নাজনীন খলিল এর সকল পোস্ট

একটি কাম্যবৃষ্টির জন্য

একটি কাম্যবৃষ্টির জন্য

যে রূপালী নিনাদ
অজস্র ফিতার ঝিলিকে চিরে ফালিফালি করছে আকাশ;
তার কিছুটা
নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়ে দেয়ালে ঝুলন্ত ‘পিয়েরে অগাস্তে কতে ‘র তৈলচিত্রে।

আবহাওয়াবার্তায় ঠিকঠাক বলা হয়না ঝড়ের পূর্বাভাষ।
আমরা শুধু দেয়ালে পেরেক ঠুকে ঠুকে ঝুলিয়ে রাখি ‘দ্য স্টর্ম’ এর নকল
আর প্রতীক্ষায় থাকি একটি কাম্যবৃষ্টির।
নস্টালজিক পাতাগুলো উল্টেপাল্টে মুখস্ত করি বর্ষণইতিহাস ;
ইলিশখিচুড়ি আর কাকভেজার গল্প।

রোদপোড়া শহরের মাটি ভিজে গেলে
স্রোতের তোড়ে ভেসে আসবে, সোঁদাগন্ধের সাথে হারানো দিনের গান।

মানুষ কেন যে এত স্মৃতিকাতর হয়!
কাঠফাটা রৌদ্রের ভেতরে, ধারাজলের ভেতরে,
কেবলই হাতড়ে বেড়ায় স্মরণবিস্মরণের সোনালী খাতা,
আর হা-হুতাশে ঘিরে ফেলে চারপাশ।

রোদঝলসানো শহরের ঘরে
ছাতার ভেতরে জড়াজড়ি ভেজে পিয়েরের বালকবালিকা।

আমরা কেবল প্রতীক্ষায় থাকি ;
বৃষ্টি
সোঁদাগন্ধ
খিচুড়িইলিশ
কাকভেজা
হারানো দিনের গান।

পতঙ্গের শবদেহ

“ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু”

কে আমায় করবে ক্ষমা?
আমিতো নিজেই আমার ঈশ্বর।

বেদেনী-বাঁশীতে নাচে লকলকে লোলুপ চেরা-জিব
বিকেলের বিষন্ন- হলুদ উঠোনে ঝেড়ে ফেলে তার বিষ-থলি
যেখানে খাদ্য-কণা খুঁটে খায় চড়ুই ছানারা;

অনন্তের ওপার থেকে ভেসে আসে বেহালার তান মাঝরাতে
বাতাসের মীড়ে মীড়ে বেজে ওঠে প্রচ্ছন্ন বর্ণমালা,
বর্ণালী মুক্তো-বৃষ্টি ঝরে ঝরে পড়ে;
বোধিকে আচ্ছন্ন করে তরঙ্গের তীব্র এক ধুন।

আনন্দের অলৌকিক প্রাসাদে বেঁধেছি ঘর-বাড়ী
আটপৌরে ক্লেশের সাথে আড়ি আড়ি খেলে
এক মহাকাল যাপন করি রোজ।

প্রতিরাতে-
রোজনামচার একটি পাতা ছিঁড়ে ফেলি —
দুমড়ে-মুচড়ে দেখি চমৎকার এক ফুল হয়ে গেছে
ভয়ংকর বিষাদ-সুগন্ধ মাখা এক বেলী ফুল।

একটি দেয়াল শুধু ছায়াকে আড়াল করে রাখে।
পতঙ্গের শবদেহ ভিজে ওঠে ভোরের শিশিরে।

মন ভালো নেই

কিছুই দেখবনা
এই চিরচেনা দৃশ্যাবলি
ঝুল বারান্দার টবে ফুলের কোলাহল
ক’টি রঙ্গিন প্রজাপতি উড়ে উড়ে মধু খায়;
সুপারি গাছের সারির বুকের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা
কৃষ্ণচুড়ার সবুজ মায়া -ছাওয়া ঘনিষ্ঠতা
ইলেক্ট্রিকের তারে ডিগবাজী খাওয়া
ঝুলে থাকা-তিনটে ফিঙ্গে;
ক’টি কাক উড়ে উড়ে
যায়
আসে
ঝুল বারান্দার রেলিঙ্গে
বসে
সামনের বাড়ির ছাদে
দেখবনা

