চন্দন ভট্টাচার্য এর সকল পোস্ট

সে কাহার জন্য

আমার ঠাকুরদার পরিবার ছিল, খুলনার ভাষায়, ধানী-পানি গিরোস্তো। দক্ষিণ-এ মানে সুন্দরবন এলাকায় তাদের আবাদ বেশ কিছু-ঘর প্রজা সমেত। এ-হেন ফ্যামিলিতে মেধাবী, সুপুরুষ কিন্তু বিবাগী প্রকৃতির ছোট ছেলেটিকে নিয়ে ছিল অগাধ দুশ্চিন্তা। বছর তেরো বয়েসে একবার বাড়ি পালিয়ে ঢাকায় হাজির হয়েছে ভারত সেবাশ্রম সংঘের সন্নিসি হবে বলে। মাস কয়েক আগে তো কলকাতা পর্যন্ত ছুটেছিল রামকৃষ্ণ মিশনের মঠে গিয়ে থাকার ইচ্ছেয়। কাজেই অল্প বয়েসে সংস্কৃতে কাব্যতীর্থ উপাধি পেয়ে দৌলতপুর স্কুলে মাস্টারি জুটে যেতেই বাড়ির লোকজন বাবাকে সংসারী করতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঘটক খবর নিয়ে আসে — পালটি ঘর, সম্পন্ন পরিবার, সুন্দরী পাত্রী; কিন্তু বাবার সেই এক কথা, সংসার করার জন্যে তার জন্ম হয়নি!

এর মধ্যে এক বর্ষাভোরে সেনহাটির লাগোয়া গ্রাম মহেশ্বরবাসা থেকে বিধবা মহিলাটি এসে খুব করে ধরে বসলেন আমার ঠাকুরদাকে। তার দুই মেয়ের বড়কে যদি একটিবার দেখে আসা হয়। মেয়ের বাবা যাত্রাদলে বাঁশি বাজাত, হঠাৎ করে তিনদিনের জ্বরে মারা গেছে গতবছর। তারা নিতান্ত গরীব, দেওয়া-থোয়ার সামর্থ নেই, মেয়ে যে রূপবতী এমন দাবীও করছেন না (পরে নাতিকে দেখলে মালুম হবে), কিন্তু তবু…।

টালির চাল ফুটো হয়ে বিছানা ভেসে যাচ্ছে, এদিকে ঘরে ডুগি-তবলা, হারমোনিয়াম, ফ্লুটবাঁশি… এককোনে ছেঁড়া চাদরে জড়ানো একটা এস্রাজও। গান জানো, মা?

শ্যামরঙা রোগাসোগা মেয়েটা গাইবে, “দুঃখের বরষায় চক্ষের জল যেই নামল…”। শেষ হতে সে মুখ-নিচু ব’সে, আর চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে আমার বাবা, ঠাকুরদা, দুই পিসি…গোটা শ্বশুরবাড়ি টিম।

এরপর থেকে প্রতিদিন সন্ধেবেলা সেনহাটির সেই ভদ্রাসনে হাঁক পড়ত, কী ছোটবৌমা, আজ আর রবি ঘটকের গান শুনতি পাবো না বুঝি!

একা রবীন্দ্রনাথ কেন হতে যাবেন, চৈত্র মাসে জামরুলপাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোকিল, সুচিত্রা সেনের একটি অপাঙ্গ, ফিদা হুসেনের ক্যানভাস উপচে পড়া স্টাডি, কিটসের চার লাইন, শ্রাবণের বিস্ফোরণে নিহত কামিনীফুলের টুকরো হওয়া কিন্তু অটুট গন্ধের শবদেহ — এরা সবাই ঘটকালি করে যাচ্ছে সেই কবে থেকে, নারীপুরুষের শাঁসের ভেতর…।

সোনাঝুরি

ভোরে উঠে মুখ ধুচ্ছো — বেসিনভরা সমুদ্রতীর
টুথপেস্টের দুধকুয়াশা মেখে আয়না মহাস্থবির

মর্নিং টি পৌঁছে সবার, নিজের কাপটি নিয়ে বসো
চা-ও শুভ্র? অথচ তুমি কালো পরতে ভালোবাসো!

ঝিনঝিনিয়ে ফোন বাজল — যেমন কানের ঝুলন দুল
শুভেচ্ছাস্বর উপচে প’ড়ে এঘর-ওঘর হাউজফুল

ব্যালকনিতে জুঁই আর চড়াই সহপাঠী হলুদ টবে
“হুশ, যা পালা”… রাতে মাকে প্রণাম করতে যেতে হবে

একধারসে বর্ষা তখন, ভিজে লতপত শাড়ির পাড়
বাবি, ঠাণ্ডা লাগেনি তো? রাস্তায় ফোন একুশবার

মোড়ের সস্তা ঘুঘনিঠেকের হাওয়ায় মিশে যা কস্তুরী
পৃথিবীর সব কেকে লেখা “হ্যাপি বার্থ ডে, সোনাঝুরি”।

রক্তের শিশির

তুমি শরতে আমাকে একবার দেখে যেয়ো
শিশু নিমপাতার পিঠে শতবিকশিত আলো পড়ে আছে
বাতাসের মাথায় দেশলাই ছোঁয়াতেই ধূপকাঠি হল
তুমি এখন কোন হাসিসমাবেশ বকফুলভাজা অথবা
উদ্যান সংস্কারের মধ্যে আছো, কীভাবে নিষ্পলক বৃষ্টি আর
সাবসিকোয়েন্ট চুমুর অধিকারে ফেলে রেখেছ অফুরন্ত ডানহাত
আমি তো জানি না

তোমার রক্তে আজ ক’ফোঁটা শিশির, মাথার চুলে ক’টা বেদানার দানা!

দূর থেকে ঋতুগুলো আসে
রাস্তার আলোজ্বলা বাতায়ন নিভিয়ে নিভিয়ে
যখন সুপ্রভাত আর শুভরাতের মধ্যে নাগাড়ে ঝড়ের বাতাস বয়ে যাচ্ছে
যখন কুয়াশাকে অনন্তমহিমা আর অন্ধকারকে ত্রিদিবেশ মনে হয়
তুমি সেই রকম জুন আর অঘ্রানে একবার আমাকে দেখে যেয়ো
শার্টের দ্বিতীয় বোতাম জগৎসমক্ষে আঁকড়েধরা
মুঠো নিয়ে পৌঁছবে না জানি। আরশোলার নিচু বস্তি,
চিৎকার পানের পিক, ফলের কনিষ্ঠ ভুতি — এইসব
কাদাজলে ভীষণ বিরক্ত হবে, তোমার ফর্সা পায়ের গোছে
তাকিয়ে থাকবে রিকশাওলা।
তবু একশেষবার যদি মনে হয় — নিজের এলেবেলে পরমাত্মার কাঁধে
মাথা রেখে আহা কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে
স্টেশানের কাউন্টারে হাত বাড়িয়ে ব’লো
বাতিল সম্পর্ক, একটা, রিটার্ন…

