মোকসেদুল ইসলাম এর সকল পোস্ট

অশরীরীঃ না গল্প না প্রবন্ধ (পর্ব নয়)

গত কয়েকটি দিন থেকে এমন ঘটনা ঘটছে। একই সময়ে প্রতিটা রাতেই ঘটছে। ঘটনাগুলোর মধ্যে মিল না থাকলেও একটা অদৃশ্য যোগসূত্র আছে বলে মনে হচ্ছে। আগেই বলেছি রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর অভ্যাস আমার নেই। দেড়টা – দুইটার দিকে ঘুমাতে যাই।

প্রথমদিন যখন আওয়াজটি কানে আসে ঘুম থেকে চমকে উঠি। মধ্যরাতে এমন পিলে চমকানো অট্টহাসির শব্দে এই প্রথম আমি ভয় পেয়ে যাই। মনে হলো একসঙ্গে প্রায় পাঁচ – ছয়জন ছেলে- মেয়ের একটি দল কিছুক্ষণ পর পর হেসে উঠছে কোন কারণ ছাড়াই। হাসিটা ঠিক দক্ষিণ দিক থেকে আসছে। ওদিকটার জানালাটা খুলে রাখি প্রায়ই। গরমকালে কখন বিদ্যুৎ যায় – আসে তার কোন ঠিক নেই। জানালা খুলে রাখলে একটু বাতাস ঘরের ভিতরে আসে। মধ্যরাতের ঘুমটা আরও জমে ওঠে। আগে কখনো এমন হয়নি। তাই ভয়ে জানালাটা বন্ধ করে লকটা পর্যন্ত লাগিয়ে দিই। দেখি মাথার ওপরে ফ্যানটা ঘুরছে। ফ্যানের স্প্রিটটা বাড়িয়ে দিই। ১০০% গতিতে এখন ফ্যান চলছে। তবুও আমি ঘেমে যাচ্ছি অকারণে।

দ্বিতীয় দিনেও যথারীতি সব কাজ সেরে সবে ঘুমিয়ে পড়ছি। এবার কেউ হাসি দিচ্ছে না। কান্না! খুব করুণ সুরে কেউ একজন কেঁদে যাছে। কান্নার রূপটা মাঝেমধ্যে পাল্টে যাচ্ছে। প্রথম প্রথম কান্নাটি আস্তে শুরু হলে সময়ের ব্যবধানে এটা আরও জোরে শব্দ করে কান্নায় পরিণত হয়। কখনো মনে হয় কোন মেয়ে বুঝি কেঁদে চলেছে। কান্নার রহস্য ভেদ করতে বাইরে যাবো ভাবতেই মনে হলো কেউ বুঝি আমার দরজার সামনে বসেই কান্না শুরু করে দিয়েছে। দরজা খুলতে গিয়েও কি মনে করে দরজা না খুলে আবার বিছানায় বসে পড়ি।

একটা সোনালি ভোরের অপেক্ষায় থাকি।
তৃতীয় দিনের ঘটনাটি আরও মারাত্মক – ভয়ংকর। ঘুমানোর আগে বারান্দায় বসে একটা সিগারেট টানার অভ্যাস আমার দীর্ঘদিনের। বারান্দায় একটা প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা আছে। প্রতিদিন রাতে এই চেয়ারে বসে একটা সিগারেট শেষ করে তারপর রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আজ বারান্দায় বের হয়েছি অনেক রাতে। বিশেষ একটা কাজে আটকা পড়ায় দেরি হয়ে গ্যাছে।

সিগারেটটা তখন মাঝামাঝি চলে এসেছে। ধোঁয়া ছাড়ছি। ধোঁয়াগুলো কুণ্ডলী পাকিয়ে মিশে যাচ্ছে দূর মেঘে। হঠাৎ অনুভব করলাম কেউ একজন আমার ঘাড়ের খুব কাছে এসে ফিসফিস করে কথা বলছে। একটু পরে আরও কিছু মুখ যুক্ত হয়ে যায়। তাদের ফিসফিসানিগুলো বেড়ে যায়। আমাকে ডাকছে খুব আস্তে করে। আমি দাঁড়িয়ে যাই। চলার শক্তি যেনো হাড়িয়ে ফেলছি। মাথা ঘুরে পড়ে চাই। কতক্ষণ ছিলাম জানি না। সকাল বেলা জেগে দেখি বিছানায় শুয়ে আছি। জলিল চাচা যিনি আমার এই একা বাসায় টুকটাক ফুটফরমাস খাটেন তিনি বসে আছেন শিয়রে। মাথা তুলতে পারছি না কিছুতেই। প্রচন্ড মাথা ব্যথা সঙ্গে জ্বর। মেপে দেখি ১০৩ ডিগ্রি।
.
(চলবে…………………..)

অশরীরীঃ না গল্প না প্রবন্ধ (পর্বঃ আট)

অনেকদিন হলো ইচ্ছে করেই রাতের বেলায় বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা বেশি বাইরে বের হই না। রাত আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে রাতের খাবার খেয়ে নিই। তারপর একটা চা আর বিড়ি টানার জন্য বাইরে বের হই। রুম থেকে বের হয়ে মিনিট তিনেক হাঁটলেই হরেকৃষ্ণের মোড়। এই মোড়েই একটা ছোট্ট চায়ের দোকান আছে। বিবি স্টোর। বিবি স্টোরের মালিক ষাটোর্ধ রহমত মিয়ার সঙ্গে ইতোমধ্যেই আমার একটা অঘোষিত সম্পর্কের ভাব চলে এসেছে। সেখানেও যাওয়াটা বাদ দিয়েছি। যদিও বিষয়টা নিয়ে এখনো কারুর সঙ্গেই শেয়ার করতে পারিনি।

সত্যি বলতে অনেকটা ভয়েই এখন আর বাইরে বের হই না। কিন্তু ঘরের মধ্যেও নিরাপদ বোধ করছি না। রাত্রিকালিন উপদ্রপ আরও বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে। ভাবছি কাউকে নিয়ে আসবো। কথাও বলে রেখেছি। কিন্তু সময়ের অভাবে যেতেও পারছি না। যাকে নিয়ে আসবো বলে মোটামুটি কথা পাক্কা হয়েছে তিনি সম্পর্কে আমার চাচা লাগেন। ভদ্রলোক আমার থেকেও অনেক বেশি সাহসী। ভূত তো দূরের কথা জ্বিনও তাঁর সামনে দাড়াতে পারে না। কথিত আছে যে, তিনি জ্বিনের সঙ্গেও কুস্তি লড়ে জিতে ছিলেন।

