রিয়া রিয়া এর সকল পোস্ট

বসন্তের তারাখসা

out.

এমন একটা সময়ে তুমি এসেছিলে যখন একটা কালো অন্ধকারের মেঘ থামিয়ে দিয়েছিলো আমায়। ফুরিয়ে যেতে যেতেও উঠে এসেছিলাম, বিশল্যকরণীর মতো তোমার স্পর্শে। তোমার জন্যই বসন্ত এসেছিলো। তোমার জন্যই শিমূলে, পলাশে খেলেছিলো জীবন। রাতজাগা ক্লান্ত পাখিটা গেয়ে উঠেছিল ভাটিয়ালী সুরে জীবনের গান। তোমার স্পর্শে গুমোট জীবনেও উঠেছিল ঢেউ। তোমার চোখ থেকে আবীর মেখেছিলো ধুসর মন। সাতটি রং সেজে উঠেছিল আমার চোখের আকাশে।

হঠাৎই অবিশ্বাসী কাঁটায় বিদ্ধ হয়ে, ‘ও কিছু নয়’ বলে চুপ থেকেছি, ভেঙেছি ভীষণ। অথচ তোমাকেই দিয়েছিলাম এক সাগর ভালোবাসা। কবোষ্ণ বুকের তরলের মতো।

ছিন্ন বিচ্ছিন্ন জীবনের টুকরো গুলো গোছাতে গোছাতে ভীষণ ক্লান্ত। একদিন নিঝুম রাতের ধূমকেতুর মতো, রাতজাগা কোনো তারাখসার মতো, কিংবা দাবানলে ঝলসে যাওয়া কোনো শুকনো পাতার মতোই ঝরে যাবো। কোনো ডাকেই আর ফেরাতে পারবে না।

শুধু পড়ে থাকবে আমার ক্ষত বিক্ষত, রক্তাক্ত পৃথিবী। কোনো বিবর্ণ ভুলে যাওয়া জলছবি মতো।
————
.
প্রচ্ছদের ছবি আঁকা: আমি।

নারী

s

নারী দিবসে সকল নারীকে সম্মান জানিয়ে…

শান দিয়ে রেখো
মরচে ফেলো না,
ঝলমলে তরবারী
কোন দিবসের
সুতো বাঁধা নয়
উজ্জ্বল তাই নারী।।

নারী নয় কোনো
দেয়ালের ছবি
দিন যাওয়া
কোন মতে
পদরেখা তার
ছড়িয়ে গিয়েছে
মরু নদী পর্বতে।।

ইতিহাস ঘেঁটে
পৃথিবীকে দেখ
হাজার লক্ষ প্রমাণ
পুরুষের সাথে
পাল্লা দিয়েছে
নারীও সমান সমান।।

বিদায় বেলা

33

আবারও অবিশ্বাসের কাঁটাগাছ দরজায় টোকা দিয়েছে। ভালো করে দেখতে চায় মানদণ্ড সোজা আছে কিনা। এতটুকু হেরফেরে ছেড়ে যাওয়া ভালোবাসার বাসভূমি। চলে যাব বলাটা নতুন নয়। শুনে চলা ছোটো থেকেই। তবুও বার বার একই কথার আবর্তে ঘোরা। আবার চিতার দহন।

নীল আকাশে কখনো ওড়া হয়নি। বারবার ডানা ভেঙেছে। যেতে চেয়েছে। যেতে দিয়েছি বিনা তর্কে, জিজ্ঞেস করিনি কেন এই শাস্তি? কেন এতো অবিশ্বাস? স্বপ্ন এঁকেছি আবার বিসর্জন দিয়েছি অশ্রুনদীতে।

যে ভালবাসা ভালোলাগার ডানা মেলে উড়তে চেয়েছিল আলো মেখে, বাসা বাঁধতে চেয়েছিল ভালোবাসার বুকে, সেও বিশ্বাস অবিশ্বাসের মানদণ্ডে পরীক্ষা করতে চেয়েছে। ডানাজোড়া কেটে রেখে দিয়েছে তারই কাছে।
আজও আমি গুণে রাখা তারাদের মাঝে মাঝে দেখি, কেউ যদি ভুল করেও চিনতে পারে। কেউ যদি সত্যিই বোঝার চেষ্টা করে!

খুব ভোরে হালকা ঠান্ডা বাতাসে চাদর টেনে নিই গায়ে। বিগত দিনগুলোর কথা বড় বেশি মনে পড়ছে। তোমাকে মনে পড়ছে। ফুসফুসে জমে থাকে অনেকটা কথা, তোমার কথা। মনের কুলুঙ্গিতেই শুধু নয়, মগজের অলিতেগলিতে শুধু নয়, ফুসফুসের কুঠুরিতে, কুঠুরিতেও শুধু নয়, আমার প্রতিটি শিরায় উপশিরায় রেখেছিলাম তোমাকে ন্যায্য দাবীতে, পরম বিশ্বাসে, ভালবাসায়।

