রোদেলা নীলা এর সকল পোস্ট

বোশেখ হয়ে আসো

277782

বৈশাখী রঙ গায়ে মেখে
হাঁটছি অনেক দূর;
ওইখানেতে বসত তোমার
কইছে সমুদ্দুর।

মেঘের আঁচল পড়িয়ে শাড়ি
থাকছি নিরব বসে,
এই পথেতে আসবে তুমি
বললে বিদায় শেষে।

আর কতোকাল ডাকবো মাঝি
ফিরিয়ে দিও নাকো ;
পরবাসী ওই মনটারে আজ
খাঁচায় বেঁধে রাখো।।

এসো হে ১৪২৯, এসো….

কবিতার মাঝেই বাস্তবতার সুন্দরতম পরাজয়

2257

ভোরের সূর্য দেখনি কোনদিন;
তুমি কী করে জানবে তানপুরার কান্নার সুর
কতোটা করুণ হয়,
শেষ রাতের ফাগুন বৃষ্টিতে কতোটা
উত্তাপ ছড়ানো থাকে।
তুমি কোনদিন কবিতার হাত ধরে সমুদ্রে নামোনি,
মধ্যরাতের নিস্তব্ধ আকাশ কতোটা নিঃসঙ্গ জেগে থাকে পলকহীন চোখে;
দেখা হয়নি তোমার।

তুমি কোন দিন জানবে না –
ঝুম বৃষ্টিতে টিনের চালে অবিরাম প্লাবনের মূর্ছনা।
প্রেয়সীর হাত ধরে কখনো কি নেমেছো
হাঁটুজল শ্রাবণে ?
তার কোমরের ভাঁজ ছুঁয়ে দেখেছো
কতোটা উন্মাদনা খেলা করে ?
তার কপালেও কি এমন টিপ ছিল
লাল আর সবুজে আঁকা ?
তার ঠোঁট জুড়ে কি নেমে এসেছিল
সীমাহীন আকুলতা ?

তুমি কি কখনো বড় রাস্তার ধারে ছাউনী ঢাকা
দোকানে চা খেয়েছো ?
ঘন পাতির আদা চা;
তোমার প্রাতঃরাশের গরম কফির মতোন
অভিজাত নয়।
কাসুন্দি দিয়ে পেয়ারা খেয়েছো কি কখনো ?
তুমি কী করে বুঝবে তার ঝাঁঝেও রমণীর কপোল বেয়ে টুপ করে বৃষ্টি ঝরে।

তুমি দেখেছো নায়াগ্রার জলপ্রপাত,
দেখেছো ম্যাগডোনালসের বিফ বার্গার;
এই ছোট্ট ঘরে লবন দিয়ে পান্তা খেতে
কেমন লাগে জানা হয়নি তোমার কোনদিন।

গোধুলিতো সব প্রান্তেই অস্তমিত হয়;
তবু কোন কোন সন্ধ্যা ভীষন অন্যরকম,
কোন কোন বিকেল বিষণ্ন কুহেলী,
কোন কোন রাত একলা এলোমেলো।

তুমি সেই প্রান্ত স্পর্শ করোনি,
তুমি কবিতাতে স্নান করোনি,
তুমি জানতেই পারোনি –
কবিতার মাঝেই বাস্তবতার সুন্দরতম পরাজয়।।
——————————————————
আকাশে যখন মেঘ জমে
পুরনো লেখা নতুন করে পড়ি তখন..

বিন্দাস ফেসবুকার

29116_n

ওরা মরলে মরুক;
আমার এতে কী এসে যায়,
টেবিল ভর্তি নানান পদের খাবার সাজাই
দফায় দফায় ছবি দিয়ে জাহির করি,
আমার হাতের রান্না অতি জাদুর খেলা;
লোকে দেখে যতোই ঢেকুর তুলুক,
আমার তাতে কী এসে যায়
লোকের যদি মন খারাপ হয়, করুক।

খাবো দাবো ফূর্তি করে
এফবি ভরে ছবি দেব;
মহামারী’র তান্ডবে আর আগুন পুড়ে
যতোই মানুষ মরুক।

যারটা গেছে বুঝুগগে সে
আমার প্রোফাইল ভরা থাকবে
আনন্দময় মহোৎসবে;
পাশের বাসায় যতোই কান্না চলুক।
দেশের ভেতর যা হচ্ছে তা চলুক
আমি কী ছাই দেশের নাকি;
আমার বাড়ি মঙ্গল গ্রহে
কার মেয়েকে খুন করে যায়
যার মনে চায় যতোই মিছিল করুক,
আমার দরজা খুলছি না ভাই
যা মনে চায় যতোই লোকে বলুক।।

নারী চরিত্রের ব্যারোমিটার মদ্যপান এবং বিচারপতি মা প্রধানমন্ত্রীর কাছে নারী’র আর্তনাদ

Scree

এবার বাংলাদেশে বর্ষা শুরুর আগ থেকেই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বৃষ্টি নেমেই চলেছে; ঢাকার রাস্তা যখন কাদায় আর পানিতে পরিপূর্ণ তখন শহুরে জনতার টক অফ দ্যা দেখনো হচ্ছে মুনিয়া, কখনো পরিমনী আবার কখনো আবু ত্ব-হা আদনান। সোস্যাল মিডিয়ার ওপর কখনও মেঘ আবার কখনো বৃষ্টির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে খবর গুলো; তার চাইতেও অধিক গতিতে নারী ভিকটিমের চরিত্রের ওপর চড়াও হচ্ছে কতিপয় ফেসবুকার, এদের সংখ্যা কম নয়।

এমন ঘটনা বাংলাদেশে নতুন না, তবে আমাদের স্বভাব হচ্ছে আমরা নতুন কোন ইস্যু পেলে পুরনো অনেক ঘটনাই বেমালুম ভুলে যাই অনেকে। মূল আলোচনায় ফিরে আসছি, তার আগে জেনে নেই মদ অর্থাৎ অ্যালকোহলের উৎপত্তি এবং এ সম্পর্কে দু’টো হাদিস।

Nobody knows exactly when humans began to create fermented beverages. The earliest known evidence comes from 7,000 BCE in China, where residue in clay pots has revealed that people were making an alcoholic beverage from fermented rice, millet, grapes, and honey. So how did alcohol come to fuel global trade and exploration? Roderick Phillips explores the evolution of alcohol.
-Rod Phillips

মদ বা অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় এক ধরনের পানীয় যাতে ইথাইল অ্যালকোহল (ইথানল) থাকে। এটি অল্প পরিমাণে গ্রহণ করলে মনে উৎফুল্ল ভাব সৃষ্টি হয়, দুঃশ্চিন্তা কমে যায় এবং সামাজিকভাবে মেলামেশা করার ইচ্ছা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে কেউ যদি মদ মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করে তাহলে তার নেশা হয়, মোহ বা ঢুলুঢুলু ভাব ধরে এবং জ্ঞানও হারাতে পারে। গবেষকেরা বলছেন, ১৫-৪৯ বছর বয়সী মানুষের ১০টি মৃত্যুর মধ্যে একটি ঘটে মদের কারণে। নিয়মিত মদ্যপান শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ও টিস্যুতে বিরূপ প্রভাব ফেলে।

মদ ইসলামী শরিয়তে নিষিদ্ধ। কোনো মুমিনের জন্য তা গ্রহণ করা বৈধ নয়। কোরআন ও হাদিসের একাধিক বর্ণনায় মুমিনদের মদপান থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন—আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! মদ, জুয়া, পূজার বেদি ও ভাগ্যনির্ণায়ক শর হচ্ছে শয়তানের অপবিত্র কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো, যাতে তোমরা কল্যাণ প্রাপ্ত হও।’ (সুরা : মায়িদাহ, আয়াত : ৯০)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর অভিশাপ মদের ওপর, তা পানকারীর ওপর, যে পান করায় তার ওপর, যে বিক্রি করে তার ওপর, যে তা নিষ্কাশন করে এবং যার আদেশে নিষ্কাশন করে তার ওপর আর যে ব্যক্তি তা বহন করে এবং যার কাছে পৌঁছে দেয়, সবার ওপর।’ (সুনানে আবি দাউদ)

আমার আলোচনা শুরু করছি উপরে বর্ণিত হাদিসের শেষ লাইন দিয়ে। মদ ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে কেবলমাত্র যিনি গ্রহণ করছেন তার জন্য নয়, যিনি উৎপাদন থেকে আরম্ভ করে বহন করা এবং বিক্রি করার ক্ষেত্রেও ভুমিকা রাখছেন তাদের ওপরও সমান নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া বহুল আলোচিত ঘটনায়, বাংলাদেশের অতি পরিচিত নায়িকা পরিমনী’র ওপর মদ গ্রহণের দায়ে ফেসবুকে অসংখ্য আল্লাহওয়ালা মুমিনদের বক্তব্যে আমার কেবল এটাই মনে হয়েছে যে মদ খাওয়া নারী’র জন্য নিষিদ্ধ বা হারাম।

গেল ১০ জুন রাতে ঢাকা বোট ক্লাবে বোট ক্লাবের চেয়ারম্যান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ অভিনেত্রী পরিমনীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা করেন, ঘটনার চারদিন পর পরিমনী তার বাড়িতে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, তার ওপর ধর্ষণ ও হত্যা চেষ্টা করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তের জন্য তাৎক্ষনিক ভাবে বাংলাদেশ পুলিশ উদ্যোগ নেয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে নাসিরুদ্দিন এবং ব্যবসায়ী অভিকে আটক করা হয়।

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসির উদ্দিন মাহমুদ, তিনি বড় ব্যবসায়ী হয়েও গ্রেফতার এড়াতে পারেন নি, যদিও এর আগে আমরা মুনিয়া হত্যার / আত্মহত্যার পর দেখেছি বসুন্ধরার এম ডি সায়েম সোবহানের বিরুদ্ধে বেশ কয়েক ডজন তথ্য প্রমাণ থাকা স্বত্ত্বেও তার নাম অব্দি কোন পত্রিকা বা নিউজে দেখা যায় নি প্রথম দিকে, তাকে ধরা তো অনেক দূরে, কয়েকদিন আগেই ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন তাকে ফুল দিয়ে আসছে, তার আগে সে শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্রের প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন। একটা হত্যা মামলার আসামী ক্যামেরার সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, পুলিশ তারে ধরছে না।

