চন্দন ভট্টাচার্য এর সকল পোস্ট

সব জলপ্রপাতের মধ্যে তুমিই মহৎ (মাকে) ১২

বারো

সব জলপ্রপাতের মধ্যে তুমিই মহৎ
যতগুলো দীর্ঘপথ ঘুরে ঘুরে বাতাসে লাঞ্ছিত
একদিকে ছায়াসারি, অন্যপিঠে সোয়েটার-পরা রোদ্দুর
তুমি তার খুব কাছে হ্রদের এগারোতলা বাড়ি

জলের নির্ভুল তীরে পাখি সাদা, পাখি অবারিত
জল — যাকে কতবার কলসিতে ঘুম পাড়িয়েছ
মানুষের কোলে কোলে জন্মেছে পাহাড়
তাতে ভাসে আকাশের দুই স্বেচ্ছাসেবী

যেখানে রাক্ষস বসে, যেখানে সমস্ত বাতি
রাত বিভীষিকা হলে মাটি ছেড়ে খেচর, উড্ডীন —
দুশো ওয়াটের চাঁদ, ফিলিপসের শুকতারা,
বলতে নিজেরই হাসি পায়, বললে নিজের থুতু
নেমে আসে, লোকে তাকে বজ্রপাতসহ বৃষ্টি বলে

সমস্ত অগ্নির মধ্যে চিরস্নিগ্ধ তোমার আগুন…

(শেষ)

সব জলপ্রপাতের মধ্যে তুমিই মহৎ (মাকে) ১১

এগারো

যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে পরিত্যাগ করেছি এখানে,
কৃতাঞ্জলি করে মুখ আগুনে ধুইয়েছি
ওকে এতোটা পথ একা ছেড়ে দিতে মন চায়নি, শুনুন
কোলে করে আগুনের মধ্যে দিয়ে হাঁটবো ভেবেছিলাম
যদি পরে দেখা হয়, ওই অভিযোগ-স্বভাবী মেয়েকে
আমি তো চিনেছি
বলবে, ঠিক ছেড়ে চলে এলি মন্ত্রের স্তূপের মধ্যে!
অন্ধকারে গদগদ নদীর জলে একটা নাভি, শুধু একজন
নাভিরই নৌকো ভাসলো?
জানিস আমার একা ঘুমোতে ভয়…!

হয়তো কোনও অপমৃত্যু এই পথে বিকেলভ্রমণ
হয়তো একটা শ্লোক বহুকষ্টে ওপরে পৌঁছোবে
তাদের কেউ বা যদি এ-খবর দিতে পারে — মেয়ে
একলা থেকো না
ভালো শবদেহ দেখে তোমার বিয়ে হোক

সব জলপ্রপাতের মধ্যে তুমিই মহৎ (মাকে) ১০

দশ

চন্দনপাটা ধান দূর্বা তুলসী গাঁদাফুল
আমাকেই সব কাজে… সব পুকুরের পাশে পা-পেছল মাটি;
দেয়াল-দেয়াল পথে যাচ্ছি, কার যেন ঘরের ভেতর
এ-বিকেলবেলা তবলামাস্টারের বোল বাজছে
চন্দনপাটা ধান তুলসী দূর্বা গাঁদাফুল

দিদাই যে বলেছিল, গৌরকিশোর, ওকে একটা
ব্যাট কিনে দিও? তবে খেললে কীসের রাগারাগি,
হাসাহাসি করলে থাপ্পড়! এটা উৎসব-বাড়ি নয় অভিষেক
যেন মনে থাকে…

মনে থাকে বলেই তো ক্লাসে প্রথম,
বলেই বিজ্ঞানী হবো আর মৃত্যুর ওষুধ আবিষ্কার!
দিদাই, ইশ একটু দেরি করতে পারলে না
যেমন করছে পুরুতঠাকুর — তাই তার বাড়ি পর্যন্ত যাও
আর বেছে নিয়ে এসো
চন্দনপাটা দূর্বা তুলসী ধান গাঁদাফুল

সব জলপ্রপাতের মধ্যে তুমিই মহৎ (মাকে) ৯

নয়

মরণোত্তর হাসপাতালের দরজা খুলে গেছে
বেরিয়েছে মা-আইসক্রিম
ঘুমে সবুজ ঠোঁটদুটো,
এক গেলাস জল খেয়ে “আ:” করছে না
যদিও মা মঞ্চে এসেছে
মাঙ্গলিক গানখানা আমাদের মুখস্থ কোথায়!

