ফকির আবদুল মালেক এর সকল পোস্ট

ফকির আবদুল মালেক সম্পর্কে

কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ লেখক।

লড়াই

১.
রুটির শেষ টুকরাটি নিয়ে, টম কিং, ধীরে আর গভীর মনযোগে মাংসের ঝোলটুকু মুছে নিয়ে যখন মুখে পুড়ল, তখন তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু-ধারা বইয়ে গেল নি:শব্দ। খাবার টেবিল থেকে যখন উঠল সে, তখনও সে দমন করল প্রচন্ড ক্ষুধার অনুভূতি। সে একাই খেল। দু’টি বাচ্চাকে তাড়াতাড়ি ঘুম পড়িয়ে রাখা হয়েছিল। যাতে বাচ্চারা টের না পায় যে, তারা কিছুই খায়নি। তার স্ত্রী, ব্লিমি কিছুই স্পর্শ করেনি, নীরবে বসে উৎসুক নেত্রে অবলোকন করে গেল। মহিলা পাতলা ধরনের, নিচুস্তরের কাজের মহিলার মত দেখতে এখন, যদিও চেহারা থেকে একটি সৌন্দর্যের রেখা চলে যায় নি। হাতে থাকা শেষ টাকাটি আটা কিনতে শেষ হয়ে গেছে তার। মাংস আনতে ধার করতে হয়েছে প্রতিবেশীর কাছ থেকে।

যখন টম বারান্দায় রাখা নড়বড়ে চেয়ারে বসল, চেয়ারটি আর্তনাদ করে উঠল কড়কড় শব্দে। তার গতিবিধি ধীর, বিশাল দেহ লোহার মতো দৃঢ় আর বলিষ্ঠ। পোশাক একেবারে নোংরা। জুতা জোড়া তার ভার সহ্য করতে পারছে না বলে মনে হয়। কয়েক জায়গায় ছিড়ে যায় যায় করছে।
সে কখনো এ ধরনের পরিস্থিতির কথা কল্পনাও করেনি।

টমের চেহারাটা বিজ্ঞাপিত করছে সে কি ছিল। মুখমন্ডলখানি একজন প্রতিনিধি স্থানীয় মুষ্টিযোদ্ধার, যে দীর্ঘ সময় চারকোনাকার রিং-এ নিবেদন করে নিজেকে একজন জান্তব লড়াকু হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার চেহারাটা ঝড়ের তান্ডবের মতো রুদ্র। গোফ-দাড়ীহীন। ঠোঁট বিকৃত। একটি দীর্ঘ লম্বা গাঢ় কাটা দাগ চেহারায়। তার চোয়াল আক্রমনাত্মক, জান্তব, শক্তিশালী। দীর্ঘ লম্বা চুল কাঁদ বরাবর ঝুলে গেছে, কপালের খানিকটা চুল দ্বারা আবৃত, চোখ দুটি শান্ত ভাবলেশহীন। নির্ভেজাল এক শিকারী সে, চোখ দু’টি পিটপিট করতে থাকে। তার চোখ , শক্ত চোয়ালসহ তার পুরো মাথাটা গভীর ভাবে লক্ষ্য করলে একজন দুর্বৃত্তের মত মনে হয়। যেন শিকারী সিংহের মাথাটি মানুষের দেহের উপর বসিয়ে দেয়া হয়েছে।

সবমিলিয়ে, তার চেহারাটা অন্ধকার বা নীরব স্থানে দেখলে যে কেউ ভড়কে যাবে। টম কখনই দুর্বৃত্ত ছিল না, কোন প্রকার আইন বিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত ছিল না। রিং এর বাইরে, জীবনের পথচলায়, সে কোন মারামারিতে কখনো জড়ায়নি। তাকে কেউ কখনও উগ্রপন্থী কার্যকলাপে দেখেনি। সে একজন পেশাধারী ফাইটার, তার সমস্ত ক্রদ্ধতা, পাশবিক আচরণ পেশাধারী মনোভাবাপন্ন। রিং-এর বাইরে সে একজন ধীরস্থির মানুষ, তার আচরণ উগ্রতাবিহীন। যৌবনের সেই দিনগুলোতে, যখন অর্থ ছিল দ্রুতগতিতে তার দিকে ধাবমান, তখনও সে দাম্ভিব ছিল না। লড়াই স্রেফ তার পেশা । রিং-এর ভিতর সে প্রচন্ড গতিতে আঘাত করত, অঘাত করত বিধ্বস্ত করার জন্য। দর্শক চিৎকার করত। তারা টিকেট কেটে দু’জনের নৃশংসতা দেখতো। বিজয়ী পেত বড় অংকের টাকার চেক। বিশ বছর আগে, যখন টম উইলিয়ামের মুখোমুখি হয়েছিল, টম জানত উইলিয়াম সবেমাত্র তার চোয়ালটার ধকল সামলে রিং-এ ফিরেছে। টম লক্ষ্য রাখছিল প্রতিপক্ষের চোয়ালটার দিকে কারণ সে জানত উইলিয়ামের মতো প্রতিষ্ঠিত প্রতিপক্ষকে পরাভূত করার এটাই একমাত্র দুর্বলতা স্থান। তৃতীয় রাউন্ডে সে তার চোয়ালটা ভেঙ্গে দেয়। কোন অন্যায় ইচ্ছা তখনো কাজ করে নি তার। সে জানে এটা একটা খেলা। দু’জনই জানে এটা একটা খেলা। তারা পরস্পরকে আঘাত করার এই খেলাতে মেতে উঠত নানা কৌশলে।

টম নীরব প্রকৃতির, কখনো বাকপটু ছিল না। বিষণ্ন মনে নিরালা বারান্দায় বসে একদৃষ্টিতে হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। তার হাতের আঙুলগুলো পুন:পুন আঘাতে শক্ত ও কদাকার । সে তার ফোলে ফোলে ওঠা শিরাগুলো গভীরভাবে লক্ষ্য করল। এখন তার অধিক পরিশ্রমের চাপ সহ্য করা কষ্টসাধ্য মনে হয়। দ্রুত গতির পাঁচ রাউন্ড, কোদালে মাটি কাটা কিম্বা হামারের সাহায্যে খনিজ পাহাড় কাটা থেকে কোন অবস্থাতেই কম পরিশ্রমের কাজ নয়। হিংস্র প্রদর্শনী ক্রমাগত হিংস্রতার রূপ নয়। বর্গাকৃতির সেই ষ্টেজটিতে কখনো আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে দড়িতে আছড়ে পড়ে কিম্বা নিজেই প্রতিপক্ষকে আঘাত হানে। হিংস্র এই প্রতিযোগিতা, পঞ্চম রাউন্ড পর্যন্ত টেনে নিয়ে সফল পরিসমাপ্তির দিকে যেতে, শরীরের ভিতর এক গভীর চিৎকার অনুভুত হয়। নিজেকে উজার করে দিতে হয়। সমস্ত শরীর শূণ্য মনে হয়, আর বৃষ্টির ফোঁটার মতো জলধারা বয়ে যেতে থাকে, নি:শ্বাসকে রাখতে হয় নিয়ন্ত্রিত। ক্ষীপ্র সেই শরীরে বিশ্বস্ততার সাথে ফুসফুস রক্ত সঞ্চালন করে দ্রুতগতিতে শিরা-উপশিরাগুলোতে। শিরাগুলো তখন ফুলে ফুলে ওঠে আর নিয়ন্ত্রিত হয়ে আবার পূর্ববস্থায় চলে যেতে চায় কিন্তু প্রতিবারই সমান্য ফোলে থাকে। সে গভীরভাবে ফোলে উঠা শিরাগুলো দেখতে লাগল।

২.

ক্ষুধার অনুভুতিতে সে আবার কাবু হয়ে পড়ল।
-‘ব্লিমি , আমি কি একটুকরা মাংসও পেতে পারি না।’
সে বিড়বিড় করতে লাগল।
-‘আমি চেষ্টা করেছি, কোথাও আর ধার পাইনি’
তার স্ত্রী দু:খের সাথে স্বীকার করল।
-‘কেউ রাজি হলো না!’ টম কিং বিস্মিত হয়ে বলল।
-‘‘ধার-দেনা তো আর কম করিনি, ভেবে দেখেছো কত দেনা, কত বড় অংক দেনা করেছি, ভাবলে তুমি অস্থির হয়ে উঠবে।’’
গোঁৎ গোঁৎ করে সে ফুলতে থাকল কিন্তু কোন উত্তর দিল না। স্মৃতিতে তার যৌবনের দিনগুলো সাঁতরাতে লাগল। তার কুত্তাটিকে সে কত মাংস দিত গননাহীনভাবে! অনেক দোকান মালিক সে সময় মনকে মন মাংস বাকী দিত। কিন্তু সময় বদলায়! টম কিং, এখন অস্তমিত সময়ে , যা উপার্জন করে, দোকান বিলের সাথে পাল্লা দিয়ে এগুতে পারে না। এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য তার কোন প্রকার প্রস্তুতি ছিল না।

অস্ট্রেলিয়ায় এটা অনাবৃষ্টির বছর, কোন ধরনের পরিশ্রমের কাজ যোগানও কষ্টসাধ্য। মান সম্মত খাবার যোগাড় করতে পারছিল না সে, যা যোগাড় হত তা যথেষ্ট ছিল না। মাঝে মাঝে নির্মান শ্রমিকের কাজ যোগাড় করতে পারত সে। অবশেষে অনেক বলে সে দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্লাবের ট্রেইনার হিসাবে যোগদান করে, যার বাবদ কিছু অগ্রীম নিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা স্থায়ী হয়নি। এটা খুব কষ্টসাধ্য কাজ, তাকে সাহায্য করার মতো কেউ ছিল না। স্ত্রী-দুই সন্তানের খাবারের চিন্তায় সে বিহ্বল ছিল। ফলে যা ঘটার তাই ঘটেছে, কর্তৃপক্ষ তাকে কাজে স্থায়ী করেনি।
-‘কটা বাজে?’ টম জিজ্ঞাসা করে।
-‘প্রায় আটটা’ ব্লিমি বলল।
তার পরবর্তী দশ মিনিট নীরবতা ভর করল ঘরটিতে। অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে টম বলল, ‘সত্যি কথা, ট্রেইনার হিসাবে আমি মোটেই ভাল নই কিন্তু ফাইট করতে জানি, জিততে জানি আমি, আজ যদি জিততে পারি…’’
টম কখনো যাবার সময় চুমু খাবার প্রস্তাবনা করে না কিন্তু ব্লিমি আজ নিজ বাহুতে টমকে জড়িয়ে ধরল। চুমুতে চুমুতে আপ্লুত করে ফেলল। বৃহদায়ত দেহের কাছে ব্লিমিকে একজন বালিকার মতো মনে হলো।
-‘গুড লাক, টম’ সে বলল,‘তুমি পারবে।’
‘আমি পারব’ কথাটি বারবার উচ্চারণ করতে লাগল টম যেন কথাটি প্রতিধ্বনি তুলল তার সমস্ত স্বত্ত্বা জুড়ে, ‘আমি পারব’।

হৃদয় বাহিত নির্মল হাসি হাসল টম। স্ত্রীকে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরল। টম বাড়িটির দিকে তাকাল। সারা পৃথিবীতে এই ক’টি কক্ষের বাড়িটি তার আশ্রয়স্থল, নিজের, তার স্ত্রী আর বাচ্চাদের।

সে এটাকে ত্যাগ করছে, তাদের খাদ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। সে বেরিয়ে যাচ্ছে আধুনিক কোন কাজে সন্ধানে নয়, কারখানার শ্রমিক, সড়ক নির্মাণশ্রমিক কিম্বা এ জাতীয় কোন কাজে নয়। সে বেরোচ্ছে, বন্য পশু যেমনি শিকারে বেরোয় নিজেদের খাদ্য সংগ্রহের জন্য, জড়িয়ে পড়ে নানামুখী আক্রমণ আর প্রতি-আক্রমণে তেমন বন্য আদিম সংঘাতে জড়িয়ে পরতে।

‘আমি পারব’ সে বারবার উচ্চারণ করতে লাগল, অবশেষে সে গোঁয়ারের মতো বলতে লাগল, ‘যদি আমি জিতি, বেশ কিছু টাকা আমার হাতে এসে যাবে, সমস্ত দেনা পরিশোধ করেও থেকে যাবে অনেক। আর যদি হেরে যাই, আমি কিছুই পাব না, এমনকি বাসের ভাড়াটাও আমার হাতে অবশিষ্ট থাকবে না।’

‘‘ হেরে গেলে প্রাইজমানি পাবে না?’’

‘‘না। এভাবেই , এ শর্তেই আমি রিং-এ ফিরছি। যদি জিততে পারি তবে সমস্ত টাকা আমার আর যদি হেরে যাই তবে ক্লাবের সেক্রেটারী নিয়ে নিবে সব প্রাইজমানি। বিদায়। আশা করি জিতেই বাড়ি ফিরব।’’
‘আর আমি তোমার প্রতীক্ষায় থাকব….’ তার স্ত্রী বলল।

৩.
একদিন সে ছিল হেভী ওয়েট চম্পিয়ন, রিং-এ আসার জন্য নানা কোম্পানীর ক্যাব থাকত। তার সাথে গাড়িতে চড়তে পেরে আনন্দিত হত অনেকে। আজ তাকে একা আসতে হলো! এক সময় সে ভেবেছিল কোন ধরনের ব্যবসায় জড়াবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠল না। তার আশে-পাশে উপদেশ দেয়ার কেউ ছিল না, থাকলেও টম কিং এতে কর্নপাত করত কিনা সন্দেহ।

টাকা উপার্জন তার জন্য ছিল সহজ। সেটা অন্য উন্মাদনা। বড় অংকের টাকা- একটি সম্মানজনক ফাইট- মাঝে অলস সময়, তোষামদকারী, পিঠ চাপড়ে দেয়া, হাতে হাত রাখা, মাত্র পাঁচ মিনিটের পরিচয়ে তরল পানীয় উপহার দিতে পেরে ধন্য হয়ে যাওয়া লোকের অভাব ছিল না। অনেক গৌরব, মানুষের উল্লাসে ফেটে পড়া গ্যালারী। রেফারীর উচ্চারণ ‘ আর একটি কিং এর বিজয়।’’ এবং পরদিন খেলার পাতায় তার নাম। কি দিন!