সেই চাচার সঙ্গে আলাপ ফাইনাল করার পর বেশ কয়েকটি দিন আমার ভালোই কাটলো। ভাবলাম, যাক অশরীরী আত্মারা তাহলে বুঝতে পারছে যে, সাহসী এক ব্যক্তি আসছে আমার বাসায়। কিন্তু আমার ভাবনাকে ভুল করে দিয়ে হঠাৎ এক রাতে তাদের আগমন ঘটলো।

রাতে সাধারণত এখন ঘুমাতে একটু দেরিই হয়। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে দিলেও ঘুমাতে ঘুমাতে এগারোটা / বারটা। সেদিন একটু ঘুম ভাব চলে এসেছিল। হঠাৎ টিনের চালের ওপর দড়াম করে কিছু একটা পড়লো বলে মনে হলো। আমি হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসি। পরপর বেশ কয়েকটি এমন শব্দ হলো। আমি টর্চলাইটি হাতে নিয়ে বাইরে বের হই মনের অজান্তেই।

যতোদূর মনে পড়ে টর্চ হাতে পুকুর ঘাট পর্যন্ত গিয়েছিলাম। ওখানে যাওয়ার পরেই হঠাৎ করে টর্চলাইটি বন্ধ হয়ে যায়। জ্বলন্ত একটা লাইট এভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বুকটা ধক্ করে ওঠে। শরীরের রোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়। গলা শুকিয়ে আসে। যা দেখি নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারি না। দেখি, এই মধ্যে রাতে পুকুরের পানিতে প্রচন্ড ঢেউ। আর সেই ঢেউয়ের মধ্যে থেকে সফেদ পোশাকে এক ব্যক্তি ধীরে ধীরে বসা থেকে উঠে দাড়াচ্ছেন। লম্বা হতে হতে তিনি এতোটাই লম্বা হলেন যে, মনে হলো তিনি আকাশ ছুঁয়ে ফেলবেন। কিন্তু যখন তাঁর মুখের দিকে আমি তাকালাম নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলাম না। মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি আর কেউ নন, তিনি আমার সম্পর্কের সেই চাচা। যিনি আমার বাসায় আসবেন বলে কথা দিয়েছেন।

পরের দিন নিজেকে আবিষ্কার করি এক জুনিয়র কলিগের বাসায়। বিধ্বস্ত চেহারা। গায়ের জামাটায় কাদা পানি লেগে একাকার।

.
(..চলবে…)

অশরীরীঃ না গল্প না প্রবন্ধ ৫

অনেকদিন আগে একটা গজারি লাঠি বানিয়ে রেখেছিলাম। বাসাটা ভাড়া নেওয়ার সময় অনেকে তখন বলেছিলেন আশেপাশে সাপ-টাপের দেখা মেলে, যেনো সাবধানে থাকি। আজ সেই লাঠিটা কাজে লাগতেছে। বিছানা থেকে উঠে সুইচ অন করতে গিয়ে দেখি বিদ্যুৎ নেই। মফস্বল এলাকায় এই একটা বড় সমস্যা। নিয়মিত বিদ্যুৎ থাকে না। যদি লোডশেডিং হয় তো বিদ্যুৎ আসার আর কোন খবর থাকে না।

আবার খাটের ওপর উঠে পড়ি। বালিশের নিচ থেকে টর্চলাইটটা খুঁজে নিই। দরজায় তখনও দুমদাম করে কেউ একজন শব্দ করেই যাচ্ছে। দরজার কাছে গিয়ে লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখতে চেষ্টা করি। অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পাই না।

দরজাটা খুলতে গিয়েও কি করে একটু অপেক্ষা করি। দুমদাম আওয়াজটা আর নেই। মিনিট দুয়েক পর আবার খেয়াল করলাম দরজায় কেউ একজন আবার নক করতেছে। এবার আর জোড়ে নয়। আস্তে আস্তে! ঠকঠক করে! শাহাদাৎ কিংবা মধ্যমা আঙুল দিয়ে কেউ দরজায় টোকা দিচ্ছে।

আমি বুকে সাহস নিয়ে গলাটা ঝেড়ে জিজ্ঞেস করি, কে? কেউ উত্তর দেয় না। বদ্ধ ঘরে শব্দটি প্রতিধ্বনি হয়ে আবার আমার কাছেই ফিরে আসে। আমার মনে হলো, বাইরে থেকে কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করছে, ভিতরে কে? আমার দম বন্ধ হবার জোগাড়। হঠাৎ ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়।

কিশোর বেলায় প্রায় প্রতি রাতেই ঘুম থেকে কান্না করে উঠতাম। সে কি জোরে জোরে কান্না! পাশের রুম থেকে বাবা- মা দুজনেই দৌড়ে আসতেন। জিজ্ঞেস করতেন কি হয়েছে? আমি তাদেরকে যা বলতাম তার মানে হল এই- স্বপ্নে দেখি ম্যাচের কাঠির মতোন চিকন একটা লোক ইয়াব্বড় একটা পাথর তুলে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে মারার জন্য আর আমি সেই পাথরের আঘাত থেকে বাঁচার জন্য এদিক-সেদিক পড়ি মরি করে দৌড়াচ্ছি। তবে দৌড়াচ্ছি যে পথে সেই পথটাও ভালো না। সুই খাড়া করে বিছানো পথের প্রত্যেকটি জায়গায়। আমি দৌড়াচ্ছি আর পা বেয়ে রক্ত ঝরছে। বাবা আয়াতুল কুরসি পড়ে আমার শরীরে ফুঁ দিতেন। পানি পড়ে দিতেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো বাবার ফূুঁ দেওয়া পানি পান করার পর সেই রাতে আর কোন স্বপ্ন দেখতাম না।

আজ অনেকদিন পর তাদের কথা মনে হলো। এমনিতেই বুকের ওপর ভয় ভর করে আছে। তার ওপর বিষণ্নতায় মন ছেঁয়ে গেল।

দরজাটা খুলে ফেলি। কেউ নেই। ভয়ে শরীর ছম ছম করে ওঠে। দৃষ্টি দূরে নিক্ষেপ করি। শুধু অন্ধকার। বাইরে দুটো ইদুঁর বোধহয় মারামারি করছে। তাদের চিকচিক শব্দে রাতের অন্ধকার খান খান হওয়ার যোগাড়।

টর্চলাইটের আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মারতে থাকি। কিছুই চোখে পড়ে না।
পা বাড়াই বাড়ির বাইরে। আশেপাশে কাউকে খুঁজে না পেয়ে যখন বাসায় ফিরবো বলে মনস্থির করেছি ঠিক তখনই কানে আসে কে যেনো খুব মিহি সুরে বলছে- “বড় বাঁচা বেঁচে গেলিরে খোকা। তোর মা হয়তোবা কচুর পাতায় ভাত দিয়েছিল আমাদের কাউকে।” শব্দগুলো কানে আসতেই আমি ত্বরিতগতিতে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ি।

.
……চলবে….

