লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী এর সকল পোস্ট

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী সম্পর্কে

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। গল্প ও রম্য রচনা আর ছোট গল্প লিখেন। বহু একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। অন্ধকারের অন্তরালে, সমাজের শত্রু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু যাত্রাপালা -সোনা ডাকাত, শ্মশানে জ্বলছে স্বামীর চিতা উল্লেখযোগ্য। কবির অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিচারক মণ্ডলী তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী একাধারে কবি ও অপর দিকে লেখক। তার লেখা “আমার গাঁ আমার মাটি”, আমার প্রিয় শহর জামুরিয়া, আমার প্রিয় শহর কুলটি, আমার প্রিয় শহর আসানসোল, আমার প্রিয় শহর রাণীগঞ্জ বহু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই ধর্মে আলাদা হলেও আমরা সবাই ভাই ভাই।

ভাদু গানের আসর আমার গীতিকবিতা (সপ্তম পর্ব)

ভাদু গানের আসর আমার গীতিকবিতা (সপ্তম পর্ব)
কথা – আঞ্চলিক সুর – অপ্রচলিত

কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

চল ভাদু জল আনত্যা যাব, অজয় লদীর ওই ঘাটে।
মাঠ্যের আল্যে ছাগল চরে ফকির ডাঙার ধানখ্যাতে।

ভাদু ধীরে চল,
অজয় লদীতে বহ্যাছ্যা কত্তো জল।
লদীর জলে পড়্যা গ্যালে পাবি নাকো থল।

জল ভর জল ভর ভাদু তুমার কাঁখের কলসীত্যা।
সিনান করে জল ভরে আসবেক ভাদু বাড়িত্যা।।

ভাদু ধীরে চল,
অজয় লদীতে বহ্যাছ্যা কত্তো জল।
লদীর জলে পড়্যা গ্যালে পাবি নাকো থল।

লদীর ঘাটে কালী মন্দির লিতুই জুড়া পাঁঠা বলি হয়।
সাঁজ্যের বেলায় ঘন্টা বাজে রাত বিরেতে লাগে ভয়।।

ভাদু ধীরে চল,
অজয় লদীতে বহ্যাছ্যা কত্তো জল।
লদীর জলে পড়্যা গ্যালে পাবি নাকো থল।

অজয় লদীর ধারে ধারে শাল পিয়াল কুলের বন।
আসছ্যে বছর এমন দিনে আনব্য ঘুরাঁই ভাদুধন।।

ভাদু ধীরে চল,
অজয় লদীতে বহ্যাছ্যা কত্তো জল।
লদীর জলে পড়্যা গ্যালে পাবি নাকো থল।

ভাদু গানের আসর আমার গীতিকবিতা (ষষ্ঠ পর্ব)

ভাদুর গল্প বিশ্বাস করতে বড়ো সাধ হয়। কেউ বলে- ভাদু শোকে আত্মঘাতী হয়েছে নদীর জলে। কেউ বলে, আকাশ থেকে মাটিতে নেমেছিল ভাদু, আবার ফিরে গেছে আকাশেই। কেউ আবার বলে ভাদু ভেসে গেছে নদীর কান্নার সঙ্গে। সেই থেকে ভাদুর গান ভাসতে ভাসতে ছড়িয়ে পড়ল গ্রাম বাংলায়।

যদিও, বীরভূমে গেলে দেখা যাবে ভদ্রাবতী নাকি পুরুলিয়ার নন, হেতমপুরের রাজকন্যে। বর্দ্ধমানের রাজপুত্রকে মন দিয়েছিল সে। ইলামবাজারের কাছে চৌপারির শালবনে ডাকাতরা যখন মেরে ফেলল রাজুপুত্রকে, তখন তাঁর সঙ্গেই সহমরণে গেছিল ভদ্রাবতী। সেই যন্ত্রণার ইতিহাসই নাকি বোনা ভাদু গানে।

ভাদু গানের আসর আমার গীতিকবিতা (ষষ্ঠ পর্ব)
কথা – আঞ্চলিক সুর – অপ্রচলিত

কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

তুরা আয় আয় আয়,
ভাদু পুজব্য আয়,
ভাদুর গলায় গেন্ধা ফুলের মালা দিবি আয়।

আয় আদুরী আয় কাজুরী ভাদুপূজা করব্য আয়,
গেন্ধা ফুলের মালা গাঁথে পরাব্যঅ ভাদুর গলায়।

তুরা আয় আয় আয়,
ভাদু পুজব্য আয়,
ভাদুর গলায় গেন্ধা ফুলের মালা দিবি আয়।

বাড়ির নামু গয়ল্যা পোখর ধারে ধারে কলাগাছ,
আমার ভাদু খায় না খাড়ি খেতে দিব পোনামাছ।

তুরা আয় আয় আয়,
ভাদু পুজব্য আয়,
ভাদুর গলায় গেন্ধা ফুলের মালা দিবি আয়।

আঁচিলে পাঁচিলে কত পোরুলের ফুল ফুটেছ্যা,
পোরুল ভাজা খেতে মজা জিভে জল আসিছ্যা।

তুরা আয় আয় আয়,
ভাদু পুজব্য আয়,
ভাদুর গলায় গেন্ধা ফুলের মালা দিবি আয়।

গুড় বাতাসা ফুল বাতাসা ভাদুকে দিব কলাপাকা,
চিড়া গুড় আর দুধের চাঁছি কুলুঙ্গিতে আছে রাখা।

তুরা আয় আয় আয়,
ভাদু পুজব্য আয়,
ভাদুর গলায় গেন্ধা ফুলের মালা দিবি আয়।

ভাদু গানের আসর আমার গীতিকবিতা (পঞ্চম পর্ব)

ভাদু পরবের ও মূল সম্পদ এই ভাদু গানগুলো। এই ভাদুর গানগুলো বেশিরভাগই প্রচলিত। একসময় এক মাসব্যাপী ভাদু গানের আসর বসত কাশীপুর রাজবাড়িতে। এই গানগুলোর মধ্যে বাড়ির মেয়েদের সাংসারিক, সামাজিক, গার্হস্থ্য জীবনের না সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশার কথা খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়।

ভাদু গানের আসর আমার গীতিকবিতা (পঞ্চম পর্ব)
কথা – আঞ্চলিক সুর – অপ্রচলিত
কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ভাদর মাসে আনব্য ভাদু, রাখব্য কুলির মাঝে বড়তলাতে,
চিড়া গুড় আর ফুল বাতাসা দিব মাটির মালসা ও হলাতে।

