জসীম উদ্দীন মুহম্মদ এর সকল পোস্ট

শ্রীলংকার বিপর্যয় এবং আমাদের শিক্ষা

27878

খুব বেশিদিন আগের কথা নয় যখন শ্রীলংকাকে মনে করা হতো দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক জায়ান্ট। মাথাপিছু আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পর্যটন এসব খাতে শ্রীলংকার সাফল্য ছিল ঈর্ষণীয়। কিন্তু হঠাৎ কী এমন ঘটল যে, ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করা দেশটি এখন অস্তিত্বের সংকটে। বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকট এবং ঋণের ভারে জর্জরিত দেশটি এমন অবস্থায় ঠেকেছে যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারছে না। জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। কাগজের অভাবে স্কুল পর্যায়ের পরীক্ষা বাতিল করেছে কর্তৃপক্ষ। জ্বালানি তেলের তীব্র সংকট। তেল সংগ্রহের জন্য হাজারো মানুষ লাইনে ভিড় করছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পেট্রোল পাম্পগুলোতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে। এক ইরানের কাছেই জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ আড়াইশ মিলিয়ন ডলার বকেয়া। অথচ ২০০৬ সালে গৃহযুদ্ধ সমাপ্তির পরে শ্রীলংকার মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ২০১২ সাল পর্যন্ত ঠিকই ছিল। সে সময় মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৩৬ ডলার থেকে বেড়ে হয় ৩ হাজার ৮১৯ ডলার, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। দেশটি ২০১৯ সালে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশেও পরিণত হয়েছিল। কিন্তু কোনো অর্জনই ধরে রাখতে পারেনি। প্রবৃদ্ধি কমতে থাকলে পরের বছরেই বিশ্বব্যাংক তাদের নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে নামিয়ে দেয়। এরপর রপ্তানি কমে চলতি আয়ে দেখা দেয় বড় ভারসাম্যহীনতা। কিন্তু বড় ধস নেমেছে মূলত গত দুই বছরে, করোনা অতিমারির সময়ে। সবশেষে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আরও বিপদে পড়ে তারা।

আই এম এফ এর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর শ্রীলংকাকে ৫০০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। অথচ হাতে আছে ২৩১ কোটি ডলার। সুতরাং ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা, নতুন করে আরও ঋণ নিতে হচ্ছে। যতই বলা হোক, চীনের ঋণের ফাঁদে বন্দি শ্রীলংকা। কিন্তু এর একাধিক কারণ রয়েছে। মূলত অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প, লাগামহীন বৈদেশিক ঋণ, ঋণ পরিশোধে বেহাল অবস্থা, কর কমানো, পর্যটন ও রেমিট্যান্স খাতের বিপর্যয়, অর্গানিক চাষে বিপর্যয় এবং সংকট সামাল দেওয়ার ব্যার্থতাই বর্তমান মহাবিপর্যের প্রধান কারণ। এ প্রসঙ্গে কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক শ্রিমাল আবিরত্নে বলেন, “কিছু বড় বড় প্রকল্প শ্রীলংকার জন্য ‘শ্বেতহস্তীতে’ রূপান্তরিত হয়েছে।”

এবার বাংলাদেশের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। যদিও আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, শ্রীলংকার সাথে বাংলাদেশের তুলনা করার কোনো সুযোগ নেই। তবে আমি এও মনে করি, সাবধানের কোনো মার নেই।

ঋণ পরিশোধের দায়ের দিক থেকে বাংলাদেশ বর্তমানে বিপজ্জনক অবস্থানে নেই। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ঋণের হার এখন জিডিপির ৩৮ শতাংশ। যার মধ্যে বিদেশি ঋণের হার ১৩ শতাংশ। সুতরাং আপাতত চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। কেননা, আইএমএফের হিসাবে এই হার ৫৫ শতাংশের বেশি হলেই বিপদ। তবুও শ্রীলঙ্কার উদাহরণ টেনে বাংলাদেশকে সতর্ক হতে হবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর কারণ- যেসব বড় প্রকল্পের সংখ্যা বাড়ছে, তার প্রায় সব ক’টিই অবকাঠামো প্রকল্প। এই খাতের ঋণের মধ্যে সরবরাহ ঋণও আছে। যার সুদহার বেশি এবং ঋণ সরবরাহকারীরাই প্রকল্প তৈরি করে দিচ্ছে। এসব প্রকল্পের কাজ সময়মতো শেষ না হলে ব্যয় আরও বাড়বে।

তাছাড়া বড় প্রকল্পের কারণে ঋণ পরিশোধের দায় বাড়ছে দ্রুতগতিতে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্র বলছে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে যেখানে পরিশোধ করতে হয়েছিল ৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯১ কোটি ডলার। ফলে বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। এদিকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে গেলে কম সুদে আর ঋণ পাবে না বাংলাদেশ। মিলবে না বাণিজ্যে বিশেষ অগ্রাধিকার সুবিধা।
এসব কারণে অর্থনীতিতে ক্রমাগত চাপ বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, দেশে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৫৬২ কোটি ডলার। অন্যদিকে এই অর্থবছরে প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধিও ঋণাত্মক। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। আমদানি ব্যয় আরও বাড়লে রিজার্ভে টানও বাড়বে। সুতরাং আগে থেকেই সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই।
————————–

গল্পের রুপালি রুপান্তর

হাঁটতে হাঁটতে যখন উড়তে থাকি তখন ভাবি
এ আর এমন কী? মশা ওড়ে, মাছি ওড়ে…..
পাখি ওড়ে, তেলাপোকা ওড়ে.. ওড়ে আরও
এমনি কতো কিছু.. ভুলে-বেভুলে যে নেয় কিংবা
যারা নেয় তিব্বতের রুপালি গল্পের পিছু..!!

