মোকসেদুল ইসলাম এর সকল পোস্ট

মুহূর্তকাল

ছায়ার মতোন একটা দীর্ঘশ্বাস
বাড়ছে – কমছে
বিলাসী বদনামে যাচ্ছি ডুবে
রোদের বাক্সে গুছিয়ে নিচ্ছি তিন প্রহর
চিহ্নগুলো রাখছি সব অন্ধকারে

লোল জিহ্বায় তীব্র ক্ষুধা
আর্তনাদে ঝরছে বর্ম আমার

মাদলের তাল – বর্ষা নামছে
আকাশজুড়ে কালো মেঘের ফ্ল্যাট
কৃষ্ণ মেয়ে – খরস্রোতা সময় এখন
যমুনার জলে বিলাসী বদনামে
মুহূর্তের কোলে সমর্পিত হই দুজন।

পরকীয়া প্রণয় … দুটি পর্ব

পরকীয়া প্রণয় (৩)

দরজাটা ভেঙ্গে ফেল যদি শুনতে না পায় কেউ ডাক। আমি সতীশ, তোমায় ডাকছি নিরন্তর। আহ্ প্রেম! সাজিয়ে রেখেছি থরে থরে। ভালোবাসো খুউব বেশি, এমন পুষ্পিত রাত আর হয়তো আসবে না ফিরে। অশুচি শরীর; তুমুল প্রেমের নৈপুণ্যতায় বিশুদ্ধ হবো দু’জন। মিথ অথবা সাইকোলজি যাই বলুক লোকে ভেতরে ঘটছে লঙ্কাকাণ্ড। মালিকানাহীন এই অন্ধকার রাতের পিঠজুড়ে মৃগনাভীর গন্ধ। মিলিয়ে যাচ্ছে শরীরে শরীর। ডুব-সাঁতার খেলা। চৌকাঠ জুড়ে ছুঁয়ে যাওয়া গোপন গন্ধে খসে খসে পড়ছে আকাশের তারা।
ইশারা বোঝ? সাদা-কালো ডাক? পা টিপে টিপে এসেছি এতোটা দূর। দরজাটা খোল! আমি সতীশ, বাইরে দাঁড়িয়ে।
.
পরকীয়া প্রণয় (৫)

ক্যালেন্ডারের বুকে একটি সংখ্যা। যেনো লাল চোখে জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে থাকে। অনিয়মের নিয়মে বাঁধা পড়েছি দু’জন। তোমাকে ঘিরে এমন কতো সংখ্যা জমা আছে বুকে। একচিলতে রোদ্দুর এঁকে যাওয়া ঠোঁটে আগুনের ডাক। অনিয়ন্ত্রিত সময়ে অনাহুত আগমন। খোলা আছে বুকের বোতাম। সন্ধ্যার লালচে রোদ্দুরে ভেসে বেড়ায় আমাদের প্রাক্তন প্রেম। তুমি মানেই প্রেম, প্রেম মানে যাদুমন্ত্র, যাদুমন্ত্র মানেই পরকীয়া; ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরে ঘুরে তোমার কাছেই আসি। কিছু সাংকেতিক ছোঁয়া-ছুঁয়ি। নগ্ন রাত। বেআবরু হৃদয়। সন্তর্পণে হারাই সুড়ঙ্গে।

প্রার্থনা শেষ করার পর

প্রার্থনা শেষ করার পর

প্রার্থনা শেষ করার পর একটা চিন্তা হয়
‘আমার প্রার্থনা কবুল হয় তো?’
এইভাবে দেহ এবং আত্মাকে নিয়ে কথা বলার পর
একটা জ্ঞানপূর্ণ রাস্তা এসে ঢুকে পড়ে নিজের মধ্যে

হাঁটতে থাকি এক সমুদ্র পথ
জ্ঞানপূর্ণ রাস্তায় এসে মিলিত হতে থাকে
শহর – নগর – বন্দর – সভ্যতা – ভালবাসা
আগ্রহ, উল্লসিত দুঃখ, আনন্দ, এবং তুমি

