ট্যাগ আর্কাইভঃ মেগা সিরিয়াল

নক্ষত্রের গোধূলি-৩৬

৫১।
যে লোকটা চেয়ার টেবিল মুছছিলো সরাসরি তার দিকে এগিয়ে গেলো। লোকটাও তার দিকে এগিয়ে এলো।
-আমি রাশেদ, মারুফ সাহেবের সাথে লন্ডনে জব সেন্টারে—
কথা শেষ করতে হলো না। লোকটা সিলেটী বাংলায় বললো-
-হ্যাঁ জানি আপনার আসার কথা তা এতো দেরি করলেন কেন? জানেন না আজ শুক্র বার, আচ্ছা আসেন।
বলে রেস্টুরেন্টের পিছন দিকে ঘুরে বেরিয়ে গেলো। রাশেদ সাহেব শুক্রবার আর মঙ্গলবার এর পার্থক্য কিছু বুঝতে পারল না তবে অনুমান করলো কিছু একটা আছে নিশ্চয়। ভাবতে ভাবতে তাকে অনুসরণ করে যেখানে এসে দাঁড়াল তা দেখে বুঝল এটা রান্নাঘর। মারুফ সাহেবকে দেখল খুব ব্যস্ত। সাথে আরও দুই জন, তারাও ব্যস্ত। সবার পরনে এপ্রণ মাথায় কাগজের টুপি। বড় বড় কয়েকটা চুলা জ্বলছে তাতে বিশাল ডেকচিতে কি কি যেন রান্না হচ্ছে। সাড়া রান্নাঘরে যা কিছু জ্বাল হচ্ছে তার মিলিত গন্ধ আর ধোয়া। যারা কাজ করছে তাদের চিৎকার শুনে মনে মনে ভাবছিলো এরা কি স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারেনা? এই সব কিছু মিলিয়ে এক ভিন্ন নতুন জগত বলে মনে হলো । মারুফ রাশেদ সাহেবকে দেখেই বললো-
-যান তাড়াতাড়ি উপরে যান কাপর বদলে চলে আসেন। আজ শুক্র বার, দেরি করে ফেলেছেন।
কোথায় উপরে যাবে কোন কুল কিনারা পাবার কথা নয় তবুও আর কি করা আজ যখন শুক্র বার তখন যাই দেখি কোথায় যাওয়া যায়। শুক্র বারের মহাত্ম পরে জানা যাবে। উপরে উঠেই একটা রুম দেখল দরজা খোলা। আরও দু একটার দরজা বন্ধ। যাই হোক খোলা ঘরের ভিতরেই ঢুকে পরল। মিট মিটে আলোয় দেখল চারটা বিছানা, একটা ছোট টেবিল, দুটা ফোল্ডিং চেয়ার, একটা রুম হিটার। ঘরের মধ্যে নোংরা দুর্গন্ধ। এলো মেলো কাপর চোপর জুতা মুজা ইত্যাদি সারা ঘর ভরে ছড়ান ছিটানো। ঘর জুরে বিছানো কার্পেটটায় যে কখনো রঙ ছিলো সেটা যে কি রঙ তা বোঝার উপায় নেই। এই কি লন্ডনের পরিবেশ? এর মধ্যেই থাকতে হবে তার ভাগ্যের পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত? যাক, ভাগ্যে যা আছে তাই ই তো হবে। এখন এসব দেখার সময় নয়। এক পাশে তার সুটকেস ব্যাগ রেখে কাপর বদলে কাজের জন্য আগে থেকে ঠিক করে রাখা কাপর পরে ফিরোজের দেয়া জুতা জোড়া পায়ে নিচে নেমে এলো।
আবার কিচেনে ঢুকতেই মারুফ ডাকল।
-এদিকে আসেন, ওই ঐ দিকে দেখেন একটা বক্স আছে ওর ভিতর এপ্রণ আছে একটা গায়ে দিয়ে আসেন।
কথা মত এগিয়ে গিয়ে কাঠের বাক্সটা খুলে এপ্রণ বের করে গায়ে দিয়ে মারুফের সামনে দাঁড়াতেই মারুফ বললো-
-এই যে সিংক এর নিচে উপরে ডেকচি ওই গুলি সব ধুয়ে ফেলেন।
রাশেদ সাহেব তাকিয়ে দেখল সাত আটটা বিভিন্ন সাইজের ডেকচি, সাথে আছে আরও অনেক গামলা বাটি ইত্যাদি। কোথায় কিভাবে এগুলি ধুবে তার কিছুই বলেনি। খুঁজতে লাগল কোথায় ধোয়া যায়। হঠাৎ মারুফ চিৎকার করে উঠল-
-কি হলো ধোয়া হলো? এদিকে আসেন এই যে এখানে এই গুলি সব উঠিয়ে ওই বিনে ফেলেন।
রাশেদ সাহেব হতভম্ব হয়ে জানতে চাইল-
-কোথায় ধুব এগুলি?
-বলেন কি এখনও ধোয়া হয়নি আরে ওই যে এতো বড় সিংক দেখছেন না তাড়াতাড়ি করেন।
হ্যাঁ এতো বড় সিংকই বটে কিন্তু এর মধ্যে যে তার চেয়েও বড় ডেকচি কিভাবে ধোয়া সম্ভব তা বুঝে উঠতে না পারলেও বুঝতে পারল এখানেই ধুতে হবে এবং এখানে এই ভাবেই কাজ করতে হবে। মানিয়ে নিতেই হবে। এখন বাছ বিচার করার উপায় নেই। বিশাল ডেকচি, তার একটা উঠিয়ে নিয়ে সিংক এর পাশে লিকুইড সাবান, তারের জালি, সবুজ রঙের হাড়ি মাজার শক্ত প্যাড সব সরঞ্জামই আছে। ঠাণ্ডা গরম পানির টেপ দেখে নিয়ে ডেকচি মাজতে শুরু করলেন। ওই সিংক এর মধ্যে এতো বড় ডেকচি নারা চারা করাই সামাল সামাল অবস্থা। তার মধ্যে ধোয়া! কি করবেন কি ভাবে করবেন কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। এমনি সময় আবার তাগাদা-
-কি ভাই সাহেব হইলো?
অথচ তখনো মাত্র একটা ধুয়ে নিচে নামিয়ে রেখেছেন।
-হ্যাঁ ভাই এই তো হচ্ছে।
এই ভাবে মোটামুটি আধ ঘণ্টার মধ্যে ধোয়া হলো। ওদিকে অন্য যারা ছিলো তারা যে তামাশা দেখছে আর সিলেটী ভাষায় নানান রকম অশ্লীল মন্তব্য করছে তা নীরবে শুনে যাচ্ছেন। ওরা ভাবছে লোকটা আমাদের কথা বুঝতে পারছে না। কেও কেও ফাঁকে ফাঁকে কৌতূহল মেটাচ্ছেন।
-ভাইছাবের বাড়ি কোথায়, নাম কি, ছেলে মেয়ে কয় জন, ফ্যামিলি কোথায়, কবে এসেছেন, কি ধরনের কত দিনের ভিসা, কেন এসেছেন এখানে আর কে আছে, আগে কখনো এসেছেন কিনা, দেশে কি করতেন????
ইত্যাদি যা সাধারণ বাঙ্গালির সাধারণ কৌতূহল। রাশেদ সাহেব বিরক্ত হলেও বেছে বেছে কিছু প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাচ্ছেন। নিজে কোন প্রশ্ন করছেন না, বিরক্তি প্রকাশ করছেন না। এদের সাথেই থাকতে হবে।
মনি চলে যাবার ব্যথা, অচেনা পরিবেশ, অনভ্যস্ত কাজ। এমনিতেই কোমরে ব্যথা হচ্ছে, হাত দুটা অবশ হয়ে আসছে। সেই ভোরে উঠেছে, পা দুটা শরীরটাকে আর দাঁড় করিয়ে রাখতে চাইছে না তার পর এই সব মন্তব্য। মনের ভিতর শুধু ঝর বইছে, প্রচণ্ড ঝর। ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে। অনন্ত ধারায় মনরক্ত ঝরছে, আর থাকতে পারছেনা শরীর। রাশেদ সাহেব জানে না আর কতক্ষণ চলবে এই ভাবে। এক সময় ওগুলি ধোয়া শেষে অন্যান্য কাজ যা বলেছিলো তা শেষ হলে পর একজন বললো-
-এই যে ভাই সাহেব একটু হাত চালিয়ে কাজ করবেন, আরও ফাস্ট করবেন। আচ্ছা ওই যে ওই ব্রাশ টা নিয়ে এবার কিচেনের ফ্লোরটা ঝাড়ু দিয়ে ফেলেন। তার পর ওই যে দরজার বাইরে ওই ঘরটা দেখা যায় ওখান থেকে এক বস্তা পিঁয়াজ এনে ছিলবেন।
মারুফ বললো –
-কেন পিঁয়াজ লাগবে কেন পিঁয়াজ তো ওই বালতিতে আছে।
-ও আচ্ছা থাক তাহলে পিঁয়াজ আনা লাগবে না।
রাশেদ সাহেব ভাবলেন যাক এখন না হয় লাগল না কিন্তু পরে আমাকেই আনতে হবে। এটাও তা হলে আমার কাজ।
কিচেন ঝাড়ু দেয়ার পর লক্ষ করলো আড়াইটা বাজে। একটু দুই মিনিটের জন্য দাঁড়াবার সুযোগ পেয়ে কবির নামে ছেলেটাকে বললো-
-এখন কি কাজ?
-না এখন শেষ।
এর মধ্যে সবাই যাদু মন্ত্রের মত কিচেন ছেড়ে চলে গেছে।
-উপরে চলেন আপনার বিছানা দেখিয়ে দেই। আসেন আমার সাথে। আচ্ছা এক মিনিট, ওই যে ওই দরজা টা বন্ধ করে আসেন, ঠাণ্ডা বাতাস আসবে। উপরে যাবার সময় সব সময় ওই দরজা বন্ধ করে যাবেন।
এই বলে কবির আবার নিচে নেমে এলো।
-আসেন আমার সাথে আপনাকে দেখিয়ে দেই।
ওই দরজা দিয়ে বাইরে এলো। রাশেদ সাহেবও এলেন ওর পিছে পিছে বাইরে আসতেই ঠাণ্ডায় সমস্ত শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠল কিন্তু তা চেপে দাঁত কামড়ে রেখে তাকিয়ে দেখলো পিছনটায় কাঠের বেড়া দিয়ে ঘেরা। ভিতরে একটা গাড়ি। ও পাশে একটা ছোট কাঠের ঘর। ঘরের ভিতরে আলু পিঁয়াজের বস্তা, আদা রসুন, ধনে পাতা, ক্যাপসিকাম, গাজর, ফুল কফি, আরও অনেক কিছু।