অশরীরীঃ না গল্প না প্রবন্ধ (৪র্থ)

অলৌকিক সব কাজ – কারবার! যে বাসায় ভাড়া থাকি সেটা অনেক দিনের পুরনো একটা বাড়ি। তিন রুমের একটা সেমি পাকা ঘর। চাকরীর সুবাদে এই শহরে আসা। এলাকায় একদম নতুন। অফিসের কাছাকাছি হবে ভেবে এই খানে ভাড়া থাকি। আরও একজন আমার পাশের রুমে ভাড়া থাকতেন। আক্কাস আলী সাহেব। তিনি পদবীতে আমার নিচে হলেও সিনিয়র হওয়ায় তাকে আক্কাস সাহেব ডাকতাম। উনি এই মুহুর্তে এখানে নেই। নেই মানে বাসা ছেড়ে চলে গেছেন।

প্রায় প্রতি রাতেই উনি এমন জোরে চিৎকার করে উঠতেন যে, পাশের রুমে আমি ঘুমিয়ে থাকা মানুষটাও চমকে উঠতাম। উনার রুমের দরজায় কষাঘাত করার পর দরজা খুলে দিলে দ্বিতীয়বার চমকে উঠতাম উনাট মুখের অবয়ব দেখে। একদম পাংশুটে মুখ। চোখগুলো যেনো ঠিকরে বের হয়ে আসতে চাইতেছে। ভয়ে অস্থির মুখটা থেকে কোন কথা বের হচ্ছে না। শুধু গরগর আওয়াজ করছেন। আমি জগ থেকে একগ্লাস পানি সামনে তুলে ধরতেই তিনি একরকম ছোঁ মেরে গ্লাসটা না নিয়ে জগটা নিয়েই ঢকঢক করে জগের সবটুকু পানি এক নিঃশ্বাসে পান করে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন।

উনি যা বললেন তা শুনে আমার গায়ের রোমগুলো সব দাঁড়িয়ে গেল। উনার কথার সারমর্ম করলে দাঁড়ায় এমন- এই মধ্যরাতে একটা জলজ্যান্ত চার-পাঁচ বছরের বাচ্চা তার পাশে শুয়ে ঘুমোতে দেখছেন। এর আগেও এমন ঘটনা দু- একবার ঘটেছিল। কিন্তু তিনি সেটা স্বপ্ন মনে করে পাশ কাটিয়ে গেছেন। তিনি বাচ্চাটার শরীরে হাত পর্যন্ত বুলিয়ে দিয়েছেন। আর হাত বুলিয়ে দিতে গিয়েই বিপত্তি বেঁধেছে। এমন ঠান্ডা শরীর যেনো বরফের ভেতর থেকে মাত্র বের হয়ে এসেছে। তখনও তিনি ভয় পাননি। কিন্তু বাচ্চাটি যখন তাঁর ডান হাতের বুড়ো আঙুলে কামড় দেওয়ার পর ধীরে ধীরে পুরো হাতটাই তার মুখের ভেতর ঢুকে ফেল ছিল তখনই তার সম্বিৎ ফিরে আসে আচমকা হেঁচকা টানে হাতটি মুখের ভেতর থেকে বের দেয় চিৎকার এবং সঙ্গে সঙ্গে এক লাফেই দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়। আর বাচ্চাটি তখন সুড়সুড় করে খাটের নিচে ঢুকে পড়ে।

ভয় কি জিনিস এটা আমার জানা নেই। ভুত-প্রেতে চিরকাল অবিশ্বাসী ছেলেটার বুকটাও একটু ধক্ করে ওঠে। অফিস থেকে দেওয়া তিন ব্যাটারীর টর্চের আলো উপুড় হয়ে খাটের নিচে ফেলি। কিছুই দেখতে পাই না। মুখটা ওপরে তুলতেই আমার চোখ পড়ে আক্কাস সাহেবের মুখে। তখনও তিনি কাঁপছেন।

এই ঘটনার পর আক্কাস সাহেব আর এখানে থাকেন নাই। তিনি চলে গেলেন পরের দিনই। আমাকেও উপদেশ দিলেন বাড়িটা যতো তাড়াতাড়ি পারি ছেড়ে দিতে। কিন্তু দেই – দিচ্ছি করেও আমি আর বাড়িটা ছেড়ে দিতে পারিনি। এর কারণও আছে। প্রথমত বাড়িটা একদম অফিসের কাছেই। দ্বিতীয়ত অল্প টাকায় এমন নিরিবিলি বাড়ি এই এই উপজেলা সদরে আর খুঁজে পাওয়াও যাবে না।

বাড়িওয়ালা এখানে থাকেন না। তিনি থাকেন একটা অজপাড়াগাঁয়ে। তিন-চার মাস পর এসে শুধু ভাড়ার টাকাটা নিয়ে যান। তার কাছে আক্কাস সাহেবের বিষয়টা বলতে গিয়েও বলিনি। বললে যদি ভেবে নেন যে, শহুরে ছেলে এ যুগে এসে এখনও ভুত প্রেতে বিশ্বাস করে।

অফিসের নানা ব্যস্ততায় আক্কাস সাহেবের ঘটনাটা ভুলেই গিয়েছিলাম। টুকটাক মাঝেমধ্যে কান্নার আওয়াজ শুনি। খুব করুণ সুরে কে যেনো প্রায়ই কাঁদে। সময় যতো বাড়তে থাকে কান্নার আওয়াজও তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণ হতে থাকে। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো কোন মেয়ের স্বামী বা বাবা/মা মারা গিয়েছে সেই শোক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কিন্তু না! ভুল ভাঙতে খুব বেশি দেরি হয়নি আমার।