ফাগুনের চোখেও বর্ষা! মনে জ্বলছে আগুন। তবুও বর্ষা নেমেছে দু’চোখে। একটা একটা করে ফোঁটা ঝরে পড়ছে আর সেই ফোঁটা নিয়ে বিন্দু বিন্দু করে মনকে সাজিয়েছি বিরহিণী রাধার মতো। আজ মৃত্যুকে মনে হয় চিরসখা,
“মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান”

ভূতের মাসি

3t

জমাট শীতে হঠাৎ এক ঝড়বাদলের রাতে।
ছমছমে এক গভীর রাত
নিজের কাঁধে রাখছি হাত
ভয়েই মরি একলা থাকি
বাঁচার এখন অনেক বাকি
ভূতের মাসি ভাংরা নাচে আনন্দেতে ছাতে।

স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখা

01

03

04

05

আমরা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। ছোটো বেলায় নানা রকম স্বপ্ন দেখতাম। কিছু স্বপ্ন সত্যি হয়েছে, কিছু ভুলে গেছি। নানা রকম উদ্ভট ইচ্ছেও ছিলো, যেমন ছোটো বেলায় গুলি খেলতাম আর সেইসব রংবেরঙের গুলি জমাতাম। বাক্স ভর্তি থাকতো নানা রঙের কাচের গুলিতে।

আজ দুটো স্বপ্নের কথা বলি – উস্তাদ জাকির হুসেনের তবলা ভীষণ পছন্দ করতাম, না না ক্ল্যাসিকাল গান বাজনা অতো বুঝি না, ভালো লাগতো জাকির হুসেনকে, তাঁর চুল যেভাবে উড়তো ওই “বাহ্ তাজ বলিয়ে” বিজ্ঞাপনে, কেমন একটা ক্রাশ ক্রাশ অনুভব করতাম। স্বপ্ন ছিলো যদি কখনও তাঁকে সামনাসামনি দেখি। স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেছিলো, ভুলেও গিয়েছিলাম সেই ছোটবেলার স্বপ্ন। জীবনের নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। বহু বছর কেটে গেছে। জীবন ট্র্যাকে দৌড়ে চলেছি। ততদিনে মেয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। একদিন কলেজ থেকে ফিরেছে, আমিও পড়িয়ে বাড়ি ফিরেছি, রাতের খাবার খেতে খেতে মেয়ে বললো – “শিশির মঞ্চে ওস্তাদ জাকির হুসেন আর পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদারের যুগলবন্দী হতে চলেছে, দেখতে যাবে?” আহা! সেই ছোটো বেলার স্বপ্ন যেন সামনে এসে দাঁড়ালো, মেয়েকে পরের দিন বললাম একেবারে সামনের সারির টিকিট কেটে আনিস। সেইদিন খুব কাছ থেকে দেখলাম ছোটো বেলার স্বপ্ন ওস্তাদ জাকির হুসেনকে।

আরও একটি স্বপ্নের কথা বলি – উস্তাদ আমজাদ আলি খান যখনই টিভির পর্দায় আসতেন মুগ্ধ হয়ে দেখতাম, তাঁর শান্ত, স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ব আমার ভালো লাগতো। ইচ্ছে ছিলো যদি কখনও সামনে বসে ওনার সরোদ বাজানো শুনতে / দেখতে পারি! সেই ইচ্ছে বা স্বপ্নও পূর্ণ হয়েছিল হঠাৎই। দৈনিক পত্রিকা টেলিগ্রাফে একটি বিজ্ঞাপন দেখলাম যে তারা একটি অনুষ্ঠান করতে চলেছেন যেখানে পণ্ডিত নয়ন ঘোষ, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর সঙ্গে থাকছেন আমার সেই স্বপ্নের মানুষ উস্তাদ আমজাদ আলি খান। টিকিট পাওয়া যাচ্ছে মেলোডিতে। রাতে বাড়ি ফেরার পথে মেলডি থেকে টিকিট সংগ্রহ করে নিলাম। তারপর খুব মন দিয়ে দেখলাম আমার সেই স্বপ্নের মানুষকে।

আহা! সব স্বপ্ন যদি এভাবে সত্যি হতো!

ভালোবাসা, ভালো বাসা

325r

আমি চিরকাল গান পাগল মানুষ। কিশোরী বয়সে কোনও কোনও সুর চোখ ভেজাতো। তারপর নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে, পলি পড়েছে। থমকে থেকেছে মন। অনেক ওঠা পড়ার পর পুরোনো আমি বদল হয়েও কোন এক ভোরে পুরোনো কোনো সুর আজও একই রকম ভিজিয়ে দেয় চোখ মন, তখন মনে হয় কোথাও কোনোখানে লুকিয়ে থেকে গেছে এক চিলতে আমার না বদলে যাওয়া আকাশ। চোখ বন্ধ করলেই ফিরে আসে না-ফেরত আসা সময়। অন্য রকম হয়ে যায় দিন।

এইসব দিনের জন্য, সেই এক চিলতে না বদলে যাওয়া আমির জন্য বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। বেঁচে থাকাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে নতুন করে। বারেবারে ফিরে আসে ভালোবাসা এ শহরের আনাচ কানাচ ধরে, পাখির ডানায় ভর করে। অযত্নে বেড়ে ওঠা জংলা গাছেদের পাতায় পাতায় ফুলে ফুলে।