আমি তাই টেনে টেনে আলপিনগুলো
মাকে খুলে মাকেই, প্লিজ, সেতারে বসাবো
প্রেতপিণ্ড বসে থাকবে কন্ঠার ওপর
সুড়সুড়ি-পিঁপড়ে তার কান ধরে উঠতে গিয়ে
উঠতে পাবে না
মা যদি এক-হাসি লাগিয়ে অনুষ্ঠান পণ্ড করে দেয়!

সব জলপ্রপাতের মধ্যে তুমিই মহৎ (মাকে)

আট

ওসব কবিতায় বিশ্বাস করি না আর ওসব ভগবান। যদি সত্যিই থাকতো সে, মা একটা চান্স পেত না? এত যে পুজোআচ্চা
ভিজে কাপড়ে, বারোটার আগে খাবেই না, ভগবান তো বলতে পারত — যা:, এবারের মতো ছেড়ে দিলাম! ভাবছেন, খুব
করল ছেলেটা এক মাস রাত জেগে! ভুল। নিশ্চয়ই ফাঁকি দিয়েছি।
যদি খাটতাম, এই কাঠের শরীর, তুলোপোরা, উপহার
জুটতো না। অবশ্য সবার কপালে সুখ লেখে কোথায়? মা আমার
কত কষ্ট করে ছেলে তিনটে মানুষ করেছে! যখন একটু ভালো সময়
সবে দোতলায় হাত দিয়েছি, ভাইটার বিয়ে হওয়া
দরকার আর মার জন্যে ছোট্ট টালিবসানো ঠাকুরঘর…
এবার ওখানে একটা পায়খানা বানাবো

শ্মশান কমিটি

জলের ট্যাঙ্কের নিচে এ-পাড়ার সমস্ত খুন হয়
তার পাশে মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, পাড়ার সব বিয়ের মিঠাই
এই দোকান থেকে
তার গায়ে পার্টি অফিস, তরকারি-হাটের তোলা
এখানে ব’সে ভাগ-বাঁটোয়ারা
তার পেছনে ওষুধ-দোকান, ছোট ও বাঁকা ডাক্তার বলছে
নতুন বৌমার চরিত্রে দোষ আছে
তার ওপরে তিনতলা বাড়ি, সে-বাড়ির ছেলে
বৌকে নাইট শো সিনেমা দেখাবে বলে
তুলে আনছে জলের ট্যাঙ্কের ঠিক নিচে।

সব জলপ্রপাতের মধ্যে তুমিই মহৎ (মাকে)

সাত

মৃতদেহের প্রথম নি:শ্বাস শরীরে এসে লাগে
চুমু খাই কপালে বুকে পায়ে — আমি ডোমেরও অধম
দেখি গায়ে চাঁদের উত্তাপ!
মৃতদেহের শোণিত ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এসে দুচোখ ভেজায়
কানের কাছে মুখ নিই, মৃতদেহ বলে:
মরে গেছি, তাই আমাকে ছেড়ে যাবি না তো?

ছুটে বেড়াচ্ছি নদীর ঘাটে দোকানে রাস্তায়
কিনে আনছি জলখাবার, মৃতদেহ মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে
বলছে, এসব ছাইভস্ম ফেলে আমাকে আইবুড়ো ভাত কবে খাওয়াবি, বল

সব জলপ্রপাতের মধ্যে তুমিই মহৎ (মাকে)

ছয়

মাকে ফেরাও আমি একটাও পিঁপড়ে মারি না
মাকে ফেরাও ছোটবৌমা বলছে একমাস ঝগড়া হয়নি
মাকে হাসাও আমি ছেড়েছি সবকটা সিগারেট
মাকে ফেরাও বন্ধুর বান্ধবীকে, ছি, কেউ চিঠি লেখে!

