ট্যাগ আর্কাইভঃ করোনাভাইরাস

কলির কালে আবির্ভাব করোনা কালের শেষ কোথায়?

717_134947

শুনেছি কাল তিন প্রকার। এই তিন প্রকার কাল হলো: অতীতকাল, বর্তমানকাল, ভবিষ্যৎকাল। কাল অর্থ সময়। মানে ক্রিয়াপদ যে সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়, সেই সময়টাকেই কাল বলা হয়। অর্থাৎ ক্রিয়া সম্পাদনের সময়কে ক্রিয়ার কাল বলে। তবে আমার মনে হয় এই কাল কিন্তু শুধুই ক্রিয়ার কালই নয়। এই কাল আরও অনেক রূপে, অনেক নামে প্রচলিত।

তাই আমি এই লেখায় অন্তত ২৩ প্রকার কাল’র নাম-সহ কাল’র বিশদ বিবরণও উল্লেখ করেছি। কারণ কেউ কেউ এই কালকে অন্যরকমও মনে করে থাকে। তবে হ্যাঁ, কালে কালে এই মানবজাতির অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে। যেমন: বনমানুষ থেকে এপর্যন্ত মানুষ এখন সভ্যজগতে পদার্পণ। সেইসাথে সেসময় থেকে এসময় পর্যন্ত পৃথিবীর অনেককিছুই বদলে গেছে। তাই আবারও উল্লেখ করেছি, কাল কিন্তু একটা সময়। তা হোক সুসময়, দুঃসময়।

আর এই সময়ের কালগুলো হলো: ক্রিয়াকাল, আদিকাল, মহাকাল, শিশুকাল, বাল্যকাল, যুবককাল, অকাল, বয়সকাল, বৃদ্ধকাল, মরণকাল, চিরকাল, গতকাল, আগামীকাল, আজকাল, আধুনিককাল, সকাল, বিকাল, রাত্রিকাল, এযাবতকাল, একাল সেকাল, কলিকাল, করোনাকাল। উল্লেখিত এই ২৩ প্রকার কালগুলো কিন্তু একটা সময়।

আর এই সময়টা হতে পারে দীর্ঘ সময় বা অল্প সময়। যেমন: “গানে আছে, “কতকাল দেখিনি তোমায়”! এখানে একমাসও হতে পারে, আবার একযুগও হতে পারে। যা বারোমেসে একবছর। আবার বারো বছরে একযুগ গণনা করা হয়।

আবার অন্য মতে কাল হলো বিষাক্ত বা জম বা বিপদ! যেমন: কথায় আছে, “সাপের মুখ লাল, মানুষের মুখে কাল”। যদি কারোর উপর কুনজরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কেউ কিছু বলে থাকে, সেটা নাকি কাল হয়ে দাঁড়ায়। মানে জম হয়ে সম্মুখে উপস্থিত হয়।

যার কারণে কারোর শখের একটা নতুন গাছে ফল ধরলে, গাছের মালিক গাছের সাথে ছেঁড়া-ফাঁড়া জুতা বেঁধে রাখে। যাতে কারোর কুনজর শখের গাছের উপর না পড়ে।

আবার ভারতে দেখেছি অনেক গাড়ির মালিকরা তাদের গাড়ির সামনে পেছনে জুতা ঝুলিয়ে রাখে। যাতে কুদৃষ্টি থেকে গাড়িটাকে রক্ষা করা যায়। কিন্তু কেউ রক্ষা পায়, আবার কেউ রক্ষা পায় না। তা পাক আর না পাক তাতে অন্য কারোর কিছুই যায়-আসে না। আমারও না। আমি বরং উপরোল্লিখিত ২৩ প্রকার কালগুলো নিয়ে আলোচনায় আসি। আমার ধারণা থেকে ২৩ প্রকার কাল গুলো নিম্নরূপ:

১. ক্রিয়াকাল: ক্রিয়ার কাল বা ক্রিয়াকাল লেখার প্রথমাংশে উল্লেখ করেছি। এই কাল তিন ভাগে বিভক্ত। যথা: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। ক্রিয়াপদে এই তিন কাল মিলে ক্রিয়াকাল। ক্রিয়াপদ যে সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়, সেই সময়টাকেই বলা হয় কাল।

২. আদিকাল: আদিকালে আমার বাবার জন্মও হয়নি। তবে ইতিহাস পড়ে কিছু-না-কিছু জেনেছি। আর যারা আদিকালের ইতিকথার ইতিহাস লিখেছিলেন, তারাও মনে হয় একটু-আধটু আনুমানিক ধারণা থেকেই লিখেছিলেন। যা আমরা বর্তমানে ইতিহাস পড়ে জানতে পারছি।

৩. মহাকাল: যে কালে কোনও মহাপুরুষ, মহামানব ও মহামুনিগণ জন্মগ্রহণ করে, সেই কাল’কে মহাকাল বলতে পারি।

৪. শিশুকাল: আমার নিজেরও একসময় শিশুকাল ছিলো। শিশু কালে মা-বাবা, বড়দা’র হাতে কতো চড়থাপ্পড় খেয়েছি, তার কোনও হিসাব-নিকাশ নেই। তবে এখনো বেশ মনে আছে। এই শিশুকাল পেরিয়ে একসময় আমিও বয়স্কদের কাতারে এসে লাইন ধরেছিলাম। বর্তমানে আমি বৃদ্ধদের কাতারে।

৫. বাল্যকাল: জন্মের পর সবাই শিশুকাল অতিক্রম করে বাল্যকালে উত্তীর্ণ হয়। শিশুকালে সবারই মুখে চুষনী থাকে। আর বাল্যকালে ফুটে ওঠে মুখের বুলি।

