নিতাই বাবু এর সকল পোস্ট

নিতাই বাবু সম্পর্কে

নিতাই বাবু ২০১৫ সালে তিনি শখের বশে একটা ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করে লেখালেখি শুরু করেন।তিনি লিখতেন নারায়ণগঞ্জ শহরের কথা। লিখতেন নগরবাসীর কথা। একসময় ২০১৭ সালে সেই ব্লগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ব্লগ কর্তৃক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জনাব সাঈদ খোকন সাহেবের হাত থেকে ২০১৬ সালের সেরা লেখক সম্মাননা গ্রহণ করেন। সাথে নগর কথক উপাধিও পেয়ে যান। এরপর সেই ব্লগে লেখালেখির পাশাপাশি ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তিনি শব্দনীড় ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করেন। শব্দনীড় ব্লগে উনার প্রথম লেখা "আমি রাত জাগা পাখি" শিরোনামে একটা কবিতা। তিনি চাকরির পাশাপাশি অবসর সময়ে লেখালেখি পছন্দ করেন এবং নিয়মিত শব্দনীড় ব্লগে লিখে যাচ্ছেন।

রোগে হয় আক্রান্ত– ভয়ে হয় রুগীর মৃত্যু

কথায় আছে, “আহার নিদ্রা ভয়, যতো বাড়ায় ততই হয়!”
আহার হলো, খাওয়া, ভোজন বা খাদ্য। যা জীবের জীবনধারণে পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য যা দরকার, তা-ই। একজন ব্যক্তি প্রতিদিন স্বাভাবিক খাবারের চেয়ে যদি প্রতিদিন প্রতি বেলার সাথে এক ছটাক করে বেশি খায়, তাহলে প্রতিদিন তাঁর স্বাভাবিক খাবারের চেয়ে তিন ছটাক খাবার বেশি প্রয়োজন হয়। এভাবে আজ তিন ছটাক বেশি, কাল চার ছটাক বেশি, পরশু পাঁচ ছটাক করে যদি বাড়তে থাকে; তাহলে ওই ব্যক্তির খোরাক তো দিনদিন বাড়তেই থাকবে। তা-ই নয় কি? হ্যাঁ, হিসাব কষে দেখা যায় অবশ্যই আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। তাই কথায় বলে “আহার” যতো বাড়াতে চায়, ততই বাড়ে! কিন্তু কমে না।

নিদ্রা: নিদ্রা বা ঘুম হলো একরকম দেহের ক্লান্তি দূর করার মহৌষধ! যা অলসতার চাবিকাঠিও বলা চলে। নিদ্রা বা ঘুমকে যতো আশ্রয় প্রশ্রয় দেওয়া যায়, ততই ব্যক্তির ঘাড়ে চেপে বসে। নিদ্রা বা ঘুম, এতোটাই অলস যে জীবন বাঁচানোর জন্য খাদ্যকেও দূরে ঠেলে দেয়। সে শুধু ঘুমাতেই চায়। তাই ‘নিদ্রা, বা ‘ঘুম’ যতো বাড়ায় ততই বাড়ে। কিন্তু কমে না।

ভয়: ভয় বা ডর, এ হলো জীবের জন্য একরকম মরণঘাতী ভয়ানক রোগ সংক্রমণ। মানুষের মনের এই ভয় জলাতঙ্ক, ডেঙ্গু, ক্যান্সার, টিবি, যক্ষা, বার্ডফ্লু, আর বর্তমান নভেল করোনা ভাইরাসকেও হার মানায়।

অনেকেই প্রশ্ন রাখতে পারেন, ‘তা কীভাবে?’ তার উত্তর দিতে হলে আমাকে অবশ্যই ভয় নিয়ে নিজের কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা এখানে তুলে ধরতে হচ্ছে। বাস্তব কথা হলো, আমরা অনেকেই জানি কুকুরের কামড়ে নাকি জলাতঙ্ক রোগ হয়! আর জলাতঙ্ক রোগের চিকিৎসা না করলে রুগীর মৃত্যু হয়। তা আমি নিজেও জানি এবং শুনেছিও। কিন্তু এই রোগ আমার কখনো হয়নি, আর কখনো এই রোগে ভুগিওনি!
এতে অনেকেই বলতে পারেন, ‘আপনাকে কখনো কুকুরে কি কামড় দিয়েছিল?’ বলবো হ্যাঁ, দিয়েছিল! কিন্তু আমি কুকুরের কামড়ে ভয় পাইনি। তাই আমার জলাতঙ্ক রোগও হয়নি। এই কথা শুনে হয়তো অনেকেই ঘাবড়ে যাচ্ছেন! কিন্তু আমি যা বলছি, তা সত্যি কথাই বলছি!

শুনুন তাহলে– একদিন হঠাৎ আমাকে একটা কুকুরে নিজের অজান্তেই ডান পায়ে কামড় বসিয়ে দিলে! সাথে সাথে কামড়ের জায়গা থেকে রক্ত বেরুতে লাগলো! তা দেখে সামনে থাকা লোকজন বলেছিল, ‘তাড়াতাড়ি করে ডাক্তারের কাছে যান! নাহয়, আপনার সমস্যা হতে পারে!’ আমি কারোর কথা মাথায় নিলাম না। কামড়ের জায়গায় পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান থেকে একটু চুন নিয়ে ঘষে দিলাম। বাসায় গিয়েও কিছু বললাম না, নিজে নিজেই চুপচাপ থেকে গেলাম। এভাবে দুই-তিন দিন পর দেখা গেল, পায়ে কুকুরের কামড়ের জায়গাটি শুকাতে লাগলো। এতে আমি নিশ্চিত হলাম যে, আমার কিছুই হয়নি। আর যদি ভয় পেয়ে সাথে সাথে ডাক্তারের কাছে যেতাম! তাতে কী হতো? ডাক্তার বাবাজী আমার নাভীর চতুর্দিকে চৌদ্দটি ইঞ্জেকশন পুস করতে। এরপর রোজকার খাবার দাবারেও আরোপ হতো নানাবিধ বিধিনিষেধ। তা আর হয়নি, ভয় না পাবার কারণে। তাহলে বুঝতেই পারছে যে, কুকুরের কামড় খেয়ে রক্ষা পেলাম শুধু ভয় না পেয়ে।

এছাড়াও কিছুদিন আগে আমার মেয়ে ফোন করে আমাকে জানিয়েছিল, ওঁর ছোট ছেলেটাকে কুকুরে কামড় দিয়েছে। আমি তা শুনে আমার মেয়েকে ভয় না পাবার পরামর্শ দিলাম। এমনকি কুকুরে কামড় দিয়েছে বলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে নিষেধ করে বললাম! আরও বললাম, এ নিয়ে নিজেদের মনের ভেতর কোনপ্রকার ভয় না রেখে ধৈর্য ধরে অন্তত তিন-চারটা দিন অপেক্ষা করো! দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার কথামতো আমার মেয়ে তা-ই করলো। শেষতক সেই ঘটনা গত হলো, আজ প্রায় তিনমাসেরও বেশি সময়। মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ আশীর্বাদে আমার ছোট নাতির কিছুই হয়নি। আর যদি আমি আমার মেয়েকে ভয় না পাবার পরামর্শ না দিতাম, মেয়ে নাতিকে নিয়ে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যেতো। ডাক্তার নাতিকে অন্তত একমাসের জন্য চারটে ইঞ্জেকশন দিতো। তারপর সম্পুর্ন সুস্থ হয়ে গেলেও আমার মেয়ের মনে জলাতঙ্ক রোগের ভয় থেকেই যেতো। কিন্তু না, সেই ভয় আর এখন আমার মেয়ের মনের ভেতরে নেই! আমার নাতি এখন আগের মতনই সুস্থ আছে। তাহলে বুঝতেই তো পারছেন যে, ভয়ে মানুষকে কতদূর নিয়ে ঠেকায়? নিশ্চিত মৃত্যু পর্যন্ত নিয়েও ঠেকায়। তবে আমার মতো কেউ এমন সাহস দেখিয়ে ভয়কে উপেক্ষা করে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে ভুলবেন না কিন্তু। হয়তো আমার কিছু হয়নি ঠিক, অন্য কারোর যে কিছু হবে না; তা কিন্তু গ্যারান্টি নেই। তাই সবাই মনে ভয় না রেখে ডাক্তারের পরামর্শমত রোগ নিরাময়ের জন্য ঔষধও সেবন করতে হবে।

