চাঁদের প্রাণিগুলো ঘুরছিল আর শুঁকছিল তাদের কুটীরের চারপাশ।
যে লোকগুলো স্বপ্ন দেখেনা তাদের কামড়ে দেবে এসে জীবন্ত গুঁইসাপ,
এবং ভগ্নহৃদয়ে পালিয়ে যাওয়া লোকটাকে পাওয়া যাবে রাস্তার মোড়ে তারাদের মৃদু প্রতিবাদের শান্ত তলদেশে অবিশ্বাস্য কুমিরগুলো।
ঘুমায়না কেউ পৃথিবীতে। কেউ নয়, কেউনা।
কেউ ঘুমায়না।
দূরের এক সমাধিতে একটি শবদেহ
পুড়ছে তিন বৎসর ধরে
কারণ তার হাটুর নীচে একটি গ্রামীণ শুষ্ক ভূমি
এবং যে সকালে তারা সমাধিস্থ করেছিল ওই ছেলেটিকে কেঁদেছিল অনেক
তাকে শান্ত করার জন্য প্রয়োজন ছিল কুকুরগুলোকে ডেকে পাঠানোর।
জীবন একটি স্বপ্ন নয়, সাবধান! সাবধান! সাবধান!
আমরা সিঁড়ি থেকে নেমে যাই ভেজামাটির স্বাদ অনুভবের জন্য
অথবা আরোহন করি বরফের ক্ষুরধার প্রান্তে মৃত ডালিয়ার কণ্ঠস্বরের সাথে।
কিন্তু বিস্মরণ বলে কিছু নেই, স্বপ্নও নেই।
অস্তিত্ব আছে মাংসের। নতুন একগুচ্ছ শিরায়
চুম্বন আমাদের মুখগুলোকে জুড়ে রাখে,
এবং এই ব্যাথাকে যে জেনেছে সে আজীবন জেনেই যাবে
এবং আজীবন মৃত্যুকে বহন করবে তার কাঁধে যে ভয় পায় সে।
একদিন
ঘোড়াগুলো বাস করতে আসবে পান্থশালায়
এবং ক্ষিপ্ত পিঁপড়েগুলো
নিজেদের নিক্ষেপ করবে গরুর চোখে আশ্রিত হলুদ আকাশে।
একদিন
আমরা সংরক্ষিত প্রজাপতিগুলোকে দেখবো মৃতদেহ থেকে উঠে আসতে
কিন্তু তখনও হাঁটছে ধুসর শৈবাল এবং স্তব্ধ নৌকার রাজ্যে।
আমরা দেখবো আমাদের আংটিগুলোর বিচ্ছুরণ এবং জিহ্বা থেকে গোলাপের ঠিকরে ওঠা।
সাবধান! সাবধান হও! সাবধান হও!
যাদের এখনো আছে বজ্রপাত এবং নখরের চিহ্নগুলো,
এবং ওই ছেলেটি যে কাঁদে কোনদিন সেতু আবিষ্কারের গল্প
শোনেনি বলে,
অথবা ওই মৃত লোকটি যে এখন মালিক শুধু তার একটি জুতো এবং মাথাটার,
আমরা অবশ্যই তাদের নিয়ে যাবো সেই দেয়ালের কাছে যেখানে অপেক্ষায় আছে গুঁইসাপ
এবং বিষধরেরা,
যেখানে ভালুকের দাঁতগুলো অপেক্ষায় আছে,
যেখানে অপেক্ষায় আছে ছেলেটির মমিকৃত হাত,
শেষপ্রান্তে দাঁড়ায় উটের কেশরগুলো তীব্র নীল কম্পনের সাথে।
কেউ ঘুমাচ্ছেনা আকাশে। কেউ নয়, কেউনা।
ঘুমাচ্ছেনা কেউ।
যদি কেউ বন্ধ করে তার চোখ
একটি চাবুক, ছেলেরা, একটি চাবুক!
