নাজনীন খলিল এর সকল পোস্ট

বিষ নিঃশ্বাস

বিষ নিঃশ্বাস

কোথাও নতুন আরেক চোরকুঠুরি তৈরি হলো ;
কোথাও জমাট বাঁধে আরো কিছু গাঢ় অন্ধকার।

স্থির হও। স্থির
চরকির বংশদণ্ডের মতো।
যখন তোমার চারপাশে হাওয়ার তালে তালে ঘুরবে
রংগীন কাগজের ঘুর্ণাবর্ত ; পৃথিবীর উল্লাস,
তোমার মনে হবে —
আহা! যদি হতাম ইন্দ্রধনুডানার শিতিকণ্ঠ পাখি,
কেউ না কেউতো কুড়িয়ে নিতো আনন্দের একটি পালক !

তোমার আকাশ দেখা জানালায় কুরুশবুননের রেশমিজাল
বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বণিগুলো।
তুমি জানো
সবাই ময়ুর নয়,
কেউ কেউ ফুল ও পাতা ঝরানো কষ্ট বুকে নিয়ে
বৃক্ষ হয়েই বেঁচে থাকে।

কবে
কত যুগ আগে যেন
তোমার জানা হয়েছিল ‘নিঃসঙ্গতা’ একটি হিংস্র ময়াল
তার কিলবিলে স্পর্শে বারবার বিবমিষা এবং শ্বাসরুদ্ধকর ভয়।

চাঁদের ঘোরলাগা দেয়ালে
হুট করে একটি ধুসর টিকটিকি নেমে আসে,
পতঙ্গভুক বীভৎসতা দেখতে চাওনি ;
বিচ্ছিন্ন করেছো সোনালি কারুকাজের দেয়াল।

পাখির কাছে ধার করেছো যে দু’টো ডানা,
আভারনাসের বিষবাষ্পে তারও পালক পুড়ে গেছে।

সারভাইভ্যাল অব দ্য ফিটেস্ট

এক প্রচণ্ড ঝড় উঠলো। ধুলোর। যেখানে যা কিছু ছিল স্থির, সব ছিটকে সরে গেল এখান থেকে ওখানে। লণ্ডভণ্ড।

ল্যাম্পপোস্টের গায়ে লেপ্টে থাকা মৃত প্রজাপতির চোখে তখনো সরব হয়ে ছিল এক বিস্মিততীব্র জিজ্ঞাসা–আলোর কাছাকাছি গেলেই পুড়তে হবে কেন! কিছুক্ষণের ভেতরই মৃতমাংস সন্ধানী পিঁপড়ারা ভীড় করবে এখানে। আত্মাহুতি দেবে আরো কিছু ক্ষুদ্রকায় প্রাণ। প্রখর তাপে পতঙ্গ পুড়ে পুড়ে খাদ্যসন্ধানী পিপীলিকা এবং যে তীব্রতাপ পুড়ায় পতঙ্গ, সেই খরদহন কখনো কখনো মানুষের নরম হাতগুলোতে ছড়িয়ে দেয় ফোসকার দাগ। আজীবনের।
এই যে মানুষ, পতঙ্গ অথবা পিঁপড়া যারা সন্ধান করে আলো অথবা মাংসের তাদের পরিণতিগুলো, একই সুতোয় বাঁধা। অবসান।

তার চাইতে এই প্রখর উত্তাপের উৎস থেকে দূরেই থাক্‌ ক্ষীণজীবী কীট-পতঙ্গ কাছিমলতাগুলো। আগুনের কাছা থাকুক কেবল অগ্নিপ্রতিরোধক ধাতব কাঠিন্য। ‘সারভাইভ্যাল অব দ্য ফিটেস্ট’।

শন শন দমকা হাওয়ায় ইতিউতি উড়ে যাচ্ছে শুকনো জীর্ণ ডালপালা, পাতা, খড়কুটো।
বাতাসের দুর্ণিবার আলোড়নে শূন্যে উঠে যাওয়া ঝরা পাতাগুলো পাখি নয়—এই কথাটা কখনো ভুলে যায় আত্মমগ্নতার গভীরে ডুবে যাওয়া কিছু মানুষ। ধূসর বর্ণের বিচ্ছিন্ন ঘুর্ণিতে তারা ভুগতে থাকে উড়ে যাওয়া ডানাবিভ্রমে। অহেতুক। ঝড় থেমে গেলে এসব ঝরে পড়া ছাইপাশ আবার নেমে আসবে মাটির মাধ্যাকর্ষণের টানে। জায়গা হবে ডাস্টবিনে। মিউনিসিপ্যালিটির আবর্জনার গাড়িতে।