[“সহ্যকে যন্ত্রণা করি” (২০১৮) বই থেকে]

জাতিস্মর চোয়ালেরা

যারা আসমুদ্র সমস্যা নিয়ে ভাবল তারা হিমাচল।
ভোঁসলে বা দেশমুখ, দাশগুপ্ত কিম্বা সিংহানিয়া — বড়জোর স্নান ক’রে
চুল আঁচড়েছে, জাতিস্মর ফুলদানির দিকে কেউ ফিরে তাকায়নি।

যারা ব্যাংকের মাথায় ছাতা ধরল, ছোট চাষির এক টোকায়
বন্ধ করল আত্মহত্যা, কারখানার গেটে ঘোল খাইয়ে দিল
উৎপাদনব্যবস্থাকে, খবরের কাগজ তাদেরই কথায়
চার থেকে বাইশ পাতায় উঠে গেছে। তারা পৃথিবীর বরকর্তা,
চিকু-বাগানের কালো ডোরাদাগ। ইন ফ্যাক্ট ওরাই শিক্ষাপদ্ধতিকে বলল
কাঁদিস না; বিল আনল, মাছ নয়, অক্ষরভর্তি বিল। শাস্তিকে কড়া ভাষায়
প্রশংসা ক’রে অত্যাচারকে সময় দিল প’চে ওঠার। তাদের মাথার চুল
যত পাতলা হতে লেগেছে ততই সেখানে শক্ত ক’রে বসল ফিফথ ব্যাটেলিয়ান।

এরপর একদিন কী ভেবে হলুদ পাঞ্জাবি পরার শখ হল তাদের,
জোঙ্গা জিপ টেনে তুলল পুরো সি-বিচের তলপেটের ওপর।
পেছনে ছায়ার তরমুজফালি থেকে বন্দুক আকাশকে
ইতস্তত তাক লাগিয়ে আছে। খরভাবে দাড়ি কামানো, লোহাচোয়াল —
দু’পা ফাঁক ক’রে দাঁড়িয়ে তারা তাকিয়ে থাকল মিশমিশে সূর্যাস্তের দিকে…

______________________
[“সহ্যকে যন্ত্রণা করি” বই থেকে]

পুরনো একটা গুঁড়ো কবিতা

আমার জন্ম শ্রাবণে, বৃষ্টির জ্যোৎস্নায়। বর্ষার প্রত্যেক কণায় জন্মদিন লেখা আছে দেখি।

পুরনো একটা গুঁড়ো কবিতা :

বৃষ্টিকে অবশ করে ও.টি.-তে শোয়াও
বৃষ্টিনাড়ি চিরে দ্যাখো ওর মধ্যে
কত জন্ম মেঘের ডিউটি, তার না-পাওয়া
মাইনে জমে আছে!
বর্ষা শুকিয়ে সেই আমড়াআচার
ভরা বালতি তুলতে যাওয়া পোয়াতির
কাটা জিভে ছড়িয়ে দাও গে’

হাতপা কোলে ব’সে থাকা গ্রামে এই যে
নিজের দু’হাঁটুতে খোল বাজানো লোক —
ওদের গুচ্ছের পোড়া বিড়ি
বৃষ্টির ঝোলায় পোরো বদমাইশি ক’রে

সত্যি, আমাদের পিঠে আর কত সহ্য হবে ধারাবেত — ভেবে শুয়ে আছি বেহুঁশ, গম্ভীর…

পগারের জলে দুলুক থার্মোমিটার কচুপাতা

হে আমার সন্ন্যাসীরা…

আমি কোনও দিন সহযাত্রী হবো না তোমাদের
একথা জানিয়ে রাখা ভালো
আমার কাজ তো শুধু বাঁধে ফাটল ধরানো
জল মুক্ত করে দেওয়া
যাতে তোমরা বোঝো, নদী সহজভাবে বইলে
ক্ষতির চেয়ে সুরাহা হতো বেশি
আমার প্রস্তাব দরজা খুলে কুকুর ডেকে আনা
যাতে সে দেহবাটির মাংসে মুখ দেয়
আর ভোরবেলা নর্দমায় তোমাদের
উপুড় করে দিতে হয় নিজের শরীর…

কেননা, আমার আকৃতিও একই বিষে সাদা, পদচিহ্নের ওপরে
সাপ এসে পড়লে শুকিয়ে মরে যাবে; যেহেতু এত অবৈধ জীবনের
ভেতরে আমি বাসা করে থেকেছি, ঘৃণা —
ফরসা এবং স্বনির্ভর ঘেন্না আমাকে এতবার অপমান
করেছে টেলিফোনে যে হাতুড়ি মেরে শিরদাঁড়ার
লোহা ভেঙেছি আমি, যেমন তোমরা দুমড়ে দিচ্ছ
নিজের পাঁজরের আয়ু ও গন্ধক
কেটে দু’খণ্ড করে নিয়েছ পিতৃনাম।
কাল ধ্বংসস্তূপের ওপরে নতুন উদ্ভিদ শুরু হবে
কিন্তু তার শেকড় খুঁজে
আমাকে উল্লেখ করতে যেও না
একথা প্রথমেই জানিয়ে রেখেছি

আমি নেই, কোনওদিন ছিলামও না…

(পুরনো কবিতা)

চোরাই শব্দ

লোকাল ট্রেনে রোদ ধুলো আর ভিড়। কিন্তু রোদ ধুলো বোঝা যায় না — ভিড় ভিড় ভিড়। আমার সামনে এক তরুণ বাবা, তার বাঁ কাঁধে ভারি ব্যাগ, ডান কোলে পুঁচকি মেয়ে। মেয়ে কলকল করতে করতে হঠাৎ থেমে গেল — আমি ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে গলায় ঢালছি।

তার একদৃষ্টি দেখে বললাম, খাবি?
ঘাড় কাত করতেই ক্যাপ খুলে হাতে বোতল ধরিয়ে দিয়েছি। ছোট মুখটায় ঠোঁট লাগিয়ে চকচক করে টানতে লাগল।
বাবা ধমকে উঠেছে, মুখ লাগিয়ে খাচ্ছিস কেন!
বললাম, আপনি কি পাগল হলেন! ওইটুকুন বাচ্চা উঁচু করে খেতে পারে?
হাসল সে, আর বলবেন না, জল জল করে সত্যিই মাথা খারাপ করে দেয়। এই দেখুন …।

তো দেখলাম ছেলেটার কাঁধঝোলার সাইডের খোপে এক লিটারের সবুজ ফেট্টি লাগানো বোতল। দাদু নাতি আর হাতি সিনেমাটার মতো বাপ মেয়ে এবং বিসলেরি… তিনে মিলে চলল কোথায়?
কোথায় আবার, ছেলেটার পরিষ্কার কামানো গালের দিকে তাকিয়ে মনে হল — নির্ঘাৎ শ্বশুরবাড়ি! কাল জামাইষষ্ঠী তো।

— ওর মা কোথায়, সঙ্গে আসেনি?
দুহাতে দুটো ভার, ছেলেটার বেশ কষ্ট হচ্ছিল এই ঠ্যালাগুঁতোর মধ্যে দাঁড়াতে।
— ভেতরদিকে বসার একটা সিট পেয়ে গেছে।
এ হল আমার উচ্চারিত প্রশ্নের উত্তর। তারপর সে অনেকখানি সুখী আর অল্প বিপন্ন মুখ করে কন্যায় আড়চোখ মেলে আমার না-বলা বাণীর জবাব দিল :
যতক্ষণ বাড়িতে আছি, এক সেকেন্ডের জন্যে কোল ছাড়বে না!