আসলে জীবন কেবল দু’আঁটি পাটের বোঝা
সরল অংক কেবল নামেই, নয় এতো সোজা!
তবুও ডেকে আনি ঢেকুর বেদনা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে
অন্তর, আমি জানি আজ হোক, কাল হোক
একদিন ঘটবেই গল্পের রুপালি রুপান্তর..!

তবুও…
সারাদিন কতোকিছু আঞ্জাম দিই বাড়ি, গাড়ি,
নারী; আচ্ছা, যে পথে হেঁটে যাই.সেপথ কি চিনে
আমায়? নাকি সবকিছু কেবল লজ্জাবতীর লজ্জা..
আশা, ভয় ও শংকার আলো-আঁধারী ফুলশয্যা!!

তথাপি থেমে নেই মধ্যরাতের উড়নচণ্ডী ভুল
হাঁটতে হাঁটতে ওড়তে ওড়তে ফিরে ফিরে আসে
মৃতনদীর দুকূল; অথচ আজকাল আর
কেউই বুঝে না, বুঝতে চায় না..লাটাইবিহীন ঘুড়ির
পাস্তুরিত ভুল..বুঝতে চায় না নদীর ভাঙা দু’কুল!!

আমাদের বৈশাখ

ddytu

বছর ঘুরে দুয়ারে এলো
আমাদেরই বৈশাখ
সেই খুশিতে সবাই নাচে
লতা-পাতা, পুঁইশাক।

গাছে গাছে পাখি ডাকে
গায় বাঙালির গান
এই বোশেখে কৃষক ভায়ে
তুলবে নতুন ধান।

নগর, শহর, পাড়া সবার
বাহারি রঙের সাজ
ছেলেবুড়ো ছুটছে মেলায়
নেই যে কোন লাজ।

খোকাখুকি সবার চোখে
স্বপ্ন যে ভাই আঁকা
মেলায় মেলায় ঘুরছে দেখ
সোনার বাংলার চাকা।

এসেছে ঐ বৈশাখ

20482

গাছের পাতায় কানাকানি
এসেছে ঐ বৈশাখ
কাঁপছে ডরে ধানের ডগা
কাঁপছে যে পুঁইশাক।

টোনাটুনির রাত কাটে না
একটি বাসা মোটে
কখন জানি পাগলা হাওয়া
হাতির মতোন ছুটে।

তালের ডালে বাবুই পাখির
ঝুলছে দেখো বাসা
কালবৈশাখীর একটা চড়ে
ভাঙতে পারে আশা।

সারা বছর আশায় কৃষক
ধানে ভরবে গোলা
সেই ধানেতে স্বপ্ন অঢেল
বাঁঁচবে মাইয়া পোলা।

তাইতো বলি বোশেখ তুমি
আর হয়ো না টাল
খোকা খুকি সবাই তোমায়
ডাকবে যে মাতাল!!

সখিনার স্বপ্ন

27776

০১
সখিনা তাড়াতাড়ি হাত চালায়। এখনও অনেক কাজ বাকি। পাশের বাড়ির মজা পুকুরে একবার যেতেই হবে। ওখানে কলমি শাক পাওয়া যায়। কারো চাষ করা নয় । একদম নিরেট প্রাকৃতিক। ভেজালের যুগে এই ঢের! কলমি শাক কদম আলীর খুব পছন্দ। যেদিন কলমি রান্না হয় ; সেদিন কদম আলী এমন ভাবে খায় যে , এর চেয়ে মজার খাবার আর ত্রিভুবনে নেই। সখিনা ঘোমটার আড়ালে মুখ টিপে টিপে হাসে। আর মনে মনে বলে – বড় লোকেরা কোর্মা পোলাও ও এত মজা করে খায় না। বিয়ের আগে সখিনা ময়মনসিংহ শহরে এক স্যারের বাসায় কাজ করত। স্যারের ছোট ছেলেটি সে কি দুষ্টু ! যাকে বলে কলি কালের পোলা।

এই কদম আলী লোকটা সখিনার স্বামী। বিয়ে হয়েছে দু বছর। তখন সখিনার বয়স আঠার। কদম আলীর আটাশ। এই দু বছরে তাদের কোন সন্তান হয়নি। অবশ্য হয়নি বললে কিছুটা ভুল হবে ; কারণ সখিনা সন্তান নেয়নি। ঝামেলা ঝামেলা লাগে। সে লুকিয়ে লুকিয়ে পরিকল্পনা আপার কাছ থেকে সুখী পিল সংগ্রহ করে নিয়মিত খায়। কদম আলী বিষয়টি বুঝতে পারে না। কদম আলীর সন্তানের প্রতি খুব আগ্রহ। কিন্তু সখিনা কোন ভুল করতে রাজি নয়। সে আধা শহুরে মেয়ে। তাছাড়া কিছুটা শিক্ষিত। গ্রামের স্কুলে চতুর্থ শ্রেণী পাশ দিয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে উঠে ছিল। বাবার অভাবের সংসার। তা না হলে রাহেলার মত সেও এখন কলেজে পড়ত!

