ট্যাগ আর্কাইভঃ চিঠির বাক্স

প্রিয় চিঠিওয়ালী

চিরকুট : ১২। তারিখ:-২৪ বৈশাখ ১৪২৬ বাংলা।

প্রিয় চিঠিওয়ালী,
পত্রারম্ভে জানাই জ্যৈষ্ঠের ভর দুপুরে রুক্ষ প্রকৃতি নগরে ঘ্রাণ বিলানো পাকা কাঁঠালের হলুদ রঙ রোয়া শুভেচ্ছা।

কোলাহল ও ব্যস্তময় ঢাকা শহরের কর্ম ব্যস্ততাকে গা-ডাকা দিয়ে নির্জন কোন সমুদ্রতটে বসে তোমায় লিখছি। মাত্র দু দিন তোমায় নিয়ে একটা বাক্য লেখা হয়নি তাতেই মনে হচ্ছে এক যুগ ধরে তোমায় লিখা হয় না।
কেমন আছো নগরে কল্লোলিনী?
আমি ভালো আছি তবে নিখাদ একাকীত্বে চাপা পড়ে যাচ্ছে ভালবাসার কবিতাগুলো। এখনো কি একলা একা নিজের সাথে গল্প করো আবেশে? একাকী থাকতে থাকতে একা থাকার বদঅভ্যাসে আমিও অভ্যস্ত হতে শিখে গেছি। যদি মুখ ফসকে কেউ বলে দিত হঠাৎ আমি তোমাকে ভালবাসি, তবে সে ভালবাসা আমি ভালবাসা হিসেবে দেখিনে।

তোমায় অক্ষি পাতের অজুহাতে মনের ভুলে পথের মোড়ে মুখ ফিরিয়ে দাড়িয়ে থাকি, কেন বলতে পারো? তোমার অভিমান ভরা নয়নে আজ কদিন নয়নকূল হয়নি আমার। দেখিনি তোমার বিমুগ্ধ চাহুনী। ভালবাসা কখনো একদিন কারো প্রতি জমেনা। অপেক্ষার উপেক্ষিত নীরব আর্তচিৎকারের সাক্ষী আকাশ- বাতাশ, চন্দ্র-সূর্য,আলো-আঁধার, জোনাক-ঝিঁঝিঁ।

আমার চারিপাশ আঁধার ঘেরা পৃথিবী,তোমার পাশে আলোর মশাল। নীরব চিত্তে তোমায় ভালবেসে যাওয়া মানুষটা দেখতে আনস্মার্ট হলেও সাদা মনের। স্মার্ট মানে কি আমি বোধহয় জানিনা। অপরাজিত গল্পের ছন্নমতি ভাব কবিতার আড়ষ্টতা কাটেনি তোমার অভিযোগে। আমার অপূর্ণতার ষোলকলা পূর্ণ করে দিয়েই তুমি বিদায় নিলে।একাকীত্বে আমায় কি আজও তোমায় একটিবার মনে পড়েনি? তীক্ষ্ণগন্ধ অভিযোগের ঝুম বৃষ্টি ঝরে মনের স্তব্ধ উঠোনে, বিচ্ছিরি তারাদের সাথে জেগেছি বহুরাত একাকী,আমিও তোমার গল্প লিখি, দর্পহারী সে গল্পের পাঠক কেবলি আমি। গৌরীশৃঙ্গের মত তোমার মনের দুয়োরে আমার ভালবাসা পৌঁছেনি, পৌঁছেছে আমার দোষগুলো। মানুষ ত্রুটি বা ভুলের উর্ধ্বে নয়, তোমারও ভুল আছে। সংজ্ঞাহীন ভালবাসার ঝড়ে আমি আর আমার জাহাজ ধ্বংস হয়েছি বারবার।