এবং এই ‘তুমি’ বিষয়ক অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে
হারিয়ে ফেলি ঈশ্বর, প্রার্থনার ঘর, জ্ঞানপূর্ণ রাস্তা
প্রার্থনা আর শেষ হয় না আগের মতো।

একগুচ্ছ কবিতা

(১). ডাকহরকরা
কোথা থেকে একজোড়া চোখ উড়ে এসে বসলো
তারপর থেকেই শুরু আলোর খ্যাপ
বিসর্গদিনে বাড়ছে দৈনিক খরচের হিসেব
দেখে যাও অনুপম কুয়োতলার ব্যাঙ এসে
নিচ্ছে ভালো মন্দের খবর।

(২). নায়িকা
নাভি জুড়ে তারাদের খেলা
ঘরময় ছড়িয়ে ছিড়িয়ে আলো
ফেলে দাও গত জন্মের নসিহত
ব্যক্তিগত দিনে একটা সন্ধ্যা মানে
একশো দিনের আয়ু।

(৩). মেকি
ঝুপ করে সন্ধ্যা নামলেই আমরা বেরিয়ে পড়ি
শালার চুতিয়া মার্কা সমাজ
অযৌন লালা নিয়ে ঘুরে
মুখে সবার বেশ্যাসুলভ হাসি।

(৪). চোখ
ভোগ করতে গেলে যোগী হতে হয়
নেড়েচেড়ে দেখি রহস্যের কাঠি
তীক্ষ্ণ চোখের আঁচে শিখে নিচ্ছি সমূহ কৌশল
সেই কবে নাগালের বাইরে চলে গেছে আস্পর্ধা।

(৫). পাখি
চুপ করে থাকা মানেই ধ্যান নয়
মিলছে না জমা – খরচের হিসেব
ওপাশে মৃত্যুগান কিশোরী মনে
পাখিরা অবুঝ শুধু উড়তেই জানে।

(৬). ভবিষ্যৎ
খাঁচার ভিতর কোন পাখি নেই
একটা আস্ত সন্ধ্যা বসে আছে।

(৭). বুদ্ধি
পাখিদের অভিশাপে এখন গাছ ভর্তি মানুষ
মানুষের পাপবোধের উদয় হবে কবে।

(৮). ঘুম
একরাত্রির ঘুম আত্মস্থ করার পর আর কোনদিন ঘুমোতে পারিনি।

(৯). গোপন কথা
হরিণ সম্পর্কিত আলোচনায় পর জানা গেল
কারো সংগ্রহে নেই মৃগনাভি।

(১০). বিজ্ঞাপন
শুকনো মৌসুমে এসে জানা গেল
একটা কাপড় কাচা সাবান বিক্রি হবে
ফিরতি ট্রেনে কিনে নেবো
কতোদিন হলো হাঁসগুলো গোসল করে না।

বুলডোজার

ব্যান্ডেজ
দুটো পায়ে
বুকে
এবং সারামুখে
জীবন এবং যৌবনভিত্তিক কথারা ডুব দিয়েছে মাত্র

ঐ দিকে হুলস্থুল কান্ড
বৃক্ষসব খুলে বসেছে গুজবের বাজার
বর্ষা নিচ্ছে শীতের বুকের মাপ
জানালা লাগিয়ে ঘুমিয়ে গেল
আমার ব্যক্তিগত বসন্ত যার মগজে ব্যান্ডেজ

তারপর যা হবার তাই হলো
একটা বুলডোজার চিরজীবন দস্যুতা করে গেল প্রতিবেশীর সাথে।

পরিশিষ্ট

এক এক করে সবাই বিদায় নিচ্ছে
চেনামুখ, ডাল-ভাত, সর্ষে ইলিশ
অন্ধদিনে মঙ্গার রিলিফ।

ভিখারির থালায় হাসে কাচা সোনা রোদ
দেখার কেউ নেই চকচকে আধুলির দুঃখ
একটাকা দুইটাকার হাঁক-ডাক।