দিনগুলো সোনার খাঁচায় বন্দি হয়ে থাকে না! যখন সে ছিল পূর্ণ যৌবনে, তার প্রতিপক্ষ ছিল প্রতিষ্ঠিত ফাইটার। টমের আজও মনে আছে দশ বছর আগে সেই দিনের সেই দৃশ্য। বাচ্চা ছেলের মতো ড্রেসিং রুমে কেঁদেছিল টসার বিল! দ্বিতীয় রাউন্ডে টমের হুকে পড়ে গিয়ে টসার বিল আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি।
-‘টসার বিল! বাড়ি ভাড়া বাকি পড়েছিল তোমার? তোমার স্ত্রী আর সন্তনদের খাদ্যাভাব তোমাকে বিষণ্ণ করে রেখেছিল? কিছু মাংসের জন্য কি হাহাকার করছিল তোমার ক্ষুধার্ত অনুভূতি? ‘

স্মৃতিতে সাঁতার কাটতে কাটতে বিলকে কাল্পনিক প্রশ্ন করে যাচ্ছে সে। দশ বছর আগে টম লড়ছিল সন্মানের জন্য, সহজ উপায়ে টাকা উপার্জনের জন্য। টসার বিল! কেনো লড়েছিল সেদিন? কেন পরাজয়ের পর ড্রেসিং রুমে বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদেছিল!

৪.

শুরু থেকেই মানুষকে লড়াই করেই এগুতো হয়। এটাই প্রকৃতির এক দৃঢ় কঠিন নির্দেশনা। শুক্রানু থেকেই শুরু এই লড়াইয়ের। তারপর প্রতিটি পদক্ষেপে, সামনে এগুতে হলে তীব্র লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হয়। কেউ দীর্ঘ সময় লড়াইয়ে জয়ী হয়ে টিকে থাকে, কেউ হয়ত কিছুটা কম। কিন্তু একসময় এই লড়াইয়ে হারতেই হয়।

হেভী ওয়েট মুষ্টিযোদ্ধা যদিও একটি খেলা, এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। কেউ হয়ত এক’শটি কঠিন লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়, কেউ হয়ত মাত্র বিশটি। এটি এক একজনের অন্তর্গত শারীরিক দক্ষতার উপর নির্ভর করে। টম অন্যদের তুলনায় একটু বেশি লড়েছে। অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি গুরত্বপূর্ণ ও কঠিন লড়াইয়ে সে টিকে আছে। তার সমকালীন আর কেউই রিং-এ নেই। সে প্রবীণদের শেষ প্রহরী। সে তাদের সকলের শেষ হয়ে যাওয়া অবলোকন করেছে এবং কাউকে কাউকে সে নিজ হাতে ধ্বংস করেছে।

প্রতিষ্ঠিতদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে তাকে এবং একে একে সব প্রতিষ্ঠিতকে বিদায় করে দিয়েছে সে। প্রতিটি বিজয় এনে দিয়েছে ভরপুর আনন্দ, হাসির উপলক্ষ্য। টম তখন হাসছিল যখন বিল ডেসিংরুমে বসে কেঁদেছে।

৫.
এখন টম পুরানো প্রতিষ্ঠিত ফাইটার, নতুনদেরকে তার বিরুদ্ধে লড়েই এগুতে হবে। যেমন আজকের প্রতিদ্বন্ধী স্যান্ডেল। সে নিউজিল্যান্ড থেকে এখানে এসেছে, ওখানে তার স্মরনীয় রেকর্ড রয়ে গেছে কিন্তু অস্ট্রেলিয়াতে সে নতুন, অপরিচিত। তাকে প্রতিষ্ঠিত টমের মুখামুখি হতে হবে। যদি স্যান্ডেল দক্ষতার পদর্শনী দেখাতে পারে, তার সামনে এসে যাবে আরো বড় ধরনের সুযোগ, আরো বৃহত্তর প্রদর্শনীর। এটা নির্ভর করছে তার উপর সে কতটা দক্ষ লড়াকু, তা প্রমাণের ওপর। সে ছিনিয়ে নিতে পারে অনেক কিছু, টাকা-সুনাম আর ক্যারিয়ার। টমও কাটিয়ে এসেছে এ সব পদক্ষেপ, এখন এই ফাইট হতে তার কিছু অর্থ হস্তক্ষেপ হওয়া ছাড়া কিছুই পাবার নেই। সে মানুষের নানা দেনা ও দোকান বাকি পারিশোধ করবে।

যেহেতু টম স্মৃতি রোমান্থন করছে যৌবনের, যৌবনের রূপরেখা দেখা দেয় তার মানসপটে। যৌবন, সম্মানিত যৌবন, উৎফুল্লতায় মাধুর্যমণ্ডিত, অজেয়, মসৃন মাংসপেশী, টসটসে ত্বক, প্রাণবন্ত ফুসফুস, ক্লান্তি এসে কাবু করতে পারে না, হৃদয়োত্থিত কান্না থমকে থমকে হানা দেবার অবসর পায় না স্রোতস্বীনি হাসির স্রোতের গতিময়তায়। হ্যা, যৌবন ধ্বংসপ্রবন, সে ধ্বংস করে পুরাতন জং ধরা স্থবিরতাকে। যদি তেমন না করতে পারে তবে সে ধ্বংস করে নিজেকে। যৌবন সর্বদাই উদ্যমী।

পৃথিবীটা যৌবনের, উদ্যমের আর বিজয়ের। যৌবন কখনো পুরানো হয় না, মানুষের বয়সটা কেবল ক্রমাগত পরিণতির দিকে ধাবমান।

যখন টম কিং মঞ্চে প্রবেশদ্বার দিয়ে ভিতরে যাচ্ছে, যুবকদের চিৎকার ধ্বনি শুনতে পায় সে। সে শুনতে পায় একজন আরেকজনকে বলছে,
-‘দেখো, দেখো, টম কিং। দ্যা, টম কিং!’

টম যখন তার ড্রেসিং রুমে প্রবেশ করল, ক্লাবের সেক্রেটারী তাকে স্বাগত জানাল।
বলল,
-‘কেমন বোধ করছো, টম?’’
‘‘সম্পূর্ণ প্রস্তুত আমি’’ টম বলল।

যদিও সে জানে সে সত্যটা বলছে না, বলছে না যে, এখন তার হাতে কিছু টাকা থাকলে সে কয়েক টুকরা ফ্রেস মাংস খেয়ে নিত।

৬.

ড্রেসিং রুম ছেড়ে টম কিং যখন মঞ্চে এসে দাড়াল তখন একটি হর্ষধ্বনি গমগম করতে লাগল সমস্ত গ্যালারী জুড়ে। প্রবেশ পথে কেউ কেউ হাত মিলাল। কিং লক্ষ্য করল যে, যারা তার সাথে হাত মিলাচ্ছে তার প্রায় সকলেই নবীন। টম কিং যখন প্রথম লড়াইয়ে নামে এবং জিতে যায় তখন এসব নবীনের অনেকে জন্মায়নি। মঞ্চে উঠে টম কিং ও প্রবীণ রেফারী, যিনি দশ বছর রিং-এ নেই, কিং- এর অনেক জানাশোনাও বটে, পরস্পর হাত মিলাল।

এরই মাঝে প্রবলতর গুঞ্জনধ্বনি, চিৎকার, হৈ চৈ-এর মাধ্যে দিয়ে আগমন ঘটল, টম কিং-এর আজকের প্রতিদ্বন্ধী স্যান্ডেলের। টসটসে ত্বক, দৃঢ় গাথুনি, চেহারায় একটি স্পষ্ট মায়াবী ভাব লক্ষ্য করল টম। টম কিং, নিজের প্রথম লড়াইয়ে ফিরে গেল স্মৃতিতে। মাত্র পাঁচ রাউন্ড টিকেছিল তার প্রতিদ্বন্ধী, নক আউট করে দিয়েছিল সে। তার দীর্ঘ লড়াইয়ের ময়দানে বহু প্রতিদ্বন্ধীকে নক-আউট করে দিয়েছে টম, তার হুকগুলো দুর্ধর্ষ, খুব কম ফাইটার তার প্রচন্ড আঘাতের পর উঠে দাড়াতে পারে।

ভাষ্যকারের নানা ধরনের উপস্থাপনার পর, ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠল। প্রথম দুই রাউন্ড পুরোটাই স্যান্ডেলের। টম কিং সমর্থকরা হতাশ হয়ে যাচ্ছে প্রথমেই কিন্তু টম কিং মোটেও নয়। সে প্রথম দুই রাউন্ড স্যান্ডেলকে লাফাতে দিয়েছে, যাতে শক্তির প্রাথমিক কিছুটা ক্ষয় হয়। টম কিং জানে শক্তিমত্তায় নবীনদের সাথে পেরে উঠা দুষ্কর কিন্তু অভিজ্ঞতা আর ব্রেনকে কাজে লাগাতে জানে টম কিং।

প্রথম দুই রাউন্ড শুধু নিজেকে বাঁচিয়ে স্যান্ডেলকে লড়তে দিয়েছে। দর্শকের চিৎকার আর হৈ চৈ এ স্যান্ডেল উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে বার বার। তৃতীয় রাউন্ডে এসে টম কিং পূর্ণ আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল। সে প্রচন্ড আঘাতে স্যান্ডেলকে ধরাশায়ী করে ফেলে। দর্শকের মাঝে সাঝ সাঝ রব পড়ে গেল। একজন বাচ্চা ছেলে পিছলে পড়ে গিয়ে পর মূহুর্তেই দাঁড়িয়ে যেমন আবার দৌঁড়াতে থাকে, স্যান্ডেল তেমনি এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল। তবে স্যান্ডেল সতর্ক হয়ে গেল, বুঝে গেল সে একজন কঠিন প্রতিদ্বন্ধীর মোকাবেলা করছে।

চতুর্থ রাউন্ডে এসে বোঝার কোন উপায় রইল না কে এগিয়ে রইল। টম অবশ্য বুঝতে পারছে যে সে কিছু পয়েন্টে পিছিয়ে আছে। অর্থাৎ লড়াই চলল প্রায় সমানে সমানে। তরুণ আর বুদ্ধিদীপ্ত সফল লড়াকুর মধ্যে এই লড়াইয়ে সমস্ত গ্যালারী উল্লাসিত।

শেষ রাউন্ড স্যান্ডেল একটু বেশি প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। টম কিং লক্ষ্য রাখল এবং কিছুটা সুযোগ করে দিল টমকে আঘাত করার জন্য। বেশ কয়েকটি আঘাতের পর স্যান্ডেল জয়ের গন্ধ পেতে শুরু করল। একটু অমনোযোগী, একটু ঢিলামি পেয়ে বসল তাকে। টম এটার অপেক্ষায় ছিল। টম জানে প্রতিপক্ষ যদি অসতর্ক হয়ে ওঠে, তার হুকগুলোর আঘাতটা যদি সঠিক শক্তিতে পাঞ্চ করতে পারে, কারো সামর্থ্য নেই উঠে দাঁড়ানোর। জীবনে বহুবার টম পয়েন্টে পিছিয়ে পড়ে তার এই হুকে নক-আউট করে দিয়েছে অনেক প্রতিপক্ষকে।

এই মুহূর্তে সমস্ত গ্যালারী স্তব্ধ হয়ে আছে যেন একটি নীরবতা এসে ভর করেছে। টমের কানে কোন শব্দ প্রবেশ করছে না। এই লড়াইয়ের শেষ দিকে টম এই প্রত্যাশা করছিল। স্যান্ডেলের অতিরিক্ত আত্ম-বিশ্বাস, সামান্য
অসতকর্তা। পর পর তিনটি আঘাত করল টম, সমস্ত শক্তি দিয়ে। তার অতীত অভিজ্ঞতা এই যে, কেউ উঠে দাঁড়াতে পারেনি। এবার টম প্রকৃতস্থ হলো, এবার সমস্ত গ্যালারি পিন পতন নিস্তব্দতা। রেফারী গুনছে এক, দুই, তিন… দর্শকের একাংশ সমস্বরে উচ্চারন করছে এক, দুই, তিন, চার… জয় থেকে টম আর মাত্র কিছু সময় দূর… সাত, আট, নয়… আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড…

কিন্তু একমাত্র যৌবন উঠে দাঁড়াতে পারে। স্যান্ডেল, উঠে দাঁড়াল। স্তব্ধ টম, তার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করে সবশেষ আক্রমন করেছে সে। কেউ, যারা তার পূর্বসূরী, যারা তার সম-সাময়িক কেউ উঠে দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু নবীন উঠে দাঁড়ায়। তারুণ্য উঠে দাঁড়াল। স্যান্ডেল আরো তীব্র হয়ে উঠল, টম কিং জানে, দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায় তখন তারুণ্য আরো দারুণ উদ্দীপিত হয়ে ওঠে, বরং যত বেশি প্রতিকূলতা এসে ভর করে তত বেশি উদ্দীপনা কাজ করতে থাকে। আর প্রবীনের যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখন তাকে বিদায় নিতে হয়।

পরবর্তী দুই রাউন্ড টম কিং একটি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত সৈনিক যেন। কেবল নক আউট হতে বেঁচে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেল। যদিও সর্বশেষ রাউন্ডে টম কিং, দ্যা টম কিং আরো একটি আক্রমণ হানলো। আর স্যান্ডেল ছিটকে পড়ল, আছড়ে পরল মঞ্চে, কিন্তু উঠে দাঁড়াতে বেগ পেতে হয় নি স্যান্ডেলের।

৭.