খোলাচোখগুলোর দৃশ্যচিত্র হতে দাও
এবং আগুনের যন্ত্রণাক্ত ক্ষত।
এই পৃথিবীতে কেউ ঘুমাচ্ছেনা। একজনও না, নয় একজনও।
আমি এটা আগেই বলেছি।
কোন একজনও ঘুমাচ্ছেনা।
কিন্তু কেউ যদি রাত্রে তার মন্দিরে খুব বেশি শ্যাঁওলার জন্ম দেয়,
মঞ্চের চোরাদরোজাগুলো খুলে দাও সে যেন চাঁদনি দেখতে পারে
মিথ্যা পানপাত্রগুলো, বিষ এবং রঙ্গমঞ্চের খুলি।
(City That Does Not Sleep – Federico Garcia Lorca)
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা
[ অনুবাদকের কথা: ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা বিশ্বসাহিত্য- অঙ্গনে এক সুপরিচিত নাম। লোরকাকে স্পেনের সর্বাপেক্ষা মহান কবি হিসেবে এবং বিশিষ্ট নাট্যকারদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়। ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার জন্ম ৫ জুন ১৮৯৮, স্পেনের ফুয়েন্তে ভ্যাকুয়ারসে। তাঁর পিতা ফেডারিকো গার্সিয়া রড্রিগেজ ছিলেন একজন সম্পন্ন কৃষক। মা ভিসেন্তা লোরকা রোমেরিও ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক এবং পিয়ানোবাদক। স্পেনিয় নামকরণ রীতি অনুসারে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা নামের গার্সিয়া এসেছে পৈতৃক সূত্রে এবং লোরকা এসেছে মায়ের সূত্রে। মা ভিসেন্তা লোরকা রোমেরিও ছিলেন লোরকার আইডল। ১৯৩৬ সালের ১৯ অথবা ২০ আগস্ট বিনা বিচারে জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর সমর্থকদের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান তিনি।
এই আপেলগুলোর স্বপ্নে আমি ঘুমুতে চাই,
সমাধিক্ষেত্রের কোলাহল থেকে উঠে এসে।
ওই শিশুটির স্বপ্নে আমি ঘুমুতে চাই
যে উত্তাল সমুদ্রে ছিন্ন করতে চেয়েছিল তার হৃদয়।
মৃতদের রক্তক্ষরণ হয়না একথাটি আর শুনতে চাইনা,
ওই যে গলিত মুখগুলো যায় জলের সন্ধানে,
আমি শিখতে চাইনা ঘাসের এই নির্যাতন,
দেখতে চাইনা ভোরের আগে কর্মচঞ্চল চাঁদের সর্পাকৃতি মুখ।
কিছুক্ষণ ঘুমুতে চাই
কিছুক্ষণ, এক মিনিট, এক শতাব্দী;
কিন্তু সবাইকে অবশ্যই তা জানতে হবে আমি মরে যাইনি।
যেহেতু আমার ঠোঁটগুলোতে স্বর্ণখণ্ড
যেহেতু আমি ওয়েস্ট উইংয়ের এক ক্ষুদে বন্ধু
যেহেতু আমি আমার কান্নার তীব্র ছায়া।
ভোরে আমাকে ঢেকে রেখো একটি আচ্ছাদনে
কারণ ভোর আমার দিকে ছুড়ে দেবে মুঠোভর্তি পিপীলিকা,
এবং আমার জুতোগুলো ভিজিয়ে দিও খর জলে
যেন পিছলে যেতে পারে বৃশ্চিকের চিমটিগুলো।
যেহেতু আমি আপেলগুলোর স্বপ্নে ঘুমুতে চাই
শিখতে চাই সেই আর্তনাদ যা আমাকে শুচি করে দেবে মৃত্তিকার সাথে;
যেহেতু আমি থাকতে চাই ওই তমসাচ্ছন্ন শিশুটির সাথে
যে তার হৃদয় ছিন্ন করতে চেয়েছিল উত্তাল সমুদ্রে।
