লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী এর সকল পোস্ট

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী সম্পর্কে

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। গল্প ও রম্য রচনা আর ছোট গল্প লিখেন। বহু একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। অন্ধকারের অন্তরালে, সমাজের শত্রু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু যাত্রাপালা -সোনা ডাকাত, শ্মশানে জ্বলছে স্বামীর চিতা উল্লেখযোগ্য। কবির অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিচারক মণ্ডলী তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী একাধারে কবি ও অপর দিকে লেখক। তার লেখা “আমার গাঁ আমার মাটি”, আমার প্রিয় শহর জামুরিয়া, আমার প্রিয় শহর কুলটি, আমার প্রিয় শহর আসানসোল, আমার প্রিয় শহর রাণীগঞ্জ বহু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই ধর্মে আলাদা হলেও আমরা সবাই ভাই ভাই।

শরতের আগমনী ……. সোনাঝরা রোদ নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা এসেছে শরৎ (দশম পর্ব)

শরতের আগমনী ……. সোনাঝরা রোদ
নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা
এসেছে শরৎ (দশম পর্ব)

নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা আর কাশফুল দেখলেই আমরা জেনে যাই শরৎ এসে গেছে। কাশফুল বাতাসে দোলে মোহনীয় ভঙ্গিতে। কাশফুলের মাঝখান দিয়ে স্বচ্ছ নীল আকাশ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।

শিউলিও শরতের ফুল। রাতে ফুটে ভোরবেলায় ঝরে যায়। এ জন্য ফুটন্ত শিউলি ফুল দেখার সুযোগ কমই পাওয়া যায়। শেষরাতে শিউলির সুবাস ছড়িয়ে পড়ে বহুদূর পর্যন্ত। শিউলি নিয়ে কবিদেরও মাতামাতির শেষ নেই। শরতের সকালে হালকা শিশিরভেজা সবুজ ঘাসের ওপর ছড়িয়ে থাকা শিউলি ফুল কুড়ানোর মজাই আলাদা।

শরতের আরেক ফুল কামিনী। কামিনী ফুলও সন্ধ্যায় ফুটে ভোরেই ঝরে যায়। ঘন সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে থোকায় থোকায় ফোটে কামিনী। ফুলের গন্ধে চারদিক ভরে ওঠে।

জবা আর টগরও শরতের ফুল। শরতে পুকুর, ডোবা, হাওর, বিল সব জায়গায় ফোটে শাপলা ফুল। এ ছাড়াও জুঁই, কেয়া, মালতি, মল্লিকা, মাধবী, ছাতিম, দোলনচাঁপা, বেলী, জারুল, নয়নতারা, ধুতরা, ঝিঙে, রাধাচূড়া, পদ্ম, স্থলপদ্ম, নানা রকমের ফুলে হেসে ওঠে প্রকৃতি।

শরৎ এলেই মাঠজুড়ে দেখা দেয় নতুন ধানের সমারোহ। নতুন ফসলের আশা জাগে কৃষকের মনে। আর সেই ফসলকে ঘিরে চারদিকে শুরু হয় উৎসবের আমেজ। ফুলের সুবাস আর পাখির কুজনে মুখরিত হয় পল্লীগ্রামের মাঠ-ঘাট-জনপদ।

শরৎ মানেই হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে শুরু হয় অপেক্ষার প্রহর। শারদীয় দুর্গাপূজার শারদীয়া শব্দের আগমনই ঘটেছে শরৎ থেকে। এই শরতেই দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গা কৈলাশ ছেড়ে মর্তে আসেন আর তাই নদীর পাড়ে কাশফুল জাগ্রত হওয়ার সাথে সাথেই বাতাসে যেন ছড়িয়ে পড়ে- শরৎ এসেছে, পুজো আসছে।

বাংলা কবিতার আসরের সকল শ্রদ্ধেয় কবিগণকে জানাই শারদ-শুভেচ্ছা। বাংলা কবিতা-আসরের জয় হোক, বাংলা কবিতার জয় হোক, কবিদের জয় হোক। সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। জয়গুরু!

নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা
এসেছে শরৎ (দশম পর্ব)

কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

শরতের রং মেখে উঠে রবি পূর্ব দিকে
সাদামেঘ ভাসে দলে দলে,
অজয়ের দুইপারে কাশফুল ধারে ধারে
সোনা রোদ ঝরে নদীজলে।

মাধবী মালতীলতা, সুনীলা অপরাজিতা
কামিনী ও শিউলিরা ঝরে,
ফুটিল টগর বেলি, কেয়াফুল ও চামেলি
সৌরভে চিত্ত পাগল করে।

অজয়ের নদীবাঁকে পাখি ডাকে তরুশাখে
রাঙাপথে আমাদের গাঁয়ে।
সবুজ ধানের খেতে মেঠোপথে যেতে যেতে
ঘাসের শিশির লাগে পায়ে।

দিঘিভরা কালোজলে, ছেলেরা শালুক তুলে
ফুলে তুলে আসে নিজ ঘরে,
মরাল মরালী আসে সারাদিন জলে ভাসে
ঘাটেতে বধূরা স্নান করে।

সরোবরে প্রস্ফুটিত শতদল বিকশিত
পুঞ্জেপুঞ্জে অলি ধেয়ে আসে,
নীল আকাশের গায় শঙ্খচিল উড়ে যায়
শরতের সাদা মেঘ ভাসে।

হৃদয়ে পুলক জাগে শরতের রং লাগে
ভেসে আসে আগমনী গান,
শরতের আগমনে রং লাগে দেহে মনে
মেতে উঠে সবাকার প্রাণ।

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (তৃতীয় পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (তৃতীয় পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

সমগ্র মানভূম এলাকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক উৎসব হল ভাদুপরব। এই পরবের উৎস সম্পর্কে নানা লোকগাথা প্রচলিত আছে। তবে বিশেষজ্ঞদের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত এর উৎস পুরুলিয়া জেলার কাশীপুরের পঞ্চকোট রাজবাড়ী। এই রাজবাড়ীর থেকেই এই ভাদু পরবের সূচনা। ধীরে ধীরে এই পরব ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র পুরুলিয়া জেলায়। আবার পাশাপাশি অবস্থানের জন্য এই পরব ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান জেলায়।

কিন্তু ভাদু পুজো কেন হয়? ভাদুর পরিচয়ই বা কি? এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত থাকলেও সবচেয়ে জনপ্রিয় মতবাদটি হল-কাশীপুরের পঞ্চকোটরাজ নীলমণি সিং দেও-র এক কন্যা ছিলেন,যার নাম ভদ্রাবতী। খুব অল্প বয়সেই এই কন্যার মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় শোকে মুহ্যমান রাজা প্রজাদের আদেশ দেন তাদের প্রিয় রাজকুমারী কে নিয়ে গান রচনার। প্রজারাও সেই আদেশ মেনে রাজকুমারীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে গান গাইতে থাকেন ও উৎসবের আয়োজন করেন।

কাশীপুরের রাজার বিটি বাগদীঘরে কি কর।
হাতের জালি কাঁধে লয়ে সুখ সায়রে মাছ ধর।।

কাশীপুরের মহারাজা সে করে ভাদুপুজা
সন্ধ্যা হলেই ঝারইল বাজে থালে জিলিপি খাজা।

এই উৎসব কারা পালন করে সেই নিয়েও প্রচুর মতভেদ। তবে এটা বলা যায় যে এই উৎসব এই উৎসব সমগ্র মানভূম এলাকায় এক সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। ভাদু পুজোয় ভাদুকে ভোগ নিবেদন। ভাদুর মূল প্রসাদই হল প্রমাণ সাইজের জিলিপি এবং মিষ্টি খাজা।

আমার ভাদু মান কইরেছে, মানে গেল সারা রাইত।
খুল ভাদু মানের কপাট, পায়ে ধরে প্রাণনাথ।।

www.youtube.com/watch?v=KLuYvOpsDjg

নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা এসেছে শরৎ (নবম পর্ব)

শরতের আগমনী ……. সোনাঝরা রোদ
নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা
এসেছে শরৎ (নবম পর্ব)

শরতের শিশিরভেজা ঘাসে কমলা রঙের নলাকার বোঁটায় সাদা পাপড়ির অজস্র ফুল পড়ে থাকার দৃশ্য লোভনীয়। শিশিরভেজা ঘাসে খালি পা মাড়িয়ে শিউলি ফুল কুড়ানোর একটা আলাদা সুখ আছে। রাতে ফুটে সকাল না হতেই ঝরে পড়ে বলে এই ফুলকে বলে ‘নাইট জেসমিন’। শিউলি ছাড়াও এর আরো অনেক নাম আছে। যেমন – শিউলি, শেফালি, শেফালিকা (বাংলা), শেওয়ালি (মণিপুরী), পারিজাত (মারাঠি), পারিজাতম (তেলেগু), গঙ্গা শিউলি (উড়িষ্যা), হরসিংগার, রাগাপুষ্পী, মালিকা ইত্যাদি।