খেলা শেষ। পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত টম সমস্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে তার জন্য নির্দিষ্ট আসনে হেলান দিয়ে বসে রইল। সকলেই ফলাফলের প্রতীক্ষায় অস্থির সময় কাটাচ্ছে। অবশেষে ভাষ্যকার মঞ্চে এলো। ভাষ্যকার বললেন-
‘প্রিয় দর্শক, যে লড়াই আজ আমরা দেখলাম, ইয়ং স্যান্ডেল আর দ্যা টম কিং-এর মাঝে, দীর্ঘ দিন এমন লড়াই দেখা যায়নি। আমার দৃষ্টিতে এ লড়াই এ মঞ্চে গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে শ্রেষ্ট। কিন্তু আমাকে ফলাফল ঘোষনা করতে হবে।’’

রেফারী দুইজন প্রতিদ্বন্ধীর দুই হাত ধরে আছে, আর প্রতীক্ষা করছে, যার নাম ঘোষনা হবে তার হাত উঁচিয়ে ধরবেন।

অবশেষে ভাষ্যকার ঘোষনা করলেন-
‘বিচারকের দৃষ্টিতে এবং বিচারে অতি সামান্য, একবারে সামান্য ব্যবধানে জয়ী হয়েছে টম কিং।’

সমস্ত গ্যালারী আবারো থমকে গেল। ফলাফল ঘোষণার পর চেঁচামেচিতে গ্যালারী উল্লাসিত থাকে কিন্তু সকলেই থমকে গেল। স্যান্ডেল, এই মঞ্চে প্রথম লড়াই তার, হেরেও আনন্দিত। সে ভাষ্যকারের হাত হতে মাইক্রোফোন নিয়ে বলল-‘ বিচারকের দৃষ্টিতে আমি হেরেছি, তবু আমি আনন্দিত। কিন্তু এই লড়াইয়ে জয়ী টম কিং, দ্যা টম কিং, দ্যা… টম কিং বটে, কিন্তু আমিও কম জয়ী নই, এক অসাধারণ লড়াই লড়েছি। আশা করি আপনারা আমাকে মনে রাখবেন। এই মঞ্চ থেকেই টম কিং-কে চ্যালেঞ্জ দিয়ে রাখলাম, আগামী লড়াইয়ে আমি তাকে হারাবোই…’

৮.
সমস্ত গ্যালারী টম কিং-টম কিং চিৎকারে কেঁপে উঠল। স্যান্ডেল এসে টমকে জড়িয়ে ধরল। টম তার হাতে হাত মিলিয়ে বিদায় নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে এলো। তার কানে স্যান্ডেলের শেষ বাক্যটি বার বার প্রতিধ্বনি তুলছে- আাগামী লড়াইয়ে আমি তাকে হারাবোই… টম বুঝে গেছে সময় একদিন তার ঘুরে দাঁড়ানো থমকে দিবে। সে মঞ্চ থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে। পিছন থেকে ভাষ্যকারে উচ্চারণ শুনা গেল, বলছেন,
-‘টম কিং, দ্যা টম কিং, আ গ্রেট ফাইটার, বয়সের বাধা পেরিয়ে কেবল দৃঢ় ইচ্ছা শক্তিতে যিনি সকলের হৃদয় জয় করে গেছেন। টম কিং, দ্যা টম কিং, আ গ্রেট ফাইটার।’

অনেকেই টমের সাথে কথা বলতে চাইল, একজন সাংবাদিক, ক্লাব সেক্রেটারীসহ আরো অনেকে। কিন্তু টম সোজা বেরিয়ে এলো ড্রেসিং রুম থেকে। হাঁটতে হাঁটতে নির্জন রুমটিতে এসে বসল । একটি অবিশ্রান্ত ক্লান্তি এসে ভর করল তার সমস্ত দেহ জুড়ে।

মঞ্চটা সব সময় কি আনন্দঘন! কিন্তু যারা মঞ্চায়িত করে এ আনন্দ দৃশ্যপট, তাদের মাঝে কত উত্থান আর পতন। শুধু থেকে যায় কিছু লড়াকু দৃশ্যায়নের ইতিহাস। যখন জয়ী হয় তখন কত সমাঝদার চারিদিকে কিন্তু যখন এই মঞ্চ হতে বিদায় নেয় একজন লড়াকু, টম তা ভালো করেই জানে, কী নিঃস্ব, একা!

মুখ ঢেকে ফেলল টম কিং, তার প্রিয়জনদের মুখ ভেসে উঠল, তার স্ত্রী, বহুদিনের আপন আর পরীক্ষিত বন্ধু, প্রাণপ্রিয় সন্তানদের। টম কিং, দ্যা টম কিং হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
(সমাপ্ত)

দহন

দহন

১.
আজ রাশেদুল বারীর জন্মদিন। জ্যৈষ্ঠের সকালে তিনি জেগে উঠলেন। বাগানে পাখিরা গান গেয়ে উঠল। জানালা দিয়ে কমলা রঙের রোদ, তার মেঝেতে বিছানো বিছানা ছাড়িয়ে, বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ফলের ছবিযুক্ত ওয়ালপেপারে আছড়ে পড়েছে।

‘আজ আমার জন্মদিন’, অবশেষে তিনি আপন মনে বললেন, ‘আজ আমি ছিয়াত্তরে। দিনগুলো কত দ্রুত পালিয়ে গেল।’
তোষকটি বহুদিনের পুরানো, বহু ব্যবহৃত। এখানে সেখানে শক্ত হয়ে উঠেছে। কখনও কখনও শরীরে ব্যথা হয়। তিনি উঠলেন। জানালায় ঝুলানো টি-শার্টটি গায়ে চাপালেন আর বাগানের কাজে লেগে গেলেন। অনেক কাজ জমে আছে। আগাছা বেয়াদবের মতো বুক উঁচিয়ে আন্দোলনরত। ওদের পিষিয়ে ফেলতে হবে। দ্রুত কাজে লেগে গেলেনে। পিঠ টান টান হয়ে ওঠে। বাগানে গোলাপগুলো হাসছে, গাঁদাগুলো অগ্নিশিখার মতো জ্বলে উঠছে।
‘আজ আমার জন্মদিন’
ওদিকে একটি কুকুর ঘেউ-ঘেউ করে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। কাঁঠাল গাছটা চড়ুইয়ের কিচির-মিচিরে মুখরিত। এ দিকটায় ফলের বাগান। আম গাছগুলো তার শেষ সন্তানদের হারিয়ে বাঁজা মেয়ে মানুষের মত উড়নচণ্ডী। নিচে বিড়ালটা কৌশলী হয়ে লুকিয়ে আছে। ভেঙ্গে পড়া পাখির বাসার ভিতর, গতদিনের একটি ছোট পাউরুটির টুকরা থেকে টুকু টুক করে খেয়ে যাচ্ছে একটি ইঁদুর। সূর্যটা দাপট নিয়ে এগিয়ে আসছে মেঘমুক্ত আকাশে। বায়ুহীন একটি গরমের দিন এগিয়ে আসছে সময়ের রথে চড়ে। রাশেদুল বারী, ছিয়াত্তর, রান্না ঘরে বসে আছেন। নীরবতা। বাড়িটির উপরে মজবুত ছাদ, কংক্রিটের; গ্যাসের চুলায় লকলকে আগুন। বারী চিকন হাতে কৌটা থেকে টোস্ট নিয়ে যখন রুমে প্রবেশ করলেন, তার পায়ের আঘাতে কার্পেট থেকে ধুলা উড়ে তীর্যক কোমল আলোতে স্পষ্ট বলয় তৈরি করে ঘুরপাক খাচ্ছে।

বারী তার রিডিং রুমে এসে বসলেন। পত্রিকার পাতায় খুঁজে খুঁজে দেখলেন কোন্ কোন্ পণ্যের ডিস্কাউন্ট দেয়া হয়েছে। অত:পর তৃষ্ণার্ত হৃদয় নিয়ে লেটার বক্সটি পরীক্ষা করলেন, না কোন চিঠি আসেনি, না জন্মদিনের কোন শুভচ্ছো কার্ড, না বিদেশ থেকে, না দেশ থেকে। ছেলেমেয়েরা যার যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত- এই দিনটির খবর কে রাখে ?

২.
‘সময় উড়ছে’- তিনি বললেন।
প্রায়ই নিজে নিজে কথা বলে ওঠেন, কে শুনবে আর! তিনি টিভি রুমে এসে বসেন পুরান দিনের ঘড়ির ঘণ্টাটা বেজে ওঠে প্রতিঘণ্টা পর পর। একগুঁয়ে। টিভি অন করেন। নানা দেশের নিউজ চ্যানেলগুলোতে ঘোরেন। যখন টিভি বন্ধ করেন নানা দেশের খবরগুলো তাকে আক্রান্ত করে। খারাপ সংবাদগুলো টিভি বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেলের মত বিনোদন দিচ্ছে। পৃথিবীটা একটা নিষ্ঠুর ধ্বংসের লীলাক্ষেত্র হয়ে উঠেছে, কেউ দেখার নেই। মাঝে মাঝে বারী অদ্ভুত ভাষার চ্যানেলগুলো দেখেন, ভাষা বোঝা যায় না কিন্তু সংবাদদাতার চোখের চিক্ চিক্ ভাব দেখে বোঝা যায় যে, শিশু ধর্ষণের খবর দিচ্ছেন। মিডিয়াগুলো সাধারণ শ্রোতা-দর্শকদের হৃদয়ে আঘাত দিতে ভালবাসে। তারা ধ্বংস আর প্রবঞ্চনা-নির্যাতনকে বিনোদন হিসাবে উপস্থাপন করে।

একা একা কিছুক্ষণ হেসে ওঠেন বারী। তিনি বাইরে বেরুবার পোষাক পরে নেন। জানালা, দরজা ঠিকমত বন্ধ করেছেন কিনা একবার পরীক্ষা করে নেন। বাইরে থেকে তিনি, লোহার দরজাটা টেনে ধরেন। লোহায় মরিচা ধরে গেছে, তার মত, তিনি ভাবেন। সামনে তাকান।
সীমা সূর্যের আলোর মত হেসে দাঁড়িয়ে আছে।
‘হ্যাপি বার্থডে, রাশেদুল বারী’।
বারী তেমন অবাক হলেন না, আনন্দে ভেসে গেলেন না, কারণ তিনি জানেন সীমা বাস্তবিক অর্থে এখানে নেই।
সীমা, পনের বছরের। বারীর সাথে সারাক্ষণ লেগে থাকে। সে তার পিছন পিছন হেঁটে বেড়ায়, যখন বারী পার্কে বসেছিল, সীমা একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে। জবাবদিহিতার মতো বলছে, ‘আমি ভুলতে পারি না, মি: বারী !’
‘আমি জানি, আমি জানি’
‘তুমি কি আমাকে নিয়ে আবার খেলবে ? খেলবে ?’
‘আমি তা পারি না। তুমি মৃত।’

৩.
সূর্যটা সামান্য উপরে উঠে গেছে। সীমা ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করে যাচ্ছে।
‘বেচারা সীমা’ বারী ফিসফিস করতে থাকেন, ‘আমার মৃত প্রেমিকা’।
বারী সচরাচর সুপার মার্কেটগুলো এড়িয়ে চলেন। ওটা অনেক জটিল আর কোলাহলে মুখরিত। মানুষের বিকট চিৎকার। বাচ্চারা হাফিয়ে উঠে কান্না শুরু করে দেয়। অল্প বয়সের যুবকেরা কানে দুল লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারা চোখ দিয়ে ধর্ষণ করতে থাকে তারা ভিড় পছন্দ করে, দ্রুত সামনে এগিয়ে যায়। যুবতীরা এসব কোলাহল, ভিড় অপছন্দ করে বলে মনে হয় না। তারা আরো বেশি প্রত্যাশা করে। গৃহিণীরা তাড়াহুড়া করতে থাকে। তাদের বাচ্চারা কাঁদে, কাজের বুয়ারা তাদের সামলায়, নিজেরা একটু স্বাধীনতা উপভোগ করে নেয়। সুপার মার্কেটগুলো কোলাহলে মুখরিত, দ্রুত পদচারণায় চঞ্চল আর বারীর নিকট বিরক্তিকর আর একা।
তিনি ছোট বাজারে যান। পরিচিত দোকান থেকে দুধ, ডিম, পাউরুটি কিনেন। পাশের টেইলারিং দোকানটা মহিলা দ্বারা পরিচালিত। ত্রিশ বছরের মধ্যবয়সী তা পরিচালনা করে। বারী প্রায়ই সেখানে যান, গল্প করেন, চা খান।
‘কেমন চলছে দিন?’ মহিলা জিজ্ঞাসা করে।
‘ভাল। আল্লাহকে শুকরিয়া, তিনি ভালই রেখেছেন। তুমি?’
‘এই যাচ্ছে চলে…’
জীবনটা ভদ্রোচিত মিথ্যার সাথে সংগ্রামরত।

বারী তাতিয়ে ওঠা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যান, হাঁফিয়ে ওঠেন, ভাবেন বয়সতো আর কম নয়, ছিয়াত্তর। বাড়ি ফিরে আসেন। বিশাল দোতলা বাড়ি। সামনে ফুলের বাগান, পিছনে ফলের গাছ দ্বারা পরিবেষ্টিত সবুজের সমারোহ। এখানে রাশেদুল বারী একা থাকেন। তিনি দোতলার খোলা বারান্দায় আরাম চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেন। এখান থেকে রাস্তাটা দেখা যায়। গার্লস স্কুলের মেয়েরা ছুটির পর পরস্পর গল্প করতে করতে বাড়ি ফেরে। চুপ করে বসে থেকে তিনি তাদের দেখে যান। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বখাটে ছেলেগুলোর গতিবিধি তিনি দেখতে থাকেন আর ভাবেন, ‘আমি খুশি যে আমি আর যুবক হবো না।’

বায়ুহীন উত্তপ্ত দিন। অসহ্য। দীর্ঘ সময়। একা। ভালো লাগে না। তিনি বই পড়ার চেষ্টা করেন। চশমার পাওয়ার এতোটা বেশি নয় যে তিনি অক্ষরগুলো স্পষ্ট দেখতে পান। চশমাটা বদলাতে হবে। তিনি ভাবেন। একটি মুচকি হাসি তার ঠোঁটের কোণে ভেসে ওঠে।

