ট্যাগ আর্কাইভঃ চিঠি

দূর পরবাসে রোযা মুখে নিয়ে তোমায় লিখছি মমতাময়ী মা

তারিখ: ০৩ রমযান ১৪৪০ হিজরি

প্রিয় মমতাময়ী মা

গ্রীষ্মের কাঠফাটা গরমে আমার কর্মব্যস্ততায় শরীর নিংড়ানো মুক্তঝরা ঘাম জড়ানো শুভেচ্ছা।

কেমন আছো রণাঙ্গনের জননী সাহসিনী। রমযানের তৃতীয় রোজা মুখে নিয়ে মাগরিবের ঠিক আগ মূহুর্তে সামান্য কিছু ইফতারী সামনে নিয়ে হাজার হাজার মাইল দূর প্রবাস সৌদি আরব থেকে তোমায় লিখছি।

দূর পরবাসে বসে জীবনে প্রথমবারের মতো তোমাকে চিঠি লিখছি। কেমন আছো জীবন যুদ্ধের জয়ী সংগ্রামী মা। আমি অালহামদুলিল্লাহ তোমার দোয়ার বদৌলতে অনেক ভালো আছি। আমার হৃদয়ের অলিগলিতে অসংখ্য অব্যক্ত অক্ষরগুলো প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে তোমার কাছে পৌঁছাবে বলে। কতগুলো বছর পার হয়ে গেল তোমাকে স্পর্শ করি না, তোমার ঐ মায়াভরা চাঁদ মুখ দেখিনা। রোযা রাখার অভ্যাসটা যদি তুমি না গড়ে দিতে, তাহলে হয়তো রোযার ফযিলত হতে বঞ্চিত হতাম। কোন ডাক্তারী পড়ালেখা ছাড়াই তুমি হলে পৃথিবীর একমাত্র জগত শীর্ষ ডাক্তার যার তুলনা হয়না। কিছুক্ষণ পরেই মাগরিবের আযান শুরু হবে,সামনে বাহারি রকমের ইফতার নিয়ে বসে আছি এমন মিথ্যা বাক্য বললেও চিঠির কথামালায় তুমি নিশ্চই সত্য উদঘাটন করবে তোমার পবিত্র চিত্তপটে বা অন্থঃকরণে, গুটি কয়েকটি খেজুর আর পানি দিয়ে আজ আমার রোযা খোলা হচ্ছে। কিন্তু এই ইফতারে আমি ঐ স্বাদ পাই না, যে স্বাদ তোমার নিজ হাতের বানানো আলুরচপে, বেগুনি, ছোলা বুট, নিমকি, ডালের বড়াতে আমি পেয়েছিলাম। হয়তো দুনিয়া থেকে পরলোক গমণের আগ সময় পর্যন্ত সে স্বাদ আমার মুখে লেগে থাকবে।

জানো আম্মা, আমার এই পরবাস দুনিয়াটা ভীষণ সুন্দর। তবুও কেন জানি এ সুন্দরের ভীড়ে তোমার অমন সুন্দর মুখ আমি খুজে পাই না। আমার এ পৃথিবীটা ধূসর লাগে তুমি নেই বলে। জীবনটা দুর্বিসহ মনে হয় তুমি দূরে বলে। তোমার কাছে আমার অনেক অনেক অভিযোগ,কেন এত আদর, স্নেহে বড় করলে আমায়। রোজ ইফতারের সময়ে আমি তোমাকে মনে করি, আর দু চোখের পানি আমার মুখের গাল বেয়ে পড়ে তোমার তরে। তুমিও নিশ্চই আমায় স্মরণ কর ইফতারের আগ মূর্হতে, আর চোখের পানি ফেল জায়নামাজের প্রার্থনায়। ভাগ্য বিধাতা যখন আমাকে তোমার থেকে যোজন যোজন দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন,তখন কেন তোমাকে নির্দয় পাষণ্ড করে সৃষ্টি করেননি। তাহলে অন্তত এ দূর পরবাসে ইফতারের আগ সময়ে আমার দূর পৃথিবীর কাচের দেয়ালের ওপাশে বসে আমার নিথর নিষ্প্রাণ আত্মাটা তোমার জন্য ডুকরে কেদে মরত না!

