চন্দন ভট্টাচার্য এর সকল পোস্ট

মায়াউচাটন

পাতা উলটে চলে গেছ, কিম্বা গেছ পাতার আড়ালে
পাশাপাশি তাঁবু, তবু ছোঁয়া নেই বামুন-চাঁড়ালে

বসন্তশিশিরে এই শির চারভাগ হল, হে নূতন
আগুনে ঝলসে তাকে যন্ত্র করো — মায়াউচাটন

যে কীর্তনমালা শুধু চিৎকারে রাজ্যজয় করে
সেখানে গানের ফোঁটা ফ্যালে যেন তোমার নওকর-এ

বিন্দু থেকে ব্রহ্ম হবে — ভয় পেয়ে আকাশতরুণী
শঙ্খ খুলে পালিয়েছে ইষ্টনামে, ঘটনা করুণই!

ছেঁড়া গলা, সুর মিঠাই; ন্যাংটো দেহ, সব্বাই চেনা
কীভাবে রাস্তায় যাব? কিনে নীল পাঞ্জাবি দিলে না…

জন্মদিন

বুকে সোনার মুদ্রা গেঁথে আছে
বেলুনের মধ্যে শুধু হাসির বাতাস
তালাবন্ধ শহরটায় কে দেয় সাঁঝ-আলো?
বকুলগাছ থেকে খ’সে পড়ছে ইতিহাস

প্রেত-রাস্তা, আমি একমাত্র ক্যুরিয়ার!
জন্মদিন-মুক্তোফলে দেহ ভেঙে পড়ে
ছিঁড়ে নাও, ও চিরায়ু, উৎসব তোমার

শুভেচ্ছাটি ধরে আছি মরণ-কামড়ে…

অগ্নিরথ

ভালোবাসা আছে কিনা এটা কোনও প্রশ্নই নয়
জিজ্ঞাসা হলো হৃদয় রয়েছে তো? না হ’লে
তাকে আবিষ্কার করো। টেবিল ফ্যানের হালকা
হাওয়ার মধ্যে, পাগলা হাতির পুরো গ্রাম দুরমুশ
ক’রে একটা শিশুকে অক্ষত রাখার মধ্যে তাকে
চিহ্নিত করো। আর এই লব্ধপ্রতিষ্ঠ মন নিয়ে
বেরিয়ে পড়ো পথে। কিন্তু যদি আমার সঙ্গে
দেখা হয় ভেবো না কখনই নিষ্কন্টক পথ চেয়ে
বসবো। বরং দাবী করবো একজোড়া চোখ —
যেভাবে আমি কখনও মাথা ঘামাইনি আগুন নিয়ে,
কিন্তু প্রার্থনা করেছি শীতকাল, কেননা,
সনির্বন্ধ শীতই ব’য়ে আনতে পারে অগ্নিরথ…

কত সীমাহীন আছে

অনেক অসংখ্য আছে। অনেক প্রার্থনা প্রার্থিতের হাত ছুঁতে
পেরেছে এখুনি। পথ আছে, বলছি বিশ্বাস করো, তাকে বর্ণনা করলেই
সমান্তরাল সড়কের জন্ম হবে পাশে।
নবজাত ফুলগুলো গায়ে নিয়ে যে বাড়ি ঘুমিয়ে আছে কী নিশ্চিত;
একটা বরফগলা-দুধ হাতে, মুখে বলিরেখা-লাগা পুরনো পাহাড়
সে ঘুম ভাঙাবে
আরও শোনো বিরক্ত হওয়ার আগে: আকর্ণ আকাশ ছিলা থেকে
শোঁ করে মুক্তি দিচ্ছে মেঘ, যবের মরাইগুলো,
বারিপ্রদ করে দিচ্ছে হাড়মাংস, তারকামণ্ডল…
আমরা জানি না — এত আহ্লাদ রয়েছে
ঘরই প্রকৃতি, আবার উপত্যকা হাওয়া দিয়ে, সূর্যকরোজ্জ্বল দিয়ে
নীলাভ খামের মতো মুড়েছে তোমাকে
যত আছে তাকে ঠিক তত দিয়ে গুণ করছে শঙ্খের নিস্বন!
নতুন ঘরের দেয়ালে আবার ঘর আঁকছে শিশু
তার সবটুকু মন বুঝে নিতে তুমি হেসে উঠবে বিবমিষা থেকে
দেখবে, আশ্চর্য তাকিয়ে আছে বিস্মিতের মতো…
আর দোহাই, শুনে রাখো, বিনাশ কখনও ছিল না
বোবাঘট ভেঙে যাওয়া ছিল শুধু, জন্মান্তর ধ’রে যাকে তিল তিল
করে জমিয়েছ, সেই পরমার্থ যদি বিস্ফোরণ-শব্দে মুক্ত হয়
তাতেই অসহ্য লাভ, মৃত্যু ব’লে ভয়ে দুঃখে শোকে ওকে
জড়িয়ে ধরো না কোনওদিন।

