চন্দন ভট্টাচার্য এর সকল পোস্ট

জ্যোতির্ময় অসুখেরা

(চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রণাম
যারা প্রতিদিন প্রাণীকুলের প্রাণ বাঁচিয়ে চলেছেন)

এক
বড় বড় গাঢ় কোঠাবাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখেছে অসুখেরা
বেদনার হাত ছাড়িয়ে আমাদের বেদানার দানায় নিয়ে তুলছে
এক একটা রোগশয্যা হাজার সুস্থকে আলো দেখায়
আর ভিড়ের ভেতর দিয়ে কেটে পড়তে পড়তে সময়
মানুষের পকেটে রেখে যাচ্ছে ফাটাফাটা নিয়তিমুখ

দুই
অসুখ একটা মাকড়সাজালের সেতু বুঝে নাও
ফ্রিজের সঙ্গে জুড়েছে ইঞ্জেকশান অ্যাম্পুল
অসমিয়া দাঁতের সঙ্গে তামিল সিনেমার হাসি
আবার, অনুগ্রহপূর্বক-এর পাশে নীরবতা-কে
বসিয়ে দিচ্ছে থমথমে বিবাহবার্ষিকীতে

আমার ডানদিকে একটা রাতচরা কাশি
তো বাঁয়ে স্যাট করে পর্দা টেনে দেওয়া সংকটের মুখের ওপর –
“বিপি পাওয়া গেছে? অ্যাট্রোপিন কোথায়!”
হলদিঘাটের বাংকারে মাথা গুঁজে লিখে যাচ্ছি এইসব :
কোনটা হাহাকার, কোনটা মেশিনের বিপ,
কোনটা বিদেশি পুঁজির হাতে ব্যাংক তুলে দেওয়া
বুঝতেই পারছি না

ভিজে বিছানার ওপর টগবগ করছে রুম ফ্রেশনারের ফুলকি

তিন
আপনাকে এক্ষুনি ঘুমের স্যুপ দেওয়া হবে
আপনাকে এক খনি দেওয়া হবে লৌহ আকরিক

দেয়ালঘড়ি বেয়ে জীবনে এলাম
আমি শান্ত টিকটিকি
অথচ অনেক বেশি সময় লাগছে পেন্ডুলামে
ঝুল হয়ে জমে যেতে
ভেন্টিলেটরই মন্দির, তার ঘন্টা সারারাত
গায়ে লেখা: যন্ত্রণা সেভাবে শুরু হয়নি বলেই ওষুধব্যবস্থা টিকে আছে

চার
দিনরাত চিরঅমঙ্গলে কেটে যায়
আমি একবার বাঁদিকে প্রার্থনা করি
একবার ডানদিকে প্রার্থনা
ওই বৃদ্ধের বুক-ধুকধুকি অ্যাকাউন্ট থেকে
বাড়তি তিরিশ তুলে নাও, অর্ধেক
দান করো বেড নাম্বার এগারো-তে
এভাবে আয়ু-সমবায় গড়ে তোলো অভিযাত্রীগণ — যারা মেসোপটেমিয়া থেকে অলীক উটে চেপে
দু’বছর পরে মহাচিনে পৌঁছবে ভেবেছিলে

যদিও যথেষ্ট লড়ছেন ম্যাডাম মুর্মু
আমি একবার বাঁদিকে সেজদা করি, একবার ডানদিকে…
আমার সেজদাও এভাবে নানা নলে অস্থিময় হয়েছিল তো!
সেই তখন থেকে লম্বা মানুষ জন্ম নেয়
স্যালাইনের বোতল আকাশে তুলে ধরবে ব’লে
অক্সিজেন পদভারে কাঁপছে মেদিনী

যারা দায়িত্ব থেকে পালনের দিকে যায়
দেখি তাদের চোখমুখ সোনায় বাঁধানো

পাঁচ
যন্ত্রণায় গোঙাতে গোঙাতে লোকটা কেঁদে উঠছিল — মাদারচোদ
শব্দটায় হয়তো ওর ব্যথা কম লাগে
কিন্তু আমি অসহায়ভাবে দেখছিলাম
ঝকঝকে নার্সিংহোম সাহিত্যে অশ্লীলতা ঢুকে পড়ছে
একজন পেশেন্ট খাটের বাজুতে পা আছড়ে কেটে ফেলল
আমি দেখছিলাম তার বুড়ো আঙুলে এখনও বেগুনি নখপালিশ

লোকটা আবার ক্ষ্যাপার মতো চেল্লায় — মাদারচোদ
ভাষাঅভাবী পুরুষ, হয়তো মাকেই ডাকছে

ছয়
তৈরি হয়ে বসে আছি, এসো প্রেম
মন টিপে টিপে অনেকটা অবসাদক্রিম
বের ক’রে দেওয়ার পরেও
তোমারই পদরেণু আমি
এসো ট্রপোনিন মাপবে না!
এখানে জঞ্জালের মধ্যে দেবশ্রী ফুটে আছে
মেয়েদের স্তনেই শুধু নয়, ডাক্তারের চিজেলেও
ভালোবাসা থাকে যেন ভুলে না যাই
এসো কেশমুক্ত করো গোপন এরিয়া
আমি শুধু দ্বিরাগমনে ফিরে গিয়ে
মাসতুতো বোনকে চোখ টিপে বলব
তোর রাহুলদা ওটার কি হালত করেছে দেখবি?

সাত
নাও রক্ত। যত পারো টিভি চ্যানেল বসাও দুহাতে
ধমনীর ভেতরে ক্যাথিটার চালিয়ে চলে এসো
তোমার এইচআইভি নেই তো ক্যাথিটার?
আর তুমি কই কন্ডোম পরলে, পোর্টেবল এক্স-রে মেশিন!