অপর দিকে, পরিমনী ইস্যুতে দেখলাম আইন শৃংখলা বাহিনী যথেষ্ট তৎপর ছিলেন। পরিমনী ঘটনার চারদিন পর অভিযোগ করেছেন; কোন প্রমাণ দিতে পারেন নি, তাতেও শুধুমাত্র মোখিক অভিযোগের ভিত্তিতে কিন্তু নাসিরুদ্দিনকে আটক করা হয়েছে, এমন ঘটনা এইদেশে বিরল। এটা কি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী বরাবর পরিমনীর’র মা মা করে লেখা ফেসবুক স্ট্যাটাসের কারণে, নাকি পরিমনী যথেষ্ট জনপ্রিয় নায়িকা নাকি নাসিরুদ্দিন জাতীয় পার্টি করেন, আওয়ামী লীগের কোন বড় পদে তার নাম নেই।

আসলে কারণ যাই হোক, এইটুকু নিশ্চিত যে শারীরিক লাঞ্চনার স্বীকার হলে ফেসবুকে লেখা বেশি কার্যকরী থানায় মামলা করবার চাইতেও। কিছু অতি পাকনা জনতা ঘটনার সুবিচার দেখার চাইতে নারী ভিকটিমকে উলঙ্গ করতেই বেশি উদ্যত অনলাইনে, তাই কেন এতো কম সময়ে ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিনকে এবং অভিকে ধরা হলো সেটা না ভেবে ভাবছেন, কেন পরিমনী মদ খেল ? কিভাবে খেল ? বারে কেন গেল ? কেন স্বল্প পোশাক পড়লো ? কেন তিনটা বিয়ে করলো ? কেন সিনেম করলো ? কেন দুবাই গেল ? এমন অনেক অনেক কেন দিয়ে তারা ফেসবুকের পাতা ভরিয়ে ফেলে যেখানে একটা মেয়েকে শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। নুসরাতের মতো পর্দানশীল নারীও এমন ট্রলের শিকার হয়েছেন তার গায়ে আগুন দেওয়ার পরো, মুনিয়া মরে যাবার পরো তার নাচ লোকে ভাইরাল করেছে, আনুস্কা বা তনু কেওই এই ধরণের নোংড়া ট্রল থেকে রেহাই পায়নি।

ধর্ষিতা হবার পর তার জন্য একমাত্র দায়ী করা হয়েছে নারীর চরিত্রকে এবং এই প্রথা আগেও ছিল এখনো চলছে, ভবিষ্যতে চলবে না এমন কোন গ্যারান্টি নেই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোন নারীর ওপর যখন আক্রমণ করা হয়েছে এমন সংবাদ আসে, তখন অধিকাংশ পাঠক বিশাল সাইজের গবেষক হয়ে যান। উক্ত নারীর চরিত্র নিয়ে তারা থিসিস করতে আরম্ভ করেন, তার লেখা পড়া থেকে শুরু করে বিয়ে অব্দি পুরো বায়োগ্রাফি পাঠকের হাতে চলে আসে চোখের পলকে। এতে করে অপরাধী চলে যায় সবার নজরের বাইরে, তার অপরাধ যেন ধীরে ধীরে হালকা হতে থাকে যদি কোন ভাবে প্রমাণ করা যায় উক্ত নারী রাত করে বাড়ি ফিরেন অথবা বাইরে কাজে যান। আর পরিমণির বেলায় বিষয়টা খুব সহজ ছিল।

পরী একজন ফোর্বস ম্যাগাজিনের লিস্টেড নায়িকা, তিনি কী পড়বেন কোথায় ঘুরবেন, কার সাথে ঘুরবেন তার জবাবদিহি দর্শককে দেবার কথা না যে দর্শক শত টাকা খরচ করে হলে তাকে দেখতে যায়, সেই দর্শক কী করে আশা করেন যে পরি বোরখা পড়বেন, আর নায়িকা বোরখা পড়ে অভিনয় করলে কি দর্শকের পয়সা উশুল হতো ? পরিমনী মদ খান ব্যস এই জায়গায় মদ একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পরিমনী যেহেতু মদ খেতে বারে যান তাহলে তাকে যে কোন পুরুষ যে কোন সময় ধর্ষণ করতেই পারে। মদ কেবল পরিমনী খাচ্ছেন তা কিন্তু না, ক্লাবে মদ সাপ্লাই করা হচ্ছে, সেখানে অভিনেত্রীর পাশাপাশি বসে পুরুষ সম্প্রদায় মদ খাচ্ছেন, যিনি আক্রমণ করেছেন এবং তাকে সহায়তা করেছেন তিনিও মদ্যপ ছিলেন। তবুও তাদের অপরাধ কোনভাবেই আলোচনায় উঠে আসেনি ফেসবুকারদের অতর্কিত মন্তব্যের তীব্র বানে।

পরিমনী রাত করে বাইরে থাকেন এবং মদ খান এবং তার তিন বিয়ে, এই বিষয় গুলো বেশি আলোচিত হয়েছে আর নারী’র মদ্য পান অন্যতম ভাবে দায়ী। অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যাচ্ছে, সমাজ পুরুষদের মদ খাওয়াটাকে খুবই স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে। পাপ পূণ্যের যে হিসাব অনলাইন হুজুররা প্রতিনিয়ত তাদের বক্তব্যে দিয়ে আসছেন তার মধ্যে মদ্যপ নারীর ক্থা উঠে আসলেও মদখোর পুরুষদের জন্য কোন বয়ান নেই যদি এলকোহল দুই জাতির জন্যই হারাম বলেছে ইসলাম।

বনানী থানায় কেন মামলা নেওয়া হয়নি, এমন প্রসংগে ওখানকার দায়িত্বরত কর্মকর্তা বলেছেন ‘পরিমনী মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন, তাই তাকে বাসায় যেতে বলা হয়; পরে মামলা নেওয়া হবে।’ এখন কথা হচ্ছে একজন লোক যদি মদ্যপ অবস্থায় কোন নারীকে ধর্ষণ করে তাহলে তার বিরুদ্ধে আইন কি সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে না, নাকি মাতাল বলে ক্ষমা করে দেবে। শহরের রাস্তায় কেও যদি মাতাল অবস্থায় হেঁটে যায় সেখানে দাঁড়িয়েও পুলিশ মামলা করে দেয় তাৎক্ষনিক, তাহলে এই মামলা হয় কোন ভিত্তিতে সেটা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। মাতালের নিরাপত্তা তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলেই আমি বিশ্বাস করি।

পরিমনী অভিযোগ করেছেন তাকে ধর্ষণ ও হত্যা চেষ্টা করা হয়েছে, তবে অভিযুক্তদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে মাদক আইনে। তার মানে এখনো পরিমনী তার অভিযোগের সঠিক বিচার পান নি। এই পরিমনী ইস্যুতে বাংলাদেশে কিছু নব্য মুসলিমদের বিরা্ট উপকার হয়েছে, তারা আবু ত্ব-হা আদনানের জন্য তাদের চোখের জল দেখাতে পেরেছেন রাষ্ট্রকে। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিন রাত একত্র করে তাদের ত্ব-হাকে হাজির করেছেন তাও আবার আজ; তার শ্বশুর বাড়ি থেকে। কোথায় ত্ব-হাকে গুম করা হয়েছে বলে বলে ফেসবুক গরম করে ফেলেছে একদল, তাদের আশায় এমন জল ঢেলে দেওয়া ত্ব-হার একদম উচিৎ হয় নি। আরো কিছুদিন প্রথম পক্ষের শ্বশুরবাড়িতে কাটালে দ্বিতীয় স্ত্রী’র কাছে গুরুত্ব আর এক ধাপ বাড়তো, আরো কিছুদিন আদনানের ভিডিও শেয়ার হতো, আরো কিছু নারী বিদ্বেষী বক্তব্য ভাইরাল হতো, তারপর আবু ত্ব-হার জন্য জাতি মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামতেন, ব্যাপারটি কতো দূর চলে যাচ্ছিল। আইন শৃংখলা বাহিনীর জন্য আমার মায়াই হয়, এই বৃষ্টির মধ্যেও তাদের অযথা হয়রানি !