বিদায় নিচ্ছে সবাই
এক থালা লবণ কষ্ট বুকে নিয়ে
ক্ষয়ে যেতে থাকে কেউ কেউ।

তিনটি পুরাতন কবিতা

বিবর্তন

তবুও বাজিয়েই যাচ্ছ মৃত্যুঘন্টা
হাঘরে মানুষের ডাক
মাছিদের ঢেউ ভেঙ্গে ছুটে চলা নিরন্তর
ওপারে অপেক্ষায় জান্নাতি হুর
এপারে একটা বিষণ্ণ কাক
কর্ষিত ঠোঁটে ডাকছে
কা – কা – কা – কা
সিঁড়ি বেয়ে উঠছে স্মৃতির বালক
বিচিত্র সব নাচন – কোদন
শেষে জানা গেল
মৃত্যু একটা পটপরিবর্তনের নাম।

.
চিৎকার

এ আমার মাটির কসম,
জলবন্দি না রেখে
ধুলোয় ছড়িযে দাও বীজ।
আমি তো ভাতের কাঙাল নই
সবুজ ধরিত্রীর রাখালগিরি করি।
শুধু জন্মের অধিকার দাও
কিছু চিহ্ন রেখে যাব
কলমের ফলায় অনরবত চাষে
শিল্পের খোরাক যুগিয়ে যাবো।
সবাই শুনতে পায়না সোনালী দুপুরের ডাক
আমার প্রতি স্নিগ্ধ মাটির সুবাসিত বিশ্বাস রেখ
বিনয়ী ঘাসফুল যেমন নিজেকে বিলিয়ে দেয়
মানুষের চরণধুলার তলে সেখানে আমি নাহয়
সত্যের ঝাণ্ডা উর্ধ্ব হাতে ধরে রাজপথে দাঁড়িয়ে যাবো।
__________________________________

মৃত্যুসুখ

এখানে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে জন্মান্ধ রাত
মৃতরা আলিঙ্গন ভালোবাসে বলেই আঁধারকে করে সঙ্গী
নারীর অধরে দেয়া প্রথম চুম্বনের কথা ভুলে কেউ কেউ
স্বেচ্ছায় বেচে নেয় দীর্ঘতম মৃত্যুযন্ত্রণার স্বাদ।
শূন্যতা যখন গ্রাস করে সন্ধ্যামন্দিরের মঙ্গল প্রদীপ
নিষিদ্ধ হতে হতেই তখন বেদনারা দু’বোন দু’হাত
প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে যায় আকাশের ঠিকানায়,
ঝুলে যাওয়া দুপুর বারান্দায় বসে রিলিজ স্লিপে
লিখে রাখে সচিত্র মৃত্যুর ইতিহাস।
এখানে মুখ খুবড়ে পড়ে থাকে জন্মান্ধ রাত
রংবাহারির দুঃসময়ে রৌদ্রলোকে দু’চোখ খোঁজে গুপ্ত ক্ষত
আমরা মানবিক মানুষ নই, ফাল্গুন রাতে
দুর্বিষহ আগুনে পুড়িয়ে দিই মলাটবন্দি সুখ।

বুলডোজার

ব্যান্ডেজ –
দুইটা পায়ে – সারামুখে
এবং বুকে ক্ষত
জীবন এবং যৌবনভিত্তিক কথারা ডুব দিয়েছে মাত্র

ঐ দিকে হুলস্থুল কাণ্ড –
বৃক্ষরা সব খুলে বসেছে গুজবের বাজার
বর্ষা নিচ্ছে শীতের বুকের মাপ,
জানালা লাগিয়ে ঘুমিয়ে গেল
ব্যক্তিগত বসন্ত যার মগজেও ব্যান্ডেজ

তারপর………..
যা হবার তাই হলো
একটা বুলডোজার চিরজীবন দস্যুতা করে গেল –
প্রতিবেশীর সাথে।