নক্ষত্রের গোধূলি-৩৫

৫০।
সুন্দর ছাউনি দেয়া ছোট্ট বাস স্ট্যান্ড, কাঁচের দেয়াল, ভিতরে বেঞ্চ আছে। তাকিয়ে দেখল বিভিন্ন বাসের সময় সূচী লেখা পোস্টারের মত কাঁচের দেয়ালে লাগানো। খুঁজে দেখল তার দরকার যে বাস ওটা আসতে আরও দশ পনের মিনিট বাকি। একটা সিগারেট হলে ভাল হোত। কি মনে করে আর সিগারেট বের করলো না। আশে পাশে তাকিয়ে দেখল ডান দিকে একটু দূরে ট্রেন স্টেশন দেখা যাচ্ছে। এবারে ওই জব সেন্টারে দেখা মারুফ সাহেবের দেয়া ঠিকানা টা পকেট থেকে বের করে দেখল জর্জ স্ট্রীট, আবিংডন। রেস্টুরেন্ট এর নাম হোল্ডিং নং মনে থাকবে। চার দিকে দেখতে দেখতেই বাস এসে দাঁড়াল। মাল পত্র নিয়ে উঠে পরতেই ড্রাইভার মাল রাখার জায়গা দেখিয়ে দিল। যাত্রীদের মালামাল রাখার জন্য গেটের পাশে আলাদা জায়গা আছে। ওগুলি রেখে ড্রাইভারকে ২ পাউন্ড ১০ পেনি ভারা দিয়ে টিকেট নিয়ে সামনের একটা সীটে বসল। এতক্ষণ কি ভাবনাই না ভাবছিলো। লোকাল বাসে এই মাল পত্র কিভাবে কোথায় রাখবে? সে তার নিজের দেশের মত করেই ভেবে নিয়েছিলো। যাই হোক বেশিক্ষণ লাগেনি কিছুক্ষণের মধ্যেই পথে দু এক জায়গায় থেমে শেষ এক জায়গায় এসে দাঁড়াল বাসটা। লোকজন নামার ভাব দেখেই অনুমান করলো এটাই গন্তব্যের শেষ।
বাস থেকে নেমে আবার এদিক ওদিক তাকিয়ে সুবিধা মত একজনকে ঠিকানাটা দেখাতেই দেখিয়ে দিল ওই যে ওইটা জর্জ স্ট্রিট। এদেশের ঠিকানা খুঁজে বের করার কায়দা লন্ডনে ফিরোজ শিখিয়ে দিয়েছিলো। রাস্তার এক দিকে জোড় নম্বর এবং অপর দিকে থাকবে বেজোড় নম্বর। সেভাবেই এগিয়ে মিনিট পাঁচেক হেঁটে একটু দূর থেকেই রেস্টুরেন্টের নাম দেখতে পেল। কাছে গিয়ে দেখে রেস্টুরেন্ট খোলা। একটু ইতস্তত করে কাঁচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেই বাংলা চেহারার একজনকে দেখল চেয়ার টেবিল মুছতে। তখন প্রায় একটা বাজে।
রেস্টুরেন্টের ভিতরে ঢুকেই মন ভরান একটা সুঘ্রাণ এলো নাকে। দেখল বাম পাশের পুরোটাই কাঁচের দেয়াল। দেয়াল এর নিচে সুন্দর করে সাজানো সুন্দর সব ঘর সাজাবার গাছ। সামনের দেয়ালে বিভিন্ন ছবির ফ্রেম। মেঝেতে সুন্দর কার্পেট বিছানো, তার উপর দুই জন চার জন বসার মত করে আলাদা আলাদা চেয়ার টেবিল সাজানো। টেবিলের উপর সাদা টেবিল ক্লথ বিছানো তার উপর ছুরি, কাটা চামচ, টেবিল চামচ, ন্যাপকিন, ওয়াইন গ্লাস এবং তার পাশে একটা করে কোয়ার্টার প্লেট। ডান পাশে একটা ছোট কাউন্টার এর মত যার ভিতরে নানান রকমের বোতল। দেখে চিনতে পারলো মদের বোতল। এটা রেস্টুরেন্টের বার। পিছনের দেয়ালে ব্র্যাকেটে আরও অনেক বোতল সাজানো। তার নিচে ওই সব মদ পরিবেশনের জন্য বিভিন্ন রকমের গ্লাস। পুরো বারটাই সুন্দর কারুকাজ দিয়ে সাজানো। সামনে দুইটা টেলিফোন, পিছনে একটা টিল, পাশে একটা পিডিকিউ মেশিন যাতে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে লেনদেন করা হয়। সামনে ব্যারেলের লাগার ঢালার কয়েকটা টেপ তাতে বিভিন্ন কোম্পানির লোগো আঁকা।

নক্ষত্রের গোধূলি-৩৪

৪৯।
দুর্বলের উপর যখন সবলের অত্যাচার চরম পর্যায়ে পৌঁছে যখন দুর্বলের কিছু করার থাকে না, দুর্বলের মনের যে হাহাকার তা শোনার মতো কেও থাকে না, সে যে কত মর্মান্তিক কত হৃদয় বিদারক ব্যাপার তা একমাত্র দুর্বলেই বুঝতে পারে। এই আঘাত শুধু মনের, আর মনের তো রক্ত নেই তাই তা দেখা যায়না কতটা আঘাত সে পেয়েছে। রক্ত থাকে শরীরের মাংসে, হাড়ে মজ্জায়। মনের যদি রক্ত থাকত তাহলে যে কত মনরক্ত ক্ষরণ দেখতে পেতাম সে হিসাব করতে পারব কি আমরা? নাকি মনরক্তের কোন মূল্য আমরা জানি? আমরা শুধু জানি আহা মুক্তির মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হলো বলিদান। কিন্তু যে বলিদান হলো সে তো চলেই গেলো যে বলিদান হতে পারল না তার মন যে চুরমার হলো সে কথা কি কখন জানতে পেরেছি না জানতে চেয়েছি? নাকি কারো দিকে তাকিয়ে দেখেছি কত মনরক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। শরীরের আঘাতে রক্ত ঝরে নয়ত হাড় মাংস থেঁতলে বা ভেঙ্গে যায়। যা চিকিৎসা করা যায়, জোড়া তালি দেয়া যায়, সেলাই করা যায়। দরকার হলে ভিন্ন শরীর থেকে রক্ত হাড় মাংস এনে পূরণ করা যায়। যার মন ভেঙ্গে গেছে তার কি চিকিৎসা? ভিন্ন মন এনে কি তার মন জোড়া যায়? মন কি সেলাই করা যায়? কেন যায়না তা হলে সে কি করে ভাঙ্গা ক্ষত বিক্ষত মন নিয়ে বেঁচে থাকবে?

বাসের সিটে বসে ভাবছিলেন। দুপাশের কোন দৃশ্য তার চোখে পরেনি। কতক্ষণ সময় গেছে তাও চোখে পরেনি। মনি কিভাবে পৌঁছবে, মেয়েরা কি ভাবে মানুষ হবে আমি কত দূর কি করতে পারব, কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে ভাগ্য, ফেলে আসা জীবন। আমার ভুল কোথায় ছিলো আদৌ কোন ভুল ছিলো কি? হ্যাঁ ভুল তো অবশ্যই ছিলো। অন্ধ বিশ্বাস আর সরলতা। কামরুল তো বলেছিল তুমি যা করতে যাচ্ছ তার মূল্য কি পাবে? তোমার যে মানসিকতা তুমি কি পারবে মানিয়ে নিতে? কিছু মনে করনা বাবা মা যাই বল কেও কিন্তু স্বার্থের বাইরে নয় তুমি যতক্ষণ দিতে পারবে ততক্ষণ তুমি ভাল। যখনই দেয়া বন্ধ হবে তখনি শুরু হবে দ্বন্দ্ব? ভেবে দেখ তোমার ফ্যামিলি চাইবে এক রকম আর তোমার বাস্তব হবে অন্য রকম। মাঝ থেকে তোমার বউ ভুগবে তোমার মেয়েরা ভুগবে তাদের মনে কিন্তু ভীষণ প্রভাব পরবে। অফিসের কলিগরা সবাই বলেছিলো রাশেদ সাহেব ভালো করে চিন্তা করে চাকরি ছাড়বেন। বস ক্যাপ্টেন মাযহার তো ছাড়তেই চাননি। বলেছিলেন দেখুন এসব ক্ষেত্রে যা হয়, আপনি কিন্তু পারিবারিক সমর্থন পাবেন না আর তখন কিন্তু আপনার দুই দিক সামাল দেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আপনার কিন্তু অত টাকা নেই।

মেয়েরা ভুগছে ঠিকই কিন্তু তারা অনেক কষ্টে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে আর মনি! সে তো তার পক্ষে যা সম্ভব তা তো করেছেই যা সম্ভব নয় তাও করার চেষ্টা করেছে এই সব ভাবছিলেন। এলো মেলো ভাবে কত কি আসছিলো মনে। আজ স্ত্রী সন্তান ছাড়তে হলো, সংসার ছাড়তে হলো, দেশ ছাড়তে হলো।
কিছুক্ষণ পর কোচ লন্ডনের ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশনে এসে দাঁড়াল। সেখানে দশ বারো জন যাত্রী উঠে যার যার সীটে বসার মিনিট চার পাঁচের মধ্যেই কোচ আবার ছেড়ে দিলো।
লন্ডন শহর পেরিয়ে মটর ওয়েতে যখন বেরিয়ে এলো তখন গাড়ির গতি দেখেই বোঝা যায় নির্বিঘ্নে কোন রকম বাঁধা হীন ভাবে এক গতিতে চলছিলো। সমস্ত গড়িতে কোন সাড়া শব্দ নেই। চুপ চাপ, শুধু গাড়ি চলার শব্দ। দুই ঘণ্টা পরে কোচ এসে অক্সফোর্ড গ্লস্টার গ্রিন কোচ স্টেশনে দাঁড়াল। কোচ থেকে নেমে মালামাল নিয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে তার পথের সন্ধান পেতে চেষ্টা করলেন কিন্তু ডান বাম সামনে পিছনে সবই তো তার কাছে সমান। কোন দিকে যাবে কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। এখানে বেশ লোক জন যাচ্ছে আসছে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। পাশেই কফি শপ সেখানে চা কফির সাথে নানান কিছু খাচ্ছে। তাদেরই এক জনকে জিজ্ঞেস করলো আমি আবিংডন যাবার বাস কোথায় পাব? কিন্তু সে যা বললো তা রাশেদ সাহেব কিছুই বুঝতে পারল না। হা না বলে মাথা ঝেঁকে কোন রকম তার হাত থেকে রেহাই নিয়ে মোটামুটি ওই দিকে এগিয়ে যাবার ভান করে অন্য একজনকে আবার ওই একই প্রশ্ন। এবারের লোকটা বয়স্ক। সে রাশেদ সাহেবের পা থেকে মাথা পর্যন্ত আর সাথের মালামাল গুলি দেখে বললো আস আমার সাথে।
ভারি ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে সুটকেসটা হ্যান্ডেল ধরে টেনে তার সাথে হাঁটতে হাঁটতে পিছন দিকে টার্মিনালের বাইরে এসে দাঁড়াল। লোকটা হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল এই রাস্তাটা পার হয়ে ওই যে রাস্তা দেখা যাচ্ছে ওই খানে বাম পাশে যে গাছটা দেখছ ওখানেই বাস স্ট্যান্ড। বেশি দূরে নয়, কাছেই ৩/৪ মিনিটের পথ মাত্র। ওখানে তুমি আবিংডনের বাস পাবে। এক হাত বারিয়ে দিয়ে হ্যান্ড সেক করে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে আবার হেঁটে গাছের নিচে এসে দাঁড়াল।

নক্ষত্রের গোধূলি-৩৩

৪৭।
ওহে অর্থ, ওহে বিত্ত, ওহে সম্পদ আজ এই পঁয়তাল্লিশ বৎসর বয়সে এসে তুমি আমার মনিকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলে? আমার মনি আমাকে একা এই নির্জন বনবাসে রেখে একা চলে গেলো? এমন হবার কথা ছিলো না। কেন এমন হলো? এ সময় মনিকে নিয়ে সন্তানদের নিয়ে সুখের সংসারে সোহাগে আহ্লাদে আমোদে কাটাবার কথা ছিলো, তাহলে? এ কি? এই জন্যই কি মাত্র উনিশ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে বের হয়েছিলাম? এই কি তার পরিণতি? সত্যিই অর্থ, তুমি মহান, তুমি বড়ই শক্তিমান। তোমার শক্তির জোড়ে চলছে বিশ্ব। তুমি যাকে ধরা দিয়েছ সেই ভাগ্যবান আর যাকে ঘৃণা করেছ সেই হতভাগা। অথচ যার প্রয়োজন তুমি তার কাছ থেকে দূরে সরে থেকেছ, পালিয়ে বেড়িয়েছ। যার প্রয়োজন নেই তার সাথেই তোমার যত প্রেম যত মাখামাখি। কেন এই লীলা? কেন এই প্রহসন? কোথায় রয়েছ তুমি, আমার এই কথা কি শুনতে পাচ্ছ? জবাব দাও! জবাব দাও! আর কত কাল তোমার এই লীলা চলবে? তোমার বোধোদয় কবে হবে? কবে? তুমি কি অন্ধ? কারো চোখের নোনা জলে কি তোমার পাষাণ হৃদয় ভিজে উঠে না? চোখের নোনা জলের, হৃদয় দুমড়ানো মোচড়ানোর কোন মূল্য কি তোমার কাছে নেই? তুমি কি এতই কঠিন, এতো বড় পাষাণ তুমি?