ভালোবেসো ভালোবাসা।

একটা বাড়ি ছিলো মনের অলিন্দে। সে বাড়িটার কোনো ছবি ছিলো না আজও নেই। শুধু অনেক ভালোবাসার খনি আঁকড়ে জড়িয়ে আছে সেই বাড়িটার সবখানে। উঠোন, ছাদ, বাগান, জানলায়, চিলেকোঠায়, সবখানে জমে আছে পরতে পরতে ভালোবাসা। ঠিক যেন রোদে শুকোতে দেওয়া মায়ের টক মিষ্টি আচারের মতো। সেই বাড়িটা যত্ন করে রেখে দিই মনের গোপন দেরাজে।

সেই বাড়িরটার বড্ড মন কেমন কেমন গন্ধ। দাদুর তৈরি মিঠে পানের মতোই মন কেমন গন্ধ। কোন কোন শীত শীত ভোরে ভালোবাসার টানে এ শহর উড়িয়ে আনে শীতের পরিযায়ী পাখি, ঘুম ভেঙে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে আনমনা মন।

ভালো থেকো ভালো বাসা।

আলোমাখা ভোর

32

ভোর চলে যেতে যেতে রেখে যায় চড়ুইদের ধূলোবালি স্নান, শালিক সংসার, কাকেদের কনসার্ট, স্কুল বাস, চায়ের দোকানের উনুনের উপচে পড়া কয়লামাখা ধোঁয়া। এ সব কিছু পেরিয়ে এগিয়ে চলে রোদ পরতে পরতে, যত দূর দেখা যায়, তার থেকেও দূরে। পালিয়ে যেতে চায় মন সেখানে, যেখানে শীত শেষে বসন্ত দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে উঠোন জুড়ে ঝরে পড়ে ঈশ্বরময় গন্ধ। পালিয়ে যেতে চায় মন সেখানে, যেখানে শৈশব জুড়ে বসে থাকে অকৃত্রিম ভালোবাসার ওম। আর এক আকাশ, কোটি কোটি টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে রূপকথা। মন খুঁজে নেয় আনন্দ আর বেঁচে থাকার রসদ।

ততদিন বিষাদ ফিরে আসিস না তুই।

বৃষ্টি বিলাস

323 নিজের সাথে আমার নিজের ছিলো অনেক কথা, খুনসুটি, ঝগড়া, আবদার, মান, অভিমান। এতো কথার মধ্যেও আমি কিন্তু কোনোদিন কথা দিইনি গুছিয়ে সংসার, নিকানো উঠোন আর পরিপাটি আলনার অথবা, রান্নার স্বাদের ঠিকঠাক মাপ। কিংবা নির্ভুল পুজোর আসন। অথবা রোজ পুজো করা। এইসব আমার জন্য নয়। আমার জন্য ছিলো খোলা মাঠ, চু কিতকিত, কিংবা মাঞ্জা দেওয়া ঘুড়ি, গুলি খেলা, ফুটবল, ক্রিকেট আরও কতো কি।

বড় বেশী দামাল ছিলাম আমি। সারাদিন দস্যিপনায় ভরপুর। দাদু ডাকতেন, বড়দিদি। দাদু খেতে বসলেই আমি ঠিক দাদুর পাশে। রাতে দাদুর পাশে ঘুমোনোর সময় দাদুর গল্পের ঝুলি থেকে গল্পেরা তখন টুপ করে চলে আসতো আমার ঝুলিতে।

মাঝেমধ্যে একলা যাপন ছিলো আমার প্রিয় স্বপ্নগুলোর সঙ্গে। আমাকে দেখেই তারা এসে ভিড় করতো। দুহাতের মুঠো খুশি থাকতো ওদের জন্য। ওদের সাথে বকম বকম করতে গিয়ে কখন যে সন্ধ্যে হয়ে যেতো খেয়ালই করতাম না। তারপর ঠাম্মা বলে উঠতেন এই ভরসন্ধ্যে বেলায় চুল খুলে কেউ ঘোরে! বেশ লম্বা চুল ছিলো আমার। বাঁধতে গিয়ে হিমশিম খেতে হতো। আবার কখনো জানলার খড়খড়িতে লুকিয়ে থাকা চোখ। দুপুর বেলার এক্কাদোক্কার ছক। আমি তখন বড্ডো অলস। আমার তখন আলসেমিতেই সুখ।

আমি কিন্তু কোনোদিন কথা দিই নি শুধুমাত্র সুখের, প্রশ্নহীন বাধ্যতার, আর অনেক সম্মানের। অথবা, লোক-দেখানো তোয়াজ, মায়াবী ব্যবহার।