অথচ সবাই সঙ্গমমাত্র পয়সা বুঝে নিয়ে চলে যাবে

নার্সিংহোম নতুন জিগোলো

আট
আজ বিভাগীয় প্রধান কবিকে স্যার বলে ডেকে দিয়েছি।
উনি খেয়াল করেননি, খুব
সংশোধনও করে দেননি কলজে — আমার দেবদাসটাকে।
“ঠিকই তো লেখেন… তবে আত্মবিশ্বাস নেই…
রাখী দাশগুপ্তকে দেখুন… আপনাদের বিজয় রাহাকে,
প্রেসার সুগার সব আছে — ওরা তো কখনও
ভয় পায় না কবিতার অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টিতে?

তিন দিনের কর্মশালা। সকালে দুটো
কবিতাপাঠের পর চাবিস্কুট
লাঞ্চ শেষ হতে আবার গোল গোল দুটো
যাতে মন একটু গড়ায়,
কবজিতে ব্লেড ঘোরালেই চট ক’রে
ভাসিয়ে দিতে পারে ল্যাপটপ

সন্ধেবেলা বিশেষ ভ্রূকুটি পাওয়া কবিদের
সেমিনারঘরে এনে কুঁচকিতে আলো প্রবেশ হ’ল, বুকের ওপরে হস্তীমুখ। তারপর মাস্ক খুলে ফেললেন কবিবিজ্ঞানী — “উঠে পড়ুন। তলপেটে দুটো ছন্দ লিখে দিচ্ছি। বাকি জীবন একদম অক্ষরে অক্ষরে…।”

যেটুকু সময়ে ব্যাগ গুছিয়ে নেবো, গট গট ক’রে ছাপা হচ্ছে আমার চার ফর্মা প্রেমের সামারি। বিকেলের আলোয় পরপর বেডে ভুল কবিদের ড্রিপ চালু হল

নয়
কোনও কিছুই ঠিক না থাকার পরেও কিছু কিছু
ঠিক থাকতে পারে আমরা সন্দেহ করছি।
সারারাত রক্ত চোঁয়ানোর পর সকালবেলা ট্রলির হাসিমুখ

কারা মৃত ফিরে গেল, প্রতিবাদে বেঁচে ফিরল কারা – তফাত বুঝতে চিকিৎসাশালায় এসে গেছি আমি রাণা প্রতাপ সিং। এমন একটা ঘড়ি পরেছি – অর্ধেক শরীরের ভেতরে ডোবানো,
আমার পায়ের ভাঁজ করা কনুই বুদ্ধিমান অথবা প্লাটিপাসের মতো ঘুরে ঘুরে দেখছে জগতকারখানা :
যদিও সবাই সবার হাতের আংটি হয়ে ওঠেনি এখানে, অসুখের সা থেকে আরোগ্যের রে পর্যন্ত গলাসাধা চলছে

ওগো সেবক সেতু, হ্যাঁগো সেবিকা সরণি,
নীল ইউনিফর্ম পরা মনে ছুটে এসো অসুখভ্রমণ বাংলোয়
মানুষের ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুতেই
চায়ের জল গরম হয় না

প্রসিদ্ধ ভূপতিচরণ রায়ে যাব এই গলি দিয়ে

  • টানা-রিকশা উড়ে যাচ্ছে কচুরিবাতাসে, তাতে
    বুলেট সিঙাড়া প্যাসেঞ্জার। বাইক শোঁ ক’রে
    কাটাতে গিয়ে গলির কনুইয়ের নুনছাল উঠে গেল
    ওমনি মেহনতি মানুষের খবরের কাগজ
    তার ওপরে পুলটিশ

    যারা লুঙির গিঁট তুলল হৃদয় পর্যন্ত, গেঞ্জি গায়ে
    রাস্তা পার হল যেন রাষ্ট্রসংঘে যাবে, যাদের
    আলোর পিপাসা দীপক মিত্তিরের কালীবাড়ি থেকে
    কেদার ঘোষের লটারি দোকান; ওদিকে ছাঁচিপান
    গালে পড়তেই গিন্নি হল যেসব কিশোরি—
    হাওয়াঠাসা গতরে তুলল এককুচি সোনার নোলক,
    তাদের গলি-জাফরিতে
    লটকন পায়রা গুড়গুড় করে

    তারা রাতারাতি নেমেছে তেমহলা থেকে
    বেড়ালশোয়া টসকানো বাথরুম চাতালে
    বিজ্ঞানের গাধা অর্থনীতির নুনের বস্তা পিঠে
    নর্দমায় পড়ে ছিল, পাশের রোয়াকে খেলে গেছে
    ইঁটের টুকরোয় ষোলো গুটি।
    তারা শুধু কথা আর নজরপট্টিতে
    জীবন অমর ক’রে গেল
    যাদের জামাই সুইসাইড-কেস, ছেলে
    সম্পর্ক রাখে না
    সেখান দিয়ে বাকি পৃথিবী
    জোর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে প্রসিদ্ধ ভূপতিচরণে

    গলিটাকে নিচু আঁচে চাপালে জিরে-মেথি এসবই
    ফোড়ন কাটবে। কান পাতবে কেবলতারের বনবীথি,
    ঝুলবারান্দায় দাঁড়ানো পেয়ারাগুচ্ছ…
    তারপর বৃষ্টি পড়ে তো ক্যারামবোর্ড বাঁচিয়ে
    আবক্ষ সূর্য সেনে পড়ে।
    জীবন শুদুমুদু ন’ড়ে বসবে কেন গো?
    সন্ধের ইমিটেশান হাওয়ায়
    গুজবের বাচ্চা আসে বেড়ালের পেটে

    [‘সন্তানপ্রণাম’ থেকে]

  • বৃক্ষা

    আমি লিখে যেন বৃক্ষাকে খুশি করতে পারি

    তাকে ডেকে এনে পুড়িয়েছি ভালোবাসামাঠের শ্মশানে
    ছাইসুর্মা চোখে প’রে লিখেছি পৃষ্ঠা জুড়ে আছাড়িপিছাড়ি