ভাবতে ভাবতে রাশেদ সাহেব সুটকেসের হ্যান্ডেল ধরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বার বার পিছনে ফিরে দেখছিলেন, যদি মনি ফিরে এসে তার সামনে দাঁড়ায় তা হলে আবার একটু দেখতে পেত এই আশায়। রাশেদ সাহেব ভালো করেই জানে তা হবার নয়। তবুও মিছে আশায় ভেজা চোখে ফিরে ফিরে দেখতে দেখতে টার্মিনাল থেকে বের হয়ে এলেন।

নক্ষত্রের গোধূলি-৩২

৪৫।
রাশেদ সাহেব বা মনিরা কেও আর কোন কথা বলতে পারেনি তবে কারো চোখে ঘুম আসেনি। শুয়ে শুয়ে উভয়েই যার যার মত করে ভাবনার একই স্রোতে সাঁতরিয়ে ব্যর্থ কূলের সন্ধান করেছে। ভোরের ট্রেনের শব্দ পেয়ে মনি বিছানায় উঠে বসে রাশেদ সাহেবকে ডাকল। রাশেদ সাহেব জেগেই ছিলেন। সারা রাত নানা চিন্তা এসে মগজের অলিতে গলিতে ইচ্ছে মত ঘুরে বেড়িয়েছে। মনি চলে যাচ্ছে ও একা এই পথ কেমন করে পাড়ি দিবে বিশেষ করে কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে ট্রান্সফার হবে কি ভাব? সে নিজেই বা এদেশে বে আইনি ভাবে আর কত দিন থাকতে পারবে? ছোট ভাইয়ের বাসায় তাদের একদিনের জন্যও জায়গা হলো না, দেশ থেকে ছয় হাজার মাইল দূরে এসে এই দেখবে তা কখনো কল্পনাও করতে পারেনি।

কেন এমন হয়েছে এই ভেবেই অস্থির, কোন কূল কিনারা পায় নি। সে কি মানসিক ভারসাম্য হারাতে বসেছে? মনি চলে যাচ্ছে কে তাকে এই সান্ত্বনা দিবে? তাকে কে দেখে রাখবে? মনিকে যতই বলুক তুমি চিন্তা করো না। আসলে যে সে নিজে কিছুই সামাল দিতে পারবে না তা সে ভাল ভাবেই জানে। সেদিন মনিকে এই কাটা ঘায়ে মলম লাগাবার কথা বললেও এই কি মন থেকে মুছে যায়? নাকি এটা মুছে যাবার ব্যাপার? আপন ছোট ভাইয়ের এই রূপ যে কোন দিন কল্পনাও করতে পারেনি। এমন কি হবার কথা ছিলো? কোন জবাব খুঁজে পায় নি। এ আবার কি ধরনের পরীক্ষা! এ যে দেখছি চরম পরীক্ষা। এই পরীক্ষার আগুনে যে সে জ্বলে পুরে ছাই হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই কয়েক দিনেই যেন তার বয়স বিশ বছর বেড়ে গেছে।
মনি জিজ্ঞেস করলো-
-সারা রাত ঘুমাও নি, তুমি কি ওই কথা ভাবছ, ও কথা ভেবে কি হবে? আর ভেবো না। নিজেকে শক্ত কর, মন শক্ত কর। মনে কর এটা আমাদের প্রাপ্য ছিলো। আজ যদি তুমি ব্যবসায় ক্ষতি না দিয়ে ভাল লাভ করে লক্ষ লক্ষ টাকা তোমার হাতে থাকত তাহলে এমন হোত না। আর ভেবো না চলো রেডি হও।

দুজনেই উঠে রেডি হয়ে মালপত্র নিয়ে নিচে নেমে এলো। আজ কেওই রোজা রাখে নি। সকালের নাস্তা খেয়ে বিদায়ের পালা। মনিরা ভাবীকে জড়িয়ে ধরে বললো-
-ভাবী, জানিনা কোন পূণ্যের ফলে নিয়তি আমাদেরকে টেনে আপনাদের কাছে নিয়ে এসেছে। আপন হলো পর আর যাকে কোন দিন দেখিনি, যার কথা কোন দিন শুনিনি সেই হলো আপন, এই বুঝি পৃথিবীর নিয়ম।
বলেই কেঁদে ফেলল। সে কান্না শেফালির মধ্যেও সংক্রমিত হলো। দুজনেই কাঁদছে। বিদায় এমনিতেই কঠিন, বিশেষ করে যেখানে মায়ার বন্ধন থাকে। মন কিছুতেই মেনে নিতে পারে না।
তবুও যেতে হয়, চলে যায়। মনিরা ফিরোজের মায়ের কাছে গিয়ে বললো-
-ফুফু আম্মা, ও তো রইল, ওকে দেখবেন, মাঝে মাঝে এখানেই আসতে বলেছি। ওর কোন জায়গা রইলো না, সবই বন্ধ হয়ে গেলো। ও এখানে এলে আপনি দেখবেন। ফিরোজ ভাই, আপনাকেও একই কথা বলছি। মানুষটা একে বারে শিশুর মত সরল, কিচ্ছু বোঝে না। আজ ছাব্বিশটা বছর ধরে আমি এই চালিয়ে আসছি। প্রয়োজন হলে একটু জায়গা দিবেন। আমি জানি এদেশে আপনি অন্তত মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবেন না।

নক্ষত্রের গোধূলি-৩১

৪৪।
রাশেদ সাহেব জব সেন্টারের বিশ পাউন্ড পরিশোধ করে একটু খুশি মনে চলে এলো। এসেই মনিকে বললো চাকরি একটা পেয়েছি।
হায়রে রাশেদুল হাসান! তুমি জান না কি চাকরি তুমি পেয়েছ। জানলে এতো খুশি হতে পারতে না। সারাটা জীবন শুধু হুকুম দিয়েই এসেছ, তোমার হুকুম তামিল করার জন্য কত জন তোমার চারপাশে ছিলো, হুকুমের সাথে সাথে তা যাদুর মত হয়ে যেত। আজ যা করতে যাচ্ছ তার জন্য তুমি কখনো ভাবতেও পারনি। শুধু তুমি কেন তোমার পারিপার্শ্বিক কেওই কখনো ভাবতে পারেনি কোন দিন তুমি এই কাজ করবে। তোমার নিয়তি তোমার জন্য এই বরাদ্দ করে রেখেছে। রাশেদের মুখে চাকরি পেয়েছি শুনে হাল ভাঙ্গা মাঝি যেমন ঝড়ের তোড়ে কূল হারিয়ে ফেলে আবার ঝড় থামলে কূলের দিকে নৌকার গলুই ঘুড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে মনিও যেন তেমনি কূলের সন্ধান পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ফিরোজ বাইরে ছিলো। ফিরে এসে রাশেদের কাছে সব শুনল। মনিরা বললো-
-ভাই এবার আমার যাবার ব্যবস্থা ঠিক করে দেন।
ফিরোজ টেলিফোনে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনের অফিসে কথা বলে নভেম্বরের সাত তারিখে সকালে মনিরার যাবার দিন ঠিক করে নিলো।
কায়সার বেয়াইর সাথে ফোনে আলাপ হলো।
-আরে বেয়াই আমিও তো ওই ফ্লাইটে কনফার্ম করেছি।
-তাহলেতো ভালই হয়েছে।
আজ চার তারিখ, মনিরা যাচ্ছে সাত তারিখে। মাঝে আর মাত্র দুই দিন। এই দুই দিন ওরা আর কোথাও বের হয়নি। রাশেদ সাহেব যেতে চাইলেও মনিরা ধার করে আনা টাকা এ ভাবে খরচের ভয়ে এড়িয়ে গেলো। রাশেদকে বোঝাবার চেষ্টা করলো।
-তুমি বোঝ না কেন, এইতো শেষ নয় তুমি রোজগার কর তারপর এসে বেড়াতে পারব। তখন মনে আর কোন কাটা বিঁধবে না।
একথা শুনে রাশেদ সাহেব আর কিছু বলতে পারেনি, যুক্তি সঠিক। আর কী বলবে, বলার মত কিছু নেইও। এ দুই দিন ঘরে বসে গল্প সল্প করেই কাটিয়ে দিল।
মনিরা যাবার আগের রাতে ফিরোজ বললো
-ভাবীকে নিয়ে এয়ারপোর্টে আমি যাব শেফালি যেতে পারবে না ওর ক্লাস আছে। তুমিও লাগেজ নিয়ে এক সাথে বের হবে ওখান থেকে অক্সফোর্ডের কোচ আছে। তোমাদের নামিয়ে দিয়েই আমাকে চিজউইক আসতে হবে একটা কাজ আছে।
রাতে শোবার পর মনিরা বললো-
-তুমি একা একা কেমন করে থাকবে? তোমার ওষুধ পত্র কি মনে করে খাবে? তুমি অত উদাস হয়ে থেকো না লক্ষ্মী আমার, একটু সজাগ হবার চেষ্টা কর। তোমার তিনটা মেয়ে রয়েছে তাদের জন্য তোমাকে শক্ত হতে হবে। যখন খারাপ লাগবে এখানে চলে আসবে। ক’দিন পর পর ফোন করবে না হলে আমি পাগল হয়ে যাব।

আস্তে আস্তে রাশেদের কাছে আরও কাছে এসে রাশেদের বুকে মাথা রেখে নির্জীবের মত পরে রইলো। কণ্ঠ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। রাশেদের বুকে কেমন একটা উষ্ণ ভাব অনুভূত হলো, আবার এরকম, আবার। ক্রমেই এই অনুভূতির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে এদিকে মনিরার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।
হাতের স্পর্শে দেখলো মনিরার চোখের নোনা জল পরে তার বুক ভিজে গেছে। শীতের পোষাক গায়ে বলে এতক্ষণ বুঝতে পারেনি। তবুও রাশেদ সাহেব তার মনিকে কিছু বলতে পারেনি। মনি কাঁদছে, কাঁদুক। এতে যদি একটু হালকা হতে পারে তাতেই মঙ্গল। কান্না থামিয়ে দিলে বোঝা আরও বেশি ভারী হতে পারে এই ভয়ে কিছু বলতে পারেনি। রাশেদ সাহেবের ভিতরে একটু দুঃখ, একটা চাপা অভিমানের উদয় হলো। যে মনিকে ছাড়া রাশেদ অচল সেই মনি এই রাত পোহালেই তাকে একা বনবাসে রেখে চলে যাবে। কি যেন বলতে চাইল কিন্তু মুখ দিয়ে সামান্য একটু শব্দের মত বের হলো কিন্তু সেটা কোন কথার মত না।
রাশেদ আবার মনির মাথা বুকে চেপে চুপ করে রইলো। মনিরা কাঁদছেই। সারা জীবনের জমে থাকা মনির চোখের নোনা পানি রাশেদের বুক ভিজিয়ে দিচ্ছে।
হোক, মনি কেঁদে কেঁদে হালকা হোক। ওর দুঃখ গুলি নোনা জলে ধুয়ে যাক। মনিকে যে শক্ত হতে হবে দেশে ওদের মেয়েরা আছে তাদেরকে মায়ের স্নেহ দিতে হবে বাবার স্নেহ দিতে হবে, মানুষ করতে হবে। রাশেদ সাহেব আবার কি যেন বলতে চাইলো কিন্তু এবারও সেই একই অবস্থা, মুখ দিয়ে কথা বের হলো না।
কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর রাশেদ ডাকলো-
-মনি!
-হু!
-কাঁদছ কেন?
-তোমাকে রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যে ভোলা মনের মানুষ থাকবে কি করে তারপর আবার ডায়াবেটিসের রুগী। কে তোমাকে দেখবে, আর কেই বা তোমার খাবার পথ্য যোগার করে দিবে?
-না মনি, তুমি শুধু দোয়া করবে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি কোন চিন্তা করবে না দেখবে রাতের পরেই দিন আসে। এক দিন দেখবে আমাদের এই দিন থাকবে না। তখন সবাই মিলে একত্রে থাকবো। আবার সেই আগের মত সব হবে। এখানে তোমার আসার ব্যবস্থা করে নিলাম যখন ইচ্ছা হবে চলে আসবে। আমি এখান থেকে টাকা পাঠাব তুমি মেয়েদের নিয়ে চলবে।
-সারা জীবন ভরে দেখে আসছি নিজের জন্য কিছু ভাবতে পারনি, নিজের কিছু করতেও পার না তাই তো ভাবনা তুমি একা থাকবে কি ভাবে?
-না মনি, সে জন্য ভাবনার কিছু নেই। প্রকৃতি মানুষকে অনেক কিছু দেয়, তার মধ্যে অনেক কিছুই থাকে। আমিও তেমনি করে শক্তি পেয়ে যাব, এ তো প্রকৃতির বিধান। এতো আমরা চাইলেই পরিবর্তন করতে পারবো না। কাজেই এ জন্য তোমার ভাবনার কিছু নেই, চিন্তারও কিছু নেই। এখন একটু ঘুমাবার চেষ্টা কর, ভোরে উঠেই লম্বা জার্নি শুরু হবে। একা যেতে পারবে তো?
-পারতে যে হবে।