আবার ফিরে আসি তোমার মনের মেঘ হয়ে। ক্লান্ত নিভু নিভু চোখে আজও রঙিন তোমায় হাসি ম্লান হয়নি। অকস্মাৎ হারিয়ে যাবো তোমায় না জানিয়ে কোন এক শেষ রাতে বা সন্ধ্যায়। অসময়ী অভিমানী মেঘ জমে মনে আর বৃষ্টি হয়ে নামে চোখে, সে বৃষ্টিতে আমার মনের তট ভিজে যায় আবেগ সাইক্লোনে। আমি গুম হয়ে যাবো গভীর ঘুমে কোন একদিন, কাউকে না জানিয়ে যে আমি চলে যাবো। আমার বক্ষপটে দুঃখ পুঁতে দিয়ে তুমি কোথায় নিখোঁজ সুখের খোঁজে? গভীর রাতে আমার মনের গহীন ঘরে বাজে শূন্যতার একতারা, সে একতারার শব্দশ্রোতা নির্বাক ছায়ার মত।

মিছেমিছি দোষ দিও আমায় জোনাকিরা, আমি তোমাদের সুখের সাথী হতে পারিনি। ইচ্ছে করে কবিতার খাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলি, ছিঁড়ে ফেলি চিরকুট, কেবল তুমি আছো বলেই পারিনে। আমায় একটু দেখ তোমার আড়চোখে যত্ন করে, এ পাগল তোমারে ভালোইবাসে। আমায় আবার তুমি চিনবে নতুন করে, কিন্তু হয়তো ততদিনে তুমি অনেক দেরি করেই ফেলবে।

সমুদ্রতটে অস্তমিত সূর্যকে সাক্ষী রেখে তোমায় বললাম ওহে প্রিয় ভালবাসি তোমায়। আজ আর নয়। প্রতিক্ষা ক্রমাগত বাড়ছেই, মন খারাপের দিনগুলো আমায় মুক্তি দিবে কবে? চিঠিওয়ালার চিঠিতে শব্দরা ঘুমে ঢুলে ঢুলে পড়ছে, তাই আর লেখা হলোনা। নতুন কোন জায়গায় নতুন করে আবার লিখার অপেক্ষায় প্রিয় মনোভবী। ভাবনার ওপারে ভালো থেকে ওহে মনোভবী সুশ্রী। আমায় নিয়ে ভাবনা ভেবে কোন লাভ নেই।

ইতি
তোমার অপ্রিয় মানব।

দূর পরবাসে রোযা মুখে নিয়ে তোমায় লিখছি মমতাময়ী মা

তারিখ: ০৩ রমযান ১৪৪০ হিজরি

প্রিয় মমতাময়ী মা

গ্রীষ্মের কাঠফাটা গরমে আমার কর্মব্যস্ততায় শরীর নিংড়ানো মুক্তঝরা ঘাম জড়ানো শুভেচ্ছা।

কেমন আছো রণাঙ্গনের জননী সাহসিনী। রমযানের তৃতীয় রোজা মুখে নিয়ে মাগরিবের ঠিক আগ মূহুর্তে সামান্য কিছু ইফতারী সামনে নিয়ে হাজার হাজার মাইল দূর প্রবাস সৌদি আরব থেকে তোমায় লিখছি।

দূর পরবাসে বসে জীবনে প্রথমবারের মতো তোমাকে চিঠি লিখছি। কেমন আছো জীবন যুদ্ধের জয়ী সংগ্রামী মা। আমি অালহামদুলিল্লাহ তোমার দোয়ার বদৌলতে অনেক ভালো আছি। আমার হৃদয়ের অলিগলিতে অসংখ্য অব্যক্ত অক্ষরগুলো প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে তোমার কাছে পৌঁছাবে বলে। কতগুলো বছর পার হয়ে গেল তোমাকে স্পর্শ করি না, তোমার ঐ মায়াভরা চাঁদ মুখ দেখিনা। রোযা রাখার অভ্যাসটা যদি তুমি না গড়ে দিতে, তাহলে হয়তো রোযার ফযিলত হতে বঞ্চিত হতাম। কোন ডাক্তারী পড়ালেখা ছাড়াই তুমি হলে পৃথিবীর একমাত্র জগত শীর্ষ ডাক্তার যার তুলনা হয়না। কিছুক্ষণ পরেই মাগরিবের আযান শুরু হবে,সামনে বাহারি রকমের ইফতার নিয়ে বসে আছি এমন মিথ্যা বাক্য বললেও চিঠির কথামালায় তুমি নিশ্চই সত্য উদঘাটন করবে তোমার পবিত্র চিত্তপটে বা অন্থঃকরণে, গুটি কয়েকটি খেজুর আর পানি দিয়ে আজ আমার রোযা খোলা হচ্ছে। কিন্তু এই ইফতারে আমি ঐ স্বাদ পাই না, যে স্বাদ তোমার নিজ হাতের বানানো আলুরচপে, বেগুনি, ছোলা বুট, নিমকি, ডালের বড়াতে আমি পেয়েছিলাম। হয়তো দুনিয়া থেকে পরলোক গমণের আগ সময় পর্যন্ত সে স্বাদ আমার মুখে লেগে থাকবে।

