জীবনের গল্প-২১ এর শেষাংশ: সব টাকা বাইর করার দরকার নেই। কোনও বাটপার দেখলে তোর পেছনে লাগবে। ভারতের বাড়ি, টাকার খুব দাম!’ আমি কানাইর কথামত কিছু টাকা সামনের পকেটে রাখলাম। আর বাদবাকি টাকা প্যান্টের ভেতরের পকেটে রাখলাম। ভগবানকে ডাকতে ডাকতে গেলাম গেইটের বাইরে।
স্টেশনের বাইরে গিয়ে চা-বিস্কুট খাচ্ছিলাম, এমন সময় ট্রেনের হুইসেল শোনা যাচ্ছিলো। ট্রেনের হুইসেল শুনে আমার বুকের ভেতরে কামড়া-কামড়ি শুরু করেছিলো। কখন আমি স্টেশনের ভেতরে যাব, সেই চিন্তায় আমার চা-বিস্কুট খাওয়া শেষ। ঝট-পট দোকানদারকে চা-বিস্কুটের দাম দিয়ে দৌড়ে চলে গিয়েছিলাম স্টেশনের ভেতরে। ভেতরে যাবার পর কানাই জিজ্ঞেস করলো, ‘কী খেয়েছিস? এতো ঝট-পট চলে এলি যে?’ কানাইর কথা শুনে আমি বললাম, ‘আরে ভাই, আমিতো ট্রেনের হুইসেল শুনেই চলে এলাম। তুই না একবার বলেছিস– ইলেক্ট্রিক ট্রেন, হুইসেল দিতে দেরি ছুটতে দেরি নেই! সেই কথায় আমি কোনোরকম খেয়ে দৌড়ে চলে এলাম।’ কানাই হেসে বলল, ‘ট্রেনের ইঞ্জিন ঘুরিয়ে সামনে নিয়ে লাগাবে। এই জন্যই হুইসেল দিয়েছিল। ইঞ্জিন ঘুরিয়ে লাগানোর পর ট্রেন ছাড়বে। ট্রেন ছাড়ার আগে মাইকেও বলে দিবে। আর মাইকে বলা কথাগুলো বাইরে থেকেও শোনা যাবে। এখন চল, ট্রেনে ওঠে সবাই বসে পড়ি।’ আমি তখন হাঁফাতে হাঁফাতে বললাম, ‘ওহ-হো, এই খবর? আমিতো মনে করেছিলাম ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে! তাই চা-বিস্কুট ফেলে রেখে চলে এলাম। চল চল ট্রেনে উঠে বসে পড়ি।’ তারপর সবাই হাসতে হাসতে কানাইর দু’বোন-সহ ট্রেনে উঠে বসলাম। আমি এর আগেও নাম শুনেছিলাম ইলেক্ট্রিক ট্রেন। কিন্তু কোনও দিন চড়িনি। এই ট্রেন আমাদের দেশের সাধারণ ডিজেল চালিত ট্রেনের মতনই। কিন্তু বিদ্যুতের সাহায্যে চলে। যা ১৯০০ সালের প্রথমদিকে ভারতবর্ষে আবির্ভাব হয়েছিল।
এর আগে একসময় পাথর কয়লা দ্বারা এই রেলগাড়ি চালানো হতো। এতে যেমন ছিলো ব্যয়বহুল খরচ, তেমন হতো আবার পরিবেশ দূষণ। পরিবেশ দূষণের কারণ হলো, এই কয়লা চালিত রেলগাড়ি চলাচলের সময় রেলগাড়ির ইঞ্জিন থেকে প্রচুর পরিমানে সাদা-কালো ধুয়া বের হতো। এতে রেললাইনের আশে-পাশে থাকা গাছগাছালি-সহ স্থানীয় কৃষকদের ফসলী জমির ফসলের ব্যপক ক্ষতি হতো। একসময় পরিবেশবাদীরা পরিবেশ দূষণ হচ্ছে বলে রেলগাড়ির ধূয়াকে দায়ী করেছিল। তারা মতপ্রকাশ করেছিল, “পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে হলে, ইঞ্জিন থেকে বাইর হওয়া ধূয়া বন্ধ করা জরুরি।” তাদের এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই আবিষ্কার করা হয় ডিজেল চালিত রেল ইঞ্জিন। এতেও খরচ তেমন বাঁচাতে পারেনি! আবার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর রেলের কালো ধূয়াও তেমন বন্ধ করতে পারছিল না। এরপর অনেক বছর চেষ্টার বিনিময়ে তৈরি করা হয়, বিদ্যুৎ চালিত ট্রেন।
