সৌমিত্র চক্রবর্তী এর সকল পোস্ট

সৌমিত্র চক্রবর্তী সম্পর্কে

পরিচিতিঃ জন্ম বিহারের এক অখ্যাত বনাঞ্চলে বাবার চাকরীস্থলে। রসায়নে স্নাতকোত্তর এবং ম্যানেজমেন্ট পাশ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী। একাধারে নাট্যকার, কবি এবং গল্পকার। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক পর্যালোচনা, বিভিন্ন ধরনের লেখা ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় ও সংবাদপত্রে। উৎপল দত্ত সহ বহু বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে শিখেছেন থিয়েটার। বহু বিচিত্র ও ব্যাপ্ত ময় তাঁর জীবন। বন, জঙ্গল, পশু, পাখি, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তাঁর দীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। কবিতা ও বিভিন্ন লেখা লেখিতে তিনি মস্তিস্কের থেকে হৃদয়ের ভুমিকাকে বড় করে দেখেন। কবিতা, গল্প, নাটক এবং মুক্তগদ্য মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নয়। প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হলো বইছে লু, থিয়েটার কথা, তিতলিঝোরা, নীলপাখিকে উড়ো চিঠি, রাত্রি আমার নৈশপ্রিয়া, ব্রিজের নীচে বৃষ্টি, ২ একাঙ্ক, প্রতিলিপি এবং বেবুশ্যে চাঁদ, খণ্ড ক্যানভাস। ইতিপূর্বে অঙ্গন সহ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে অক্ষর বৃত্ত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। নেশা ফটোগ্রাফি ও ভ্রমণ।

এদেশ ওদেশ ৭

(শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ সপ্তম পর্ব।)

এদিকে ভারত রাষ্ট্রে তখন রাজনৈতিক ঝড়ের আসন্ন পূর্বাভাস। স্বাধীনতার পরে যখন একে একে স্বপ্ন ঝরে পড়তে শুরু করলো স্বভাবতই মানুষ বিমুখ হতে শুরু করলো শাসকদের থেকে। বহু প্রতিশ্রুতি দেখা গেল শুধুই মিথ্যাচার।

ল্যাম্পপোষ্টে একজনও মজুতদারকে ঝোলানো হলো না, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস হাতছাড়া হতে শুরু হলো, সম্পদ জমতে শুরু করলো চরম ধনীদের সিন্দুকে। সুভষের মতো নিবেদিতপ্রাণ বিপ্লবীকে দেশে ফিরলে ইংরেজের হাতে তুলে দেওয়ার ঘৃণ্য মুচলেকা দেওয়ার কথা প্রকাশ্যে এসে গেল। অপুষ্টি, দারিদ্র্য, অশিক্ষা বাড়তে লাগলো হু হু করে।

ষাটের দশকে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত ঘা মারলো দু দুখানা যুদ্ধ। পাকিস্তানের সঙ্গে জিতলেও চীনের কাছে হেরে ভারতখন্ড তাদের হাতে তুলে দিয়ে মাথা নীচু করে পিছিয়ে আসতে হলো। যুদ্ধ পরবর্তী যাপনচিত্র হয়ে উঠলো ক্রমশঃ ঘন কালো।

মারা গেলেন দুজন খ্যাতনামা প্রধানমন্ত্রী। জওহরলাল নেহরু এবং লালবাহাদুর শাস্ত্রী। কংগ্রেসের মধ্যে ক্ষমতা দখলের উদগ্র লোভ আবার প্রকাশ্যে এসে গেল। দিল্লীর মসনদ দখলের চেষ্টায় সব দুষ্কর্ম বৈধতা পাচ্ছিল।

সমস্ত বাধা সরিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের পিছু হটিয়ে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতা দখল করলেও পরিস্থিতির বিশেষ পরিবর্তন না হয়ে আরো অধগামী হতে থাকলো।

ঠিক এই সময়েই পরপর দুবার ভাগ হয়ে গেল কমিউনিস্ট পার্টি শুধুমাত্র আদর্শগত বিরোধের মাশুল দিয়ে। নরম, মধ্য ও চরমপন্থার বিরোধের সুযোগে শাসক কংগ্রেস তাদের ধ্বংস করতে উদ্যত হলো। কিন্তু মানুষ অপ্রত্যাশিত ভাবে মধ্যপন্থী কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে শুরু করলো।

৬৮ র বর্দ্ধমান প্লেনামে বিকল্প দলিল পেশ করে চারু মজুমদারের চরমপন্থী গোষ্ঠী হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করলো। অন্যরা তাদের এই কাজকে হঠকারিতা আখ্যা দিলেও যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে গেল এই মতাদর্শ। আগুন জ্বলার আগে বাতাস তখন থমকে দাঁড়িয়ে।

অবস্থা সামাল দিয়ে নিজের অপ্রতিহত শাসনদন্ড প্রতিষ্ঠার জন্য ইন্দিরার তখন দরকার ছিল একটা ঝড়ের। অথচ সমগ্র উপমহাদেশ তখন কাঁপছে স্থিতিশীল সুশাসনের অভাবে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই ৭০ এর নির্বাচন হলো পাকিস্তানে। জনরায়ে ব্যাপক হার সেখানকার শাসকেরা মেনে না নিয়ে নির্বাচনের রায় ভন্ডুল করে পূর্ব অংশে সর্বার্থে মিলিটারি শাসন জারীর কুচেষ্টা করে লেলিয়ে দিল আলবদর, রাজাকার ও আর্মি। তছনছ হয়ে গেল সামাজিক, অর্থনৈতিক বন্ধন। কাতারে কাতারে শরনার্থী পালিয়ে আসতে শুরু করলো এপারে।

এমনিতেই এপার বাংলার অর্থনীতি ভারতের সাথে জুড়েই তখন বিপর্যস্ত। তার ওপর এত বিপুল পরিমাণে শরনার্থীর চাপে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠলো।

এপারের বাঙালি কিন্তু অসীম সহ্যশক্তি নিয়ে জায়গা ছেড়ে দিতে লাগলো তাদের। কমিউনিস্ট পার্টিরা তাদের সমর্থনে পাশে দাঁড়াল। কিন্তু পরিকাঠামোর অভাবে শিবির গুলোতে হানা দিতে লাগলো মহামারী, ক্ষুধা। প্রচুর মানুষ মারা গেল এপারে এসেও। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এতদিন চুপ করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল, নড়েচড়ে বসতেই হলো তাদের এবার।

(আবার কাল)

এদেশ ওদেশ ৬

(শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ ষষ্ঠ পর্ব।)

পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী জুটি ইস্কান্দার মির্জা ও লিয়াকত আলি খানের শাসনকাল ছিল গণতান্ত্রিক। যদিও রাষ্ট্রের ঘোষিত নাম ছিল ইসলামিক স্টেট অব পাকিস্তান। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত এক অস্থির অবস্থার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে যেতে হয়েছিল। এই সময়ে ছয় জন প্রধানমন্ত্রী পদ পেয়েছেন এবং দুর্ভাগ্যজনক ভাবে অপসৃত হয়েছেন।

গণতন্ত্রের এই দুরবস্থা সৃষ্টির জন্য আপাতদৃষ্টিতে সেখানকার ভঙ্গুর শাসনকাঠামো কে দায়ী করা হলেও আসলে এর পেছনে ছিল আমেরিকার আগ্রাসনের ইচ্ছা। পাকিস্তানে গণতন্ত্র কায়েম থাকলে সেখানকার সিস্টেম কে দিয়ে নিজের স্বার্থে কাজ করানো সম্ভব নয় জেনেই ১৯৫৮ তে জেনারেল আইয়ুব খান কে দিয়ে ক্যু ঘটিয়ে শাসনযন্ত্র দখল করানো হলো।

কিন্তু মিলিটারি স্বৈরশাসনের ওপরে ভরসা রাখলেও সেখানে মৌলবাদকে কাজে লাগানোর প্রয়োজন তখনো পড়েনি। ধর্মপালন সব দেশেই সাধারণ মানুষের এক অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে এই ধারণা সেই প্রাচীন কাল থেকেই মনের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে। কিন্তু ধর্মপ্রচারকরা সব ধর্মেই কখনো হানাহানির কথা বলেননি। সর্বদাই শান্তির কথা, পবিত্রতার কথা, সৌহার্দ্যের কথা বলেছেন। অথচ সেই মহাপুরুষদের বাণী বিকৃত করে একদল কুচক্রী সেই সময়েই সক্রিয় হচ্ছিল ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে। কিন্তু রাষ্ট্র তখনো তাদের কাজে লাগায়নি।

আইয়ুবের দেখানো রাস্তা ধরেই ক্ষমতায় এলেন ইয়াহিয়া খান – জুলফিকার আলি ভুট্টো জুটি। আর ক্ষমতায় এসেই উপনিবেশ পূর্বের ওপরে শোষনের মাত্রা বাড়িয়ে দিলেন তাঁরা। এদিকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দুনিয়া জুড়ে প্রতিবাদের সামনে সংসদ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু চালে একটু ভুল হয়ে গেল।

আয়তন অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের সাংসদ সংখ্যা যে নীতিনির্ধারক হয়ে উঠতে পারে এই গণনা সম্ভবত স্বৈরশাসকরা করেন নি। দেশের দুই অঞ্চলেই তখন পাকিস্তান মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে কুশাসনের জন্য জমেছে ব্যাপক ক্ষোভ। তরতর করে বাড়ছে আওয়ামী লিগের জনপ্রিয়তা। মুসলিম লীগের বিরোধী সব দলই তখন গ্রহণযোগ্য। আর এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মধ্যেই হলো নির্বাচন।

হরেকরকম দুর্নীতির আশ্রয় নিলেও শেষরক্ষা হলোনা। ক্ষমতা হস্তান্তর অবশ্যম্ভাবী জেনে সক্রিয় হয়ে উঠলো গণতন্ত্র বিরোধী সবকটি অশুভ শক্তি। যেনতেনপ্রকারে নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক সাংসদপদ বিজয়ী আওয়ামী লিগ এবং বিরোধী জোটকে ক্ষমতায় আসা আটকাতে তড়িঘড়ি কারারুদ্ধ করা হলো শেখ মুজিবর রহমান সহ প্রথম সারির নেতাদের। আলোচনার সব প্রয়াস ভেস্তে দেওয়া হলো ইচ্ছাকৃত ভাবে। পূর্বের উপনিবেশে পাকিস্তানের যেসব এজেন্সি তাদের স্বার্থরক্ষায় নিযুক্ত ছিলো, যেমন আলবদর, রাজাকার ইত্যাদি এই সংগঠনগুলোর শক্তিবর্ধন করে দেশব্যাপী বিক্ষোভ প্রতিরোধের কাজে সামিল করা হল। আর নামানো হল সেনাবাহিনী। ঠিক সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে পাকিস্তান মৌলানা ভাসানী সহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের চেষ্টা করেও গ্রেপ্তার করতে পারে নি। ভাসানী ভারতে পালিয়ে এসে জনমত ও রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছিলেন।

একদিকে পূর্ব পাকিস্তানের পিষ্ট বাঙালি হাতে তুলে নিচ্ছিল রাইফেল অন্যদিকে কূটনৈতিক দৌত্য চালিয়ে পূর্বের অংশকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন স্বতন্ত্র সত্তা গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়ে গেল। মজার ব্যাপার এই ভীষণ দুর্দিনে কোনো পীড়িত মানুষের মনে ধর্মের নামে অধর্মের বিচ্ছিন্নতাবাদী ভাবনা উঁকি দিতে পারেনি কারণ সেই সময়ে লড়াইয়ের মুখ্য চরিত্রে যাঁরা ছিলেন তাঁরা কেউ মৌলবাদী ছিলেন না।

(আবার কাল)

এদেশ ওদেশ ৪

(শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ চতুর্থ পর্ব।)

দুই দেশেই প্রথম দিকে মৌলবাদকে মদত দিয়েছিল শাসকগোষ্ঠী। পাকিস্তানের প্রয়োজন ছিল উপনিবেশ পূর্বঅংশকে তাঁবে রাখা, আর এপারে ভোটের রাজনীতি। ফলে উত্তর বা পশ্চিমের পাক অঞ্চলে বিষবৃক্ষ হয়ে বাড়ছিল উগ্রবাদ। ভারতের পূর্বাঞ্চলে।

নিরীহ বাঙালি বহুদিন চুপ করেই ছিল। আগেই বলেছি, ভাষাআন্দোলনের মত কিছু অরাজনৈতিক ক্ষোভ ছাড়া তারা মোটামুটি মেনেই নিয়েছিল বঞ্চনার ইতিবৃত্ত। তলেতলে ক্ষোভ দানা বেঁধেছিল কিন্তু বিস্ফোরণের স্তরে পৌঁছে যায়নি।

সেই ৪৭ এ অনেক স্বপ্ন দেখেছিল মানুষ। ভেবেছিল ইংরেজ গেলে স্বর্গরাজ্য হবে। প্রতিশ্রুতির ফোয়ারা ছুটেছিল। মানুষকে বোঝানো হয়েছিল স্বাধীনতা মানেই দুর্নীতির অবসান, স্বাধীনতা মানেই দারিদ্র্য মুক্তি।

অথচ বাস্তবে দেখা গেল, ইংরেজ আমলে তাদের চাটুকারবৃত্তি করে যারা রীতিমতো পরাক্রমশালী আর ধনশালী হয়ে উঠেছিল, তারাই মাছির মত শাসন মধুর চারপাশে ভীড় জমালো। আর আশ্চর্যজনক ভাবে তারাই ক্ষমতার চাবিকাঠি পেতে শুরু করল।

এতে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের আখেরে লাভ হলেও দ্রুত বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে শুরু করল শাসক দলগুলো। একের পর এক দুর্নীতির ছবি ফাঁস হয়ে যাচ্ছিল। এপারে জীপ কেলেংকারীর দায়ে পদত্যাগ করলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণমেনন। বিশ্বাস হারিয়ে মানুষ খুঁজতে লাগলো বিকল্প।

প্রশাসনিক স্তর ক্রমশঃ আমলা নির্ভর হয়ে উঠলো। আর যেহেতু শীর্ষ আমলারা প্রায় সকলেই সমাজের উচ্চশ্রেণীর তাই স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছিল তাদেরই। মধ্যবিত্ত উচ্চের পদলেহন করে উপরে ওঠার মসৃণ চেষ্টা একমনে করছিল। আর নিম্ন মধ্যবিত্ত, দরিদ্র আর দরিদ্রেতর অসহনীয় যন্ত্রণায় দিনাতিপাত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছিল।

এর মধ্যেই ছোটোখাটো ইস্যু থেকে জ্বলে উঠছিল আগুন। দাবানলের শক্তি কব্জা করে ছড়িয়ে পড়ছিল। অভুক্ত মানুষ সামিল হচ্ছিল তেভাগা আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, এক পয়সার ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির আন্দোলনে।

এর মধ্যেই নরমপন্থী কংগ্রেসের দিক থেকে মানুষ ঝুঁকে পড়ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর দলগুলোর দিকে। এদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি বেড়ে উঠছিল তরতর করে। নীচুতলার সমাজ থেকে উঠে আসা কিছু যুবক যুবতী সমাজ পাল্টে বিভেদ অবসানের স্বপ্ন দেখাচ্ছিল। অন্যদিকে বিষগাছের মত সংগোপনে ছড়াচ্ছিল ধর্মের নামে বেসাতি করা মৌলবাদের শিকড়।

একটা সময় এল, যখন আম মানুষ কংগ্রেসের নামই শুনতে চাইত না। তবুও ভিভিআইপিদের বিভিন্ন দেবস্থানে ভোট নদী পার হওয়ার জন্য মাথা ঠোকার ছবি ফলাও করে খবরের কাগজে ছাপা হলেই সবাই হুমড়ি খেয়ে দেখত, কারন ভেতরে ছিল আজন্মলালিত হাজার কুসংস্কার। আর দুর্নীতির দুর্গন্ধ আড়াল করতে নেতারাও বেশী করে প্রচারের শিরোনামে থাকার জন্য এরকম ছবির পোজ দিতে লাগলো।