লাশফুল ফুটিয়েছো

উদ্যত খাঁড়ার নিচে তথাগতকে চুপ করে দাঁড়িয়ে
থাকতে দেখে অঙ্গুলিমাল জিজ্ঞাসা করল, তুমি
প্রাণভিক্ষা করছো না কেন? ভয় পাও না আমাকে!
তথাগত সামান্য হাসলেন — একদিন সকলেরই মৃত্যু
হবে, তাছাড়া শক্তিহীনকে কীসের ভয়! দস্যু অঙ্গুলিমালের
দুচোখ রাগে বিস্ফারিত — আমার ক্ষমতার
কোন প্রমাণ দেখতে চাও, এক্ষুণি বলো। তথাগত
নিকটের গাছটির দিকে নির্দেশ করলেন — যাও,
ওই বটবৃক্ষের দুটি পাতা ছিঁড়ে নিয়ে এসো। ঘাতক
তৎক্ষণাত দুটি বটপত্র ছিন্ন করে দিল সন্ন্যাসীর হাতে।
মঞ্জুশ্রী শান্ত গলায় বললেন, এবার পাতাদুটি
গাছের ডালে লাগিয়ে দাও দেখি।…কিম্বা লোহার স্ট্রেচারে
যে নিথর বউশরীর, ব্যান্ডেজে জড়ানো মাথা সদ্য-বাঁধা
বোমার মতো লাগছে, ওর ঘুম ভাঙাও তো। আটবছর
বয়সী এক শৃঙ্খলাবিরোধীর লাশ খুঁজেই পাচ্ছি না,
সে কাল থেকে আবার ফড়িংবন্ধুর সঙ্গে লাফাতে লাফাতে
স্কুলে যাক। তোমার গায়ে ফুটে ওঠা শাসনঅক্ষর ওর ঠান্ডা
ভিজে জলন্যাকড়ায় মুছে নাও।
তারপর আমার কুর্নিশ চাইতে এসো।

চা বল

কাল বর্ধমানে গিয়েছিলাম পান্নাদার সঙ্গে, দেখি ট্রেন থেকে জি আর পি বস্তায় মোড়া লাশ নামাচ্ছে, কেউ চেনে না। আমাদের রাধাকান্তপুর লোকাল কমিটি কিন্তু সব্বার চেনা, তার হেড কল্যাণ উকিল… আরে ওকে তো তুলল অমিয়দা, দোকানে দোকানে চানাচুর সাপ্লাই দিত, তারপর ছ’মাসের ট্রেনিংয়ে এমন টিপ, অন্ধকারে বাদুড় মেরে দেয়! না না, অমিয় তরফদারকে কালু সরায়নি, ওই যে নথের দোষ! শিক্ষা ছিল, হোল্ড ছিল, কিন্তু দেখেছি তো রাত বারোটায় খোঁড়া হরেনের ঘর থেকে বেরোচ্ছে। এই বিশু ওস্তাদকে কেউ ফাঁকি দিতে পারবে না, বস। সন্ধেবেলা একটা পাঁইট পেটে পড়লেই নজর সাফ — কার কোথায় ঠেক… এই যে শান্তিকমিটি নিয়ে রাজ্যপর্যায় পর্যন্ত কথা গড়াল, মানে বিক্ষুব্ধ দেবাশিস আর প্রভাসকাকুর ছেলে অয়ন…শোন, অয়নকে আমাকে চেনাস না, ডানপায়ে ছ’টা আঙুল, রীতাবৌদির মেয়েকে পড়াতে যেত গাঁজা খেয়ে কিন্তু হ্যাঁ অনেস্ট, আরে বাবা অনেস্ট ধুয়ে কি চাটনি খাবে? শত্রুমিত্র চেনার ব্যাপার নেই? রাজনীতির কৌশলগত দিক আছে না! কালকের যোগী এসে অসীমদাকে চমকালে, তিমির গুছাইতের পেছনে ফেউ লাগালে যা হবার তাই হবে, বর্ধমান লোকাল থেকে লাশ নামবে, ডানপায়ে ছ’টা আঙুল; নে, চা বল।