এবার আসি মহামারি ডেঙ্গু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায়। গতবছর আমাদের দেশের খোদ রাজধানী ঢাকা-সহ প্রায় বিভাগীয় জেলা শহরগুলোতে ডেঙ্গুজ্বর একরকম মহামারি আকার ধারণ করেছিল। ওইসময় আমার নিজেরও কিছুদিন প্রচণ্ড জ্বর জ্বর অনুভূত হয়েছিল। কিন্তু ওই জ্বরের কথা আমি আমার নিজের সহধর্মিণীর কাছেও কখনো বলিনি। তখন ওইসময় যদি জ্বরের কথা সহধর্মিণীর কাছে বলতাম, তাহলে অবশ্যই আমাকে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হতো। আর যদি ওইসময় ওই জ্বর নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতাম; তাহ‌লে অবশ্যই আমাকে হাসপাতালে থাকা ডেঙ্গু বিভাগে ভর্তি হতে হতো। কিন্তু তা আর হয়নি! এতোও রক্ষা পেয়েছি শুধ ভয় না পেয়ে। নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া এরকম আরও অনেক ভয়ের ঘটনার বর্ণনা উপস্থাপন করা যায়, কিন্তু তা না করে এবার আসল কথায় আসি।

আসল কথা হলো বর্তমানে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়া নভেল কোরোনা ভাইরাস। এই নভেল করোনা ভাইরাস দেখা দিয়েছে গণচীন থেকে। যখন গণচীনের উহানে করোনা ভাইরাসের পাদুর্ভাব দেখা দেয়, তখন আমাদের দেশের অনেকেই ভেবেছিল এবার গণচীনকে হয়তো শয়তানে ধরেছে। এখন দেখা গণচীনের কথা পত্রপত্রিকায় বেশি শোনা যায় না, শোনা যায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আক্রান্তের কথা। এখন এই করোনা ভাইরাস নিয়ে সারাবিশ্বই আতঙ্কিত শঙ্কিত। এই রোগটাও কিন্তু ডেঙ্গু রোগের মতনই জ্বর নিয়েই মানব দেহে দেখা দেয়! জানা যায়, এখন পর্যন্ত এই মরণঘাতী করোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন বা ঔষধ আবিস্কার হয়নি এবং এই রোগ সংক্রমণেরর নির্ধারিত করণীয় কী; তাও সুনির্দিষ্টভাবে কোনও বিশেষজ্ঞ সঠিক মত দিতে পারেনি।

কেউ বলছে এটা করো। কেউ বলছে ওটা করতে হবে। কেউ বলছে এটা ছোঁয়াছুঁয়ি রোগ। একের শ্বাসপ্রশ্বাস থেকে অন্যজন আক্রান্ত হয়। তাই কেউ কারোর সাথে করমর্দন বা হ্যাণ্ডশেক করতে পারবে না। কেউ কারোর সাথে বুকে বুক মেলাতে পারবে না। কেউ কাউকে চুমু দিতে পারবে না। রাস্তায় বেশি ঘোরাফেরা করতে পারবে না ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়েও বিশেষজ্ঞরা মত দিচ্ছেন। আবার কিছু ভণ্ড তেলেসমাতি সাধু অসাধুরাও নানারকম বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। কেউ বলছে নিয়মিত গোমূত্র সেবন করতে। কেউ বলছে শরীরে গোবর মাখতে। কেউ বলছে আবে জমজম কুয়োর পানি সেবন করতে। কেউ বলছে পলিথিনের জামাপ্যান্ট পরে থাকতে। বাইরের আলো-বাতাস, ধূলো বালি যাতে শরীরে না লাগে!কেউ আবার বলছে ঘরে বাইরে না যেতে।

যে যা-ই বলুক-না-কেন, আসল কাজের কিন্তু বেজে যাচ্ছে বারোটা। কাজের কাজ কিন্তু কিছুই হচ্ছে না, বরং এই নভেল করোনা ভাইরাসের জন্মভূমি গণচীন থেকে বেড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দুনিয়াব্যাপী। প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে হাজারে-হাজার। আক্রান্ত হচ্ছে লক্ষলক্ষ মানুষ। এরমধ্যে ডাক্তার কবিরাজদেরও আদেশ উপদেশ আসছে জোরালোভাবে। এতে সাধারণ মানুষও নভেল করোনা ভাইরাসে ভয়ে হয়ে যাচ্ছে দিশাহীন, অস্থির, আতঙ্ক। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা বাধাগ্রস্ত। সারাবিশ্বের সকল দেশের ব্যবসা বানিজ্য হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত। এর মূল কারণই হচ্ছে ভয়। মানে, কখন যেন কী হয়! নভেল করোনা ভাইরাসে কী হয় তা আমার জানা নেই। তবে জানা আছে রোগের চেয়ে বেশি ক্ষতিকারক হলো মানুষের মনের ভয়!

আমার মতে এই করোনা ভাইরাস বা রোগটি যত না মরণঘাতী, তারচেয়ে বেশি মরণঘাতী হলো আমাদের মনের ভয়! আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, এই রোগ মানব দেহে ঢুকে যতটুকু ক্ষতি না করে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করছে মানুষের মনের ভয়ে। বিশ্ব বিশেষজ্ঞরাও বেশি বেশি করে মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। তাই বলছি, করোনা ভাইরাস যেমন-তেমন, মানুষ ভয়ে কাতর হয়ে মৃত্যুবরণ করছে সবচেয়ে বেশি।

আমার পরামর্শ:
পরামর্শ হলো, ‘ভয়’! মানে নিজের মনের ভয়কে জয় করতে হবে। পাশাপাশি বিজ্ঞ ডাক্তারদের পরামর্শও গ্রহণ করতে হবে। করোনা ভাইরাস আসুক বা না আসুক। ধরুক বা না ধরুক রোগে। আমাকে থাকতে হবে নির্ভয়ে। আমি যদি ভয়ে কাতর হয়ে পড়ি, তাহলে শুধু করোনা ভাইরাসই নয়, আমাকে নানারকম রোগেও কাবু করে ছাড়বে। মনের ভয় না যাওয়া পর্যন্ত আমাকে কোনও বিশেষজ্ঞের ভালো নামী-দামী ঔষধেও ধরবে না। আর আমিও কঠিন রোগ থেকে মুক্তি পাবো না। বরং দিনদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বো। তাই আসুন, আমরা আগে ভয়কে জয় করতে শিখি। তারপর নিজেদের মনের সাহস দিয়ে মরণঘাতী করোনা ভাইরাসকে প্রতিহত করি।

ক্ষমা করো

স্রষ্টা করেছে সৃষ্টি আমায়
এই পৃথিবীর তরে,
বাবা দিলো জন্ম আমায়
মা গর্ভে ধরে।

শিক্ষক দিয়েছে জ্ঞানের আলো
গুরু দিয়েছে বাক্য,
মানুষ দিয়েছে প্রেম ভালোবাসা
দিচ্ছি আমি সাক্ষ্য!