(ফের আগামীকাল)

এদেশ ওদেশ ৩

(শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ তৃতীয় পর্ব।)

পুরাকালে ভারতবর্ষের পরিধি ছিল আফগানিস্তানের কাবুল (গান্ধার প্রদেশ) থেকে নাগপ্রদেশ (বর্তমানের অরুনাচল)। এখনকার মায়ানমার ছিল অন্য দেশ, আর উত্তরে ছিল ইলাবৃতবর্ষ (বর্তমানে তিব্বত)। এই বিশাল এলাকা ভারতবর্ষের অন্তর্গত হলেও বিভিন্ন স্বাধীন শাসকের শাসনে থাকত। এই এলাকা থেকে মুঘল আমলে বিচ্ছিন্ন হয়ে গান্ধার প্রদেশ হয়ে গেল পাঠান ভূমি। ইংরেজ আমলে ক্রমাগত বিদ্রোহে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন দেশ হয়ে গেল তরাই অঞ্চল।

রাজনীতির কান্ডারীরা যাই করুন না কেন, এই বিশাল ভূমিখন্ডের সাধারণ মানুষ কিন্তু এসবে মাথা ঘামাত না, সত্যি কথা বলতে তারা এত বিভেদের বৃত্তান্ত জানতোও না। রুটি রুজির জোগাড়ে সীমান্ত অতিক্রম করা তখন অন্যায় ছিল না।

৪৭ পরবর্তী দেশগুলোতে শাসকেরা ছিল উচ্চবর্ণের এবং রীতিমতো ধনী সম্প্রদায়ভূক্ত। এরা প্রায় সকলেই ছিল বিদেশে উচ্চশিক্ষিত। আমজনতার শিকড়ের সমস্যা সম্পর্কে এরা কেউই খুব একটা ওয়াকিবহাল ছিল না। রাজতন্ত্র নামেই বিদায় নিয়েছিল। রাজা মন্ত্রী নবাব উজির নাজিরের দল ক্ষমতা ভোগ করছিল নিজেদের মধ্যে গোপণ আঁতাত এবং প্রকাশ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ ছড়ানোর কূট খেলা খেলে।

ভারতে নেহরু আর পাকিস্তানে জিন্নাহ্ র নরম নীতির কাল ফুরিয়ে এল খুব দ্রুত। পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃত্ব মুখে আলোচনায় বসার কথা বললেও কার্যত উগ্র আক্রমণ করে স্ব স্ব দেশে নিজের জনপ্রিয়তা বজায় রাখা বা বাড়িয়ে মূলতঃ ভোট বৈতরণী পেরনোর চেষ্টা করতে শুরু করেছিল।

এই সহজ রাস্তার সন্ধান তারা পেয়েছিল ৪৬ – ৪৭ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়েই। নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে এতে ইন্ধন যুগিয়ে ছিল অপসৃয়মান ইংরেজ শাসক।

এদিকে দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসনের ছায়ায় থাকতে থাকতে ঔপনিবেশিক শাসকের সমস্ত খারাপ ধ্যানধারণা মজ্জায় মজ্জায় ঢুকেছিল ওই উঁচুতলার শাসকদের মধ্যেও।

দুই স্বতন্ত্র দেশ ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের আলাদা বৃত্ত গড়ে নিল। অথচ একটু চেষ্টা করলেই বিভাজনের কষ্ট ভুলে সৌহার্দ্য বাড়ানো যেত অনায়াসে।

ভারতে বাড়ছিল হিন্দু মৌলবাদ। আর পাকিস্তানকে ততদিনে গ্রাস করতে শুরু করেছে অন্ধ মৌলবাদ। প্রাদেশিকতায় আচ্ছন্ন পাকিস্তানের উচ্চসম্প্রদায় ভারত থেকে আসা উদবাস্তুদের গায়ে ছাপ মেরে তাদের করে দিল স্বতন্ত্র দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মোহাজির। সিন্ধপ্রদেশের বালুচিস্তান অবহেলিত রয়ে গেল। আর পূর্ব পাকিস্তান হল উপনিবেশ। ভারতেও সর্বাধিক গুরুত্ব পেল উত্তর ও পশ্চিমের প্রদেশগুলো। উত্তর পূর্বের প্রদেশগুলোর জন্য বরাদ্দ হল চরম অবহেলা।

বঞ্চনা আনলো চরম দারিদ্র্য, দারিদ্র্য আনলো ক্ষোভ। ক্ষুব্ধ প্রজন্ম আবেদন নিবেদনের রাস্তা ছেড়ে হাতে তুলে নিল অস্ত্র। অশিক্ষিত এইসব বিদ্রোহীরা খুব সহজেই ধর্মের নামে মিথ্যা প্রচার করা ক্ষমতালোভীদের খপ্পরে পড়ে গেল।

(আবার আগামীকাল)

এদেশ ওদেশ ২

(শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ দ্বিতীয় পর্ব।)

কিন্তু গোল বাঁধলো এখানেই। গান্ধীর পরেই সবচেয়ে সিনিয়র নেতা ছিলেন মহম্মদ আলি জিন্নাহ্। আর এই জিন্নাহ্ থাকলে নতুন দেশের প্রধানমন্ত্রী যে তিনিই হবেন তা বুঝেই দিল্লীর মসনদ দখলে শুরু হলো চিরাচরিত ষড়যন্ত্রের খেলা।

স্বায়ত্তশাসন পাওয়ার সময়েই রীতিমতো প্রস্তাব পাস করিয়ে জিন্নাহ্ কে অর্থদপ্তর দেওয়ার কৌশল, সুভাষচন্দ্র কে কংগ্রেস থেকে তাড়ানোর কৌশল, এই খেলারই শাখাপ্রশাখা। স্বভাবতই মর্যাদায় আহত জিন্নাহ্ বেরিয়ে গিয়ে তৈরী করলেন মুসলিম লীগ।

কিন্তু মজার ব্যাপার জিন্নাহ্ বা তাঁর দল প্রথমেই স্বতন্ত্র ভূমিখন্ডের দাবী তোলেন নি। কংগ্রেসের শীর্ষ ক্ষমতালোভীরা একের পর এক বৈষম্যমূলক আচরণ করে যাওয়ার পরে জিন্নাহ্ দাবী তুললেন পাক – ই – স্তান এর।

নিজে জিন্নাহ্ উদারমনস্ক পাশ্চাত্য শিক্ষার মানুষ ছিলেন। ধর্মীয় আচার তিনি নিজে প্রায় পালনই করতেন না। অপরদিকে হিন্দু মৌলবাদ তখন শিকড় ছড়াতে শুরু করেছে। বিভিন্ন ভাবে বিপর্যস্ত আমজনতাকে দলের সমর্থনে টানতে গেলে সবচেয়ে সহজ উপায় ধর্মীয় মেরুকরণ। অথচ হিন্দু মৌলবাদীরা সেটা করতে শুরু করে দিয়েছে, অতএব মরীয়া কংগ্রেস নিজেকে পুরো সেদিকে ঝুঁকিয়ে দিল। মুসলিম লীগ বুদ্ধিমানের মত সে কাজটা সেরেই ফেলেছিল। ফলতঃ সবচেয়ে সহজ রাস্তায় হাঁটল দুই দলই। আনঅফিসিয়ালি দুই দলের গায়ে দুই ধর্মের তকমা পড়ে গেল।

ভারত বা পাকিস্তান দুই দেশই জন্মলগ্ন থেকেই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেয়ে অন্য বৃহৎ ক্ষমতাশালীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে শুরু করেছিল। পাকিস্তান আমেরিকার আর ভারত রাশিয়ার। অথচ প্রায় সমসাময়িক স্বাধীনতা লাভের পরেই চীন বা জাপান অনেক এগিয়ে যাচ্ছিল শুধুমাত্র নিজস্ব ভাবনা আর উদ্যোগে।

বৃহৎ রাষ্ট্র তাদের নিজেদের স্বার্থেই এই দুই নবগঠিত দেশ কে মদত দিতে শুরু করল, কারন ভৌগলিক অবস্থানের সুবাদে দুই দেশই অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। বড় দেশের দাদাগিরি বা স্বার্থ বজায় রাখতে যেকোনো একটা দেশ তাদের হাতে রাখা অবশ্যম্ভাবী ছিল।

আর এখানেই শুরু হল ধর্মীয় মৌলবাদের বাড়বাড়ন্ত। নেহরু বা জিন্নাহ্ দুজনের কেউই আর যাই হোক মৌলবাদী ছিলেন না। কিন্তু তাঁদের চারপাশে আবর্তিত মৌলবাদ ঠেকানোর কোনো চেষ্টাই তাঁরা বা তাঁদের দল করেনি ভোটের মুখের দিকে তাকিয়ে। অশিক্ষিত, হতদরিদ্র দুইদেশের মানুষগুলোকে যে শুধু ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে এক ছাতার তলায় এনে নিজেদের ক্ষমতায় টিকে থাকার পথ প্রশস্ত হয়, তা তাঁদের দুই দলই ততদিনে বুঝে গেছিল। আর এরা ক্ষমতায় থাকলে বৃহৎ শক্তিরও এই অঞ্চলে ছড়ি ঘোরাতে সুবিধা হয় বলে তারাও এতে হয় চোখ বুজে ছিল নয়তো অর্থ, সরঞ্জাম দিয়ে বাড়তে সাহায্য করে চলেছিল। সাধারণ জনতা এই কূটকথা বুঝতেই পারেনি।

(আবার আগামীকাল)

এদেশ ওদেশ ১

(শুরু করছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। বুঝতেই পারছেন লেখাটি সামান্য বড়, তাই কয়েক পর্বে এখানে দেব।)

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এই চব্বিশ বছর পাকিস্তান শাসনে ছিল বিভক্ত বাংলার টুকরো। পূর্ব ও পশ্চিম নামকরণেই ছিল বিচ্ছিন্নতার আভাস। আসলে পাকিস্তানের শাসকেরা কখনোই পূর্বপ্রান্তের এই ভূমিকে তাদের উপনিবেশের বেশী কিছুই ভাবতে পারত না। আর এর কারনও ছিল বহুমুখী। ভাষাগত, খাদ্যাভ্যাসগত, সংস্কৃতিগত পার্থক্য কোনোদিনই দুই প্রান্তকে কাছে তো আনেইনি, উল্টে শাসকের অহমিকায় দূরে ঠেলে দিয়েছিল।

আপাদমস্তক গরীব এই অঞ্চল থেকেই চব্বিশ বছর পাকিস্তান লুঠ করে তাদের রাজধানীতে নিয়ে যেত শষ্যসম্পদ থেকে জাত বিপুল পরিমাণে কর। অথচ উন্নয়ণের জন্য ফেরত আসত না কিছুই।

সাম্রাজ্যবাদী শাসকের শাসনযন্ত্রের নিয়মে পূর্ব পাকিস্তানে তখন বাসা বেঁধেছিল মূল পাকিস্তান ভূখণ্ডের কিছু লোক আর সাতচল্লিশে দেশভাগের সময়ে ভারতের বিহার, উত্তরপ্রদেশের কিছু মানুষ। কিন্তু পূর্বপ্রান্ততে বাসা বাঁধলেও, তারা উর্দু, আরবী বা ফার্সি না জানা বা বলা বাঙালিদের মানুষ বলে মনেই করত না। তারা ছিল মূল শাসকদের এজেন্ট। এরাই পরবর্তীতে রাজাকার, আলবদর এর মত কুখ্যাত হত্যাকারী সংগঠনগুলির স্রষ্টা।
মৌলানা ভাসানী, শেখ মুজিবরের নেতৃত্বেই যে প্রথম ওপারের বাঙালি মাথা তুলেছিল তা নয়। তাদের শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ছিল ভাষা আন্দোলন। এরপরও ছোটখাটো কিছু আন্দোলন দানা বাঁধলেও বিস্ফোরণ ঘটলো ১৯৭০ এ পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রায় কে গায়ের জোরে পাকিস্তানি শাসকেরা রদ করতে চাওয়ায়।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কিম্বা তার আগের ইতিহাসের পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্য এই প্রতিবেদন নয়। ইতিহাস সবার জানা, বহু চর্চিত। আমরা শুধু প্রেক্ষাপট বুঝতে বেশ কিছুটা পেছনে একটু অনুসন্ধানে যাই।

উনবিংশ শতকে অনেকগুলি ঘটনা ইংরেজ শাসকদের চিন্তিত করেছিল। একের পর এক বিদ্রোহ আর তার ফলস্বরূপ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে রাজশক্তির ভারত অধিগ্রহণ। এই বিক্ষোভের মাত্রা কমানোর উদ্দেশ্যেই ১৮৮৫ তে অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম কে দিয়ে তৈরী করা হল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নামে ধামাধরা সংগঠনের। সশস্ত্র বিপ্লবের প্রশমনের উদ্দেশ্যে এই সংগঠন কাজ করবে নরম পন্থায় তা ধরেই নেওয়া হয়েছিল। আর কার্যত হয়েছিল তাই।

বলতে কি এই কংগ্রেস কোনোদিনই সংগঠিত দল ছিলনা, আদতে এ এক মঞ্চ। আর শাসকের কাছে অগ্রাধিকার পাওয়ায় বেশ কিছুটা ক্ষমতা সম্পন্ন। তাই এর মারফত ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যাওয়ার জন্য শীর্ষ স্তরের নেতৃত্বে ছিল তীব্র প্রতিযোগিতা ও হরেক বৈধ বা অবৈধ কৌশল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই বোঝা গেছিল ইংরেজ আর তাদের এই ব্যায়বহুল উপনিবেশ ধরে রাখবে না। তাহলে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে কার হাতে? স্বাভাবিকভাবেই প্রিয়পাত্র কংগ্রেস ই দৌড়ে এগিয়ে।

(চলবে)

এদেশ ওদেশ ৫

(বর্তমানে পাকিস্তান অশান্ত। আজ থেকে কয়েক বছর আগে আমার “এদেশ ওদেশ” নিবন্ধে লিখেছিলাম এরকম ঘটনা ওখানে বারবার হয়, কেন হয়। প্রকাশিত সেই পূর্ণ নিবন্ধের কিছুটা অংশ মাঝে মধ্যে তুলে দেব। পাঠকের দেখুন কিছু বোঝেন কি না।)

মজার ব্যাপার হলো, চরম দক্ষিণপন্থার মৌলবাদকে প্রতিরোধ করতে পারত যে বামপন্থী কমিউনিস্ট দল, তারাই জন্মলগ্ন থেকেই অদ্ভুত মতাদর্শগত দ্বন্দ্বে সর্বদাই লিপ্ত থাকত, আর কিছু সময় অন্তরই টুকরো হতে থাকত। নরম কমিউনিস্ট, মধ্যপন্থী কমিউনিস্ট, চরমপন্থী কমিউনিস্ট। আবার এক জাতীয় মতাদর্শেও বহু আলাদা আলাদা আণুবীক্ষণিক দল। অথচ, ধর্মীয় ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দলগুলো টুকরো হওয়া তো দূরের কথা বিভিন্ন শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে বেড়েই চলছিল। এর আরেক কারন হলো, মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও, বহু বামপন্থী দলও সেই ভোটবাদী হয়ে ধর্মীয় ওড়নায় মাঝেমধ্যে মাথা ঢাকতে শুরু করেছিল। মানুষ এটাও ভালোভাবে মেনে নেয়নি। ফলতঃ বাড়বাড়ন্ত মৌলবাদের।

ওপারের দেশ পাকিস্তানের অবস্থা প্রায় কাছাকাছি হয়েও স্বতন্ত্র কারনে বিভাজিত হচ্ছিল।