জান, আমার সব আছে, শুধু তোমার স্নেহটুকু নেই। উন্নত প্রযুক্তির দেশে এখন আর কেউ আমাকে খাইয়ে দেয় না। হাজার দিন হয়ে গেলো তোমার হাতের রান্না করা খাবার খাওয়া হয়না। তোমাকে ঘিরে সব ভালবাসারা হারিয়েছে স্মৃতির মণিকোঠায়। আমার নির্ঘুম রাত্রিগুলো কাটে অসহনীয় মন ব্যাথার ক্ষতবিক্ষত আঘাতে। কষ্টে ভেজা বালিশটা নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রতিটি প্রহরে। মমতাময়ী মা কী? মাতৃত্ব কী আমি বুঝেছিলাম সেদিন,যেদিন আমি তোমার ভালবাসার ছায়া হতে দূর হচ্ছিলাম। তোমার কি মনে আছে আম্মা বিমানবন্দরে আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কেঁদেছিলাম বিদায়কালে, ঐ দিন সবাই আমাদেরকে দেখে ভিতরে ভিতরে তারাও কান্না করতেছিলো হয়তো। সেদিন আমি তোমাকে ছেড়ে যতই সামনে অগ্রসর হচ্ছিলাম,আমার বুকপট ততই ভারী হচ্ছিলো হৃদকম্পনে।

মনে হচ্ছিলো কেউ আমার বক্ষ বিদীর্ণ করে তার ভিতর তোমার সব মায়া ঢালাও করেছে, সেদিন আমার বুকটা অনেক ভারী মনে হচ্ছিলো, যে ভার সহ্য করা অনেক কষ্টকর ছিলো। আমার এই দু বছরের যাত্রাপথে আমি একটু একটু করে তোমাকে আবিস্কার করেছি দ্বিতীয়বারের মত। অবলোকন করেছি তোমার ভালবাসা, দূর পরবাসে এসে বুঝতে পেরেছি মা তুমি কি মানবী? তোমাকে ঐ উপরওয়ালা যে মাটি দিয়ে তোমাকে সৃষ্টি করেছে সে মাটি হয়তো আলাদা। তোমার ধৈর্য্য ক্ষমতা সীমাহীন। কত কষ্ট আর ত্যাগের মধ্য দিয়ে তুমি আমাকে বড় করেছিলে। তোমার কি মনে আছে আম্মা, আমার সেই নয় মাসের যাত্রাপথে আমি তোমাকে কতই না ব্যাথা দিয়েছি, আমার জন্মের পর থেকেই তুমি আনারস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলে ভয়ে, ভয়ের কারন জানতে গিয়ে শুনতে পারলাম আমি যখন ছয় মাসের গর্ভে ছিলাম, তখন তুমি অানারস খাওয়ার কারনে অনেক ব্যাথা অনুভব করেছিলে পেটে। সেই ভয়ে তুমি নাকি আজও আনারস খাও না। আমাদেরকে অবশ্য তুমি আনারস কেটে দিতে, নিজে খেতে না সেই ভয়ে। কতইনা যত্নে আগলে রেখেছিলে আমায় তা আজ অনুভব করি আমি।

মা তুমিহীনা আমি আমার বিবর্ণ পৃথিবীতে ভীষণ ক্লান্ত। কত বছর তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাই না। কতদিন প্রাণখুলে হাসি না,কতদিন চিৎকার করে কাঁদি না। তোমার মতো করে কেউ যে আমায় বোঝে না মা। আমার অভিমান গুলোকে সবাই অভিমান ভাবলেও তুমি কিন্তু আমার অভিমানের আড়ালে ভালবাসাটাই বোঝতে। আমার চোখের ভাষা কেবল তুমিই পড়তে পারতে এ ধরায়।আমি প্রতিদিনের প্রার্থনায় বিধাতার কাছে কেবল একটা আকুতি রাখি,আমার সবটুকু আয়ু দিয়ে তিনি যেন তোমায় দীর্ঘায়ু করেন ভালো রাখেন। আমার দীর্ঘ প্রতীক্ষার স্বপ্নরা একদিন বাড়ি ফিরবে। তোমার নীড়ে ফেরার আশায় পথ চেয়ে বসে আছি। আমি ফিরে আসতে চাই আমার সেই মমতার বন্ধনের আবদ্ধ করা স্নেহের নীড়ে।

মমতাময়ী তোমার কোলে মাথা রেখে একটু শান্তিতে ঘুমাতে চাই। সেই দিনটির জন্য সুস্থ দেহে অপেক্ষা করিও মা। এক জীবনের যাবতীয় অপরাধের জন্য ক্ষমা চাই মা। বিধাতার দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার তুমি। অনেক ভালো থেকো। আমার জন্য শুধু এটুকু দোয়া করো, জীবনযুদ্ধে যেন আমি জয়ী হতে পারি। সব বাঁধা বিপদ উত্তাল ঢেউ অতিক্রম করে যেন তোমার আঁচলে মুখের ঘাম মুছতে পারি।