জানো আম্মা, আমার এই পরবাস দুনিয়াটা ভীষণ সুন্দর। তবুও কেন জানি এ সুন্দরের ভীড়ে তোমার অমন সুন্দর মুখ আমি খুজে পাই না। আমার এ পৃথিবীটা ধূসর লাগে তুমি নেই বলে। জীবনটা দুর্বিসহ মনে হয় তুমি দূরে বলে। তোমার কাছে আমার অনেক অনেক অভিযোগ,কেন এত আদর, স্নেহে বড় করলে আমায়। রোজ ইফতারের সময়ে আমি তোমাকে মনে করি, আর দু চোখের পানি আমার মুখের গাল বেয়ে পড়ে তোমার তরে। তুমিও নিশ্চই আমায় স্মরণ কর ইফতারের আগ মূর্হতে, আর চোখের পানি ফেল জায়নামাজের প্রার্থনায়। ভাগ্য বিধাতা যখন আমাকে তোমার থেকে যোজন যোজন দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন,তখন কেন তোমাকে নির্দয় পাষণ্ড করে সৃষ্টি করেননি। তাহলে অন্তত এ দূর পরবাসে ইফতারের আগ সময়ে আমার দূর পৃথিবীর কাচের দেয়ালের ওপাশে বসে আমার নিথর নিষ্প্রাণ আত্মাটা তোমার জন্য ডুকরে কেদে মরত না!

জান, আমার সব আছে, শুধু তোমার স্নেহটুকু নেই। উন্নত প্রযুক্তির দেশে এখন আর কেউ আমাকে খাইয়ে দেয় না। হাজার দিন হয়ে গেলো তোমার হাতের রান্না করা খাবার খাওয়া হয়না। তোমাকে ঘিরে সব ভালবাসারা হারিয়েছে স্মৃতির মণিকোঠায়। আমার নির্ঘুম রাত্রিগুলো কাটে অসহনীয় মন ব্যাথার ক্ষতবিক্ষত আঘাতে। কষ্টে ভেজা বালিশটা নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রতিটি প্রহরে। মমতাময়ী মা কী? মাতৃত্ব কী আমি বুঝেছিলাম সেদিন,যেদিন আমি তোমার ভালবাসার ছায়া হতে দূর হচ্ছিলাম। তোমার কি মনে আছে আম্মা বিমানবন্দরে আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কেঁদেছিলাম বিদায়কালে, ঐ দিন সবাই আমাদেরকে দেখে ভিতরে ভিতরে তারাও কান্না করতেছিলো হয়তো। সেদিন আমি তোমাকে ছেড়ে যতই সামনে অগ্রসর হচ্ছিলাম,আমার বুকপট ততই ভারী হচ্ছিলো হৃদকম্পনে।

