয়ে বলল, আমি তো দিতে জানি না, স্যার। ওহ, ইয়ে… গলা খাঁখারি দিয়ে ডাক্তার কাঁপা হাতে পুশ ক’রে মন্তব্য করল, নন্দ আসলে বেড়ালও নয়, বাঘও নয়, দুইয়ের মাঝামাঝি।
— মাঝামাঝি কেমন ক’রে হয়?

হয়। শিউলিকে বোঝানো যাবে না, কাওরাপাড়ার একটা ছেলে রাস্তা দিয়ে যায় ছাপা লুঙি প’রে, চুলগুলো বড় বড়, মাথা নামিয়ে ঢং ক’রে হাঁটে। ও ছেলে-মেয়ের মদ্দিখানে আছে। তবে নন্দ যত বড় হবে, বাঘের দিকে যাবে — ডাক্তার অভিমত দিল। এরপর ন’জনে মিলে নন্দকে সাবধানে ধরে গাড়িতে তুলে শোঁ করে চলে গেল।
— কুথায় গেল? আমি নন্দুরে ফেরত নিয়ে আসব।

আনবি কী ক’রে? ওকে সুন্দরবনে বাঘদের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে এসেছে তো!

(আরও আছে)

অণুগল্পঃ মায়াবী কোমল আদর

নিজের টাইমলাইন একান্ত নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করার একটা শক্তিশালী প্ল্যাটফরম। কিন্তু গল্প লিখতে লিখতে নিজের কথাই বলা হয়ে ওঠে না।

আমি মিস করি আমার ছোট ভাইকে। ‘ইমিডিয়েট’ ছোট ভাই। আমার জীবনের অধিকাংশ সময় ওর সাথে কেটেছে। সেই ছেলেবেলা থেকে একসাথে স্কুলে যাওয়া, এক সাথে বেড়ে উঠা, কলেজ-ভার্সিটির সময়গুলোতেও কাছাকাছি ছিলাম। মুসা ভাই চবিতে যখন গুলিবিদ্ধ হলেন, আমি তখন সেই দোকানটির সামনে বসে চা পান করছিলাম। হঠাৎ সিনেমা স্টাইলে ক্রলিং করে ফায়ারিং শুরু হলো। দেখছিলাম সব চুপচাপ। দৌঁড়াতে বা পালাতে তখন লজ্জা লাগতো। আমার সাথের সবাই হাওয়া। ভাই ছিল পাশে তখনো। পাশে ফিরে ছোট ভাইকে দেখে এবং আমাকে ছেড়ে তার না যাওয়াটা দেখে বড্ড ভালো লেগেছিল সেদিন।

এরকম অনেক ভালোলাগা রয়েছে আমার চিন্তার গোপন আলমিরায় এই ভাইটিকে ঘিরে।

সে আমার দেখা দুর্দান্ত মটরবাইক চালক। আমাদের আব্বাও ছিলেন তাই। আমার ভাই আর আমি চট্টগ্রাম থেকে মটরবাইকে করে খুলনায় নিজেদের বাড়িতে এসেছিলাম একবার। ওর সাথে এবং আরো কয়েকজন ভাই-বন্ধুদের সাথে বাইক বহর নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি যশোহর, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, কালিগঞ্জ, বাগেরহাট, পিরোজপুর, গোপালগঞ্জ, মঠবাড়িয়া, পাথরঘাটা, বরগুনা, পটুয়াখালী।

নিজেকে একজন রাজপুত্র মনে হতো তখন। আব্বার সাথে ছিলাম যে তখন!

এখন কি মনে হয় নিজেকে?
কিছুই না।
‘নাথিং এট অল।’

জীবনের খারাপ এবং ভালো সময়গুলো আমরা দুই ভাই আরো ভাইদেরকে নিয়ে একত্রে কাটিয়েছি। যদিও তৃপ্ত সময়গুলো কিছু অতৃপ্তিও বুকে নিয়ে চলেছিল তখন।

সারা রাত জার্ণি করে ঢাকা থেকে ফজরের আজানের একটু আগে বাড়ি পৌঁছে মেইন গেটের সামনে একটুও অপেক্ষা করতে হয়নি আমাকে। চাবি হাতে ভাইকে দাঁড়ানো পেয়েছি! যতবার গেছি ঠিক ততোবারই এভাবেই পেয়েছি। বউয়েরা সবাই তখন ঘুমে বিভোর।

আর ঘুরে ঢুকে পেয়েছি আম্মাকে। সোজা তাঁর বিছানায় আমার জন্য রাখা খালি জায়গাটায় গিয়ে শুয়ে পড়েছি। মা আরো অনেকক্ষণ জেগে থাকতেন। আমি তখন ঘুমে বিভোর।

সেই শুণ্য জায়গাটি আজো শুণ্য আছে। কেবল আমি নেই। মায়ের আঁচলের আদর এখনো শীতের নরম রোদের মত বড্ড মায়াবী কোমল! কিন্তু অনুভব করার জন্য সেখানে আমি নেই। আমি আছি এই কংক্রিট নগরে। ইউনিটে আবদ্ধ বাসা পরিবারে।

আমার মাটি নেই। মাটি মায়ের কাছে। মা নেই এই কংক্রিট নগরে।

ভাই মায়ের কাছে। আমার আদরের অংশটুকু বড্ড যত্ন করে পাহারা দিচ্ছে।

সব পাখি একসময় নীড়ে ফিরে। মানুষ ও বাড়ি ফেরে। কিন্তু আমি বাড়ি ফিরবো কখন?

ফুলকপি (বড়দের গল্প) /পর্ব-২

প্রায় তিন যুগ আগের কথা, “নতুন বাংলাদেশ গড়বো মোরা/নতুন করে আজ শপথ নিলাম” গান আর “আটষট্টি হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে” শ্লোগানে ক্ষমতাসীন এরশাদ ও তার অনুসারীরা দশদিক মুখরিত করে রেখেছে। এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এশীয় কবিতা উৎসব আয়োজিত হচ্ছে। একদল শক্তিমান কবি এরশাদকে ঘিরে রয়েছে। এরশাদও কবি, পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় তার কবিতা ছাপা হয়। আওয়ামী লীগের সাথে জাতীয় পার্টির সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় তৃতীয় জাতীয় সংসদের আয়ু অকালে ফুরিয়ে এসেছে। তবে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের প্রধান হিসেবে এরশাদ বহাল তবিয়তে ক্ষমতায় রয়েছে। তার পকেটে ঢুকে পড়া জাসদ (সিরাজ), ফ্রিডম পার্টি আর গুরুত্বহীন বামপন্থীদলসহ কিছু নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলের জোট সম্মিলিত বিরোধীদলকে সাথে নিয়ে সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। যদিও সবাই জানে ভোট হোক বা না হোক ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টিই জিতবে।

অপরদিকে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েও এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার স্মৃতি টাটকা থাকায় শেখ হাসিনা কিছুটা ব্যাকফুটে রয়েছেন। বিধবা গৃহবধূ থেকে খালেদা জিয়া জাতীয় নেত্রী হয়ে উঠেছেন। দুই নেত্রীর নেতৃত্বে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। ছাত্র আন্দোলন চলছে। যে সব্যসাচী লেখক এরশাদকে পল্লীবন্ধু উপাধি দিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়, তিনিও পক্ষ বদল করেছেন। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান আর একুশে বইমেলার স্টল থেকে ভেসে আসে আলী যাকেরের উদাত্ত আবৃত্তি “জাগো বাহে, কোনঠে সবাই।” এসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহের কিছুই কৃষি কামলা বজলুকে স্পর্শ করে নাই। কার্তিকের মঙ্গায় একটানা সাত দিন কলাগাছের কান্ড সেদ্ধ খেয়ে আর সহ্য করতে পারে নাই। এক মুঠো ভাতের আশায় রংপুরের এক গ্রাম থেকে বজলু রাজধানীর পথে পা বাড়িয়েছিল। সাথে ছিলো বউ আর ওবায়দুলসহ চার সন্তান।

চিরদিনের জন্য গ্রাম ছাড়তে বজলুর বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় নাই। পিছুটানের মায়া তাড়া করে নাই। তার কোনো কৃষি জমি ছিল না। নিজ হাতে বানানো একচালা খড়ের ঘরে বউ আর চার সন্তান নিয়ে থাকতো। ওই জমিও নিজের নয়। নিজের বলতে ছিল সীমাহীন অভাব, তীব্র ক্ষুধা আর একপাল গরীব আত্মীয় ও স্বজন। এসবের প্রতি কে’ই বা পিছুটান অনুভব করে! তীব্র ক্ষুধা আর যাত্রাপথে রংপুর শহরে লাগানো সোডিয়াম বাতির অদ্ভূত আলো দেখার বিস্ময় নিয়ে পরিবারসহ আরও অনেকের সাথে বজলুরা ঢাকা শহরে এসেছিল। শহরের রূপ দেখে বিস্মিত হয়েছিল। সবচে বিস্মিত হয়েছিল তেল ছাড়া বাত্তি জ্বলা এই শহরে সারাদেশ থেকেই বহু গরীব এসেছে এবং আসছে দেখে।

রাজধানী ঢাকার চরিত্রে একটা নির্লিপ্ত আভিজাত্য বা অহঙ্কার রয়েছে। এ শহর গরীবদের সাড়ম্বরে স্বাগত জানায় না। দূর দূর করে তাড়িয়েও দেয় না। অনারোগ্য অসুখের মত মেনে নেয়। তিলে তিলে বুঝিয়ে দেয় তাদের দায়িত্ব শহরের করুণা ও দয়ায় নির্ভর করে বাঁচার চেষ্টা করা। চতুর্থ শ্রেণির নাগরিক হিসেবে সন্তুষ্ট থাকা। স্বাধীন রাষ্ট্রে সম্পদের সুষম বন্টনের দাবী তোলা নয়। কাজের খোঁজে চার পাঁচ দিন এলোমেলো ঘুরার সময়ে বজলু নিজের মত করে বিষয়টা বুঝে নিয়েছিল।

স্ব-পরিবার নিয়ে দশ/বারো দিন কমলাপুর রেলস্টেশনের মালগাড়ির প্ল্যাটফর্মে কাটানোর পর এক দেশী ভায়ের হাত ধরে বজলু পরিবারসহ কাওরান বাজার রেল বস্তিতে আশ্রয় পায়। পাঁচ হাত বাই ছয় হাত সাইজের একটামাত্র ঝুপড়ি ঘরে ছয়জন মানুষের মাথা গোঁজার ব্যবস্থা হয়। আরেক ভায়ের কল্যাণে বজলু একটা মজবুত বড় টুকরি কিনে কাওরান বাজারে কুলির দলে নাম লেখায়।

বড় ছেলে হাফিজুলের বয়স পনেরো বছর। মেজো ছেলে মফিজুল এক বছরের ছোট। তাদের ভাগ্য ভাল। কাওরান বাজারের এক হোটেলে চাকরী জুটিয়ে নিতে পারে। দায়িত্ব অতি সহজ – সারাদিন কল থেকে পানি টানা। প্লেট, বাটি, জগ ও হাড়িপাতিল ধোয়া। টেবিল পরিস্কার করা। হোটেল ঝাড়ু দেওয়া। সামান্য ভুলে মালিক, ম্যানেজার বা কাস্টমারের হাতে চড়-থাপ্পড় খাওয়া এবং বিনা প্রতিবাদে হজম করা। কার্লমার্ক্স পড়া নাই বলে ‘পেটে ভাতে’ বেতনপ্রথাও তাদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়। একটানা ষোল সতেরো ঘণ্টা কাজের বিনিময়ে তারা দৈনিক দুই বেলা ভাত খেতে পাবে। কখনো লবণ, পেঁয়াজ আর ডাল দিয়ে ডলে খাবে। কখনো তরকারির ঝোলের সাথে এক আধ টুকরা আলু আর ভেঙে যাওয়া মাছের কাঁটা। কোনো কোনো দিন মিলে যাবে অমৃতের মত কাস্টমারের এঁটো ভাত। পরিমাণে বেশী হলে বাসায়ও নিয়ে যেতে পারবে। ভাতের জন্য যারা রাজধানীতে আসে, রাজধানী তাদের বিমুখ করে না।

ভোরের আলো ফোটার আগে বজলু ও দুই ছেলে কাজে চলে যায়। ময়মুনা আর ওবায়দুল ঘুমায়। বজলুর বউ সবিরা বসে থাকে। অস্ফুট স্বরে বিলাপ করে কাঁদে। তার মোটা ঠোঁট আর ভাঙা গ্রীবা তিরতির করে কাঁপে। বোঁচা নাকের পাটি ফুলে উঠে। সবিরার একটা মাত্র শাড়ি। আমপাতা রঙ জমিনে খয়েরি পাড়। টেনেটুনে আট হাত হবে। রং জ্বলে তার ত্বকের মত খসখসে কালচে হয়ে গেছে। সে ছেড়া আঁচলে চোখ মুছে, নাক মুছে। সবিরা নতুন শাড়ির জন্য কাঁদে না। আধা উদোম অবস্থায় শরীরের শাড়ি শরীরে শুকানোর দুর্ভাগ্যের প্রতি অভিসম্পাত করেও অশ্রু বিসর্জন করে না। তাকে কাঁদায় ছেড়ে আসা মহিষমুড়ি গ্রাম- নিজের গ্রামে ফেরার আকুতি এবং ‘আর কোনোদিনও ফেরা হবে না’র মত নির্মম সত্য মিলেমিশে তাকে কাঁদায়। কান্নার বেগ থিতিয়ে এলে প্রত্যেকদিন ঝুপড়ি ঘর কাঁপিয়ে হুইসেল দিতে দিতে একটা যাত্রীবোঝাই ট্রেন খুব ধীর গতিতে কমলাপুর স্টেশনের দিকে যায়।

বেলা বাড়ে। রোদ উঠে। সবিরা পানি আনতে যায়। বস্তির কলপাড়ায় ঝগড়া করে পানির অধিকার আদায়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠে নাই। প্রতিদিন কেউ না কেউ দয়া করে কলসিতে পানি ভড়ার জন্য তাকে কল ছেড়ে দেয়। সে পানি নিয়ে ঘরে ফিরে। ফিরার পথে দীর্ঘশ্বাস গোপন করে না। মহিষমুড়ি নয়, দীর্ঘশ্বাসের কারণ আসন্ন বাস্তবতা। অভাবী সংসারে ভাঙনের শুরুটা এত মোলায়েমভাবে হয় যে সবার পক্ষে আঁচ করা সম্ভব হয় না। তবে মেয়েরা বুঝতে পারে। সংসারে ভাঙনের বীজ বুনা হয়ে গেছে। বুঝতে পারলেও দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া সবিরার করার কিছু নাই। সে দীর্ঘশ্বাসই ফেলে যায়। সে বুঝতে পারছে সংসারের সবাই একে একে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। একই শহরে থাকলেও তারা পরস্পরের কাছ থেকে হারিয়ে যাবে। কে কোথায় থাকবে কে জানে! ফিরে ঘরে ময়মুনা আর ওবায়দুলকে দেখতে পায় না। খুঁজেও না। স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে। সে বাজার নিয়ে ফিরলে পেটের আগুন নিভাতে চুলার আগুন জ্বালাবে।

বজলুর একমাত্র মেয়ে ময়মুনার বয়স বারো হলেও অপুষ্টির কারণে তাকে দশ বছর বয়সী ওবায়দুলের থেকেও ছোট মনে হয়। ময়মুনাও সম্ভবত ওবায়দুলের ছোট হয়েই থাকতে চায়। ওবায়দুলের পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়ায় যেনো ওবায়দুল ওর মুরুব্বী। বস্তির অন্য কিশোর-কিশোরীদের মত তাদের জীবনেও সকালের নাস্তা নামক কোনো বস্তুর উপস্থিতি নাই। মা পানি আনতে গেলে ভাইবোন মিলে বেরিয়ে পড়ে। নাস্তার আবশ্যিকতা তাদের আটকে রাখতে পারে না। পেট ভরা ক্ষুধা এবং মন ভরা আনন্দ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। খুব বেশী দূরে তারা যায় না। পেটে ক্ষুধা নিয়ে তারা রেলবস্তি হতে সামান্য দূরের অদ্ভুত জগত দেখে। তারা ওই জগত দেখে হাসে। ওই জগতের মানুষের মুখের ভাষা শুনে হাসে। তাদের কাজ কারবার দেখে হাসে। পোশাক দেখে হাসে। স্কুলে যাওয়া হাফপ্যান্ট আর স্কার্ট পড়া সমবয়সী শিশুদের দেখে বিস্মিত হয় এবং হাসে। ক্ষুধার জ্বালায় যে তারা ত্যাক্ত হয় না এমন নয়। ত্যাক্ত হলেও খাওয়া মিলবে না এই চরম সত্য জেনে যাওয়ায় ত্যাক্ত হয়েও হাসে।

কিছুদিন পর বস্তিতে নির্বাচনের ক্যাম্প বসে। ক্যাম্পে সারাদিন গান বাজে “নতুন বাংলাদেশ গড়বো মোরা/নতুন করে আজ শপথ নিলাম।” গানের অর্থ না বুঝলেও বস্তিবাসীর এই গান মুখস্থ হয়ে যায়। এই গানের প্রতি বজলু বিশেষ ধরণের মায়া অনুভব করে। সে শুনেছে এই গানটা প্রেসিডেন্ট এরশাদ লিখেছে। প্রেসিডেন্ট মানে দেশের রাজা। বজলু গুনগুনিয়ে গানটা গায়, বেশ গর্বের সাথে বলে, “আজা হামার অমপুরের ছাওয়াল, বাহে। আজায় গান ন্যাকছে..।” তার এই গর্ব অন্যরা উপভোগ করলেও নিজের ঘরে বলে শান্তি পায় না। সবিরা মুখ ঝামটা দিয়ে গজগজ করে, “হাগার থাকি ঢ্যাড়ঢ্যাড়ি বেশী। পাচাত নাই ত্যানা, ভাসুরে বাজায়ই ব্যানা। পুঁটকিত নাই চাম, আদা কৃষ্ণ নাম।”

নির্বাচনী ক্যাম্পের আশপাশে ওবায়দুল আর মায়মুনা ঘুরঘুর করে। রোজ মিছিল হয়। মিছিলের সাথে গেলে ওবায়দুল এক টাকা পায়। মায়মুনা কোনো টাকা পায় না। উপার্জিত টাকায় কখনো মোয়া কখনো আচার কিনে সমান ভাগ করে খায়। এক একদিন মায়ের জন্যও নিয়ে যায়। নির্বাচন শেষ হয়ে যায়। আবার সব আগের মত। পাঁচ মাস পরে শুরু হয় ভয়াবহ বন্যা। বন্যার প্রথম দিকে কাওরান বাজারের রেল বস্তিতে পানি না উঠলেও বজলুর পরিবারে শোক নেমে আসে। ডায়রিয়া আক্রান্ত ময়মুনা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় সকাল থেকে পড়েছিল। নিস্তেজ হতে হতে সন্ধ্যায় মারা যায়। ময়মুনা সারাদিনে কোনো চিকিৎসা না পেলেও তড়িত গতিতে ডেথ সার্টিফিকেট পেয়েছিল। মায়মুনা কখনো ওবায়দুলের থেকে বড় হতে চায়নি, এখন সে সকল চাওয়া ও না চাওয়ার বৃত্তের বাইরে চলে গেছে।

ময়মুনার মৃত্যু ওবায়দুলকে একা করে দেয়। বাবা আর বড় দুই ভাই প্রতিদিন আগের মত কাজে চলে যায়। ফার্মগেটের দুই মেসে মা রান্নার কাজ করে। পরিবারে একমাত্র বেকার ওবায়দুল। মন চাইলে ঘরে শুয়ে থাকে। মন চাইলে এলোমেলো ঘুরে বেড়ায়। তাকে কেউ কাজের কথা বলে না। শহরে মিছিল হয়। মাঝে মাঝে হরতাল হয়। হরতালের দিন ওবায়দুল হাঁটতে হাঁটতে কাওরান বাজার বা তেজগাঁও মোড়ে যায়। পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়তে ভালো লাগে। আরও পরে, নব্বই সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময়ে দু’বার ককটেল ফুটিয়েছিল। নেতা নগদ দশ টাকা করে মজুরী দিয়েছিল। বয়স কম বলেই হয় তো দশ টাকা উপার্জনের আনন্দ ওবায়দুলের কাছে বোন হারানোর শোক ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠে নাই। দু’টা পাঁচ টাকার নোট মুঠোয় পুড়ে ময়মুনার অভাব বোধ করছিল। খুব কান্না পাচ্ছিলো, বুক চুরমার করা অবর্ননীয় কষ্টের কান্না।