ছোটবেলায় জেনেছিলাম আমি অলক্ষ্মী। এই শব্দটা কেমন যেনো অস্পৃশ্য। তখনও পাভেল, ইভান আর তাতিয়ানা গেরস্ত ঘরের নাম হয়ে ওঠেনি। তখনও রদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেলতাম, “ইস্পাত”, “মাদার”। এই অলক্ষ্মী নামেই হয়তো অলক্ষ্যে হেসেছিলেন সেই সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার! তাইতো জীবনের খেলাঘরে লক্ষ্মী নয় দুর্গা হয়ে উঠতে পেরেছিলাম।

যখন বৃষ্টি হতো লুকিয়ে ভিজতাম ইচ্ছেমতো। আর তারপর হ্যাচ্চো হ্যাচ্চো। আবার কখনো রোদ পোহানো আমের আচার মন। আবার কখনো মেঘবিলাসী ঠাকুরঘরের হাজার আলোর প্রদীপ। ঘরের কোণের খাঁজে খাঁজে চড়ুই পাখির পালক। জীবনের পথ চিনেছি গহীন বনের তুমুল ঝড়ের।

আলতা পাতা-কাজল লতা চোখের কোণের জল। তুলসি মঞ্চ, আকাশ প্রদীপ,তারারা উজ্জ্বল। একলা চাঁদ, হিমেল রাত, একলা হাতে হাত। একলা ছাদের, একলা দুপুর, একলা মনের সাথ।

এইতো, শুধু এইটকুই আমি, ভুল নামতার সাথ। তবুও হাসতে পারি যখন তখন সন্ধ্যে কিংবা রাত। কখনও মেঘ পেরিয়ে রোদের ঝিলিক মাস কয়েকের দেরি, মন খারাপের বাদলা দিনে বৃষ্টি বিলাস বাড়ি।

পূর্বরাগ

3179

চাঁদের আলোয় লিখছে নতুন স্বপ্ন
ইউলিসিসের মতো তীব্র অথচ,
নার্সিসাসের মতো প্রেমাচ্ছন্ন
ট্যারেন্টুলার বিষাক্ত লালায় প্রেমের
রন্ধ্রে রন্ধ্রে গজিয়ে উঠেছিল পার্থেনিয়াম।

এসো, মনের সমস্ত আভরণ খুলে
কৃষকের ধানবোনা ছন্দের মতো
নির্জন সমুদ্রের গর্জনের মতো,
পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা
একলা পাখির মতো এসো।

হরপ্পার প্রাচীনতম শব্দ থেকে
আবিষ্কার করো তোমার শিলালিপি।

জলরঙ স্বপ্ন

3168

এক স্বপ্ন থেকে আর এক স্বপ্নের দূরত্ব কয়েক আলোকবর্ষ!

দুই স্বপ্নের মাঝে এসে দাঁড়ায়
সাংঘাতিক ভুল, যা শূন্যতার মুখোমুখি হবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

স্বপ্নের সারথি ছিল জলরঙ, তেলরঙ, গাছ, পাখি, নদী, ফুল, নৌকো।
কোন এক ঝড়ের রাতে কে যেন তছনছ করে দিয়ে গেছে, ভ্যান গঘের সোনালি ধানক্ষেত।

স্বপ্নেরা ছিল ক্ষণজীবী
মৃত্যুতে কেঁপে উঠেছিল
মেরুদণ্ড, স্নায়ু,মজ্জা, মাংস

আমি এখন স্মৃতি সাম্রাজ্যের পাহারাদার
জেগে থাকি হোয়াং হো-র বুক চিরে।
কোন রাতচরা পাখি ভুল পথে চলে আসে,
আর অবিরাম স্পষ্ট উচ্চারণে জেগে ওঠে
পুরনো রক্তাক্ত স্মৃতি।

নিরাপদ দূরত্ব রেখে সরে যাই এক পৃথিবী থেকে অন্য পৃথিবীতে।

এই আছি এই নেই

2404

লবণ জলে চোখের পাতা,
আঁকছে জীবন আলপনা।

রাতবিরেতে আকাশটাও,
গাইছে মেঘের বন্দনায়।

যখন তখন মনগলিতে,
চলছে মধুর দিনগোনা।

ঝিলমিলিয়ে হৃদয়পুরে
তোমারই যে আনাগোনা।

চাঁদের বুড়ি চড়কা কাটে,
জ্যোৎস্না সুখের জালবোনা।

পাখির নীড়ে ঠিক দুপুরে,
ঐ সাতসুরেরা আনমনা।

নিবিড় সুখে ঘর আমার!
যত বাঁধন ছেঁড়া কল্পনা।

আমি যদি নাই হয়ে যাই,
দেখো ইচ্ছে কিন্তু মন্দ না!