মনে হচ্ছিলো কেউ আমার বক্ষ বিদীর্ণ করে তার ভিতর তোমার সব মায়া ঢালাও করেছে, সেদিন আমার বুকটা অনেক ভারী মনে হচ্ছিলো, যে ভার সহ্য করা অনেক কষ্টকর ছিলো। আমার এই দু বছরের যাত্রাপথে আমি একটু একটু করে তোমাকে আবিস্কার করেছি দ্বিতীয়বারের মত। অবলোকন করেছি তোমার ভালবাসা, দূর পরবাসে এসে বুঝতে পেরেছি মা তুমি কি মানবী? তোমাকে ঐ উপরওয়ালা যে মাটি দিয়ে তোমাকে সৃষ্টি করেছে সে মাটি হয়তো আলাদা। তোমার ধৈর্য্য ক্ষমতা সীমাহীন। কত কষ্ট আর ত্যাগের মধ্য দিয়ে তুমি আমাকে বড় করেছিলে। তোমার কি মনে আছে আম্মা, আমার সেই নয় মাসের যাত্রাপথে আমি তোমাকে কতই না ব্যাথা দিয়েছি, আমার জন্মের পর থেকেই তুমি আনারস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলে ভয়ে, ভয়ের কারন জানতে গিয়ে শুনতে পারলাম আমি যখন ছয় মাসের গর্ভে ছিলাম, তখন তুমি অানারস খাওয়ার কারনে অনেক ব্যাথা অনুভব করেছিলে পেটে। সেই ভয়ে তুমি নাকি আজও আনারস খাও না। আমাদেরকে অবশ্য তুমি আনারস কেটে দিতে, নিজে খেতে না সেই ভয়ে। কতইনা যত্নে আগলে রেখেছিলে আমায় তা আজ অনুভব করি আমি।

মা তুমিহীনা আমি আমার বিবর্ণ পৃথিবীতে ভীষণ ক্লান্ত। কত বছর তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাই না। কতদিন প্রাণখুলে হাসি না,কতদিন চিৎকার করে কাঁদি না। তোমার মতো করে কেউ যে আমায় বোঝে না মা। আমার অভিমান গুলোকে সবাই অভিমান ভাবলেও তুমি কিন্তু আমার অভিমানের আড়ালে ভালবাসাটাই বোঝতে। আমার চোখের ভাষা কেবল তুমিই পড়তে পারতে এ ধরায়।আমি প্রতিদিনের প্রার্থনায় বিধাতার কাছে কেবল একটা আকুতি রাখি,আমার সবটুকু আয়ু দিয়ে তিনি যেন তোমায় দীর্ঘায়ু করেন ভালো রাখেন। আমার দীর্ঘ প্রতীক্ষার স্বপ্নরা একদিন বাড়ি ফিরবে। তোমার নীড়ে ফেরার আশায় পথ চেয়ে বসে আছি। আমি ফিরে আসতে চাই আমার সেই মমতার বন্ধনের আবদ্ধ করা স্নেহের নীড়ে।

মমতাময়ী তোমার কোলে মাথা রেখে একটু শান্তিতে ঘুমাতে চাই। সেই দিনটির জন্য সুস্থ দেহে অপেক্ষা করিও মা। এক জীবনের যাবতীয় অপরাধের জন্য ক্ষমা চাই মা। বিধাতার দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার তুমি। অনেক ভালো থেকো। আমার জন্য শুধু এটুকু দোয়া করো, জীবনযুদ্ধে যেন আমি জয়ী হতে পারি। সব বাঁধা বিপদ উত্তাল ঢেউ অতিক্রম করে যেন তোমার আঁচলে মুখের ঘাম মুছতে পারি।

ইতি,
তোমার স্নেহের ছোট ছেলে।
শাহাদাত হোসাইন।

নোট:-চিরকুটটি গত হয়ে যাওয়া ৩য় রমযানে লিখেছিলাম। ৪ রমযান সেহরীর সময় জানতে পারি আমার প্রিয় মমতাময়ী মা চিরকুট বারবার পাঠ করে অঝোর ধারায় কেঁদেছেন। সকালে বিকাল শুধু চিরকুট পড়ে কাঁদে আর ঘন্টার পর ঘন্টা আমার সাথে কথা বলে। চিরকুটের প্রতিটি লাইনে লাইনে শব্দে শব্দে আমার সহোদর ভাইও কেঁদেছেন।