তবে তখনও বিশাল ভারতে বৈদ্যুতিক ট্রেনের পাশা-পাশি ডিজেল চালিত ইঞ্জিনও অনেক ছিলো। ছিলো টু-ইন-ওয়ান সিস্টেম ট্রেন ইঞ্জিন। মানে একটা ট্রেন ইঞ্জিনে ডিজেল ও বিদ্যুৎ দুটোই থাকতো। আরও সহজ করে বললে বলা যেতে পারে– একটা ট্রেন ইঞ্জিন ডিজেলেও চলতো, আবার বিদ্যুতেও চালানো যেতো। এই ইঞ্জিনগুলো দূরপাল্লায় যাতায়াতের ট্রেনগুলোতেই বেশি ব্যবহার করা হতো।
যাইহোক, আমার ওই প্রথমই বৈদ্যুতিক ট্রেনে চড়া। ট্রেনের বগিগুলো অনেক চওড়া! দুইপাশে বসার লম্বা টেবিল। মাঝখানে বেশ খানিকটা খালি জায়গা। খালি জায়গার উপরে আছে সারি সারি হাতা। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীগণ এই হাতায় ধরেই গন্তব্যে পৌঁছায়। আমরা যেই ট্রেনে চড়ে যাচ্ছিলাম, এটি চিল বনগাঁ টু শিয়ালদা। তা-ও আবার ওই রুটে রাতের জন্য ছিলো শেষ ট্রেন। তাই যাত্রীও ছিলো সীমিত। পুরো বগিতে কানাইর দু’বোন-সহ আমরা যাত্রী ছিলাম, ৭/৮ জনের মতো। ট্রেনের হুইসেল যখন শোনা যাচ্ছিলো, তখন আমি ট্রেনের টেবিল সিটে বসে বসে ভাবতেছিলাম, এবার হয়ত ট্রেন ছাড়ছে! ঠিক তা-ই হয়েছিলো। হুইসেল দেওয়ার সাথে সাথে ট্রেন ছুটে চললো।
বাংলাদেশর ডিজেল ট্রেনও স্টেশন থেকে ছাড়ার আগে হুইসেল দেয়। কিন্তু ট্রেনের হুইসেল শুনেও দৌড়ে এসে ট্রেনে ওঠা সম্ভব হয়। ভারতের বৈদ্যুতিক ট্রেনের বেলায় তা-আর সম্ভব হয় না। হুইসেল দেওয়ার সাথে সাথেই শোঁ! মানে, ট্রেন আর দেখা যাবে না। ট্রেন চলছে দ্রুতগতিতে! আমি বসা কানাইর পাশে। কানাইর দু’বোন সিটের এককোণে বসা। ট্রেন অনেকক্ষণ চলার পর নাম না জানা একটা স্টেশনে থামল। ট্রেন ছাড়ার আগে আমাদের বগিতে তিনজন ফেরিওয়ালা উঠেলো। একজন বাদাম নিয়ে। আরেকজন আপেল, আরেকজন চানাচুর নিয়ে। কানাই ওর দু’বোনকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই তোরা কি বাদাম খাবি? না আপেল খাবি?’ দু’বোন বললো, ‘বাদাম খাব।’ আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই কিছু খাবি?’ আমি বললাম, ‘এখন কিছু খাব না।’
ওরা তিনজনই বাদাম কিনে খাচ্ছে। মুহূর্তেই আমার মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেলো। মনটা খারাপ করেই একা একা বসে অনেককিছুই ভাবতে লাগলাম! আজ পহেলা বৈশাখ, ১৪০০ বঙ্গাব্দ। আমার বৌ বাচ্চা-কাচ্চা সবাই বাংলাদেশে। আমি কী করলাম! ওরাই-বা-কী করবে? আমার চিন্তার যেন শেষ নেই! কেন আসলাম! কোথায় যাবো! কী করবো! এমন হাজার প্রশ্ন মনের ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর মেলাতে পারছি না। চিন্তায় আমার দেহ-মন দুটোই যেন ভারী হয়ে যাচ্ছে। ভাবতে লাগলাম বার-বার!