ফার্মগেটের মেসে মা’র বেশী দিন কাজ করা হয় নাই। একদিন কাজ থেকে ফিরে খুব গোমড়া হয়ে রইলেন। তিন চারবার গোছল করলেন। পরদিন ভোর হবার আগে বাবা আর বড় দুই ভাই কাজে চলে গেলে ওবায়দুলকে ধরে অনেকক্ষণ শুয়ে রইলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ওবায়দুলের ঘুম গাঢ় হয়ে এলো। প্রতিদিনের মত পানি আনতে গেলেন। কিন্তু ফিরলেন না। তুমুল চেঁচামেচিতে ওবায়দুলের ঘুম ভাঙলো। জেগে কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। একজন তাকে জোড় করে টানতে টানতে এনে ঠেলে রেল লাইন ঘিরে থাকা জটলার ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো। সে দেখলো ট্রেনের চাকায় পিষ্ট একটা নারী শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে। কেউ তাকে বলে নাই, তবু সে বুঝতে পারলো এটা মায়ের শরীর। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রক্ত, মাংস, চর্বি, হাড় আর ঘিলু দেখে মায়ের জন্য কান্নার পরিবর্তে তার বমি পেলো। মায়ের আত্মহত্যার পর কিছু ঘটনা খুব দ্রুত ঘটলো – বাবা আবার বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেল। দুই ভাই কাওরান বাজারের রেল বস্তির ঘর ছেড়ে আগাওগাঁও বিএনপি বস্তিতে চলে গেল। বিশাল এই দুনিয়ায় ওবায়দুলের আর কেউ রইলো না, সে একা হয়ে গেলো।

কাওরান বাজারে ওবায়দুল বহুবার ঢুকেছে। বারো বছর বয়সে প্রথমবারের মত ঢুকলো কাজের সন্ধানে। মুরগি পট্টির গন্ধ সহ্য করতে না পারলেও কিছু দিন মুরগি জবাই ও নাড়িভুড়ি পরিস্কারের কাজ করলো। এরপর সবজীর ব্যবসা বেছে নিলো। পোকায় ধরা ও পঁচা সবজি টুকিয়ে ও কিনে , পঁচা অংশ কেটে বাদ দিয়ে ভালো অংশটা ছালায় সাজিয়ে বিক্রি করতো। তিন দশক পরে এসে একই বাজারে তার দুইটা পাইকারী আলু বিক্রির দোকান। মাঝে কেটে গেছে প্রায় বত্রিশ বছর।

তিন দশকে ওবায়দুল নিজেকে, নিজের পরিবার আর ঢাকা শহরকে বদলে যেতে দেখেছে। কাওরান বাজরও পরিবর্তনের বাইরে থাকে নাই। নাম বদলে হয়েছে কারওয়ান বাজার। ওবায়দুলের চোখে এই পয়ত্রিশ বছরে কারওয়ান বাজারে জিনিসপত্রের দামের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সাংবাদিকের সংখ্যা। এদের অনেকে এক কেজি আলু বা এক’শ গ্রাম কাঁচামরিচও পাইকারি দরে কিনার জন্য তোলপাড় করে। ফকিরাপুল হতে প্রকাশিত আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার ক্রাইম রিপোর্টার সবুজ ভাই এমনই এক সাংবাদিক এবং ওবায়দুল তার কাছে হাতে-নাতে ধরা খেয়েছে। ঘটনার নায়ক বা খলনায়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ক্যান্টিনের ম্যানেজার জাফর নিরাপদে থাকলেও ওবায়দুলের দুঃসহ সময় কাটছে।

(চলবে)

হে ক্ষণিকের অতিথি … পর্ব: ১

324

আমি যখন অনুভব করা শিখলাম, তখন থেকেই ওকে ভালো লাগতো। এই ভালো লাগা অন্যসব ভালো লাগার থেকে আলাদা। বাবা-মা কিংবা ভাই-বোনের জন্য যে ভালো লাগা সেরকম না। লতায় পাতায় জড়ানো আত্মীয়কূলদের জন্যও তো আলাদা এক ‘ফিলিংস’ থাকে, তেমনও না। আবার ওই ভালো লাগাকে ভালোবাসা ও বলা যাবে না।

তাহলে ওর প্রতি আমার ভালো লাগাটা কেমন ছিলো?
ওটা যেন গন্তব্যহীন কোনো পথের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা ‘ল্যান্ডমার্ক’ এর দেখা পাওয়ার উদগ্র বাসনায় তাড়িত হওয়া। অন্ধকার টানেলে দিকভ্রান্ত ছুটে চলে এক কোটি বছর পর বহুদূরে শেষ মাথায় আলোর আভাস পাওয়া। কিংবা পাতা ঝড়ার দিনে- দুইপাশে সারি সারি গাছের মাঝ দিয়ে কালো পিচের পথ ধরে পাগলা হাওয়ায় নিঃশব্দে হেঁটে চলা। অথবা শীতের দুপুরে ভরপেট ঘুম চোখে প্রিয় কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ ঝাপসা করে দেয়া বিস্মৃতির অতল গভীরে ডুব দেওয়ার আগ মুহুর্ত!

ওকে যেদিন প্রথম দেখি, জীবনের প্রথম সমুদ্র দর্শনের চেয়ে সেটা কোনো অংশে কম ছিলো না। কিংবা প্রথম বিমান ভ্রমণ। অথবা মায়ের আঁচল ছেড়ে প্রথম একা বান্ধবীদের সাথে বাইরে যাওয়া। অক্ষরে সেই অনুভব প্রকাশ করা দায়।

ওর ঘামে ভেজা লেপ্টানো কোঁকড়া চুল যখন বাতাসে ভেসে বেড়ায়, আমি তখন আর জন্মে বাতাস হতে চাই! ওর কপালে জমে থাকা মুক্তোর মত শ্বেদবিন্দু শীতের নরম রোদে যখন চকচক করে, পরের জন্মে আমার নরম রোদ হতে ইচ্ছে করে। ও যে পথ ধরে বন্ধুদের আড্ডায় যায়, সেই পথে ওর শরীরের ঘ্রাণ পেতে আমি পৌণঃপুণিক হেঁটে চলি!

বাবা মারা গেলেন। মায়ের আবার বিয়ে হলো। ওদের বাড়িতে আশ্রিতা হলাম। বাবার বড় বোনের ছেলে সে। সে দিক থেকে সম্পর্কে আমরা ভাই-বোন। কিন্তু আমি চাইলাম- যতবার জন্মাবো, আমি ওর হবো! এভাবেই বেড়ে উঠলাম আমরা। আনন্দ-হাসি-কান্নার মাঝে শৈশব পেরিয়ে কৈশোর ছাড়িয়ে আলগোছে একদিন হৃদয়বতী হয়ে উঠলাম।

যখন হৃদয়বতী হলাম, ভালো লাগা প্রেমের আগুনে পুড়ে পুড়ে ভালোবাসায় রুপ নিলো। আমি পুইঁয়ের লতার মতো আমার হৃদয়বানকে ঘিরে নেতিয়ে পড়লাম। মোমের মতো গলে গেলাম। আবার ধীরে ধীরে শক্ত মোম হলাম। কিন্তু ওকে ভালোবাসি তা কী বুঝাতে পারলাম?

এক ভরা সাঁঝে সে চলে গেলো। ওর আর আমার গল্পের শুরুটা এখান থেকেই।

#হে_ক্ষণিকের_অতিথি_পর্ব_১

(ক্রমশঃ)

ফুলকপি (বড়দের গল্প)

‘ফুলকপি’ বড়দের গল্প। আয়তনেও বড়, নভেলা বলা যায়। গল্পটা টাইমলাইনে শেয়ার করার আগে কিছু বলা দরকার- এখন একটানা তিন চার লাইনের বেশী লিখতে পারি না, চোখে প্রচণ্ড চাপ পড়ে। চোখের চাপ ছড়িয়ে যায় মাথায়। ছাইপাশ বা অখাদ্য যাই লিখি, হিরো আলমের গানের এসব লেখারও কিছু পাঠক আছেন। এদের অনেকে নতুন লিখার জন্য তাগাদা দেন- হাসিমুখে এড়িয়ে যাই। তবে Asif Iqbal-এর নিয়মিত তাগাদা – “তুমি কিন্তু ক’মাস ধরে তেমন কিছুই লিখছো না, কিছু লিখ। মনসুখিয়া বা গল্প- যা হোক লিখ।” ওকে বলা হয় না, “লিখতে তো চাই, কিন্তু পারি না।” শেষ পর্যন্ত ঘরবন্দী অবস্থায় ভয়েজ টাইপিং’য়ে ধীরে ধীরে “ফুলকপি” গল্পটা লেখা হলো, প্রযুক্তিকে ধন্যবাদ। খসড়াটা কথাসাহিত্য ডটকমে প্রকাশ করেছিলাম। এরপর ধীরে ধীরে এডিট করতে গিয়ে আকার আরও বড় হলো। বড়দের বড়গল্প ‘ফুপকপি’ ভালো না খারাপ সে প্রশ্ন যৌক্তিক, তবে বাংলায় বাটারফ্লাই ইফেক্ট প্রভাবিত এই ধরণের পলিটিক্যাল স্যাটায়ার লেখার সংখ্যা খুবই কম, হয় তো আগে লেখাই হয়নি, কেউ লেখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন নাই।
আজ ফুলকপি গল্পের প্রথম পর্ব শেয়ার করলাম-

ফুলকপি (বড়দের গল্প)
ফুলকপি (বড়দের গল্প/ফাইনাল)

১.
ফুলকপি দু’টা কি করবে – দ্বিধাগ্রস্ত হানিফ সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। প্রতিদিন ভোর ৫টার মধ্যে তার দোকানদারি শেষ হয়ে যায়। আজ সোয়া চারটার মধ্যে দু’টা বাদে সব কপি বিক্রি হয়ে গেছে। লাভসহ চালান উঠে এসেছে। এখন ভোর পৌনে ছ’টা, ফুলকপি নিয়ে বিভ্রান্ত হানিফ দাঁড়িয়ে আছে।

হানিফ মাঝরাতে কারওয়ান বাজারের আড়ত থেকে ঠিকায় দু’শ ফুলকপি আর এক’শ বাঁধা কপি কিনে। খুচরা বাজারে নিজের দোকানে সাইজ অনুযায়ী সাজায়। ক্রেতার চাহিদার পরিমাণ অনুযায়ী সাইজ ভেদে পাইকারি ও খুচরা দামে বিক্রি করে। এই কৌশলে তুলনামূলক বেশী লাভ হয়। বর্তমানে ফ্যাশন অনুসারে হানিফকে সবজী উদ্যোক্তা বলা যায়, কিন্তু চল্লিশ বছর বয়সী হানিফ পঁচিশ বছর ধরে একই কৌশলে ব্যবসা করে আসছে।

অবিক্রীত ফুলকপি জোড়া হানিফের মনে বাবার স্মৃতি জাগিয়ে তুলে। বাবা বেঁচে থাকতে ধমক খাওয়া ছাড়া হানিফকে কোনো কিছু করতে হয় নাই- না পড়ালেখা, না কাজ। এই কথাটি অবশ্য আংশিক সত্য, কারণ পড়ালেখার দৌড়ে সে ক্লাশ সেভেনের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা পর্যন্ত টিকেছিল। এরপর বস্তির বখাটে বন্ধুদের সাথে ঘনিষ্ঠতার শুরু। এক একদিন একা বা দলবেঁধে দয়াগঞ্জ রেল লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা বা ঢাকার কমলাপুরে চলে যাওয়া, বস্তির বাইরের ক্লাব ঘরে ক্যারাম খেলা, নিয়মিত সিগারেট খাওয়া এবং মাঝে মধ্যে খুচরো মাস্তানি – এসবকে যদি কাজ বলা যায়, তবে সে কাজও করেছে। এসব কাজের চাপে হানিফ এক ফূর্তিময় জীবন যাপন করছিল।

বাবা রিকশা চালাতেন। স্বল্প আয়, তবু খাবার ব্যাপারে তার জমিদারের মত বাছবিচার ছিল। অন্য রিকশাচালকরা আকিজ বিড়িতে অভ্যস্ত হলেও তিনি স্টার সিগারেট টানতেন। ফুলকপি ছিলো তার অপছন্দের সব্জী। ফুলকপির গন্ধ সহ্য করতে পারতেন না। মুখে তোলা তো দূরের কথা, পাতেও তুলতেন না, বলতেন, “মাইনষ্যে ফুল্কফি খায় ক্যাম্নে!” এই বিস্ময় বা প্রশ্নের মিমাংসা জরুরী ছিলো না, তাই গ্রহণযোগ্য উত্তর পাবার আগেই শীতের এক কুয়াশাঘন সকালে তিনি বিদায় নিলেন। টিকাটুলি মোড়ে “সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচ টন” গোত্রের ট্রাক তাকে পিষ্ট করে পালালো। তার থেতলে যাওয়া দলাপাকানো শরীরটা তিন চারবার ঝাঁকি দিয়ে স্থির হয়ে গেল । আইনী প্রক্রিয়া মেনে থানা থেকে মেডিকেল কলেজ, ফের মেডিকেল কলেজ থেকে থানার চক্কর কেটে সন্ধ্যায় লাশ দয়াগঞ্জ বস্তিতে আনার পর হানিফ, একমাত্র ছোট বোন আর তার মা’কে স্বজন হারানোর বেদনা নয়, আসন্ন দিনের অনিশ্চয়তা গ্রাস করেছিল।

বাবা মারা যাওয়ার পর হানিফের সামনে দুটি পথ খোলা ছিল – বাবার পেশা রিকশা চালানো বা দয়াগঞ্জ বস্তির বেল-বাটি পার্টিতে যোগ দেয়া। ট্রাকের চাকায় পিষ্ট বাবার দলাপাকানো শরীরটা বহুদিন হানিফকে আতঙ্কে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। রিকশার প্যাডেলে পা রাখার সাহস হয় নাই। বেল-বাটি পার্টিতে যোগ দিলে রিকশার বেল চুরি, ছিনতাই এবং ফেনসিডিল ও হিরোইনসহ মাদক কারবার করা যায়। স্বাধীন পেশা, ‘নো ওয়ার্ক নো পে’ নীতি সত্ত্বেও উপার্জন বেশ ভাল। তবে দু’টা ঝুঁকি রয়েছে- নেতারা পুলিশের সাথে ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে ঝামেলা করলে বা পত্রিকায় বেল-বাটি পার্টির দৌরাত্ম্য ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা বিষয়ক খবর ছাপলে পুলিশ অতি তৎপর হয়ে পার্টির সাধারণ সদস্যদের গ্রেফতার করে অমানবিক ধোলাই দেয়। দ্বিতীয় ঝুঁকি আরও মারাত্মক- পাবলিকের হাতে ধরা পড়লে নির্বিবাদী ও ভীতু মানুষগুলিই দানবে পরিণত হয়, পৈশাচিকভাবে পিটায়। মেরে ফেলার কৃতিত্বে উল্লসিত হয়। সাহসের অভাবে বেল-বাটি পার্টিতেও হানিফের যোগ দেওয়া হলো না।

রিকশার মহাজনের দেওয়া পাঁচ’শ টাকা পূঁজি নিয়ে হানিফের নতুন জীবনের শুরু। বয়স তখন চৌদ্দ কি পনেরো বছর, ফজরের ওয়াক্তে পুরান ঢাকার শ্যামবাজার থেকে কাঁচামরিচ, লেবু, ধনেপাতা, পুদিনা পাতা, শসা পাইকারি দামে কিনে সকালে সূত্রাপুর বাজারে খুচরা দামে বিক্রির মাধ্যমে হানিফের সব্জী ব্যবসায়ে হাতেখড়ি। সময়ের পরিক্রমায় রায় সাহেব বাজার ও জুরাইন বাজার পেরিয়ে, কিছুদিন ঠাটারিবাজারে মাছের ব্যবসা শেষে টানা আট বছর ধরে হানিফ কারওয়ান বাজারের সব্জী কারবারি। ক্ষুদ্র পূঁজির পাইকার। বাঁধা ক্রেতাদের অনেকেই তাকে ‘মাহাজন’ বলে ডাকে।

হানিফ সবুজ রঙের মাফলারটা গলা থেকে খুলে কোমড়ে বাঁধে। লুঙ্গিতে গুঁজে রাখা গোল্ডলিফের প্যাকেট বের করে। সিগারেট ধরায়। চা’য়ের জন্য আশপাশে তাকায়। মোখলেস নামের দশ বারো বছরের একটা ছেলে মাঝরাত থেকেই ফ্লাস্কে করে চা বিক্রি করে। মোখলেসকে বাজারের সবাই মেসি নামে ডাকে, কেনো ডাকে হানিফ জানে না। সম্ভবত মোখলেসের মেসি হবার ঘটনা কেউই জানে না। আশেপাশে মেসিকে দেখা গেলো না। হানিফ সিগারেটে টান দেয়। প্রথম টানের ধোঁয়া ছাড়তেই মনে জিহাদী হুজুরের চেহারা ভেসে উঠে। জিহাদী হুজুর ওয়াজে সিগারেট টানার এমন অভিনয় করে যে সবাই হেসে গড়াগড়ি খায়। ইউটিউবে যতবার জিহাদী হুজুরের ওয়াজ দেখেছে ততবারই হাসির দমকে হানিফের দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়েছে। কিন্তু এখন হাসি পাচ্ছে না, গোঁফ চুলকে ভাবছে- আজকের লটের সবচে সুন্দর ফুলকপি দু’টা বিক্রির জন্য আরও অপেক্ষা করবে না প্রতিদিনের মত বাড়ির ফেরার পথ ধরবে।

চলতি মৌসুমে ফুলকপির সরবরাহ বেশ ভালো। বাজারে শীতের সবজি আসার শুরুর দিকে মাঝারি আকারের এক জোড়া ফুলকপি দেড়’শ থেকে দু’শ টাকায় বিক্রি করতে পেরেছে। এখন দাম কমে জোড়া ষাট থেকে সত্তুর টাকায় নেমে এসেছে। হানিফ সিগারেট খাওয়া শেষে ফুলকপি দু’টোর দিকে তাকায়। সবুজ ডাটার মাঝখানে বরফ শাদায় হালকা হলুদ আভায় আচ্ছাদিত বৃত্ত। জমাট বাঁধা ফুল- চূড়োয় মধ্যবিন্দুকে রেখে ফুটবলের অর্ধাংশের মত সুষমভাবে স্ফিত হয়ে আছে। ফুলের কারণে সামান্য এবড়োথেবড়ো হলেও কোমল ও মসৃণ। হানিফ কপির ডাঁটি দুটো ফুলের তোড়ার মত দুই হাতে শক্ত করে ধরে। ঘ্রাণ নেওয়ার ভঙ্গিতে নাকের কাছে এনে শুঁকে। মুহুর্তের মধ্যে ওর চোখ বন্ধ হয়ে আসে। বাজারের কোলাহলকে দখল করে গাঢ় নিরবতা। বন্ধ চোখে ভেসে ওঠে আবছায়া ঘর, ছোটো জানালায় লাগানো প্রিন্টের পর্দা ফুড়ে ঢুকা নরম আলোয় সবুজ ব্লাউজ খোলা মাকসুদার ফর্সা বুক। শ্বাস নেবার দোলায় উঠছে নামছে। ফুলকপির ডাঁটির মত পাতলা-শুকনা একটা গতরে এত স্ফিত বুক কিভাবে হয়- হানিফের কাছে এ এক অমিমাংসিত রহস্য।

দ্রুতই নিজেকে সামলে নেয় হানিফ। কিছুটা লজ্জাও পায়। কল্পনার রাজ্য ছেড়ে কোলাহল আর প্যাচপেচে কাদা ও সব্জীর মিশ্রণে সৃষ্ট গন্ধ ভরা বাজারে ফিরে আসে। মাথার ভিতরে জেগে থাকে মাকসুদা। মাকসুদার এই উপস্থিতি তাকে অন্যান্য দিনের মত ফুলকপি জোড়া বাসায় নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনুৎসাহিত করে। মাকসুদা সব কিছুই খুব ভালো রান্না করে। কিন্তু ফুলকপির তরকারি রান্না করতে পারে না। ফুলকপির তরকারিতে এত বেশী হলুদ দেয় যে খেতে বিস্বাদ লাগে। বিস্বাদ ফুলকপির তরকারি উগরে আসা বমি চেপে হাসিমুখে খেতে হয়। খাওয়া শেষে প্রশংসা করতে হয়। কঠিন কিছু বললে মাকসুদা ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদে, হানিফের কষ্ট হয়। আজ সে নির্যাতিত হবার মত বস্তু নিয়ে ঘরে ফিরবে না, কম দামে হলেও ফুলকপি বিক্রি করে তারপর ফিরবে।

মাকসুদাকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতে হানিফ রাজী ছিলো না। বাবা মারা যাবার এক বছরের মাথায়, বাবার অভাবটাহাড়ে হাড়ে টের পেতে শুরু করেছে, মধ্যবয়সী মা এক ঠেলাওয়ালাকে বিয়ে করে আগারগাঁও বস্তিতে চলে গেলেন। তখনই হানিফ প্রতিজ্ঞা করেছিল বিয়ে করবে না। সে মরে গেলে বউ অন্য পুরুষের সাথে সংসার করবে, রঙ্গ তামাশা করবে, এক বিছানায় শুবে – এ কথা ভাবতেই বিয়ের প্রতি অনাস্থা এবং সংসারের প্রতি তীব্র বৈরাগ্য ও ঘৃণা জন্মেছিল। একমাত্র ছোটবোন তাকে বিয়ের জন্য ত্যাক্তের চূড়ান্ত করলো। “ভাই, তোমার বয়স বাড়তাছে, সেবাযত্ম দরকার” এবং “তোমার থেকা বুইড়া বয়সে মাইনষ্যে বিয়া করে, তোমার বিয়া করতে সমস্যা কি” – এই যুক্তিতে ছোটবোনের নেতৃত্বে সাঁড়াশি আক্রমণে যোগ দিলো বোন জামাই, ভাগ্না-ভাগ্নি আর এক চাচা। হানিফ শেষ পর্যন্ত বিয়েতে সম্মত হলো।ছোটবোন নিজ উদ্যোগে চল্লিশ বছর বয়সী ভাইকে দূর সম্পর্কের বাপ-মা মরা এতিম বিশ বাইশ বছর বয়সী ননদ মাকসুদার সাথে বিয়ে করালো। বয়সের ফারাকজনিত হীনমন্যতার কারণে অল্প বয়সী রূপবতী বউয়ের প্রতি হানিফ কঠোর হতে পারে না।

হানিফের দোকানের তিন-চার দোকান পরই ওবায়দুলের আলুর দোকান। ওবায়দুল অনেকক্ষণ ধরে হানিফকে খেয়াল করছিল। চোখাচোখি হতেই ওবায়দুল ইশারায় হানিফকে ডাকে। হানিফ কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ওবায়দুল বলে,
– ফুলকপি দুইটারে বুড়া হাত্তির বিচির মত ঝুলায়া দুই ঘণ্টা ধইরা খাড়ায়া আছো ক্যান? বাড়িতে লয়া যাও।
– আইজ বাড়িতে লইয়া যাইত্তাম না।

ওবায়দুল হাসে,
– ক্যান! ফুলকপি লয়া গেলে ভাবী মাইর দিবো! ভাবীরে ডরাও! ভাবী চিল্লাইবো! বাড়িত থেকা বাইর কইরা দিবো! রাইতে একলগে..

ওবায়দুলের রসিকতা হানিফের ভালো লাগে না। ওবায়দুলের কথা শেষ হবার আগেই বলে উঠে,
– ডাইকছো ক্যান! কি কইতে চাও তা কও!

ওবায়দুল হাসে,
– বাড়িতে না নিয়া গেলে আমারে দাও, আমি লয়া যাই। শইল মাছ দিয়া রাইন্ধা বউপোলাপান লয়া খাই।

ওবায়দুলের রসিকতায় তেঁতে থাকা হানিফ ঝাঁঝের সাথে বলে,
– দাম দিয়া নিবা! মাগনা দিতাম না।

ওবায়দুলের স্বরে ঝাঁঝ,
– ওই মিয়া! দামের গরম আমার লগে দেখাইও না। দাম দিয়াই লমু। ওবায়দুল মাগনা কিছু লয় না। বুড়া হাত্তির বিচির দাম কত চাও, কও?

হানিফ নরম হয়। একটা সিগারেট ধরিয়ে ওবায়দুলকে দেয়। ওবায়দুল সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লে হানিফ বলে,
– চ্যাতো ক্যান! আমি কি কইছি তুমি মাগনা নিবা! ফুলকপির আজকার দাম তো তুমি জানোই। ওই দাম লাগবো না। আমার বাড়িত যাওনের বাস ভাড়া বিশ টাকা, তুমি বিশ টাকা দিলেই সই। এমন কপি সারা বাজারে নাই।

এতক্ষণ পর ফ্লাস্ক হাতে মেসিকে দেখা যায়, হানিফ মেসিকে ডেকে ওবায়দুলকে বলে,
– চা খামু। তিয়াস পাইছে। খাওয়াইবা!

ওবায়দুল ফুলকপির দাম বাবদ বিশ টাকা দেয়, হানিফের সাথে নিজেও রঙ চা আর কাচ্চা বিস্কুট খায়। হাসিমুখে হানিফকে বিদায় দেয়।

ওবায়দুল ফুলকপি দু’টার দিকে মন্ত্রমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। একজোড়া সরস ফুলকপি, দেখলেই মন ভরে যায়। হানিফ মাত্র বিশ টাকার বিনিময়ে এই ফুলকপি বিক্রি করেছে- ভাবতেই আশ্চর্য হচ্ছে। সকাল ৮টার পর খুচরা ক্রেতার কাছে এই কপি দু’টা খুব কম করে হলেও দেড়’শ টাকায় বিক্রি করা যাবে। নগদ লাভ এক’শ ত্রিশ টাকা। কিন্তু ওবায়দুল বিক্রি করবে না। সবকিছুতে টাকার লাভ দেখলে চলে না। আরও অনেক বড লাভ প্রাপ্তির লক্ষ্যে সে এই ফুলকপি জোড়া বিনিয়োগ করবে।

(চলবে)

শোয়া-পণ্ডিতের গুষ্টি

দশ
নির্মল সহজে ঘন মেঘস্তর থেকে নেমে বৃষ্টি হয়ে কচুপাতার মৃণাল ঘিরে দাঁড়াতে পারে না। “সরল তরল হও, বিকাশের রীতিনীতি এই” এক কবি লিখেছিলেন; কিন্তু মায়া কখনও দুধ তৈরি করতে বললে সে এত মোটা ক’রে গুলত, খাওয়ালে বাচ্চাদের অবধারিত পেট ছেড়ে দেবে। নির্মল নিজেকে মেলে ধরে শিলাবৃষ্টির মতো; প্রথমে অপ্রবেশ্য, পরে হয়ত গ’লে জল হবে। ছোটদের জবান তার নয়, ভাবও কি বোঝে? সবাই জানে, এ-বংশের যতেক পুরুষ — সন্তানপাগল। রাতে বাচ্চারা নিঃসাড় ঘুমন্ত হলে নির্মল অন্ধকারে আন্দাজে-আন্দাজে ন’বছরের ছেলের হাঁটুর ঘা’য় মলম লাগিয়ে দিচ্ছে, কোমরে দাগ ব’সবে ব’লে ঢিলে ক’রে বাঁধছে তেরো বছরের কন্যার প্যান্টের ফিতে। সঞ্জু সব সময় টের পায় না, শিউলি লজ্জায় কাঠ হয়ে থাকে।

নির্মলের গল্পের ভাষাগাড়ি ছোট্ট শ্রোতাদের নানা সিগন্যালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এগোচ্ছিল :
— সভায় তখন গুনগুন শুরু। আরে, ‘নির্গুণ আত্মজ্ঞান’ তো পাতঞ্জল-যোগের গোড়ার কথা, সবে দু’এক বছর নবদ্বীপ শান্তিপুর বা গোপালপাড়ার টোলে যাতায়াত করছে এমন ছেলেছোকরাও জানে। জমায়েত ধরতেই পারছে না হলটা কী! হঠাৎ সভায় বসা একটা লোক চট ক’রে উঠে দাঁড়িয়েছে, তারপর দে ছুট ভীমবেগে। ভিড় চেঁচিয়ে উঠল : ব্যাটা অশা, আরে মধুসূদনের বড় শালা পালাচ্ছে… পালিয়ে মুখ বাঁচাবি ভেবেছিস?

ডামাডোল বেশ বড় চেহারা নিল। গাঁয়ের মোড়লরা জোড় হাত উঁচু ক’রে “শান্তি শান্তি” বলেও ম্যানেজ দিতে পারছে না। এমন সময় দেখা গেল, ডবল জোরে দৌড়ে ফিরে আসছে সেই অশ্বিনীচন্দ্র। কিন্তু অশার হাতে ওটা কী, এ-বাবা, কচি বাচ্চাদের তেলচিটে সরষে-বালিশ একখানা। সেটা ফরাসের ওপর পেতে অশ্বিনী জামাইবাবুকে হাত ধ’রে টেনে শোয়াবেই, আর মধুসূদনও শোবেন না। আবার বিরাট হই হই। সব দেখেশুনে দশরথ মিশ্রের ব্যাঁকা হাসি থেকে করুণা ঝরে পড়ছে। তিনি হাত তুলে বললেন, শয্যাগ্রহণ করতে লজ্জা কী, সার্বভৌম মহাশয়? হয়ত তাতে আপনার শরীরটি কিঞ্চিৎ পরিতোষ লাভ করবে।

দশের ও দশরথের অনুরোধে শেষতক শুয়েই পড়লেন তারকনাথ। ওমনি এক আশ্চর্য পরিবর্তন, ঝিমুনিভাব কেটে গিয়ে জ্বলে উঠল চোখদুটো। মুখে মুচকি হাসি টেনে এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটু গলা খাঁখারি দিলেন :

ধর্ম দুই রকমের, প্রবৃত্তিধর্ম ও নিবৃত্তি বা মোক্ষধর্ম। যার সাহায্যে সুখলাভ, তাই প্রবৃত্তিধর্ম। এটা সারা পৃথিবীতেই প্রচলিত আছে। কিন্তু শান্তিলাভের জন্যে নিবৃত্তিধর্মের অনুশীলন শুধু ভারতেই শুরু হয়েছিল। আত্মজ্ঞানও দু’প্রকার — সগুণ আর নির্গুণ। সগুণ আত্মজ্ঞানের ধারণা দিলেন বাগাম্ভৃণী ঋষি, কপিল ব্যাখ্যা করলেন নির্গুণ আত্মজ্ঞান। মাননীয় নৈয়ায়িক কপিল রাঢ়বঙ্গের সন্তান। আচ্ছা পণ্ডিত দরশরথ মিশ্র, বলুন তো…।

এর পর তর্কসভা মেরেকেটে পনেরো মিনিট স্থায়ী হয়েছিল। মিথিলার মহামহোপাধ্যায় পক্ষধর মিশ্রের বংশজ টের পেলেন, স্মৃতি, কাব্য, ন্যায়, ব্যাকরণ ও তর্ক বিষয়ে মধুসূদনের জ্ঞানের যে প্রখরতা, তাতে অনায়াসে পঞ্চতীর্থ উপাধিতে ভূষিত হতে পারেন। কাজেই টিকি-কাছা আস্ত রেখে মানে-মানে সরে পড়াই শ্রেয়। বজরায় ওঠার আগে বিমূঢ় দশরথ মধুপণ্ডিতের কাছে এসে নীচু স্বরে প্রশ্ন করলেন, মহাশয়, স্মার্ত রঘুনন্দনের মতে তিনভাবে অধ্যয়ন করা যেতে পারে — বাচিক বা উচ্চকন্ঠে পাঠ, উপাংশু বা অনুচ্চ স্বরে পাঠ এবং মানস বা মনেমনে পড়া। তো, আপনার এই শুয়ে শুয়ে পঠন-টি কোন ধারার অন্তর্গত?

এগারো
ঝড়ের বেগে সুধা ঢুকল ঘরে, রাতে যে কাঁথা নিয়ে ঘুমিয়েছিল সেটাই গায়ে জড়ানো।
— দিদিমা শুনিছ? টিপুদা বিয়ে ক’রে বউ নিয়ে আইছে!
— আমাগো টিপু? ওমা, আমার কী হবে! বউ পালো ক’নে?

সুধা ঠান্ডা মাটিতে ধেবড়ে ব’সে পড়ে। ওরে মুখপুড়ি, হাসবি পরে, আগে ঘটনা বল।

টিপু জলপাইগুড়ি গেছিল বন্ধু অসীমের মামাতো বোনের বিয়েতে। গেছে যদিও, বিয়েবাড়িতে কনের চাপা রঙ নিয়ে মহিলাদের ঠাট্টা-বোটকেরা, ছাদনাতলায় চ্যাংড়াদের মাতন, পাঁঠার মাংস খেয়ে মাটির গেলাসে হাত গোলা — কিছুই তাকে টানে না। সে কোনও রকমে কাঁধের ব্যাগ নামিয়েই আশপাশের বনপাহাড়ে ঘুরতে বেরিয়ে গেছে। এদিকে বিয়ের আগে পণের পুরো টাকা হাতে না পেয়ে বরপক্ষ পাত্র উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। তখন টিপুকে জঙ্গল থেকে খুঁজে এনে তার হাতে মেয়েকে তুলে দিয়েছে অসীমের মামা। টিপু অনেক বাধা দিয়েছিল : এ-বিয়ে আমার মা মানবে না। বিশ্বাস করবে না একটা কথাও। বলবে, ওই মেয়ের সঙ্গে তোর আগে থেকেই ভাব ছিল।

তৃপ্তিমামিমার চিৎকার শোনা যাচ্ছে এ-বাড়ি থেকে। সেই শাপশাপান্তকে নতুন বউ দেখার আহ্বান মনে ক’রে ছেলেমেয়েরা ছুটল। এই ফাঁকে চুপ ক’রে ঘরে ঢুকে একটা সবুজ প্যাকেট চাঁদের কোলের ওপর ছুঁড়ে দিয়েছে দিদিমা।
— প্রত্যেক দিন সকালে-বিকেলে ঠোঁটে লাগাবা। ভাইবোনরা কেউ চালি আঙুলির মাথায় ক’রে এট্টু দিয়ে আবার রাখে দেবা নিজির কাছে।

ননীবালা খেয়াল করেনি তার জাঁদরেল মেয়ে পেছন-পেছন বড়ঘরে উঠে এসেছে।
— কী এডা, দেহি? বোরোলীন! এর তো অনেক দাম। টাকা পালে কোথায়, মা? তোমার পানের ডাবরখান দেখতিছি না দুই-তিন দিন।
— তোরঙ্গে তুলে রাখিছি।
— তোমার মুখ না পাইখানা? ডাবর বের করো, আমি দ্যাখবো।
— ভর সন্ধেকালে মা’র পেছনে না লাগলি কি তোর পেটের ভাত হজম হচ্‌ছে না, নাদু?
— এক ফোঁটা দুধির সর মাখলি ঠোঁটফাটা সারে যায়। সংসার চালাতি যে কী কষ্ট তুমি তার কী বোজ্‌বা? কথায় কয়, চালডাল তোমার ম্যাজমানি আমার। দিদিমা হয়ে নাতির ভবিষ্যত ঝজ্‌ঝরে ক’রে দেচ্‌ছো!

নির্মল সদ্য ‘গাঁদাফুল’ লেখা শেষ করল, কবিতাটা দাঁড়াল মোট আট স্তবক, চব্বিশ লাইন। এবার সে কিছুক্ষণ বউ-শাশুড়ির ঝগড়া শুনল মন দিয়ে। ওদিকে হঠাৎ বলরাম ঘোষের বাড়ির হাত্‌নে থেকে উঠোনে খ্যানখ্যান করে গড়িয়ে পড়েছে কাঁসার থালা আর বারান্দাময় লালচে মোটা মুড়ি — শালী, হারামির বাচ্চা, সারাদিন গাধার খাটনি খাটে আসব আর তুই আমারে এই ব্যাতানো মুড়ি খাওয়াবি! ভাবিছিসডা কী?

প্রদীপ থেকে প্রদীপে যাওয়ার মতো ঝগড়ার শিখা সন্ধের কলোনি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। বলরামের মুখখিস্তি ঢেকে গেল পাশের রেখা-রত্নার বাড়ির শাঁখশব্দ, অতি-গৌরাঙ্গী রেখার মায়ের তীব্র উলুতে।

বারো
প্রতিটা মানুষই তর্কে-বিবাদে নিজের মতকে জিতিয়ে আনতে চায়, আর অপরের ধারণাসৌধকে ধসিয়ে দিতে। প্রত্যেকে বিশ্বাস করে ঠিক-টা তার সঙ্গেই আছে, অন্য পক্ষ মিথ্যের রজনীগন্ধা। কলোনির গলাবাজি, কাশ্মীরের সংঘর্ষ বা রাষ্ট্রসংঘের শান্তিআলোচনা সব জায়গাতেই সবাই বোঝাতে রাজি, বুঝতে নয়। তাই শুরু যেখানে আরম্ভ করে, সমাপ্তিও সেখানেই শেষ হয়, একটা বড় গোল্লার ওপর গালে হাত দিয়ে বসে থাকে মানুষের ভবিষ্যৎ।

আজাদ হিন্দ ক্লাবের মাঠে রামযাত্রার কনসার্ট শেষ হয়ে অভিনয় শুরু হল। সীতা খুব কাকুতিমিনতি করছে — প্রাণনাথ, তোমার সঙ্গে বনবাসে যাব। উত্তরে রাঘব : জীবনে চলার পথে, নারী নাহি নিব সাথে। ভাই লক্ষ্মণ, তোমার কী পরামর্শ? ভ্রাতা, তুমি যা বলিবে, কিন্তু আমারও মত : জীবনে চলার পথে, নারী… নারী নাহি নিব সাথে।

মায়া এসে ঠক করে এক কাপ চা খাটের কোনায় রেখে বলল, ছেলেডা এই নিয়ে দুবার জ্বরে-টানে পড়ল এক শীতে। আজ মাঘের মোটে তেরো দিন। আপনারে কতবার বলিছি, এইসব ছাইভস্ম না লিখে চাঁদের কুষ্টিডা বানান।

নির্মল উত্তর দেয় না, তার মাথায় সমাধানচিন্তা খেলে গেছে। আচ্ছা যদি এমন হয়, প্রতিটা মানুষ যে-কোনও মতবিনিময়ের সময়ে নিজের দোষ বা ভুলগুলো বলবে আর সমর্থন করবে তার বিরোধীর যুক্তিপূর্ণ মন্তব্যকে, তাহলে এই ট্র্যাফিক জ্যাম খুলে বেরিয়ে আসা যায় না? কথা মানেই যদি হয় নিজের বিরুদ্ধে কথা, তাহলে শব্দ ঘিরে যে ক্ষমতার দুর্গ গড়ে উঠেছে তাকে ভেঙে ফেলা সম্ভব। তখন মানুষের অহং নেমে আসবে গ্রীষ্ম-পুকুরের জলস্তরের মতো, অন্যকে ভালোবাসতে বাধা দেওয়া দেয়ালটা সরে যাবে। কিন্তু এই বুঝ মানুষের মাথায় ঢোকাবে কে?