    এবার আকাশ ভেঙে উঠে যাক কিস্তিমাৎ মৃত্যুর মানে…

    [‘সন্তানপ্রণাম’ বইতে আছে]

    কুঞ্জভঙ্গ

    আমাদের খেলা ধ্বংস করে দেওয়া বৃষ্টি আজও আসে
    জামার ওপরে জামা, তারও আগে জানলা বন্ধ ক’রে দিই;
    গ্রহটির কষ্টের নিঃশ্বাসে —
    আষাঢ়-ঝাপটা লাগে। শুকনো গামছা মুছে দাও
    পৃথিবীর সমস্ত পা পথে ও প্রবাসে
    আমাদের আলো ধ্বংস ক’রে দেওয়া বৃষ্টি আজও আসে

    আকাশ পাথর ছোঁড়ে — শালগ্রামশিলা
    হাতে নিয়ে ব্রাহ্মণের বাক্যরোধ হয়
    আজ যদি অধিবাস, পরশু হবে কুঞ্জভঙ্গ এই অছিলায়
    মুখ থেকে জিভ নয়, উলু খ’সে যেতে থাকে। গ্রামের মেয়েরা
    বিদ্যুৎজোনাকি যেন — একই দীপ্তি, শব্দ সেই এক সসাগরা!
    জয় বলো গৌর অঙ্গে, কৃষ্ণ অঙ্গে বলো জয়…

    এই আলো-অন্ধকারগুলো ছেড়ে দিয়ে
    এই ছেড়ে জীবনে-মরণে অন্ত্যমিল
    কোথাও কোকিল ডাকলে আমরা তার কুহু-তে সামিল
    ওই ডানাসেচ থেকে ফুটে ওঠা দুঃখ পিয়ে মৃত্যুশোক পিয়ে
    ভেবেছ নীলাক্ত হবে আকাশ মেঘের অবকাশে?
    আমাদের লেখা ধ্বংস ক’রে দেওয়া বৃষ্টি আজও আসে

    সন্তানপ্রণাম … চার

    ভোর সাতটার জামরুলতলা, কী খুঁজছে দুধ-খরগোশ!
    জবাব যে জানে রাত করে শোয়, ডেকে দি’ দাঁড়া — নিসর্গ?

    ধূপকাঠি-ছেলে, জিয়ল মাছের ঝোল খাক রোজ দুপুরে
    কান্না থামবে, তবেই না খাওয়া! ছেড়ে এসো মাছ পুকুরে…

    মাঠপথে হাঁটি ঘাস না মাড়িয়ে — কাঁহাতক বলো পারা যায়?
    “দেখে দেখে চলো বাবা, ওরা ছোট, চিৎকার ক’রে মারা যায়”

    রেজাল্ট বেরলো, নিচু নাম্বার, সান্ত্বনা দেব — তৈরি।
    একগাল হেসে: “ফার্স্ট কে, শুনেছ? ভীষণ বন্ধু গৈরিক!”

    এখন জোফার, রিফ্যামপিসিন, পেনিসিলিনের বদলে
    ওকে প্লেটো-হিনি-জয়েস-দেরিদা পাহারা দিচ্ছে সদলে

    আয়ু-খরগোশ লাফিয়ে উঠল ডাল থেকে পাতা — বৃক্ষের,
    নি-সা-রে-গা — তুই আখরের সুর, তোর আলো করি ভিক্ষে…

    সন্তানপ্রণাম

    অধ্যায় : সাত

    বাবাকে যে-কোনও সংখ্যা দিয়ে ভাগ করো
    একদলা ভাগশেষ থাকে —
    ইলিশমাছের তেল অথবা জলপাই চাটনি দিয়ে মাখা;
    শূন্য করে আনা যায় না কোনও বাবাকেই।
    বন্ধু নেই, কিডনি নেই, তবু ঢলঢলে ফুলপ্যান্ট
    ছেলেবৌ আনবে ব’লে চৌরাস্তায় এগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে
    যত কথা তার চেয়ে গলা খাঁখারি বেশি
    ড্রাইভারের পাশে ব’সে ভুল পাড়ায় গাড়ি ঢুকিয়ে দিল

    এই সব বাবা প্রেসার কুকারে টানা সিটি মারলেও
    সেদ্ধ হবে না
    গায়েব হয়ে যেতে পারে কিছুদিন আইসিইউয়ের ভেতর
    শরীরে বারোটা নল, ছাদে তাকিয়ে চাঁদ খুঁজছে মহাকাশচারী…
    বাবাই যে একঘেয়ে পৃথিবীর দাঁড়-টানা পাখি, কলমে সামান্য কালি
    অথচ গল্পের অসীম কিস্তি জমা দিতে হবে —
    সেটা কেউ তাকিয়ে দেখেছে?

    দেখেছে সম্পর্ক — তাকে শিয়ালদায় ঢেলে-বিক্রি
    দিস্তেখাতা বলে,
    আস্তে লিখলে দাগ পড়বে না
    জোরে লিখলে পাতা ছিঁড়ে যায়।
    মেয়ে বিয়ের পর থেকে লোকটা আর কারও সামনে
    চশমা খোলেনি
    তারপর রাতের দোতলা থেকে নেমে আসতে গিয়ে
    দুটো হাত মনমরা ইনহেলার, জলের বোতল…
    নিজেরই গ্রন্থিত সিঁড়ি অন্ধকারে ধাক্কা মেরে
    তিন ধাপ গড়িয়ে দেয় ঝুনো নারকোল,
    রিক্ত অতিরিক্ত হয়ে ফাটে