লাশফুল ফুটিয়েছ: আট

হে রাজ্ঞী, আমি যা দেখেছি — উচ্চারণ করা অনুচিত, কেননা মানুষ তা বিশ্বাস করবে না। আমি কি জগৎবাসীকে জানাব গ্রামের শরীর উৎক্ষিপ্ত হয়েছে কাপাস তুলোর মতো, ছোট ছোট ধাতুর ফুৎকার সেই দেহগুলিতে ছিদ্র করে দিচ্ছে। আমি কি ফাঁস করে দেব এই তথ্য যে শ্রীমধুসূদনের হাতের টানে শিশুরা পায়ুবরাবর দু’ফালি হয়ে যাচ্ছিল, তারপর রাজাবাজারের কসাইবস্তিতে যেমন গোরুর মুন্ডু, কলজে, নাড়িভুঁড়ি চপারে কেটে আলাদা আলাদা প্যাকিং হয়, তাদের ঠাসা হচ্ছিল বস্তার মধ্যে। একের পর এক এলাকাদখল, সেখানে মারুতি থেকে নামছেন, ধৃষ্টকেতু, চেকিতান আর কুন্তিভোজ … এর মধ্যে খবরঃ কোনও কোনও সাংবাদিক ঘটনাস্থলেই লুকিয়ে আছে। হল্লা উঠল, শালা সঞ্জয় মিত্র যেন পালাতে না পারে! কুঁজো হয়ে ছুটতে ছুটতে দেখছিলাম লাশের ঢিবি নিয়ে ট্রলার পাড়ি দিচ্ছে মোহনার দিকে, আর জলে তাজা রক্তের গন্ধ পাওয়া ঝাঁক ঝাঁক হাঙর, কুমির, ঘড়িয়াল উঠে এসেছে নদীতে, খালের মুখটায়। অয়ি পৃথা, ক্ষমা করবেন, কেননা আমি আজও জানতে পারিনি এই দৃশ্য দুঃস্বপ্ন না বাস্তব যে ধানখেতে আমার পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল মেয়েদের মাথার চুল, টুকরো অন্তর্বাস; এ-প্রশ্নও করবেন না কেন আমি হোটেলের মেঝে বেসিন বাথরুম কঠিন বমনে ভরিয়ে দিচ্ছিলাম এবং তা থেকে ছিটকে বেরোচ্ছিল খণ্ড খণ্ড রক্তমহাভারত, শ্রীশ্রীগীতার কার্তুজ…

চাঁদ


এত সকালে কোথায় ঢাক বাজছে, মা?
কাত্তিক দাসের বাড়ি মনসাপুজো, না!