নির্মল তার ছোট্ট শেলফের বইগুলোর দিকে তাকায় — উপনিষদ-সংহিতা, স্তোত্ররত্নাবলী, অ্যান্ড্রু মোশানের নির্বাচিত কবিতা কিটস, এ হিস্ট্রি অফ স্যানসক্রিট লিটারেচার, অমরকোষ, গীতবিতান, ব্রহ্মসূত্র সঞ্চয়ন, দ্য পিকচার অফ ডোরিয়ান গ্রে…।

— ও গৃহস্থ?
— শুনতিছি।
— কাল সকালে চাঁদরে নিয়ে যাব ইস্কুলে। ভর্তি করে দিয়ে আসব।

মায়া বিপদ আশঙ্কা করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
— এখনও আট মাস বয়েস কম ছেলেডার। তার উপর এই শরীর…।
— বাড়ি রাখলি আবার আমতলার শিশিরে গড়াগড়ি খেয়ে জ্বর বাধাবে। তার চেয়ে ইস্কুলই ভালো।

(শেষ)

মশা ঘনুবাবু ও ছটা বিয়াল্লিশ

চটাস করে এক চড় নিজেরই ডান পায়ের গুলফের ওপর কষালেন ঘনুবাবু। চলন্ত ট্রেনে যে এত মশা কি করে থাকে! আশ্চর্য! হালকা সাদা আলোয় হাতটা চোখের সামনে তুলে এনে দেখলেন নাহ মরেনি ব্যাটা। মশা মারায় ঘনু একেবারেই অপদার্থ। গিন্নীও হামেশাই বলেন সেকথা। অবশ্য এই একটাই কথা বলেন না। বলতে গেলে সারাদিনই অসহ্য নাকচাবি পরা বোয়াল মাছের মত জাবদা মুখখানা চলছে তো চলছেই। সেই সাতসকালে শুরু হয়ে এই কথার চর্বিতচর্বণ চলতেই থাকে অবিরাম। তাকে থামায় কার বাপের সাধ্যি। আর সব কথার সার হল, ঘনুবাবু অতি অকর্মণ্য। ভাগ্যিস বহু তপস্যা করে তাঁর মত একপিস বউ পেয়েছিলেন তাই বর্তে গেছেন। নইলে যে ঘনুর কি হতো, ভাবলেও তিনি শিউরে ওঠেন। পাড়ার আর পাঁচটা বউকে দেখুক ঘনু, তাহলেই বুঝবে সে কি রত্ন পেয়েছে। শুধু পাড়ার বউদেরই নয়, তার সাথে নিজের অকালকুষ্মান্ড পরিবারের অন্য মেয়ে বউ দেরও দেখুক। তাহলেই হাড়ে হাড়ে বুঝবে তার নিজের বউ কত্তো গুনী। এটসেট্রা…এটসেট্রা…

পাড়ার বউদের যে দেখেন না ঘনু, তা নয়। বরং কাছেপিঠে বউ নেই দেখলেই বেশ ভালো করেই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন। চব্ব্যচোষ্য করেই চেটেপুটে দেখেন। আর শুধু দেখাই নয়, অনেককিছু কল্পনাও করেন। মাঝেমধ্যে অবশ্য বউএর অবস্থানটা দেখে নিতে হয়। এখন এই মাঝবয়সে পাড়া কেন দুনিয়ার তাবৎ অন্যলোকের বউ কেই দেখার কি যে সুখ! আহা! চলতি ট্রেনেই মুচকি হাসি ভেসে ওঠে তাঁর দুঠোঁটের মাঝে। পাশের লোকটার এক ঠেলা খেয়ে একটু কাত হয়ে পড়তেই সংবিত ফিরে এল তাঁর।

-“আস্তে রে ভাই! আস্তে আস্তে”।
এই ছটা বিয়াল্লিশের লক্ষীকান্তপুর লোকালের আশি পার্সেন্ট প্যাসেঞ্জারই ডেইলি। তাই মোটামুটি সবাইই মুখ চেনা। বীভৎস ভীড় হয় এসময়টায়। শেয়ালদা থেকে ছাড়ার সময়েই ভীড় কামরা ছাড়িয়ে রড ধরে ঝুলতে থাকে। সবই ছোটখাট চাকরীজীবী কিম্বা হকার, ছোট দোকানদার। সারাদিনের পেটের বন্দোবস্ত করে ফিরে চললো নিজের গ্রামের বাড়ীতে। এই ভীড় ঠেলে ওঠা বা নামা দুইই বেশ কসরতের কাজ। বছরের পর বছর রীতিমত ঠোক্কর খেয়ে তাঁকে শিখতে হয়েছে ওঠা-নামা- দাঁড়িয়ে থাকার কায়দা কানুন। যদিও খুব বেশিদূর যাতায়াত নয় তাঁর। শেয়ালদা থেকে মাত্র খান চারেক স্টপেজ পরেই বাঘাযতীন। বাসেও যেতে পারেন, কিন্তু সিগন্যালে ঠেক খেতে খেতে বাসের প্রায় ঘন্টা দেড়েক লাগে। তাছাড়া শেয়ালদা থেকে এদিকের বাস পাওয়াও সমস্যা। অনেকক্ষণ দাঁড়ালে তবে একটা ভীড়ঠাসা বাস আসে। অনেক ভেবেচিন্তে এই ট্রেনলাইনই বেছে নিয়েছেন তিনি। হোক ভীড় তবু মিনিট পনেরোর মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায়। আর বছর সাতেক চাকরী আছে। চালিয়ে নেবেন এভাবেই। একটা স্টেশন এল। উঁকি মেরে দেখলেন পার্কসার্কাস।

-“দাদারা, বোনেরা, মিস্টার এন্ড মিসেসেরা, এই চলন্ত ট্রেনে অনেক হকারই আপনাদের কাছে আসে। রোজই তাদের দেখেন। অনেকেই খুব পরিচিত হয়ে গেছে আপনাদের”।

এই ঠাসা ভীড়ের মধ্যে কিভাবে যে এই হকাররা যায়, সেটা একটা ম্যাজিক। শুধু যাতায়াত করাই নয়, কাউকে বিরক্ত না করেই দিব্যি নিজের প্রোডাক্ট নিয়ে বকবক করে গছিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে চলেও যায় ফের। আর কি না বিক্রী করে ওরা! সেফটিপিন থেকে জলের বোতল, গামছা থেকে ডাব। ভাবা যায় না। ওই ভারী জিনিসগুলো বয়ে অনায়াসে এ কামরা সে কামরা করে বেড়ায় ওরা। ঠিকই বলেছে এই নতুন হকার, বহু হকারই ডেলি প্যাসেঞ্জারদের পরিচিত হয়ে গেছে।

একটু স্বস্তি পেয়ে, ভালো করে হকারের দিকে তাকালেন ঘনুবাবু। বাপরে! এই লোকালে রীতিমত সাদা শার্ট, প্যান্ট, টাই পরে সেজেগুজে উঠেছে লোকটা। টাই দেখলেই ঘনুবাবু বেশ সম্ভ্রমের চোখে তাকান। তিনি জীবনে কখনো ওই জিনিসটা ছুঁয়েও দেখেন নি। আসলে টাই এর কোনো দরকারই পরেনি তাঁর। টাই বাঁধতে গেলে যে জিনিস টা দরকার, সেই স্যুটও নেই তাঁর। থাকতোও যদি তাহলেও ওই অফিস-বাড়ী-বাজারের পরিক্রমায় তিনি কিছুতেই সেটা পরতেন না প্যাঁক খাবার জন্যে। অথচ এই হকার তো দিব্যি পুরোদস্তুর অফিসার মার্কা চেহারা আর সাজগোজ নিয়েও চলে এসেছে। এঁকে তো আগে কোনোদিন দেখেননি তিনি। অন্য ডেইলিদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তারাও কেমন হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে ওই হকারের দিকে।

এ নিশ্চয়ই খুব শিক্ষিত কেউ। অবস্থার চাপে পড়ে আজ হকারি করতে এসেছে। মনে মনে ভাবলেন ঘনু। এবার মন দিলেন ওর কথায়।

-“ দাদারা- বৌদিরা! আপনারা রোজই হরেক সমস্যায় বিব্রত। সারাদিন হাড়ভাঙা খটুনির পরে সন্ধেয় বাড়ী ফিরে চলেছেন একটু শান্তির আশায়। নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখীরা কুলায় ফিরছে সারাদিনের শেষ হয়ে যাওয়া এনার্জি লেভেল বাড়ীর শান্তিতে একটু ঘুমিয়ে বাড়িয়ে নিয়ে আগামীকাল ফের ঝাঁপিয়ে পড়বেন জীবন যুদ্ধে।

কিন্তু ভাবুন তো দাদারা-বৌদিরা, বাড়ী ফিরে সেখানে শান্তি পাবেন কি? বাড়ীতে ঢুকে হাত মুখ ধুয়ে যেই একটু বিশ্রামের জন্যে জলখাবারের প্লেট হাতে মাদুরে কিম্বা চেয়ারে কিম্বা টুলে কিম্বা বিছানায় বসবেন, ওমনি প্যাঁক… ইয়াব্বড় ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ হাতে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে কয়েক লক্ষ মশা। কোথায় পালাবেন? রান্নাঘরে- মশা, বাথরুমে- মশা, ক্লাবে- মশা, রাত্তিরে বিছানায় থইথই করছে মশাবাহিনী। আর কি না রোগ বয়ে আপনার শরীরে ঢুকিয়ে দিতে ওঁত পেতে বসে আছে ওরা। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, এনকেফেলাইটিস, এনসেফেলাইটিস, ফাইলেরিয়া আরো কত হাজার রোগ। একটা মশা কামড়ানো মানে আপনার কাজ বন্ধ, ডাক্তারের কাছে বা হাসপাতালে ছোটাছুটি। টাকার শ্রাদ্ধ”।

এত রোগের ফিরিস্তি শুনে যেন ঘনুর শরীর টা খারাপ লাগতে শুরু করলো। আজ সকালেই বাজারে শুনে এসেছেন আজাদগড়ে একজন ডেঙ্গুতে মারা গেছে। ডেঙ্গু না কি ডেঙ্গি তাও জানেন না তিনি। কেমন জঙ্গি জঙ্গি মনে হয় শব্দটা। ডেঙ্গু হলে কি করে লোকে মরে যায় পটাস করে তাও তাঁর অজানা। কিন্তু শব্দটা শুনলেই গায়ে কাঁটা দেয়।

-“আপনারা এতদিন বহু কোম্পানির অনেক নামী দামী প্রোডাক্ট ব্যবহার করেছেন। কিন্তু একবারও ভেবেছেন কি, সেইসব কয়েল বা লিকুইড বা ম্যাটের সাইড এফেক্ট কি? জানেন কি এগুলো দিনের পর দিন ব্যবহার করলে হাঁপানি, চর্মরোগ, এমন কি ক্যান্সারও হতে পারে!”

ঘনুর অবস্থা এখন রীতিমত করুণ। ক্যান্সার! ওরেবাবা! অফিসের এক পিওন সদ্য পটল তুললো ওই রোগে। শুনেছেন ভয়ংকর যন্ত্রণা পেয়ে দগ্ধে দগ্ধে মরতে হয়। গরমে নাকি ভীড়ের চাপেই দরদর করে ঘামতে থাকেন ঘনু।

-“ আমি আজ আপনাদের কাছে হকারি করে জিনিস বিক্রী করতে আসিনি দাদারা-বৌদিরা। আমি এসেছি বিখ্যাত বিজ্ঞানী নিধিরাম নস্করের তৈরী এক অনবদ্য ওষুধ এই প্রথম পরীক্ষামূলক ভাবে আপনাদের কাছে পৌঁছে দিতে। কিছুদিনের মধ্যেই পেটেন্ট এসে যাচ্ছে। এরমধ্যেই হামলে পড়েছে দেশ বিদেশের বড় বড় নামী দামী কোম্পানী। ওদের হাতে এর স্বত্ত্ব চলে গেলেই আকাশছোঁয়া দামে বিক্রী করে বিপুল লাভ করবে ওরা”।
পেটেন্ট টা কি ব্যাপার! কাল অফিসে জানতে হবে অম্লানের কাছে। ভাবলেন ঘনু।

-“এই জগতবিখ্যাত ওষুধের কোনো সাইড এফেক্ট নেই। একটা ওষুধ সুতোয় বেঁধে ঘরে ঝুলিয়ে দিলেই মশারা পিলপিল করে পাড়া ছেড়ে পগাড়পার। কোনো রোগ নেই, কোনো অস্বস্তি নেই, আর দামও আপনার হাতের নাগালেই”।

-“পরে এই ওষুধের কি দাম হবে জানিনা। কিন্তু এখন প্রথম আমার দেশকে প্রনাম জানাতে বিজ্ঞানী নস্কর এই ওষুধের দাম রেখেছেন প্যাকেট প্রতি মাত্র পাঁচ টাকা – পাঁচ টাকা – পাঁচ টাকা। প্রায় জলের দরে কিম্বা ফ্রী বলতে পারেন। আর শুধুমাত্র আপনাদের জন্যেই আছে একটা স্পেশাল অফার। তিনটে একসাথে যেকোন বড় দোকানে পরে কিনতে গেলে আপনার পড়বে প্রায় একশো টাকা। কিন্তু আপনাদের জন্যে, শুধুই আপনাদের জন্যে আজ একসাথে এই তিন প্যাকেট নিলে দাম পড়বে মাত্র দশ টাকা – দশ টাকা – দশ টাকা। আমার কাছে আজ বেশি প্যাকেট নেই। পরীক্ষামূলকভাবে মাত্র কয়েক পিস এনেছি। যদি কারো দরকার লাগে তাহলে দয়া করে হাত বাড়ান”।

দেখতে দেখতে লোকটার ব্যাগ খালি হয়ে গেল। ঘনু শুধু নেবার সময় আস্তে জিজ্ঞেস করেছিলেন-“দাদা কাজ হবে তো?” লোকটা ভুবনমোহন হাসি হেসে বললে-“ বহু টাকাই তো জলে যায় দাদা, এটা একবার ব্যবহার করে দেখুন। তারপরে আবার আমাকে খুঁজে বেড়াবেন”। বেশ গর্বিত হাসি হেসে ঘনু প্যাকেট তিনটে তাঁর ছেঁড়া রঙচটা ক্যাম্বিস ব্যাগে ঢোকালেন।

#
অন্যদিন মশা তাঁকে খোঁজে, আজ বিছানায় বসে তিনি মশা খুঁজছেন। এখনো পর্যন্ত দেখতে পাননি। সদ্য রাতের বরাদ্দ রুটি আর আলু বিহীন পেঁপের তরকারি খেয়ে বিছানায় বসে মেজাজে একটা বিড়ি ধরিয়েছেন। গিন্নী এখন রান্নাঘরে ব্যস্ত থালাবাসন ধোবার কাজে। রাতের বাসন ধুয়ে না রাখলে সকালে ফের রান্না করতে অসুবিধা হয় তাঁর। সন্ধেয় বাড়ীতে ফিরে বেশ মেজাজে ব্যাগ থেকে প্যাকেট তিনটে বার করে তার গুণাগুণ বোঝাতে শুরু করেছেন, অমনি এক ঝামটা দিয়ে তাঁকে থামিয়ে দিয়েছিলেন গিন্নী।

-“দয়া করে ওসব কেরামতি না দেখিয়ে এখন হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর। আবার রাতের রান্না আছে”।

বেজার মুখে পড়তে বসে উৎসুক তাকিয়ে থাকা মেয়েকেই চুপিচুপি বুঝিয়ে উঠে পড়েছিলেন ঘনু। গিন্নীর যে তাঁর ওপর এতটুকু আস্থা কেন নেই কে জানে!

মেয়ে আগেই পাশের ঘরে শুয়ে পড়েছে। কাল ওর ক্লাসটেস্ট আছে। তিনটে প্যাকেট ওই খুলে সুতো দিয়ে টাঙিয়েছিল খেতে যাবার আগে। হাসি হাসি মুখে বেশ প্রশ্রয়ের ভঙ্গীতেই দেখছিলেন ঘনু। গিন্নী এলেন হাতের কাজ চুকিয়ে।

-“কি গো মশারী না টাঙিয়েই শুয়ে পড়েছ যে? বাঘাযতীনের বাঘা মশা কি তোমাকে ছেড়ে দেবে ওই পুরিয়াগুলো দেখে?”
-“হে হে, দেখ, এখনো পর্যন্ত একটাও মশা নেই”।
আর কথা না বাড়িয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন ঘনুজায়া।

এপাশ ওপাশ করতে করতে সবে ঘুম আসছিল, তখন মনে হল পায়ে একটা কিছু কামড়ালো। পা টা চুলকে নিলেন ঘনু। মনের ভুল হয়তো। ভাবতে না ভাবতেই চারদিক থেকে সাঁড়াশী আক্রমন। এদিকে কামড়ায়, ওদিকে কামড়ায়। উঠে আলো জ্বালাতেই দেখেন গৃহিণী আগেই উঠে বিছানায় বসে আছেন।

-“রইলো তোমার এই পাগলের সংসার। কাল সকালে উঠেই আমি বাপের বাড়ী চলে যাব। আর সহ্য হচ্ছে না। থাক তুমি এ ঘরে তোমার পুরিয়া আর মশাদের নিয়ে, আমি মেয়ের ঘরে চললাম”।

রেগে গজগজ করতে করতে পাশের ঘরে চলে গেলেন তিনি।
আলোয় ঘরটা দেখে ঘনুর চোখ কপালে। গিজগিজ করছে মশা। ঘরের মশা বাইরে যাওয়া তো দূরের কথা, মনে হচ্ছে বাইরের যত মশা ঘরের মধ্যে চলে এসেছে। উঠে পাশের ঘরে উঁকি দিলেন তিনি। অন্ধকারে আবছা আলোয় দেখলেন মেয়ে আগেই মশারী টাঙিয়ে নিয়েছে। ভীষণ রেগে ঘরে ফিরে এলেন ঘনু। একটানে সুতো ছিঁড়ে নামিয়ে আনলেন প্যাকেট টা। আজ হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বেন তিনি। দেখবেন কি মহামহৌষধ আছে ওতে।
প্যাকেট মানে ফুটো ফুটো প্লাস্টিকে মোড়া একটা পুরিয়া। সেটা ছিঁড়তেই ভেতরে আরেকটা কাগজের পুরিয়া। সেটা খুলতে বেরোল আরেকটা ছোট কাগজের পুরিয়া। উত্তরোত্তর রাগ বাড়ছে। এটাও খুললেন ঘনু। ভেতরে মোড়া একটা সাদা কাগজ। তাতে লেখা-

“মশারী টাঙান। এর কোনো সাইড এফেক্ট নেই।– ইতি বিজ্ঞানী নিধিরাম নস্কর”।

মকাইশা মোকাম্মিল

মোকাম্মিলকে আমি ডাকি ‘মকাইশা’, আমরা যখন ছোট তখন মকাইশা নামে এক অদ্ভুত, অলৌকিক মানুষ আমাদের পাড়ায় আসতেন। তিনি আমাদের খুব পছন্দের মানুষ ছিলেন; তাঁর বিচিত্র আচার-আচরণের জন্য। আমাদের পাড়ায় যতগুলো টিউবওয়েল ছিল প্রত্যেক টিউবওয়েলে তাঁর একছত্র রাজত্ব। টিউবওয়েলের পানি তাঁর কথা শুনতো তিনি যা চাইতেন টিউবয়েলের পানি তাই করতো, ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁর মাথায় পানি ঝরতেই থাকতো, ঝরতেই থাকতো।

টিউবওয়েলের পানি যেভাবে তাঁর অনুগত ছিল, আমরাও ঠিক সেভাবে তাঁর অনুগত, ভক্ত ছিলাম। তিনি যা বলতেন আমরা তাই করতাম। আমাদের যে ছোটখাটো রাজত্ব ছিল, আমরা তাঁকে সেই রাজত্বের রাজা হিসাবে স্বীকার করেছিলাম। তিনি ছিলেন আমাদের জন্য হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা, তাঁর বাঁশির ডাকে আমরা ছুটে বেরিয়ে আসতাম। তিনি বললে আমরা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তাম।

আমরা বড় হতে শুরু করলে তিনি তিরোহিত হলেন, কিন্তু তাঁর চিহ্ন থেকে গেল আমাদের হৃদয়ে। বন্ধুবান্ধব যখনই একত্র হই মকাইশাকে খুঁজতে থাকি, ইচ্ছে করে পুনরায় শৈশবে ফিরে যাই, ইচ্ছে করে টিউবওয়েলে ঘন্টার পর ঘন্টা মাথায় পানি ঢালি।

মোকাম্মিলের মাঝে মকাইশার কিছু চিহ্ন আছে। সেও অদ্ভুত স্বভাবের, তার সম্মোহনের ক্ষমতা অসাধারণ! একদিন লক্ষ্য করলাম আমরা তাকে অনুসরণ করছি। একদিন সে আমাদের দলনেতা হিসেবে দেখা দিল।

দেশে গেলে মোকাম্মিল ছাড়া আমার জীবন অচল। বিশ্বাস করুন এক বিন্দুও বাড়িয়ে বলছি না, মোকাম্মিল ছাড়া দেশের কোন আকর্ষণ নেই। আমি যদি বাসা থেকে এক ফুট দূরত্বে যাই, মোকাম্মিলকে সাথে থাকতে হয়। যদিও আমি দেশ থেকে বড় হয়ে এসেছি তবুও কেন জানি মনে হয় মোকাম্মিল সঙ্গে না থাকলে আমি হারিয়ে যাব। অথবা কেউ আমাকে চুরি করে নিয়ে যাবে। যতদিন দেশে থাকি নিজের চেয়ে মোকাম্মিলের উপর ভরসা করতে হয় বেশি।