নক্ষত্রের গোধূলি-৩০

৪৩।
বাসায় এসে ওরা উপরে গিয়ে শীতের কাপড় বদলে নিচে নেমে এসে দেখে ফিরোজ একটা বাংলা পত্রিকা নিয়ে বসে আছে। রাশেদকে দেখে বললো-
-দেখ এখানে রেস্টুরেন্টের কাজের অনেক বিজ্ঞাপন আছে, কিছু জব সেন্টারের ঠিকানাও আছে। তুমি কাল কোন একটা জব সেন্টারে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখ কি বলে। এই সব জব সেন্টারে রেস্টুরেন্টের কাজের চাহিদা আসে, ওরা কোথাও প্রোভাইড করে দিতে পারবে তবে ওরা একটা ফি নিবে। আমি এই ব্যবসা অনেক আগে ছেড়ে দিয়েছি বলে এই লাইনের কারো সাথে যোগাযোগ নেই না হলে আমিই করে দিতে পারতাম। এখানে এই কাজই বাঙ্গালিদের জন্য সবচেয়ে ভাল। থাকা খাওয়ার কোন চিন্তা নেই, সপ্তাহ পার হলেই কিছু বেতন পাবে, সপ্তাহে এক দিন ছুটি। তোমার কোন অভিজ্ঞতা নেই বলে প্রথম দিকে বেশ কম দিবে তবে আস্তে আস্তে অভিজ্ঞতা বাড়বে সে সাথে বেতনও বাড়বে। আমার মনে হয় এটাই ভাল, ভাবী কি বলেন?
-আমি আর কি বলবো ভাই আপনি যা ভাল মনে করেন তাই করেন। কাল কিন্তু আমার যাবার ব্যবস্থা করবেন।
-আচ্ছা সে দেখা যাবে আগে ওর কিছু হোক, তারপর আপনি যাবেন। ওর কিছু হওয়া পর্যন্ত আপনি থাকেন।
এমন সময় ভাবী কিচেন থেকে খাবার জন্য ডাকলেন।

পরদিন সকালে রাশেদ সাহেব ওই পত্রিকাটা হাতে নিয়ে বের হয়ে টিউবে করে ইস্ট লন্ডনের ব্রিক লেনের দুই একটা জব সেন্টারে গেলেন। তাদের কাছে কাজের কথা বলতেই বলে ফেলল আপনার বয়স হয়েছে এখন আর এসব কাজ আপনাকে দিয়ে হবে না, রেস্টুরেন্টের মালিকেরা সবাই ইয়াং ম্যান চায়। রাশেদ সাহেবের মনটা দমে গেলো। সেখান থেকে বের হয়ে পত্রিকা দেখে ঠিকানা বের করে আর একটা সেন্টারে গেলো। কাজের কথা বললো।
-আপনার কি কোন অভিজ্ঞতা আছে?
-না।
-ইংরেজি জানেন?
-কোন রকম কাজ চালাতে পারব মনে হয়।
-কি কাজ করবেন?
-দেখুন আমার কিছুই জানা নেই, যা হয় তাই দেন।
-আচ্ছা কিচেন পোর্টারের কাজ করতে পারবেন?
-এটা আবার কি কাজ?
-তাও জানেন না?
-কিচেন পোর্টার হলো হাড়ি পাতিল ধোয়া, বাসন পেয়ালা ধোয়া, আলু পিঁয়াজ ছিলবেন আর সেফ যা হুকুম করে তাই করবেন, পারবেন?
-রাশেদ সাহেব না বুঝেই বলে ফেললো, হ্যাঁ পারবো।

লোকটা একটা ডাইরি উল্টিয়ে ফোন নম্বর বের করে ফোন করে জানতে চাইল আপনারা একজন কিচেন পোর্টার চেয়েছিলেন, নতুন এসেছে কোন অভিজ্ঞতা নেই, চলবে? হ্যাঁ নেন আপনি নিজেই কথা বলেন বলেই রিসিভারটা রাশেদ সাহেবের হাতে দিয়ে দিলো।
রাশেদ সাহেব ফোন হাতে নিয়ে সালাম জানালো, কি বলতে হবে কিছুই জানে না।
ওপাশ থেকে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় জানতে চাইল -কবে এসেছেন?
-এইতো তিন দিন।
-ভিসা আছে?
-হ্যাঁ আছে।
-কাজ করতে পারবেন তো?
-চেষ্টা করে দেখব।
-আমাদের এখানে থাকবেন, খাবেন, সপ্তাহে একদিন ছুটি আর সপ্তাহে একশত বিশ পাউন্ড মজুরী পাবেন।
-আছা ঠিক আছে।
-কবে আসতে পারবেন?
এবার রাশেদ সাহেব একটু মনির কথা ভেবে নিলেন হয়তো তিন চার দিনে ও যেতে পারবে, ভেবে নিয়ে চার দিন সময় চাইলো।
বলেই ফেললো -দেখুন আমার স্ত্রী চলে যাবে সে গেলেই আমি আসতে পারব। এখনও তার টিকেট কনফার্ম করা হয়নি, আজ করবো।
-আছা ঠিক আছে যেখান থেকে কথা বলছেন ওদের কাছে আমাদের ফোন নম্বর ঠিকানা সব আছে আপনি এখানে এসে ফোন করলে আমাদের লোক এগিয়ে নিয়ে আসবে।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
-তাহলে এই কথা রইলো, আপনি চার দিন পর আসছেন।
-হ্যাঁ ঠিক আছে।
ফোন রেখে দেয়ার পর এক লোক এসে জানতে চাইল, আচ্ছা আমাদের যে কিচেন পোর্টার চেয়েছিলাম তার কি করেছেন? হ্যাঁ এইতো, বলে রাশেদ সাহেবকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন এই যে ইনি।
আপনি যেখানে যাবেন ইনি সেখানকার কুক, এনার সাথে কথা বলেন।
-আচ্ছা, আমি রাশেদ।
-আমি মারুফ বলে দুই জনে হ্যান্ড সেক করে আলাপ শুরু করলো।
-ভাই আমিতো একেবারে নতুন কি ভাবে যেতে হবে, ওখানে কি কাজ করতে হবে একটু দেখিয়ে দিতে হবে।
-হ্যাঁ সব দেখিয়ে দিব নেন এই ঠিকানাটা রাখেন। কোথা থেকে যাবেন, ভিক্টোরিয়া?
-না সম্ভবত আমাকে হিথরো থেকে যেতে হবে।
-আচ্ছা ঠিক আছে যেখান থেকেই যান অক্সফোর্ড নেমে বের হয়ে এসে আবিংডনের বাস ধরবেন, যেখানে এসে থামবে তার কাছেই রেস্টুরেন্ট। তাহলে কবে আসছেন?
রাশেদ সাহেব সব খুলে বললো,
-সে যাবার সাথে সাথেই আমি আসতে পারব। আজই টিকেট কনফার্ম করবো দেখি কবে সিট পাই। বুঝতেই তো পারছেন ভাই আমি এ লাইনে একেবারে নতুন কাজেই আমাকে সব শিখিয়ে নিতে হবে।
-হ্যাঁ হ্যাঁ সে জন্য ভাববেন না। আপনি সময় মত চলে আসবেন। তাহলে ভাই আসি।

নক্ষত্রের গোধূলি-২৯

৪১।
হাত মুখ ধুয়ে শীতের কাপড় পরে দুই জনে এক সাথে নিচে নেমে এলো।
ভাবী জিজ্ঞেস করলো
-কি ব্যাপার কোথাও যাবেন বুঝি?
-হ্যাঁ ভাবী যাই দেখি একটু ঘোরাঘুরি করে আসি।
-যান ভালো লাগবে। ঘুরে আসুন, ইফতারের আগেই এসে পরবেন।
ইস্ট একটন টিউব স্টেশনে এসে অল (ছয়টা জোন) জোনের দুইটা টিকেট নিয়ে ট্রেনে চেপে ম্যাপ দেখে দেখে এখান থেকে সেখানে, সেখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে নানান জায়গায় সারাটা দিন ভরে ঘুরে ঘুরে অনেক কিছু এক নজর দেখে গেলো। মনে স্বস্তি পাচ্ছে না, কোথাও ভাল লাগছে না শুধু যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে জানে না। কোন গন্তব্য নেই। ট্রেনে উঠে বসছে হঠাৎ যেখানে ইচ্ছা হচ্ছে সেখানেই নামছে আবার একটু ঘুরে এসে ট্রেনে চেপে বসছে। প্রথমে লন্ডনের বাঙ্গালি প্রধান এলাকা হোয়াইট চ্যাপেল এসে এটা সেটা কিছু দেখে গেলো। বাকিংহাম প্যালেস, ট্রাফেলগার স্কয়ার, ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারী, সবই টিউব থেকে নেমে স্টেশনের উপরে এসে এক নজর চোখের দেখা দেখে আবার টিউবে। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের বাইরে থেকেই চলে এসেছে ভিতরে যাবার সময় বা মন মানসিকতা নেই। পাশের একটা ফোন বুথ থেকে বাড়িতে মেয়েদের সাথে কথা বললো । তারপর সবার শেষে টেমস নদীর পাড়ে এক জায়গায় ফুটপাথের পাশে রেলিং ধরে দু’জনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো টেমসের বয়ে যাওয়া স্রোতের দিকে।
-মনি দেখ, এইতো টেমস নদী, টাওয়ার ব্রিজ, এতকাল যা ছবিতে দেখেছ আজ তা নিজ চোখে দেখে নাও।

সুদূর বাংলাদেশ থেকে দুই জন ভাগ্য বিতাড়িত নর নারী টেমসের পাড়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে কি বুঝতে পারছে কিছু? এরা যে ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য এখানে এসেছে! ওদের দেশের মাটিতে ভাগ্যের জমি এতই অনুর্বর যে শেষ পর্যন্ত তাদের ওখানে ঠাই হয়নি! অন্তহীন জ্বালা বুকে চেপে এই যে ঘুরে বেড়ানো এর শেষ কোথায়? এর পরিণতি কি? এ ভাবে কতদূর যেতে হবে কোথায় যেতে হবে তাও ওরা জানে না।
-মনি শুনছ!
-বল।
-আজ এখানেই কিছু খেয়ে ইফতার করি? চলো আবার হোয়াইট চ্যাপেলে যাই ওখানে কত বাঙ্গালি রেস্টুরেন্ট দেখে এলাম।
-না পাগল, চলো বাসায় চলো, ভাবী বলে দিল না যে ইফতারির আগে চলে আসতে।
-চলো তা হলে।
বিকেলে সাড়ে তিনটার দিকে ইফতারির কিছু আগে এসে দেখে ভাবী বিশাল আয়োজন করেছে।
তাই দেখে মনি বললো -দেখেছ না এলে কি হতো?
ফিরোজ পিছনের বাগানে কি যেন করছিলো ওদের সাড়া পেয়ে ভিতরে এসে বললো-
-এই যে স্যার এতো দেরি করলেন, কোথায় গিয়েছিলেন?
-আরে এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন ইফতার করে নিই সব বলবো। ম্যাডামকে লন্ডন দেখিয়ে নিয়ে এলাম
শেফালি বললো -তাহলে আর আমি কি দেখাব?
-না আপনার জন্য কিছু বাকী রেখেছি, আমি কি এতই বোকা?
ইফতার খেয়ে নামাজ কালাম পড়ে ফিরোজ বললো চলো একটু ঘুরে আসি, আমি তোমাদের জন্য সেই কখন থেকে বসে আছি।
-কি মনি, আবার যাবে?
-চলো।
এবারও ভাবীই গাড়ি চালাচ্ছে আর ফিরোজ পাশে বসে বিবরণী দিয়ে যাচ্ছে। ওই দেখ এটা হচ্ছে হোয়াইট সিটি এখানে বিবিসি ব্রডকাস্টিং অফিস, এই জায়গার নাম মার্বেল আর্চ, এটা অক্সফোর্ড সার্কাস এখানে বড় লোকদের শপিং সেন্টার। এই ভাবে নানা জায়গা ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত সেই টেমসের পাড়। ওই যেখানে ওরা বিকেলে এসেছিলো।
-রাশেদ বললো ঠিক এই খানেই আমরা বিকেলে এসেছিলাম।
-তাই নাকি?
-চলো এখন তাহলে রাতের টেমস দেখবে।
গাড়ি থেকে নেমে সবাই সেই রেলিং ধরে দাঁড়ালো। ফিরোজ বললো-
-ভাবী দিনের টেমস আর রাতের টেমসের মধ্যে কোন তফাত খুঁজে পাচ্ছেন?
-হ্যাঁ, শুধু টেমসই না পুরো লন্ডনের চেহারাই রাতে ভিন্ন রকম লাগছে। এ কি আর বলে দিতে হবে ভাই? এ যে লন্ডন মহানগরী। আমার পরম ভাগ্য যে আপনার বন্ধু আমাকে ছেড়ে কিছুতেই এলো না। আবার আমি এসে আপনাদের মত এত আপন জনের সাক্ষাত পেয়েছি যে তা কোন দিন ভুলতে পারবো না। ও যদি জোড় করে নিয়ে না আসত তাহলেতো আমার আসাই হোত না, এতো কিছু দেখতেও পারতাম না।

