ফকির আবদুল মালেক এর সকল পোস্ট

ফকির আবদুল মালেক সম্পর্কে

কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ লেখক।

আওয়ামী থ্রেট ও সেনাপ্রধানের প্রস্তাবনা: একটি ব্যতিক্রমি পর্যালোচনা

post_img-1737023028546-633243425

দেশ এখন এক ক্রান্তিকালীন সময় পার করছে, নানা রকমের পেনিক ছড়ানো হচ্ছে ফেসবুকের মাধ্যমে। বর্তমানে ফেসবুক হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বড় গণমাধ্যম। খুব সহজেই যে কোন বক্তব্য প্রকাশ করা যায়। এটা বাস্তবতা, এটা মেনে নিয়ে কাজ করতে হবে। যখন কেউ একটা মাধ্যমে কাজ করে, প্রযুক্তির বদলের কারণে সেই মাধ্যমটি হয়ে পরে অনুপযোগী। অনেক ডিমান্ডেবল পেশাও একেবারে গুরুত্বহীন হয়ে পরে ট্যাকনোলজির বদলের কারণে।

এক সময় আমি ব্লগে লেখালেখি করেছি। কিন্তু লেখালেখি ব্লগগুলি এখন আর লোকেরা তেমন পড়ে বলে মনে হয় না। তবু ব্লগের সেই যে এক ধরণের লেখা অভ্যস্থ হয়ে গেছি তার থেকে বের হয়ে ফেসবুকে লিখতে বাধ্য হচ্ছি। কখনও গুরুত্বপূর্ণ লেখক ছিলাম না। ব্লগের ব্যাপারটা এমন যে, সেখানে লেখকই পাঠক, আবার পাঠকই লেখক। সেই ক্ষেত্রে আমি যেমন অনেকের পাঠক ছিলাম, আমার পাঠকও বেশ অনেক পরিমানেই ছিল। কিন্তু ফেসবুক ব্যাপারটা এমন নয়, সত্যি কথা এখনও ফেসবুকে অভস্ত্যতা হয়ে উঠে নাই। তবু ফেসবুকে নজর থাকে। আর গত কয়েকদিন যাবৎ ফেসবুকে ঢুকে শংকিত হয়ে পরি। কোনটা যে গুজব আর কোনটা বাস্তব তা বুঝে উঠাই দায় হয়ে উঠেছে।

কয়েকদিন যাবৎ এক শ্রেণির পোস্টে দেখছি বারবার টাইম বলে দেয়া হচ্ছে কেউ যেন দেশ ছাড়তে না পারে। এয়ারপোর্টে পাহারা বসাতে বলা হইতাছে। বলা হইতাছে আওয়ামীলীগ ভীষণ শক্তি নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকবে, ফলে যারা এখনে এনসিপি, বিএনপি,জামায়াতের লোক আছে তারা যেন পলাইয়া যাইতে বাধ্য হয়। এই শ্রেণিটি কিন্তু নিজেরাই বিদেশে আছে, তবু হুমকি দিয়া যাইতাছে। নিঝুম মজুমদারের মত লোকেরা পর্যন্ত এমনভাবে কথা বলছে যেন এখানে একটা ক্যু হয়ে যাবে, কিম্বা ইন্ডিয়া এ্যাটাক করে বাংলাদেশকে তছনছ করে শেখ হাছিনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে যাবে। এই ঘটনাগুলি খেয়াল করছিলাম।

এদিকে হাসনাত আবদুল্লাহর পোস্টগুলি পড়ছিলাম। কয়েকদিন যাবৎ সে আওয়ামী রাজনৈতিক অবস্থা নিয়া পোস্ট দিতাছিল। অবশেষে এক বিস্ফোরণ পোস্ট দিল। সকল রাজনৈতিক আগ্রহের বিষয় পরিনত হলো সে স্ট্যাটাস। তার পোস্ট থেকে কোড করছি-

“আমাদেরকে আরো বলা হয়-রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ যাদের দিয়ে করা হবে, তারা এপ্রিল-মে থেকে শেখ পরিবারের অপরাধ স্বীকার করবে, হাসিনাকে অস্বীকার করবে এবং তারা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করবে এমন প্রতিশ্রুতি নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হবে।

আমাদেরকে এই প্রস্তাব দেওয়া হলে আমরা তৎক্ষণাৎ এর বিরোধিতা করি এবং জানাই যে, আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের বিচার নিয়ে কাজ করুন।

এর উত্তরে আমাদের বলা হয়, আওয়ামী লীগকে ফিরতে কোন ধরণের বাধা দিলে দেশে যে সংকট সৃষ্টি হবে, তার দায়ভার আমাদের নিতে হবে এবং ‘আওয়ামী লীগ মাস্ট কাম ব্যাক’। ”

এর মধ্যে অন্তবর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুইঁয়া আর এক তথ্য ফাঁস করলেন যে, সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ্জামানের সম্মতি ছিল না প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসের দায়িত্ব দেবার ব্যাপারে। আসিফ মাহমুদ এর ভাষ্য মতে- তিনি বলেছেন তিনি বুকে পাথর বেঁধে এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন।

অনেক বড় বড় অনলাইন এক্টিভিস্টদের মাঝে পিনাকীসহ কয়েকজন দেখলাম সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ্জামানের উপর বিল্লা হয়ে আছে বেশ আগে থেকে। তারা ক্রডিাাট নিতাছে তারা এই দেশে ইন্ডিয়া বিরোধী মনোভাব তৈরি করেছে। সেনাপ্রধান ইন্ডিয়াপন্থী।

এইসব ফেসবুকের পোস্ট চিন্তা চেতনা আক্রান্ত হই বারবার। বের করতে চেষ্টা করি প্রকৃত ঘটনা। আমি আমার মত করে কিছু ভাবনা চিন্তা করি। এটা আমার একান্ত নিজের চিন্তা, কারোর সাথে মিল না হলেও এটা করার এবং প্রকাশ করার অধিকার আমার আছে।

আওয়ামী লীগের ইন্টারন্যাশনাল লবি, ভারতীয় গোয়ান্দা বিভাগ র সহ অনেকেই আওয়ামী লীগকে এখানে প্রতিষ্ঠিত করার নানামুখী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা নিজে চট করে ঢুকে পারবেন বলে অডিও ভাইরাল হয়, এমনকি তারা হরতাল ডাকেন। ঐদিকে অপি পিয়াল গং ব্যাপক প্রচারণা চালাইতে আছে যে, এই ঢুলে গেল তারা। এগুলি একেবারে এমনি এমনি বলছেন তা নয়।

সেনাপ্রধান অনেক বছর এই প্রফেশনে জড়িত। শুধু আওয়ামী আমলে নয় এই পর্যায়ে যেতে হলে অনেককিছু মেনেজ করেই যেতে হয়। ডিনিও তাই করেছেন। তিনি শেখ হাসিনার আত্মীয়ও বটে। তাই সব ধরনের যোগাযোগ তাকে রাখতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। ধারণা করি, তাকে বলা হয়েছে একটা কিছু করতে, তিনি বলছেন আচ্ছা দেখি। কেন এমন ধারণা হলো? তাকে যেমন পেয়েছি আমরা তাতে মনে হয়েছে তিনি হান্ড্রেড পার্সেন্ট প্রফেসনাল একজন মানুষ। নিজের ডিপার্টমেন্টের উপর যখন জাতিসংঘের শান্তি রক্ষীবাহিনীতে কাজ হারাবারের প্রশ্ন উঠেছে তখন তিনি রাজনীতি, আত্মীয়তার সম্পর্কে চেয়ে নিজের প্রফেসনকে তিনি বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। তিনি অনেক রক্তপাত এড়াতে সক্ষম হয়েছেন। শেখ হাসিনাকে নিরাপদ এক্সিট দিয়েছেন। নিজে সামরিক শাসন জারি করতে পারতেন। তা না করে জাতীয় উদ্দেশ্যে ভাষণে বলেন – তিনি সকলের জান মালের হেফাজতের দায়িত্ব নিয়েছেন এবং তার পছন্দের বাইরে প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসের দায়িত্ব দেবার বিষয়টি মেনে নিয়েছেন। এখানে তিনি যেই কমিটমেন্টটি দেখিয়েছেন তা সম্পূর্ণ রূপে একজন প্রফেশনাল দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। আর নিজের অজান্তেই গণতন্ত্রের একটা প্রয়োগ উদাহরণ হিসাবে দেখাইয়া দিলেন। নিজের মতের বিরুদ্ধে যখন অন্য মত প্রবল হয় তখন বুকে পাথর বেঁধে তা মেনে নেওয়ার নামই গণতন্ত্র।

এখন আসি যে প্রসঙ্গে বলছিলাম সেদিকে। এই যে থ্রেটগুলি দেয়া হচ্ছিল, আওয়ামী প্রতিষ্ঠা, শেখ হাসিনার ফেরত আসা, অনেকের উগ্র চিন্তানা ইত্যাদি সবই সেনাবাহিনীর প্রধানের নলেজে ছিল। আমরা ধারণা তিনি তাদের বলেছেন- আচ্ছা দেখি। এবং বাস্তবতা মিলিয়ে আবারও রক্তপাতের সম্ভবনা দেখে তিনি একটা নেগোসিয়েশনের কথা ভেবেছেন। তাই তিনি হাসনাত আবদুল্লাহদের এমন একটা প্রস্তাব দিয়েছেন। হাসনাত আবদুল্লাহ তা প্রত্যাখান করেছে এবং দশ দিন পর ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সকলের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন এবং এখনও প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন।

এখানেও আমি গণতান্ত্রিক চর্চার সুমহান নিদর্শন দেখতে পাইছি। মত প্রকাশের স্বাধীনতার একটা উদাহরণ দেখতে পারছি। অনেকে অনেক কথা বলেন, আমি শুধু সেনাপ্রধানের ভাষনে ইউনুস বলে সম্বোধন করাকে একমাত্র নন-প্রফিজম হিসাবে পেয়েছি। এছাড়া এখন পর্যন্ত তার ভুমিকা এই দেশটিতে মানুষের রক্তপ্রবাহ কমাতে বিশাল ভুমিকা রেখে চলেছেন এবং কামনা করি তিনি নিজকে সংযত করে পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হবেন।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রতিতে ড. ইউনুসের আন্তর্জাতিক সফলতা