সখিনার বিয়ের দিন তুমুল বৃষ্টি। সারা বাড়িতে কাদা। তবু বিয়ের আনন্দ থেমে থাকেনি। পাড়ার মেয়েরা দল বেঁধে গীত গেয়ে , হাসি তামাশা করে পুরো বাড়ি মাতিয়ে তুলে। মাঝ রাতে কদম আলীর সাথে সখিনার বিয়ে পরানো হয়। ১০ হাজার টাকা দেন মোহর। নাকের ফুল, কানের দুল আরও ইত্যাদি ইত্যাদি মিলে পাঁচ হাজার টাকা উসুল। মা-বাবা , ভাই, বোনকে কাঁদিয়ে সখিনা শ্বশুর বাড়ি যায় সেদিন শেষ রাতে। তখনও বৃষ্টি পুরোপুরি থামেনি।

বাসর ঘর। এক পাশে মাটির পিদিম। সখিনা প্রায় ২৪ ঘণ্টার অভুক্ত। ঘরের এখানে সেখানে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। সখিনার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সারা দেহ, মনে ভয় ও আনন্দের অভূতপূর্ব মিলন মেলা। লুঙ্গি পড়া কদম আলী বাসর ঘরে প্রবেশ করে। গায়ে কোন জামা নেই। সখিনা আড় নয়নে স্বামীর দিকে তাকায়। প্রায় অন্ধকারে কদম আলীর কালো শরীর আরও কালো লাগে। সখিনা জড়সড়। মাটির দিকে মুখ। মাথায় বার হাত লম্বা ঘোমটা! কদম আলী সখিনার দু হাত ধরে। ঘোমটা সরিয়ে দেয়।

সখিনা একটু পেছনে যায়। কদম আলী একটু এগিয়ে আসে। বলে, এই ভয় পাছ নাকি? আমি তো তোর স্বামী । নিজের স্বামীকে আবার ভয় কিসের? এই বলে কদম আলী আরও নিবিড় হবার চেষ্টা করে। সখিনা কথা বলে না । কদম আলী ফুঁ দিয়ে বাতি নিবিয়ে দেয়। আবার ডাকে আদুরে গলায় , এই সখিনা! এই সখি!
এই বার সখিনা চুপ থাকতে পারে না। মুরুব্বিদের মুখে শুনেছে, আল্লার পরে নাকি স্বামীর স্থান। আধো আধো গলায় বলে , কি বলেন?
কদম আলী হা হা হা করে হেসে উঠে। বলে, এই তো আমার সখির মুখে কথা ফুটছে। আবার বলে, একখান কথা কইতাম সখি?
সখিনা বলল, কী?
আমারে মোহরানার টাকাটা মাফ কইরা দে।
সখিনা আমতা আমতা করে বলে, মাফ করতে পারি ; তবে আমারও একটা শর্ত আছে।
কি শর্ত? এই বলে কদম আলী সখিনার আরও কাছে আসে।
সখিনা বাঁধা দেয় না। স্বামীকে বাঁধা দেওয়ার চেয়ে বড় পাপ আর নেই। বলে, শর্তটি হল–আমারে সারা জীবন ভাল বাসন লাগব আর —- এইটুকু বলে সখিনা থেমে যায়।
কদম আলী ব্যাকুল চিত্তে বলে , আর কী?
সখিনা কথা বলে না । মনে মনে ভয় পায়। পাছে স্বামী মাইন্ড করে । তাকে স্বার্থপর , লোভী ভাবে।
কদম আলী ব্যাপারটি বুঝতে পারে । বলে, আল্লা তোরে আর আমারে জোড়া মিলাইছে। আমি কথা দিতাছি , তোরে সারা জীবন ভালা বাসবাম। আর কী সেইটা তাড়াতাড়ি কইয়া ফালা। ডরের কিছু নাই।
এইবার সখিনার মন থেকে ভয়ের কালো মেঘ সরে যায়। স্বামীর বুকে মুখ রাখে। বলে , আমারে একটা জামদানি শাড়ী দেওন লাগব। আমার বহুদিনের স্বপ্ন। ময়মনসিংহ থাকতে স্যারের বউকে দেখতাম পড়ত। আহা কি সুন্দর শাড়ি ! স্যারের বউ আমারে সব সময় বলত , সখি, জামদানি শাড়ী পরলে তোমাকে পরীর মত লাগবে। আমি তোমার জন্য একদিন পরী সাজবার চাই। এক নিঃশ্বাসে এত গুলো কথা বলে সখিনা স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে।

কদম আলী একটু হতচকিত হয়। সে জীবনে জামদানী শাড়ীর নাম শুনেনি। কত দাম , কোথায় পাওয়া যায় কিছুই জানে না। একটা গাভীর দুধ ও করগাঁও বাজারে সবজি বিক্রি করে কদম আলীদের সংসার কোন মতে খেয়ে না খেয়ে চলে যায়। ঘরে বৃদ্ধ মা বাবা। ছোট ছোট কয়েকটি ভাই বোন। বড় তিন ভাই বউদের পরামর্শে আলাদা খায়। বলা যায়, সমস্ত সংসারের জোয়াল কদম আলীর কাঁধে। তবু আজকের এই মধুরাতে কদম আলী বউয়ের মন পূর্ণিমার আলোর মত রাঙিয়ে দিতে চায়। বলে, অবশ্যই দিবাম। কি খুশী ত?
সখিনা স্বামীর গলা আরও শক্ত করে ধরে রাখে। বলে, খুব খুশী খুব খুশী! খুব খুশি।
কদম আলী বলে, আমারও একটা কথা আছে।
কী কথা?
আমারে কিন্তু আপনে কইরা কইতে পারবি না। পর পর লাগে।
সখিনা হাসতে হাসতে বলে, না, আমি পারুম না। আমার শরম লাগে।
কদম আলী আরও জোরে সখিনাকে বুকে টেনে নেয়। বলে, আয় তোর শরমটা একটু ভাঙাইয়া দেই।