সীমানার ওপারে বিভাজনের সমস্যা বুঝতে আরোও পিছিয়ে যেতে হয়। পৃথিবীর প্রথম ধর্ম ভিত্তিক দ্বেষ এবং তার আধারে যুদ্ধ ছিল ক্রুশেড। খ্রীস্টান ও ইসলাম ধর্মের এই বিবাদও আধারিত ছিল সাম্রাজ্য কেন্দ্রিক মূলতঃ ভূমি দখলের লড়াই। আসলে তখন ওই জাতীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে যুদ্ধে পরস্পর বিবাদমান প্রতিবেশী দেশগুলোকে একত্রিত করে মুসলমান শাসকদের সাম্রাজ্য দখলের ফন্দির হোতা ছিল ইউরোপ। ধর্মীয় জিগির তুলে কার্যসিদ্ধির চেষ্টা সেই শুরু।

চারশো বছর অতিক্রান্ত তবু সেই অপচেষ্টা সমানে অব্যাহত। ইউরোপের সাম্রাজ্য সূর্য অস্তমিত হলে আসরে নামলো আমেরিকা। পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য বহাল রাখার জন্য তারা যেকোনো কুকাজ করতে পিছপা হলো না। ধর্মীয় জিগির তুলে হোক কিম্বা সুশিক্ষিতের ছদ্মবেশে হোক দুনিয়ায় তাদের থাবা কায়েম হচ্ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তর সময়ে পরমানু শক্তিধর আমেরিকা নিজের স্বার্থে বিভিন্ন দেশে নিজের প্রতিনিধি বসানোর চেষ্টা করছিল। ফলস্বরূপ তেলসমৃদ্ধ মধ্য এশিয়া আর দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে দ্রুত বিভিন্ন উপায়ে শাসক পরিবর্তন ঘটছিল। আগেই বলেছি ভারতীয় উপমহাদেশ সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এর চতুর্দিকে শক্তির আকর এর খনি। তাই ইরান, ইরাক, তুরস্ক, সৌদি আরব, লেবানন, আরব আমীরশাহী, ইজরায়েল সমেত মধ্য এশিয়া করায়ত্ত করার পরেও তাদের দরকার ছিল উপমহাদেশের মালিকানা। একদিকে রাশিয়া অন্যদিকে চীন হয়ে উঠছিল প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি।

ভারত নিজেকে জোট নিরপেক্ষ ঘোষণা করেও রাশিয়ার মিত্রজোটে সামিল হয়ে গেল। অতএব পাকিস্তান কে যেন তেন উপায়ে নিজের দিকে টানতেই তার আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে লাগলো আমেরিকা। সামরিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক সবরকম সাহায্য অবাধে আসতে লাগলো। মধ্য এশিয়ায় অবাধ্যদের শায়েস্তা আর রাশিয়াকে সহবত শেখানোর জন্য তৈরী হল ফ্রাঙ্কেস্টাইন সাদ্দাম হোসেন, বিন লাদেন ইত্যাদি এবং তাদের সুসজ্জিত সামরিক বাহিনী।
পাকিস্তানেও গণতন্ত্র ভন্ডুল করে নিজের জোহুজুর কে বসানোর জন্যই এভাবেই সাদ্দাম বা লাদেন যুগের কয়েক দশক আগেই হয়েছিল আমেরিকার প্রচ্ছন্ন মদতে সেনা অভ্যুত্থান।

জিন্নাহ্ যুগ যে পাকিস্তানের স্বর্ণযুগ ছিল, তা বলব না। কিন্তু এই সময়ে অন্তত সেই দেশের নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক ধর্মীয় শাখার বিবাদ ছিলনা। ছিল গণতন্ত্র। ছিলনা আমেরিকা বা কোনো বৃহৎ শক্তির চাটুকারবৃত্তি। উচ্চশিক্ষিত এই মানুষটির সম্পর্কে বিরোধী মৌলবাদীরা যাই প্রচার করুক, কিম্বা শাসক হিসেবে তাঁর সাফল্য অসাফল্যের যতই চুলচেরা বিচার হোক, মানুষ হিসেবে জিন্নাহ্ সাহেব ছিলেন সাচ্চা। নরমপন্থী চিহ্নিত করে জিন্নাহ্ কে গান্ধীর মতোই ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে ক্ষমতাহীন করার কাজ তলেতলে শুরু হয়ে গেছিল তাঁর জীবিতকালেই।

জিন্নাহ্ শাসনের অন্তকেই ধরা যেতে পারে উপমহাদেশের কালো অধ্যায়ের সূচনা। জেনারেল আইয়ুবের সময় থেকেই পারস্পরিক দ্বেষে বিভাজিত হতে থাকল প্রাচীন ঐতিহ্যের সুসভ্য সমাজ।

(যদি কেউ সত্যিই পড়েন তাহলে বাকি অংশ পরে দেব)

যুদ্ধ ১০ শেষ পর্ব

27568 আজ যুদ্ধ সম্পর্কিত আমার লেখার শেষ দিন। এর মধ্যেই এই লেখা সম্পর্কে বহু ফোন পেয়েছি। হুমকি পেয়েছি লেখা বন্ধ করার জন্য। ফেসবুক একবার বাহাত্তর ঘন্টার জন্য ব্লক করেছে। এখনো পর্যন্ত অ্যাকাউন্ট রেস্ট্রিকটেড করে রেখেছে ওরা যাতে বেশী মানুষের কাছে এই লেখার নোটিফিকেশন না যেতে পারে। কিন্তু সেদিন বলেছিলাম সেই বিখ্যাত পুরুষের মহান উক্তি আমার লাইটহাউস। শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “তোমরা আমাকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।” তাই লেখা বন্ধ করি নি। ফলস্বরূপ পেয়েছি অসংখ্য পরিচিত, অপরিচিতের সমর্থন। তাঁদের অনেকেই আমাকে বহু তথ্য যুগিয়েছেন, যা আমার অজানা ছিল। আজ সকালেই বন্ধু সুভাষ বন্দ্যোপাধ্যায় ফোন করে অনেক অজানা তথ্য জানালেন আর জানালেন দু হাত তুলে সমর্থন। এই সব প্রশ্রয় সম্বল করে আমি এগিয়ে যাই। এই ভালোবাসাই আমার পুরস্কার। আমার আর কোনো সরকারি পুরস্কারের দরকার নেই।

274572 ইতিহাস বলছে ১৯৯১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত যুদ্ধ হয়েছে ৭৯ টি এবং ২০০৩ থেকে ২০২১ পর্যন্ত যুদ্ধ হয়েছে ১১৬ টি। এই সব যুদ্ধের মধ্যে অধিকাংশই ছোট ছোট দেশের নিজেদের মধ্যে বড় শক্তিধর দেশের উস্কানিতে বা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্যে সংঘটিত হয়েছে। আর এদের মধ্যে বেশ কিছু যুদ্ধ এখনো চলছে। মানব সভ্যতায় যুদ্ধের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। বলা যায় পুরাতন প্রস্তর যুগ থেকে নূতন প্রস্তর যুগে উন্নীত হওয়ার সময় থেকেই বিভিন্ন গোষ্ঠীর শিকারের তাগিদে এলাকা দখলের লড়াই থেকেই বৃহৎ যুদ্ধের সূচনা। আর সেই থেকে ঠিক কত যুদ্ধ হয়েছে তার সঠিক হিসাব কেউ দিতে পারবেন না। তবে যে কোনো যুদ্ধের পিছনে আছে অনন্ত অধোগামী লোভ। এখনো যে সব যুদ্ধ চলছে তার পিছনে একই কারণ।

যে কোনো দেশে এক‌টি ভোট সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পরে যে হারজিতের বিশ্লেষণ হয় তাতে যেমন কোনো এক‌টি কারণ থাকতে পারে না, যুদ্ধের ক্ষেত্রেও ঠিক একই ব্যাপার। কোনো যুদ্ধ মাত্র এক‌টি কারণের উপরে নির্ভর করে হয় না। ছোট বড় অসংখ্য কারণ, অসংখ্য স্বার্থ তার পিছনে কাজ করে। বর্তমানে যে যুদ্ধটি সর্বত্র আলোচিত হয়ে চলেছে তা হলো রাশিয়া – ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের পিছনেও আছে অসংখ্য কারণ। সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকাকালীন তার সঙ্গে পশ্চিমী শক্তির ঠান্ডা লড়াই চলছিল এবং যার পরিণতিতে সোভিয়েত সংঘ ভেঙে যায় এ কথা আগেই বলেছি। সেই সোভিয়েত থাকাকালীন সময়ে ১৯৫৪ সালে তৎকালীন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকিতা ক্রুশ্চেভ তাঁদের রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য রাশিয়া প্রদেশ থেকে ভেঙে ক্রিমিয়াকে ইউক্রেন প্রদেশের সঙ্গে সংযুক্ত করেন। সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পরে দেখা যায় তার সর্ববৃহৎ প্রদেশ রাশিয়ার চারদিকে যে সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলো সেগুলি প্রায় সবই NATO জোটভুক্ত দেশগুলির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। আর সোভিয়েতকে ভয় পাওয়া পশ্চিমী শক্তির জোট সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পরেও রাশিয়াকে ভয় পেতে শুরু করল, তার একমাত্র কারণ দেশটির আয়তন এত বড় এবং সেখানে থেকে যাওয়া প্রাক্তন সোভিয়েতের অস্ত্রভাণ্ডার এতটাই বেশী যে NATO জোটের আশংকা হয়েছিল সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পরেও বাকি পৃথিবীর উপরে তাদের আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পনা সম্ভবতঃ কার্যকর হতে বাধা দেবে রাশিয়া। ফলস্বরূপ রাশিয়ার চারপাশে একের পর এক অস্ত্র ও সেনাঘাঁটি তৈরী করে দেশটিকে মানসিক চাপের মধ্যে রাখার চেষ্টা করতে থাকল NATO। এদিকে ২০১৪ সালে রাশিয়া দাবী করে বসল ক্রিমিয়ার। তাদের দাবী ছিল ক্রিমিয়া রাশিয়ারই অংশ যা শাসনতন্ত্রের সুবিধার জন্য ইউক্রেনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছিল।

এই দাবী শুধুমাত্র এক খণ্ড জমির জন্য ছিল না। এর পিছনেও ছিল বহু জটিল অংক। প্রথমতঃ ক্রিমিয়া এবং ইউক্রেনের দক্ষিণ পূর্বের ভূমির নীচে আছে বৃহৎ প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার। যা ছিল রাশিয়া এবং NATO জোট উভয়েরই প্রাথমিক লক্ষ্য। দ্বিতীয়ত, ইউক্রেনের অধিবাসীদের এক বড় অংশ সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকাকালীন সময়ে রাশিয়া থেকে আগত, যারা এখনো রুশভাষী। তৃতীয়ত, ক্রিমিয়া ইউক্রেন থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এক অংশ যেখানে অস্ত্র ও সেনাঘাঁটি বসাতে পারলে সরাসরি রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর উপরে মিসাইল হানা করা সম্ভব। এছাড়াও বহু কারণ ছিল সেদিন ক্রিমিয়া সম্পর্কিত। যাইহোক ২০১৪ তে ক্রিমিয়ার অধিবাসীদের এক বড় অংশ বিদ্রোহ ঘোষণা করে ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। এই সুযোগ হাতছাড়া না করতে চেয়ে সেদিন কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ক্রিমিয়াতে ঢুকে বিদ্রোহীদের সাহায্য করে রাশিয়ান সৈন্যবাহিনী এবং ক্রিমিয়া ইউক্রেনের দখল থেকে চলে আসে রাশিয়ার দখলে।

“The 1954 transfer of Crimea, home to the Black Sea Fleet, from the Russian SFSR to the Ukrainian SSR came at the direction of Soviet premier Nikita Khrushchev. It was viewed as an insignificant “symbolic gesture”, as both republics were a part of the Soviet Union and answerable to the government in Moscow. Crimean autonomy was re-established after a referendum in 1991.

Although an independent country since 1991, as a former soviet socialist republic, Russia considers Ukraine part of its sphere of influence. Iulian Chifu and his co-authors say that, in regard to Ukraine, Russia pursues a modernized version of the Brezhnev Doctrine on “limited sovereignty”, which dictates that the sovereignty of Ukraine cannot be larger than that of the Warsaw Pact prior to the demise of the Soviet sphere of influence with the Revolutions of 1989. This claim is based on statements of Russian leaders that possible integration of Ukraine into NATO would jeopardize Russia’s national security.

Following the dissolution of the Soviet Union in 1991, Ukraine and Russia retained very close ties for decades. Yet there were several sticking points, most importantly Ukraine’s significant nuclear arsenal, which Ukraine agreed to abandon in the Budapest Memorandum on Security Assurances (December 1994) on condition that Russia and the other signatories would issue an assurance against threats or use of force against the territorial integrity or political independence of Ukraine. In 1999, Russia signed the Charter for European Security, where it ‘reaffirmed the inherent right of each and every participating State to be free to choose or change its security arrangements, including treaties of alliance, as they evolve’.

Another point was the division of the Black Sea Fleet. Ukraine agreed to lease a number of naval facilities including those in Sevastopol, so that the Russian Black Sea fleet could continue to be based there together with Ukrainian naval forces. Starting in 1993, through the 1990’s and 2000’s, Ukraine and Russia engaged in several gas disputes. In 2001, Ukraine, alongwith Georgia, Azerbaijan, and Moldova, formed a group called GUAM Organization for Democracy and Economic Development, which Russia saw as a direct challenge to the Commonwealth of Independent States, the Russian-dominated trade group established after the collapse of the Soviet Union.
Russia was further irritated by the Orange Revolution of 2004, in which the pro-European Viktor Yushchenko was elected president instead of the pro-Russian Viktor Yanukovych. Moreover, Ukraine continued to increase its cooperation with NATO, deploying the third-largest contingent of troops to Iraq in 2004, and dedicating peacekeepers to NATO missions such as the ISAF force in Afghanistan and KFOR in Kosovo.”