একটি শালিক, আমার খুব বন্ধু
রোজ বসে পাশের বাড়ীর কার্নিশে
কোনদিন না এলে কষ্ট হয়;
তাকেও দেখবনা
রোজ বিকেলের মতো
সারাটা বিকেল নিঃসঙ্গ বারান্দায়
শুধুই নির্জীব
বসে থাকা
কিছুই দেখবনা
শরতের তীব্র নীল আকাশময়
শুভ্র মেঘপরীদের নেচে নেচে যাওয়া
কিশোরের লাল ও সাদা ঘুড়ির
প্রখর শত্রুতা
যেসব বালকের কোলাহলের আয়নায়
নিমেষেই নস্টালজিক
শৈশবের মুখ ভেসে ওঠে

আটপৌরে জীবনের সমস্ত বিষণ্নতা কোলে করে
ঘরে ফেরা কর্মজীবীর দল
এঁচড়ে পাকা কিশোরের
বিড়িটানা বখাটে রৈ রৈ হল্লা
এ শহরের এই পরিচিত ছুটে চলা;
ফিরেও দেখবনা।

মন ভালো নেই ।

অমূল্য-আপন

প্যান্ডোরার বাক্স থেকে একে একে ছড়িয়ে পড়ে
জরা, মৃত্যু, ভয়, মহামারী
দুঃখ- দৈন্য- ক্লেশে পৃথিবীর বাতাস ভারী হয়ে ওঠে ;
অবশেষে একটুখানি আশাইতো বাকী আছে।

-‘তবে আর ভয় কেন সাকী
মদিরালয়ের রুদ্ধ দুয়ার খোল
পেয়ালা পূর্ণ করে দাও দ্রাক্ষারসে
পাত্রখানি ভরে দিলে এই পিপাসার
অমৃতলোকের সাতটি দরোজা খুলে দেবো’

পানশালার দ্বারে করাঘাত , আজন্ম পানপিয়াসীর।
ঝড়ের মুদ্রায় মত্ত নটরাজ, প্রলয়-নাচনে
একে একে সাতটি দরোজা ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ে
মদিরা বিলিয়ে চলে সাকী, মুদ্রার বিস্ময়ে।

বুকে দুরন্ত দুপুরের সমস্ত আনন্দ জড়ো করে
জীবন হেঁটে চলে বিষণ্ন বিকেলের পথে
আষ্টে পৃষ্টে বেঁধে রাখে হারাই হারাই ভয়
কোথাও অমূল্য-আপন কিছু যেন আজ বাকী
এক খন্ড হরিৎ বর্ণ ঘেসো জমি
একটি গন্ধ-মাতাল সন্ধ্যামালতির ঝাড়।

মধুর অনুযোগের সনেট: ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা

অনুবাদ- নাজনীন খলিল।

আমাকে কখনো হারাতে দিওনা এই এই বিস্ময়
তোমার স্ট্যাচুর মতো চোখের , অথবা এই স্বরসঙ্ঘাত
তোমার নিঃশ্বাসের স্বতন্ত্র গোলাপ
যা রাত্রে স্থাপিত হয় আমার কপোলে।

আমি তটস্থ থাকি, এই সৈকতে
এই শাখাহীন গুঁড়ি, যা আমার তীব্র অনুতাপ
পুষ্পহীনতা, শাঁস অথবা মৃত্তিকা
আমার উদ্যমহীনতার জীবাণুর জন্য।

তুমি যদি হও আমার গুপ্তধন
তুমি যদি হও আমার দুর্দশা, আমার বিষন্ন যন্ত্রণা
যদি আমি হই সারমেয়, তুমি একাকী আমার প্রভু।

কখনো হারাতে দিওনা যা পেয়েছি আমি,
এবং সাজিয়ে দেবো তোমার নদীর শাখা
আমার বিচ্ছিন্ন শরতের পত্র-পল্লবে।

Never let me lose the marvel
of your statue-like eyes, or the accent
the solitary rose of your breath
places on my cheek at night.

I am afraid of being, on this shore,
a branchless trunk, and what I most regret
is having no flower, pulp, or clay
for the worm of my despair.

If you are my hidden treasure,
if you are my cross, my dampened pain,
if I am a dog, and you alone my master,

never let me lose what I have gained,
and adorn the branches of your river
with leaves of my estranged Autumn.

Sonnet Of The Sweet Complaint — Federico Garcia Lorca.