এসেছি ভবে আনন্দ উল্লাসে
চলছি হেসে খেলে,
ভাবি নাতো চলে যাবো–
দুনিয়ার সবকিছু ফেলে!

এসেছি একা যাবো একা
সঙ্গে যাবে নীতি,
আমার ভুলত্রুটি করিয়ে ক্ষমা
কে রাখবে স্মৃতি?

সবার জন্য ভালোবাসা

ভালোবাসা বেঁচে থাকুক চিরকাল
সবাই সবাইকে ভালোবাসুক সকাল-বিকাল
ভালোবাসা জাগুক সকলের অন্তরে
ভালোবাসা ছড়িয়ে পরুক মাঠ-ঘাট প্রান্তরে।

ভালোবাসা নয় শুধু একদিন
ভালোবাসা বেঁচে থাকুক বছরের প্রতিদিন
ভালবাসা শুধু মানুষ মানুষেই নয়
ভালবাসা যেন সকল প্রাণীর জন্য হয়!

জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক!

ভালোবাসা দিবসের দোষ কী?

আমি আমার স্রষ্টাকে ভালোবাসি
আমি স্রষ্টার সৃষ্টিকে ভালোবাসি
আমি আমার মাকে ভালোবাসি
আমি আমার বাবাকে ভালোবাসি
আমি আমার সন্তানকে ভালোবাসি
আমি আমার সহধর্মিণীকে ভালোবাসি
আমি আমার ভাই-বোনকে ভালোবাসি
আমি আমার আত্মীয়স্বজনকে ভালোবাসি
আমি আমার সমাজকে ভালোবাসি
আমি আমার প্রতিবেশীদের ভালোবাসি
আমি পৃথিবীর সকলকে ভালোবাসি
আমি আমার দেশটাকে ভালোবাসি
আমি আমার ধনসম্পদকে ভালোবাসি
আমি আমার ব্যবসাকে ভালোবাসি
আমি আমার কর্মকে ভালোবাসি
আমি আমার ধর্মকে ভালোবাসি
আমি নিজেও নিজেকে ভালোবাসি।

তাহলে ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কি?
ভালোবাসা হলো এ-দেহের নিঃশ্বাস
নিঃশ্বাস ছাড়া কেউ কখনো বাঁচে কি?

সবাইকে ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা।

হিসাবের খাতা

পরকে ঠকিয়েছি মাত্র চারআনা
নিজে ঠকে গেলাম পুরো আটআনা
হিসাব মিলিয়ে দেখি যে আয় না
পাপের সাজা ভোগ হয় ষোলআনা!

থাকে না আর কিছুই যে বাকি
কাউকে দেওয়া যায় না ফাঁকি
যমের ভয়ে যেখানেই লুকিয়ে থাকি
যমরাজ বীরদর্পে সেখানে মারে উঁকি!

কোরোনা ভাইরাস থেকে সাবধান!

রোগটির নাম নভেল কোরোনা
রোগটাকে কেউ অবহেলা কোরোনা
এই রোগ কাউকে বাঁচতে দেয়না
কোরোনা থেকে কেউ মুক্তি পায়ওনা

এই রোগ শুরু হয় জ্বর দিয়ে
সাথে থাকে সর্দি-কাশি,
থাকে মাথাব্যথা শরীর ব্যথা
শুকনো কাশি শ্বাসকষ্ট হাঁচি।

এটি ছিল গণচীনের উহানে
এখন ছড়াচ্ছে সারা জাহানে
ঘুরে বেড়াচ্ছে অস্ট্রেলিয়া জাপানে
পৃথিবী কাঁপছে এটির কাঁপানে।

বাঁচতে হলে যা করতে হবে
একশোবার হাত ধুতে হবে
লোকালয়ের আড়ালে থাকতে হবে
মুখে মাস্ক লাগাতে হবে
হাতে হাতমোজা পরতে হবে।

চোখে চশমা পারতে হবে
পরিবেশ পরিস্কার রাখতে হবে
জ্বরে ডাক্তার দেখাতে হবে
হাঁচি-কাশির দূরে থাকতে হবে।

জেনে রাখুন!
নভেল করোনাভাইরাসের কোনো টিকা বা ভ্যাকসিন এখনো তৈরি হয়নি। ফলে এমন কোনো চিকিৎসা এখনও মানুষের জানা নেই, যা এ রোগ ঠেকাতে পারে।

ভাইরাসটির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হল, যারা ইতোমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছেন বা এ ভাইরাস বহন করছেন- তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. গ্যাব্রিয়েল লিউং বলছেন, বার বার হাত ধুলে, হাত দিয়ে নাক-মুখ স্পর্শ না করলে এবং ঘরের বাইরে গেলে মুখোশ পরলে ভাইরাসের সংক্রমণ এড়ানো সহজ হতে পারে।

পাশাপাশি কাশি বা হাঁচির সময় মুখ ও নাক ঢেকে রাখা, মাংস ও ডিম ভালোভাবে ধুয়ে এমনভাবে রান্না করে (যাতে কোনোভাবে কাঁচা না থাকে) খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আর যাদের মধ্যে ইতোমধ্যে সংক্রমণ ঘটেছে, তাদেরও মুখোশ ব্যবহার করা উচিৎ, যাতে অন্যদের মধ্যে ভাইরাস না ছড়াতে পারে।

মাটির পুতুল?

মানুষ নাকি মাটির পুতুল,
স্বার্থ ছাড়া তো বোঝে না!
মাটির পুতুল নাচতেও জানে,
টাকা ছাড়া তো নাচে না!

নাচের পুতুল অভিনয় করে,
টাকার জোরে গানও গায়!
মাটির পুতুল কয় না কথা,
স্বার্থ ফুরালে সে ভুলে যায়!

মানুষ নাকি জীবের সেরা,
মান আছে তাঁর হুঁশও আছে!
মহান স্রষ্টার সৃষ্টির সেরা,
কেউ কি ভাবে আগে পাছে?

সৃষ্টিকর্তা ক’জন?

আমরা যাকে বাবা বলি
কেউ বলে কাকাবাবু,
কেউ বলে জেঠা মশাই
কেউ বলে জামাইবাবু!

কেউ বলে মামা, মেসো
কেউ বলে পিসেমশাই,
কেউ বলে শালা সমন্ধি
কেউ বলে জামাই!

কেউ বলে ওগো স্বামী
কেউ বলে দাদাঠাকুর,
কেউ বলে বেয়াই মশাই
কেউ বলে শ্বশুর!

এতে কিন্তু জন্মদাতা পিতা মনঃক্ষুণ্ণ হচ্ছেন না। বরং তিনি সবার ডাকেই সারা দিচ্ছেন। তিনি কাউকে বলেন না যে, আমাকে তুমি বাবা বলছো কেন? আমাকে কাকা বলছো কেন? আমাকে এটা বলছো কেন? আমাকে ওটা বলছো কেন? তিনি সবার ডাকেই সন্তুষ্ট!