ইউক্রেনের উপরে NATO জোটের এই প্রভাব ভালো চোখে দেখেনি মস্কো। তাই ক্রিমিয়াকে ইউক্রেন থেকে আলাদা করে তারা ক্ষান্ত থাকল না। কড়া নজর রাখল ইউক্রেনের উপরে আর যে মুহূর্তে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেস্কি ইউক্রেনকে NATO জোটে নেওয়ার জন্য আবেদন জানালেন তখন শিয়রে সমন দেখল রাশিয়া। আর শুরু হয়ে গেল একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে আরেক বৃহৎ যুদ্ধ।

এই যুদ্ধের ফলাফল কি হবে কিম্বা কতদিন স্থায়ী হবে তা এখন অজানা। ইতিমধ্যেই NATO জোটের প্রধান দেশ আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য দেশগুলি ইউক্রেন প্রেসিডেন্টের আবেদন সত্বেও সরাসরি যুদ্ধে যুক্ত হতে অরাজী হয়েছে, তার একটিই কারণ, তা হলো এরকম হলেই শুরু হয়ে যাবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং আজকের ভয়াবহ অস্ত্রের সম্ভারে পূর্ণ পৃথিবীর পরবর্তী অবস্থা কি হবে তা কেউ বলতে পারবে না। আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলি নানারকম অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে রাশিয়ায় বিরুদ্ধে। কিন্তু সর্বশেষ খবর অনুযায়ী রাশিয়ার পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের উপরে যে আমেরিকান নিষেধাজ্ঞা জারী হয়েছে তা খারিজ করে দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কারণ তাদের দেশগুলির ৬৫ শতাংশ পেট্রোলিয়াম ও গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে, যা বন্ধ হলে অচল হয়ে যাবে ইউরোপ।

যে কোনো যুদ্ধ চলার সময়ে এক পক্ষ অন্য পক্ষের প্রতি মানবতাবিরোধী নানারকম কাজের অভিযোগ আনে। এই যুদ্ধের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। ইতিমধ্যেই অভিযোগ এসেছে রাশিয়ার আক্রমণের জন্য বারো লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে, ইউক্রেনের এক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মারক সৌধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কতিপয় সাধারণ মানুষ মারা গেছেন যুদ্ধে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ক্ষতির নিন্দা করছি আমি, ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সর্বাত্মক সহানুভূতি। কিন্তু আরেক দিকে দৃষ্টিপাত করতে চাই। মনে আছে কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পরাজিত জার্মানির সেনানায়কদের বিচার হয়েছিল আন্তর্জাতিক আদালতে এবং তাঁদের শাস্তি হয়েছিল। অথচ পরবর্তীতে ভিয়েতনাম যুদ্ধে ভয়াবহ ধ্বংস, হত্যা, ধর্ষণ লীলা চালিয়েও পরাজিত হওয়ার পরে মার্কিন বা ফ্রান্সের রাষ্ট্রনায়ক ও সেনানায়কদের কোনো বিচারের সম্মুখীন হতে হয় নি। বলতে কি কারো সেই বিচারের প্রসঙ্গ উত্থাপনের সাহসই ছিল না, কারণ তারা বৃহৎ শক্তি। ইরাক যুদ্ধের পরে বাগদাদে খলিফা হারুন অল রশিদের সময়কালের মিউজিয়াম ধ্বংসের ছবির কথা মনে আছে? সেই সময়ের বহু সংবাদপত্রে ছবি সহ খবর প্রকাশিত হয়েছিল। প্রায় তিন হাজার বছরের পুরোনো বাগদাদের প্রাচীন লাইব্রেরী ও স্মৃতি সৌধগুলি লুট ও ধ্বংস করেছিল একের পর এক মার্কিন সেনাবাহিনী। তাদের কোনো বিচার হয় নি। আফগানিস্তানে মার্কিন ও পাক মদতপুষ্ট মুজাহিদীন বাহিনী তাদের উপস্থিতিতেই বামিয়ানে আড়াই হাজার বছরের বিশালকায় পুরোনো প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করেছিল। এক‌টি শব্দও খরচ করে সেই ধ্বংস আটকানো বা তার নিন্দা করা হয় নি মার্কিন তরফ থেকে। বাংলাদেশে মার্কিন মদতপুষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং রাজাকার – আলবদর বাহিনী প্রায় তিরিশ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছিল, ধর্ষিতা হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন প্রায় চার লক্ষ বাঙালি রমনী, সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান (যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ) হয়ে গেছিল ধ্বংসস্তুপ। অথচ পরাজিত পাক বাহিনীর বিচারের জন্য এগিয়ে এসে দাবি করে নি কোনো মার্কিন মানবতাবাদী। সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের প্রত্যেক দেশে অজস্র মানবতাবিরোধী হত্যা, ধ্বংস চালিয়েছে মার্কিন সেনা বা তাদের মদতপুষ্টরা। কিউবাতে ৯০ বছরের জীবনে সেই দেশের প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রোকে ৬৩৮ বার হত্যার চেষ্টা করে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর চরেরা এই চেষ্টা চালায়। ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতার সঙ্গে হত্যা করা হয় চে গুয়েভারাকে। তল্পিবাহক পিনোচেত এর দ্বারা হত্যা করা করা হয় চিলির পাবলো নেরুদাকে। আন্তর্জাতিক আদালতে, রাষ্ট্রসংঘে এক‌টি শব্দও উচ্চারিত হয় নি সেদিন। এরকম অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে প্রত্যেক যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে। যুদ্ধ অবশ্যই মানবতাবিরোধী। কিন্তু তার জন্য সেই প্রত্যেক পক্ষই দায়ী হওয়া উচিৎ যারা যুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে এবং নিজেরা ধ্বংস করে।

যুদ্ধ কখনো কোনো স্থায়ী সমাধান আনে না। একটা যুদ্ধ পরবর্তী যুদ্ধের প্রস্তুতি মাত্র। সর্বশেষ যুদ্ধের যে ছবি আমাদের কাছে এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে কয়েক লক্ষ নিরীহ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে শরণার্থী হয়েছেন, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে অজস্র বাড়ি, অফিস, স্মারক। মারা গেছেন এবং যাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। মনে রাখতে হবে দু দেশের যে সৈন্যরা মারা গেছেন বা যাচ্ছেন তাঁরাও কারো সন্তান, কারো বাবা – মা, তাঁরাও মানুষ। সুতরাং মানুষ মারছে মানুষকে সামান্য লোভের জন্য, স্বার্থের জন্য। অথচ প্রত্যেকটি দেশ যদি নিজের সম্পদ নিয়ে সুখী হতো, যদি বিভিন্ন মানবতাবাদী আবিষ্কারের মাধ্যমে নিজেদের উন্নত করার কাজে ব্যস্ত থাকত, যদি অন্যের সম্পদের জন্য লোভ না করে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিত, তাহলে এত ধ্বংস, এত হত্যা, এত রক্তপাত মানুষকে দেখতে হতো না। অথচ অবুঝ লোভী মানুষের জন্যই তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। দেখা যাক আগামী পৃথিবীর আগামী প্রজন্ম কখনো এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে কি না! আমরা আশায় বাঁচি।

পাঠককে ধন্যবাদ ও প্রিয়তে জানিয়ে আজ আপাতত বিদায় নিলাম। ফিরে আসব ফের কোনো অবিচারের প্রতিবাদ জানিয়ে।

(শেষ)

যুদ্ধ ৯

274572

কেউ কেউ ভাবতে পারেন এতক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধের নানান বিবরণীতে বারবার কেন মার্কিন আগ্রাসনের কথা লিখছি! মতাদর্শগত বিষয় সম্পর্কে পুঁজিবাদ, সমাজবাদ, গণতন্ত্র ইত্যাদি ইত্যাদি বিশদে কেন যাচ্ছি না! আসলে আমি কোনো বিশেষ দেশ বা মতবাদের পক্ষে বা বিপক্ষে লিখতে বসিনি। আমার উদ্দেশ্য হলো, মুখে আধুনিকতা, গণতন্ত্র, মানবতাবাদ ইত্যাদির বুলি আওড়ে চলা বৃহৎ শক্তিগুলি প্রায় প্রত্যেক দশকে তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষার তাগিদে কারণে অকারণে অন্য দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায়, জমি দখল করে, সম্পদ দখল করে। এই মুখোশ মাঝেমধ্যে খুলে যায়, তবুও নির্লজ্জের মত যুদ্ধের সপক্ষে তারা অলৌকিক ও অবাস্তব কারণ তৈরী করে নেয়। আর সারা পৃথিবী ভয়ে তা শুনতে বাধ্য হয়।

এরকমই এক‌টি মিথ্যার ভিত্তিতে হয়ে গেছিল আরেকটি উপসাগরীয় যুদ্ধ, যা ইরাক আমেরিকা যুদ্ধ নামে কুখ্যাত। এই যুদ্ধের সম্পর্কে জানার আগের পরিস্থিতি জানা বিশেষ প্রয়োজন। মধ্য এশিয়ার বিশাল পেট্রোলিয়াম সম্পদের ওপরে আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলির নজর বহুদিনের। আর এই দখলের জন্যই সংঘটিত হয়ে গেছে ইরান – ইরাক যুদ্ধ। সেই সময়ে ইরাকের মদতদাতা ছিল ন্যাটো জোট। ইরাকের তৎকালীন শাসক সাদ্দাম হোসেন মার্কিন শক্তির সাহায্যেই ইরাকের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ঠিক যেমন সন্ত্রাসী ওসামা বিন লাদেন আমেরিকার সাহায্যেই প্রথমে দুনিয়ার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু ইরান – ইরাক যুদ্ধে পরাজয়ের পরে সাদ্দামের আমেরিকা প্রীতিতে চিড় ধরে এবং হাতে না মারতে পেরে ভাতে মারার উদ্দেশ্যে সাদ্দাম তার নিজের দেশের তৈলকূপগুলিতে উৎপন্ন পেট্রোলিয়ামের বাজার দর কমিয়ে দেয়। ফলে বিপদে পড়ে আমেরিকা ও তার মিত্রদেশ পরিচালিত সংগঠন ওপেক এর তেল ব্যবসা। অতএব ইরাককে শায়েস্তা করতে প্রচার করা হলো ইরাক নাকি ইউরোপ আক্রমণের উদ্দেশ্যে রাসায়নিক অস্ত্র তৈরী করছে। স্রেফ এই মিথ্যা অজুহাতে সেদিন শুরু হয়েছিল আরেক যুদ্ধ।

ইরাক যুদ্ধ (মার্কিন অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম নামেও পরিচিত; অন্য নাম: অপারেশন টেলিক, ইরাক দখল) একটি চলমান যুদ্ধ যা ২০০৩ সালের ২০শে মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত বাহিনীর ইরাক আগ্রাসনের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। এই আগ্রাসী বাহিনীতে অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, পোল্যান্ড এবং অন্যান্য কয়েকটি জাতির সৈন্যদল অংশ নিয়েছিল।

ইরাক আক্রমণ করার জন্য তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ ও কোয়ালিশন বাহিনী যে কারণ দেখিয়েছিল তা হল: ইরাক ১৯৯১ সালের চুক্তি অমান্য করে গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণ করছে এবং তাদের কাছে এ ধরনের অস্ত্রের মজুদও আছে। তখন সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছিল, ইরাক যুক্তরাষ্ট্র, এর জনগণ এবং মিত্র রাষ্ট্রগুলোর জন্য বড় ধরনের হুমকি। পরবর্তীতে আমেরিকা সমর্থক কর্মকর্তাদের প্রচণ্ড সমালোচনা করা হয়। কারণ আগ্রাসনের পরে পরিদর্শকরা ইরাকে গিয়ে কোন ধরনের গণবিধ্বংসী অস্ত্র খুঁজে পায়নি। তারা জানায়, ইরাক ১৯৯১ সালেই গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণ ত্যাগ করেছে, ইরাকের উপর থেকে আন্তর্জাতিক অনুমোদন সরিয়ে নেয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের নতুন করে গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণের কোন পরিকল্পনাও ছিল না। এখানে সেখানে ছড়িয়ে থাকা যা কিছু অস্ত্র পাওয়া গেছে আগেরগুলোরই ভগ্নাবশেষ। এগুলোর জন্য মার্কিন বাহিনী ইরাক আক্রমণ করেনি। কোন কোন মার্কিন কর্মকর্তা দাবী করেন যে, সাদ্দাম হোসেন আল-কায়েদাকে সহযোগিতা করছেন, কিন্তু এর পক্ষেও কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তার পরও আগ্রাসনের কিছু কারণ দেখানো হয়েছে। যেমন: ফিলিস্তিনের আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করা, ইরাকী সরকার কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা এবং ইরাকের তেল সম্পদ অধিগ্রহণ করা। অবশ্য সর্বশেষ কারণটির কথা মার্কিন কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করেছে।

আগ্রাসী বাহিনী আক্রমণ করার পরপরই ইরাকী সামরিক বাহিনী পরাজিত হয়। রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হোসেন পালিয়ে বেড়ায়, অবশেষে ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে তাকে আটক করা হয়। ২০০৬ এর ডিসেম্বরে সাদ্দামের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মার্কিন কোয়ালিশন বাহিনী ইরাক দখল করে সেখানে একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের চেষ্টা চালায়। কিন্তু আগ্রাসনের পরপরই কোয়ালিশন বাহিনীর বিরুদ্ধে এবং ইরাকের বিভিন্ন পন্থী দলগুলোর মধ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে অপ্রতিসম বিভিন্নমুখী আক্রমণের মাধ্যমে ইরাকী অভ্যুত্থানের সূচনা ঘটে। সুন্নি এবং শিয়া দলগুলোর মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং আল-কায়েদা ইরাকে তাদের কার্যক্রম ত্বরান্বিত করে। এই যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা আনুমানিক ১৫০,০০০ থেকে ১০ লক্ষের বেশি। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় হয়েছে ৮৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চেয়েও বেশি, আর যুক্তরাজ্যের ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন ইউরো। উল্লেখ্য এই সময়ে মার্কিন অর্থনীতির মোট ব্যয়ের পরিমাণ ৩ থেকে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের মধ্যে। এক পর্যায়ে কোয়ালিশনের বেশ কিছু রাষ্ট্র ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করে। গণ অসন্তোষ এবং ইরাকী বাহিনীর প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেয়ার কারণেই এই প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শুরু হয়।

১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধ শেষ হবার পর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ রিজলিউশন ৬৮৭ সংশোধনের মাধ্যমে আদেশ জারি করে যে, ইরাকের সকল ধরনের রাসায়নিক, জৈব, নিউক্লীয় এবং দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রোগ্রাম অবিলম্বে বন্ধ করে দিতে হবে। জাতিসংঘ বিশেষ কমিশন কন্ট্রোলের (ইউএনএসকম) মাধ্যমে এই আদেশ প্রচার করা হয়। জাতিসংঘ পরিদর্শকদের উপস্থিতিতে ইরাক বিপুল পরিমাণ গণবিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংস করে, তার পরও কিছু বস্তুনিষ্ঠ ইস্যুর সমাধান হয়নি। ১৯৯৮ সালে পরিদর্শক দল ইরাক ত্যাগ করে, কারণ কমিশন কন্ট্রোলের প্রধান রিচার্ড বাটলার বুঝতে পারছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সামরিক মহড়া আসন্ন। পরিদর্শকেরা চলে আসার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ৪ দিনব্যাপী বোমা বিস্ফোরণের মহড়া চালায়।

জাতিসংঘ পরিদর্শনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য (১৯৯৮ পর্যন্ত ফ্রান্স) উত্তর ও দক্ষিণ ইরাকের নো-ফ্লাই জোনে ইরাকের সাথে ছোটোখাটোো যুদ্ধে লিপ্ত হয়। উপসাগরীয় যুদ্ধের পর উত্তর ও দক্ষিণ ইরাকের শিয়া অঞ্চলের কুর্দিস্তান রক্ষার জন্য এই নো-ফ্লাই জোন তৈরি করা হয়েছিল। ইরাক সরকার এটাকে ইরাকের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন বলে মনে করতো। সেখানে ইরাক আকাশ-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে মার্কিন ও ব্রিটিশ আকাশ পেট্রোলের নিয়মিত ছোট আকারের গোলাবারুদ বিনিময় চলতো।

২০০১ সালের এপ্রিলে বুশের কেবিনেট ইরাকে সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে সম্মত হয়, কারণ ইরাক মধ্যপ্রাচ্য থেকে আন্তর্জাতিক তেল বাজারে একটা অস্থিতিশীল প্রভাব বিস্তার করেছিল। ১১ই সেপ্টেম্বর হামলার অনেক আগেই নিওকনজারভেটিভেরা ইরাকের তেল ক্ষেত্রগুলো আয়ত্তে আনার জন্য একটি ক্যু এর পরিকল্পনা করেছিল। তারা আশা করছিল, “একটি নতুন সরকার ইরাকের তেল ব্যবহার করে ওপেক কোটা থেকে বেশি তেল উৎপাদনের মাধ্যমে ওপেক বাণিজ্য-জোট ভেঙে দিতে সক্ষম হবে।” কিন্তু আগ্রাসনের পরপরই এ পরিকল্পনা ভেস্তে যায়, কারণ শেল অয়েল কোম্পানির তৎকালীন সিইও ফিলিপ ক্যারল (যাকে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল) ইরাকী তেল কারখানাগুলো ব্যক্তি মালিকানায় নিয়ে আসার সাথে জড়িত হতে চাচ্ছিলেন না, যেহেতু জড়িত হলে মার্কিন ফার্মগুলো বর্জন করতে হতে পারে। রাজ্য পরিচালিত তেল মন্ত্রনালয়ের অবশ্য এ ভয় ছিল না, তাই তারা ইরাকে তেল আগ্রাসন চালাতে উদ্যত হয়। মার্কিন তেল বাণিজ্য উপদেষ্টা ফালাহ্ আলজিবারি দাবী করেছেন, ২০০১ সালে বুশ ক্ষমতা পাওয়ার পরপরই ওয়াশিংটন, মধ্যপ্রাচ্য ও ক্যালিফোর্নিয়াতে ইরাকের বর্তমান সরকার উচ্ছেদ বিষয়ে গোপন মিটিং শুরু করেছিলেন। আলজিবারি বিবিসি-কে বলেছেন, তিনি বুশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাদ্দাম হোসেনের প্রভাবশালী উত্তরসূরীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন।

অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম এর এক বছর আগেই যুক্তরাষ্ট্র অপারেশন সাউদার্ন ফোকাস শুরু করেছিল, এর সাড়া দানের কৌশল পরিবর্তনের জন্য। তারা নির্বাচিত লক্ষ্যবস্তু অনেকাংশে বৃদ্ধি এবং ইরাকের নো-ফ্লাই জোনে ঢুকে পড়ার মত কাজকর্মের মাধ্যমে ইরাকের নিয়ন্ত্রণ কাঠামোতে বিঘ্ন সৃষ্টি করার চেষ্টা করছিল। ইরাকে নিক্ষেপিত বোমার ভর ২০০২ সালের মার্চে ছিল ০, এপ্রিলে হয়েছে ০.৩, আর মে-আগস্টে গিয়ে তা হয়েছে ৮-১৪ টনের মত। যুদ্ধের আগে সবচেয়ে বেশি বোমাবর্ষণ ঘটেছিল সেপ্টেম্বরে, সপ্তাহ প্রতি ৫৪.৬ টন।

(চলবে)

যুদ্ধ ৮

274572

আগেই বলেছি ১৯৭১ এর যুদ্ধে ভারত এবং বর্তমান বাংলাদেশ ইউনাইটেড স্টেটস এর রণতরী সপ্তম নৌবহরের আক্রমণ থেকে বেঁচে গেছিল তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিরোধের ফলে। আজ যাঁরা আমেরিকার স্বরূপ না জেনে অথবা জেনেও চোখ বুজে আছেন তাঁদের অনেকের এই ঘটনাটি ভালো না লাগলেও এটাই চরম সত্য। আর এই জন্যই তৃতীয় বিশ্বের কাছে সেদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ত্রাতা। যাইহোক বহু চেষ্টার ফলস্বরূপ ১৯৯১ সালে ভেঙে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর এরপর তৃতীয় বিশ্ব চলে গেল সম্পূর্ণ এক মেরু বিশিষ্ট শক্তির কব্জায়।

সোভিয়েতের পতনের পিছনে আমেরিকা ও ইউরোপীয় বড় দেশগুলির দীর্ঘ প্রয়াস সফল হয় সোভিয়েতের নিজের ভুলে। ব্রেজনেভ প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন একটি সিদ্ধান্ত নেন যা পোল্যান্ড চুক্তি নামে খ্যাত। চুক্তিটি হলো কোনো দেশের কমিউনিস্ট পার্টি যদি হুমকির সম্মুখীন হয় তাহলে সেখানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপ করবে। এই চুক্তি অনুযায়ী আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট প্রশাসন যখন পাক – ইয়াংকি যৌথ হুমকির মুখোমুখি হয় তখন ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে প্রবেশ করল সোভিয়েত সেনাবাহিনী। কিন্তু আগেই বলেছি গেরিলা যুদ্ধের জন্য আফগান জনগণ বিগত আটশ বছর ধরে প্রসিদ্ধ। সেখানে যুদ্ধ করে তাদের দমন করতে পৃথিবীর কোনো শক্তি কখনো সক্ষম হয় নি। তার ওপরে সেখানে কমিউনিস্ট সরকার উৎখাত করার জন্য মুজাহিদীন বাহিনী নামে এক বিদ্রোহী বাহিনী তৈরী করে তাদের অস্ত্র, অর্থ, প্রশিক্ষণ সহ সবরকম সাহায্য দিতে থাকে ইউনাইটেড স্টেটস এবং তাদের সহযোগী পাকিস্তান। ফল যা হওয়ার তাই হলো। মুজাহিদীনদের আচমকা গেরিলা আক্রমণে ক্রমাগত বিপর্যস্ত হয়ে তৎকালীন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলেন আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহার করা হবে ১৯৮৯ এর ১৫ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে এবং এরপর থেকে কোনো দেশে কোনো বিপদ হলে সোভিয়েত সেনা যাবে না। সিদ্ধান্ত কার্যকর করা মাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকা হয়ে গেল। ১৯৭৯-১৯৮৯ দীর্ঘ সোভিয়েত বনাম আফগান মুজাহিদীন – আমেরিকা – পাকিস্তান জোটের লড়াইয়ের সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক সোভিয়েত অনুগামী সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে কমিউনিস্ট সরকারগুলির পতন হতে থাকল ন্যাটো ভুক্ত দেশগুলির চাপে ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। অবশেষে চুয়াত্তর বছর স্থায়ী হওয়ার পরে ভেঙে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন।

এই ঘটনাক্রমের মধ্যেই পৃথিবীর মধ্য স্থানে ঘটে গেছে আরেকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ যা ইরান – ইরাক যুদ্ধ নামে খ্যাত। ইরান-ইরাক যুদ্ধের সূচনা হয় ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ১৯৮৮ সালের আগস্টে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে এর অবসান ঘটে। ইরানের কাছে এ যুদ্ধ অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ (জঙ্গ এ তাহমিলি) এবং পবিত্র প্রতিরোধ (দেফা এ মাক্বাদ্দাস) হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন এ যুদ্ধকে ব্যাটল অব ক্বাদেসিয়া নামে অভিহিত করেন। আদতে ইরান মধ্য এশিয়ার এমন এক বৃহৎ পেট্রোলিয়াম সম্পদের ভাণ্ডার যা দখল করা ন্যাটো ভুক্ত দেশগুলির বহুদিনের স্বপ্ন। সেখানে তাদের মদতে শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে তখত দখল করেন রুহুল্লাহ খোমেইনী। অথচ ক্ষমতা হস্তান্তরের কিছুদিন পরেই ইরানের তৈলকূপগুলি থেকে পশ্চিমী দেশগুলির অবাধ তৈল নিষ্কাশন বন্ধ করে দেয়। তার প্রতিবেশী দেশ ইরাকে তখন মার্কিন মদতে আরেক পুতুল সাদ্দাম হোসেনের সরকার। ধর্মীয় মত অনুযায়ী এই দুই দেশ ইসলামের শিয়া ও সুন্নি দুই আলাদা পথে বিভক্ত। ধর্মীয় মত, সীমানা, পেট্রোলিয়াম নিষ্কাশন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তাদের আগেও মতবিরোধ ছিল আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইরাককে দিয়ে আক্রমণ করানো হলো ইরানকে।

সীমান্ত বিরোধ এবং ইরাকের অভ্যন্তরে শিয়া জঙ্গীদের ইরানি মদত দেয়ার অভিযোগে ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরাকি বাহিনী পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই অবৈধভাবে ইরানি ভূ-খন্ড আক্রমণ এবং সেখানে অণুপ্রবেশ চালায়। সদ্য ঘটে যাওয়া ইরানি ইসলামি বিপ্লবের পরবর্তী অবস্থাকে ব্যবহার করে ইরাক যুদ্ধে দ্রুত অগ্রগতি অর্জনের চেষ্টা চালায়। কিন্তু কার্যত সে চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৯৮২ সালের জুনের মধ্যে ইরান তার হারানো সমস্ত ভূ-খন্ড পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয়। এর পরের ৬ বছর ইরানি বাহিনী যুদ্ধে অগ্রসর ভূমিকায় ছিল। জাতিসংঘের বারবার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ১৯৮৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়। ২০০৩ সালে দু’দেশের মধ্যে সর্বশেষ যুদ্ধবন্দীর বিনিময় ঘটে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কৌশলের সাথে এ যুদ্ধের বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। পরিখা, কাঁটাতার, মানব স্রোত, বেয়নেট চার্জ এ যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। ইরাকি বাহিনী ইরানি সৈন্য, বেসামরিক নাগরিক এবং ইরাকি কুর্দিদের উপর রাসায়নিক গ্যাস এবং মাস্টার্ড গ্যাস প্রয়োগ করে। ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধ পশ্চিমী শক্তিদের স্বার্থে লাগানো হল অথচ মারা গেল ইরান ও ইরাকের অসংখ্য নিরীহ মানুষ। পশ্চিমী বৃহৎ পুঁজিবাজার দ্বারা মধ্য এশিয়ার তেল সম্পদ লুটের জন্য দুই দেশের আভ্যন্তরীণ বিবাদ পরিণত হয়ে গেল মারণ যুদ্ধে।

(চলবে)

যুদ্ধ ৭

274572

যুদ্ধ পাড়ার বাচ্চাদের খেলার ঝগড়া নয় যে খেলতে খেলতে ছোট ছোট অপছন্দে ঝগড়া আবার পরদিন ভাব। যুদ্ধ বড়দের স্বার্থের সংঘাত। ১৯৬৫ র পাক – ভারত যুদ্ধের পরে সিন্ধু নদীতে অনেক জল গড়িয়েছে। ১৯৯১ এ ভেঙে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন। এটা ছিল আমেরিকা ও ইউরোপের বড় দেশগুলির বহুদিনের চেষ্টার ফল। সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকলে পৃথিবী জুড়ে লুঠ চালানো প্রায় অসম্ভব হয় যাচ্ছিল। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যাবে সপ্তদশ শতকের থেকে বিংশ শতক পর্যন্ত টানা প্রায় চারশো বছর ধরে পৃথিবীর দুর্বল দেশগুলি অধিকার করে, উপনিবেশ স্থাপন করে ডাকাতি করেছে ইউরোপের দেশগুলি। এদের মধ্যে প্রধান সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি হলো ব্রিটেন, স্পেন, ফ্রান্স, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, জার্মানি, নেদারল্যান্ড (তৎকালীন হল্যান্ড)। কিন্তু প্রথমে অষ্টাদশ শতাব্দীতে (৪ঠা জুলাই, ১৭৭৬) স্পেন ও ব্রিটেনের উপনিবেশ দুই আমেরিকার স্বাধীনতা এবং পরে বিংশ শতকের গোড়ায় শ্রমজীবী মানুষের দ্বারা পরিচালিত সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান, চীনের মত বড় দেশে রাজতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ক্রমশ বিশ্বের অন্য উপনিবেশগুলির পরাধীন মানুষদের উৎসাহিত করেছিল স্বাধীন হওয়ার জন্য। আর প্রত্যেক স্বাধীনতার মাশুল ছিল যুদ্ধ। ভয়াবহ হিংস্রতা, রক্তক্ষয়, সম্পদ বিনষ্টিকরণ এই যুদ্ধগুলির ফলাফল হিসাবে দীর্ঘদিন প্রভাব রেখেছিল মানুষের জীবনযাত্রায়, মননে, সংস্কৃতিতে। অসংখ্য সাহিত্য, নাটক, গান সৃষ্টি হয়েছিল সেইসব রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের স্মরণে।

যাইহোক, নিজের পরাধীন অবস্থার কথা ভুলে গিয়ে দুই আমেরিকা মহাদেশের মধ্যে প্রধান দেশ ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা মরীয়া হয়ে উঠেছিল নিজেও ঔপনিবেশিক শক্তি হয়ে ওঠার জন্য। পাশাপাশি সঙ্গত করেছিল পূর্ব ঔপনিবেশিক শক্তির গরীমা বিস্মৃত ইউরোপের বড় দেশগুলি। তাদের পরিচালনা করছিল সেইসব দেশের বড় ব্যবসায়ীরা, যাদের মুনাফার ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আসছিল। আর তারই ফলস্বরূপ বেঁধেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

এই দুটি বড় যুদ্ধ ছাড়াও যে সব প্রধান যুদ্ধ হয়েছিল তার মধ্যে এক‌টি ছিল ১৯৭১ সালের ভারত -পূর্ব পাকিস্তান বনাম পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধ, যার সম্পর্কে আগেই কিছুটা বলেছি। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে যে অন্য দেশটির জন্ম হয়েছিল তার আপাত নাম পাকিস্তান হলেও তা এক সঙ্গে জোড়া এক‌টি সমগ্র দেশ ছিল না। ভারতের পশ্চিম প্রান্তে ছিল পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব প্রান্তে ছিল পূর্ব পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষেরা পাখতুন, পুশতুন, পাঞ্জাবী, বালুচ প্রভৃতি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর এবং পূর্ব পাকিস্তানের মানুষেরা ছিলেন মূলতঃ বাঙালি, আর খুব সামান্য অংশ অবাঙালী বিহারী। এত রকমারি ভাষার মানুষ থাকলেও পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় থাকতেন পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবী ও সিন্ধ্রী সম্প্রদায়। এরা ছিলেন বিত্তশালী, ক্ষমতাবান, উচ্চাকাঙ্ক্ষী। নিজেদের স্বার্থে এরা অন্যন্য ভাষাভাষীর মানুষদের দমিয়ে নিজেদের শাসনে রাখতেন। আসলে পূর্ব পাকিস্তানকে তাঁরা ভাবতেন পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ।

“After the partition of India in 1947, Bengali-speaking people in East Bengal, the non-contiguous eastern part of the Dominion of Pakistan, made up 44 million of the newly formed Dominion of Pakistan’s 69 million people. The Dominion of Pakistan’s government, civil services, and military, however, was dominated by personnel from the western wing of the Dominion of Pakistan. In 1947, a key resolution at a national education summit in Karachi advocated Urdu as the sole state language and its exclusive use in the media and in schools. Opposition and protests immediately arose. Students from Dhaka rallied under the leadership of Abul Kashem, the secretary of Tamaddun Majlish, a Bengali Islamic cultural organisation. The meeting stipulated Bengali as an official language of the Dominion of Pakistan and as a medium of education in East Bengal. However, the Pakistan Public Service Commission removed Bengali from the list of approved subjects, as well as from currency notes and stamps. The central education minister Fazlur Rahman made extensive preparations to make Urdu the only state language of the Dominion of Pakistan. Public outrage spread and a large number of Bengali students met on the University of Dhaka campus on 8 December 1947 to formally demand that Bengali be made an official language. To promote their cause, Bengali students organised processions and rallies in Dhaka. The language movement prompted the people of East Bengal (later East Pakistan) to establish a separate national identity, distinct from that of the remainder of Pakistan (later West Pakistan.)”

বাংলা ভাষাকে মুছে দিয়ে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার এই চেষ্টা শুধুমাত্র ভাষাগত ছিল না। এর আসল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে তাদের দাস করে তোলা। অথচ সমগ্র পাকিস্তানের রসদ ও সম্পদের প্রধান যোগানদার ছিল পূর্ব পাকিস্তান। এই চেষ্টার বিরুদ্ধে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি রুখে দাঁড়ালেন পূর্বীরা। গুলি চলল, ভাষা রক্ষায় শহীদ হলেন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। আপাত হার মেনে নিয়ে পিছিয়ে গেল তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা। কিন্তু রাগ তাদের রয়েই গেল। পূর্ব পাকিস্তানের ওপরে আরও বেশী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলো। আরও অনেক বেশী সম্পদ পশ্চিমে নিয়ে যাওয়া শুরু হলো সেখান থেকে পূর্ব অংশকে অবহেলিত, বঞ্চিত, দরিদ্র রেখে। পূর্বের মানুষদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছিল। তার প্রতিফলন দেখা গেল ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে। বিপুল ভোটে পশ্চিম পাকিস্তানী দলগুলিকে হারিয়ে যেই পূর্ব পাকিস্তানের দল আওয়ামী লিগ ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানাল ওমনি হিংস্র হয়ে পশ্চিমের রাজনৈতিক দলগুলি লেলিয়ে দিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে।

“Bangladesh War of Independence, or simply the Liberation War in Bangladesh, was a revolution and armed conflict sparked by the rise of the Bengali nationalist and self-determination movement in erstwhile East Pakistan which resulted in the independence of Bangladesh. The war began when the Pakistani military junta based in West Pakistan under the orders of Yahya Khan launched Operation Searchlight against the people of East Pakistan on the night of 25 March 1971, initiating the Bangladesh genocide. It pursued the systematic annihilation of nationalist Bengali civilians, students, intelligentsia, religious minorities and armed personnel. The junta annulled the results of the 1970 elections and arrested Prime minister-designate Sheikh Mujibur Rahman. The war ended on 16 December 1971 when the military forces of West Pakistan that were in Bangladesh surrendered in what remains to date the largest surrender of soldiers since the Second World War.”

