সৌমিত্র চক্রবর্তী এর সকল পোস্ট

সৌমিত্র চক্রবর্তী সম্পর্কে

পরিচিতিঃ জন্ম বিহারের এক অখ্যাত বনাঞ্চলে বাবার চাকরীস্থলে। রসায়নে স্নাতকোত্তর এবং ম্যানেজমেন্ট পাশ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী। একাধারে নাট্যকার, কবি এবং গল্পকার। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক পর্যালোচনা, বিভিন্ন ধরনের লেখা ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় ও সংবাদপত্রে। উৎপল দত্ত সহ বহু বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে শিখেছেন থিয়েটার। বহু বিচিত্র ও ব্যাপ্ত ময় তাঁর জীবন। বন, জঙ্গল, পশু, পাখি, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তাঁর দীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। কবিতা ও বিভিন্ন লেখা লেখিতে তিনি মস্তিস্কের থেকে হৃদয়ের ভুমিকাকে বড় করে দেখেন। কবিতা, গল্প, নাটক এবং মুক্তগদ্য মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নয়। প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হলো বইছে লু, থিয়েটার কথা, তিতলিঝোরা, নীলপাখিকে উড়ো চিঠি, রাত্রি আমার নৈশপ্রিয়া, ব্রিজের নীচে বৃষ্টি, ২ একাঙ্ক, প্রতিলিপি এবং বেবুশ্যে চাঁদ, খণ্ড ক্যানভাস। ইতিপূর্বে অঙ্গন সহ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে অক্ষর বৃত্ত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। নেশা ফটোগ্রাফি ও ভ্রমণ।

যুদ্ধ ২

274572

বিগত শতকের গোড়ার থেকেই বদলে যাচ্ছিল আর্থসামাজিক ব্যবস্থার সমীকরণ। পাল্টে যাচ্ছিল সেই প্রাচীন সিল্ক রুট নীতির বাণিজ্যিক গতিপথ। প্রাচীন রাশিয়াতে অভ্যুত্থান, ইউরোপের দেশগুলোতে একের পর এক বিভিন্ন শাখায় আবিষ্কার, ক্রমশঃ অবক্ষয়িত সামন্তবাদের শ্বাস উঠতে শুরু করেছিল। তখনই বিশ্বজুড়ে আবার একটা মহামারীর কবলে পড়ল মানুষ।

“The 1918 influenza pandemic was the most severe pandemic in recent history. It was caused by an H1N1 virus with genes of avian origin. Although there is not universal consensus regarding where the virus originated, it spread worldwide during 1918-1919. In the United States, it was first identified in military personnel in spring 1918. It is estimated that about 500 million people or one-third of the world’s population became infected with this virus. The number of deaths was estimated to be at least 50 million worldwide with about 675,000 occurring in the United States.”

সদ্য চার বছর ধরে চলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। ১৮৫৫ র বিধ্বংসী প্লেগ দেখেছি পৃথিবী। যা সামলাতে প্রায় পঞ্চাশ বছর লেগেছিল। কিন্তু তার ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই সামন্তবাদের প্রতি ধাক্কা এবং সেই সীমানা দখলের লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ল তখনকার ঔপনিবেশিক বিশ্ব। জার্মানিকে কেন্দ্র করে ইউরোপের সব দেশ, আমেরিকা, এশিয়ার কিছু দেশ জড়িয়ে গেল যুদ্ধে। চার বছর তিন মাস দু সপ্তাহ ধরে চলা যুদ্ধের ফল জার্মানির পরাজয়।

কিন্তু সীমানা দখল বা সম্পদ দখলের এই যুদ্ধের ধাক্কা সামলানোর আগেই আছড়ে পড়ল স্প্যানিশ ফ্লু নামের জীবাণু। কাতারে কাতারে মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। আর একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে গেল উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক কাঠামো। একে সামাল দেওয়ার জন্য চললো একের পর এক পরিকল্পনা। নতুন উপনিবেশ করার জায়গা আর নেই। সুতরাং পরাজিতের সম্পত্তি দখল করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা। অথচ সব আশার আগুনে জল ঢেলে দিয়ে ১৯৩২ থেকে পৃথিবী পড়ল ভয়ঙ্কর আর্থিক মন্দার কবলে।

‘The Great Depression lasted from 1929 to 1939 and was the worst economic downturn in history. By 1933, 15 million Americans were unemployed, 20,000 companies went bankrupt and a majority of American banks failed.’

এই লেখা যখন লিখছি তখন একটা যুদ্ধের দামামা বেজে গেছে। ঝলসে উঠছে রাত ও দিনের আকাশ। না আমাদের দেশে নয়। কিন্তু আজকের গ্লোবালাইজেশনের যুগে পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে যুদ্ধ বাধলে তার প্রভাব সারা গোলোক জুড়েই পড়ে। এখানেও পড়বে। আর সেদিনও তাই পড়েছিল উন্নত দেশগুলোর বাজারে।

সত্যি বলতে কি, ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসা বাজার উন্নত দেশগুলোর অর্থব্যবস্থাকে তছনছ করে দিয়েছিল সেদিন। একদিকে ইউরোপের সবচেয়ে বড় দেশ রাশিয়া তার বাজারে নিষিদ্ধ করেছিল উন্নত দেশের প্রবেশ। অন্যদিকে উপনিবেশগুলোতে ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভ, স্বদেশ প্রিয়তার ধোঁয়া উন্নত দেশের সামগ্রী বিক্রি সীমাবদ্ধ করে দিচ্ছিল। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যবসা অস্ত্র বিক্রি, তারপর ক্রমান্বয়ে গাড়ি বিক্রি, ওষুধ বিক্রি, কাপড় বিক্রি প্রায় তলানিতে ঠেকে গেছিল সেদিন। আর এক দিকে হিটলারের মত এক উন্মাদের একই ধরনের অর্থনৈতিক উন্নতি কামনার লোভ মস্ত সুযোগ এনে দিল উন্নত দেশদের। সামন্ততান্ত্রিক প্রভাব তখন প্রায় শূন্য। দেশের সব ধরনের সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে ক্রমবর্ধমান পুঁজিবাজার। ফলে আর্থিক মন্দা সামাল দেবার জন্য সৃষ্টি হলো আরেকটা বিশ্বযুদ্ধের।