মাকে ফেরাও জন্মদ্বার ধুয়ে দিলাম ওষুধে চন্দনে
মাও বুঝুক ওর যাওয়া শুধু আমার হাতে
মাকে বলেছো বাবার স্বপ্ন ঠিকই সত্যি হবে?
মাকে ফেরাও এই যে বুক — মাতৃশোক সহ্য করে না

সব জলপ্রপাতের মধ্যে তুমিই মহৎ (মাকে)

পাঁচ

একটা পথ — তাকে বহুদূর পথ দেখিয়ে নিয়ে যাই
মৃতদেহে মিশিয়ে দিই তাকে
যে দেহ আজ থেকে জীবিতের মাঝখানে শোবে
এবং ঘুমোবে কিনা ঈশ্বরই জানেন

আমার সমস্ত হরলিকস তবে ব্যর্থ হল
আমার সমস্ত ডায়াজেপাম
বৃষ্টিতে ফুটবল খেলে বাধানো জ্বর
কিম্বা কাশতে কাশতে লাল হয়ে যাওয়া সিগারেটে
যত বকুনি এসে লাগে
তার চেয়ে অনেকটা মাথা গড়িয়ে পড়ল
বালিশ থেকে এবং ফেটে পড়ল এমন পলকহীন নক্ষত্রজাতির ভেতরে
যে-অনিমেষ আমাকে আর দেখতে চায় না

তবে আমি মায়ের ছেলে নই
বেশ আমি মায়েরও তারা হব…

সব জলপ্রপাতের মধ্যে তুমিই মহৎ (মাকে)

চার

শেষ কথা আমাকে শোনাও, আমি জেগে আছি
দুহাতের মাঝখানে মাথাগোঁজা আবিষ্কার ক’রে
ক’টা পাখি ডাকে সারারাত, পাখা কতোবার ঘোরে
ঘোরের ভেতর…
অচৈতন্য হাত আমি উঠিয়ে উঠিয়ে ফের নামিয়ে রেখেছি

শেষ কথা শব্দহীন? সেও শেষ রাতের এক খুরি চা — মুখে না দিয়েই
যাকে পান করি — তার মধ্যে ডুবে যাওয়া কোনও আশীর্বাদ?
নাকি মুক্তি চেয়েছিলে তুমি লোভী ফুসফুস,
এইমাত্র ঘুমিয়ে-পড়ার কানে বলে গেছ
আসি এবার, ছেলে তুইও তৈরি থাকিস

সব জলপ্রপাতের মধ্যে তুমিই মহৎ (মাকে)

তিন

টর্চ জ্বেলে বসে আছি দেখি প্রাণ কীভাবে পালায়
আরুণির মতো শুয়ে দিয়ে আছি মৃত্যুজলে বাঁধ
দেবতা দেবতা — তাকে মানুষের বাধ্য হও ব’লে শাসিয়েছি
আর কী করবো বলো দিনে-রাতে যোগসন্ধি ছাড়া

যুদ্ধক্ষেত্রে বসে সন্ধিপুজো, তাতে লাগছে
মধু তুলসি দুধ, দুধ নেই বলে একটু কমপ্লান গুলেছি
ঢেলে দিচ্ছি কলাগাছের নৌকোয়। আর তক্কে থাকা,
যদি বেড়াল ঢুকে আসে দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে
লেজটি আকাশে তুলে রক্তের বাটিতে মুখ দেয়। ওই দিলো! আমি
লাঠি ছুঁড়ে এক-ঘা বসাতে গিয়ে দেখি
সাদা পাল দুহাতে, গলায় শক্ত কাছি দিয়ে
নৌকোখানা শ্মশানমাটিতে বাঁধা আছে

সব জলপ্রপাতের মধ্যে তুমিই মহৎ (মাকে)

দুই

মূর্খ চেয়ারে ব’সে এই মূর্খ শীতরাত দেখি
পাথর সিমেন্ট বালি একসাথে জড়ো হয়ে সবাই গরম
কিন্তু গাছ পালিয়েছে লন থেকে, খুব নিচু আয়ের
ওই চায়ের দোকান ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়েছে আর
ঘুমে নিবুনিবু চায়ের কেটলি নিজেকে নি:সঙ্গ
একা অরণ্যের মধ্যে পেয়ে ভয়সচকিত, বলছে — বাবা,
এবার আমাকে আর বাঁচাতে পারলি না!
ফলে মূর্খ ওষুধ ঢুকে যাচ্ছে ধমনী-ধমনীতে
ফেলে রেখে ফুলের বাগান ঘেরা অনন্ত ছাদের নিচে
আলোয় সাজানো মৃত্যুভয়