৬. যুবককাল: যুবককালে সবাই এক অন্যরকম দিন অতিক্রম করে। কেউ হাসিতে মাতে। কেউ মাতে খেলায়। কেউ মনোনিবেশ করে লেখাপড়ায়। কেউবা আবার কাজে কর্মে। কেউ আবার অকালেই ঝরে পড়ে।

৭. অকাল: অকাল অর্থ অসময়। যা সময়তে হয় না, অসময়ে হয়। হঠাৎ কোনও সুস্থ মানুষ মৃত্যুবরণ করলে, লোকে বলে, “লোকটা অসময়ে চলে গেলো”। কোনও দুর্ঘটনায় কোনও যুবকের মৃত্যু হলে লোকে বলে, “অকালমৃত্যু” আবার অনেকেই বলে, “অকালে ঝরে গেলো”। কারোর দুর্দিনেও বলে, “অসময়ে আছি”। এটাও কিন্তু একটা সময়।

৮. বয়সকাল: যুবককাল পেরিয়ে বয়সকালের হাতছানি। এই বয়সকালে কেউ-না-কেউ খেলাধুলা, লেখাপড়ার পাশাপাশি কাজকর্ম ও সংসার গড়ার পালায় পড়ে। তারমধ্যে আমি নিজেও একজন ছিলাম।

৯. বৃদ্ধকাল: এই বৃদ্ধকালে প্রত্যেক মানুষেই নিজের জীবনের কর্মফলের হিসেব-নিকেশ নিয়ে সময় কাটায়। এই বৃদ্ধকালে সব মানুষের দেহ-মনে শেষ বিদায়ের বার্তা অনুভূত হয়। যেমন: কারোর মাথার কালো কুচকুচে চুল সাদা হয়ে যায়। যাকে বলে পাকা চুল। আসলে কিন্তু শেষ বিদায়ের বার্তা। আবার কারোর মুখের ভেতরে থাকা ৩২টি দাঁতই পড়ে যায়। কারোর অবশিষ্ট দু’একটা আটকে থাকে। তা-ও নড়বড়ে অবস্থায়। এইরূপ অবস্থা কিন্তু শেষ বিদায়েরই বার্তা। এই বৃদ্ধকালে শরীরের টাইট চামড়া বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিবিহীন খড়ায় কাঠফাটা রোদে চৌচির হয়ে যাওয়া কৃষকদের ফসলী জমির মতো হয়ে যায়। যাকে বলে, শরীরের চামড়া মরে গেছে। এর মানেই হচ্ছে মরণের হাতছানি।

১০. মরণকাল: বৃদ্ধকাল মানেই জীবনের শেষকাল। আর বৃদ্ধকাল শেষে মরণ কালের মরণকামড় সবারই সইতে হয়, মরতে হয়। জীব মানেই মরণশীল। এই সুন্দর পৃথিবীর সকল জীবকেই একদিন-না-একদিন মরণকে বরণ করতে হয়। সে থাকুক রাজা, নাহয় বাদশা। হোক সে ফকির, হোক গুণধর সাধু অথবা কোনও হিংস্র প্রাণী। এই পৃথিবীতে যাকিছু আছে, সবকিছুই অনিশ্চিত, কেবল জীবের মরণই নিশ্চিত। মরণকালে অনেক মানুষের মুখের জবান বন্ধ হয়ে যায়। চোখের আলো নিভে যায়। পানাহার বন্ধ হয়ে যায়। অনুভব অনুভূতি হ্রাস পায়। কেউ কেউ প্রিয়জনের কাছে কিছু কথা বলার জন্য ছটফট করতে থাকে। কিন্তু কেউ বলে যেতে পারে, কেউ পারে না। না বলা কথা মরণের সাথে মিশিয়ে দেয়। মরণকালে কারোর প্রাণপাখী উড়ে যায় শান্ত স্বভাবে। কারোর প্রাণপাখী যাওয়ার সময় সমস্ত দেহটা ভেঙেচুরে তচনচ করে ফেলে। তখন মরণকে বরণকারী মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। তারপর একসময় প্রাণপাখী উড়ে যায়। দেহটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে। সেই দেহটাকে বলে লাশ বা মরদেহ।

১১. চিরকাল: চিরকাল মানে ‘অনন্তকাল’। আর অনন্তকাল মানে চিরকাল, নিত্যতা, যুগযুগান্ত, অপরিমেয়, চিরস্থায়ী। অর্থাৎ যা ছিলো, তা থাকবে। যেমন: আকাশ, বাতাস, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র এমন। কিন্তু আমি থাকবো না। হয়তো আমার বংশধর কেউ থাকবে না।

১২. গতকাল: যে দিন গত হয়। দিন গত রাত শেষে আজও গতকাল হবে। সবার জীবনের কতকিছুই না গত হয়ে গেলো। তবুও মানুষ বেঁচে থাকে আগামী দিনের আশায়। কেউ আগামী দিনের নাগাল পায়, কেউবা হারায়। তবে এই নশ্বর ভবসংসারে কেউ আগামী দিন হারাতে চায় না। সবাই আশায় বুক বেঁধে রাখে আগামী দিনের আশায়।

১৩. আগামীকাল: রাত শেষে সূর্যোদয়ে সাথে শুরু হয় আগামীকাল। আজ নাহয় হলো না দেখা। তাতে কী! দেখা হবে আগামীকাল। তবে আজ যেই কাজটা শেষ করা যাবে, সেই কাজটা যেন কেউ আগামী কালের আশায় ফেলে না রাখে। কারণ, আগামী কালের নাগল পাওয়াটাই অনিশ্চিত!