রঙ্গমঞ্চ

30

জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে
বাৎস্যায়ন পর্ব দূরে রাখি।
কতডিগ্রী ফিরে তাকালে
দর্শক প্রেমে ঘায়েল হবে-
কতখানি ক্লিভেজ দেখালে
জেগে উঠবে ধ্যানমগ্ন বিশ্বামিত্র –
চোখের কতখানি ঝড় তুললে-
হৃদয়ে প্লাবন ডাকবে।

অবাঞ্ছিত সব দরজা বন্ধ রাখি,
লক্ষ্মী থেকে দুর্গা হয়ে উঠতে,
দানব বধের খেলায়
এইসব অপ্রয়োজনীয়।

শুভ জন্মদিন … রামকিঙ্কর বেইজ

2838aজন্মদিনে শ্রদ্ধা জানিয়ে —
আমার যে লেখাটি অনেকেই চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছে সেটিই আবার দিলাম।

রামকিঙ্কর বেইজের জন্ম ১৯০৬ সালের ২৫ মে। পিতা চণ্ডীচরণ, মার নাম সম্পূর্ণা। তাঁদের বাড়ি ছিল বাঁকুড়ায়। পারিবারিক পদবি ছিলো পরামাণিক। রামকিঙ্করই প্রথম বেইজ পদবি চালু করেন তাঁদের পরিবারে। ক্ষৌরকর্ম তাঁদের পারিবারিক পেশা। এই পরিবারে তিনিই সর্বপ্রথম শিল্পের পথে এলেন উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া পারিবারিক প্রথা ভেঙে।

রামকিঙ্কর বেইজের শিল্পের চৌহদ্দি ছিল অনেক প্রশস্ত। তেলরং, জলরঙ, ড্রইং, স্কেচ, ভাস্কর্য সহ বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছেন তিনি। তাঁর ছবি এবং ভাস্কর্য দুটোকেই তিনি নিয়ে গেছেন শিল্পসৌকর্যের চূড়ায়। প্রথমদিকে ছবি আঁকার প্রতিই রামকিঙ্করের মনযোগ ছিল বেশি। পরবর্তীতে পূর্ণোদ্যমে শুরু করেন ভাস্কর্য। কখনোই গতানুগতিক, বাঁধাধরা নিয়মে শিল্পসৃষ্টির পক্ষপাতি ছিলেন না তিনি। নিজের তৈরি পথেই চলেছেন সবসময়। প্রতিনিয়তই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। গড়েছেন ভেঙেছেন আবার গড়েছেন; এভাবেই এগিয়ে গেছে তাঁর শিল্প সাধনার পথ। দৃশ্যশিল্পের নতুন শৈলী, টেকনিক অথবা মাধ্যমের সন্ধানে সবসময় খোলা থাকত তাঁর দৃষ্টি।

রামকিঙ্করের গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্যগুলোর বেশিরভাগ শান্তিনিকেতনে। ইউক্যালিপটাস গাছের সারির ভেতর ‘সুজাতা’ কিংবা কলাভবনের ‘সাঁওতাল পরিবার’, ‘বাতিদান” মিলেমিশে অন্যরকম এক দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে। তবে শান্তিনিকেতনে করা ‘ধানঝাড়া’ ভাস্কর্যটির কথা উল্লেখ করা যায়। খোলামেলা শারীরিক প্রকাশের জন্য এই ভাস্কর্যটি অনেক গোঁড়া আশ্রমিকের সমালোচনার শিকার হয়েছিল। কিন্তু আশেপাশের সাঁওতাল গ্রামবাসীদের কাছে এটা ছিল খুব প্রিয়। কাজের প্রতি তাঁর একরোখা মনোভাব এবং রবীন্দ্রনাথ নন্দলালের প্রশ্রয়, বিনোদবিহারী সহ অন্যান্য সুহৃদ বন্ধুর সহযোগিতা আর সর্বোপরি তাঁর প্রতি ছাত্রদের শ্রদ্ধা ও সমর্থনের কারণে তাঁর কাজ ঠেকিয়ে রাখা যায় নি। শেষ পর্যন্ত সমালোচকরাই চুপ করে গিয়েছিলেন।

১৯২৫ সালে ছাত্র হিসাবে শান্তিনিকেতনে যোগ দেয়ার পর একই বছর লক্ষ্ণৌর নিখিল ভারত শিল্প প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে রৌপ্যপদক লাভ করেন রামকিঙ্কর। ঐ প্রদর্শনীতে স্বর্ণপদক পান নন্দলাল বসু। ১৯২৭ সালে ভারতের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ স্থানে ঘুরে বেড়ান তিনি। নালন্দা, জয়পুর, চিতোর, উদয়পুরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান ভ্রমণ করেন। ফলে প্রাচীন ভারতবর্ষের নানা স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে।

রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচয়ের সূত্রে ভিয়েনার ভাস্কর লিজা ভনপট ১৯২৮ সালে ভারত আসেন। রামকিঙ্কর তাঁর কাছে ভাস্কর্যের বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ নেন। এর কিছুদিন ভারতে আসেন বিশ্বখ্যাত ভাস্কর রঁদ্যার শিষ্য বুর্দেলের ছাত্রী মাদাম মিলওয়ার্দ। মিলওয়ার্দের সাহচর্য রামকিঙ্করকে নানাভাবে উপকৃত করে। তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক উভয় দিকে তাঁর কাছে শিক্ষালাভ করেন। এরপর বিখ্যাত ইংরেজ ভাস্কর বার্গম্যানের কাছে রিলিফের কাজ শেখেন রামকিঙ্কর।