যাই হোক, প্রধানমন্ত্রী বরাবর কান্নাকাটি করলে যে অনেক কাজ হয় সেটাই আমি উপলন্ধি করেছি বেশ কয়েক বছর ধরে। সেই যে নোয়াখালীর নুসরাতকে পুড়িয়ে মারা হলো, তাদের পরিবার যদি প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুবিচার না চাইতেন তাহলে তো অপরাধীদের শাস্তি হতো না (যদিও নুসরাত মেয়েটিকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি বীভৎস ভাবে)

{ বিএনপি ঘরের ভেতর সেমিনার না করে এই ফর্মুলায় এগুলে এতদিনে বেগম খালেদা জিয়া বিদেশে চিকিৎসা পেয়ে যেতেন সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। }

এটা পরিমনীর বেলায়ও দেখলাম। কিন্তু মুনিয়া বা আনুস্কাদের বেলায় তা দেখিনি, মুনিয়ার বড় বোন বা আনুস্কার মা তাহলে মনে হয় ঠিকঠাক করে কান্না করতে পারেন নি। মা সম্বোধনে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটা চিঠিও পাঠাতে পারেন নি, আমি অন্তত শুনিনি। মুনিয়া বা আনুস্কা দুই জনেরই সম্ভাব্য খুনি তাদের বয়ফ্রেন্ড, তাদের অপরিণত বয়সের প্রেম। এই দুইটি ঘটনার কোন সমাধান আজো আইন শৃংখলা বাহিনী করতে পারেনি। তেমনি তনু হত্যার বিচার করতে পারে নি, আদিবাসী বাচ্চা মেয়েটি বাবা সহ আত্মাহূতি দিল, বিচার হয়নি, ঘরের ভেতর প্রবেশ করে গাজিপুর ছোট শিশুকে রেপ করা হয়, বিচার হয়নি, আশুলিয়ার বাসে দুই নারী শ্রমিককে ধর্ষণ করা হয়, কোন বিচার নাই; এমন শত শত নারী দৈনিক শারীরিকভাবে লাঞ্চনার শিকার হয়।

বিচার পায়না এরা, উলটো এদের চরিত্র নিয়ে কথা ওঠে সোস্যাল মিডিয়ায়, এদেরকে বেশ্যা উপাধি দেওয়া হয় আর এই দেশে বেশ্যাদের ধর্ষণ করা খুবই নেক কাজের মধ্যে অন্যতম একটি বলেই বিবেচিত। আজ সুপ্রিম কোর্টের বড় বিচারপতি কে তাঁকে আমি চিনি না, তাঁকে চেনার আমাদের কোন দরকার নেই। আমরা চিনি আমাদের মা’কে; আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে, আপনাকেই বলছি; ‘মা, আপনার মেয়েগুলো বড় অসহায় আপনার রাষ্ট্রে। তাদের ইচ্ছে করলেই হাঁটুজল বৃষ্টিতে পা ডুবিয়ে খেলতে পারে না, তারা খোলা ছাদে চুল এলিয়ে দাঁড়াতে পারে না মা, তাদের ইচ্ছে করে সাইকেল নিয়ে এই শহর ঘুরে বেড়াতে, খোলা পুকুরে ডুব সাঁতার দিতে। মা, তাদের জন্য একটি নিরাপদ জায়গা দিন, তাদের অবাধে কাজ করার সুযোগ করে দিন, তাদের বেঁচে থাকার নিরাপত্তাটুকু দিন মা।

মা, আপনি কি এই নারীদের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছেন ? মা, আপনিই এই অসহায় মেয়েদের একমাত্র আশ্রয়স্থল, আপনিই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত, একমাত্র প্রধান বিচারপতি।‘

পুনরায় শূণ্য থেকে শুরু

148747669_10165

শেষ হতে হতেও আচমকাই পূর্ণ হয়ে গেল
চল্লিশ বছরের নারী জীবন।
বুভুক্ষু এ হৃদয়ে হঠাৎই তোমার আবির্ভাব;
যেন পূর্ণজন্ম হলো আমার।
কষ্টিপাথরে ঘেরা শুষ্ক ভূমিতে
ক্রমশ ঝরণা বইছে এখন।

আমার লাজ লজ্জা আভরণ
সবই , তোমার হাতে সমর্পিত।
তোমার এক জোড়া চোখ
যেখানে ডুব দিতেই ঘুরে আসতে পারি
সমগ্র বঙ্গোপসাগর।
একটুখানি উষ্ম আলিঙ্গন ভাসিয়ে নিয়ে যায়
অস্তিত্বের শেষ সীমানায়।

তুমি কি হারিয়েছ অথবা পেয়েছ জানিনা।
তবে আমি যা হারিয়েছি;
পাওয়ার আনন্দ ভাসিয়ে দিয়েছে
অশ্রুভেজা জলে।।

মেলে ধরো উষ্ণতা …

185_n

তোমাকে পাবার পর;
সবুজ ঘাসে রোদ হেসে ওঠে
ঝলমলে আলোর ঘ্রাণে।
পোড়া কাঠ মরমর শব্দে ভেঙ্গে
উড়ে যায় মাঘী হাওয়ায়;
এখানে শুকনো দেয়াশলাই
কুয়াশার জলে সিক্ত,
লেলিহান শিখার আদর স্পর্শ
ছুঁয়ে যায় না সর্বাঙ্গ।

এখানে কেবল কেরোসিনের ঝাঁঝালো গন্ধ,
হাজার টাকার সিলিন্ডার।
এখানে তিতাসের উনুন আগুন ছড়ালেও
উত্তাপ ছড়াতে পারেনি প্রবল চাওয়ায়।
মোটা কার্ডিগেনের ভাঁজে ভাঁজে বরফ সফেদ ঠান্ডা;
মেঘের আস্তিনে ঘুমিয়ে আছে শীত সকাল,
ধোঁয়া তোলা গরম কফির পেয়ালা;
করোনা নামে তীব্র থাবা,
থামিয়ে রেখেছে পৌষ উৎসব।

হিম হিম রাতগুলো নিয়ত নিয়ন আলোতে
আদ্রতা ছাড়ায়,
নরম কাঁথায় জড়ানো পুরনো গন্ধের কাছে
ফিরে ফিরে যায়।
তোমার সোয়েটার খুলে দাও ,
বহুল ব্যবহৃত সোয়েটার;
যার প্রতি সূতোর ওলি পেরিয়ে
মেখে নেবো আজন্ম উষ্ণতা।।

গোধূলির নিমগ্নতা

97020

লেনা দেনার এই যাদুর শহরে
বড্ড বেশি ক্লান্ত লাগে আজকাল ;
কেবল ছুটে চলেছি বাড়তি ভালো থাকবার প্রশ্রয়ে।
কর্মের ভারে ন্যুব্জতা নয়,
এ যেন যন্ত্রের যাঁতাকলে
নিষ্পেষিত প্রত্যেকটি মুহূর্ত।
তারপরও তুমি পাশে থাকলে
মাঘী বৃষ্টি ঘূর্ণিঝড় হতো বারুদ আকাশে ;
তুমি হাত ছুঁয়ে দিলে ;
ভূমিকম্প ঘটে যেত ১০৫ মাত্রায়।

জানি, নির্ভয়ে আঙ্গুল ভাঁজে আঙ্গুল
রাখা হবে ব্যপ্তি হীন চাওয়া।
অর্থহীন সময়ের হিসাব কষে বুঝে নিতে থাকি –
এখানেও অপচয়ের মহা উৎসব।
তবু সীমান্ত তার উপেক্ষা করবার প্রচেষ্টা
অব্যাহত রাখতে চাই।
এখানে ধর্মান্ধদের অযাচিত পাঁয়তারা জেনেও
আলিঙ্গনে রাখি আশ্চর্য ভাবনা।

সাদা শাখা নয়, সিঁথির সিঁদুর নয় ;
বারো হাত ঘোমটায় আবদ্ধ থেকেও নয়,
নাম বর্ণহীন অসাম্প্রদায়িক সম্পর্কের জেদ ধরে
প্রণয় সূত্রে গেঁথে রেখেছি গোধূলির নিমগ্নতা।।

আলিঙ্গনের কাব্য

250_o

আমায় তুমি বাইন্ধো সখা
স্বজল দুইখান চক্ষে ;
তারো অধিক বাইন্ধ্যা থুইও
সুঠাম প্রসার বক্ষে।
কিড়া কাইটা কওগো সখা
যাইবানা দূর পানে ;
বাহুর বান্দন শক্ত কইরা
রাখবা ওই পরাণে।
নয়ন তারায় আসন তোমার
পিঞ্জিরাতে থাইকো ;
পরবাসী মনটারে তাই
হিয়ার খাঁচায় রাইখো।

স্মৃতিকথন অনলাইন গ্রুপ প্রাতিষ্ঠানিক রূপে আত্মপ্রকাশ করলো

সন্মানিত সুধী,
গত ৩১ শে অগাস্ট ২০২০, সোমবার রাজধানীর বনানী ডিওএইচএস-এ সারাদিন ব্যাপি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল স্মৃতিকথন অনলাইন গ্রুপের মিলনমেলা। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্মৃতিকথন গ্রুপ সাংগঠনিকভাবে আত্মপ্রকাশ করলো। উক্ত অনুষ্ঠানে গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা পথিক মুসাফিরের ৪৫তম জন্মদিন উৎযাপন করা হয়। সংগঠনের উপদেষ্টা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন লেখক সৈয়দ আশরাফ মহি-উদ্-দ্বীন, জনাব এ কে এম তারেক, ডেপুটি সেক্রেটারী, কৃষি বিপনন অধিদপ্তর, কৃষি মন্ত্রাণালয় এবং কণ্ঠশিল্পী কাজি আরিফ।

বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের প্রাদূর্ভাবের কারণে সবাই যখন ঘরে বসে অবসর সময় কাটাচ্ছিলেন ঠিক তখনি অন্যান্য অনলাইন গ্রুপের মতো স্মৃতিকথনের যাত্রা শুরু হয় এই বছরের মে মাসের ১৭ তারিখ। মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে বিপুল সংখ্যক সাহিত্য অনুরাগী এবং সংস্কৃতিকর্মী উক্ত গ্রুপে জয়েন করেন, অন্যান্য গ্রুপের সাথে স্মৃতিকথন গ্রুপের পার্থক্য হলো – গ্রুপে বা পেইজে পোস্ট করা লেখা নিয়ে আগামী বছর অমর একুশে বইমেলায় গল্প ও কবিতা সংকলন ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করা হবে।

গ্রুপের কর্ণধার পথিক মুসাফির স্মৃতিকথনের কার্যক্রমকে সর্বত্র পৌঁছে দেবার ইচ্ছে ব্যক্ত করেন। করোনা পরিস্থিতি অনুকূলে এলে দাতা সংস্থার মাধ্যমে দেশের দুস্থ শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করেন; শুধু অনলাইন কেন্দ্রিক আড্ডা বা বিনোদনে স্মৃতিকথনকে আবদ্ধ না রেখে মাঠ পর্যায়ে সমাজ সেবামূলক কাজে নিজেদের নিয়োজিত করতে চান।