ইতি,
তোমার স্নেহের ছোট ছেলে।
শাহাদাত হোসাইন।

নোট:-চিরকুটটি গত হয়ে যাওয়া ৩য় রমযানে লিখেছিলাম। ৪ রমযান সেহরীর সময় জানতে পারি আমার প্রিয় মমতাময়ী মা চিরকুট বারবার পাঠ করে অঝোর ধারায় কেঁদেছেন। সকালে বিকাল শুধু চিরকুট পড়ে কাঁদে আর ঘন্টার পর ঘন্টা আমার সাথে কথা বলে। চিরকুটের প্রতিটি লাইনে লাইনে শব্দে শব্দে আমার সহোদর ভাইও কেঁদেছেন।

বাবার কাছে লেখা এক সন্তানের চিঠি

তারিখঃ ঢাকা। ২৪ এপ্রিল ২০১৩ ইং।

প্রিয় বাবা,

এটাই হয়তো তোমার কাছে আমার শেষ চিঠি
এ চিঠি তোমার হাতে পৌঁছুবে কিনা আমি জানি না
আমি হয়ত একটু পরেই মারা যেতে পারি বাবা!

গতকাল রাতে যে সুন্দর স্বপ্নটি দেখেছিলাম
আজ সকালে কাজে আসার আগে তোমাকে বলেছিলাম
কিন্তু তা আর সম্ভব হল না!

আজ সকালে আমাদের কারখানায় এক দুর্ঘটনা ঘটেছে!
তারপর!

তারপর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম!
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন চারিদিকে মানুষের বেঁচে থাকার আর্তনাদ! হাহাকার!! চীৎকার!!!
আমাদের অফিসের বিল্ডিংটা আজ ভেঙ্গে পড়েছে!
আমি দোতালায় কাজ করছিলাম কিন্তু এখন কোথায় আছি বুঝতে পারছি না বাবা!

বাবা!
আমার মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে!
আমার মাথার উপরে একটা সেলাই মেশিন খুব শক্তভাবে আটকে আছে!
আর সেলাই মেশিনের উপরে ভেঙ্গে পড়েছে ছাদ।
মনে হচ্ছে সেলাই মেশিনের সুচের কিছুটা অংশ মাথায়!
মাথায় ঢুকে গিয়েছে!

বাবা!
আমার মাথা থেকে রক্ত বের হচ্ছে
আমার গলা, বুক, শার্ট সব রক্তে ভিজে গেছে
আমি একটুও নড়তে পারছি না বাবা!!!

বাবা!
আমার শার্টের পকেটে এক টুকরা কাগজ ছিল আর কলম
আমি এখন সেই কাগজে তোমার কাছে চিঠি লিখছি
কিন্তু বাবা!
এই কাগজটাতে আমার মাথা থেকে রক্ত পড়ে কিছুটা ভিজে গিয়েছে
আমার খুব যন্ত্রণা হচ্ছে বাবা!

দূরে কোথাও অনেক মানুষের কথা শোনা যাচ্ছে
মনে হয় উনারা উদ্ধার কর্মী
ওরা কি আমাকে খুজে পাবে?
আমিতো জোরে ডাকতে পারছি না বাবা!
আমিতো চিৎকার করে বলতে পারছি না, “আমি এখানে আটকা পড়ে আছি! তোমরা এদিকে এসো!! আমাকে বাঁচাও!!!”

বাবা!
সোনালীর পেটে আমার সন্তান এসেছে সেই সু সংবাদটা তোমাকে দেয়াই হয় নি
ও গতকাল রাতেই আমাকে বলেছিলো
সোনালীর প্রতি যত্ন নিও বাবা!
মাকে কাঁদতে নিষেধ করো বাবা!
মাকে আর নতুন শাড়ি কিনে দেয়া হলো না!
আমি তোমাকে আর ঔষধ কিনে দিতে পারব না বাবা! আমাকে ক্ষমা করে দিও!

