ট্যাগ আর্কাইভঃ মামুনের কবিতা

শৃঙ্খলিত বাংলাদেশ!

5399592567

আমার চলার পথে কিংবা
বাড়ি ফেরার সময়, কয়েদী বহনকারী
নীল গাড়িটি আমি প্রায়ই দেখি। শিকের ওপারে
একচিলতে আকাশ ছুঁতে চাওয়া
অসহায় কতগুলো হাত, যেন
নিঃস্ব কাব্যকলার এক বোবা ভাস্কর্য!

আজ আরো একজোড়া হাত দেখলাম
আয়তাকার শিকের ওপারে অসহায়
নির্ণিমেষ চেয়ে থাকা সেই হাত
আকাশ ছুঁতে না পারার অক্ষমতায় স্থবির
অতি পরিচিত ওই হাত জাতির বিবেকের!

শিকের ঘেরাটোপে রোজিনা ইসলাম
মুক্ত স্বদেশে বন্দী বিবেক, যেন শৃঙ্খলিত
একচিলতে বাংলাদেশ!
শিকের ওপারে থেকে যার হাত, আকাশ ছুঁতে চেয়ে
নিঃশব্দে লিখে চলে, আকাশ ছুঁতে না পারার
স্বপ্নভঙ্গের গোপন ইতিহাস!

অপেক্ষায় আছি..
কয়েদী বহনকারী নীল গাড়িটি আমাকে পাশ কাটাবে
শিকের ওপাশে তখন নেই ‘শৃঙ্খলিত বাংলাদেশ!’

#মামুনের_কবিতা_শৃঙ্খলিত_বাংলাদেশ

কবিতাঃ এখন দুঃসময়

inb43764

আঁধারের বুক চিরে ধুমকেতু হবে বলে জন্ম যার
স্বেচ্ছায় শৃংখলিত সেই গণমাধ্যম
বেঁচে আছে এক নিষিদ্ধ নগরীতে।

নতুন দিনের সূচনা সংগীতের কম্পমান লহরী হতে জন্ম যার
নতজানু হয়ে সেই গণমাধ্যম
জেগে থাকে এক ধর্ষিত পরবাসে।

মুক্ত স্বদেশে এখন দুঃসময়!
সাংবাদিকের এক একটি অক্ষর
বলপয়েন্টের প্রসবপথ থেকে বের হতেও ভয় পায়।

এখন লিখতে গেলেই
কে যেন ডেকে বলে, ‘ঠিক লিখছ তো?’
ঠিক বেঠিকের গোলকধাঁধায় অস্থির এই সময়!

সাংবাদিকতা এখন আর সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপায় না
দুঃস্বপ্নে আঁতকে উঠে সাংবাদিক নিজেই খুঁজে ফেরেন
শৃংখলিত এক একটি ব্ল্যাকহোল!

কামরুজ্জামান থেকে মুজাক্কিরের রক্তাক্ত লাশ মাড়িয়ে
কোটি টাকার প্রণোদনার প্রহ্লাদ নৃত্যে উদ্বেলিত যখন সাংবাদিক নেতারা
রোজিনা ইসলাম! তোমার কলম দিয়ে কি লিখতে চাও?

এখন লিখতে গেলেই থামতে হবে
ভাবতে হবে, চাটতে হবে
এখন দুঃসময়!

সুসময়গুলো গণমাধ্যমকে একলা রেখে
বারান্দার চড়ুইগুলোর মত পালিয়েছে
চড়ুইদের ফিরে আসার গল্প লিখো আগে।

দুঃস্বপ্নের এই শহরের প্রতিটি সন্ধ্যা এখন
বিবর্ণ, বিষণ্ন, বিরক্ত আর
বিবশ অনুভবে রিক্ত!

রাতের আঁধার থেকে আরও অন্ধকার চুরি করে
জীবিত হাজারো লাশদের ভিড়ে
নিজের হৃদস্পন্দন শুনবে তুমি অবাহ্নিত এই নগরে।

বিষণ্ন সন্ধ্যাগুলো অবহেলায় গড়িয়ে দিয়ে
এই স্বৈরিণী জনপদে বাস করবে তুমি
এক বোবা শয়তান হয়ে।

নিষিদ্ধ এই নগরীতে লিখতে গেলেই থামতে হবে
ভাবতে হবে, চাটতে হবে
এখন দুঃসময়!