সেদিনের সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ আজকের রাষ্ট্রসংঘের মতই ধৃতরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়েছিল। সত্যি বলতে কি বরাবর এটাই দেখা গেছে যে সব রাষ্ট্রের এই মিলিত সংঘ আসলে শক্তিশালী দেশের স্বার্থে তাদের অঙ্গুলিসঞ্চালনে চলে। আর তাই সেদিন সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের কিছুই করার ছিল না। যুদ্ধ হলো। উন্মাদ হিটলারের পতন হলো। পৃথিবীর তিন চতুর্থাংশ দেশ তখন বিধ্বস্ত সব দিক থেকেই। আবারও সেই আগের ভাগাভাগি। আবারও দুর্বল দেশের ওপরে সবলের লুট। সব ঠিক চলছিল। বাদ সাধলো ফের সেই আর্থিক মন্দা।

(চলবে)

যুদ্ধ ১

274572

আমরা চাই বা না চাই, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। কারণ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো শুধুমাত্র বাজার ছাড়া আর কোনো মান্যতা রাখে না প্রথম বিশ্বের দেশগুলোর কাছে। আর চোখ বুজে থেকে কেউ রাশিয়ার পক্ষে, কেউ ইউক্রেনের পক্ষে গলা ফাটিয়ে এটা ভাবতেই পারেন যে এই যুদ্ধ মাত্র দুটো দেশের আভ্যন্তরীণ সম্মানের প্রশ্ন থেকে শুরু ও শেষ। কিন্তু আসল ব্যাপার অত্যন্ত জটিল। আর শুধু এই যুদ্ধই নয় আজ পর্যন্ত সংঘটিত যে কোনো যুদ্ধের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল অর্থনৈতিক লোভ।

একবার পিছনের দিকে তাকানো যাক। গোলাপের যুদ্ধ বা ক্রুশেডের যুদ্ধের মত বহু বছর ধরে চলা প্রাচীন যুদ্ধের আসল উদ্দেশ্য ছিল ঔপনিবেশিক দখলের সীমানা বাড়ানো, যার মাধ্যমে নিজের নিজের দেশের অর্থনীতি শক্ত ভিতের ওপরে দাঁড় করানোর চেষ্টা। তখন উপনিবেশ থেকে যে সম্পদ লুঠ হতো তা নিজের পক্ষে আনার জন্যই ওইসব যুদ্ধের অবতারণা। আর সেই যুদ্ধ শুরু, চলা ও শেষের পেছনে ছিল রাজশক্তি। কিন্তু এই অবস্থা বদলে গেল বিংশ শতকের থেকে।

(চলবে)

শেষ বেলার গান ৩

‘যখন ভাঙলো … ভাঙলো মিলনমেলা ভাঙলো …’। সেই কবে অদূর ভবিষ্যতের কোনো এক দিন বা রাত্রির হিসাব ধরে মানুষ আনন্দের প্রস্তুতি শুরু করে দেয়। একে একে গোনা হতে থাকে দিন, সপ্তাহ, মাস। আর অবশেষে সেই অমোঘ মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে।

মঞ্চ তখন প্রস্তুত। তার আভরণ সব এসে পৌঁছে যাচ্ছে। শেষ টেনশনের ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে পরিচালকের হাতের আঙুল বেয়ে ঠোঁট থেকে ওপরের স্ট্রাসের কাঠামোর দিকে। প্রস্তুত কুশীলবেরা তাদের সংলাপের নিবিড় অনুশীলনের পরে। আলো শিল্পী, আবহ শিল্পী, প্রসাধন শিল্পী, মঞ্চ শিল্পী, পোষাক শিল্পীরা বেজায় ব্যস্ত হয়ে ডাউন রাইট থেকে আপ লেফট প্রতিমার চক্ষুদানে টেনে চলেছে তুলির আঁচড়। ড্রপসিন অপেক্ষায় ঝোলে আর কিছু পরেই মালাবদল।

এত ব্যস্ততা, এত শোরগোল, এত চিন্তার জমাট বুনন ছিঁড়ে এক সময়ে সব আলো নিভে যায়। কুশীলবেরা ফিরে গেছে নিজের চিলতে বাসে পরের অধ্যায়ের প্রস্তুতির জন্য। মানুষের আপাত মিলনমেলা ভেঙে যায়, তবু জারি থাকে খোঁজ।

খোঁজ জারি থাকে মানুষ আর নিহিত ভালোবাসার। খোঁজে কেটে যায় সম্পূর্ণ এক নষ্ট জীবন। অন্তরালে সূর্য ডাকে, “আয়…আয়…ও অবয়ব আয় তোকে ঔজ্জ্বল্য দিই, উত্তাপ দিই। আয় রে ছায়া তোকে দিই রোদ্দুর।” আঘাতের পরে আঘাতে বোধশূন্য ছায়াবয়ব সেই একচিলতে আশাতেই বাঁচে … হাঁটে … এগিয়ে চলে সামনের উন্মোচন উৎসবের সন্ধানে। ঠোঁটের কিনারে, মস্তিষ্কের সুপ্ত কোষে কে যেন গেয়ে চলে, “চলো মুসাফির বাঁধো গাঁঠরি রাস্তা বহোত দূর হ্যায়! চরৈবেতি … চরৈবেতি …”

বোধের তফাৎ হলেই বোধগম্যতা দূরে সরে যায়। শিক্ষায়, মননে, চিন্তায়, কল্পনায় মিল হলে সেটাই বাড়ী হয়ে ওঠে। বোধ বেঁচে ওঠে নিজের মত করে। ভালবাসে প্রবল আবেগে। গভীরে চলে যায়, সমস্ত শরীর মন একাকার করে চুমু খায় ভালবাসাজনকে বন্যার জলের তোড়ে। সেখানেই তৈরী হবে তার সম্পূর্ণ নিজস্ব বাড়ী, তার একান্ত নিজস্ব ঘর।

শেষ বেলার গান ২

মাঝেমধ্যে শাহেনশাহ হয়ে যাই। দু হাতে বিলিয়ে চলি সঞ্চ‌িত নুড়ি পাথর। নিজের মনে নিজেকেই বলি ‘খুশহামদিল – খুশহামদিল’। রাত্রির মধ্যযাম হোক কিম্বা শীতের দুপুরের কৃপণ রোদ্দুর আমার মাথায় তখন ইউক্যালিপ্টাস পাতার তাজ, হাতে ময়ূর পালক।