১৪. আজকাল: আজকাল যা হচ্ছে তো হচ্ছেই। আজকাল মেয়েরা পরে ছেলেদের পোশাক। ছেলেরা পরে মেয়েদের গহনাগাঁটি। কানে ঝুলিয়ে রাখে কানপাশা। হাতে পরে চুড়ি। গলায় ঝুলিয়ে রাখে বড় সাইজের মুতির মালা। আজকাল কেউ কারোর কথা শুনে না। স্ত্রী শুনে না স্বামীর কথা। স্বামী শুনে না স্ত্রীর কথা। রাজা শুনে না প্রজার কথা। প্রজা শুনে না রাজার কথা। আর আজকাল তো ছেলেমেয়েদের কিছু বালাই যায় না। ওরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তাই আজকাল’কে আধুনিককাল বলে।

১৫. আধুনিককাল: “আধুনিক” শব্দটির অর্থ এইমাত্র। আর কাল শব্দটির অর্থ সময়। দুটে মিলিয়ে হয় এইসময়। যা বর্তমান বা সাম্প্রতিক সময়কে নির্দেশ করার জন্য ব্যবহিত হয়। একসময় বুড়ে-বুড়িরা বলতো, “সামনের দিনগুলোতে আরাস্তা (রাস্তার উপযোগী নয় এমন) রাস্তা হবে। আঘাট (ঘাটের উপযোগী নয় এমন) ঘাট হবে। এই আধুনিককালে কিন্তু তা-ই হচ্ছে। তা শহর, বন্দর, গ্রামেও লক্ষনীয়। যেখানে নর্দমা ছিলো, সেটা এখন রাস্তা। যেসব জায়গা দিয়ে মানুষ হেঁটে যেতে ভয় পেতো, সেসব জায়গায় এখন দিনরাত ২৪ ঘণ্টা লোকে লোকারণ্য। এই আধুনিককালে শিল্প কলকারখানা তথা সমগ্র বাংলাদেশের যেমন উন্নতি সাধিত হয়েছে, তেমনি মানুষের জীবনধারণেরও উন্নীত হয়েছে।

১৬. সকাল: শুভ সকাল। আবার কথার কথা “সাতসকাল”। কিন্তু সকাল সাতটা নয়, একটাই। মানে সকাল। যা সূর্যোদয়ের সাথে সাথে আরম্ভ। কিন্তু সকালের সময় আছে। এর সময় সূর্যোদয় হতে ১১.৫৯ মিনিট পর্যন্ত। এই আধুনিককালে আমরা অনেকেই সকালবেলা হাতমুখ ধুয়ে মহান সৃষ্টিকর্তাকে শুভেচ্ছা না জানিয়ে ফেসবুকে থাকা সকল বন্ধুদের শুভ সকালের শুভেচ্ছা জানাই। না জানালে ফেসবুকে থাকা সকল বন্ধুদের মনে কষ্ট পাবে, তাই। যাইহোক, সকালের সময় পেরিয়ে তারপর দুপুর। যাকে বলে শুভ দুপুর। তারপর বিকাল।

১৭. বিকাল: এই বিকাল শুরু হয় দুপুর পেরিয়ে। আমারা কেউ-না-কেউ দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়া সেরে বিশ্রাম নিই। তারপর বিকাল হতে-না-হতেই কেউ-না-কেউ প্রিয় মানুষকে সাথে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে পড়ি। উদ্দেশ্য একটু হাওয়া-বাতাস গায়ে লাগানোর জন্য। কেউ শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে। কেউ চিত্তরঞ্জন পুকুর পাড়ে। কেউ রাস্তায়। কেউবা আবার মার্কেটে থাকা নামীদামী রেঁস্তোরায়। সকলেই মেতে ওঠে আড্ডায়। সেই আড্ডা চলে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতদুপুর পর্যন্ত।

১৮. রাত্রিকাল: সূর্যাস্তের পর সন্ধ্যা ঘোর হতেই নেমে আসে রাতের আঁধার। তবে শহরাঞ্চলের মানুষ কিন্তু রাতের আঁধার টের পায় না। কারণ এই আধুনিককালে বৈদ্যুতিক বাতির ঝলমল আলো শহরাঞ্চলের রাতের আঁধার কেড়ে নিয়েছে। তাই আমাবস্যা রাতের ঘোর অন্ধকারও কেউ টের পায় না। মোটকথা কেউ বুঝেও না পূর্ণিমা কী আর আমাবস্যা কী? কিন্তু গ্রামাঞ্চলের মানুষ ঠিকই বুঝে, জানে। সন্ধ্যা হতেই তারা তড়িঘড়ি করে বাড়ির সকলের সান্নিধ্যে পৌঁছায়। কারণ গ্রামাঞ্চলে চোর-ডাকাতদের উপদ্রব বেশি। চোর-ডাকাতদের কামাই রোজগারই হয় রাত্রিকালে।

১৯. এযাবতকাল: এ পর্যন্ত সময়ে। মানে শুরু থেকে এ পর্যন্ত। যেমন: “বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পাশাপাশি বাংলাদেশের ইতিহাসে এযাবতকালের মধ্যে সর্ব্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৭.২৮৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে”। আর আমরা দেশবাসী আছি এযাবতকালের সবচেয়ে খারাপ সময়ের মধ্যে। না পারি বলতে, না পারি সইতে, না পারি মরতে।

২০. একাল: এ সময়ে। একালে যার কিছুই নেই, তার একটা মোবাইল ফোন আছে। অনেকের আছে এন্ড্রয়েড টাচস্ক্রীন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির তৈরি স্মার্ট ফোন। এ সময়ে এই অত্যাধুনিক স্মার্ট ফোনের সাহায্যে হাতের মুঠোয় দুনিয়াদারী নিয়ে ঘোরাফেরা করে। মুহূর্তেই পৃথিবীর সব খবরাখবর জেনে যায়। এই অত্যাধুনিক ছোট যন্ত্রটার সাহায্যে সবকিছু দেখা যায়, শোনা যায়। কিন্তু সেকালে এসব কিছুই ছিলো না।

