রোদেলা নীলা এর সকল পোস্ট

তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে ডুবে থাকি

ঝুম বৃষ্টিতে গা ভিজিয়ে খুঁজতে গিয়েছি
বেগুনি রঙ্গের স্পর্শ।
তোমার সীমাহীন ব্যস্ততা আন্দোলিত করেছে
দগ্ধ করেছে হৃদপিণ্ড।
ঘন আকাশের বুকে শরীর বিছিয়ে অবসাদ গাহন
তৃপ্তি দিয়েছে সাময়িক।
তুমি দাড়িপাল্লায় মেপে মেপে হিসেব করে
নিক্ষেপ করো অপর্যাপ্ত অনুভূতি।

আমি যে শঙ্খচিল ;
উড়তে জানা সাদা পায়রা,
অদৃশ্য ডানা দিয়ে উড়ে যাই মেঘ বাড়িতে।
তবু শেকল পড়বার মিথ্যে প্রলোভন স্বপ্ন
দু’চোখে মাখি আজো।

তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে ডুবে থাকি –
ওত পাতা কোন এক বেসামাল সৈকতে
ওখানে নিতান্তই চোরাবালি ঘেরা ঘাট ;
সে আমার অজানা নয় মোটেও।
ডাহুকের হাহাকার জমানো কান্না ;
অশুদ্ধ প্রেমের নিঃশব্দ হাতছানি,
একলা করে দেওয়া ক্লান্ত গোধূলি লগন
ভুলের পরিমাপ বাড়াতে অজান্তে ঘুম হয়ে আসে ।।

কল্পনার বিষবাষ্প

কল্পনার বিষবাষ্প

মুঠোফোন ছাপিয়ে যখন তোমার কণ্ঠের বৃষ্টি নামে,
মুগ্ধতা এসে হাঁটু গেড়ে বসে আমার পায়ের কাছে।
নিজেকে সম্রাজ্ঞীর আসনে বসিয়ে মনের মাধুরীতে অংকন করি-
স্বপ্নীল রাজপ্রাসাদ।
সেখানে তুমি হয়ে ওঠো মুকুটবিহীন রাজা,
তোমার ঘোড়াশালে ঘোড়া নেই ;
হাতি শালে হাতিও নেই,
তবু কী তীর্যক শব্দ ভাণ্ডার দ্বিগুন অশ্বগতিতে
নির্বিঘ্নে ছুটতে থাকে আমার অন্দরমহলে।

লোহার প্রাচীর মোড়ানো ঘরটায়
আলোকবর্তিকা আচমকাই নাচন তোলে,
আমি সেই উজ্জ্বলতার তীব্র বাণে নিহত হয়ে যাই।

চায়ের কাপে অপেক্ষা

চায়ের কাপে অপেক্ষা

পাশে অলস পড়ে থাকে সেল ফোন;
ঘন্টার পর ঘন্টা !
হঠাৎ টুং করে আওয়াজ হতেই আমি চমকে উঠি;
হুম, নোটিফিকেশন এসেছে;
কিন্তু সেগুলো আমার পেইজ থেকে।
গত দশ বছরের ডিজিটাল দুনিয়াতে আর কিছু কামাই না করি;
কয়েক খানা পেইজের সুপার এডমিন পোস্টটা ঠিকঠাক
দখল করে রেখেছি।
জানি, দখল করে থাকার মধ্যেও যোগ্যতা আছে,
কিন্তু সেই যোগ্যতা কেবল আমার প্রফেশনে;
বাস্তবিক অর্থে কাওকে দখল করবার কোন যোগ্যতাই
আমার কোন কালেও ছিল না।

মাঝে মধ্যে এমন উদ্ভট ইচ্ছেরা এই অসময়ে যখন উঁকি ঝুঁকি
মারার চেষ্টা করে,
তাকে আমি কঠিন ভাষায় পরাস্ত্র করি।
ভীষন রকম সন্দেহ বাতিক হয়েছে আমার;
কাওকেই আর বিশ্বাস করতে পারছি না আগের মতোন,
কিছুটা সময় কথার খেলায় মেতে ওঠার পরেই মনে হতে থাকে –
এই গল্পটা বুঝি সে আরো একটি মেয়ের সাথেও করছে,
সেই একই আবেগ, একই কন্ঠ, একই ভনীতা;
ব্যাস, সীমানা রেখায় শেষাংক টেনে দিলাম।

আমার আসলে মুঠোফোনের কাছ থেকে চাইবার মতোন কিছু নেই;
সেখানে কোন মিসকল হয়ে থাকলো কীনা,
সেখানে মন ভালো করে দেবার মতোন কোন বার্তা এলো কীনা;
কিচ্ছু না।
আমার শুধু একটাই কষ্ট;
মন খারাপের সন্ধ্যেগুলো ধূলোয় মিলিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত,
মিরপুর স্টেডিয়ামের গলি ঘেষে আর ফুচকা খাওয়া হয় না।
অফিস ফেরার পথে লাভ রোডের তে’মাথায় বসে
মাল্টা দেওয়া গরম কাপে ঠোঁট ভেজাতে পারিনা।

চায়ের অবসরে ঝড় ওঠাবার জন্যেও বুঝি একজন বিশ্বস্ত বন্ধু লাগে !!