আসলে ঘটনা কী? তিনি তো একজন’ই! কিন্তু তাকে এভাবে জনে জনে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকা হচ্ছে কেন? যে যেই নামেই ডাকুক-না-কেন, এতে কিন্তু আমার জন্মদাতা পিতা মনঃক্ষুণ্ণ না হয়ে বরং তিনি সবার ডাকেই সুন্দরভাবে সারা দিচ্ছেন। তিনি সবার ডাকেই মহাখুশি এবং খুবই সন্তুষ্ট! এর কারণ কী? এর কারণ হচ্ছে, তিনি একজন হলেও, তাকে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে ডাকতেই পারে! তাতে তাঁর কোনও সমস্যা হচ্ছে না বলেই তিনি সবার ডাক স্বাদরে গ্রহণ করছেন।

তদ্রূপ মহান সৃষ্টিকর্তাকেও যে যারভাবে ডেকে তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টায় থাকি! যেমন– মহান সৃষ্টিকর্তাকে আমরা কেউ চোখে দেখিনি! কিন্তু অবশ্যই অবশ্যই স্বীকার করি মহান সৃষ্টিকর্তা একজন আছেন। তাঁর সৃষ্টিকে দেখি! তাঁর দান বা দয়া উপলব্ধি করি এবং পেয়েও থাকি! তিনি একজন। কিন্তু আমরা বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা মহান সৃষ্টিকর্তাকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডেকে থাকি এবং বিভিন্নভাবে তাঁর উপাসনা করে থাকি। বিভিন্নরকমের আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে প্রার্থনা করে থাকি। কেউ সেজদাতে। কেউ পূজোতে। কেউ ভক্তিতে।

তিনি মহান সৃষ্টিকর্তা একজন
করেছেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি,
তাঁর হুকুমে হচ্ছে রাত-দিন
তুফান জলোচ্ছ্বাস ঝড়বৃষ্টি!

কেউ বলে তিনি কলবে
কেউ বলে আকাশে,
কেউ বলে তিনি গ্রহ-নক্ষত্রে
কেউ বলে বাতাসে!

অনেক নামে স্রষ্টাকে চিনি
কেউ বলে ভগবান,
কেউ আল্লাহ, ঈশ্বর, খোদা
সব ধর্মে সমানসমান!

যদি মহান সৃষ্টিকর্তা একজনই হয়ে থাকে, তাহলে আমরা কেন একে অপরকে এতো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে থাকি? কেন নিজ ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মের কাউকে দুই নয়নে সহ্য করতে পারছি না? আমরা জানি মহান সৃষ্টিকর্তার হুকুম মেনে সূর্য পৃথিবীতে আলো দান করে থাকে। যদি তা-ই হয়, তাহলে মহান সৃষ্টিকর্তা তো সূর্যকে বারণ করছে না যে, আমার এই ধর্ম ছাড়া অন্যকোনো ধর্মের অনুসারীরা যাতে আলো না পায়! বাতাসকেও বারণ করছে না, যাতে এই ধর্ম ছাড়া অন্যকোনো ধর্মের অনুসারীদের বাতাস দিও না। আসলে মহান সৃষ্টিকর্তা সকল জীবেরই স্রষ্টা। তিনি একজন’ই! তিনি সকল ধর্মের মানুষের ডাকেই সারা দিয়ে থাকেন। তিনি অলংকারহীন! তিনি কোনও ধর্মকেই হিংসা করেন না। সকল ধর্মের সত্যের এবং অহিংস বাণী। হিংসা শুধু আমাদের মধ্যেই।

বি:দ্র: এটা আমার ব্যক্তিগত ধারণা থেকে লেখা। ভুল মানুষেরই হয়ে থাকে। ভুল হলে কেউ ক্ষিপ্ত না হয়ে সবাই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে মনে করি।

ফেসবুক কী?

ফেসবুক হলো বিশ্বের সস্তা যোগাযোগ ব্যবস্থা,
ফেসবুক হলো নিপীড়কদের রোখবার আস্থা।

ফেসবুক হলো ঘুমন্ত মানুষকে জাগানো,
ফেসবুক হলো দুশমন দুর্নীতিবাজ হটানো।

ফেসবুক হলো ব্যক্তি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা,
ফেসবুক হলো কারোর কাছে হীনমন্যতা।

ফেসবুক হলো কারোর অনুভবে শূন্যতা,
ফেসবুক হলো কারোর কাছে উদারতা।

ফেসবুক হলো ব্যক্তিগত ডায়েরির পাতা,
ফেসবুক হলো অভিভাবকের মতো উপদেশদাতা।

ফেসবুক হলো পৃথিবীর মিথ্যাবাদীর জন্মদাতা,
ফেসবুক হলো গুজব সৃষ্টিকারীর সৃষ্টিকর্তা।

ফেসবুক হলো টাটকা গরম খবরদাতা,
ফেসবুক হলো দুনিয়ায় শয়তানদের আশ্রয়দাতা।

ফেসবুক হলো দুনিয়ায় সকল ধর্মের কথা,
ফেসবুক হলো অনেকের আবার মাথাব্যথা।

ফেসবুক হলো চেনা-জানা অচেনা বন্ধুত্ব,
ফেসবুক হলো কাছের মানুষ থেকে দূরত্ব।

ফেসবুক হলো বিশ্বের উদার মানবতা,
ফেসবুক হলো সবাই মিলেমিশে একতা।

২০২০ইং হোক দুর্নীতিমুক্ত

ইতি টেনেছে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ
স্মৃতিগুলো নীরব নিস্তব্ধ,
শুভাগমন ঘটলো ২০২০ খ্রিস্টাব্দ
আতশবাজির কত শব্দ।

২০১৯’এ ঘটেছিল কতো ঘটনা
ঘটেছে সবকিছুর অবসান,
শুরু হলো ২০২০’র শুভসূচনা
থাকুক শান্তি বিরাজমান।

এসেছে ২০২০ হেসে খেলে
সুখ শান্তির বার্তা নিয়ে,
কত আশা নিয়ে হেলেদুলে
দুর্নীতিমুক্ত শ্লোগান দিয়ে।

ইতি হলো ২০১৯ইং

ইতি তো টানা যায়,
তবুও তো হয়না শেষ
অনেক কিছু থেকে যায়!

ইতি হয়েও হলোনা ইতি
গুজব ডেঙ্গু ক্যাসিনো কাণ্ড
রয়ে গেল কতো স্মৃতি।

থেকে যায় কিছু কথা,
কিছু থাকে পুরনো স্মৃতি
জমা থাকে হৃদয়ে ব্যথা!

মাস শেষে আসে মাস,
শেষ হয় ৩৬৫-৩৬৬ দিন
ইতি হয়ে যায় বারোমাস।

ইতি হলো ইংরেজি ২০১৯,
সবাইকে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা
স্বাগত ইংরেজি নববর্ষ ২০২০!

ধনিয়া পাতার বড়া

শিরোনাম দেখে অনেকেই হয়তো ভাবছেন, এ আবার কী! হ্যাঁ, এটা আমাদের দেশে হিন্দু পরিবারে সকালে, দুপুরে, আর রাতের খাবার ভাতের সাথে থাকা একরকম সুস্বাদু খাবার। শুধু হিন্দুই নয়, আমরা বাঙালিরা ভাত খাবারের সাথে প্রথম ধাপে হাল্কা পাতলা কিছু তরকারি বা সবজি ব্যবহার করে থাকি। যেমন: শাক, ভর্তা, ডালের বড়া, সবজি বড়া, বেগুন ভাজি, করলা ভাজি, কালিজিরা বাটা ইত্যাদি ইত্যাদি। তারমধ্যে ধনিয়া পাতার বড়াও তেমনই একটা।

এই সুস্বাদু খাবার তৈরি করতে বেশি পরিশ্রম আর বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না। একটু পরিশ্রমের বিনিময়ে আধাঘন্টা সময়ের মধ্যেই ১০ থেকে ১২টি ধনিয়া পাতার বড়া তৈরি করা যায়। খেতেও খুবই মজা। শীতের দিনে গরম ভাতের সাথে গরম গরম ধনিয়া পাতার বড়া অন্যকোনো মজাদার খাবারের সাথে তুলনা করা যাবে না। এ একরকম অতুলনীয় সুস্বাদু ঘ্রাণযুক্ত মচমচে খাবার। তাহলে জেনে নিন, কীভাবে ধনিয়া পাতার সুস্বাদু বড়া তৈরি করবেন!