৪.
সীমা ফিসফিস করে বলে যাচ্ছে এবং তার মাথার ভিতর চক্রাকারে একটি ঘণ্টা বেজে যাচ্ছে।
‘আমার সীমা, সীমা আমার, আমার সীমা।’
চোখ দুটি মুদিত। বিকারগ্রস্ত রোগী, বিড়বিড় করছে সে, একটা জীবন্ত স্বপ্ন যেন এবং তিনি স্পষ্ট কলিংবেল শুনতে পেলেন। তিনি দরজাটা খুলে দিলেন। দরজার ওপাশে সীমা দাঁড়িয়ে, পনের আর লাবণ্যময়ী, সূর্য শিখার মতো উজ্জ্বল। সীমা নারী আর বালিকার মাঝামাঝি, টলমল লাস্যময়ী।
‘তুমি কি আমাদের সাথে খেলতে আসবে না, বারী?’
পিছন থেকে আর একজন, বারীর মা হাসছেন।
সেই হাসিতে দৃশ্যপট বদলে গেল।

‘শোন সীমা, বারী আমার জন্য কিছু মার্কেটিং করতে যাবে, তুমি কি যাবে তার সাথে ?’
সীমা যেন এটুকুরই প্রতীক্ষায় ছিল। বারী, আঠার, সদাহাস্যময়ী প্রাণবন্ত মেয়ের সঙ্গ পাবার প্রত্যাশায় উল্লসিত হয়ে উঠল।
সীমা আর বারীকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন মা। মায়ের উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেল তার কণ্ঠস্বরে। রাস্তা সাবধানে পারাপারের পরামর্শ দিলেন। আর এমন আশংকা করলেন যেন সমস্ত রাস্তা জুড়ে ম্যালেরিয়া, হাম, পোলিও’র জীবাণু গিজগিজ করছে। একজন মা যেমন করেন।

সীমা এবং বারী, স্বপ্নগ্রস্ত, চুম্বকের মত আকর্ষণ বোধ করতে থাকলো। তারা অযথাই কথা বলছে, হাসছে। পরস্পর ভালবাসায় পতিত দুটি উল্লসিত আবেগ-প্রবণ যুবক-যুবতী। সীমা’র দাঁড় কাকের মত কুচকুচে কোঁকড়ানো চুল, মাঝে মাঝে সরিয়ে নিচ্ছে যা বার বার তার চেহারাকে ঢেকে দিচ্ছিল। আর বারী তাকে পূর্ণিমার চাঁদ ছাড়া কিছুই ভাবল না।
‘তুমি কি সবসময় আমাকে ভালবাসবে ?’
বারী জানতে চায়।
‘সবসময় এবং এখন’ বলে সীমা বারীর হাতটা ধরে রাখল। বারী সেই স্পর্শে গভীরভাবে কেঁপে উঠল। তারা মার্কেটিং এর পরিবর্তে পার্কের নির্জন স্থানে বসে রইল দীর্ঘ সময়। তারপর তাদের মুখ কথা বলল না আর, চোখ দুটি কথা বলল, ঠোঁট দুটি অপর দু’টি ঠোঁটে আশ্রয় নিল।

৫.
আঠার পর্যন্ত রাশেদুল বারী’র জীবনটা যেন গ্রীষ্মকালীন ছুটির মত ছিল। তারপর বারী, পিতার হাত ধরে, বাইরের জগতে ঢুকে গেল। তাদের বিশাল স্পিনিং মিলের দায়িত্বটা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য পাগল হয়ে গেলেন তার পিতা। তার পিতার বন্ধু মি: আজাদ। যা কিছু স্থিরকৃত বিশ্বাস সেখানেই তিনি বুনে যাচ্ছেন অবিশ্বাসের বীজ। ঈশ্বরের অস্তিত্বে সন্দিহান। পাপ বলে যা কিছু প্রচলিত তাতেই তার স্পষ্ট বিরোধিতা। মি: আজাদ যুক্তিবাদী। প্রেম-ভালবাসা তার কাছে হাস্যকর। তিনি বুঝান যে জগতের সকল মানবীয় প্রবণতার মূলে যৌনতা। ক্রমে ক্রমে মি: আজাদ বারীর আদর্শ হয়ে উঠলেন। মদ খাওয়াকে সে পাপ মনে করে না। তার মা তাকে বারণ করলে বলে- মদ কোন খারাপ জিনিস না মা। জগতের বড় বড় বিজ্ঞানী, কবি, সাহিত্যিক সকলেই মদ খেয়েছেন, খাচ্ছেন।
একদিন পার্টিতে ভরপুর মদ খেয়ে বাড়ি ফিরল বারী গভীর রাতে। সকালে সীমা উপস্থিত।
‘তোমার বাবা-মা কখন বাসা থেকে বেরিয়ে গেছেন, আর তুমি এখনও ঘুমে!’ সীমা বলে।
‘আমাকে বিছানা থেকে উঠতে সাহায্য কর’ বারী বলে।
সে খেলার সব নিয়ম-কানুন জেনে গেছে, প্রতারণার সমস্ত কৌশল।
সীমা ভালবাসার গন্ধ পাচ্ছিল। হারিয়ে গেল। সব কিছুই দিতে প্রস্তুত ছিল সীমা। কিন্তু একটি পরিচ্ছন্নতা উপহার হিসাবে রাখতে চাইছিল বাসর রাতের জন্য। বারী অস্থির ছিল, সে আরো চেয়েছিল, গভীর আকুতি নিয়ে।

কিছুদিন পর বারী বিমুখ হয়ে গেল।
‘তুমি কি আমাকে আর চাচ্ছোনা ?’
‘এমন ভাবছ কেন! হা হা হা ’ শারীরিক ভাষায় অবজ্ঞার প্রকাশ সুস্পষ্ট।
চোখের জলে সীমা ভিজে গেল। শরীর ব্যথাক্রান্ত হয়ে উঠল। হৃদয় বিবর্ণ।
বারী দুরন্ত হয়ে উঠল। প্রায়শই রুচির পরিবর্তন করতে লাগল।

৬.
সীমা গুরুতর অসুস্থ। বারী খবর পায়। যতক্ষণে বারী ফিরে এলো, ততক্ষণে সব শেষ।
কালো রক্ত তার ঠোঁটের কোণায় লেগে আছে। মুখনিঃসৃত লালাগুলো জমে রয়েছে দু-ঠোঁটের মাঝখানে।
‘আমার সীমা!’
কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বারী। দেরী হয়ে গেছে, খুব বেশি।
মা চিৎকার করে উঠলেন-
‘ তুই খুনি, তুই আমার মেয়েটাকে, আমার বোনের মেয়েটাকে খুন করেছিস। আমি খুন করেছি, আমি! আমি, তোদের ছাড়ব না। তোর বাবা, তুই পুরুষ মানুষ। ঘৃণা করি তোদের…’
বলতে বলতে মা ঢলে পড়লেন মেঝেতে। দু’টি লাশ পাশাপাশি দাফন করা হলো।
সময় চলে গেল। সীমা কুড়ি, কোনদিন একুশে এলোনা। মা মধ্যবয়সী কখনও বৃদ্ধা হলেন না।
বারী নিজের ভিতর ফিরে আসতে চেষ্টা করেই যাচ্ছেন। বহু কষ্টে ফিরে এলেন। মনে পড়ে তার আজ তার ছিয়াত্তরতম জন্মদিন। কেউ তাকে শুভেচ্ছা জানায়নি। না ছেলে, না মেয়ে। কে খবর রাখে এই দিনের?

৭.
চোখ বুঁজতেই ভয় পাচ্ছিলেন বারী। মেঘমুক্ত জ্যৈষ্ঠের আকাশ। চমৎকার চাঁদ উঠেছে। বারী জানালা বন্ধ করে দিলেন। ঘরের ভিতর ক্রমে গরমে ভয়াবহ হয়ে উঠছে। বারী বাইরে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন। স্পষ্ট দু’টি ছায়া বাইরে অপেক্ষারত। একটা দমকা হাওয়া। দরজাটা খুলে গেল। বারী হাসছে, প্রাণবন্ত যৌবনের সেই হাসি…
‘তুমি কি আসতে চাও, রাশেদুল বারী, তুমি কি আমাকে নিয়ে খেলবে ? আমাকে ?’
‘হ্যাঁ এখন আমি তা পারি। আমি তোমাকে ভালবাসি, শেষ পর্যন্ত তোমার বুকেই আমার আশ্রয়।’
‘আমি খুবই খুশি, রাশেদুল বারী। আমি দীর্ঘদিন তোমার প্রতীক্ষায় ছিলাম।’

বারী বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। প্রাণবন্ত যুবক।

ছিয়াত্তর বছরের একটি দেহ পড়ে রইল মেঝেতে। নীরব। নিস্তব্ধ। একা।

ক্ষুধার্ত বাঘ অথবা প্রেমময়ী নারী

১.
প্রিয় পাঠক, আজকের গল্পটি অনেক দিন আগেকার পটভূমিতে রচিত। এক দেশে এক রাজা ছিল। একরোখা। যখন তিনি কিছু করবেন বলে ভাবতেন, তা করতেন। যখন তার প্রজারা তার কথা বিনা দ্বিধায় মেনে নিত, তখন রাজা দিল দরিয়া হয়ে যেতেন। আর সামান্য এদিক ওদিক হলে রক্ষা নেই। ব্যাপারটা এমন প্রজারা একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে, যা রাজা তৈরী করে দিয়েছিলেন, সে পথে যদি চলে তবে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সব রকমের সাহায্য পাবে আর কখনও যদি কক্ষচ্যুত হয় তবে এক অভিনব ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হতো।

পাঠক, আমরা এই রাজার মুখোমুখি হবার আগে একটু অন্যদিক থেকে ঘুরে আসি।

২.
একটা সময় ছিল পৃথিবীতে যুদ্ধের পর যুদ্ধ চলতেই থাকতো। বর্বরতার সে সময়ে যুদ্ধে যারা বন্দী হতো তাদের বানানো হত ক্রীতদাস।

যুদ্ধে বন্দী লক্ষ লক্ষ দাস এবং রোমের অধীন প্রদেশগুলোয় নিষ্ঠুর অত্যাচার চালাবার ফলে রোমে দাসের সংখ্যা পরিমানে বেড়ে যায়। ফলে শত শত দাসদাসী কেনাবেচার বাজার গড়ে ওঠে। সবচেয়ে বড় বাজার ছিল ইজিয়ান সাগরের মধ্যে দেলোস দ্বীপ। এই বাজারে দিনে দশ হাজার পর্যন্ত দাসদাসী ক্রয়-বিক্রয় হত। আর তাদেরকে ব্যাবহার করা হত কৃষিকাজে, খনিতে, জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বা জাহাজের মাঝিমাল্লা হিসেবে।

এসব দাসদের মধ্যে যারা ক্ষিপ্র, চটপটে ও শক্তিশালী ছিল তাদেরকে রোমবাসীগণ অস্ত্রচালনা শিক্ষা দিত এবং পরে তাদের একজনকে অন্যজনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বাধ্য করত। এই দাসদের বলা হত গ্লাডিয়েটর (Gladiator)।

গ্লাডিয়েটরদের দ্বন্দ্বযুদ্ধ দেখার জন্যে অ্যাম্ফিফেয়াত্রোন বা অ্যাম্ফিথিয়েটার (Amphitheatre) তৈরী করা হয়েছিল, দেখতে ছিল সার্কাসের মঞ্চের মত। এর কেন্দ্রস্থলে থাকত বালুময় খোলা জায়গা যাকে বলা হত আরেনা (arena)। এই আরেনার চারদিকে ধাপে ধাপে দর্শকরা বসত। উৎসবের সময়ে এই গ্লাডিয়েটরদের দ্বৈরথ অনুষ্ঠিত হত বিনোদনের জন্যে। দাস মালিকেরা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে ঐ পৈশাচিক মল্লযুদ্ধ উপভোগ করত। যে সব দাস যুদ্ধে হেরে যেত কিন্তু তখনও বেঁচে থাকতো – এ ধরণের গ্লাডিয়েটরদের ভাগ্য দর্শকদের উপর নির্ভর করতো। দর্শকেরা হাত তুললে তার জীবন রক্ষা পেত, আর যদি তারা হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল নীচের দিকে করত, তাহলে বিজয়ী তাকে হত্যা করত। পরে ভৃত্যেরা আঙটা পরানো লাঠি দিয়ে মৃতদেহকে আরেনার বাইরে টেনে নিয়ে যেত।

সিংহ, বাঘ ও অন্যান্য হিংস্র পশুদের সাথেও গ্লাডিয়েটরদের এধরণের যুদ্ধ করতে হত।

৩.
আমাদের এই গল্পের রাজা এই বর্বরোচিত মল্লযুদ্ধ হতে অনুপ্রাণিত হয়ে এক অভিনব বিচারব্যবস্থা চালু করেন। রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তার। যখন কোন বিষয়ে নিজে সিদ্ধান্তে আসেন তা বাস্তবায়ন হতো।

তিনি একটি অ্যাম্ফিথিয়েটার গ্যালারী তৈরি করেছেন। জনগনের গ্লাডিয়েটরের পাশবিকতার মহাকাব্যিক উত্তেজনায় কাঁপানোর সুযোগ দিতে চান না তিনি। তিনি বিচারের এক উত্তেজনাকর কাব্য রচনা করেছিলেন। এখানে তার মত করে অপরাধীর শাস্তির ব্যবস্থা করা হত। আর যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি ভাগ্যগুণে নির্দোষী হত তাকে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন।

কেউ কোন একটি বিষয়ে অভিযুক্ত হলে বিষয়টি যদি রাজার আগ্রহ তৈরি করতো তখন জনসাধারণকে ঢোল পিটিয়ে তারিখ-সময় জানিয়ে দেয়া হতো। সেই নির্দিষ্ট দিনে নির্ধারিত হতো অভিযুক্ত ব্যক্তির ভাগ্য।

সকল লোকজন গ্যালারীতে সমবেত হলে রাজা তার সভা পরিষদ নিয়ে আসতেন। সবচেয়ে সুন্দর স্থানটিতে রাখা রাজসিংহাসনটিতে রাজা বসতেন। তার পরিষদ তাকে ঘিরে থাকত। রাজার ইশারায় একদিকের দরোজা দিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আরেনায় ঢুকিয়ে দেয়া হতো। তার উল্টো দিকে থাকত পাশাপাশি দুটি বন্ধ দরোজা। এই বিচারের ফয়সালা এই যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি এই দরজা দুটির দিকে এগিয়ে যাবে এবং যে কোন একটি দরজা খুলবে।

সে তার ইচ্ছামতো একটি দরজা খুলবে। কেউ তাকে কোন গাইড করবে না বা কেউ তাকে প্রভাবিত করবে না। যেই একটি দরজা খুললো। হতে পারে, একটা ক্ষুধার্ত বাঘ বেরিয়ে আসবে, হিংস্র আর খুবই নিষ্ঠুর, যাকে দীর্ঘদিন না খাইতে দিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে। বাঘটি মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পরবে, টুকরো টুকরো করে বিদীর্ণ করে ফেলবে। অপরাধীর এই শাস্তি!