বেগুনি রঙের বৃষ্টি

বেগুনি রঙের বৃষ্টি

ঝুম বৃষ্টিতে গা ভিজিয়ে খুঁজতে গিয়েছি
বেগুনি রঙের স্পর্শে।
তোমার সীমাহীন ব্যস্ততা আন্দোলিত করেছে
দগ্ধ করেছে হৃদপিণ্ড।

ঘন আকাশের বুকে শরীর বিছিয়ে অবসাদ গাহন
তৃপ্তি দিয়েছে সাময়িক।
তুমি দাড়িপাল্লায় মেপে মেপে হিসেব করে
নিক্ষেপ করো অপর্যাপ্ত অনুভূতি।

আমি যে শঙ্খচিল ;
উড়তে জানা সাদা পায়রা,
অদৃশ্য ডানা দিয়ে উড়ে যাই মেঘ বাড়িতে।
তবু শেকল পড়বার মিথ্যে প্রলোভন স্বপ্ন
দু’চোখে মাখি আজো,
তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে ডুবে থাকি –
ওত পাতা কোন এক বেসামাল সৈকতে
ওখানে নিতান্তই চোরাবালি ঘেরা ঘাট ;
সে আমার অজানা নয় মোটেও।

ডাহুকের হাহাকার জমানো কান্না ;
অশুদ্ধ প্রেমের নিঃশব্দ হাতছানি,
একলা করে দেওয়া ক্লান্ত গোধূলি লগন
ভুলের পরিমাপ বাড়াতে অজান্তে ঘুম হয়ে আসে।।

রেখেছি দেখো পূর্ণ থাকা পাঁজরে

রেখেছি দেখো পূর্ণ থাকা পাঁজরে

তোমাকে রেখেছি আজ
মেঘ কালো রোদ্দুরে ;
শ্যাওলা জড়ানো পুরনো স্নান ঘরে।
তোমাকে রেখেছি এই
বাসমতী চাল ঝরে ;
আধ ফোটা মুশুরী ডাল ভরে।
তোমাকে রেখেছি দেখো
পূর্ণ থাকা পাঁজরে ;
এলেবেলে মাখামাখি শুদ্ধ চাদরে।
তোমাকে রেখেছি মেখে
আটপৌঢ় সময় ধরে,
সময়ের আহবানে মননে শরীরে।।

___________________
ছবির সৃষ্টি মাহমুদ এইচ খান
রাংগাউটি, মৌলভিবাজার ।

আমি না পাহাড়, না অরণ্য … শুধুই নারী

কণ্ঠে আমার শেষ শব্দটা ভীষন সংযত;
কেউবা পিছে শুনে নেয় সব কথা।
জানি; চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়,
হিমধরা এই রাত্তিরে এক টুকরো উষ্ণতা হাত ধরে বলে –
আমাকে আগলে রাখো তোমার বুকে।

আমি যদি পাহাড় হতাম
তবে সত্যি তোমাকে জড়িয়ে রাখতাম,
যদি অরণ্য হতাম
তবে নিশ্চিত লুকিয়ে রাখতাম তোমাকে।
আমি না পাহাড়, না অরণ্য;
আমিতো শুধুই নারী।

সমাজের সব গুলো নিয়ম কড়ায় গণ্ডায় মেনেই
তোমার কাছে আসতে পারি।
নির্দিষ্ট সময়ের আচ্ছাদনে আবিষ্ট ছুটির ঘন্টা
ঢং ঢং বাজতে থাকে।
তুমি মানব না হয়ে …
ভুলে ফেলে যাওয়া কালো চশমা হতে পারতে,
দিব্যি হাত ব্যাগে নিয়ে ঘুরতে পারতাম
মিরপুর থেকে শাহবাগ।

মাঝে মধ্যে আমারো ইচ্ছে করে খুব;
তোমার গলায় ঝুলে থাকা কালো মাফলার হতে,
অন্ততপক্ষে এই কঠিন শৈত্যে কিছুটা সময়
উষ্ণতা ছড়ানো যেত।

গলির শেষ বাড়িটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে দ্বিধাহীন;
আমার চোখ দু’টো তাকিয়ে থাকে পলকহীন,
তুমিহীনা এ রাজ্য এক মুহূর্তে হয়ে গেল অর্থহীন।

________________________
ছবি : আহমেদ বাবু। অক্টোবর ২০১৭।

ফিরে এসো অনির্বাণ

ফিরে এসো অনির্বাণ

তোমাকে ভুলে থাকবার এক প্রশস্ত ওয়াদামগ্ন আমি;
খুলে বসে আছি তোমার লেখা খেরোখাতা।
তোমাকে আর কোন দিন মনে করবোনা ভাবতে ভাবতে;
আলোকচিত্রে চোখ রেখে রেখে রাত্রি কেটে ভোর।

তোমাকে আর একবারো পেছন ফিরে ডাক দেব না জেনেও;
কী ভীষন রকম উলঙ্গ মানবীর আহবান।
জানি তুমি নও উড়ন্ত মেঘদল,
তুমি রাজহংস নও,
পালকহীন শরীরে ভর করে উড়তে চাইছে না কোন স্বপ্নহংসী,
ব্যস্ত জনপদে দু’পায়ে ভর করে হেঁটে যাওয়াই তোমার নিত্য অভ্যেস।

সেই চিরচেনা রাস্তাটা থেকে তোমাকে একটু সরে আসতে বলেছি মাত্র;
নগ্ন পা ছুঁয়ে দাঁড়াতে বলেছি নিজস্ব আকাশের নীচে,
রূপসা নদীর পাড় ঘেঁসে বেড়ে ওঠা নরম কাশফুলের সাদা ঘ্রাণ
মাখতে বলেছি সর্বাঙ্গে।

শত সহস্র শতাব্দ গড়া কঠিন বৃত্ত থেকে কেবল একবার বের হয়ে দেখো-
এখানে কী আশ্চর্য রকম রোদ খেলা করে,
এখানে সকাল হয় ডাহুকের ঠোঁট জোড়া হেসে,
এঁটো কাঁদা মেখে আর একবার খেলো কানামাছি ভোঁ ভোঁ,
সাত চাড়া অথবা ডাঙ্গুলি।

জীবনের সূত্র মেলেনা কারো কোন দিন;
জটিল সূত্রের মাঝেই বেঁচে থাকে কারোবা অতীত কারোবা বর্তমান;
অভিযোগ রেখে যাব না ধূলোময় প্রান্তর মাঝে;
শুধু সুরহীন সেতারের ক্লান্ত আকুতির মতোন ডেকে যাব –
ফিরে এসো অনির্বাণ,
ব্যর্থ খোলসের আভরণ ঝেড়ে,
ফিরে এসো ধান শালিকের কুঞ্জে ভরা
অবহেলিত এই সোনার বাংলায়।