(Gacela of the Dark Death – Federico Gercia Lorca)
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা
[ অনুবাদকের কথা: ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা বিশ্বসাহিত্য- অঙ্গনে এক সুপরিচিত নাম। লোরকাকে স্পেনের সর্বাপেক্ষা মহান কবি হিসেবে এবং বিশিষ্ট নাট্যকারদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়। ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার জন্ম ৫ জুন ১৮৯৮, স্পেনের ফুয়েন্তে ভ্যাকুয়ারসে। তাঁর পিতা ফেডারিকো গার্সিয়া রড্রিগেজ ছিলেন একজন সম্পন্ন কৃষক। মা ভিসেন্তা লোরকা রোমেরিও ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক এবং পিয়ানোবাদক। স্পেনিয় নামকরণ রীতি অনুসারে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা নামের গার্সিয়া এসেছে পৈতৃক সূত্রে এবং লোরকা এসেছে মায়ের সূত্রে। মা ভিসেন্তা লোরকা রোমেরিও ছিলেন লোরকার আইডল। ১৯৩৬ সালের ১৯ অথবা ২০ আগস্ট বিনা বিচারে জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর সমর্থকদের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান তিনি।
তখন হাঁটছিলাম রংধনুর পথে
এতোটুকু বাজেনি দুর্লঙ্ঘ্য অতিক্রমের কোন ব্যাথা,
পথের দুপাশে থোকা থোকা
বর্ণালী রডোডেনড্রন ফুটেছিল।
এক উল্লসিত পুষ্পবিহার শেষে
চিহ্নিত হলো পায়ের পাতার গাঢ় ক্ষতদাগ।
খুব দ্রুত ঝরে পড়ে সোনালি পরাগ, তাই
ডানায় খুশীর সুগন্ধ মেখে প্রজাপতি উড়ে গেলে
ঈর্ষা হয়।
সেই থেকে
সোনালি নূপুরের একফোঁটা দ্বেষণার মেঘ,
সযতনে আগলে রেখেছি ;
কোন একদিন
পাথুরে নাচঘরে ঝরে যাবে শিঞ্জিনীর তালে।
সব ছবি জমা থাকে চশমার কাঁচে।
মাঝেমাঝে চোখ ঝাপসা হলে
অসময়-আচমকা বৃষ্টির ছাঁট ভেবে মনকে ভুলাই।
কু-উ-উ-উ-ঝিক-ঝিক-ঝিক—কু-উ-উ-ঝিক-ঝিক—–
চলে যাচ্ছি—-চলে যাচ্ছি—–চলে যাচ্ছি———–
ছুটে চলেছে বিশাল ড্রাগন মুখে আগুনের ধোঁয়া।
আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে স্টেশন—-চেনা শহরের শেষ চিহ্ন।
দু’পাশের ধানক্ষেত –ক্ষেতে কাজ করা চাষী—মাঠে চরা গরুর পাল–বাঁশী-বাজানো রাখাল-বালক—
-খাল-বিল—–নদী-
মাছের জাল আটকে রাখা বাঁশের মাচান—দূরগ্রাম—হাটুরে মানুষ;
কত দ্রুত পিছনে চলে যাচ্ছে সব—আড়াল হয়ে যাচ্ছে।
জানালা-খোলা কামরার ভেতরে জমছে কুয়াশার মতো ধুলো। জমছে স্মৃতি।শৈশব। ছুটি।ট্রেন। মামাবাড়ী।
—–“মামাবাড়ির পদ্মপুকুর গলায় গলায় জল
এপার হতে ওপার গিয়ে নাচে ঢেউয়ের দল।”
কু-উ-উ-ঝিক-ঝিক–কু-উ–উ–ঝিক–ঝিক—-
চা-বাগান–পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ফুটে থাকা নাম না জানা ফুলের নানারঙ —অচেনা লোকালয়–