এক মাঠ বৃষ্টির ভেতর

দীর্ঘশ্বাসের অবশেষটুকু রেখে ,
দূরদিগন্তে ছায়াটা মিলিয়ে যায় ;
কুয়াশার মতো অস্পস্ট ধারাজলের ভেতরে।

কী যে প্রখর ফুটেছে জারুল-সোনালু !
পাতাগুলো লাজনম্র আবছা হয়ে আছে।
তীব্র কৃষ্ণচূড়া ; আকাশের নীচে সামিয়ানা পেতে অপেক্ষায় আছে
যেনো এক্ষুণি শুরু হবে বর্ষামাঙ্গলিক মেঘমল্লারের তালে তালে,
নেচে যাবে একশ ময়ুর;
লাল মখমলে মেঘের অশ্রুগুলো
টুপটাপ মুক্তোর মতো ঝরে গেছে আজ সারাদিন।

ফিরে আসে বৃষ্টিদিন,কদমকেতকীর রাত ।

প্রবল উল্টেপাল্টে যায়,
খুলে যায় স্মৃতির সোনালীপাতাগুলো।
গভীর গোপন খামগুলো
চন্দনসুগন্ধী কুঠরিতে অস্ফুটে কথা বলে ওঠে।

একটা যতিহীন সুদীর্ঘপথ হেঁটেছি কেবল ছায়ামগ্নতার ভেতরে ;
দরোজার বাইরে ছিল সুর্যশিখার পথ ;
স্বপ্নের ঘোরে কেউতো খুঁজে না রোদতপ্ত দিন !

আজ কি দুঃখদিন?
অঝোরধারা চিরে উড়ে গেল একটি শালিখ ;
জুড়িটা কোথায় গেল কোথাও পাইনি খুঁজে।
চিলেকোঠার পাশে জড়োসড় ভিজেকাক।

আজকে নাহয় এক মাঠ বৃষ্টির ভেতরেই ছড়িয়ে দিলাম
রোজনামচার ছেঁড়াপাতাগুলো।

( ভুল দরোজা এবং পুরনো অসুখ)

কিচ্ছু যায় আসেনা

বারান্দায় কুকুরের লেজের মতো বাঁকা একটা ছায়া পড়ে আছে।
ক্লীব হয়ে যাচ্ছি ,কিছুতেই যায় আসেনা কিছু।
সময়কে পাখির মতো খাঁচায় ঝুলিয়ে রাখি
খেয়াল-খুশী মতো দোল খেয়ে যাক।
কিচ্ছু যায় আসে না

উঠোনে ঝুলিয়ে রাখি পোড়া-লাশ ,সার্কাসের ক্লাউনের মতো।
লাশের কি আসে যায় মানুষের বীভৎস উল্লাসে?

কি দরকার এতো প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের হৈ চৈ ;
মায়ের ছেলে যদি মাঝনদীতেই হারিয়ে যায় বাড়ী ফেরার পথে?

সময় হেঁটে যাচ্ছে তমসাচ্ছন্ন জঙ্গলের দিকে,
সভ্যতার পোশাক আশাক খুলে ফেলে,
আদিমগুহার পথে হাঁটছে মানুষ।
অথবা
আস্ত একটা অন্ধকার বনই উঠে এসেছে জনপদে,পশুর অভয়ারণ্য।

লাল টেলিফোন পাশে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছো শীতাতপ ঘরে?
গহনঅরণ্য থেকে হা-মুখ অজগর আসছে ছুটে।
শুনতে পাচ্ছো? কিচ্ছু যায় আসেনা?

এখানে জীবন যেন জলে ভাসা তুচ্ছ খড়কুটো
যেমন তেমন ভেসে যাক বাতাসের তোড়ে,
হা-ঘরে মানুষগুলো বাঁচুক মরুক ;কিচ্ছু যায় আসেনা।

(ভুল দরোজা এবং পুরনো অসুখ)

মিউট

একটা ঝাপসা রাতের ভেতর জুড়ে বসে আছে
আরেকটা কুয়াশামোড়া রাত।
মর্মরের ঘুঙুর বাজার অপেক্ষায় খোলা ছিল একটা জানালা।

তখন।
যখন আমরা শিখে নিয়েছিলাম
অন্ধকারের স্যাঁতসেঁতে আলোয়ানের ভেতর থেকে
কিভাবে সবুজ পায়রা ওড়াতে হয়,
প্রবল হিমের ভেতর
বেড়ালের ওম মাখা পশমী আমেজ।

ঘোর মহুয়া আর মাদলের মাতাল তালে বেজে যাচ্ছে কেউ।
আমিতো সব মিউটেই দিয়ে রেখেছিলাম!

ঈশ্বর

আকণ্ঠসূরার ভারে টলতে টলতে কোথায় যাচ্ছে এ মাতাল শহর!