২১. সেকাল: যে কাল গত হয়েছে, তাকেই বলে সেকাল। সেকালে ঘরে ঘরে কালার টেলিভিশন ছিলো না। যা ছিলো, তা-ও সাদাকালো ছোট একটা টেলিভিশন। তা-ও ছিলো দশ গ্রামের ভেতরে দু’একটা বাড়িতে। সবার হাতে হাতঘড়ি ছিলো না। যাদের হাতে হাতঘড়ি থাকতো, তারা ছিলো বড় শিক্ষিত লোক। সবার গলায় ট্রাই বাঁধা ছিলো না। ছিলো রাষ্ট্রপ্রধান ও মন্ত্রীদের গলায়। আর আদালতে থাকা বিচারকের ও অ্যাডভোকেটদের গলায়। আর এখন রাস্তার টোকাইদের গলায়ও ট্রাই বাঁধা থাকে। হাতঘড়ির তো মানসম্মান আরও অনেক আগেই চলে গেছে।

২২. কলিকাল: কলিকাল বা কলির কাল বা করিরযুগ। এই কলিযুগ হিন্দু ধর্মে চার যুগের মধ্যে এক যুগ। যথা: সত্যযুগ, ত্রেতাযুগ, দ্বাপরযুগ, ও কলির যুগ বা কলিযুগ। সত্য যুগের আয়ু ছিলো, ১৭.২৮.০০০ বছর। এই যুগে কোনও পাপ ছিলো না।
ত্রেতা যুগের আয়ু ছিলো, ১২.৯৬.০০০ বছর। এই যুগে পুণ্য ছিলো তিনভাগ, পাপ ছিলো একভাগ।
দ্বাপর যুগের আয়ু ৮.৬৪.০০০ বছর। এই যুগে পুণ্য অর্ধেক, পাপ অর্ধেক।
কলি যুগ বা কলির যুগ বা কলিকাল আক্ষরিকভাবে কলির যুগ, বা “পাপের যুগ।

এই কলির যুগ বা কলির কাল বা কলিকাল হলো হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী চার যুগের শেষ যুগ। এই কলি যুগের আয়ু হলো, ৪,৩২,০০০ বছর। কলি যুগে পুণ্য এক ভাগ, পাপ তিন ভাগ। মানুষের আয়ু প্রায় একশ বছর । মানুষের শরীরের দৈর্ঘ্য নিজের হাতে সাড়ে তিন হাত । প্রাণ বাঁচে ডালভাতে। তীর্থ গঙ্গার জলে। এই যুগে ধর্ম সংকোচিত। মানুষ তপস্যাহীন, সত্য থেকে দূরে অবস্থানরত। রাজনীতি কুটিল। শাসক ধনলোভী। ব্রাহ্মণ শাস্ত্রহীন। পুরুষ স্ত্রীর অনুগত। সৎ মানুষের কষ্ট বৃদ্ধি। দুষ্টের প্রভাব বৃদ্ধি। এই যুগে মানুষের ইচ্ছা পূর্ণ করা প্রায় অসম্ভব। মোটকথা পাপে অনুরক্ত। তাই এতো এতো রোগব্যাধি। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী দেখা দিয়েছে একপ্রকার প্রাণঘাতী ভাইরাস। বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসের নাম রেখেছে করোনাভাইরাস।

২৩. করোনাকাল: সব কালের শেষকাল করোনাকাল। হিন্দু ধর্মে চার যুগের শেষ যুগ হলো কলির যুগ। অনেকেই বলে কলিকাল। আর কলি কালেরও শেষকাল হতে পারে করোনাকাল। এই করোনা কালের আবির্ভাব গণচীনের উহান শহরে। সময়টা ছিলো ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। এই করোনাকালের আয়ু হবে কেয়ামত বা প্রলয় পর্যন্ত।এই প্রাণঘাতী ভাইরাস বাতাসে ভেসে বেড়ায়। মানুষের শরীরে প্রবেশ করে হাত-মুখ, চোখ ও নাককান দিয়ে। লক্ষ্মণ সর্দি-জ্বর,কাশি, মাথাব্যথা-সহ আরও কিছু উপসর্গ।

এই করোনাকাল আমাদের সামনে কবে থেকে কবে হাজির হয়েছে, তা এদেশের একটা মাসুম বাচ্চাও জানে। তবে কবে নাগাদ করোনাকাল শেষ হবে তা আর কেউ জানে না। এই করোনাকালে সারা বিশ্বই এখন বিপদগ্রস্ত। এই করোনাকালে সারাবিশ্বে কতো কতো মানুষ যে প্রাণ হারিয়েছে, তা প্রতিদিন খবরে প্রকাশ হচ্ছে। তবে কতো ব্যবসায়ী যে তার পূঁজি বাট্টা সহায়সম্বল শেষ করে দিয়েছে, তার কোনো হিসাব-কিতাব নেই। কতো শিশু যে লেখাপড়া ছেড়ে জীবন বাঁচানোর ধান্দায় রাস্তায় নেমেছে, তারও কোনও হিসাব নেই।

কতো গৃহিণী মা যে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে দিনের পর দিন না খেয়ে আছে, তারও কোনও হিসাব নেই। কতো বৃদ্ধ বাবা যে অবুঝ সন্তানের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দেয়ার জন্য হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করছে, তারও কোনও হিসাব নেই। হিসাব আছে শুধু মহামারি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কতজন মারা যাচ্ছে, তার হিসাব। কিন্তু কোটি কোটি অসহায় মানুষ যে জীবিত থেকেও নিজেকে মৃত ভাবছে, তার হিসাব কারোর কাছেই নেই।

১৬/১৭ কোটি মানুষের দেশে এই হিসাব রাখাও তো সম্ভব হয়ে পরছে। তবে বর্তমান সরকার এই সময়ে এই করোনাকালে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে, যাতে কেউ যেন না খেয়ে থাকে। পাশাপাশি এই করোনাকালে করোনা সংক্রমণ থেকে মানুষ বাঁচতে সরকার নিরুপায় হয়ে একের পর এক লকডাউন ঘোষণা দিচ্ছে। তবুও কিছুতেই এই করোনা কালটাকে সামলাতে পারছে না। দিনদিন নতুন করে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেই। জানি না এই করোনা কালের শেষ কোথায়?