এসব দুই চোখে মেখে নিয়ে আমিও ফিরে যাচ্ছি বার বার আমার শৈশবে-কৈশোরে।
স্মৃতি থেকে খুঁড়ে তুলছি সেইসব রূপালী-বিষাদ যারা চোরা-জ্যোৎস্নার আড়ালে লুকোনো ছিল।
আর আগুনের স্তব গাইতে গাইতে একদিন ছায়াপথে মিলিয়ে গিয়েছিল যে নীলকণ্ঠ পাখীর ঝাঁক,
আজ আবার ফিরে এলো ডানায় আগুন ছড়াতে ছড়াতে।
আজ আবার মনে পড়ে গেল
এমনি এক জংশনে আমি উঠে পড়েছিলাম একটি ভুল গাড়ীতে।
টিকিট-চেকার বললো–‘এ গাড়ীতো আপনার নয়,–এখানেই নেমে যান’।
সকলেরই কি থাকে অচেনা-মাঝপথে নেমে যাবার সাহস? আমার ছিলনা।
বিমুগ্ধ-আবেশ কেটে গেলে শরাব মিথ্যে হয়ে যায়
তবু লালপানির পেয়ালা হাতে বসে থাকি;
জীবন দোল খাচ্ছে অবিরত ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো।
এখনো এ ঘরের সব কোন ছেয়ে আছে শেষ বিকেলের সুরভি-মদিরা
এখনো মুছেনি তানপুরার শেষ ঝংকারের রেশ
গোধুলীর কনে দেখা আলোর ঘেরে ফুটি ফুটি সন্ধ্যামালতী
আকাশে পাখসাট বাজে——-বিহঙ্গম ফিরছে কুলায়;
নিষ্প্রাণ স্ট্যাচুর মতো এক জোড়া মানব-মানবী
নির্বাক। ওদের সব কথা শেষ হয়ে গেছে।
তুমি তো জানতে —
চাঁদের কতটা গভীরে গেলে স্পর্শ করা যায় চরকাবুড়ির সুতো
আমাদের জন্য বাকী ছিল আরো এক তৃতীয়াংশ পথ।
ফিরে আসা যথার্থ ফিরে আসা হয়না আর
বারবার ভুল হয় প্রত্যাবর্তনের অলিখিত শর্তগুলো
অমলিন আঁকা থাকে পদযাত্রার ছাপ;
ফিরে আসি। পিছনে পায়ের দাগ রেখে আসি।
তুমি জানো তা কেমন করে:
যদি তাকিয়ে থাকি স্ফটিক চাঁদের দিকে
আমার জানালায় ধীর শরতের লালিম শাখায়,
যদি স্পর্শ করি
আগুনের পাশে
স্পর্শাতীত ছাই
অথবা জরাজীর্ণ কাঠের গুঁড়ি,
সব কিছু আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যায়,
যেন সবই অস্তিত্বময়,
সুরভীটুকু, আলো,ধাতুগুলো,
ছোট্ট নৌকাগুলোর
পাল ছিল
আমার প্রতীক্ষারত তোমার দ্বীপগুলোর দিকে।
বেশ, এখন,
যদি একটু একটু করে থামিয়ে দাও আমাকে ভালোবাসা
আমিও অল্প অল্প করে রুদ্ধ করে দেবো তোমাকে ভালোবাসা।
যদি আকস্মিক,
তুমি আমাকে ভুলে যাও
আর খুঁজোনা আমাকে
কারণ এরমাঝেই আমি ভুলে যাবো তোমাকে।
যদি তুমি এটা দীর্ঘ এবং মাতলামো ভাবো,
বৈজয়ন্তী বায়ুপ্রবাহের ভেতরে বয়ে যায় আমার জীবন,
এবং তোমার সিদ্ধান্ত
আমাকে ছেড়ে যাওয়া সেখানে
হৃদয়ের যে তটরেখায় আমার অধিষ্ঠান,
মনে রেখো
সেটা সেই দিন
সেই প্রহর
আমি আমার বাহুদ্বয় উত্থিত করবো
এবং আমার শেকড় উঠবে অন্য ভূমির সন্ধানে।
কিন্তু
যদি প্রতিদিন,
প্রতি ঘন্টা,
তুমি অনুভব করো তুমি এগিয়ে আসছো আমার দিকে
তোমার অপ্রশম্য মধুরতা সহ,
যদি প্রতিদিন একটি পুষ্প
তোমার ওষ্ঠদ্বয়ে আরোহণ করে আমার সন্ধানে,
আহ আমার প্রেম, আহ আমার আপন,