ভাবনার এক ফাঁকে কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কানাই, আমরা কোথায় গিয়ে নামবো?’ কানাই বলল, ‘আমরা এখন প্রথমে দমদম যাব। ওখানে আমার এক বন্ধু থাকে। তার বাসায় আজকের রাতটা থাকব। কাল সকালে আবার ট্রেনে করে যাব শিয়ালদা। এই গাড়িতে করে যদি শিয়ালদা যাই, তবে রাত হয়ে যাবে প্রায় তিনটে। এতো রাতে দু’বোনকে সাথে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। সমস্যাও হতে পারে। তাই আজ রাতটা দমদম বন্ধুর বাসাই থাকব।’ আমি বললাম, ‘এখন তো রাত ১১টার মতো বাজে। দমদম পৌঁছতে কয়টা বাজবে?’ কানাই বললো, ‘রাত ১২টার মতো বাজতে পারে।’
কানাইর কথাই ঠিক হলো। রাত ১২টা দশ মিনিটের সময় ট্রেন দমদম পৌঁছাল। দু’বোনকে নিয়ে আমরা ট্রেন থেকে নামলাম। তখন দমদম স্টেশনটা নিরব নিস্তব্ধ! কোনও মানুষজন নেই। ভারতের মানুষ এমনিতেই অনেক হিসাব করে চলে। বাইরে বেশি রাত করে না। সবাই চলে নিজের ধান্ধায়। কী করবে আর কীভাবে চলবে এসব নিয়ে তারা বেশি চিন্তা করে। বাংলাদেশের মতো অযথা রাস্তাঘাটে, হাট-বাজারে আড্ডা দেয় না। আর এখন তো রাত ১২ টারও বেশি! তাই দমদম রেলস্টেশনটা একেবারেই জনশূন্য। ট্রেন থেকে যে-কয়জন যাত্রী নামল, সেই ক’জন মানুষও ক্ষণিকের জন্য। যাত্রীরা যার-যার গন্তব্যে চলে গেলে স্টেশনে আর কোনও মানুষই থাকবে না বলে আমার মনে হচ্ছিলো।
সবাই স্টেশনের ভেতর থেকে বাইরে গেলাম। আমি এদিক-ওদিক দেখলাম, কোনও চা-দোকান আছে কি না। নেই, কোথাও কোনও চা-দোকান এতো রাতে খোলা নেই। নেই কোনও রিকশা বা ভ্যানগাড়িও। দমদম স্টেশন থেকে কানাইর বন্ধুর বাড়ির দূরত্ব প্রায়ই দুই কিলোমিটারের পথ। সাথে তিন-চারটা বড়-বড় ব্যাগ। সেই সন্ধ্যার পর থেকেই টেনশন আর হাঁটা। আমার শরীর একরকম ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু কিছু বলতেও পারছি না যে, আমি খুবই ক্লান্ত অনুভব করছি। কী আর করা! দুই কিলোমিটার পথ খুব কষ্ট করে হেঁটে, কানাইর বন্ধুর বাসায় পৌঁছালাম। ভারতের বাড়ি। হিসেবি মানুষের দেশ। ভাই আর বন্ধু, অসময়ে কেউ কারোর জন্য মাথা ঘামায় না। নিজের আপন বোনও ভাইকে দুইদিন জায়গা দিতে চায় না। কোনও লোকের বাড়িতে একবেলা খাবার যেমন-তেমন, পরের বেলাই হিসাব কষতে শুরু করে।
কানাইর বন্ধুর বাড়ির গেইটের সামনে গিয়ে সবাই দাঁড়ালাম। কানাইর বন্ধুটির নাম, প্রদীপ। কানাই বন্ধুর নাম ধরেই অনেক ডাকতে লাগলো! কারোরই সাড়াশব্দ নেই। অনেকক্ষণ ডাকার পর, বন্ধুটি চোখ মুছতে মুছতে গেইটে আসলো। গেইটে এসেই জিজ্ঞেস করলো, ‘কী-রে, এতো রাতে?’ কানাই বললো, ‘বাংলাদেশ থেকে এলাম। যেতে হবে শিয়ালদা। কিন্তু শিয়ালদা পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে যাবে। তাই তোদের বাড়ি এলাম, রাতটা কাটানোর জন্য। খুব ভোরে উঠে চলে যাবো।’ প্রদীপ জিজ্ঞেস করলো, ‘সাথে ওরা কারা?’ কানাই আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বললো, ‘ও আমার বন্ধু। আর ওরা আমার ছোট দুই বোন।’ কথা বলতে বলতেই প্রদীপ বাড়ির গেইট খুলতে লাগলো। এমন সময় প্রদীপের বৃদ্ধ মা সামনে এসে প্রদীপকে জিজ্ঞেস করলো, ‘প্রদীপ, কে আসলো রে? এতো রাতে কোত্থেকে?’ মায়ের কথায় প্রদীপ জবাব দিল, ‘মা, আমার বন্ধু কানাই, দু’বোন নিয়ে বাংলাদেশ থেকে এসেছে। আজকের রাতটা আমাদের এখানে থাকবে ওরা। সকাল হলেই চলে যাবে।’ প্রদীপের মা বললো, ‘আয়, ওদের ভেতরে নিয়ে আয়। রাত অনেক হয়েছে। ওরা কী বাইরে থেকে খাওয়া দাওয়া সেরে এসেছে? না আমার কিছু করতে হবে? আমার শরীরটাও ক’দিন যাবত বেশি একটা ভালো যাচ্ছে না। আসো আসো ভেতরে আসো শিগগির।’
প্রদীপ আগে, আমরা চারজন পেছনে পেছনে যাচ্ছি বাড়ির ভেতরে। অনেক বড়ো ঘর! পুরানো বিল্ডিং। দেয়ালের চারদিক নক্সা করা কারুকার্য। ঘরের ভেতরে সুবিশাল আয়তাকার অতিথিশালা আর চারদিক দামী চেয়ার বসানো। দেয়ালে রয়েছে নানা রঙের ছবি টানানো। আমাদের সাথে নেওয়া ব্যাগগুলো মেঝেতে রেখে সবাই বসলাম। প্রদীপের মা একটা প্লেটে করে কিছু বিস্কুট নিয়ে আসলো, অতিথিশালায়। বিস্কুটগুলো সামনে দিয়ে বললো, ‘খাও বাবা সকল। এতো রাতে আর কোনও ঝামেলা করবো না। এগুলো খেয়ে শুয়ে পড়ো। সকালের খাবার খেয়ে তোমরা যাবে।’ কানাই বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে মাসিমা, আমরা হাত মুখ ধুয়ে তারপর খাব। আর সকাল বেলাও আমাদের জন্য আপনার কিছু করতে হবে না। আমাদের খুব ভোরবেলা উঠেই রওনা দিতে হবে।’
প্রদীপের মা শোবার ঘরে চলে গেলো। প্রদীপ তখনও অতিথিশালায়। কানাইর সাথে শোফার একপাশে বসে ঝিমাচ্ছে। কানাই প্রদীপকে বললো, ‘কি হলো রে প্রদীপ? ঘুমিয়ে পড়লি নাকি? আমরা কে কোথায় ঘুমাবো একটু বলে দে?’ প্রদীপ চোখ ডলতে-ডলতে সোফা থেকে ওঠে বললো, ‘ভেতরে আর জায়গা নেই যে! তোদের সবাইকে এখানেই কষ্ট করে ঘুমাতে হবে।’ এই কথা বলেই প্রদীপ আরেক ঘরে চলে গেল। অতিথিশালায় তখন আমরা চারজন ছাড়া কেউ ছিলো না। পেটের খুদায় আর ঠিক থাকতে পারছি না। খুদা নিবারণের জন্য মাসিমার দেয়া বিস্কুটগুলো সবাই মিলে-মিশে হজম করলাম। অতিথিশালায় তিনটে সোফা ছাড়া আর কোনও বিছানাপত্র ছিল না। কানাই একটায়, আমি একটায় আর দু’বোন একটা সোফায় ঘুমিয়ে পড়লো। সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও আমার চোখে ঘুম ছিলো না। আমার শুধু চিন্তা! ভারতের এমন কেচ্ছা-কাহিনী আমি অনেক আগেই শুনেছিলাম। কিন্তু স্বচক্ষে দেখিনি। কানাইর সাথে যাবার পর-ই নিজ চোখে দেখার ভাগ্য হলো। যেমনটা দেখলাম, কিছুক্ষণ আগে কানাইর বন্ধু প্রদীপদের বাড়িতে আসার পর।