তখন আদুরে মেয়ে বাপের বুকের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে কাঁধের ঝোলার দিকে হাত বাড়াচ্ছে। আমি গল্পটা টের পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বিসলেরির বোতল টেনে নিয়ে ঢাকনি খুলে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়েছি। আবার সেই চকচক।
বাবা হতবাক হয়ে বলল, এখুনি না খেলি! কতবার জল লাগে?

ডান হাতের উলটো পিঠে মুখ মুছে মেয়ে এবার চোখ পাকিয়েছে। তখন থেকে জল জল করছ কেন, পানি বলো পানি।

গব্বরের গুলির পরের সন্নাটা নেমে এল এক মুহূর্তে। চুপসে গেছে কচি বাবা। যেন সে এতক্ষণ বুকপকেটে চোরাই মালের মতো একটা চোরাই শব্দ লুকিয়ে নিয়ে ঘুরছিল, এইমাত্র ফাঁস!

আমি তাড়াতাড়ি পুঁচকির দিকে তাকিয়ে একই লাইন রিপিট করতে লাগলাম, “পানি আর জল একই। পানি মানেই জল, বুঝেছিস?” তারপর মনে হল, আসলে ঘাবড়ে আছে তো ওর বাবা। “যা জল তাই পানি” — ছেলেটার বাঁ কাঁধে আমার হাত উঠে এল।

চলন্ত ট্রেনে এসব সংলাপের কোনও শ্রোতা ছিল না। শুধু ভিড়ের গুনগুনের মধ্যে একজন চেঁচিয়ে উঠেছে, শালা তিনদিন হয়ে গেল বৃষ্টি নেই!
সত্যিই তো! স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমার হাত আবার চলে গেছে নিজের পিঠব্যাগের ভেতরে।

জল খেতে খেতে শুনতে পেলাম বাপসোহাগীর হি হি হাসি:
এমা! আব্বু দ্যাখো, আমার মতন ক’রে পানি খাচ্ছে!

যৌথখামার আর হাফ রাইটিং

যৌথখামার আর হাফ রাইটিং

ফেসবুকের শুরুতে বন্ধুদের অনেকে বারণ করেছে – এটা চ্যাট আর গসিপ করার জায়গা, একটাও সিরিয়াস পাঠক নেই, লেখা পোস্ট করা মানে সেগুলোর বেইজ্জতি!

ভাবতাম, ফেসবুক যদি সামাজিক আন্দোলন ট্রিগার করতে পারে তবে সাহিত্যের আধারপাত্র হতে মুশকিল কোথায়? তাছাড়া, পৃথিবীর সব গোল গর্তে চৌকো স্ক্রু একমাত্র আমিই – মানা যাচ্ছে না! আরও কিছু মক্কেল থাকবে ঠিক – বর্ষায়-ভাসা পুকুরের কইমাছ, যারা গন্ধ শুঁকে শুঁকে এখানেই নির্ভুল জড়ো হয়েছে।

কাট টু…

দার্শনিকদের মধ্যে স্ল্যাভয় জিজেক-এর ইমেজ অনেকটা ধর্মগুরু হিসেবে ওশো বা সাহিত্যিক হিসেবে হারুকি মুরাকামির মতো – কেউ মাথায় তুলে রাখেন তো কারও মতে পপুলিস্ট, অ্যাক্কেবারে সময় নষ্ট!

জিজেকের ওপরে অনেকগুলো তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছে, তার একটা ‘দা পারভার্ট’স গাইড টু ইডিওলজি’। সেখানে চমৎকার সব কথাবার্তা বলেছেন – “আমরা ইডিওলজি-উত্তর সমাজে বাস করি। ‘ইডিওলজি’ লেখা একটা ট্র্যাশ ক্যান থেকে খাবার কুড়িয়ে কুড়িয়ে খাচ্ছি সবাই” – ইত্যাকার।

কিন্তু জিজেক হেসে ফেলেন, তার ছোটো ছোটো সাজানো দাঁত দেখা যায় একবারই, যখন ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে কোট করছিলেন – প্রসঙ্গঃ কিছুদিন আগে লন্ডনের কালো, ঘেটোবাসী জনতা কর্তৃক বাড়িঘরে ভাঙচুর করা, দোকানপাটে আগুন লাগানো। ডেভিড ক্যামেরন বলছেন, “ঠিক আছে, ওরা লোকজনকে ধরে ঠ্যাঙাচ্ছে বা বাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু সত্যিকারের ভয়াবহ জিনিস হল, দোকান থেকে মালপত্র নিয়ে চলে যাচ্ছে দাম না দিয়ে!”

জিজেকের অবাক উপলব্ধি, “এটাই যেন সেই সর্বোচ্চ পাপ যা মানুষ কল্পনায় আনতে পারে!… তাহলে আদর্শ, ন্যায়বিচার, সাম্য, এরা সব ভেঙে পড়ল, আর যা থেকে গেল তা বিশুদ্ধ কনজিউমারিজম?”

কাট টু…

আমি ভেবেছিলাম, যেভাবে মেট্রো রেলে মোবাইলের টাওয়ার কাজ করে না, যোগাযোগ-মাধ্যমগুলোর ভেতরে কোথাও একটা শিল্পতালুক (শিল্প মানে আর্ট) তৈরি করা চাই যেখানে বাজারনীতি ব্যর্থ হবে। ব্লগ বা ফেসবুকের মতো ব্যক্তিগত মিডিয়াগুলো সেই সুযোগ এনে দিয়েছে, এক পূর্বশর্তহীন সাহিত্যদর্শনের জন্ম দেওয়ার সুযোগ।