আমরা যেমন আছি এই সময়ে

কী আশ্চর্য রাত! তোমার রূপ গড়িয়ে পড়ছে ভূমিতে
বুকের সুবাতাস ঢেলে দাও আমার চোরাগলি পথে
পাথর রাতে অচেতন ঘুম এনে হাজির করো শহুরে দরজায়।
নয়তো আজ আমি অশান্ত হবো,
কম্পমান হাতে ধরে ফেলব তোমার শাড়ির আঁচল
বৃত্তের বাইরে যে সুখ আছে গা ভাসিয়ে দেব সেথায়।

কী ভয়ংকর কথা! মাতাল রাতে মৃত্যুরা অবিরাম হাঁটছে
খুঁজছে গোপন প্রিয়ার উষ্ণ শ্বাস, আলোড়িত জলরাশি
সুডৌল স্তন চুষে অমরত্বের আশায় ঘুরছে দ্বারে দ্বারে।
নিশ্চল সময়ে ভোরের কুয়াশা ঠাঁই খোঁজে পাতার ভাঁজে
জীবনের সব অর্জন অনায়াসে ফেলে দিয়েছি অন্ধকার গুহায়
চোখের নোনতা জলধারায় ভেসে যাচ্ছে সভ্যতার অহম।

কী দুঃখজনক সময়! যে পথে ছিল আমাদের নিত্য গতায়াত
সে পথ এখন খানাখন্দে ভরা, বিষাক্ত পোকার আবাস
সহসাই অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে দিনযাপনের গ্লানির ভেতর।
ঝুলন্ত রাত, বিক্ষিপ্ত সময়. দুঃখ নদী, খরস্রোতা দুপুর-
তামাটে প্রেম, স্নিগ্ধ ভোর, গণিকার মতো উদার প্রকৃতি
সবকিছুতেই তোমায় দেখি, সবকিছুই তোমার মত মনে হয়।

কী অবাক করা ভালোবাসা! বৃদ্ধাশ্রমে আছে গর্ভধারিণী মাতা
পণ্যবাদী দিনে নারী ভুলে গেছে নীতিবোধ, স্বীয় স্বত্বা
মরীচিকার পিছে ছুটে ছুটে উন্মাদ হয়েছে তৃষ্ণার্ত প্রেমিক।
আত্মকেন্দ্রিক সময়ে কারো মাঝে প্রেম নেই, শুদ্ধতা নেই
শূন্য পাকস্থলী নিয়ে উল্লাসে ছিঁড়ে খাচ্ছে চেতনার বীজ
আঁধারের গুহায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে পরাজিত ভালোবাসা।

কী দুঃসহ যাতনা! সুখগুলো আর্তনাদে মেতে উঠছে প্রণয়ের আশায়
কষ্টের ক্রমোন্নতিতে খুলে খুলে পড়ছে নীলাভ বুকের ভাঁজ
আঘাতের গ্লানি মুছে দিতে পারে না নিদ্রাহীন স্বাপ্নিক রাত।
চুপসে যাওয়া সময়ে উত্তাল যমুনায় মাথাখুঁটে মরছে আলোর মিছিল
বোধশূন্য দিনে অশুদ্ধ অভিলাষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে মনের ভেতর
আর আমি বারবার হেরে যাচ্ছি নষ্টালজিয়া আঁধারের খেলায়।

কী উন্মাদ সুখ! সভ্যতার গ্লানি খসে খসে পড়ছে ঝরে যাওয়া তারার মত
নারীর পূজারী হয়ে কেহ কেহ ভুলে যায় দ্রোহকালে শপথের কথা
কোন কোন বিবেক ঈশ্বরের বুকে তন্ন তন্ন করে খোঁজে সভ্য অস্তিত্ব।
আত্মার অভিধান খুলে খুঁজে ফেরে পণ্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার অর্থ
শুদ্ধলিপির অভাবে কেউ কেউ গেয়ে ওঠে পাজর ভাঙ্গার গান
ভুলে যায় জাগতিক বোধ, নীতিকথা, মান-সম্মান।