    ভাগশেষ রক্তদলা মুছে দিয়ো সকালের আলো

    অতিপর্ব

    আজ দশ বছর পর তোমাকে দেখতে পেলাম
    একটা হাই তুলতে গিয়ে
    এক দশক আমি রেড সিগন্যালকে নিয়তি আর
    ট্র্যাফিক পুলিশকে দেবতা মেনে ঘুরে বেড়িয়েছি রাস্তায়
    তোমার অফিসের উল্টোদিকে গুটখা দোকানদারের
    তিন মেয়ের নাম বেছে দিয়েছি অভিধান দেখে
    আর এই গোটা সময়কালে আমি মূলত হাই তুলে গেছি
    কোটি কোটি নানা সাইজ আর মনোভাবের হাই
    ঘড়ি ধ’রে ওষুধ খাওয়ার মতো
    চারপাশ দিয়ে জীবনযাত্রা উড়ে যাচ্ছিল বিমানযাত্রা হয়ে — উঁচু অনিশ্চিত,
    আর আমি মেসার্স অতীতকাল অ্যান্ড সন্সের
    প্রধান দরজার তাকিয়ে ভাবছিলাম, যে ফিরে আসে
    সে হয়তো বাঁচে না, কিন্তু যে বেঁচে থাকে সে তো ফিরে আসেই

    দিনগুলো হেডলাইন না নিয়ে আসতো
    রুবি হাসপাতালের মোড় থেকে শুরু হয়েছিল প্রায়শ্চিত্ত
    তবু যতবার মাটি খুঁড়ে অতলস্পর্শে যেতে চাই, কোদালের আগায় ঠং ক’রে লাগে নিজের করোটি। ন্যায় থেকে অন্যায় খুলে নেওয়া
    মানে ধড় থেকে মুন্ডু আলাদা করা — বুঝে
    আজ থেকে আজ পর্যন্ত আমি চুপ ক’রে আছি, আর
    চারদিকে আলো লোহা হয়ে যাচ্ছে
    কবিতার বই থেকে একটা-দুটো ইঁদুর লাফিয়ে পড়তে পড়তে দু’মলাটের মধ্যে
    একপাটি বাঁধানো দাঁত ছাড়া কিচ্ছু নেই

    দশ বছর পর আবার নক্ষত্রের অতিপর্ব তৈরি করছি
    জামরুলকুঁড়ির ভেতরে; তোমার নেমপ্লেটের পাশে
    ম্যাটাডোর-ভর্তি ক’রে নিয়ে যাচ্ছি নিজের ঠিকানা
    কাল থেকে দুজনের একই পুজোকমিটি, এক কেবলভাড়া, এক রাস্তায় জমা রোদ্দুর। ভাবতেই শিহরণ হচ্ছে তোমার অটো থেকে
    আমি খুচরোর অভাবে নেমে গেলাম…

    [‘সন্তানপ্রণাম’ বইতে আছে]

    শত্রুই ঈশ্বর

    আমরা জানি বাঁচতে গেলে বেশির ভাগ মানুষের যতখানি বন্ধু লাগে, ততটাই শত্রুর দরকার হয়। নিজেকে ভালো বা ঠিক প্রমাণ করার আগ্রহ আমাদের অপরিসীম, এবং ভালো-খারাপ একটা তুলনামূলক বিচার। কাজেই, এই ‘আমি’টি অন্যে খারাপ প্রমাণিত না হলে নিজের ভালোত্বকে প্রতিষ্ঠা করতেই পারবে না। খারাপ কখন শত্রু হয়ে যায়? এমনি এমনিই হয়, অথবা যখন সে নিজের কথা বলে। আমাদের সহজ শত্রু কে? যার আমার চেয়ে আলাদা গায়ের রঙ, ভাবনা, ভাষা, জাত, ধর্ম, রাজনীতি…। এই ‘ভিন্ন’ লোকজন, মানে যাদের সে তলিয়ে চেনে না এবং চিনতে চায়ও না, তাদের পাশ কাটিয়ে বেশির ভাগ মানুষ নিজেরমতো-দের সঙ্গে থাকে। মজা হল, উল্টোদিকে যে তার সঙ্গে মেলামেশা করতে রিফিউজ করছে, তাকেও শত্রুপর্যায়ের ব’লে ধরে নেয়।

    আমরা আমাদের উন্নতির জন্যে নিজের ধর্মের ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, পুজো দিই; কিন্তু নিজের সমস্যা বা অবনমনের জন্যে কখনও ঈশ্বরকে দায়ি করি না। দায়ি করি মানুষকে, আমার শত্রু মানুষকে। সেদিক থেকে, শত্রু = ঈশ্বর।

    সাফল্য খুঁজে না পাই যদি, তবে শত্রু খুঁজে পাওয়া দ্বিতীয় সাফল্যের মতো। এতে মন সক্রিয় হয়, উদ্দীপনা ফিরে আসে। কোনও রাজনৈতিক দল বা ধর্মীয় গুরু যদি বলে দেয়, এই লোক বা এই সম্প্রদায়ের জন্যে তোমার চাকরিটি হচ্ছে না, তার মানে সেই দল বা গুরু আমাকে ইষ্টসিদ্ধির দরজায় দাঁড় করিয়ে দিল। অর্থাৎ, শত্রু = সফলতা। (“বন্ধুত্ব করে সাফল্য অর্জন করুন” এই প্রতিশ্রুতি আপনি শুধু এসকর্ট সার্ভিসের বিজ্ঞাপনেই দেখতে পাবেন)।
    শত্রু না থাকলে কার মাথায় নিজের ব্যর্থতার বোঝা চাপাবো, অথবা, কে হবে আমাদের ক্ষমতার সিঁড়ি!