০২
আজ বাদে কাল ঈদ। ঈদুল ফিতর। এইবারের ঈদ সখিনার জন্য অন্যরকম। আজ কদম বাজার থেকে ফিরলেই দুজনে মিলে ভাঙবে মাটির ব্যাংক। গত দু বছরে জমানো টাকা গুনবে। অতঃপর কদম যাবে শহরে। কিনে আনবে সখিনার স্বপ্নের জামদানি। এখনও কদম আসছে না কেন? সখিনা যত্ন করে ভাত বাড়ে। হাতে নেয় তাল পাতার পাখা । কয়েক দিন যাবত বেজায় গরম । সখিনার শরীরে ঘামাচি। একবার ভেবেছিল কদমকে বলবে একটি ট্যালকম পাউডার কিনার জন্য । পরক্ষণেই মনকে বুঝিয়েছে – তাহলে শাড়ী কিনার টাকা যদি কম পড়ে!

এই সখি, এই সখি, তাড়াতাড়ি ভাত দে – এই বলে কদম আলী ঘরে ঢুকে। সখিনা বলে, অনেক দেরী কইরা ফেললা। শহরে যাইবা না?
যামুরে পাগলী যামু। অনেক আগেই আইতে চাইছিলাম। কিন্তু আইজ অনেক কাস্টমার। মেলা বিক্রি অইছে।
সখিনা খিল খিল করে হাসে। বলে, আমার শাড়ীর জন্যই কিন্ত আল্লা রহমত করতাছে। কদম আলীও হাসে । সে হাসিতে আনন্দ যেমন আছে ; তেমনি আছে গোটা সংসারের কষ্টের মানচিত্র!
দুজনে মিলে ব্যাংক ভাঙল। খুব মজা করে টাকা গুনল। কদম আলীর মনে হল, পৃথিবীতে টাকা গুণার চেয়ে আনন্দের আর কিছুই নেই। সর্বমোট এক হাজার সাতশ একুশ টাকা। কে জানে এই টাকায় শাড়ী পাওয়া যাবে কি না! কদম আলীর বুকটা দুরু দুরু করে। কিন্ত সখিনারে বুঝতে দেয় না। বলে, সখি আমি তাইলে শাড়ী কিনতে যাই । সখিনার চোখে মুখে বিশ্ব জয়ের আনন্দ!

আমারে নিবা না —– এই কথা বলে সখি অন্যদিকে মুখ ফিরায়। আকাশের এক কোণে ঘন কালো মেঘ। অনেক গুলো চিল উড়ছে। ঝড়ের আগমনী বার্তা। সখিনার বিয়ের দিনের কথা মনে পড়ে।
কদম আলী মুচকি হেসে বলে, তর যাওনের কাম নাই । আব্বা রাগ করব । মেয়ে মানুষ শহরের বাজারে পুরুষ মানুষের সাথে চলব এইডা আমারও ভালা লাগে না ।
সখিনা আর কথা বাড়ায় না। শুধু বলে, সুন্দর দেইখা কিনবা কিন্তু।
কদম আলী সখিনার কপালে আলতো করে একটি চুমো খায়। সখিনা দেখে কদমের চোখে জল। বুঝতে পারে এই কান্না কষ্টের নয় ; ভালবাসার। গর্বে সখিনার বুক ভরে যায়। আর কদম আলী জোড় কদমে শহরের দিকে পা বাড়ায়।

০৩
কদম আলী পিকাপে উঠে। বসার সিট নাই। দাঁড়িয়েও থাকা যায় না। পিকাপের ছাদে মাথা লেগে যায়। গন্তব্য কিশোরগঞ্জ শহর। গৌরাঙ্গ বাজার। ড্রাইভার যথেষ্ট জোরে চালাচ্ছে । কিন্তু কদম আলীর তর সইছে না। ক্ষণে ক্ষণে ভেসে উঠছে সখিনার মায়াবী মুখ। সেই মুখ যেন কদম আলীরে জাদু করেছে। রাস্তার দু পাশে গাছের সারি। বর্ষার পানি কিছুটা নামতে শুরু করেছে। আকাশের সেই কালো মেঘ এখন আর নেই। কদম আলীর মনে প্রশান্তির ঢেউ। ইতিমধ্যে গাড়ী কিশোরগঞ্জ রেল স্টেশনের পেছনে এসে থামল। কদম আলী সবার আগে নেমে পড়ল।

এই দোস, এই দোস ডাক শুনে কদম আলী পেছনে ফিরে থাকায়। একজন লোক। জীর্ণ-শীর্ণ, রোগা, পাতলা। শরীরের তুলনায় পেট অনেক বড়। হলুদ, কোটরাগত চোখ । মাথার বেশির ভাগই টাক। লাঠি ভর দিয়েও ভাল ভাবে হাঁটতে পারছে না। মনে হয় প্রতিবন্ধী । কদম আলী লোকটার দিকে এগিয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে, আমারে কিছু কইছেন?