গতকাল তারাবিতে হুজুর যখন ফিলিস্তিনের মানুষদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া ধরলেন হাউ মাউ কেঁদে উঠল সকলে। অনেককেই বলতে শুনছি, আমরা শুধু দোয়া করি, কিছুই করতে পারি না। কথা ঠিক । আমাদের কিছুই করার নেই। ঐ সব পিতারা যখন তাদের সন্তানদের রক্তমাখা শিশুদের হাতে নিয়ে আল্লাহ আল্লাহ করে তখন অন্তর ফেটে যায়। আমরা আর্তনাদ করে উঠি। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করি। আমাদের যুব সমাজের অনেকে প্রতিবাদ মিছিল করে। কিন্তু আমরা সকলেই জানি ফিলিস্তিনের মানুষদের জন্য কিছু মানবিক সাহায্য ও দোয়া করা ছাড়া আমরা বড়ই অসহায়।
FB_IMG_1742476482266

FB_IMG_1742476487578

আবার এদিকে আমরা দেখি ভারতে এই রমজানের মধ্যে মুসলমানদের উপর জুলুম হইতাছে। এখানে আমরা একটা টু শব্দও করি না। আমরা অসহায় ভাবে জুলুমগুলি অবলোকন করি। আমরা সকলেই জানি ভারতীয় মুসলমানদের জন্য দোয়া করা ছাড়া আমরা বড়ই অসহায়।

সাম্প্রদায়িকতা এমনই এক বিষয় যে, আমাদের এখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার জুলুম করা হয়, রাজনৈতিক নানা সুবিধা আদায় করার জন্য। এখানে হিন্দুরা সব সময় কেমন জানি ছোট হয়ে থাকে। একবার আমার এক ভাড়াটিয়া বলে বসল, আপনারা আমাদের দেখবেন, আপনি আমাদের মা বাপ। তার কথায় আমি লজ্জিত হয়ে যাই। ওরা আমার উপর ভরসা করছে, আমি কখনও আল্লাহ ছাড়া এভাবে কারোর উপর ভরসা করি না, তাই বড়ই লজ্জিত হইয়া গেছি। আমি হিন্দু ভাড়াটিয়াকে বলি, শুনেন আপনি আমার ভাড়াটিয়া, অন্য মুসলমানর ভাড়াটিয়া যেমন, তেমনি। শুনেন এখানে আপনার উপর কেউ কিছু বলতে আইলে আমি আপনার পাশে আছি। কিন্তু লড়াইটা আপনাকেই করতে হবে। এদেশটা কারোর বাপের না, এখানে আপনি যেমন নাগরিক আমিও তেমনি নাগরিক।

ভদ্রলোক বলল, আপনারা এখানে স্থানীয়, বাড়ি করে আছেন অনেক বছর। ভাই, আমরা তাই আপনার কথা বললাম। আমি তাকে বললাম, কেউ কিছু কইছে? বলল, না কেউ কিছু কয় নাই তবু ভয়ে থাকি।

আমার মত আপনাদের মাঝে কারো কারো এমন ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে নিশ্চয়ই।

আমি রাজনৈতিক নেতাদের মুখে সংখ্যালঘুদের উপর যাতে নির্যাতন না হয় তেমন আহ্বান শুনেছি। ধন্য হয়েছি, গুনগান গাইছি। কিন্তু এবারই প্রথম শুনেছি এই কথাটা যে, সংখ্যালঘু বলে কিছু নাই, আমরা সবাই বাংলাদেশি। শুধু যে মুখের কথা তাও নয়। দেখেছি, হিন্দুদের মন্দির পাহারা দিতে গেছেন কেউ কেউ, যাদেরকে মনে করা হয় মুসলিম সাম্প্রদায়িক সম্প্রদায়।

আমাদের এখানে হিন্দুদের কোন নিরাপত্তা ঝুকি দেখিনি। মহল্লাবাসী সকলে আগের মতই আছি। কিন্তু এখনও হিন্দুদের মাঝে কেমন জানি একটা হীনমন্যতা দেখি।

৫ আগস্টের পর রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। শেখ হাসিনা পালাইছে। তার অনুসারীদের বেশিরভাগই পালাইছে। কিন্তু এখনও রয়ে গেছে তাকে নিঃশর্ত সমর্থন দেয়া অনেকে। এর মাঝে মুসলিম আছে, হিন্দুদের বেশিরভাগ তার সমর্থক। শেখ হাসিনার সমর্থক আছে ভারতের সরকারি ও বিরোধীদলসহ সেই দেশের মিডিয়া। ভারতীয় সাংবাদিকরা যেখানেই সুযোগ পাইতাছে, বলে বেড়াইতেছে যে, বাংলাদেশের ভিতর হিন্দুদের উপর ব্যাপক জুলুম হইতাছে। তারা আমেরিকার উচ্চ পর্যায়ে যেখানে সুযোগ পাইছে সেখানে বাংলাদেশের প্রসঙ্গে কথা বলছেই।
Untitled-5-67d91bd67bb4c
এর মধ্যে এলেন আমেরিকার গোয়েন্দা বিভাগের হাই প্রোফাইলের ক্ষমতাধর একজন ভারতীয় বংশদ্ভূত মহিলা। তিনি যখন বলছিলেন বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির কথা। সত্যি ভয় পেয়ে গেছি। একদিকে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের উপর নৃশংসভাবে জুলুম করে বিশেষ করে শিশু ও মহিলাদের মেরে ফেলছে, আমেরিকা এই অমানবিক জুলুমকে সমর্থন করছে। আবার প্রসিডেন্ট ট্রাম্প বলছে মুসলিমরা হেইটার, তাদের হেইট করে।

সার্বিক বিবেচনায় মনে হতে থাকে এই বুঝি আমেরিকার সহযোগিতায় ভারত বাংলাদেশে হামলা করছে। কিন্তু না। আমেরিকা বলছে ডা. ইউনুসের সরকার যেই ভুমিকা রাখছে তা আমেরিকা সমর্থন করে। আর একটি সফলতা দেখতে পাওয়া গেল ড. ইউনুস স্যারের।
FB_IMG_1742477081765

এই বাংলাদেশে আমরা সবাই বাংলাদেশি। এটা আমাদের দেশ। এই নীতিতে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ।

আহা! আরও কিছু বেশি সময় যদি ইউনুস স্যারকে দেয়া যেত!!!

আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় ডক্টর ইউনুস

‘আমরা দুনিয়ার মাঠে খেলার খেলোয়াড়, আমরা ছোট মাঠে খেলার খেলোয়াড় না বাংলাদেশ, ওই যে বললাম, বাংলাদেশ অপূর্ব একটা দেশ। সে দেশে যারা আমরা দুনিয়ার মাঠে খেলি। আমাদের দেখে লোকে হাততালি দেয়, এরা এসেছে। বাংলাদেশ নেমেছে এবার। ওরকম চাই, ওরকম এবং করতে পারি।…আমরা বাস্তবে পারি। আমাদের সে সুযোগ আছে। সেই সুযোগের কথা বারে বারে বলার চেষ্টা করছি। এই সুযোগগুলো যেন আমরা গ্রহণ করি।’

– ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

images

দেশ বিদেশে খেলা শুরু হয়ে গেছে। খেলার কথা যখন এলোই তো ফুটবলের কথা দিয়ে হোক শুরু।

বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল গতকাল সৌদি থেকে দেশে ফিরেছে। আজ সন্ধ্যায় বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায় বাংলাদেশ দল অনুশীলন করবে। প্রথমবারের মতো দলের সঙ্গে অনুশীলন করবেন হামজা চৌধুরী।

বাংলাদেশের ফুটবলে জাতীয় দলের জন্য কখনো টিকিট ব্যবস্থা হয়নি। হামজার অনুশীলনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বাফুফে টিকিটের ব্যবস্থা করছে। বাফুফের অধিভুক্ত বিভিন্ন ক্লাব, ফেডারেশনকে টিকিট দিয়েছে ফেডারেশন। টিকিট ছাড়া আজকের এই অনুশীলন সেশনে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।

hamzaa-20250319153615

খেলা শুরু হয়ে গেছে দেশের ভিতর। খেলাটা শুরু করেছে বিএনপি।

‘ওদের হাতের, ওদের কলমের কোনো সংস্কার আমরা সহজে মেনে নেব না। সংস্কার যদি করেন, আমরা কারেকশন (সংশোধন) করব। বিএনপি সেই কারেকশন অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মিলেমিশে ঠিক করে তা জাতির কাছে তুলে ধরবে। ওই সমস্ত তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, যারা এ দেশের নাগরিক পর্যন্ত নয়, তাদের দিয়ে আপনারা সংস্কার করবেন, এটা আমরা মেনে নেব না।’

মির্জা আব্বাস

faa6e0c7beca86e117ea07bdb91a9b0e906b960bbde4331e

এদিকে খেলাটা শুরু একেবারে রেডজোন থেকে।

ভারত সফরে এসে বাংলাদেশ নিয়ে মন্তব্য করে এখন আলোচনায় মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা (ডিএনআই) বিভাগের প্রধান তুলসি গ্যাবার্ড। দিল্লিতে অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড ও আরও কয়েকটি দেশের গোয়েন্দা প্রধানদের নিয়ে বৈঠক করেছেন তিনি।

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের কয়েকটি দেশে সফরের অংশ হিসেবে তুলসি গ্যাবার্ড ভারতে এসেছেন। সোমবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি ওয়ার্ল্ডকে সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ আনেন তিনি। তবে তার এমন মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার।

Untitled-5-67d91bd67bb4c

দেখা যাক আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়েরা কেমন সামাল দেন।

তুমি রিয়েলিটি মেনে নাও: প্রসঙ্গ সংস্কার

তুমি রিয়েলিটি মেনে নাও
ফকির আবদুল মালেক

আমি আমার কথা বলি, রাজনীতি থেকে কোন ফয়দা খোঁজার কোন অভিপ্রায় সারা জীবনে ছিল না।

সময় যাই যাই করতে করতে পঞ্চাশ উর্ধে এসে পৌঁছেছি। আলহামদুলিল্লাহ, ভালই হায়াত পেয়েছি এবং বাড়তি পাওনা হিসাবে সুস্থ সবল সুচিন্তিত সর্বাত্মক বিচার বিশ্লেষণের ক্ষমতা আছে এখনও। কখনও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলতে যা বুঝায় তা ছিলাম না। কিন্তু রাজনীতি মুক্ত থাকা কোন নাগরিকদের পক্ষে সম্ভব নয়। অন্য সবার মত আড্ডায়, সামাজিক ওখান বৈঠকে নিজের মতামত দিয়েছি। এটা খুবই মামুলি ব্যাপার কিন্তু এতেও অনেকে ধরে নিয়েছে এই লোকটা এই পন্থী। এছাড়া নির্বাচনের সময় সবার মত কোন না দলের পক্ষে বিপক্ষে তর্ক বিতর্ক করেছি। এতেই অন্য অনেকের মত আমার একটা রাজনৈতিক পরিচয় গড়ে উঠে। আবার অনেক সময় এমন হয় রাজনীতির নেতৃস্থানীয় কেউ আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, মহল্লাবাসী। সেই হিসাবে তাদের সাথে কখনও কোথাও গিয়াছি, হয়ত কোন বিয়ের দাওয়াত, কিম্বা কোন পারবারিক বা সামাজিক বা শালিসি বৈঠকে উপস্থিত থেকেছি। এতে কেউ কেউ ধরে নিয়েছে, আমি ঐ নেতার দলে আছি।