দোমাহানির ধানখ্যাতে
তিন পাংখা জাহাজ নেম্যেছ্যা………
আমার ভাদু দ্যাশে যাবেক, তাই তো ভাদু সেজেছ্যা।

ও ভাদু মা ও ভাদু মা তুমি অ্যাত্তো দিন ছিলে কুথায়,
বিদ্যাশে যেয়ে ক্যামন ছিলে শুন্যা জীবন যায় জুড়ায়।

দোমাহানির ধানখ্যাতে
তিন পাংখা জাহাজ নেম্যেছ্যা………
আমার ভাদু দ্যাশে যাবেক, তাই তো ভাদু সেজেছ্যা।

বাড়ির নামু লারকেল গাছটি কত লারকেল ধরেছ্যা,
বিদ্যাশ থিকা আসছ্যা ভাদু, লারকেল লাড়ু রাখিছ্যা।

দোমাহানির ধানখ্যাতে
তিন পাংখা জাহাজ নেম্যেছ্যা………
আমার ভাদু দ্যাশে যাবেক, তাই তো ভাদু সেজেছ্যা।

জল খেতে দে ভাদুকে লারকেল লাড়ু ও বাতাসা,
রাখা আছে কুলুঙ্গিতে মুড়ি -মুড়কি আর খই ভাজা।

দোমাহানির ধানখ্যাতে
তিন পাংখা জাহাজ নেম্যেছ্যা………
আমার ভাদু দ্যাশে যাবেক, তাই তো ভাদু সেজেছ্যা।

বিদ্যাশ থিকা অ্যালে ভাদু কি আনিছ্য আমার লেগে,
তুমার তরে ঘুম আসে না তাই থাকি রাইত জেগে।

দোমাহানির ধানখ্যাতে
তিন পাংখা জাহাজ নেম্যেছ্যা………
আমার ভাদু দ্যাশে যাবেক, তাই তো ভাদু সেজেছ্যা।

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (দশম পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (দশম পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ভাদুপুজো নিয়ে নানা পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। ভাদুকে অনেকেই লক্ষ্মী হিসেবে পুজো করেন। বলা হয় শস্যের দেবী। ধান ওঠার পরই চাষিদের ঘরে তাই ভাদুর আরাধনা হয়। ভাদ্র সংক্রান্তির দিন একটি পাত্রে ফুল রেখে ভাদুর বিমূর্ত রূপ কল্পনা করে পুজো করেন গ্রামের মেয়েরা। আবার বহু জায়গায় লক্ষ্মীর আদলে ভাদু মূর্তিও তৈরি হয়। প্রসাদ হিসেবে তৈরি হয় বিশেষ জিলিপি আর খাজা। পুজোর পর শেষ রাতে নদীতে ভাসানো হয় ভাদুকে। ভাদুর অন্যতম আকর্ষণ হল ভাদুগান।

বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া জেলার অধিকাংশ বাড়িতেই ভাদ্র মাস এলেই একটা উৎসব শুরু হয়ে যায়। মহিলা’রা ছোট ছোট দল বেঁধে ভাদু’র মূর্তি নিয়ে এ বাড়ি সে বাড়ি করে বেরাবে। সে মূর্তি’র হাতে থাকবে ধানের শীষ, মিষ্টি, পান, সঙ্গে থাকবে নাচ, গান, আনন্দ আর তলে তলে ভাদু চলে যাওয়ার বেদনাও। চলে যাওয়ার বলছি, কারণ ভাদুকে নিয়ে যত গল্প আপনি শুনবেন, প্রত্যেকটির শেষ হচ্ছে ভদ্রেশ্বরী বা ভদ্রাবতী’র আত্মহনন দিয়ে। মানে যত ক্ষণ রয়েছে, প্রাণোচ্ছ্বল, আর যাওয়ার বেলা, করুণ সুর।

গল্পে আছে, পুরুলিয়া’র কাশিপুর অঞ্চলের রাজা নীলমণি সিংহ খোঁজ পেয়েছিলেন এই ‘সাক্ষাৎ লক্ষ্মীঠাকুর’-এর। ছোট্ট ভদ্রেশ্বরীতে এমনই মজে গেলেন নীলমণি, যে তাকে মনে মনে রাজকন্যা ভেবে ফেললেন। কিন্তু তার পালক পিতা তো ভদ্রেশ্বরীকে কিছুতেই কাছছাড়া করবেন না, অতএব সে থেকে গেল, ওই গ্রামেই। বড় হয়ে সে প্রেমে পড়ল পাশের গ্রামের অঞ্জনের। নীলমণি মানস-কন্যাকে আরও ভাল হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন, তাই অঞ্জনকে কারাগারে আটক করে রাখলেন। দুঃখিনি ভদ্রেশ্বরী এ বার, দুই সখাকে নিয়ে সারা রাজ্য ঘুরতে লাগল। চোখ খুঁজে চলেছে অঞ্জনকে আর মুখে গান। যদি অঞ্জন এক বার শুনে চিনে ফেলে…যত দিনে অঞ্জনকে মুক্তি দিলেন নীলমণি, তত দিনে ভদ্রেশ্বরী আর নেই, ভাদু হয়ে গিয়েছে, আর তার ওই গান, ভাদু গান।

ওই সব অঞ্চলের রুখা মাটিতে এই ভাদ্র মাসেই আউশ ধান পাকে আর সেই আনন্দ আরও বাড়িয়ে তোলে ভাদু পুজো। ধান চাষ করে ঘরে তোলার কাজটা মূলত পুরুষ’রা করলেও, ভাদু কিন্তু নারী-উৎসব। সারা বছরের হাড় ভাঙা খাটুনির পর এই সময়টাই তো খানিক মুখ তোলার অবসর। আর মুখ তুলে ও দেশের মেয়েরা যা বলেন, তার থোক মানে হল, আজ তাঁদের কেউ কিচ্ছু বলতে পারবে না, এমনকী মরদ’রাও না। আজ শুধুই ‘র্যান্ডম ফুর্তি’। ভাদু গানে বলে ‘ভাদু পুজার দিনে, সারা রাত উড়াব ফুর্তি হে, কাটাব জাগরণে, বাকি আজ রাইখনা কিছু, যা ইচ্ছা মনে, রাখ লোক-লজ্জা, দাও দরজা, মহাপুজা এইখানে…’