পারিজাত শিউলির আরেকটি বিশেষ নাম। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীতে অনেকবার এসেছে শিউলি ফুল বা পারিজাতের কথা। পূজোয় শিউলিই এমন ফুল যেটি মাটিতে ঝরে পড়লেও তাকে দেবতার উদ্দেশে নিবেদন করা যায়। প্রাচীনকালে এ ফুলের বোঁটার রঙ পায়েস ও বিভিন্ন মিষ্টান্নে ব্যবহার করা হতো। তাছাড়া শিউলির মালা খোঁপার সৌন্দর্য বাড়াতেও অনন্য। ফুল চ্যাপ্টা ধরনের। শিউলির পাতা ও বাকল বিভিন্ন রোগের মহৌষধ। ঔষধি হিসেবে ব্যবহার হয় শিউলির বীজ, পাতা ও ফুল। এই ফুল বোঁটা শুকিয়ে গুঁড়ো করে পাউডার বানিয়ে হালকা গরম পানিতে মেশালে চমৎকার রঙ হয়।

শিউলি ফুলের আরেক নাম শেফালি। দিনের আলোর স্পর্শে এই কমলা-সাদা ফুলটি তার নিজস্বতা হারায়। সূর্য ওঠার আগেই গাছ থেকে খসে পড়ে মাটিতে।

শিউলিই এমন এক ফুল যেটি মাটিতে ঝড়ে পড়লেও পূজোয় দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা যায় এই ঝরা ফুল।এই ফুল শরৎকালে ফোটে। এর ফুলগুলি রাতে ফোটে এবং সকালে ঝরে যায়। শরৎকালের শিশির ভেজা সকালে ঝরে থাকা শিউলি এক সুন্দর মনোরম দৃশ্য তৈরি করে।

বাংলা কবিতার আসরের সকল শ্রদ্ধেয় কবিগণকে জানাই শারদ-শুভেচ্ছা। বাংলা কবিতা-আসরের জয় হোক, বাংলা কবিতার জয় হোক, কবিদের জয় হোক। সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। জয়গুরু!

নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা
এসেছে শরৎ (নবম পর্ব)

কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

শরতের সোনা রবি
লাল রং মাখে,
ফুলবনে ফুলকলি
ফুটে ফুলশাখে।

শরতের আকাশেতে
সাদামেঘ ভাসে,
দূর হতে আগমনী
গীত ভেসে আসে।

শিশিরের বিন্দু ঝরে
ঘাসের আগায়,
ময়না চড়ুই আসে,
চরে আঙিনায়।

গাঁয়ের পথের বাঁকে
গোরুগুলি চরে,
বধূরা অজয় থেকে
জল আনে ঘরে।

শঙ্খচিল ভেসে চলে
আকাশের গায়,
শালিকের দল উড়ে
নদী কিনারায়।

সোনাঝরা রোদ হাসে
অজয়ের চরে,
দুই ধারে কাশ ফুল
ফুটে থরে থরে।

শাল পিয়ালের বনে,
মহুল তলায়,
সাঁওতালীরা উল্লাসে
মাদল বাজায়।

পূজার খুশিতে চিত্ত
পুলকিত হয়,
শরতের আগমনে
নাচেরে হৃদয়।

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব-২০২০ (দ্বিতীয় পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- 2020 (দ্বিতীয় পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

youtube.com/watch?v=-KgWdcD7f0A

ভাদু লে লে লে পয়সা দু আনা, কিনে খাবি মিছরির দানা। এই সেই জনপ্রিয় ভাদু গান, কয়েকবছর আগে পর্যন্ত এই গান গেয়ে এবং নিচে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত বেশ কিছু ভাদু শিল্পীদের ভাদ্র মাসে।

কিন্তু বর্তমান মুঠোফোন, অত্যাধুনিক সাউন্ড সিস্টেম ইত্যাদির আড়ালে দুই দশক ধরে এই ভাদু গান এবং ভাদু শিল্পীরা লুপ্তপ্রায়। ভাদ্র মাসের দিনের বেলায় প্যাঁচপ্যাঁচে গরমে অথবা সন্ধ্যার পর আর সচরাচর দেখা যায় না এই সকল ভাদু শিল্পীদের। অথচ কয়েক বছর বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান, পুরুলিয়ার মত রাঢ় বাংলায় গ্রামে গ্রামে দেখা যেত এই সকল ভাদু শিল্পীদের।

তবে বীরভূমে বেশকিছু গ্রামের সাধারণ দিনমজুর সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ এই ডিজের যুগেও টিকিয়ে রেখেছে এই ভাদু শিল্পকে। ভাদ্র মাসের পহেলা তারিখ থেকে একটি মেয়েকে ঘাগরার মত শাড়ি পরিয়ে ও মাথায় ওড়না দিয়ে ভাদু সাজিয়ে গানের সঙ্গে নাচানো চিরাচরিত রীতি। আর মাটির ভাদু মূর্তি কোলে করে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে টাকা পয়সা আদায় করে ভাদু শিল্পীরা। ভাদু শিল্পীরা মুখে মুখে রচনা করেন গান, তাদের গানে উঠে আসে তাদের জীবন যন্ত্রণার প্রসঙ্গ, উঠে আসে সামাজিক বিষয়। ঢোল, হারমোনিয়াম, কাঁসা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গান শোনান ভাদু গানের লোক শিল্পীরা।

এই ভাদু গানের পিছনে আছে এক রাজকুমারীর করুণ কাহিনী। পুরুলিয়ার কাশীপুরের পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিং দেওরের কন্যা ছিল ভদ্রাবতী বা ভাদু। তাঁর বিবাহের ঠিক হয় বীরভৃমের এক রাজপুত্রের সঙ্গে। বিয়ের দিন বিবাহ করতে আসার পথে ডাকাতদলের হাতে খুন হন ভদ্রাবতীর হবু স্বামী।শোকে মুহ্যমান হয়ে ভদ্রাবতী আত্মঘাতী হয়।
কারও মতে ভদ্রাবতী বা ভাদু চিতার আগুনে আত্মাহুতি দেয়। আবার কারো মতে জলে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুকে বেছে নেয়।রাজার প্রিয় ভদ্রাবতীকে জনমানসে স্মরণীয় করে রাখতে রাজা নীলমণি সিং দেওর ভাদু গানের প্রচলন করেন। ভাদু একটা লোকগান কিন্তু তার প্রচলন রাজপরিবারের হাত ধরে।আর তা শুরু হয় পয়লা ভাদ্র থেকে ভাদু পুজোর মধ্য দিয়ে।

একসময় এই ভাদুগান এবং ভদ্র শিল্পীদের ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিপুল উত্সাবহ দেখা গেলেও বর্তমান প্রজন্ম আর এই ভাদু গান নিয়ে তেমন উত্সা্হ দেখায় না। ফলত এই সকল ভাদু শিল্পীদের আয় হয় যত্সািমান্য। তাই শিল্পীরাও বর্তমানে রোজগারের তাগিদে যুক্ত হয়ে পড়ছেন অন্য কাজে।

একসময় বীরভূমের রতন কাহার এর হাত ধরে ভাদু গান খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। মহঃবাজারের সুদন দাস এখনও পর্যন্ত ভাদ্র মাস এলে দলবল নিয়ে ভাদু গান শোনানোর জন্য বেরিয়ে পড়েন গ্রামে গ্রামে। বৃদ্ধ সুদন দাস ভাদু শিল্পী হিসাবে সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছেন, মাসে মাসে পান ভাতাও। কিন্তু তাঁর আক্ষেপ, আর আগের মত এই গান শুনতে লোক হয়না।
হিমাদ্রি মন্ডল, বীরভূম থেকে

ভাদু গানের আসর আমার গীতিকবিতা-1
কথা – আঞ্চলিক সুর – অপ্রচলিত
(তাল- দাদরা)

ও ভাদু মা ও ভাদু মা ফেলছো কেনো চোখের জল,
কি হয়েছে বলো মা আমায় খেতো দেবো রম্ভা ফল।
ও ভাদু মা ও ভাদু মা……..

আমার ভাদু রাগ করেছে কথা সে আর কইবে না,
ও ভাদু মা এই বয়েসে রাগ করা আর সাজে না।
ও ভাদু মা ও ভাদু মা……..

ও পাড়া যেও না ভাদু মা, ও পাড়া যেতে মানা,
ও পাড়াতে সতীন আছে ধরলে পরে ছাড়ে না।
ও ভাদু মা ও ভাদু মা……..

ওপর কুলি নামু কুলি মাঝ কুলিতে গোল হচ্যা,
আমার ভাদু ছুটু ছ্যালা ঘরে ফিরতে লারিছ্যা।
ও ভাদু মা ও ভাদু মা……..