আমাদের দেশে শীতকালীন অনেকপ্রকার সবজির সাথে ধনিয়া পাতাও প্রচুর পরিমানে বাজারে পাওয়া যায়। আমরা যাঁরা শহরের বসবাস করে থাকি, তাঁদের সম্বলই একমাত্র বাজার। তাই বাজার থেকে মাত্র দশ টাকার ধনিয়া পাতা কিনুন! বাসায় বা বাড়িতে গিয়ে উপরে ছবির মতো ধনিয়া পাতার গোড়াগুলো ছেটে নিন। তারপর ভালো করে ধুয়ে নিন। ধোয়া হয়ে গেলে ধনিয়া পাতাগুলো একটু বড়মাপের করে কুচি করুন! সাথে তিন থেকে চারটে কাঁচামরিচ আর দুটো মাঝারি সাইজের পেঁয়াজ কুচি করে কুচি করা ধনিয়া পাতার সাথে মেশান। সাথে পরিমাণ মতো লবণ আর একটু হলুদের ফাকি মেশান। এর সাথে একমুঠ সুজি আটা বা চালের গুড়ো মিশিয়ে ভালো করে মাখুন! যাতে ধনিয়া পাতাগুলো আঠা আঠা হয়ে দলা ধরতে পারে। এবার নিচের ছবি লক্ষ্য করুন!

উপরের ছবিটি দেখুন! ধনিয়া পাতা কুচির সাথে কাঁচামরিচ কুচি, পেঁয়াজ কুচি, লবণ ও সুজি আটা বা চালের গুড়ো মিশিয়ে মাখার পর এরকম হবে। এরপর বড়া ভাজার জন্য কড়াই নিয়ে গ্যাসের বা লাড়কির চুলোর সামনে যান। চুলায় কড়াই বসান! কড়াইতে পরিমাণ মতো রান্না করার তেল ঢালুন! তেল ঠিকমতো গরম হলে পিঁয়াজু সাইজে কড়াইতে ছাড়ুন! এরপর নিচের ছবি ফলো করুন!

উপরের ছবির মতো এভাবে কিছুক্ষণ সিদ্ধ হতে সময় নিন। বড়ার নিচের পিঠ একটু পোড়া পোড়া হয়ে গেলে উল্টিয়ে দিন। এপিঠ ওপিঠ ইলিশ মাছ ভাজার মতো মচমচা করে ভাজতে থাকুন! নিচের ছবিতে ফলো করুন!

উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ধনিয়া পাতার পিঁয়াজু সাইজের বড়াগুলো একটু লালচে রং ধরেছে। কিন্তু পুরোপুরিভাবে ভাজা হয়নি। পুরোপুরিভাবে হতে আরেকটু সময় অপেক্ষা করতে হবে। যদি পারেন, এর সাথে কয়েকটা শুকনো মরিচ ভেজে নিন। খানিক সময়ের মধ্যেই হয়ে গেল স্বাদের ধনিয়া পাতার বড়া। সাথে আছে স্বাদের শুকনো মরিচ ভাজা। এবার গরম ভাতের সাথে পরিবেশ করুন! নিজেও মনের আনন্দে ইচ্ছেমতো খেতে থাকুন। নিচের ছবিতে ফলো করুন!

মাত্র দশ টাকার ধনিয়া পাতায় অন্তত বিশটা বড়া তৈরি করা যাবে। যা একটি বড়সড় পরিবারের একবেলা ভাত খাবারের প্রথম ধাপের সাথে থাকা সুস্বাদু স্বাস্থ্যসম্মত যথেষ্ট খাবার। দুইজনের সুখী পরিবার হলে দুইবেলা খেতে পারবেন বলে আশা করি। ধনিয়া পাতার বড়া খেতে মন চাইলে পরিবারের কাউকে জ্বালাতন না করে, নিজের টা নিজেই করতে পারেন। খেয়ে মজা পেলে বা ভালো লাগলে আমার এই পোস্ট সার্থক হবে। সবাইকে শুভেচ্ছা।

মুক্তিযুদ্ধের কথা– বিজয় দিবসের কথা

বছরের শুরুতেই অনেক নতুন নতুন ক্যালেন্ডার বাজারে বিক্রি হয়। নানান রঙের, নানান কোম্পানির। নানান ব্যাংকের, নানান ইন্স্যুরেন্সের ক্যালেন্ডার। ইংরেজি ক্যালেন্ডারে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ মাসের পরও কতগুলো মাস গত হয়ে যখন নভেম্বরের শেষে ডিসেম্বরের আগমন ঘটে, তখনই বাংলাদেশের বাঙালিদের মনে বাজতে থাকে মহান বিজয় দিবসের গান। আর ক’দিন পরেই ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ’র এই দিনটির (১৬ই ডিসেম্বর) জ্বলন্ত সাক্ষী আমি নিজে। তাই এই বিশেষ দিনটিকে আমি গভীরভাবে স্মরণ করি। যদি পারি কিছু লিখে সবার মাঝে শেয়ারও করি। সে-সময়কার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির কিছু স্মৃতি রোমন্থন করে রাখি। তাই এই ২০১৯ইং বর্ষের বিজয়ের মাসে আসন্ন ১৬ই ডিসেম্বরকে সামনে রেখে স্বনামধন্য দিনলিপি শব্দনীড় ব্লগেও কিছু লিখে রাখলাম। যাতে আগামীতে এই লেখা আমার জীবনের একটি ডায়েরি হয়ে থাকে। আশা করি সবাই সাথে থাকবেন।

বর্তমানে আমরা সবাই জানি ইংরেজি বর্ষের ফেব্রুয়ারি আমাদের মাতৃভাষা দিবস। যা এখন সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এরপরই আসে অগ্নি ঝরা মার্চমাস। এই মার্চ মাসেই শুরু হয় বাঙালির মুক্তির জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে ৭ই মার্চ ঢাকার রমনায় একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণের মাধ্যমেই স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে আমাদের জাতির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণে বজ্র কণ্ঠে বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

জনসভায় লাখো বাঙালি এই ঘোষণার অপেক্ষাই বাঙালি জাতি করছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ গোটা জাতিকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উন্মাতাল করে তুললো। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাষণে দিক নির্দেশনা পেয়ে সবাই প্রস্তুত হতে শুরু করে। শহর থেকে সাধারণ মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামমুখী হতে লাগলো। বড়সড় নেতা কর্মীরা মফস্বল ও গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করতে শুরু করল। আর পশ্চিমা শাসকেরা গোলাবারুদ সৈন্যসামন্ত পূর্ব-পাকিস্তানে এনে বাঙালি নিধনের নীল নকশা তৈরি করতে লাগল। তারপরও চলতে থাকে অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যদিয়ে মিছিল, মিটিং। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার চালায় গুলি, ধরপাকড়, লাঠিচার্জ, গ্রেফতার।