#মামুনের_কবিতা_এখন_দুঃসময়

।। কবিতাঃ একটা গল্প বলি শোনো ।।

[ একটি উপন্যাস লিখে চলেছি অনেক বছর ধরে। প্রথম খন্ড শেষ করে দ্বিতীয় খন্ডের কাজ চলছে। এই সমগ্র উপন্যাসটিকে একটি গদ্য কবিতায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম আমি। আমার কাব্যগ্রন্থ শেষ তৈলচিত্রে এই দীর্ঘ কবিতাটি স্থান পেয়েছে। যারা টেনে কবিতা আবৃত্তি করতে কিংবা এমন ‘টাইপ’ এর কবিতা শুনতে ভালোবাসেন, তারা সাথে থাকতে পারেন ধৈর্য্য নিয়ে; বাকীরা এখান থেকেই ফিরে গেলে চরম বিরক্তিকর বিষয় ‘ধৈর্য্য’র পরীক্ষা দেবার হাত থেকে রক্ষা পাবেন। ]

একটা গল্প বলি শোনো

মিথিলা বাবু!
আজ তোমায় একটা গল্প বলি শোনো
তোমার বাবার গল্প এটা
বাবাতে মিশে থাকা তোমার মাটি, জল, হাওয়া, রোদ
এ সব মিলিয়েই আজ আজকের তুমি জেনো।

তোমার মত হাসপাতালে জন্ম হয়নি আমার
বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মেছিলাম
রহস্যময় কাঠের দোতলা বাড়িতে, আলো-আঁধারিতে
সেথায় রহস্য ছিল অপার।

আমরা পড়া-লেখা করেছি
কেরোসিনের ল্যাম্প ও হ্যারিকেনের আলোয়
বড় একটা উঠান ঘিরে বড় পরিবার
বড় বড় টিনের চৌচালা চারটা ঘরের প্রশস্ত উঠান
ফসল তোলার দিনে গোবর দিয়ে লেপা থাকত
সেখানে ধান মাড়াই হতো গরুর মুখে ঠুসি লাগিয়ে
আমাদের শোরগোলে কাটতো দিন
কেউ দাড়িয়া বান্ধা কিংবা ডাংগুলি খেলতো
উঠানের এক কোণে রান্নাবান্না অথবা ইচিং বিচিং চিচিং।

আমার শৈশবের গ্রাম ছিল নিখাদ নিসর্গ
সূর্য উঠার সাথে সাথে দিনের কর্মচাঞ্চল্যের শুরু
সুর্য ডোবার সাথে সাথে দিনের কোলাহল আর ব্যস্ততার শেষ
সন্ধ্যা নামায় পৃথিবী নিঝুম তখন
তবুও রয়ে যেত ভালোলাগার একটু রেশ।

সারাদিনে যা কিছু দেখতাম-শুনতাম, জানতাম-বুঝতাম
তা থেকে জন্মাতো প্রশ্ন হাজার শত শত
মা’কে, বাবাকে, দাদুকে – যখন যাকে কাছে পেতাম
তার কাছেই জানতে চাইতাম সে সব
উত্তরগুলি একটার সাথে অন্যটা
জোড়া দিয়ে দিয়ে জীবনকে বোঝার চেষ্টা করতাম ততো।

তোমার দাদাভাইয়েরা ছিলেন তিন ভাই
বাবা আমার ছিলেন আর্থিক দিক থেকে সবচেয়ে গরীব
বড় চাচার দুইটি নিয়ে তিন পরিবারের চারটি টিনের ঘর
অসাধারণ জীবনবোধে ছাওয়া সে এক বিচিত্র সংসার।