মোবাইল যুগে ডাকবাক্স নিয়ে স্মৃতিকথা


নারায়ণগঞ্জ হাজীগঞ্জ এলাকার কিল্লারপুল সংলগ্ন ড্রেজার সংস্থার গেইটের সামনে ময়লার স্তুপে পড়ে থাকা ডাকবাক্স। ছবি মোবাইল দিয়ে তোলা

একসময় দেশের প্রতিটি পোস্ট অফিসের সামনে, আর গ্রাম গঞ্জের হাট-বাজারের রাস্তার পাশে দেখা যেতো ডাকবাক্স। এখনো সারাদেশ জুড়ে যত্রতত্র দেখা মেলে ডাকবাক্স। তবে আগের মতো ডাকবাক্সের তেমন একটা কদর নেই। আগেকার সময়ে ডাকবাক্সে মানুষ চিঠি ফেলতো। ডাকপিয়ন সময়মত ডাকবাক্সের তালা খুলে চিঠি বের করতো। তারপর চিঠিগুলো একটা বস্তা ভরে নিকটস্থ পোস্ট অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হতো। ডাকপিয়নের হাতে থাকতো একটা হারিকেন, আর একটা বল্লম। পায়ে বাঁধা থাকতো ঘুংগুর। ডাকপিয়ন চিঠির বস্তা কাধে নিয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে পথ চলতো। আর বলতে শোনা যেতো হুশিয়ার সাবধান! এভাবে রাতবেরাতে ডাকপিয়ন গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হাঁটতে থাকতো। ডাকপিয়নের গলার আওয়াজ আর পায়ে বাঁধা সেই ঘুংগুরের শব্দে মানুষ ঘুম থেকে জেগে উঠতো।

ডাকপিয়ন কতো বাধা আর ঝড়বৃষ্টি, চোর ডাকাতের ভয় উপেক্ষা করে চিঠির বস্তা পৌঁছে দিতো হেড পোস্ট অফিসে। হেড পোস্ট অফিসের মাধ্যমে চিঠি চলে যেতো দেশের বিভিন্ন জেলাশহরে। পৌঁছে যেতো প্রাপকের কাছে। সেসময় এই ডাকবাক্সের অনেক আদর ছিল, কদর ছিল, যত্ন ছিল। মানুষ চিঠি প্রেরণের জন্য, টাকা পাঠানোর জন্য ছুটে যেতো নিকটস্থ পোস্ট অফিসে। আবার অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকতো ডাকপিয়নের আশায়। লেখাপড়া না জানা মানুষ চিঠি হাতে পেয়ে কেউ আবার হাউ-মাউ করে কাঁদতো। মনে করতো কী যেন দুঃসংবাদ এসেছে। অনেকে খুশিতে হয়ে যেতো আত্মহারা। এখন আর সেইদিন নেই। মানুষ এখন চিঠি বা পত্র লেখা প্রায় ভুলেই গেছে। পোস্ট অফিসেও আগের মতো তেমন ভিড় দেখা যায় না। ডাকবাক্সে মানুষ এখন চিঠি ফেলে না। ডাকবাক্সে পড়ে থাকে ময়লা আবর্জনা আর ধুলোবালি।

একসময় মোবাইল ওয়াপ পদ্ধতির স্মার্ট ফোন নেটওয়ার্ক চালু হবার পর থেকে ডাকবাক্সের কদর কমতে থাকে। সেইসাথে যোগ হয়েছে বর্তমান সময়ের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা। তাই হাট-বাজারে, রাস্তার পাশে থাকা ডাকবাক্সে শেওলা পড়তে শুরু করেছে। মানুষ ভুলতে শুরু করেছে চিঠি লেখা। মানুষ একরকম পোস্ট অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। একেবারে যে পোস্ট অফিসে যায় না, তা কিন্তু নয়! যায় অনেকের দরকারি কাজে। তবে বর্তমানে মানুষ যে ডাকবাক্সের ধারেকাছেও যায় না সেটা সত্য এবং বাস্তব।