দেরিদার “অফ গ্র্যামাটোলজি” থেকে জানা যাবে — জাঁ জাক রুশো তার গ্রন্থ ‘কনফেশন’-এ ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে লেখক হলেন। “তার লেখার দিকে যাত্রা হল একরকম অনুপস্থিতির সাহায্যে; এবং যে উপস্থিতি কথ্যভাষা নিয়ে নিরাশ (disappointed), তাকে একরকম হিসেব ক’ষে মুছে দেওয়ার ভেতর দিয়ে”। রুশো বিশেষজ্ঞ স্টারোবিনস্কি মূল্যায়ন করছেন, “নিজের সত্যমূল্য অনুযায়ী নিজেকে প্রকাশ করা থেকে লেখককে যা আটকে দেয়, সেই ভুল বোঝাবুঝি কীভাবে অতিক্রম করবেন তিনি? শক্তিহীন (impoverished) কথার বিপদ থেকে কীভাবে বাঁচবেন একজন লেখক? …আর কী উপায়েই বা নিজেকে প্রকাশ করবেন? জাঁ জাক বেছে নিলেন অনুপস্থিত থাকা আর লেখাকে। আত্মবিরোধী (paradox) মনে হতে পারে — তিনি নিজেকে লুকিয়ে ফেলবেন নিজেকে আরও ভালোভাবে দেখাবেন বলে। এবং নিজেকে সীমাবদ্ধ করে নেবেন লিখিত কথার মধ্যে”।

এবার রুশো থেকে সরাসরিঃ “আমি সমাজকে অন্যদের মতোই ভালোবাসব, যদি না আমি নিঃসন্দেহ হই যে (এর ফলে) নিজেকে শুধুমাত্র একটা অসুবিধে হিসেবে দেখানো নয়, আমি নিজে যা তার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা হিসেবে দেখাব। লেখা এবং নিজেকে লুকোনোর যে ভূমিকা সেটা সংক্ষেপে আমার পক্ষে মানানসই। আমি যদি উপস্থিত থাকি, কেউ জানবে না আমি কতখানির যোগ্য”।

ওপরের আলোচনাটা আদতে ছিল কথ্য আর লেখ্য ভাষার তুলনা নিয়ে যেখানে রুশো, হাইডেগার, দুক্লোস, সসুর ইত্যাদিরা মুখের ভাষাকে এগিয়ে রেখেছেন, আর দেরিদা তার সিন্থেসিসের শেষে লেখার ভাষাকেও দিচ্ছেন সমানের গুরুত্ব। কিন্তু আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করেছিল রুশোর প্রতিবেদন। লেখকের লুকিয়ে থাকা জরুরি, আবছা হয়ে থাকা; এটা খুব মানি আমি। কোকিলই যে বসন্ত, তার বড় কারণ ওকে দেখা-ছোঁয়া যায় না। সুরই কুহুর সবকিছু — সাড়া-প্রতিক্রিয়া, দেনা-পাওনা, অর্থ-অর্থহীনতা, প্রেম-পরাজয় আর এর হাইফেনচিহ্নের ভেতরে বাইরে চারপাশে যা যা আছে।

ভার্চুয়াল মিডিয়ায় আমি আর পাঠক-পৃথিবী মুখোমুখি, অথচ সামনা-সামনি নেই; তাই নিজের পরিচয় লেখার মধ্যে বা বাইরে বা বাইরের পরেও একই থেকে যাচ্ছে। পড়ুয়াই তো ইনফর্মার যার ভেতর দিয়ে হাত বাড়িয়ে লেখাকে স্টেশানে পৌঁছনোর আগে থামিয়ে বা রাস্তা ঘুরিয়ে দেয় বাজারনীতি। তাই আপাত-উপস্থিতির ভেতর একই সঙ্গে অ্যাবসেন্স আর প্রেজেন্স ধরা থাকল।

কাট টু…

এদিকে “আকাঙ্খার জন্যে আকাঙ্খাকেই আকাঙ্খা বলে”, জিজেক জানিয়েছেন। কোক খেয়ে আমাদের তেষ্টা মেটে না, বেড়ে যায়। তার মানে, লেখাকে লাভজনক হয়ে ওঠার লক্ষ্য থেকে সরিয়ে দিলেও এমন নয় যে সে চাহিদা-যোগান বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবে। বাধ্যবাধকতা থেকে যায়, মুখাপেক্ষিতা। পকেটে টাকা না থাক, মনে ডিজায়ারের মৃত্যু ঘনাবে না! কনজিউমারিজম থেকে ছুটকারা যদিও বা পাও, ভোগ্যপণ্যবাদের দর্শন থেকে মুক্তি নেই।

বাজার চাহিদা-যোগানের ‘পরে দাঁড়িয়ে আছে — এই ভাষ্যও তাহলে আধা সচ্‌! সাপ্লাই-ডিম্যান্ডের আরামচেয়ার আসলে পাতা ইডিওলজির ওপরে, যে আদর্শের ‘দানা’ আমাদের শুরুতেই ‘খাইয়ে’ দেওয়া হয়েছে।

হয়তো এই জন্যেই ফেসবুকে মোটের ওপর প্রতিক্রিয়ার ঢেউ বইতে দেখি — রাজনীতিতে সিপিএম-এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া, নয়তো তৃণমূলের বিরুদ্ধে। জাতীয়তাবাদে হয় ভারত নয় বাংলাদেশের পক্ষে, ধর্মে হিন্দু নতুবা মুসলমান, ঠিক যেমন ফুটবলে ব্রাজিল কিম্বা আর্জেন্টিনা। বাইনারির কোনও একটা বাহুতে দাঁড়িয়ে অন্যের দিকে লেখা ছুঁড়ে দেওয়া যা পূর্ণিমার সাতদিন আগের আকাশের মতো…আধখানা।

আনকাট

এই গোটা লেখাটাই নিজের জন্যে, নিজের বিরুদ্ধে।
স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন ছিল, কিন্তু “extreme violence of liberation”-কে কবজিতে বেঁধে নেওয়ার সাহস কোথায়?

কোথাও মুনাফার ছোঁয়া না থাকুক, ইনভেস্টমেন্ট-রিটার্ন জুটির হাত ধরে ঘুরপথে দ্যাখো সেই চাহিদা-যোগান ব্যবস্থাই তো ফিরিয়ে আনছি ফেসবুকে। নিয়ম করে খিচুড়িভোগও বানানো! বাজারের লেখক একলাখ পাঠকের জন্যে খুন্তি নাড়ে, আমিও একই নিয়মে তিরিশ জনের পাতে খাবার তুলে দিই — নিজেই নিজেকে লেখার ফর্দ ধরিয়ে দেওয়া সাহিত্যরাঁধুনি।

স্লোগান

তোমার স্তন কখনও তোমার অপরাধ হতে পারে না।
মাথার সুচিন্তিত চুল হতে পারে না আঁকশি — রান্নাঘরে শিকে টাঙানোর।
সন্ধেবেলা টিউশান পড়ে বাড়ি ফেরার রাস্তায়
পাথর মেরে ভেঙে রাখা টিউবলাইট তোমারই বোকামি হতে পারে না।
যারা একপাটি জুতোর ভেতরে ভরতে চেয়েছে তোমার দুটো পা-ই,
তাদের বিরুদ্ধে উরু ছড়িয়ে দাঁড়ানো হতে পারে না
চরিত্রহীনতা।