ভুসকালো বাড়ির একমাত্র ফরসা শিশু উঠোনে শোয়ানো
ল্যাংটো, পেট ফুলে আছে। তাকে ঘিরে অনেকটা জল-কাদা,
ভেতরে পেচ্ছাপ খুঁজলে পাবে। ঠোঁট নীল, বাঁহাতে কনুইয়ের
ওপরটা বসা-মতো। পুরো বারো ঘন্টা বাঁধন ছিল
রক্তাম্বর-পরা জটাধারীকে
কাঁদতে কাঁদতে প্রণাম করছে বাচ্চার কাকিমা।


চিৎকার দিতে দিতে গলা ভেঙে গেল কাত্তিক দাসের।
ধুপ ধুপ করে এক একটা মূর্তি মন্দির থেকে
বাইরে এসে পড়ে আর সাপের পাঁচটা ফনা গুঁড়ো হয়ে
কাঠি বেরিয়ে যায়,
সিঁদুরকৌটো দুভাগ হয়ে কাদামাটি লাল।
ওদের বড়ছেলে শংকরদা, যাকে ওঝা রাজাবাজারে
নিয়ে গিয়ে খুব পিটিয়ে চারশো টাকা কেড়ে নিয়েছিল,
আমার বুকে ধাক্কা মারে, “এখেনে কী দেখতিছিস?”
মাকে বললে আবার স্নান করাবে


বছর ঘুরতেই হাতে নৈবেদ্যর থালা, মা তুমি কোথায় ছোটো?
কাত্তিক দাসের বাড়ি মনসাপুজো তো

পুরনো কবিতা … রাস্তার ঘর

রাস্তা বহুদিন শখ করেছে
ঘরের ভেতর পর্যন্ত যাবে
যে-গম্ভীর লোক সকালে বাজার নিয়ে বাড়ি
যে-বাচ্চা স্কুলবাস থেকে লাফ দিয়ে নেমে
সে-লাফ সমাপ্ত করে ইংলিশ মিসের কাছে সন্ধেবেলা,
তাদের দলে মিশে গিয়ে দেখবে
রান্নাঘর থেকে ফ্রিজ পর্যন্ত মেয়ে-রাস্তা
কেমন সুন্দরী আর কতোটা শিথিল।
বা, খাবারটেবিলে মোটে একখানা বাউটি-পরা হাত
কীভাবে চারটে জীবিত শাখায় মাছের ঝোল পাঠায়
রাস্তার শখ হয়েছে দেখবে — শীতরাতে মন থেকে
দেহের ভেতর যে সরণী বয়ে চলে
সে কোনও ছদ্মনাম পেল কিনা!
ছোট ছোট বিদ্যুত-আগুনে যার রূপকথা
ওই একই দামিনীচমকে কি তার বিনাশও হতে পারে?

হ্যাঁ সম্ভব — বলে ঘর রাস্তায় আছড়ে ভেঙে পড়ে

কথাসমাগম

কথা পূর্ণ হয় না সোহিনী
আশৈশব কাল থেকে যত ইতিহাস আমি চিনি
তুমি জানো — তারও বেশি ইচ্ছের ভ্রমণ…
শতায়ু বৃদ্ধের মন
তবু কথার পাগড়ি পরে আছে!
হিমবাহে নিরঙ্কুশ একা উঠে গিয়ে
উদ্ভিদের গাঢ় মধ্যে ব’সে কেউ
একদিন হঠাৎ সিদ্ধাই।
নিশ্চুপের ফোঁটা টুপিয়ে টুপিয়ে পাওয়া
তার অলৌকিক
জনপদে ফিরে গেছে খচ্চরের পিঠে
বল, কেন?
ক্ষণজন্মা বাক্য হবে, তাই
জননীজর্জর বোল ভেসে আসে ভোরবেলা, সে-ই
মুমূর্ষু ছায়ার কানে হরিনাম
অসমাপ্ত…শেষ।
কথাসৈন্য কী নরম — ভাবো যদি, হাসিমাখা আলজিভ
কেঁপে উঠছে এক অক্ষৌহিণী…
কথা পূর্ণ হয় না, সোহিনী