রামকিঙ্কর এমন একজন শিল্পী যাকে কোন দলে ফেলে মাপা যায় না। তাঁর জীবন ইতিহাস অন্যান্য শিল্পীর চেয়ে একেবারেই অন্যরকম। বাঁকুড়ার এক অখ্যাত পল্লীর দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিবারের সন্তান রামকিঙ্কর, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দৌঁড়ও তেমন কিছু নয়। যার পারিবারিক পেশা ছিল ক্ষৌরকর্ম। আর শৈশব কাটতো পাশের কুমোর পাড়ায় ঘুরে ঘুরে। কী অদ্ভুত এক নিবিষ্টতায়, শিল্পের প্রতি ভালোবাসায় তিনি হয়ে উঠলেন ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বিশ্বের অগ্রগণ্য এক শিল্পী। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘যাঁরা প্রতিভাশালী তাঁদের কেউ লুকিয়ে রাখতে পারবে না’। আর শান্তিনিকেতনের সাথে তাঁর যোগাযোগটাও নিশ্চয় তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। যদি ঘটনাক্রমে তাঁর সাথে শান্তিনিকেতনের যোগাযোগ না ঘটতো তবুও হয়ত শিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশের পথ তিনি খুঁজে পেতেন, খুঁজে নিতেন। কিন্তু যে রামকিঙ্করকে আজ আমরা জানি, ঠিক সেই রামকিঙ্করকে পেতাম না আমরা। শান্তিনিকেতনে তাঁর শিল্পী সত্ত্বা মুক্তির যথার্থ পথ পেয়েছে। এক্ষেত্রে সবার মাথার ওপরে রবীন্দ্রনাথতো ছিলেনই, সহায়ক হিসাবে আরও ছিলেন গুরু নন্দলাল বসু ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রামকিঙ্করের অন্যান্য বিখ্যাত ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে আছে:

প্লাস্টারে করা মা ও ছেলে (১৯২৮), কচ ও দেবযানী (১৯২৯), মিথুন-১ (১৯৩১), মিথুন-২ (১৯৩১), মিথুন-৩ (১৯৩১), সাঁওতাল-সাঁওতাল রমণী (১৯৩৫), সাঁওতাল দম্পতি (১৯৩৫), আলাউদ্দিন খাঁ (১৯৩৫), কংক্রীটে করা সাঁওতাল পরিবার (১৯৩৮), প্লাস্টারে করা রবীন্দ্রনাথের বিমূর্ত ভাস্কর্য (১৯৩৮), সিমেন্টে করা রবীন্দ্রনাথের আরও একটি ভাস্কর্য (১৯৪১), হার্ভেস্টার (১৯৪২), ফেমিন (১৯৪৩), সাঁওতাল নাচ (১৯৪৩), অবনীন্দ্রনাথ (১৯৪৩), সিমেন্টে করা কুলি মাদার (১৯৪৩-৪৪), বিনোদিনী (১৯৪৫), বুদ্ধ (১৯৪৬-৫০ ?), সিমেন্টের দ্য মার্চ (১৯৪৮), ডাণ্ডী মার্চ (১৯৪৮), লেবার মেমরী (১৯৪৮), মা ও ছেলে (১৯৪৯), স্পীড এন্ড গ্রাভিটি (১৯৪৯), শুয়োর (১৯৫২), পিতা-পুত্র ( ১৯৫২), মিলকল (১৯৫৬), গান্ধী (১৯৫৭), শার্পেনার (১৯৫৮?), ম্যান এন্ড হর্স ( ১৯৬০), সুভাসচন্দ্র বসু (১৯৬০-৬১), হর্স হেড (১৯৬২), মহিষ-১ (১৯৬২) কাক ও কোয়েল (১৯৬২), আগুনের জন্ম (১৯৬৩), যক্ষী-১১(১৯৬৩?) মহিষ ও ফোয়ারা (১৯৬৩), মাছ (১৯৬৪), তিমি মাছ (১৯৬৫), নৃত্যরতা নারী (১৯৬৫), লালন ফকির (১৯৬৫), যক্ষ যক্ষী (১৯৬৬), প্রেগন্যান্ট লেডি (১৯৬৭-৬৯), বলিদান (১৯৭৬), রাজপথ (১৯৭৭), রেখা, কলেজ গার্ল, গণেশ, সিটেড লেডি, মা ও শিশু, কুকুর, মা, সেপারেশন, রাহুপ্রেম, প্যাশন, ত্রিভুজ, দ্য ফ্রুট অফ হেভেন, হাসি, বন্ধু ইত্যাদি।