(পুরনো গল্প) বোকা বোকা লম্বা (শেষ পর্ব)

(পুরনো গল্প) বোকা বোকা লম্বা
(শেষ পর্ব)

মা
সরকারবাড়ির পুকুরে অর্ধেক জল, বাকি অর্ধেক ঢেকে গেছে কলমি-বেতো শাকে। সেখান থেকে ঢাল বেয়ে ওপরে উঠলে লম্বা ঘাসভরা জমি, মুখ না তুলে হাঁটো যদি, নাকে সুড়সুড়ি খেয়ে হাঁচি আসতে বাধ্য। তারপর বাতাবিলেবু গাছ একটা, যেখানে সোমঋতাদের দুধেল গরু আব্বুলিশ বাঁধা থাকে। জগন্নাথ সরকার বারাসাতে বাড়ি ক’রে ফ্যামিলি সমেত উঠে যাওয়ার পর এই সবুজ মাঠের টুকরোটা পাড়ার বেড়ালদের আড্ডা বা সেমিনারের জায়গা। বিবিল সেখানে দাঁড়িয়ে বারবার তাকাচ্ছিল কীর্তনবাড়ির দিকে। মিনিট খানিক পরেই, ঠিক যা ভেবেছি, সে-বাড়ির গেট পেরিয়ে দিশা মেয়েটা এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে সুড়ুত করে কাঠটগর গাছের জঙ্গলে ঢুকে পড়ল।

দিশার পুরো নাম অনেকগুলো সিংঘে, নায়েকে, আর্থার, পেরেরা দিয়ে বানানো, তিংসা বগির ট্রেনের মতো (তিংসা মানে বারো)। ও আসলে শ্রীলংকার খ্রিস্টান বেড়াল, কলোম্বোর বিখ্যাত উকিল মেন্ডিস পেরেরার কাছে মানুষ হয়েছে। ওই বাড়িতেই দুবছর ভাড়া ছিলেন কীর্তনবাড়ির ডক্টর রামবিলাস কীর্তনিয়া। দেশে ফেরার সময় বাচ্চাটাকে সঙ্গে নিয়ে আসেন।

কাঠটগর-বন পেরিয়ে জামরুল গাছের আড়াল দিয়ে দিশা খুব জোরে ছুটে এল মাঠটুকু। তারপর বিবিলের নজরে আসার ঠিক আগে থেমে গিয়ে হেলেদুলে হাঁটতে লাগল। মুখের আহ্লাদি ভাব লুকিয়ে চোখদুটো উদাসীন-মতো করে বলল, আবার কী হ’ল? ডাকছিলিস কেন!
—এই, “আডমিটিকার” মানে কী রে?

মেয়েটা তো হেসেই বাঁচে না। “ওটা অ্যাডমিট কার্ড, ওতে রোল নম্বর, ছবি, সব দেওয়া থাকে। না নিয়ে গেলে পরীক্ষার হলে ঢুকতেই দেবে না। আমাদের বাড়ির বন্দনাদিও ন’টা বেয়াল্লিশের ট্রেনে যাচ্ছে, ওর আবার বিধাননগর কলেজে সিট পড়েছে তো!

আমি আকাশের দিকে মুখ তুলে রোদের হেলানো রশ্মি দেখতে পেলাম। মনে মনে অল্প একটু পরিমিতি ক’ষে নিয়ে বললাম, আর ঠিক আধ ঘন্টা বাকি। কিন্তু এখন আমাদের আর কী-ই বা করার আছে!

আছে অনেক কিছু। বুন্নিদির অ্যাডমিট কার্ড আমি গতকালই দেখেছি ওর হাতে। নিশ্চয়ই ওই ঘরের মধ্যে কোথাও….। বিবিল যেন কুকুরের তাড়া খেয়েছে, শরীরটা এমন ছোট্ট করে ছুট দিল দত্তবাড়ির দিকে। দিশা চেঁচিয়ে বলল, “ঝামেলা মিটল কিনা বিকেলবেলা এসে জানিয়ে যাস”। তারপর আমার দিকে চোখ পড়তে থতমত খেয়ে ক্যাবলার মতো হাসল, “আপনিও আসবেন, কাকিমা”।

কিন্তু সেসব দেখার সময় নেই এখন। প্রাণপণ দৌড়ে বড়রাস্তা লাগোয়া কচুবাগানের কাছে ধরে ফেললাম বিবিলকে। তোর কি মাথা খারাপ হল যে মানুষকে সাহায্য করতে ছুটছিস! ওরা এক্ষুনি বুঝতে পেরে যাবে আমরা বাংলা ভাষা জানি। তারপর বাকি জীবন কুকুর হয়ে কাটাতে পারবি তো?

একটা অ্যাডমিট কার্ড খুঁজে দিলাম, আর এতকিছু ঘটে গেল!

শোনো, তোমারই মতো বোকা একটি সারমেয় মানুষের কথা শুনে একবার শুধু আহ্লাদে লেজ নেড়ে ফেলেছিল। বাকিটা ইতিহাস। এখন কুকুরদের সারারাত জেগে বাড়ি পাহারা দিয়ে আবার ভোরের আলো ফুটতেই বাড়ির বুড়োবুড়িকে মর্নিং ওয়াকে নিয়ে ছুটতে হয়। তারপর সকালের খবরের কাগজ মুখে করে নিয়ে আসা থেকে বাজারের ব্যাগ বওয়া, দুপুরে বৌদি ঘুমোলে বাচ্চার নজরদারি, দুবেলা বাড়ির ছোটদের সঙ্গে ফুটবল প্র্যাক্টিস —এসব তো আছেই। রেডিও-টিভিতে, সিনেমায়, এমনকি মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপনে পর্যন্ত খাটছে কুকুর, অথচ কোনও কুকুরের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির লিস্টিতে একটা নোকিয়া বা স্যামসাং বা এলজি-র চোদ্দশো টাকার সেট-ও খুঁজে পাওয়া যাবে? আর, সবচেয়ে দুঃখের কথা কী জানিস? পুলিশ-মিলিটারিতেও কুকুর গিজগিজ করছে। মানুষ নিজের কাজ করাচ্ছে কুকুরকে দিয়ে।

আবেগে চোখে জল এসে গেছিল। বিবিল পেছনের দরজা দিয়ে দত্তদের ঘরে ঢুকে তক্ষুনি বেরিয়ে এসে বলল, কেন, ওরা মোটা মাইনেও তো পায়? তাছাড়া কুকুর কতো বিশ্বাসী প্রাণী সেটা বল? পেট ভরা থাকলে রান্নাঘরে ঢুকে খাবারে মুখ দেবার কু-স্বভাবটা নেই।

শুনে মেজাজ এত গরম হয়ে গেল, বাঁ হাত তুলে ওর মাথায় এক থাবা বসালাম, “জিভ খসে পড়বে নিজের জাতের বদনাম করিস তো। আমাদের দেবতা বেড়াদাস বলেছেন, চুরিই হচ্ছে খাঁটি বেড়ালধর্ম। বুঝলি ইঁদুরটা!