একটা দুরন্ত লোহার ঘন্টা বেজে উঠবে। অরোনায় নিয়োজিত ভাড়াটিয়া লোকেরা উল্লাস করে উঠবে। বিশাল গ্যালারীর লোকেরা মাথা নিচু করে থাকবে। তাদের হৃদয় ব্যথিত হবে। তারা আফসোস করতে থাকবে, লোকটি কি প্রাণবন্ত ও সুন্দর ছিল কিম্বা কত বয়োবৃদ্ধ আর সম্মানিত ব্যক্তি ছিল। ভাগ্য কি নির্মম ভাবে শাস্তি দিল!

কিন্তু যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি অপর দরোজাটা খুলত তবে সে একজন মেয়ের সামনে পড়তো, সুশ্রী, লাবণ্যময়ী তরুণী। এটা মহামান্য রাজার পক্ষ থেকে উপহার, যাকে বিয়ে করে নিতে হতো দ্রুত। এটা কোন বিষয় নয় অভিযুক্ত ব্যক্তিটি বিবাহিত কিনা কিম্বা তার কোন পছন্দ ভালোবাসা আছে কিনা। রাজার কাছে এ ধরণের অজুহাতের কোন মূল্য নেই। অন্য একটা দরজা খুলে গেছে, রাজা তার উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা নিয়ে আরেনার ভিতর হাজির হতো। তার পিছনে কাজী হাজির। একদল কুমারী মেয়ে নাচতে নাচতে, ফুল ছিটাতে ছিটাতে, বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে এগুতো থাকতো। অনেক আনন্দের পর অভিযুক্ত ব্যক্তি নববধূ নিয়ে বাড়িতে ফিরত।

রাজার এই বিচার ন্যায় বিচার হিসাবে স্বীকৃত ছিল। কোন রূপ বিতর্কহীন। আসামী জানত না কোন দরোজায় সুন্দরী অপেক্ষা করছে। কোনরূপ পূর্ব ধারণা ছাড়াই সে দরজা খুলছে। সে জানত না কোন দরোজায় সে গ্রাস হবে আর কোন দরজায় বিয়ে। এই বিচার কার্যক্রমকে শুধু ন্যায্য দাবী করত তা নয় এটা সাথে সাথে বাস্তবায়ন করা হত। যে দোষী চিহ্নিত হত তাকে শাস্তি দেয়া হত আর যে নিরপরাধ তাকে পুরস্কৃত করা হতো। এই বিচার কার্যক্রম থেকে কিম্বা রাজার আরেনা হতে বের হওয়ার কোন সুযোগ ছিল না।

এই পদ্ধতিটি বেশ জনপ্রিয় ছিল। এই বিচারের দিন যখন সকলে সমবেত হতো তখন কেউ জানত না কে জবাই হবে বাঘের হাতে বা অধিকার করবে সুন্দরী। ব্যাপক আলোচনা হতো এ বিচার নিয়ে। ব্যাপক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের কারণে এই পদ্ধতিতে কোন প্রশ্ন উঠত না কোনদিন। কেননা অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজেই তার পরিণতির জন্য দায়ী ধরে নেয়া হতো।

৪.
রাজার এক কন্যা সন্তান ছিল। ফুটন্ত গোলাপ। তার সৌন্দর্য কল্পনাকে হার মানাত। রাজার চোখের মনি। সমস্ত মন প্রাণ দিয়ে রাজা তাকে ভালোবাসতেন। সেই রাজ্যে উচ্চ বংশীয়, পদমর্যাদায় উন্নত এক সুদর্শন যুবক রাজ কন্যাকে ভালোবাসত। রাজার কন্যা এই যুবকের ভালোবাসায় সাড়া দিয়েছিলো। কারণ যুবক শুধু দেখতেই সুন্দর ছিল না অত্যন্ত সাহসী যোদ্ধা ছিল সে, কয়েকটি যুদ্ধ জয়ের তিলক ছিল তার ললাটে। অনেক মাস যাবৎ যুবক যুবতীর প্রণয় চলছিল নির্বিঘ্নে। কিন্তু যখন ঘটনাটি রাজার দৃষ্টিতে আসে তখন তিনি কোন ধরনের দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছাড়া তাকে দোষী সাব্যস্ত করলেন এবং জেলে বন্দী করলেন। একটি তারিখ প্রচার করা হলো যেদিন রাজার বিচারালয়ে তার বিচার হবে।

এটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা রাজার জন্য, প্রজাদের জন্যও বটে। কারণ এর আগে এধরণের কোন ঘটনা ঘটেনি। রাজার মেয়েকে ভালোবাসার মত দুঃসাহস কেউ দেখায়নি।

বাঘের খাঁচায় সবচেয়ে হিংস্র, নির্দয় পশুকে না খাইয়ে রাখা হয়েছে যা বিচারের দিন আরেনার এক দরজার ও পাশে রেখে দেয়া হবে। আর যদি যুবক নির্দোষ দরোজা খোলে, তার সাথে মানানসই ভারসাম্যপূর্ণ কুমারী নির্বাচন করা হয়েছে। সকলেই জানে যুবকের অপরাধ রাজ কন্যাকে ভালোবাসা কিন্তু রাজা তার বিচার ব্যবস্থাতে কোন ধরনের শৈথিল্য পছন্দ করেন না। অনেক অনন্দ আর সন্তুষ্টির সাথে তিনি তার প্রবর্তন করেছেন। এটা কোন ঘটনা নয় যে, কন্যার ভালোবাসার পরিণতি কি হবে, তিনি সমস্ত ঘটনাটিকে উপভোগ করছেন। তিনি তার বিচার ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখতে দৃঢ প্রতিজ্ঞ। এটা তিনি তার ভাবনাতে আনতে রাজি নন যে, তার কন্যাকে ভালোবেসে যুবক কিছু অপরাধ করেছে কিনা।

নির্দিষ্ট দিনে জনসমাগম হতে থাকলো বিচারালয়ের কাছে। আরেনা টইটম্বুর, যারা প্রবেশের অনুমতি পায়নি তারা দেয়ালের বাইরে ভিড় জমাতে থাকলো, চিৎকার চেচামেচি করতে লাগলো। রাজা যমজ দরোজা দুইটার বিপরীতে তার রাজকীয় আসনে বসলেন।

সবকিছু ঠিকঠাক। সংকেত দেয়া হলো। রাজকন্যার প্রেমিককে আরেনার ভিতর ঠেলে দেয়া হলো। দর্শক স্তম্ভিত হয়ে দেখল সুদর্শন, বলিষ্ঠ গড়নের সুঠাম দেহের অধিকারী এক যুবককে ঠেলা দেয়া হচ্ছে বিচারের মুখোমুখি। অনেকে এই যুবককে দেখেনি আগে কিন্তু এমন ছেলেকে ভালোবেসে রাজকন্যা কোন ভুল করেনি এটা মেনে নিতে কারো কোন দ্বিধা থাকলো না। অথচ তার সামনে কি ভয়ানক সময় অপেক্ষা করছে।

৫.
যুবককে আরেনায় প্রবেশ করানো হল। প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী রাজাকে মাথা নোয়ায়ে সমানে এগিয়ে যাবার কথা। কিন্তু তার সেদিকে খেয়াল নেই। সে রাজার ডানদিকে বসা রাজকন্যার দিকে তাকিয়ে রইল। রাজকন্যা এই মহিমান্বিত বিচারে আগ্রহী নয় মোটেই। কিন্তু আজ তাকে এখানে আসতেই হলো। এই বিচারটি যে তারই কর্মফল।

বিচারের ফরমান যখন সামনে এলো তখন থেকে দিনরাত সে কিছুই ভাবল না। কিন্তু যা কখনো কেউ করতে সাহস পায় নাই তাই সে করল। সে ঐ দুইটি রুমের খোঁজ নিল। নিজের ইচ্ছা, ক্ষমতা, প্রভাব পরিচিত আর স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে সে জেনে নিয়েছে কোন দরোজা খুললে তার প্রেমিক বাঘের মুখোমুখি হবে আর কোনটা খুললে সুন্দরী মেয়ের মুখোমুখি হবে।

এবং সে শুধু জানল না কোন রুমটাতে সুন্দরীকে রাখা হয়েছে বরং কাকে রাখা হয়েছে তাও জেনে গেল। এখানে এই রাজ্যের সবচেয়ে সুন্দরীতমা, লাবণ্যময়ী কুমারী নারীকে রাখা হয়েছে উপহার হিসাবে তাকে রাজকন্যা পূর্ব হতে চিনত। দুই একবার তার প্রেমিকের সাথে এই মেয়েকে কথা বলতে দেখেছে। আর নারীসুলভ দৃষ্টিতে রাজকন্যা ঐ মেয়ের চোখে যুবকের প্রতি ভালোবাসা দেখেছে। এটা সেই মেয়ে যে রাজকন্যার ভালোবাসার দিকে মন দিয়ে তাকিয়েছিল। রাজকন্যার ভিতর বইয়ে বেড়াচ্ছে রাজার বংশধারা। রুমের ভিতর জড়োসড়ো হয়ে লজ্জিত মুখে বসে থাকা নারীর প্রতি রাজকন্যার ঘৃণা প্রবাহিত হতে থাকলো।

এদিকে, এই হট্টগোলের মাঝেও যখন যুবক রাজকন্যার দিকে অপলক ভাবে প্রচণ্ড নির্ভরতা নিয়ে তাকিয়ে রইল, তখন রাজকন্যা প্রেমিকের চোখে চোখ রাখল, তার মনে হলো এক প্রেমময় আর নিষ্পাপ চাহুনি! তারা দু’জন বুঝতে পারল তাদের দু’টি আত্মা এক হয়ে গেছে। একটা তীক্ষ্ণ চাহুনি যখন রাজকন্যার কাছে জানতে চাইল ‘কোনটি’, রাজকন্যার এর উত্তর দেয়া ছাড়া কোন পথ খোলা থাকল না।

রাজকন্যার ডান হাত কুশনের উপর রেখে তাকিয়েছিল। তার হাত একটু শুইয়ে দিয়ে ইশারা দিল ডান দিকে, কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পেল না কিছুই কিন্তু প্রেমিক ছুটল প্রেমিকার ইশারায়। সমস্ত গ্যালারী স্তব্ধ হয়ে রইল, যুবক এগিয়ে গেল ডানদিকে, ডানদিকের দরোজার হাতল ছুঁলো এবং সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে খুলে ফেলল ডানদিকের দরোজা।

৬.
গল্পের এইখানে এসে আমি থমকে গেলাম। কি অপেক্ষা করছে দরোজার ওপাশে। ক্ষুধার্ত বাঘ নাকি প্রেমময়ী নারী?

রাজকন্যা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না এমন এক দৃশ্য যেখানে তার প্রেমিক তার প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে হাত রেখে ফুল বিছানো পথে হেঁটে যাবে। তার রক্তে বইছে পিতার রক্ত। ঈর্ষা থেকে না হোক প্রাচীন বিশ্বাস থেকে সে চাইতে পারে ওপারের জগতে গিয়ে অপেক্ষা করুক, তারপর রাজকন্যা পিতার সামনে নিজেকে হত্যা করে চলে যাবে তার কাছে। তবে কি ডানদিকের দরোজায় অপেক্ষা করছে ক্ষুধার্ত বাঘ?

এখানে আর একটা পয়েন্ট আমার মনে উকি দিচ্ছে, যতই ঈর্ষা কাতর হোক রাজকন্যা অনেক আগে থেকেই জানত কোথায় অবস্থান করছে সেই প্রতিদ্বন্দ্বী নারী। সে হয়ত শান্ত মাথায় নিজের ভালোবাসাকে উৎসর্গ করে দিল। সে ক্ষেত্রে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মত বলে দিতে পারি গল্পটি বলছে, বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না দূরেও সরিয়ে দেয়। তবে কি ডানদিকের দরোজায় অপেক্ষা করছে প্রেমময়ী নারী ?

কিন্তু পাঠক আমি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না গল্পের ইতি টানতে। তাই এই গল্পের ইতি আমি একা টানতে চাই না। তোমাদের কাছে জানতে চাই। প্রিয় পাঠক, তবে তোমরাই বলো, ডান দিকের দরোজায় কি অপেক্ষা করছে, ক্ষুধার্ত বাঘ নাকি প্রেমময়ী নারী?