একদিন রাতে অফিসের কাজ করতে গিয়ে ঘুমোতে ষনেক দেরি হয়ে যায়। অফিসে অডিট আসবে। রাজ্যের কাজ। কাজ শেষ করে মাত্র বিছানায় যাবো আর ঠিক তখনই আবারও সেই কান্নার আওয়াজ। এবার আর দূরে কোথাও নয়। আমারই রুমের বাইরে থেকে। আমি খরগোশের মতো কানদুটো খাঁড়া করে দিই। বুঝতে পারি বাড়ির ডান কোণ ঘেঁষেই যে ছোট্ট একটা পুকুর আছে সেখান থেকেই কান্নার আওয়াজ আসতেছে। আমি ওদিকটার জানালা খুলে ডানে-বামে, উপরে-নিচে দেখার চেষ্টা করি। শুধু কালো ঘুটঘুটে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পাই না।
এবার অফিসের দেয়া তিন ব্যাটারী টর্চলাইটটি হাতে নিয়ে দরজা খুলে বের হই। খুব সন্তর্পণে পুকুরটা দিকে এগিয়ে যেতে থাকি।.

……….……….চলবে..!

অশরীরীঃ না গল্প না প্রবন্ধ

ভয়ংকর রাতগুলো এভাবেই কাটে। একা! নিঃসঙ্গ! আমি যেখানে থাকি সেটা থানা সদর হলেও জেলা কিংবা রাজধানী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন একটা শহর। ঠিক শহর না বলে এটাকে একটা অজপাড়াগাঁ বলটাই বোধহয় শ্রেয়।

এই মধ্যরাতে আমার মনে হয় শুধু মাত্র এই অজপাড়াগাঁটা নয় যেনো সমগ্র পৃথিবী ঘুমিয়ে আছে। সুনসান নিরবতা। দূরের মাঠে কিছুক্ষণ পর পর শেয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক কানে আসলেও এখন এতোটাই ভীতু হয়ে গেছি যে, মধ্যরাতের শেয়ালের ডাকলেও মনে হয় হায়েনা ডাকতেছে। এই বুঝি এখনই হায়েনার দল হামলে পড়বে আমার ঘরের ওপর।

কোন যেনো মুভিতে দেখেছিলাম। নামটা ঠিক মনে নেই। এরকম অন্ধকার রাত তার ওপর আবার মেঘের গুড়িগুড়ি ডাক। পথ হারিয়ে এক লোক হাঁটছে বনের পাশ দিয়ে ক্ষেতের আইল ধরে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর হায়েনারা তার পথ রোধ করে দাঁড়ায়। অতঃপর … সব শেষ।

আমি ভয়ে বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে এগিয়ে যাই। দরজার খিলটা ঠিক মতো লাগিয়েছি কিনা পরীক্ষা করি। পাশের বাড়িতে একটা বিড়াল অনেক্ষণ মিঁউ মিঁউ করেই যাচ্ছে। ছোটবেলার দাদী বলতেন, বিড়ালের কান্না ভালো নয়। যা তো মিঠু বিড়ালটাকে তাড়িয়ে দিয়ে আয়। আমি বীরদর্পে লাঠি নিয়ে বিড়ালটাকে দূরে তাড়িয়ে দিয়ে আসতাম।

বিড়ালের কান্নাটা আগের থেকে আরও তীব্র হচ্ছে। ওদিকে শেয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক তখনও শেষ হয়নি। পিপাসায় মনে হচ্ছে আমার বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। ইচ্ছে করেই পানি পান করি না। গ্লাস ধরে রাখার মতো শক্তি বা সাহস এই মূহুর্তে আমার নেই। কোন এক অদৃশ্য শক্তি যেনো সব শুষে নিয়েছে।
হঠাৎ দরজায় দুমদাম আওয়াজে চমকে উঠি। আশেপাশে কেউ নেই।

.
(………চলবে………..)

নাকফুল

কিছু নাকফুলের আলাদা ঘ্রাণ থাকে
বিকেলের রোদ গায়ে মেখেও ছুটে আসে পুরুষ প্রজাতি
দুধসাদা দুপুরবেলায় কেউ কেউ লেখে বিচ্ছেদের এপিটাফ।
সোনাভান পুঁথি কিংবা গুনাই বিবির কেচ্ছা পড়ে আছে অবহেলায়
তোরা দে তালি দে
আমার ঘরে ফেরার তাড়া নেই
দীর্ঘশ্বাসের ঝোলাটা বাড়তি হলে কিছু দুঃখ বিলিয়ে যাবো।
নাকফুল হারিয়ে গেছে সেই কবে
এ পোড়া শহর!
মানুষের ব্যস্ততা গিলে খায় মানবতার নহর।

মানুষ বাঁচতে চায় কেন? (পর্ব-৩)

মানুষের খুব সাধারণ একটা চাওয়া হলো সম্মান। সবাই সম্মান নিয়েই পৃথিবীতে বাঁচতে চায় পাশাপাশি সবাই সম্মানিত হতেও চায়। হতে চাওয়াটা দোষের নয় কিন্তু সম্মান খুঁয়ানোটা বড় দোষের। সম্মান যদি একবার হারিয়ে যায় তবে ফিরে পাওয়াটা খুব কঠিন। সম্মান হারিয়ে অনেকেই মৃত্যুর পথ বেছে নেয়। সম্মান মানুষের বিশাল সম্পদ। পৃথিবীতে এমন বহু বিত্তবান এবং ক্ষমতাবান মানুষ আছেন – যারা তাদের ক্ষমতাবলে অনেক কিছুই করতে পারেন। কিন্তু তাদের সম্মান নেই। মানুষ তাদের সম্মান দেয় ভয়ে স্বইচ্ছায় নয়। আবার এমনও আছেন যারা কিনা খুবই সাধারণ জীবনযাপন করেন, না আছে কোন ক্ষমতা না আছে কোন অর্থবিত্ত অথচ সমাজে তারা প্রভূত সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকেন। সম্মানিত হতে হলে কিংবা সম্মান পেতে হলে আপনাকে নিজের জন্য, সমাজের জন্য, দেশের জন্য অনেক কিছুই করতে হবে। এর মধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য হলোঃ কাউকে কোন কথা দিলে সেই কথাটি রক্ষা করার চেষ্টা করা। মানুষের কাছে সম্মানিত হতে হলে বলা চলে এটা অন্যতম একটা শর্ত।
মানুষের জন্য এমন কিছু করা যা তাদের উপকারে বা কাজে লাগে। আপনার টাকা থাকলে মসজিদ-মন্দির, খেলার মাঠ – ঈদগাহ্ মাঠ করে দিতে পারেন, অভাবী-ঋণগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করতে পারেন। এগুলো করলে আত্মতৃপ্তি পাবেন। বেঁচে থাকার অভিপ্রায়টা আরও বেড়ে যাবে।