_______________________________________
কবিতা যখন পেছন ফিরে দেখায় …ছবিতে আমার বাংলাদেশ ।।

দুই জীবন

পাশে অলস পড়ে থাকে সেল ফোন;
ঘন্টার পর ঘন্টা !
হঠাত টুং করে আওয়াজ হতেই আমি চমকে উঠি;
হুম, নোটিফিকেশন এসেছে;
কিন্তু সেগুলো আমার পেইজ থেকে।

গত দশ বছরের ডিজিটাল দুনিয়াতে আর কিছু কামাই না করি;
কয়েক খানা পেইজের সুপার এডমিন পোস্টটা ঠিকঠাক
দখল করে রেখেছি।
জানি, দখল করে থাকার মধ্যেও যোগ্যতা আছে,
কিন্তু সেই যোগ্যতা কেবল আমার প্রফেশনে;
বাস্তবিক অর্থে কাউকে দখল করবার কোন যোগ্যতাই
আমার কোন কালেও ছিল না।

মাঝে মধ্যে এমন উদ্ভট ইচ্ছেরা এই অসময়ে যখন উঁকি ঝুঁকি
মারার চেষ্টা করে,
তাকে আমি কঠিন ভাষায় পরাস্ত্র করি।

ভীষন রকম সন্দেহ বাতিক হয়েছে আমার;
কাউকেই আর বিশ্বাস করতে পারছি না আগের মতোন।
কিছুটা সময় কথার খেলায় মেতে ওঠার পরেই মনে হতে থাকে –
এই গল্পটা বুঝি সে আরো একটি মেয়ের সাথেও করছে,
সেই একই আবেগ, একই কণ্ঠ;
ব্যাস, সীমানা রেখায় শেষাংক টেনে দিলাম।

আমার আসলে মুঠোফোনের কাছ থেকে চাইবার মতোন কিছু নেই;
সেখানে কোন মিসকল হয়ে থাকলো কীনা,
সেখানে মন ভালো করে দেবার মতোন কোন বার্তা এলো কীনা;
কিচ্ছু না।

আমার শুধু একটাই কষ্ট;
মন খারাপের সন্ধ্যেগুলো ধূলোয় মিলিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত,
মিরপুর স্টেডিয়ামের গলি ঘেষে আর ফুচকা খাওয়া হয় না
অফিস ফেরার পথে লাভ রোডের তে’মাথায় বসে
মাল্টা দেওয়া গরম কাপে ঠোঁট ভেজাতে পারিনা।

চা’য়ের অবসরে ঝড় ওঠাবার জন্যেও বুঝি একজন বিশ্বস্ত বন্ধু লাগে !!

সব মুছে ফেলেছি

সব মুছে ফেলেছি –
স্থাবর –অস্থাবর;
সকল সম্পত্তি
তিল তিল করে জমিয়ে রাখা সমস্ত অনুভূতি
সব মুছে ফেলেছি –

ইনবক্স, টেক্স, ই-মেইল
ফোন নম্বর, কন্ট্যাক্ট ইনফো, ফেইসবুক আই ডি।
সব মুছে ফেলেছি –
স-ব।

গাল ছুঁয়ে থাকা হাতের স্পর্শ;
ঠোঁটের ভাজে ঠোঁট
বুকের মাঝে সোদা গন্ধ
লেপটে যাওয়া লিপস্টিকের দাগ
উম্মুক্ত বুকে তোমার ঝড় হয়ে ওঠা;
কোমর জড়িয়ে নিবিড় আলিঙ্গন
নাভীর চারপাশে অবাধ বিচরণ
সবুজ চায়ের সাথে মুগ্ধ মুখরতা
গোধূলির ক্লান্ত ছায়ায় উচ্ছ্বল গুনগুন
সুউচ্চ শিখরে আকাশের পানে ছুটে যাওয়া
হার্ডডিস্কে জমিয়ে রাখা সমস্ত ড্রাইভ মুছে দিয়েছি।

এটাচ করার মতোন আর একটা ফাইলো অবশিষ্ট নেই
চোখের সামনে একটাই শব্দ–এরর এরর এরর … ।

_________________________________________

পুরনো কিংবা নতুন, সবটাকেই মুছে ফেলা শিখে নিতে হয়।।
তিনিই আদর্শ মানুষ যিনি সহজে সব কিছু মুছে ফেলতে পারেন !

মেঘ পাহাড়ে ঘুরোঘুরি

‘পিয়াইন নদীর স্রোতে’ গল্পটা লিখতে লিখতে ভাবছিলাম, কবে যে মেঘালয় পাহাড়ে উঠবো! সবাই বলতো ডাউকি সীমান্ত পার হলেই নাকি মেঘালয় পাহাড়ের আসল সৌন্দর্য বোঝা যায়। তাই আমি ভারতীয় ভিসাতে ডাউকি বর্ডার নিয়ে রেখে দিতাম, কখন কাজে লেগে যায় এই আশায়।

সুযোগটা হয়ে গেল এই জুলাই মাসেই। বৃষ্টিতে পুরো সিলেট একেবারে পানিতে থৈ থৈ। নাজনীন খলিল আপুকে নিয়ে শহর ঘুরতে ঘুরতে পরিচয় হয়ে গেল একজন ব্যবসায়ী দম্পতির সঙ্গে, যারা প্রায় প্রতি মাসেই শিলং যান। তাদের কাছ থেকেই পেয়ে গেলাম ডাউকি বর্ডার থেকে শিলং যাবার পুরো তথ্য। শুধু তাই নয়, আমাকে বর্ডার থেকে কোন গাড়ি ডাউকি বাজার অব্দি নিয়ে যাবে তার নম্বর পর্যন্ত দিয়ে দিলেন। এরপর আর মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী ঘুরতে যাওয়া নিয়ে আমার কোনো সংশয় থাকলো না।