প্রবলবর্ষণের তোড়ে ছাদ উপচে পড়া অবিরাম জলধারাও তো মাঝে মাঝে ঝর্ণার বিভ্রম তৈরি করে ফেলে এক নিমেষে। পাহাড়, ঝর্ণা এবং নদী পিয়াসী মানুষের কাছে এও এক তৃপ্তিদায়ক সান্ত্বনা। উঠোনে মিছেমিছি তৈরি হওয়া এক নদীতে মানুষ ভাসিয়ে দেয় নানা রঙের কাগজের নৌকা আর কপোলকল্পনায় ভাবে– ‘সপ্তডিঙ্গা মধুকর দিয়েছি ভাসায়ে’।

একটি কাম্যবৃষ্টির জন্য

একটি কাম্যবৃষ্টির জন্য

যে রূপালী নিনাদ
অজস্র ফিতার ঝিলিকে চিরে ফালিফালি করছে আকাশ;
তার কিছুটা
নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়ে দেয়ালে ঝুলন্ত ‘পিয়েরে অগাস্তে কতে’র তৈলচিত্রে।

আবহাওয়াবার্তায় ঠিকঠাক বলা হয়না ঝড়ের পূর্বাভাষ।
আমরা শুধু দেয়ালে পেরেক ঠুকে ঠুকে ঝুলিয়ে রাখি ‘দ্য স্টর্ম’ এর নকল
আর প্রতীক্ষায় থাকি একটি কাম্যবৃষ্টির।
নস্টালজিক পাতাগুলো উল্টেপাল্টে মুখস্ত করি বর্ষণইতিহাস ;
ইলিশখিচুড়ি আর কাকভেজার গল্প।

রোদপোড়া শহরের মাটি ভিজে গেলে
স্রোতের তোড়ে ভেসে আসবে, সোঁদাগন্ধের সাথে হারানো দিনের গান।

মানুষ কেন যে এত স্মৃতিকাতর হয়!
কাঠফাটা রৌদ্রের ভেতরে, ধারাজলের ভেতরে,
কেবলই হাতড়ে বেড়ায় স্মরণবিস্মরণের সোনালী খাতা,
আর হা-হুতাশে ঘিরে ফেলে চারপাশ।

রোদঝলসানো শহরের ঘরে
ছাতার ভেতরে জড়াজড়ি ভেজে পিয়েরের বালকবালিকা।

আমরা কেবল প্রতীক্ষায় থাকি ;
বৃষ্টি
সোঁদাগন্ধ
খিচুড়িইলিশ
কাকভেজা
হারানো দিনের গান।

আকাশবাড়ির ঠিকানা

আকাশের পকেটে কোন ডাকবাক্স আছে?

চিঠি উড়ে যাচ্ছে একটা প্রগাঢ় নীল অভিযাত্রার দিকে
শূন্যের সাথে শূন্যের দ্বন্দ্বজ কোলাহলে কে বেশী বেগবান
নির্ধারিত হোক।
হিপনিক জার্কসে ঘুম ভেঙ্গে গেলে
বুকের মাঝখান থেকে এক জোড়া সারস উড়ে যায়
অন্তহীন মেঘের বাড়ির পথে…….
একটি প্রবল ঘুম দ্রুত পতনোন্মুখ
অভ্রংলিহ পাহাড়ের চূড়া থেকে নিতল গহ্বরে।
আহা স্বপ্ন! সূর্যমহলের সিংহদুয়ারে আটকে পড়া স্বপ্নগুলো!
মনোশরীরবৃত্তে বন্ধী ঘুম অথবা স্বপ্নের প্রতি
তর্জনী তাক করা ; অভিষঙ্গবাহুল্য। মনে হলো এমন।

রাত বেয়ে নেমে আসে কাঁকরভেজা এক পথ
শিথানে চুলের গোড়া থেকে ঝরে পড়ছে মেডুসার সাপ…

এক মাঠ বৃষ্টির ভেতর

এক মাঠ বৃষ্টির ভেতর

দীর্ঘশ্বাসের অবশেষটুকু রেখে,
দূরদিগন্তে ছায়াটা মিলিয়ে যায়;
কুয়াশার মতো অস্পস্ট ধারাজলের ভেতরে।