করোনা কালের ইতিহাস

download-1-30

২০১৯ সালের শেষদিকে প্রাণঘাতী নভেল করোনা ভাইরাস যখন গণচীনে আবির্ভূত হয়েছিল, তখনো এ-দেশের কোটি মানুষের মতো আমিও ছিলাম নির্ভয়ে। ভয়টা বেড়ে গিয়েছিল, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমদিকে। সে-সময় নিজের সহধর্মিণী জ্বর-সর্দি- কাশিতে ভুগতে ছিল। এই ডাক্তার, সেই ডাক্তার, এটা-ওটা করতে করতে কেটে গেলো, দিনেক ৭ দিনের মতো। তারপরও যখন সহধর্মিণীর শরীরের জ্বর-সর্দি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিলাম না, তখন আমি রীতিমতো আমার সহধর্মিণীর আশা ছেড়ে দিয়ে নীরবে কাঁদতে লাগলাম। কারণ, সে-সময় গণচীনের করোনা ভাইরাস গণচীন থেকে উড়তে- উড়তে পৃথিবীর অনেক দেশে বিরাজ করছিল। কিন্তু আমাদের দেশে তখনো করোনা ভাইরাসের আগমনের খবর ছিলো না।

যদিও তখন আমাদের দেশে ঘাতক করোনা ভাইরাসের আগমন ঘটেনি, তবুও সহধর্মিণীর শারীরিক অবস্থার অবনতি দেখে আমার মনে শুধু করোনা ভাইরাসের করুণ সুর বাজতে ছিলো। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম, হয়তো আমার সহধর্মিণীকে গণচীনের করোনা ভাইরাসে আক্রমণ করেছে। নিজের মনে এইরকম ভাবনা থেকে আমি নিজেও একরকম কাহিল হয়ে পড়লাম। কিন্তু নিজের চেনা-জানা ছাড়া অন্য কারোর সাথে এব্যাপারে কোনও কথা বলতাম না। না বলার কারণ ছিলো করোনা ভাইরাস। মনে মনে ভাবতাম! যদি কারোর কাছে সহধর্মিণীর জ্বর-সর্দির কথা বলি, তাহলে মানুষ মনে করবে আমার সহধর্মিণী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। সেই ভয়ে আমি মহল্লার অপরিচিত কারোর কাছেই এ-বিষয়ে কোনও আলাপ করতাম না।

একদিন পরিচিত এক ব্যক্তি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “দাদা, দিদি কেমন আছে?” উত্তরে আমি বললাম, ‘বেশি ভালো না, দাদা।’ আমার কথা শুনে পরিচিত ব্যক্তি জানতে চাইলো, “দিদির কী এমন সমস্যা হয়েছে?” তখন পরিচিত ব্যক্তির কাছে সবকিছু খুলে বললাম। উনি আমাকে উনারই পরিচিত একজন বিজ্ঞ ডাক্তারের ঠিকানা দিলেন এবং খুব তাড়াতাড়ি সেই ডাক্তারের কাছে আমার সহধর্মিণীকে নিয়ে যেতে বললেন। উনার কথা শুনে আমি সেদিন সে-সময়ই ফোনের মাধ্যমে সিরিয়াল লিস্টে নাম লেখালাম। পরদিন বিকালে আমার সহধর্মিণীকে নিয়ে ওই বিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তারের চেম্বারে আরও আরও রুগীদের সাথে কিছুক্ষণ বসে থাকার পরই আমার সহধর্মিণীর নাম ডাক পড়লো। ডাক্তার সাহেব রুগীর মুখে বিস্তারিত শুনে তিনটে পরীক্ষা-সহ কিছু ঔষধ লিখে দিলেন। এক-এক করে পরীক্ষাগুলো করানো হলো। রিপোর্ট বের হবে এর পরদিন।

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরুলাম। ঔষধের দোকান থেকে তিনবেলার ঔষধ কিনলাম। বাসায় এসে রাতে এক-এক করে দুই-তিন পদের ঔষধ খাওয়ালাম। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখন কেমন লাগছে?’ বলল, “কই, আগের মতনই তো!” কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি গতকালের চেয়ে আমার সহধর্মিণী চেহারা- সুরত একটু ভালো। মনে মনে প্রভুকে ডাকতে লাগলাম! সকালেও এক ডোজ ঔষধ খাওয়ালাম। দুপুরবেলাও খাওয়ালাম। বিকালবেলা আবার সহধর্মিণীকে বিজ্ঞ চিকিৎসকের চেম্বারে নিয়ে গেলাম। ডাক্তারের দেওয়া শারীরিক পরীক্ষার রিপোর্টগুলো সংগ্রহ করে ডাক্তারের কাছে গেলাম।

ডাক্তার সাহেব পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট দেখে আবার ৭ দিনের ঔষধ লিখে দিয়ে বললো, “এই ঔষধগুলো ঠিকমত সেবন করে ৭দিন পর যেতে। প্রথমবারের ভিজিটের অর্ধেক মূল্য ভিজিট দিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরুলাম। ৭ দিনের ঔষধ কিনে বাসায় ফিরলাম। রাতে ঔষধ খাওয়াল। পরদিন সকালবেলা দেখি আমার সহধর্মিণীর শারীরিক অবস্থা গত দুইদিনের চেয়ে অনেক ভালো। চলতে থাকলো ঔষধ। আস্তে-আস্তে সহধর্মিণীও সুস্থ হতে লাগলো। ৭ দিন গত না হতেই আবার বিজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলাম। বিজ্ঞ চিকিৎসক আবার কিছু ঔষধ লিখে দিলেন। কিছু ১৫ দিনের, কিছু ১ মাসের। ঔষধ কিনে বাসায় আসলাম। দিন যতো গত হতে লাগলো, সহধর্মিণীও সেই আগের অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করলো। কেটে গেলো ফেব্রুয়ারি মাস।