৪২।
ফিরোজ তার এই প্রিয় জায়গার বিবরণ দিতে গিয়ে তার বিয়ের প্রথম দিকের অনেক কথা বলে গেলো। রাতে বিছানায় শুয়ে পড়েছি এমন সময় হঠাৎ মনে হলো তো সঙ্গে সঙ্গে দুজনে উঠে গাড়ি নিয়ে এখানে চলে এসেছি তবে সেটা অবশ্যই সামারে করতাম। শীতকালে তো সম্ভব না, আজ এলাম শুধু তোমাদের দেখাবার জন্য। এমনকি রাতে দুই জনে গাড়ি নিয়ে কোথাও চলে যেতাম, এক নাগারে ২/৩ ঘণ্টা যেয়ে আবার ফিরে আসতাম। একবার সাউথ ওয়েলসে চলে গিয়েছিলাম। ওখানে যেয়ে দেখি অনেক রাত হয়ে গেছে, সে রাতে আর বাড়িতে ফিরিনি ওখানেই একটা হোটেলের রুম নিয়ে থেকে পরদিন দুপুরে ফিরেছিলাম।
-ভাবীর কি শীত লাগছে?
-হ্যাঁ একটু লাগছে।
-তাহলে চলেন গাড়িতে বসি, গাড়িতে হিটার চলছিলো এখনও গরম আছে।
গাড়িতে বসে মনি রাশেদের কানে কানে বললো আমার ফেরার কথা ভাইকে বলে আমার টিকেট কনফার্মের ব্যবস্থা কর। সামনের ভিউ মিররে দেখে ভাবী জিজ্ঞেস করলো-
-কি ভাবী কানে কানে কি হচ্ছে?
-না, কিছু না, এই আমার ফেরার কথা বলছিলাম।
-এতো তাড়া কিসের? কয়েক দিন থাকেন তারপর দেখা যাবে। আবার কবে আসা হয় না হয় তার কি ঠিক আছে? চলেন এখন একটা পার্কে নিয়ে যাই।
বলেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মিনিট বিশেকের মধ্যে একটা বিশাল এলাকা নিয়ে পার্কের গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো। নামটা মনে নেই তবে চারিদিকের আলো এবং পার্কের ভিতরের আলো আঁধারি মিলে মিশে কি যে এক মায়া ভরা দৃশ্য তা না দেখলে বোঝানো কঠিন ব্যাপার। এখানে পার্কের পাশে গাড়িতে বসেই ফিরোজ তাদের জীবনের কিছু ঘটনা বললো ।
গাড়িতে বসেই মনি বললো-
-ভাই আমার টিকেটটা তাড়াতাড়ি কনফার্ম করে দেন। আমি যত তাড়াতাড়ি যেতে পারব তত তাড়াতাড়ি ও কাজ শুরু করতে পারবে। আমার জন্য এখন একটা দিনও অনেক।
ভাবী গাড়ি স্টার্ট করে বললো-
-তাহলে এখন ফিরে যাই, নাকি আর কোথাও যাবেন, লং ওয়েতে? সেহেরীর আগে ফিরে আসব।
-না ভাবী আর না যথেষ্ট হয়েছে এবার বাসায় চলেন।

নক্ষত্রের গোধূলি-২৮

৪০।
সবাই গাড়িতে উঠা মাত্রই ভাবী গাড়ি স্টার্ট করে লন্ডনের পথে ছুটে চলল। ইফতারির আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। গাড়িতে এক মাত্র দুই বোতল পানি ছাড়া আর কিছু নেই। শেফালি স্ট্রাউড শহরে ঢুকে একটা সুপারস্টোরের পার্কিঙে গাড়ি পার্ক করে ফিরোজকে বললো তাড়াতাড়ি নেমে যাও দেখ কিছু নিয়ে এসো। এখানেই গাড়িতে বসে ইফতার করে আবার লন্ডনের পথে। অল্পক্ষণের মধ্যেই সেই এম ফাইভ মটর ওয়ে। ঝড়ের মত একশত মাইল বেগে ছুটছে গাড়ি। ড্রাইভিং এর শিক্ষিকা মিসেস শেফালি আতিক মুখে কেমন একটা অস্বস্তির কালো রঙ মেখে ট্রাফিক নিয়মের কোন বালাই না মেনে এক মনে ছুটে চলেছে।

যেন পিছনে বৃশ্চিক দংশনের কোন অগ্নি দগ্ধ করুন বিভীষিকা ফেলে যত তাড়াতাড়ি পালিয়ে যেতে পারলেই বেঁচে যায়। গাড়ির ভিতরটা নিস্তব্ধ, কারো মুখে কোন কথা নেই। কেবল মাত্র ইঞ্জিনের যান্ত্রিক একটা শব্দ আর তার সাথে গাড়ির চারটা চাকার সাথে মটর ওয়ের কঠিন পাথর আর পিচ মেশানো পথের ঘর্ষণের শব্দ। একটু পরেই হঠাৎ ফিরোজ পকেট থেকে মোবাইল বের করে ওর বাসায় ফোন করে বলে দিল আমরা আসছি। ——রাশেদ সাহেব মনিরাকে বললো মনি পানির বোতলটা দাও তো।
রাত সাড়ে আটটা নাগাদ ওরা ফিরোজের বাড়ির সামনে নেমে মালামাল নিয়ে নেমে এলো। এর মধ্যে কারো মুখে কোন কথা নেই। রাশেদ যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। ঘরে গিয়ে শীতের কাপড় চোপর ছেড়ে কোন ভাবে রান্না ঘরে এসে খেয়ে মনিকে নিয়ে উপরে গিয়েই এই পৃথিবীতে এক মাত্র আশ্রয় মনির বুকে মাথা রেখে শুধু জিজ্ঞেস করলো-
-মনি, একি হলো? কেন এমন হলো? এটা কিসের প্রাপ্তি?
মনিরা কিছু বলতে পারলো না শুধু স্বামীর মাথাটা শক্ত হাতে চেপে রেখে চুপ করে রইলো। মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে রাশেদের ঘুমের জন্য চেষ্টা করতে লাগল। রাশেদের ঘুম আসছে না। মনে মনে বার বার ওই একই কথা ভাবছে। কি হলো, কেন হলো? কোন জবাব সে খুঁজে পেল না। আজ যদি ফিরোজ গাড়িতে করে না নিয়ে যেত, তারা যদি কোচ বা ট্রেনে করে যেত তাহলে কি হোত? কি করতে পারত সে। এই শীতের মধ্যে এতগুলি মালামাল সহ একজন মহিলাকে নিয়ে তার কি অবস্থা দাঁড়াতো? সে মনিরাকেও আর কিছু জিগ্যেস করার সাহস পাচ্ছে না। মনিরাও একই কথা ভাবছে। দু’জনের কারোরই ঘুম আসছে না। সারাটা রাত নিদ্রাহীন ভাবেই কেটে গেলো, কিন্তু এর মধ্যেও কেও কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না। কারো মুখে কোন কথা নেই, নীরব, নিস্তব্ধ। যেন কোন রাক্ষস পুরী থেকে তারা কোন ভাবে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছে, সেই রাক্ষস পুরীর আতঙ্ক ওদের কণ্ঠ রুদ্ধ করে দিয়েছে।

সুখের রজনী কোথা দিয়ে পার হয়ে যায় সে কেও কোন দিন টের পায় না, হিসেব কেও রাখতে পারেও না, কিন্তু দুঃখের রজনী? সে তো সহজে পোহাতে চায় না, সহজে শেষ হয় না, যেন অনন্তের যাত্রা। সে যাত্রা যে কোথায় শেষ হবে তা কেও জানে না! কণ্টক জর্জরিত সে পথ ফুরাতে চায় না! এই এত বড় পৃথিবীর কে কোথায় সুখে আছে আর কে দুঃখে আছে সে হিসেব কে রাখে? এ তো পৃথিবীর কাজ না! তোমরা কে সুখে আছ আর কে দুঃখে আছ সে দেখতে গেলে কি আমার চলে? আমিতো তোমাদের সবাইকেই জায়গা দিয়েছি। তোমরা নিজ নিজ সুখ বা দুঃখ খুঁজে নাও, আমাকে আমার পথে চলতে দাও। তোমাদের জন্য কি আমি থেমে থাকতে পারি? আমাকে কেও কখনো দেখেছ ক্ষণকালের জন্য আমি থেমেছি?

রাতের পরেই দিন আসে, উদয় হয় নতুন সূর্যের। বিগত রাতের সকল দুঃখ ব্যথা, আনন্দ বেদনা সব কিছু সূর্যের তাপে জ্বলে পুরে নিঃশেষ হয়ে আবার নতুন করে সব শুরু হয়। মানুষ নতুন প্রেরণা পেয়ে, নতুন উৎসাহ নিয়ে, শক্তি নিয়ে আবার শুরু করে। এই বুঝি প্রকৃতির উপহার। এতেই বুঝি সব দুঃখ, জ্বালা যন্ত্রণা সব শেষ হয়ে যাবে!
এক সময় রাশেদ মনিরার কাল রাত্রি শেষ হয়। এটা লন্ডন শহর, এখানে আজানের সুরে ভোর হয় না। এখানে ভোর হয় ঘড়ির কাটা ধরে। সূর্য উঠুক বা না উঠুক, ঘড়ির কাটা ধরে ভোর হয়ে যায়। আজ আকাশটা একটু ফর্সা দেখাচ্ছে, পাশের ট্রেন লাইন ধরে ভোরের প্রথম ট্রেন যাবার শব্দ ওরা দু’জনেই শুয়ে শুয়ে শুনল।
এতক্ষণে মনিরা রাশেদকে ডাকল-
-উঠবে?
-ওরা কেও উঠেনি, একটু পরেই উঠি।
-সারা রাত তুমি ঘুমাওনি।
-তুমিও ঘুমাওনি।
-শোন মনি, কাল যা যা দেখলাম তার শিক্ষাটা রেখে বাকী সব ভুলে যাবার চেষ্টা কর, আর কাওকে কিছু বলার দরকার নেই। এই লজ্জার কথা, এই অপমানের কথা কী বলা যায়? কাকেই বা জানাবে বা জানিয়ে হবেই বা কি?
-হ্যাঁ, আমিও তাই ভেবেছি, যদিও আমি সারারাত ভেবে এর কোন কুল কিনারা পাইনি, নিজের সাথে যুদ্ধ করেও কোন সমাধান পাইনি, তোমাকে আর কি সান্ত্বনা দিব? আমি সে ভাষা খুঁজে পাইনি। তাই আমিও তোমাকে বলব বলে ভেবে রেখেছি, এ ভুলে যাওয়াই ভালো। আশা করি এর একদিন পরিবর্তন হবে। যদি না ও হয় তবে ভাববো এটাই আমাদের নিয়তি।
-হ্যাঁ মনি আমিও আশা করি একদিন এই লোহার কপাট ভাঙবে তবে হয়তবা সেদিন সব শেষ হয়ে যাবে।
-তুমি লক্ষ করনি ওখানে যখন ওরা দরজা খুলছিলো না বলে আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন ফিরোজ আমার কানে কানে বলছিলো তোমার ভাই নিশ্চয়ই ঢাকায় ফোন করে তোমার বাবার সাথে কথা বলে নিচ্ছে, সে এখন কি করবে এই ব্যাপারে। এছাড়া আমি দরজা না খোলার আর কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।
একটু থেমে কি যেন ভেবে রাশেদ সাহেব জিজ্ঞেস করল -আচ্ছা কি হয়েছিল বলত।
-সে কথা না শোনাই ভাল।
-কিন্তু আমাকে যে জানতে হবে!
-ভাবী বলবে, এখানকার টানে ইংরেজি আর সিলেটী ভাষা মিশিয়ে বলেছে, ওর কথা আমি সব বুঝতে পারিনি, তুমি ভাবীকেই জিজ্ঞেস করে দেখ।
-ভাবীকে এ কথা জিজ্ঞেস করা কি ঠিক হবে?
-তাহলে ফিরোজ ভাইকেই বলবে।
-তুমি যা বুঝেছ তাই বল।
-এ কথা বলার মত না তবুও শোন, জাহিদের বৌ বলল, তোমরা এখানে কেন এসেছ? এক্ষনি চলে যাও নয়ত আমি পুলিশ ডাকব। এই বলেই ভাবীকে ইংরেজিতে অনেক গালাগালি করেছে।
-কেন পুলিশ কেন ডাকবে? আর ভাবীকেই বা গালাগালি করবে কেন, তার সাথে ওর কি সম্পর্ক?
-আমি নাকি সাপ! বলল এই সাপকে কেন নিয়ে এসেছ? আমি এইটুকই বুঝেছি।
-কি বললে?
-আমি বলিনি, ও যা বলেছে আমি তাই বললাম।