একজন পাঠক এসে আমায় চুপি চুপি বলে গেল, গল্পের এখানে থামবেন না হে প্রিয় গল্পকার, তারচেয়ে নায়ককে দাঁড় করিয়ে দিন বাঘের সামনে, বিপুল বিক্রমে জিতিয়ে দিন তাকে। জনতার ক্রোধকে দিন বাড়িয়ে। বীরযোদ্ধা একনিষ্ঠ প্রেমিক নেতৃত্ব দিয়ে বাঘকে পরাজিত করে ছিনিয়ে আনুক রাজার কাছ থেকে রাজকন্যাকে।
আমি বলি, তাহলে তো ভেঙে পড়বে একটি প্রতিষ্ঠিত বিচার ব্যবস্থা।
পাঠক বললো, তবে তাই হোক।

পাপিয়া এবং লাল গোলাপ

te-rose

১.
যুবক ছাত্র হতাশ হয়ে কান্নার স্বরে চিৎকার করে বলছে “একটি লাল গোলাপ যদি উপহার দেই, আমার সাথে নাচবে তবে সে কিন্তু কপাল আমার মন্দ! লাল গোলাপ নেই বাগানে।”

কৃষ্ণচূড়া গাছের লাল, কমলা ফুল হলুদে আঁকা এবং সবুজ পাতা অন্যরকম দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। ওখানে এক পাপিয়া বসে অবাক হয়ে দেখলো, কৃষ্ণচূড়ার তলে হতাশ হয়ে কাঁদছে যুবক, জল চোখের কোনে ফোটায় ফোটা। বলছে, ‘সুখ কতটা সরল! জ্ঞানের কথা যা বইয়ে লেখা নিয়েছি পড়ে। অথচ সামান্য লাল গোলাপ আমার জীবনটা বেহুদা করে তুলছে।’

পাপিয়া বললো, ‘অবশেষে এক সত্যিকারের প্রেমিক পাওয়া গেল। রাতের পর রাত আমি তার গান গাই, যদিও তাকে দেখনি আমি কোনদিন। রাতের পর রাত তারার কাছে যার গল্প বলে যাই, আজ পেলাম তাহার দেখা। চুল তার কুচকুচে কালো, কুঁকড়ানো আর ঠোঁটটি লাল যেন লাল গোলাপ। অথচ চেহারা মলিন, কপাল কুঞ্চিত।’

‘আগামীকাল সন্ধ্যায় শুরু চলবে ভোর পর্যন্ত জন্ম দিনের উৎসব!’ যুবক ছাত্র পাগলের মত চলল বলে- ‘দিয়াছে কথা আমায়, যদি গোলাপ পারি দিতে উপহার তবে সে সকাল পর্যন্ত আমাকে সময় দিবে। রাখবে হাত আমার হাতে, জড়িয়ে নিবে বাহুতে আমাকে, বাহুতে আমার রাখবে মাথা। আমার বাগানে লাল গোলাপ নেই। আমি সারারাত অপার হয়ে রইব বসে একাকী, সামনে দিয়ে চলে যাবে ভালোবাসা, তাকে ছুয়ে দেখার অনুমতি মিলবে না। সে আমার দিকে ফিরেও তাকাবে না, হৃদয় ভেঙ্গে যাবে আমার।’

২.
‘এখানে বাস্তবিক সত্যিকারের প্রেমিক!’ পাপিয়া পিউ পিউ বলে চলল,’ ভালোবাসা সত্যি এক আশ্চর্যজনক অনুভূতি। মনিমুক্তার চেয়ে অমূল্য, পান্নার চেয়ে প্রিয়। কোন কিছু দিয়ে যায় না তারে কিনা, আর না বেচে কেউ তারে হাটে বন্দর শহরে। বড় সওদাগর না পারে সওদা করতে তারে, স্বর্ণের ওজনে যায় না তারে মাপা।’

‘মিউজিক চলবে, নামীদামী ক্লাসিক বাদকের দল’ বলে চলছে যুবক ছাত্র- ‘তালের সেই সূর মূর্ছনায় নাচবে আমার ভালোবাসা। সেই কি নৃত্য! মাটি ছুঁবে না তার পা, ঘিরে থাকবে নানান বর্ণের পোশাক সজ্জিত সহচর-সহচরী। কিন্তু একটু নজর দিবে না সে আমার দিকে, আমার নাই লাল গোলাপ।’ অনন্ত বিলাপ ! যুবক কেঁদে উঠল ফুঁপিয়ে।

পাপিয়ার পিউ পিউ ডাক নকল করে কমলা পেট পাতা বুলবুলি যাকে আমরা অন্য পাখির স্বর নকল করে ডাকতে পারে তাই কমলা পেট হরবোলা বলি, বলল,’ কাঁদছে কেন ছেলেটা?’

রঙিন ডানা মেলে রবিকরে উড়াউড়ি করছিল একটা রঙিন প্রজাপতি। ‘কেন কাঁদছে, কি কারণে, আহারে’ ব্যথিত হয়ে জানতে চাইল।

‘কেন কাঁদছে’ পাশে বাতাসে দুলতে থাকা ফুলের গাছটি মোলায়েম স্বরে চাইল জানতে। পাপিয়া বলল, ‘বুঝবে কেবা, একটা লাল গোলাপে জন্য কাঁদছে প্রেমিক যুবা।’

‘একটা গোলাপের জন্য কাঁদছে! কি হাস্যকর!’ বলে ছেলেটার কান্না নকল করে কমলা পেট পাতা বুলবুলি হরবোলা হাসাহাসি শুরু করে দিল। একটা ব্যপক আমোদ ছড়িয়ে পড়ল বাগানে।

কিন্তু পাপিয়া ছাত্রটির দুঃখের কারণটা অনুধাবন করছে। চুপ করে রইল। সে ভালোবাসার রহস্য খোঁজার চেষ্টা করছে।

৩.
হঠাৎ তার খয়েরী রঙের ডানা বাতাসে মেলে দিল। সে ঘন পল্লবে ঘেরা ছোট গ্রামের উপর দিয়ে ছায়ার মতো উড়ে গেল। সে ছায়ার মতো উড়ে গেল নানা বীথিকা ঘেরা নয়নাভিরাম বাগানের উপর দিয়ে। এই বাগানে একটি গোলাপের গাছ দেখতে পেল। সে গাছে এসে পাখা ঝাপটিয়ে ডালের উপর বসল।

পাপিয়া কাকুতিমিনতি সূরে গাছকে বলল,’আমাকে একটা লাল গোলাপ দাও, আমি তোমাকে আমার সবচেয়ে মিষ্টি গানটি শোনাব।’

গোলাপ গাছ বলল, ‘কিন্তু আমার গোলাপ সাদা। আমার গোলাপ এতটাই সাদা যে মনে হবে সমুদ্রের ফেনা। আর এক জায়গায় পাবে তুমি এমন সাদা যখন বরফে ঢেকে যায় পাহাড়, এক অলৌকিক পবিত্রতায় আর সাদায় উজ্জ্বল হয়ে থাকে। যদি তেমন সাদা গোলাপ চাও তবে নিয়ে নাও। আর যদি তা না চাও তবে ঐ বনে ধারে যাও চলে, সেখানে আমার এক ভাই বসবাস করে, তার কাছে পেতে পারো তুমি যা চাও।’

পাপিয়া বনের ধারে এসে কাকুতিমিনতি সূরে গোলাপ গাছকে বলল, ‘আমাকে একটা লাল গোলাপ দাও, আমি তোমাকে আমার সবচেয়ে মিষ্টি গানটি শোনাব।’

গাছ বলল, ‘আমার গোলাপ হলুদ। মৎস্যকন্যার চুলের মতো হলুদ যা ট্রাফিক সিগনালের মধ্যের বাতিতে উঠে জ্বলে। যদি তুমি তেমন হলুদ গোলাপ চাও তবে নিয়ে নাও। কিন্তু লাল গোলাপ পাবে তুমি ঐ যে প্রফেসরের নিকট ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য পড়াশুনা করছে যে ছাত্রটি তার জানালার পাশে থাকে গোলাপ গাছটিতে। তুমি সেখানে চলে যাও।’

৪.
অবশেষে পাপিয়া প্রেমিক ছাত্রটির জানালার পাশে গোলাপ গাছের ডালে এসে বসল। বলল,’আমাকে একটা লাল গোলাপ দাও, আমি আমার সবচেয়ে মধুরতম গান তোমাকে শুনাব।’

গাছ জানানো, তার গোলাপ লাল। এমন লাল যেন লাল লেজ মৌটুসীর লেজের মত লাল। এমন লাল যা দেখা যায় সমুদ্রের জলে ভেসে বেড়ানো লাল প্রবালের প্রাঞ্জলতায়। তারপর দুঃখের সাথে বলল, ‘কিন্তু এই শীতের ভয়াবহ ঠান্ডায় আমার শিরা মরে গেছে, আমার কুড়ি ঝরে গেছে, আর ঝড়ে ভেঙে গেছে আমার ডাল। হয়ত সারা বছরে ফুল ফুটবে না।’

পাপিয়া অস্থির হয়ে উঠল। বলল, ‘অন্তত একটা লাল ফুল দাও। এটা আমার খুবই দরকার।’

গাছ জানাল, ‘একটা উপায় আছে প্রিয় সহযোগী পাপিয়া। কিন্তু সেটা তোমাকে বলতে মন চাইছে না।’

‘বল আমাকে। কি সেই উপায়। বল তুমি দ্বিধাহীনভাবে।’

‘তবে বলি তোমায় সেই উপায়। একমাত্র তুমি পারো লাল গোলাপ ফোটাতে। তোমাকে গানের শৈল্পিকতা আনতে হবে চন্দ্রকিরণ হতে। আমাতে তা প্রবাহিত করতে হবে তোমার হৃদয়ের রক্ত মিশিয়ে। আমার প্রতি গাইবে তুমি কণ্ঠের চেয়ে হৃদয়ের স্পষ্ট স্পন্দনে। তোমার জীবন রক্ত প্রবাহিত করতে হবে আমার শিরা উপশিরায়।’

‘যেহেতু চাও লাল গোলাপ’, বলল গাছ, ‘চন্দালোকের সংগীতে তা তোমাকে গড়ে তুলতে হবে, তার সাথে মিশাতে হবে তোমার হৃদয়ের লও। কণ্ঠের বিপরীতে বুকের গহীন থেকে গাইতে হবে গান। সারারাত আমার প্রতি নিবেদিত হতে হবে সেই গান। তোমার জীবন রক্ত আমার শিরায় বইতে হবে, হতে হবে আমার।’

‘একটা লাল গোলাপের মূল্য চুকাতে হবে জীবন দিয়ে’ আর্তনাদ করে উঠল পাপিয়া, ‘জীবন সবচেয়ে আপন সকলের কাছে। সবুজ গাছে বসা, স্বর্ণের রথে চড়ে আসা সূর্যের আলো, মুক্তার ঝলমলে আলোর বাহনে আসা চাঁদের কিরণ- কতইনা প্রিয়। এইসব জীবনের তরঙ্গ মধুরতম, তারচেয়েও মধুর ভালোবাসা। ভালোবাসা জীবনের চেয়েও ভালো। মানুষের হৃদয় কি পাখির হৃদয়ের মতো নয়?’

৫.
পাখিটি তার খয়েরী রঙের ডানা মেলে উড়াল দিল এবং বাতাসে সাঁতার কাটলো। সে বাগানের উপর দিয়ে উড়ালপথে চলল কিছু সময়, সে ঘন বনের উপরে কয়েক চক্কর দিল।

ছাত্রটি তখনও ঘাসের উপর শুয়ে আছে যেখানে তার সাথে তার সর্বশেষ কথা হয়েছে। এখনও তার চোখের জল অনবরত ঝরছে।

‘সুখী হও, ‘পাপিয়া বলল,’সুখী হও। তুমি পাবে তোমার কাঙ্খিত লাল গোলাপ। চাদের আলোর মায়াবী কম্পনজাত সংগীতে আমি তাকে জাগিয়ে তুলব আর মিশিয়ে দিব আমার বুকের তাজা রক্তে। এসব এ কারণে করব কারণ তুমি একজন সত্যিকারের প্রেমিক পুরুষ। মনে রেখো ভালোবাসা ফিলোসোফির চেয়ে জ্ঞানী, রাজার চেয়ে ক্ষমতাবান। আগুনের শিখার মতো গায়ের রঙ তার, সেই বর্ণ প্রকাশিত হয় প্রেমিকের দেহে যা আমি খোঁজে পেয়েছি তোমার দেহে।’

যুবক ঘাসে চিৎ হয়ে শুয়ে শুনছিল পাপিয়ার কথা, কিছুই বুঝল না। সে কেবল ফিলোসোফি বইয়ের ভাষাই বুঝতে পারে।

কিন্তু ঐ যে হিজল, তমাল, মহুয়া গাছেরা, তারা বুঝেছিল সেই ভাষা। তারা চুপি চুপি বলে যায় পাপিয়া যেন তার শেষ সময়ের গানটি শুনিয়ে যায়।

হিজল গাছটি ঝিরিঝিরি করে বলে গেল,’যখন তুমি চলে যাবে বড় একা হয়ে যাব। তোমার গান শুনিয়ে যাও আমায়।’
পাপিয়া গেয়ে গেল গান, তার কণ্ঠে যেন অনন্তকালের অনন্য সংগীত বেজে উঠলো।
যুবক চলে গেল তার কামড়াতে।
রাত নেমে এলো চরাচরে। নেমে এলো চাঁদের স্বর্গীয় আলো। পাপিয়ে উড়ে এসে বসল গোলাপ গাছে।

সারারাত ব্যাপী পাপিয়া ডেকে চলল তার হৃদয় ছেড়া গান। রাত বাড়তে থাকলে গভীর থেকে গভীর হলো হৃদয়ের প্রতিধ্বনি, টুকরো টুকরো হয়ে যেতে থাকল পাপিয়ার বুক। যখন স্বর উঠলো চরমে একটা অলৌকিক ফুল ফোটল গোলাপ গাছটায়। গাছ বলে চললো আরও জোরে জোরে গাও, আরও দ্রুত, আরও ঘন। হয়ত নেমে আসবে ভোর, তখনও ফোটবে না পুরো ফুল। পাপিয়া গেয়ে উঠলো আরও আরও জোরে, তন্ময় হয়ে, বুকে তার একটা ব্যাথা জেগে উঠলো, আরও ব্যাথা আরও। তার জীবনের রক্ত বইয়ে গেলো গোলাপ গাছের শিরা উপশিরায়। একটা অফুরন্ত সৌন্দর্যমাখা লাল গোলাপ জেগে উঠলো গাছ জুড়ে। গাছ চিৎকার করে উঠলো, ‘দেখো কি অসাধারণ লাল গোলাপ!’ কিন্তু পাপিয়া নিথর।

৬.
দুপুরে ছাত্রটি জানালা খুলে বাইরে তাকাল। সে চিৎকার করে উঠলো,’ কি আশ্চর্য! কি সৌভাগ্য আমার! এখানে একটি লাল গোলাপ, আমার সারা জীবনে এমন অসাধারণ গোলাপ দেখিনি আমি।’ সে ফুলটি ছিড়ে নিয়ে প্রফেসরের বাসায় হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছল।

প্রফেসরের কন্যা নীল রঙের মখমলের শাড়ি পরে বসে আছে। যুবক বলল, ’তুমি আমায় বলেছিলে যদি লাল গোলাপ এনে দেই, তবে তুমি আমার সাথে নাচবে। দেখো পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ লাল গোলাপ তোমাকে নিবেদন করছি। এটা খোঁপায় পড়ে নাও, এটাই তোমাকে বলে দিবে কতটা ভালোবাসি তোমায়।’

কন্যা বলল, ’আজ আমি যে রঙের শাড়ি পড়েছি, এ ফুলটি তার সাথে ম্যাচিং করবে না, দেখো আমার শাড়ির রঙটি, দেখো।‘

যুবক রেগে গেল,’ তুমি আমাকে বলোনি লাল গোলাপ এনে দিলে তুমি আমাকে ভালোবাসবে। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর লাল গোলাপ এনেছি, আনিনি?’