সেদিন নারায়ণগঞ্জ থেকে আসার পথে কিল্লার পুল সংলগ্ন ড্রেজার সংস্থার মেইন গেইটের সামনে একটা ডাকবাক্স চোখে পড়ে। ডাকবাক্সটি পড়ে আছে অযত্নে অবহেলায়, ময়লা আবর্জনায়। ডাকবাক্সটি ময়লার স্তুপের উপর ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। বাক্সের চারপাশে জঙ্গলে একাকার। দেখে মনে হয় হয়তো মাসে, নাহয় বছরে একবার এই ডাকবাক্সটির তালা খোলা হয়।

একসময় এদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে ডাকবাক্স ছিল খুবই সম্মানী বস্তু। এই ডাকবাক্স ছিল অগণিত মানুষের সুখ-দুঃখের সাথি। এসবের জ্বলন্ত সাক্ষী আমি নিজেই। দেখতাম একটা চিঠির অপেক্ষায় আমার মা ডাকপিয়নের বাড়িতেও দৌড়াতে। বাবার প্রেরিত চিঠি মা হাতে পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতো। চিঠি হাতে পেয়ে ডাকপিয়নকে কতনা অনুরোধ করতো, চিঠি পড়ে শোনানোর জন্য।

ছোটবেলার স্মৃতিগুলো এখনো মাঝে মাঝে মনে পড়ে। মনে হয় তখন, যখন একটা পোস্ট অফিসের সামনে অথবা রাস্তার ধারে ডাকবাক্স চোখে পড়ে। ছোটবেলা দেখতাম আমার মা চিঠির মাধ্যমে বাড়ির সুসংবাদ, দুঃসংবাদ বাবাকে জানাতেন। বাবা থাকতেন নারায়ণগঞ্জ। চাকরি করতেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন চিত্তরঞ্জন কটন মিলে। মা সংবাদ পোঁছাতেন চিঠির মাধ্যমে। আমার মা লেখা-পড়া জানতেন না। চিঠি লেখাতেন গ্রামে থাকা পাশের বাড়ির শিক্ষিত মানুষ দিয়ে। এখনকার মতন তো শিক্ষিত মানুষ তখনকার সময়ে ছিল না। কোনও কোনও গ্রামে একজন মেট্রিক পাস মানুষও ছিল না। যদি একটা গ্রামে একজন মানুষ ভাগ্যক্রমে মেট্রিক পাস করতো, দু’একটা গ্রামের মানুষ তাকে দেখার জন্য ভিড় জমাতো। আমাদের গ্রামে একই বাড়িতে তিনজন শিক্ষিত মানুষই ছিলেন। তাঁরা তিনজনই ছিলেন স্কুলের মাস্টার। সেই কারণেই তাদের বাড়ির নাম হয়েছিল মাস্টার বাড়ি। তাদের নাম ছিল, দক্ষিণা মাস্টার, প্রমোদ মাস্টার ও সুবল মাস্টার।

মাকে যিনি সবসময় চিঠি লিখে দিতেন, তিনি ছিলেন সুবল মাস্টার। সম্পর্কে নিজেদের আত্মীয়স্বজন। চিঠি লেখাও একটা বিরক্তের কাজ। চিঠি লিখতে হলে সময় লাগে, মন লাগে, ধৈর্য লাগে, তারপর চিঠি লিখা। সব শিক্ষিত মানুষ চিঠি লিখে দেয় না, চিঠি লিখতে পারে না, জানেও না। সুবল মাস্টার সম্পর্কে আমার জেঠা মশাই। আমার বাবার খুড়াতো ভাই (চাচাতো ভাই)। আমার বাবার বয়স থেকে সুবল মাস্টার অল্প কয়েকমাসের বড়। তাই আমার মায়ের ভাশুর। মা জেঠাদের বাড়িতে গিয়ে অনেকসময় ফিরে আসতেন, চিঠি না লেখাতে পেরে। এভাবে দু’তিনদিন যাবার পর একদিন শ্রদ্ধেয় জেঠা মশাই মাকে সময় দিতেন, চিঠি লিখে দিতেন। জেঠা-মশাই কাগজ কলম হাতে নিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করতেন কী ব্যাপারে চিঠি দিবে? মা বলতেন, ঘরে চাল নেই, ডাল নেই, তেল নেই, হাট-বাজার করার মতো টাকা-পয়সাও নেই। এই নিয়েই আপনি সুন্দর করে লিখে দেন, যাতে ওর বাবা বুঝতে পারে।