আর পারছি না বাবা!
আমি মনে হয় মারা যাচ্ছি!
কত মানুষ মারা গেছে শুনেছি, দেখেছি কিন্তু কোনও দিন বুঝিনি মৃত্যু কি!
মৃত্যু মানে কি বাবা? আমি কোথায় যাচ্ছি বাবা!
আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে বাবা!
বাবা! বাবা!
বাবা!!!!………

আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাললা………

বাবার কাছে লিখা এক সন্তানের চিঠি

প্রিয়তমা

iStock_000020751712_Double

যদি আমায় ভুলে যাও তুমি
ভুলো না আমার এ গান
ঘুম ভাঙ্গা রাতে এ গান গেয়ে
জুড়িয়ো তোমার প্রাণ।।

যদি নিশীথে জাগে মনে
শিয়রে দীপ জ্বেলে বাতায়নে
খুঁজো আমায় তারার মিছিলে
রাত জাগা পাখি হয়তোবা
শোনাবে আমারই গান।।

বিকেলে মিষ্টি রোদে বসে
দৃষ্টি মেলে দিও দূর গগনে
কখনো খুঁজে সন্ধ্যায় সেই
উদাস নদীর তীরে আমারই সুরে
শুনো পাখির গান।।

যাযাবরের চিঠি

2013-11-05 quill-pen-line-art

প্রিয় শফিক,
আশা করি ভাল আছিস। অনেক দিন যাবত তোর কোন চিঠি পাই না। জানি বারবার এত করে বলার পরেও তোদের গ্রামের বাড়ি না গিয়ে চলে এসেছি বলে রাগ করেছিস তাই না?আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি। কিন্তু, আমি কেন যাইনি সে কথা এতো দিনেও বলি বলি করে বলা হয়নি। তুই যখন রাগ করে আমাকে ভুল বুঝে চুপ করে বসে আছিস তা হলে আজ বলি, দেখ চেষ্টা করে আমাকে ক্ষমা করতে পারিস কি না। তোদের গ্রামে এমন এক জন আছে যার হবার কথা ছিল আমার অনেক কিছু অথচ সে এখন আমার কেউ না।
এ কথা আমার বাবা মা, আমি আর আমার বাবার এক বন্ধু ছাড়া আর কেউ জানে না, আরো এক জন জানতেন তবে তিনি এখন এই পৃথিবীতে নেই। কি ভাবে যেন সব ওলট পালট হয়ে বিধাতার যা ইচ্ছা তাই হয়ে গেল।

আচ্ছা, শুনেছিস কোথাও, যে নাকি বৌ হবে তাকে জন্মের পর প্রথম কোলে নিয়েছে কেউ? আমার জীবনে ঠিক এমনি এক ঘটনা ঘটতে গিয়েও নিয়তির নিতান্ত অনিচ্ছা ছিল বলে আর হয়ে উঠেনি। আমার ছোট বেলা বিদেশে কেটেছে সে তুই জানিস। ওখানে একটা নাম করা হাসপাতালে আমার বাবার এক বন্ধু কালাম চাচার কণ্যা সন্তান জন্ম নেয়। চাচী অত্যন্ত অসুস্থ ছিল বলে আমার মা তাকে দেখা শুনা করছিল। মেয়ে হবার সংবাদ পেয়ে কালাম চাচা বাবা এবং আমাকে নিয়ে হাসপাতালে গেল। হাসপাতালে দেখি চাচির বিছানার পাশে দোলনায় ফুটফুটে এক মোমের পুতুল ঘুমাচ্ছে। পাশে আমার মা বসে। কিছুক্ষণ আগে নার্সরা দোলনায় দিয়ে গেছে এখনো কেউ কোলে নেয়নি। চাচির অবস্থা খুবই খারাপ। কে কেমন আছে কার কি অবস্থা এসব কথার মধ্যে সেই পুতুলের ঘুম ভেঙ্গে গেল, একটু কান্না করতে চাইল। আমি এগিয়ে দোলনার কাছে গেলাম আর চাচী আমাকে বলল নাও কোলে নাও। ওই বয়সে যতটা সাবধান হয়ে এমন নব জাতক কে কোলে নিতে হবে বুঝেছি ততটা সাবধানে আস্তে করে তুলে নিলাম। কি করি না করি সে ভয়ে মা এসে কাছে দাঁড়ালেন। চাচী ডান দিকে মুখ ফিরিয়ে আমার কোলে তার মেয়েকে দেখে রোগ ক্লিষ্ট মুখে একটু হেসে বলল তুমিই প্রথম কোলে নিলে বাবা, এটা তোমাকেই দিব। তখন চাচির এ কথার মানে বুঝিনি। এমনিতেই চাচী আমাকে খুব আদর করতেন। না, মেয়ের জামাই করবে এই আশা নিয়ে নয় কারণ তখন তাদের কোন বাচ্চাই ছিল না। বাসায় গেলেই ফ্রিজ খুলে যত রকমের খাবার আছে সব বের করে দিত। না খেলে সাঙ্ঘাতিক বকা বকি করত। আমি নাকি ছোট বেলায় খুব শান্ত সুবোধ আর একটু বোকা ধরনের ছিলাম।