লেখক সৈয়দ আশরাফ মহি-উদ্-দ্বীন বলেন, স্মৃতি কথনের সাথে যুক্ত হয়েছি মাস তিনেক হলো। স্মৃতি কথনের উদ্দেশ্য অনেক মহৎ এবং সুদূর প্রসারী। এঁরা মানুষের কল্যাণে, সমাজের উন্নতিতে আর নতুন প্রজন্মের মেধা বিকাশে কাজ করে যাবেন বলে সবাই এক হয়েছেন। প্রবাসে বসে আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব এই মহতী উদ্যোগে একজন সহযাত্রী হয়ে থাকবো ইনশাআল্লাহ। আমি আশা করি স্মৃতিকথন নিয়মিত মানুষের পাশে থেকে মেধা এবং ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

কণ্ঠশিল্পী কাজি আরিফ ‘স্মৃতিকথন’ সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি ভবিষ্যতে অন্যান্য সামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহন করবার প্রত্যাশা রেখে বলেন, দেশের শিক্ষা, দারিদ্রতা দূরীকরণ, পরিবেশ রক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালনের পরিকল্পনা আছে স্মৃতিকথন পরিবারের। তিনি আরো বলেন, ছোট্ট একটা বীজ থেকেই একদিন বিশাল মহীরুহ তৈরী হয়। আমি আশা করি তারুণ্যের শক্তি নিয়ে ‘স্মৃতিকথন’ একদিন এই দেশে এই সমাজে বিশাল মহীরুহ হয়ে একটা ইতিবাচক অবস্থান তৈরী করতে সক্ষম হবে।

জনাব এ কে এম তারেক স্মৃতিকথনের সফলতা কামনা করে বলেন, ‘স্মৃতিকথন’ একটি সাংস্কৃতিক পরিবার। লেখালেখি এবং ভার্চুয়াল আড্ডার মাধ্যমে দেশীয় সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরছে প্রতিনিয়ত। তরুণ লেখকদের একটি একক প্লাটফর্মে এনে তাদের প্রতিভাকে ছড়িয়ে দেওয়া, আবার ভার্চুয়াল জগতে সংগীত, নৃত্যকলা ও আবৃত্তিকে আড্ডার ছলে বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষাভাষীদের নিকট পৌঁছে দেয়া নিঃসন্দেহে একটি ভাল উদ্যোগ। এ পরিবারটি বর্তমান কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যতেও নতুন নতুন সৃষ্টিশীলতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।

গ্রুপের এডমিনদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কথা সাহিত্যিক তাহমিনা খলিল, অবঃসিনিয়র শিক্ষক ভিকারুননিসা নুন স্কুল ও কলেজ, জনাব মুক্তাদিরুল আলম ডলার, কবি – লেখক ও আবৃত্তিকার শাইনি শিফা এবং গল্পকার ও নাগরিক সাংবাদিক রোদেলা নীলা। এডমিন প্যানেল থেকে তাহমিনা খলিল বলেন, সমাজের ক্ষয়িষ্ণু নৈতিক মূল্যবোধের উন্নতিতে স্মৃতিকথন পরিবার কাজ করছে, কর্মদ্যম মানুষের পাশে থেকে এই পরিবার অনেক দূর এগিয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

মডারেটরদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সঙ্গীত শিল্পী আব্দুর রহিম রুবেল, সুজিত রঞ্জন সরকার এবং রজনী মিম। সংগীতশিল্পী সাহিদা স্মিতা’র আধুনিক গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানটি সমাপ্ত হয়।

ধন্যবাদান্তে
রোদেলা নীলা
সমন্বয়ক, স্মৃতিকথন পরিবার।

ফেসবুক পেজ : স্মৃতি কথন

পরান মাঝি … তুই বৈঠা থামা

মাঝি, তুই বৈঠা থামা;
আমি ঘাটের জলে ডুইবা মরতে চাই।
মাঝ দরিয়ার ঢেউয়ের নাচে বসন সমেত
ভাইসা যাইতে চাই,
পরান মাঝিরে, তুই বৈঠা থামা।
বুক কাঁপি যায় জ্বারে,
এ জ্বার আসে ডাঙ্গায় বাঁধা অচিন কোন ঘরে।

অমাবস্যায় বসন কাঁপে, কাঁপলো দরিয়ার জল;
আমার গতর-তোরি গতর নামলো নদের ঢল।
তোর সোঁদা গন্ধে ভইরা গেসাল অংগ জরা জ্বরে;
এখন কীবা এমন কইরা বুক কাঁপে মোর ডরে।

মাঝি তুই বৈঠা থামা,
গাঙ্গের জলে কার জানি ছায়া পিছন করে।
সুঠাম বাহু আলগা করতেও ভয় লাগে তোর বুঝি,
ওই খানে আর আমি নাইরে,
আছে আরেক পরী;
তার শইল্যের গন্ধ আইস্যা আমার নাকে লাগে,
কইলজ্যা পুইড়া যায়রে মাঝি,
কয়লা হয় এই মাটি।

দেহের জ্বারে মনের জ্বারে একাকার হই আমি,
পরান মাঝি, তুই বৈঠা নিয়া চইলা যা উজানে;
তোর জন্যে বইস্যা আছে হুর পরী ওই ঘাটে।
গলগলাইয়া চান্দের আলোয় আমার গতর ভাসে;
ভাটির টানে মরন যদি আবার ফিরা আসে,
মাঝি, তুই বৈঠা থামা।
গাঙ যে আমায় ডাকে।।

অণুগল্প : মীরার ৪১ দিন শেষ পর্ব

পরদিন মীরার জীবনে অর্থি ছাড়া নতুন সকাল। বুকের ভেতর কেবল শূন্যতা। রাহেলা বেগম মেয়েকে অনেক বার চেষ্টা করেন খাওয়াতে কিন্তু,ব্যর্থ হন। মীরা বড় খালার বাসায় চলে যায়, সব খুলে বলে। কিন্তু খালু আর বেঁচে নেই, নিজের বাবাকে তো হারিয়েছে অনেক আগেই। এইসব পুলিশ কেসে মীরা কাকে সাথে নেবে, সহজে কেও রাজি হয় না। মীরা বুঝতে পারছিল ও বাড়িতে খালি হাত পা’য়ে গেলে কাজ হবে না । সে খালাকে নিয়ে একজন পারিবারিক উকিলের সাথে দেখা করে। তিনি খুবই গুছিয়ে কথা বলেন, – “দেখেন, এই কেস খুবই সেন্সিটিভ, বাবা মেয়েকে নিয়ে গেছে, তার অর্থ হচ্ছে একজন অভিভাবকের তত্বাবধানে কন্যা সন্তান আছে, আর মুসলিম আইন অনুযায়ী ১৮ বছর পর্যন্ত মা হচ্ছে সন্তানের হেফাজতকারী, অভিভাবক নন।”

মীরা একটু যোগ করে কথার মাঝে, – “আসলে আমাদের মধ্যে এমন কোন কিছু হয়নি, যেখানে আইনগত কোন সমস্যার সম্মুখীন আমি হতে পারি, আমি ভয় পাচ্ছি যদি একা গেলে সে মেয়েকে না দেয় তখন আমি কী করবো। আমি তো বরগুনায় কাউকে চিনি না।”
– “আপনি আপনার থানায় একটি জিডি করেন, সেটার কপি নিয়ে যান, দেখেন দেয় কীনা। আর যদি একেবারেই না দেয় তখন মামলা করে ওয়ারেন্ট করতে হবে।”
উকিলের পরামর্শে খুব ভয় পেয়ে যায় মীরা, কিন্তু জিডি না করে ওখানে একা যাওয়া ঠিক হবে না তা পরিষ্কার বুঝতে পারে। বরগুনায় সাথে যাবার জন্য খালাতো – চাচাতো সব ভাইদের অনুরোধ করলেও এই ঝামেলায় অফিস ফেলে কেও যেতে চায় না। মীরার অফিস থেকে ফোন আসে। সে একটা সিক্ লিভ নেয় তিন দিনের, সেটাই ইমেইলে পাঠিয়ে দেয়।

তারপর দূরসম্পর্কের একজন কাকাকে সাথে নিয়ে রওনা দেয় বরগুনার উদ্দেশ্যে, সারা রাস্তা মেঝ খালা সালমা তাকে খাওয়ানোর অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু মীরার চোখ দিয়ে শুধু পানি ঝরছে। বরগুনায় নেমে প্রথমেই থানায় যেতে মীরা রাজি হচ্ছিল না, অর্থিকে এক নজর দেখার তৃষ্ণা তার চোখে মুখে। কিন্তু জিডির কপি উকিল বলেছে আগে থানায় জমা দিতে। ওখানকার ওসি রহমতুল্লাহ বেশ বয়স্ক একজন মানুষ। তিনিই নির্দেশ দিলেন, – “আপনি ঢাকা থেকে মেয়েকে নিতে চলে আসছেন, ইফতির বাড়ি পর্যন্ত চেনেন না, ওদিকের এলাকা ভালো না, তাই আমি চাই আপনি একজন অফিসার নিয়ে যান।”

মীরা গড়িমসি করে, “দেখেন আমি কোন পুলিশি ঝামেলায় যেতে চাচ্ছি না। আমি চাই তারা সুন্দর ভাবে আমার বাচ্চা আর আমার স্বামীকে আমার কাছে দিয়ে দিক, আমি দু’জনকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাই।” ওসি জোরে হেসে উঠেন, – “আপনি হয়তো আপনার বাচ্চা সাথে করে নিয়ে যেতে পারবেন, সে ক্ষেত্রে অন্যের বাচ্চা আপনার সাথে যাবে কীনা সেটা নিশ্চিত বলা যাবে না। আর আমি আপনাকে আমার এলাকায় একা ছাড়তে পারবো না।” ওসি’র কথা মতোই এস আই রফিক তাদের সাথে ইফতির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। ঠিকানা পাওয়া গেল ইফতির জাতীয় পরিচয় পত্রের কপি থেকে। ঠিকানা যেখানে দেওয়া আছে সে বাড়িতে গিয়ে জানা গেল তারা গেল মাসেই নতুন একটা ফ্ল্যাট কিনে সেখানে চলে গেছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে ইফতির বাবা এবং মা পুরো ঘটনাটাই আগের থেকে পরিকল্পনা করে করেছেন। অর্থিকে দিয়ে তারা মীরাকে এইখানে নিয়ে আসবার একটা চেষ্টা করছেন, যেন নিজেদের বাড়িতে ইফতি নিরাপদে মাদক গ্রহণ করতে পারে আর অর্থি মফস্বলের পরিবেশে বড় হবে, মীরাকে এভাবে মেনে নিতে বাধ্য করার সুন্দর সাজানো নাটক ।