একসময় মার্চ মাসের আগমণ ঘটলো। করোনা ভাইরাস নিয়ে দেশের চারদিকে শোরগোল শুরু হয়ে হলো। মার্চ ২০২০ দেশে প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রুগী সনাক্ত হলো। মার্চের শেষদিকে করোনা ভাইরাসে প্রথম মৃত্যু ঘটলো। সরকার রেডিও, টেলিভিশনে ও জাতীয় পত্রপত্রিকায় করোনা ভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকতে দেশের জনগণকে সতর্কতা অবলম্বন করে চলা-ফেরা করতে বললো। পাশাপাশি বিশ্ব রোগ বিশেষজ্ঞ ও দেশের রোগ বিশেষজ্ঞরাও নানারকম পরামর্শ দিতে শুরু করলো। তাতেও যখন করোনা ভাইরাসের উপদ্রব কমানো যাচ্ছিল না, তখনই শুরু হলো লকডাউনের চিন্তা। একসময় সারা দেশই লকডাউনের আওতায় নেওয়া হলো। ঐ লকডাউনের ফলে ধর্মীয় উপসনালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বানিজ্যিক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেলো। এমনকি সরকার দূরপাল্লার যানবাহন-সহ লোকাল যাত্রি পরিবহন ও বহির্বিশ্বের সাথে বিমান চলাচলও বন্ধ করে দিলো। মানুষের রুটিরুজির সংগ্রাম একেবারে থেমে গেলো।

তখন একদিকে শুরু হলো গরিব মানুষের হাহাকার ও ক্ষুধার্তের কান্না। অন্যদিকে বাড়তে লাগলো করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার। তখন দেশের প্রায় ১৭ কোটি জনগণ হয়ে পড়লো একরকম কর্মহীন ঘরবন্দী। জনগণের মনে বিরাজ করতে লাগলো করোনা ভাইরাসের ভয়! আর রাত পোহালে খাবারের চিন্তা। সাথে ভাইরাসের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো দেশের সর্বত্র।

তখন করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে দেশের মানুষ এমন ভীত হয়ে পড়লো যে, কারোর সাধারণ সর্দি-জ্বর হলে, ওই সর্দি-জ্বরের রুগীর পরিবারের সাথে সমাজের আরও দশটা পরিবারের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যেতো। বুড়ো মা-বাবাকেও রাস্তায় ফেলে দেওয়া হতো, যদি সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হতো। দাদা-দাদি, ভাই-বোন কারোর জ্বর হলেই হতো সর্বনাশ। কোনোকোনো সংসারে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ফাটল ধরতে শুরু করছিল। তখন একদিকে মানুষের ছিলো না কাজকর্ম। অন্যদিকে ছিলো করোনা ভাইরাসের ভয় আর কর্মহীন মানুষের ক্ষুধার চিৎকার।

এমতাবস্থায় দেশে গণমানুষের সরকার সিংহভাগ কর্মহীন দরিদ্র জনগণ ও ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে ঘোষণা দিলো হাজার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা। ওইসব প্রণোদনার মধ্যে ছিলো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য সুদ বিহীন ঋণ। গরিব সাধারণ মানুষের জন্য ছিলো রিলিফ-সহ নগদ অর্থের যোগান ও বিনামূল্যে করোনা ভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবার কার্যক্রম। যা এখনো দেশে কোথাও-না-কোথাও সেই কার্যক্রম চালু আছে। একসময় ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়া জনজীবনের সবকিছু আবার সচল হতে শুরু করলো। জনজীবনে কিছুটা স্বস্তি নেমে আসতে লাগলো। করোনা ভাইরাসের আক্রমণও কিছুটা হ্রাস পেতে শুরু করলো। মৃত্যুর হারও কমতে লাগলো।

পরিবর্তন ঘটতে শুরু হলো মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কিছু অভ্যাস। যেমন- মুখে মাস্ক পড়া। নিয়মিত হাত ধোয়া। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। স্যানিটাইজার ব্যবহার করা। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাতে গরম গরম লাল বা রং চা সেবন করা। ঘরের বাহির না হওয়া। দিনে অত্যন্ত দুই একবার ব্যায়াম করা। সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা-সহ আরও অনেক নিয়মকানুন। করোনা ভাইরাস থেকে দেশের জনগণকে বাঁচতে এসব নিয়ম দিক নির্দেশনাগুলো ছিলো দেশের বিজ্ঞ চিকিৎসকদের। এছাড়াও নির্দেশ ছিলো, কারোর সামান্য সর্দি-কাশি হলে সাথে সাথে নিকটস্থ ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হওয়া। অমুক নাম্বারে কল করে যোগাযোগ করা। তমুক নাম্বার থেকে সাজেশন নেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। করোনা ভাইরাস আক্রমণের ভয়ে দেশের জনগণও বিজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে চলতে থাকলো সবাই। একসময় মার্চমাস পেরিয়ে এপ্রিল, মে, জুন, জুলাই, আগষ্ট গত হতে লাগলো।