চাচির কি যে একটা কঠিন অসুখ হয়েছিল নাম মনে নেই, এখনো মনে আছে শরতের স্নিগ্ধ জোসনার সাথে সিঁদুর মাখা মাখি হলে যেমন হয় তেমন ছিল চাচির গায়ের রঙ। পরে আস্তে আস্তে তার শরীরের নানা জায়গা নীল হয়ে যেতে দেখেছি। মাংশ পেশিতে পচন। সোনার পুতুলটাকে রেখে ওই রোগেই চাচী বছর খানিক পর মারা গেল। স্বাভাবিক ভাবে পুতুলটার সব ভার এসে পরল আমার মায়ের উপর, নিজের কাছে এনে রাখলেন। এ ছাড়া আর কিছু করার ছিল না, বিদেশে কার কয় জন আত্মীয় থাকে? প্রথম মাস কয়েক চাচার অবস্থা প্রায় পাগলের মত, অফিস নেই খাওয়া নেই, কখন কোথায় যায় কি করে কিচ্ছু ঠিক ঠিকানা নেই। এ ভাবে প্রায় বছর খানিক পর অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমার মা বাবা পুতুল সহ চাচাকে দেশে পাঠিয়ে দিলেন লম্বা ছুটি নিয়ে। এই মেয়ের ভার কে নিবে?দেশে যাবার পর সবাই ভেবে চিন্তে মেয়ের কথা ভেবে চাচির মার পেটের ছোট বোনের সাথে আবার চাচার বিয়ে দিলেন। কিন্তু মার পেটের বোন তার মেয়েকে নিজের পেটের মেয়ে বলে মেনে নিতে পারেনি। যা হবার তাই হোল। ও মেয়ের আশ্রয় হোল নানির কাছে।

এর মধ্যে হিমালয় থেকে অনেক বরফ গলা পানি গঙ্গা যমুনা পদ্মা বয়ে সাগরে, মিশেছে, অনেক কলি ফুটে ঝরে গেছে। পৃথিবীর মানচিত্রে একটা নতুন দেশের জন্ম হয়েছে আর আমরা সেই দেশে ফিরে এসেছি। কলেজে তোর সাথে প্রথম পরিচয়, মনে আছে সে দিনের কথা?ওই তখনকার কথা। সে যখন ক্লাস এইটে তখন নারায়ণগঞ্জে ওর নানার বাড়িতে আমি শেষ দেখেছি। ওর অবস্থা দেখে এসে মাকে বললাম সব কথা। বিশ্বাস করবি কিনা, গায়ের রংটা পেয়েছিল মায়ের মত সেই রঙ পুড়ে তামার মত হয়ে গেছে, আমি চিনতেই পারিনি। এই মেয়েকে ময়লা কাপড় পরনে, বিষণ্ণ মলিন মুখে রান্না ঘরে হাড়ি পাতিল মাজতে দেখলে কার সহ্য হয় বলতে পারবি? আমার মা কিছুক্ষণ কাঁদলেন, মার সাথে আমিও কেঁদেছিলাম। কয়েক দিন পর গিয়ে মা দেখে আসলেন, এসে আবার কান্না। এতো দিনে চাচির সেই কথার মানে বুঝতে শিখেছি। মনে মনে কখন যে মোর স্বপন চারিণী হয়ে গিয়েছিল বুঝিনি। তাই বুঝি মার কান্নার সাথে আমার কান্নাও মিশে গিয়েছিল আমরা ঢাকায় আসার পরে বাবা দেখে শুনে ঢাকায় আমাদের বাড়ির কাছে একটা জায়গা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ওই জায়গা কিনে চাচা বাড়িও করলেন কিন্তু বাবার এই বাড়িতে ওই মেয়ের থাকা হয়নি। ছোট বেলা থেকেই আমি বিশেষ করে মেয়েদের কষ্ট সহ্য করতে পারতাম না। আমার একটাই বোন তাকে যে আমি কি ভালবাসি সে তুই জানিস। তত দিনে লেখা পড়ার পাট শেষ করে এই চাকরিতে জয়েন করেছি, ওই যে যখন প্রথম চিটাগাং গেলাম তখন।