মীরা চোখের পানি মুছে, পাশের বাড়ির দরজায় নক করে নিজের পরিচয় দেয়। ওরা বলে, – “আমরা আপনাকে চিনি, ছবি দেখেছি ইফতিদের বাড়িতে। অমন ফেরেস্তা বাচ্চাকে মায়ের বুক থেকে আনে ? আপনি চিন্তা করবেন না, আমি ওদের নতুন বাড়ির ঠিকানা লিখে দিচ্ছি, ওর বাবার ডাক নাম বাবলা, নাম বললেই লোকে চিনবে।” মীরা ঠিকানাটা একদম মুখস্থ করে ফেললো। এই এলাকা থেকে দূরত্ব খুব বেশি নয়, তারা আবার ওসি সাহেবের দেওয়া জীপে উঠে বসলো। দূর থেকে পুলিশের গাড়ি দেখে ইতিমধ্যে ইফতির বাড়িতে খবর রটে গেছে – “ঢাকা থেকে একজন মহিলা ইফতিকে ধরতে আসছে।” এই যখন পরিস্থিতি তখন আর ভালো করে কথা বলার পরিবেশ রইলো না। থানার এস আইকে বাইরে বসিয়ে রেখে মীরাকে নিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন সালেহা এবং কাকা মামুন। তাদের ঢুকতে দেখে বাবলা খুব বিরক্ত, – “আপনারা পুলিশ নিয়ে এসেছেন কেন ?”

মামুন তাকে আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করেন, – “দেখুন, আমরা এই এলাকায় নতুন, পুলিশ আমাদের বাড়ি চিনতে সাহায্য করেছে।” তাদের বাক্ বিতণ্ডা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে, মীরা কেবল অস্থির পায়চারি করছে অর্থিকে বুকে নেবার জন্য। মা ছাড়া এক বছরের অর্থির হাতে তখন একটা বিস্কুট ধরা। সে অবাক চোখে মা’য়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, মীরা তাকে বুকে নেয়, কামিজের সামনের চেইন খুলে দুধ বের করে সন্তানের মুখে দেয়। উহহ! কী যে শান্তি, এতো শান্তি যেন দুনিয়ার আর কিছুতেই নেই। কোন রকম দুধটুকু খাওয়াতে পারলেও ইফতি মেয়েকে তার কাছে আর ঘেঁষতে দেয় না, – “তুমি অফিস করোগা যাও, অর্থি এখানেই থাকবে।”
মীরা খুব বিরক্ত হয়, – “তোমার বাবা মায়ের কাছে তুমি থাকো, আমার মেয়েকে টানবা না এখানে। আর আমি জব করি সংসার চালাতে, শখ করে নয়।”

এর মধ্যে ইফতির মা নাজমা এসে উপস্থিত হন, তিনি ডায়বেটিসের পেশেন্ট। বেশিরভাগ সময় বিছানায় কাটান। তিনি মীরার হাত ধরে বলেন, – “তুমি যেমন তোমার বাচ্চাকে ছাড়া থাকতে পারো না, আমিও তেমন আমার বাচ্চাকে ছাড়া থাকতে পারছি না।” মীরার মেজাজ যায় চড়ে, – “তাহলে আনি আপনার বত্রিশ বছরের বাচ্চাকে বিয়ে দিলেন কেন, তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমান।” মীরার চিতকারে পুলিশ অফিসার ভেতরে চলে এলো- “কি হয়েছে, ব্যাপার কী ?” তাকে শান্ত করতে বাবলা নিজের পকেটে হাত দিলেন। বাংলাদেশের বেশিরভাগ পুলিশ কীসে ঠান্ডা থাকে তার সব পদ্ধতি এই লোকের জানা। এবার এস আই উল্টো মীরাকে বোঝাচ্ছে, – “মেয়েতো ভালোই আছে দাদা দাদির কাছে, আপনি জব করেন, রাত বি- রাতে বাইরে থাকেন, সময় দিতে পারেন না, থাক ও এখানে, আমার এলাকা আপা, আমি আছি তো।”

মীরার মাথা ঘুরছে, সালমা আর নাজমা তর্ক করছে আর ওদিকে মামুনের সাথে বাবলা। সব মিলিয়ে অর্থি খুব ভয় পেয়ে গেল, জোরে চিৎকার করে কাঁদছে মেয়েটা।
এবার সুযোগ যেন পেয়ে গেল বাবলা, – “দেখেন আমার শান্ত নাতনিটা এদের কারণে ভয় পাচ্ছে।” মীরাকে রেখে দেবার জন্য অনেক চেষ্টা করলো ইফতি, কিন্তু সালমা তাকে এখানে রাখতে ভয় পাচ্ছে। যে লোক নিজের এক বছরের মেয়েকে না বলে নিয়ে আসতে পারে তার কাছে নিজেদের মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠে যায়। এক রকম মীরাকে জোর করে গাড়িতে তোলা হলো। মেয়ের আধো আধো বোলের মুখ কেবল ভাসতে থাকে চোখের গভীরে।

ঢাকায় ফিরে আর জয়েন করতে পারলো না মীরা, ছুটি চাইবার আগেই তার কাছে স্যাক নোটিশ চলে এলো। অসুস্থতার কথা বললেও সে মুহূর্তে মীরা কোন প্রেসক্রিপশান দেখাতে পারেনি, তাই দায়িত্বে অবহেলার জন্য এই সিদ্ধান্ত। প্রাইভেট অর্গানাইজেশন, তাই তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আর এমনিতেও মীরার পক্ষে জব করা সম্ভব ছিল না, কারণ তাকে উকিল সাহেব জানিয়ে দিয়েছেন –ওয়ারেন্ট না নিয়ে কোন ভাবেই বাচ্চাকে নিজের অধীনে আনা সম্ভব নয়।

রোজার মাস শুরু হয়ে গেছে, ওয়ারেন্ট করতে হলে মামলা করতে হয়। টাকা পয়সাতো লাগেই তার ওপর ঢাকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কোর্ট, যেতে আসতেই সারাদিন শেষ। মীরা ভোর ছ’টায় কিছু মুখে না দিয়েই জজ কোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়; সকাল ১০ টার মধ্যে কোর্ট বসার কথা থাকলেও অনেক সময় দেরি হয়। মীরার কেস শুরু হয়, পেশকারকে টাকা দিতে হয় তারিখ কাছাকাছি আনবার জন্য। উকিলকে তো প্রতি জেরাতে অনেক বড় অংকের টাকা দিতে হয় যদিও বিবাদী পক্ষের একজন উকিল ছাড়া আর কেও আসেনি। বাবলা এবং ইফতি হয়তো ধরেই নিয়েছিলেন, তারা পুরুষ, কোর্টে হাজিরা দেবার দরকার নেই, কিন্তু আইন সবার জন্য সমান তালে চল এটা তারা ভুলে যায়।

বরগুনা কোর্টে তারা উলটো অভিভাবকত্বের মামলা করে বসে তাও আবার নাবালিকা কন্যা সন্তানের জন্য। বরগুনা একবার গিয়ে বার বার যাওয়া এখন মীরার পক্ষে সম্ভব। সে রাতের বাসে বরগুনা যায়, সকালে কোর্টে হাজিরা দিয়ে পরের দিন দুপুরের বাসে ফেরত আসে। ফেরার সময় বুকের ভেতর হুহু করে – “আহারে কলিজা পাখি যার জন্য এতো যুদ্ধ তাকে এক নজর দেখতেও পারলাম না।” এই যাওয়া আসা, কোর্টের খরচ সব মিলিয়ে জমানো সব টাকা শেষ। বিয়ের যে গহনাগুলো ছিল সেগুলো খুব কম দামে বিক্রি করতে হলো, সারাদিন রোজা রেখে শরীর যেন আর চলছিল না। এক ফোটা ঘুম নেই মীরার, বুকের দুধ প্রতিদিন টিপে টিপে বের করে ফেলে দিতে হচ্ছে।

ডাক্তার বলেছেন, – “দুধ এভাবে জমে থাকলে জ্বর হতে পারে।” সারা শহর ঈদের আনন্দে উদ্বেলিত, কেনাকাটা চলছে সবার হমদম। কোর্ট বন্ধ হয়ে যাবে সাত দিনের জন্য, ওয়ারেন্ট লেখা হয়নি এখনো। মীরা বার বার তাড়া দিচ্ছে – “প্লিজ ভাই, আপনি ওয়ারেন্ট করিয়ে দেন, স্যারের একটা সই এনে দেন যে করেই হোক।”
পেশকার হেসে উত্তর দেন – “বাবা মেয়েকে না বলে নিয়ে গেছে, এটার ওয়ারেন্ট কি খালি মুখে হয়।” আদালতে দাঁড়িয়ে থাকা মীরা বুঝতে সময় নেয় এই দেশে কী কী করলে কী কী হয়। তার পাশে একজন ভদ্রলোক স্বর নীচু করে বলে – “আপা কিছু টাকা ছাড়েন, সব এমনিই হইয়া যাইবো ?”
মীরা অবাক –“এইখানেও ঘুস ?”
লোকটি হাসে, “কী যে বলেন আপা, রোজার মাসই কামাই করার আসল সময়।” অনেক দেন দরবারের পর পেশকার ঘোষনা দেয় – “পঞ্চাশ হাজার টাকা না হলে
এই কেস আরো এক বছর চলবে।” কোন উপায় নেই; ব্যাংকের বাকি সম্বলটুকু পেশকারের রুমে দিয়ে সে বাংলাদেশ জর্জ কোর্টের সিল দেওয়া কাগজ হাতে পায়, যেটার মূল্য ৫০ হাজার টাকা। সেই মহামূল্যবান ওয়ারেন্ট হাতে নিয়ে মীরা একটি গাড়ি রেন্ট করে ফেলে বরগুনা যাবার জন্য। এবার আর খালি হাতে গেলে চলবে না, পুলিশের ফোর্স নিতে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে পরিবারের কোন পুরুষ সদস্য সঙ্গী হিসেবে পাওয়া যায় না, সবাই মামলা খাওয়ার ভয়ে শিথিয়ে আছে। উপয়ায়ন্তর না দেখে মীরা তার মেঝো খালা সালমাকে অনেকটা জোর করেই সাথে নেয়। সারাটা পথ সালমা তজবি বে করে আল্লাহ আল্লাহ পড়তে থাকেন। আর কিছুক্ষণ পর পর মীরাকে বলেন – “যদি অর্থিকে না পাওয়া যায়, তখন আমরা কি করবো ?”
মীরার কণ্ঠে প্রত্যয় – “দুনিয়া ফুড়ে আমি আমার মেয়েকে বের করে আনবো।”