    এন-ব্লক বা চাঁই হিসেবে শত্রু খোঁজার ইচ্ছেই মানুষকে অবমানব করে তোলে — ধর্মে হোক, কি রাজনৈতিক দর্শনে। যখনই সে কোনও ব্যক্তিকে দেখছে, ভাবছে কোন চাঁইয়ে বসাবো — শোষক, শোষিত, নারীবাদী, মৌলবাদী, দেশভক্ত, দেশবিরোধী, তৃণমূল না সিপিএম…? তারপর নিজেরটা বাদে অন্য সব চাঁইয়ের বিরুদ্ধে অ্যাকশান শুরু করো। গত কয়েক বছর আমাদের দেশে সবচেয়ে আলোচিত ব্লকের নাম মুসলমান। ভারতবর্ষের সব অসুখের কারণ হিসেবে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে চরম গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। এভাবেও বলা যায় যে, এই মুহূর্তে ভারতীয় হিন্দুরাই হল মুসলিম সম্প্রদায়ের জনপ্রিয় ব্র‍্যান্ড অ্যাম্বাসাডার।

    আমরা ধর্ষক বা হত্যাকারীর নাগরিকত্ব মুছে দিতে চাই না। সংখ্যাগুরু শ্রেণীর লোক অপরাধে জড়ালে দেখতে যাই না তার ধর্ম। অথচ একই কাজের জন্যে সংখ্যালঘুর সঙ্গে তার কমিউনিটিকে জুড়ে দিই। ফলে যে স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে তা হল : একটা সম্প্রদায় সামগ্রিকভাবে বেআইনি কাজে, রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধাচরণে এবং স্বাভাবিক জনজীবনকে ধ্বংস করার চেষ্টায় গোপনে ও খোলাখুলি নিযুক্ত আছে।

    এটা সামাজিক স্কিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ। ক্রাইমের পেছনের আর্থসামাজিক কারণ ভুলে গিয়ে এক কাল্পনিক জিনবিজ্ঞানের জন্ম দিয়ে আমরা স্কিজোফ্রেনিক। যে নিজের ভেতর থেকেই আক্রান্ত তার পক্ষে আসল আক্রমণকারী কে তা বোঝাও সম্ভব নয়।

    তবু গুহার মধ্যে একটা আলোও তো জ্বলছে। সংখ্যাগুরুর সংখ্যাগুরু অংশের এই মনোভাব সংখ্যালঘুর ক্ষমতায়নেরই একটা রাস্তা খুলে দেয়। গুরুর শত্রুপ্রচারের ভেতর দিয়েই এই এমপাওয়ারমেন্ট ঘটাতে থাকে। এর ফলে লঘুরা সচেতন ও প্রতিবাদী হবে, মেজরিটির একটা অংশ খুলে এসে লাগবে তার গায়ে। অলস জলধারাকে চাপ দিয়ে দূরগামী ফোয়ারা করে তুললে দেশ ও গোটা পৃথিবীর নজরে পড়বে তাদের সমস্যাগুলো। গত কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছে না, আমাদের দেশে শুধু মুসলিমরাই বাস করে অথবা তারাই প্রধান সমাজ? বুদ্ধিজীবী, ছাত্র বা সাধারণ মানুষ শুধু তাদের হয়েই কথা বলছে? মিডিয়ায় শুধু তাদেরই আলোচনা এবং বাকি ভারতবর্ষ ভ্যানিশ করে গেছে! শত্রুরাজনীতি ভারসাম্য হারিয়ে নিজেকেই অপ্রাসঙ্গিক করে তোলার এই বিরল ক্ষমতাটি ধারণ করে।

    তাছাড়া এদেশের সংখ্যাগুরু কি চাইতে পারে মুসলমানহীন দেশ? কক্ষণও না! লঘু যদি না-ই থাকে, তবে দিনরাত কার নামগান করবে সে, কাকে অমিত শক্তিশালী ভেবে ভয় পাবে? নিজের ব্যর্থতা আর অপারগতা থেকে তৈরি দুঃখরাগঅজুহাত নিশ্চিন্ত মনে সমর্পণ করবে কার পায়ে?

    শত্রুই তো ঈশ্বর।

    পরপুরুষ

    এক
    এক দশকে তাদের একবারও দেখা হয়নি! বিশ্বাস হচ্ছে না? আসলে দুজনের কেউ-একটা অনিচ্ছুক হলেই সাক্ষাৎ অগুন্তি কাল ধরে পিছিয়ে যেতে থাকে।

    ডিভোর্সের পরের মাসেই অরুণাভ বদলি হয়ে কলকাতা অফিসে চলে এল। শেক্সপিয়ার সরণি থেকে রাসেল স্ট্রিটে অদিতির ব্যাংক কতটুকু? তবু দশ ইন্টু তিনশো পঁয়ষট্টি ইনটু চব্বিশ ঘন্টা লেগে গেছে দুজনের মুখোমুখি হতে!

    ফ্লাইট ন’টা দশে, বোর্ডিং টাইম আটটা পঁয়ত্রিশ। সে এয়ার ইন্ডিয়ার কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে মোবাইল ঘাঁটছিল। হাতে বারো মিনিট, মানে কেএফসি থেকে একটা মুরগির ঠ্যাং সাঁটানোর পক্ষে যথেষ্ট — ভাবতে ভাবতে হাই উঠলো। মুখে হাত চাপা দিয়ে বাঁদিকে ঘাড় ঘুরিয়েছে কি…

    অদিতি! ঝপঝপ করে হাঁটছে, সঙ্গে কে, গৌরবই তো। দশ বছর পিছিয়ে গেলে পাঁচ বছরের সংসার ছিল তাদের, তারও আগে তেরো মাসের প্রেম। তখন থেকে অরুণাভর কাছে শ্বেতপাথরের নগ্ন মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সময়; যদিও তার এক্স-বউ, হয়তো অরুণাভর ফিরে আসার সম্ভাবনায় ভয় পেয়েই, দু’বছরের মধ্যে ছোটবেলার বন্ধুকে বিয়ে করে বসেছিল।

    আমি এতক্ষণ ধরে দিনমাসের হিসেব দিয়ে যাচ্ছি, তাই না? জীবন আসলে সংখ্যারই খেলা। সবাই বোঝে, সাড়ে দশ বছরের বড় বর তার গিন্নির সঙ্গে কিছুতেই ম্যাচ করতে পারবে না। অরুণাভ সরকার হোন না যতই হিন্দুস্তান লিভারের কমার্শিয়াল ট্যাক্স ম্যানেজার, যতই সারা বছর চরকিপাক মেরে বেড়ান কোম্পানির পনেরোটা ইউনিটে, বর্ধমানের ধ্যাড়ধেড়ে অম্বিকা-কালনায় তার শেকড়, যেখানে পরপুরুষ শব্দটা হচ্ছে মেয়েদের কাছে স্বামী ছাড়া অন্য সব ছেলের এক-কথায়-প্রকাশ!