শরতের আগমনী ……. সোনাঝরা রোদ নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা এসেছে শরৎ (অষ্টম পর্ব)

শরতের আগমনী ……. সোনাঝরা রোদ
নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা
এসেছে শরৎ (অষ্টম পর্ব)

সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে, শুভ্র কাশের আঁচল উড়িয়ে, কণ্ঠে শিউলি ফুলের মালা দুলিয়ে শরৎ আসে প্রকৃতি জুড়ে। মাঠে সবুজ ধান ক্ষেতের নয়নাভিরাম দৃশ্য, ধানের শীষে আগামী দিনের ফসলের বারতা। শরতের শান্ত ও স্নিগ্ধ রূপ মনে এনে দেয় এক প্রশান্তির পরশ। দিনের উজ্জ্বল রোদ্দুরের ঝিকিমিকি আর রাতের ধবল জ্যোৎস্নাস্নাত রূপ মনোহরা।

ফুলের মধ্যে শিউলিকে নিয়ে পৌরাণিক উপাখ্যান আছে, যে বেদনা বয়ে বেড়ায় শিউলি। একবার এক রাজকন্যা প্রভায় মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়ে সূর্যের। সূর্য প্রত্যাখ্যান করে মর্তবাসিনীর হৃদয়ের আবেগ। বঞ্চনায় আত্মহনন করে অভিমানী রাজকন্যা। তার চিতাভষ্ম থেকে জন্ম নেয় এক বৃক্ষ। দিনে দিনে বৃক্ষটি বেড়ে ওঠে। শিশিরভেজা এক মৌসুমে বৃক্ষের শাখা-প্রশাখায় ফুটল মিষ্টি সৌরভ ছড়ানো শুভ্র ফুলের রাশি। তবে ফুলগুলো ফুটল রাতের নিভৃতে। ঝরে পড়ল দিনের আলো ফোটার আগেই। যেন সূর্যের আলো তাকে স্পর্শ করতে না পারে। নিশুতি রাতের এ ফুলই শিউলি শেফালি নামেও পরিচিত।

নিশির শিশিরভেজা ফুলগুলো ঝরে পড়ে সূর্যোদয়ের আগেই। গাছতলা ভরে ওঠে স্নিগ্ধ ফুলের সমারোহে। ভোরে ঘুম থেকে জেগে শিউলি কুড়াতে যাওয়ার উৎসাহ আনন্দ চিরকালের। আজও প্রবীণ ও মধ্যবয়সীদের অনেককে স্মৃতির পাতা মেলে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই ফুল কুড়ানোর ছোট্টবেলায়। কুলা-ডালায় শিউলি ফুল নিয়ে আজও মালা গাঁথতে বসে অনেকে।

বাংলা কবিতার আসরের সকল শ্রদ্ধেয় কবিগণকে জানাই শারদ-শুভেচ্ছা। বাংলা কবিতা-আসরের জয় হোক, বাংলা কবিতার জয় হোক, কবিদের জয় হোক। সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। জয়গুরু!

নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা
এসেছে শরৎ (অষ্টম পর্ব)

শারদ প্রভাতে আজি কমল ফুটিল,
মধু লোভে অলিদল আসিয়া জুটিল।
পাখি সব গীত গায় সুমধুর সুরে,
আগমনী গান ভাসে দূর হতে দূরে।

সকালের সোনা রোদ নদীজলে ঝরে,
ধারে ধারে কাশ ফুল অজয়ের চরে।
নদী তীর সুশীতল পাখি গীত গায়,
সাদাপাল তুলে মাঝি তরী বেয়ে যায়।

দিঘি জলে সাঁতরায় মরালের দল,
মরালীর পাছে ধায় করে কোলাহল।
ফুল বনে ফুল ফুটে সৌরভ ছড়ায়।
রাঙাপথে গরুগাড়ি দ্রুতবেগে ধায়।

শিশিরের বিন্দু ঝরে ঘাসের আগায়,
শরতের রং লাগে স্নিগ্ধ হাওয়ায়।

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- (প্রথম পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদু গান ও ভাদু উত্সব- (প্রথম পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

১৮৫৭ -র মহাবিদ্রোহে যে রাজারা যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পঞ্চকোটরাজ নীলমণি সিংহ দেও। পুরুলিয়ার প্রখ্যাত লোকসংস্কৃতি গবেষক দিলীপ গোস্বামী বলেন, ‘লোককথা অনুযায়ী, নীলমণি সিংহের কন্যা ছিলেন ভদ্রাবতী বা ভাদু। তাঁর অকালমৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিতে ভাদু উত্সবের প্রচলন হয় রাজবাড়িতে।’

ভাদ্র মাসের পয়লা দিনে রাজবাড়িতে ভাদুর মূর্তি স্থাপন করা হত। অন্তঃপুরের মহিলারা প্রতি রাতে ভাদুর সামনে বসে গান করে ভাদু উত্সব করতেন। ভাদ্র সংক্রান্তির দিন সারা রাত জেগে হত ভাদু উত্সব। এই দিনটিকে বলা হয় ভাদুর জাগরণ। পয়লা আশ্বিন ভাদু বিসর্জন। কাশীপুর রাজবাড়িতে সুনসান গেটের সামনে নির্লিপ্ত বসেছিলেন অবাঙালি দারোয়ান। ভাদুর কথা উঠতেই বলে উঠলেন, ‘এখানে কে ভাদু করবে ? রাজকন্যা লখনৌতে থাকেন। আসেন পুজোর সময়৷’

লোককথা অনুযায়ী, কারাবন্দি প্রেমিক অঞ্জনের খোঁজে গান গেয়ে গেয়ে ঘুরে বেরিয়েছিলেন ভাদু। তাই মন্ত্রোচ্চারণ নয়, লোকায়ত সুরেই হয় ভাদুর বন্দনা। নিবেদন করা হয় খাজা -গজা, জিলিপি, লাড্ডু। নীলমণি সিংহের রাজত্ব বাজেয়াপ্ত করেছিল ব্রিটিশরা। সেই রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য নীলমণি ব্রিটিশ আদালতে আবেদন করেছিলেন। রাজার আইন উপদেষ্টার চাকরি নিয়ে সেই সময় পুরুলিয়া আসেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। রাজবাড়ির ভাদু উত্সবে যোগ দিতেন কবি। লিখেছিলেন কয়েকটি ভাদু গানও।

ঐতিহ্যের এই ভাদু উত্সব এখন রাজবাড়ি থেকে হারিয়ে গেলেও টিকে রয়েছে কাশীপুরের কিছু মহল্লায়। সঞ্জয় সূত্রধর, ষষ্ঠীপদ বাউড়ি, বাবলু মোদক, সুশীল শা -রা এখনও ভাদ্র সংক্রান্তিতে ভাদু গানের আসর বসান। তবে তা রাজকীয় মর্যাদা পায় না।

মানভূমের গ্রামাঞ্চলে ভাদ্র সংক্রান্তিতে বিশ্বকর্মা পুজোকেও ছাপিয়ে যায় ভাদু। মেয়েরা কুমোর বাড়ি থেকে ভাদু মূর্তি কিনে এনে গ্রামে স্থাপন করেন। ভাদু গানে কখনও দৈনন্দিন জীবন কখনও বা চাওয়া -পাওয়ার যন্ত্রণা ফুটে ওঠে।
‘ভাদু আমার ছোট ছেলে, কাপড় পড়তে জানে না’ (পুরুলিয়ায় শিশুদের লিঙ্গ নির্বিশেষে ছেল্যা >ছেলে বলা হয় )।
ভাদুর গীতে ক্রমশ উহ্য হয়েছেন খোদ ভাদুই। এসেছে রামায়ণ -মহাভারতের কাহিনি। ‘রামের মা সিনাতে গেল , রাম কাঁদে ধুলায় পড়ে / কেনে গরবি ধুলা দিলি / ধুলা ঝাড়ে লিই কোলে।’

বিদায় বেলায় যেন ডুকরে উঠলেন সেই অবাঙালি দারোয়ান, ‘সব উঠে গেল বাবু। ভাদু, আগমনী, পুজো, যাত্রাপালা সব …’তালাবন্ধ কাশীপুর রাজবাড়ি।

আমার কবিতা এসেছে শরৎ (সপ্তম পর্ব)

শরতের আগমনী …… সোনাঝরা রোদ
নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা
এসেছে শরৎ (সপ্তম পর্ব)

শিউলি ও শেফালি দুটো নামই লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘ শেফালী বনের মনের কামনা’, ‘শিউলি ফুল, শিউলি ফুল, কেমন ভুল, এমন ভুল’, ‘শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি……শিউলি বনের বুক যে ওঠে আন্দোলি’, ‘শিউলী বনের উদাস বায়ু পড়ে থাকে তরুতলে এই গানগুলো শিউলির মতোই সুরভিত হয়ে আছে শ্রোতাদের কাছে। শিউলি কেবল কবিদেরই বিমুগ্ধ করেনি, তার অসংখ্য মুগ্ধ অনুরাগী যুগে যুগে।