এক বার ছুটিতে এসেছি তখন এক দিন সন্ধ্যায় কালাম চাচা তার মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে আমাদের বাড়িতে এলেন। কথাটা শুনে চমকে উঠলাম, মা অবাক হয়ে মুখে কি!! বলে কিছুক্ষণ চাচার দিকে তাকিয়ে থেকে চাচাকে ডেকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। চাচাও কোন কিছু না বলে মাথা নিচু করে মাকে অনুসরণ করলেন। বাবা বাসায় নেই। ও ঘরে কি কথা হোল সব শুনতে পাইনি তবে মাঝে একবার মায়ের উচ্চ কণ্ঠ পেলাম এ মেয়ে আমার, আমি কিচ্ছু বুঝি না আমাকে এ মেয়ে দিতে হবে মার এ কথার প্রেক্ষিতে চাচার একটু উচ্চ কণ্ঠ শুনলাম, “আমি কি করব ভাবী”। সেদিনের মত চাচা চলে গেল। একটু পরে বাবা এলেন। বাবার সাথে যখন মা এ নিয়ে আলাপ করছিল তখন যা শুনলাম তা হচ্ছে মেয়ের নানা বিয়ে ঠিক করেছে, ছেলে গ্রামে (তোদের গ্রাম) থেকে দোকান দারী করে, অনেক জমি জমা নাকি আছে, এর চেয়ে ভাল পাত্র পাওয়া যাবে না তাই দেরি না করে বিয়ের দিন ঠিক করে পাকা কথা দিয়ে দিয়েছে। মেয়ের বাবাকে একটু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করেনি। মেয়ের বাবা এ কথা শুনে প্রতিবাদ করেছিল, না আমি মেয়ের জন্য ছেলে ঠিক করে রেখেছি, ওর মা বলে গেছে, এ বিয়ে হবে না। আমার মেয়ে আমাকে একটু জিজ্ঞেস করবেন না? তোমাকে কি জিজ্ঞেস করব, মেয়ে কি তুমি পেলে বড় করেছ?

দেখ, এই হোল আমাদের মেয়েদের জীবন, এক জন মা হারা মেয়ের জীবন কি এমন হতে হবে?এখানে তার কি দোষ ছিল? বাবা থাকতেও বাবার গলা জড়িয়ে ধরে একটু সোহাগ, একটু স্নেহ কেন পেল না? আমার মা বাবা ওই বিয়েতে যেতে পারেনি, আমার বিয়েতে ও ওই চাচা আসেনি। আমার বিয়ের আগে হবু বৌকে সব বলেছি এমনকি বিয়ের পরে ওকে সাথে নিয়ে চাচার বাড়িও গেছি। ওর কৌতুহল ছিল এ কেমন মা একটু দেখব, সৎ মা হলেই কি এমন হতে হবে আর বাবাই বা কেমন বাবা? তাই দেখাতে নিয়ে গেছিলাম। ও বাড়ি যাবার পর আমার বৌ এর মাথায় হাত রেখে চাচা কেঁদে ফেললেন, আমি তাকিয়ে দেখলাম। এ কান্না কিসের কান্না আমাকে একটু বুঝিয়ে দিবি? তবে আমার বৌ ওই পুতুলকে দেখতে চেয়েছিল তা আর হয়ে উঠেনি। তখন সে তোদের গ্রামে কোন এক ঘরের ঘরনী!

এখন বল আমার পক্ষে কি ওই গ্রামে যাওয়া উচিত? এখানে আমার কি দোষ? আশা করি আমাকে ভুল বুঝবি না। কারো মনে কষ্ট দেয়া তো দূরের কথা সে রকম কিছু ভাবাও আমার পক্ষে সম্ভব না। মানুষের সাথে সু সম্পর্ক না হতে পারে কিন্তু খারাপ সম্পর্ক থাকবে কেন?একটু খানি বন্ধুত্ব গড়ে তোলা অনেক কঠিন তাই চেষ্টা করি তা টিকিয়ে রাখতে। তোদের মত বন্ধুদের ভালবাসা আমার জীবনের পাথেয়। ও্ কথা ভুলে থাকার চেষ্টা করেছি, কিন্তু মানুষ কি তা পারে?