আমার বাবা ছিলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ের একজন ঘোর বিএনপি নেতা। অনেকে তখন আমাকে বিএনপির লোক হিসাবে জানত।

এখন ফেসবুকের যুগ। এমন কি একটি ফেসবুকের স্ট্যাটাস ঘিরে বিভিন্ন রকমের গোলযোগ হতেও দেখেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে একটা পোষ্টের কারনে পদস্ত দায়িত্বশীল লোক কতৃক ধমক খেয়েছি, আবার ফেসবুকে এক পোস্টের কারণে এলাকার চেয়ারম্যান ফোন করে বাবা মা তুলে গালাগালিও করেছে। ফেসবুককে এখনে আড্ডার অবস্থা বলা যায় না। বরং এটা এখন একটা মিডিয়ায় পরিনত হয়েছে। ইদানীং কয়েকটি স্ট্যাটাস দিয়েছি। আমি ভাবছিলাম মাত্র ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ / ১০০ টা লাইক পাই, আমি এই মাধ্যমেটিকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভাবছিলাম না। কিন্ত কয়েকজন বন্ধু ও ঘনিষ্ঠ জন বলল, তোমার লেখাগুলি বিএনপির বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। বাদ দাও কি দরকার। সারা দেশের বেশিরভাগ মানুষ বিএনপির পক্ষে, তো এখন এই অবস্থায় বিএনপির বিরুদ্ধে লেখালেখি করার দরকারটা কি?

৫ আগস্ট শুধু আওয়ামী লীগকে বিতারত করেনি, জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব স্থানীয় ছাত্র নেতৃত্ব একটি নতুন দল গঠন করেছে, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলছে। তারা মুটামুটি মিডিয়াতে বেশ আলোচিত। বেশ কভারেজ পাচ্ছে তারা। এদিকে ডক্টর ইউনুস সরকার এতদিন ব্যর্থ হতে হতে সফলাতার দিকে পা বাড়াইতাছে। তারা আন্তর্জাতিক বেশ কারিসমা দেখাইলেন, জিনিস পত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছেন এমনকি রমজানে। অবাক বিস্ময়ে দেখছি দাবী দাওয়ার হিরিক পড়েছে এই সরকারের দিকে, মথাচড়া দিয়ে উঠতে চাইছে গার্মেন্টস সেক্টর, ছাত্র, শ্রমজীবী, চাকুরীজীবি, ডাক্তার নার্স মোট কথা এমন কোন সেক্টর নাই যারা দাবী নিয়ে রাজপথ অবরোধ করে সরকারকে আলটিমেটাম দিতাছে দাবী নিতে। এখন পর্যন্ত ৭ মাসে প্রায় ২০০ রাজপথের আন্দোলনকে মোকাবিলা করেছে, একটাতেও তেমন কোন বিশৃঙ্খলা হতে পারে নাই, পুলিশ সেনাবাহিনী প্রতিরোধমূলক সামান্য বল প্রয়োগের মাধ্যমে এসব আন্দোলন থামানো গেছে। এইসব আন্দোলনের মাঝে কিছু ছিল মামা বাড়ির আবদার, অটোপ্রমোশন, বেতন বৃদ্ধি, প্রতিষ্ঠানকে সরকারিকরন ইত্যাকার দাবি ছিল। এসবকিছু মোকাবিলা করে সরকার এগাইয়া যাইতাছে। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি সচিত্র ভিডিও ফুটেজ প্রচার করে এমনভাবে প্রচার করা হইতাছে যেন দেশে এখন গৃহযুদ্ধ অবস্থা। আলোচিত ধর্ষণের ঘটনায় সরকার পক্ষ থেকে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া সত্ত্বেও, এমনকি আইন সংশোধন করে নিলেও প্রায় সকল মহল থেকে সরকারকে চাপ দেয়া হইতাছে। এমনকি বামপন্থীরা ব্যাপক গনজায়াতের পরিকল্পনা নিয়ে এগাইয়া যাইতাছে।

এসবের মাঝেই সরকারের সংস্কার কমিশন গুলো কাজ গুছিয়ে আনছে। কিন্তু তাদেরকে সহযোগিতা না করে বারবার বলা হইতাছে নির্বচিত সংসদে গিয়ে সংস্কার করবে। দীর্ঘ ৩৫ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে সবার কাছে এটা স্পষ্ট হইছে যে যদি রাজনীতিবিদদের কোন সিস্টেমের মাঝে আটকানো না যায় তবে তারা বারবার বেপরোয়া হয়ে উঠবে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে একক ব্যক্তির শাসন ঘুরে ফির আসবে। অর্থাৎ ফ্যাসিবাদ ঘুরে ফিরে আসবে। এই সিস্টেম ডেভেলপ করার জন্য সংস্কার কমিশনগুলি কাজ করেছেন। এখন এই সংস্কারতো রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে একটা সিস্টেম ডেভেলপ করার জন্য।

আমাদের সংসদ আমাদেরকে তার কাজ সম্পর্কে কি ধারণা দেয়? আমরা দেখেছি গত ৩৫ বছরে সংসদ অকার্যকর ছিল। বিরোধীদল বেশিরভাগই সংসদ বর্জন করে রাজপথে থেকেছে। এমনকি সরকারি দলের কোন সদস্যও নিজের মতে ভোট দিতে পারেনি যখন তা দলের মতের বিরুদ্ধে যায়। এমনই অকার্যকর সংসদে ব্যর্থ লোভী পেশিশক্তির প্রয়োগকারী ব্যবসায়ী দ্বারা ভরপুর সংসদ সদস্যরা নিজেদের অবস্থার উন্নয়ন করা ছাড়া দেশের সামগ্রিক কল্যানের জন্য কোন ভুমিকাই রাখে না। এই ঐতিহাসিক সত্যের আলোকে একথা স্পষ্ট ভাবেই বলা যায় সংসদে সদস্য হয়ে যারা আসেন তারা স্থানীয় সরকারের মেম্বার চেয়ারম্যানের ভুমিকা ছাড়া কিছুই ভুমিকা রাখতে পারেন না। এটাই এখানকার সিস্টেম। এই সিস্টেম কে সংসদ সদস্যরা পাল্টাবে? না আছে তাদের ইচ্ছে আর না আছে তাদের যোগ্যতা। তাই রাজনৈতিক সংস্কারগুলি এই ইউনুস স্যারের নিয়োগকৃত সংস্কার কমিশনের মাধ্যমেই মিটাতে হবে।

যারা এই সংস্কারের বিরোধিতা করবে তদের বলে দেওয়ার সময় এসেছে- তোমার বারটা বেজে গেছে, তুমি রিয়েলিটি মেনে নাও। ব্যক্তিকেন্দ্রীক রাজনীতি পরিহার করে সিস্টেমের রাজনীতিতে আসো। টাকা কামাইতে চাইলে ব্যবসা কর, কিন্তু রাজনীতিকে নাও দায়িত্ব পালন হিসাবে, দেশ ও জাতিকে মেধা ভিত্তিক সেবা দান হিসাবে।

ড. ইউনুসকে হঠানোর প্লান

;নিচের তিনটি ঘটনা বহুল আলোচিত :

২০২০ সালে সিলেটের এমসি কলেজে স্বামী কে বেঁধে রেখে স্ত্রী কে গণধর্ষণ করে তখনকার রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন।

২০১৮ সালে বিএনপিকে ভোট দেওয়ায় নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ৪ সন্তানের মা’কে গণধর্ষণ করা হয় ।

২০১৬ সালে কুমিল্লা ক্যান্টমেন্টের মধ্যে তনুকে নির্মম ভাবে গণধর্ষণ করে হত্যা করা হয় ।

এই ৩ টা ঘটনা তে ই নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে এবং ধর্ষকদের গ্রেফতারের দাবিতে সারাদেশের মানুষ বিক্ষোভ মিছিল করে ।

মোটামুটি সকল জায়গায় আন্দোলনকারীদের উপর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লোকেরা হামলা করে ।

তখন লাকি আক্তারেরা রাজপথে গদিতে আগুন জ্বালো স্লোগান দিয়ে রাজপথ কাঁপাতে দেখা যায়নি। গিয়াছে কি?
তখন কেন গণভবনে স্মারকলিপি দিতে গিয়ে পুলিশের উপর হামলা করেনি?