“আমার অতশত বুঝে-সুঝে কাজ-টাজ নেই। বুন্নিদি আমাকে ভালোবাসে। দিদি পরীক্ষা দিতে না পারলে খুব কষ্ট হবে, ব্যাস।”

দেখলাম, বিবিল দত্তভিলার পেছন দিকটায় চলে গেল। তার মানে পেঁপে গাছ বেয়ে ছাদে উঠে স্টোররুমের ফোঁকর গলে দোতলায় ঢুকে তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামবে। যে মানুষ ওকে ঘরে ঢুকতে দেখলেই তাড়িয়ে দেয়, উনি চললেন তাদের উদ্ধার করতে। হুঁহ্‌!

ছেলে
শুনেছি, এর আগে তিন দফায় আমার মোট পাঁচটা দাদা-দিদি হয়েছিল। মা তখন যে বাড়িতে, সেই হালদারবাবুরা আড়াল দিলে ওরা হয়তো শেয়ালের পেটে যেত না। তারপর থেকেই মা একটু মানুষ-বিরক্ত। যাহোক, অনেকদিন পরে স্টোররুমে ঢুকে অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। এই ঘরই আমার জন্মস্থান কিনা! ওই তো সেই প্লাইউডের বাক্স যার মধ্যে খেলা করে আমার “বৈশব” (বেড়ালের শৈশব আর কি) কেটেছে। কিন্তু পুরনো খবরের কাগজ লাট করে রাখার জায়গাটা যেন কোথায়?

বুন্নিদির খাটের ওপর বইপত্র আর খবরের কাগজ নিয়ে পড়তে বসার ওভ্যেস। অ্যাডমিট কার্ড বইয়ের সঙ্গে উঠে গিয়ে থাকলে এতক্ষণে শেলফ ঘেঁটে খুঁজে পাওয়ার কথা। কিন্তু রাঁধুনি নিরুমাসি বা অন্য কেউ যদি পেপারের সঙ্গে তুলে ফেলে? কাগজের স্তূপ থেকে এক একটা করে কামড়ে নামিয়ে ফের মুখে তুলে ঝাঁকাতে লাগলাম। নাহ, কিচ্ছু নেই, শুধু ধুলোয় গা-মাথা ভরে গেল। হঠাৎ মনে হল, নতুন কাগজের ডাঁই হলে তো এত ধুলো জমার কথা নয়! দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছি, বুন্নিদির গলায় চাপা কান্নার আওয়াজ! ইস, মা মারা যাওয়ার পর আমাকে তুলোয় করে দুধ খাইয়ে বাঁচিয়েছে যে, সেই দিদিটার জন্যে কিছুই করতে পারব না!

ঠিক এমন সময় সিঁড়ির ঠিক নিচে গৌরীকাকুর সাইকেল আর গ্যাস সিলিন্ডারের মাঝখানটায় চোখে পড়ল, আরও কিছু খবরের কাগজ ভাঁজ করে সাজানো, আর তার প্রথমটা ধরে টান দিতেই নিচে থেকে বুন্নিদির ছবি বেরিয়ে এসেছে। অ্যাডমিট কার্ড মুখে করে ছুটতে যাচ্ছিলাম ও-ঘরে, মনে পড়ল মা-র সাবধান-বাণী! আমাদের ধর্মগ্রন্থ (পড়ব পড়ব করে আর পড়া হয়ে ওঠেনি) “বেড়াভাগবতে” নাকি লিখেছে, বেড়ালের বুদ্ধির কথা জানতে পারলে মানুষ তাদের রকেটে করে মহাশূন্যে পাঠিয়ে দেবে। আর সেখানে তাদের গায়ের লোম ঝরে গিয়ে চেহারাটা ঝাঁটার শলার মতো হয়ে উঠলে নিজেরাই নিজেদের তেলাপিয়া মাছের কাঁটা ভেবে খেয়ে ফেলবে তারা। আমি অ্যাডমিট কার্ডের ওপরে বসে পরিত্রাহি চেঁচাতে লাগলাম। গৌরীকাকু এসে “সোবাতাং জিয়াও মুনি” (বাড়ি মাথায় করেছিস কেন?) বলে ঝুলঝাড়ু দিয়ে জোরসে পিঠের ওপর একখানা কষিয়ে দিল। কিন্তু ভয় পেলে সাহসের কাজ করা চলে না। আমি চিৎকারের ভল্যুম বাড়িয়ে দেওয়ামাত্র শুনতে পাচ্ছি তরুকাকিমার গলা, “বেজিনা লুসিও। পিং সে কাই অরন তুদা।“ (তুমি পারবে না। গায়ে জল ঢেলে দিলে ও শায়েস্তা)। এই রে, পরীক্ষার প্রবেশপত্রও যে ভিজে সপসপে হয়ে যাবে! তরুকাকি এলে তেড়ে যাব কিনা ভাবছি, বুন্নিদি এতক্ষণে সিঁড়ির ঘরে ঢুকল — “সব সময় একটা অবলা জীবের পেছনে লেগে আছো কেন! সকালে খেতে পায়নি বলে চিৎকার করছে সেটাও বুঝলে না?”

“ইচিদং ত্রামে সোহা” (তোর জন্যেই এটা মাথায় উঠেছে) বলতে বলতে দুজনে বেরিয়ে গেলে আমি মেঝেয় পড়ে থাকা অ্যাডমিট কার্ডটার চারপাশে পাক খেতে লাগলাম। বুন্নিদি তক্ষুনি লাফিয়ে এসে কাগজটা তুলে নিয়ে একদম অবাক হয়ে গেছে। “কোথায় পেলি এটা? এত বুদ্ধি তোর! এবার তো সিসিল বলে ডাকতে হবে ওস্তাদকে, মানে চালাক-চালাক-লম্বা! আমার কিন্তু প্রথম থেকেই সন্দেহ হত বাংলা ভাষাটা তুই কব্জা করে ফেলেছিস…হ্যাঁ রে, হাঁ করে দেখছিস কী?

আমার মাথার অনুবাদ-যন্ত্র ঘুমিয়ে পড়েছে। বুন্নিদির কথা শোনামাত্র বুঝে ফেলছি আমি। তার মানে মানুষই হোক, বা পশু-পাখি বা গাছপালা, ভালোবাসার ভাষা সবার বেলাতেই এক। একজনের মুখ ফুটলেই আরেকজন টের পেয়ে যাবে। এমনকি উচ্চারণ করারও দরকার নেই। যেমন বুন্নিদি এখন আমার গলায় সুড়সুড়ি দিতে দিতে মনে মনে বলছে, কিন্তু তুই ইংরিজি কী করে শিখলি, বিবিল? নিশ্চয়ই তোর সেই শ্রীলংকান বান্ধবীর কাছে!