আমার মাঝে পুন: প্রজ্বলিত হয় সে সব আগুন
আমার মাঝে কিছুই নি:শেষ হয়নি অথবা হয়নি বিস্মৃত।
আমার ভালোবাসা শুষে নেয় তোমার প্রেম, প্রিয়,
এবং যতদিন বেঁচে থাকবে তুমি তোমার বাহুডোরে থাকবে
আমাকে না ছেড়ে।
[If You Forget Me – Pabolo Neruda]
লেখক পরিচিতি: পাবলো নেরুদা (১২ জুলাই, ১৯০৪ – ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩) ছিলেন চিলিয়ান কবি ও রাজনীতিবিদ। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল নেফতালি রিকার্দো রেয়েস বাসোয়ালতো। পাবলো নেরুদা প্রথমে তাঁর ছদ্মনাম হলেও পরে নামটি আইনি বৈধতা পায়।
পাবলো নেরুদাকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও প্রভাবশালী লেখক মনে করা হয়। তাঁর রচনা অনুদিত হয়েছে একাধিক ভাষায়। ১৯৭১ সালে নেরুদাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁকে এই পুরস্কার প্রদান নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। কলম্বিয়ান ঔপন্যাসিক গাব্রিয়েল মার্সিয়া মার্কেজ একদা নেরুদাকে ‘বিংশ শতাব্দীর সকল ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি‘ বলে বর্ণনা করেন।
তোমার শহরের মানচিত্র আঁকছিলাম দীর্ঘক্ষণ
সাদা কাগজে অবিরত পেন্সিলের উল্টোপিঠ ঘষে গেছি ; কোন দাগ পড়েনি কোথাও।
ছায়াঘন চোখের রাজপথ থেকে
গলি-উপগলি পেরিয়ে
এক গভীর উদ্যানের সাথে
মিশে গেছে যে অঙ্গুলি-নির্দেশ
কোন আঁচড়ের টানে যায়না ধরে রাখা তাকে।
নিমগ্ন পাঠে খুঁজেছি
শব্দের অর্ধস্ফুট বর্ণমালার ঘ্রাণ।
যন্ত্রণাগুলোকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে
একটা হট্টগোলের পৃথিবীতে চলে গেলেও
বিস্মরণে হারিয়ে যেতে দেয়না সুষুপ্ত একটা খোঁচা।
মুঠোর ঘর্ষণে সমস্ত সবুজ ঝরে গেলে
পাতার কংকাল হাতে বসে থাকি।
বরফে চোবানো বোতলটা এবার খোলো
ময়ুরপাখায় উড়তে থাকুক অবরুদ্ধ স্বপ্নগুলো;
একটি নাচের পালক খসে গেলে,তুলে নিয়ে
মহার্ঘ্য স্যুভেনির করে রেখে দিও।
পাবলো নেরুদার কবিতা : আমাকে রেখে দাও একটি গুপ্তস্থানে
আমাকে রেখে দাও ভূগর্ভস্থ একটি স্থানে, একটি গোলকধাঁধায়,
যেখানে আমি যেতে পারি,
যখন ফিরতে চাই
দৃষ্টিহীন, স্পর্শহীন,
পরিত্যক্ত, নির্বাক পাথরে, অথবা ছায়ার অঙ্গুলিতে।
আমি জানি তুমি তা পারবেনা, কেউ না, কিছুই পরিত্যাগ করতে পারেনা
সেই স্থান
অথবা সেই পথ,
কিন্তু কি করতে পারি আমি আমার দরদপূর্ণ তীব্র আবেগের সাথে,
যদি তারা অব্যবহৃত থাকে, প্রাত্যহিক জীবনের প্রান্তসীমায়,
যদি আমি দৃষ্টি নিবদ্ধ না করি টিকে থাকার দিকে,
প্রত্যাশা মৃত্যুর দিকে, অতিক্রম করছে, প্রবিষ্ট হচ্ছে এই অবস্থায়
ধাতব এবং তন্দ্রাচ্ছন্ন, আদিম অগ্নিশিখায়?