এরমধ্যেই শুরু হলো আমার বাম হাতের অনামিকা আঙুলে ব্যথা। প্রচণ্ড ব্যথা। মাঝেমধ্যে আঙুলের ব্যথায় পুরো হাতই অবস হয়ে যেতো। এভাবে দিন যায়, সপ্তাহ গড়ায়, কিন্তু আঙুলের ব্যথা নিরাময় হচ্ছিল না। বরং দিন-দিন বেড়েই চলছিল। তারপর নিকটস্থ ফার্মেসি থেকে ব্যথার ঔষধ কিনে সেবন করতে লাগলাম। কিন্তু তাতেও যখন কোনও উপকার পাচ্ছিলাম না, তখন পরিচিত এক ব্যক্তির সাথে নিজের হাতের আঙুলের সমস্যার কথা বললাম। উনি নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে চাকরি করতেন। উনি আমাকে হারের (অর্থোপেডিক্স) ডাক্তার দেখাতে বললেন। কিন্তু হারের ডাক্তার সম্বন্ধে আমার তেমন ধারণা ছিলো না বলে, আমি উনার মাধ্যমেই নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের সামনে থাকা এক হারের ডাক্তারের কাছে গেলাম। ওই ডাক্তারের ভিজিটি ছিলো ৮০০/= টাকা।

সিরিয়ালে নাম ডাক পড়লে আমি-সহ পরিচিত ব্যক্তি ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলাম। করোনা কালে বিজ্ঞ হারের ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশ করে মনে হচ্ছিল যে, আমি যেন চাঁদের দেশে অবস্থান করছি। আর বিজ্ঞ ডাক্তার সাহেবকেও দেখা যাচ্ছিল চাঁদের নভোচারী। ডাক্তারের শরীরে ধপধপে সাদা প্লাস্টিকের জামা। যেটাকে বলা হয় পিপি। হাতে ডাবল গ্লাভস। মুখে ডাবল মাস্ক। চোখে বড় আকারের চাঁদের দেশে যাওয়া নভোচারীদের মতো চশমা। সামনে দাঁড়ানো আছে ডাক্তারকে সাহায্যকারী পিয়ন বা উনার কর্মচারী। আমি সত্যি ভয় পেলাম! অবাকও হলাম। কিন্তু এ-বিষয়ে কিছু বলার সুযোগ না থাকায়, কিছুই বললাম না, জিজ্ঞেসও করলাম না। শুধু আমাকে সাথে করে নিয়ে যাওয়া পরিচিত লোকটাকে কানে-কানে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ডাক্তার সাহেবের এ-অবস্থা কেন?’ জবাবে উনি বললো, “ডাক্তার সাহেব করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলো। গত একমাস আগে ডাক্তার সাহেব ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থেকে ভাইরাস মুক্ত হয়েছেন। তাই উনার এই পোশাক, এই ড্রেস। উনি এখনও করোনা ভাইরাসের ভয়ে ভয়ে আছেন।” শুনলাম সব কথা। বুঝলাম অনেককিছু।

আমি ডাক্তার সাহেবের সামনা-সামনি বসলাম। আমার সামনে দেখতে পেলাম সাদা চকচকা কাঁচের গ্লাসের বাক্স। দেখতে হুবহু সিনেমা হলের টিকেট কাউন্টারের বুকিং এর মতো। বসার উপরিভাগে হাত ঢুকানোর জন্য বড় আকারের ছিদ্র আছে। ডাক্তার সাহেব আমার সমস্যা জানতে চাইলে, আমি আমার সমস্যার কথা বললাম। উনি আমাকে হাতের আঙুল দেখাতে বললেন। আমি গ্লাস বক্সের সেই ছিদ্র দিয়ে নিজের হাত ঢুকাতেই ডাক্তার সাহেবের কর্মচারী আমাকে সরাসরি হাত ঢুকাতে বারণ করলেন। আমি আর হাত ঢোকালাম না। চুপচাপ বসে আছি। ডাক্তার সাহেবের কর্মচারী একটা বড় স্যানিটাইজারের বোতল আমার সামনে এনে আমাকে হাত বাড়াতে বললো। আমি হাত বাড়াতেই আমার বাম হাতে স্প্রে করা শুরু করলো। দুই-তিন বার স্প্রে করার পর হাত ঢুকানোর অনুমতি দিলো। আমি গ্লাসের ছিদ্র দিয়ে বামহাত ঢোকালাম। ডাক্তার সাহেব আমার বাম হাতের ব্যথাযুক্ত আঙুলটা টেনে-টুনে, আর নেড়ে-চেড়ে দেখলো। যেই আঙুলটা ব্যথা, সেই আঙুলে সিপ্টিপিন দিয়ে গাঁই মেরে বললো, আমি টের পাচ্ছি কি-না। আমি বললাম, ‘টের পাচ্ছি এবং ব্যথাও পাচ্ছি!’ আমার কথা শুনে ডাক্তার সাহেব উনার কর্মচারীকে উনার হাতে স্যানিটাইজার দিয়ে স্প্রে করতে বললো।

কর্মচারী সাথে সাথে স্যানিটাইজারের বড় বোতল এনে প্যাঁচপ্যাঁচ করে ডাক্তার সাহেবের হাতে দুই-তিন বার স্প্রে করলো। এরপর ডাক্তার সাহেব উনার প্রেসক্রিপশন লেখার পেইড টেনে কলম দিয়ে লিখতে লাগলো। ডেসক্রিপশন লিখছে, আমি তাকিয়ে আছি। উনি বাম সাইটে দুই-তিনটে ঔষধ লিখে ডান সাইটে কী কী পরীক্ষা করতে হবে, তা লিখলেন। প্রেসক্রিপশন আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে সাথে যাওয়া লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী কী পরীক্ষা করতে হবে?’ সাথে যাওয়া লোকটি প্রেসক্রিপশন দেখে বললো, “প্রথমে করোনা ভাইরাস নমুনা পরীক্ষা করতে হবে। তারপর হাত ও আঙুলের রগের দুইটা পরীক্ষা করতে হবে।” সাথে যাওয়া লোকটিকে বললাম, ‘আমি করোনা ভাইরাস নমুনা পরীক্ষা করবো না। এতে আমার মরণ হলেও না। মোটকথা চিকিৎসার দরকারই নেই।’ আমার কথাগুলো ডাক্তার সাহেব শুনছিলেন, কিন্তু কিছুই বললো না। সাথে যাওয়া লোকটি আমার কথা শুনে একরকম অবাকই হলেন।