পরদিন ভোর ৭টায় তাদের পরিচিত ড্রাইভার এসে হাজির। কারণ সকাল দশটার মধ্যে সীমান্তের ঝামেলা শেষ করা ভালো। বৃষ্টির মধ্যে ডাউকি বাজার পৌঁছতে দেরি হয়ে গেলে শিলং পৌঁছতে সন্ধ্যা নেমে যাবে। সিলেট–তামাবিলের সেই এবড়ো-থেবড়ো রাস্তা দিয়ে দুই ঘন্টার ক্লান্তিময় যাত্রা শেষ হলো তামাবিল ইমিগ্রেশনে। বাংলাদেশের সীমান্তের শীর্ণ চেহারা সব সময় আমাকে হতবাক করে। হয় সরকার এই খাতে কোনো খরচ করে না অথবা আমরা যে যাবার সময় জনপ্রতি ৫০০-৬০০ টাকা দেই তার সঠিক ব্যবহার এখানে হয় না। সার্ভিস চার্জ এবং সেই সঙ্গে কিছু উপঢৌকন কাস্টম অফিসারের হাতে দিয়ে বেরিয়ে গেলাম ল্যাগেজ হাতে।

জিরো পয়েন্টে দাঁড়িয়ে অসাধারণ অনুভূতি জাগলো মনে। এপাশে বাংলাদেশ আর ওপাশে ভারত। ধীরে ধীরে আমি উপরের দিকে উঠছি, ডাউকি বাজারের দিকে। ওখান থেকে ট্যাক্সিতে শিলং যেতে লাগবে প্রায় তিন ঘন্টা। মাঝে ইমিগ্রেশনে চেক-ইন করে নিতে হবে। ওদের ইমিগ্রেশন আর আমাদের ইমিগ্রেশন অফিস সম্পূর্ণ আলাদা। সাজানো গোছানো অফিস। সবার পরণে অফিসিয়াল পোশাক এবং অবশ্যই তারা কথা বলছেন ইংলিশে এবং প্রয়োজনে হিন্দিতে।

অনেকেই বলে থাকেন ভারতীয় সীমান্তে ল্যাগেজ খুলে চেক করা হয়। যদিও আমার বেলাতে কোনো কালেও ঘটেনি এমনটা। আর ওরা আধুনিক মেশিনের ভেতরে ল্যাগেজ ভরে দিয়ে চেক করছে; প্রাচীন পদ্ধতির আর দরকার পড়ছে না। হিন্দিতে একজন লেডি অফিসার জিজ্ঞেস করলেন – ‘এধারমে কেয়া ভিজিট মে?’ হিন্দি ভালো পারিনা, তাই ইংলিশে চালিয়ে দিলাম- ইয়েস, ওয়ান্ট টু ভিজিট শিলং।

আবার প্রশ্ন; আপ কেয়া করতে হো?
আমি হেসে উত্তর দিলাম, আই এম এ রাইটার, ট্রাভেলিং ইজ মাই প্যাশন।
মহিলার চোখে-মুখে সন্তুষ্টি খেলা করে উঠলো, তিনি হাসি মুখে সিল মেরে দিলেন। এর মধ্যেই বাংলাদেশের সিমে বিপ্লবদার কল। তিনি ট্যাক্সি নিয়ে এসেছেন আমাকে ডাউকি বাজার অব্দি দিয়ে আসবেন বলে। আমি আর দেরি না করে উঠে পড়লাম। এই ফাঁকে সেদিনের ইন্ডিয়ান রেট জেনে নিলাম আমার একজন ব্যাংকার বন্ধুর কাছ থেকে। সে যা রেট বললো বিপ্লবদা তার চাইতে ১০ রুপি করে কম দিতে চাইলো। পনের হাজারে তিন দিন মেঘালয়ে ঘোরাঘুরি ভালো ভাবেই করা যাবে এমন ধারণা ছিল। কেবল বোকামি হয়ে গেল পুরো টাকাটা না ভাঙ্গিয়ে। ভেবেছিলাম শিলং পৌঁছে সবটা ভেঙ্গে রুপি করবো। কিন্তু ওখানে যা দিতে চাইলো তা এর থেকেও অর্ধেক ।

বিপ্লবদা আমাকে একটা টাটা ন্যানো জিপে বসিয়ে দিলেন। এটাতে বসে দার্জিলিং ওঠার অভ্যেস আমার আছে। মোট আট জন প্যাসেঞ্জার থাকেন। আড়াইশ করে ভাড়া। সাঁই সাঁই উঠে যায় পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায়। প্রতিবারই মনে হবে এই বুঝি পড়ে গেলাম। ড্রাইভার এমন দক্ষ হাতে গাড়ি চালান যে ওপাশ থেকে অদেখা গাড়িগুলো বাঁক ঘুরে আসলেও কখনো টক্কর খায় না। অবশ্য ঘটনাক্রমে কেউ যদি দুর্ঘটনায় একবার পড়েই যায় তবে আর রেহাই নেই।

আমি বসেছি জিপের সবচাইতে ডানে। ইচ্ছে ছিল বাম দিকে বসে বাংলাদেশের পিয়াইন নদীটি আর একবার কাছ থেকে দেখবো। জিপ ডাউকি ব্রিজের ওপর দিয়ে যাবার সময় জ্যামে পড়ে গেল। আমি ডান পাশের পিয়াইন নদীর স্রোতধারা দেখতে লাগলাম। সবুজের গা ছুঁয়ে ভেসে যাওয়া জল। আর সেই জলে ধাক্কা খাচ্ছে বড় বড় পাহাড়। সারাটা জীবন সেই পাথরে বসে ছবি তুলেছি আর এই প্রথম ওপর থেকে দেখতে পাচ্ছি আমার বাংলাদেশ।

জিপ ওপরে উঠছে। আর চোখ আটকে যাচ্ছে পাহাড়ের মাটি ফুঁড়ে ঝরতে থাকা জলস্বিনী ঝরনায়। শিলং যাবার পথেই যে কতোগুলো ঝরনা দেখলাম তা আর গুণে শেষ করা গেল না। যত উপরের দিকে উঠছি তত তাপমাত্রা কমছে। এক সময় সাদা মেঘ এসে জড়িয়ে ধরলো। এশিয়ার সবচাইতে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলিংলং-এর মধ্য দিয়ে আমরা এগুচ্ছি। তাদের পোশাক আর তাদের ভাষা বোঝার সাধ্য আমার নেই। অসমীয়া ভাষায় তারা কথা বলছে। বোঝাই যাচ্ছে ভীষণ কর্মঠ মানুষ এরা। পাহাড়ের এতো উঁচুতে কাঠের বাড়ি করে থাকা সোজা কথা নয়। বাচ্চারা দেখলাম হেঁটে হেঁটে স্কুলেও যাচ্ছে।