শরতের সকালে শিশিরমাখা শিউলি ফুল দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু হেমন্তের প্রভাব বাড়ছে প্রকৃতিতে। সন্ধ্যা ও ভোরে এখন বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া ও কুয়াশা বা শিশির পড়া শুরু হয়ে গেছে। আসলেই শরৎ বাংলাদেশের কোমল, স্নিগ্ধ এক ঋতু। শিউলি ফুল প্রত্যেক মানুষের কাছে খুব প্রিয়। বিশেষত, বাঙালির কাছে তো খুবই প্রিয়। কারণ, এই ফুল ফুটলে বোঝা যায় শরৎ এসেছে। শরৎ ঋতুর রয়েছে স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য।

শিউলি আর কাশ ফুলের মিলিত প্রকাশ মানেই এটা শরৎকাল। আর শরৎকাল মানেই শিউলির গন্ধ, কাশ ফুলের মেলা, সব মিলিয়ে আকাশে বাতাসে উৎসবের ছটা। শোনা যায় মায়ের পদধ্বনি । প্রত্যেক বাঙালির কাছে শিউলি ফুল, কাশ ফুল আর শরৎ কালের একটা আলাদাই গুরুত্ব আছে।

বাংলা কবিতার আসরের সকল শ্রদ্ধেয় কবিগণকে জানাই শারদ-শুভেচ্ছা। বাংলা কবিতা-আসরের জয় হোক, বাংলা কবিতার জয় হোক, কবিদের জয় হোক। সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। জয়গুরু!

নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা
এসেছে শরৎ (সপ্তম পর্ব)

সোনা রোদ হাসে সাদা মেঘ ভাসে
নীল আকাশের গায়,
শরৎ এলো রে বসুন্ধরা পরে
শিউলিরা ঝরে যায়।

শিশিরে শিশিরে শিউলির ফুলে
সোনাঝরা রোদ ঝরে,
কমল কাননে ধায় অলিগণে
দলে দলে সরোবরে।

অজয়ের পারে হেরি দুইধারে
কাশফুল ফুটে রয়।
আকাশের গায় চিল উড়ে যায়
কুলু কুলু নদী বয়।

রাখালিয়া সুরে বাঁশি বাজে দূরে
হৃদয়ে পুলক জাগে,
অরুণের রাগে ফুল বাগে বাগে
শরতের রং লাগে।

শরতের শোভা, অতি মনলোভা
সবুজের অভিযান,
আকাশে বাতাসে শুধু ভেসে আসে
নব আগমনী গান।

শরতের আগমনী …… সোনাঝরা রোদ নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা এসেছে শরৎ (ষষ্ঠ পর্ব)

শরতের আগমনী …… সোনাঝরা রোদ
নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা
এসেছে শরৎ (ষষ্ঠ পর্ব)

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো লিখে গেছেন?—‘‘শিউলি ডালে কুঁড়ি ভরে এল/টগর ফুটিল মেলা/মালতীলতায় খোঁজ নিয়ে যায়/মৌমাছি দুই বেলা।’’ শিউলি ফুলের আরেক নাম শেফালি। দিনের আলোর স্পর্শে এই কমলা-সাদা ফুলটি তার নিজস্বতা হারায়। সূর্য ওঠার আগেই গাছ থেকে খসে পড়ে মাটিতে। টুপটাপ, গালিচার মতো বিছিয়ে থাকে শিশির-ভেজা কমলা-সাদা বৈভব। শিউলি ফুলের পিছনে লুকিয়ে রয়েছে কিছু পৌরাণিক কাহিনী।

নাগরাজের অপরূপা লাবণ্যময়ী কন্যা পারিজাতিকা সূর্যের প্রেমে পড়েন। কিন্তু দিনমণির-র কাছে সে পবিত্র প্রেম নজরে পরে না। শেষে দিনমণি সূর্যকে না পেয়ে পারিজাতিকা আত্মহনন করেন। তার দেহের ভস্ম পারিজাত ফুল রূপে স্বর্গে ফুটে ওঠে। সূর্যের স্পর্শমাত্রাই সে নীরব ব্যর্থ প্রেমিকার মতো ধরে পড়ে মাটিতে। এই পারিজাত হল স্বর্গের শ্রেষ্ঠ কুসুম। পারিজাত শিউলিরই নামান্তর। পুষ্পপুরাণে রয়েছে অন্য গল্প। পারিজাত স্বর্গের ফুল।

শরৎ-হেমন্তের সকালে শিউলির সৌরভ বাঙালির প্রাণে আনে উৎসবের মেজাজ। শ্রীকৃষ্ণের দুই পত্নী সত্যভামা ও রুক্মিনীর মনে খুব দ্বন্দ্ব যে কৃষ্ণ কাকে বেশি ভালোবাসেন। সত্যভামা না রুক্মিনী কাকে। কৃষ্ণ উদাসীন থাকেন এ প্রশ্নে। শেষে একদিন তাঁরা আবদার করলে পারিজাত ফুল যদি কৃষ্ণ এনে দিতে পারেন স্বর্গ থেকে, তাহলেই বোঝা যাবে কৃষ্ণের পত্নীপ্রেমের গাঢ়তা।

কৃষ্ণ স্বর্গ থেকে চুপিচুপি পারিজাত বৃক্ষ চুরি করে আনেন। সত্যভামা সকালে ঘুম ভেঙে দেখেন তার প্রাসাদে একটি অপূর্ব পারিজাত বৃক্ষ এহং সেই ফুলের গুচ্ছ বিছিয়ে রয়েছে রুক্মিনীর প্রাসাদকোণে। এ দিকে স্বর্গের ফুল পারিজাত চুরির অপরাধে দেবরাজ ইন্দ্র আভিশাপ দেন, পারিজাত কেবল ফুল ফুটেই ঝরে যাবে। ফল হবে না কখনও সে ফুলের। তা না হোক, আমরা তো শিউলি-শেফালিকা-পারিজাত যে মানেই ডাকা হোক, তার ফুলটাই ভালোবাসি। শরৎ ঋতুর শ্রেষ্ঠ সে ফুল।

বাংলা কবিতার আসরের সকল শ্রদ্ধেয় কবিগণকে জানাই শারদ-শুভেচ্ছা। বাংলা কবিতা-আসরের জয় হোক, বাংলা কবিতার জয় হোক, কবিদের জয় হোক। সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। জয়গুরু!

নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা
এসেছে শরৎ (ষষ্ঠ পর্ব)

সুনীল আকাশে সাদা মেঘ ভাসে
শরতের আগমনে,
তরুর শাখায় পিকদল গায়
ফুল ফুটে বনে বনে।

ফুটেছে কমল আসে অলিদল
দলে দলে সরোবরে,
মরালেরা ধায় মরালীরা চায়
জলে জলকেলি করে।

পথে তরুশাখে বিহগেরা ডাকে
সোনাঝরা রোদ ঝরে,
শরত্ এলোরে আজি ধরা পরে
পরাণ পাগল করে।

মাধবী মালতী টগর ও যুথী
ফুটে আছে থরে থরে,
রাশি রাশি কত শিউলিরা শত
পড়ে ঝরে অনাদরে,

কচি দূর্বাঘাসে পথের দুপাশে
শিশিরের বিন্দু শোভে,
ফুটে ফুল কলি দলে দলে অলি
ছুটে আসে মধু লোভে।

শরতের আগমনী …… সোনাঝরা রোদ নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা এসেছে শরৎ (পঞ্চম পর্ব)

শরতের আগমনী …… সোনাঝরা রোদ
নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা
এসেছে শরৎ (পঞ্চম পর্ব)

শিউলি আর কাশ ফুলের মিলিত প্রকাশ মানেই এটা শরৎকাল। আর শরৎকাল মানেই শিউলির গন্ধ, কাশ ফুলের মেলা, সব মিলিয়ে আকাশে বাতাসে উৎসবের ছটা। শোনাযায় মায়ের পদধ্বনি.. তাই, প্রত্যেক বাঙালির কাছে শিউলি ফুল, কাশ ফুল আর শরৎ কালের একটা আলাদাই গুরুত্ব আছে। কারণ, সর্বপ্রথম এরাই জানান দেয় পুজো আসছে। আর, বেশি দেরি নেই। দরজায় কড়া নাড়ল বলে, এবার আনন্দের দিন শুরু।

শিউলিকে স্বর্গের ফুল বলা হয়। প্রভু কৃষ্ণ স্বর্গ থেকে এই ফুল মর্তে এনেছিল। আবার সারা রাত গাছে থেকে ভোরে ঝরে যাওয়ায় এই ফুল নিয়ে আছে নানা গল্প।