উপরের আলোচিত ৩ টা ঘটনার একটায় ও ভিক্টিম বিচার পায়নি ।
আসামিরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে গেছে ।

এখনকার সময়ের আলোচিত ধর্ষণের ঘটনা আমরা দেখলাম সরকার ও সেনাবাহিনী সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে নিষ্ঠুর পাশবিকতার শিকার মেয়েটিকে বাচাতে এবং সরকার অপরাধীদের আটক করতে সক্ষম হয়েছে, আইনের সংশোধন এনেছে, দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা নিচ্ছে। এটাই গত ৭ মাসে ফিরে পাওয়া স্বাধীনতা । এই স্বাধীনতা আনতে দেশের মানুষের তাজা রক্ত ঝরাতে হয়েছে রাজপথে ।

এখন যাতে দৃষ্টান্তমূলক বিচার৷ হয় এবং রায় কার্যকর হয় আমরা সবাই এটা চাইছি। আর এইসব বামপন্থীরা ও কিছু উশৃংখল রাস্তায় বিড়ি খেতে চাওয়া অসভ্য মেয়েরা দেশের সকল মানুষের দাবীর সাথে একমত না হয়ে এরা যাইতাছে যমুনা ঘেরাও করতে। ওদের উদ্দেশ্য বিচার চাওয়া নয় এটা স্পষ্ট। এরা পুলিশের উপর হামলা করেছে।

উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে পুলিশের উপর হামলা করে নিজেরা ভিক্টিম সাজতে চাইছে। তারপর গ্রেফতারের দাবি উঠলে গ্রেফতার হবে। তারপর এদের সহযোগি বন্ধুরা বিশ্বকে দেখাবে যে,বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে এবং ইউনুস যৌক্তিক আন্দোলন দমাতে আন্দোলকারীদের উপর নিপীড়ন শুরু করেছে ।

আর তারপর দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে ড. ইউনুসকে হঠানোর প্লান নিয়ে আসবে সেটা অন্তত দেশের সচেতন কোন নাগরিক হতে দেবে না ।

এসব বাদ দিয়ে দেশে সুশাসন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করেন ।

একটি গালি ও একটি উচ্চাভিলাষী চিন্তভাবনা

একটি গালি ও একটি উচ্চাভিলাষী চিন্তভাবনা

FB_IMG_1741931625398
ফকির আবদুল মালেক ১৪/০৩/২০২৫

জ. ই. মামুনের স্ট্যাটাস থেকে শুরু করি। তিনি লিখেন-

Off the Record বলে একটা কথা আছে ইংরেজিতে, যার মানে হলো রেকর্ডের বাইরে অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তা। আমরা যারা টেলিভিশনে ক‍্যামেরার সামনে কাজ করি, যে কোনা লাইভ টক শো বা সংবাদের বিজ্ঞাপন বিরতিতে কিংবা অনুষ্ঠানের আগে-পরে স্টুডিওতে বসে অতিথি বা কন্ট্রোল রুমের সহকর্মীদের সাথে নানারকম কথা বলি। তার মধ্যে কাজের কথার বাইরে অকাজের কথাও থাকে। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সংবাদ কর্মীরা অফ দ‍্যা রেকর্ডে মাঝে মধ্যে গালাগাল‍িও করে থাকে। বেশিরভাগ সময় গালাগালির প্রধান টার্গেট থাকে নিজের কপাল, নিউজরুমের বস, অথবা টিভির মালিক কিংবা কখনো কখনো নেতা- মন্ত্রী থেকে শুরুর করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব‍্যক্তি।

শুনলাম, সেরকম একটা অফ দ‍্য রেকর্ড বক্তব‍্যের জন‍্য আজ এখন টেলিভিশনের একজন সংবাদ কর্মীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।

উনি হয়ত ঠিকই শুনেছেন। আমরা অনেকেই শুনেছি। তবে আমাদের শুনা আর জ. ই. মামুনের শোনার মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য আছে। তার শোনাটা আমাদের থেকে বেশি অথেনটিক হবে এটা স্বাভাবিক।

এখন অনলাইনের যুগ। অডিওটি আমরাও শুনেছি। সেখানে সারসিজ ও হাসনাত আবদুল্লাহকে শুয়র বলে গালি দেয়া হয়েছে।

জ.ই. মামুন সবশেষে একটি কথা বলেছেন যা আমার খুবই নজর কেড়েছে। তিনি লিখেন-

সবচেয়ে বড় কথা, একজনের গালি টেলিভিশনের টেকনিক‍্যাল ভুলের কারণে আপনি শুনে ফেলেছেন বলে তাকে চাকরিচ‍্যুত করলেন, কিন্তু যাদের গুলো শুনছেন না- তাদের মুখ বন্ধ করবেন কি করে!

এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বেড়িয়ে আসছে গালিগালাজ অনেকেই করছেন। এখন আমি যে বিষয়টা আলোচনায় আনতে চাইছি সেখানে প্রসঙ্গিক ভলতেয়ার ও আমাদের দেশের সমসাময়িক আলোচিত সমালোচিত শুয়র গালি খাওয়া হাসনাত আবদুল্লাহ।

অনেকে হয়ত বলে বসবেন কিসের সাথে কি পান্তভাতে ঘি! অনেকে হয়ত হাসতে পারেন কিন্তু যে যাই বলুক, আমারও স্বাধীনতা থাকতে হবে নিজের মত প্রকাশের।

মত প্রকাশের প্রচলিত পথগুলো যখন সংকুচিত হয়ে আসে, তখন মনে পড়ে ফরাসি লেখক, প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক ম্যারিক আরোয়েট ভলতেয়ারকে। যিনি বিশ্বব্যাপী ভলতেয়ার নামেই পরিচিত। যাঁকে বলা হয় অষ্টাদশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী ফরাসি সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক।

ভলতেয়ারের যে উক্তি সমাজে সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক তা হলো, “তোমার মতের সঙ্গে আমি হয়তো একমত নাও হতে পারি; কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি আমার জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে যাব।”

এখন আসি খালি খাওয়া আমাদের সেই ছেলে কি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। সে তার স্ট্যটাসে লিখেছে-

“এখন” টিভির সাংবাদিকদের চাকরি ফিরিয়ে দিতে হবে। আমরা এই দ্বিমত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্যই আন্দোলন করেছিলাম। আপনার এই গালির স্বাধীনতার জন্যই আন্দোলন করেছিলাম।

শুধু মত প্রকাশ নয়,দ্বিমত প্রকাশও অব্যাহত থাকুক।’

এখন যারা তাদের গালি দিচ্ছেন আরও উচ্চস্বরে দিন। কিন্তু এই গালি খাওয়া ছেলেমেয়ের চিন্তাভাবনাকে আমি সন্মান জানাই। কেউ হয়ত বলবেন এটা চমক। আমাদের চমকে দেয়ার আর ভালোবাসা পাওয়ার মত কাজ আর মতামত তারা অব্যাহতভাবে দিয়ে যাক এই কামনা রইল।

উত্তর না পাওয়া প্রশ্নগুলি

মহুয়া বন মাতাল হাওয়ায় এলোমেলো দুলছে কেন
ঘনকালো মেঘগুলো সব এদিক ওদিক ছুটছে কেন
চিত্ত হরণ রিক্ত কারণ আমার প্রেমে করতে বারণ
অশ্রুতে ছলো ছলো নয়ন দু’টি টলোমলো হইছে কেন

কবুতর দুইটি থেকে থেকে ঠোটাঠোটি করছে কেন
বনহংস বনহংসী পাশাপাশি আনমনে উড়ছে কেন
কি কারণে কার স্মরণে তোমার নিটোল ননীর গাল
অশ্রু অঙ্গারে পুড়ে লাল জ্বলজ্বল বেসামাল হচ্ছে কেন

বৃষ্টির ফোটা আকাশ চুইয়ে কাঁদন হয়ে ঝরছে কেন
ঝর্ণা থেকে জলধারা ধরণীতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়ছে কেন
আমায় শুন্য হাতে ফিরিয়ে দিতে পারলে যখন
উথাল পাথাল ঝড়ের তোড়ে সবেগে কান্না কেন!

পরিবর্তন আসুক

সকলের মত আমিও চাই আমুল পরিবর্তন আসুক,
যেই পরিবর্তনে দূর্নীতির কমবে,
দেশের উন্নয়ন এর ধারা আরও গতিশীল হবে,
অর্থনৈতিক ভাবে দেশ হবে আরও সমৃদ্ধ,
প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ হবে,
সুষ্ঠু নির্বাচনী ধারা ফিরে আসবে,
বন্ধ হবে নমিনেশন বানিজ্য,
নিয়োগ বানিজ্য থামবে,
সর্বোপরী প্রশাসনের বিভিন্ন সেক্টরের
অনিয়ম বা দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যাবে।।

এই নির্জনে

এই নির্জনে

বাইরে ঝিমঝিম করে পড়ন্ত দুপুর।
ভারী নির্জন, নিরিবিলি অথচ কোমল রোদে ঝলমলে।
মস্ত মস্ত ঘরের ঘুলঘুলি, বারান্দায় ওপরের কড়ি বর্গায়
নানান জাতের পায়রা নড়াচড়া করে আর ডেকে ওঠে।
পড়ন্ত দুপুরে পায়রার গদগদ স্বরের ডাক এক অদ্ভুত মায়া তৈরি করে।

শব্দের কি কোন আকার আছে?
শব্দরা সম্ভবত নিরাকার।
তবু পায়রার বুকুম বুকুম শব্দের আকার
গোল মনে হয় আমার,
তুলোর বলের মত গোল।
স্টিমারের হুইছালের
বাঁশির শব্দটি কি সরু ও দীর্ঘ মনে হয়!
সেতারের ঝনৎকার
যেন ফুলঝুরির বহুবর্ণ কেন্দ্রতিগ অগ্নিবিন্দু।
এজরাসের ছড় টানলেই
মনে ভেসে ওঠে তন্তুজালের মত আকৃতি,
অদৃশ্য এক মাকড়সা অদ্ভুত দ্রুতলয়ে বুনে চলছে।

পশু-পাখির আত্মজন নেই, সংসার নেই।
তবু পায়রারা গদগদ শব্দে এ কী কথা কয়?
ধ্বনিগুলোকে পরস্পর আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিয়ে
ক্রমাগত বুনন চলায় মাকড়শার মতো,
তাতীবাড়ির একটানা ঠকঠককের মতো,
কাঠঠোকরার একটানা ঠোকরের মতো,
সেতারের ঝনৎকারের ফুলঝুরির মতো
এজরাসের ছড় টানার ঐক্যতানের মতো
বুকুম বুকুম স্বরে আপ্লুত হতে থাকা আত্মজনহীন, সংসারহীন পায়রারা
এই নির্জনে আমাকে স্মৃতিময় এক সুন্দরীর কথা কয়!

জেন-জি

জেন-জি

তারা কথা যথা তথা কাজ বেশি
বহু মত বহু পথ রাশি রাশি
নানা বর্ণ নানা ধর্ম মিলন মেলা
সৃজন শীল কর্মে লীন অরূপ খেলা
এক জন আর জন জানবে ভালো
তারা শিষ্য সারা বিশ্ব যেথা আলো।

ছুড়ে হীন তুচ্ছতাধীন মতবাদ
ব্যাক্তি সমাজে রাস্ট্র রাজে ফ্যাসিবাদ
সততার মনুষ্যত্বার নয়া দুনিয়া
ওরা জেন-জি হবে বিজয়ী যাই বলিয়া
ঝাকে ঝাকে দিকে দিকে রই তাকাইয়া
কাপে ধমনী কাটে রজনী দু’হাত বাড়াইয়া।

ঠিকানা

ঠিকানা খুঁজেছো কার, নেই পথ যার হারাবার
এখন আমি উদাস ফকির আকাশে কারবার!