কী যে প্রখর ফুটেছে জারুল-সোনালু !
পাতাগুলো লাজনম্র আবছা হয়ে আছে।
তীব্র কৃষ্ণচূড়া; আকাশের নীচে সামিয়ানা পেতে অপেক্ষায় আছে
যেনো এক্ষুণি শুরু হবে বর্ষামাঙ্গলিক মেঘমল্লারের তালে তালে,
নেচে যাবে একশ ময়ুর;
লাল মখমলে মেঘের অশ্রুগুলো
টুপটাপ মুক্তোর মতো ঝরে গেছে আজ সারাদিন।

ফিরে আসে বৃষ্টিদিন, কদমকেতকীর রাত।

প্রবল উল্টেপাল্টে যায়,
খুলে যায় স্মৃতির সোনালীপাতাগুলো।
গভীর গোপন খামগুলো
চন্দনসুগন্ধী কুঠরিতে অস্ফুটে কথা বলে ওঠে।

একটা যতিহীন সুদীর্ঘপথ হেঁটেছি কেবল ছায়ামগ্নতার ভেতরে;
দরোজার বাইরে ছিল সুর্যশিখার পথ;
স্বপ্নের ঘোরে কেউতো খুঁজে না রোদতপ্ত দিন !

আজ কি দুঃখদিন?
অঝোরধারা চিরে উড়ে গেল একটি শালিখ;
জুড়িটা কোথায় গেল কোথাও পাইনি খুঁজে।
চিলেকোঠার পাশে জড়োসড় ভিজেকাক।

আজকে নাহয় এক মাঠ বৃষ্টির ভেতরেই ছড়িয়ে দিলাম
রোজনামচার ছেঁড়াপাতাগুলো।

( ভুল দরোজা এবং পুরনো অসুখ)

আমি ঘুমোতে চেয়েছি

আমি ঘুমোতে চেয়েছি

আমিতো ঘুমোতে চেয়েছি
গাছের ছায়ায় ঢাকা নিমগ্ন ঘাসের মতো নিরিবিলি
চাঁদটাই তার প্রখর জ্যোৎস্নাউচ্ছ্বাসে ঘুমোতে দেয়নি,
চাঁদনি প্রাবল্যে ঢেলে দিল আজীবন অনিদ্রাঅসুখ।
ঘোর চন্দ্রিমার সোনালি আগুনে
কেন যে তীব্র এক হা-হুতাশ বাঙময় হয়ে গেল !
হাহাকারের শব্দগুলো এতোটাই প্রবল ছিল
যেন নিঃশ্বাসের শব্দ বেজে যাচ্ছে
কামারশালার নেহাইয়ে হাপরস্পন্দনের মতো।
স্রোতে টলমল ডিঙ্গির শোকে সমুদ্র যখন ফেলল দীর্ঘশ্বাস
আরো প্রবল থেকে প্রবলতর ঢেউ উঠলো
গিলে নিলো আস্ত ডিঙ্গিটাকেই।