সব ঘর বাইরে থেকে দেখতে একই ছিল
উপরে টিনের শীর্ষে চাঁদ তারার নক্সা
আর বিভিন্ন ডিজাইন করা কাঠের সিঁড়িটাও অপুর্ব বেশ
একান্নবর্তী মানুষগুলির কি বিচিত্র সাংসারিক জীবন!
কিছু বুঝতাম কিছু বুঝতাম না
এখন বুঝি, এখন ভাবি, কত সুন্দর ছিল সময় তখন
রাগ, অনুরাগ, উদ্বেগ, উৎকন্ঠা, স্বপ্ন , চেষ্টা নিরন্তর
ব্যর্থতা, কান্না, সফলতা, হাসি-আনন্দ উচ্ছ্বাস
জীবন সাদাসিধা তবু ছিল কত উজ্জ্বল স্বাস্থ্যকর।

বাবা মায়েরা কখনো কেউ কাউকে ভালোবাসি বলেছে
বাবুটা এমন স্মৃতি আমার নাই
দেখেছি তবু তাদের সুখ দুঃখের নিঃশব্দ ভাগাভাগিটাতে
একের জন্য অন্যের শ্রদ্ধা, টান
বড্ড স্পষ্ট ছিলো তখন স্যাক্রিফাইসটা-ই।
তাদের চিন্তাগুলি, কথাগুলি ছিলো হয়ত নিতান্তই সাধারণ
আমাদের থাকা খাওয়া সুখ অসুখ বা পড়ালেখা সংক্রান্ত
তাই দিয়ে যে সংসার গড়েছিলেন তারা
তার মহিমা ভুলে যাচ্ছি আজ আমরা বড্ড রণক্লান্ত।

বিশ্বাস, নির্ভরতা আর বিশ্বস্ততায়
বছরের পর বছর ধীরে ধীরে মহীরুহ হয়ে ওঠা
বাবা মায়ের সেই প্রেমকে তারা
র‍্যাপিং কাগজে মোড়ানো দামী উপহারের মতই লুকিয়ে রাখতেন।
সকলের চোখের আড়ালে মাটির নিচে
নিরবে বইতো তাদের ভালবাসার ফল্গুধারা
তার জল হাওয়ায় সতেজ স্বাচ্ছন্দ্যে বেড়ে উঠেছি
আজ আমরা এই পুরানা আছি যারা।

বড় চাচার বাড়িতে প্রতিদিনই ভালো ভালো রান্না হতো
সেগুলোর ঘ্রাণ আসত আমাদের বাড়িতে
মা বাবা তাদের দুই সন্তানের জন্য প্রতিদিন
পারতেন না এই খাবার সংগ্রহ করতে
অতি সাধারণ খাবার তখন আমার মায়ের বিবর্ণ হাড়িতে।

তোমার ছোট চাচু মাকে জিজ্ঞেস করতো ,
‘মা, আজ আমাদের ঘরে মুরগী রান্না করেছো?’
বা হয়ত বলে বসতো, ‘মাংস খেতে ইচ্ছে করছে’
মা এক একদিন কাঁদতেন
এক একদিন রাগ করতেন,
‘তোমাদের যা আছে তা কি সবার আছে? নিজেরটা নিয়ে খুশি হও না কেন?’
বাবা কোন কোনদিন বোঝাতেন,
‘অন্যের জিনিসে চোখ দিতে নেই’।

বাবার কত অসহায় লাগতো এখন তা বুঝি
তাদের কষ্টগুলি সীমাহীন হতো অন্য দুই পরিবারের
স্বাচ্ছন্দ্য আর প্রাচুর্যের সাথে অসম প্রতিযোগিতায়।
মাঝে মাঝে চাচীরা এটা ওটা দিলে মা আরো সংকোচ করতেন
তিনি এর সমান কিছু দিতে পারবেন না জানতেন
তবু কখনো পিঠা পায়েস করতে পারলে দিতেন।
মায়ের মুখটা হাসিতে আলো হয়ে থাকতো তখন!
এদের ভিতরের সুপ্ত ভালোবাসা মাঝে মাঝে চোখ মেলতো
যা অর্থের নিরিখে এক ধরণের দূরত্ব ধরে রাখত
এই তিনটি পরিবার এক সাথে তবু তাদের খাবার ছিল আলাদা
ঈদ কুরবানে বিয়েশাদীতে যাদের পোশাকে আশাকে তারতম্য
তবুও কখনো পাশের বাড়ির সাথে সীমানা নিয়ে বিরোধে
কিম্বা তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণকে ধরে ঝগড়া বিবাদে
তিনটি পরিবার ঠিকই এক হয়ে ফুঁসে উঠত সরোবে।