সত্যিই যেন তাই, থানার ওসিকে আগ থেকেই উর্ধ্বতন কর্মকর্তার মাধ্যমে পুরো বিষয়টা জানিয়ে রেখেছিল মীরা। তাই বরগুনায় পা রেখেই এক গাড়ি পুলিশ ফোর্স পাওয়া গেল। আজ ৪১ তম দিন মীরা অর্থিকে দেখেনি। ব্যস্ত থানা লোকে লোকারণ্য, মীরা রুগ্ন শরীর টেনে জিপে উঠলো। আবার মেয়েকে দেখতে পাবে কীনা সারাক্ষণ একটা অজানা আশংকা বুকের ভেতর কাজ করছিল। সেই বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে পুলিশ যখন দরজায় জোরে জোরে নক করছিল – “দরজা খোলেন, আমাদের হাতে ওয়ারেন্ট এসেছে।” তখন মীরার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছিল, বাড়ির ভেতর থেকে কোন সাড়া শব্দ নাই।

– আমার অর্থিকে কী ওরা ? ভাবতেই পারছিল না মীরা। পুলিশ আরো জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিল। তখন ভেতর থেকে আলো জ্বলে উঠলো। দরজা খুলে ইফতি বের হয়ে এলো, মীরার উৎসুক চোখ তখন ভেতর ঘরে- “কোথায় আমার মেয়ে ?” পুলিশ ততক্ষণে ভেতরের রুমে চলে গেছে। অর্থিকে কোলে নিয়ে বাবলা হম্বিতম্বি বেরিয়ে এলো – “আমি এভাবে বাচ্চা দেব না, কোর্টে যাব।” বেলা তখন ৩টা বেজে গেছে, রোজার মাস; আদালত শেষ পর্যায়ে। কিন্তু কোন এক অদ্ভূত কারণে সহকারি জাজ সাহেব রাজি হলেন কোর্ট চালাতে। বরগুনায় এমন কাউকে মীরা চেনে না যে তার পক্ষ হয়ে লড়তে পারে, পেশকার এসে কানে কানে বললো – “আরে আপা, মহিলা আইনজীবী অফিসে কল দেন, এরাই পারবে আপনাকে সাহায্য করতে।” সম্বিত ফিরে পেল মীরা। তাইতো !! সে নিজেও তাদের ব্যাপারে বহু সংবাদ পড়েছে।

তাই আর দেরী নয়, ফোন দিয়ে দিল তেজগাঁও হেড অফিস। ওপাশ থেকে মুহূর্তে ফোন চলে গেল বরগুনা পারিবারিক আদালতে। একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব মহিলা কালো কাপড় পরিহিত কোর্টে পা রাখলেন; তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন – “মীরা কে?”
ভীত মীরা তখন যেন অন্ধকার ঘরে এক টুকরো আলো দেখতে পেল, – “আমি।”
– “আপনি এজলাসে দাঁড়ান এবং এই কাগজে সই করুন।”
অতো কাগজ ঘাটার সময় তখন মীরার নেই বং নিজের হাতে ধরা কাগজ উকিল আপার হাতে দিল। তার অর্থি তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা মনে হয় চিন্তেও পারছে না নিজের মা-কে। মীরা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শপথ নিল – “আমি শপথ করিতেছি যে যা বলিব সত্য বলিব …।”

খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি মীরার। দু’টো মাত্র কথা বলেছিল উকিল আপা। – “মাননীয় কোর্ট, বুঝলাম আমার ক্লায়েন্ট চাকরি করেন, তার একার আয়ে
পুরো সংসার চলে। তাহলে কেন ইফতি সাহেব সমর্থ হয়েও ঘরে বসে খান ?” উত্তরে তাদের উকিল বলেন – “না, তিনি ঘরে বসে মোটেও খান না, একটি মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে কাজ করেন।” কিন্তু তারা জানতো না যে ইফতিকে যে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল সেই কাগজ ইতিমধ্যে উকিলের হাতে মীরা দিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় আর্জি যেটা ছিল তা খুব ভয়াবহ, সেটা মীরা নিরবে হজম করে নেয়। উকিল আপা কোর্টকে বলেন, – “আমি যদি ধরেও নেই, আমার ক্লায়েন্ট
বেশ্যাবৃত্তি করে পয়সা উপার্জন করছে, তবুও এটাই সত্যি কোন মায়ের কাছ থেকে তার নাবালিকা কন্যাকে আলাদা রাখা যাবে না।”

বাদী পক্ষের উকিল অনেক বার মীরা দুশ্চরিত্র, বেশ্যা, শিশু পাচারকারী এই ধরণের বিশেষণে বিশেষিত করেছেন, কিন্তু তার দেওয়া শূলে যে নিজেই আঘাতপ্রাপ্ত হবেন বোঝেন নি।

কোর্ট রায় দিল, – “নাবালিকা কন্যা শিশু অর্থি বিয়ে না হওয়া অব্দি তার মা’য়ের হেফাজতে থাকবে, পিতা ইচ্ছে করলে দেখার অনুমতি পাবেন।” নিজের কানকে খুব ভাড়ি মনে হচ্ছিল মীরার। যখন সে নীচে নেমে আসে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে উকিল আপা তার কোলে দেয়। সাথে সাথে পুলিশ তাকে ঘিরে দাঁড়ায়। একজন এস আই দ্রুত এগিয়ে আসেন, – “আপা তাড়াতড়ি বের হয়ে যান, মুভ।” আদালত থেকে বেরুবার সময় বাবলার ক্ষিপ্ত দল তাদের তেড়ে আসছিল মারার জন্য। উক্ত এস আই খুব দ্রুত মীরা –অর্থি আর সালমাকে গাড়িতে তুলে দেন। ফিরে আসবার সময় কিছু সন্মানী তার হাতে দিয়ে মীরা বলেন, – “আপনি আমার ভাইয়ের কাজ করলেন।”

গাড়ি ছুটে চললো চল্লিশ- এর উপরে, ড্রাইভার বুঝতে পারছিল এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ালে বিপদ হতে পারে। মীরা অর্থিকে বুকে পেল ঠিকই, কিন্তু কিছুতেই বাচ্চাটা বুকের দুধ মুখে দিচ্ছিল না। খালা বার বার সূরা পড়ে ফুঁ দিচ্ছিল, কোন কাজ হচ্ছিল না। ড্রাইভার কিছুক্ষণ বিষয়টি খেয়াল করলেন তারপর বললেন, – “দেখেন তো আপা, বাচ্চার গায়ে কোন তাবিজ পান কীনা।” অর্থির কোমরের কাপড় সরিয়ে মীরাতো অবাক, – “সত্যি ভাই, একটা ছোট সাইজের তাবিজ প্যাঁচানো।” – “আপনি ওটা ছিঁড়ে এখানেই গেড়ে ফেলুন, বরগুনার সীমা পাড় হয়ে গেলে কাজ হবে না।” মীরা গাড়ি সাইড করতে বলে দ্রুত নামলো, তাবিজ ছিঁড়ে ফেলে সেটা মাটিতে গর্ত করে ঢুকিয়ে দিল।

বিজ্ঞানের সব ফর্মুলা উপেক্ষা করে অর্থি সত্যি সত্যি আবার মীরার বুকের দুধ পান করতে শুরু করলো। জগতে এমন কিছু থাকে যার ব্যাখ্যা কোন দিন বিজ্ঞান দিয়ে করা যাবে না, এটাও বোধ কই এমন একটি ব্যাপার। ইফতির জন্য মায়া হলো মীরার, ছেলেটা নেশার ঘোরে বাবা মা যা বলছে তাই করছে, সে জানতেও পারলো না – মা’ডাকটার পর সব চাইতে মধুর সম্বোধন “বাবা”। যা একবার শোনার জন্য মানব সন্তান দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে, কারো কপালে জোটে আবার কারো বা জোটে না।

ছোটগল্প : মীরার ৪১ দিন প্রথম পর্ব

ইফতির কাশিটা আগের থেকে বেড়েছে; রাতে ঘু্মোতে গেলে এপাশ ওপাশ করছে। যে কাতেই শোয় না কেনো শরীর যেন কোন ভাবেই স্বস্তি দিতে পারছিল না, মাঝে মাঝে উঠে বসে থাকতো। মাঝ রাত্তিরে মীরাকে ডেকে তুলবে সে সাহস হচ্ছে না কিছুতেই; মেয়েটা সারাদিন বাইরে কাজ করে বাড়ি ফিরে। এরপর বাচ্চা
সামলানো, রান্না করা, সব নিজের হাতেই করছে।