আহ্ কী সুন্দর অন্ধকার! শোকাতুর অনুভূতিগুলো ঠাঁই করে নিচ্ছে বুকের ভেতর
স্মৃতিফলক দিন দিন আত্মঘাতী হয়ে উঠছে তোমার মতো করে
প্রিয় নিরবতা এখন অবাধ্য প্রলাপ হয়ে ঘুরছে মানুষের মুখে মুখে।
খুলে গেলে অন্ধকার রাত্রির ভাঁজ অনুভূতির অমোঘ ভেষজ গন্ধ লাগে না নাকে
মাঝেমধ্যে চোখের দৃষ্টিও হাজার রঙের কথা বলে আঁধারে ডুব দেয় স্নেহার্ত পাপ
এসো আলিঙ্গন করি কিছু অন্ধকার বাঁচতে শিখুক মানুষের মতো করে।

দ্বিতীয় ঈশ্বর

একটা মানচিত্র। লাল পৃথিবীর
তার ভেতর নীল মানুষ। বেঁচে থাকে
অসুস্থ চোখ। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে জানা গেল
মানুষের মৃত্যু হয়। জ্বরগ্রস্ত রোগীর মতো
অতঃপর জানলাম। আমাদের দ্বিতীয় কোন ঈশ্বর নেই
পরিচয়হীন একটা চিঠি। পোস্টম্যান হয়রান
খয়রাতি আত্মাকে খুঁজে পাওয়া
অতোটা সহজ কাজ নয়।

দীর্ঘ একটা রাত কেটে গেলে আমরা ঢুকে পড়ি
পোস্টবক্সের অন্ধকার থলির ভেতর
খয়রাতি আত্মারা মূলত প্রচুর ভীত।
অথচ পৃথিবী দিব্যি বেঁচে আছে। হাজার বছর।

বেলা শেষের গান

49b9a

একদিন হারিয়ে যাব
গহন চৈত্রের দিনে দহন চিরস্থায়ী হলে
আগমন নিষিদ্ধ কর হে পুত
এখানে বিছিয়ে দিয়েছি শামুক জীবন
নিরুদ্ধ অন্ধকার – মুখোশের দিন
দূর অরণ্যে মিশে গেছে মায়াবী গল্পের জীবন।
পৃথিবীর শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে সবাই
কে রাখে কার খোঁজ
ফুরিয়ে আসছে আগুনের দিন
সঘন মেঘ – অরণ্য সারি সারি
দৃশ্যের ভেতর জন্ম নিচ্ছে শৈশব
পৃথিবী- যেন একটা অচেনা গুহা।
একদিন হারিয়ে যাব
পাশে পড়ে থাকবে ব্যথিত মুখ
হাহাকার – পরিত্যক্ত হবে দেহ
অসমাপ্ত কাহিনী – লিখবে না কেউ
একা বসে নৌকায় – শেষ যাত্রী আমি
কোন মাঝি যেন গায় ধল প্রহরের গান।

অশরীরীঃ না গল্প না প্রবন্ধ … পর্ব- ১০

1on-barua

ঘুমানোর আগে কিছু টুকটাক কাজ সেরে ঘুমাতে যাই। দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। বিয়ের আগে অভ্যাসটি রীতিমতো ভয়ংকর ছিল। বিয়ের পর একটু কমে আসলেও মহুয়া’র মৃত্যুর পর পুরনো অভ্যাসটি আবারো জেঁকে বসেছে। এখন অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, প্রায় প্রতি রাতেই নির্ঘুম কাটে।