লোকটি যেন আকাশ থেকে পড়ে। বলে, আমারে চিনতে পারলা না দোস! আমি মরম আলী। ছোট কালে তুমার বাপে আর আমার বাপে আমরারে দোস্তি পাতাইছিল। অবশ্যি না চিনার অই কথা। সেই আমি আর এই আমি এক না। আকাশ পাতাল ফারাক।

কদম আলীর মাথা ঝিম ঝিম করে। পায়ের তলায় মাটি আছে কি না বুঝতে পারে না।
হা ডু ডু খেলায় মরম আলী ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। গায়ে সিংহের মত শক্তি। কেউ তাকে আটকাতে পারত না। একি হাল হয়েছে তার ! কদম আলীর বিশ্বাস করতে মন চাইছে না।
কদম আলী, মরম আলীকে জড়িয়ে ধরে। দু জনেরই চোখের জল বাঁধ মানে না। দু বন্ধু মিলে রেল স্টেশনের উত্তর পাশের বড় বট গাছটার নিচে বসে। কদম আলী জিজ্ঞেস করে, দোস এই অবস্থা কেমনে অইল? আমারে একবার খবর দিলা না কেন?

মরম আলী কথা বলে না। চোখের পানি সব প্রশ্নের জবাব দেয় । অবশেষে চোখের জল বুঝি ফুরিয়ে আসে ! মরম আলীর মনের ঝড় কিছুটা থামে। বট গাছে বসা একটি পাখি কদম আলীর হাতে হাগু করে দেয়। মরম আলী পাখিটাকে বিশ্রি একটা গালি দেয়।

কদম আলী আবার জিজ্ঞেস করে, দোস এই শরীল নিয়া শহরে আইছ ক্যান?
মরম আলী ভাবলেশহীন ; অথচ দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দেয়, – তিনডা কাম ঠিক করছি দোস।
কোন তিনডা?
ভিক্ষা করবাম। চুরি করবাম। এই দুইডাতে কাম না অইলে রেল গাড়ীর নিচে ঝাঁপ দিবাম।
কদম আলীর মাথা ঘুরে যায় । বলে, দোস, একটা কামও ভালা না।
এ ছাড়া আমার যে আর কিছু করার নাই । আল্লা আমারে মরণ দেয় না ক্যান?
এই কথা কইতে নাই দোস । আল্লা নারাজ অইব। আসল ঘটনাডা একটু খোলাসা কইরা কও।

মরম আলী একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। আর তার অন্তরের কষ্ট গুলো বাতাস ভেদ করে কদম আলীর হৃদয়ে এসে ক্ষেপা সাগরের ঢেউয়ের মত আঁচড়ে পড়ে। অতঃপর মরম আলী বলা শুরু করে — দোস,
অনেক সুন্দর মেয়ে দেইখ্যা বাপ মা বিয়া দিছিল। দুই বছরে দুইডা পোলা অইল। সারাদিন কাম করি। সন্ধ্যার সময় অইলে ঘরে আই। বউয়ের সাথে, পোলা পানের সাথে সোহাগ করি। ভালা সুখেই দিন যাইতাছিল। এরপর আমি কডিন অসুখে পড়লাম। ডাকতর বলল, ঠিক মত অসুধ খাইতে না পারলে বাঁচার আশা নাই। বউ–পোলা পানরে খাওন দিতে পারি না। কাপড় দিতে পারি না। শেষতক ভিটে মাটি বেইচা দিলাম। অহন থাহনের কোন জায়গা নাই। বউরে মিয়া বাড়িতে কামে পাডাইলাম। হে অইখানে আর যাবার চায় না। মিয়া সাব নাকি শরীর ধরতে চায়। ওর দিকে তাকানো যায় না। একটা ছিঁড়া কাপড়। বদলাইয়া গোসল দিবার পারে না । দিন রাইত আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে । শুধু চইল্যা যাইতে চায়। ফাঁস দিয়া মরবার কথা কয় । এই ঈদে —–।

কদম আলী আর শুনতে পারে না। চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ে । সখিনার কথা ভুলে যায়। ভুলে যায় সখিনার স্বপ্নের কথা। আস্তে আস্তে হাত ঢুকিয়ে দেয় পকেটে। বের করে আনে এক হাজার সাতশ একুশ টাকা। গুঁজে দেয় বাল্যকালের দোস মরম আলীর হাতে। মরম নিতে চায় না। কদম আলীর দু হাত ধরে কাঁদতে থাকে।


সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। কিছুক্ষণ পরই গ্রাস করবে অন্ধকার। কদম আলীর মনে আলো আর আঁধারের সমান খেলা। এক চোখে বিজয়ের হাসি। বন্ধুর জন্য কিছু করতে পারার আনন্দ। অন্য চোখে জল। কোনটির দাম বেশি কদম আলী বুঝতে পারে না। তার শুধু মনে হয়, মানুষের জীবনে কেন এমন হয়? বিধাতা তো ইচ্ছে করলেই সবাইকে সুখী করতে পারে।

কদম আলী বাড়ির কাছে এসে পড়েছে। বাড়ির সামনের আম গাছটার নিচে সখিনা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সখিনাকে দেখে আজ তার পা কাঁপছে কেন? পা আর সামনে চলতে চাইছে না কেন? কদম আলীর অজান্তেই হাত দুটো তার পেছনে চলে যায়। সখিনা হয়ত এই হাতের দিকেই তাকিয়ে আছে।
——————————————–

খতিয়ান পৃষ্ঠার কথা

আজ সবকিছু ঝিম মেরে আছে…
উড়ন্ত পাখির ঝাঁক, হালদা নদীর বাঁক, ঘরের চালের উপর কা কা করা দাঁড়কাক!