প্রায় দশলক্ষ শরনার্থীর চাপে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যবর্তী দেশ ভারতের। তারা কেন শরনার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে এই ছুতোয় আচমকা পাকিস্তান আক্রমণ করল ভারতকেও। আসলে এই আক্রমণের পিছনে ছিল আমেরিকার উস্কানি। আমেরিকার স্বার্থ ছিল যদি তাদের সাহায্য নিয়ে পাকিস্তান ভারত দখল করতে পারে তাহলে আফগানিস্তান থেকে মায়ানমার (তৎকালীন বার্মা) পর্যন্ত আমেরিকান সমরক্ষেত্র ও ব্যবসাক্ষেত্রের উন্মুক্ত করিডর তৈরী হবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনকে দমিয়ে রাখতে অসুবিধা হবে না। সুতরাং নিজেদের বৈষয়িক স্বার্থে তারা বাধিয়ে দিল যুদ্ধ। ফল আজ সবার জানা। এই যুদ্ধেও প্রবল মার খেয়ে পিছিয়ে গেছিল সাম্রাজ্যবাদ।

“Rural and urban areas across East Pakistan saw extensive military operations and air strikes to suppress the tide of civil disobedience that formed following the 1970 election stalemate. The Pakistan Army, which had the backing of Islamists, created radical religious militias — the Razakars, Al-Badr and Al-Shams — to assist it during raids on the local populace. Urdu-speaking Biharis in Bangladesh (an ethnic minority) were also in support of Pakistani military.[clarification needed] Members of the Pakistani military and supporting militias engaged in mass murder, deportation and genocidal rape. The capital Dhaka was the scene of numerous massacres, including Operation Searchlight and the Dhaka University massacre. An estimated 10 million Bengali refugees fled to neighbouring India, while 30 million were internally displaced. Sectarian violence broke out between Bengalis and Urdu-speaking immigrants. An academic consensus prevails that the atrocities committed by the Pakistani military were a genocide.

The Bangladeshi Declaration of Independence was broadcast from Chittagong by members of the Mukti Bahini the national liberation army formed by Bengali military, paramilitary and civilians. The East Bengal Regiment and the East Pakistan Rifles played a crucial role in the resistance. Led by General M. A. G. Osmani and eleven sector commanders, the Bangladesh Forces waged a mass guerrilla war against the Pakistani military. They liberated numerous towns and cities in the initial months of the conflict. The Pakistan Army regained momentum in the monsoon. Bengali guerrillas carried out widespread sabotage, including Operation Jackpot against the Pakistan Navy. The nascent Bangladesh Air Force flew sorties against Pakistani military bases. By November, the Bangladesh forces restricted the Pakistani military to its barracks during the night. They secured control of most parts of the countryside.

The Provisional Government of Bangladesh was formed on 17 April 1971 in Mujibnagar and moved to Calcutta as a government in exile. Bengali members of the Pakistani civil, military and diplomatic corps defected to the Bangladeshi provisional government. Thousands of Bengali families were interned in West Pakistan, from where many escaped to Afghanistan. Bengali cultural activists operated the clandestine Free Bengal Radio Station. The plight of millions of war-ravaged Bengali civilians caused worldwide outrage and alarm. India, which was led by Indira Gandhi, provided substantial diplomatic, economic and military support to Bangladeshi nationalists. British, Indian and American musicians organised the world’s first benefit concert in New York City to support the Bangladeshi people. Senator Ted Kennedy in the United States led a congressional campaign for an end to Pakistani military persecution; while U.S. diplomats in East Pakistan strongly dissented with the Nixon administration’s close ties to the Pakistani military dictator Yahya Khan.

India joined the war on 3 December 1971, after Pakistan launched preemptive air strikes on North India. The subsequent Indo-Pakistani War witnessed engagements on two war fronts. With air supremacy achieved in the eastern theatre and the rapid advance of the Allied Forces of Mukti Bahini and Indian military, Pakistan surrendered in Dacca on 16 December 1971.

The war changed the geopolitical landscape of South Asia, with the emergence of Bangladesh as the seventh-most populous country in the world. Due to complex regional alliances, the war was a major episode in Cold War tensions involving the United States, the Soviet Union and the People’s Republic of China. The majority of member states in the United Nations recognised Bangladesh as a sovereign nation in 1972.”

(চলবে)

যুদ্ধ ৬

274572

যুদ্ধ মানে শুধু অস্ত্রের লড়াই নয়, যুদ্ধ মানে বাকচাতুরী। কে কতটা মিথ্যে বলতে পারে, কে কিভাবে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে তার কৃৎকৌশলের লড়াই। যুদ্ধ মানে কূটনৈতিক লড়াইও বটে। বর্তমান রাশিয়া – ইউক্রেন যুদ্ধের যা কিছু আমরা দেখছি ভাবতেও পারবেন না তার মধ্যে ঠিক কতটা জল মেশানো আছে। কিছুক্ষণ আগে এক খবরের চ্যানেলের কভারেজ ভাইরাল হয়ে গেছে সোস্যাল মিডিয়ায়। দেখা যাচ্ছে এক ভিডিও সাংবাদিক বলছেন ইউক্রেনের যুদ্ধে রাশিয়ান আক্রমণের ফলে ইউক্রেনের কত বিশাল সংখ্যক সাধারণ মানুষ মারা গেছেন। সাংবাদিকের পিছনে অজস্র ঢাকা দেওয়া সারি সারি মৃতদেহ। হঠাৎ দেখা গেল সেই মৃতদের মধ্যে এক শব তার দুই হাত চাদরের থেকে বার করে নিজের চাদর ঠিক করছে। লাইভ হওয়ার কারণে এই ভিডিও এডিট করার আগেই সম্প্রচার হয়ে যায়। এরকম হলুদ সাংবাদিকতা যুদ্ধরত রাষ্ট্র করে পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর সহানুভূতি আদায় করে বিপক্ষ শক্তির উপরে চাপ বাড়াতে। আবার আরেক রকম মিথ্যে বলা হয় নিজের দেশের জনগণকে নিজের বিফলতা সম্পর্কে অন্ধকারে রাখতে। যেমন হয়েছিল আমেরিকা – ভিয়েতনাম যুদ্ধে। বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ আমেরিকা নিজের পরাজয়, নিজের লক্ষ লক্ষ সৈন্য নিধন, ভয়াবহ খরচের বহর সম্পর্কে তার নিজের দেশের মানুষদের অন্ধকারে রেখেছিল। এমনকি ভিয়েতনাম যুদ্ধের খবর প্রকাশে ছিল নিষেধাজ্ঞা, ছিল সেন্সর। তবুও সত্যকে চেপে রাখা যায় নি।

১৯৬২ তে আচমকা প্রতিবেশী দেশ চীন ভারতের বেশ কিছু জায়গা নিজের বলে দাবী করে দখল করে বসল। এর মধ্যে ছিল অরুণাচল প্রদেশ (তৎকালীন NEFA), লাদাখ ইত্যাদি সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। অথচ ইতিহাস জানে এই জায়গাগুলি তো দূরস্থান তাদেরও উত্তরে তিব্বত কখনোই চীনের অংশ ছিল না। তিব্বতের শাসকদের বিতাড়িত ও হত্যা করে এভাবেই আচমকা দখল করেছিল চীন। সেই একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল এটা ভেবে যে মাত্র পনেরো বছর আগে স্বাধীন হওয়া অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত দুর্বল দেশ ভারত প্রতিরোধ করতে পারবে না। কিন্তু প্রবল প্রতিরোধে চীন দখলচ্যূত হলেও সারা পৃথিবীকে ভুল তথ্য দিয়ে জানাতে থাকল যে তারা বিজয়ী। নিজের দেশের মানচিত্রে সংযোগ করল এই দুটি স্থান। ফলতঃ ভারতের সঙ্গে হাজার হাজার বছরের সুসম্পর্ক নষ্ট করে ফেলল তারা।

সেই একই পদ্ধতি অনুসরণ করে কিছুটা সাফল্য পেয়েছিল পাকিস্তান। যদিও যুদ্ধে তারা পরাজিত হয়েছিল। ১৯৪৭ এর অক্টোবরে কাশ্মীরের রাজা হরি সিং এক চুক্তি স্বাক্ষর করে ভারতে যোগ করেন সমগ্র জম্মু ও কাশ্মীরকে। এই সিদ্ধান্ত মানতে পারে নি পাকিস্তান। ১৯৪৮ এ কাশ্মীরের দুর্গম পার্বত্য এলাকা দিয়ে ঢুকে একটা বড় অংশ তারা দখল করে বসল। যুদ্ধ হয়েছিলো, শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলো পাকিস্তান। কিন্তু যুদ্ধের শেষ অবস্থায় ব্রিটেনের হস্তক্ষেপে ১৯৪৯ সালে যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদিত হলো তাতে দখলীকৃত অংশ কার তার ফয়সালা না হওয়ায় সেই অংশ থেকে গেল পাকিস্তানের কবলে। পরে ১৯৬৫ র যুদ্ধে এবং পরবর্তীতে ১৯৭১ এ ভারতের সৈন্য লাহোর ও করাচি পর্যন্ত অগ্রসর হলেও জোটনিরপেক্ষ শক্তির নেতৃত্বে থাকার ভদ্রতার কারণে অধিকৃত অংশ ছেড়ে দেয় পাকিস্তানকে, যা ১৯৪৯ এ পাকিস্তান করে নি এবং এখনো সম্পূর্ণ কাশ্মীরকে তাদের মানচিত্রে দেখায় পাকিস্তান।

“As long as the territory’s existence was guaranteed by the United Kingdom, the weaknesses in its structure and along its peripheries were not of great consequence, but they became apparent after the British withdrawal from South Asia in 1947. By the terms agreed to by India and Pakistan for the partition of the Indian subcontinent, the rulers of princely states were given the right to opt for either Pakistan or India or—with certain reservations—to remain independent. Hari Singh, the maharaja of Kashmir, initially believed that by delaying his decision he could maintain the independence of Kashmir, but ultimately he signed an Instrument of Accession to the Indian union in October 1947. This was the signal for intervention by Pakistan, which considered the state to be a natural extension of Pakistan, which intended to confirm the act of accession. Localized warfare continued during 1948 and ended, through the intercession of the United Nations, in a cease-fire that took effect in January 1949. In July of that year, India and Pakistan defined a cease-fire line—the line of control—that divided the administration of the territory. Regarded at the time as a temporary expedient, the partition along that line still exists.”

১৯৬৫ সালে ফের সেই পাকিস্তান ঝাঁপিয়ে পড়ল ভারতের আরও অংশ দখল করার উদ্দেশ্যে। পাকিস্তানের এই আগ্রাসনের পিছনে ছিল আমেরিকার সরাসরি মদত। অত্যন্ত আধুনিক অস্ত্র দিয়ে তারা সাহায্য করেছিল তাদের বন্ধুরাষ্ট্রকে। অবশ্য এটা শুধুই সাহায্য ছিল তা ভাবা ভুল। কারণ, প্রাকৃতিক অবস্থানের জন্য বৃহৎ শক্তি আমেরিকার কাছে সামরিক দিক থেকে পাকিস্তান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির এক দিকে আফগানিস্তান এবং তার পাশেই ইরান, তুর্কমেনিস্তান, কিজিঘিস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান অর্থাৎ তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের চারটি প্রদেশ ও মধ্য এশিয়ার পেট্রোলিয়াম সম্পদের অন্যতম বড় দেশ, এক দিকে চীন, অন্য দিকে ভারত ও নেপাল যা পেরোলেই তিব্বত। তাই এরকম গুরুত্বপূর্ণ দেশ নিয়ন্ত্রণে থাকলে আমেরিকার ছড়ি ঘোরানোর ক্ষমতা অনেক বেশি হবে, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও ভারতকে হুমকির মুখে রেখে ব্যবসা বাড়ানো যাবে। তাই সেই সাহায্য। আর পাকিস্তান উৎসাহিত হয়েছিল ১৯৬২ তে ভারতকে চীনের আক্রমণে।

“The result of Sino-India Conflict of 1962 encouraged Pakistan to seek a military solution of the Kashmir problem: A modernised Army, to which U.S.A. had contributed substantially, added to her confidence. By 1965, she had been able to acquire an edge over India in armour, artillery and air-power. This sense of superiority prompted her to plan aggression on Kashmir in 1965. It was a three-phased programme. In the first phase the Indian capacity to react was tested in the Rann of Kutch. In the second phase trouble was fomented in Kashmir to weaken the Indian hold. In the third phase an attempt was made to bottle up the Indian Army in Kashmir by sealing the supply line in Chhamb-Jaurian sector of Jammu.

The First Phase
The Rann of Kutch is an 80 km wide and 515 km long stretch of land bordering on Sind in Pakistan and Gujarat in India. The area was better defended from the Pakistan side. On the Indian side police posts guarded the border. Despite Pakistani mischief in Kanjarkot in January 1965, India expected no major instrusion in this area.

On 7 April 1965, Pakistan the Indian border at Sardar post, Kanjarkot, Vigokot, Biar Bet, Chhad Bet, etc., in Brigade strength and over-ran the first two posts. India moved a Bde (50 Para) to check the Pakistani intrusion. Pakistan strengthened her Brigade with a tank regiment. On 23 April, Pakistan again struck on four border posts and captured Vigokot and Biar Bet. The hostilities ended on 1 July 1965, at the intervention of the British Prime Minister. Though no major gains accrued to either side, Pakistan felt elated by this adventure.

The Second Phase
After this supposed success in the Rann of Kutch, Pakistan put into action her plan to grab the valley of Kashmir by infiltration and sabotage. The conspiracy was code-named ‘Operation Gibraltar’. 30,000 Raiders (Mujahids) divided into ‘Task Forces’ infiltrated into Kashmir between 1 and 5 August with this intent. The Indian XV Corps took some quick measures and was able to contain the infiltrators within fifteen days. But to remove the threat completely it was necessary to seal the entry points of the infiltrators. Indian Army attacked Kargil (in Leh sector), Tangdhar (Tithwal sector) and Haji Pir (in Uri sector) with this intent. To further seal the entry points of the infiltrators a link with Punch was effected by 93 Brigade. In the process two strong features of Raja and Chand Tekri, held in strength by the enemy, were reduced on 5-6 September 1965. Mirpur area on river Kishanganga was taken care of by 104 Bde. The operation opened in this sector on 24 August and lasted till 21 September. The brigade fought many fierce battles to acquire complete domination in this area. In short, the timely action of the Indian Army (19 Division) turned ‘Gibraltar’ into a total disaster.

The Third Phase
Pakistan finally launched the operation ‘Grand Slam’ to retrieve the situation. The aim was to defeat Indian forces in Chhamb area to facilitate the capture of Akhnur bridge and Jammu. This in turn would have cut the Indian line of communication to Kashmir.

The Pak offensive in Division strength came at 0345 hrs on 1 September 1965. Comparative superiority in artillery, armour and infantry almost ensured its success. The Indian 10 Division was still in the making. The 191 Bde responsible for the defence of the area could not stop the Pak three-pronged advance and retreated to Akhnur on 4 September. With Pakistan resuming advance on Akhnur on the 5th, the situation became very critical. India took recourse to diversionary attacks on Pakistan in Lahore, Sialkot and Rajasthan sectors. This shattered the Pak dream to bottle up Indian forces in Kashmir.