-এখন আমার মনে হচ্ছে ফিরোজের অনুমান একেবারে নির্ভুল। কি জানি হতেও পারে, আমারও মনে হয় কথাটা ভুল না। তাই বলে এ কি করে সম্ভব?
কিছুক্ষন নিরব থেকে কি ভাবল, সম্ভবত ভুলে যাবার চেষ্টা করার জন্য মনিকে বললো-
-চলো আজ কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসি।
-কি যে বল তুমি, আমার আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।
-তুমিই বা কি বলছ, কেন যেতে ইচ্ছে করবে না? কাওকে তো আর সাথে যেতে বলবো না। এমনকি ফিরোজকেও না। একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ?
-কি?
-দেখ ফিরোজ কিন্তু আমরা আসার পর আমাদের সংগ দেবার জন্য কাজে যাচ্ছে না, এটা কিন্তু এদেশে আশা করা যায় না। চলো শুধু তুমি আর আমি কোথাও থেকে একটু ঘুরে আসি। সারা দিন বাইরে ঘুরব, ঘরে বসে থাকলে আরও খারাপ লাগবে। তার চেয়ে চলো পিকাডেলি সার্কাস, টেমস নদী, বিগবেন, বাকিংহাম প্যালেস এসব দেখে আসি হয়তবা কাটা ঘায়ে একটু মলমের প্রলেপ হয়েও যেতে পারে। তুমি আমার সাথে আমার পাশে থাকবে, এই এতো বড় লন্ডন শহরে শুধু তুমি আর আমি। কেও জানবে না যে আমরা মনের আঘাতের চিকিৎসার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছি। আঘাতটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সারিয়ে তুলতে হবে। তুমি চলে গেলে আমি এই আঘাত বুকে নিয়ে থাকবো কি করে?
-তুমি যদি মনে কর এতে কালকের ঘা শুকিয়ে যাবে তাহলে বেশ, চলো। কিন্তু, তুমি কি চিনে যেতে পারবে?
-এখনও তোমার সন্দেহ যায় নি? চলো না গেলেই দেখবে, নাহয় একটু বেশি হাঁটলেই বা। এ দেশে রিকশা নেই যে ‘এই রিকশা চলো’ বলে আমার মনিকে রিকশায় নিয়ে যেতে পারব।

নক্ষত্রের গোধূলি-২৭

৩৯।
তাড়াতাড়ি মালপত্র আর দুই বোতল পানি নিয়ে ভাবীর পিছে পিছে বের হয়ে সামনে পার্ক করে রাখা গাড়িতে বসল। ড্রাইভিং সিটে ভাবী, তার পাশে ফিরোজ আর পিছনে মনিরার পাশে রাশেদ সাহেব। ভাবী বসে ম্যাপটা দেখে ফিরোজের সাথে রাস্তা সম্পর্কে কি কি যেন আলাপ করে নিল। পিছনে তাকিয়ে ফিরোজ জিজ্ঞেস করলো-
-ওখানে আমি কখনো যাইনি, কাছে গেলে তুমি চিনতে পারবে তো?
-হ্যাঁ আমি এই না এক বৎসর আগেই এসে গেলাম। আশা করি ভুলে যাই নি। তাছাড়া তোমাদের দেশ কি আর আমাদের দেশের মত? এখানে রাস্তায় কত সাইনপোস্ট দেয়া আছে না? তাই দেখেই তো যেতে পারবে, আর তুমি এত চিন্তা করছে কেন? মাস্টারনির পাশে বসে তোমার এতো চিন্তা কিসের? দেখি রোড ম্যাপটা দেখি

ম্যাপটা নিয়ে খুঁজে পেয়ে বললো-
-গত বার হিথরো থেকে যখন গিয়েছিলাম তখন এম ফাইভ দিয়ে যায়নি, সম্ভবত এম ফোর দিয়ে গেছে। এম ফাইভ গেছে স্ট্রাউডের উত্তর দিয়ে, এইতো গ্লস্টারসায়ার, ওখানে কাছে গেলেই আমি চিনব, চলো। ভাবী চলেন।
শেফালী গাড়ি ছেড়ে দিল। শহর থেকে বের হয়ে এম ফাইভ ধরে নব্বই পঁচানব্বই মাইল বেগে চালিয়ে ঘণ্টা খানিকের মধ্যেই রাশেদ বাম দিকে স্ট্রাউডের সাইন দেখে বললো-
-ভাবী দেখেছেন? স্ট্রাউড বাম দিকে।
-হ্যাঁ ভাই দেখেছি।
-তাহলে আর চিন্তা কি এগিয়ে চলেন। ভাবী, ভাগ্য ভাল যে আপনি চালাচ্ছেন, না হলে ইশারায় ফিরোজকে দেখিয়ে বললো এই মিয়া যে কোথায় নিয়ে যেত কে জানে!
-ঠিকই বলেছেন ভাই, লং রুটে ও চালাতেই চায় না, বলে আমি সাইন দেখে পড়ে নিতে পারি না। এত জোরে গাড়ি চালাচ্ছে বলে মনিরা ভয় পেয়ে বললো-
-চুপ কর ভাবীর সাথে কথা বলো না উনি নিজেই চিনে যেতে পারবে।
এর মধ্যেই ভাবী বায়ে টার্ন নেয়ার ইন্ডিকেটর জ্বালিয়ে দিয়েছে, আস্তে আস্তে বায়ের লেনে চলে আসছে। এবারে স্ট্রাউডের সাইন দেখেই বাম দিকে টার্ন নিতেই সামনে দেখা গেলো স্ট্রাউড মাত্র বিশ মাইল দূরে। স্ট্রাউড ছোট্ট একটা শহর। কাছে এসে রাশেদ ডান বাম বলে কিছু ক্ষণের মধ্যেই তার ভাইয়ের বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে মালপত্র নামিয়ে বাসার কলিং বেলের সুইচ টিপে দিল একটু পরে দরজার সাথের স্পিকারে শোনা গেলো,
-হু ইজ দেয়ার?
মনিরা এগিয়ে মাইকের সামনে বললো-
-আমি ভাবী, দরজা খোল।
দরজা খুলছে না। প্রায় দশ মিনিট কেটে গেলো, কি ব্যাপার? আবার বেল বাজাল, না, কোন শব্দ নেই। ফিরোজ, ভাবী এরা সবাই এ ওর মুখের দিকে দেখছে। আসার সময় গাড়ির ড্যাশ বোর্ডে দেখেছে তাপমাত্রা ০ ডিগ্রী। এই ঠাণ্ডার মধ্যে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়? মনিরা রাশেদ সাহেব উভয়ে উভয়ের দিকে তাকাচ্ছে, উভয়ের মুখে অব্যক্ত প্রশ্নের ছাপ কিন্তু কেও কিছু বলতে পারছে না। এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়? অপেক্ষা যে মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর যন্ত্রণা দায়ক বিশেষ করে এই রকম পরিস্থিতিতে। প্রচণ্ড শীতে হাড়ে কাঁপুনি ধরার উপক্রম হয়েছে। নিজেদের গাড়িতে আসছে বলে তেমন গরম কাপড় গায়ে দিয়ে আসেনি।
আরও প্রায় মিনিট পাঁচেক পর রাশেদ সাহেবের ভাই এসে দরজা খুলে ফিরোজ আর তার স্ত্রীকে দেখে অবাক কি জানি হয়তোবা একটু লজ্জাও পেয়েছিলো। আগে ওদের দেখেনি তবে অনুমানে বুঝে নিল বড় ভাইয়ের যে বন্ধু লন্ডনে থাকে, হয়তো ইনিই সেই ফিরোজ ভাই। কোথা থেকে যেন একটু হাসি ধার করে এনে মুখে লাগিয়ে বললো আসুন ভিতরে আসুন। ফিরোজ রাশেদের সাথে মালামালগুলি নিয়ে ভিতরে ঢুকল। বাসার ভিতরে ঢুকেই মনিরা দেখল ওদের একমাত্র এগার বছরের মেয়েটি আগন্তুকদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনিরা বুকে টেনে নিয়ে বললো-
-আমাকে চিনেছ, বলত আমি কে?
-বড় চাচী।
রোজার দিন বলে ওর বৌ রান্না ঘরে ইফতার বানাচ্ছিল। মনিরা ভাবীকে নিয়ে রান্না ঘরেই চলে গেলো, রাশেদ ফিরোজকে নিয়ে বসার ঘরে বসিয়ে রেখে রান্না ঘরে ঢুকে মনিরার কোল থেকে ভাতিজিকে বুকে নিয়ে সেও মনিরার মত জিজ্ঞেস করলো-
-আমাকে চিনতে পেরেছ মা? বলত আমি কে?
-বড় চাচা।
ফিরোজ ওর সাথে আলাপ করছিলো, প্রথমে রাজনীতি নিয়ে আলাপ শুরু সে আবার এখানকার ডিসট্রিক্ট কাউন্সিলর।
-তোমাদের এই জায়গাটা তো বেশ সুন্দর, পাহাড়ি এলাকা। মাঝে মাঝে জঙ্গল চার দিকের দৃশ্য বেশ সুন্দর। আমি গাড়িতে বসে তাই ভাবছিলাম এই এলাকায় এসে বাড়ি করব কিনা, লন্ডনে একদম থাকতে ইচ্ছা করে না।
প্রায় পনের বিশ মিনিট পর শেফালি আর মনিরা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে এসেই রাশেদ সাহেবকে ডেকে বাইরে বারান্দায় নিয়ে এলো। বারান্দা না ঠিক তবে দুই ঘরের মাঝের ফাঁকায় দাঁড়িয়ে
শেফালি বললো-
-ভাই কিছু মনে করবেন না, এখানে আপনাদের থাকা হবে না, এক্ষুনি উঠে পরুন। চলেন লন্ডনে ফিরে যাই।
-কি ব্যাপার ভাবী?
-বলব লন্ডন যেয়ে সব বলব আপনি এক মিনিটও দেরি করবেন না। মালপত্র যা নামিয়েছেন নিয়ে আবার গাড়িতে উঠে পরুন।
রাশেদ সাহেব কিছু বুঝতে না পেরে ভাবীর পিছনে মনিরাকে জিজ্ঞেস করলো, -কি ব্যাপার ভাবী কি বলছে?
-যা বলেছে তা তুমি স্পষ্টই শুনতে পেরেছ, যা বলেছে তাই কর পরে ভাবীই সব বলবে, দেরী করোনা, ইফতারির সময় হয়ে গেছে।
শুনেই রাশেদ সাহেবের মুখটা কাল আঁধার হয়ে গেলো, চোখ ভিজে গেলো, পায়ের তলা থেকে কে যেন টান দিয়ে মাটি গুলি সরিয়ে নিয়ে গেলো, বুকটা ছ্যাঁত করে কেঁপে উঠলো, গলা শুকিয়ে জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে গেলো। আর কোন কথা তার মুখ দিয়ে বের হলো না। মনিরা হতবিহবলের মত থমকে দাঁড়িয়ে রইল। মেয়েটা তখনো রাশেদের কাছে দাঁড়িয়ে একে একে সবার দিকে অবাক চোখে তাকাচ্ছে।
ভাবী আবার তাগিদ দিয়ে বসার ঘরে গিয়ে ফিরোজকে নিয়ে এসে কি সব আলাপ করলো। ফিরোজ রাশেদকে বললো-
-চলো তাড়াতাড়ি কর।
বলেই মালামাল যেখানে নামিয়ে রেখেছিলো সেখানে এসে দাঁড়িয়ে হঠাৎ কি যেন মনে করে পিছনে ঘুরে রাশেদকে বললো ওদের জন্য কি কি এনেছ সেগুলি বের করে দিয়ে যাও।
-না থাক, কি হবে ওসব দিয়ে, সময় নেই। ভাবী বলছে তাড়াতাড়ি করতে, চলো পরে কখনো সুযোগ হলে দেয়া যাবে।
দুজনে মিলে যে ভাবে এনেছিলো যেই ভাবে আবার গাড়িতে তুলে রেখে এসে দেখে মনিরার বুকে বাচ্চা মেয়েটা ভাবছে এর মধ্যে এমন কি হলো যে বড় চাচা চাচী এসেই আবার চলে যাচ্ছে! পৃথিবীতে ওর এই মাত্র এগার বৎসর বয়সের অভিজ্ঞতা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে। কোন কূল কিনারা পাচ্ছে না। পৃথিবীর কোন কাঠিন্যের ছোঁয়া ওকে এখনও স্পর্শ করতে পারেনি তাই ঠিক কোন সমাধান পাচ্ছে না। ফিরোজ এগিয়ে বসার ঘরে গিয়ে রাশেদের ভাইকে বললো-
-তাহলে আমরা আসি!
-বসেন এখনি যাবেন কেন একটু চা খেয়ে যান।
-না না চা খেতে হবে না, পরে কখনো এলে তখন হবে, এখন আসি।
মনি মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে বললো-
-আসি মা, ভাল থেক, আমরা চললাম।
বলেই কোন রকমে ঘড় থেকে বের হয়ে গেলো। সামনে শেফালি পিছনে রাশেদ সাহেব আর তার পিছনে ফিরোজ। রাশেদ সাহেবের মনে হচ্ছিল তার পায়ে লোহার জুতা আর সে হেঁটে যাচ্ছে কোন চুম্বক বিছানো পথ দিয়ে। অনেক কষ্ট করে পা টেনে নিতে হচ্ছে, চুম্বক যেন তার পাগুলিকে আটকে ধরে রেখেছে সে পা চালাতে পারছে না।