যেটা বেশি করে চোখে পড়ছে, তা হল নারী’র মুখের, শরীরেরও, স্বাধীন ভাষা, ভঙ্গি। খেয়াল করলে হয়তো দেখবেন, এই অবস্থা, বছরের অন্য কোনও সময়ে পাওয়া যায় না। এই সময়ে, মহিলা’রা দল বেঁধে উঠোনে জমিয়ে গান বাঁধেন। গান শুরু হয় এক জনের মুখ থেকে, তার পর চক্কর খেতে খেতে যায় অন্যের কাছে, এমনটা চলতে থাকে, যত ক্ষণ না একটা গোটা গান তৈরি হয়ে যাচ্ছে। গান বানাচ্ছেন মেয়েরাই, কিন্তু এখন ও সব অঞ্চলে গেলে দেখবেন, অনেক চটি বই পাওয়া যায় (অনেকটা কিশোর-রফি’র লিরিক বইয়ের মতো), যেখানে ভাদু গানের কথা লিখে ছাপাচ্ছেন কিছু পুরুষও, অবশ্যই নারীর স্বরে। ঠিক যেমন বিচ্ছেদী গানে রাধা’র ব্যথার কথা লেখেন পুরুষ’রা। এই সব গানে যেমন ঝুমুর গানের প্রভাব খুব থাকে, তেমনই দেখা যায় যে রামপ্রসাদী সুরেরও অসম্ভব ঝোঁক। বেশ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কিন্তু এটা, কারণ রামপ্রসাদী গানের ধুয়ো ধরে লোক সঙ্গীতে বিশেষ চর্চা হয় না।

পৌরাণিক ও সামাজিক বিভিন্ন বিষয়কেই ভাদু গানে তুলে ধরা হয়। মূলত পাঁচালির সুরেই চার লাইনের ভাদুগান গাওয়া হয়। সারারাত জেগে গান গাওয়ার পর শেষ রাতে সকলে মিলে ভাদুকে বিসর্জন দিতে যান। সেই সঙ্গে করুণ সুরে সকলে গেয়ে ওঠেন…

‘ভাদু যায়ো না জলে
কোলের ভাদু যায়ো না মোদের ছেড়ে
গটা ভাদর থাকলে ভাদু গো
মা বলে ত ডাকলে না
যাবার সময় রগড় লিলে
মা বিনে ত যাব না’।

www.youtube.com/watch?v=hicuD8Kl74Y

ভাদু গানের আসর আমার গীতিকবিতা (চতুর্থ পর্ব)

ভাদু গানের আসর আমার গীতিকবিতা (চতুর্থ পর্ব)
কথা – আঞ্চলিক সুর – অপ্রচলিত

কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

সখি, কখন এলি?
শ্বশুরঘরে বল না লো ক্যামন ছিলি?

শ্বশুর ভাল শাশুড়ি ভাল গো ….
…………………….আর ভাল দেওরগুলা।
দেওরের দাদা ভাল, ননদিনী গালফুলা।।

সখি, কখন এলি?
শ্বশুরঘরে বল না লো ক্যামন ছিলি?

সকাল দশটায় কাজ যায় উ………
…………………ঘরকে ফিরে আসে সাঁইঝ বেলা।
তার কথা বেশি মনে পড়ে, ঘরে থাকি একেলা।।

সখি, কখন এলি?
শ্বশুরঘরে বল না লো ক্যামন ছিলি?

ত্যাল সাবুন কলসী লিয়ে গো ……
……………………………..গা ধুয়ে আসি পোখরে।
সিনান করে ঘরে ঢুকি বাঁশ ঝোপের পথ ধরে।।

সখি, কখন এলি,
শ্বশুরঘরে বল না লো ক্যামন ছিলি?

রাঁধাবাড়া হল্যা পরে গো ………
……………………………..শাশুড়ি আমার ভাত বাড়ে।
ননদি যায় না স্বামীর ঘরে খায় বসে বাপের ঘাড়ে।।

সখি, কখন এলি,
শ্বশুরঘরে বল না লো ক্যামন ছিলি?

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- 2020 (নবম পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- 2020 (নবম পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

নদীর ধারে একটু জটলা। দূর থেকে ভেসে আসে গান – “কাশীপুরের রাজার বিটি/বাগদি ঘরে কী কর?/কলসী কাঁখে লয়ে পরে/ সুখ সাগরে মাছ ধর।” সারিবদ্ধ মহিলাদের কোলে-কাঁখে ছোট্ট মূর্তি। যেন কচি মেয়েকে কোলে নিয়ে জলাধারে গিয়েছেন মায়েরা। কার মেয়ে কত ভাল, সেই নিয়ে গান বেঁধে লড়াই চলে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই এই গানের রেশ কেটে যায়। জলে ফেলে মেয়ের বিসর্জন হয়ে যায়। চেনা লাগছে গল্পটা? দুর্গা বিদায়ের সঙ্গে মিল পাচ্ছেন?
দেবী দুর্গার আবাহন-বিসর্জনের মতো শস্যদেবী আসেন, আবার চলে যান।

উমার মতোই ভাদুও আমবাঙালির ঘরের মেয়ে। লোক উৎসবের কাহিনিতে কান পাতলে শোনা যায়, কাশীপুরে পঞ্চকোট রাজবংশের রাজা নীলমনি সিং দেও-র কন্যা ভদ্রেশ্বরী। যদিও এ নিয়ে বহু বিতর্ক আছে। সেই বিতর্ক সরিয়ে রেখেই শুধুমাত্র কাহিনির মাধুর্যেই এই পার্বণ হয়ে উঠেছে চিরায়ত, লোকায়ত। তো সেই রাজা নীলমণি সিং দেও কিশোরী কন্যার অকাল প্রয়াণের পর তাঁর স্মৃতি আঁকড়ে রাখতে ভাদু উৎসবের প্রচলন করেন। এখন তাই কাশীপুরেই সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে ভাদুর নিয়মনীতি পালন।

ভাদ্র সংক্রান্তির ঠিক আগে পুরুলিয়া, বাঁকু়ড়ায় পুরোদমে চলছে ভাদুর আরাধনা। তবে এই আনন্দের একতারাতেও আজকাল বিষাদ বেজে ওঠে। না আছে সেকালের গানের কথা, না আছেন গায়ক। ভাদু উৎসব যেন অনেকটাই পঞ্জিকায় পিঞ্জরাবদ্ধ। মেয়ে-বউদের প্রাণের সুর বসানো গানে গানে যেন হঠাৎই সজীব হয়ে উঠত চারপাশ। কিন্তু আজ গান আছে, প্রাণ নেই, সুর গেছে কেটে।