ব্যক্তিগতভাবে মোকাম্মিল আমার ওস্তাদ। আমার জীবনের ‘প্রথম’ অনেক কিছু তার কাছে শিখেছি। দু একটা উদাহরণ দেই: সিগারেট খাওয়া ক্ষতিকর সবাই জানি, আমাদের পারিবারিক শৃঙ্খলার মাঝে সিগারেটের কোন স্থান নেই। এটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের অতিরিক্ত আকর্ষণ থাকে। আমাদেরও ছিল; কিন্তু নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করে স্বর্গচ্যুত না হওয়া কীভাবে সম্ভব মোকাম্মিল সেটা শিখিয়েছিল। সিগারেট খেয়ে কচি লেবুর পাতা কতক্ষণ চিবুলে সিগারেটের দুর্গন্ধ দূর হয়ে যায়, হাতের আঙ্গুলেও যাতে নাসির বিড়ির দুর্গন্ধ না থাকে সেজন্য কচি লেবুর পাতার রস বানিয়ে হাতে মাখতে হয়।

দুই টাকার বিনিময়ে কুসুমবাগে সিনেমা দেখা যায় সেটাও তার কাছে শেখা। কুসুমবাগের তখনকার যে টিকেট কন্ট্রোলার ছিলেন, তাকে দুই টাকার ঘুষ দিলে তিনি আমাদের থার্ড ক্লাসে বসিয়ে দিতেন, বিরতির পূর্বে শুধুমাত্র ১৫ মিনিটের জন্য বাইরে আসতে হতো তখন হল মালিকের নির্বাচিত লোক পরিদর্শনে আসতো, পরিদর্শন শেষ হওয়া মাত্র পুনরায় সিনেমা দেখার সুযোগ পেতাম।

শবেবরাতের নফল নামাজের জন্য মসজিদের প্রতিটি কোনা যে কভার করা লাগে সেটাও মোকাম্মিলের কাজ থেকে শেখা। আল্লাহ তাঁর রহমত মসজিদের কোন কোনায় বর্ষণ করছেন সেটা আমরা জানি না, সব কোনা কাভার হয়ে গেলে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হলাম না পরীক্ষা পাশও সহজ হয়ে গেল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক যে শেখ মুজিবুর রহমান এই সত্য সে-ই আমাকে প্রথম জানিয়েছিল। তখন খাল কাটার জমানা, বাজারে সাধারণ জ্ঞানের অসংখ্য বই বেরিয়েছে। আমাদের জায়গীর মাস্টার চাকরির ধান্দায় এসব বই গোগ্রাসে গিলছে। সাধারণ জ্ঞানের এক বইয়ে স্বাধীনতার ঘোষক হিসাবে দেখেছিলাম সানগ্লাস মেজরের নাম।

মোকাম্মিল বলেছিল এসব মিথ্যা; মেজর কোনভাবেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারে না তার সেই অধিকার নেই। স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার একমাত্র বঙ্গবন্ধুর, তখন গুগল জামানা ছিল না তাই দলিল, দস্তাবেজ দেখিয়ে প্রমাণ করার সুযোগ ছিল না কিন্তু যাকে সাক্ষী মেনে ছিল তাঁর সত্যবাদীতার কাছে হাজারটা গুগল পৌঁছাতে পারবে না। সাক্ষী ছিলেন সৈয়দ আমজাদ আলী, মোকাম্মিলের পিতা। সত্যবাদিতা এবং সৈয়দ আমজাদ আলী সমার্থক ছিলেন। আমাদের শহরে তাঁর সত্যের সামনে দাঁড়াতে পারে এমন কেউ ছিল না। সত্যের মূর্তপ্রতিক যখন বললেন শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক; সন্দেহ করার তিল পরিমাণ অবকাশ থাকল না।

মোকাম্মিল সম্পর্কে আমার চাচা, কিন্তু আমাদের সম্পর্ক কোনদিনই চাচা ভাতিজায় রূপ নেয়নি। সেরকম সম্ভাবনা ছিল না। আমাদের জন্ম প্রায় একসাথে দু-চার দিনের কম বেশি হতে পারে, বাসা পাশাপাশি। আমরা যখন বড় হই তখন কে কোন বাসার সে চিন্তা মাথায় আসেনি আমি যেমন অনায়াসে তাদের পাক ঘরে ঢুকে খাবার খেতে পারতাম, সে ঠিক তেমনি আমার সাথে এক পাতে খেতে বসে যেত। মোকাম্মিল আমার বন্ধু, সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। যে গোপন কথা বিবাহিত বউকে বলা যায় না; সে গোপন কথা মোকাম্মিলের সিন্দুকে আজীবন নিরাপদ থাকে।

আমার গায়ের রং কৃষ্ণ অর্থাৎ কালো মোকাম্মিল ফর্সা, মহাভারতের জমানা হলে সব গোপিনী আমার জন্য পাগল হতো কিন্তু এটা কলিকাল। এটা বুক ফেটে যাওয়ার জমানা; আমার ভাগ্যে কোনদিনই কোন গোপিনী জোটেনি, যাকে পছন্দ করি সেও আমার সামনে দিয়ে মোকাম্মিলের হাত ধরে চলে যায়। তবে ভাতিজার জন্য, প্রাণের বন্ধুর জন্য মোকাম্মিল চেষ্টা করেছে অনেক, তাকে পছন্দ করা গোপিনীদের আমার কাছে ভিড়াতে চেয়েছে, কিন্তু কলিকালের কারণে কেউ রাধা হতে রাজী হয়নি।

আমার দুঃখের এক বয়ান দিয়ে এই লেখার সমাপ্তি করি। মোকাম্মিলের সাথে ঢাকায় যাচ্ছি, ট্রেনে শ্রীমঙ্গল থেকে। ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে এমন সময় এক তরুণী আমাদের কামরায় উঠে এলো তরুণীর আলোয় ঝলমল করে উঠলো কামরা। মোকাম্মিল এবং আমি সামনাসামনি বসেছি। আমার পাশের সিট খালি, মোকাম্মিলেরও। তরুণী একবার আমার দিকে তাকিয়ে মোকাম্মিলের দিকে তাকাল, তারপর বলল ‘ভাইয়া আপনার পাশে কী একটু বসতে পারি’। মোকাম্মিল সায় দিলে বসে পড়ল, একটু ধাতস্থ হওয়ার পরে আমার দিকে চেয়ে বলল ‘চাচা কী ঢাকা পর্যন্ত যাচ্ছেন…’

আমার তখন মরমে মরে যাওয়ার অবস্থা…

গল্পঃ প্রকৌশল

‘গল্প লেখা মোটেও কঠিন নয়, পুরস্কারের জন্য গল্প লেখা আরও সহজ। কলম আর এ ফোর সাইজের দুটো কাগজ নাও, ফরমুলা শিখিয়ে দিচ্ছি’ বলে নোমান থামে, প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরায়, লম্বা একটা টান দিয়ে মাছের খাবি খাওয়ার মত করে ধোঁয়া ছেড়ে হাওয়ায় রিং বানানোর চেষ্টা করে। টেবিলের অপর পাশে বসে আছে নবীন লেখিকা হেনা মুস্তারি, সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে নোমানকে দেখছে, মনে মনে বলছে — ‘গল্প লেখা যদি এতই সহজ তবে আপনি লিখেন না কেনো!’

হেনার মনের ভাব টের পায় নোমান, নিজেই একটা কাগজ সামনে টেনে নেয়, কলম দিয়ে দাগ কাটতে কাটতে বলে,
— এ গল্পটা রেজাউলের পরিবারের গল্প। পরিবারের কর্তা রেজাউল দরিদ্র হলে নামের শেষে মিয়া এবং ডাক নাম রেউজ্জা’ করে দিলেই হত। কিন্তু গল্পের প্রয়োজনে রেজাউল দরিদ্র নয়, উচ্চবিত্ত শ্রেণির শহুরে মানুষ। তাই তার নাম হবে ‘রেজাউল করিম’। এদেশে বিত্তবান মানেই প্রভাবশালী, প্রভাবের ভাব ফুটাতে নামের শেষে পদবী ‘চৌধুরী’ বা ‘খান’ যোগ করা প্রয়োজন। রেজাউল করিমের সাথে চৌধুরী পদবীটা মানায়, ওটাই থাক। অবশ্য রেজাউলকে আরও বিশেষ করে তুলতে চাইলে নামের আগে ‘খান মোহম্মদ’ যোগ করা যায়।

হেনা মুস্তারি গল্প লেখার ফরমুলা শুনছে। এ ফরমুলা জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকার তরুণ সাহিত্য সম্পাদক নোমানের রসিকতা কি না বুঝতে না পারলেও শুনতে ভালোই লাগছে। হেনা জানতে চায়,
— তবে কি গল্পের পরিবারের কর্তার নাম খান মোহম্মদ রেজাউল করিম চৌধুরী?
— না, না, তা নয়। গল্পে রেজাউল করিমকে দিয়ে কিছু অনৈতিক কাজ করানো হবে। তাই নামের আগে মোহম্মদ যোগ করা ঠিক হবে না।
— সে কি! কেনো! আমাদের দেশে অধিকাংশ পুরুষের নাম শুরু হয় মোহম্মদ দিয়ে, এ প্রথা যতটা না ধর্মীয় তার চাইতে বেশী কালচার। রেজাউলের নামের আগে মোহম্মদ থাকলে সমস্যা কি!

নোমানের মুখে হাসির রেখা, এলোমেলো চুলে আঙুল চালায়, তর্জনী দিয়ে চাঁদি চুলকায়, হাসিটাকে সামান্য বিস্তৃত করে বলে,
— কালচারের অংশ! কিন্তু কালচারের পাহারাদার আমাদের ক’জন প্রধান বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতি কর্মী আর সাহিত্যিকদের নামের আগে মোহম্মদ আছে! নামের আগে সৈয়দ বা আল ব্যবহারে আপত্তি নেই, নামের শেষে আহমেদ, ওসমান, রহমান ব্যবহারেও আপত্তি নেই, প্রথা মেনে নামের শুরুতে মোহম্মদ শব্দের ব্যবহার তেমন কই! সবাই তো আর প্রথাবিরোধী লেখক নন। এদের গল্প উপন্যাসের চরিত্রগুলোর অবস্থা অনেকাংশে একই রকম। রাজনীতিকদের নামের শুরুতেও মোহম্মদের ব্যবহার খুব কম।
— এটা উনাদের ইচ্ছাকৃত নয়, উনাদের নাম যেমন রাখা হয়েছে, তেমনই তো থাকবে।
— হেনা, উনাদের এসএসসি পরীক্ষার সনদপত্র দেখার ইচ্ছে হয়, সাহিত্য করতে এসে রইসুদ্দীনও এদেশে রইসু হয়ে যায়।

হেনা প্রতিবাদ করে ওঠে,
— ভাইয়া, কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করবেন না, উনি আমার খুউউউব প্রিয় লেখক ও বুদ্ধজীবী।
— আমিও উনার বিশেষ ভক্ত। কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করছি না, সমষ্টিগত প্রবণতাকে বুঝাচ্ছি।

হেনা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায়, বুঝতে চেষ্টা করে নোমান সত্য বলছে কি না। যুক্তি দিয়ে নোমানকে পরাভূত করতে চায়,
— আশ্চর্যকথা! গল্পের কোনো চরিত্র অনৈতিক কাজ করলে তার নামের শুরুতে ‘মোহম্মদ’ ব্যবহার করা যাবে না!
— যাবে না কেনো, অবশ্যই যাবে। তবে পুরস্কারের জন্য লেখা গল্পতে ব্যবহার না করাই ভালো। ব্যবহার করলে উগ্র ইসলামিস্টদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে, তাদের বক্তব্য হবে মুসলমানদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের জন্য রেজাউলের নামের আগে মোহম্মদ যোগ করা হয়েছে। ইসলামফোবিকরা বলবে, নায়ক মুসলিম বলেই অনৈতিক কাজ করছে, মুসলমান মানেই দুষ্টু। দুই পক্ষের কোনো পক্ষকেই প্রশ্ন তোলার সুযোগ দেওয়া যাবে না, এমন বিতর্কে পরিচিতি বাড়বে কিন্তু পুরস্কার সুদূরপরাহত।

হেনার কণ্ঠে দ্বিধা,
— এমনিতে তো গল্পের তেমন পাঠক নেই। এ গল্প কি অনেকে পড়বে?

নোমানের স্বরে দৃঢ়তা,
— প্রথমে এ গল্প খুব বেশী পাঠক পড়বে না, সাহিত্য পুরস্কার পেলে অনেকেই পড়বে। গল্প পড়ে তোমার ভক্তরা বলবে ‘অসাধারণ, বাংলা সাহিত্যে এমন গল্প লেখা হয়নি’, প্রতিদ্বন্দ্বীরা বলবে ‘অতি দুর্বল গল্প, এ গল্প পুরস্কার পায় কি করে?’ আর একদল সমালোচক এক জীবনে সঞ্চিত সমস্ত বিরক্তি চেহারায় ফুটিয়ে তুলে প্রশ্ন করবে, ‘এ গল্পে গল্পটা কই?’
— আচ্ছা, বুঝলাম।
— মন দিয়ে ফরমুলার বাকী অংশটা শোনো, গল্পটা রেজাউল করিম চৌধুরীর পরিবারকে ঘিরে। রেজাউলের বয়স সাকুল্যে পঞ্চাশ বছর। এ বয়সেও বলশালী শরীর। নাকের নিচে কলপ দেওয়া পুরু গোঁফ, তার ব্যক্তিত্ব ফোঁটাতে গল্পে গোঁফের ডিটেইলস জরুরী, সাথে মোটা ভ্রু’র ডিটেলস। স্ত্রী আর দুই ছেলেকে নিয়ে বিত্তবান ও প্রভাবশালী রেজাউলের সংসার। স্ত্রী চির রুগ্ন এবং প্রায়ই শয্যাশায়ী থাকে, তবে স্বামীর সুকর্ম ও অপকর্ম সবকিছু তার কানে আসে। স্বামীর সুকর্মে আনন্দিত হয়, অপকর্মে ভয়াবহ সব অভিশাপ দেয়।

হেনার নারীবাদী মন বুঝতে চেষ্টা করে রেজাউল করিমের স্ত্রীকেই কেনো রুগ্ন হতে হবে! বলশালী স্বামীর চির রুগ্ন স্ত্রী কি আধিপত্যবাদী সবলের সাথে নিরুপায় দুর্বলের সহাবস্থানের প্রতীক! অথবা স্ত্রীকে রুগ্ন দেখানো কি প্রকৃতপক্ষে নারীকে দুর্বল হিসেবে প্রতিষ্ঠার পুরুষতান্ত্রিক আচরণ! হেনা প্রশ্ন করে,
— স্ত্রীকেই কেনো রুগ্ন দেখাতে হবে?
— এ প্রশ্নের উত্তর তো খুবই সহজ, রুগ্ন স্ত্রীর কাছে ক্ষমতাবান সবল স্বামীর অপকর্ম গোপন থাকছে না। সে সবসময় স্বামীর অপকর্মের প্রতিবাদ করছে, বিদ্রোহ করছে। কিন্তু স্বামী মোটেও পাত্তা দিচ্ছে না। এ যে আমাদের সোসাইটির প্রতীক, রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের সাথে সাধারণ নাগরিকের সম্পর্কের ঘরোয়া সংস্করণ।
— বুঝতে পারছি।
— ইজমের দায় মেটাতে গল্পে যৌনতা আর নীতিহীনতা মানে মানব চরিত্রের অন্ধকার দিকের কিছু ছিটেফোঁটা মেশাতে হবে, তা না হলে বোদ্ধারা নাক কুঁচকে বলবে গল্পের মধ্যে পোস্ট মর্ডানিজম বা উত্তর আধুনিকতার ছোঁয়া নেই। গল্পে যৌনতার প্রয়োজনে রেজাউলের সংসারে দূর সম্পর্কের এক শালীকে আশ্রয় দাও, ধরা যাক তার নাম ফারজানা। ২৫ বছরের চোখ ধাঁধানো সুন্দরী শালীকে দেখলে রেজাউলের শরীর জেগে ওঠে। স্ত্রীর তীক্ষ্ম নজরদারির জন্য জাগ্রত শরীর বেশীদূর অগ্রসর হতে পারে না। গল্পের এ পর্যায়টাতে একটু ইয়োইয়ো খেলবে, রেজাউল এই বুঝি ঝাপিয়ে পড়ে, এই বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়ে পরিস্থিতি তৈরী করবে।

হেনা শব্দ করে হেসে ওঠে। পত্রিকা অফিসে দুপুরের ব্যস্ততায় সুর তুলে যায় হাসি। আশপাশের ডেস্ক থেকে দুই তিনজন চোখ তুলে তাকায়। অফিস বয় টেবিলে দুই কাপ রঙ চা আর প্লেটে চারটা বিস্কিট রেখে যায়, হেনা নিজেকে সামলে নিয়ে হাসি থামায়,
— শেষ পর্যন্ত ঝাঁপিয়ে পড়বে না!
— পড়বে তো অবশ্যই। তবে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত পাঠককে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ অস্থিরতার মধ্যে রাখতে হবে। গল্পে কমপক্ষে একটা দরিদ্র চরিত্র থাকতে হয়, আপাতত আশ্রিত ফারজানা ওই দরিদ্র চরিত্র। এক রাতে রেজাউল পেছন থেকে তাকে ঝাপটে ধরবে বা শাড়ির আঁচল ধরে টান দিবে — এ দু’টো আচরণেই বুনো দস্যুতা আছে, পাঠকের অবদমিত যৌন আকাঙ্ক্ষা দোলায়িত করার স্পন্দন আছে। আর সুরিয়ালিস্টিক করে উপস্থাপন করতে চাইলে এভাবে লিখতে পারো— ফারজানার বুকের ওপর কিছু একটা চেপে বসেছে, শ্বাস নিতে কষ্ট প্রচণ্ড হচ্ছে, বুঝতে পারছে না ও স্বপ্ন দেখছে না জেগে আছে। ঠোঁটে কামড়ের চাপ বাড়তেই তীব্র ব্যথা আর সিগারেটের উৎকট গন্ধটা একসাথে পায়, হাঁসফাঁস করতে করতে ঘরের হালকা আলোয় চোখ মেলে তাকাতেই দেখে ক’সেন্টিমিটার দূরে রেজাউল, না রেজাউল নয়, মাকড়সার বড় বড় চোখ। ওর বুকে লোমশ বিশাল মাকড়সাটা চেপে বসছে, বড় বড় লোমশ পা গুলো শরীরে কিলবিল করছে। মাকড়সার বিষাক্ত লালায় ভরে যাচ্ছে শরীর। ফারজানা হিস্টিরিয়ার রোগীর মত কাঁপছে।

নোমানের বর্ণনায় হেনার শরীর শিরশিরিয়ে ওঠে। ও মাকড়সা খুব ভয় পায়। ওর মনে হচ্ছে চেয়ার বা টেবিলের নিচে একটা মাকড়সা ওত পেতে আছে। সুযোগ পেলেই শরীর বেয়ে উঠতে শুরু করবে। চারদিকের দেয়ালে মাকড়সা আছে কি না দেখে নোমানের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়, এক মুহুর্তেরও কম সময়ের মধ্যে নোমান চোখ ফিরিয়ে নিলেও হেনা বুঝতে পারে নোমান ওর বুকের দিকে তাকিয়ে ছিলো। ওর কাছে নোমানের চোখ দু’টোকে ক’মুহুর্ত মৃত মাছের চোখের মত লাগে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নোমান বলে,
— গল্পের মধ্যে একটু মুক্তিযুদ্ধ মেশাতে হবে। আমাদের দেশে ওটাই ভালো গল্প যার মধ্যে প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিকভাবে দারিদ্র অথবা মুক্তিযুদ্ধ রয়েছে। তুমি রেজাউল করিম খানকে শান্তি কমিটির সদস্য বানিয়ে দাও, স্বাধীনতার পর রঙ বদলে সে আরও ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী হয়েছে।

নোমান সাদা কাগজে আঁকিবুঁকি আঁকছে আর বলে যাচ্ছে,
— কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে হেনা। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে অল্প সংখ্যক মানুষ। তাদের শক্তির উৎস ছিলো পাকবাহিনী। স্বাধীনতা অর্জনের পর পর এদের একটা অংশ রাতারাতি সিক্সটিনথ ডিভিশনের মুক্তিযোদ্ধা বনে যায়। বড় অংশটা পরাজয় মেনে সাধারণ মানুষের স্রোতে মিশে যায়। আকারে ছোট আরেকটা অংশ যে রাজনৈতিক স্ট্যান্ড থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিলো, ওই স্ট্যান্ড থেকে প্রকাশ্যে গোপনে রাজনীতিটা চালু রাখলো। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও তাদের প্রকট উপস্থিতি দেখানো হলে মোটেও প্রশ্ন তোলা যাবে না — তাদের রাজনৈতিক অবস্থান কেনো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠেছে? এ প্রশ্নও তোলা যাবে না, স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প সংস্কৃতিসহ সব কিছুর বিকাশ ও নিয়ন্ত্রণ তো মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির হাতেই ছিলো, তারা কেনো এদের প্রতিরোধে ব্যর্থ হলো।

হেনা বিষ্ময় গোপন করে না,
— সত্যি, এ প্রশ্নগুলো মনে আসছিলো। তবে দুটো বিষয় একটু পরিস্কার করেন- সিক্সটিন্থ ডিভিশনের মুক্তিযোদ্ধা কি? রেজাউলের বয়স পঞ্চাশ বছর, স্বাধীনতার বয়স পঞ্চাশ বছর, রেজাউল শান্তি কমিটির সদস্য হয় কিভাবে?