সামনে নৃত্যরত বিদ্যুৎ মাটির পাত্রে মদিরা দেওয়ার আবছায়ায় গানের ফুলকি উড়িয়ে দেয়, ‘লাগ যা গলে…’। কখনো কি পুরোনো বিষন্নতার গান সত্য হয়ে যায় প্রত্যেক পায়ের জলছাপে। বাদশাহী মেজাজ গাঢ় হতে হতে সূর্যাস্তের শেষ রক্তহংস হয়ে যায়।

‘মুঝকো ইস রাত কো তানহাই মে আওয়াজ না দো…’। নদীর দু পাশের সবুজ ফসল প্রসবিনী ক্ষেত টাইম মেশিনের ফাঁকে পড়ে কখন যে ধূসর হয়ে যায় কেউ তার নিয়ত হিসাব রাখে না। তনহাই বেশি হয়ে গেলে মদিরা আক্রমণ করে মস্তিষ্কের কোষে।

নদীর পাশের পাখি আর হরিণেরা ফিরে যায় যে যার নিজের ঘরের বিশ্বস্ততায়। বাদশাহ ফিরে চলে নিজের ফেলে আসা কবরের শান্ত পাতাঝরা নীরবতায়। বেলা শেষের গান সুর তোলে আবহে।
মাঝে মাঝে ঝাপসা হয়ে যাই …

খাঁটি বেওসাদার

271839

শস্তা দেখে বস্তা কিনে
পোস্তাবাজার যাই
ঘেসোনুডলস, পাস্তা ভরি
হোলসেল সাপ্লাই।

সবুজ নধর ঘাস
নিজেই করি চাষ
ঘাসের বীজে তেল তৈরী
জ্বালিয়ে হাড় ও মাস।

কায়দা করে সওদা করা
আমার ভীষণ নেশা
সওদা থেকেই পয়দা করি
এটাই আমার পেশা।

পূর্বী থেকে ওজন করে
ডার্বি কিনে আনি
আর্বীতে তাই বিক্রি করি
পেরিয়ে কালা পানি।

বেওসা আমার রক্তে আছে
মৌসা কড়োরপতি
ঘাস বেচেই গেটস হব
কার তাতে কি ক্ষতি!

শেষ বেলার গান

দেখতে দেখতে জানুয়ারির তিন তারিখও শেষ হতে চলল। এইভাবে প্রত্যেক বছর আসে, যায়, সঙ্গে নিয়ে যায় আলোর ঝলকানি একের পর এক উৎসব মুহূর্ত। রেখে যায় জলের মধ্যে জলের দাগ, একগুচ্ছ শীতের ঝরাপাতা স্মৃতি।

স্মৃতি থাকে, কিন্তু শতাংশের হিসাবে খুবই সামান্য। স্মৃতি থাকে আমাদের নীরব অন্ধকার নিউরনের বন্ধ কুঠরিতে। ভালো থাকে খারাপ থাকে। তবুও সময়ের দ্রুতগতির ধাবমান চাকায় ধীরে ধীরে পিষে যায় বয়ে চলে যাওয়া বহু খারাপ সময়।

কে কখন এসেছিল, কে কখন চলে গেল সাত ঘোড়ার ফিটন গাড়িতে! শীত শুধু আনন্দ পৌষল্যা দেয় না, শীত শোক এঁকে দেয় দরজার চৌখুপিতে। শীত আসে যন্ত্রণায় ঢাকা মহামারীর হাত ধরে। অখণ্ড অবসরের অনির্দেশ্য দিন আর রাতের হিসাব তালগোল পাকিয়ে শীত আসে কৈশোরের খেজুর রসের সুগন্ধি স্মরণে।

প্রতিশোধস্পৃহা, রাগ, অভিমান সামান্য কিছু সময়ের মনন অতিথি মাত্র। একটা সময়ে সব অপরাধ, সব অবহেলা, সব অপমান ক্ষমা করে দেওয়া হয় কালের প্রলেপে। অজর অমর হয়ে থেকে যায় ভালবাসার স্নিগ্ধ কিছু গান। হাতের ভেতরে থাকে শীতের গোলাপি হাতের ছোঁয়া।

ভালো থাকা না থাকা ২৪

ধীরে ধীরে রাত্রির শ্বাস গাঢ় হয়ে আসছে। মাথার ওপরে পৃথিবীর ছাদ রঙ বদলে যাচ্ছে একটানা, হালকা ছায়া থেকে গভীর, আরও গভীর, আরও গভীরতর। কুমারী হাওয়ায় শরীরের প্রত্যেক খাঁজে লেখা হয়ে যাচ্ছে অলৌকিক কবিতা। নেপথ্যে প্রগাঢ় নিবেশে মান্না ভাসছে – “ক ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালবাসবে…”।

হাতে গোনা দিন দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। কখন যে বৈশাখী উদ্বেলিত মেঘের দল শান্ত হৈমন্তিক রোমান্স পেরিয়ে পৌষের নীল শীতআদরের দরজায় ডেকে যায়, কখন যে সময় ফুরিয়ে যায় কেউই তার হিসেব রাখতে পারে না।

শেষ বাস্তুসাপও মাটির ত্রিশ হাত নীচে আশ্রয় নিয়েছে কুণ্ডলী পাকিয়ে। তার খসখসে আপাত প্রেমবোধশূন্য ত্বক আস্তে আস্তে মোটা হয়ে পরম প্রেমে জড়িয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখবে আসন্ন অন্ধকার শীতের কামড় থেকে। পৃথিবীর শেষ বাস্তুসাপের দু চোখের মাঝখানে বয়ে যায় ছোটনাগপুর মালভূমির স্বচ্ছ একলা ঝোরা।

মাটির ওপরে হেমন্ত কুয়াশার দিকে এক মুঠো তাচ্ছিল্য ছুঁড়ে দিয়ে হেঁটে যায় আজন্ম বালক, যার মস্তিষ্কে আজও পর্যন্ত কোনো ক্ষমতা দখলের গল্প কড়া নাড়েনি। প্রাচীন সিন্ধুর ছলছল ঢেউ তাকে ডেকে বলে, “এ দিল তুম বিন কাঁহি লাগতা নেহি, হাম ক্যায়া করেঁ…”।