হঠাত্ করে সেদিন মনে হয়ে যাওয়ায় মনটা ভীষন ভাবে অস্থির হয়েছিল। বৌকে বললাম এখন আমি কি করি? বৌ কি চিকিৎসা দিল শুনবি? বলল ঘুমাবার চেষ্টা কর, আর তার জন্য দোয়া কর তার ইহ কালের সুখ যেন পর কালে পায়, এ ছাড়া আর কিছু বলার নেই। তুই তো জানিস আমার স্ত্রী ভাগ্য খুবই ভাল, এদিক দিয়ে আমি অত্যন্ত সুখী মানুষ। আমার কি প্রয়োজন তা আমি বোঝার আগেই সে বুঝে ফেলে। তাই মনে হয় আমার এই ভবঘুরে ছন্ন ছাড়া জীবন এখনো টিকে আছে। আশা করি তোর ভুল ভেঙ্গেছে, এবার চিঠির উত্তর দিবি। এবার দেশে আসলে অবশ্যই দেখা করবি।
ইতি,
যে নামে আমাকে ডাকতে তুই পছন্দ করিস তোর সেই যাযাবর

শূণ্য বিষণ্ণ

বেলা শেষে উদাস পথিক ভাবে,
সে যেন কোন অনেক দূরে যাবে –
উদাস পথিক ভাবে।

‘ঘরে এস’ সন্ধ্যা সবায় ডাকে,
‘নয় তোরে নয়’ বলে একা তাকে;
পথের পথিক পথেই বসে থাকে,

গত কালের সন্ধ্যাটা আমার কিছুতেই কাটছিল না। কোন সন্ধ্যাই আমার কাটে না। প্রতিটি সন্ধ্যার গোধূলি বেলা আমার কাছে কেমন এক অজানা অক্ষরের বেদনা নিয়ে হাজির হয়। রাস্তার সোডিয়াম বাতির সাথে সাথে যখন সমস্ত বাড়ি ঘর আর বহুতল বিপনিবিতান গুলো রঙ-বেরঙের আলোয় ঝলমল করে উঠে আর শহরের কাক গুলো যখন কা কা করতে করতে দলবেঁধে ঘরে ফিরে আমার শুধু মনে হয় আমার কোথাও যাবার নেই। এতো আলো এত কথার ঝনাৎকারের মাঝে আমি দূর দিগন্তে দাঁড়িয়ে বৃক্ষ এক। কোন আড্ডা কিংবা রেস্তোঁরায় যাই না। একা একা এদিক সেদিক হেঁটে হেঁটে আর কাটছিল না সময়গুলো। কাল সন্ধ্যার পরেই তাই ট্রেনে চেপে বসলাম। সারারাত আমার একটুও ঘুম হয় নি। পাশের যাত্রীটি মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে আমার গায়ের উপর এসে পড়ছিল। সারারাত নির্ঘুম আমি যেন একটু ক্লান্ত হইনি। বরং বিশ্বাস কর, বহুদিন পর আমি যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। আমার মত নিতান্ত নির্জীব ঘরমুখো একটা জীবের পক্ষে এ যেন এক বিরাট ঘটনা। মনে আছে একবার তুমি আমাকে বলেছিলে,’’ তুমি কি কোন দিন আমাকে দেখতে আসবে!” আমার মত উদাসীন উজবুকের পক্ষে এ যে অভাবনীয় সে তুমিও টের পেয়েছিলে। অথচ দেখ সেই উজবুকই গতকাল সারারাত না ঘুমিয়ে তোমার দেশে হাজির হয়েছে। আমরা যখন ক্লাস শেষে একসাথে বাসায় ফিরতাম তুমি অনবরত কথা বলতে। তোমার এত গল্প ছিল আর এত সুন্দর তোমার বলা আমি কেবল শুনেই যেতাম। তাছাড়া এমনিতেই কথা বলি কম। গুছিয়ে কথা বলা শিখিনি কোন দিন। তাই তোমার কথাগুলো আমার কাছে যেন পুষ্প হয়ে ফুটত।

কাল যখন আর কিছুতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না, চেপে বসেছি মেইল ট্রেনে। মনে হচ্ছিল একদিন, শুধু এক সন্ধ্যায় যদি মুখোমুখি বসি। দরকার নেই নদীর ধার, কাশবন। দিগন্ত জোড়া কোন মাঠ, বটবৃক্ষ এসবও দরকার নেই কিছুতেই। শুধু একসন্ধ্যা, মুখোমুখি কোথাও। ফুটপাত, টং দোকান, আটপৌরে যেকোন জায়গায়।