যদি তুমি আমাকে ভুলে যাও –পাবলো নেরুদা

যদি তুমি আমাকে ভুলে যাও —-পাবলো নেরুদা
অনুবাদ– নাজনীন খলিল।

আমি তোমাকে
একটি কথা জানাতে চাই
তুমি জানো তা কেমন করে :
যদি তাকিয়ে থাকি স্ফটিক চাঁদের দিকে
আমার জানালায় ধীর শরতের লালিম শাখায়,
যদি স্পর্শ করি
আগুনের পাশে
স্পর্শাতীত ছাই
অথবা জরাজীর্ণ কাঠের গুঁড়ি,
সব কিছু আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যায়,
যেন সবই অস্তিত্বময়,
সুরভীটুকু, আলো,ধাতুগুলো,
ছোট্ট নৌকাগুলোর
পাল ছিল
আমার প্রতীক্ষারত তোমার দ্বীপগুলোর দিকে।
বেশ, এখন,
যদি একটু একটু করে থামিয়ে দাও আমাকে ভালোবাসা
আমিও অল্প অল্প করে রুদ্ধ করে দেবো তোমাকে ভালোবাসা।
যদি আকস্মিক,
তুমি আমাকে ভুলে যাও
আর খুঁজোনা আমাকে
কারণ এরমাঝেই আমি ভুলে যাবো তোমাকে।
যদি তুমি এটা দীর্ঘ এবং মাতলামো ভাবো,
বৈজয়ন্তী বায়ুপ্রবাহের ভেতরে বয়ে যায় আমার জীবন,
এবং তোমার সিদ্ধান্ত
আমাকে ছেড়ে যাওয়া সেখানে
হৃদয়ের যে তটরেখায় আমার অধিষ্ঠান,
মনে রেখো
সেটা সেই দিন
সেই প্রহর
আমি আমার বাহুদ্বয় উত্থিত করবো
এবং আমার শেকড় উঠবে অন্য ভূমির সন্ধানে।
কিন্তু
যদি প্রতিদিন,
প্রতি ঘন্টা,
তুমি অনুভব করো তুমি এগিয়ে আসছো আমার দিকে
তোমার অপ্রশম্য মধুরতা সহ,
যদি প্রতিদিন একটি পুষ্প
তোমার ওষ্ঠদ্বয়ে আরোহণ করে আমার সন্ধানে,
আহ আমার প্রেম, আহ আমার আপন,
আমার মাঝে পুন: প্রজ্বলিত হয় সে সব আগুন
আমার মাঝে কিছুই নিঃশেষ হয়নি অথবা হয়নি বিস্মৃত।
আমার ভালোবাসা শুষে নেয় তোমার প্রেম, প্রিয়,
এবং যতদিন বেঁচে থাকবে তুমি তোমার বাহুডোরে থাকবে
আমাকে না ছেড়ে।

[If You Forget Me —Pabolo Neruda]

অচিন্ত্য প্রেমের হরিণ /ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা

অচিন্ত্য প্রেমের হরিণ /ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা
অনুবাদ: নাজনীন খলিল

কেউ বুঝতে পারেনি তোমার জরায়ুর
গাঢ় ম্যাগনোলিয়ার সৌরভ।
কেউ জানতোনা তুমি দাঁতের ফাঁকে সয়েছিলে
ভালবাসার একটি হামিংবার্ড তাও।
তোমার কপালের শশীকলার সাথে খোলাপ্রান্তরে
ঘুমিয়ে পড়েছিল সহস্র ক্ষুদে পার্সিয়ান ঘোড়া,
তুষারের শত্রু,
যখন চার রাত তোমার কোমর রেখেছিলাম আলিঙ্গনাবদ্ধ করে।
প্লাস্টার এবং যূথিকার ফাঁকে তোমার চকিতচাহনি
ছিল একটি বিবর্ণ বীজশাখা।
তোমাকে দেবার জন্য আমার হৃদয়ে খুঁজেছিলাম
গজদন্ত অক্ষরগুলো যা বলে, “সিয়েমপ্রে” ,
“সিয়েমপ্রে “,”সিয়েমপ্রে” : আমার নিদারুণ যন্ত্রনার উদ্যান,
সর্বদাই ধরাছোঁয়ার বাইরে তোমার শরীর,
আমার মুখবিবরে তোমার ধমনীর ওই রক্ত,
ইতিমধ্যেই তোমার মুখগহবর আলোহীন
আমার মৃত্যুর জন্য।
[সিয়েমপ্রে– চিরকালীন]

ইংরেজী :
Gacela Of Unforseen Love – Poem by Federico García Lorca

No one understood the perfume
of the dark magnolia of your womb.
Nobody knew that you tormented
a hummingbird of love between your teeth.
A thousand Persian little horses fell asleep
in the plaza with moon of your forehead,
while through four nights I embraced
your waist, enemy of the snow.
Between plaster and jasmins, your glance
was a pale branch of seeds.
I sought in my heart to give you
the ivory letters that say “siempre”,
“siempre”, “siempre” : garden of my agony,
your body elusive always,
that blood of your veins in my mouth,
your mouth already lightless for my death.