এখন ভাদুর সুরে শোনা যায় বিজ্ঞাপনের কথা – “সিম এসেছে জিও/ এবার কিন্তু যাবার আগেই আমায় একটা দিও/ গত বছর স্পিড ছিল না/ টুজি–থ্রিজির জন্য/ ফোর জি যখন এসে গিয়েছে/ এবার ব্যাপার অন্য।”
আগে পয়লা ভাদ্র থেকেই ভাদুর মূর্তি কিনে ফি সন্ধ্যায় প্রায় রাত পর্যন্ত গান গাইতেন মহিলারা। কাশীপুরের ন’পাড়ার বাসিন্দা শিবানী বাউড়ি বলেন, “আমাদের গান গাওয়ার সঙ্গীরা সব ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছেন। অনেকে মারাও গিয়েছেন। তাই আর আগের মত সমগ্র ভাদ্র মাস জুড়ে গান হয় না। এখন কেবল ভাদ্র শেষে জাগরণেই আটকে গিয়েছে ভাদু গীত।” লোকসংস্কৃতি গবেষক সুভাষ রায়ের কথায়, “তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর বলেছিল, ভাদু গানকে সংরক্ষণ করতে তারা একটা সংকলন করবে। কিন্তু আজও সেই কাজ এগোয়নি। তবে আমার কাছে সংগ্রহ করা আড়াইশো গান রয়েছে।” সেই গানে–গানেই হয়ত আজকের রাত্রি জাগরণ পঞ্চকোটের।

আর উৎসব মানেই তো পেটপুজো। তাই ভাদুকে সামনে রেখে খাজা, কোস্তা, লবঙ্গ লতিকা, গজা, মতিচুরের লাড্ডু, চিনির পুতুল। ভাদুর জাগরণ–বিসর্জনে এই হরেকরকম মিষ্টান্নতে ম–ম করত পঞ্চকোট। এই পঞ্চকোটের রাজসভায় ভাদু উৎসবে পঁচিশ কেজির লাড্ডু তৈরি হত। ভাদুকে দেওয়া হত একান্ন রকমের মিষ্টি। কিন্তু আজ সেসব অতীত। ভাদু জাগরণে মিষ্টি নিয়েও শোনা গেল গান। এই মিষ্টি নিয়েও রয়েছে ইতিহাস। এই পরবের মিষ্টি চেখে দেখতেন স্বয়ং ছোটলাটও। তাই ভাদু পরবের মিষ্টি বানানোকে ঘিরে কম তোড়জোড় ছিল না এই ভাদুভূমে।

সেইসময় পুরুলিয়ার কাশীপুরের পঞ্চকোট রাজপরিবারে যে দোকান থেকে মিষ্টি যেত, সেই দোকানের বর্তমান মালিক চিত্তরঞ্জন দাস মোদক বলেন, “ভাদু–র সময় ছোটলাটের কাছে মিষ্টি পাঠানো হত। দু’কেজি ওজনের লাড্ডু, থালার মত জিলিপি দোকানে সুতোয় বেঁধে ঝোলানো থাকত। এমনকি লাড্ডু–জিলিপির নিলাম হত। সারা ভাদ্র মাস জুড়ে যে কত রকমের মিষ্টি তৈরি করতেন বাপ–ঠাকুরদা! এখন সেসব শুধুই স্মৃতি।”

www.youtube.com/watch?v=FL5GaUk_zXI

ভাদু গানের আসর আমার গীতিকবিতা (তৃতীয় পর্ব)

ভাদু গানের আসর আমার গীতিকবিতা (তৃতীয় পর্ব)
কথা – আঞ্চলিক সুর – অপ্রচলিত

কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ভাদর মাসে ভাদু-পূজা করি আমরা সকলে,
সংক্রান্তিতে বিদায় দিব অজয় লদীর জলে।
আমার ভাদু খেলতে যাবে অজয়ের বড়তলা,
মাঠে যেতে দেখবে ভাদু ওল আর কাঁচকলা।

উপর নামু কুলের গাছটি কুল কেনে ধরে না,
কুলের কাঁটা শক্ত কাঁটা পায়ে লাগলে যাতনা।
চল ভাদু চল হাট যাব হিজলগড়ার উ মাথায়,
ফুল বাতাসা, গুড় বাতাসা বিক্রি হচ্যা দুটাকায়।

ভাদর মাসে ভরা লদী কুলিতে কত যেছ্যা জল,
কুলির জলে ডূবলে পরে পাবি নাকো আর থল।
আয় সরলা আয় মঙ্গলা, কুলিতে বাঁধ বাঁধাবো,
কুলির জলে সিনান করে উঠোনে চুল শুকাবো।

ভাদু তুমি কাঁদছ্য কেনে-
এ বছরে দুগ্গাপূজায় জামদানি শাড়ী দিব কিনে।

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- 2020 (অষ্টম পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- 2020 (অষ্টম পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ভাদু উৎসব ভাদ্র মাসের উৎসব। ভাদ্রমাসের সংক্রান্তির দিনে ভাদু পুজো হয়ে থাকে। ব্রতের ক্ষেত্রে ভাদ্র মাসের প্রারম্ভেই শুরু হয় মেয়েলি ব্রত। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এবং লাগোয়া, বিহার, ঝাড়খণ্ডের দু-একটা জেলায় প্রধানত ভাদু উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

আদিবাসী, সাঁওতালদের মধ্যে করম গান ও উৎসবে পালন করার রীতি রয়েছে বর্ষাকালে। তা-ও বিশেষ ভাবে ভাদ্র মাসে। বর্ষা উৎসবের এই করম গানের হিন্দু সংস্করণ হিসেবে ভাদু গানকে ধরেছেন আশুতোষ ভট্টাচার্য। তিনি ভাদু গানকে আর্যেতর সমাজ উদ্ভূত ধরে, হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতার প্রভাবজাত বলেছেন।

পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুরের কিছু অংশ, আসানসোল মহকুমা, ঝাড়খন্ডের রাঁচি, হাজারিবাগে পালিত হচ্ছে এই উৎসব। কথিত আছে, পঞ্চকোট রাজপরিবারের রাজকন্যা ভদ্রাবতীর বিয়ের দিন বিয়েবাড়িতে ডাকাত পড়ে। সেখানেই খুন হন বরযাত্রী সহ ভদ্রাবতীর স্বামী। আর সেই শোকেই আত্মহত্যা করেন ভদ্রাবতী।