যেখানে থাকি সেই গ্রামটির নাম হাওয়া পাইড়া। এই গ্রামের একদম শেষ মাথায় দুই রুমের একটা ছোট টিনের ঘরে আমার বাস। ঘরের পিছনে এবং ডানে-বামে পুরাটাই ফাঁকা। এককথায় বলা যায় যতো দূর চোখ যায় শুধু মাঠ আর মাঠ। সামনের সাইটে একটা গ্রাম আছে, পাথরঘাটা তার নাম। পায়ে হেঁটে গেলে তাও প্রায় মিনিট বিশেক তো লাগবেই। তবে আমার কখনো যাওয়া হয়নি ওদিকে। একদিকে তো ওই গ্রামে তেমন কোন কাজ থাকে না তার ওপর মহুয়ার বিশেষ নিষেধ ছিল ওদিকটায় যাওয়ার।

কিন্তু আজ যেতে হচ্ছে আমায়। এই নিশুতি রাতে জনমানবহীন জমির আইল ধরে হেঁটে যাচ্ছি। উদ্দেশ্য জমির চাচা। আপন চাচা নন তিনি আমার। বয়স প্রায় সত্তুরের ওপরে। এখনো লাঠির সাহায্য ছাড়াই দিব্যি হেঁটে বেড়ান। শুনেছি নামকরা কবিরাজ তিনি। দুই-চারটা জ্বিন – ভুত নাকি তার সবসময়ের সঙ্গী। যে আইল ধরে হাঁটছি সেটা৷ একটু পিছলা। সন্ধ্যার দিকে একটা বড় বৃষ্টি হয়ে গেছে। সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। তিন- চারবার পা পিছলে পড়ে যেতে গিয়ে নিজেকে ঠিক রেখেছি।

লাইট না থাকায় সমস্যা হচ্ছে বেশি। রাত জাগা পোকামাকড়ের ডাক বড়ই অদ্ভুত লাগছে। হঠাৎ একসঙ্গে তিন-চারটা বিড়ালের ডাক কানে। এর মধ্যে আবার একটা কান্না শুরু করে দিয়েছে। ছোট্ট বাচ্চার কান্নার আওয়াজের মতো। ছোট বেলায় মা বলতেন বিড়ালের কান্না ভালো নয়। কুলক্ষণ। বিড়ালের চিৎকারে টেকা দায়। মাথাটা তুলে সবে ডান দিকে তাকিয়েছি। আর অমনিই বাঁ পাটা পিছলে পড়ে যাবো ঠিক সেই মুহূর্তে আমার ডান হাতটা কে যেনো খপ করে ধরে ফেলল। তাকিয়ে দেখি জমির চাচা। ধবধবে সাদা পাজামা – পাঞ্জাবি পড়ে আছেন। মুখে হাসি। তার পায়ে কোন কাদার চিহ্ন নাই দেখে একটু হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে ছালাম দিলাম।
– চাচা আমি তো আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম
– হু, চলো তাহলে বাসায় চলো সেখানে আলাপ পাড়বো।
বলেই তিনি সামনে এগিয়ে গেলেন। আমি ওনার পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। গল্পে পড়েছিলাম ভুতদের পায়ের গোড়ালি, আঙুল, পাতা কিছুই থাকে না। কিন্তু চাচার পায়ের দিকে তাকিয়েও আমি কিছু উদ্ধার করতে পারলাম না তার পাজামার কারণ।

জমির চাচার বাড়ি। আমি দাঁড়িয়ে তার দরজার সামনে। উনি বাথরুমে গেছেন। যাওয়ার আগে বললেন, একটু অপেক্ষা করো আমি আসছি। প্রায় মিনিট দশেক পেরিয়ে গেলেও তিনি বাথরুম থেকে বের হচ্ছেন না। এভাবে পনের, বিশ, পঁচিশ আধাঘন্টা পেরিয়ে গেলেও তিনি বের হচ্ছেন না দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আশ্বিনের রাতেও আমি ঘেমে উঠছি। একসময় বাধ্য হয়ে দরজায় গিয়ে কড়া নাড়া শুরু করলাম। যিনি দরজা খুলে দিলেন তাকে দেখে হোঁচট খেলাম। একি জমির চাচা! কিন্তু বয়স এতো কম কেন তার?