ঠিকানা একটা ছিল বটে, সবুজে শ্যামলে ঘেরা
ছিল তখন ছন বাঁধানো ছোট্ট একটি ডেড়া
পিপিলিকা দল উঠান বেয়ে দৌড়ে যেতো স্ত্রস্ত
মাটির বুকে আঁকাবাঁকা পথ হতো সাব্যস্ত

কদম ফুল বিলকুল খা খা রোদ্দুর
কৃষ্ণচূঢ়া রক্ত লালে রাঙাবে কদ্দুর?

আমি উদাস ফকির, তারা দানা তসবি গুনি
প্রাণীসম দেহমাঝে মানুষ নামে স্বপ্ন বুনি।

কেমন বৃষ্টি আজ

bb1

কেমন বৃষ্টি আজ!
ভেসে যাচ্ছে সব, জেগে উঠছে স্মৃতি।
যা ছিল সহজ সরল,
তা-ই করে কারুকাজ
মনে আনছে,
সৌন্দর্যের বিপুল আকুতি।

অই যে বালকের দল
ডুব সাতার দিচ্ছে পুকুরে!
আমিও ভাসছি নাকি তাদের সাথে?
কোন একদিন, আহারে!
অই দেখো কাদামাখা ছেলেটা
ফুটবলে রেখে দুই হাত
ভেসে বেড়ায় পুকুরের জলে
আমিই নাকি? অন্য আমি! সময়ের ফারাক।

বৃষ্টি আসে বহমান কাল ধরে
এমনি ঝরে অঝোরে ঘুরে ঘুরে ফিরে ফিরে।

দেশের গান

এখন পৃথিবী আমার আবাস নয়
এখন আমাকে দিয়াছে বিদায় ঝুপ
আমার সাথীরা গিয়েছে হারিয়ে চুপ
আকাশ ছাড়িয়ে কোথাও হয়েছি লয়।

ফেরেশতা আমাকে ফিরিয়ে এনেছে উড়ে
বেহেশত ফটক খুঁজেছে আমায় খুব
আমিতো পাইনি আপন সুবাস ফিরে
তাইতো থাকিনি চাইনি অসীম সুখ।

ও খোদা তুমিতো আমার হৃদয় চিন
কে আছে বন্ধুর আসনে তোমার মত
তোমাতে আমার না যদি হয় গো নাড়ী
তখন ও খোদা কোথায় খুজব পথ!

আমার ছিল যে এক দয়াময়ী মা
ঘুরিয়া বেড়াত মহিমান্বিত ভূমিতে
বারেবারে তার স্বপ্নীল মায়াবি হাতে
থামতে পারি না যতক্ষণ দেই চুমা ।

বেহেশতের চারিধারের পাঁচিল খোলে
সেই মা পাইনি অনেক মানুষ ভীড়ে
আমিতো বুঝিনি ওখানে আমার নাড়ী
সকলে যদিও সব সুখ চেয়েছে দোলে।

ওগো মা তুমিতো আমার হৃদয় চিন
কে আছে বন্ধুর আসনে তোমার মত
তোমাতে আমার না যদি শোধে গো ঋণ
তখন ওগো মা কোথায় খুজব পথ !

যে পথে শহীদ রক্তের সৌরভ বয়
যে পথে আপন সূর সদা জেগে রয়
সে পথে বিজয় উল্লাসে মা খোঁজে পাই
উচ্চকণ্ঠে নিজ দেশের গান তাই !

এ গান গেয়েছি সকল হইতে ফিরে
এ গান বেঁধেছি স্বর্গীয় শিল্প নিয়ে
এ গান আমার মায়ের নাড়ী জুড়ে
এ গান আমার সকল স্বত্বা দিয়ে।

বিসর্জন

গোয়াল ঘরে যখন আগুন লাগল তখন সোহেল তার মায়ের সাথে তর্ক করছিল।

গফুর আর সোহেলের চিন্তা ভাবনায় অনেক মিল থাকলেও মায়ের সাথে সোহেলের প্রায়ই তর্ক বেধে যায়। গফুরের মা যখন বলল, তগো ঢং দেইখ্খা আর বাচি না। বলি গফুর কি একলাই বাপ অইব নাকি? দুইন্না জুইরা আর মানইষের কি আর পোলাপান অয় না। কয়দিন পর পর অই ডাক্তার হেই ডাক্তার, কই, টাহাডা আহে কই তন?
সোহেল বলে- দ্যোখ মা বেশি কতা কইবা না কইয়া দিলাম। কয়েকদিনে মধ্যে ভাবীর বাচ্চা অইব, অহন কি আর টাহার দিহে চাইয়া থাকলে অইব নাহি?
: কেন অইব না? তোরা কি অছ নাই? তগো কি আমি পেটে ধরি নাই নাহি?
: তোমাগ দিন গেছে গা, এহন সরকারী হাসপাতাল অইছে, ডাক্তাররা কত চিকিস্যা করে। কত সুন্দর সুন্দর কতা কয়।
: তা তরা সুন্দর কতা হাজার শুনগা, কিন্তুক মহাজনী টাকা ধার লইয়া তরা যে বাহাদুরি দেখাইতছ তা ভালা অইব না বইল্লা দিলাম। টাহা শুধাবি কেমনে? জানি না কি অলক্ষীই না ঘরে আইতাছে! পথের ফকির বানাইয়া ছাড়ব।

সোহেল আর কোন কথা বলল না। বর্ষার পানি নামতে শুরু করেছে। পুটি মাছের ‘মাইর’ পড়ছে। গত কয়েক দিনে পলো ভরে ভরে মাছ নিয়ে আসছে গফুর। অন্যসব মানুষেরা যেখানে অভাবে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে গত কয়েক মাসে গফুরের আয় বেশ ভালই হচ্ছিল। সোহেল ভাবে হয়ত নতুন কেউ আসছে বলেই তাদের দিন বদলাতে শুরু করেছে। পুটি মাছগুলো রোদ্রে দিয়ে শুটকি করছে তারা। তার মা শুটকিগুলোর দিকেই যাচ্ছিল। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, অ গফুর রে … অ সোহেল রে … এদিকে আয় রে … আগুন আগুন … আগুন…

মুহুর্তের মধ্যে সোহেল দৌড়ে গেল গোয়াল ঘরের দিকে। গোয়াল ঘরের পিছন দিকে নাড়া আর কুটার স্তুপের মধ্যে আগুল লেগেছে। ধাউ ধাউ করে জ্বলে উঠছে আগুনের লেলিহান শিখা। কোথা থেকে বাতাস বইতে শুরু করল। সোহেল লক্ষ্য করেছে যখনই কখনো কোথাও আগুল লেগে যায় তখন একটা বাতাস বইতে শুরু করে। মুরব্বীরা বলেন অশরীরী বাতাস । বাতাসের প্রবাহ বেড়ে গেলে সে আগুল গোয়াল ঘরের পাটকাঠিতে তৈরী বেড়াতে লেগে যায়। কিছু ক্ষনের মধ্যে একটা হুলস্থুল কান্ড ঘটে গেল। যুবক, যুবতী, বালক, বৃদ্ধ সকলে আগুন নিভানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সমস্ত উঠান জুড়ে মানুষের ছুটাছুটি। ছাগলগুলো দৌড়ে পালাল, মুরগীগুলো কক কক করে ছুটে গেল কিন্তু একটি গরুর হাম্বা হাম্বা করে গগন বিদারী চিৎকার করে যাচ্ছে সেদিকে কারোরই খেয়াল রইল না।

কয়েক দিন যাবৎ তারামনের শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। শরীর ভারী হয়ে গেছে। হাত পা ফুলে উঠেছে। পেটের আকার এতটা বড় হয়ে উঠেছে যে নড়তেই বেশ বেগ পেতে হয় তার। শুয়ে ছিল তারামন। হঠাৎ আগুন আগুন চিৎকারে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভাঙ্গতেই তুমুল হৈ চৈ-এ দিশেহারা হয়ে গেল তারামন। কিন্তু এইসব চিৎকার চেচামেচি ছাড়িয়ে তার গরুর হাম্বা হাম্বা চিৎকারটা কানে ধাক্কা দিতে থাকল। ঘর থেকে বেরিয়ে গোয়াল ঘরের দিকে চোখ যেতেই দেখতে পেল গায়ের মধ্যে আগুন নিয়ে তাদের গরুটি এলোপাথাড়ি লাফাচ্ছে। তারামন তার নিজের কথা ভুলে গেল। প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে এলো, চিৎকার করে বলল- অ সোহেল রে তোর ভাই গেল কইরে? গরুডারে বাচারে! গরুডার গায়েতো আগুন লাইগা গেছে রে।

এতক্ষন আগুন নিভাতে যেয়ে কেউ খেয়াল করছিল না গরুটার দিকে। তারামনের চিৎকারে সকলে তাকিয়ে দেখল এক বিভষৎ দৃশ্য। গরুটা সারা গা ঝলসে গেছে। পুরা মাংসগুলো দেখা যাচ্ছে।
তারামন প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে আসতে গিয়ে টের পেল তার পেটে ভিষন ব্যাথা হচ্ছে। বসে পড়ল । ব্যাথা ক্রমে বেড়ে উঠায় উঠানে মধ্যে শুয়ে পড়ল সে।
তারামনের শাশুড়ি দৌড়ে এলো, বলল- এই শরীর নিয়া দৌড় দিলি কেনরে। এখন কি হইব রে … অ সোহেল রে… অ গফুর রে….