সব জলপ্রপাতের মধ্যে তুমিই মহৎ (মাকে)

এক

তিলের নাড়ুর মতো দুহাতের পাকে
মা কেবল ছোট হয়ে আসে
দুর্দান্ত করবীগাছ, বীজের ভেতরে সেও
লুকিয়ে যায় কোমর অবধি
তাকে মশারি টাঙিয়ে, তাকে ধামাচাপা দিয়ে
আমিই দুহাত তাস খেলতে বসেছি
বেলা শেষ, খেতে বসেছি কাঠটগর শিউলিবাটা দিয়ে
প্রতি গরাসের সাথে ওই হাত হয়ে উঠছে হাতপাখা
ওই গ্রীবা গতজন্মে গলায়-দড়ি মেয়ের মতো
লম্বা রাজহাঁস
মা উড়বেই…
আর আমি তক্ষুনি ঝাঁপিয়েছি বুকের ওপর
ও মা চোখ খোলো, কেন মাগো কথা বলছো না!

কবিকুলগাছ

মার খাইয়েছিলাম মনে পড়ে? এক-চোরের মার?
তারপর ফ্রকের পকেটভর্তি মিষ্টি কুল নিয়ে
কাটা ঘায়ে সেধেছিলাম কমপক্ষে সাত দিন!
তারও দশ বছর পরে জমানো মনস্তাপ
বিবাহ-প্রস্তাব আকারে পাঠিয়েছি ও-বাড়িতে

এখন দুপুরবেলা দুচোখ লেগে এলে দরজাও বন্ধ হয়
ভেতরে ফোঁপানি আর প্রহারশব্দকোষ ছুটে চলে
এখন সন্ধেয় ছাদে মুখোমুখি আমি আর কবি-কুলগাছ
দু’একটা সদ্য-লেখা মুখে দিয়ে মিছিমিছি “কী টক কী টক” —
বাঁচোখ বুঁজিয়ে ফেলি
তুই হাসিস, ছি:, তুমি হাসো
“তাহলে সেদিন কুলতলায় অসভ্যতা করিনি, মানো তো?”

জোগাড়ে মিস্ত্রির আগে আসে

ঘরের পাঁচিলে সাইকেল শ্রীকৃষ্ণ ক’রে রাখা
পাথরকুচির সাঁচিস্তূপ পার হলে ফারাওয়ের দেশ
উঠোনের গন্ধরাজটা ঠিক এবার মরে যাবে!
কিচ্ছু করার নেই, সিমেন্টের ধক টেনে
আমরা যদি বাঁচতে পারি, দিনমানে ষোলটা বিড়ি টেনে
ব্যাগ থেকে লুঙি আর ফুটো গেঞ্জি পরে নিই জোগাড়ের ড্রেস
জোগাড়ে মিস্ত্রির আগে আসে
দেয়ালগাঁথনি চলে গেছে পৃথিবীর ছ’ইঞ্চি জায়গা হাতে নিয়ে
দুপাশে বাড়ির চারা জল পায় হালকামতো,
সালোকসংশ্লেষ? দেরি হবে
ছক ছক মশলা পড়ছে ইঁটের গলিতে
ওগো খাটিয়ে হাত ধোও, বাবুর গিন্নির করা চা আসে চা আসে
এই বাড়ি শেষ হলে চিনতে পারব না
ঘরে ঢুকব কলিংবেলে চেপে —
জোগাড়ের কথা ধরতে নেই
ঘরের বিধ্বস্ত উড়ছে তাকে ধরো, ঘরের উত্থান উড়ে যায়…
আকাশঅফিসে তালা দিয়ে কানাকুয়ো ছাদে একটু
বসতে যাবে কি, জোগাড়ের মিথ্যে ঢিল খেয়ে ফের পাখি
পিঁপড়ের সারি কাঁচা সিঁড়ি বেয়ে উঠছে বদর বদর
আর মুখ তুললেই বহুতল চাঁদ, চাঁদের কার্নিশে
দুটিখানা চাপান গাঁথনি হয়ে আমাদের জোগাড়ে শুয়েছে