বাংলাদেশে একজনের বাড়িতে কোনও অতিথি আসলে, কত না সমাদর করে। অতিথির জন্য রাত আর দিন কোনও বিষয় থাকে না। অতিথিকে সমাদর করাটাই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আর এখানে রাত হয়েছে বলে যত যন্ত্রণা! কিছু খাও আর না খাও, সকালবেলা চলে যাও! আমি ভাবছিলাম, যার কাছে যাব, সে যদি এমন করে? তাহলে কোথায় যাব? কানাইর কাছেও ক’দিন থাকব! বড় দিদির বাড়ি গেলে, বড় দিদি যদি আমাকে দেখে বিরক্ত হয়? তাহলে যাবো কোথায়? চাকরি যদি মনোমত না হয়, তাহলে? এমন আরও অনেক অনেক প্রশ্ন নিয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম! একসময় সকাল হল। সময় তখন ভোর ৫টা। সূর্য মামা তখনও উঁকি দেয়নি। আমারা অনেক রাতে ঘুমিয়েছিলাম, তাই সবাই তখনও ঘুমে বিভোর। সেসময় প্রদীপের মা এসে সবাইকে ডেকে বলছে, ‘ওঠো ওঠো গো বাবা সকল। সকাল ৫টা বাজে। তোমরা যখন শিয়ালদা যাবে, সকাল পৌনে ছয়টার সময় একটা ট্রেন আছে। তাড়াতাড়ি ওঠো। ট্রেনটা ধরতে পারলে নিরিবিলি যেতে পারবে।’ প্রদীপের মায়ের কথা শুনে আমি ওঠে কানাইকে বললাম, ‘এই কানাই, তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে নে। ছয়টা বাজতে আরো ৪৫ মিনিট বাকি আছে, ট্রেনটা হয়ত ধরতে পারব।’
কানাই কুরমুড়ি দিয়ে ওঠে ওর দু’বোনকে ঘুম থেকে ওঠাল। প্রদীপদের বাড়িতে আর কিছু খাওয়া হল না। চলে আসলাম দমদম রেলস্টেশনে। স্টেশনে এসে একটা চা-দোকানে সবাই চা-বিস্কুট খেয়ে সকালের নাস্তা সারলাম। এরপর কানাই তাড়াতাড়ি করে স্টেশনের ভেতরে গিয়ে চারটে টিকেট কিনল। ট্রেন আসার পর সবাই ট্রেনে গিয়ে বসলাম। ট্রেন শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছালো সকাল ৮টায়। শিয়ালদা স্টেশনের বাইরে এসে একটা অটো রিজার্ভ করলাম। অটো দিয়ে যাচ্ছি আর দেখেছি সেখানকার ১৪০০ বঙ্গাব্দ, বর্ষবরণ উৎসবে সাজানো রাস্তার আশ-পাশ। মনে হয়েছিলো, প্রতিটি রাস্তার মোড়ে-মোড়ে, মহল্লায়-মহল্লায় এখানে-সেখানেই বর্ষবরণের আয়োজন হয়েছিলো। কোথাও-কোথাও বৈশাখী লোকজ মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চও দেখা গেলো। অটো চলল প্রায় ৩০ মিনিটের মতো। নামলাম বাঘ যতীন রেলস্টেশনের বিপরীতে এক মহল্লায়। সেখান থেকে একটু পায়ে হেঁটে গেলাম কানাইর ভাড়া করা বাসায়।
এই জায়গাটার নাম বাঘা যতীন কেন হলো তা কানাইর কাছে জানতে চাইলাম। জবাবে কানাই বলল, “এই বাঘা যতীনের বাড়ি ছিল আমাদের বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার কয়া গ্রামে। তার পিতার নাম উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মাতার নাম শরৎশশী। বাঘা যতীন শৈশব থেকেই শারীরিক শক্তির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। শুধুমাত্র একটি ছোরা দিয়ে তিনি একাই একটি বাঘকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিল বলে, তাঁর নাম রটে যায় বাঘা যতীন। এখানে থেকেই নাকি বাঘা যতীন লেখাপড়া শিখেছিলেন। তিনি একসময় হয়ে উঠেছিলেন একজন বাঙালি ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী নেতা। ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের সম্মুখ যুদ্ধে উড়িষ্যার বালেশ্বরে তিনি গুরুতর আহত হন। কিছুদিন বালাসোর হাসপাতালে থাকার পর অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর একসময় ভারত ব্রিটিশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাঘা যতীন স্মরণে জায়গার নাম রাখা হয় বাঘা যতীন।’ বর্তমানে বিশ্ববিখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগলে সন্ধান করলেও বাঘা যতীন-এর বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।
এই বাঘা যতীন এলাকার কানাই এখন স্থায়ী বাসিন্দা। ও আরও অনেক আগে থাকেই যেই বাড়িতে থাকে, সেই বাড়িওয়ালার ঘরেই কানাই খাওয়া-দাওয়া করে। কানাই থাকে একা। কিন্তু এখন কানাইর সাথে আরও তিনজন দেখে বাড়িওয়ালার মাথায় হাত। এখন কানাইকে কিছু বলতেও পারছে না, আবার সইতেও পারছে না। আমি সেটা ভালো করে ফলো করতে লাগলাম। তাদের এমন ভাবটা বোঝা যেতো তখন, যখন খাবার খেতে যেতাম। সেখানে দুইদিন থাকার পর কানাইকে বললাম, ‘আমাকে রতন চক্রবর্তীর বাড়ি নিয়ে চল। এখানে তোর সমস্যা হচ্ছে।’ তখন কানাই বলল, ‘যাবো আরো দুইদিন পরে। আগে তোকে কোলকাতা শহরটা একটু ঘুরিয়ে দেখাই। ওখানে গেলে-তো আর সহা-শিগগির আসতে পারবি না। তাই কিছু সুন্দর-সুন্দর জায়গা দেখে যা, চিনেও যা।’ আমি বলছিলাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তা-ই হবে।’ কানাইর কথায় আর অমত করেনি। দুইদিন কানাইর সাথে শুধু ঘোরাফেরা করতে লাগলাম।
এদিকে রতন চক্রবর্তীর স্ত্রীর ভারত আসার কথা ছিলো, আমাকে সুন্দর একটা ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু না, তিনি আর আসছে না। কানাইও তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। এই অপেক্ষার মধ্যে কেটে গেল আরও দুইদিন। এর এক ফাঁকে আমি নিকটস্থ পোস্ট অফিস থেকে একটা চিঠির খাম (এনভেলপ) কিনলাম। নিরিবিলি সময়ে একটা চিঠি লিখে পাঠালাম, আমার স্ত্রীর ঠিকানায়। চিঠিতে জানিয়ে দিলাম, আমি মঙ্গল মতো কলিকাতা পৌঁছেছি। চিঠি পাঠালাম এই কারণে যে, আমার জন্য যেন কোনও প্রকার চিন্তা না করে, তাই। এভাবে কেটে গেল আরও বেশ কয়েকদিন। আমার চিন্তাও বাড়তে লাগল।
চলবে…
শুভ হোক জীবনমান।
শুভকামনা থাকলো দাদা।
এতোটাই তন্ময় হয়ে পড়ছিলাম যে, আশে পাশে বা সময়ের হিসাব কষতে ভুলে গিয়েছিলাম প্রিয় কবি নিতাই বাবু। জীবনের অসম্ভব এই বাস্তবতা।
হ্যাঁ দাদা, ঠিক তা-ই! শুভকামনা থাকলো।