এই ঘটনা স্মরণ করেই ভাদু পুজো।
যাছ যাছ যাছ ভাদু
ক্ষনেক দাঁড়াও আঙিনাতে।
সম্বৎসরের মনের কথা বলব্য তুমার সাক্ষাতে।।”

এই ভাদু পরবের ও মূল সম্পদ এই ভাদু গানগুলো।এই ঝুমুর গানগুলো বেশিরভাগই প্রচলিত।একসময় একমাসব্যাপী ভাদু গানের আসর বসত কাশীপুর রাজবাড়িতে।এই গানগুলোর মধ্যে বাড়ির মেয়েদের সাংসারিক,সামাজিক,গার্হস্থ্য জীবনের না সুখ-দুঃখ,হাসি-কান্না,আশা-নিরাশার কথা খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়।

এই গানগুলোকেও বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করা যায় –
১.আগমনী
২.ভাদু বন্দনা

তাই এই গানগুলো লোকসাহিত্যের অন্যতম সম্পদ। তাই এককথায় বলাই যায় মানভূমের এই পরব এক সার্বজনীন মিলনক্ষেত্র।

www.youtube.com/watch?v=FL5GaUk_zXI

ভাদু গানের আসর আমার গীতিকবিতা-2 কথা – আঞ্চলিক সুর – অপ্রচলিত

ভাদু গানের আসর আমার গীতিকবিতা-2
কথা – আঞ্চলিক সুর – অপ্রচলিত

কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

চল ভাদু চল সিনাতে যাবো অজয় লদীর ঘাটে,
আসার পথে শালুক তুলবো ঐ কাদা ডোবাতে।
আমার ভাদু মান করেছ্যা মানে গেলো সারাদিন,
উপর কুলি নামু কুলি মাঝ কুলিতে আছে সতীন।

চল ভাদু চল খেলত্যা যাব রাণীগঞ্জের বড়তলা,
অমন পথে দেখে আসবি খাদানের ডুলি চলা।
ও ভাদু মা, ও ভাদু মা তোমার কেনে মন ভারি,
চল তুমায় দেখায় আনবো ইস্টিশানের রেলগাড়ি।

আমার ভাদু ছুটু ছ্যালা কাপড় পরত্যা জানে না,
তুদের ভাদু গতর খাকি হয়েছ্যা তাই রাতকানা।
ভাদর মাসে ভাদু এলো কয়লাখাদে আঘাম জল,
পা হড়কে পড়্যা যাবি তাই তো বলি ধীরে চল।

ভাদু করি গো মানা,
উ পাড়াতে সতীন আছে পান দিলে পান খেয়ো না।

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (সপ্তম পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (সপ্তম পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ভাদু আদতে লোকজীবনের সঙ্গে লেপ্টে থাকা মেয়েদের গান। শুধু তাই নয়, ভাদু আসলে লোকউৎসবও। যে গান, যে উৎসবের গড়ন, রীতি ঐ রাজপরিবারের দরবার ছাড়িয়ে নেমে এসেছে মাটিতে। এ কেমন করে সম্ভব? ভদ্রাবতীকে নিয়ে আরেকটি গল্পে হয়তো রয়েছে এর ইঙ্গিত। সেই গল্পে ভদ্রাবতী রাজার ঔরসজাত রাজকন্যে নয়।

লাড়া গ্রামের মোড়ল এক ভাদ্রমাসে ধানখেতের আলের পাশ থেকে কুড়িয়ে পেলেন ফুটফুটে এক কন্যাসন্তানকে। তাকে কোলে নিয়েই মোড়ল বুঝলেন, শিশুটি সদ্যোজাত। কে জানে, হয়তো এই উর্বরা ভূমিই জন্ম দিয়েছে তার। যেভাবে ভূমি জন্ম দিয়েছিল সীতারও। মোড়ল শিশুটিকে নিয়ে এলেন ঘরে। সেই ভাদ্র ছিল রোদে পোড়া, খটখটে। কিন্তু, এই মেয়ে ঘরে আসতেই বৃষ্টি এল ঝেঁপে। ধান হল খুব। সবাই বললে, এ মেয়ে ভারী লক্ষ্মীমন্ত। মোড়ল-দম্পতি মেয়ের নাম দিলেন ভদ্রাবতী। ডাকনাম ভাদু। ভাদুর রূপ হল খুব। চাষির ঘরে এমন রূপ মানায় না। রাজা নীলমণি সিংদেওর কানেও গেল ভাদুর কথা। মন্ত্রী ধ্রুবচাঁদকে রাজা বললেন, ওই মেয়েকে তিনি দত্তক নেবেন। রাজপরিবারই ওর যোগ্য স্থান। কিন্তু, ভাদু কিছুতেই যেতে চাইল না বাবা-মাকে ছেড়ে। তখন রাজা গ্রামে-গ্রামে ঢেঁড়া পিটিয়ে বলে দিলেন, রাজপ্রাসাদে না থাকলেও ভদ্রাবতী রাজকন্যেই।

ভাদু তখন ষোড়শী। তার কানে উজিয়ে আসে বাঁশির সুর। গ্রামের কবিরাজের ছেলে অঞ্জন সেই বংশীবাদক। মন দেওয়া-নেওয়া হয়। ইতিমধ্যে, হইহই করে পঞ্চকোটেও এসে পড়ে ১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহের আগুন। বিদ্রোহে মদত দেওয়ার অভিযোগে ইংরেজদের হাতে বন্দি হন রাজা নীলমণি সিংদেও। রাজা বন্দি, এদিকে রাজকন্যে প্রেমে পড়েছে কবিরাজপুত্রর। মন্ত্রী ধ্রুবচাঁদের দুশ্চিন্তা বাড়ে। রাজা মুক্তি পেতেই সে জানায় সবটা। ক্রুদ্ধ রাজা বন্দি করেন অঞ্জনকে।

অঞ্জনের কয়েদের খবরে ছুটে আসে ভদ্রাবতী। তার করুণ আকুতিতেও মন গলে না রাজার। তখন ভাদু, দিনের পর দিন হৃদয় নিঙড়ানো করুণ গান গেয়ে ঘুরতে থাকে কয়েদখানার চারপাশে। সেই গানে একদিন মন গলল রাজার। অঞ্জনকে মুক্তি দিলেন তিনি। কিন্তু, ভাদুর খোঁজ আর মেলে না। কেউ বলল, ভাদু শোকে আত্মঘাতী হয়েছে নদীর জলে। কেউ বলল, আকাশ থেকে মাটিতে নেমেছিল ভাদু, আবার ফিরে গেছে আকাশেই। বাকিরা বলল, ভাদু ভেসে গেছে নদীর কান্নার সঙ্গে। সেই থেকে ভাদুর গান ভাসতে ভাসতে ছড়িয়ে পড়ল বাংলাদেশের নানান কোণে।