এক রাজকুমারী সূর্যকে ভালোবেসে না পেয়ে আত্মহত্যা করে ফুল গাছে পরিণত হয়। সকাল বেলায় যেন সূর্যের মুখ না দেখতে হয়, তার জন্য সূর্য উঠার আগেই ঝরে পরে গাছ থেকে। রাজকন্যার নাম ছিল পারিজাতিকা। এই জন্য শিউলির আরেক নাম পারিজাত।

কৃষ্ণের দুই স্ত্রী সত্যভামা ও রক্ষিণীর খুব ইচ্ছে তাদের বাগান পারিজাতের ঘ্রাণে আমোদিত হোক। কিন্তু পারিজাত তো স্বর্গের শোভা ! কৃষ্ণ স্ত্রীদের খুশি করতে চান। তাই লুকিয়ে স্বর্গের পারিজাত বৃক্ষ থেকে ডাল এনে বাগানে রোপণ করেন।

গাছ থেকে ফুল ঝরে পড়ে সুগন্ধ ছড়ায়। স্বর্গের রাজা ইন্দ্র এ ঘটনা জেনে রেগে যান। তিনি কৃষ্ণকে শাপ দেন, পারিজাত ফুল দেবে ঠিকই কিন্তু বীজ থেকে নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে না।

বাংলা কবিতার আসরের সকল শ্রদ্ধেয় কবিগণকে জানাই শারদ-শুভেচ্ছা। বাংলা কবিতা-আসরের জয় হোক, বাংলা কবিতার জয় হোক, কবিদের জয় হোক। সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। জয়গুরু!

নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা
এসেছে শরৎ (পঞ্চম পর্ব)

শারদ প্রভাতে তরুর শাখাতে
পাখি সব গান গায়,
কমল কাননে মধু আহরণে
দলে দলে অলি ধায়।

পথের দুপাশে তৃণদল হাসে
শিশিরের বিন্দু ঝরে,
নিশির শিশির পড়ে ঝিরঝির
রোদে ঝিকমিক করে।

সোনা রোদ ঝরে আঙিনার পরে
কচি কচি দূর্বাঘাসে,
মাধবী মালতী কেতকী ও যুথী
টগর, শিউলি হাসে।

অজয়ের চরে সারাদিন ধরে
যাত্রীদের কোলাহল,
ধবল বলাকা থাকে বসে একা
উড়ে শালিকের দল।

শারদ আকাশে সাদা মেঘ ভাসে
শুনি আগমনী গান,
পূজা এলো কাছে হৃদয় যে নাচে
ভরে ওঠে মনপ্রাণ।

শরতের আগমনী …… সোনাঝরা রোদ নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা এসেছে শরৎ (চতুর্থ পর্ব)

শরতের আগমনী …… সোনাঝরা রোদ
নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা
এসেছে শরৎ (চতুর্থ পর্ব)

নীলাকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে বর্ষার আবরণের মধ্যে এসেছে শরৎ। বর্ষার বিষণ্ণতা পরিহার করে শরৎ এসেছে শান্ত স্নিগ্ধ কোমল রূপ নিয়ে রৌদ্র-মেঘের ছায়ার খেলা, ছড়িয়ে পড়া শিউলি ফুল, দুলতে থাকা কাশবনের সিগ্ধ কোমল রূপ নিয়ে সেজেছে প্রকৃতি। গাছে গাছে ফুটছে কাশফুল, বকফুল, শেফালি/শিউলি, গগণশিরীষ, ছাতিম, হিমঝুরি, মিনজিরি, পাখিফুল, পান্থপাদপসহ নানা জাতের ফুল। শেফালি, মালতী, কামিনী, জুঁই আর টগর মাথা উঁচিয়ে জানান দেয় সৌন্দর্য। মিষ্টি সুবাস ছড়িয়ে দেয় চার পাশে।

নদীর কিনার ঘেঁষে কাশগুচ্ছে মৃদু হাওয়ার দোলা। মাথার ওপর নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘ কিংবা শিউলিতলায় ফুলের গল্পব্দমাখা স্নিগ্ধ ভোর— ইট-কংক্রিটের নাগরিক জীবনে শরতের এ রূপ দেখা এখন কল্পনায়ও আসে না। তারপরও প্রকৃতির নিয়মে ঝকঝকে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা জানিয়ে দেয় শরৎ এসেছে। গ্রামাঞ্চল আর বহমান নদ-নদী পাড়জুড়ে সাদা কাশফুল তাই জানিয়ে দিচ্ছে, এসেছে শরৎ।

এই শরতে উদযাপিত হয় হিন্দুধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দূর্গোৎসব। মণ্ডপে মণ্ডপে বাজে ঢাক। সেই ঢাকের সাজ-সজ্জাতে ব্যবহৃত হয় কাশফুল। শীতের আগমনী বার্তা শুরু হয় এই শরতেই। শরতের শেষ দিকে ঘাসের ডগায় পড়তে থাকে শিশির বিন্দু। সূর্যের আলোয় শিশিরের বিন্দু মুক্তোর মতো ঝিকমিক করে।

বাংলা কবিতার আসরের সকল শ্রদ্ধেয় কবিগণকে জানাই শারদ-শুভেচ্ছা। বাংলা কবিতা-আসরের জয় হোক, বাংলা কবিতার জয় হোক, কবিদের জয় হোক। সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। জয়গুরু!

নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা
এসেছে শরৎ (চতুর্থ পর্ব)

শারদ প্রভাতে আজি ফুটিল কুসুমরাজি
সোনার অরুণ পূবে উঠে,
কাজলা দিঘির পাড়ে অশ্বত্থ গাছের আড়ে
ধারে ধারে কেয়াফুল ফুটে।

অজয় নদীর পারে কাশফুল ধারে ধারে
শরতের সাদামেঘ ভাসে,
বক বসে নদীচরে, ছোট পুঁটিমাছ ধরে
শালিকের দল উড়ে আসে।

শাল পিয়ালের বনে চেয়ে থাকি আনমনে
পাখি সব নাচে তরু শাখে,
অজয় নদীর বাঁকে তরীখানি বাঁধা থাকে
শালিকেরা নিত্য আসে ঝাঁকে।

ছল-ছল কল-কল বহে নদী অবিরল
শঙ্খচিলে ডাক দিয়ে যায়,
শরতের আগমনে ফুল ফুটে বনেবনে
দূরে কারা মাদল বাজায়।

দিঘিতে কমল ফুটে অলি তথা আসি জুটে
ফুলে মধু করে আহরণ,
ঢাকীরা বাজায় ঢাক, ঘরে ঘরে বাজে শাঁখ
পূজার আনন্দে ভরে মন।

শরতের আগমনী …… সোনাঝরা রোদ নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা এসেছে শরৎ (তৃতীয় পর্ব)

শরতের আগমনী …… সোনাঝরা রোদ
নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা
এসেছে শরৎ (তৃতীয় পর্ব)

শরৎ মানে সতেজতা। আর এই সতেজতাকে ঘিরে থাকে নানা ফুল। শরতের ফুলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হল কাশফুল আর শিউলি। বালুর চরগুলো হালকা আর লোমশ কাশফুলে ভরে উঠে এসময়। এ যেন প্রকৃতির এক সাদা গালিচা। শরতের রাতে সুগন্ধ বিলায় ছোট্ট ফুল শিউলি। আর সকালে কমলা-সাদা শিউলি ফুলে ভরে যায় শিউলি তলা।

জ্যোৎস্নাকে যারা উপভোগ করতে চান তাদের জন্য সেরা ঋতু শরৎ। নিজের সৌন্দর্যের সবটুকু ঢেলে শরতের জোছনা রাঙিয়ে রাখে প্রকৃতি। অন্য সময়ে জোছনার তুলনায় তাই শরতের জোছনা আবেদনময়ী বেশি। জোছনারাতে নদী পাড়ে বসে হালকা বাতাস আর শিউলির ঘ্রাণকে সঙ্গী করে চাঁদের মায়াজালে বন্দি হতে চান অনেকেই।

শরতের অন্যান্য ফুলগুলোর মধ্যে রয়েছে- শেফালি, হিমঝুরি, গগনশিরীষ, ছাতিম, পাখিফুল, পান্থপাদপ, বকফুল, মিনজিরি, কলিয়েন্ড্রা। কেবল তাই নয়, শরতের রূপের অংশ হয় শাপলা, শালুক, পদ্ম, জুঁই, কেয়া, কামিনী, মালতি, মল্লিকা, মাধবী, ছাতিম ফুল, বড়ই ফুল, দোলনচাঁপা, বেলি, জারুল, নয়নতারা, ধুতরা, ঝিঙে, জয়ন্ত্রী, রাধাচূড়া, স্থল পদ্মসহ নানা রকমের ফুল।