তারপরও ক্ষিপ্ত বাঙালি কিছুতেই থামছে না। আন্দোলন চলছেই। এরমধ্যেই পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তথা কথিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে। যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে একেবারে স্তব্ধ করে দেওয়া। তখন ঘড়ির কাটা মধ্যরাত পেরিয়ে যাওয়ায় আমাদের স্বাধীনতা ২৬ মার্চ। তারপরই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর পূর্ব বাংলা রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র পাঠ করেন ও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মেজর জিয়ার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ তখন স্বাধীনতাকামী মানুষের মাঝে উৎসাহ জোগায়। এমনিভাবে আগুনঝরা মার্চে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। এই মুক্তিযুদ্ধ চলে দীর্ঘ ৯মাস। অর্থাৎ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখে হয় বিজয়ের শুভসূচনা। মানে গৌরবোজ্জ্বল মহান বিজয় দিবস।

আমি তখন ৮ বছরের নাবালক এক শিশু। তখন আমার বাবা চাকরি করতেন নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড় চিত্তরঞ্জন কটন মিলে। আর বড়দাদা চাকরি করতেন শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড় আদর্শ কটন মিলে (বর্তমান সোহাগপুর টেক্সটাইল)। ঐ ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ের সকল শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরাও অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই জনসভায় লাখো মানুষের মধ্যে আমার বাবাও একজন ছিলেন। সেদিন ঢাকার আশ-পাশের সকল শিল্পপ্রতিষ্ঠানই বন্ধ ছিল। শুনেছিলাম বাবার মুখে। তখনকার সময়ে এই মার্চ মাস থেকেই আমরা হয়ে পড়ি বিপদগ্রস্ত। বাবার মিল বন্ধ, চাকরি নেই। বড়দা শরণার্থী হয়ে ভারতে অবস্থান। আমার মা-সহ তিন বোন থাকতাম নোয়াখালী বেগমগঞ্জ থানাধীন বজরা রেলস্টেশনের পশ্চিমে মাহাতাবপুর গ্রামের বাড়িতে। আমাদের পরিবারে সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে তখন কষ্টের আর শেষ ছিল না। আমাদের সংসারই চলতো বাবা বড়দা’র চাকরির বেতনে। তখন এই বঙ্গদেশে টাকার যেমন দাম ছিল। আবার চলছে যুদ্ধ! যুদ্ধের কারণে কেউ কাউকে টাকা-পয়সা ধারকর্জও দিত না। তাই কোনদিন দুপুরে খেতাম, রাতে না খেয়ে রাত কাটাতাম। আবার কোনদিন সকালে খেতাম দুপুরে না খেয়ে থাকতাম। কিছুদিন এভাবেই চলছিল আমাদের দিনগুলো।

তাই প্রতিবছর মার্চ মাসের আগমনেই ঐসব অতীত হয়ে যাওয়া দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় বাবার কথা। রাজাকারদের হাতে প্রাণ হারানো এক মামার কথা। কানে বাজে মেশিনগান আর এলমজির গুলির শব্দের আওয়াজ। চোখে ভাসে হাট-বাজারে লাগানো আগুনের ধোঁয়া। তখন ছিলাম চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ুয়া ছাত্র। বাবা নারায়ণগঞ্জ থেকে বাড়িতে আসে। সময়টা তখন ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি। যুদ্ধের কারণে মিল বন্ধ। বাবার পকেট খালি। মিল এলাকার স্থানীয় সহকর্মীদের কাছ থেকে ২০ টাকা কর্জ করে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়। অনেক কষ্ট করে খালি হাত পা নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আসে। বাবা বাড়িতে এসে জেঠা জেঠিমা আর মায়ের কাছে সব কথা বললেন। আমরা সবাই শুনলাম। কিন্তু বাড়িতে এসেও বাবা নিরুপায়! হাতে টাকা-পয়সা নেই। সংসারে খাবার নেই। কোথাও কোনও দিনমজুরের কাজও নেই। এদিকে বড়দা’রও খবর নেই। মা হয়ে গেলেন পাগলের মতো।

তখন এই দেশে টাকার খুবই অভাব ছিলো। তখন জিনিসের দামও যেমন সস্তা ছিল, টাকার দামও অনেক ছিলো। সংসারে খানেওয়ালা ছিলাম ৫জন। বাবার পকেট শূন্য। মায়ের শেষ সম্বল একজোড়া কানের দুল ছিলো। সেই কানের দুল বন্দক রেখে কিছু টাকা সংগ্রহ করতে চাইল। কিন্তু না, তা আর হলো না। যুদ্ধের সময় মানুষের প্রাণ বাঁচানো যেখানে জরুরি, সেখানে সোনার জিনিস দিয়ে কী হবে? তার আর মায়ের কানের দুল রেখে টাকা জোগাড় করা হলো না। শেষ সম্বল বাড়ির দলিল। একজন সম্মানিত মুসলমান ব্যক্তির কাছে বাড়ির দলিল রেখে কিছু টাকা কর্জ করা হলো। ঐ টাকা থেকে ৫০ টাকার ধান কিনে বাবা মুড়ির ব্যবসা শুরু করে। গ্রামের আরও অনেকেই মুড়ির ব্যবসা করতো। একদিন বাবার সাথে মুড়ি নিয়ে নিকটস্থ একটা বাজারে যাই। বাজারটির নাম আমিষাড়া বাজার। বজরা রেলস্টেশন থেকে ৩ মাইল পশ্চিমে এই আমিষাড়া বাজার অবস্থিত।

সকাল দশটার মতো বাজে। বাবা বিক্রি করার জন্য মুড়ির বস্তা বাজারে রাখলো। এমন সময় হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। পাকবাহিনী বাজারে হানা দিয়েছে। রাস্তার ধারে কয়েকটা দোকানে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এই খবর ছড়িয়ে পড়া মাত্রই বাজারের মানুষ এদিক-সেদিক ছোটাছুটি শুরু করে দিলো। বাজারটিতে একেক পণ্যের একেক সাইট ছিলো। বাবার সাথে মুড়ি বিক্রেতা আরও অনেকেই ছিলো। সবাই সবার মুড়ি বস্তা নিয়ে পালাতে শুরু করে দিলো। বাবা আর পালাতে পারছে না, মুড়ির বস্তাটার জন্য। হুড়াহুড়ির কারণে মুড়ির বস্তাটা কেউ আর বাবার মাথায় উঠিয়ে দিচ্ছে না। বাপ-ছেলে দুইজনেই মুড়ির বস্তাটা নিয়ে অনেক পারাপারি করলাম। কিন্তু মুড়ির বস্তাটা বাবার মাথায় আর উঠিয়ে দিতে পারলাম না। তখন বস্তাটা ধরেই বাবা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। বাবাকে ঝাপটে ধরে কাঁদতে শুরু করলাম। মনের ভেতরে ভয়, শুধুই ভয়।