সাধু সাবধান

সত্যি কথা বলতে কি
আমরা যখন ছোট ছিলাম-
মনের মধ্যে ভুল ছিল,
কিন্তু তখন খুশ ছিল
অভিমানে অনুরাগে
কাটিয়ে দিতাম দিনগুলো,
পরস্পরের প্রতি কেমন
অখণ্ড এক টান ছিল।

মোদ্দা কথা আমরা যখন
মাঝের দলে পা দিলাম,
সবজান্তা নেতা হয়ে
পায়ের ওপর পা তুলে
ভক্কি দেওয়ার শিক্ষা পেলাম,
চালবাজি আর পরস্পরকে
প্রবঞ্চনার প্রেজেন্টেশান…
আদর্শের বুলি কপচেই
কেরিয়ারের দৌড় দিলাম,
দাদা কাকা ধরে নিয়ে
সমস্ত দিক সামাল দিয়ে
কুয়োয় বাঁধা মন লুকিয়ে
গায়ে বড়র রঙ চড়ালাম।

ভালবাসার ঝুড়ি থেকে
আশেপাশের দানগুলো
কখন যে সব ফাঁক হল
পারিওনি তা জানতে,
ফোঁপরা বালির বাঁধে বসে
গোঁফজোড়াতে তা দিয়ে
চালবাজি টা লুকিয়ে ফেলে
কেউ জানেনা-কেউ বোঝেনি
এই চালাকি মাথায় নিয়ে
মানুষ থেকে জন্তু হলাম।

দুদিন পরে ভস করে
অবিশ্বাসের বাঁধ ভেঙে
তলিয়ে যাব ফস করে,
যাদের ঠকাই- যারা ঠকে
ঠকে শিখে পরম স্নেহে
শুদ্ধ করতে যারা বকে,
ভালবাসার হাত সরালে
বহুকষ্টে গড়ে তোলা
ইমেজ হবে ষাটখানা
ঝুলকালিতে জড়িয়ে গিয়ে
সবার চক্ষুশূল হোলে
কোথায় যাব কূল পাবনা।

বেলা থাকতে আলো থাকতে
আমরা কি তা বুঝবো না?

এক অনন্য দলিল: ২০১৪ তে লিখেছিলেন জিহান আল হামাদী

f71gm4k4

“৭ মার্চ ১৯৭১।
রেসকোর্স ময়দানে মঞ্চ প্রস্তুত। উপস্থিত সম্মিলিত দর্শক শ্রোতারা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তাঁদের অবিসংবাদিত নেতার জন্য। অবশেষে তিনি এলেন এবং উঠে দাঁড়ালেন জনসমুদ্রের মঞ্চে। তিনি শুরু করলেন। তাঁর প্রতিটি শব্দ আছড়ে পড়তে লাগল, ঢেউ খেলে গেল জনসমুদ্রের মাঝে।
“এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”
তারপর-
“রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো
এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ।”

রক্তদানের অহংকারে অহংকারী তাঁর কণ্ঠস্বর, তা শোনাল আশার বাণীও। আর এই আশার বাণী হল স্বাধীনতা, যার জন্য দেশের প্রতিটি জনগন ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর বিরুদ্ধে এবং তাঁর নির্দেশনায় দীর্ঘ নয় মাস জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা।

এই অবিসংবাদিত নেতা হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অবিভক্ত ভারতবর্ষের গোপালগঞ্জ জেলার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে তিনি ১৭ মার্চ, ১৯২০ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। বাবা শেখ লুত্‍ফর রহমান আর মা মোসাম্মত্‍ সায়েরা বেগম৷ পরিবারের প্রথম পুত্র। ৪ বোন ও ২ ভাইয়ের মাঝে তৃতীয় এ সন্তানকে আদর করে ডাকা হতো ‘খোকা’। ছেলেটির ভালো নাম রাখা হয় ‘শেখ মুজিবুর রহমান’।

খুব মোটাসোটা নন তিনি। হ্যাংলা, ছিপছিপে দৈহিক গঠন, তবে সুশ্রী। তাঁর বেড়ে ওঠা শুরু হয়৷ ছায়া-ঢাকা পথ-ঘাটহীন শহর থেকে দূরে নিভৃত পল্লীতে, তাঁর লালিত-পালিত ও পরিবর্ধিত হওয়া। বাড়িতেই তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি, পণ্ডিত সাখাওয়াত্‍ উল্লাহর কাছে। বড় হতে থাকেন তিনি। সামনের সময় অপেক্ষা করছে তাঁর ইতিহাস হয়ে ওঠার পথের দিকে চেয়ে।

৭ বছর বয়সে ১৯২৭ সালে তাঁর স্কুল শিক্ষার শুরু গমা ডাংগা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন ১৯২৯ সালে। শেখ মুজিবুর রহমানের পিতা ছিলেন মাদারীপুর দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার। ১০/১১ বছর বয়সে তিনি পুত্রকে নিজের কাছে মাদারীপুরে নিয়ে যান। সেখানকার মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলে তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হয় চতুর্থ শ্রেণীতে। ১৯৩৬ সালে তিনি গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন।

মাদারীপুর থাকার সময়েই শেখ মুজিবুর রহমানের বেরিবেরি রোগের কারণে চোখে ছানি পড়ে। শেখ লুত্‍ফর রহমান ছেলেকে কলকাতা মেডিকেল কলেজের বিখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক ডা. টি আহমদের কাছে নিয়ে যান। সেখানে সফল অস্ত্রপচারের পর তিনি সুস্থ হলেও ডাক্তারের পরামর্শে তখন থেকেই চশমা পড়তে শুরু করেন।

নবম শ্রেণীতে পড়ার সময়, মিশন স্কুলে ছাত্রদের সভা হবে। এসডিও ১৪৪ ধারা জারি করে সেই সভা বন্ধ করে দেন। ছাত্ররা সমবেত হয়ে মসজিদে গিয়ে সভা করে। শেখ মুজিব দাঁড়িয়ে দু’একটা কথা বলতেই তাঁকে গ্রেফতার করে সেকেন্ড কোর্টে হাজির করে দু’ঘন্টা আটক রাখা হয়। ছাত্রদের বিক্ষোভ ও চাপে শেষ পর্যন্ত কোর্ট থেকেই তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এটাই তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের প্রথম গ্রেফতার।

মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯৩৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বিয়ে হয় ফজিলাতুন্নেসা ওরফে রেনুর সাথে। পরবর্তীকালে এ দম্পতির ৩ পুত্র ও ২ কন্যা সন্তান জন্ম নেয়।

১৯৪০ সালে, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক ও খাদ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ স্কুল পরিদর্শনে আসেন। পরিদর্শন কাজ শেষে বাংলোতে ফেরার পথে এক ছাত্র তাঁদের পথ আগলে দাঁড়ায়। অকপটে বলে যায়, ছাত্রাবাসের ছাদ চুইয়ে পড়া পানিতে বর্ষাকালে ছাত্রদের বিছানাপত্র নষ্ট হবার ভোগান্তির কথা। তা মেরামতের দাবি জানায় সে। প্রধানমন্ত্রী তৎক্ষণাত্‍ তাঁর স্বেচ্ছাধীন তহবিল থেকে ১,২০০ টাকা মঞ্জুর করেন এবং ছাত্রাবাসটি মেরামত করার নির্দেশ দেন।

সোহরাওয়ার্দী ছেলেটির সত্‍ সাহস, কর্তব্যজ্ঞান ও নির্ভীকতায় মুগ্ধ হন। পিয়ন মারফত স্লিপ পাঠিয়ে বাংলোতে এনে নানারকম আলাপ-আলোচনা করেন ও প্রীত হন ছেলেটির প্রতি। এই ছেলেটি আর কেউ নয় পরবর্তীকালের অনেক বিদ্রোহের অগ্রপুরুষ ও সময়ের প্রয়োজনে অনেক মহান বাক্য উচ্চারণ করা শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি সোহরাওয়ার্দীকে রাজনৈতিক গুরু বলে স্বীকার করতেন। আর শেরেবাংলা পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘নাতি’ বলে সম্বোধন করতেন।

১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমান মাওলানা আজাদ কলেজ) আইএ ক্লাসে ভর্তি হন। তখন থেকেই মুসলীম লীগ রাজনীতিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন তিনি।

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৬ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসে অনার্সসহ ব্যাচেলার ডিগ্রি লাভ করেন। তখন থেকেই তিনি ছিলেন প্রাদেশিক বেঙ্গল মুসলিম লীগের কর্মী এবং ১৯৪৩ সাল থেকেই ছিলেন সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর। বঙ্গীয় মুসলিম লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী-হাসিম গ্রুপের সাথে তিনি ছিলেন সক্রিয়ভাবে যুক্ত। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ তাঁকে ফরিদপুর জেলার দায়িত্বে নিয়োজিত করে।

১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি-দাওয়ার প্রতি কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে ১৯৪৯ সালের প্রথমদিকে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। তারপরই তিনি আবার গ্রেফতার হয়ে যান। তাই তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা জীবন আর সমাপ্ত হয়নি। ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি মুক্তি লাভ করেন শেখ মুজিব।

এ বছরের ২৩ জুন, ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক গোপন বৈঠকে “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী-মুসলীম লীগ” গঠিত হলো। একজন রাজবন্দি হিসেবে তখন তিনি ফরিদপুর জেলে অন্তরীণ ছিলেন। কারাবন্দি থেকেই শেখ মুজিব নির্বাচিত হলেন অন্যতম যুগ্ম-সম্পাদক পদে। ১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে জেল থেকে বেরিয়েই শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অক্টোবরে আর্মানীটোলা থেকে এক বিশাল ভুখা মিছিল থেকেই গ্রেফতার হলেন মাওলানা ভাসানী, শামসুল হক আর শেখ মুজিব।

১৯৫২ সাল। তিনি তখনও জেলে৷ ভাষার জন্য আন্দোলন-সংগ্রামে দেশ তখন উত্তপ্ত। ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশনের দিনটিকে ঘোষণা করা হলো ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন আকস্মিকভাবে ১৪৪ ধারা জারি করলে গভীর রাতে কিছু ছাত্রনেতা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নেন। শেখ মুজিব কারাগার থেকে এই সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানান এবং মহিউদ্দিন আহমদকে সঙ্গে নিয়ে অনশন অব্যাহত রাখেন।

২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর শহীদ হন। কারাগারে স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হওয়ায় ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেওয়া হয়। মাওলানা ভাসানী স্বীয় ক্ষমতাবলে শেখ মুজিবকে আওয়ামী মুসলীম লীগের অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করেন। ১৯৫২ সালে মহাচীনের রাজধানী বেইজিং নগরীতে আয়োজিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগ দেন শেখ মুজিব। ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে দলের সভাপতি হবার আগ পর্যন্ত তিনি এ পদে ছিলেন।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, যিনি শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু, তাঁর মতো শেখ মুজিবও পার্টির সংগঠন ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অনুধাবন করতেন। দলকে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে তিনি ১৯৫৭ সালে আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিপরিষদ (১৯৫৬-১৯৫৮) থেকে পদত্যাগ করেন এবং তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। মুজিব ছিলেন দক্ষ সংগঠক। তিনি ষাটের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং অগ্রসর হতে সক্ষম হন। সোহরাওয়াদী তখনও রাজনৈতিক দলসমূহ পুনরুজ্জীবনের পক্ষে ছিলেন না এবং এনডিএফ বা ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টভুক্ত হয়ে একযোগে সকলের কাজের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু ১৯৬৩ সালে শেখ মুজিব এনডিএফ ত্যাগের ঘোষণা দেন।

২৫ জানুয়ারি, ১৯৬৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। সেই সভায় মওলানা তর্কবাগীশ সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। এই প্রস্তাবিত ৬ দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ। ১৯৬৬ সালের ১ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এবছর প্রথম তিন মাসে শেখ মুজিব ৮ বার গ্রেফতার হন।
এ সময় রাজনৈতিক অঙ্গন অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। ৬ দফা প্রকাশ হওয়ায় বাঙালিদের হৃদয়ে আশার নতুন আলো দেখা দেয়। ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত এক প্রেসনোটে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১নং বিবাদী হিসেবে শেখ মুজিবকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট থেকে গ্রেফতারের ঘোষণা দেয়। এর পূর্বের ২০ মাসও শেখ মুজিব জেলে আটক ছিলেন।