অজয় নদীর তীর ঘেঁষে কাশফুলের অপরূপ সমারোহ, উত্তরের বাতাসে সাদা কাশফুলের ঢেউ খেলা স্রোত, খালবিলে জলজ ফুলের রূপ-লাবণ্য প্রকৃতিকে সাজিয়ে তোলে প্রেয়সীর মতো। শিউলির সৌরভ, ঘাসের ডগায় শিশিরের আল্পনা মনে করিয়ে দেয় শরৎ এসেছে।

নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা
এসেছে শরৎ (তৃতীয় পর্ব)

কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

সাদামেঘ দলে দলে আকাশেতে উড়ে চলে
সোনারোদ ঝরে আঙিনায়,
শরতের আগমনে ফুল ফুটে ফুলবনে
গুঞ্জরিয়া অলি তথা ধায়।

তরুর শাখায় পাখি কিচিমিচি ডাকি ডাকি
সুমধুর সুরে গায় গান,
সবুজ মাঠের পরে সকালে শিশির ঝরে
মাঠে সবুজের অভিযান।

কচি কচি ধানগাছে মাঠ সব ভরে আছে
ছাগল আলের ধারে চরে,
সবুজ ডাঙার পরে, গরু ও মহিষ চরে
এক সাথে সারাদিন ধরে।

রাখাল বাজায় বাঁশি মাঠে চাষ করে চাষী
সাঁঝ হলে ফিরে আসে ঘরে,
গাঁয়ের মন্দির মাঝে সন্ধ্যায় কাঁসর বাজে
ঢাক বাজে চিত্ত উঠে ভরে।

আকাশেতে তারা ফুটে পূর্ণিমার চাঁদ উঠে
জোছনায় ভরে চারিদিক,
অজয় নদীর চরে চাঁদের আলোক ঝরে,
নদীজল করে ঝিকমিক।

শরতের আগমনী …….. সোনাঝরা রোদ নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা এসেছে শরৎ (দ্বিতীয় পর্ব)

শরতের আগমনী …….. সোনাঝরা রোদ
নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা
এসেছে শরৎ (দ্বিতীয় পর্ব)

শরৎকালে ঝকঝকে নীল আকাশ। মৃদু বাতাস দোলা দিচ্ছে তাদের নরম পাপড়িতে। এই তো চিরচেনা শরত। কাশফুল শিশির ভেজা সবুজ ঘাসের বিছানায় রাশি রাশি শিউলি ফুল। যেন খসে পড়েছে রাতের ঝলমলে তারা। মাটিতে মিশে গেছে তার গন্ধ।

ছোট ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে নামে শিউলি ফুল কুড়োতে। আর পাল্লা দিয়ে চলে মালা গাঁথার প্রতিযোগিতা, কিন্তু এখনকার সময়ে সবই স্মৃতি।

শরতের আগমন সম্পর্কে কবি বলেছেন,
‘আজি শরৎ তপনে প্রভাত স্বপনে কী জানি পরান কী যে চায়
ওই শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে বিহগ বিহগী কী যে গায় গো
আজি মধুর বাতাসে হৃদয় উদাসে, রহে না আবাসে মন হায়
কোন কুসুমের আশে কোন ফুলবাসে সুনীল আকাশে মন ধায় গো।’

শরতের আকাশ, শরতের নদী, শরতের ফুল এই সবকিছুই কেমন যেন শান্ত-মায়াময়। শরতের এই শুভ্র রূপ পবিত্রতার প্রতীক। বিলের শাপলা, নদীতীরের কাশফুল, আঙিনার শিউলি—সবই কোমল এবং পবিত্র। যখন শিশিরের শব্দের মতো টুপটাপ শিউলি ঝরে তখন আসে অনুভবের শরৎ। কাশবনে দল বেঁধে আসে চড়ুই পাখিরা। শান্ত নদীতে দু’কূল ছাপানো ঢেউয়ের বদলে দৃশ্যমান হয় কাশবনের ছোট ছোট রুপালি ঢেউ।

শরতের স্নিগ্ধতাকে আরও মোহময় করে এ মৌসুমের বিচিত্র ফুলেরা। নদী কিংবা জলার ধারে ফোটে কাশ-কুশ, ঘরের আঙিনায় ফোটে শিউলি বা শেফালি, খাল-বিল-পুকুর-ডোবায় থাকে অসংখ্য জলজ ফুল।

শরৎ মানেই শিউলির মধুগন্ধ ভেসে বেড়ানোর দিন। শিউলির আরেক নাম শেফালি। শিউলি বা শেফালি যাই বলি না কেন চমৎকার এ ফুল নিয়ে দুটি গ্রিক ও ভারতীয় উপকথা আছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক উপন্যাসে শিউলির বিশাল বন ও তার তীব্র ঘ্রাণের কথা বলা হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ এরা সকলেই বারবার শিউলির প্রশংসা করেছেন। ফুলকলিরা মুখ তোলে সন্ধ্যায়। সূর্যের সঙ্গে এদের আড়ি, নিশিভোরেই ঝরে পড়ে মাটিতে। বোঁটার হলুদ রং টিকে থাকে বহুদিন। কাশ শরতের অনন্য ফুল।

বাংলা কবিতার আসরের সকল শ্রদ্ধেয় কবিগণকে জানাই শারদ-শুভেচ্ছা। বাংলা কবিতা-আসরের জয় হোক, বাংলা কবিতার জয় হোক, কবিদের জয় হোক। সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। জয়গুরু!

নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা
এসেছে শরৎ (দ্বিতীয় পর্ব)

কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

শরৎ এলো রে ঝরে ধরা পরে
শিউলির ফুলগুলি,
তরুর শাখায় পাখি গীত গায়
সুমধুর সুর তুলি।

পূর্বের গগনে সূর্যের কিরণে
শিশিরের বিন্দু হাসে,
নিশির শিশির পড়ে ঝিরঝির
আঙিনার কচি ঘাসে।

মরাল মরালী করে জলকেলি
দিঘিভরা কালো জলে,
গাঁয়ের বধূরা রাঙা শাড়ী পরা
জল নিয়ে ঘরে চলে।

অজয়ের পারে নদীর কিনারে
কাশফুল ধারে ধারে,
শালিকের দল করে কোলাহল
বক বসে সারে সারে।

খেয়াঘাটে মাঝি হাল ধরে আজি
গান গেয়ে বৈঠা বায়,
শরৎ আকাশে সাদা মেঘ ভাসে
নীল আকাশের গায়।

শরতের আগমনী …….. সোনাঝরা রোদ নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা এসেছে শরৎ (প্রথম পর্ব)

শরতের আগমনী …….. সোনাঝরা রোদ
নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা
এসেছে শরৎ (প্রথম পর্ব)

শরতের শিউলি ঝরা ভোর আমাদের অন্তরজুড়ে স্নিগ্ধতার প্রলেপ বিছিয়ে দেয়। ক্ষণিকের অতিথি এই শরৎ। শরতের এ সময়টা শস্যপূর্ণা। ধানক্ষেত এ সময় ফল সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। মাস দু-এক পরেই কৃষকের গোলা ভরবে ধানে। কিষাণীর নোলক দোলানো হাসি বলে দেবে পরিতৃপ্তির কথা। শরৎ আনন্দের ঋতু। শরৎ পূর্ণতার ঋতু, প্রাচুর্যের ঋতু। এমনি ঋতুকে কি ভুলে থাকা যায়?

শরৎ প্রকৃতিকে অপরূপ রূপে সাজিয়ে যায় যার আবেশে অতি সাধারন মানুষ ও ভাবাবেগে আপ্লুত হয়। শরৎ অবসাদগ্রস্ত মনেও নতুন প্রেরণার সঞ্চার করে। তাই তো আমরা প্রকৃতিতে দেখি, এই ঋতুতে কি অপূর্ব রঙের খেলা, কি অপরূপ রঙিন ভুবন সাজায় প্রকৃতি। শরতে প্রাণবন্ত রূপ নিয়ে হেসে ওঠে গ্রাম বাংলার বিস্তৃত দিগন্ত। তাইতো রবীন্দ্রনাথের সুরে সুর মিলিয়ে বলতে হয়-

“শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে,
আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে।।”

বাংলা কবিতার আসরের সকল শ্রদ্ধেয় কবিগণকে জানাই শারদ-শুভেচ্ছা। বাংলা কবিতা-আসরের জয় হোক, বাংলা কবিতার জয় হোক, কবিদের জয় হোক। সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। জয়গুরু!