পাকবাহিনীরা গুলি করে মানুষকে মেরে ফেলে, তাই এতো ভয়। বাবা এক হাতে বস্তা আরেক হাতে আমাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক কষ্টের মুড়ির চালান। সেজন্য বাবা মুড়ির বস্তা রেখেও পালাতে পারছে না। এরমধ্যে পুরো বাজার জনশূন্য হয়ে গেল। সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেলো। বাজারের কয়েকটা দোকানে লাগানো আগুনের তাপ শরীরে লাগতে শুরু করলো। চারজন পাকবাহিনী বাবার সামনে এসেই রাইফেলের বাঁট দিয়ে বাবাকে আঘাত করলো। বাবা মুড়ির বস্তা ছেড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। বাবাকে বললো কলেমা বাতাও। বাবা কলেমা বলতে পারল না। বাবা কাঁপছে আর কাঁদছে। পাকবাহিনী আমার দিকে বড়বড় চোখ করে কয়েকবার তাকালো। আমি বাবাকে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে দিলাম। তাঁদের দয়া হলো। তারা আর আমাদের কিছুই বললো না, সোজা বাজারের দিকে চলে গেল। বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি আমার কান্নাতে হয়তো তাদের মায়া লেগেছিল। তাই তারা আমাদের কিছু না বলে সোজা বাজারের ভেতরে চলে গেল। এর কিছুক্ষণ পরই পাকবাহিনী তাদের সাঁজোয়া যান নিয়ে বাজার ত্যাগ করলো। সেদিন আর আমাদের সব মুড়ি বিক্রি হলো না। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাবা কয়েক সের মুড়ি বিক্রি করে, কোনরকমে বাবা-সহ বাড়ি চলে আসি।

রাইফেলের আঘাতে বাবা পুরোপুরিভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবা রাইফেলের বাঁটের আঘাতে, ৬/৭দিন আর বাজারে যেতে পারেনি। তখন আমাদের গ্রামে তেমন কোনও নামিদামি ডাক্তারও ছিল না। পুরো গ্রামে কেবল একজন মাত্র ডাক্তার ছিলো, তাও হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। সেই ডাক্তারের ঔষধ মেশানো জলপড়া খেয়ে ক’দিন পর বাবা সুস্থ হলেন। আবার শুরু করে দিলেন মুড়ি নিয়ে জীবনসংগ্রাম। খবর পেলাম বড়দাদা শরণার্থী হয়ে ভারত ভ্রমণে। বড়দাদার জন্য মায়ের কান্নাকাটিতে বাতাস ভারী হতে লাগলো। কিন্তু বড়দাদা ফিরে আসার কোনও খবরও নেই। সেসময়ে এই বঙ্গদেশে মোবাইলের আগমন হয়নি। যা-ই সংবাদ পেতো, তা শুধু রেডিওর সংবাদ। আর চিঠির মাধ্যমে। কিন্তু চিঠি দিবে কে, আর পাবেই বা কে? পোস্ট অফিসও বন্ধ। ট্রেন বন্ধ, ব্যাংক বন্ধ, লঞ্চ-স্টিমার সবই বন্ধ। তাই আর বড়দা’র খবর আমরা কেউ জানতাম না। শুধু জানা যেত পাকবাহিনীরা কোথায় কোন বাজারে আগুন লাগিয়েছে, ক’জন মেরেছে এই খবর। আমরা থাকতাম ভয়ে ভয়ে! ভয় শুধু কখন যেন পাকবাহিনীরা গ্রামে ঢুকে পড়ে, সেই ভয়েই বেশি অস্থির হয়ে থাকতাম। অবশ্য পাকবাহিনীরা তাঁদের গাড়ি নিয়ে আমাদের ঢুকতে পারবে না। গাড়ি নিয়ে গ্রামে আসার মতো রাস্তা ছিল না। তবুও ছিল ভয়!

আমাদের বাড়িটা ছিল বজরা রেলস্টেশনের পশ্চিমে। বজরা পাকা সড়ক থেকে আমাদের গ্রামে আসার জন্য কোনও পাকা রাস্তা ছিল না। ছিলো সরু একটা মাটির রাস্তা। সেসময় ওই মাটির রাস্তা দিয়ে দু’একটা গরুর গাড়ি আসা-যাওয়া করতো। তাই পুরো যুদ্ধের সময়ও পাকবাহিনী আমাদের গ্রামে আসতে পারেনি। যা কিছু টুকিটাকি অত্যাচার-অবিচার করেছে, তা কেবল পার্শ্ববর্তী গ্রামের রাজাকাররা করেছে। মাহাতাবপুর গ্রামে ছিলো হিন্দু জনবসতি। পুরো গ্রামে মুসলমান বাড়ি ছিল মাত্র দুটি, তাও খরিদ সূত্রে তাঁরা মালিক ছিল। সারাদেশে যখন মুক্তিবাহিনীর জয়জয়কার। তখন মে মাস ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ। আমাদের বাড়িটি ছিল গ্রামে প্রবেশদ্বারের প্রথম বাড়ি। আমাদের বাড়ির পরেই পার্শ্ববর্তী গ্রাম ‘হিলমুদ’।

হিলমুদ গ্রামের পরেই বজরা বাজার ও রেলস্টেশন। তাই আমাদের বাড়িটা ছিল মুক্তিবাহিনীদের পছন্দের বাড়ি। আমার দুই জেঠা ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি পুলিশ। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আমাদের বাড়িতে আসতো। এসেই আমার দুই জেঠার সাথে বসে গল্প করতো। মাঝেমাঝে চা’র আড্ডা হতো। বাড়িতে বানানো মুড়ির মোয়া থাকতো। নারিকেল কোরা সহ মুড়ি তাদের দেওয়া হতো। তারা আনন্দের সাথে খেতো আর জেঠা মহাশয়ের সাথে কথা বলতো। সময় সময় জেঠার সাথে বসে বসে নিজেও তাদের কথা শুনতাম। মা চা বানিয়ে দিতেন, সেই চা তাদের এনে দিতাম। সেসব হৃদয়বান মুক্তিযোদ্ধাদের কথা কোনদিন ভুলবো না। পাকবাহিনী আর রাজাকার বাহিনীদের ভয়ে অনেক মানুষই গ্রাম ছেড়ে শরণার্থী হয়ে ভারত চলে গেছে। আমাদের তেমন টাকা-পয়সা ছিল না বিধায় আমরা নিজ গ্রামেই থেকে যাই।

আমাদের ভরসাই ছিল একমাত্র হৃদয়বান মুক্তিযোদ্ধারা। সেসব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সুনজরের কারণে, রাজাকার আর পাকবাহিনীরা গ্রামের একটা বাড়িতেও ক্ষতি করতে পারেনি। এভাবে চলতে চলতে কেটে গেল দীর্ঘ ৮ মাস। সময় তখন নভেম্বর ১৯৭১ সাল। রেডিওর শুধু সংবাদ ছিল বিবিসি, আর আকাশবাণী কোলকাতার বাংলা সংবাদ। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরপর মায়ের সাথে বড়বাড়িতে গিয়ে রেডিওর খবর শুনতাম। মুক্তিবাহিনীদের কাছেও একটা রেডিও ছিলো। যা দিয়ে তারা খবর শুনতো। তখন চারিদিকে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জয়জয়কার। জাগায় জাগায় ঘটতে লাগলো পাকবাহিনীর পরাজয় এর আত্মসমর্পণ। আর পিছু হঠার খবর। সামনেই ডিসেম্বর মাস। পুরো ডিসেম্বর মাসই ছিল সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। কুকুর পাগল হলো যেমন এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করে মানুষকে কামড়ায়, ঠিক সেই অবস্থাই হয়েছিল পাকবাহিনীদের বেলায়। তারা ঠিক হিংস্র জানোয়ারের মতো হিংসাত্মক হয়ে উঠলো। নিরস্ত্র সাধারণ মানুষদের গুলি করে মারতে লাগলো।