১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি সমাপ্ত হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ মামলার অন্যতম প্রধান আইনজীবী ছিলেন। একই সময়ে তিনি আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বও পালন করছিলেন। এ সময় ছাত্র ধর্মঘট এবং বিক্ষোভে ঢাকাসহ সারা দেশ ফুঁসে ওঠে। পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস, কারফিউ, সান্ধ্য আইন, ১৪৪ ধারায় দেশ অস্থির হয়ে ওঠে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে রাজপথ৷ অবশেষে সরকার ‘প্যারোলে’ মুক্তি নিয়ে শেখ মুজিবকে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের কথা বললে তিনি তা প্রত্যাখান করেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সংক্রান্ত অর্ডিন্যান্স বাতিল করেন। মুক্তি লাভ করেন শেখ মুজিবসহ আগরতলা মামলার অন্য আসামিরা।

১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে গণসম্বর্ধনা দেওয়া হয়। সেই সভায় ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে সভার সভাপতি তোফায়েল আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নিরঙ্কুশ এ বিজয়ে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মাঝে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ১৯৯টি আসন লাভ করে।

১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন। পাকিস্তানের দুই প্রদেশের জন্য দুই প্রধানমন্ত্রীর যে দাবি ভূট্টো করেছিল বঙ্গবন্ধু তার তীব্র সমালোচনা করে তা প্রত্যাখান করেন। ১৪ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ভবিষ্যত্‍ প্রধানমন্ত্রী বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেও ১লা মার্চ তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা দিলে দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। দেশ জুড়ে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। আসে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ।

রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার ঢল নামে। সবাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার অপেক্ষায়। এ সেই দিন, যেদিন তিনি প্রদান করেন এক ঐতিহাসিক ভাষণ। তাতে ছিল নির্দেশনা আর সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতির কথা।

এরই মাঝে ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া ঢাকা আসে আলোচনার জন্য, যা ২৫ মার্চ সকাল পর্যন্ত চলে। কিন্তু আলোচনা অসমাপ্ত রেখে হঠাৎ ইয়াহিয়া গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যায়। এদিকে ঢাকায় ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা নিরীহ জনগণের উপর বর্বরোচিত হামলা করে। গণহত্যা চালায়। ২৫ মার্চ সকালে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান ডিএফআই চিফ মারফত খবর পান ঢাকায় ক্র্যাকডাউন হতে যাচ্ছে। সাথে সাথে তিনি দলীয় হাই কমান্ডের নেতা ও অন্যান্য নেতাদের আত্মগোপনে যাবার নির্দেশ দেন। নিজে রয়ে যান ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে। ২৫ মার্চ রাতের শুরুতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। প্রথমে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এবং পরে তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।

এরপর বঙ্গবন্ধুর আদর্শের হাইকমান্ড গোপনে ভারতে চলে যায়। সেখানে অন্যান্য নেতাদের সহযোগিতায় এবং ভারত সরকারের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁকেই রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদকে মন্ত্রী করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বদ্যিনাথ তলার আম্রকাননে সরকার শপথ গ্রহণ করে। প্রবাসী এ সরকার মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও পরিচালনা এবং বহিঃর্বিশ্বের সাথে যোগাযোগও সমর্থনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রাম, ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত আর ৩০ লাখ বাঙালির রক্তে স্নাত হয়ে স্বাধীনতার সূর্য ওঠে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। যার জন্য এতদিনের অপেক্ষা, প্রতীক্ষা।

স্বাধীন দেশে ফিরে বাংলাদেশ সরকার তাদের কাণ্ডারী বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলে এবং ১৯৭২ সালের ১০ মার্চ তিনি লন্ডন হয়ে বাংলাদেশে আসেন। এদিন ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর শিরোনাম ছিল “ঐ মহামানব আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ জাগে৷” দৈনিক পূর্বদেশ- “ভেঙ্গেছে দুয়ার, এসেছে জ্যোতির্ময়” আবারও রেসকোর্স ময়দানে এসে দাঁড়ান তিনি। লাখো মানুষ আনন্দাশ্রু ভেজা চোখে তাদের জাতির জনককে বরণ করে নেয়।

এবার তিনি হাত দেন দেশ গঠনে। মন্ত্রী পরিষদ শাসিত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং নিজে প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করে। তিনি প্রায় সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তাঁকে অত্যন্ত প্রতিকূলতা এবং বিধ্বস্ত অবস্থার মাঝে কাজ করতে হয়।

তিনি যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি অসংখ্য সমস্যা-সঙ্কুল, সাড়ে ৭ কোটি জনমানুষ অধ্যুষিত দেশের সমস্যা সমাধানের কাজ শুরু করেছিলেন শূন্য হাতে দেশ পরিচালনার মাধ্যমে। আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন, তাদের দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন, অনাহারি ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে অন্ন যোগান এবং আরো নানামুখী সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়। বিপুল অস্ত্র তখনও দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে রয়ে গেছে। তিনি আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং দেশ জুড়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য রক্ষী বাহিনী গঠন করেন। এ পদক্ষেপ ব্যর্থ হয়। এরই সাথে তাঁর সরকারের মাঝে অবস্থানকারী কতিপয় ক্ষমতালোভী, চাটুকার, স্বার্থলোভীর নির্লজ্জ কর্মতত্পরতায়, বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে। দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। শেখ মুজিবের সাথে তাঁর দুঃসময়ের অনেক প্রকৃত সাথীর দূরত্ব বেড়ে যায়।

এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য শেখ মুজিব একদলীয় ‘বাকশাল’ গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। এবং দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কিন্তু কোনো সুখকর উন্নতি আসার আগেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে স্বাধীনতা বিরোধীদের তাবেদার এক শ্রেণীর উচ্চাভিলাসী, সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্য। এ সময় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং প্রথিতযশা রাজনৈতিক নেতারা শেখ মুজিবকে সেনাবাহিনীর এক অংশের মাঝে তাঁর উপর পুঞ্জিভূত ক্ষোভের কথা তাঁকে অবগত করেন। কিন্তু তিনি বলতেন-’এরা আমার সন্তানের মতো।’ তাঁর স্বভাব-সুলভ উদারতা তাঁর বিপদ ডেকে আনে।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল৷ রাতে সেনাবাহিনীর বিপথগামী সেনারা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন ঘেরাও করে ভেতরে প্রবেশ করে এবং তাঁর পুত্র, পুত্রবধু, স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজনসহ ১৭ জনকে গুলি করে হত্যা করে। তাঁর মৃতদেহ হেলিকপ্টারে করে টুঙ্গিপাড়া নেওয়া হয় এবং তড়িঘড়ি করে দাফন করা হয়। তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদের প্রত্যক্ষ মদদে এ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। বাঙালি জাতি চিৎকার করে কাঁদার পরিবর্তে স্তম্ভিত হয়ে যায়। দেশের স্বাধীনতার জনক তাঁর বুলেট বিদ্ধ ঝাঁঝড়া বুক নিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছেন যে এই মাটিতেই। এ যে লজ্জা, শোক কি তাকে অতিক্রম করতে পারে?

আজ ১৭ই মার্চ, বাঙালি জাতির জীবনের এক আনন্দের দিন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৪তম জন্মবার্ষিকী। আজও আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ দেহ, সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবি, কালো মুজিব কোট, পেছনে আঁচড়ানো কাঁচা-পাকা চুল, কালো মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতে পাইপ৷ শুধু সে পাইপ থেকে এডিনমুর’স তামাকের সুবাস বের হয় না।

তথ্যসূত্র :
১. বাংলা পিডিয়া। ২. উইকিপিডিয়া। ৩. “মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি” – আমির-উল ইসলাম। ৪. “দুশো ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা” – মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ নুরুল কাদির। ৫. “পলাশী প্রান্তর থেকে বাংলাদেশ” – খুরশীদ আলম সাগর। ৬. “দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান” – লে. জে.এ. কে. নিয়াজী। ৭. “শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ” – শাহজাহান বিন মোহাম্মদ। ৮. “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান” – সিরাজ উদ্দীন আহমদ। ৯. “বাংলাদেশ গড়লেন যারা” – সিরাজ উদ্দীন আহমদ। ১০. “ভুট্টো, শেখ মুজিব বাংলাদেশ” – রাও ফরমান আলী।”

আজ নাটক

সে এক দিন। ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধু পরিচালক – অভিনেতা উজ্জ্বল হকের আমন্ত্রণে সিউড়িতে আননের নাটক দেখতে গেছিলাম। সেদিন অডিটোরিয়ামে বসে নাটক শুরুর আগে লিখেছিলাম নীচের কবিতা। থিয়েটার শেষ হলে সেখানে অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, যার মধ্যে নাট্যকার অতনু বর্মণ এখনো বন্ধু বৃত্তে আছেন। আর থিয়েটার শেষে উজ্জ্বলের বাড়িতে যে আন্তরিক আতিথেয়তা পেয়েছিলাম ওর পুরো পরিবারের কাছে সেটা আজও ভুলিনি। সেখানে রাত্রিবাস করে ফিরেছিলাম পরদিন সকালে। Ujjwal ও অতনু দুজনেই আরও উজ্জ্বল হয়েছেন তাঁদের থিয়েটার নিয়ে। এই আনন্দটুকুই থেকে যায় স্মৃতির সঞ্চয়ে।

2475

নিঃশব্দ অডিটোরিয়ামে
মহুয়ার ঝিম ধরা আলো
সহস্র চেয়ারের বলিরেখায়
মশাদের গুনগুন সমাপতন
ড্রপসিন ফাঁক করে
উঁকি দেয়
আলুথালু মঞ্চ
খাঁজ কাটা স্টেপ বেয়ে –
‘মা এদিকে এস…’
রসের কলসি আসে
দ্রিমিদ্রিমি পায়ে
ইতিউতি প্রস্তুতি
আজ নাটক।

কথা অকথা

মাঝে মধ্যে কথা বলার খুব ইচ্ছে করে। এমনিতে সবার সঙ্গে বসে জমিয়ে গল্প করতে আমি কোনদিনই দক্ষ নই। অনেকে বসে থাকলে অন্যদের কথা, গল্প শুনি। আর মাঝেমধ্যে টুকটাক বলি। গল্প শুনতে বেশি ভালো লাগে। কিন্তু কথা বলার সব ইচ্ছে চাগিয়ে ওঠে এরকম রাতে।

বাইরে গত রাত্রি থেকেই কখনো বেশি কখনো কম নাগাড়ে বৃষ্টি পড়ে চলেছে। রাত্রি ঘন হচ্ছে। সারাদিন পুজো প্যান্ডেলে যারা হপিং করেছে তারা সারারাত জেগে থৈথৈ করার শত ইচ্ছে সত্বেও বাইরে থেকে বাড়িতে ঢুকে পড়তে বাধ্য হয়েছে। আর সারাদিনের ক্লান্তি তাদের ঘুমের রাজত্বে টুপ করে ঢুকিয়ে ফেলেছে। এরকম রাতে যখন প্রকৃতি কথা বলতে শুরু করে, তখন আমি তার একমাত্র শ্রোতা। তার একমাত্র প্রেমিক। গরম দুধে সর পড়ার মত পরতের পরে পরত পরে সুস্বাদু হচ্ছে রাত্রি।

বাইরে খুব সূক্ষ্ম স্বরে একটানা ঝিঁঝি ডেকে চলেছে। ভেতরে মাথার ওপরে মানুষের তৈরী নকল হাওয়ার শব্দ। আশ্চর্য এই বৃষ্টির রাত্রিগুলোতে পথ কুকুরের দল কোথায় যায়, কি করে কে জানে! এরকম মগন সময়ে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করে। বলি, নিজের সঙ্গে নিজেই বলি। নিঃশব্দ উচ্চারণে একের পর এক কখনো না বলা কথারা, অস্ফূট না বলা চাওয়া বা না পাওয়ার কথা, বিধিনির্দেশ বেড়াজাল ভেদ করে বেরোতে না পারা কথার দল, হিম ভয়ে জমে যাওয়া শিশু কথারা এই সময়ে স্কুল ছুটির পরে হৈচৈ করে বেরিয়ে পড়ে। নির্বাক সিনেমার মত তাদের হৈহৈ বোঝা যায় অনুভূতির একান্ত কোনো ধমনীতে। কথারা কথা বলে, কথারাই শোনে।