তবুও আমি চেয়েছিলাম ভুত অথবা অদ্ভুত.. সকল
ঝিম ধরা ভাব ভেঙেচুরে যাক, গ্রন্থিত হোক কালের কেয়া; দুঃখগুলো ভাগাভাগি হোক.. হোক দেয়া-নেয়া!

প্রকৃত ভগ্নাংশ হোক, অপ্রাকৃত হোক অথবা মিশ্রই
হোক..আমি চাই কবিতার মতো সবকিছু লাবণ্যময় হোক! দিনশেষে হেসে উঠুক নিষ্ফলা নিবিড় জীবন
ডোরাকাটা পাহাড়ের চূড়ায় বসে দিগ্বিদিক জ্বলুক জ্বলতে থাকুক.. সুখের উল্লম্ফন!

তবুও হ-য-ব-র-ল খতিয়ান পৃষ্ঠার কথা ভাবতে হয়
ভাবতে ভাত আর কাত; যার হাতে আমার চাবি, সে ছাড়া আর কারো কাছে নেই কিঞ্চিৎ দাবি..!!

একজন কবির ফেরা

যে কবি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন চৈত্রচিতে
আজ তিনি অকস্মাৎ ফিরে এলেন
ফিরে এলো অপ্রকাশিত কিছু কবিতা
হেলেন দ্বীপের কিছু নির্জন শ্রাবণ সন্ধ্যা
কামদার দেবী আফ্রোদিতি আর
মুক্তগদ্যে লেখা বেশ কয়েকটি ভাঁজপত্র!!

যে আকাশ কাঁচপাত্রের মতো কবির মাথার
উপর একদিন ভেঙে পড়েছিলো
সেই আকাশ এখন ভাত ছিটালে কাকের
অভাব হয় না নামিয় পদ্যের জায়গীরদার!!

অতঃপর মহাঘটা করে ভাঁজপত্রটি খোলা হলো
সেই অকবির একক কবিতা সন্ধ্যা
শিরোনামে লেখা ছিলো “কাক ও কবি”
যেই কবি ফিরে এসেছিলেন চৈত্রচিতে
সেই কবি আবার খুঁজছেন ফিরে যাওয়ার
উছিলা… তাঁর জন্য অপেক্ষা করে আছে
শিরোনামহীন কোনো এক নির্জন দ্বীপ সন্ধ্যা!!

শরীর বেঁয়ে হাঁটে পুণ্যের ঘাম

হেমন্তের উড়ন্ত সূচনায় ওড়ে অভিসারী মন
বউ বাজারের চড়া দামে তা টিকে না বেশিক্ষণ!
স্বরলিপির সমস্ত জমিন জুড়ে অংকিত সোনা
এভাবেই হউক রোপা আমনের শৈল্পিক বোনা!
কিষাণীর একহারা শরীর বেঁয়ে হাঁটে পুণ্যের ঘাম
কাগজের টাকায় কতোটা শোধ হবে তার দাম!
তবুও তোমাদের বিত্ত আর চিত্তের ফানুস ওড়ে
সৌখিন শালের আশ্রয়ে গড়ায়, ওরা ওঠে ভোরে।
কৃষকের সমস্ত বুকের জমিনে রাশি রাশি সামান
আইনের নাম করে সেই বক্ষপুটে দাগাও কামান!
যারা গোড়ায় জল ঢালে তুমি খাও সোনার ফল
ভেবে দেখ চাষিহীন দেশে তুমি কোথা পাবে বল!

প্রিয় স্বাধীনতা

স্বাধীনতা.. প্রিয় স্বাধীনতা একের পর এক অধরা
বাতিক কোন নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে তোমাকে?
আটলান্টিকের গভীরে দেদীপ্যমান কোন চূড়া নাকি
এভারেস্ট? সাগর সঙ্গম অথবা জল জঙ্গমে কেনো
এঁকে চলেছো অতি বিশেষায়িত স্বপ্ন বিলাস!

অথচ মনের কিনারের কোনো একধারে বিনে পয়সায়
সহজেই খুঁজে নিতে পারতে দ্বিতীয় জন্মের ঠিকানা!
জানি কুয়াশার ভেতর
শিশু ঘাসফুলের আদর
নরম রোদের ছায়ায়
কিশোর তমালের সুনিবিড় মায়ায়!

দেখো, এখনও বাতাসে ভেসে বেড়ায় মায়ের আকুতি
এখনও বেহায়া ইচ্ছেরা তোমায় জানায় মিনতি!
অথচ তুমি কিছু বুঝলে না, কিসের আঁশে মাতাল বেশে
কাঁটা লতার ঝোপে তোমার নিরন্তর একি ছুটে চলা!
কলমি, জুঁই আর আলোর কথা মনে পড়ে তোমার?
ওরা এখনও সেই আগের মতোই পথ চেয়ে আছে
অথচ তুমি আর তোমার আজানুলম্বিত ইচ্ছে ঘুড়ির
ঠিকানা তাদের আজও অজানা ——অজানা….!!