মানুষ কেন বাঁচতে চায়? ছোট্ট একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরও পরিস্কার হবে। ধরুন আপনি চাকুরী করেন। সরকারী চাকুরী। বেসরকারী বলছি না একারণেই যে, বেসরকারী চাকুরীজীবীদের ক্ষেত্রে এই ঘটনা খুব কমই ঘটে। কোন এক অফিসে দীর্ঘদিন চাকুরী করার পর হঠাৎ করে আপনার অফিসের বস আপনার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিল। বদলির চিঠি। আগামী দিন কয়েকের মধ্যেই আপনার পুরাতন কর্মস্থল ছেড়ে নতুন কর্মস্থলে যোগদান করতে হবে। ইস্! আরো যদি কিছুদিন এখানে থাকতে পারতাম। এই পরিচিত শহর, বাজার, দীর্গদিনের কলিগ, বন্ধু-বান্ধব সব ছেড়ে চলে যেতে সহসা মন চাইবে না। বাসার সব আসবাবপত্র, তল্পিতল্পা গুছাতে গিয়ে মন আরও খারাপ হয়ে যাবে আপনার। মন কিছুতেই এই শহর, চিরচেনা কর্মস্থল ছেড়ে চলে যেতে সায় দিবে না। মনে হবে এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পড়েছেন। কিংবা দীর্ঘদিন পর যখন কেউ তার বাবা-মা স্বানিদ্ধ্যে আসে বা আত্মীয় স্বজনের কাছে আসে চলে যাওয়ার সময় তখনও সবার মন খারাপ হয়। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা সব চেয়ে বেশি হয়। বিয়ের পর চির চেনা পরিবেশ ছেড়ে যখন শ্বশুড় বাড়ির দিকে রওয়ানা হয় তখন তো কান্নার রোল পড়ে যায়।
সবকিছু ছেড়ে না যাওয়ার জন্য এই যে একটা পিছুটান, এই পিছুটান এর কারণেও মানুষ বাঁচতে চায়। মানুষ যে পৃথিবী জন্মগ্রহন করে একদম বুদ্ধিহীন অবস্থায় সেখানে যখন সে বড় হতে থাকে, বুদ্ধি-বিবেচনা তৈরি হয়, বুকের ভেতর ভালোবাসার জন্ম হয় তখন গোটা পৃথিবী, সমাজ এবং তার পারিপার্শ্বিকতার একটা টান তৈরি হয়, অদৃশ্য ভালোবাসার একটা বন্ধন সৃষ্টি হয়। তাই হয়তো মৃত্যু চির সত্য জেনেও মানুষ আরও কিছুদিন এখানে থেকে যেতে চায়। বাঁচতে চায় আরও কিছুদিন।

মানুষের বেঁচে থাকার আর একটা কারণ হতে পারে পাপ। পাপের কারণেও অনেকেই মরতে ভয় পায়। মানুষ যখন তরতাজা থাকে, যখন রক্তে আগুন জ্বলে তখন সে পাপ করতে কোন দ্বিধা করে। খুন – ধর্ষণ – রাহাজানি – চুরি – ডাকাতি – ঘুষ – সুদ – ঝগড়া – গালমন্দ –পরনিন্দা – পরচর্চা হেন পাপ নেই যা সে করে নাই। পাপ করার একটা নির্দিষ্ট বয়সে গিয়ে তার মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে। তখন সে বাঁচতে চায় যেন মৃত্যুর আগে ক্ষমা চেয়ে নিতে পারে। আরও ভালো ভালো কাজ করতে চায় বলে সে আরও বেশিদিন বাঁচতে চায়। কিন্তু সত্যটা হলো মানুষ ভালো কাজের পরিবর্তে খারাপ কাজই বেশি করে এবং মরতেও ভয় পায়।

”মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।”

মানুষ বাঁচতে চায় কেন? কবিগুরু লেখা এই দুটি চরণের মধ্যেই তার উত্তর নিহিত আছে। এই পৃথিবীটা বড়ই সুন্দর। মায়াময়! প্রেম আর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। এই ভুবনে যার একবার আগমন ঘটে সে আর এর মায়া ত্যাগ করতে পারে না। তাই সে এমন সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চায় না। আবার অনেকেই চান তিনি তার সৃষ্টি দিয়ে মানুষের হৃদয়ে, ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকতে। তাই তারাও আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে চান। কিন্তু আমাদের জীবনটা খুব ছোট্ট, চাহিদা অসীম। কিন্তু এই সীমাহীন চাহিদা পুরণ করার মতো সম্পদের পরিমাণও সীমিত। ঠিক তেমনি মানুষের চাওয়ার যেমন কোন শেষ নেই, দেখারও শেষ নেই কিন্তু আয়ু তো সীমিত। একটা নির্দিষ্ট সীমায় পৌঁছানোর পর আয়ু রেখার গতি আর উপরে উঠবে না। গতি থেমে যাবে। এটা সব মানুষই জানে। তারপরেও এই সীমিত আয়ু নিয়েও মানুষ চিরকাল বাঁচতে চায়।

মানুষ খুব সহজে মরে না। মানুষের কই মাছের প্রাণ। নানা রকম অখাদ্য – কুখাদ্য খেয়েও মানুষ দিব্যি বেঁচে থাকে। আবার অনেকেই বেঁচে থাকার মূল্যটাকে বোঝে। জীবনের মূল্য কারো কারো কাছে হয়তো বা অনেক বেশিই। তাই অধিকাংশ মানুষই আত্মহত্যার মতো জঘন্য পথে পা বাড়ায় না। তারা বেঁচে থাকতে চায় আরও কিছু কাল।