কখনো মেঘ, আবার কখনো রোদের মিষ্টি আলো এই করতে করতে পুরো ছয় হাজার ফুট উপরে উঠে গেলাম। জুলাই মাস মানে ভ্রমণের মৌসুম চলছে। তাই ব্যাপক ভিড়। ড্রাইভার আমাদের নামিয়ে দিল একটা স্ট্যান্ডের ভেতর যার দুই ধারে কেনাকাটার দোকান। আমি এখন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার উত্তরে প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড নামে খ্যাত স্বপ্নময় শিলং শহরে।

আমি কোনো হোটেল বুক করে এখানে আসিনি। কলকাতা থেকে আগত বন্ধু রাম গোপাল চ্যাটার্জি থাকার ব্যবস্থা করেছেন ভারতীয় সেবা আশ্রমে। অবশ্যই হিন্দু ব্রাহ্মণদের সাথে। আমার কাছে কোনো ভারতীয় সিম নেই, কোনো রুপিও নেই। এখন যদি পাসপোর্টখানাও হারিয়ে যায় তবে নিজেকে কোন দেশের বলে চালিয়ে দেব তাই ভাবছি। ট্র্যাভেল ব্যাগ টেনে টেনে আরো ওপরের দিকে উঠলাম। চারপাশে কত বাহারি ফলের আড়ত। কিনবো কী করে? বেশি স্মার্ট হতে গিয়ে টাকা ভাঙ্গাইনি। আমি যখন এমন এলোমেলা ঘুরে বেড়াচ্ছি, পেছন থেকে কেউ একজন ডেকে উঠলো-‘নীলা’।

ছয় ফুট লম্বা মানুষটার দেখা পাওয়া গেল অবশেষে। প্রথম দেখা হলে লোকে কুশল বিনিময় করে। তখন এসব থোরাই কেয়ার করার দশা আমার। সোজা বলে বসলাম, “উফ, ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে দাদা। আগে কিছু খাব।” দাদা ঘড়ি দেখলেন, “দুটো ক্রস করে গেছে। আগে রুম বুঝে নাও। পরে তো সেটাই পাবে না। দেখছো না শিলং লোকে লোকারণ্য।”

আমার মোটেও রুম নিয়ে ভাবনা ছিল না। এমন পরিচ্ছন্ন শহরে পাহাড়ের গায়ে গা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেও আমার খারাপ লাগবে না। তবু দাদার পিছু নিলাম। আশ্রমের ম্যানেজারের কাছে পাসপোর্ট কপি জমা দিয়ে থাকার ঘরটা একবার দেখে নিলাম। বাহ! কোনো ফ্যান নেই এখানে। হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে। কল ছেড়ে মুখ ধুতেই শিহরিত হলাম বরফ শীতলতায়। সুরুচি রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। এতো ভিড় থাকে ওখানে ভাবাই যায় না। ভেবেছিলাম ভাত পাব না। আমাকে অবাক করে দিয়ে ভাতের সঙ্গে মাছ, সবজি, খাসি সব দিল। যে তিন দিন ছিলাম ওখানেই দুপুরের খাবার সেরেছি।

বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধে নামার পথে। দাদার হাতে ডিএসএলআর। আমরা পুলিশ বাজার থেকে আরো ওপরে উঠতে লাগলাম। পাহাড়ের উঁচুতে গভীর এক লেক। সে রাতেই ছিল গুরু পূর্ণিমা। ছয় হাজার ফুট ওপরে বসে ঘন সাদা থালার মতোন জ্বলজ্বলে একটি চাঁদ দেখতে দেখতেই শুরু হলো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। মাথার ওপর জলভেজা চাঁদ নিয়ে সে রাতে আর ঘুম হলো না। পুলিশ বাজার ঘুরে ঘুরে বেশ কম দামে কিছু চপ্পল নিলাম আর কয়েকটা লন কিনে নিলাম। রুমে ফেরার সময় খেলাম মৌ। চিকেন দিয়ে তৈরি খাবারটির প্রেমে পড়েছিলাম সেই প্রথমবার যেদিন কলকাতা গিয়েছিলাম। দাদা বেশ ভোরেই হাঁটতে চলে গেলেন। আমি তার ঘরে গিয়ে খুঁজে না পেয়ে আশ্রমের ম্যানেজারের অফিসে গিয়ে ফোনে চার্জ দিতে থাকি; যদি কোনো রকমে একটা সিম জোগাড় করতে পারি। ভারতে কেজি দরে সিম বিক্রি হয় না। এর আগে পনেরো দিন থেকেও নিজের নামে সিম তুলতে পারিনি। তাই আশা ছেড়ে দিয়ে ওদের সঙ্গে বসে নাস্তা সেরে নিলাম।

একটি থালাতে বাহারি পদের খাবার পরিবেশন করা হয়েছে – লুচি,পায়েস, ফল, সবজি, ডাল। দু’পাশে লম্বা সারি করে সবাই বসেছে আর ধবধবে সাদা ধুতি পরা একজন মধ্যবয়সী লোক বালতির ভেতর বড় আকারের চামচ ডুবিয়ে খাবার তুলে তুলে দিচ্ছেন। কেউ কেউ পূজো করছেন প্রতিমার পায়ের কাছে জবা এবং গাঁদা ফুল দিয়ে। আর কেউ কেউ আমার সাথে বসে গেছেন ভোগ খেতে। পুরো বিষয়টা যখন সম্পন্ন হয়ে গেল তখন দাদা এসে বললেন – “ও তুমি ভোগ সেড়ে নিয়েছো? তবে রেডি হয়ে নাও। আমরা শিলং পিক- এ যাব।”