(পুরনো গল্প) বোকা বোকা লম্বা

(পুরনো গল্প) বোকা বোকা লম্বা

মা
শীতের সকাল। বারান্দায় গ্রিলের পাশে আমি চমৎকার রোদে ব’সে আছি। না না, রোদ্দুরটি সুন্দর তা বলিনি কিন্তু। চমৎকার আমার নাম, এ-গল্পও এক বেড়াল-ফ্যামিলির।

আজ মানুষের রোববার, কিন্তু বেড়ালের ক্যালেন্ডারে লেখা, “দেরিতে ব্রেকফাস্ট”। মনুষ্যজাতির মধ্যে যারা অফিসবাবু, ছুটির দিনে আটটার আগে তো বিছানা ছাড়েন না। আর সেই জন্যেই এখনও পর্যন্ত বিবিলের দেখা নেই, পাড়া টহল দিতে বেরিয়েছে। বাচ্চা মানুষ, স্যরি বেড়াল, খিদেও বেশি।

তবে শুধু বয়েসের দোষ দেব কেন, বিবিলের ফিগারটাও মাথায় রাখা দরকার। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কসরত করতে গেলেই তারা আমার কাছে এসে কমপ্লেন ঠোকেঃ তোমার ছেলেকে সামলাও। আমরা সব তিন কেজি বিভাগের কুস্তিগির, অথচ বিবিল সাড়ে পাঁচ কিলো চেহারা নিয়ে লড়তে আসছে। আমাদের ঘাড় মটকে যাবে না!
মনের এই হতাশায় বেচারা আরও বেশি মানুষ-ঘেঁষা হয়ে পড়েছে। আমাদের আস্তানা, মানে এই দত্তবাড়ির ছোট মেয়ে বুন্নি-র ল্যাপটপের দিকে সারাক্ষণ হাঁ ক’রে তাকিয়ে ব’সে থাকে। বুন্নি গেমস খেলতে খেলতে হয়তো জিগেস করল, “বল তো এবার কোন বাটনটা টিপতে হবে?” ওমনি সে উঠে যেতে গিয়ে অ্যাত্তোখানি পায়ের থাবায় ভুল বোতাম প্রেস ক’রে দেয়। বুন্নি হেসে ফেলে, “ তুই একইরকম থেকে গেলি, বোকা বোকা লম্বা, সংক্ষেপে বি বি এল, মানে…উঁ উঁ…আমার বিবিলসোনা।
………….
গল্প থামিয়ে চমৎকার উলটো দিকে ঘুরে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়ল। তারপর পাঁচিলের ওপর দিয়ে এক দৌড়ে রান্নাঘরের সামনে। আজ এতো সকাল সকাল গ্যাস ওভেনে চায়ের জল চাপানোর শব্দ শোনা যায় কেন? এবার একটু পেছনে হেঁটে সে জানলা দিয়ে মুখ বাড়ায়। এটা বুন্নির ঘর। মেয়েটাও নেই বিছানায়। হয়তো কাল রাতে দোতলার স্টাডি রুমে আলো জ্বালিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। দেয়াল-ঘড়িটা উল্টো দিকের দেয়ালে, দেখা যায় না। কিন্তু ঘন্টা পড়ছে। চমৎকার গুনতে লাগলঃ আউ, সাউ, চিন কিত, অন্তা, মিউ, পার…। হা ভগবান, সবে সাতটা বাজে! টোস্টের কয়েকটা পোড়া টুকরো, তিন-চারটে বিস্কুট, কিছুটা ছানা, ডিমের কুসুম একটুসফোঁটা — এইমাত্র সকালের খোরাকের জন্যে আরও দেড়টি ঘন্টা চুপ ক’রে ব’সে থাকা পোষায়, বল তো!

ছেলে
আমার মা যেদিন মারা যায়, এ-পাড়ার সব মা-বেড়াল গোল হয়ে আমাকে ঘিরে ব’সে ছলছল চোখে মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি তাদের মধ্যে চমৎকারের কাছে গিয়ে ওর কোলে মাথাটা গুঁজে দিই। সেদিন থেকে চমৎকারই আমার মা, আর এই গল্পটাও আমরা মা-ছেলেতে মিলে-মিশে বলব।
যাই হোক, পাড়া ঘুরে দত্তবাড়ির পেছনের পাঁচিল টপকে নিমগাছের ডাল থেকে একলাফে নেমেই থতমত খেয়ে দেখি, ঠিক সামনে গৌরীশংকর দত্ত। কিন্তু আজ তার আমাকে তাড়া দেওয়ার মেজাজ নেই, জলের পাম্পের পাশে বাতিল কাগজের ঝুড়িতে কী একটা খুঁজতে ব্যস্ত। পেরিয়ে যেতে যেতে শুনলাম, চেঁচিয়ে বলছেন, “আরিয়ান্তোসে ইকড়িমিং চাউতা”। না না, গৌরীকাকু বাংলাতেই বলেছেন কথাটা, কিন্তু আমরা বেড়ালরা তো আর বাংলা জানি না, বলি না, বা বুঝি না। অথচ আমরা বেড়ালরাই আবার পৃথিবীর সব ভাষাই জানি এবং বুঝি। আসলে বেড়ালের মস্তিষ্কের কোষে এমন এক অটোম্যাটিক অনুবাদ ব্যবস্থা রয়েছে যাতে যে কোনও ল্যাঙ্গুয়েজ বেড়ালের নিজস্ব ভাষা “মার্জারিক”-এ পালটে যায়। শুধু তাই নয়, মানুষ কোনও শব্দ উচ্চারণ করলেই তার মার্জারিক অনুবাদ মস্তিষ্ক থেকে স্পষ্ট উচ্চারণে আমাদের কানে পৌঁছোবে। ঠিক যেন মেট্রো রেলে ঘোষণা হচ্ছে, “অগলা স্টেশন গিরীশ পার্ক”। যাই হোক, “আরিয়ান্তোসে ইকড়িমিং চাউতা” মানে হল, কাগজটা তো এখানেও নেই।

রোববারের সাত-সকালে বাড়িসুদ্ধ লোক উঠে পড়ে কী খুঁজছে তাহলে? ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নেব ভাবছি, আমার মা রান্নাঘরের জানলার নিচ থেকে ঠোঁট চাটতে চাটতে বেরিয়ে এল। এসেই যথারীতি বকুনি, “কোথায় চরতে গেছিলি, হতচ্ছাড়াটা? এখন বেলা দুটো পর্যন্ত খালি পেটে ঘুরে বেড়াও গে”। তারপর গলা নামিয়ে বলল, “বুন্নি আর ওর বাবা কলকাতায় যাবে। মেয়েটার কী যেন পরীক্ষা আছে”।
—রবিবারে পরীক্ষা!
— তাই তো বলল, “ইগুতিনো আঙরাসু চিয়াং ডলুমি”। কিন্তু বুন্নি “আডমিটিকার” খুঁজে পাচ্ছে না ব’লে হুলুস্থুল। সে আবার কী জিনিস রে!
আমিও তো জানি না। মনে হচ্ছে, শব্দটা গ্রীক বা ইতালিয়। মুশকিল হল, আমাদের ব্রেইন এখনও ততো উন্নত হয়নি ব’লে কেউ দুটো ভাষা মিশিয়ে কথা বললে শুধু প্রধান ভাষাটার অনুবাদই কানে পৌঁছোয়।