দরজা খুলেই তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, কে আপনি, এতো রাতে কি চাই?

আমি কোনরকমে আমতা আমতা করে বললাম, জ..মি..র চাচা….! আমার মুখের কথা শেষ করার আগেই উনি কেড়ে নিয়ে বললেন, আব্বা তো নেই। তিন বছর আগে তিনি মারা গেছেন।

এবার আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না। ধপাস করে পড়ে গেলাম সেখানেই। দেখি লাল – নীল – হলুদ বিভিন্ন রকমের আলো দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে। আর আলোর মাঝখানে মাথা তুলে তাকিয়ে আছে মহুয়া। সে যেনো বলছে, আমি তোমাকে নিষেধ করছি না, ওদিকে যাবা না, যাবা না।

.
চলবে…

এক অলৌকিক নক্ষত্রের অপেক্ষায়

তবুও ভুলভালসহ ঠিকই কাটছে জীবন
খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে পাথর সময় – নগ্ন ইতিহাস
আর যুৎসই কৌশলে বৃষ্টিকে নামিয়ে আনি
ঠিক বুকের ওপর – নদীকে দত্তক দিয়েছি যে!

তবুও পাখির উড়ে যাবার কী তীব্র বাসনা
গায়কী ঢঙ – বিজ্ঞাপন প্রচারের মতো
আঙুলে গুণে রাখছি নিজস্ব কিছু সংখ্যা
বাড়ছে ভ্রুণের মতো ঠোঁটের কিনারে – ভাষা!

অপেক্ষায় আছি – এক অলৌকিক নক্ষত্র ঝরে পড়ার
বুকের মধ্যবর্তী দেশে জায়গা করে দেবো তাকে!

বাবা

fathers-lov

বাবা নেই অনেক দিন হলো। দেড় যুগ পেরিয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে মনে হয় কে যেন নাম ধরে ডাক দেয়। ঠিক বাবার কণ্ঠের মতো। রাশভারি গলা। আমি হুড়মুড় করে উঠে বসি বিছানায়। ঘুম ভাঙ্গলে দেখি গলা শুকিয়ে গেছে। দ্বিপ্রহর রাত। টেবিলের ওপর রাখা মগ থেকে ঢকঢক করে পানি পান করি। বড় রাস্তায় তখন এক-দুইটা গাড়ি চলাচল করছে। কিছুক্ষণ পর পরই প্যাঁ-পুঁ আওয়াজ। পাশে শুয়ে থাকা ছেলের দিকে তাকাই। নিষ্পাপ একটা মুখ। কতো যত্ন করে গড়ে দিয়েছেন বিধাতা। ঠিক আমার বাবার মতো দেখতে! অজান্তেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাবার মুখ। সেই মায়াময় হাসিমুখে যেনো আমাকে ডাকছেন। বাবা অদৃশ্য হয়ে যান ধীরে ধীরে। বাবা চোখের দৃষ্টি থেকে হারিয়ে গেলে টের পাই চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। অশ্রু মুছি না। অনেকটা ইচ্ছে করেই। এভাবে বাবা প্রায়ই আসেন। পাশে বসেন। কথা বলেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমি শুনি। শুধু তাঁকে ছুঁয়ে দিতে পারি না আগের মতো।

আমিও তো আমার সন্তানের বাবা! সেও কি আমার কথা মনে করে এভাবে রাত জেগে থাকবে? এমন করে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে কি ওর? আমার বাবার মতো আমিও কি তাঁকে ডাকবো? যখন সে বেভুল ঘুমে ঘুমিয়ে থাকবে।