বেশ কিছু প্রতিকৃতি এঁকেছেন রামকিঙ্কর। এগুলো ফরমায়েশি প্রতিকৃতি চিত্রের মত নয়। শুধু ব্যক্তির অবয়বকে ধরে রাখার জন্য এই ছবিগুলো আঁকা হয়নি। এই ছবিগুলোর প্রত্যেকটিতেই ব্যক্তির চেহারার সাথে মিলে মিশে গেছে চরিত্র-প্রকৃতি এবং শিল্পীর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁর প্রতিকৃতি চিত্রগুলোর মধ্যে ‘স্বপ্নময়ী’, ‘ সোমা যোশী’, ‘বিনোদিনী’, ‘নীলিমা দেবী’ উল্লেখযোগ্য। চারপাশের পরিবেশ প্রকৃতি, মানুষ ও তাদের জীবনযাত্রা নিয়ে বেশকিছু ছবি আছে রামকিঙ্করের। এই ছবিগুলোতে বিষয়ের চিত্ররূপের সাথে শিল্পীর বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ছবিগুলোর কোনটিতে যুক্ত হয়েছে মিথের প্রতীক কোনটিতে বা এসেছে বিমূর্ত চারিত্র। এই ধরণের ছবির মধ্যে ‘ঘরামি’, ‘ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রাম’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

রামকিঙ্করের সারা জীবনের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৭০ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ উপাধিতে সম্মানিত করেন। ১৯৭৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট সম্মাননায় ভূষিত করে।
তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। চিকিৎসার জন্য তাঁকে কলকাতায় নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কলকাতা যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। যাহোক ১৯৮০ সালের ২৩ মার্চ রামকিঙ্করকে কলকাতার পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁর চিকিৎসার খরচের দায়িত্ব নেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকেও কিছু টাকা দেয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় মস্তিষ্কে জমে থাকা জল বের করার। ধারণা করা হয় এতে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। ২৬ জুলাই তাঁর মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হবে। তার আগের দিন মাটি দিয়ে বানালেন ছোট্ট একটি ভাস্কর্য। এটিই তাঁর জীবনের সর্বশেষ শিল্পকর্ম। পরের দিন অস্ত্রোপচার হল। দু‘একদিন সুস্থ ছিলেন। তারপর শুরু হলো মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ।

১৯৮০ সালের ২ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়। জীবনের , সৃজনের দীর্ঘ সময় তিনি যেখানে কাটিয়েছিলেন সেই শান্তিনিকেতনেই রচিত হলো তাঁর শেষ শয্যা।

তোমাকে চাই

2830aa

তোমাকে শুধু একবার ছুঁতে চাই
শুধু একবার।

ওই দূরের পাহাড়ের মতো কতবার
আলতো ভাবে ছুঁয়েছি তোমায়।
বহুবার, বহুভাবে।
শুধু আমিই জানি, যখন তখন।
মন গুটিয়ে নিয়ে আবার ছড়িয়ে দিয়েছি
তোমার দিকেই।

নদীর বুক জুড়ে তোমার চলাচল।
তোমার নামেই চলে শ্বাস প্রশ্বাস।
তোমায় ছায়ায় বাঁচি, অবরে সবরে।
ছুঁয়ে যেতে চাই আরও গভীর থেকে গভীরে
মিশে যাবো বলে …

সেই আলোক বিন্দুতে, যেখানে অন্ধকারের শেষ।
রামধনু রং মেখে সাতটি তারা মিশে গেছে
আমার অস্তিত্বে। আমার চেতনায়।
তবু তুমি অধরাই থেকে গেছো।

শুধু একবার কাছে এসো, ছুঁয়ে দেখি
তারপর বৃন্দাবনে আলোর আভাস।।

আজ বিশ্ব চা দিবসেও রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক …

2832

চা-পান ছিল রবীন্দ্রনাথের অন্যতম পছন্দ। প্রতিদিন অন্ধকার থাকতে বনমালীর হাতের তৈরি চা সহযোগেই তাঁর দিন শুরু হত। খুব সকালেই চা পান করতে অভ্যস্ত ছিলেন কবি। শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ যখন থাকতেন তখন খুব ভােরবেলা অন্ধকার থাকতেই উনুন ধরিয়ে কবির জন্য চা করে দিত কবিভৃত্য বনমালী। গুরুদেবের চা ছিল একটু অভিনব। কেটলি ভরা গরম জলে কয়েকটা চা-পাতা ফেলা হত, চায়ে রঙ সামান্য একটু ধরলেই পেয়ালার অর্ধেকটা সেই চা ঢেলে বাকি অর্ধেক দুধে ভর্তি করে নিতেন কবি। দু-চামচ চিনি দিতেন তাতে। চায়ের সঙ্গে আসত মাখন-পাউরুটি, একটু মুড়ি কিংবা আদার কুচি বা গুড় দিয়ে কল বেরােনাে ভিজে মুগ বা ছােলা, কোনওদিন বা একটা আধ সিদ্ধ ডিম।

সকলকে চা পানে উদ্বুদ্ধ করবার জন্য রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে একটা চায়ের আসর গড়েছিলেন যার নাম সুসীম চা-চক্র। এই আসরের একটা ছোট্টো ইতিহাস আছে, আছে নেপথ্যে একটা গানের খবরও।