নোমান নতুন একটা সিগারেট ধরায়, বয়কে আরেক কাপ চা দিতে বলে। মন দিয়ে হেনাকে দেখে— হেনার বয়স কত আর হবে চব্বিশ বা পঁচিশ বছর। অথচ চোখে কিশোরীর উচ্ছসিত সরলতা। কাঁধ ছোঁয়া কুচকুচে কালো কোকড়া চুল, গোল মুখে চাপা নাক আর ফোলা গালের জন্য চোখের সরলতা পুরো মুখাবয়বে সংক্রমিত হয়েছে। কলাপাতা পাড়ের মাখন রঙা মনিপুরী শাড়িতে শ্যামলা হেনাকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে, বহু রঙা পালকে আবৃত কৌতূহলী এক ফিঞ্চ পাখি বসে আছে মুখোমুখি। নোমান নরম স্বরে বলে,
— একদল মানুষ যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিলো বা সম্মুখ সমরে অংশ নেয়নি বা কোনো পক্ষেই ছিলো না, ১৬ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় ধারণ করে, এরাই সিক্সটিনথ ডিভিশনের মুক্তিযোদ্ধা। তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ, মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর বয়সে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করা সার্টিফিকেটধারী চল্লিশ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া গেলে পঞ্চাশ বছর বয়সী শান্তি কমিটির সদস্য থাকবে না কেনো!
নোমানের তীর্যক বক্তব্যে হেনা আমোদ বোধ করে,
— মানলাম রেজাউল শান্তি কমিটির সদস্য ছিলো। গল্প কি এখানেই শেষ! মানে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর বয়স, কিন্তু এখনও সব অপকর্ম স্বাধীনতা বিরোধীরাই করে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা সর্বশক্তি দিয়ে অল্প কিছু স্বাধীনতা বিরোধীকে সামলাতে পারছে না, যুদ্ধ করেই যাচ্ছে যুদ্ধ করেই যাচ্ছে যুদ্ধ করেই যাচ্ছে। মানে মুক্তিযুদ্ধ চলছেই।
— মুক্তিযুদ্ধ একটা চলমান বিষয়, মুক্তিযুদ্ধ চলতেই থাকবে। কিন্তু এখানে গল্প থামালে বিদগ্ধ পাঠকরা বলবে, টুইস্ট কই! গল্পে টুইস্ট নেই কেনো!
— সত্যিই তো, এ গল্পে টুইস্ট কই?

নোমান মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
— গল্পে টুইস্টের যোগান দিবে রেজাউলের দুই ছেলে। রেজাউল অতি বদ লোক, সে অপরাধের শাস্তি পায়নি, কিন্তু প্রকৃতি চরম প্রতিশোধ নিবে। তুমি তার সবচে প্রিয় সন্তানটাকে হঠাৎ পাগল বানিয়ে দিবে, বদ্ধ পাগল।
— কি বলছেন এসব! প্রকৃতি কি এভাবে প্রতিশোধ নেয়, নোমান ভাই?
— না, নেয় না। প্রকৃতি বা আমাদের সৃষ্টিকর্তা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা সদা বিরক্ত এবং প্রতিশোধ পরায়ণ রগচটা সাইকো নন। পরম মমতায় যে বা যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, সে বা তিনি এতটা উন্মাদ নন যে একের অপরাধে অন্যকে শাস্তি দিবেন।

হেনা চমকে ওঠে,
— এমন করে বলবেন না, বিপদে পড়ে যাবেন। টুইস্ট’টা বলেন?
— প্রথম টুইস্ট রেজাউলের এক সন্তানের পাগল হয়ে যাওয়া। তবে বড় টুইস্টটা দ্বিতীয় ছেলেকে দিয়ে দেখাবে। রেজাউলের দূর সম্পর্কের আশ্রিত শালী ফারজানা এবং দ্বিতীয় ছেলে সমবয়সী, দু’জনের গভীর প্রেম।
— বলেন কি! এ তো মারাত্মক টুইস্ট।
— শুধু টুইস্ট’ই দেখলে, হেনা! এর মধ্যে ট্যাবু ভাঙা আছে, মানব মানবীর দুর্নিবার প্রেম আছে। গল্পের এ পর্যায়ে তুমি রেজাউলের প্রতি ঘৃণাটা গাঢ় করে দিতে পারো— রেজাউল যখন জেনে যায় ছেলের সাথে ফারজানার প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে, তখনই ফারজানার শরীরের প্রতি তার লোভ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে।

গল্পের ফরমুলা হেনার পছন্দ হয়েছে, নিখিলবঙ্গ প্রগতিশীল সাহিত্য পুরস্কারের জন্য গল্প পাঠানোর শেষ তারিখ আগামী মাসের ২২তারিখ, হাতে প্রায় মাস খানেক সময় রয়েছে। গল্পটা নামিয়ে ফেলা যাবে। হেনা জানতে চায়,
— গল্পের শেষটা কি হবে?
— ফারজানা, রেজাউল বা রেজাউলের দ্বিতীয় ছেলে— এদের যে কোনো একজনকে খুন করে গল্পটা শেষ করা যায়, কিন্তু আরও কিছু অতি জরুরী উপাদান বাকী রয়ে গেছে।
— কি উপাদান?
— সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, দারিদ্রের কষাঘাত, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন।

আকাশ থেকে পড়ার দশা হেনার,
— এক গল্পে এতকিছু! কিভাবে সম্ভব!
— খুব সহজেই সম্ভব। বাবার কু-কর্মের কথা জেনে ফারজানাকে নিয়ে রেজাউলের ছেলে পালাবে। বাস ছুটছে। রেজাউলের ছেলের মনে হবে গত সরকারের আমলে একবার এ রাস্তা দিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলো। ভাঙা রাস্তায় অনবরত ঝাঁকির কারনে পেট ব্যথা হয়ে গিয়েছিলো। এখন কোনো ঝাঁকি নেই, রাস্তাগুলো যেনো মাখন দিয়ে তৈরী। আর কিছুক্ষণের মধ্যে বাস পদ্মা সেতুতে উঠবে। এই সেতুটার বিরুদ্ধে কত আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র যে হলো, সব ষড়যন্ত্র নস্যাত করে প্রধানমন্ত্রী সেতুটা তৈরী করে দিলেন। রেজাউলের ছেলে ফারজানার ঘুমন্ত মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাসের জানালা দিয়ে তারা ভরা আকাশ দেখবে, সে জানে তারার ভিড়ে জেগে আছে স্যাটেলাইট, সে স্যাটেলাইট কি জানে পৃথিবীর সবচে রূপবতী মেয়েটা তার পাশে বসে আছে। বাস পদ্মা সেতু পাড়ি দিচ্ছে, পদ্মার স্রোতে আলোর নান্দনিক খেলা। কাঁধে মাথা রেখে ঘুমের গভীর সমুদ্রে সাবমেরিনের মত ডুব সাতার দিচ্ছে ফারজানা, বাসের স্পিকারে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা গাইছেন ‘এমনি করে যায় যদি দিন যাক না।’

হেনার মনে প্রশ্ন জাগে — নোমান কি রসিকতা করছে! কিন্তু চেহারা দেখে আর কণ্ঠস্বর শুনে তা মনে হচ্ছে না। নোমান এশট্রেতে ঘষে সিগারেটের আগুন নেভায়, ফিল্টারটা ভিতরে ফেলে বলে,
— অসাম্প্রদায়িক চেতনার অংশ হিসেবে রেজাউলের ছেলে এক হিন্দু বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নিবে। বন্ধুটি ওদের সেবাযত্মের চূড়ান্ত করবে। কাজী ডেকে বিয়ে পড়াবে। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী মিলে নফল নামাজ আদায় করবে, হিন্দু বন্ধুটি ওই সময় ঘরে দেব-দেবীর মূর্তি ও ছবিগুলো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিবে, যাতে নামাজ আদায়ে সমস্যা না হয়।

— বাহ! বাহ! বেশ বলেছেন। পরের অংশটা মনে হয় ধরতে পারছি। এ সংবাদ রেজাউলের কানে পৌছাবে, রেজাউল ছেলেকে শায়েস্তা করতে হিন্দু পাড়ায় আক্রমণ চালাবে। ঘটনা গড়াবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায়। এই তো?
— ঠিক তাই। হামলার পাশাপাশি অভাবগ্রস্ত হিন্দু মুসলমানদের ফোকাস করে গল্পে দারিদ্রের কষ্টের ছবি আঁকবে। তবে দারিদ্রের কারণ বা রেজাউলের ক্ষমতার উৎস সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না। রেজাউল এমনি এমনি ক্ষমতাবান, ক্ষমতাসীন কারো মমতার ছায়া তার ওপর নেই, থাকলেও তা বিরোধী দলের।
— নোমান ভাই, তাই হবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭মার্চের ভাষণ কি সত্যিই এই গল্পে প্রাসঙ্গিক? গল্পের প্রয়োজনে ব্যবহার হবে!

নোমান হাই তুলে, মোবাইল অন করে সময় দেখে, সাদা কাগজে আঁকিবুঁকি করতে করতে বলে,
— পুরস্কারের জন্য গল্প লেখা হচ্ছে— এ গল্পে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থাকবে না! গল্পের প্রয়োজনেই তো সবকিছু আসছে, ভাষণও আসবে। হিন্দু পাড়ায় হামলার পর হিন্দু এবং মুসলিম প্রতিবেশীরা মিলে হামলাকারীদের প্রতিরোধ করবে। প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিবে রেজাউলের ছেলে, তার মনে বেজে চলবে বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত কণ্ঠের ভাষণ, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
— গল্পের শেষটা কি হবে?
— গল্পটা বেশ ক’ভাবে শেষ করা যেতে পারে, যেমন রেজাউলের ইন্ধনে সংঘটিত হামলায় ছেলে মারা যাবে, ফারজানাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবেনা। অথবা, রেজাউলকে বিষ খাইয়ে হত্যা করে আত্মঘাতী হবে স্ত্রী। আরও ভয়াবহও শেষ হতে পারে, রেজাউলের ছেলে মারা যাবে, ফারজানার গর্ভে বেড়ে উঠবে রেজাউলের সন্তান।

হেনা বলার মত কোনো কথা খুঁজে পায় না, নোমান তাকে উদ্ধার করে,
— গল্পের ঝোপ বুঝে সীমিত পরিমাণে কাফকা, মারকেজ আর চমেস্কির কোপ মারতে হবে। তুমি আগে গল্পটা লিখে ফেলো, তারপর ঝোপ বুঝে বুঝে লাগসই কোপ মারা যাবে।

হেনা হ্যা সূচক মাথা নাড়ে, আগ্রহ ভরে জানতে চায়,
— আচ্ছা, রেজাউলের ছেলে মানে দ্বিতীয় ছেলের নাম কি দিবো? আর, নোমান ভাই, গল্পটা আপনি লিখছেন না কেনো?

কিছুক্ষণ কি যেনো ভাবে নোমান, চোখ থেকে চশমা খুলে টেবিলে রাখে, হেনার চোখে তাকিয়ে বলে,
— দ্বিতীয় ছেলের নাম দিও নোমান, নোমান করিম। আর রেজাউলের ছেলেদের এমন গল্প লিখতে নেই।

নোমানের এ কথা কি শুধুই টুইস্ট! ইংগিতপূর্ণ রসিকতা! অথবা নিরেট বাস্তবতা— হেনা একই সাথে বিভ্রান্ত, বিস্মিত এবং আশ্চর্যান্বিত। টেবিলের অপরপাশে এ ফোর সাইজের সাদা কাগজের এক পিঠে আঁকিবুঁকি শেষে অপর পিঠে আঁকিবুঁকি কাটছে জনপ্রিয় দৈনিকের তরুণ সাহিত্য সম্পাদক নোমান করিম।

ম্যা’ক্রেটিস

‘২টা মাঝারি সাইজের বুদ্ধিজীবি বিক্রয় করা হবে। ঘাড়ের হাড্ডি নরম, সহজেই সামনের দিকে ঝুঁকে যায়। মেরুদণ্ড ফ্লেক্সিবল। হাতের রেখা মুছে গেছে। দীর্ঘদিন পাম ওয়েল বিক্রি এবং ম্যাসেজ পার্লারে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে।’ বুদ্ধিজীবী দু’জন বিমর্ষ দৃষ্টিতে বিজ্ঞাপনটির দিকে তাকিয়ে আছেন। দেশের জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকায় টানা ৩দিন ধরে বিজ্ঞাপনটি ছাপানো হচ্ছে, কিন্তু কেউ যোগাযোগ করেনি। কারোই বুদ্ধিজীবী কেনার আগ্রহ নেই।

চাহিদা হ্রাস পেলে পণ্যের দাম কমে- চাহিদা ও যোগান তত্বের ওপর দীর্ঘ আলোচনা শেষে নির্ধারিত হলো তিন দিন বিরতি দিয়ে ফের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। তবে এবার প্রথম লাইনটার আগে যোগ হবে, ‘একটা কিনলে আরেকটা ফ্রি।’

নতুন করে বিজ্ঞাপন প্রকাশের দিনেই প্রথম কল এলো। স্পিকার চালু করে কল রিসিভ করলেন বুদ্ধিজীবীদের একজন-

: হ্যালো। কে বলছেন?
: আমি মোয়াজ্জেম। গাবতলী হাটের গরুর লবিস্ট।
: গরুর লবিস্ট মানে!! আপনি কি গরুর দালাল?
: জ্বি, স্যার। ওই একই হইলো।

প্রচণ্ড বিরক্তি এবং তুমুল কৌতূহল নিয়ে বুদ্ধজীবী জানতে চাইলেন-
: আপনি এখানে ফোন করেছেন কেনো?
: স্যার, একটা রিকুয়েস্ট – দয়া কইরা বিজ্ঞাপনটা আর ছাপায়েন না। পেটে লাত্তি মাইরেন না।
: শাট ইউর মাউথ স্টুপিড। আমরা বিজ্ঞাপন ছাপালে তোর সমস্যা কি!

এসব গালিগালাজ গায়ে না মেখে মোয়াজ্জেম কান্নাজড়িত স্বরে বললো-
: স্যার, আপনাদের বিজ্ঞাপনের কারণে ভেড়ার বাজারে ধ্বস নামছে। ছাগলের দাম কইমা গেছে আর
মোয়াজ্জেমকে ‘ফাক ইউ’ বলে গালি দেবার আগেই মোয়াজ্জেম যোগ করল-
: আপনাদের দুইটারে গরুর হাটে বলদ হিসাবে বেঁচতে তুললে ব্রয়লার মুরগির দাম দিয়াও কেউ কিনবো না।

সব কথা গায়ে মাখলে, গুরুত্ব দিলে বুদ্ধিজীবী হওয়া যায় না। বুদ্ধিজীবী হওয়া কি সহজ কথা! বুদ্ধিজীবীতা এক অতিপক্ক কাঁঠাল, কোষ গলে ল্যাদল্যাদে, বহু বিঁচির গর্বে বলীয়ান ভুতি গরুর প্রিয় খাদ্য, মাছির আবাস।

কওওও

এই শহরে কেউ কথা বলেনা, তবু সব কথা ছড়িয়ে যায় কানে কানে।

মন্ত্রী পরিষদ জিরাফের দামে খরগোশ কেনার সিদ্ধান্ত নিতেই রাজ্য জুড়ে হুহু হাওয়া বয়ে যায় –‘চুপ.. চুপ.. চুপ… বিনে পয়সায় তো আর কিনেনি.. চুপ.. চুপ.. চুপ… খরগোশ বড় হলেই জিরাফ হয়…।’ হাওয়া জানে এই শহরে কেউ কথা বলেনা, এই বলা তার অভ্যাসের দায়।

সিংহাসনের গদিতে মখমল লাগানোর জন্য ডলফিনের দামে সমুদ্রটা বেঁচে দেবার আগে রাজা বললেন, ‘মহাকাশে গড়ে তুলবো প্রজাপতির খামার, মেঘে মেঘে বুনে দিবো সমুদ্রের বীজ- এ নিয়ে আর কোনো কথা নয়।’ রাজাও জানেন এই শহরে কেউ কথা বলেনা, এই বলা তার অভ্যাসের দায়।

সেদিন সন্ধ্যায় আকাশ লাল। ক’দিন ধরেই গুমোট গরম চলছিলো। আকাশের লাল ও গুমোটের গরমে এ শহর প্রতিক্রিয়াহীন, শুধু হাওয়ার অস্বস্তি– ‘চুপ.. চুপ.. চুপ.. প্রজাপতির খামারে আগুন লেগেছে, সমুদ্রের বীজগুলোকে ভস্ম করে দিচ্ছে তাপ.. চুপ.. চুপ.. চুপ.. ভস্ম ছড়ালেই সমুদ্র হয়…।’

সন্ধ্যা শেষে নামে বৃষ্টি, তুমুল ঝমঝমিয়ে। রাজবাড়ির দেয়ালে ঠেসে ধরে প্রজাপতিমন্ত্রীকে গুলি করে কারাগার ভাঙা তিন কয়েদী। প্রজাপতি মন্ত্রীর ছটফটানো পাখায় থুথু দিতেই জিরাফ মন্ত্রীর বিশাল গলা শুকোরের মত ছোট হয়ে আসে, তীব্র শ্বাসকষ্টে খাবি খেতে খেতে দেখে রাজাকে গিলে খাচ্ছে ডলফিন। উথাল পাথাল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে রাজপ্রাসাদ।

এই শহরে কেউ কথা বলেনা, তবু সব কথা ছড়িয়ে যায় কানে কানে। তাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হাওয়া সম্বিৎ ফিরে পেতেই বয়ে যায়, বয়ে যেতে যেতে বলে যায় ‘চুপ… চুপ.. চুপ.. … চুপ.. চুপ.. চুপ… চুপ.. চুপ.. চুপ..।’ কথা না বলার অভ্যাস ভুলে বহুদিন পর ডেকে ওঠে এক বউকথা পাখি, ‘কেউ কথা কও.. কেউ কথা কওও.. কওওও…।’

শোয়া-পণ্ডিতের গুষ্টি

তিন
আপনি তো বাজারে চলে গেলেন, এদিকে ছেলে আবার চোখ উলটোয় পড়িছিল।
তারক ডাক্তার স্টেথো দিয়ে রোগির বুক-পিঠ ছেনে যথারীতি বাঁহাতে তার কবজি ধ’রে নিজের রিস্টওয়চে ডুবে গেছে। আর দিদিমার বুক ঢিপ ঢিপ, তারক সেই উদ্‌ভুট্টি কথাটা ব’লে বসবে না তো — ঘ্যাঁজ্‌ড়া?

জর্দাপানের গন্ধলাগা পুরিয়া নির্মলের হাতে ধরিয়ে ডাক্তার চলে গেল। তা থেকে এইটুকুন হাফ ট্যাবলেট “ওঁ বিষ্ণু ওঁ বিষ্ণু” ক’রে খাইয়ে দিতেই গায়ে নড়াচড়া লেগে চাঁদের হাঁচি পড়ল একটা। নির্মল বলল, জীব!
কাহিল গলা শ্বাস টানতে টানতে জিগ্যেস করে :
— জীবো মানে কী?
— মানে জীব সহস্রং, হাজার বছর বেঁচে থাকো।
— কেউ হাঁচি দিলি আপনি বাঁচতি বলেন কেন?