আমাদের ঘরে কোন ঈশ্বর আসেননা।
মেঘ ছিঁড়ে ঝুম বৃষ্টি নামলেই,
আধোঅন্ধকার ঘরে
থোবড়ানো বিয়ারের ক্যান হাতে কেবলই ঝিমান।
আমরা দিনরাত্রি তার তপস্যায় থাকি
প্রার্থনারত হাতগুলো থেকে মাঝেমধ্যে ‘আহা ‘ ধ্বনি বাজে।

মাত্র আধহাত দূরে পানপাত্র রেখে
যে লোকটা অসীমধৈর্যে বসে আছে
ঠোঁটে ছোঁয়ালেই শেষ হয়ে যাবে ভয়ে ;
সেই সুস্থির লোকটাকেই ঈশ্বর মনে হয়।

এই যে এখন টালমাটাল পায়ে হেঁটে যাচ্ছে একজন ঘোরমাতাল
যদি ঠিকঠাক দরোজায় ঠোকা দেয় সেও তো ঈশ্বর হয়ে যেতে পারে!

পারদ উঠে যাওয়া একটি আয়না

তুমি বলছো ওটা একটা আয়না
হ্যাঁ ছিল।
ঘর্ষণে ঘর্ষণে এখানে ওখানে পারদগুলো উঠে গেছে।
এখন,না আয়না না কাঁচ।
সামনে দাঁড়াও
ভাঙ্গাচোরা টুকরো খন্ড খন্ড ছবিগুলো বলে-
‘বাকীটা কোথায় হারালে?পুরো তুমি নেই।’
ধীরে ধীরে সমস্ত পারদ উঠে গেলে
নিরেট এক টুকরো কাঁচের এপাশ ওপাশ বলে কিছুই থাকেনা।

এলো মেলো বাতাসের পাকে
উদাসী ঘুড়ির মতো ছেড়ে দেওয়া সময় কোন ছাড় দেয়নি;
কোথাও তোমার অপেক্ষায় থমকে যায়নি তার নির্ধারিত কাঁটাগুলো।

বোকা মাছ !
জলের গভীরে না গিয়ে চড়ে বসেছি্লো ঢেঊয়ের চূড়ায়
জোয়ারের টানে কেমন ডাঙ্গায় উঠে এলো!
কিছুতেই ছাড় দেয়নি ধীবরহাতের মুঠোময় উল্লাস।
মার্জারের চোখের লালসা ঘুরে রসুইয়ের আনাচে-কানাচে।

তরঙ্গ কখনো কাঁদে মাছের মরণে?
অবয়ব ধরেনা পারদবিহীন একখণ্ড কাঁচ।

(ভুল দরোজা এবং পুরনো অসুখ)

মেয়েটা

মেয়েটা আসতো মাঝেমধ্যে ছেলেটার খোঁজে
—- এমন বললো পুরনো বাড়িওয়ালা।
আসতো চোখভরা এক আকাশ মেঘ সাথে করে
আচমকা বৃষ্টিতে চৌকাঠ ভিজে যেতো।
সেই প্রবল বর্ষণের ভেতরে বিষণ্ন
পা টলোমলো করতে করতে ফিরে যেতো ;
তার কোন বর্ষাতি ছিলোনা।
পুরনো ঠিকানায় রোজ মেয়েটার চিঠি। জমে জমে স্তুপ।
স্থান সংকুলানে মাঝেমাঝে ফেলে দিতে হয় ডাস্টবিনে;
ছেলেটা দেয়নি তার নতুন ঠিকানা।

ড্রয়ারভর্তি স্মৃতির কোলাজ সামনে নিয়ে বসে থাকে মেয়ে।
পুরনো এলবাম। কাঁশবন।শূন্যে উড়ে যাওয়া যুগলবন্ধী ছবি;
ফ্যাঁকাসে হতে হতে সাদা মেঘের কিনারা ছুঁয়েছে ।
হুডখোলা রিকশায় শহর মুঠোয় পোরা দিন ;
সব নিয়ে চলে গেছে ছেলে।