‘হা বলেছি। তুমি খুবই বিরক্ত করছিলে, পাগলের মতো করছিলে। তাই বলেছি। দেখো, তুমি এখন যাও, বাবার কামড়ায় বসে আছে তার পছন্দের এক ছাত্র , সে এনেছে আমার জন্য মুক্তোর নেকলেস। সে এখন সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আর তুমি এনেছো সামান্য গোলাপ। তুমি কি? তুমি একজন সাধারণত ছাত্র মাত্র।’

ছাত্রটি লাল গোলাপ ছুড়ে ফেললো রাস্তায়, একটা বাচ্চা ছেলের সাইকেলের চাকার নিচে পড়ে থেতলে গেল।
ছাত্রটি হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো। মনে মনে বলছে, ‘প্রেম কত বিরক্তিকর জিনিস। এর অর্ধেকটাও যুক্তি যুক্ত নয়। এটা কিচ্ছু প্রমাণ করে না। সব সময় এমন কথা বলে যা কখনো ঘটে না। এটা এমন কথা বলে যা সত্যি নয়। এটা একেবারে অবাস্তব। আমাকে প্রতিটি ব্যাপারে বাস্তবমূখী হতে হবে। আমি আমার ফিলোসোফি আর মেটাফিজিক্সে ফিরে যাব।’

বাড়ি ফিরে যুবক ধুলোমাখা বইগুলো টেনে নিল আবার পড়া শুরু করল।

সমাপ্ত।

শূন্য গ্লাস থেকে সমুদ্র যাত্রা

এর মাঝে? তাকিয়ে থাকি।
বৃষ্টির দিনে ঘরের ভিতর ছাতা খুলে রাখি।
জুতা জোড়া দিয়ে পাতিলে
দেই তাপ আগুনে।
হায়রে ভুল, কেবলি ভুল।
ভুল মজ্জাগত, অকুল।

শৈশব থেকে আমি সেই জন, ছোট খাট,
কুঁকড়ানো কালো চুলের সংক্ষিপ্ত ছাট-
অনুগত ছিলাম, বয়স্করা ফুট-ফরমাশ খাটিয়ে নিত
অন্য ছেলেমেয়েদের ভয়ে কুঁকড়ে থাকতে হতো।
বদলাইনি আমি কোনদিন,
কিন্তু ভয় জয় করে ঘুরে দাড়ালাম হাতে নিয়ে লাঠি
ফলে গ্লাসের ভিতরে,
বোধের বিমূর্ত জোয়ারে
রাতারাতি অনুগত থেকে বিদ্রোহী হয়ে উঠি।

এটা কি সমুদ্র ছিল বিশালতা জাগানিয়া?
ঐশ্বরিক শক্তির প্রতিক্রিয়া?
আমি প্রর্থনা করি যেন নিরাপদ থাকি।
আমি ভালো মানুষ হতে চেষ্টা করি। একি?
পরবর্তীতে মনে হলো,
যার শুরু বিদ্রোহে হলো
এবং পরিমাপক হলো আত্মনিমগ্নতা
তা প্রকৃতপক্ষে বিকশিত করল আমার মানবিকতা।

আমার বন্ধুরা কি বুঝাতে চেয়েছিল?
অবশেষে আমার হাতে রেখে হাত বলেছিল-
আনুগত্যের অপব্যবহারটা বুঝতে পেরেছি
কিন্তু আমি ঘৃণাকে গ্রহন করেছি
বুঝিয়েছিল আমি কিছুটা অসুস্থ,
অনেক ছোট ব্যাপারে দিয়েছি অনেক বেশি মূল্য।

তারা বুঝাতে চেয়েছিল আমি ভালো ছিলাম-
একজন ভালো বন্ধু, একজন ভালো মানুষ। আজীব
আমি জানি আমি ছিলাম উদ্দীপনাহীন জীব!

আমি নির্লিপ্ত থাকি।
আমি সূর্যের মতো সুস্পষ্ট ছিলাম, রুক্ষতা ধিকিধিকি
সকলে আকর্ষণীয় অনুমানে তৈরি করছে নিজেকে।
যা কিছু ঘটে তার জন্য বিশ্বাস করে না প্রচেষ্টাকে
অবশ্যই কিছু জিনিস সামান্য প্রচেষ্টায় পাওয়া যায়।
অবশ্যই সুবিশাল জ্ঞান, অসীম ক্ষমতা দেখা যায়।
ভালোকে খারাপে পরিচালিত করার প্রচেষ্টা সচল।

এসব ছাড়া আমরা কারা চলি অবিরল?
অন্ধকার হাতড়ে বিশ্বে পরিভ্রমণকারী-
আলোর দিকে ভ্রাম্যমান আধারের যাত্রী।

আমাদের কি আছে তাহলে?
দুঃখজনক নোনা কৌশলে,
সিড়ি এবং জুতা, শুদ্ধ প্রেরণা, প্রতিরোধের ছাতা
আলোকিত চরিত্র গঠনের পদক্ষেপ, মানবিকতা।

এই বিশাল শক্তি কি আমাদের উপর ক্রুদ্ধ হয়ে আছে? বিশাল শক্তিকে শান্ত করার আমাদের কি করার আছে?
এবং দিনশেষে আমি ভাবি-
এটা সেই প্রশ্ন, অতৃপ্ত মনের ছবি
যা টাইটানিক ধ্বংস হবার পর উঠেছিল জেগে
সমুদ্রের বুকে অদম্য জাহাজ ছুটছিল সগর্ব বেগে
অদৃশ্য অজানা শক্তি রূপ নিয়ে বরফে
হয়ে উঠলো প্রাণঘাতী, অস্থির, বিক্ষোভে।
তারা উদ্যত ছিল অহংকারে
ভেবেছিল সবকিছু প্রচেষ্টা নিয়ন্ত্রণ করে।
সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হবার নয়।
আমরা কেবল ভুল করতে করতে করে ভয় জয়
আবিষ্কার করতে পারি মানবিকতার স্বরূপ।
আর বলতে পারি-
আমার কিছুই নাই, আছি তোমার ক্ষমায় অপরূপ।

সন্তানের প্রতি

আমরা স্বপ্নদ্রষ্টা!
আমরা জানি না আমরা কারা!

কিছু প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় আমরা তৈরী হয়েছি,
পৃথিবীর কিছু সংকীর্ণ উপাদানে যা বিদ্যমান,
তারপর একে পরিশুদ্ধ করার প্রচেষ্টা।

আমরা স্বপ্ন!
আমরা মনে করতে পারি না!

পরিবার,
লোমশ অন্ধকার,
মায়ের জঙ্গল।
মায়ের শরীর ;
তার ভিতরে পরিচ্ছন্ন শহর।

তারও আগে; মৃত্তিকা জল।
পাথরের ভিতরের শৈবাল, টুকরো পাতা, ঘাস।
মহান অন্ধকরের লুকিয়ে থাকা কোষ।
তারও পরে পৃথিবীর পর্দা ভেদ করা চিৎকার।

এসব কারণে এভাবে তুমি জন্মেছিলে;
আমার স্তব্ধতায়
আমার পিতা মাতার কোষগুলি,
তোমাতে মৌলিক রূপান্তর,
একটা মহান শিল্পকর্মে।

আমি অসম্পূর্ণ;
আমি কখনো জানতে পারিনি।
এখন তোমার সময়,
তুমি জানতে চাইতে পার;
কেন আমি এসেছি?
কেন আমি এতটা অজ্ঞ?

মহান অন্ধকারের ভিতরকার কোষ।
কিছু প্রাকৃতিক পক্রিয়াতে আমরা জন্মাই;
এখন তোমার পালা, সেই পুরাতন জিজ্ঞাসার-
আমি কিসের জন্য? আমি কিসের জন্য?

অর্ধেক মানবিক আর অর্ধেক পশু

একটা সময় মানুষ কিছু করে
একটা সময় মানুষ কিছু বলে
একটা সময় মানুষ ঘুম ঘোরে
একটা সময চুমোয় সৃষ্টির গালে

একটা সময় মানুষ ঘর ছাড়ে
একটা সময় মানুষ ঘরে ফিরে
একটা সময় আকাশ পানে ছুটে
একটা সময় সাগর টানে হাটে
একটা সময় মানুষ হতে চায়
একটা সময় পশুতে ফিরে যায়।

ফকির মালেক পায় না খুঁজে দিশা
মানুষ অর্ধেক তরল অর্ধেক শিশা
মানুষ পাগল বিশেষ অবুঝ শিশু
অর্ধেক মানবিক আর অর্ধেক পশু।

আহা প্রেম-৩ (ঝর্ণা মিশে নদীর সাথে)

ঝর্ণা মিশে নদীর সাথে
নদী মিশে সাগরে,
বাতাস বহে মৃদুমন্দে
আরাম দিয়ে আহারে।
জুটি ছাড়া নয় কিছু পৃথিবীর
সব চলে প্রকৃতির নির্দিষ্ট আইনে
একজন অন্যজনে মিশে যেতে অধীর
তবে আমি থাকব কেন তুমি বিহীনে?

পাহাড় কেমন ছুঁতে চায় আকাশ
ঢেউগুলো পরস্পর মিলে মিশে দেয় তালি
ফুলগুলো সব খুঁজে নেয় বাতাস
আপন ফুলে করতে মিতালী।
সূর্য আলো ছুয়ে যায় পৃথিবী
চন্দ্র আলো চুমু দেয় উদার বিশাল সাগর
আনমনে ভাবি
আমায় তবে তুমি কেন করে দিচ্ছো পর?

আহা প্রেম-২ ( কতটুকু ভালোবাসি তোমায়)

..
কতটুকু ভালোবাসি তোমায়? থাম, এসো খুঁজে দেখি
ভালোবাসি তোমায় দৈর্ঘ্যে, গহীনে, উচ্চতায়।
থাকো যদি দৃষ্টি সীমা বাইরে তবু হৃদয়ে দাও উঁকি
তুমি সৌন্দর্যানুভূতিতে অস্তিত্বের শেষ সীমায়।
ভালোবাসি তোমায় নিত্যদিনের প্রত্যেকটি স্তরে স্তরে
যেমনি করে সূর্য আলো, জল-বায়ু ঘিরে থাকে জীবন
ভালোবাসি মুক্তভাবে, অধিকারের জন্যে যেমনি লড়ে
আমি ভালোবাসি শুদ্ধতায়, করে বর্জন মহিমাকীর্তন।

আমি ভালোবাসি তোমায় সমস্ত গহীন আবেগ দিয়ে
আমার সকল চিত্তক্ষোভ আর শৈশব নির্মল বিশ্বাসে
আমি ভালোবাসি তোমায়, সেই ভালোবাসা যেন হারিয়ে
খোঁজা চড়ুইভাতি সাথীর মত, ভালোবাসি প্রতি নিশ্বাসে
প্রতি কান্না হাসি এই জীবনে, এবং খোদা যদি চায়
মৃত্যুর পরে জেগে, কেবল তোমাকে যাব ভালোবেসে।

আহা প্রেম-১ ( নেই কোন আশা)

নেই কোন আশা? এসো কাছে বসে চলে যাই দূরে-
শুধু কিছুক্ষণ পাশাপাশি! গ্রহণ যদি না-ই করো
কি করতে পারি ! আমার হৃদয়ের সব প্রান্ত ঘিরে
জমেছিল মেঘ, বৃষ্টি ঝরে ঝরে, মুক্ত হবে আরো?
এই হাতে রাখো হাত শেষবার। ছুঁয়ে পুরান ব্যাথা
থেমে যাই যদি কোন অচিন কালে হয়ে মুখোমুখি
খুঁজে নেব সেই, যাহা ছিল না এই কপালে লেখা
আবার পড়বে মনে প্রেমালোক, হবে দেখাদেখি?