    দুই
    অদিতিও তাকে দেখামাত্র চটাং করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আড়াআড়ি পার হয়ে যাওয়ার সময় একবার মেপে নেওয়ার ইচ্ছে ছিল অবশ্য, কিন্তু হাঁ করে এদিকেই তাকিয়ে আছে শয়তানটা। ওই পাগলের সঙ্গে এ-জন্মে চোখাচোখি করার ইচ্ছে নেই আর।

    দা গ্রেট তারকাটা পরিবার তো অরুণাভদের!বাবা বুড়ো বয়েসে কোমরে দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকতো খাটের পায়ার সঙ্গে, এবং ওর ছোট মাসিকে বিয়ের একমাসের মধ্যে শ্বশুরবাড়ি কর্তৃক খাট-আলমারিসহ ওয়াপস! সেই বাড়ির মেজোপুত্রের মাথাখারাপের সঙ্গে উপরি পাওনা সন্দেহবাতিক। ইনস্যানিটির দু’কোটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ডিপ নেক ব্লাউজ কোনও কালেও পরতো না অদিতি, অথচ অসভ্য লোকটা অশান্তি শুরু করলো — “ছেলেরা তোমার পিঠের দিকে লোভীর মতো তাকিয়ে থাকে, খুব কষ্ট হয় আমার! তুমি ভিড়টিড়ের মধ্যে আঁচলটা নয় একটু পিঠের ওপর…।”

    মানে, স্লো মোশানে দু’চারটে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া ছাড়া বুড়োর আর কোনও গুণ স্নিফার ডগ লাগিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওহ ভালো কথা, গৌরব আজ কটন বাডস আনতে ভুলে যায়নি তো?

    তিন
    শিলিগুড়ির টিটি-কোচের মেয়ে, প্লেন উথাল আর পাথালের সময়ে তুলোগোঁজা কান শক্ত দুহাতে চেপে রাখতো যে, তার মোস্ট অপছন্দ ছিল রবীন্দ্রগান। তারপর হঠাৎ এক ব্যাঙ্গালোর-কলকাতা উড়ানে ধরিত্রীর সাতশো কোটি মানুষকে হতবাক করে বলে ওঠে, “গান শোনাও প্লিজ; না না অরিজিৎ সিং নয়, অরুণাভ সরকারের”! তাড়াতাড়ি ইউ টিউব থেকে নামিয়ে রাখা নিজের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত চালিয়ে হেড ফোন অদিতির কানে গুঁজে দিলে শান্তিতে চোখ বুজেছিল সে। পরের তিন বছর প্লেনে উঠলে ওটাই নিয়ম।

    আজ আবার সেই চেনা পারফিউমের ঝটকা, ঠিক তিন সেকেন্ডের জন্যে ফিরে আসা প্রত্নযুগ। অরুণাভর চোখ শিউরে উঠল অদিতির শিরদাঁড়ার পেছল পুষ্প উপত্যকায়, তৎক্ষণাৎ মুছেও গেল — মেয়েটা পিঠে আঁচল টেনে দিয়েছে!

    নিভে যাওয়া চিতার কাঠে খইয়ের মতো আগুনের ফুলকি ফুটেছিল দেখার সঙ্গে সঙ্গে, এবার ওরা উড়তে লাগলো অরুণাভর চোখের তারায়! আমাকে বাতিল করলেও আমার সব আর্তিগুলো তাহলে মুছে দাওনি, সোনা!

    তক্ষুনি পিঠোপিঠি ভাইয়ের মতো এল পরের ভাবনাটা। অরুণাভ টের পেল, শাবলের চাড় দিয়ে মাটি থেকে ফুলগাছ উপড়ে তোলা হচ্ছে:

    আচ্ছা, অদিতি আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়েই গা ঢেকে নিলে কেন…ওহ, আমিও তো এখন পরপুরুষ! বন্ধু প্রেমিক বর বা ঝগড়ার উপলক্ষ্য কিচ্ছু নই। চোখ নাক ঠোঁট না-থাকা এক মুখ, স্বভাবহীন, নিশ্চিন্ত অচেনা…!

    যোগমায়া

    আমি এমন ব্যবস্থা রেখেছি
    সব তান্ত্রিক নিভে গিয়েও আমার ধুনি জ্বলে!
    মেঘের গর্জন শেষে মৃদু হাসি বইতে থাকে — ভোর,
    আমি এমন লাইনঘাট করেছি…

    যোগ ও মায়া — দুটির একত্র বলে
    নিজেকে উদ্ধার করেছি, আমার
    রতিমোক্ষ শরীরে হয়েছে
    আর মন ধুনুচিধোঁয়ার মতো অনর্গল ভয় তুলে তুলে
    ওই দেখো, ভস্মমাখা ছাই
    চলাচলই আমার দরোজা, তার বাইরে তাকালে
    হৃদস্পন্দনের মতো ছোট পথ,
    জলের দুর্দান্ত কাছে পাখি বসে আছে

    এতদিন শুকনো নদীর ‘পরে সেতু টেনে গেছি
    আজ রাতে ঢেউ এল একান্ত উপায়হীন এলোকেশী ঢেউ, তার
    নাভি ঘিরে রক্তগাঁদার মতো আলো

    আমি ভালো আছি
    আমার ঈশ্বর পথে বসেছে আজ

    .
    ____________________
    [‘জগৎমঙ্গল কাব্য’ বইয়ে আছে]