অস্থায়ী আকাশ

আমি যখন জনশূন্য হই, যখন শেষবন্ধু ধুলো উড়িয়ে
কাছে দাঁড়িয়েছে
আমাকেও তুলে কাগজের ঠোঙার মতো অস্থায়ী আকাশে
ঠাশ ক’রে সাপবেলুন ফাটিয়ে তার খোলশ ছেড়ে গেছে
তখন আমি ভূত হই, ভিজে পেছল টালির চালে
রাতে-বসা কাক হই তখন
হিমার্ত রাতকেও বলিহারি, চোখের জলের ছোট ছোট
পিরামিড সাজিয়ে রেখেছে! তাদের পাশ কাটিয়ে,
কোনওটা হয়তো ভেস্তে দিয়ে আমি উড়ন্ত এক হাঁটা শুরু হই
দুদিকে নিজের সমাধির পাশে গালে হাত দিয়ে বসে থাকা মানুষ
সেই যে সমবেত গান হতো, কথা ও সুর: মা মনসা
সেই যে বেড়ার ফাঁক দিয়ে ছিটকে রাস্তায় পড়ত
হারিকেনের গোল গোল ইবন বতুতা, ইলতুতমিস — তাদের সামান্য কাছে
টিনের বাউন্ডারি, ভেতরে যাত্রাদল নেই, ফাঁকা মাঠ
বসে বসে সিগারেট খাচ্ছে, ‘ক্যালিপটাস গাছ উঠে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে
যাত্রা শেষ, তবু লম্বা পথশূন্য পথ পড়ে আছে
পেছন থেকে ভেসে আসে কলের প্রথম জল বালতিতে
রোদের পিরামিড তৈরি হবে, তার খুটখাট ব্যস্ত শ্রমিকেরা
আর ট্রেনশব্দ, মানে চলন্ত বন্ধু কোনও স্থির বন্ধুর
কাছে ঘেঁষে আবার দাঁড়াল।

পুরনো মেয়েদের দুপুরবেলার বিন্তিখেলা

যেন মাটির দাওয়া উঁচু, কোথাও ফাট নেই এত কথায় কথায় গোবর নিকোনো উঠোনের পিছুতে পুকুর, জলে বাঁশডালের নত-নমস্কার দুপুর যত রোদালো তত ছায়া আমরা বেঁধে রেখেছি কামিনীগাছে, বাতাবিতলায় যত রূপ দিয়ে উচ্ছ্বসিত করুক কেন শরীরনৌকো আমরা প্রশমন ভাতের গরম নিঃশ্বাসে তামার রেকাবি করা মা-লক্ষ্মীর শসাবাতাসায়।

তোমাদের ওপর দিয়ে ইতিহাস বয়ে যায় নিশ্চুপ! ঢেঁকিতে পাড় দেওয়া পায়ে দুদিনের বাসি আলতা সন্ধেয় খারাপ শরীর সকালে স্বাধীনভাবে সেরে ওঠে আর নদী যাওয়ার মাঝখানে ঘোর আতাবাগানের মধ্যে পায়খানা শুকনো পাতা আর গিরগিটি-শান্তি ছাড়া যেখানে অন্যকিছু নড়ে উঠছে না।

তাহলে আঁচলে বাঁধা গেল সংসারকে তাহলে লজ্জিত যৌনতার সঙ্গে মিশে থাকল আগুনমিশ্রিত স্নেহ আদেশ যেখানে কী আশ্চর্য অপমান হয়ে আসে না! এবং নায়কেরাও নেয়াপাতি, পৈতে গামছা কাঁধে নাভিতে সরষের তেল, গলায় গরগর করছে শ্রীশ্রীচণ্ডিকা এবং ঘুমিয়েও পড়ছে ঘন-দুপুর ধুতি-বানিয়ানে, আমার পুরনো মেয়েরা — বোনঝি-ভাস্তি, পিসশাশুড়ি-বৌঠান রোদ যখন পেঁপেগাছের মাথায় শান্ত বুলবুলি গোলামচোর খেলা নিয়ে হাসতে গিয়ে কী বিষমটাই না খাচ্ছো পান-সুপুরি মুখে।

পরপুরুষ গ্লাসভর্তি কাচের জল, ছোঁবে না?