দুঃখদিনের দূতি

দুঃখদিনের দূতি

তোরঙ্গ খুলতেই ঘর জুড়ে
ন্যাপথেলিনগন্ধের মতো স্মৃতির ঝাপটা
আয়নায় একটুকরো মনখারাপ, বিষন্ন হাসে।
অপটিক ক্যাবল থেকে উড়ে যায়
ফিরে আসে বিষাদমগ্ন একলা শালিখ;
নিঃসঙ্গ শালিখ দুঃখদিনের দূতি–
সকলেই জানতো সে কথা।

মাত্র একটি শব্দ-উচ্চারণের হেরফের

মাত্র একটি শব্দ-উচ্চারণের হেরফের

তেমন করে যাওয়া হয়না।
কোন সীমাহীনেই তো হারিয়ে যেতে চেয়েছিলাম————-
গন্তব্যবিহীন এক ট্রেনের হুইসেল যখন বেজে ওঠে,
বলি–একটু থামো।ভেবে দেখি আর আমার নেবার মতো কিছু বাকী আছে কিনা।

নিতান্ত প্রকৃতির খেয়ালে বেড়ে ওঠা অশ্বত্থ–কতদূর তার শিকড় ছড়ায়
কেমন রাশি রাশি নেমে আসা ঝুরি-জটাগুলো ঘিরে রাখে তার সমস্ত অবয়ব!

এওতো সত্যি–সম্পর্কগুলো কুরুশ-কাঁটার বুননে নকশী-ফুলের মতো
মনে করো –অনবধানে শেষ গিঁট খুলে গেছে
তখন আর কোথায় নকশা
কোথায়ইবা মনোলোভা কারুকাজ!
পরিত্যাজ্য-প্রায় কুঁচকানো অতি-সাধারণ একখণ্ড সুতো।
তবু কি তার মাহাত্ম্য!
দ্রৌপদীর অন্তহীন আঁচলের মতন–কেবলই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর, দীর্ঘতম……….

কোন পথে গেছে অমৃত-উদ্যান
কোনটি অতলান্ত-অন্ধকার টানেলের পথ

মাত্র একটি শব্দ-উচ্চারণের হেরফের বদলে দেয় আমূল জীবন;
মাত্র একটি——হ্যাঁ
অথবা———-না।

___________________
(এক বৎসর আগের এই দিনে)

হরস্কোপ

হরস্কোপ

ভাবছি একটা খাঁচাবন্ধী টিয়া হাতে
বসে যাবো রাস্তার পাশে।
তুমি বলতে পারো
এসব ভাগ্যগণনা,
হরস্কোপ টোপ সব বাজে কথা,
কুসংস্কার!
কিন্তু আমি তোমাকে নির্দ্বিধায় বলতে পারি
টিয়ার ঠোঁটে তুলে নেওয়া রংগীন কাগজে
বিশ্বাস রেখো।
সময়ের শবদেহ ক্ষমা চায় শুধু
অবিরত ক্ষমা করতে করতে
একবার আয়নার সামনে দাঁড়াই;
ক্ষমাহীন সব কালশিরা ফোটে আছে।
কেবল নিজেকেই ক্ষমা করা যায়না কখনো।
আহা! আমার কুড়িয়ে পাওয়া রঙীন কাগজ…

তীব্র বাজাও তবে

তীব্র বাজাও তবে

তুমি হুইসেল বাজাতে জানো?
নিমেষে খান খান
ভেঙ্গে ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ করতে পারো
স্থবির পাথরের জগদ্দল স্তব্ধতা?
একটি আকাশপাতাল জোড়া খাতা খুলে বসে আছি।
অমিয়ঘোরে নিষিক্ত নতুন শব্দ লেখা হোক কিছু
এমন ভাবতে ভাবতে
চুরি হয়ে গেলো ভৈঁরো রাগে বাঁধা বেলীর সুগন্ধ।
বাতাসের কানে কানে রেখে দেই তবে
কিছু নীরবতা।

ক্যারিকেচার

ক্যারিকেচার

এক ঢেউসমুদ্রের খুব মন কেমন করা অন্ধকারে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে,
ইচ্ছে করে নিষিদ্ধ করে দিতে
জানালার ফাঁক গলে অনাহুত ঢুকে পড়া
আবছা চাঁদের ছড়ানোছিটানো পাপড়িগুলো।
দূরে কোথাও একটি ‘পিউ কাহা’র কুহুতান
থেকে থেকে নাহয় ডেকেই গেলো অনিবার।

যখন আগাপাছতলা দেখে নিলাম একটি সম্পূর্ণ জীবন ;
মনে হলো এই দিনযাপনের ছবিটা
উদভ্রান্ত কাঁপা হাতে আঁকা এক ক্যারিকেচার।
ঈর্ষাতুর তাকিয়ে থাকি অনিমেষ
কোথাও আঁকা হয়নি সেই অসম্ভব ছবিটির দিকে।