…………
কিছু ক্ষণ চুপচাপ দুই থাবার মধ্যে মুখ লুকিয়ে বসে থাকল বিবিল। তারপর হঠাৎ গা-ঝাড়া দিয়ে বারান্দার গ্রিলের ফাঁক গ’লে উঠোনে লাফিয়ে পড়ে তীরবেগে ছুট। “আবার কোথায় আড্ডা মারতে চললি?” ব’লে তার পেছনে হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়ল চমৎকারও।

(আরেক পর্বে শেষ)

গল্পছড়া : দ্যাখো সে বাঙালি দুর্গ

গল্পছড়া
দ্যাখো সে বাঙালি দুর্গ

শুরুতে সবারই মতো এক টুকরো মাটি কিনেছিল
বাউন্ডারি দিতে এসে চা-বিস্কুট পড়শির বাড়ি
তারপর একতলা, সন্দেহ করিনি একতিলও
শিউলি-করঞ্জাগাছে টিয়া এসে বসতো অভিসারী

পাখি বাড়ি নোংরা করে, সেই দোষে গাছ শাস্তি পাবে?
যত সূর্য বন্ধ ছিল, ঝাঁপ দিয়ে নেমেছে পাড়ায়
ঘাসে পোকা — উঠোন বাঁধানো হল ঘোড়ার রেকাবে
আলোর আগুনে হেঁটে পৃথিবীর মুখ ঝলসে যায়

বাড়ি মানে বেড়ে চলি, গ্যারেজে গিজারে মোজেইকে!
দেড়-মানুষ দরজায় হাত ছোঁয়ালে বাজ ঘন্টি বাজ
সমস্ত জোনাকি খুন — টুনিবাল্‌ব ঘিরেছে নেই-কে,
স্থলদস্যু ট্যাটু আঁকা থমথমে ভূমধ্যজাহাজ

অথবা বাঙালি দুর্গ! আলসেতে বেড়াল হাঁটে না
বসতে গিয়ে জিভ কেটে উড়ে যায় শিমূলের তুলো
গোয়ালা ডাকল — দুধ, মাছওলা জলের দরে কেনা
দুটো রুই দিয়ে যাবে, বারান্দায় বিয়েচিঠিগুলো…

শুনতে পাচ্ছে না গলা, কোন ঘরে ব’সে অকাতর,
লোকটা হারিয়ে গেছে সীমাহীন বাড়ির ভেতর

গল্পছড়া : বেড়াল-পাখি

গল্পছড়া : বেড়াল-পাখি

তিনটে পুষিবেড়াল, তাদের সটান রোগা মা,
তিনি ঝাঁপান কোলে তো পুচু-রা টানে হামা
একটা ঝুঁটিশালিখ — সবাই ‘গ্রামসেবক’ই ডাকে
“থাকবি কুথা? — কাঁঠালপাতা পেয়ারাপাতাকে।”

টেলি-র তারে ব’সে সে দেয় বন্ধুকে মিসড কল
“ব্যাক করেনি? শুকোচ্ছে প্রেম! করুণাধারায় চল…”
ব’লে রাখলাম ভাঙা বিস্কুট আধখোলা জানলায়
দুধের পাউচ উপুড় হল বিল্লিমাতার পা’য়

এমনি ক’রেই রানার ছোটে, কাটতে থাকে দিন
আজ বেড়ালি দুগ্ধবিমুখ, ত্বকের যত্ন নিন —
চাটছে নিজের হাত-পা; কিন্তু শালিখসোনা কই!
মেঘভেজানো গাছের মাথায় শোঁ-হাওয়া কাঁকই…

হঠাৎ তাকাই মেঝেয় — দেদার ছেঁড়া পালক! ভ্রম?
তাসের মতো ছড়ানো আর ঠোঁটমতো নরম…

কান্না শুনে ছি ছি করছে মুখচেনা মৌসুমী
এক জীবনে মাংস ও দাঁত পুষতে গেছ তুমি!

কনুইয়ে সূর্য

কনুইয়ে সূর্য

— সারা পৃথিবী টাইট হয়ে গেছে
জামার হাতা ছোট, সাবানে কেচে।
ঘরে ঢুকতে দরজা-ছ্যাঁচা খাচ্ছি
খাটেও শরীর আঁটছে না গো, সচ্চি!
সেদিন বেড়াতে গেলাম হাসপাতালে
আমি আর তুই দুই চড়মাতালে
টি কর্নারে চুমুক দিচ্ছি চা’য়
আহ, পেশেন্টও ধাক্কা মেরে যায়!
ফেরার ট্রেনে এগিয়ে এল দেয়াল
হাতে ঘষটা খেলাম বেখেয়াল

— তার মানে তুই মুটিয়ে গেছিস, ছোঁড়া?
— কনুইয়ে সূর্য উঠেছে রে —বিষফোঁড়া!

গল্পছড়া : নভোনীলচাঁপা

তোমাদের হ্যাপি ন্যু ইয়ার
লেখা হয় বরফাক্ষরে
যদি না খোলো শ্যাম্পেন
যিশুবাবা হেবি রাগ করে

যদি না করো এনজয়
সারারাত যে-রাত জাগে
ওদিকে বুড়ো বেডরুম
টুক ক’রে ঠান্ডা লাগে

ভিখিরি ব্রিজের তলায়
উন্মাদ যেখানে খুশি
প’ড়ে কাঠবৎ আচরণ
বুকে বেঁধা শীত-আলকুশি

তোমাদের নব জানুয়ারি
আমাদের মাথার ছাদে
(সেন নীরেন অশ্রুকুমার)
ফুটো করে কী আহ্লাদে!

বাঙালি তো সূর্যসেনা
বাঙালি সূর্যঘেমো
যদি গলা শুকিয়ে আসে
চাঁদপুর মেলায় নেমো

কাল গেছে নীলের উপোষ
রাত্তিরে সাবুদুধমাখা
আজকে চড়ক-বাণে
ঝ’রে পড়ে আশমানচাঁপা

মাঠে ক্ষেতে অন্ধকারে
শোয় মানুষ আর অরণি
ভোরে মাথা গুনতি করো
একটাও কম পড়েনি

আমাদের নতুন ধারণ
অসু, চেত, আনন্দসাধ
বোশেখের পয়লা দিনে।
কিছুদূরে রবীন্দ্রনাথ…