নক্ষত্রের গোধূলি-২৬

৩৮।
ওরা চলে যাবার পর রাশেদ আর মনিরা টিউব স্টেশনে নেমে দেখে একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি ওতে উঠে বসল। ট্রেন ছাড়ার আগ পর্যন্ত চতুর্দিকে মানুষের চলা ফেরার ভাব দেখছিলো। ওই আগের মত কারো কোন দিকে তাকাবার সময় নেই, সবাই ছুটছে। তাই দেখে মনিরা বললো-
-এরা উন্নতি করবে না কেন, সবাই কি ভাবে ছুটছে!
কয়েক মিনিটের মধ্যে স্টার্টফোর্ড স্টেশনে নেমে আবার সেন্ট্রাল লাইনের ট্রেন কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে খুঁজে বের করে ওখানে এসে দাঁড়াল। প্ল্যাটফর্মের উপরে মনিটরে দেখাচ্ছে সেন্ট্রাল লাইনের ট্রেন আট মিনিট পরে আসবে।

এখানেও মানুষ আর মানুষ গিজ গিজ করছে কিন্তু সবাই দৌড়ের মত ছুটছে। একই দৃশ্য। ট্রেনের জন্য যারা দাঁড়িয়ে বা বেঞ্চে বসে আছে তাদের প্রায় সবার হাতে পড়ার মত কিছু পড়ছে আবার কেও তার সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে চুমু খাচ্ছে। রাশেদ সাহেব মনিরাকে ইশারা করে এমন একটা দৃশ্য দেখাল। মনিরার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেলো,
-এসব আবার কি?।
-আহা, তুমি লজ্জা পাচ্ছ কেন? তোমাকে কি কেও, এপর্যন্ত বলেই থেমে গেলো। এরা এসবে কিছু মনে করে না। দেখ কে কাকে দেখছে, কেও ওদের দেখছে? দেখবে না। এটাই এদেশের রীতি। মনে করে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে কেও কাউকে জোর করে কিছু করতে গেলেই বিপত্তি। আমরা আপন মনে নিজেদের মাঝে সুখে আছি তাতে কার কি, এমন একটা ব্যাপার। তোমার কেও নেই তুমি দেখবে না। তোমার ইচ্ছা হলে তুমি তোমার মানুষের সাথে কর কেও নিষেধ করবে না। বুঝলে মনি বিবি? এই হচ্ছে সভ্যতা। তা তোমার কি একটুও ইচ্ছা হচ্ছে না, আমি কি তোমার এতোই না পছন্দের?
-অসভ্য বলে মনিরা একটা গাল দিল।
-কে, আমি না ওরা?
-ওরা হবে কেন, তুমি।
-যে দেশে যে রীতি, দেশের কোন স্টেশনে দাঁড়িয়ে কি তোমাকে কখনো বলেছি? ওই দেখ এই শীতের মধ্যে মেয়েটা কেমন শর্ট স্কার্ট পরে আছে আমি কি তোমাকে অমন পোষাক পরতে বলেছি? শুধু—।
বলে সত্যিই রাশেদ সাহেব মনিরাকে জড়িয়ে ধরে বললো এখন তুমি চিৎকার করলেই পুলিশ এসে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। তখন তুমি বাসায় যাবে কার সাথে? কী, ভাবছ পুলিশ আসবে কি ভাবে? ওই দেখ কতগুলি ক্যামেরা। এই ক্যামেরা দিয়ে এখানে কে কি করছে সব কন্ট্রোল রুমে বসে দেখছে। কাজেই তুমি চিৎকার করার সাথে সাথেই দেখবে পুলিশ এসে হাজির। বিশ্বাস না হয় পরীক্ষা করেই দেখ, একবার একটু চিৎকার করেই দেখ কি হয়।
-ছাড়ত, কি যে পাগলামি করছ, তোমার পাগলামি আর গেলো না। ওরা যা করছে করুক, তাই বলে তুমিও কি তাই করবে নাকি?
এমন সময় বেরসিক ট্রেনটা গড় গড় করে এসে আস্তে করে সামনে দাঁড়ালো। রাশেদ সাহেব মনিরাকে ছেড়ে হাত ধরে ট্রেনে উঠে পড়লো। সিট খালি ছিলো। বসে আবার ওই কথার সূত্র ধরে বললো-
-বিলাতে এসেছ আর বিলাতি রীতি মানবে না এটা কেমন কথা বুঝলাম না।
-একটু থামবে নাকি বকবক করবে? আর কোন কথা শুনতে চাই না।
-আচ্ছা ম্যাডাম, চুপ করলাম।
কিছুক্ষণ একটু থেমে থেকে আবার বললো
-তাহলে তখন পুলিশ ডাকলে না কেন?
-এবারে মনিরা আর চুপ থাকতে পারল না, হেসে ফেলল।
-তুমি আসলেই পাগল।
-আর আমাকে পাগল করেছে কে? তুমিই তো পাগল বানিয়েছ। এখন পাগলের পাগলামি সামলাবে না? নাকি কোন মেম সাহেবের সাহায্য নিতে হবে?
-আবার কথা, বলেছি না একটু চুপ কর।
বলতে বলতেই ট্রেন ইস্ট একটন স্টেশনে এসে দাঁড়াল। ছোট্ট স্টেশন, মনিরার হাত ধরতে গিয়েও ছেড়ে দিল,
-ম্যাডামের মনটা কি ঠাণ্ডা হয়েছে? বলেই আবার হাত ধরে ট্রেন থেকে নামিয়ে নিয়ে সোজা ফিরোজের বাসায়।

নক্ষত্রের গোধূলি-২৫

৩৭।
বাসার সামনে এসে কলিং বেল বাজাতেই যে মহিলা দরজা খুলে দিলেন সে ওদের দেখেই বললো-
-ও! আপনারা এসেছেন, আসুন ভিতরে আসুন।
বলেই মনিরার দিকে তাকিয়ে যেন চমকে গেলো এমন একটা ভাব মনে হলো রাশেদ সাহেবের কাছে। বসার ঘরে নিয়ে বসতে বলেই মনিরার দিকে আবার সেই কেমন একটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ।
-আচ্ছা আপনি কি মনিরা আপা?
-হ্যাঁ, আমার নাম মনিরা কিন্তু আপনি আমাকে চিনলেন কি ভাবে?
-চিনবো না কেন, আপনারা যেবার স্কুল থেকে বিদায় নিলেন আমি তখন ভর্তি হলাম। যদি না জানতাম যে ভাই মানিকগঞ্জের তাহলে হয়তো একটু সময় লাগতো। কত দিন, মনে হয় পঁচিশ বৎসর তাই না আপা?
-হ্যাঁ তা হবে কিন্তু আপনার নামটা আমার মনে পরছে না।
-আমাকে আপনি করে বলছেন কেন, আমার নাম রুবি।
-ও হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পরেছে।
-আপনাদের ফেয়ার ওয়েলের দিন আপনি যে গান গাইলেন সেই সুর এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে। কত খুঁজেছি সেই গান কোথাও পাইনি।
মনি এবার একটু হেসে বললো-
-পাবে কি করে সে গানের কি রেকর্ড আছে যে তুমি পাবে!
এবার রাশেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো-
-কই ভাই আপনি তো আপার কথা কিছু বলেননি!
-কি করে বলি, আমি কি জানি যে ভাবী এখন আপা হয়ে যাবে?
কথার ফাঁকে কখন কায়সার বেয়াই পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে কেও লক্ষ করেনি। -আলাপের ধরন দেখে মনে হচ্ছে ভাবী এখন তার আপাকে পেয়ে আমাদের ভুলে গেছেন।
-সে কি ভাই, তাই কি হয়? আসলে আপা স্কুল ছেড়ে যাবার পর আর দেখিনি। শুনেছি কে যেন ছোঁ দিয়ে নিয়ে গেছে। আজ দেখলাম কে নিয়েছে। আজ আপনাকে দেখার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ভাবতে পারিনি যে আবার দেখা হবে।
মনিরা বললো -হ্যাঁ মেয়েদের জীবন এমনই।
-আপার ছেলে মেয়ে?
-আমার তিন মেয়ে, বড়টা এমকম ফাইনাল দিবে আর ছোটটা স্কুল ফাইনাল দিবে।
-ওদের কেও আসেনি?
-না রুবি, আসলে আমরা বেড়াতেও আসিনি আর তোমার দুলাভাই এই বুড়ো বয়সে হানিমুন করার জন্যেও আনেনি। আমরা এসেছি একটা প্রয়োজনে।
এ পর্যন্ত বলে মনিরা আসল কথাটা এড়িয়ে থেমে গেলো। রুবির স্বামী বাচ্চাদের আনতে স্কুলে গিয়েছিলো, ওরা এলে রুবি একটু উত্তেজিত হয়েই বললো দেখ কে এসেছে! মনিরা আপা। বলে পরিচয় দিয়ে দিল।
-আপা কি এখনও গান করেন?
-একটু করতে হয়, চোখ দিয়ে রাশেদকে দেখিয়ে বললো ওর এই একটা নেশা তাই এখনও ছাড়তে পারিনি।
-মেয়েরা কেও শিখেছে?
-হ্যাঁ বড়টা ছায়ানট থেকে পাশ করেছে। মেঝ টা শুরু করেছিলো, মাঝে মাঝে দুই একটা ফাংশনে যেত। তার আবার কথা বাবার গান ছাড়া সে গাইবে না। গলাও ছিলো বেশ কিন্তু হঠাৎ করেই গান ছেড়ে দিল। ওর মনে কি এলো কে জানে।
-মানে? দুলাভাই কি লেখেন নাকি?
-না, লিখি তা ঠিক বলা যায় না, তবে সময় কাটাই।
-বাহ! বেশ মজার তো। তা আপনি দুলা ভাইর গান গান না?
-হ্যাঁ রে ভাই, ওর জন্যই তো এখনও টিকিয়ে রেখেছি। নইলে সংসারের ঘানিতে কোথায় চলে যেত। ওর কথাই হলো তোমার জন্য আমি গান লিখে দিব আর তুমি তা গেয়ে আমাকে শোনাবে।

রুবির স্বামী হঠাৎ বায়না ধরলো আপা একটা গান শোনান। শুধু বায়না করেই ক্ষান্ত না ভদ্রলোক রীতিমত নাছোড় বান্দা। না আপা গাইতেই হবে, এদেশে এসে এখনও কারো সামনে বসে গান শুনতে পারিনি। মনিরার মন কি আর এখন গানের জন্য তৈরি আছে? মন বিক্ষুব্ধ, অশান্ত, শঙ্কিত। মনিরা অসহায় ভাবে রাশেদ সাহেবের দিকে তাকাল, যেন কোন অসাধ্য সাধন করার জন্য জুলুম করা হচ্ছে। রাশেদ সাহেব বুঝতে পারল। সেই বা কি করে, সেও অসহায় ভাবে মনির দিকে তাকিয়েই রইলো। কাদেরের পিড়া পিরিতে শেষ পর্যন্ত একটু সাজানো হাসি ফুটিয়ে বললো আচ্ছা তাহলে শুনেন। শুরু করলো:

লিখতে বলেছিলে গান
হয়নি লিখা আজো তাই, আকাশ ছেয়ে গেছে মেঘে,
বসন্ত আসেনি, বহেনি বাতাস
ওঠেনি এখনও বসে আছি নিশি জেগে।।
ফিরায়ে দিয়েছিলে তুমি
হয়নি দেখা সেই দিন
সেই থেকে আজো ভরে আছে মোর বীণ
হৃদয়ে আজো তুমি তো আছ জেগে।।
বাতাস ছিলো মৌসুমি
মনে পরে সেই দিন
এসেছিলে তুমি ফাগুন নিয়ে, এসেছিলে সেই দিন
স্বপনে যেন সেই ছোঁয়া আছে লেগে।।