আগুনের খবর পেয়ে এসেছে মাষ্টার সাব, এসেছেন মসজিদের ঈমাম, মাতবর, মেম্বার আরো অনেকে। এসেছে বয়সের ভারে প্রায় নুয়ে পড়া জরিমুনের মা। বিশ-বাইশ বছর যাবৎ এই গ্রাম সেই গ্রামে দাইয়ের কাজ করেছে জরিমুনের মা। এখন আর লোকে তাকে তেমন ডাকে না। সকলে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দৌঁড়ায়। সামন্য সমস্যা হলেই স্বাস্থ্য কর্মীর মেয়েটাকে লোকে খবর দেয়। জরিমুনের মা দেখলেন তারামন শুয়ে আছে উঠানে আর ব্যাথায় কোকড়ে কোকড়ে যাচ্ছে। জরিমুনের মা দৌড়ে এল। এখন তার দিন নেই অথচ কি দিন গেছে তার। তিন গ্রাম দুর থেকে লোক এসে তাকে নিয়ে যেত। বাচ্চা হলে টাকা আর নতুন কাপড় দিত। কখনও যে অঘটন ঘটেনি তা নয়। তখন সকলের অগোচরে বেরিয়ে আসতো । লোকে জিজ্ঞাসা করলে জরিমুনের মা বলতো, সব আল্লার ইচ্ছা। আমরা কি পারি? সকলে মেনে নিত তার কথা। কিন্তু এখন আর শুধু উপরওয়ালার ইচ্ছার দিকে বসে থাকে না। সকলেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দিকে দৌড়ায়, তাকে কেউ ডাকে না ।

একটা মানসিক জটিলতায় ভুগতে থাকে জরিমুনের মা। সে কি যাবে এই পোয়াতি মেয়েটার দিকে? না কি অপেক্ষা করবে, কেউ ডাকে কিনা তার অপেক্ষা করবে। কিন্তু দীর্ঘ দিনে অভিজ্ঞতায় দাই বুঝতে পারে এখন অভিমানের সময় না। ব্যাথা উঠে গেছে আর দেরি করা যায় না। তাড়াতাড়ি তারামনের কাছে যেতেই সে টের পেল যে, পানি ভেঙ্গে গেছে। যে আবরনের ভিতর মানব শিশু পরম নিশ্চিন্তে বেড়ে উঠছিল তার অবসান হয়ে গেছে। ভেঙ্গে গেছে নিরাপত্তা বেষ্টনী। এখন দ্রুততম সময়ের মধ্যে যদি বাচ্চার আগমন পথ তৈরী করে দেয়া না যায় তবে ঘটে যাবে অঘটন।
সকলে ধরাধরি করে তারামনকে ভিতরে নিয়ে গেল।

গফুর বিলে গিয়েছিল মাছ ধরতে । পানি নেমে যাচ্ছে দ্রুত। এখন খালগুলি দিয়ে মাছের ঝাকেরা নেমে যাচ্ছে নিম্নমুখী স্রোতের দিকে। এখন পলো দিয়ে কাড়িকাড়ি মাছ ধরা যায়। যাবার সময় বারবার জিজ্ঞাসা করেছে সে তারামনকে কোন খারাপ লাগছে কিনা। তারামন তাকে নিশ্চিন্তে যেতে দিয়েছে আর ডাক্তাররা ডেলিভারীর যে তারিখ দিয়েছে তার আরো এক সপ্তাহ বাকি। অনেক মাছ পেয়েছে সে আজ। গত কয়েক মাসে সে যত মাছ পেয়েছে সারা জীবনেও তা পায় নাই। বেশ খুশি মনে বাড়ি ফিরছিল গফুর। কিন্তু পাড়ায় ঢুকার পথে দোকানটার সামনে আসতেই লোকেরা জানাল যে, তার বাড়িতে আগুন লেগেছে। প্রায় দৌড়ে বাড়ি ফিরছিল সে। পথে সোহেলের সাথে দেখা।
: কি রে সোহেল কি হইছে?
: আগুন লাগছিল গোয়াইল ঘরে। গরুডা বাচব না ভাই। গরুডা বাচব না। তয় হেইডা বড় কতা নয়, বড় কতা হইল ভাবীর ব্যাথা উইঠা গেছে। আমি যাইতাছি স্বাস্থ্য কর্মীকে খবর দিতে। তুমি বাইত যাও।

গফুর প্রায় ছুটে আসল। অনেক মানুষের জটলা। সকলে দাড়িয়ে বিভৎষ গরুটাকে দেখতে লাগল। মেম্বারকে দেখে গফুর থমকে দাড়াল।
মেম্বার তাকে দেখে বলল: গফুর আইছো। আহো আহো। গরুডা বড় কষ্ট পাইতাছে। এহন কি করা যায়। কেউ কেউ কইতাছে গরুডারে জবাহ দিয়া দিতে। আমি কি কই জানো, পশু চিকিৎসককে খবর দেই। একটা চিকিস্যা অবশ্যই আছে।

গফুরের হৃদয়খানি কেপে উঠল। হু হু করে তার বুক। হাউ মাউ করে কেদে দিলো সে। বোবা জানোয়ারটার কষ্ট তাকে বেদনা বিহ্বল করে তুলল। গরুটা যেন গফুরের পথের দিকে তাকিয়ে ছিল। এখন তার চিৎকার করা শক্তি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। পা দুটি ভাজ করে সে মাটিতে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। গফুর একটা কাঁথা ভিজিয়ে নিয়ে এলো। তারপর ঝলসে যাওয়া জানোয়ারটার গায় জড়িয়ে দিল। এতে বোধ হয় গরুটা আরাম পেল কিছুটা। মাঝে মাঝে এটা উঠে দাড়াতে চেষ্টা করল।
গফুর দৌড়ে গেল বাড়ির ভিতর। এখানে মেয়েদের ভিড়। গফুরকে দেখে তার মা বেরিয়ে এলো। গফুর আর্তনাদ করে উঠল: কি হইছে মা?
: বউ দৌড় দিছিল অর পরই তার ব্যাথা শুরু হইছে।
: এহন আমি কি করুম।
: আল্লা আল্লা কর। জরিমুনের মা দেখতাছে।
: ডাক জরিমুনের মারে। সোহেল গেছে ডাক্তার আনতে।
: আন বাবা তাড়াতাড়ি কর। নাইলে বউডারে বাচানো যাইবো না। পানি ভাইঙ্গা গেছে।
গফুরের মা জরিমুনের মারে ভিতর থেকে ডেকে আনল। জরিমুনের মা যা বলল তা হলো জরাযুর মুখ খুলে গেছে। বাচ্চাটার মাথাটা দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় তাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া অনেক রিক্স। যদি অনুমতি দেয়া হয় তবে এই দাই-ই বাচ্চা ডেলিভারীর চেষ্টা করতে পারে। গফুরের মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠল। ঘটনার নাটকীয়তা সে বিহ্বল হয়ে গেল। এমন সময় সোহেল এলো স্বাস্থ্যকর্মী মেয়েটিকে নিয়ে । তারা ভিতরে ঢুকে গেল। গফুর আল্লা আল্লা করতে লাগল।

মেয়েটি বেরিয়ে এসে বলল: সময় নেই গফুর ভাই। এ অবস্থায় কোথাও নেয়া যাবে না। এখানেই চেষ্টা করতে হবে। আমি দাইয়ের সাথে কথা বলেছি। আমরা দুজনই চেষ্টা করব। আল্লাহর উপর ভরসা রাখেন।

সন্ধ্যা প্রায় সমাগত। পাখিরা নীড়ে ফিরে যাচ্ছে উড়ে উড়ে। একঝাক সাদা বক উড়ে গেল হিজল গাছটার উপর দিয়ে । তারই ফাক দিয়ে অস্তগামী লাল সুর্যটা দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে বাড়িটা প্রায় ফাকা হয়ে গেল। মেম্বার এসে একবার গফুরের মাথায় হাত বুলিয়ে গেল। ঈমাম সাহেব মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। গরুটা আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আসছে। তার দুচোখ বুজে যাচ্ছে মৃত্যুর অবসাদে।

একসময় তার মনে পড়ল তারামনের কথা। বুকের ভিতর ঝির ঝির একটা ব্যাথা অনুভব করল গফুর। বেহুশ নেশাগ্রস্থ মানুষের মত টলতে টলতে এগিয়ে গেল সে। এখানে এক ভয়াবহ নিরবতা বিরাজ করছে, সকলের চোখে মুখে আতংকের ছাপ। কিছুই বুঝতে পারল না গফুর। তার মাথাটা ঠিক কাজ করছে না। টলতে টলতে এগিয়ে গেল সে, বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগল- ব্যাপার কি?
কেউ কোন জবাব দিল না। সকলে চোখে মুখে ভয় আর বিস্ময় নিয়ে দাড়িয়ে আছে। এতো লোক তবুও কোথাও কোন শব্দ নেই। গফুর ভাবল- বউটিও মারা গেল কি?
বুড়ি দাই-কে দেখা গেল থর থর করে কাঁপছে।
-ও খালা কি অইছে ? আমারে কেউ কিছু কও না ক্যান ? কি হইছে?
-আমি কইতে পারুম না। তুই ভিতরে গিয়া দ্যাখ।

ভিতরে ঢুকল গফুর। না, বউ জীবিত-ই আছে। জ্বল জ্বল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তারপর তার চোখ গেল পাশে রাখা ছোট বাচ্চাটার দিকে। কাঁথার উপর বাচ্চাটি কাঁদছে না এক ফোঁটাও। কিন্তু হাত দুটি নাড়ছে। নিচের দিকে চোখ যেতেই থমকে গেল সে। বাচ্চাটার নিচের দিকে দুটি পা ঠিকই নড়ছে। তার পাশেই আরও দুটি পা, দুটি হাত সামান্য ঝুলছে।
ব্যাপারটা একসাথে খেয়াল করল গফুর। বউ তার বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মরে যায়নি, ভীষন ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। উঠান ভর্তি মানুষ, বাচ্চাটি জীবিত কিন্তু কাঁদছে না এক ফোঁটাও। উপরের দিকে স্বাভাবিক এক মেয়ের অবয়ব। কিন্তু নীচের দিকে কিম্ভুতকিমাকার এক প্রাণীবিশেষ।

স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে।

চলবে….

একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে

একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে

১.
ব্যতিক্রম শব্দটা ভাঙ্গলে দাড়ায় ক্রমের ব্যত্যয় অর্থাৎ প্রবহমান ধারাটায় বিচ্যুতি। মাত্র দুইশত বৎসর আগেও মানুষের কাছে যা ছিল রহস্যময় তা বিজ্ঞানের কল্যাণে এতটাই সুস্পষ্ট যে আস্তে আস্তে মানুষ সত্যের প্রায় কাছে এসে দাড়াচ্ছে। কোন কিছুই এখন আর রহস্য মনে করা হয় না। হাতে নাতে প্রমানের ভিত্তিতে এখন ব্যাখ্যা করা যায় প্রকৃতির নানা খাম খেয়ালীপনার। আগে যেখানে এসে থমকে গেছে মানুষ সেখানে এসে একজন অতিপ্রাকৃতিক মহাশক্তির উপস্থিতির মাধ্যমে তার ব্যাখ্যা করা হতো। এখন মানুষের মাঝে সে প্রবণতা ক্রমে ক্রমে ফ্যাকাসে হতে যাচ্ছে। সত্যি কি যাচ্ছে? আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। আমাদের এই গল্পে সেই সব বিষয়ের অবতারণা হচ্ছে না। তবে ব্যতিক্রমটা এখানে লক্ষনীয় হয়ে উঠতে পারে। প্রকৃতির খাম-খেয়ালীপনার একটি চিত্র এখানে দেখা যেতে পারে।

দিনটি অন্যান্য দিনের মতোই ছিল। পাওয়ার লোমে কাজ করতে গিয়েছিল মোহাইমেন। তাদের ডিউটি হয় দুই শিফট্। ডে-শিফট্ আর নাইট-শিফট্। এক সপ্তাহে দিনে আর এক সপ্তাহ রাতে। দিন রাত চলে কাজ। রমজানের মাস আসছে সামনে। কাপড়ের ব্যবসায় এই সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মহাজনরা কাপড়ের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে। সুযোগটা নেয় শ্রমিকেরা। একে তো দক্ষ শ্রমিকের অভাব, তার উপর মহাজনের বার বার উৎপাদনের তাগাদাটাকে বেশ কাজে লাগায় শ্রমিকেরা। তারা জানে এখন এমন একটা সময় যখন কিছু টাকা অগ্রীম হিসেবে নেয়া যায় তার গজ প্রতি রেট টাও বাড়ানো যায় একটু মোচড় দিলেই। প্রায় ৫০ জন শ্রমিক আছে এই ফ্যাক্টরীতে। যতক্ষন বিদ্যুৎ আছে পাওয়ার লোম- এর বিকট আওয়াজটা গম গম করতে থাকে আশ-পাশের এলাকাতে। আজকে ব্যতিক্রম। আজ ধর্মঘট। মোহাইমেন নির্দেশ দিয়েছে- কেউ যেন কোন লোম চালু না করে। মালিকের সাথে রেট নিয়ে ফয়সালা হবে তারপর চালু হবে। একটা ভৌতিক নীরবতা বিরাজ করছে। মহাজন ঢাকায় গেছেন তাগাদায়, ফিরতে রাত হবে। তিনি ফিরে এলে মিটিং শেষে বাড়ি ফিরবে। সকলে অপেক্ষায় আছে।
খবরটা আসল ঠিক তখন। মোহাইমেনের বউয়ের প্রসববেদনা শুরু হয়ে গেছে। সম্ভবত: যমজ বাচ্চা হবে। বউটার পুরো আকৃতি ভয়াবহ রূপ ধারন করেছে। পেটটা যেন একটি মটকির মতো বড় হয়ে উঠেছে। নড়াচড়া করতে ভীষন কষ্ট হচ্ছে , তার উপর পানি নেমে গেছে শরীরে। হাত-পা ফোলে ফোলে উঠেছে। অস্থির হয়ে উঠল মোহাইমেন। তাদের প্রথম বাচ্চা আসছে, কোন কিছুই খেয়াল না করে সে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল। ফ্যাক্টরী থেকে তার বাড়ি পৌঁছতে সময় লাগে আধ ঘন্টার উপর। সময়টা যেন কিছুতেই কাটতে চাচ্ছেনা। দৌড়ের উপর ছুটছে সে, বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরছে তার কপাল থেকে। পথ যেন ফুরাতে চায় না। অবশেষে বাড়ির পাশে এসে থমকে দাঁড়ালো। উঠান ভর্তি মানুষ। পাড়ার সকল মানুষ যেন ভেঙ্গে পড়েছে এই বাড়িটিতে।
মোহাইমেনকে পথ ছেড়ে দিল সকলে। সে বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগল- ব্যাপার কি? কেউ কোন জবাব দিল না। সকলে চোখে মুখে এক বিস্ময় নিয়ে দাড়িয়ে আছে। এতো লোক তবুও কোথাও কোন শব্দ নেই। মোহাইমেন ভাবল- বউটি মারা গেল না কি? না, সেরকম কোন ব্যাপার নয়, কোথাও কান্নার কোন শব্দ পাওয়া গেল না। বুড়ি দাই-কে দেখা গেল থর থর করে কাঁপছে।
-ও খালা কি অইছে ? আমারে কেউ কিছু কও না ক্যান ? কি হইছে?
-আমি কইতে পারুম না। তুই ভিতরে গিয়া দ্যাখ।
ভিতরে ঢুকল মোহাইমেন। না, বউ জীবিত-ই আছে। জ্বল জ্বল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তারপর তার চোখ গেল পাশে রাখা ছোট বাচ্চাটার দিকে। কাঁথার উপর বাচ্চাটি কাঁদছে না এক ফোঁটাও। কিন্তু হাত দুটি নাড়ছে। নীচের দিকে চোখ যেতেই থমকে গেল সে। বাচ্চাটার নীচের দিকে দুটি পা ঠিকই নড়ছে। তার পাশেই আরও দুটি পা, দুটি হাত সামান্য ঝুলছে।
ব্যাপারটা একসাথে খেয়াল করল মোহাইমেন। বউ তার বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মরে যায়নি, ভীষন কান্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। উঠান ভর্তি মানুষ, বাচ্চাটি জীবিত কিন্তু কাঁদছে না এক ফোঁটাও। উপরের দিকে স্বাভাবিক এক মেয়ের অবয়ব। কিন্তু নীচের দিকে কিম্ভুতকিমাকার এক প্রাণীবিশেষ। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে।

২.
প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার এক নিদর্শন হয়ে জন্ম নিয়েছে মেয়েটি। জন্মের পর থেকেই তার পিতার ভাগ্য বদলাতে শুরু করেছে। এ কারনে তার নাম রাখা হয়েছে ভাগ্যলক্ষী। অসাধারণ মেধা নিয়ে জন্ম নিয়েছে সে। অল্প সময়ে কথা বলতে পারা, তীক্ষ্ম স্মৃতি শক্তি আর মাঝে মাঝে ভবিষ্যৎ বলে দিয়ে সে অনন্য অবস্থান তৈরী করেছে। এখন আর মোহাইমেন পাওয়ার লোমে কাজ করতে যায় না। সারাদিন কোন্ মেলায় কোন্ প্রদর্শনী আছে তার হিসাব করে। অদ্ভুত এই মেয়েটিকে দেখতে দলে দলে লোক আসে। সার্কাসের যে অংশে মেয়েটাকে প্রদর্শন করা হয় সেখানে কেবল মানুষের ভীড়। মানুষ আর মানুষ। আর মানুষের ভীড়, যত মানুষ তত টাকা। এই অর্থ সমাগমে স্বপ্নের একটা বিরাট ভূমিকা আছে।

কয়েক দিন একটানা বৃষ্টিতে সারা প্রকৃতি ভিজে আছে। বৃষ্টিটা থেমেছে। চমৎকার রাত। পূর্ণিমা হবে হয়তো। এমন দিনে কবি আর পাগল ছাড়া কেউ জেগে জেগে জ্যোস্না দেখে না। গরমের মধ্যে বৃষ্টির এই পরশগুলি শীতলতা নিয়ে আসে দেহে। তখন বড় ঘুম পায়, বড় আরামের ঘুম। মোহাইমেন গভীর ঘুমে মগ্ন ছিল। আর এমন সময় স্বপ্নটা এলো। সাধারণ কোন স্বপ্ন নয়, যেন বাস্তবের মতো স্বচ্ছ।
বর্ষার থৈ থৈ পানিতে ডুবে আছে নীচু জমিন। চারিদিকে পানি আর পানি। শুধু ভেসে আছে বাড়িটা। চারিদিক থেকে নাও-কোষা নিয়ে দলে দলে লোক আসছে, হাজারে হাজারে, অসংখ্য মানুষ। ভয় পেয়ে গেল মোহাইমেন। সে বার বার জিজ্ঞেস করছে- কোথায় যান আপপনারা ? যেন তাকে কেউ শুনতেই পেল না। সকলের একই উদ্দেশ্য। মোহাইমেন তাদের অনুসরন করতে করতে এসে দাঁড়ালো ভাগ্যলক্ষ্মীর ঘরটায়। ঘরটা আর ঘর থাকে না। ক্রমাগত বড় হতে হতে একটি খোলা মাঠে রূপ নেয়। হঠাৎ তাকাল মেয়েটির দিকে আর একবার মানুষের দিকে। সকল মানুষগুলো মাথানত করে প্রণামের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মোহাইমেন খেয়াল করল ভাগ্যলক্ষ্মীর পায়ের দিকে। তার বর্ধিত পা দুটিতে ঝুলে আছে দুটি সাপ, ফনা তুলে পাহাড়া দিচ্ছে যেন। আর কি উজ্জ্বল মেয়েটার চেহারা! যেন পূর্ণিমার চাঁদ নেমে এসেছে তার প্রাঙ্গনে। সমবেত সকলের মতো মোহাইমেনও নত হয়ে তাকিয়ে আছে উজ্জ্বল সে আলোর দিকে।
এই স্বপ্ন আর স্বপ্ন থাকে না যখন মোহাইমেনের বউ এসে ধাক্কা দেয় তাকে।
-এখানে কি করছেন আপনে? ঘর থেকে কখন আইছেন এহানে? চান্দের দিকে তাকাইয়া কি করতাছেন?
মোহাইমেন প্রকৃতিস্থ হল। না, সে তো এখানেই দাঁড়িয়েছিল, খোলা প্রান্তরে, হাজার হাজার মানুষের ভীড়ে। মানুষেরা সব গেল কই! আর ভাগ্যলক্ষ্মী কোথায়? তার পায়ের কাছে ঝুলে থাকা সাপ দুটো ? ফনা তুলে পাহাড়া দিচ্ছিল…… মোহাইমেন আপন মনে বলতে থাকল।
-আপনি পাগল হইছেন নি?
প্রকৃতিতস্থ হলো মোহাইমেন । খেয়াল করে দেখল সে দাড়িয়ে আছে তার উঠানে এবং থর থর করে কাঁপছে। সে তার স্বপ্নের বিবরণ বর্ণনা করল। এর পর দিন এই স্বপ্নের বিবরণ ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত গ্রামের মধ্যে। স্বপ্ন কি সংক্রামক হয় নাকি? কিছুদিন পর দশটি গ্রাম থেকে দশটি স্বপ্নের বিবরণ এলো বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে। কিন্তু বিষয়বস্তু একই, আর তা হলো ভাগ্যলক্ষ্মী একটি সাধারণ মানবী নয়। সে এক অলৌকিক মানবী। যাকে পুঁজি করে জোয়ারের জলের মতো অর্থ সমাগত হতে লাগলো মোহাইমেনের।
কিন্তু সেই রাতে শুধু একটি স্বপ্নই দেখা হয়নি। মোহাইমেনের সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে জেগে উঠেছিল এক ক্রন্দন।
মোহাইমেন ও তার বউ দৌড়ে গেল ভাগ্যলক্ষ্মীর ঘরে। এত রাতেও মেয়েটি ঘুমায়নি। চোখ ফুলে আছে। কান্নার স্পষ্ট চিহ্ন তার চেহারায়। যেই মেয়ে জন্মের সময় কাঁদেনি, শুধু হাত নেড়ে জানান দিয়েছিল সে বেঁচে আছে। সেই মেয়ের এই কান্নায় মোহাইমেনের বুকে তীব্র শেলের মতো বিঁধেছিল। এমনিতেই তীব্র বাস্তবের মতো স্বপ্ন তার উপর এই কান্না হকচকিয়ে গেল মোহাইমেন. . .
-ক, মা তোর কি হইছে, আমারে ক। আমার টাকা পয়সার অভাব নাই। সবই তোর। ক মা তুই কি চাস? যা চাইবি আমি তাই আইন্যা দিমু।
এই মেয়ে যখন কথা বলছিল তখন তার পা চারটি একসাথে নড়ে নড়ে উঠছিল। তার হাত দুটিও মুষ্টিবদ্ধ ছিল। যেন বা সারা পৃথিবী সে খামছে ধরেছে, বলল-
-বাবা, আমি হাঁটতে পারি না কেন? বাবা, আমি দাঁড়াতে চাই, বাবা গো তোমরা সবাই হাঁট, তোমরা সবাই কি সুন্দর হাঁট, আমি পারি না কেন? বাবা, আমি দাঁড়াতে চাই।
মোহাইমেন বলেছিল- মাগো আমি তোকে নিয়ে যেখানেই যাই মানুষ আমারে টাকা দেয়। সেই টাকায় আমি সোনার পালঙ্ক কইরা দিতে পারি, নিজে শুতে পারি রূপার খাটে। কিন্তু আমি যে তোকে দাঁড়াতে দিতে পারি না, পারি না মা। আল্লা যে তোরে হেইভাবে পাঠায় নাই.. .. ..
তারপর তিনটি মানুষ কেঁদেছিল বহু ক্ষন, বহু বহুক্ষন .. .. ..