শুধুমাত্র পৃথিবীতে জন্ম নিয়েই একজন মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। বরং জন্ম নেয়াটা তার জন্য দায়িত্ব ও কর্তব্যের সূচনা বলা যায়। সন্তান জন্ম নেয়ার পর বাবা-মা’র দায়িত্ব হলো সন্তানকে মানুষ করা। পড়ালেখা করানো। মানুষের মতো মানুষ করে বড় করে তোলা। এখানে ‘মানুষের মতো মানুষ’ বলতে শুধু বড় পদে চাকুরী বুঝাচ্ছে না, একজন মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ করে তোলা। যাতে করে সন্তানকে নিয়ে তার বাবা-মা গর্ব (অহংকার নয়) করতে পারেন। তারপর সন্তানকে বিয়েশাদি করানো। অতঃপর সংসারে নতুন অতিথি আসলে তাকে নিয়ে বাবা-মায়ের খেলা করার স্বপ্ন। কার না থাকে এমন আশা। এই স্বপ্নগুলোর কারণেও মানুষ বাঁচতে চায়।
…………….চলবে

বাবা (৪)

“ভুগোলে কাঁচা হতে নেই
সবার আগে জানতে হয় নিজের অবস্থান”-
বাবা বলতেন, দেশ ভ্রমণ করাও অনেক সওয়াবের কাজ
জ্ঞানার্জনসহ নতুন জায়গা এবং পরিবেশ সম্পর্কেও জানা হয়।
“জীববিদ্যা জানার আগে নিজেকে জানো”
শুধুমাত্র বাবারাই বলতে পারেন এমন জ্ঞানের কথা
মানুষ খুব সহজে ভেঙ্গে পড়ার মতো যন্ত্র নয়
মানুষের অবস্থান সবার উপরে।
বাবা খুব দূরদর্শী মানুষ ছিলেন
চোখ বন্ধ করে বলে দিতেন অনেক কিছুই
জীবনকে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন
হতাশার কোন ছাপ গ্রাস করেনি কোনদিন
শত দৈন্যদশায় থাকার পরেও হাসি মুখে যখন বলতেন
‘আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি’
তখন এক অদ্ভুত আলো খেলা করতো বাবার চোখে – মুখে
যেন অগণিত সুখপাখি উড়ছে বাবার মাথার উপর
শুধু ধরার উপায়টুকু জানতে হয়
ভীষণ কৌশলী হয়ে বেঁচে থাকতে হয়
বাবা সুখে থাকার মন্ত্র জানতেন
জানতেন সুখ পাখি ধরার সমূহ কৌশল।

বাবা নেই! অনেকদিন হলো
মাথার ওপর থেকে সরে গিয়েছে ছাদ
আশ্রয় খুঁজি! এখানে – ওখানে – সেখানে
একটু ওম নিবো বাবার বুকের
সেই পরম নির্ভয়ের জায়গাটা আর নেই।

অনেক বছর হলো সুখ পাখিগুলোও উড়াল দিছে
আমার এখন ব্যস্ত সময় কাটে জীববিদ্যায়
ভূগোল সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞানও নেই
অনন্তকাল ধরে শুধু একটা ডাহুক ডেকে যায়
বেদনার ডাক!
বুকের ভেতর কোথায় যেন মোচড় মেরে ওঠে
ভারী হয়ে ওঠে ডান হাতের শাহাদত আঙুল
মনে হয় বাবা আমার আঙুল ধরে আছে
আমি পথ হাঁটছি! হাটঁছি!
নির্ভয়ে শত মাইলের পথ।

মিমসিটি এক্সপ্রেস

তখন আমরা ঘুমের তালিম নিচ্ছিলাম কোনো এক জলসাঘরে সম্ভবত
চাঁদনিহাট থেকে আসা সেই ঘর আমাদের ঘুমের আয়োজন করতে গিয়ে
নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছিল বিব্রতকর নাকডাকা ভঙ্গিতে। এ উন্মাদ ঘরকে
ঘুমের ভেতর গচ্ছা দিয়ে আমরা রাজশাহীগামী ট্রেন ধরলাম। পথমধ্যে
আমাদের রুখে দাঁড়ালো একজন সিল্কি ঘুম, যার হাসিতে ফুটে পড়ছিল
চন্দনের ঘ্রাণ আর একটা মিম-মিম সৌন্দর্য!
.
দলের কনিষ্ঠ হিসেবে আমার উপর ভার ছিল সফরটা নির্বিঘ্ন করা। উদ্ভূত
পরিস্থিতিতে আমি যা করলাম, প্রথমেই ট্রেনটির নাম পরিবর্তন করে রাখলাম
মিমসিটি-এক্সপ্রেস।
অতঃপর সকলকে আশ্বস্ত করলাম এই বলে যে, পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়লেও আমরা ঠিক
গন্তব্যে পৌঁছে যাবো!
.
সবশেষে ট্রেনটির অট্টহাসির সাথে আমরাও ফেটে পড়লাম পৃথিবীর নানা প্রান্তে যেন
প্রত্যেকেই এক-একটা মিমসিটি এক্সপ্রেস!

মানুষ বাঁচতে চায় কেন? (পর্ব-২)

মানুষ কেন বাঁচতে চায়? এটা বিরাট একটা প্রশ্ন। বেঁচে থাকার সংজ্ঞা সাধারণত এক একেক জনের কাছে এক একেক রকম। বেঁচে থাকাটা ব্যক্তি, ব্যক্তির মনন, ব্যক্তির অবস্থান ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে থাকে। যারা জীবন নিয়ে হতাশ। ভাবছেন জীবন হয়তো থেমে গেছে। বাঁচার আশা খুবই ক্ষীণ তারাও কিন্তু চায় শেষ নিঃশ্বাসটি যেনো স্বস্তির হয়। তাই দেখা যায় মরণ পথের একদম সন্ধিক্ষণে এসেও কেউ কেউ প্রিয় জনের মুখ দেখতে চায়। হয়তো ভাবে প্রিয়জনের আশ্বাসের বাণীতে যদি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকা যায়! অনেকেই আবার না বলা কথাগুলো বলতে চায়। অনেকেই বলতে পারে, অনেকেই হয়তো পারে না।

মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হলো খাদ্য। তারপরেই আছে বাসস্থান। আনুষঙ্গিক আরও যে উপাদানগুলো লাগে তা হচ্ছে শিক্ষা, চিকিৎসা, বস্ত্র। মানুষের ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য আরও কিছু চাহিদার প্রয়োজন। যেগুলো না হলে তাদের বেঁচে থাকাটা সম্পূর্ণ হয় না। বেঁচে থাকার জন্য এসবের অতীব প্রয়োজন না হলেও মানুষের বেঁচে থাকাকে এরা প্ররোচিত করে। অনেকটা প্রভাবকের ভূমিকার মতো। এর মধ্যে আছে আত্মসম্মান বা সম্মানবোধ, শ্রদ্ধা, স্নেহ, মায়া, মমতা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না।

আমরা জানি কিশোর থেকে পৌঢ় এবং মূর্খ থেকে শিক্ষিত সবারই একটি সম্মানবোধ আছে। তারা হোক অতিশয় গরীব কিংবা অত্যন্ত ধনী। এই সম্মানবোধটুকু একবার চলে গেলে সে নিজেকে বেঁচে থাকাটা মূল্যহীন মনে করে। ঘরে বলেন আর কর্মক্ষেত্রেই বলেন না কেন পারস্পরিক সম্মানবোধটি থাকা খুবই জরুরী। শুধুমাত্র সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ নির্মাণ করার জন্যই কি মানুষ বাঁচতে চায়? ঘুম, খাওয়া আর আনন্দ-বিনোদনের মধ্যেই অনেকেই জীবনের মানে খুঁজে। আমরা প্রায়শঃ ভুলে যাই যে, বেঁচে থাকা মানে শুধু নিঃশ্বাস নেওয়া নয়। বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-পরিজন সবাই সবার সহযোগিতায় দাঁড়াতে চাওয়া, কাছাকাছি আসতে চাওয়া বেঁচে থাকার মানে এমনও হতে পারে। আমৃত্যু সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে চলা এবং কোনরূপ শঠতা-মিথ্যাকে প্রশ্রয় না দেওয়াটাও অনেকের কাছে বেঁচে থাকার মানে হতে পারে। যদিও এমন লোকের এখন বড়ই অভাব। তবে থাকাটাও বিচিত্র নয়।

কিশোর-যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্যে এসে বেশির ভাগ মানুষ একা হয়ে পড়ে। ভালোবাসার মানুষের সর্বাধিক প্রয়োজন পড়ে মূলত বৃদ্ধাবস্থায়। জীবনের অন্তিমক্ষণে দাঁড়িয়ে মানুষের চাওয়ার পরিমাণটি খুবই কমই থাকে। এমতাবস্থায়, যে মানুষটি সার্বক্ষণিক পাশে থেকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় তাকেই মনে হয় পৃথিবীর মধ্যে সব থেকে আপনজন। তখন মনে হতে পারে এই মানুষটি ছাড়া তার বেঁচে থাকাটা অসম্ভব।

এর বিপরীতও আছে। মানুষ শুধু বয়সে বাঁচে না বাঁচে তাঁর কর্মে। মানুষ সাধারণত তাদেরকেই মনে রাখে যারা তাদের কর্মের মধ্যে দিয়ে অমর হয়ে আছেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.), সক্রেটিস, প্লেটো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাদার তেরেসা, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, নিউটন, কাজি নজরুল ইসলাম প্রমূখ। এরা কিন্তু কেউ মরেনি সবাই বেঁচে আছেন মানুষের হৃদয়ে।

কেউ যখন বাঁচতে চায় তখন তার মধ্যে কিছু উদ্দীপনা কাজ করে যা তাকে বেঁচে থাকতে উৎসাহ যোগায়। মানুষ মাত্রই আশা নিয়ে বাঁচে। আশার তরীতে নিজের স্বপ্নগুলোকে সঙ্গী করে ভাসিয়ে নিতে কার না ভালো লাগে। এ ধরনের আশা এবং বিভিন্ন রকমের প্রান্তি প্রত্যেকটা মানুষের বেঁচে থাকার নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায়। স্বপ্ন হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার আর একটি নিয়ামক। কিছু স্বপ্ন মানুষকে বাঁচতে শেখায়। বাঁচার তীব্র ইচ্ছায় নিজেকে ভাসিয়ে নেয় এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। মানুষ অনেক কিছুই করতে চায়, কতো কিছুই না করার স্বপ্ন থাকে তাঁদের। মৃত্যুকে খুব সহজে আলিঙ্গন করতে পারে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কমই আছে। এই মরার ভয় মানুষের বেঁচে ইচ্ছেটাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও প্রিয়জন, আপনজন আর পরিবার মানুষকে যে মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে এই মায়াও তাকে বাঁচতে উৎসাহ দেয়।

পৃথিবীতে হাজারো বাঁচার উপকরণ আছে। প্রেম-প্রকৃতি, সংসার-মায়া, আনন্দ-সুখ এসবের প্রতি কেউ যখন তার মনোযোগ বাড়িয়ে দেয়, তার ভেতর ডুব দেয় নিভৃতে-একান্তে তখন তার বেঁচে ইচ্ছেটা এমনিই বাড়তে থাকে।
.
(চলবে…………….)
মানুষ বাঁচতে চায় কেন? ১ম পর্ব এখানে।

শিল্পিত পান্ডুলিপির কথা

রাতের বাতি নিভিয়ে দিয়ে যে আয়নায় মুখ দেখি
সেতো আমি নই, দেখি ঈশ্বরীর মুখোচ্ছবি,
কাঠঠোকরার ঠোঁট থেকে সুখ কেড়ে নিয়ে লিখি
উজ্জ্বল নাগরিক জীবনের মৃত্যু চিঠি।
আমাদের চারদিকে বেড়ে উঠছে শূন্যতা
বিষাদের ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে সব অঙ্কুরিত সুখ,
জানালার কার্নিশে বসে যে পাখি গায় ভালোবাসার গান
সেকি ভালোবাসা বোঝে
বোঝে খয়েরী রোদের কষ্টগাঁথা?
কচি ডগার মতো উর্ধ্বাকাশে এবার হাতদুটো তোলো
নিষিদ্ধ আগুনে পুড়িয়ে দেবো সুগন্ধি লোবান
উপেক্ষার রাতে তুমুল আঁধারে পুড়ে যাচ্ছে যে মানবিক ঠোঁট
তার ছোঁয়াতেও রচিত হতে পারে আজ শিল্পিত পান্ডুলিপি।

.
৯ জানুয়ারী, ২০১৬

মানুষ বাঁচতে চায় কেন?