দুজন ধার্মিক

প্রজাপতির পেছনে ঠিক একটা বাচ্চা থেকে যায়
অনেক শৈশব ভেঙে পায়ে জল, কাদা;
অনেক তারা-দূরত্ব থেকে পেটে কিছু পড়েনি বাচ্চার।
এদিকে প্রজাপতি ছুটতে ছুটতে বোনের বাড়ি কিছুটা বসে গেল
দুটো প্রজাপতির গলাও শোনা যাচ্ছে — বাচ্চা এত চুপ!
একবার এমনও হয়েছে, বিছানায় অসুস্থ প্রজাপতি
আর বাচ্চাটা উড়ছে, উড়ে উড়ে দরকারি কাজ
সেরে দিচ্ছে তার
নিজেকে কী ভাবছে সে? সেই হাসি চেপে রাখা কিন্নর?
তার শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে হালকা উদাস রামধনু-রেখা চলে গেছে
এখন ঘুরে ঘুরে বাতাসে পাহাড় আঁকে আর্টিস্ট প্রজাপতি, বাচ্চা-পা
পা টিপে উঠতে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে
সত্যি দুটো সেলাই পড়েছে মাথায়, এত জ্বালাস তুই — ব’লে
একটা ঠাস পড়েছে গালে
তারপর তো তুমি খুঁজেই পাবে না সামনের ছুট আর পেছনের
মিসিং ডায়েরি নম্বর বাইশ
হয়তো লম্বা পৃথিবী থেকে পা পিছলে গেছে
মুছে গেছে দুজন ধার্মিক
তবু প্রজাপতির পেছনে শেষ পর্যন্ত আর তার পরেও
ঠিক সেই সেই বাচ্চা থেকে গেছে…

ঝাড়খাওয়া কবিতাগুচ্ছ

পাঁচ
আমার জন্মের গায়ে এক পাত্র অগ্নি ফেলে দাও
আমার শূকর-আয়ু চলে যাক লোধি, চোল
প্রতিহারের দখলে
আমার সহস্রবাহু আত্মীয়জনেরা ধ্বংস হোক
অক্ষরেখা-সুত্‌লিতে টান করে বাঁধা এই গ্রহবিস্ফোরক
মাথার শূন্য মহাকাশ-স্টেশনে বসে আছে
আমার জনৈক লেখা, আমার সর্বস্ব কাতরতা দিয়ে
তাকে শায়েস্তা করতে গিয়ে গিয়ে দেখেছি, শিবাজি,
স্নায়ুদল তোমার চাকুতে ছিন্ন ছিন্ন করে ওলটানো
তবে রাত্রিযোগে স্বপ্নরোগে লেখা
এইসব অশনিসংকেত ছেনে আমি কী পেয়েছি,
পিনাকেশ?
তোমার আদেশ ছিল জগৎমঙ্গলকাব্য লিখি
তোমার আদেশ — নতসবুজ যে মেয়ে, তার বুক থেকে
ছিদ্রময় দুধের ফোয়ারা খুলে দেব
সে আশা উৎখাত করে, মহাযম,
ধু ধু এই প্রলাপ-দুর্গের দেয়ালে ঠোঁট ঘষি…
ভেবে দেখো এ-শরীর কতদিন যোনিরত্ন ধারণ করেনি

যোগমায়া

আমি এমন ব্যবস্থা রেখেছি
সব তান্ত্রিক নিভে গিয়েও আমার ধুনি জ্বলে!
মেঘের গর্জন শেষে মৃদু হাসি বইতে থাকে — ভোর,
আমি এমন লাইনঘাট করেছি…
যোগ ও মায়া — দুটির একত্র বলে
নিজেকে উদ্ধার করেছি, আমার
রতিমোক্ষ শরীরে হয়েছে
আর মন ধুনুচিধোঁয়ার মতো অনর্গল ভয় তুলে তুলে
ওই দেখো, ভস্মমাখা ছাই
চলাচলই আমার দরোজা, তার বাইরে তাকালে
হৃদস্পন্দনের মতো ছোট পথ,
জলের দুর্দান্ত কাছে পাখি বসে আছে
এতদিন শুকনো নদীর ‘পরে সেতু টেনে গেছি
আজ রাতে ঢেউ এল একান্ত উপায়হীন এলোকেশী ঢেউ, তার
নাভি ঘিরে রক্তগাঁদার মতো আলো
আমি ভালো আছি
আমার ঈশ্বর পথে বসেছে আজ