নীল আকাশের আঙিনায় আমার কবিতা
এসেছে শরৎ (প্রথম পর্ব)

কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

শরৎ এসেছে তপন হেসেছে
পূব আকাশের গায়,
ফুটে ফুলকলি ছুটে আসে অলি
ফুলবনে বাগিচায়।

ফুটিল সকলি টগর ও বেলি
উঠোনে মাধবী লতা,
মাধবী মালতী, কেতকী ও যুথী
সুনীল অপরাজিতা।

কমল কাননে ধায় অলিগণে
ফুলে ফুলে মধু খায়,
অজয় নদীতে মাঝি খেয়াঘাটে
সারাদিন খেয়া বায়।

কচি ধানগাছে খেত ভরে আছে
সবুজের অভিযান,
আকাশে বাতাসে শুধু ভেসে আসে
নব আগমনী গান।

দিন অবসানে পশ্চিমের পানে
লুকায় অরুণ রবি,
রাতে তারা ফুটে দূরে চাঁদ উঠে
জোছনায় আঁকা ছবি।

মা মনসার পূজা (ধর্মীয় কবিতা) সমাপ্তি পর্ব

মনসার বন্দনা গান

গ্রামের সার্বজনীন মন্দির গুলির মহোৎসব পর্বে মনসা দেবীর উত্থান ও পূজা পার্বণের পুণ্য লগ্নে সমগ্র উনবিংশ, বিংশ শতাব্দী থেকে আজও গ্রামের সধবা মহিলাদের একদল সমবেত কণ্ঠে ভক্তি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে মঙ্গল ঘট বসিয়ে এক সুন্দর লোক সুরের আঙ্গিকে মনসার বন্দনা গান গায় দশহরার ব্রত পালন করে। প্রতিটি গ্রামের সার্বজনীন থান বা মন্দিরে সমগ্র গ্রামের মাঙ্গলিক লোক দেবী রূপে দীর্ঘকাল যাবৎ ভক্তদের কাছে থেকে মনসা পূজা নিয়ে আসছে। তাই বৎসরান্তে এক দুই বার তার মহিমা কীর্তন পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে মানসিক সুখ শান্তি অনুভব করে দক্ষিণ বঙ্গে এই দেবীর অনুগত ভক্তরা। লোক সঙ্গীতের আর অন্যান্য শৈলীর মতো মনসার পাঁচালীগান বা অভিনয়ের মধ্যেে দিয়ে যাত্রা পাঁচালী পরিবেশনের মধ্যেশ দিয়ে তারা দেবীর গুনকীর্তনে আনন্দে মাতে।

মনসার পাঁচালী গান‌ সম্প্রদায়ের শিল্পীরা দেবী মাহাত্ম্য কীর্তনের পালায় অনুপ্রবেশের পুণ্য মূহুর্তে পুরুষ ও মহিলা চরিত্রের সমস্ত নরনারীরা সর্বপ্রথমে ‘আশাবারী’ খনন করে দেবীকে আনয়ন করে। লোক সমাজের প্রতিটি গৃহস্থের ধারণা এই সময় মনসা দেবী জাগ্রত হয়ে তার অনুগত ভক্তদের কৃপা করেন। সেই কৃপা বর্ষনের সামান্য করুণা লাভের আশায় হিন্দু সম্প্রদায়ের পুরুষ ও মহিলাদের একদল গন্ডি দেয় থানের চতুর্দিকে। অন্যা ন্যু জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষরা এই পবিত্র সঙ্গীতানুষ্ঠানেও কমবেশি উপস্থিত হয়। সেই পুন্যদ ক্ষনে শিল্পীরা মহানন্দে মনসা বন্দনা পরিবেশনের মধ্যের দিয়ে দেবীর চরণে নিবেদন রেখে সকলে উচ্চৈঃস্বরে গাইতে থাকে ;

জয় জয় মা মনসা, জয় বিষহরি গো ।
বন্দনা করি মাগো মা মনসার চরণে।।
তার পরে বন্দনা করি মহাদেবের চরণে। জয় জয় মা মনসা
তার পরে বন্দনা করি ভগবতীর চরণে।জয় জয় মা মনসা
তার পরে বন্দনা করি মা কালীর চরণে। জয় জয় মা মনসা
ও মা – – –
মাগো আকাল বন্দন পাতাল বন্দন বন্দনা করলাম,
আমি গুরুদেবের চরণে। জয় জয় মা মনসা
তার পরে বন্দনা করি তেত্রিশ কোটি দেবতা। (জয় জয়) (সংগৃহীত)

মা মনসার পূজা (ধর্মীয় কবিতা) সমাপ্তি পর্ব
কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

(পঞ্চম পরিচ্ছেদ)

চাঁদ সদাগরে বলে সায়বেনের ঝি,
বামহস্তে পূজা দিতে চাঁদ হল রাজি।
ছয় পুত্র প্রাণ পায়, ভাসে মধুকর,
বামহস্তে পূজা করে সাধু চন্দ্রধর।

পূজা নিতে মনসার মর্ত্যে আগমন,
স্বর্গ হতে পুষ্প বৃষ্টি করে দেবগণ।
মা মনসার পাঁচালি যেবা পাঠ করে,
সর্প ভয় কাটে তার মনসার বরে।

শুনহ জীবের জীব বচন আমার,
শ্রাবণ সংক্রান্তিতে পূজা মনসার।
উপবাসী থাকি সবে পূজা কর তাঁর,
লভিবে অপার সুখ কহিলাম সার।

মা মনসার পাঁচালি হল সমাপন,
জয় মা মনসা দেবী বল সর্বজন।

(শ্রী শ্রী মা মনসার পাঁচালি পর্বে পর্বে সমাপ্ত। বাকি পর্বগুলি ভাদ্র সংক্রান্তিতে প্রকাশ করার রাখি)

মনসা মঙ্গল কাব্য …. জয় জয় মা মনসা মা মনসার গল্প (সমাপ্তি পর্ব)

মনসা মঙ্গল কাব্য …. জয় জয় মা মনসা
মা মনসার গল্প (সমাপ্তি পর্ব)

তথ্যসংগ্রহ, সম্পাদনা ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

দক্ষিণ বঙ্গে অধিকাংশ গ্রামগুলির সার্বজনীন থানে মনসা দেবীর মূর্তি পূজার একটা বেশ বড়সড় রীতি রিয়াজ পালন করা হয়ে আসছে বহু পূর্বপুরুষ ধরে। যদিও সেখানে দেবাদিদেব মহাদেব (পঞ্চনন্দ), বনবিবি, শীতলা, লক্ষ্মী, কালি, চণ্ডী, বারা ঠাকুর সহ আরো আট দশটা দেব দেবীকে পূজা করে গ্রামের মানুষ। কিন্তু তার সত্বেও সার্বজনীন মন্দিরের বাইরেও এমন কিছু কিছু থান বা মন্দির রয়েছে যেগুলোতে শুধুমাত্র মনসা দেবীর মূর্তি ব্যাতিত আর অন্য কোনো দেব দেবীর মূর্তি পূজা করা হয় না অর্থাৎ ব্যক্তিগত ভাবে শুধুমাত্র মনসা দেবীর জন্য বহু মনসা মন্দির রয়েছে। সেগুলি মনসার থান নামে পরিচিত।

দক্ষিণ বঙ্গের চাষাবাদ যুক্ত পল্লী গ্রামাঞ্চল গুলিতে এ জাতীয় মনসা মন্দির সচরাচর বহু পরিমাণে দেখা যায়। কোনো স্থানে একবার মনসা মন্দির প্রতিষ্ঠিত হলে সেই স্থান দিনের পর ভক্তদের সমাগম বাড়ে কিন্তু কমে না। শুধু তাই নয় সেই মন্দির নির্মাণের উপাদান প্রথমে মাটির দেওয়াল ও খড়ের ছাউনি হলেও দিনের পর দিন অজস্র ভক্তের গুপ্ত ব্যা ধি তথা নানান রোগ নিরাময় ও অন্যাান্যি বহু সুখ সমৃদ্ধির মূলে দেবীর মহিমাকে দায়ী করে তাঁকে স্বর্ণ, রৌপ্য ও নানান গহনাদি দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়।

পাড়ার বয়স্ক মোড়ল মতিব্বরদের উপস্থিতিতে সকলকে সাক্ষী করে ব্যাকক্তিগত জায়গায় সৃষ্ট পূজনীয় স্থানকে মনসা দেবীর মন্দিরের নামেই উৎসর্গ করে জমির মালিক পক্ষ। এরপরে ধুমধাম করে জাগ্রত করা হয় পুরোহিতের পূজার নানান সাংস্কৃত মন্ত্রে। গ্রামের কুমারী, সধবা ও বিধবা মহিলারা প্রতিনিয়ত সকাল সন্ধ্যায় এইসব থানে বা মন্দিরে ভোগ লাগাতে শুরু করে।

বহু ক্ষেত্র সমীক্ষায় দেখা গেছে অধিকাংশ মনসা দেবীর থানের সন্নিকটে রয়েছে সিজ মনসার গাছ। এই গাছকে দক্ষিণাঞ্চলের মনসা ভক্তদের একাংশ স্বয়ংসিদ্ধ মনসা দেবীই জ্ঞান করে। বহু স্থানে কিছু পুরানো মনসা মন্দির রয়েছে। যেখানে সিজ মনসার গাছ গুলি প্রচণ্ড বড় এবং তার নিচের অংশ গুঁড়ির আকারে পরিণত হয়েছে। তাই মনসা দেবীর মুর্তি পূজার সঙ্গে সঙ্গে সীজ মনসার ডাল পূজার প্রচলনও রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। মনসা ভক্তদের একদল অনুগত ভক্তরা বলেন যে সমস্ত গৃহে মনসা মূর্তি নাই তাঁরা সীজ মনসার কান্ড কাদায় প্রতিষ্ঠিত করে যদি পূজা দেয় তবে সেই পূজাতেও এই দেবী সন্তুষ্ট হয়।