কতো কী যে বদলায়!
নিজস্ব অবয়ব দ্বিধাহীন উহ্য ফেলে রেখে
মহুয়ামাতাল ঘোরে
ভিন্ন কোন জীবনের ছায়াপাঠে মগ্ন হই।
চিহ্নিত হবার আগেই শরীরে ছড়িয়ে পড়ে সংক্রামক-দুরারোগ্য রোগের কণিকা।
প্রতিচ্ছবি বদলে যায়, রোগাক্রান্ত এক আকৃতি ভেসে ওঠে
তবু প্রতিদিন হাসপাতালের রাস্তার এক ফার্লং দূরপথ দিয়ে হেঁটে গেছি।

জীবন ফুরিয়ে যায় যেমনতেমন;
খোলামকুচির মতো অবজ্ঞায় ফেলে দেয়া সময়ের হাহাকার তবু বেঁচে থাকে,
গোধূলির রংয়ে বেজে ওঠা বিদায়ী সানাইয়ের ধুনে
জেগে ওঠে শেষঘন্টার হা-হুতাশ;
অস্তরাগের আবীরে মাখামাখি কিছু প্রত্যাশাও
বাকী থাকে যেন।

মানচিত্রের বাইরে থেকে পৃথিবীটাকে একবার দেখে নিতে চেয়েছিলাম;
জ্বলজ্বলে লাল দাগের বাইরে যেতে পারলোনা চোখ।

বৃক্ষের মতো

বৃক্ষের মতো

ছায়া বাঁকানো পথটা চলতে চলতে
কোথাও না কোথাও হুটহাট ঢুকে পড়বে
কোন অচেনা গলিতে।

ক্রমশঃ সাহসী হয়ে উঠা মুমূর্ষু গাছ
আনকোরা কুঁড়ি ও পল্লবের জেগে ওঠা ;
এসব দেখলে —
স্বপ্ন দেখার সাহস ফিরে আসে। ত্রাস কেটে যায়।

গ্লেসিয়ারে অনিচ্ছুক ঢুকে পড়া
মত্ত তুষার ঝটিকার হাড়ভেদী হিমের কীলক
মৃত্যুভয়ে কেঁপে ওঠা ; মনে থাকেনা।

কোন না কোন একদিন
রোদের চোখের ভেতর থেকে
আমিও উপড়ে ফেলবো তার ছায়া। আমি।

ইনকগনিটো

ইনকগনিটো

সবাই সতর্ক খেলছে। চেস, ট্রাম্পকার্ড, হাউজির খেলা।
ছায়ার অন্তর্গত ভিন্ন ছায়াবাজির খেল ;
ইন্দ্রজাল আর ছদ্মবেশের চৌকাঠে
পা আটকে যাচ্ছে বারবার।

হয়তো-
তোমার পিংক বাথটাবেরকানাভর্তি স্বচ্ছতার
আড়ালে আছে কোন প্রাণঘাতী দাহক ;
উপুড় অডি কোলনের শিশি ঢাললেই
রুদ্ধ হবেনা তার জ্বলন স্বভাব।
বিপরীতে –
গায়ে ভীতিকর রোঁয়া ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে
ভয় দেখাচ্ছে যে হত কুৎসিত শুঁয়াপোকা ;
সে-ও একদিন ঠিক মধুবর্ণী প্রজাপতি হবে।

কোনটা যে কার আসল রূপ!
কে যে কোন আড়ালে লুকোনো!

কখনওবা আবরণও মনোহর
চরকির ফ্যাকাসে কাগজে
চড়া রঙের প্রলেপ মাখানো ঘূর্ণনে বুঁদ হয়ে থাকি।

একটি গাঢ় রাত যখন তিমিরাশ্রয়ী আরেকটা রাতকে
আবরণ খুলতে বলে ;
অন্য রাত অবজ্ঞায় পাশ ফিরে শোয়।
যেন সে বধির। যেন সে স্পর্শ স্পন্দনহীন।

দেয়াল এঁকে যাচ্ছে ঝড়মন্দ্র বাতাসের করতাল
ফুটে ওঠে একটা হাঙ্গর ভয়ের ছায়া
ঝরে যাচ্ছে সব আচ্ছাদন………

আড়াল ভালোবাসি আমিও তো।