৩.
পাঠক, আপনাদের মনে আছে? যেদিন মোহাইমেন খরবটা শুনতে পায় যে, তার স্ত্রীর প্রসববেদনা শুরু হয়ে গেছে সেদিন সে নেতৃত্ব দিচ্ছিল একটি ধর্মঘটের। কারখানার মালিক ঢাকা গিয়েছিল তাগাদা করতে। গল্পের এই অংশে সেই মালিকের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া দরকার। গ্রামের এই পাওয়ার লুম কারখানা পরিচলনা করলেও আর এই গ্রামের ছেলে হলেও সে বড় হয়েছে শহরে, লেখা পড়া করেছে নানা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেউ কেউ সন্দেহ পোষন করে সে হয়তো লেখা পড়া শেষ করতে পারেনি, না হলে চাকুরী না করে এই ধরনের কাপড়ের ব্যবসায় কেন জড়াবে? আমরা সে দিকে যাব না, আমরা শুধু মোহাইমেনের সাথে তার বিরোধের আর সহযোগিতার ব্যাপারটা তুলে ধরব।
মোহাইমেন যখন শ্রমিক তখন সে মহাজন। আর এখন মোহাইমেন সামান্য শ্রমিক নয়, সমাজ সংসারে, বিচার মজলিসে এখন তার কদর আছে। বিশ্বাসের নেতৃত্ব দিয়ে সে এখন সামনের কাতারের মানুষ আর সেই মহাজন এখন যেন আন্দোলনকারী। সে বলে বেড়ায়, ভাগ্যলক্ষী কোন ঐশ্বরিক মানবী নয়। প্রকৃতির ব্যতিক্রমের সে একটি নিদর্শন মাত্র। সে বলে, ভাগ্যলক্ষী জমজ দুই বাচ্চার একত্রে লেগে যাওয়া এক বিরল নিদর্শন বটে কিন্তু সে-ই প্রথম নয়। এর আগেও আরো অনেক ঘটনা ঘটেছে, সবচেয়ে আলোচিত ইরানের দুই জমজ মেয়েরা যাদের মাথা দুটি জোড়া লেগে ছিল। তার এসব কথা কেউ বুঝে না, বিশ্বাস ও করে না।

যে রাতে অদ্ভুতরে মেয়েটি তার সমস্ত স্বত্ত্বা দিয়ে কেঁদে উঠেছিল- বাবা তোমরা সকলে কি সুন্দর হাটতে পারো, আমি কেন দাঁড়াতে পারি না? সে রাতের পর হতে মোহাইমেন তার এই প্রতিপক্ষ মহাজনকে আর প্রতিপক্ষ ভাবলো না।
আমরা তাদের সর্বশেষ সম্পর্কটিকে একটু দেখে আসতে পারি-
: তাইলে আপনে আমাকে অপারেশন করতে বলেন?
: দেখ আমি কিছু বলতে চাই না, সিদ্ধান্ত তোমার। আমার বন্ধু ডা: তুহিন বলেছে অষ্ট্রেলিয়া থেকে অনেক বড় একজন ডা: এসেছেন। তিনি এধরনের জটিল অপারেশন করেন। ডা: তুহিনের সাথে তার আলাপ হয়েছে, তিনি এই অপারেশন করতে চান। এখন তোমার ইচ্ছা।
: আমার সব যাবে, বুঝতে পারছেন? মানুষজন আর আইবো না আমার কাছে, আইবো না সার্কাসের সেই লোকেরা। আমার টাকা পয়সা সব যাক, সব যাক……. শুধু বলেন আমার মাইয়াডা বাচবো তো…..
: এই ব্যাপারটা তোমাকে বলে রাখা দরকার, এর আগে ইরানের জোড়ামাথা দু’জন মেয়েকে আলাদা করতে পৃথিবীর বড় বড় ডাক্তারা চেষ্টা করেছেন কিন্তু তারা তাদের বাচাতে পারেননি। দুজনই মারা গেছে। তবে তোমার মেয়ের জোড়াটা কোমড়ে , হয়ত বাঁচবে। আমি কিছু বলব না- সিদ্ধান্ত তোমার, তোমাকেই নিতে হবে…. শুধু এটুকু বলতে পারি যদি অপারেশন সাকসেস হয় তোমার মেয়ে স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়াতে পারবে, নিজের পায়ের উপর ভর করে নাড়া চড়া করতে পারবে, এগুতে পারবে সামনের দিকে….

৪.
পুবের আকাশে সুর্য্য উদয়ের রক্তিম আভা ভেসে উঠছে। বাতাসে হিম হিম নির্মল পরশ লেগে আছে । হিজল গাছের ডালে একটা ডাহুক ডেকে যাচ্ছে অনবরত। জমি চাষের জন্য কৃষাণ গরুকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পাজনের আঘাতে। হাম্বা হাম্বা স্বরে ডেকে উঠছে গাভী, বালতি নিয়ে যায় কৃষাণী দুধ ধুয়াতে, বাছুরটা ঘুর ঘুর করছে আসে পাশে।
এই অনিন্দ সুন্দর সকালের সৌন্দর্য্যরে মাত্রা বহুগুন বাড়িয়ে ভাগ্যলক্ষী আস্তে আস্তে হেটে যাচ্ছে মোহাইমেনের হাত ধরে, একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে।

অপারেশনগুলো সাকসেসফুল ছিল একটির পর একটি। গত নয় মাসে বেশ কয়েকটি অপারেশনের পর, দেহের সাথে লেগে থাকা অপর একটি দেহের বিসর্জনের পর ভাগ্যলক্ষী দাড়িয়ে গেছে, খুড়িয়ে খুড়িয়ে এগুচ্ছে সামনের দিকে পিতার হাত ধরে।
আমরা মোহাইমেনের হৃদয়ের অবস্থার বর্ননা করতে পারি না। সে হারিয়েছে তার সমস্ত অর্জিত অর্থ, আর হারিয়েছে উপার্জনের মাধ্যম। তবু তার সন্তান অন্যসব সাধারণ প্রনীর মত হাটছে, এই দৃশ্য দর্শনে তার হৃদয়ের প্রতিক্রিয়া বর্ননা করার মতো মতা আমাকে প্রকৃতি দেয়নি। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে বহুবার আমি চেষ্টা করেছি হৃদয়ের এই অনুভবকে ফুটিয়ে তুলতে, আমি ব্যর্থ হয়েছি। আমার ভাবনায় একটি অপ্রাসঙ্গিক দৃশ্য ফুটে উঠছে, সেইদিকে একটু ঘুরে আসি।
প্রকৃতির তান্ডবলীলায় ঝড়ের উন্মক্ততায় উপকুলের মানুষ দিশেহারা। সেইসব হৃদয় বিদারক দৃশ্যাবলী পুজি করে মিডিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া হলো সহানুভুতির আবেদন। দলে দলে সাহায্য আসতে লাগল। হেলিকপ্টারে ছিটিয়ে দেয়া হচ্ছে খাদ্যদ্রব্য আর মানুষের পাল ছুটে চলছে সেই খদ্যের পিছনে পিছনে। এইসব দৃশ্যাবলী পুজি করে চললো রাজনীতি বানিজ্য। একটি জাতি আর দাঁড়াতেই পারলনা কেবল সহানুভুতি আর দানের দিকে তাকিয়ে রইল।
এই হচ্ছে আমার সমস্যা। লোকে পাগলতো আর শুধু শুধু বলে না। কোথায় এক প্রকৃতির ব্যতিক্রম ভাগ্যলক্ষীর গল্প বলতে এলাম, এলাম তার পিতার ত্যাগকে ফুটিয়ে তুলতে, কোত্থেকে কথা নেই বর্তা নেই একটা খন্ড চিত্রের বর্ননা করে দিলাম। আসুন, আপনাদের একটা গান শুনাই। আমার গান, আমাদের গান , আমাদের প্রিয় গান…
পূর্ব দিগন্তে সূর্য্য উঠেছে
রক্ত লাল রক্ত লাল…