(Leave Me A Place Underground – Pablo Neruda)
লেখক পরিচিতি: পাবলো নেরুদা (১২ জুলাই, ১৯০৪ – ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩) ছিলেন চিলিয়ান কবি ও রাজনীতিবিদ। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল নেফতালি রিকার্দো রেয়েস বাসোয়ালতো। পাবলো নেরুদা প্রথমে তাঁর ছদ্মনাম হলেও পরে নামটি আইনি বৈধতা পায়।
পাবলো নেরুদাকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও প্রভাবশালী লেখক মনে করা হয়। তাঁর রচনা অনুদিত হয়েছে একাধিক ভাষায়। ১৯৭১ সালে নেরুদাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁকে এই পুরস্কার প্রদান নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। কলম্বিয়ান ঔপন্যাসিক গাব্রিয়েল মার্সিয়া মার্কেজ একদা নেরুদাকে ‘বিংশ শতাব্দীর সকল ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি‘ বলে বর্ণনা করেন।
এক শ্রাবণ-
তখনো ভোর তার সবগুলো দরোজা খুলেনি; সূর্য কেবল মিটি মিটি হাসিমুখ দাঁড়িয়ে আছে, আকাশের এক কোণে; চুপচাপ; অপেক্ষায় আছে কখন মেঘ, আলগা করবে তার নীল আঁচলের ঘোমটা। জলার ধারে এক পায়ে দাঁড়ানো ঘুমন্ত বক। মাত্রই ডানার আড়মোড়া ভাঙ্গছে গাঙ্গশালিক, মাছরাঙ্গা, ফিঙ্গে, পানকৌড়ি। প্রবল হাতছানিতে খুব ডাকছিল জলাশয়ের মাঝখানে ফুটে থাকা লালনীলসাদা পদ্মগুলো।
পাখায় তীব্র রঙের ঘোরলাগা প্রজাপতিটিকে দেখে আমার যে কী ভীষণ ইচ্ছা হলো- প্রজাপতি হয়ে যাই’। বৃষ্টি যখন পদ্মপাতায় বাজাবে জলতরঙ্গের সিম্ফনি; কত্থকের বোলে বোলে আমার দু’পায়ের ঘুঙুর বেজে যাবে … ঝমঝমাঝম। পাপড়ির ভাঁজে ভাঁজে শুষে নেবো বিজলী চমকের সবটুকু আলোকরশ্মি।
এই নীলমত্ততার ভেতরে বুনেছি নীলকমলের বীজ।
কত কিছু যে হতে চেয়েছি এক জীবনে ! পাখি, ফড়িং, প্রজাপতি, মেঘের ভেলায় চড়ে ঘুরে বেড়ানো লালঘুড়ি, পাতার বাঁশী, মেলার কাঠের ঘোড়া।
সাপ হবার কোন ইচ্ছা কখনো ছিলনা; তবুও দেখি হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে বিষদাঁত; রপ্ত হয়ে গেছে খোলস বদলের কলাকৌশল। অজান্তে জীবন কি তবে বদলে গেল অন্য কোন জীবনের সাথে ! দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকি।
“একদিনেরই জীবন হলেও ফুল হয়ে যে জন্ম নেবো…”
হ্যাঁ ফুলইতো হতে চেয়েছি। একটি উজ্জ্বল উচ্ছল কুমুদ-কুসুম। কোন অনামিকায় জড়ানো বৈদুর্য মণির আংটির মতো; দীপ্তি ছড়ানো। কথিত বাক্যে শুনি, সবার সহ্য হয়না নীলা। কারো দুর্ভাগ্যের প্রতীক হয়ে থাকে। তবু কেউ না কেউ চড়া দামে একখণ্ড নীল কাঁচের অভিশাপ কিনে বাড়ী ফেরে।
কারো গাঢ় নীল চোখ
বেজে যাচ্ছে বেদনার্ত সেতারের মতো ;
যেন ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে এক খণ্ড আকাশ,
যেন এক্ষুণি জন্ম নেবে এক নতুন সমুদ্র।
অথবা মনে করো
এক বিভোর উদ্যানে অপরাজিতা ফুটেছে অনেক
যেন নীল নীল ভোরের আধখোলা জানালায়
সবুজ ঝালরের ফাঁকে উঁকিঝুঁকি দেয়া সকালের দূত।
আকাশ অথবা সমুদ্রের এই প্রগাঢ় রঙ
আনন্দ নাকি যন্ত্রণার এই প্রশ্ন ভুলে
এক মনোরম ল্যান্ডস্কেপে বিমুগ্ধ,
তাকিয়েই থাকি।
মাঝেমাঝে
দুঃখ ও সুখের সব রঙ বুঝি এমনি একাত্ম!
এখনো দুই হাতে বিবর্ণ ধূসরতা মাখা,
ছায়াটাকে আততায়ী ভেবে নিয়েছি সন্ন্যাস ;
রঙিন ফানুশ ওড়ানো কালে
এই চিত্রকল্প খুব বেমানান মনে হয়।
চোখের ব্যাথা দেখি,
অথবা নীলকণ্ঠ ফুলের সুন্দর
কথাতো একটাই
আমার বিবর্ণ ধুসর হাত নীল ছুঁয়ে থাকে।
মনে হয়
এইসব রঙের বিপরীতে ভিন্ন কোন রঙ নেই,
ছিলোনা কোথাও।