এখন এই প্রেম উচ্ছ্বাসের শেষ নিঃশ্বাসের কালে
যখন নাড়ি তার থমকে চুপচাপ হয়ে যায় স্থির
যখন বিশ্বাস মৃত্যুর কোলেতে পড়ে যায় ঢলে
আর সরলতা মৃত্যু বিছানায় থমকে যায় ধীর।

এখন যদি তুমি চাও, সকল খেলা হয়ে যাবে শেষ?
মৃত্যু থেকে জেগে উঠে, খুঁজব সব আবেগের রেষ।

ব্যক্তিপুজা

আমার অনুকরণ করিও না।
হৃদয় আমার নানা ঘটনা প্রবাহে প্রভাবিত,
নিরপেক্ষ নয়।
আমিতো আমাকে চিনি,
মনোবিজ্ঞানীর মত শুনতে শিখেছি আমি।
গভীর ভালোবাসা নিয়ে কিছু বলি যখন,
তার উপর সামান্য বিশ্বাস রাখতে পার,
যেমন এখন বলছি।

এটা দুঃখজনক!
সারা জীবন আমার বুদ্ধিমত্তা,
ভাষার উপর আমার দখল,
আমার গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রশংসিত হয়েছে-
দিনশেষে এগুলো অপচয়।

কখনো নিজেকে দেখিনি।
সামনের পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করেছি
হাত ধরে অগ্রজের, হিসাব করতে পারিনি,
তার হাতটা কতটুকু খোলা।

আমার নিজের পথে আমি যখন অদৃশ্য;
আমি বিপদজনক।
যারা আমার অন্ধ অনুসারী, মনে হবে তারা নিঃস্বার্থ।
আমরা উভয়ে পঙ্গু, মিথ্যবাদী।
সত্যের খাতিরে আমাদের আলাদা মত থাকা দরকার।

যখন সত্য উদয় হয় আমি স্থির হই।
একটা পরিষ্কার আকাশ, মেঘগুলো শুভ্র সাদা
নিচে ধুসর বাড়ি, চমৎকার ফুলে ঘেরা।

যদি তুমি সত্য জানতে চাও
তোমার অগ্রজকে দূরে ছুড়ে ফেলো।
আমি যখন এই আঘাতটা করতে পারি-
আমার গভীর ভাবনাগুলো বদলে যায়।

আমি পরিপূর্ণ বিশ্বস্ত নই।
তোলপাড় করা হৃদয়, পথকে বদলে দেয়।

গরু খাওয়া ও মুসলিম, গাভীর দুধ খাও

1448729017

কেউ বলে রমজানে শয়তান বন্দী, শয়তান বন্দী,
কেউ বলে শয়তান শিকলে বাঁধা, সারা মাসের জন্যে
অনেকে বলে গোলাপের সাথে তার হয়েছে সন্ধি
এখন নয়া রূপে উঠেছে জেগে, ইজরায়েলি সৈন্যে।

প্রতিদিন ঘরছাড়া, ধরে নিয়ে যায় যুবক পুরুষেরে
প্রতিদিন বাস্তুহারা, দিন দিন বেড়ে যায় মৃত্যু মিছিল
দখলদাররা ক্ষমতার শীর্ষে নাচায় বিশ্ব মোড়লেরে
মানবতা রুদ্ধশ্বাসে অসহায় আজকে, বেদনায় নীল।
তাদের অনেক বুদ্ধি টাকা, তাদের অনেক বুদ্ধি টাকা
তাদের অনেক বুদ্ধি টাকা, তারা কাজ করে মগজে
আমরা দুইটা পাথর ছুড়ি, ডাংগুলিতে মাটির চাকা
তাদের প্রতিরক্ষা, আমরা সন্ত্রাসী মিডিয়া কাগজে।

আমাদের তারা ছয় ফুট লম্বা, লম্বা টাকার বান্ডিল
সরাপ পিয়ে শুয়ে থাকে, বিছানায় যৌবতী তম্নী নারী
আবার যারা হাদিস মাখায় কুরান ভাতে, মারে ঢিল
আপন জাতে, চলছে লড়াই নিজের সাথে মনোহরী!
কেউ বলে রমজানে শয়তান বন্দী, শয়তান বন্দী,
কেউ বলে শয়তান শিকলে বাঁধা, সারা মাসের জন্যে
অনেকে বলে গোলাপের সাথে তার হয়েছে সন্ধি
এখন নয়া রূপে উঠেছে জেগে, ইজরায়েলি সৈন্যে।

গরু খাওয়া ও মুসলিম, গভীর দুধ খাও, হে মুসলিম
দুধু খাও, দুধু খাও, গাভীর দুধ খাও প্রত্যেহ সকালে
আপন পায়ে দাঁড়াও, মেরুদণ্ড সোজা কর এইদিন
এখন সময় এক জোট বাঁধার সব বিভেদ ভুলে।
কেউ বলে রমজানে শয়তান বন্দী, শয়তান বন্দী,
কেউ বলে শয়তান শিকলে বাঁধা, সারা মাসের জন্যে
অনেকে বলে গোলাপের সাথে তার হয়েছে সন্ধি
এখন পশুরূপে উঠেছে জেগে, ইজরায়েলি সৈন্যে।

স্বাধীনতার সহজ পাঠ

Dug4uB

ও প্রিয়,
কি ঘটেছিল এই জমিনে, পেয়েছো তোমরা শুনতে
করেছিল বারণ আইনে, মা’কে দেয়নি ‘মা’ ডাকতে
হয়নি রঙের কোন মিল, ওদের সাথে তাঁদের দিলে
তাই মায়ের নোলক খুঁজে খুঁজে বিলীন হলো লালে।

স্বপ্নে ভাসানী’র হাতে রাখি হাত, চেয়েছেন জানতে
দেশটার বয়স কত হলো, পেরেছে কি দাঁড়াতে?
সবচেয়ে দুখীনি করা হলো তাকে, বঙ্গবন্ধু’র কালে
সবুজ পোষাক পড়াতে চেয়ে বিলীন হলেন লালে।

তাই সবুজ পোষাক পড়তে
তাই সবুজ পোষাক পড়তে
নর আর নারী লাখে লাখে
সবুজ পোষাক পড়তে চেয়ে বিলীন হলো লালে।

পিতার হাতকে করা হলো প্রতিরোধে রঞ্জিত
সন্তানেরা ভুলবো না, দেশটা বহু রক্তে অর্জিত
এখানে আপন ধর্ম পালন করো নিরাপদে নির্বিঘ্নে
এখানে অনেক ঝরেছে লাল, সবুজ পোষাকের জন্যে।

শহীদেরা গভীর ভালোবেসে ঘুমায় এ দেশের বুকে
আমরা লড়ছি আমরন ছড়াতে সন্মান চারিদিকে
মায়ের চোখের নোনাজল মিষ্টি হয়ে উঠবে আহ্লাদে
সবুজ ধ্বনি উঠছে বেজে মিশিয়ে লালের সংগীতে।

তাই সবুজ পোষাক পড়তে
তাই সবুজ পোষাক পড়তে
নর আর নারী লাখে লাখে
সবুজ পোষাক পড়তে চেয়ে বিলীন হলো লালে।

কিন্তু অবশেষে আমরা ভাঙ্গি বাংলাদেশের হৃদয়?
পিতার রক্তের অপমান যদি আমাদের অবক্ষয়!
ভাবি উদার সাগর পারের সবুজ ডাকা দেশটাতে
ধনী গরীব এক কাতারে পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে।

সুশাসনের হাতে আমাদের দেশ এগিয়ে চলে যদি
মুক্তিযোদ্ধার সন্মান বাড়বে দুনিয়া জুড়ে নিরবধি
আবার কেউ আঘাতে ভাঙতে চায় যদি স্বাধীনতা
আবার সবুজ পোষাকে লাল মাখাবে বীর জনতা।

তাই সবুজ পোষাক পড়তে
তাই সবুজ পোষাক পড়তে
নর আর নারী লাখে লাখে
সবুজ পোষাক পড়তে চেয়ে বিলীন হলো লালে।

তাই সবুজ পোষাক পড়তে
তাই সবুজ পোষাক পড়তে
নর আর নারী লাখে লাখে
সবুজ পোষাক পড়তে চেয়ে বিলীন হলো লালে।

মায়ের গান

মা মারা গেছে গত রাতে।
মা মারা গেছে গত রাতে?
মা মারা গেছে গত রাতে!

রাত্রি তার ডানা মেলে ঝাপটে ধরে আছে পুকুরটাকে
গোল চাঁদ টর্চ জ্বালিয়ে রূপালী দাত মেলে হাসছে।
পোনারা ঝাঁক বেঁধে ছুটে চলে মা মাছের পিছু পিছু
চাদের আলোর প্রতিফলনে সেই আলোতে
দেখি আমার মায়ের মুখখানি!

আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম
বাবু গান গাইছে দূরদেশ থেকে-
আমি কত একা
এই ধরনের গান।

আমি কত একা
মার বুকে নেই,
আমার মাথা যেন কী ফাঁকা!

গোল চাঁদের নিচে
পুকুরে চিৎ সাতার দেই
অন্ধকার জঙ্গলে জোনাকি বিন্দুর মত
আকাশের ছোট ছোট আলোগুলি স্মৃতিতে আমার
মায়ের একই মুখ একে চলছে।

আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম
বাবু গান গাইছে –
আমি কী একা! কিন্তু দেশের সঙ্গীতে
আমার একাকীত্বই আমার আনন্দ।

সবুজ পোষাকে সবুজ গিটারের মূর্ছনায়
মৌটুসী আর পাপিয়ার সুরে ফোটে লাল গোলাপ
ভিনদেশে থাকা বাবুর গাওয়া গানের আবেগ
পুকুর ধারে রাত্রিতে সবুজ ঘাসে শুয়ে দেখা আকাশ
এক হয়ে যায়, মিশে যায়।

পাপিয়া এবং লাল গোলাপ- দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব

পাপিয়া এবং লাল গোলাপ – প্রথম পর্ব

৫.
পাখিটি তার খয়েরী রঙের ডানা মেলে উড়াল দিল এবং বাতাসে সাঁতার কটলো। সে বাগানের উপর দিয়ে উড়ালপথে চলল কিছু সময়, সে ঘন বনের উপরে কয়েক চক্কর দিল।

ছাত্রটি তখনও ঘাসের উপর শুয়ে আছে যেখানে তার সাথে তার সর্বশেষ কথা হয়েছে। এখনও তার চোখের জল অনবরত ঝরছে।

‘সুখী হও, ‘পাপিয়া বলল,’সুখী হও। তুমি পাবে তোমার কাঙ্খিত লাল গোলাপ। চাদের আলোর মায়াবী কম্পনজাত সংগীতে আমি তাকে জাগিয়ে তুলব আর মিশিয়ে দিব আমার বুকের তাজা রক্তে। এসব এ কারণে করব কারণ তুমি একজন সত্যিকারের প্রেমিক পুরুষ। মনে রেখো ভালোবাসা ফিলোসোফির চেয়ে জ্ঞানী, রাজার চেয়ে ক্ষমতাবান। আগুনের শিখার মতো গায়ের রঙ তার, সেই বর্ণ প্রকাশিত হয় প্রেমিকের দেহে যা আমি খোঁজে পেয়েছি তোমার দেহে।’

যুবক ঘাসে চিৎ হয়ে শুয়ে শুনছিল পাপিয়ার কথা, কিছুই বুঝল না। সে কেবল ফিলোসোফি বইয়ের ভাষাই বুঝতে পারে।

কিন্তু ঐ যে হিজল, তমাল, মহুয়া গাছেরা, তারা বুঝেছিল সেই ভাষা। তারা চুপি চুপি বলে যায় পাপিয়া যেন তার শেষ সময়ের গানটি শুনিয়ে যায়।

হিজল গাছটি ঝিরিঝিরি করে বলে গেল,’যখন তুমি চলে যাবে বড় একা হয়ে যাব। তোমার গান শুনিয়ে যাও আমায়।’
পাপিয়া গেয়ে গেল গান, তার কণ্ঠে যেন অনন্তকালের অনন্য সংগীত বেজে উঠলো।
যুবক চলে গেল তার কামড়াতে।
রাত নেমে এলো চরাচরে। নেমে এলো চাঁদের স্বর্গীয় আলো। পাপিয়ে উড়ে এসে বসল গোলাপ গাছে।

সারারাত ব্যাপী পাপিয়া ডেকে চলল তার হৃদয় ছেড়া গান। রাত বাড়তে থাকলে গভীর থেকে গভীর হলো হৃদয়ের প্রতিধ্বনি, টুকরো টুকরো হয়ে যেতে থাকল পাপিয়ার বুক। যখন স্বর উঠলো চরমে একটা অলৌকিক ফুল ফোটল গোলাপ গাছটায়। গাছ বলে চললো আরও জোরে জোরে গাও, আরও দ্রুত, আরও ঘন। হয়ত নেমে আসবে ভোর, তখনও ফোটবে না পুরো ফুল। পাপিয়া গেয়ে উঠলো আরও আরও জোরে, তন্ময় হয়ে, বুকে তার একটা ব্যাথা জেগে উঠলো, আরও ব্যাথা আরও। তার জীবনের রক্ত বইয়ে গেলো গোলাপ গাছের শিরা উপশিরায়। একটা অফুরন্ত সৌন্দর্যমাখা লাল গোলাপ জেগে উঠলো গাছ জুড়ে। গাছ চিৎকার করে উঠলো, ‘দেখো কি অসাধারণ লাল গোলাপ!’ কিন্তু পাপিয়া নিথর।

৬.
দুপুরে ছাত্রটি জানালা খুলে বাইরে তাকাল। সে চিৎকার করে উঠলো,’ কি আশ্চর্য! কি সৌভাগ্য আমার! এখানে একটি লাল গোলাপ, আমার সারা জীবনে এমন অসাধারণ গোলাপ দেখিনি আমি।’ সে ফুলটি ছিড়ে নিয়ে প্রফেসরের বাসায় হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছল।

প্রফেসরের কন্যা নীল রঙের মখমলের শাড়ি পরে বসে আছে। যুবক বলল,’ তুমি আমায় বলেছিলে যদি লাল গোলাপ এনে দেই, তবে তুমি আমার সাথে নাচবে। দেখো পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ লাল গোলাপ তোমাকে নিবেদন করছি। এটা খোঁপায় পড়ে নাও, এটাই তোমাকে বলে দিবে কতটা ভালোবাসি তোমায়।’

কন্যা বলল,’ আজ আমি যে রঙের শাড়ি পড়েছি, এ ফুলটি তার সাথে ম্যাচিং করবে না, দেখো আমার শাড়ির রঙটি, দেখো। ‘

যুবক রেগে গেল,’ তুমি আমাকে বলোনি লাল গোলাপ এনে দিলে তুমি আমাকে ভালোবাসবে। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর লাল গোলাপ এনেছি, আনিনি?’

‘ হা বলেছি। তুমি খুবই বিরক্ত করছিলে, পাগলের মতো করছিলে। তাই বলেছি। দেখো, তুমি এখন যাও, বাবার কামড়ায় বসে আছে তার পছন্দের এক ছাত্র , সে এনেছে আমার জন্য মুক্তোর নেকলেস। সে এখন সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আর তুমি এনেছো সামান্য গেলাপ। তুমি কি? তুমি একজন সাধারণত ছাত্র মাত্র।’

ছাত্রটি লাল গোলাপ ছুড়ে ফেললো রাস্তায়, একটা বাচ্চা ছেলের সাইকেলের চাকার নিচে পড়ে থেতলে গেল।
ছাত্রটি হাটতে হাটতে চলে এলো। মনে মনে বলছে,’ প্রেম কত বিরক্তিকর জিনিস। এর অর্ধেকটাও যুক্তি যুক্ত নয়। এটা কিচ্ছু প্রমাণ করে না। সব সময় এমন কথা বলে যা কখনো ঘটে না। এটা এমন কথা বলে যা সত্যি নয়। এটা একেবারে অবাস্তব। আমাকে প্রতিটি ব্যাপারে বাস্তবমূখী হতে হবে। আমি আমার ফিলোসোফি আর মেটাফিজিক্সে ফিরে যাব।’

বাড়ি ফিরে যুবক ধুলোমাখা বইগুলো টেনে নিল আবার পড়া শুরু করল।

সমাপ্ত।