এই গল্প বিশ্বাস করতে বড়ো সাধ হয়। যদিও, বীরভূমে গেলে দেখা যাবে ভদ্রাবতী নাকি পুরুলিয়ার নন, হেতমপুরের রাজকন্যে। বর্দ্ধমানের রাজপুত্রকে মন দিয়েছিল সে। ইলামবাজারের কাছে চৌপারির শালবনে ডাকাতরা যখন মেরে ফেলল রাজুপুত্রকে, তখন তাঁর সঙ্গেই সহমরণে গেছিল ভদ্রাবতী। সেই যন্ত্রণার ইতিহাসই নাকি বোনা ভাদু গানে।

www.youtube.com/watch?v=HzCUvwC7fUg

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (ষষ্ঠ পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (ষষ্ঠ পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

কাশীপুরে দেখে আইলাম / দালান কোঠায় টিকটিকি / এমনই বাবার বিবেচনা / এক জামাইকে দুই বিটি। লালপাড় শাড়ি পরে কোমর দুলিয়ে ঢোলের নিখুঁত বোলের সঙ্গে গাইছেন শঙ্করী দাস, কুমকুম দাসরা। কাটোয়ার চুড়পুনি গ্রামের দাসপাড়ার অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের মহিলারা বছর বছর ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিন ভাদু গাইতে বেরিয়ে পড়েন। মাটির তৈরি ভাদু ঠাকরুণকে নিয়ে। কাটোয়া মহকুমার নানা গ্রাম ঘুরে পয়লা আশ্বিন গঙ্গায় স্নান করে ঘরে ফেরেন।

ভাদু গানের মতো পুরনো লোকগানকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছে চুরপুনি দাসপাড়া। বিভিন্ন জায়গায় ভাদু দলে পুরুষরা মেয়ে সেজে গান–নাচ করেন। কিন্তু চুড়পুনির ভাদু গাওনার পুরো দলটিই মহিলাদের। দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারের ১৩ জন মহিলার দলটি ভাদ্র মাস পড়লেই সংসারের যাবতীয় কাজ সামলে মহড়া শুরু করে দেন। মূল গায়েন শঙ্করী দাস গান ধরেন, মাটি ফুঁড়ে জল সরে / ভাদুকে কে সাজাইছে। দলের অন্যান্য সদস্য সুমিত্রা দাস, কুমকুম দাসরা ধরতাই দেন, সেই জলে জমি আবাদ হছে / ভাদুকে কে সাজাইছে।

কাটোয়ার লোকসংস্কৃতি গবেষক রণদেব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘ভাদুকে সামনে রেখে গাওনার দলের সদস্যরা তাঁদের রাগ–দুঃখ–জ্বালা–অভিমান–আনন্দ গানের মাধ্যমে তুলে ধরেন। এই গানে গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার প্রকৃত ছবিটা ধরা পড়ে। শস্যকন্যা ভাদুর মধ্যে নিজেকে খোঁজার এই ধারাটিই ভাদু গানের নজরটানা বৈশিষ্ট্য। শুধু কাটোয়া মহকুমাই নয়, দক্ষিণবঙ্গের বীরভূম, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, পুরুলিয়া জেলাতেও ভাদ্র মাসজুড়ে ভাদু গানের উৎসব চলে।’ গায়িকা শঙ্করী–কুমকুমরা প্রশাসনকে কুর্নিশ জানিয়েছেন। তঁারা বলেন, ‘আমাদের দলে সকলে মহিলা।

কিন্তু আমরা নিরাপদেই গ্রামে গ্রামে ঘুরতে পারছি। এটা খুবই ভাল ব্যাপার।’ ভাদুকে ফসলের প্রতীক হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। শ্রাবণ মাসে ধান রোয়া–সহ চাষবাস শেষ হয়ে যায়। ভাদ্র মাসটা কৃষক পরিবারের সদস্যদের কাছে অখণ্ড অবসর। সেই অবসর যাপনের জন্য বিনোদন হিসেবে ভাদু গানের উৎপত্তি বলে মনে করেন লোক গবেষকরা। ভাদু–মূর্তিকে সামনে রেখে ফসল ভাল হওয়ার প্রার্থনা করেন শিল্পীরা। অঝোর বৃষ্টি চান গানে গানে, চল্ ভাদু চল্ / মেঘে এল জল / ভিজে গেল দামি শাড়ি / ভেঙে গেল মল। কাটোয়ার বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি বলেন, ‘বর্তমান রাজ্য সরকার ভাদু–সহ বাংলার বিভিন্ন লোকসংস্কৃতি বঁাচাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছেন। লোকশিল্পীদের মাসোহারার ব্যবস্থা করেছেন। বাংলার লুপ্তপ্রায় লোকসংস্কৃতির শাখাগুলিকে বঁাচাতে এমন পদক্ষেপ এর আগে কেউ নেয়নি।’

ভাদু গান গেয়ে ঘুরে বেড়ানোর শিল্পীরা কোনও পারিশ্রমিক দাবি করেন না। যার যা মন চায় দেন শ্রোতা–দর্শকরা। তাতেই খুশি শিল্পীরা। তবে দক্ষিণা দাবির কৌশলটিও বেশ। দাবি করা হয় গানের কলিতেই, ভাদু লে লে লে পয়সা দু’আনা / কিনে খাবি মিছরিদানা। সেই আবেদনে পয়সার বটুয়া উপচে পড়ে। শিল্পীদের হাসি চওড়া হয়। টিভি–মোবাইলের যুগেও মানুষ ভাদু গান শুনছেন, এটাই শিল্পীদের প্রাপ্তি। সেই প্রাপ্তির আনন্দই গানে গানে ঝরে, এক পিঠ চুল ভাদুর / পিঠের পরে রহে না/ শাশুড়িতে তেল দেয় না / চুলের যতন জানে না।

www.youtube.com/watch?v=6hhY_72Olx0

মহান ৫ই সেপ্টেম্বর ও শিক্ষক-দিবস সকল শিক্ষককে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম

মহান ৫ই সেপ্টেম্বর ও শিক্ষক-দিবস
সকল শিক্ষককে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম

তথ্য সংগ্রহ, সম্পাদনা ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

বিশ্বব্যাপী ৫ই অক্টোবর শিক্ষক দিবস পালিত হলেও, ভারতে এই দিবসটি পালিত হয় ৫ই সেপ্টেম্বর। ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি ও দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি তথা প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ডঃ সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণের জন্মজয়ন্তী ৫ই সেপ্টেম্বর। সেদিনই শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ গড়ার উদ্দেশে শিক্ষকদের অবদানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জাহিরের জন্যই এই দিনটি শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হয়।

শিক্ষক দিবসের ইতিহাস:
১৯৬২ সালে ডঃ সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণ ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হয়েছিলেন। শোনা যায়, কয়েকজন ছাত্র, বন্ধুবান্ধব প্রখ্যাত শিক্ষাবিদের জন্মদিন পালন করতে চেয়েছিলেন। সেই সময় রাধাকৃষ্ণণ জানিয়েছিলেন, তাঁর জন্মদিন আলাদাভাবে পালন না করে সেই দিনটি দেশের সব শিক্ষকের জন্য পালন করা হলে তিনি গর্ববোধ করবেন। এই আবেদন শিক্ষকদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও সম্মানকেই প্রকাশ করে। তাই ১৯৬২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ডঃ রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিন শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করা হতে থাকে। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদেরই শিক্ষক হওয়া উচিত।

ডঃ সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণ সম্পর্কে কিছু তথ্য:

• ডঃ সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণের বাবা তাঁর ইংরেজি শিক্ষা ও স্কুল যাওয়ার বিরোধী ছিলেন। ডঃ রাধাকৃষ্ণণের বাবা চেয়েছিলেন, ছেলে পুরোহিত হোক।
• মেধাবী ডঃ রাধাকৃষ্ণণ নিজের অধিকাংশ পড়াশোনাই ছাত্রবৃত্তির সাহায্যে পুরো করেছিলেন।
• ডঃ রাধাকৃষ্ণণ পড়ুয়াদের মধ্যে এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে, তাঁর কলকাতা যাওয়ার সময় তাঁকে ফুলে সাজানো গাড়িতে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রেল স্টেশন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
• প্রখ্যাত অধ্যাপক এইচ. এন. স্পেলডিঙ্গ ডঃ রাধাকৃষ্ণণের ভাষণের এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর জন্য চেয়ার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
• শিক্ষাক্ষেত্রে অভূতপূর্ব যোগদানের জন্য ১৯৩১ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করে।
শিক্ষক দিবস সম্পর্কে কিছু জানা-অজানা তথ্য:
• ৫ই অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হয়। জার্মানি, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, রোমানিয়া, সার্বিয়ার মতো কয়েকটি দেশে সেই দিনে শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। তাছাড়া বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে পৃথক পৃথক তারিখে শিক্ষক দিবস পালিত হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষক দিবস পালিত হয় লিবিয়া, মরক্কো, আলজেরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো দেশে।
• শিক্ষকদের অবদানকে সম্মান জানাতে ১৯৯৪ সাল থেকে ৫ই অক্টোবর ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালন শুরু করে ইউনেস্কো।
• ১৯৪৪ সালে আমেরিকার মৈটে ওয়ায়েটে উডব্রিজ সর্বপ্রথম শিক্ষক দিবসের পক্ষে সওয়াল করেন। পরে ১৯৫৩ সালে মার্কিন কংগ্রেস তাতে সায় দেয়। ১৯৮০ সাল থেকে ৭ই মার্চ শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করা শুরু হয়। কিন্তু পরে মে মাসের প্রথম মঙ্গলবার এটি পালিত হতে থাকে। সিঙ্গাপুরে সেপ্টেম্বরের প্রথম শুক্রবার শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হয়। আফগানিস্তানে ৫ই অক্টোবরই এই দিনটি পালিত হয়।

সারাবছরই আমাদের জীবনে তাঁরা থাকেন প্রবলভাবে। কখনও ভুল ধরিয়ে দেন, কখনও নতুন জিনিস শিখিয়ে দেন, কখনও বকুনি দেন, কখনও আবার স্নেহের সঙ্গে নিজের কাছে টেনে নেন। প্রত্যেকের জীবনেই শিক্ষকরাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষক দিবস হল সেই বিশেষ মানুষ-পথপ্রদর্শকদের আরও একবার শ্রদ্ধা জানানোর দিন।

আমার কবিতা শিক্ষাচার্যের প্রতি
কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

শিক্ষার আলোক তুমি শিক্ষার জগতে,
জ্ঞানের বর্তিকা তুমি সেই জানে চিত্তে
অজ্ঞান যে। হে শিক্ষক, জ্ঞানদাতা তুমি
তব করুণায় জ্ঞান, লভিয়াছি আমি।

বিদ্যার প্রদীপ তুমি জ্বালিয়াছ আলো,
শিখেছি বুঝেছি যত সবকিছু ভালো।
তব আশীর্বাদে আমি বিদ্যাভ্যাস করি,
তোমার দয়ার দানে ভাসালাম তরী।

বন্দিব আচার্য্য আজি তব শ্রীচরণ,
জানাই বিনতি শ্রদ্ধা করিনু জ্ঞাপন।
যা কিছু সকলি মম সব তব দান,
তব শ্রীচরণে আজি জানাই প্রণাম।

শিক্ষক দিবস আজি, তাই জোড় করে,
হে শিক্ষক! শিক্ষাদাতা প্রণমি তোমারে।

ভাদু গানের আসর আমার গীতিকবিতা-১

ভাদু গানের আসর আমার গীতিকবিতা-১
কথা – আঞ্চলিক সুর – অপ্রচলিত (তাল- দাদরা)

কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ও ভাদু মা ও ভাদু মা ফেলছো কেনো চোখের জল,
কি হয়েছে বলো মা আমায় খেতো দেবো রম্ভা ফল।
ও ভাদু মা ও ভাদু মা……..

আমার ভাদু রাগ করেছে কথা সে আর কইবে না,
ও ভাদু মা এই বয়েসে রাগ করা আর সাজে না।
ও ভাদু মা ও ভাদু মা……..

ও পাড়া যেও না ভাদু মা, ও পাড়া যেতে মানা,
ও পাড়াতে সতীন আছে ধরলে পরে ছাড়ে না।
ও ভাদু মা ও ভাদু মা……..