শিলং পিক কেবল আমার কাছে বইয়ে পড়া গল্পের মতো ছিল। এবার বুঝলাম পিক কতোটা উপরে হয়। যে ছেলেটির গাড়ি আমরা সারাদিনের জন্য ভাড়া করে নিয়েছিলাম সে স্থানীয় ছেলে। মোটামুটি একটানে উঠিয়ে নিল শিলং পিকে। দুই ধারে চাষের জমি আর সেখানে গরু আর ভেড়া চরাচ্ছে রাখাল। আকাশের কাছাকাছি এসেও এমন চেনা দৃশ্য চোখে না দেখলে সত্যি বিশ্বাস করতাম না ।পুলিশ বাজার থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরত্বে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে ছয় হাজার ফুট উঁচুতে এই শিলং পিক।

শিলং পিক ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বেইজ। একটি রাডার স্টেশন রয়েছে । ফলে চূড়া থেকে শহরের ছবি তোলার অনুমতি থাকলেও রাডারের দিকে ক্যামেরা ঘোরানো যাবে না। মূল চূড়ার এক কিলোমিটার আগেই সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট। সঙ্গে ভারতীয় নাগরিক আছেন তাই তার পরিচয়পত্র জমা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। দুটো ওয়াচটাওয়ার আছে এখানে। একটি টাওয়ার থেকে ২৭০ ডিগ্রি কোণে দেখে নিলাম পুরো শিলং; যেন পাখির চোখে আকাশ দেখা। এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য ভিডিও করে নিলাম হাতের মুঠোয় ধরে রাখা মোবাইলে। আরেকটি টাওয়ারে রয়েছে টেলিস্কোপ। ৫০ রুপি দিয়ে টেলিস্কোপে পুরো শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো দেখে নিলাম। রুপিগুলো দাদার কাছ থেকে বিনিময় করেছি টাকার বদলে।

এখানেও নানান পদের ফল পাওয়া গেল। খাসিয়াদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পড়ে মাথায় ফুল লাগিয়ে অনেকেই ছবি তুলছেন। আর আমার সারাক্ষণ ইচ্ছে হলো মেঘগুলোকে ছুঁয়ে থাকি। এদিকে বেলা বেড়ে যাচ্ছে। যেতে হবে আমার কাছে সবচাইতে আকর্ষনীয় স্থান অ্যালিফেন্ট ফলসে। ফলসে গা ভেজাবার আগে ড্রাইভার নিজেই বললো- “চলুন দিদি, একটা বন আছে এখানে। ওটা দেখে নেই।”

আমি মজা করে বললাম, “ওই বনে কি রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে?”
সে হেসে উত্তর করলো, “না, তা নেই। তবে অনেক জন্তু-জানোয়ার আছে।”

দক্ষ হাতে সে গাড়ি আরো কিছুটা নামিয়ে নিয়ে এলো, এখান থেকে পুরো পাহাড়টা ন্যাড়া দেখাচ্ছে। চারপাশে শুধুই সারি সারি বাড়ি। কোথাও আর গাছপালা নেই। গলফ খেলার খোলা মাঠ পেরিয়ে চলে গেলাম সেই অরণ্যে। যদিও আমরা অরণ্যের ভেতর ঢুকিনি; খোলা মাঠে ১০০ রুপি দিয়ে গাড়ি থামিয়ে গরম গরম চায়ে চুমুক দিচ্ছি। পাহাড়ের ওপর বিস্তৃত খোলা মাঠ। দাদা ছবি তুলছেন অনবরত। বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের খেলতে দিয়ে নিশ্চিত গল্প করছেন। পরিবার নিয়ে সময় কাটাবার জন্য এটা ভীষণ নিরিবিলি একটা জায়গা।

খোলা ময়দানে কিছু সময় কাটিয়ে সোজা চলে গেলাম এলিফ্যান্ট ফলসে। শতাধিক মানুষ, পার্কিং এলাকায় অনেক গাড়ি, কিন্তু রাস্তায় এক-আধটুও ময়লা নেই। এবার আর উপরের দিকে নয়, আমাদের নামতে হচ্ছে নীচের দিকে। মেঘালয়ের পূর্ব খাসিয়া পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ছে এলিফ্যান্টস ফলস। ভারতের খাসিয়া রাজ্যে এ ঝরনা ধারাকে বলা হতো ‘কা খাসাইদ লাই পাতেং খোসিউ’; বাংলায় একে বলে তিন ধাপের ঝরনা। এখানে তিনটি ধাপে পাথর বেয়ে নামে পানি। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা এ ঝরনার নাম দেয় এলিফ্যান্ট ফলস। এই জলপ্রপাতের কালো পাথরগুলো মিলিত হয়ে এক ঐরাবত আকৃতির সৃষ্টি করেছিল, সেই থেকে এর নাম দ্য এলিফ্যান্ট ফলস।

তিনশো সিঁড়ি মাড়িয়ে নেমে গেলাম ঝরনার জলে গা ভেজাতে। কিন্তু ওখানে নিরাপত্তা বেষ্টনি এতোটাই কড়া ছিল যে তা আর পার হতে পারলাম না। তাই হাঁটু পানিতে নিজেকে ভিজিয়ে স্বান্তনা দিলাম।

সে রাতে দুই পা সটান করে ঘুমানোর চেষ্টা করেছিলাম; ওই তিনশ সিঁড়ি উঠতে দম বেরিয়ে গিয়েছিল। পরদিন খুব ভোরে উঠে নাস্তা সেড়ে নিলাম মাদ্রাস ক্যাফেতে। দোসার সঙ্গে পনির আর সবজি। যেতে হবে মেঘের আরেক বাড়ি নীলাচল যা অবস্থিত আসামের একসময়কার রাজধানী গৌহাটিতে।

সকাল ৯টার মধ্যেই জিপ ছেড়ে দেয় গৌহাটির উদ্দেশ্যে। তাই আমরাও ল্যাগেজ গুছিয়ে নিয়েছিলাম সকাল সকাল। আর গৌহাটি থেকে ঢাকায় ফেরার জন্য বাংলাদেশের বিআরটিসি ট্র্যাভেল তো আছেই। যা কিনা আসাম ছেড়ে ডাউকি সীমান্ত হয়ে সিলেট ধরে আমাকে আবার নিজের দেশ বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেবে।