ইফতি নিজেই বুঝতে পারে, সে একটা বাড়তি বোঝা নিজের সংসারেই কিন্তু কোন ভাবেই নেশাটা ছাড়তে পারছে না। সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে জামালের দোকানে গিয়েছিল, বেশ পুরনো বন্ধু। খুব আবদার জুড়ে দিল, “এতোদিন পর আসছিস দোস্ত, একটু বাংলা খা।” ইফতি খানিক ইতস্তত করছিল, কারণ তখন অব্দি তার গাঁজার নেশা ছাড়েনি, তার মধ্যে বাংলা মদ পড়লে পেটের অবস্থা কী হবে তা নিয়ে খানিকক্ষণ চিন্তা করলো। আবার নিজেই নিজেকে শান্তনা দিয়ে বললো, – “কী আর হবে, গ্যাস্ট্রিকে আবার ব্যথা উঠলে অষুধ খেয়ে নেব।”

ডাক্তার বহু আগেই ইফতির আলসারের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে চিকিৎসা নিতে বলেছিলেন; কিন্তু অতো গুরুত্ব দেওয়া তার পক্ষে মোটেও সমীচিন মনে হয়নি। “ডাক্তারের কাছে গেলে এমন দুই চার খানা টেস্ট না দিলে তাদের ওয়েট থাকে না – “এই বলে সে দিনের মতো মীরাকে নিয়ে ফিরে এসেছিল। এক কাপ দুধ অব্দি যে ছেলের পেটে সয় না, সে প্রায়শই দেশি বিদেশি যখন যা পাচ্ছে কিনে গিলছে। এই দেখে দেখে মীরা এখন বিরক্ত; মেয়ে বড় হচ্ছে; সামনে অনেক টাকা কামাই করতে হবে। এই সব কথা এখন বাসী ভাতের মতো পঁচে গেছে।

জামালের আখড়া থেকে বেড়িয়ে বড় রাস্তাটা পার হবার সময় ঘটলো বিপত্তি, কোন কিছু বুঝে উঠবার আগেই মাথা ঘুরে পড়ে গেল ইফতি, তখন বেশ রাত হয়ে গেছে, কিন্তু শহরে দু’চারজন মানুষ জুটে গেল। তারাই ধরাধরি করে ভর্তি করে দিল এলাকার একটি হাসপাতালে। কিন্তু এমন রোগীতো আর অভিভাবক ছাড়া বেডে নেওয়া যায় না, পুলিশ কেস হতে পারে। ইফতির পকেট থেকে অফিসের আইডি কার্ড বের করে নিল নার্স; সোজা ফোন বেজে উঠলো ইফতির অফিসের টেবিলে। ব্যস যা হবার তাই, পরদিন অফিস শুদ্ধ এমপ্লয়ি জেনে গেল ইফতিকে মাতাল অবস্থায় পাওয়া গেছে রাস্তায়। এম ডি সাহেবের ফোন পেয়ে খুব অবাক হলো মীরা, এতো রাতে ভাই কী মনে করে কল দিয়েছেন। মনে মনে ভাবতে ভাবতে হ্যালো বলতেই ওপাশের কড়া কণ্ঠ, – “সরি ভাবি, আপনাকে এভাবে কল দিতে চাইনি; তবে এর আগেও ইফতি সম্পর্কে অনেক তথ্য পেয়েছি এবং তাকে বহুবার অফিসিয়ালি আমি ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম। সে তার কথা রাখেনি; নিজের ইচ্ছে মতো অফিস থেকে বের হয়ে যায়, একাউন্টস থেকে মাস শেষ হবার আগেই টাকা নিয়ে যায়, আমি ভাবতাম বুঝি বাচ্চার জন্য, এখন দেখছি নেশার পেছনেই তার সব খরচ !”

মীরা চুপ করে শোনে; কারণ এটা তার জন্য নতুন কোন তথ্য নয়। বিয়ের দিন রাতে যখন ইফতি বাসর ঘরে প্রবেশ করছিল না, তখন উৎসুক ননদিনী এসে উঁকি
দিল, – “ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছো ভাবি, কোন লাভ নাই।”
মীরা শুধু অবাক হয়ে তাকালো, “কেন, কী হয়েছে ?”
ভেংচি কাটার মতো মুখ করে মেয়েটি বলে গেল, – “ও, তুমি দেখছি কিছুই জানো না, ভাইয়া এই সময় ফুয়াং ক্লাবে থাকে। ফিরতে ফিরতে সকাল। তুমি ঘুমাও। কিছু লাগলে আমাকে ডাক দিও।” কথাগুলো ঈশিতা এমন ভাবে বলে গেল যেন ক্লাবে যাওয়া আর মসজিদে যাওয়া এক কথা। এই বাড়িতে ঢোকার পর সে প্রথম জানতে পারলো ইফতি শুধু নেশাই করে তা নয়, তার সাথে আনুসঙ্গিক অনেক নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি তার আসক্তি শুধুমাত্র নারী আসক্তি ছাড়া। আর এই নারী আসক্তি এতোই কম ছিল যে মীরার মতো একজন অপরূপা তরুণী ইফতির দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হলো।

ওয়্যারড্রবের ওপরের ড্রয়ারে কাগজের ভাঁজে যে গোলাপী বস্তুটি রাখা থাকে তাকে ইয়াবা বলা হয়, এই তথ্য মীরা প্রথম জানলো তার ছোট বোনের কাছ থেকে। বোনের বাড়িতে দু’দিনের জন্য বেড়াতে এসে মিমি দেখলো – দুলাভাই সারা রাত জেগে বই পড়ে। “এতো কি পড়েন দুলাভাই ?” – প্রশ্ন করলেও সঠিক উত্তর ঠিক মতো পাওয়া যায় না। ইফতির চেহারার মধ্যে দুলাভাই সূচক কোন আভাস নেই। সে কেবল আড় চোখে শালিকে দেখে নেয় ,তারপর বই বন্ধ করে চোখ বুজে থাকে। মিমি বোঝে, ইফতি মোটেও ঘুমায়নি, কারণ তার বাম পা অবিরত তখন নড়ছে। ইফতি আসলে এতো রাত জেগে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে কী করে, সেটাই তার জানার আগ্রহ ছিল। একটু হাতাহাতি করে মিমি পেয়েও গেল সেই বিষাক্ত দ্রব্য হাতের মুঠোয়।

মীরা কখনো ইয়াবা দেখেনি, খবরে মাঝে মাঝে ইয়াবা ব্যবসার প্রসার সম্পর্কে জেনেছে। তাই খুব অবাক হয়ে মিমিকে জিজ্ঞেস করল, “ইফতি বলে, এটা খেলে
নাকি তিন রাত ঘুম হবে না, ও যখন লম্বা জার্নি করে তখন খায়।” মীরার বোকামি দেখে খুব রাগ হয় মিমির, “কী পড়া লেখা করেছো তুমি, এটা ইয়াবা আপু। সর্বনাশা, মানুষকে শেষ করে দেয়। প্রথম প্রথম সবাই খায় রাত জেগে কাজ করবার জন্য, কিন্তু এটা আসলে ভয়াবহ নেশা। ধীরে ধীরে মানুষের শরীরকে গ্রাস করে ফেলে।” মীরা এতো কিছু বোঝে না। সেদিন হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল মীরার। ডাক্তার বার বার বলছিলেন, – “আপা, আপনি চাইলে আপনার হাজবেন্ডকে রিহ্যাবে দিতে পারেন, আমার পরিচিত।”

কিন্তু ইফতির বাবা মা কিছুতেই ছেলেকে রিহ্যাবে পাঠাবে না, এক মাত্র ছেলের কোন অযত্ন তারা চায় না। উত্তরে বলে দেয়, – “আপনি রিলিজ দিয়ে দেন, বাড়ির ছেলে বাড়ি ফিরে যাক।” বাড়ির ছেলে বাড়ি ফিরলো ঠিকি, মাঝখান থেকে ভালো চাকরিটা খোয়ালো। সারারাত জেগে এই অস্বাভাবিক কাশি আর সারাদিন চোখ বুজে ঝিমানো ছাড়া আর কোন কাজ নেই। মীরা জব ছাড়েনি; সংসার তো চালাতে হবে। এখন এই সময়ে শ্বশুর শাশুড়ির ওপর পুরো নির্ভরশীল হয়ে গেলে তো চলবে না। তারা নিজের বাড়ি বরগুনা চলে গেছে, ওখান থেকেই ছেলের যখন যা লাগে দিচ্ছে; তাই বলে সংসারের খরচ কাওকে দিতে বলা ঠিক না।

মীরা ইচ্ছে করলে মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যেতে পারে; কিন্তু ভাবীরা এই নিয়ে বাজে কথা শোনাবে তাই আর ও পথে যাওয়া হয় না। ইফতির শরীর দিন দিন খারাপ হচ্ছে, কিন্তু সন্ধ্যার আলো নামতেই সেই ধোঁয়া তোলা নেশার দ্রব্য নিয়ে বসা সে ছাড়তে পারেনি। মীরা প্রথমে ভেবেছিল, কন্যা সন্তান কোলে নিয়ে ইফতি সমস্ত নেশা ভুলে সংসারে মন দেবে কিন্তু তার এই যেচে পড়ে মা হবার প্রক্রিয়াও কোন কাজে আসেনি। বিয়ের প্রথম রাতেই যেমন নির্বিকার ছিল ইফতি, আজো তাই।

ছোট্ট অর্থিকে রাখবার জন্য একজন কিশোরীকে রাখা হলো বাসায়; সেই মেয়েকে গোসল করায় খাওয়ায়। মীরা অফিসে চলে গেলে তার মা রাহেলা বেগমের কাছে মেয়েকে দিয়ে যায়। অফিস থেকে ফেরার পর মা নিজ বাড়িতে ফিরে যান। এভাবে ভালোই চলছিল, কিন্তু একদিন হঠাৎ ইফতি শাশুড়িকে বলে, – “মা, অর্থিকে তৈরি করে দেন, আমি ওকে নিয়ে বোটানিক্যাল বেড়াতে যাব।”
রাহেলা প্রথমে ভীষন অবাক হন, – “এইটুকু বাচ্চা মেয়ে, গার্ডেনের কী বুঝবে ?”
ইফতি ভালোই জোর করে, – “সারাক্ষণ বাসায় বসে থাকতে ভালো লাগে না মা, যাই মেয়েকে নিয়ে ঘুরে আসি।” অনেকটা জবরদস্তি করেই দেড় বছরের অর্থিকে নিয়ে ইফতি বাইরে বেড়িয়ে আসে।