উত্তর নেই। আলাম্‌-ফালাম্‌ কথা না ক’য়ে চোখ বুজে এট্টু শুয়ে থাক, বলে মায়া রান্নাঘরে পা বাড়ায়। ছেলে চোখে পলক টেনে দেয়, কিন্তু ভ্রূ কুঞ্চিত থাকে।

মায়ার পড়াশুনো প্রাইমারি স্কুলের চার কেলাস; ওই জ্ঞানবলে সে যে-কোনও বাংলা বই সগৌরবে পড়ে ফেলতে এবং পরিচ্ছন্ন চিঠি লিখতে পারে। তার ওপর শ্রুতি-বিদ্যেয় মহিলার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া মুশকিল — বড় বড় রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন দত্ত বা কুসুমকুমারী ভাতের মাড় গালতে গালতেও টর-টরিয়ে ব’লে যাবে।
শুধু সেলাইফোঁড়াইটা বিশেষ আসে না ব’লে মায়ের ঠেলা খেয়ে জন্মের-মধ্যে-কর্ম একখানাই কুরুশকাঠির আসন বানিয়েছিল। সেটা বড়ঘরের দেওয়ালে ঝুলছে — মুখোমুখি দুই সুতোর ময়ূর আর লেজের নীচে “বেদনার সাধনায় যে জন নির্ভয়, আজ হোক কাল হোক জয় তার জয়”। বর্গীয় জ-এর মাকড়ি কাঁচা হাতের টানে আ-কার হয়ে যাওয়ায় সঞ্জু প্রায়ই তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে পড়ে — বেদনার সাধনায় যে ডান নির্ভয়, আডা হোক কাল হোক ডায় তার ডায়। ছেলে তো না, এট্টি পাকা কলা!

শোনা-বিদ্যেয় ধুরন্ধর মায়া জানত, অথর্ব বেদে বলা আছে — কেউ হাঁচি দিলে ওমনি জীব সহস্রং উচ্চারণ ক’রো, কেননা হঞ্ছিকাকালে মানুষ মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যায়। বাবা সে-কথা ভাঙতে চায়নি অসুস্থ ছেলের কাছে।

চার
— বন্ধুগণ, আগামি কাল সন্ধ্যা ছ’ঘটিকায়… আসুন দেখুন… দশরথ কেঁদে কেঁদে অন্ধ, ভরত শোকে পাথর… মা ইচ্ছাময়ী অপেরার পরিচালনায়… ধনীর দুলালি সীতা আজি পথের ভিখারি…কলোনির সমস্ত অধিবাসীবৃন্দের অনুরোধে… আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হল… রামের বনবাস, রামের বনবাস, রামের বনবাস।
মুখের সামনে খবরের কাগজের চোঙা ধ’রে ক্ষয়াটে চেহারার একজন ভ্যানরিকশায় যেতে যেতে চেঁচাচ্ছে। যেখানে দু’চারটে বাড়ি বা রাস্তার তেমাথা, সজনেগাছের গায়ে বিজ্ঞাপনের কাগজ চিটিয়ে দিচ্ছে লোকটা। তারপর ভ্যানের পেছনে ছোটা বাচ্চাদের একটা পোস্টারের জন্যে আবেদন অগ্রাহ্য ক’রে :
— একই সন্ধ্যায় রূপসী সীতা ও রাক্ষসী শূর্পনখা… সকলের বসিবার সুবন্দোবস্ত… হ্যাজাকের আলোয় দেখুন এই প্রথম গ্রামের মঞ্চে সোনার হরিণ… তাছাড়া ফুলুটে মালতীপুরের খলিফা শিল্পী স্বদেশ পাল… পালা শেষে মুক্ত হস্তে মালা-ডাকের সুযুগ আছে…।

— দিদ্‌মা, আমি রামযাত্রা দেখতি যাবো।
— যাবাই তো। বুকির কষ্ট এট্টু কি কোমিছে, দাদাভাই?

চাঁদ সোয়েটারের ওপর দিয়ে গলার অস্থি এমন আলতো ছোঁয়, যেন সাত দিনের বাসি গোলাপ, দোকা লাগলেই পাপড়ি ঝরে যাবে। তারপর দুবার নিঃশ্বাস টেনে চোখ বড় ক’রে বলে, ব্যথা লাগতিছে না! ঝুপড়ি ভেঙে রাস্তা পাকা করার মতো তার বুকের খাঁচার মধ্যে ফুসফুস হৃদপিণ্ড সব উড়িয়ে দিয়ে শুধু একটা তেলমাখা ঝাঁ-ঝাঁ করা ন্যাশানাল হাইওয়ে, যার ওপর বাতাসের অনন্তপ্রসূন শুধু ফুটেই চলেছে… কড়াইতে উচ্ছ্বসিত খইয়ের মতো। দিদিমা নিজের কপালে যুক্তকর তুলে আনে — জয় মা বিপত্তারিণী! তারকের ওষুদি কথা কয়! তখন বাসু বুড়ির কাঁধ জড়িয়ে ধ’রে ফিসফিসিয়ে জানাচ্ছে, ওষুধে কথা কোতি পারে, কিন্তু জানো, যে হাতঘড়িতি ডাক্তারবাবু রুগির নাড়ি পরীক্ষে করে, সেটা ডাহা অচল; সকালবেলা আড়াইটে বাজে ব’সে আছে। মা সরস্বতীর দিব্যি!

পাঁচ
— আমার চোখের দিকি তাকায় বল, রান্নাঘরে ঢুকে তালের ফোপ্‌ড়া খাইছিস?

চার ভাইবোন দাঁড়িয়ে, মা এক এক ক’রে জেরা করছে। যে হেসে দেবে, সে চোর।
— ভাইয়ের জ্বর ব’লে তার ভাগেরটা রাখে দিছিলাম, সেও গিলতি হ’লো!
আজ শিউলি হেসেছে, কিন্তু কথায় কথায় ফুটফুটে দাঁত দেখায় ব’লেই না সে শিউলি। সঞ্জুকে যেমন “ঘুর ঘুর স্ট্যাচু” খেলাতেও হাসানো যায় না, তার মানে সে সাধুপুরুষ? মা বিরক্ত হয়ে চার বাচ্চাকেই চড়াচ্ছে।

তারপর — বাসু, আমতলাত্থে আমের ডালটা উঠোনে নিয়ে থো, বাবা কুড়োল দিয়ে ফাড়ে দেবেনে। কয়লা ফুরোয় গেছে — ব’লে মায়া চাঁদের কপালে গাল ঠেকিয়ে জ্বর আছে কিনা দ্যাখে।
বাসু ওমনি মারধর ভুলে ভারি আমডালের এক দিক উঁচু করে “মাগো আমার দে না কেন একটি ছোটো ভাই” বলতে বলতে খানিকটা ছেঁচড়ে আনল, দম নিয়ে “দুইজনেতে মিলে আমরা বনে চলে যাই” ব’লে আরও খানিকটা। এভাবে কবিতা ফুরোতে ফুরোতে কাজও শেষ। কিন্তু আরও একটা ছোটো ভাইয়ের শখ নাকি বাসুর? আপ্‌নি শুতি ঠাঁই পায় না, শংকরারে ডাকে!

রান্নাঘরের উঁকি মেরে গোপা দেখল, মা ঠোঁটে হাসি চেপে জ্বাল দেওয়া দুধ একটা কাপে ঢালছে। ঘর জুড়ে যেন শিশুর মুখের গন্ধ…।
— মা, আমার পেটে কিচ্ছু নেই!
— সে কি, অ্যাক্‌খুনি চিঁড়ে দিয়ে কলা দিয়ে খালি যে?
— আমার দুধির ক্ষিদে পাইছে।
মায়া প্রথমে চোখ পাকায়, তারপর হাতছানি দিয়ে মেয়েকে ডাকে, ডেকচি থেকে দু’হাতা দুধ ব’ক্‌নো থালায় ঢেলে ফুঁ দিয়ে হাতে ধরিয়ে ভর্ৎসনা করে : সব দৃষ্টিক্ষিদে। মুখ পুড়োস না। খায়ে চুপ ক’রে বেরোয় যাও।… আগে ঠোঁট মোছ, ঠোঁট মোছ!

ছয়
কাপের দুধে চুমুক দিতে দিতে কাঁথা-গায়ে চাঁদ জানলার ফোকর দিয়ে রাস্তা দেখছিল। সুপুরিগাছের শুকনো খোলার ওপর একটা কচি বাচ্চাকে বসিয়ে তিনটে খুদে টানছে। হ্যাঁচকা টান খেয়ে সে পেছনে উলটে প’ড়ে অপরিমেয় কাঁদতে লাগল। একটা ছেলে চলে গেল চটপটি বাজাতে বাজাতে। মনিদাও খুব সুন্দর চটপটি বানায় — কলাপাতার মোটা ডাঁটি এক-হাত মতো কেটে নিয়ে তার এক মাথা দা দিয়ে লম্বালম্বি তিন ভাগে চিরে দুপাশের ফালিদুটোর গোড়া একটু ভেঙে নিতে হবে। এবার ডাঁটির আর এক মাথা ধ’রে ঘন্টা বাজানোর মতো নাড়লেই চটপট চটপট…। এইসব লোক-চলাচলের ফাঁকে দেখা যাচ্ছে রাস্তার ওপিঠে চন্ডীবাবুদের জমিতে গেঞ্জি আর লুঙি পরা মানুষটাকে; দুটো ইঁটের ওপর ব’সে সামনের দুটো ইঁটে পা বিছিয়ে দু’পায়ের পাতার মাঝখানে ঝামা ইঁট রেখে হাতুড়ি চালাচ্ছে। তিনবার চারবার বাড়ি খেয়ে ইঁট শোকে পাথর না থেকে ভেঙে পড়ছে, হয়ে যাচ্ছে খোয়া।

এমনি ক’রে আস্তে আস্তে ছোট্ট খোয়াটিলা তৈরি হচ্ছিল আর লোকটাও ভেসে উঠছিল টিলার মাথায়… মাটি থেকে তার দূরত্ব বাড়ছে ধিকিধিকি। প্রত্যেকবার হাতুড়ির ঘায়ের সঙ্গে হ্যাহ্‌ নামের একটা গোঙানি বা গর্জন মিশিয়ে দিচ্ছে আর চাঁদের কানে সেই শব্দজোড় পৌঁছোচ্ছে হাতুড়ি ইঁটে পড়ার ভগ্ন-মুহূর্ত পরে। এভাবে সকালে যে ভূমিপুত্র, দুপুরে ভাত খেয়ে এসে তুমি দেখলে কিছুটা পাহাড়ি, আর বিকেলে খেলতে বেরোনোর সময়ে সে গোঁফেগেঞ্জিতে লাল সুরকি লাগা খোয়া-হিমালয়ের ঈশ্বর, শান্তিমতো একটা বিড়ি ধরাচ্ছে। ওদিকে রাস্তার ধারে কোনও বাচ্চা উবু হয়ে বসল, ন্যাংটো পাছার নীচে হলুদ ধোঁয়া-ওঠা অজগর-পাক, শেষে ছুঁচোলো ফনাটা। জানলায় মাজালি বিড়বিড় ক’রে চরে বেড়ায়, এখন রোদ্দুর গোধূমবর্ণ ত্যাগ ক’রে অল্প অল্প চাঁটি মেরে আমাদের পিঠ গরম করার উপযুক্ত। সেই অনবরত ধূপছাঁওয়ের মধ্যে একটা ঝিমধরা খট খট আওয়াজ শোনা গেল। পদপাতহীন কেঠো পা নিয়ে চাঁদের আমতলাবাড়ির পাশ দিয়ে বিজুখোঁড়া দুলে দুলে হেঁটে যাচ্ছে স্টেশানের দিকে।

(আর একটু)

শোয়া-পণ্ডিতের গুষ্টি

এক
নিবাধুইয়ের সবজি বাজারটা কেমন যেন কম-রোশনি, চোখ-বোজা, মরা-মরা। ইঁটের দাঁত বের করা পিলারের ওপর টালির চাল, নীচে কাঁচা এবড়ো-খেবড়ো মাটিতে একটা চটের বস্তা পেতে ব’সে দুতিনটে বস্তার ওপর আনাজের ডাঁই তুলেছে দোকানদাররা, বিক্রির টাকাপয়সা চালান করছে হাঁটুর নীচে চাপা অন্য একটা দুভাঁজ করা বস্তায়।

আলু-পেঁয়াজের লাটের সামনে উবু হয়ে সওদা বাছছে লোকজন, তার মধ্যে লং ক্লথের সাদা পাঞ্জাবি আর ধুতির ওই যে নির্মলচন্দ্র। জাহাজের মতো একজন খদ্দের হেলেদুলে এসে হাতের ডিবে থেকে চুন খুবলে লাল জিভে মাখিয়ে নিয়ে জিগেস করল, আলু ক’পহা? দোকানদার ব্যস্ত হয়ে হাতবোমা সাইজের আলুগুলো বেছে চুপড়িতে তুলতে তুলতে জবাব দিল, ক’কেজি লাগবে বলুন, মুখুজ্জেদা। হুগলি হাটের পাল্লা-দরে দিয়ে দোবো।

ওমনি পেছনে একটা ধাবমান আওয়াজ শোনা গেল, আলু ক’পহা? তোর বাপের পহা? ঢলঢলে ধুলোমাখা শার্টপ্যান্ট পরা, কোমরে নারকোল-দড়ির বেল্ট, হাতে কঞ্চির লাঠি — সীতাপাগলি হুশ করে বেরিয়ে গেল। বাজারের ও-মাথায় পৌঁছে কুচকাওয়াজরত সৈন্যের মতো মুখ ঘুরিয়ে ফিরে আসতে লাগল, মুখে সেই মন্ত্র, তোর বাপের পয়সা?

এই বাজারপাড়াতেই উন্মাদিনীর বিচরণ; বর কলেরায় ফৌত হওয়ার পরে ছেলেকে নিয়ে থাকত; কিশোরপুত্র রাস্তায় লরিচাপা পড়ায় সীতা রাতারাতি পাগল হয়ে যায়। তবে নির্মল দেখেছে, অনেক সময় গ্রামের গরীব মানুষেরা মাথাখারাপ হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। টিফিনে রুটিটা-মুড়িটা কি দুপুরে দুটো ভাত যেভাবে হোক নসিব হচ্ছে তাদের। ফলে কোনও কোনও খ্যাপা আপনা থেকে সুস্থ হয়ে গেলেও খ্যাপামির ভেক ছাড়তে চায় না। নির্মল দেখে বুঝতে পারে, অভিনয়ের ফাঁকে কখন তারা ব্রেক নেয় অথবা কখন পাগল ফাঁকি দিচ্ছে পাগলামিতে।

আলুর দোকান থেকে দু’নয়া ভিক্ষে পেয়ে সীতা চলে গেছে পারিজাত টকিজের দিকে, নির্মল ঢুকল মাছবাজারে। শোল, চ্যাং, কই, কাঁকড়া, কচ্ছপ আর প্রচুর পুঁটি-মৌরলার ঢেউ পার হয়ে তবে মাটির হাঁড়ি নিয়ে বসা মেছুনি। মেয়েটা তিতিলের সরা তুলতেই গোল্লা পাকানো চারটে গাঢ় বাদামি সর্পপ্রতিম কুচে মাছ; তা থেকে সবচে’ প্রশস্তটি নির্মল কিনে নিল থোক দামে। কুচেমাছ খেলে গায়ে রক্ত হয়, তাকে গরম মশলা দিয়ে মাংসের মতো রাঁধতে হবে। তার আগে কুচের গলা বরাবর গোল ক’রে পোঁচ দিয়ে গোটা চামড়াটা লেজের দিক দিয়ে টেনে ছাড়িয়ে ফেলাই হল আসল ক্যাপাকাইটি! আঁশ-নিরামিষ যাতে ঠেকে না যায়, দুই হাতে দুই ব্যাগ ঝুলিয়ে নির্মল বাজার থেকে বেরোতে যাবে — “আ রে, পণ্ডিতমসাই, পাঁটার মাংস কিনেছেন ভালো কতা, আমরা তো আর আব্‌নার বাড়ি যাচ্ছিনে নেমন্তন্ন খেতে। তাড়া কীসের?”

সুধাময়… ট্রেনে তারা এক বগিতে বারাসাত যাতায়াত করে। ব্লক-অফিসে-চাকরি সুধা ভাবতে পারবে না মাসের এগারো তারিখেও নির্মলের বেতন হয়নি। আজ ঘর-কুড়িয়ে টাকাক’টা হাতে দেওয়ার সময় মায়া জানিয়ে দিয়েছে, আগামি কাল থেকে মাইনে না পাওয়া পর্যন্ত বাজার বন্ধ।

সুধাময় তার অসন্তুষ্ট হাসিটা হাসে :
— সান্তিপ্‌পিয়ো মানুস, এক মনে সঙ্‌সার কোচ্ছে। আজকের নিউজপেপার পড়েছ?

রবিবারের খবরের কাগজ নির্মল পরের দিন স্কুলে গিয়ে পড়তে পায়। তাদের বাড়িতে রেডিয়ো নেই।

—তাসখন্দো চুক্তি সই হয়ে গেল জানো নাকো! রাসিয়ার পেসিডেন্ট তো ভারতের হাতে হারিকেন ধরিয়ে দিয়েছে। দুই দেসের সোন্নোদেরকে নিজের এরিয়ার ফিরে যেতে হবে বলো।
— ভালোই তো হয়েছে।
— কী বলছ, মাস্টার? আজাত কাস্‌মির দখলের এত বড় চান্স হাতছাড়া হয়ে গেল! পাকিস্তানও সাওস পেয়ে গেল।

সুধাময় যে কীসে খুশি বোঝা মুশকিল। যুদ্ধ যখন বাধে সেই অগাস্ট মাসে, বলেছিল মানুষ এবার না-খেতে পেয়ে মরবে। আবার এখন থামাতে চাইছে না। হাঁটতে হাঁটতে তারা সিনেমাহলের উল্টোদিকে বিজু খোঁড়ার চা-দোকানে হাজির হয়েছে। পায়ের-পাতাহীন কাঠের পা-টা পাশে খুলে রেখে বিজু তোবড়া মুখে জমিদারের মতো বিড়ি টানে, আর তার বেঁটে-বামন বউ শান্তি চা বানিয়ে একটা অ্যালুমিনিয়ামের ট্রেতে গেলাসগুলো বসিয়ে ছুটছে দোকানে দোকানে — মেহবুব রেডিয়ো-সারাই, পাশে সেলাই-মেশিন নিয়ে বসা চিরকেলে কথার খেলাপি হারাধন দর্জি, তারপর গমকলের সাধুখাঁ, আদ্যাশক্তি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, পারিজাত হলের লাইটম্যান মোটরম্যান, এইসব।

বিশ্‌কুটের যুদ্দো… চায়ের যুদ্দো… ফুলুরির যুদ্দো…সন্নেসের যুদ্দো — কখন সীতাপাগলি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতের এস-বিস্কুটখানা তাকে সঁপে দিয়ে বিজুর বউকে আর একটা চা দিতে বলে নির্মল। শান্তি গেলাসে চামচ নাড়তে নাড়তে টাকরায় চটাস আওয়াজ করে : নামেতেই মেয়েটাকে খেয়ে নিল, বুয়েচেন? সীতা নামে ওবিসাপ নেগে আচে।

এসবে ভ্রূক্ষেপহীন সুধাময় বকবক করেই যায় :
— আমাদের উচিত ছিল লাহোর এয়ারপোর্ট কেড়ে নোয়া। পাকিস্তান যদি জম্মুর আকনুরের দখল পেতো, তাহলে আমেরিকা রাসিয়া কারও কথাতেই ভারত ছাড়ত না — আমি তোমাকে লিকে দিচ্ছি, মাস্টার।

বাড়ির গেটে বুগেনভিলিয়ার ডালের মতো একটা সামনে ঝোঁকা লোক দাঁড়িয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। সে বলল, আয়ুব খান বলেছেল হিঁদুরা জ্যাগামতো দুএকটা শক্ত ঘা খেলিই ভেঙে পড়বে। ব্যাটা কচি-র হাতের খেলনা পেয়েচে!

সুধাময় জবাব দিল, খেলনা নয় তো কী? মনে নেই, গত সালের এপ্পিল মাসে কচ্চের রানে অ্যাটাক করেছিল পাকিস্তান? বলে, কচ্চের সাড়ে তিন হাজার মাইল এলাকা নাকি ওদের। তাই নিয়ে ইংল্যান কমিসান বসিয়ে দিয়েছে। দ্যাকো, সেকানে আবার কী হয়!