ওপর কুলি নামু কুলি মাঝ কুলিতে গোল হচ্যা,
আমার ভাদু ছুটু ছ্যালা ঘরে ফিরতে লারিছ্যা।
ও ভাদু মা ও ভাদু মা……..

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- 2020 (পঞ্চম পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- 2020 (পঞ্চম পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ভাদুর রাত জাগরণ এই উৎসবের অন্যতম আকর্ষণীয় অংশ।ত্রিশ দিন ধরে ভাদুকে পুজো করার পর কাল ভাদুকে বিদায়ের দিন।তাই পাড়ায় পাড়ায় চলে নিশি জাগরণ।ভাদুর উপাসক মেয়েদের কাছে ভাদু হয়ে ওঠে কখনও মা,কখনও মেয়ে আবার কখনও দেবী।তাই গানের মাধ্যমে তাদের আদরের ভাদুর কাছে নিবেদন করে তাদের সুখ-দুঃখ,অভাব-অভিযোগ।

অবিচ্ছিন্ন ভাবে সারারাত ধরে চলতে থাকে ভাদু গানের ফোয়ারা।রাত কেটে হয় ভোর,ভোর থেকে সকাল এগিয়ে আসে ভাদুকে বিদায়ের মুহূর্ত।

সারারাত ব্যাপী রাতজাগরণের পর বাড়ির মেয়েরা সকালে ভাদুকে বিসর্জন দেয়ার জন্য তৈরি হয়।এই সময় তা বড় আবেগঘন মুহুর্ত তাদের কাছে।তাই আবেগরুদ্ধ কন্ঠে গেয়ে ওঠে ভাদুর বিদায় সঙ্গীত।

“তিরিশ দিন রাইখলাম ভাদু তিরিশ টিফুল দিয়ে
আর ত রাইখতে লাইরবঅ ভাদু চাতা হইলঅ বাদী গো।”

ভাদু কে বিসর্জন দেওয়ার আগে ভাদু র মৃন্ময় মূর্তিকে বাড়ির ও গ্রামের সবাই বরণ করে। একে বলা হয় চুমানো। এরপর ভাদু কে মাথায় করে সারাগ্রাম ঘুরে ভাদু কে কোনও নদীতে বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। জলাশয়ে আদরের কন্যাকে বিদায় দিয়ে সমস্ত গ্রামের মহিলারা সমবেতভাবে আবেগঘন কন্ঠে গেয়ে ওঠে-
আন্যেছি শখের ভাদু,রাখ্যেছি ঘরে।
পুরাব মনের আশা,ভাঁসাব জলে।।

ভাদুকে জলে বিসর্জন দেওয়ার পর চিড়া-গুড়-ঘি-মধু-বাতাসা মাখানো প্রসাদ বিতরণ করা হয় সকল গ্রামবাসীদের। ভাদু পুজোয় ভাদুকে ভোগ নিবেদন।
ভাদুর মূল প্রসাদই হল প্রমাণ সাইজের জিলিপি এবং মিষ্টি খাজা।

এই ভাদু পরবের ও মূল সম্পদ এই ভাদু গানগুলো।এই ভাদুর গানগুলো বেশিরভাগই প্রচলিত। একসময় একমাসব্যাপী ভাদু গানের আসর বসত কাশীপুর রাজবাড়িতে।এই গানগুলোর মধ্যে বাড়ির মেয়েদের সাংসারিক,সামাজিক,গার্হস্থ্য জীবনের না সুখ-দুঃখ,হাসি-কান্না,আশা-নিরাশার কথা খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়।

https://www.youtube.com/watch?v=vdQE4RiU-xI&list=RDvdQE4RiU-xI&start_radio=1&t=24

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (চতুর্থ পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (চতুর্থ পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ভাদুর সময়কাল ও ভাদু পালন:
ভাদু পুজো প্রতি বছর ভাদ্র সংক্রান্তিতে জাঁকজমক সহকারে অনুষ্ঠিত হয়। যদিও এর প্রস্তুতি শুরু হয়ে প্রায় এক মাস আগে থেকেই। ভাদ্র মাসের শুরু থেকেই গ্রামের বাড়ির একটি নির্দিষ্ট স্থানে ভাদুর পিঁড়ি বা চৌকি স্থাপন করে। প্রতিদিন স্নান করে এসে বাড়িয়ে সকল মেয়েরা ভাদু পিঁড়িতে ফুল দিয়ে, ধুপ জ্বালিয়ে ভাদুর উদ্দেশ্যে প্রণাম করে এবং ভাদু গান গেয়ে চলে আরাধনা।

এই ভাবে একমাসব্যাপী চলার পর অবশেষে আসে ভাদ্র মাসের সংক্রান্তি। তবে এর আগের দিন হয় ভাদু ‘রাত জাগরণ’। এই দিন সকাল বেলা বাজার থেকে পিঁড়িতে ভাদুর মৃন্ময় মূর্তি কিনে এনে, তাকে মনের মত করে ফুল-মালা দিয়ে সাজিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর সারারাত ধরে চলে গানের মাধ্যমে চলে ভাদু র আরাধনা।

“তিরিশ দিন রাইখলাম ভাদু তিরিশ টিফুল দিয়ে
আর ত রাইখতে লাইরবঅ ভাদু চাতা হইলঅ বাদী গো।”

তবে ভাদু কে বিসর্জন দেওয়ার আগে ভাদু র মৃন্ময় মূর্তিকে বাড়ির ও গ্রামের সবাই বরণ করে। একে বলা হয় চুমানো। এরপর ভাদু কে মাথায় করে সারাগ্রাম ঘুরে ভাদু কে কোনও নদীতে বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।

ভাদুকে বিসর্জনের আগে আরও একবার গ্রামের সবাই মেতে ওঠে ভাদু গান ও নাচে। এরপরই তাদের আদরের ভাদু ধন কে বিদায় দেওয়ার পালা, যদিও তাদের মন চায় না। তবুও নিয়ম তো মানতেই হয়।গ্রামের কোনো মহিলা ভাদুকে মাথায় নিয়ে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে জলাশয়ে।

জলাশয়ে আদরের কন্যাকে বিদায় দিয়ে সমস্ত গ্রামের মহিলারা সমবেতভাবে আবেগঘন কন্ঠে গেয়ে ওঠে-
“যাছঅ যদি ভাদুমনি কাঁদঅ কেনে অকারণ।
আর বছরে থাকি যদি আইনব গো প্রাণধন।”

www.youtube.com/watch?v=lrSzhR8f4pk