Lahore Sector
In Lahore sector the three Divisions (15, 7, 4) of Indian XI Corps mounted attack on an area extending from Pathankot in the north to Suratgarh in the south. The area was divided into three sectors. The northern sector along the GT Road axis was assigned to 15 Division, the central sector along a the Khalra-Barki axis to 7 Division and the southern sector along the Khem si Karan-Kasur axis to 4 Mountain Division. Necessary armour and artillery Ir support was provided to each division. The corps aimed to capture all Pakistani territory east of Ichhogil Canal. The Indian attack commenced at 0400 hrs on 6 September 1965. In the beginning the operations of 15 Division in the northern sector went well. Its advance brigade captured Dograi in the first sweep and established a bridgehead across the Ichhogil It and reached Batapore on the outskirts of Lahore. But it could not capitalise Ir on these initial gains and fell back when the Pak troops retaliated with of good armour support. The second attempt of the division to capture the Si Pak territory, initiated on 10 September, brought only a limited success. The highlight of this thrust was the capture of Dograi by the 3 Jat at Tc midnight on 21 September. In this action Pak suffered 150 men dead and in 100 others made prisoners.

The operations went on well in the central sector. Here the 7 Infantry Division advanced on Khalra-Barki axis with great dash and completed fu its assignment by 11 September 1965. The most difficult action during the Di advance was fought by the Division at Barki, which was protected by pr strong bunkers. 4 Sikh broke all enemy resistance and captured Barki by pr 2130 hrs on 10 September. Both sides suffered heavy casualties in this Pa battle.

The 4 Division, however, found the going difficult in the southern sector. It shouldered a two-fold responsibPity—capture Pak territory east of Ichhogil Th and contain possible enemy attack on Kasur-Khem Karan axis. The Division Di gained some initial success but the Pak counter offensive blunted the Jas Indian advance. In fact, Pak had planned a powerful offensive in this sector att as an enveloping move to destroy XI Corps.

The Indian 4 Division, unable to check the powerful attack, fell back ME on Asal Uttar. It now comprised only three and a half battalions as the 7 Bde had been rendered ineffective in the first Pak attack. But the Div 181 was now occupying a well defended position with well sited artillery and Ra armour in support. The Pak effort to run through the Indian position was, Inc therefore,, foiled. On the 8th night Pakistanis tried to outflank the position in on the right with an armoured bde, but here again 4 Grenadiers stood like of a rock to beat the Patton attack. Havildar Abdul Hamid alone destroyed Pal two tanks and damaged one in this battle. Another outflanking move by doi a Pak armoured bde from the left side on Mahmoodpura-Dibbipura axis also failed as the well sited Indian armour regiments trapped them on three sides. Pakistan lost 97 tanks including 72 Pattons in the battle of Asal Uttar. Indians made some attempts to recapture the lost territory, but Pakistanis held on to the area till the last. The cease-fire denied the Indians another opportunity to beat back the Pakistanis. The right flank of XI Corps was protected by 29 Infantry Bde Group. It launched an attack on Dera Baba Nanak and captured it on 7 September_ Indian XI Corps generally succeeded in its mission to capture areas east of Ichhogil Canal except in the Khem Karan, sector.

Sialkot Sector
To ease pressure on Chhamb another front was opened by the Indian Army in Sialkot sector by launching 1 Corps on 8 September 1965. 26 Infantry Division carried diversionary move in the north towards Sialkot. 6 Mountain Division attacked Charwa-Maharajake area and captured it after some fighting. 14 Infantry Division established a bridge-head in Ikhnal area further to the east. This set the stage for the advance of 1 Armoured Division. It moved out on 8 September but bad weather hindered its progress. The commander then chose another axis to mount attack on Phillora on 11 September. While the Armoured Brigade was engaging the Pak armour, 43 Lorried Bde captured Phillora in a spirited action. Pak army lost nearly 61 tanks in this battle.

1 Armoured Division then proceeded to capture Chawinda on the 14th. The Pak armour had already concentratred in the area and, therefore, the Division could make little progress. However, it succeeded in capturing Jassoran and Batur Dograndi on the 16th. It was in one of the Pak counter attacks on Batur Dograndi that Lt Col Tarapore of Poona Horse was killed fighting. Another effort by 1 Corps to capture Chawinda on,the 18th night met with limited success. The corps, however, succeeded in capturing about 466 sq kilometres of Pak territory. It destroyed and captured about 180 Pak tanks.

Rajasthan Sector
India opened a third front in Rajasthan sector to tie down the enemy forces in Sind. 11 Infantry Division carried operations on Barmer-Hyderabad axis of this sector. Gadra was occupied in the first sweep on 8 September and Pak Rangers were driven out from many more areas of the desert. Ding dong battle continued in the desert till the end of the war and Indian made some more gains. In all, India captured 388 sq km of Pak territory in this sector.

Air Support
The IAF gave substantial support to the Army in fighting the enemy on many fronts. On the first day of war Indian Vampires and Mysteres struck heavy blows on Pak armour, advancing on the Chhamb-Jaurian axis. Subsequently, IAF Canberras raided major Pakistan Air Force bases at Sargodha and Chaklala at night. Pakistani bases at Akwal, Peshawar, Kohat, Chak Jhumra and Risaiwala were also raided. The Mysteres were employed primarily in the ground attack role whereas the Hunters were utilised for counter air interdiction and close support missions, as well as flying combat air patrols. The Gnat squadrons were the air defence mainstay. The astounding success of the Gnat against the Pak F-86 earned it the appellation “Sabre Slayer”. During this conflict India lost 35 aircraft as against 70 by Pakistan.

The Indian Navy ensured the safety of our ports and coast-line. Pakistani Navy managed a sneak raid on Dwarka port but it caused no damage of military consequence.

In the 1965 War, Pakistan suffered heavily in men and material in spite of her superiority in arms and equipment. It is estimated that Pak Army lost 5988 killed and many more wounded. India suffered 2735 men in killed and 8225 in wounded. Indian tank losses were 80 as against 475 of Pakistan.

Finally, a cease-fire was agreed upon with effect from 23 September 1965 with UN efforts. The Tashkent Declaration and the subsequent agreement between the two countries led to the disengagement of forces and their withdrawal to positions occupied by them before 5 August 1965. This restored peace in the sub-continent for some time.”

(চলবে)

যুদ্ধ ৫

274572

আজ শুরু করার আগে প্রথমেই ইউক্রেনে যে দুজন ভারতীয় ছাত্র যুদ্ধের শিকার হয়ে মারা গেলেন তাঁদের স্মৃতিতে শোক ও শ্রদ্ধা জানাই। আমার এই লেখা যুদ্ধের বিরুদ্ধে, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন আমজনতার ইচ্ছার প্রতিফলন। আমরা যুদ্ধ চাই না। যুদ্ধ আমাদের কোনো উপকার করে না। যুদ্ধ শুধুমাত্র বৃহৎ ব্যবসাদারদের মুনাফার রাস্তা সরল করার সাধণ। আর কে না জানে আজকের পৃথিবী ব্যবসাদারদের অঙ্গুলিসঞ্চালনে চলে। এটা পরিস্কার মনে রাখতে হবে আজকের আমেরিকা আব্রাহাম লিংকনের জনকল্যাণের রাষ্ট্র নয়, আজকের রাশিয়া ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিনের সমাজকল্যাণমূলক সমাজতান্ত্রিক দেশ নয়। দুটি পরস্পর বিবাদমান দেশই পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রিত। দুটি দেশেই বৃহৎ পুঁজিপতিরা আছে। তাদের এই বিবাদ পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং অন্য দেশের উপরে কর্তৃত্ব নিয়ে। আমরা, পাকিস্তান বাদে ভারতীয় উপমহাদেশের বাকি রাষ্ট্রের মানুষেরা পুরোনো নীতিতে জোটনিরপেক্ষ থেকেও যুদ্ধের বিরোধিতা করব। এটা সাম্রাজ্যবাদের অপছন্দ হলেও আমাদের কিছু করার নেই। সুতরাং ফেসবুক কর্তৃক টানা বাহাত্তর ঘন্টা ব্লক থাকার পরেও ফের এই লেখা লিখতে বসেছি এবং লিখব। শেখ মুজিবুর রহমানের সেই বিখ্যাত উক্তি লাইটহাউস হোক – “তোমরা আমাকে দাবায়ে রাখতে পারবা না”।

আগেও বলেছি আবারও বলছি যুদ্ধ কখনো সাধারণ মানুষের জন্য সদর্থক কোনো বার্তা দেয় না। সবচেয়ে অবস্থা খারাপ হয় সাধারণ মানুষের। অথচ যে মুষ্টিমেয় নীলরক্তের ঝাঁকের স্বার্থে যুদ্ধ হয়, যারা যুদ্ধের ফলে মুনাফায় ফুলেফেঁপে ওঠে, তারা নিজের স্বার্থ ছাড়া অন্য মানুষ বা জীবদের ভয়াবহ অবস্থার অবণতির কথা মাথায় রাখে না। ১৯৪৫ এ শেষ হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আরও বহু যুদ্ধ এই গ্রহে সংঘটিত হয়ে গেছে। ৩০শে ডিসেম্বর ১৯২২ থেকে ২৬শে ডিসেম্বর ১৯৯১ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছিল। এই সময়ে কোনো বড় আকারের যুদ্ধ হতে পারে নি, কারণ বড় আকারে যুদ্ধ শুরু করার মত পরিবেশ তৈরী হলেই সেই দেশটি সর্বক্ষেত্রে ভেটো প্রয়োগ করে যুদ্ধ আটকে দিত। অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে। পৃথিবী হয়ে গেল শক্তির এক মেরু বিশিষ্ট গ্রহ। এই পর্যায়ে সুপার পাওয়ার হলো আমেরিকা। তার অজস্র অনুগামী দেশ।

এই পর্যায়ে অত্যন্ত শক্তিধর দেশগুলি বলতে গেলে এক প্রকার খোলা লুঠ চালিয়েছে পৃথিবী জুড়ে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ মধ্য এশিয়ার দেশগুলি। প্রাকৃতিক পেট্রোলিয়াম ও গ্যাসে সমৃদ্ধ দেশগুলিতে নিজেদের ইচ্ছামতো শাসক বসিয়ে সেখানকার সম্পদ জোর করে তুলে নিয়েছে শক্তিশালী দেশগুলির জোট। যখনই কোনো দেশের কোনো শাসক এই লুটপাটের বিরোধিতা করেছে, তখনই যুদ্ধের নামে সেই শাসককে হত্যা করা হয়েছে, সেই দেশে নিজেদের পুতুল শাসক বসিয়ে ফের জারি থেকেছে লুঠ। অথচ দেখা গেছে সেইসব দেশে অশান্তি ছড়িয়ে দেশ, শাসক, সাধারণ নাগরিক ও বাকি পৃথিবীর নজর ঘুরিয়ে রাখার জন্য যে সব ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনদের তৈরী করা হয়েছিল তারাই পরে নিজেদের স্রষ্টার বিরোধিতা করে অবশেষে তাদের হাতেই মারা যায়। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ ওসামা বিন লাদেন, সাদ্দাম হোসেন বা আইএসআইএস দল ও আফগান তালিবান দল। আরও বহু আছে, কিন্তু সে সব বিস্তৃত উদাহরণে আপাতত যাচ্ছি না।

১৯৪৫ এর পরে যে বড় আকারের যুদ্ধগুলির আওয়াজ পৃথিবীকে আশংকিত করেছিল তার মধ্যে প্রধান আমেরিকা – ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আফগানিস্তানে সোভিয়েত – তালিবান যুদ্ধ ও পরে আমেরিকা – তালিবান যুদ্ধ এবং NATO বনাম ইরান ও NATO বনাম ইরাক যুদ্ধ। এর মধ্যে দুটি যুদ্ধ অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য, কারণ সেই যুদ্ধগুলিতে সুপার পাওয়ারকে পরাজিত করেছিল দুর্বল প্রতিপক্ষ। প্রথম উদাহরণ সোভিয়েত – তালিবান যুদ্ধ। এখানে সমগ্র আফগানিস্তান রাষ্ট্র সেই যুদ্ধে জড়িত ছিল না। বস্তুতঃ আফগানিস্তান দখল করে সেই দেশকে NATO র করিডর তৈরী করতে চাওয়া তালিবানকে দখলচ্যুত করার উদ্দেশ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধ করে বিফল হয়। এর মূলতঃ দুটি কারণ, প্রথম – সেই সময়ে তারা পাকিস্তানের মাধ্যমে আমেরিকার সর্বাত্মক সাহায্য পেয়েছিল। দ্বিতীয় – হিমালয়ের বিভিন্ন পর্বত বেষ্টিত সেই দেশে বিগত ছয়শত বছর ধরে গেরিলা যুদ্ধের কাছে কখনো কোনো শক্তি জিততে পারে নি। যদিও পরবর্তীতে সেই তালিবানদের তাদের স্রষ্টারা কখনো যুদ্ধে দমিয়েছে আবার কখনো ফের ক্ষমতায় বসিয়েছে, যেমন এখন হয়েছে গত বছরে।

গত শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য যুদ্ধগুলোর মধ্যে ছিল আমেরিকা – ভিয়েতনাম যুদ্ধ। বিশাল শক্তিধর আমেরিকা আক্রমণ করে বসল এক‌টি মাইক্রোস্কোপিক দেশ ভিয়েতনামকে। পৃথিবী ভেবেছিল কয়েক দিনের মধ্যে ধ্বস্ত হয়ে যাবে ভিয়েতনাম। আরেকটু বিশদে গেলে জানতে হবে প্রকৃতপক্ষে ১৯৫৫ – ১৯৭৫ পর্যন্ত কুড়ি বছর ব্যাপী চলা সেই যুদ্ধের প্রেক্ষাপট। সেই সময়ে অন্য ছোট দুর্বল দেশের মত ভিয়েতনামও ছিল প্রবল শক্তিশালী দেশ ফ্রান্সের উপনিবেশ। প্রধানত দক্ষিণ ভিয়েতনাম ছিল ফ্রান্সের দখলে। আর ফ্রান্সের মদতদাতা ছিল NATO তথা আমেরিকা। উত্তর ভিয়েতনাম যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের সাহায্য নিয়ে দক্ষিণকে ঔপনিবেশিক দখল মুক্ত করতে চাইল তখনই শুরু হয়ে গেল বিংশ শতাব্দীর আরেক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। কুড়ি বছর স্থায়ী হওয়া এই যুদ্ধে প্রতি ইঞ্চিতে বোমা ফেলে ধ্বংস করেছিল আমেরিকা। ব্যবহার করেছিল ভয়ঙ্কর ধ্বংসকারী নাপাম বোমা সহ সব ধরনের আধুনিক অস্ত্র। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ভিয়েতনামীদের গেরিলাযুদ্ধের কাছে নতি স্বীকার করে নিজেদের ভয়াবহ ক্ষতি স্বীকার করে তাদের পরাজয় মেনে নিয়ে ফিরে যেতে হয়।

“The United States in the Vietnam War began shortly after the end of World War II in an extremely limited capacity and over a period of 20-years escalated peaking in April 1969 with 543,000 American combat troops stationed in Vietnam. By the conclusion of the United States’s involvement in Vietnam, over 3.1 million Americans had been stationed in Vietnam. At home this involvement played a key role in sparking the Civil Rights Movement, hippie culture and wide ranging changes in popular culture.

American Paratroopers of the 173rd Airborne Brigade on patrol in March 1966. The U.S. involvement in South Vietnam stemmed from a combination of factors: Joseph Stalin and Mao Zedong’s pledge in 1950 to support Ho Chi Minh and the Viet Minh’s guerrilla forces against France’s colonial occupation, the U.S. war with Japan in the Pacific, and domestic pressure to act against communism after the loss of mainland China and indecisive conclusion of the Korean War. The U.S. was initially adamantly against providing any aid to France that would prop up France’s struggle to maintain its pre-WWII colonial empire. However, Stalin and Mao’s offering their support to the Viet Minh in 1950, changed the battlefield dynamic and geopolitical character of the conflict from a struggle for independence from a colonial power to one of a global conflict against communist expansionism. It was at the time, in September 1950, that French forces began to be moderately backed by America.