বুগেনভিলিয়া বলে, সাদিনতা হয়ে গেচে বিস বচোর, এখনও সীমানা নিয়ে বিবাদ কীসের? আইন মোতাবেক ধোল্লে এটা বেআইনি।
— আইন মোতাবেক মানে জানো? আইনকে মুতিয়ে ছাড়বে। ওর নাম পাকিস্তান। হা হা ক’রে হাসে সুধাময়।

এই শব্দখেলা কথা বলতে উৎসাহ দেয় নির্মলকে।
— খবরের কাগজে দেখবা, ভারত বলিছে আমরা যুদ্ধে পাকিস্তানের দু’হাজার বর্গ কিলোমিটার জমি দখল করিছিলাম, আর ওরা মোটে সাড়ে পাঁশ্‌শো। আবার পাকিস্তান বলে, আমরা ষোলোশো বর্গ কিলোমিটারের দখল নিছিলাম, ভারত সে তুলোনায় কিছুই না। গড়ে দেখতে পাবা, দু’দেশেরই সমান-সমান ক্ষতি। আমরা মারামারি বাধালিউ বড় দেশ এসে থামায় দেবে। মাঝখান দিয়ে নিজেদের কয় হাজার সেনা মরল, গোলাবারুদ নষ্ট হল, বাজারে চালির দাম বাড়ে গেল।

এমন মন্তব্য জনপ্রিয় হয় না, উলটে শীত-সকালের চা জুড়িয়ে দেয়। কিন্তু সুধাময়ের মন হল তিনচোখো মাছের বুড়বুড়ি কাটা ডোবা। মেহবুব রেডিয়োর কাউন্টারে বসা দাড়িওলা জামালভাইয়ের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে সে বলল,
— ঠান্ডাটা যাক, পাকিস্তান আবার অ্যাটাক কোরবে, তুমি কাস্‌মির আগলে রাকতে পারবে নাকো।

দুই
বাজার নিয়ে ফিরতে ফিরতে পছন্দসই চেনা একাকিত্বের মধ্যে আবার ঢুকে পড়ছিল সে। শীতের রোদ কৈশোর পার হচ্ছে; উঠোনে উঠোনে এত গাঁদাফুল… বাচ্চারা তাদের ফেদার বানিয়ে পিচবোর্ড দিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলার পর পাপড়ির থ্যাঁতলানো গন্ধে বাতাস বাঘবন্দী। মুখে নরম হাসি নিয়ে একটা লোক সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। যার সঙ্গে আলাপ ক’রে ফিরছে, সে নিশ্চয় এই সুহাস উপহার দিয়েছে তাকে। এভাবে প্রত্যেক মানুষ অন্যের অনুভূতির জলছাপ বয়ে বেড়ায় বুকের ভেতর। যেমন সুধাময় তার মনে ঘুগনির শালপাতায় চানাচুরের মতো সন্দেহ ছড়িয়ে দিয়ে গেল।

চৌবাড়ি ময়দানের অশ্বত্থগাছে দল বেঁধে অনেক পাখি ডাকছে, উলের লেচিতে জট পাকিয়ে গেলে যা হয়। সে সাবধানে ছাড়াতে চেষ্টা করছিল — শালিখ, টিয়া, ছাতারে, ফিঙে, বউ কথা কও…। পাখি শুনতে শুনতে দেশভাগ পেছনে চলে যায়, টানাটানির সংসারও যেন পিঠে সুড়সুড়ি দেওয়া পালক। তারপর কাঁসর শোনা গেল মান্নাপাড়া কালীবাড়ির, নির্মলের মনও শিস থেকে ভেসে গিয়ে নোঙর করল সংগীতে। তিন বার টং-এর পরে একটা মাত্রা চুপ, তারপরে আবার টং টং টং। নির্মল কাঁসরঘন্টাকে ত্রিতাল বানিয়ে ওই লয়ে গুনগুন ক’রে বোলকারি গড়তে লাগল। কাব্যতীর্থ পাশ দেওয়ার পরপরই তার নড়াল-এর জমিদারবাড়িতে গৃহশিক্ষকের চাকরি জুটে যায়। মাস-মাইনে করা গোয়ালিয়র ঘরানার ওস্তাদজি থাকতেন পাশের ঘরে। সন্ধেবেলার মজলিশে সে মাঝেমধ্যে মৃদঙ্গ নিয়ে বসেছে।

একটু এগিয়ে নির্মল দেখল কলোনির একটা বাচ্চা, চাকা চালাতে চালাতে এতদূর এসে পড়েছে। লতপত ক’রে পাক-খাওয়া বাতিল সাইকেলের টায়ার সামান্য লাঠি দিয়ে পাকা ড্রাইভারের মতো সামলাচ্ছে সে; এই শীতে গায়ে কোনও রকম একটা ছিটের জামা, প্যান্টের বোতাম নেই ব’লে বাঁহাতের ছোট্ট মুঠোয় ঢাকা তার সংক্ষিপ্ত লজ্জাশরম, পা খালি আর ধারাবাহিক শিকনি নাক দিয়ে। বিষণ্ণতার সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় আবার মোর হয়ে গেল নির্মল। সে জানে এই শিশু বিপর্যয়ের মায়াহীন প্রতীক যার সারা গায়ে উল্কি ক’রে লেখা আছে চারটে অক্ষর — শরণার্থী।

(চলবে)

রূপকথাঃ এক যে বাঘ

প্রাপ্তবয়স্কদের রূপকথা, ছোটরা এড়িয়ে যাও-

তারপর হলো কি শিয়াল এসে দেখে বাঘ বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে। বাঘের চোখ বন্ধ, কপালের চামড়া ব্যাথায় কুঁচকে আছে। শিয়াল জিজ্ঞেস করলো,
– বাঘ মামা, কি হয়েছে! পেটে গ্যাসের ট্রাবল না এপেনডিসাইটিসের পেইন?

বাঘ এপাশ-ওপাশ করতে করতেই চোখ খুলে তাকালো, তারপর চোখ বন্ধ করে কাতর স্বরে বললো,
– শিয়াল পণ্ডিত যে! তা কখন এলে?

“পণ্ডিত” বললে শিয়ালের খুব রাগ হয়। তোমরাই বলো, শিয়ালের সেই পণ্ডিতির যুগ কি আর আছে! টকশোজীবী এবং চারুকলা ও বুয়েটের কমার্স বিভাগের বিজ্ঞানীরা এখন সর্ববিষয়ে পণ্ডিতি করে। এসব দেখে শিয়ালের খুব কষ্ট হয়। হাজার বছরের ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে ওরা শিয়াল পণ্ডিতের লাখ বছরের পণ্ডিতির ঐতিহ্যটাও দখল করে নিয়েছে। এপ্লায়েড হিস্ট্রি এন্ড সহমতিয়ান ফিলোসফিতে পিএইচডিধারী ড. শিয়াল তাই নামের শেষে ‘স্যার’ সম্বোধনেই স্বস্তিবোধ করতেন।

সম্প্রতি ঘটেছে আরেক কাণ্ড, তোমাদের মত একদল দুষ্টু কি করেছে শুনো, সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা “স্যার” সম্বোধনটা “ড. শিয়াল”-এর আগে বসিয়ে ভাইরাল করে দিয়েছে। সবাই এখন তাকে ডাকে “স্যার ড. শিয়াল”।এই সম্বোধনে প্রথম প্রথম একটু অস্বস্তি হলেও ‘নাইটহুড’ ছাড়াই ‘স্যার’ বানিয়ে দেওয়ায় শিয়াল কিন্তু দুষ্টদের সকল দুষ্টুমি ক্ষমা করে দিয়েছে। বাঘের প্রশ্নের উত্তরে শিয়াল বললো,
– বাঘমামা, স্যার শিয়ালকে তুমি শিয়াল পণ্ডিত ডাকছো কেনো! শরীর কি বেশী খারাপ! মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে!

শিয়ালের কথায় বাঘ চোখ মেললো। চোখ টকটকে লাল হয়ে আছে। শিয়ালের চোখে চোখ রেখে হুংকার দিলো,
– মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ। আমি কি ইন্সটিট্যুট অফ চা-ছপ-সিঙ্গারা-সমুচা ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজির ভিসি টাইগারুজ্জামান যে তুমি আমাকে ‘মামা’ সম্বোধন করে ডাকবে! বহুবার বলেছি আমাকে “মাননীয় বাঘমশাই” বা “বিকল্পহীন বনরাজ” বলে ডাকবে, এই নামে ডাকতে সমস্যা হলে “লিডার” বলে ডাকবে।

বাঘের হুংকারের শুরুতেই ঘরের দেয়ালে থাকা দু’টো টিকটিকি আর জানালার বাইরে চড়তে থাকা ক’টা রামছাগল কানখাড়া করেছিল। বাঘের হুংকার শেষ হতেই তারা একসাথে শ্লোগান দিলো, “সহমত লিডার.. সহমত লিডার।” সম্মিলিত টিকটিকি ও রামছাগল জোটের শ্লোগানে বাঘের মন কিছুটা নরম হলো।

তারপর হলো কি, শিয়ালের কানের কাছে মুখ নিয়ে বাঘ ফিসফিসিয়ে বললো,
– ইউ হ্যাভ টু বুঝতে হবে মাই কৌশল অব ক্যারিশমাটিক লিডারশিপ। আমি রোজ লাঞ্চ আর ডিনারে মাটন তেহারি খাচ্ছি তবু রামছাগলরা ‘সহমত লিডার’ শ্লোগান দিচ্ছে। সো, নো হাংকিপাংকি, ডোন্ট কল মি “মামা”, ক্লিয়ার স্যার ড. শিয়াল!”

বাঘের কথায় শিয়াল ভয় পেয়েছে। তবু ভয় না পাওয়ার অভিনয় করে ভক্তি ভয়গদগদ কণ্ঠে বললো,
– সহমত লিডার। এই জঙ্গলে তুমি আমাদের ‘বনবন্ধু।” কেউ পারলে তোমার বিকল্প দেখাক, চ্যালেঞ্জ দিলাম।মাই বক্তব্য কি ইউর কাছে ক্লিয়ার, লিডার!

শিয়ালের কথা শেষ হতেই সম্মিলিত টিকটিকি ও রামছাগল জোটের নেতা-কর্মীরা শ্লোগান দিলো, “সহমত স্যার শিয়াল.. সহমত স্যার শিয়াল.. আমাদের লিডারের কোনো বিকল্প নেই।” শিয়ালের বক্তব্য আর শ্লোগানে বাঘের মন ভালো হলেও শরীর কিন্তু খারাপ। বাঘ আবার এপাশ-ওপাশ করতে শুরু করায় শেয়াল বললো,
– লিডার, চলো তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।

বাঘ হুংকার দিলো,
– ডোন্ট আন্ডার ইস্টিমেট মি, স্যার ড. শিয়াল। আমি আমেরিকার কম্পাউন্ডারের কাছে যাই, ইউরোপের ওয়ার্ড বয়ের কাছে, পাশের জঙ্গলের কবিরাজের কাছে যাই, কিন্তু ইউ হ্যাভ টু বুঝতে হবে, এই জঙ্গলের একটা প্রোটোকল আছে, এখানে ডাক্তারকে হাসপাতালসহ আমার কাছে আসতে হয়।

শিয়াল ‘স্যরি’ বলে দ্রুত ডাক্তারকে ফোন করলো। ডাক্তার পুরো হাসপাতাল কাঁধে চাপিয়ে চলে এলো, বাঘের শরীরে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললো,
– আওয়ার সুপ্রিম লিডার, আপনার ব্লাড প্রেসার হাই। হার্টে ব্লক। মগজে ময়লা (গোবর বলার সাহস পেলো না) জমেছে।

বাঘ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো,
– জঙ্গলের উন্নয়নের চিন্তা করতে করতে ঘুমোতে পারি না। জানো ডাক্তার, জঙ্গলের উন্নয়নের জন্য নিজেকে শেষ করে দিচ্ছি। এখন কি করতে হবে?

ডাক্তার কি না ডাক্তার, চিকিৎসার কথা তাকে বলতেই হবে। তাই সে বললো,
– আওয়ার সুপ্রিম লিডার, এক্কেবারে রেড মিট খাওয়া যাবে না। নো সুগার। কোলেস্টেরল ও ফ্যাটি খাবার নিষিদ্ধ। রাত জেগে জেগে নো হুইস্কি, নো ভদকা, হু। টেনশনও করা যাবে না।

“তেইলে কি আমি এনার্জি বিস্কুট আর মামপানি খায়া বাঁচুম” বলে বাঘ হুংকার দিতে যাচ্ছিলো, কিন্তু এর আগেই ডাক্তার কোমল স্বরে বললো, ‘আওয়ার সুপ্রিম লিডার, উত্তেজিত হবেন না, স্ট্রোক হতে পারে। হার্ট এটাক হতে পারে। কন্ট্রোল ইওরসেল্ফ।” ডাক্তারের কথা শুনে সম্মিলিত টিকটিকি ও রামছাগল জোটের নেতা-কর্মীরা দারুণ উত্তেজনায় দু’বার “সহমত ডাক্তার.. সহমত ডাক্তার.. লিডারের স্ট্রোক আর হার্ট এটাকের বিকল্প নাই.. লিডারের স্ট্রোক আর হার্ট এটাকের বিকল্প নাই” শ্লোগান দিলো এবং ভুল বুঝতে পারার সাথে সাথে দুই হাতে দুই কান ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।

‘কানে ধরার’ ব্যাপারটা দেখে বাঘের উত্তেজনা কিছুটা কমলো,
– ডাক্তার, তবে আমি খাবো কি?
– সুপ্রিম লিডার, আপনি ডায়েট করবেন। সকালে আর রাতে ওটস এন্ড মিল্ক। দুপুরে ভেজিটেবল স্যুপ।

বাঘের মন খুব খারাপ হলো, কিন্তু সুস্থ থাকতে হলে ডাক্তারের কথা মানতেই হবে। বাঘ বললো,
– খাওয়া না হয় ঠিক করলাম। টেনশন কমাবো কিভাবে?

ডাক্তার বললো,
– আওয়ার সুপ্রীম লিডার, আপনার বয়স হয়েছে, বিশ্রাম দরকার। অনেক তো হলো, এবার অন্য কাউকে দায়িত্ব দিয়ে বিশ্রাম নিন।

বাঘ মনে মনে ডাক্তারকে “বিএনপি-জামাত” বলে গাল দিয়ে প্রশ্ন করলো,
– দায়িত্ব তো দিতে চাই, কিন্তু কে নিবে! অন্য কাউকে দায়িত্ব দিবো কিভাবে? আমার ছেলে বা মেয়েকে দায়িত্ব দিলে এই জঙ্গলের বজ্জাতগুলো কি মেনে নিবে?

বাঘ ভেবেছিলো ডাক্তার বলবে “মানবে না কেনো, বজ্জাতগুলোর চৌদ্দ দু গুণে আটাশ গুষ্টি মানবে”, কিন্তু ডাক্তার সঙ্কোচ ও ভয়ে ভয়ে বললো,
– আওয়ার গ্রেট লিডার, আপনি টেনশন করবেন কেনো! একটা নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে অনুষ্ঠান হলে জঙ্গলবাসীরা ভোট দিয়ে নিজেদের নেতাকে বাছাই করে নিবে। যাকে বলে ডেমোক্রেটিক সিস্টেম।

ডাক্তারের কথার প্রতিবাদে বাঘ হুংকার দিলো,
– বজ্জাতগুলো সঠিক নেতাকে ভোট দিবে ভেবেছো! সঠিক নেতাকে ভোট দিলে কি দিনের নির্বাচন আমাকে রাতে করাতে হয়? এই জঙ্গলের উন্নয়নে আমি কি না করেছি, তুমিই বলো। আমার কি কোনো বিকল্প আছে?

“উন্নয়নের মাইনকা চিপায়, জনগণের বিঁচি হাঁপায়” বলতে গিয়েও ডাক্তার নিজেকে সামলে নিলো। তবে সম্মিলিত টিকটিকি ও রামছাগল জোটের নেতা-কর্মীরা কান ধরা অবস্থাতেই শ্লোগান দিলো, “সহমত লিডার, আপনার কোনো বিকল্প নাই। সহমত লিডার, আপনার কোনো বিকল্প নাই।”

ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে শিয়াল বললো, “আমাদের বিকল্পহীন বনরাজ থাকতে আবার ইলেকশন কিসের! তোমরা যারা ডাক্তারি করো তাদের বলছি, আমরা কি এমন চিকিৎসা চেয়েছিলাম!”

সম্মিলিত টিকটিকি ও রামছাগল জোটের শ্লোগান এবং স্যার শিয়ালের বক্তব্য বাঘের রাগ বা টেনশন কমাতে পারলো না। নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা শুনলেই এমনিতেই বাঘের টেনশন হয়। ভোটের মৌসুমে টেনশনের সাথে রাগ আর ভয়ও হয়। টেনশন হলে ব্লাডপ্রেশার বাড়ে; ব্লাড প্রেশার বাড়লে রাগ বাড়ে; রাগ বাড়লে আবার টেনশনও বাড়ে- অনেকটা নাইট্রোজেন চক্রের মত (দেখলে আমিও সায়েন্স জানি)।

বাঘের টেনশন বাড়ায় রাগও বাড়ছে.. বাড়ছে.. বাড়ছে। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বাঘ একলাফে ডাক্তারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ডাক্তারকে চেটেপুটে খাওয়ার পর বাঘের রাগ কমলো। রাগ কমায় টেনশন কমলো। টেনশন কমায় ব্লাড প্রেশার প্রায় স্বাভাবিক হলো। ডাক্তারের একটা হাড় শেয়ালের দিকে ছুড়ে দিয়ে বাঘ হাসতে হাসতে বললো,
– স্যার শিয়াল, আমার বয়স হয়েছে। আমি আর রাজা থাকবো না। তোমরা তোমাদের নতুন রাজা বেছে নাও, আমাকে মুক্তি দাও।

শিয়াল মনেমনে “শালার বাঘ, নতুন নেতা বাইছা নিতে গেলে তুই আমারে কি করবি তা কি বুঝি না! আমি কি মফিজ!” বললেও মুখে বললো,
– এমন কথা বইলো না লিডার। এমন কথা বললে উন্নয়ন পাপ দিবে।

বাঘ অবাক স্বরে প্রশ্ন করলো,
– উন্নয়নেও পাপ দেয়! তা উন্নয়নে কি পাপ দিবে?
শিয়াল এপ্লায়েড হিস্ট্রি বইয়ের পাতা উল্টে একটা পাতা বের করে বললো,
– কবি বলেছেন– উন্নয়নে দিলে পাপ
সবার আগে ভাগে বাপ।”

শিয়ালের কবিতা শুনে সম্মিলিত টিকটিকি ও রামছাগল জোটের নেতা-কর্মীরা বাঘের দিকে তাকাতেই বাঘ বললো,
– শরীরে একবিন্দু রক্ত থাকতেও ভাগবো না। এর আগে ভাগি নাই, চিকিৎসার জন্য এমাজনের জঙ্গলে গিয়েছিলাম।

সম্মিলিত টিকটিকি ও রামছাগল জোটের নেতা কর্মীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই শিয়াল আরেকটা পাতা খুলে উঁচু স্বরে আবৃত্তি করলো,
– হাতেনাতে পড়লে ধরা জনগণের ফান্দে
একটানেতে বিঁচি ছিড়ে ঝুলিয়ে দিবে কান্দে।

এমন পাপের কথা শোনার সাথে সাথে সম্মিলিত টিকটিকি ও রামছাগল জোটের নেতা-কর্মীরা কান ছেড়ে দুই হাতে ব্যক্তিগত ইউটিউবের সাবস্ক্রাইবার বেল-বাটন ঢেকে ফেললো। বাঘও নিজের লেজটা দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে ভিতরে গুটিয়ে নিলো, যেনো ওর বেল বাটন দেখা না যায়।

তারপর হলো কি, বাঘের নির্দেশে সবাই এখন কবিকে খুঁজছে। তোমাদের পরিচিতদের মধ্যে কেউ কবি থাকলে তাকে সাবধানে থাকতে বলবে। আর ডাক্তারের পরিবারের কাউকে চিনলে জানিয়ে দিবে যে ডাক্তার স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে আছে। ভাগ্যিস, আমরা জঙ্গলে থাকি না, আমাদের দেশের মত উন্নত দেশে এমনটা ভাবাও যায় না।

আজ এই পর্যন্তই, মনে রেখো- লোডশেডিং আছে বলেই এমন রূপকথা শুনতে পাচ্ছো, লোডশেডিং নিয়ে কোনো দুষ্টুমি করবে না, হু।