বেঁচে থাকার উৎস কি? বিভিন্ন বিষয়কে অবলম্বন করে মানুষ বেঁচে থাকতে চেষ্টা করে। ছেলে-মেয়ে, টাকা-পয়সা, প্রেম-ভালোবাসা মূলত এগুলোই আঁকড়ে ধরেই মানুষ বাঁচতে চায়। কিশোর-তরুণ বেলায় মনে হয় আহ্ প্রেম-ভালোবাসা ছাড়া জীবন বৃথা। ‘তোমাকে না পেলে এ জীবন রেখে আর কি লাভ’ কিংবা ‘বিশ্বাস করো, তুমিই আমার জীবন’ সিনেমাটিক এমন সংলাপ অনেকেই বলে থাকে। কিন্তু বাস্তব বড়ই নির্মম। তাই দেখা যায় প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়েও কেমন করে অন্যের সঙ্গে ঘর বেঁধে দিব্যি সংসার করে যাচ্ছে। ব্যতিক্রমও আছে। তবে সেটা উল্লেখ করার মতো নয়।

একটা পরিণত বয়সে গিয়ে যখন অনেকেই সন্তানের বাবা-মা হয়ে যান তখন মনে হয় সন্তানই তো সব। বেঁচে থাকার মানে হচ্ছে এই সন্তান। সন্তানের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে মূল্য দিতে গিয়ে অনেক বাবা-মা’ই নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে কবর দিয়ে দেন। বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে যায় তখন সন্তান। কিসে সন্তানের ভালো হবে সেই চিন্তায় বাবা-মায়ের ঘুম হারাম হয়ে যায়। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর লিখেছিলেন- “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”। এই উক্তিতেই বুঝা যায় সন্তানকে নিয়ে বাবা-মায়ের কতো চিন্তা কাজ করে।

অনেকের কাছে টাকা-পয়সাও হতে পারে বেঁচে থাকার উৎস। টাকা ছাড়া জীবনই বৃথা। টাকা নেই তো আপনার কোন দাম নেই। স্ত্রী-সন্তানকে যদি ভাত-কাপড়ই দিতে না পারেন তাহলে আপনি কেমন স্বামী। সন্তানকে যদি আপনি ভালো স্কুলে পড়াতে না পারেন তাহলে আপনি কেমন বাবা, কেমন মা (অনেকেই এমন করে বলে)। “অভাবে স্বভাব নষ্ট” বলে একটা কথা আছে। তবে এটা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। টাকাকে যারা বেঁচে থাকার উৎস মনে করেন তাদের মধ্যে মানবিকতাটা একটু কম কাজ করে। সারাদিন যারা শুধুমাত্র টাকার পিছনে ছুটতে থাকেন তাদের মধ্যে অন্য কোন চিন্তা করার অবকাশ থাকে না। টাকা কখনও বেঁচে থাকার উৎস হতে পারে না। তবে টাকা বেঁচে থাকার একটা নিয়ামক হিসাবে কাজ করে মাত্র। এই যা।

বেঁচে থাকার উৎস হচ্ছে প্রেম-ভালোবাসা। হতে পারে সেটা ঈশ্বর প্রেম। প্রকৃতি প্রেম।অথবা মানবপ্রেম। অনেকেই আছেন জীবনের একটা শেষ পর্যায় গিয়ে ঈশ্বর প্রেমে নিজেকে উৎসর্গ করে দেন। তার ধ্যান-জ্ঞান সবই তখন হয়ে আধ্যাত্মিক। যুগল জীবনে যখন কোন নতুন অতিথি আসে তখন সে হয়ে যায় তাদের বেঁচে থাকার উৎস।

বেঁচে থাকার উৎস যেহেতু প্রেম, সে প্রেম আপনার অতীতও হতে পারে। কেননা এমন অনেকেই আছেন যারা তাদের অতীতকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকতে চান। প্রেম-ভালোবাসা জিনিসটাকে ভুলে যাওয়া অতোটা সহজ নয়। এটা রসগোল্লা নয় যে, খেয়ে ফেল্লাম, মুখটা মিষ্টি হয়ে গেল আর এক গ্লাস পানি পান করলাম। ব্যাস। শেষ! এটা হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা একটা অদৃশ্য অভিব্যক্তি।
.
(চলবে……………)

শূন্যচ্ছেদ

আলো ঘর – ঘর আলো
গুপ্ত প্রণয়ের সিম্ফনি
শব – শ্মশান – কান্না
তারপর বিবর্তনের রাত।
উষ্ণ নাভিতে আঁকা শিলালিপি
মুদ্রিত টেক্সট – চিহ্ন
আমরা পড়তে পারি – ধরতে পারি
শূন্যচ্ছেদ – যতিচিহ্ন।
এইযে আমাদের বহুমাত্রিক চাওয়া
কামারশালার উত্তপ্ত আগুন
চোরাবালি পথ – যৌনতা
অস্তিত্ব ধরে নাচে কেউ থৈ থৈ নাচ।
তবু স্থবির
সাপ লুডু খেলার জীবন
শূন্য একটা ধারণা মাত্র
যেন কৈশোরে পাওয়া যৌবন।

বিবর্তনবাদ

চুমুর ইকুয়েশান ছেড়ে দাও
কালাশনিকভ রাইফেল দেবো উপহার
মস্তিষ্ক বরাবর আঘাত করো
এক্স ওয়াই জেড বিবর্তিত স্পার্ম
দেখ, পাল্টে গেছে নিয়মের ব্যাকরণ
ম্যাথম্যাটিকসের জটিল হিসাব
মেকানিক্যাল এবং ইঞ্জিনিয়ারিং এর সূত্র
ফ্লেমিং ম্যাক্সওয়েল জুল ও রেসিস্ট্যান্টের সুত্র সমূহও
এবার ড্রয়িং খাতার মাঝ বরাবর ছিঁড়ে ফেল
এক অংশ নারীর অন্য অংশ পুরুষের
রাইফেল ফেলে একটা চুমু দাও
খেলার বয়স ঝরে গিয়ে মানুষের পুনরুত্থান হোক।