বাবা নেই। কিন্তু তার ছোঁয়া লেগে আছে বাড়ির সব জায়গায়। এইযে আমার শাহাদৎ আঙুল, যে আঙুলটি বাবা তার হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে আমায় হেঁটে নিয়ে বেড়াতেন। ঝুল বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখা বাজারের ব্যাগ, বাবার পানি পান করার জন্য বড় কাঁচের গ্লাস, হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ার, ঘরের এককোণায় অবহেলায় পড়ে থাকা ভাঙ্গা হ্যারিকেন, তিন ব্যাটারির লাইটটিও আছে। কাঠের ডান্ডাওয়ালা ছাতাটিও আছে। আছে বাবার হাতের লাঠিটাও। সবকিছুতেই তাঁর হাতের পরশ লেগে আছে। শুধু তিনিই নেই।

তবুও বাবা আছেন। সব বাবারা আসে – যায়। অসীম শূল্যতা থেকে ডাকেন। কারণে – অকারণে। যা লিখে রাখে মহাকাল তার সবকিছুই সত্য নয়। মাকে দেখেছি, বাবা চলে যাবার পর অভিমানের কাঁটা গলায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সদর দরজায়। অপেক্ষা; এক পতিত সময়ের নাম। মাকে বুঝাতে পারিনি তখন। শ্বাস-প্রশ্বাস দীর্ঘ থেকে দীঘ হতে থাকে। মনে রাখিস, মৃত্যুতে মানুষের মুক্তি আসে বা বলতে পারিস মৃত্যুর আরেক নাম মুক্তি। বাবা বলেছিলেন। অথচ আমরা ক্রমশ বন্দি হয়ে যাই বাবার ছায়ার ভেতর।

সমস্ত দুপুর জুড়ে এখন থৈ থৈ রোদ। বাবা যেখানে বসতেন সেই কাঁঠাল গাছের ছায়াটাও উধাও। ঘুণপোকা খেয়েছে তার জলচৌকিটাও। হাতের লাঠিটারও কোন খোঁজ নেই দীর্ঘদিন। সবুজের ছাদে এখন বিরান ভূমি। পূর্ণিমা উড়ে এসে বসেছিল যে ঘরে সেখানে শুধু এখন শূন্যের হাহাকার। হায় রুদ্রপথ! তুমি কেমন করে রপ্ত করেছ বশীকরণ মন্ত্র। হাওয়া ঘরে এখন কালশীটে মেঘ। বাবার মস্ত বড় অভিমান। কতো বছর কেটে গেছে। দেখা নেই, কথা নেই। অথচ আমরা সবাই কেমন দিব্যি আছি। বেঁচে আছি। খাচ্ছি, ঘুরছি, ঘুমাচ্ছি। না, ঘুমাচ্ছি না। বাবা বলতেন, ঘুমের আরেক নাম মৃত্যু। ঘুম থেকে জেগে ওঠা মানে হলো মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে ফিরে আসা।

কি করলে শোধ হয় রক্তঋণ? এই প্রশ্ন জুড়ে দিয়েছিলাম মায়ের আঁচলে। মা শুধু মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, বড় হ বাবা। অনেক বড়। তারপর মাও অন্তর্ধ্যানে চলে গেলেন। আমি বড় হতে থাকি। আমার মাথায় মায়ের হাত। কপালে আদর রেখা। অতঃপর অপেক্ষা। নাতিদীর্ঘ বছর। মায়ের হাত আর সরে না মাথার ওপর থেকে। আমি কি তবে বড় হয়নি আজও?

প্রেমজ কথা

হ্যালো, এইযে শুনছেন
ইদানিং আমিও আপনাকে লুকিয়ে চুপিয়ে দেখি
ইনিয়ে – বিনিয়ে কথা বলার সমূহ চেষ্টাও করি
বেহুশ ঘুমের সময় স্বপ্নেও আসেন প্রায়ই
কথা হয়
হাতে হাত রাখি
চুমু খাই
নাগরদোলায় চড়ি;
আপনার যা রূপ!
মাশাআল্লাহ্! হুর – পরীও ফেল মারবে নিশ্চিত।
মাইরি বলছি
আমার ভালোবাসায় খাদ নেই কোন
হ্যালো শুনছেন
আমি শুধু আপনাকেই ভালো ভালোবাসি।