রাহেলা বেগম ঘরে গিয়ে দেখেন অর্থির কাপড় চোপড় কিছুই নাই, এমন কী ছোট ব্যাগটাও গায়েব। নেশাগ্রস্ত ছেলেটা এতোটুকু বাচ্চা নিয়ে কোথায় গেল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন, পরে ভয়ে ফোন দেন মীরার মোবাইলে, – “মীরা, ইফতি অর্থিকে নিয়ে বাইরে গেছে।” মীরার স্বাভাবিক প্রশ্ন, – “দোকানে গেছে, চলে আসবে মা।”
রাহেলা থরথর করে কাঁপছেন, – “না, অর্থির কাপড় চোপড় নিয়ে গেছে।”
এবার গলা শুকোনোর পালা মীরার, – “কী বলছো মা ? ওরতো নেশা করলে কোন সেন্স থাকে না, শেষে আমার মেয়েটাকে যদি বিক্রি …”
কথাটা আর শেষ করতে পারে না মীরা, টেক্সি ডেকে সোজা বাড়িতে চলে আসে। কাকে ফোন দেবে, কোথায় খোঁজ নেবে ? পাগলের মতো এলোমেলো কল দিতে থাকে মীরা। ঢাকায় ইফতির সব আত্মীয়ের বাসায় দেয়, কিন্তু কেও কিচ্ছু বলতে পারে না। সে ভুলেও ভাবতে পারে নি ঢাকা থেকে ৫ ঘন্টার পথ পেরিয়ে ইফতি তার বুকের মানিককে নিয়ে তার গ্রামের বাড়ি চলে যাবে। সারাদিন উৎকণ্ঠার পর শেষে ফোনটি আসে, – “আমি অর্থিকে নিয়ে আব্বা আম্মার কাছে আছি।” এরপর সব চুপ, কথা কেটে যায়। ফোন হাতে নিয়ে বোবা মূর্তির মতো বসে থাকে মীরা।

ঢাকা থেকে ৫/৬ ঘন্টার পথ, বরগুনা। এতো অল্প সময়ের মধ্যে এসি গাড়ির টিকিট পাওয়া গেল না। ইফতির গ্রামের বাড়িতে যাব যাব করেও সময় করে যাওয়া হয়নি মীরার এর আগে। ঠিকানা কাকে জিজ্ঞেস করবে বুঝতে পারছে না, ওর খালাতো বোন– দুলাভাই, মামা মামীকে বেশ ক’বার ফোন দেওয়া শেষ।

তাদের একটাই উত্তর, – “দেখো, এগুলো তোমাদের পারিবারিক ব্যাপার, আমরা কথা বলতে গেলে ওরা রাগ করতে পারে।” – “মামী, ইফতি আমার এক বছরের বাচ্চাকে না বলে নিয়ে গেছে, মেয়ে আমার বুকের দুধ পাচ্ছে না, এটা ক্রাইম” – মীরা এক নিঃশ্বাসে বলে। মামী শাশুড়ির উত্তর, – “বাবা তার মেয়েকে ঘুরতে নিয়ে গেছে, একে ক্রাইম বলো কিভাবে ?” মীরা বুঝতে পারে এদের কাছ থেকে কোনই সহযোগিতা পাওয়া যাবে না। কিন্তু ইফতিতো তাকে বলে ছুটির সময় মা মেয়ে দু’জনকেই গ্রামে নিয়ে যেতে পারতো। তা না করে অর্থিকে লুকিয়ে নিল কেন !! তাদের মধ্যে এমন কোন বড় ঝগড়া হয় নি। নিশ্চই এর পেছনে অন্য কারণ আছে। কারণ পাওয়া গেল ইফতির কথার স্বরে। মীরা ফোনে অনুনয় করতে থাকে – “আমার মেয়েটাকে আমার বুকে ফিরিয়ে দাও ইফতি, বুকের দুধ গলে পড়ে যাচ্ছে, মেয়ে আমার খেতে পারছে না।” ইফতির মধ্যে এই নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই, সে ঠান্ডা জবাব দিল – “তুমি সারাদিন কাজ করো, অর্থিকে রাখার সময় পাওনা, ও আব্বু আম্মুর কাছেই থাক। তুমি পারলে চলে আসো।”

মীরার কণ্ঠে বিরক্তি, – “এইগুলা কী বলো ইফতি, এতো ভালো বেতনের কাজ ছেড়ে আমি গ্রামে চলে আসবো ? ওখানে গিয়ে আমি কি করবো ? ইফতি রেগে যায়, – “এটা গ্রাম না, মফস্বল, অনেক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আছে, বাচ্চাদের পড়াবা।” মীরা খুব বিরক্তি দেখায় – “আমি একটা ইন্টারন্যাশনাল ফার্মে কো-ওর্ডিনেটর হিসেবে আছি, তুমি জানো আমার মাসে বেতন কতো, এই দিয়েই আমাদের সংসার চলছে, তুমি কি বলছো বুঝতে পারছো ? আই ওয়ান্ট মাই চাইল্ড ব্যাক।” ইফতি ফোন রেখে দেয়। তারপর রাত্রি আরো ঘন হতে থাকে। অর্থি বুকের দুধ ছাড়া থাকবে কী করে, মীরা সারারাত বারান্দায় বসে কাটিয়ে দেয়।

.
আগামী পর্বে সমাপ্য।

কোন এক অদৃশ্য বিলীন যন্ত্রের ছোঁয়ায়

উন্মাতাল দিনের রাঙা পাঁয়ে শেকল পড়াতে ইচ্ছে করে আজকাল;
আমি বিনা দর-দামে বেঁচে দিতে চাই অযৌক্তিক হাসি খেলা্র দিন,
আমি একদম বিনে পয়সায় নিলামে চড়াতে চাই –
অযাচিত স্মৃতির মেলা ।

ক্লান্ত দিনের শেষে অনাবিল সূর্যের ডুবন্ত মুখ,
মাঘী সন্ধ্যায় উত্তাপ ছড়ানো আলিঙ্গন ;
সব কিছু একেবারেই মুছে ফেলতে চাই
কোন এক অদৃশ্য বিলীন যন্ত্রের ছোঁয়ায়।

এখানে এক চিলতে রোদও পড়েনি কোন দিন;
এমন অন্ধকার ঘুঁটঘুঁটেই ছিল ,
যেমন অন্ধকারে আগলে ছিল আমার শাড়ীর কালো আঁচল ;
ঘন লাল টিপ।

নীল চুড়িগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে একটা একটা করে,
ভেঙে যাচ্ছে সময় ;
ভেঙে যাচ্ছে ছন্দ।

মনে হয় ;
আর কোন দিন রোদ্দুরের গল্পের মোড়ক উন্মোচিত হবে না,
কোথাও ফুটে উঠবেনা একটা নীলপদ্ম।
নস্টালজিকের অভিপ্রায় বেঁচে দিতে চাই চিরদিনের জন্যে ;

হাঁপিয়ে উঠেছি খুব;
ক্লান্ত মস্তিষ্ক আর কোন স্মৃতি বহন করতে পারছে না,
সোনালী রঙ ছটা রোদ্দুর দিন নিলামে চড়িয়ে
নিশ্চিন্তে চাষ করতে চাই আগত সময়।।

একটি নতুন কবিতা জন্মাবে বলে

তুমি আমার কাছে একটি কবিতা চেয়েছিলে;
ভোরের প্রথম সূর্যের মতো দীপ্ত –
বৃষ্টিধোয়া সবুজ বৃক্ষের মতো স্নিগ্ধ
একটি তরতাজা কবিতা।

নরম ঠোঁটের অনুরণন চাওনি তুমি,
চাওনি খেলতে এলোমেলো বেনুনীতে;
শুধুই চেয়েছিলে মূর্তমাণ একটি কবিতা।

তোমার চিলেকোঠায় বহুবার কড়া নেড়ে ফিরে গেছি –
পুরনো পর্দার ফাঁক গলে ভেসে এসেছে তানপুরার মৃদু ধ্বনি;
ফিরেও চাইলে না !
তাইতো অব্যক্ত আকাঙ্খারা বৃষ্টি হয়ে ঝরে গেল
চোখের তারায়।

কোন কবিতারি জন্ম হলো না আর।

এই শহরে তোমাকে বিদায়

আমার শহরে তোমার চলে যাবার ঘন্টা ধ্বনি
বেজে উঠুক খুব সন্তর্পণে।
অলিন্দ থেকে নিলয়,
কর্ণগুহর থেকে হূদপিণ্ড অব্দি ;
চলে যাবার শব্দ যেন না পৌঁছয় শরীরের কোন রন্ধ্রে।
ইথারের তরঙ্গ ঘেসে ভেসে আসা আকুতিমাখা কণ্ঠ
আমি নিজ হাতে গলা টিপে হত্যা করেছি ;
আজলা ভরা আকাঙ্খাকে
কড়া চোখের ইশারায় দমিয়ে রেখেছি,
বন্ধ করে দিয়েছি ঝড়ো হাওয়ায়
দুমড়ে যাওয়া দরজা-জানালা,
এই পথে তোমার হেঁটে আসবার কোন যৌক্তিকতা
একেবারেই অবশিষ্ট নেই,
আমি এও জানি ;
যুক্তিরও অনেক বাইরে ছিল ক্ষণ মুহূর্তের রসায়ন,
পরাস্ত আবেগ বাস্তবতার কাছে নতি স্বীকার
করে গেল বিক্ষুব্ধ হৃদয়ে।

পরিত্যক্ত এই শহরে তোমার আর থাকবার
কোন প্রয়োজন নেই।।

১৮ ই মে ২০১৯