ডাক্তারের ভিজিট ৮০০/= টাকা বুঝিয়ে দিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে বাইরে এলাম। দুইজনে চা-সিগারেট পান করলাম। আমি আমার সাথে যাওয়া লোকটিকে বললাম, ‘দাদা, আপনি দয়া করে আবার একটু ডাক্তারের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন, করোনা ভাইরাস নমুনা পরীক্ষা ছাড়া চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্র দেওয়া যায় কি-না।’ উনি আমার কথা শুনে ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরে এসে বললো, “না দাদা, করোনা নমুনা পরীক্ষা করা ছাড়া উনি চিকিৎসা করবেন না।” সাথে যাওয়া লোকটির কথা শুনে আমি আর কিছুই বললাম না, সোজা বাসায় ফিরে এলাম।

এর দুইদিন পর পরিচিত লোকটার সাথে দেখা। জিজ্ঞেস করলো, “দাদা হাতের ব্যথার চিকিৎসার কী খবর? পরীক্ষা কবে করাবেন?” আমি বললাম, ‘না দাদা, আমি করোনা ভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করতে নারাজ! লোকটা জিজ্ঞেস করলো, “কেন?” বললাম, ‘যেই দেশে ঘাতক করোনা ভাইরাস নমুনা পরীক্ষা নিয়ে সর্বত্র দুর্নীতি আর তেলেসমাতি চলছে, সেই দেশে এই জটিল পরীক্ষার কী এমন গ্যারান্টি আছে? দেখতেই পারছেন প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই সবার চোখে পড়ে নমুনা পরীক্ষার তেলেসমাতির খবর। আর আমি নাহয় পরীক্ষা করালাম, দাদা। কিন্তু পরীক্ষা করার পর যদি ভুল রিপোর্টে আমার পজেটিভ আসে, তাহলে আমার গরিবের সংসার-সহ ভাড়াটিয়া বাড়ির সবাইকে লকডাউনে ফেলে রাখা হবে। তাই আর নমুনা পরীক্ষা অন্তত আমি করবো না। এতে আমার কিছু হলে হোক।’ আমার কথা শুনে লোকটা আর কিছুই বললো না, সোজা উনার কাজে উনি চলে গেলো। আমিও আমার সিদ্ধান্তের মাঝেই রয়ে গেলাম। ভাবেই গত হয়ে গেলো বেশ কয়েক মাস।

কিন্তু আমি আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি। আমার সহধর্মিণীও ভালো আছে। জানি না সামনের দিনগুলোতে কী হয়! আশা করি সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও যখন করোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন প্রয়োগ শুরু হয়েছে। তখন সামনের দিনগুলো ভালোভাবেই অতিবাহিত হবে। রোগ আসে। রোগ নিরাময়ের ঔষধও আবিস্কার হয়। দিন মাস বছর গত হয়। ফেলে আসা দিনগুলো শুধু ইতিহাস হয়ে রয়। এটাও আমাদের জীবনেরই একটা ইতিহাস। যার শিরোনাম করোনা কালের ইতিহাস।

মানুষের শরীরই করোনার বাড়ি

করোনা ভাইরাস ঠেকাতে আমরা অনেকেই অনেক কিছু করছি- সচেতনতার জন্য লিফলেট, মাস্ক, সাবান এবং কি লকডাউন মোকাবেলার জন্য দরিদ্র অসহায়দের মাঝে খাবার বিতরণ! আপাত দৃষ্টিতে এই কাজগুলো খুব ভাল কাজ। এবং এসব করে আমাদের আত্ম তুষ্টিরও অভাব নাই।

কিন্তু এই ভাইরাস ঠেকাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কিছু না করা!

হ্যাঁ ভাই। আপনি কিছু না করে শুধু মাত্র নিজেকে একা করে ফেলুন অন্যদের থেকে সরিয়ে রাখুন। হোক তা ঘরে বা ঘরের বাহিরে আপনি শুধু আলাদা হয়ে যান! ..
বিশ্বাস করুন এটিই হবে এই ভাইরাস ঠেকাতে সবচেয়ে বড় কাজ। এবং আপনার নিজের ও অন্যের কল্যাণের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারন করোনা ভাইরাস এমন একটি ভাইরাস যা শুধু মাত্র মানুষই বহন করতে পারে, মানে এই ভাইরাস শুধু মাত্র মানুষের শরীরেই বসবাস করতে পারে।

তাহলে আপনি নিজেই ভাবুন। আপনার নিজের ও অন্যের উপকার যদি করতে হয় তাহলে কি করতে হবে? সবচেয়ে বেশি উপকার হবে যদি কিছু না করে একা হয়ে যান। এই যুদ্ধটাই এমন। তা নইলে আগামী বিশেষজ্ঞদের মতে এটি সারা পৃথিবীর মানুষকে নিজেদের বসবাসের জন্য দখল করে নেবে। এর মধ্যে ঝরে পড়বে দশ শতাংশ প্রাণ! মানে প্রায় ছয় কোটি মানুষ!

প্লিজ ঘরে থাকুন। একা থাকার সুযোগে বেশি বেশি এবাদত করুন। কোরান পাঠ, জিকির, ও নামাজের মাধ্যমে স্রষ্টার সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ লাভ করুন। আল্লাহ সকলের মঙ্গল করুন। আমীন…