মেয়েটা
ব্যাগভর্তি ঘুম কিনে নিয়ে আসে।

এবং দ্বিতীয় আমি

ম্যাজিক মিরর।
এপাশেও প্রতিচ্ছবি। ওপাশেও।
তোমাকে দেখছি আমি। তুমিও কি দেখছো আমাকে?
জেনে নাও
আমরা কোনদিন হাত ধরাধরি করে হাঁটবো না
রোমান্টিক কাপলের মতো।
মাঝখানে অভঙ্গুর কাচের দেয়াল;
তবু অলৌকিক স্পর্শ ছুঁয়ে যাবে, যাচ্ছে।
অহোর্নিশ অন্তর্গত যুদ্ধ হবে। সমঝোতা হবে।
মাঝেমাঝে,—‘তোমার তুমিকে বড়ো ভালোবাসি’ বলে ফেলবে বেখেয়ালে।
আমিও তোমাকে এমন কিছু…
আমরা আজীবন সমান্তর দূরত্বে।
আমরা আজীবন পাশাপাশি।
আমরা এক নই।
অবিচ্ছিন্ন নই।
তবু আমাদের বিচ্ছেদ হবে না।
পৃথিবীর নিক্তির মাপে দুজন একত্র।
কিন্তু আমরাতো এক নই—দুজনেই জানি। আমরা দুজন।
শুধুমাত্র অন্যোন্য।
আমরা পৃথক নই তবু আমৃত্যু বিভেদদহন বয়ে চলি।
আমি
এবং
দ্বিতীয় আমি।

গল্পের প্রতিকূল সময়

এই বিপ্রতীপ সময়
গল্পের অনুকূল নয় মোটে
কথাগুলোর কোন ক্রমানুসার নেই।
যেন বালকের অগোছালো খেলাঘর…..
কাঠের ঘোড়া
রোবোটমানব
মাঠিরপুতুল
সাইরেন বাজানো গাড়ি
প্লাস্টিকের লাটিমগুলো
লালনীল ঘুড়ি
নাটাইয়ের এলোমেলো সুতো
রঙিন বেলুন
ঝিকিমিকি মার্বেল
সারা ঘরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

জানিনা কোন কথা আগে বলা যায়
গোলাপ এবং বারুদের গন্ধ মিলেমিশে গেলে
সব কথা এলোমেলো হয়ে যায় বড়ো…..
সেন্সরড ‘আহা’ ‘উহু’ গুলো।
আগে ছাড়পত্র নিতে হবে
কতোটুকু বলা যাবে ;
কাম্য নয় কাঠগড়া অথবা হাতকড়া।

কেন আদিবস্তির আকাশে কাকচিলের মচ্ছব লাগে বারবার
এমন গল্প নিরাপদ নয়।

একমাত্র বৈধ ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলোই
সত্য
এবং
নিরাপদ
আপাতত।

___________________________
( কাব্যগ্রন্থ : ভুল দরোজা এবং পুরনো অসুখ)

বিষাদের প্রখর বেলুনগুলো

দ্রোহে নেই
বিদ্রোহেও নেই

সন্ধিতে আছি;

ভাঙ্গতে পারিনা
তাই
নির্মাণে আছি।

সৃষ্টির আনন্দ শুধুই নির্মমতায়?

নয়নমোহন ওই যে কাঠঠোকরা পাখিটি

— সেও কেমন নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে !
ঠোঁটের আদরে আদরে ছিন্ন করে গাছের বাকল
বৃক্ষের পাঁজর ভাঙ্গে ঠোকরে ঠোকরে।

শেষপর্যন্ত—-
ঠাকুরমার ঝুলির ছেঁড়া পাতাগুলো প্রবল বাতাসে উড়ে যেতে থাকে
সেই সুনসান মাঠে–হতবিহ্বল পাঠক ছাড়া আর কেউ থাকেনা;

গল্পটি শেষ হয়নি…………
বিষাদের প্রখর বেলুনগুলো বাতাসে ছড়িয়ে দিলে
আকাশের নয়নাভিরাম আতশবাজি হয়ে গেল;

বিমোহিত জনতার তুমুল করতালি বাজে–

——-বাহ্‌!
——-বেশ!
——-ভালইতো!

(বিষাদের প্রখর বেলুনগুলো ‘ কাব্যগ্রন্থ থেকে)

যাবার সময় হলে

কোথাও যাবার কথা হলেই আমার ট্রেনের কথা মনে হয়
এবং টিকেটচেকারের বিষাদমগ্ন আঙ্গুলে ধরা টিকেটের কথা।
এক কামরাভরা যাত্রী,
সদ্য স্বজন ফেলে আসা বিরহব্যথা;
ইঞ্জিনের ঝিক ঝিক ঝিক বাজনার মন আনচান করা কোরাসে
সম্মিলিত বিষন্নব্যথা বেজে ওঠে।

পূর্বতন ভ্রমণের নস্টালজিক স্মৃতিমন্থনের সাথে দুলতে দুলতে
আমরা এক নিরূপিত গন্তব্যের দিকে ছুটে যাই।

শেষ হুইসেল বেজে ওঠার সাথে সাথে
আসন্ন একাকীত্বের যন্ত্রণাব্যাকুল
প্লাটফরমের হৃদয়মথিত দীর্ঘশ্বাসের কথা মনে হয়।