তাদের মুখে ছিলো শুধু ইদুর কাঁহা (হিন্দু)? মুক্তিবাহিনী কোন আদমি হ্যাঁ? এটাই ছিল তাদের প্রথম জিজ্ঞাসা। হিন্দুদের বেশি খুঁজতো এই কারণে যে, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে পার্শ্ববর্তী ভারত সহযোগিতা করছিল, তাই। আমাদের বীর বাঙালিরা ভারত গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করার ট্রেনিং নিয়ে আসছে, তাই। তাই পাকবাহিনীদের প্রথম শত্রুই ছিলো ভারত ও হিন্দু। রাস্তাঘাটে পাকবাহিনীরা চেকপোস্ট বসিয়ে মুক্তিবাহিনী আর হিন্দুদের খুঁজতো। যাকেই ধরতো, আগেই জিজ্ঞেস করতো, ‘তুমি হিন্দু না মুসলমান?’ যদি বলতো, আমি মুসলমান। তাহলে আদেশ আসতো, ‘কলমা পড়ে শোনাও।’ কলমা পড়ে শোনানোর পরও বলা হতো, ‘কাপড়া উঠাও।’ কাপড় উঠিয়ে দেখানোর পরই ওরা নিশ্চিত হতো লোকটি হিন্দু না মুসলমান। হিন্দু হলে মরণ অনিবার্য। আর মুসলমান হলেও তবু সন্দেহ থেকেই যেতো।

সন্দেহ শুধু একটাই, তা হলো- সাধারণ মানুষ, না মুক্তিবাহিনী? অনেক সময় সাধারণ মানুষকে মুক্তিবাহিনী সন্দেহ করে মেরেও ফেলেছে ঐ হিংসাত্মক পাকবাহিনী। আবার অনেকসময় একটু স্বাস্থ্যবান মানুষদেরও ধরে নিয়ে মেরে ফেলতো। তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে দেশীয় রাজাকারবাহিনীও হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড শুরু করে দিলো। কার বাড়িতে কয়টা যুবতী মেয়ে আছে, সেসব তালিকা পাকবাহিনীদের কাছে পৌঁছাতে লাগলো। সময় সময় পাকবাহিনীদের মনোরঞ্জনের জন্য, বাড়ি থেকে জোরপূর্বক যুবতী মা-বোনদের তুলে নিয়ে যেতো। এসব দেশীয় আলবদর-রাজাকাররাই পাকবাহিনীদের সবকিছু শিখিয়েছিলো। অচেনা রাস্তাঘাট চিনিয়ে দিয়েছিলো। হিন্দুদের কিভাবে চেনা যায়, সেটাও শিখিয়েছিল। ডিসেম্বরের আগমনের সাথে সাথে পাকবাহিনী সহ তাদের দোসররাও মানুষ খেকো রাক্ষসের মতন হয়ে উঠলো।

ডিসেম্বরের প্রথম থেকে এভাবে চলতে চলতে একসময় সারাদেশেই পাকবাহিনী পরাজয় বরণ করতে লাগলো। ১৫ ডিসেম্বর দেখেছি, মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো থেকে রাজাকারদের হাত বেঁধে রাস্তা দিয়ে নিয়ে যেতে। সেই দৃশ্য দেখার জন্য গ্রামের অনেক মানুষের মধ্যে আমিও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। মা-বাবা বড়দিদিদের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে জয়বাংলা ধ্বনি শুনেছি। গ্রামের হাজার হাজার মানুষের মুখেও শুনেছি জয়বাংলা বাংলার জয়। যা-ই দেখেছি বা শুনছি, সবকিছুই ১৯৭১ সালের স্মরণীয় মার্চ মাস থেকে শুরু করে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত। তাই প্রতিবছর মার্চমাস আর ডিসেম্বর মাস আসলেই মনে পড়ে সেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ মুক্তিযুদ্ধের কথা। মুক্তিযোদ্ধাদের কথা। বিজয়ের কথা। বিজয় দিবসের কথা।

সময় বড় নিষ্ঠুর

আমি এক সময়হীনা, ব্যস্ত মানব,
সময়ের স্রোতে ভেসে চলি, তবুও সময় পাই না।
সময় আমার কাছে এক নিষ্ঠুর দানব।

সময় দয়াহীন, মায়াহীন, নিদারুণ,
সময়ের নেই দয়া-মায়া, সময় কারোর দ্বার ধারে না!
সময় কারোর ভালো, কারোর করুণ!

সময় চলে টিকটিক কাটায় কাটায়,
সময় মেপে কেউ কাউকে মারে, ধরে, নির্যাতন করে।
সময়তে গুনীজনরাও অজ্ঞানীকে ঠকায়।

সময় মেপে চলে চন্দ্র, সূর্য, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড,
চলে এই পৃথিবীর সকল জীবজন্তু, চলে যত কাজকর্ম।
সময় সময় ঘটে যায় যত লঙ্কাকাণ্ড।

সময় বলে দেয় জীবের আগমনী বার্তা,
আগমন ঘটে ধনীর দুলাল, ফকির, সাধু, জ্ঞানীগুণী।
সময় শেষে বিদায় নেয় সকল কর্তা।

সময় চলে তার আপন গতিতে,
সময়ের কাছে সবাই ধরা, বড়লোক থেকে সর্বহারা।
সময় খ্যান্ত হবে আমার মৃত্যুতে।

ফিরাইয়া দে

যেসুম গেরামের বন্ধুগো লগে উড়াইছি ঘুড়ি,
খেলছিলাম ফুটবল, গোল্লাছুট, কানামাছি।
আইস্বা খেইল্লা দিনগুলা কাডাই দিছি!

যেসুম হগলতে মিল্লা সাদাকালা টেলিভিশন দেখতে যাইয়া মাইষের আতে খাইছি কত মাইরগুতা।
ইশকুলে খাইছি মাস্টারের বেতের গুতা!

যেসুম চারআনা দিয়া বুটভাজা, বাদাম, লেবনচুষ, আইসক্রিম, মালাই খাইছি মনে অনন্দ লইয়া।
হারা দুপুর কাডাই দিছি নদীতে হাতরাইয়া।

যেসুম বড়দা’র কান্দে চইড়া মেলায় যাইয়া কিন্না আনতাম, নিমকি, জিলাপি বাতাসা সন্দেশ।
হেই দিনগুলা অহনে অইয়া গেছে নিরুদ্দেশ!

যেসুম মজা খাওনের লাইগা বাবার পকেট থেইক্কা পাঁচপাই, দশপাই চুরি কইয়া রাখছি পলাইয়া!
হেই দিনগুলা কই গেলগা আরাইয়া?

যেসুম ঘুদারা পাড় অইয়া, পাঁচপাই বাঁচানের লাইগা, পরনের হাপপেন্ট খুইল্লা আন্দা-গুন্দা দৌড়াইছিলাম।
দশপাই লগে লইয়া টাউন দেখতে গেছিলাম!

যেসুম চলছিল সিনামা হলে দি রেইন ছায়াছবি। অভিনয় করছিলো, নায়ক ওয়াসিম ওলিভিয়া।
হেই সিনামা দেখছি বই কিননের টেকা দিয়া।

যেসুম বাবার কান্দে চইড়া ঘরতাম! মা’র কোলে আর বড় দিদিগো কোলে কোলে থাকতাম হারাদিন।
সময়, তুই আমারে ফিরাইয়া দে হেইদিন?

যেসুম মা আমারে ছাড়া থাকতে পারতো না, আমিও থাকতে পারতাম না! মা’র গলেই থাকতাম হারাদিন।
সময়, তুই আমারে ফিরাইয়া দে হেইদিন!