__________________________
ছবি: রাম গোপাল চ্যাটার্জি, বর্ধমান, কলকাতা।

শেষ ভোজন

শেষ ভোজন

নিয়ন আলোয় মুগ্ধ আঁধারের হাত ধরে প্রবাহমান
নদীর মতন ভেসে যাওয়া সময়;
ফিরিয়ে দিয়েছি চাঁদের আলোর অবাক বিচ্ছুরণ,
ছোট ছোট পোনাদের ডুব সাঁতার আর
বুনো হাঁসের অবারিত ছুটোছুটি।

সব কিছুই ফিরিয়ে দিয়েছি আমি, একদম হিসেব নিকেশ করেই-
আমার কাছে আজ তোমার আর কোন দেনা নেই।

রূমঝুম নুপূরের নিক্কন, ঝির ঝির বাতাসের আনাগোনা,
হাতের রেশমী চুড়ি,তোমার দেওয়া নীল শাড়িটা;
তার সাথে পছন্দসই কানের ঝুমকোটা পর্যন্ত
ফিরিয়ে দিয়েছি।

ধবধবে সফেদ পায়ের নরম আঙিনা ছুঁয়ে গিয়েছিল
যে কটা চপ্পল তাও তো বাদ রাখিনি,
তার সাথে ফিরিয়ে দিয়েছি হাফ ডজন ব্যাগ,
হাতের অঙ্গুরী আরো যে কতো কি;

খুব রাত হয়ে গেলে কালো ঝোলা থেকে বেরিয়ে আসতো অনেক মন্ডা মিঠাই;
তুমি অনুরোধের সুরে বলতে –খেয়ে নিও রাতে,
যদি ক্ষিদে পায় খুব।

আমিতো তাও ফিরিয়ে দিয়েছি।

মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে পড়ে যে হাসির মূর্ছনা –
নিয়ে গেছো নিজের কব্জির মুঠোতে,
টেবিল ভর্তি সাজানো মাংস –কাবাব, হালুয়া –রুটি
সব সব ফিরিয়ে দিয়েছি কড়ায় গণ্ডায়।

মেপে- মেপে, খেয়াল করে দেখো এক মন ওজোনও
কম হবে না কোথা্‌ও,
কেবল ফিরিয়ে দিতে পারলাম না তোমার দেওয়া
অসম্ভব সুন্দর সেই মুহূর্তগুলো।।

একলা রাতের উপাখ্যান

একলা রাতের উপাখ্যান

কোন একদিন ধূপছায়া রোদ্দুর পথ পাড়ি দিয়ে
আমি নৈঃশব্দের ভেলা ভাসাবো;
খুব নির্জন অরণ্য থেকে খুঁড়ে নেব লালচে মৃত্তিকা,
তার ছৈ হয়ে অবিরত জেগে থাকবে নির্ঘুম আকাশ।

মেঘকে বলে দেব ভীষন শ্রাবণে ঢাল হয়ে থাকতে,
আমি কোন মানবের ছায়াতলে স্বস্তি পাই নি
এক মুহুর্তের জন্য।
প্রকৃতি আমাকে দিয়েছে অবিরাম ভিজে যাওয়ার স্বাধীনতা,
মন ভরে নিঃ শ্বাস নেবার উদারতা আর দিয়েছে
উপেক্ষিত জনপদ মাড়িয়ে হাসির ঝর্ণার মূর্ছনা।
মানব দিয়েছে সুখকর অনুভূতি, প্রকাণ্ড,
কখনো তা বিস্তৃত;
আবার কখনো পরিধি ছাড়িয়ে বহূ দূর পথ।

কিন্তু, বেলা শেষে হিসেব কষে দেখেছি –
এই আমি যেখান থেকে শুরু করেছিলাম
পিছিয়ে গিয়েছি তারো চাইতে ঢের।
মানব শুধু সুখের আলিঙ্গন দেয় নি,
ফিরে যাবার সময় দু’ হাত ভরে এঁকে দিয়েছে অবহেলার স্মৃতি চিহ্ন।

তাইতো সেইসব ফেলে আসা অনুভূতিকে
আমি বড্ড রকম ভয় পাই আজকাল।

নিজস্ব কারাবাস

নিজস্ব কারাবাস

রঙচড়া মেকাপের আড়ালে অশ্রুভেজা চোখ আরশীতে দেখতে দেখতে
একদিন ক্লান্ত হয়ে নিজেই বেরিয়ে পড়লাম সত্য সুখের সন্ধানে;
সুখ ! এ এক মরিচীকাসদৃশ শব্দ।
কেউ তার সন্ধান পায় মার্শিডিজ হাঁকিয়ে,
কেউবা পায় অট্টালিকায় ঘুমিয়ে।

আমার মতোন নগন্য মধ্যবিত্ত সুখ পেতে হাজির হয়;
দু’বাহু বাড়িয়ে কেবল প্রকৃতির কাছ।
আহা ! বিধাতা …
কী অপরূপ সাজে সাজিয়েছো তুমি ধরণী,
আমার হাজার টাকার রেভলন,
ডোভের মিষ্টি সুবাস আর জেসমিনের ঠাণ্ডা পরশ
হার মেনে গেল নিমিষে।

আমি যদি পাখি হতে পারতাম;
তবে উড়ে বেড়াতাম ভূমধ্যসাগরের নীল ছুঁয়ে।
যদি মেঘ হতে পারতাম;
তবে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পরতাম নায়াগ্রার জলে।

আমি নারী হয়ে জন্মেছি,
বছরের তিনশত পয়ষট্টি দিন আমাকে কড়ায় গণ্ডায়
হিসেব করে রাখতে হয়।
দাঁড়িপাল্লার এক পাশ যদি একটু ভারি ঠেকে
তবে তীব্রবানে জবাব চায় কৈফিয়ত।

ছোট বেলায় পিতা, আর বড় বেলায় স্বামী,
আর ও দু’টো পথ যারা মাড়িয়ে এসেছে তাদের জন্যে
সমাজ পতিরা খুব মুখিয়ে থাকেন।
আমি যতোই নিজের খাই, নিজের পরি;
কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমি অন্যের কাছে জিম্মি।