গানের সুর শুনে রুবির ছেলে মেয়েরাও এসে মা বাবার পাশে বসে পড়ল। রাশেদ সাহেব লক্ষ করলেন আজকের এই কণ্ঠ আর মনির আসল কণ্ঠের মধ্যে কত তফাত। থামার পর তিন জোড়া হাতে তালি বেজে উঠলো। বাচ্চারাও কিছু বুঝে কিছু না বুঝে বড়দের সাথে হাত তালি দিতেই থাকল।
কাদের বলেই ফেলল আপা এ গান তো আগে শুনিনি কখনো।
রুবি বললো -আমি যে গানের কথা তোমাকে বলি এটা সেই গান, যে গান আপার কণ্ঠে আমি আজ থেকে পঁচিশ বৎসর আগে শুনেছিলাম, তাই না আপা?
-আপা প্লিজ আর একটা। না ভাই আর পারবো না, সে শক্তি এখন নেই, আর বলবেন না।
-এটা কি দুলাভাইর লেখা?
-হ্যাঁ।
-সত্যিই আপা আপনি অসাধারণ।
-না ভাই এভাবে বলবেন না।

-আপা চলেন রান্না ঘরে যাই। কি খাবেন বলেন, রান্না করি এখানে ইফতার করে খেয়েদেয়ে যাবেন।
-না রুবি কিছু করবে না, ওখানে ভাবী রান্না করছে।
রুবির স্বামী বললো -তাই কি হয় নাকি? কোনদিন আসেন নি, আর এখানে আমরা নিজেদের মানুষ পাই কোথায় বলেন, যে ভাবেই হোক আপনারা এসেছেন না খেয়ে যাবেন তাই কি হয়?
-রোজা না হলে হয়ত কিছু খেয়েই যেতাম।
-না না তা হবে না।
-না ভাই পরে সময় হলে আর একদিন আসবো আজ না, আজ আমাদের গ্লস্টার যেতে হবে।
-গ্লস্টার কেন?
কায়সার বেয়াই বললো, -ওখানে উনার ভাই থাকে।
-তো খেয়ে যান এ দেশে ঘড়ে সব কিছুই রাখতে হয়, সব সময় বাজার করা যায় না। রান্না করুক এক সাথে বসে খাওয়া, এইতো!
-না ভাই আজ কিছুতেই সম্ভব না।
দুপুর একটা নাগাদ ওরা উঠলো। কায়সার বেয়াই সহ কাদের ওদেরকে গাড়িতে করে টিউব স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে আবার আসার অনুরোধ জানিয়ে চলে গেলো। যাবার আগে বেয়াইর সাথে আবার কবে কখন কোথায় দেখা হবে সে ব্যাপারটাও ঠিক করে নিল।

নক্ষত্রের গোধূলি-২৪

৩৬।
ওরা বের হয়ে কাছের যে টিউব স্টেশন সেটা ফিরোজের বাড়ি থেকে মাত্র দুই মিনিটের পথ, ওখানে যেয়ে ফিরোজের কথা মত দুইটা ডে টিকেট নিয়ে একটা টিউব ম্যাপ নিয়ে সেন্ট্রাল লাইনে চেপে বসল। ইস্ট একটন স্টেশনটা টিউব স্টেশন হলেও মাটির উপরে। তবে ট্রেন মিনিট তিন চারেক চলার পরেই সুরঙ্গের মত লাইনে ঢুকে পরে। ওখান থেকে স্টার্টফোর্ড স্টেশনে নেমে জুবিলী লাইন ধরে ক্যানিং টাউন স্টেশনে নেমে উপরে উঠে ভদ্র মহিলার কথামত পূর্ব দিকে কিছুটা যাবার পর ম্যাকডোনাল পার হয়ে চার মিনিট হেঁটে বাসা পেল।
-মনিরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো তুমি চিনলে কি ভাবে?
-তুমি তো হারিয়ে যাবার ভয়ে আমার সাথে আসতেই চাইছিলে না। এখন বল তোমাকে অযথা হাঁটিয়েছি?
-না।
-তাহলে আসতে চাওনি কেন? মনে নেই সেবার কলকাতায় কি করেছিলে? ওই যে চুরির দোকান থেকে ভিড়ের জন্য বাইরে এসে দাঁড়িয়ে ছিলাম আর তুমি আমাকে দোকানের ভিতর না দেখে কাঁদতে কাঁদতে বাইরে চলে এসেছিলে, মনে আছে?
-সেই কথা বলছ? ইস সেদিন যে আমি কি ভয় পেয়েছিলাম!
-তুমি ভাবলে কি করে তোমাকে ফেলে আমি চলে যাব? এত ভয় কিসের?

পথে যে স্টেশনেই থেমেছে বিভিন্ন বর্ণের, বিভিন্ন গড়নের, বিভিন্ন ভাষার মানুষ শুধু দৌড়াচ্ছে। কারো এক মুহূর্ত সময় নেই। এই বুঝি কি যেন চলে গেলো এমন ভাব। ট্রেনে উঠে সবাই যার যার মত হাতের ব্যাগ থেকে বের করে বই বা পত্রিকা পড়ছে। কারো অন্য দিকে তাকাবার মত সময় বা ইচ্ছা কোনটাই নেই প্রয়োজনও নেই অবাঞ্ছিত কৌতূহলও নেই।
-মনিরা জিজ্ঞেস করলো ওরা দৌড়াচ্ছে কেন?
-ওদের কাজ আর কাজ, একটা মুহূর্ত নষ্ট করার মত এতো সময় ওদের নেই তাই এমন করে দ্রুত হাঁটছে দৌড়াচ্ছে না। আশে পাশে কে কি করছে তা দেখার মত সময় বা ইচ্ছা কোনটাই ওদের নেই সবাই নিজের মাথা ব্যথা নিয়েই ব্যস্ত। দেখেছ, পুরুষ মহিলার মধ্যে কোন তফাত আছে? সবাই সমান তালে হাঁটছে। বাড়ি থেকে নাশতা করার সুযোগ বা সময় পায়নি তো কি হয়েছে, স্টেশনের দোকান থেকে স্যান্ডউইচ বা অন্য কিছুর সাথে একটা পানীয় কিনে খেতে খেতে হাঁটছে, কোথাও বসে খেতে গেলে সময়ে কুলাবে না। এটা তো আর আমাদের ঢাকা শহর নয়, এটা হচ্ছে লন্ডন মহা নগরী!

নক্ষত্রের গোধূলি-২৩

৩৫।
কথা বলতে বলতে ফিরোজের ছোট বোন সুইটি ভাইয়ের বন্ধু এসেছে তাই দেখা করতে এসেছে। এসেই সরাসরি বললো ভাবী, ভাই ভাবীকে নিয়ে আমার বাসায় চলো। রাশেদ সাহেবের কোন আপত্তি নেই। সুইটির গাড়িতেই চলে গেলো সবাই। রাশেদ সাহেব মনিরাকে খোঁচা দিয়ে কানে কানে বললো নিজের পয়সা খরচ করে বেড়ানোর চেয়ে চলো ঘুরেই আসি। সুইটি তার বাড়িতে এনে অনেকক্ষণ গল্প গুজব করে বিশাল আয়োজনের চা নাস্তা খাইয়ে আবার এনে দিয়ে গেলো। ওর বাড়িটাও সুন্দর।
পরদিন ফিরোজ কি একটা কাজে বাইরে গেলো। যাবার আগে বলে গেলো
-আমার ফিরতে বিকেল হবে, আমি এসেই গ্লস্টার যাব এই ফাঁকে তোমরা ঘুরে আসতে পার। পাশের টিউব স্টেশন দেখেছ। এই নাও লন্ডনের ম্যাপ। টিউবের ম্যাপ স্টেশনেই পাবে, ওখান থেকে একটা ম্যাপ নিয়ে নিও তাতে কোথায় কোন লাইন চেঞ্জ করতে হবে বুঝতে পারবে আর জোন এক দুইয়ের ডে টিকেট নিবে তাতে ভাড়া কম লাগবে, সারাদিন ভরে এক দুই নম্বর জোনে ঘুরতে পারবে।

ফিরোজ বের হয়ে যাবার পর কায়সার বেয়াইর কথা মনে হলো। সে যেখানে আসবে বলে ফোন নম্বর দিয়েছে সেখানে ফোন করলো। ফোন ধরল বাড়ির কর্ত্রী। রাশেদ সাহেব জানতে চাইল
-কায়সার সাহেব এসেছে কি না।
-ওপাশ থেকে জবাব এলো, উনি আজ সকালে এসেছেন।
কায়সার সাহেবকে খুঁজছে জেনে নিতান্ত কৌতূহল বসে ভদ্র মহিলা জানতে চাইল।
-ভাই আপনার বাড়ি কোথায়?
-মানিকগঞ্জ।
-তাই নাকি? আমাদের বাড়িও মানিকগঞ্জ।
এ কথা সে কথায় জানা গেলো মনিরা যে স্কুলে পড়েছে এই ভদ্র মহিলাও সেই স্কুলের ছাত্রী।
-ভাই তাহলে আমাদের এখানে আসবেন না?
বলেই তার বাড়ির ঠিকানা সহ কোন লাইনের টিউবে কি ভাবে যেতে হবে কোথায় নামতে হবে সব হর হর করে বলে দিল।
-আচ্ছা ঠিক আছে দেখি যদি পারি তাহলে আসব তবে আমাদের বিকেলের আগেই ফিরতে হবে, আমরা আবার গ্লস্টার যাবো।
-আপনারা আসুন আমি কায়সার ভাইকে বলে রাখছি।
-বলবেন আমরা বিকেলে গ্লস্টার যাবো উনি চিনে সে জায়গা, গত বৎসর বেয়াইনকে নিয়ে এসেছিলেন তখন গিয়েছিলেন।
-আচ্ছা বলবো, আপনারা এখনই চলে আসেন।
ফোন রেখে রাশেদ সাহেব মনিরাকে বললো চলো কোথাও থেকে ঘুরে আসি। মনিরাকে চমকে দেয়ার জন্য আসল কথা চেপে গেলেন।
-না ভাবীকে ছাড়া আমি কোথাও যাব না, যেতে চাইলে তুমি একা যাও।
-আরে আমি তো থাকছি, তুমি চলে যাবে বলে একটু দেখে যাও, না হলে দেশে গিয়ে মেয়েদের বলবে কি?
ভাবী বললো-
-যান না ভাবী, ভাই কি আর আপনাকে হারিয়ে রেখে আসবে? বাব্বাহ যে টান! এই মানুষ কি আপনাকে বদলিয়ে বিলাতি মেম নিয়ে ফিরতে পারবে? তাহলে ভয় কিসে? যান ঘুরে আসেন। শুনেছি ভাই তো সারা জীবন প্রায় বিদেশেই কাটিয়েছে সে কি আর হারিয়ে যাবে? আপনি নিশ্চিন্তে যান। বিকেলে তো আমি যাচ্ছি, আমাকেই ড্রাইভ করতে হবে সারা পথ, আমার সাথে বের হলে ও ড্রাইভ করতে চায় না। আপনারা যান ঘুরে আসেন আমি রান্না বান্না দেখি। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেন, বাইরে কিন্তু বেশ ঠাণ্ডা।

নক্ষত্রের গোধূলি-২২

৩৪।
আজ সারা দিন গল্প গুজব করেই কেটে গেলো। ইফতার করে সন্ধ্যার পর রাশেদ সাহেব মনিকে বললো ,
-আচ্ছা, ছোট ভাই বুঝে হোক বা না বুঝেই হোক তার ওখানে যেতে নিষেধ করেছে, তাই বলে কি আমরা এতো দূর এসে ওদের না দেখে বিশেষ করে মেয়েটাকে না দেখা কি উচিত হবে?
-হ্যাঁ আমিও তাই ভাবছি। এদিকে ওদের নীরবতা আবার এতো দূর এসে না দেখা তারপর ওদের জন্য যা আনা হয়েছে সে গুলিও তো দিতে হবে, ব্যাপারটা কেমন হয়!
-আমার মনে হয় চলো যাই দেখি কি অবস্থা। তেমন মনে হলে এখানে আবার ফিরে আসব।
মনিরা জানতে চাইল -কত দূর?
-সে অনেক দূর। কোচ কিংবা ট্রেনে যেতে হবে। প্রায় তিন ঘণ্টার পথ।
-তুমি চিনে যেতে পারবে?
-কী যে বল, পারবো না কেন?
-গিয়ে যদি আবার ফিরে আসতে হয়, তাহলে এই শীতের মধ্যে! আমার মনে হয় যাবার আগে এক বার ফোন করে খোঁজ নিয়ে দেখ।
-না ফোনে নয়, একেবারে সশরীরে উপস্থিত হলে ব্যাপারটা অন্য রকম হবে না? দেখ চিন্তা করে।

রাতে ফিরোজের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ হলো। ফিরোজের একই কথা।
-কোথায় যেন থাকে?
-গ্লস্টারের কাছে।
-তুমি চিনে নিতে পারবে?
-হ্যাঁ, স্ট্রাউড পর্যন্ত গেলে ওখান থেকে আমি চিনতে পারব।
-তাহলে চলো, আমরাও ওদিকে যাইনি তোমাদের নিয়ে আমরাও ঘুরে আসি। তোমার ভাবী আবার লং ড্রাইভ পছন্দ করে।