১৯২৪ সালে চিন ও জাপান পরিভ্রমণ শেষে দেশে ফিরে আসার সময়ে রবীন্দ্রনাথ চীন থেকে চায়ের সরঞ্জাম, নানা উপকরণ, চা ও নানা রকম খাবার সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। জাপান ও চীনের বিভিন্ন চা-অনুষ্ঠানে অনুপ্রাণিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনেও একটি চা-সভা স্থাপন করলেন। চিন ভ্রমণের সময়ে সু সীমো নামে যে তরুণ রবীন্দ্রনাথকে দোভাষী হিসাবে সাহায্য করেছিলেন, তার নাম অনুসারে এই চা-সভার নাম রাখা হল সুসীম চা-চক্র। সুসীম চা-চক্রের উদ্বোধন হয় ২২ শ্রাবণ ১৩৩১ সালে, বর্তমান পাঠভবন অফিসের একতলায় বিদ্যাভবনের লম্বা হল ঘরে। এই উপলক্ষে ওই দিনেই রবীন্দ্রনাথ একটি গান রচনা করেন এবং দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে সমবেত কণ্ঠে সেটি গাওয়া হয়।

”হায় হায় হায় দিন চলি যায়।
চা-স্পৃহ চঞ্চল চাতকদল চল’ চল’ চল’ হে।।

টগ’বগ’-উচ্ছ্বল কাথলিতল-জল কল’কল’হে।
এল চীনগগন হতে পূর্বপবনস্রোতে শ্যামলরসধরপুঞ্জ।।

শ্রাবণবাসরে রস ঝর’ঝর’ ঝরে, ভুঞ্জ হে ভুঞ্জ দলবল হে।
এস’ পুঁথিপরিচারক তদ্ধিতকারক তারক তুমি কাণ্ডারী।
এস’ গণিতধুরন্ধর কাব্যপুরন্দর ভূবিবরণভাণ্ডারী।
এস’ বিশ্বভারনত শুষ্করুটিনপথ- মরু-পরিচারণক্লান্ত।

এস’ হিসাবপত্তরত্রস্ত তহবিল-মিল-ভুল-গ্রস্ত লোচনপ্রান্ত- ছল’ছল’ হে।
এস’ গীতিবীথিচর তম্বুরকরধর তানতালতলমগ্ন।
এস’ চিত্রী চট’পট’ ফেলি তুলিকপট রেখাবর্ণবিলগ্ন।
এস’ কন্‌স্‌টিট্যুশন- নিয়মবিভূষণ তর্কে অপরিশ্রান্ত।
এস’ কমিটিপলাতক বিধানঘাতক এস’ দিগভ্রান্ত টল’মল’ হে।

বাঙালির জীবনে এমন কোনও বিষয় নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া পড়েনি। তাই চা নিয়ে যে এমন একটি মজার গান লিখবেন তাতে অবাক হবার কিছু নেই। তিনি জানতেন চা মন ও শরীরের ক্লান্তি দূর করে। তাই তিনি পুঁথি বিশারদ, গণিতবিদ, কাব্যরসিক, চিত্রকর, বাউণ্ডুলে থেকে শুরু করে এমনকী শশব্যস্ত হিসাব রক্ষকদেরকেও কর্মজীবনের গ্লানি ভুলবার জন্য চা পানে আহ্বান জানিয়েছিলেন। এ বিষয়ে শান্তিনিকেতন পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘পূজনীয় গুরুদেব প্রথমে এই চক্রের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন। প্রথমত, ইহা আশ্রমের কর্মী ও অধ্যাপকগণের অবসরসময়ে একটি মিলন ক্ষেত্রের মত হইবে – যেখানে সকলে একত্রিত হইয়া আলাপ-আলোচনায় পরস্পরের যোগসূত্র দৃঢ় করিতে পারিবেন।

দ্বিতীয়ত, চিন দেশের চা-পান একটি আর্টের মধ্যে গণ্য। সেখানে আমাদের দেশের মতো যেমন-তেমন ভাবে সম্পন্ন হয় না। তিনি আশা করেন, চিনের এই দৃষ্টান্ত আমাদের ব্যবহারের মধ্যে একটি সৌষ্ঠব ও সুসঙ্গতি দান করবে।’

শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে কবির কোণার্ক বাড়ির লাল বারান্দাটি ছিল চায়ের আসরের জন্য বিখ্যাত। গণ্যমান্য অতিথিদের জন্য প্রায়ই এখানে চায়ের টেবিলের বন্দোবস্ত করতে হত। যেবার জওহরলাল সস্ত্রীক শান্তিনিকেতনে এলেন, উঠেছিলেন এই কোণার্ক বাড়িতে। লাল বারান্দাতেই বসল চায়ের আসর। একবার জাপান থেকে এক অতিথি দম্পতি এলেন আশ্রমে। গুরুদেবকে শ্রদ্ধা জানাতে তারা জাপানি প্রথায় ‘টি সেরিমনি’র আয়োজন করেছিলেন এই লাল বারান্দাতেই। সেদিন অতিথি ভদ্রমহিলা নিজে হাতে জাপানি প্রথায় চা তৈরি করে সকলকে পরিবেশন করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ চায়ের কদর বুঝতেন। চা-পান ছিল তাঁর কাজের অন্যতম সঙ্গী। হয়ত তাঁর অনবদ্য সৃজনশীলতার পিছনেও ছিল চায়ের পরোক্ষ প্রভাব।