মুক্ত বলে আদৌ কি কোন শব্দ আছে অভিধানে ?
আদতে খাঁচার পাখিকে তুমি যতোই বলে দাও উড়াল দিতে,
বেলা শেষে সে ঠিকঠিক নিড়ে ফিরতে চায়
যতোই সেখানে শেকল পড়ানো থাক।
এ হলো অভ্যাস;
নারীরা জন্মের পর থেকে এক অদৃশ্য মায়ায় নিজেকে বেঁধে ফেলেছে।
সে মায়া সংসারের।

কেউ হয়তো ছুটে যেতে পারে আবার কেউ কেউ চেষ্টা করে মাত্র;
কিন্তু বেলা শেষে দু’পা সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলে – নাও, শেকল পরাও।
প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করা আর হয়ে ওঠে না …
নিজস্ব কারাবাসেই লিখে যেতে চায় তার আপন পরিচয়।

ইন্দ্রাবতী … তোমায় স্পর্শ করবো বলে

ইন্দ্রাবতী; তোমায় স্পর্শ করবো বলে

সাতরঙা জল ছুঁয়ে দেখবো বলে
সে কী আয়োজন আমার;
কখনো নীল শাড়ির ভাঁজ খুলে দেখছি,
কখনোবা আকাশি রঙের শাড়িটা।

আচ্ছা, আকাশ যখন সমুদ্রে হেলে পড়ে
তখন গোধূলি আলোর কোন আভার খেলা
তোমাকে মুগ্ধ করে বলতে পারো ?

তুমি কথায় কথায় বলো –নীল পড়ো,
সেটা বোশেখ হোক, কিংবা বসন্ত;
নীলে তোমার আছে তীব্র আকর্ষন।

ইন্দ্রাবতীর গা ছুঁয়ে সাতখানা জলপ্রপাত
কিভাবে ধেয়ে চলে,
তা দেখবার কী ব্যকুল প্রতীক্ষা আমার !
তাই যখনি সুযোগ পাচ্ছি একটা একটা করে শাড়ি
গুছিয়ে নিচ্ছি লাল ট্রাভেল ব্যাগে;
কে জানে; হয়তো রংধনুর মিষ্টি আলো
তোমার মনকে খানিক হলেও বদলে দিতেও পারে।

কিন্তু, বেরসিক ডাক্তার এক গাদা অষুধ লিখেই খালাস;
এত্তো এত্তো ইনহেলার নিয়ে কী চব্বিশ ঘন্টা
কাটিয়ে দেওয়া যায় !
শ্বাসনালীর সাথে হৃদপিণ্ডের দারুণ রকম যুদ্ধ চলছে,
কিছুতেই অক্সিজেন যাচ্ছে না শরীরে;
তাহলে বোধ করি সাতরঙা জল দেখা হবে না এ জন্মে।

এই শহরের বিষবাষ্পে ভেসে আছে কালো কার্বন
একটু একটু করে সময় কুড়িয়ে নিচ্ছি,
একটু একটু করে কাজ গুছিয়ে নিচ্ছি,
আমি চিত্রকুটের জল স্পর্শ করবো।

আমায় তুমি নিয়ে চলো ছিয়ানব্বই মিটার উঁচুতে,
আমি তোমার হাত ছোঁব না,
আমি তোমার ঠোঁট ছোঁব না,
কথা দিলাম;
আমি তোমার ব্যক্তিগত বাঁধা হবো না।

কেবল আমার পাশে মূর্তি হয়েই দাঁড়িয়ে থেকো,
আমি একটিবার অমন ঝরতে পারা জলস্রোতিনী
ছুঁয়ে দেখতে চাই।।

এক টুকরো আহবান

এক টুকরো আহবান

অশুদ্ধতার ভরা স্রোতে প্লাবন
ছড়িয়ে তুমি চলে যাও
তোমরা বিগত হতে থাকো,
এই তুমি আমি মার্কা মিথ্যে প্রহসন একদিন থামবে জানি।

তবু একদিন
খুব বেশি ঝড় হতে ইচ্ছে করে আবার
প্রলয়ঙ্করী প্রেতাত্মার মতো মটকে দিতে ইচ্ছে করে কুকুরের হাড় গোড়।
ওরাও কি মানুষ ?

দু’চোখ বেয়ে কেবল লালসার লালা খেলা করে
বার্ধক্যের মলাট পড়ানো যৌবনে
হাসি পায়, ভীষন হাসি পায়
পাট করা সিঁথিতে সাদা চুলের উঁকি ঝুঁকি খেলা।

হয়তো সময় মেনে নিয়েছে আধুনিকতার ডাক
কিন্তু তারপরো কিছু কথা থেকে যায়
থেকে যায় নৈতিকতার সত্য অহংকার যার গলায় মালা পরালে কেবল নিজে নয়,
চারপাশটাও বড্ড বেশি আলোময় হয়ে ওঠে।

এই সোনা রোদ ছড়ানো মুক্ত উঠোনে একবার পা ফেলে দেখো-
একটি বার চোখ মেলে তাকাও দিগন্তের পাড় ঘেঁষা নীলান্তে
ওখানে ভালোবাসারা সারাদিন লুটোপুটি খায়,
বিশ্বাসে মেঘকে করে আলিঙ্গন।

তুমি বা তোমরা,
তা যেই হউ না কেন
ক্ষমতার শক্ত শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে একবার সবুজ ঘাসে পা ছুঁয়ে দেখো
কি অপরুপ স্নিগ্ধতার ডালা সাজিয়ে রেখেছেন বিধাতা।

ঠাণ্ডা বাক্সের হিম ঘরে আর আটকে রেখোনা নিজেকে ,
গাদা গাদা ফাইলের মাঝে মুখ ডুবিয়ে খুঁজতে চেও না চেনা নোটের হাসি
শেষবারের মতোন শুধু একবার হায়েনার মুখোশটা খুলে ফেলে দেখো
তোমাদের কপোল জুড়ে নেমে আসবে অবাক মুগ্ধতা।