তখনকার সময়ে শর্টকাট চিঠি লিখতে পোস্টকার্ডই বেশি ব্যবহার করতো। একটা পোস্টকার্ডের মূল্য ছিল মাত্র ১৫ পয়সা। আর একটা ইনভেলাপের মূল্য ছিল মাত্র চার আনা(২৫) পয়সা মাত্র। তখনকার সময়ে দশ পয়সার খুবই মূল্য ছিল। সহজে বিনা দরকারে কেউ পাঁচটি পয়সাও খরচ করতো না। পোস্টকার্ড আর ইনভেলাপের মূল্য দশ পয়সা এদিক সেদিক হওয়াতে মানুষ অল্প কথার জন্য পোস্টকার্ডই বেশি ব্যবহার করতো। পোস্টকার্ডে জেঠা মশাই চিঠি লিখে মাকে পড়ে শুনাইতেন, মা শুনতেন। পোস্টকার্ড বুকে জড়িয়ে বাড়ি চলে আসতেন। পরদিন সকালবেলা আমি স্কুলে যাবার সময় আমার কাছে পোস্টকার্ডটা দিয়ে বলতেন– বাজারে গিয়ে চিঠিটা পোস্ট অফিসের সামনে থাকা বাক্সে ফেলে দিবি! মায়ের কথামত পোস্টকার্ডটা খুব যত্নসহকারে বইয়ের ভেতরে রেখে বাড়ি থেকে রওনা হতাম।

আমাদের বাড়ি থেকে পোস্ট অফিসের দূরত্ব ছিল প্রায় এক কিলোমিটার। বাজারে যাবার রাস্তার পাশেই ছিল স্কুল। চিঠি নিয়ে সোজা বাজারে চলে যেতাম। ডাকবাক্সে পোস্টকার্ডটা ফেলে দিয়ে তারপর আসতাম স্কুলে। স্কুল ছুটি হবার পর বাড়ি আসার সাথে সাথেই মা জিজ্ঞেস করতেন– চিটি বাক্সে ফেলেছিস? বলতাম, হ্যাঁ মা ফেলেছি! এরপর থেকে মা অপেক্ষায় থাকতেন ডাকপিয়নের আশায়। মানে বাবার দেওয়া চিঠির আশায়। কখন আসবে বাবার চিঠি বা মানি অর্ডার করা টাকা। পোস্ট অফিস থেকে (ডাকপিয়ন) যিনি বাড়ি বাড়ি চিঠি পৌঁছে দিতেন, তিনি গ্রামের সবার নাম জানতেন এবং বাড়িও চিনতেন। ডাকপিয়ন আমাদের পাশের গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন।

পোস্ট অফিসে চিঠি বা মানি অর্ডার করা টাকা আসার পরপরই ডাকপিয়ন চিঠি পৌঁছে দিতেন বাড়িতে। বকসিস হিসেবে ডাকপিয়নকে এক টাকা বা লাড়ু-মুড়ি খাওয়াইয়ে আপ্যায়ন করে দিতেন। এতে ডাকপিয়ন সাহেব খুব খুশি হতেন। বাবা যদি মানি অর্ডার করে টাকা পাঠাতেন, তাহলে আমার মা বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই টাকা রেখে দিতেন। আর যদি টাকার বদলে চিঠি আসতো, তাহলে হাতে পাওয়া চিঠি ডাকপিয়ন সাহেবকে দিয়ে পড়াতেন, না হয় চিঠি নিয়ে দৌড়াতেন মাস্টার বাড়ি। মায়ের চিন্তা শুধু কী সংবাদ এলো চিঠির মাধ্যমে। জেঠা মশাই মাকে দুঃখসুখ নিয়ে বাবার লেখা চিঠি পড়ে শুনাইতেন। মা চুপ করে বসে শুনতেন। সেসময়ে আমার মায়ের মতো এমন আরও অনেক মা ছিল, যারা লেখা-পড়া জানতো না। তাঁরা ডাকপিয়ন থেকে চিঠি হাতে পেলে অনেকেই দুঃচিন্তায় পড়ে যেতো। ভাবতো সুসংবাদ এলো, না দুঃসংবাদ এলো?