    গয়ন্ত জাঙ্গুলি

    যত সব সোকাবোকা ছেলে নিয়ে জেরবার
    স্যার বলতেন
    জয়ন্ত গাঙ্গুলি, হায়মন্ড ডারবার
    ফা হিয়েন লেন

    স্বামী-স্ত্রী দুইজন আর এক বোন ঘরে
    অবিবাহিতা
    বেথুন কলেজে পড়ে, পাঠ করে অবসরে
    কেষের শবিতা

    সেই মেয়ে হায় হায় ফেল হ’ল বাংলায়
    অঘটন কী এ!
    স্যার কান্নায় ভিজে — বোনটির শুখটি যে
    গিয়েছে মুকিয়ে

    স্টুডেন্ট ভালোই, যত বোকাসোকা টাসমার
    স্যার বললেন
    গয়ন্ত জাঙ্গুলি, ডায়মন্ড হারবার
    (অহিফেন নেন)

    _______________________
    [“হিরের স্বপ্ন চারকোলে” বইয়ের ছড়া]

    কত সীমাহীন আছে

    অনেক অসংখ্য আছে। অনেক প্রার্থনা প্রার্থিতের হাত ছুঁতে পেরেছে এখুনি
    পথ আছে; বলছি বিশ্বাস করো, তাকে বর্ণনা করলেই সমান্তরাল সড়কের
    জন্ম হবে পাশে
    নবজাত ফুলগুলো গায়ে নিয়ে যে-বাড়ি ঘুমিয়ে আছে কী নিশ্চিত;
    একটা বরফগলা দুধ হাতে, মুখে বলিরেখা-লাগা, পুরনো পাহাড়
    সে ঘুম ভাঙাবে
    আরও শোনো বিরক্ত হওয়ার আগে — আকর্ণ আকাশ ছিলা থেকে শোঁ ক’রে
    মুক্তি দিচ্ছে মেঘ, যবের মরাইগুলো, বারিপ্রদ ক’রে দিচ্ছে
    হাড়মাংস, তারকামণ্ডল
    আমরা জানি না এত আহ্লাদ রয়েছে
    ঘরই প্রকৃতি, আবার উপত্যকা হাওয়া দিয়ে সূর্যোকরোজ্জ্বল দিয়ে নীলাভ খামের মতো
    মুড়েছে তোমাকে
    যত আছে তাকে ঠিক তত দিয়ে গুণ করেছে শঙখের নিস্বন
    নতুন ঘরের দেয়ালে আবার ঘর আঁকছে শিশু
    তার সবটুকু মন বুঝে নিতে তুমি হেসে উঠবে
    বিবমিষা থেকে
    দেখবে, আশ্চর্য তাকিয়ে আছে বিস্মিতের মতো
    আর দোহাই, শুনে রাখো, বিনাশ কখনও ছিল না
    বোবাঘট ভেঙে যাওয়া ছিল শুধু; জন্মান্তর ধরে যাকে তিল তিল
    ক’রে জমিয়েছ সেই পরমার্থ যদি বিস্ফোরণশব্দে বের হয়
    তাতেই অসহ্য লাভ, মৃত্যু ব’লে ভয়ে দুঃখে শোকে
    ওকে জড়িয়ে ধ’রো না কোনওদিন

    ________________________
    [“তিনটি ডানার পাখি” বইয়ের কবিতা]

    আমি উন্মাদ আত্মজীবনীতে

    তিন

    ঠিক এমনি গরমের সময়ে একবার বাবার চারপাইতে উঠে
    একটা দাঁড়াশ লম্বা হয়ে ঘুমিয়ে নিল। ওই দেখতে পাচ্ছ
    ঝুঁটি শালিখ গন্ধরাজের ডালে? আর টিউবয়েলের মাথায়
    এক সেকেন্ড বসেই পিঠটান — না না, দোয়েল ছাড়া আর
    কারও লেজে অতটা লাল থাকতে নেই

    সবার উঠোনই তো শুকনো পাতায় ভ’রে আসে, কিন্তু আমাদের
    বারান্দায় মায়ের ছেড়ে রাখা শাড়ির ওপর সারা সকাল
    ঝাঁপাবে গোটা গোটা নিমফল। আনাড়ি লম্বুগাছের ডাঁটিগুলো
    ভাতের থালা ছুঁয়ে নিজেদের এঁটো করে নেবে। এমনকি আমার
    পড়ার টেবিলেও দেখি ধাই-মা হয়ে বসে আছেন বাবলার
    সর্বাঙ্গহলুদ পাতাটি

    আবার কার্তিকী পূর্ণিমার ঠিক পরের দিন একটা বেজি
    বেমালুম বড়ঘরে ঢুকে এল — বেরোবে না তো না-ই!
    রাতে প্রেমিক এসে চোখের জল ফেলতে রান্নাঘরের
    দাওয়ায় মিলমিশ হতো ওদের। তারপর চারটে স্বা, গ, ত আর ম;
    মুখভাঙা মাটির হাঁড়িতে তাদের পুরে রেখেছিল ছোটবোন

    আজ যে দোয়েলবাবুকে দেখলে, ওমনিই এক মক্কেল জানলা দিয়ে
    ঢুকে, এই গেল-বেস্পোতিবার, পড়বি তো পড় দেয়াল আলমারির
    আয়নার সামনে। এবার তার ডাক দ্যাখে কে! কনটিনিউয়াস শিস
    দিয়ে যাচ্ছে নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এমন যে
    তুমি ঘরে ঢুকতেই পারবে না

    বলো চন্দন, কতটা মাঠ কুড়িয়েছি!

    _________________________
    ভুবনভোজন চলছে” নামের বই থেকে।

    আমি আর প্লক্ষতরুণী

    ছয়

    দেখে মনে হবে রেস্তোরাঁ। আসলে বাইরের ঘর।
    মুখোমুখি বসে প্রেমকাহিনি বাড়িয়ে নিচ্ছিলাম
    একবারও দৃষ্টি সরাচ্ছে না উজ্জ্বল আনন্দিত
    চোখ সে-মেয়ের। অল্প নিউরটিক কি ঝিলাম?