As of 2020, records reported that the conflict resulted in 58,279 U.S. fatalities before the official end of combat operations in 1973. As of 2019 it was estimated that approximately 610,000 Vietnam Veterans are still alive, making them the second largest group of Veterans behind those of the Global War on Terror. The war’s lasting impact can be seen in the thousands of movies, books, and video games centered on the conflict.”

একটা ছোট্ট অংশের অনুভবী মানুষ যুদ্ধ চায় না। তারা কিন্তু কাউকে চোখ রাঙিয়ে অযৌক্তিক কথা বলে না। অথচ বড় অংশের মানুষেরা যারা যুদ্ধ সমর্থন করে তারাই ছোট অংশকে চোখ রাঙায়, গালাগালি দেয়, দেশদ্রোহী বলে। দুপক্ষের সমাধানের মত ও পথ আলাদা। এরা জানে না একটা যুদ্ধ শুধু হত্যাই করে না, দুর্বল জাতির অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়।

(চলবে)

যুদ্ধ ৪

274572

যুদ্ধ শব্দটা শুনলে বা পড়লে আমাদের মাথায় আসে হলিউডের বা বলিউডের কিছু সিনেমার ছবি। যেখানে দেশাত্মবোধের টগবগে আবেগে মাখামাখি হয়ে আমরা দুটো পক্ষ নিজের থেকেই ভাগ করে ফেলি, ভালো আর খারাপ। মজার ব্যাপার এই ভালোটা সর্বদাই নিজের দেশের উর্দি পরে যে অটোমেটিক রাইফেল হাতে শত্রুদেশের উর্দিপরাদের বিরুদ্ধে গুলি খেতে খেতেও এগিয়ে গিয়ে শেষে বিজয়ের পতাকা তুলে সবাইকে কান্নায় ভাসিয়ে নিজে মারা যায়। কিন্তু এই সোজাসাপটা কল্পনার গতিপথের মত বাস্তব এত সরল নয়। আর তাই একটা যুদ্ধের পিছনে প্রচুর জটিল গলিপথ থাকে যা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না, কারণ আমজনতার পক্ষে ক্ষমতার অলিন্দের গোলোকধাঁধা বুঝতে পারা একেবারেই অসম্ভব।

১লা সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ থেকে ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ পর্যন্ত পাক্কা ছয় বছর একদিনের যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরে সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারল না সেই যুদ্ধের ফলে এক শ্রেণীর বৃহৎ ব্যবসায়ী ফুলে ফেঁপে বিকট আকার ধারণ করল। আর এদের অধিকাংশই সেই উন্নত দেশগুলোর বাসিন্দা যারা পুরো যুদ্ধে নিজেদের গায়ে সাদা রঙের তকমা এঁটে রেখেছিল।

ঠান্ডা যুদ্ধ অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে হয় নি, হয়েছিল অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক অলিন্দের নীলরক্তের মানুষদের বুদ্ধি আর কার্যকলাপের দ্বারা। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্মের প্রথম দিন থেকেই তাকে ভেঙে ফেলার কূট ষড়যন্ত্র শুরু করার পিছনে সেই একই কারণ ছিল। উন্নত দেশগুলোর বাজারে তৈরী জিনিস বিক্রি এবং মুনাফা, যার রাস্তা সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্মধারেরা আটকে রেখেছিল। তাই বাইরে থেকে নানারকম নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি সোভিয়েতের অন্দরমহলে একের পর এক ক্ষমতার কারবারীকে কিনে ফেলে ইউনিয়নকে ধ্বংসের চেষ্টা হচ্ছিল বহু শতক ধরে। ট্রটস্কি থেকে অনেকে বিফল হওয়ার পরে শেষ সুযোগ এসে গেল গোর্বাচভের হাত ধরে। কিন্তু এই প্রসঙ্গে আসার আগে আজকের অবস্থার আসার রাস্তায় দু একটা ঘটনার কথা বলি।

জন্মলগ্ন থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলিতে নিজেদের মধ্যে বিবাদ চলছিল। এই বিবাদের পিছনেও ছিল উন্নত দেশগুলির ইন্ধন। ভারত – পাকিস্তান বা ভারত – চীনের মধ্যে যত বেশী বিবাদ হবে উন্নত দেশগুলোর তত বেশী অস্ত্র বিক্রি হবে, তত বেশী মুনাফা হবে এটা মূল বিষয়। তাছাড়া পাকিস্তানকে সাহায্য দেওয়ার নামে আমেরিকা ও চীন হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র বিক্রি করে পাকিস্তানকে প্রায় দেউলিয়া করে দিয়েছে এটা পাকিস্তানের গরীব নাগরিক জানতে পারে নি। ভারত যেহেতু নিরপেক্ষ রাজনীতির অবস্থান নিয়েছিল প্রথম থেকেই, তাই ভারতকে দমিয়ে বাণিজ্য বাড়ানোর এই চেষ্টা বহু দশক সফল হয়েছে, এখনো হচ্ছে।

জন্মলগ্নের পরেই ১৯৪৯ এ পাকিস্তানের দ্বারা ভারতের জমি দখল, ১৯৬২ তে চীন – ভারত যুদ্ধ, ১৯৬৫ তে ফের পাকিস্তান – ভারত যুদ্ধ এসবের পিছনে ভারতের জমি আগ্রাসনের ইচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে বহু ডলার ও পাউন্ডের অস্ত্র বিক্রি করতে পেরেছিল উন্নত দেশগুলো। যদিও দেখানো হয়েছিল ভারত নাকি সোভিয়েতের অনুগামী এবং পাকিস্তান বা চীন আমেরিকার। কিন্তু আসল ঘটনা হলো মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ছিল পশ্চিমী দেশগুলোরই। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের এরকম আগ্রাসন ছিল না। আর তাই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রবক্তা ও নেতৃত্বে থাকা ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো অসুবিধা সৃষ্টি করে নি, যতটা করেছিল উন্নত দেশগুলোর। মূলতঃ সোভিয়েত কে আটকানো ও ভাঙার প্রচেষ্টাতেই ৪ঠা এপ্রিল, ১৯৪৯ এ ইউরোপের বারোটি দেশ নিয়ে আমেরিকা গঠন করেছিল NATO. এর উদ্দেশ্য বলা হয়েছিল সেই জোটের মধ্যে থাকা কোনো দেশের প্রতি আক্রমণ হলে তা প্রতিরোধ করা। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল সদস্য দেশ দিয়ে অন্যের ভূমি দখল করতেও তাকে কাজে লাগানো হচ্ছে। সেই সময়ে এই কাজের বিরোধিতা করে আমেরিকার রোষে পড়ে ভারত। কিন্তু সোভিয়েতের সঙ্গে ভালো বন্ধুত্বের কারণে ভারতের সরাসরি কোনো ক্ষতি করার সুযোগ পায় নি। যা পেল ১৯৭১ সালে।

পাকিস্তান তাদের অঙ্গরাজ্য তথা উপনিবেশ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক হামলা চালিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা, ধর্ষণ, সম্পত্তি নষ্ট শুরু করল ২৬শে মার্চ, ১৯৭১ এবং আচমকা ভারতের পশ্চিম প্রান্তে হামলা করে বসে তারা ডিসেম্বরে। এই মার্চ থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে কয়েক কোটি শরণার্থী প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতে যা পাকিস্তানের অপছন্দ ছিল। তাদের উসকে দিয়ে আমেরিকা ভারত আক্রমণ করিয়ে দিল যা অত্যন্ত ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। ৩রা ডিসেম্বর যুদ্ধ ঘোষণা করে দিল ভারত এবং মাত্র তেরদিন চলার পরে ১৬ই ডিসেম্বর পরাজিত হলো পাকিস্তান। কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ হতো না। কারণ যুদ্ধ ঘোষণার পরেই পাকিস্তানের সাহায্যের জন্য আমেরিকা তথা NATO পাঠিয়ে ছিল তাদের যুদ্ধ জাহাজের সারি সপ্তম নৌবহর। সেদিন সত্যিই সেই নৌবহর এসে পৌঁছে গেলে আজ ভারত বা বাংলাদেশ নামে দুটো আলাদা দেশ থাকত না, সম্পূর্ণ একটা দেশ হয়ে যেত পাকিস্তান। এই দুর্ঘটনা থেকে সেদিন বাঁচিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। আমেরিকার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের হুমকি দেয় সম্পূর্ণ শক্তি নিয়ে তারা ভারতের পিছনে আছে। এতে সাহস হারিয়ে পিছিয়ে যায় আমেরিকা। জন্ম হয় নতুন সার্বভৌম দেশ বাংলাদেশ।

(চলবে)

যুদ্ধ ৩

274572

১৯২৯ এ বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার পিছনে যে কারণগুলি ছিল তা আগে কিছুটা বলেছি। ইউরোপের সবচেয়ে বড় দেশ রাশিয়ার জারতন্ত্রের উচ্ছেদ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ফ্লু মহামারী, একের পর এক বিপর্যয়। বস্তুত পৃথিবীর ক্ষমতার মেরু পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে আগের সুবিধা ভোগকারী দেশগুলো ক্রমশই নিজেদের বাণিজ্যিক জমি হারাচ্ছিল। এর ফলে তাদের দেশের মাথাপিছু আয় যেমন কমে যাচ্ছিল তেমনই বৃহৎ পুঁজি মালিকরা ক্রমাগত লোকসানের খপ্পরে পড়ে যাচ্ছিল। ওইসব দেশগুলিতে বাণিজ্যিক বৃদ্ধির মাত্রা শূণ্যের নীচে নেমে আসছিল। ফলস্বরূপ বিশ্বজুড়ে শুরু হয়ে গেল আর্থিক মন্দা। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ দশ বছর ধরে এই ভয়াবহ মন্দায় একের পর এক বড় বাণিজ্য সংস্থা বন্ধ হয়ে গেল। বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ার ফলে বাড়তে থাকলো জন বিক্ষোভ, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, খাদ্য সংকট, আর দেশগুলোর মাথাদের অবস্থা সামলানোর প্রয়াসে ঘন ঘন বৈঠক। কিন্তু সমাধান কিছুতেই যখন হচ্ছিল না তখনই আরেক উন্মাদ জার্মানির হিটলার ও ক্ষমতালোভী মুসোলিনি তাদের দেশের কিছু অংশের মানুষের স্বার্থে ঘোষণা করে দিল যুদ্ধের। রে রে করে উঠলো ইউরোপের এতদিনের উন্নত দেশগুলো। একে তাদের দেশের অবস্থা খারাপ, তার ওপরে হিটলারের জার্মানি তাদের অংশের বাণিজ্যিক জমি দখল করে নিলে তাদের অবস্থা আরও সঙ্গীন হয়ে উঠবে এই আশংকায় ইউরোপের বাকি দেশ জড়িয়ে পড়ল যুদ্ধে। অবশ্য তাদের এ ছাড়া অন্য গতি ছিল না।

হিটলারের প্রবল অত্যাচারী নাৎসী বাহিনী অস্ট্রিয়া থেকে এক এক করে তাদের দেশগুলি দখল করার উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দীর্ঘ বর্ণনা এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য নয়। কিছু আজকের পরিস্থিতি বোঝাতে গেলে যে সামান্য আলোচনা দরকার আমি সেটুকুই শুধু এখানে করব। প্রথমে আমেরিকা ও রাশিয়া সেই যুদ্ধে নিরপেক্ষ ছিল। রাশিয়ার সঙ্গে জার্মানির যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদিত ছিল আগেই। কিন্তু সেই আগ্রাসী যুদ্ধের লোভ ছড়িয়ে গেল। জার্মানি ও ইতালির পরে অক্ষশক্তিতে যোগ দিল তুরস্ক ও জাপান। তুরস্কের যোগ দেওয়ার পিছনে উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপের উন্নত দেশগুলির আগ্রাসন থেকে বেরিয়ে আসা। আর জাপানের উদ্দেশ্য একইভাবে ব্রিটেন ও আমেরিকা অধিকৃত চীনের আগ্রাসন থেকে বেরোনো। হিটলার ইউরোপের ছোট ছোট দেশগুলিতে সাফল্য পাওয়ার পরে রক্তের গন্ধ পাওয়া হিংস্র জন্তুর মত আরও পাওয়ার লোভে ভুল করে বসল। সেটা হলো অনেকগুলো ওয়ার ফ্রন্ট খুলে ফেলা। একদিকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ অন্যদিকে আফ্রিকার দেশগুলোর উপনিবেশ দখলের উদ্দেশ্যে সেখানে যুদ্ধ শুরু। কিন্তু সবচেয়ে বিপর্যয়কারী ভুল হলো রাশিয়া আক্রমণ।

যে দুর্ভেদ্য রাশিয়াকে নেপোলিয়ন দখল করতে পারেন নি, যে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের যুদ্ধবিরতি চুক্তি ছিল, সেই রাশিয়া আক্রমণ করার হঠকারিতা করল হিটলার। অন্যদিকে তারই শরিক জাপান আমেরিকা
আক্রমণ করে আরেক ভুল করল। পৃথিবীর দুই সুপার পাওয়ার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় একদিকে যেমন যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্ব জুড়ে, অন্যদিকে হিটলারের জার্মানির অন্তিম ক্ষণের সূচনা হয়ে গেল। এখন প্রশ্ন হলো এই যুদ্ধে লাভ হলো কার?

‘This study analyzes the important increase in the rate of profit which occurred in the United States during World War II. The gap between the predepression trend line, from 1900 to 1929, and the postwar line, from 1946 to 1989, is estimated as a shift of 15.8% in absolute terms (to be compared with an average of 29.0% over the whole period). Using a production function analysis, we demonstrate that this transformation can be explained by an acceleration in the rate of “autonomous progress” between 1930 and 1945. We identify a sudden and nonneutral discontinuity in the process of technical change, characterized by an autonomous substitution of equipment for structures.’

কিছু বোঝা গেল? ১৯৩৯-১৯৪৬ গ্রেট ডিপেসন থেকে লাভজনক অবস্থায় উত্তরণ কিভাবে সম্ভব হলো? বিশেষ করে যুদ্ধের এত ক্ষয়ক্ষতি সামলে? সাধারণ্যে এত কূটকচালি পোষায় না, তাই কেউ যুদ্ধের অন্তর্নিহিত কারণ বুঝতে পারে না। বিংশ শতক থেকে যুদ্ধ বাজার নিয়ন্ত্রিত এক ঘটনা মাত্র। সেটা না জেনেই মানুষ দু হাত তুলে যুদ্ধ সমর্থন করতে থাকে।

‘An additional reason for contributing to the growth of the financial base and the accelerating flow of gold as an immediate consequence of the outbreak of war in Europe was that Britain and its allies paid for war materials and other supplies that sent gold domestically. United States. These two factors led to a strong expansion of the financial base and funding.’

আশাকরি আর বিস্তৃত কিছু বলার থাকবে না। উপরের এই রিপোর্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই। যাইহোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়ে গেল পৃথিবীতে। পৃথিবী হলো ক্ষমতার দুই মেরু বিশিষ্ট গ্রহ। আগেকার বিভিন্ন শক্তির খেয়োখেয়ি থাকলো না। ইউরোপ তার ক্ষমতার রাজমুকুট হারালো। এবারে তাদের হতে হলো আমেরিকার অনুগামী। পাশাপাশি রাশিয়া থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে উত্তরিত বিশালতম দেশটি গড়ে তুললো আরেক স্বতন্ত্র শক্তি। তার অনুগামীর সংখ্যাও বহু। শুরু হয়ে গেল ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ঠান্ডা লড়াই।

(চলবে)