কথারা ঝগড়া করে, যুক্তির পরে যুক্তি শানায়। কথারা ভালবেসে নিজেদের আদর করে। রাত্রি ভিজে যায় অসময় শেষ আশ্বিনের অঝোর বৃষ্টির জলে। এক সময়ে রাত্রি কনসিভ করে। ত্বরিৎ গতিতে তার প্রসব বেদনা ওঠে। কথারা পারদর্শী ধাত্রীর হাতে প্রসব করায় কিছু অনুভবী শব্দ। তাকে কবিতা ভাবলে কবিতা, গদ্য ভাবলে গদ্য, কান্না ভাবলে কান্না, পিরীতিপুরের ঝুম গান ভাবলে তাই। কথা শেষ হলে রাত্রির কোল জুড়ে স্বপ্ন নেমে আসে।

শিরোনামহীন কবিতা

নারকেলের পাতার ফাঁকে পাতলা হয়ে
উঁকি দেয় গেরুয়া ঝিরিঝিরি মেঘচোখ,
তেত্রিশ সার্পেন্টাইন লেনে
সি শার্পে মাথা দোলায় ষাটের দশকের
হলদিবাড়ির স্মৃতির অ্যাকর্ডিয়ান
আর পিটারের যাযাবর গিটার,
রাত্রির দ্বিতীয় চরণ সবে আদরপর্বে।

টুপচুপ আকাশগ্ল্যান্ডের ক্ষরণে
আশ্রয়চ্যুত চারপেয়ে দোপেয়ের যুগলবন্দী
খুঁজে বেড়ায় একটুকরো বেশ্যাছাদ-
অন্তত সেখানে কেউ
গেট আউট বাক্যবন্ধে বাস করেনা।

একটানা ঝিমঝিম বেজে চলা টিনশেড-
দূরের কারখানার বেরসিক ভোঁ-
দেওয়ালে ঝোলানো চারকোনা
বাক্সের লাম্পট্য বিলাস-
উদাসী রাতস্পর্শে বিন্দুছাপও ফেলেনা।

শোঁ শোঁ হাওয়ায় কোন দূরবাসিনীর গলায়
ফিরে ফিরে আসে ইন্দুবালা রাগ বেহাগে।

নিজকিয়া ৯

আমি কি বিষণ্ন হয়ে আছি?
আমি তো বিষণ্ন হয়ে আছি।
ঠোঁটের ওপরে ভ্যানিশিং জলরংয়ে
এঁকে রাখা হাসির নকল টুকরো
হাতের মুঠোয় এগিয়ে দেওয়া
শুভেচ্ছা সন্দেশ কেউই বোঝেনি
ঠিক কতখানি ভেজাল ছিল।
আমি তো বিষগমণ করেছি
এই পান্থবেলায়, দুহাত জড়ো করে
ওয়েলকাম করেছি তোমার
অনাকাঙ্খিত গমণ; এই অবেলায়
দরজার বাইরে জুতো খুলে
কথারা অকালমৃত হয়:আমি তো
বিষণ্নই আছি, বিষণ্ন থাকবো
আমার বয়ে নেওয়া বাকী
অবসাদগ্রস্ত হলুদ বিকেল সময়।

দহন ২৯ এবং ৩০

unti

দহন ২৯

মৃত্যু আসে চুপিসারে
মৃত্যু আসে কক্ষে
মৃত্যু আসে অন্ধকারে
নিবিড় কৃষ্ণ পক্ষে।
***

দহন ৩০

হাতে রইলো ক্ষয়াটে পেন্সিল
ভাঙা শ্লেট গড়াগড়ি যায়
আবহে খোয়া খোয়া চাঁদ
পাটিগণিত বাংলা নেশায়।

মেমসাহেবা

একঘন্টা বকমবকম করার পরে আজও
আসল কথাটাই বলা হলো না,
ফোন তুললেই তুই এমন
পাহাড়ি ঝোরা হয়ে যাস!
আর আমি ভাসতে ভাসতে
সাঁঝবিহানের কল্পমানুষ হই।

চার চারটে বছর মেশিন হয়েই
কাটিয়ে দিলাম এপাড়া ওপাড়া,
কলেজের পড়ার রক্তচাপ বাড়ছে যতই
ততই ইচ্ছে করছে এই সব
চারদিকে ছড়ানো ছেটানো
বই খাতা পেন পেন্সিলের আজন্ম
সংস্কার লাথি মেরেই তোর দরজায়
টুক টুক ফিস ফিস এই এই এই…
কিন্তু তুইই যে বিভীষণ হয়ে বলেছিস…

আর কতদিন এই খেদমতের কড়ায়
রগড়াতে রগড়াতে পুরো মেশিনই হয়ে যাব!
অথচ তুইই যে আমার আশ্রয়,
কেন বুঝিস না আমারও
ইচ্ছে করে নীল খোলা আকাশসীমায়
হুইইই আওয়াজ ছুটিয়ে দৌড়াই
আর তুই বসে থাক বাউন্ডুলে
ইচ্ছেঘুড়ি টা খপ করে ধরবি বলে!

আর কয়েকটা মাত্র দিন,
তারপরেই তো ফাইনাল,
এবারেও তোর কথা শুনেই
দিয়েই ফেলছি চাকরের দলে
নাম লেখানোর প্রথম অক্ষরবলয়ের
আপাতকঠিন ইন্টারভিউ …

কিন্তু তারপর?
এবার পালাবি তো ঠিক
আমার, হ্যাঁ শুধুই আমারই
সঙ্গে যে কোনো নির্জন
কৃষ্ণচূড়া ঘেরা
লালসাদা রেলের প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে
সেই ছবির নীল সবুজ গ্রামে
যেখানে আজও একটা নদী
একটা ঝাঁকড়া চুল গাছ
আর একটা ময়না
একমনে আমাদেরই ডেকে যায়!