এখন আর সেই সময় নেই। চিটির যুগ প্রায় শেষপ্রান্তে এসে গেছে। এখন মোবাইল ফোনের যুগ। কথা হয় মোবাইলে। বিদেশে থাকা প্রিয়জনের সাথে কথা বলার জন্য টেলিফোন এক্সচেঞ্জেও কাউকে যেতে হয় না। জরুরি কোনও সংবাদ টেলিগ্রাফ করতে পোস্ট অফিসে যেতে হয় না। পোস্ট অফিসে গিয়ে লাইন ধরে চিটির খাম ওজন দিয়ে আর রেজিস্টার করতে হয় না। এখন সব কাজ সমাধা হয়ে যাচ্ছে ছোট একটা যন্ত্র মোবাইল ফোনেই। চিঠির মতন লেখা হয় মেসেজের মাধ্যমে। যখন খুশি তখন যেকোনো সময়।

বিদেশ থেকে প্রিয়জনের পাঠানো টাকা আসে ব্যাংকে, আর মোবাইলে। টাকার পরিমাণ এবং কোন ব্যাংকে টাকা পাঠানো হয়েছে, তা মোবাইল মেসেজের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয় প্রিয়জনকে। মোবাইলের মাধ্যমে নিমিষেই সব হয়ে যাচ্ছে। যখন খুশি টাকা উঠানো, টাকা পাঠানো, মোবাইল ফোনে রিচার্জ করার মত সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। এতে ব্যাংকে যাওয়া কিংবা ব্যাংকের লাইনে দাঁড়ানোর বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি মিলছে মানুষের। দিন যত গড়াচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তাও তুঙ্গে উঠছে। বাড়ছে লেনদেনের পরিমাণও। কদর কমছে পোস্ট অফিস আর ডাকবাক্সের।

মোবাইল ব্যাংকিং জনপ্রিয় হওয়ায় গ্রামীণ জনজীবন অনেক সহজ হয়েছে। এ সেবার মাধ্যমে ঘরে বসেই অনেক কাজ করা যাচ্ছে। বাস, ট্রেনের টিকিট থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনও পরিশোধ করা যাচ্ছে মানুষের হাতের মুঠোয় থাকা ছোট্ট যন্ত্রটির মাধ্যমে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যেসব কাজ করা যায় সেগুলো হলো– রেমট্যান্স পাঠানো, ক্যাশ ইন, ক্যাশ আউট। একজনের অ্যাকাউন্ট থেকে অন্যজনের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো। ইউটিলিটি বিল দেওয়া। মোবাইল ফোনের এয়ার টাইম কেনা।

পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে মার্চেন্ট পেমেন্ট। সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেতন দেওয়া। পানির বিল পরিশোধ করা। মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ অন্যান্য ভাতা, বিমা প্রিমিয়াম, ডিপিএস দেওয়া যায়। আরও আছে ভিডিও কল। কথা বলার সাথে সাথে প্রিয়জনের ছবি বা ভিডিও দেখা যাচ্ছে মোবাইল স্কিনে। মনে হয় প্রিয়জনের সাথে সামনাসামনি বসে কথা হচ্ছে। এটা ছিল কোনোএক সময়ে মানুষের কল্পনাতীত। কিন্তু এখন তা বাস্তব। এতকিছুর শর্টকাট সুবিধা পাওয়ার পর, কে যায় কষ্ট করে পোস্ট অফিসে? আর কে-ই-বা যায় চিঠি লিখে ডাকবাক্সে ফেলতে? কেউ যাক আর না যাক, হারানো দিনের স্মৃতি হিসেবে যেন ডাকবাক্স সবসময় আমাদের পাশে থাকে, এই কামনাই করি।