    তাকানোর মধ্যে একটা গোগ্রাস আছে। সে যেন
    প্রেমের কাছে পিণ্ডদান চায়। আঙুলে আঙুলের
    শেকড় জড়ানো, উঠতে গিয়ে মন অপরাধী।
    “চলে যাচ্ছ! ভেবেছিলাম আজ দুজনে ধরা দিই…”

    সে ও তার ল্যাব্রাডর — দুজন বলতে। ঝিলামের
    ধূসর দাদাও ভেতরের ঘরে থাকে, প্রতিবেশীসম।
    একদিন চা খেয়েছি একসঙ্গে, সিপগুলো গুনে
    … এগারোটা। এ-বাড়িও পৃথিবীর একাদশ কোণে

    আসতে আসতে একদিন দুম করে দাদাশূন্য ঘর
    সিল্কের শাড়িটা ওর ত্বক থেকে পায়ের নুপূর
    মরু-পরিশ্রম শেষে বর্ষা নামে দুগুণে চৌগুণে
    ঝমঝম শব্দে ডুবছে চেন বাঁধা ক্ষ্যাপা ল্যাব্রাডর

    আমি সেই বৃষ্টিজল থেকে মুখ তুলে দেখি, ঠোঁটে
    জোয়ারির হাসি, কপালে কুর্নিশে উঁচু ডান হাত!
    কোথাও প্লাবন নেই, কামনার তৃপ্তি ছেঁড়া পাতা
    সে আমাকে দিল তার ইয়ারকির মতোই যৌনতা

    ছিটকিনি খুলতেই কুকুর লাফিয়ে এসে ঢোকে
    চন্দ্রদীঘল নারী, যেরকম স্কেচবুকে পাও
    সামান্য আর্তির মতো ঘাসজমি শরীরে যেখানে —
    সন্তানসজল চোখ, জিভ নেমে যায় বীতশোকে

    বেরিয়ে এসেছি। সর্বস্বসমেত এই বেরিয়ে আসাকে
    সি অফ করে না কেউ। দুই বন্ধু অন্তরঙ্গে আছে
    যে কোনও সত্তায় ওরা সুগভীর, যেমন বোর্হেস
    অন্ধ হয়ে যান, তবু হলুদ আলোটি পাশে থাকে

    এই নীলোৎপল একা, না বুঝি না বোঝাতে সক্ষম
    নাল ছিঁড়ে গিয়ে শুধু ঘূর্ণিদশা, শুভদৃষ্টি কম

    .
    [“ছোট পুষ্পবৃষ্টি হোক” বইয়ের কবিতা]

    মুখঢাকা গল্প

    আমার বাঁহাতে মুখঢাকা গল্প মনিটার শুনতে পেয়ে গেছে?
    তাই কি টেবিলে ডাস্টার ঠুকল তুহিনস্যারের মতো!
    অথচ সবাই ছুটে বেরোচ্ছে ক্লাস থেকে টানা-বারান্দায়
    ফাইভসিক্সের চোখে জল
    টিচার্স রুমের কাছে জটিলতা…
    চার-পাঁচটা মহাপাপী ছেলে ‘আসতে পারি স্যার?’ না ব’লেই
    ঢুকে গিয়ে, এমা দ্যাখ, জুতো পায়ে টেবিলে উঠল!
    পেড়ে নামাল বড় ফ্রেমের আবছা মহাপুরুষ-মুখগুলো
    শুধু ভালোর মধ্যে একটা গান গাইছে ইংরাজির
    মিষ্টি কোরাসে আর কাচের চৌচিরশব্দ; আলমারির ভাঙা হাড়
    ঝাঁঝরের বিট ধরে আছে।
    হাতে ছোট্ট রডের ডান্ডিয়া; রচনাবলীর সাঁচিস্তূপে
    বোতল উপুড় করে দেশলাই ঠুকে দিচ্ছে গান

    কিছু সৎকার দাঁড়িয়ে দেখার মতো
    যেন দিদিমা পুড়ছে আমাকে প্রেমের অপরাধে
    ঘরে এত কুঁজো দিশেহারা বই থাকলে আমিও কি
    খুঁজতাম না কাঠের গুদাম? হয়তো আমিও ছুঁড়তাম
    এরকম ক্যাম্বিস বল দেয়ালে আর দুম শব্দ ক’রে
    হাতে আসতো ‘শরতের আকাশে তাকাইলে চোখে পড়ে’।

    উক্ত স্তূপমেঘ কোনাচে হেডে আর একটু ওপরে পাঠিয়ে
    ছুট ছুট পুলিশফাঁড়িতে। পৌঁছে জানা গেল
    জারুলগাছের নিচে একজন ব’সে —
    মাথা অল্প ফাঁক করা।
    ‘যেভাবে পথিক ঝরনার তলদেশ লক্ষ করে’ আমি ঝুঁকে
    স্থলপদ্ম দেখি, হুঁ বায়োলজি চার্ট কিছু মিথ্যে আঁকেনি।
    শুধু কপাল-ফাটল থেকে লাল স্কেচপেনধারা ডান চোখের
    তীর ঘেঁষে পাতলা গোঁফে মিশেছে। গোঁফ অল্প কেঁদে বলছে
    ‘ওদের কাউকে চিনি না, বিশ্বাস করুন!’ সেই দেখে
    জিভ আমার ছোট্ট করে বাইরে — ইশ, দিদি যদি এখানে থাকত,
    যে-কোনও মুশকিল টিফিন বাক্স বুকে চেপে খটটাস ক’রে
    আটকাতে ওস্তাদ ছোড়দিটা…

    [‘ছোট পুষ্পবৃষ্টি হোক’ বইয়ের কবিতা]