মনসা রূপী এই সীজ মনসার ডালের সামনে পূজার নানান নৈবেদ্যাদি সাজিয়ে পূজার আয়োজন করা যেতে পারে। বস্তুত মনসা মূর্তি ও সীজ মনসার কান্ড পূজার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দী হতে পল্লী বাংলার গ্রামাঞ্চল গুলিতে গৃহস্থের নিজের আরাধ্য দেবীর পূজার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে আসছে এই মনসা। এই দেবীর ভাক্তাসনে সুপ্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয়তার যে কারণ গুলি মানা ‌হয় তা বিস্তারিত তথ্যে উপস্থাপন করা হল;

1. অখণ্ড বাংলায় আর দশ বিশটি লৌকিক দেবদেবীর মতো খ্রিষ্টীয় একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীতে মনসা দেবীর উত্থান হয়েছিল সমগ্র দক্ষিণ বঙ্গ তথা বাংলার লোক সমাজে। প্রতিটি লোক দেব দেবীর বাহনের ন্যায় এই দেবীর প্রধান অনুচর কাল বিষাক্ত সর্প। যার কামড়ের হাত থেকে রক্ষার্থে অতি সহজেই তার পূজার জনপ্রিয়তা কয়েক দশকের মধ্যে তুঙ্গে উঠে যায়। তার ভক্তরা স্বেচ্ছায় নয় বরং ভয়ে ভয়ে দেবীকে বেশি পূজা দেয় কেবলমাত্র কাল সর্পের কামড়ের হাত থেকে সপরিবারের অন্যান্য সদস্যদের রক্ষার্থে।

2. প্রতিটি লোক দেবী দেবীর উত্থানের পিছনে একটি মহান উদ্দেশ্য থাকে। গ্রামের মোড়ল মতিব্বরদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্রামের সীমান্তবর্তী এলাকায় এই সব দেব দেবীর মূর্তি রাখার প্রধান উদ্দেশ্য বহিরাগত শত্রুদের আক্রমণ থেকে সমগ্র গ্রাম কে রক্ষা করা। অনুরুপ কালসর্পমূর্তি বিশেষ মনসা দেবীর এই ভয়ঙ্কর মূর্তি প্রতিষ্টার পিছনে এটাই মহান উদ্দেশ্য।

3. শিবের অসাধ্য হাম, বসন্ত, গুটি বসন্তের মতো কতকগুলো রোগের প্রকোপে অষ্টাদশ, উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে গ্রামের পর গ্রাম মড়ক দেখা দিত। যার ফলশ্রুতিতে উজাড় হয়ে যেত সমগ্র গ্রামের নিরপরাধী মানুষ। এই সমস্ত রোগের কোনো চিকিৎসা তো ছিলই না বরং বলা হত শীতলা, মনসা ও বিবি মায়ের মতো কিছু দেব দেবীর ব্রত ও পূজা পার্বনের কর্মকাণ্ডে ভুল ত্রুটি হলে তার পরিবর্তে রুষ্ট হয়ে দেবদেবীরা এসব অনিষ্ট দুরারোগ্য ব্যাধির সৃষ্টি করেন। তাই ভক্তি সহকারে ধুমধাম করে তাদের পূজা ও সন্তুষ্টিতে এহেন রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে এমন ধ্যান ধারণায় শীতলা বনবিবির ন্যায় মনসার ও সামাজিক গুরুত্ব অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছিল।

4. মনসা ভয়াল, ভয়ঙ্কর সর্পের দেবী রূপে জগতে পূজিতা হয়ে আসছে। কিন্তু মনসা মঙ্গল কাব্যের একেবারে শেষ মূহুর্তে আমরা এই দেবীর একটু বিপরীত চরিত্র খুঁজে পায়। চাঁদ বনিকের সমস্ত বিষয় সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার কাহিনী বঙ্গের কোনোও নারীর অজানা নয়। বেহুলার সতীত্ব ও সত্য বচন রক্ষার্থে চাঁদ সওদাগর মনসাকে বাম হাতে পূজা দেয়। চাঁদ সওদাগরের মনসা পূজার পরিবর্তে মনসা যখন সন্তুষ্ট হয়ে লক্ষীন্দর সহ ছয় পুত্রের জীবন ফিরিয়ে দিল, তার প্রিয় বন্ধু শঙ্কর গারুরীর জীবন ফিরিয়ে দিল, সপ্ত ডিঙ্গার প্রতি ডিঙ্গা জলে ভাসিয়ে দিল এবং মহাজ্ঞান মন্ত্র সহ হাতি শালের হাতি, ঘোড়া একে একে সব ফিরিয়ে দিল এসমস্ত ঘটনায় আমরা কাহিনীতে আমরা মনসার ভক্ত বাৎসল্য রূপ খুঁজে পাই। সেই হারানো কাঙ্ক্ষিত সুখ সমৃদ্ধি ও শান্তি পুনরায় ফিরে পাওয়ার অবিশ্বাস্য আশায় দক্ষিণ বঙ্গে মনসার দেবীর পূজা খুবই শীঘ্রই জনপ্রিয়তা লাভ করে।

5. মনসার প্রধান অনুচর কাল সর্প। যা বংশবৃদ্ধি ও বংশগতির ধারাবাহিকতার অগ্রগতির বিশেষ প্রতীক। স্নেহ বাৎসল্য়ময়ী এক পুত্র সন্তানের বা কন্যার সন্ততির জননী হওয়ার আশা বা বাসনা প্রতিটি সধবা রমনীর মনে থাকে। সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, ব্যা থা বেদনায় সে মনসার কাছে আকুণ্ঠ ভরে প্রার্থনা করে শুধুমাত্র একটি পুত্র বা কন্যাহ পাওয়ার আশায়।

6. দেবী ভাগবত বা দেবী পুরাণে দুই হিন্দু দেবীর সন্ধান পাওয়া যায় যাদের প্রধান বাহন শ্বেত হংস। এই দুই দেবীর একদিকে মা স্বরস্বতী ও অন্য দিকে মা মনসা। যদিও দেবী স্বরস্বতী বৈদিক যুগের সুরের আরাধ্য দেবী। তার প্রধান বাহন হংস হলেও এযুগের লোক দেবী মনসারও প্রধান বাহন হংস। হিন্দু সম্প্রদায়ের আর দশ বিশটি দেব দেবীদের ভিন্ন ভিন্ন বাহন দেখা গেলেও শ্বেত হংস সচরাচর নম্র, ভদ্র ও শ্বেতশুভ্র শান্তির পথিক। পঙ্কিল সলিলে হংস যেমন তার প্রয়োজনীয় খাদ্যেবস্তু গ্রহন করে অপ্রয়োজনীয় খাদ্য্বস্তু পরিত্যা্গ করে। তৎরূপ ভক্ত বাৎসল্য ময়ী এই মনসা ভক্তদের মন কেই ভালোবাসে, কোনো পূজার বাহ্যিক আড়ম্বরে নয়। তাই তার ভক্তদের একাংশ বিনম্র ভক্তি ও শ্রদ্ধায় তাঁকে পূজা করে।

7. দক্ষিণাঞ্চলের লোক সঙ্গীতের আসরে এক শ্রেণীর সঙ্গীতজীবি সম্প্রদায়ের কাছে এই দেবীর গুরুত্ব অসীম। মনসামঙ্গল কাহিনীর মূল মাহাত্ম্য কথা মনসার গান আজ বাংলার কোণায় কোণায় প্রচলিত রয়েছে। পূর্বে এই পালাগান সিঙ্গেল পাঁচালির মতো করে গান ও অভিনয়ের প্রথা প্রচলন থাকলেও বর্তমানে শ্রোতাদেরকে রসাপ্লুত ও দৃষ্টিগোচরে অত্যঁন্ত আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য যাত্রাপাঁচালির প্রচলন শুরু হয়েছে। এহেন লোক শিল্পীরা বছরে প্রায় সত্তর, আশি, এমনকি একশো পালা পর্যন্ত মনসা, শীতলা ও বনবিবির গান করে তাদের সংসার খরচ বহন করে আসছে। তাই এদিক দিয়ে এই দেবীর সামাজিক গুরুত্ব অনেক খানি।

(গ্রন্থঋণ :-বাংলা মঙ্গল কাব্যেওর ইতিহাস – ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য ও সুন্দরবনের লোকদেবতা – ড . দেবব্রত নস্কর।)