সমস্ত বন বাদাড়, ধানক্ষেত পাড়ি দিয়ে সকাল বেলা নেমে সোজা তোমার ঠিকানায়। এসে দেখি আমার প্যারাডাইস লস্ট। তুমি নেই আর আগের ঠিকানায়।

বৃদ্ধাশ্রম থেকে পাঠানো মায়ের চিঠি

খোকা,

কেমন আছিস জানতে চাইবো না। কেননা সব মায়েদের চাওয়াই থাকে তার খোকা যেন সব সময় ভাল থাকে, সুস্থ্য থাকে। আমাকে ছেড়ে নিশ্চয়ই তুইও ভাল আছিস। আর ভাল থাকবি না কেন বল? ভাল থাকার জন্য তো তোরা আমায় এখানে পাঠিয়ে দিয়েছিস। আমি ভাল আছি, তবে ছোটদাদুর জন্য মনটা খুব কাঁদে রে। ওকে ভুলে থাকতে পারি না। বউমাও নিশ্চয় খুব ভাল আছে।

যখন একলা থাকি তোর বাবার স্মৃতি খুব মনে পড়ে। বাড়ীর প্রতিটা আসবাবপত্রে তোর বাবার হাতের ছোঁয়া লেগে আছে। ইচ্ছে ছিল জীবনের শেষ অবধি সেগুলো বুকে আগলে রাখবো। কিন্তু তোরা আমার সুখ চাস বলেই নাকি এই বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়েছিস। তাই মাঝে মাঝে চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লেও এই ভেবে হেসে উঠি যে তোরা আমায় কত ভালোবাসিস। জগতে কোন ছেলে তার মাকে ভালোবেসে এমন সুন্দর জায়গায় পাঠায়। যেখানে কোন কাজ করতে হয় না। শুধু বসে বসে খাওয়া আর গল্প করে সময় কাটানো যায়।

জানিস খোকা, তুই তখন খুব ছোট। কেবল মাত্র হাঁটতে শিখেছিস। থাপুস-থুপুস করে পা ফেলে বাড়ীর আঙিনা জুড়ে হেঁটে বেড়াস। আমি তোর পাশাপাশি হাঁটছি। হঠাৎ তোর পা কেটে রক্ত বের হল। তোর বাবা তো সেটা দেখে আমার সাথে সেকি রাগ। পারে তো বাড়ী থেকে আমায় বের করে দেয়। তোকে কেন বুকে না রেখে মাটিতে হাঁটতে দিয়েছি এই অপরাধে। সেদিন আমরা তোর চিল্লা-চিল্লি দেখে কিছুই খেতে পারি নি। সারারাত নির্ঘুম কেটেছে দুজনের। তুই এখনও ভাল করে বাঁ পায়ের নিচে তাকালেই দেখতে পারবি আমাদের দুজনের আদরের ছোঁয়া।

খোকা, তোর বাবা প্রায়ই বলতো দেখে নিও আমাদের খোকা একদিন মস্ত বড় হবে। তোর বাবার কথা সত্যি হয়েছে। তুই অনেক বড় হয়েছিস। দোয়া করি আরও বড় হ। যতো বড় হলে মানুষ আকাশ ছুঁতে পারে। তোর জন্য মন খুব কাঁদে। কতোদিন হলো তোকে দেখিনা। এতো ব্যস্ত থাকিস কেন? এই বুড়ো মাকে একদিন একটু সময় করে দেখতে আসিস। ভয় নেই কিছুই নেব না তোর কাছে। শুধু তোর মুখটা দেখে প্রাণটা জুড়িয়ে নিব। তোকে এখন দেখতে না পারায় আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন খাঁ খাঁ করে রে। আমি তোকে জন্ম দিয়েছি। বুকে আগলে রেখে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেছি। ছোট্ট বিছানায় পেচ্ছাব করে ভিজিয়ে দিয়েছিস যখন তখন আমি সেই ভেজা বিছানায় শুয়ে তোকে বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুম পাড়িয়েছি। একেই বলে বুঝি জন্মান্তরের বাঁধন। এই বাঁধনটা কেটে দিতে নেইরে খোকা। কেটে দিলে সবাই যে তোকে অমানুষ ভাববে। আর আমি মা হয়ে সেটা সইবো কেমন করে বল

আজ আর নয়। আমার বংশের প্রদীপ ছোটদাদুর প্রতি খেয়াল রাখিস। ভাল থাকিস খোকা। হাজার বছর বেঁচে থাকিস।

ইতি,
তোর মা।