স্বাধীনতার সুখ

27735

কোন সুখে বাবুই পাখি
করে শিল্পের বড়াই
যেই সুখেতে মুক্তিযোদ্ধা
করেছিলেন লড়াই।

কোন সুখে একটি শিশু
পতাকার ছবি আঁকে
যেই সুখেতে একটি শিশু
মা…মা বলে ডাকে।

কোন সুখেতে মাঝি ভাই
ধরে নৌকার হাল
যেই সুখেতে বয়ে চলেছে
বাংলার নদী খাল।

কোন সুখেতে বৃষ্টি ঝরে
মায়ে ফুলায় বুক
যেই সুখেতে চাষি ভাই
সব ভুলে যায় দুখ।

কোন সুখে দামাল ছেলে
আকাশে ওড়ায় ঘুড়ি
যেই সুখেতে দাদা-দাদু
খুলে গল্পের ঝুঁড়ি।।

প্রকৃত স্বাধীনতার সুঘ্রাণ আর কতদূর …

2762

কবি বলেছেন, “স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়?” একেবারেই যথার্থ উক্তি। মানুষ তো বটেই, পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ… এমন কি ক্ষেত্র বিশেষে প্রায় সকল প্রাণি-ই স্বাধীনতা প্রিয়। পরাধীন মানুষ আর খাঁচায় বন্দি সিংহের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। আর এই স্বাধীনতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা৷ একটি দেশের ভৌগলিক অখণ্ডতা। সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি। বিশ্বের মানচিত্রে আলদা জাতিসত্ত্বা হিসাবে মানচিত্রের উপস্থিতি এবং সগৌরবে উড্ডীন জাতীয় পতাকা। অত্যন্ত গৌরব এবং অহংকারের জায়গাটি হল, আমাদের এসব কিছুই আছে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সর্বাত্মক সংগ্রামের ইতিহাস আছে। সেজন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা কোনোদিন শেষ হবে না।

তবুও মনের ভেতরে খচখচ করে। ইতোমধ্যে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত এবং সঠিক ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে পারিনি। আফসোস হয়, যখন দেখি এখনো সভা, সেমিনারে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লাগামহীনভাবে প্রচার করা হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের মতো এমন একটি সার্বজনীন বিষয়েও আমরা দলীয় সংকীর্ণতা বিসর্জন দিতে পারিনি। প্রতিটি দলের আদর্শগত মত-পার্থক্য থাকবেই। এটি অস্বীকার করছি না। তাই বলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে পক্ষপাতদুষ্ট অভিমত থাকবে? রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের প্রপাগান্ডা থাকবে? ইতিহাসের বিকৃতি থাকবে? সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যদি আমরা এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিই.. তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দাঁড়ায়, নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস কীভাবে শিখবে, কার নিকট থেকে শিখবে?

শুধু এখানেই শেষ নয়। পরিতাপের সহিত বলতে হয়, এখনো আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাংগ তালিকা করতে পারিনি। পঞ্চাশ বছর পরেও এই তালিকায় সংযোজন- বিয়োজন হচ্ছে। কাটা ছেঁড়া হচ্ছে। কেউ বাদ যাচ্ছেন আর কেউ নতুন করে তালিকায় ঢুকছেন। ভাবতেই ভীষণ অবাক লাগে, এতো বছর পরেও একটি পূর্ণাংগ তালিকা করতে না পারার দায় আমরা কেউ নিই না। একজন আরেকজনের উপর চাপিয়ে দিই। একদল অন্য দলের উপর চাপিয়ে দেয়। অথচ আমার জানা মতে, বিশ্বের কোন দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে এহেন হ-য-ব-র-ল নেই। আমি মনে করি, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করার হীন উদ্দেশ্যেই এই অবস্থার তৈরি হয়েছে। যা বহির্বিশ্বে দেশের গৌরব এবং সম্মান বিনষ্ট করছে। আমরা দ্রুত এই অবস্থার অবসান চাই। দলমত নির্বিশেষে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা চাই। জাতির সূর্য সন্তান প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের যথার্থ মূল্যায়ন চাই। আমরা চাই, ভাষা আন্দোলনের যেমন সর্বজন গ্রহণযোগ্য ইতিহাস আছে, ভাষা শহীদদের তালিকা আছে; মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাও তেমনি হোক। যা নিয়ে কোনো বির্তকের অবকাশ থাকবে না। আর এটি করতে পারলে আমি বিশ্বাস করি, নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকবে না। সত্যিকার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েই তারা তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করবে। বিশ্বের বুকে আমাদের প্রানপ্রিয় বাংলাদেশকে উপস্থাপন করবে।

আমরা ভৌগলিক স্বাধীনতা পেয়েছি। মানচিত্র, পতাকা, জাতীয় সংগীত পেয়েছি। তবুও আমাকে শিরোনাম লিখতে হয়েছে, প্রকৃত স্বাধীনতার সুঘ্রাণ আর কতদূর.! কিন্তু কেন? এর কারণ হল, স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা এখনও প্রকৃত স্বাধীনতার সুঘ্রাণ পুরোপুরি পাইনি। এখনও দেশের মানুষের আয়-বৈষম্য চরম পর্যায়ে। ধনী আরও ধনী হচ্ছে। দরিদ্র আরও দরিদ্র হচ্ছে। এখনও অধিকাংশ মানুষ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এখনও আমরা সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ পারিনি। পারিনি সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, মাদক, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, রাহাজানি, লাল ফিতার দৌরাত্ম্য, চোরাচালান, মানব পাচার, হত্যা, ধর্ষণ, গুম, মানি লন্ডারিংয়ের মূলোৎপাটন করতে। পারিনি প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করতে। পারিনি ভারী শিল্পের বিকাশ ঘটাতে। পারিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের কাঙ্খিত প্রসার ঘটাতে। দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরলেও পরিবেশ, প্রতিবেশ, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা এবং মানব উন্নয়ন সূচক এখনও উচ্চ ঝুঁকিতে। এসব ক্ষেত্রে উন্নয়নসহ সার্বিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু কাগজে কলমে নয়, প্রকৃত অর্থে আইনের শাসন অত্যন্ত জরুরি৷

তবেই আমাদের গ্রিলকাটা চোরের ভয়ে কুঁকড়ে মুকরে রাত্রি যাপন করতে হবে না৷ দরজা-জানালা খোলা থাকলেও যেদিন বুক ফুলিয়ে ঘুমাতে পারব, সরকারি অফিসে ফাইল জমা দিলে কোনো প্রকার তদবিরের প্রয়োজন হবে না — সেদিনই আমরা প্রকৃত স্বাধীনতার সুঘ্রাণ আস্বাদন করতে পারব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে, দেশের অর্থনীতির চাকা বর্তমানে যে গতিতে ঘুরছে, সেই গতি অব্যাহত থাকলে আমাদের সবার কাঙ্খিত সেইদিন হয়ত খুব বেশি দূরেও নয়।

একটি ভাষণ শোনো

খোকাখুকি তোমরা সবাই
একটি ভাষণ শোনো
এই ভাষণের মতো ভাষণ
আর যে নাই কোনো।

সেই ভাষণের শব্দে শব্দে
হাজার স্বপন বোনা
সেই ভাষণের বাক্যে বাক্যে
লুকিয়ে আছে সোনা।

যেই ভাষণে দেশের সবাই
কৃষক, কুলি, মুজুর
পায় ফিরে পায় সাহস বুকে
ভয় করেনি জুজুর।

যে যার মতোন অস্ত্র হাতে
পাক হানাদার রুখে
সেই ভাষণের মন্ত্রে এখন
আমরা সবাই সুখে।।

বসন্ত এসেছিলো, তবে

আজ সকালে অফিস পাড়ায় একবার, দুইবার নয়;
তিন তিনবার বসন্ত এসেছিলো! কিছু মানুষের ঘুম
ভাঙলেও প্রকৃতির ঘুম তখনও ভাঙেনি…
আধাভাঙা, আধাগড়া সড়ক আড়ামোড়া ভাঙছে
পাঁতিহাঁসেরা জলের ছোঁয়ায় আকাশে ডানা মেলছে
ভালোবাসার নাম করে একজন আরেকজনের কামড়ে
দিচ্ছে চুলের মুঠি..এমনি এক ভাসন্ত সময়ে..

বসন্তের কোকিলের দানাদার আওয়াজ শুনে চমকে উঠি!
প্রথমে ভেবেছিলাম আমার ডানা ভেঙে যে পাখিটা
একদিন শঙ্খচিল হয়ে উড়ে গিয়েছিলো….
আমার আকাশ ভেঙে অন্য আকাশ খুঁজে নিয়েছিলো
আজ এতো বছর পর আহত ডানা মেরামত করতে
সে-ই বুঝি ফিরে এসেছে; সে-ই বুঝি নীড় চিনে নিয়েছে!

এমনি হাজার আশার কোটি কোটি গুড়েবালি যে
আমাকে সজ্ঞানে কবর দিতে হয়েছে;
আচ্ছা বলো তো দেখি, এসব খোঁড়াখুঁড়ির শেষে….
সেই আমি কি পারবো না…
এই আশাটিরও বাঁধন কেটে দিতে? নাকি আমারও
একদা বসন্তের মতোন হবে লেজ গুটিয়ে নিতে….?

ব স ন্ত বা তা সে

যেভাবে চলছে, সেভাবে মন্দ কী?
আহ্নিকগতি, বার্ষিকগতি…..
পৃথিবীকে কেন্দ্র করে যেমন ঘুরে
কুমারীচাঁদ
সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবীও ঘুরে
কেউ বুঝতে পারে না কারো ফাঁদ!

আমি যেমন ঘুরি তোমার পিছু পিছু
তোমার চকিত চাহনির লোভে করি
কাঁচুমাচু!
আমি ভাবি ইশারার ফুল ফুটুক
তোমার ঠোটে রাঙা রবি উঠুক
হিংসায় মরুক মাঁচুপিচু!!

আমি চাই হরবোলারা সব ভুলে যাক
হিংসুটেরা জ্বলে পুড়ে হউক খাক
তবুও আজি এই বসন্ত বাতাসে.
তোমার-আমার প্রেম মুক্তি পাক.!!

৭ই মার্চের ভাষণ

একটি ভাষণ বজ্রকণ্ঠে
ধ্বনিত হলো আজ
কিশোর, যুবা, বৃদ্ধ সবাই
ছুটলো ফেলে কাজ।

নিমিষেই তা ছড়িয়ে গেল
শহর, বন্দর, গ্রাম
সবার মুখে একটিই রব
শেখ মুজিবের নাম।

একটি কণ্ঠ কোটি কণ্ঠে
হলো যে রুপান্তর
স্বাধীন স্বাধীন বলে সবার
জাগলো রে অন্তর।

সেই ভাষণটা বিশ্বজুড়ে
ফেলে দিলো সাড়া
স্বাধীন নামের শুকপাখিটা
ধরতে পাগলপারা।