এক রাত্রে খাওয়া শেষে দুই ভাই শুয়ে আছি
আম্মা খাটে উঠে বসেছেন, আব্বা পড়ার টেবিলের
একমাত্র চেয়ারটাতে বসা।
আমি চোখ বন্ধ করে দু’জনের কথা শুনতে পেলাম
সেই রাতে আমার চোখে গ্রামের নতুন একটা ছবি ধরা পড়লো!
অবারিত নীল আকাশ আর দিগন্ত ছোঁয়া সবুজ মাঠ
খালের স্রোত আর স্কুলের উদ্দাম উচ্ছ্বাস কোলাহলকে পিছনে রেখে
সামনে এসে দাঁড়ালো মানুষ!
নোংরা, হিংস্র রাজনীতির সাথে পরিচয় হলো
জোতদার ভুমিপতিদের শক্তি
আর সেই শক্তি দিয়ে দুর্বল সামর্থ্যের মানুষকে শিকারের নিয়ম জানলাম!
আব্বা আম্মার অচেনা এক রূপ দেখলাম
জানলাম – আমরা গরীব! শক্তিহীন!
শক্তিমানের নির্যাতনের শিকার হবার জন্য উপযুক্ত!

জীবনে প্রথম নিজেকে ঘৃণা করলাম!
ঘৃণায় কী শক্তি তা না জেনেই দুই হাত মুঠো করে শপথ করলাম
বড় হবো! হতে হবেই!
কত আলগোছে সমাজের নির্যাতিত অংশ ছেড়ে
প্রতিবাদী অংশে উঠে গিয়েছি আমরা সেদিন
প্রিয় মিথিলা বাবু!
তা জেনেছিলাম আরো অনেক পরে।

সারা পৃথিবীতে তখন কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের ধাক্কা
যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের প্রথম দিনগুলিতে তার কম্পন বেশ ভালোই উঠেছিল
শুরুতে টগবগে আবেগ আর দিন বদলের তীব্র আকাংখা
যারা মন প্রাণ সমর্পণ করেছিল তাদের সাথে প্রাণের টানে
বিশ্বাসের আকর্ষণে তোমার এই বাবাও যোগ দিয়েছিল মিথিলা বাবু!
অনেক ভালো ভালো চিন্তা ছিল
কঠিন আদর্শ ছিল
মনে মনে প্রত্যেকেই আমরা এক একজন চে’গুয়েভারা!
পৃথিবীর কোথায় কোন কোণায় সমাজতন্ত্র আন্দোলনে নেমে
‘রে রে ‘ রবে পুঁজিবাদকে তাড়া করেছে
প্রতিদিনের জয় পরাজয়ের খবর স্নায়ুকে টানটান করে রাখতো।
যে কোন রকম ভাংচুর
যে কোন লোকসানের বিনিময়ে হোক যৌথখামার হতেই হবে!
জীবনের কী দাম যদি দুনিয়াকে বদলাতে না পারি?
অনাচার অবিচার বন্ধ করার জন্য যা দরকার
যেভাবে দরকার করতেই হবে!
ধনী – দরিদ্রের বিভক্ত পৃথিবীকে এক পৃথিবী করার জন্য
অন্তত একটা সুখী, দু:খ -দারিদ্র্য-অশান্তিমুক্ত দেশের জন্য
যুগ যুগান্ত ধরে চলে আসা ‘দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার ‘ শেষ করার জন্য
একটা দুটো জীবন বলি দিলে কী আসে যায়?
একটা দুটো পরিবারের সাময়িক কষ্ট তো নগন্যই
এই উৎসর্গের মহিমা অপার!

দলে তো ঢুকলাম
এক এক করে খুলতে লাগলো এক এক অচেনা জগতের প্রবেশ দুয়ার।
এক সময় আবিষ্কার করলাম
দলে টিকে থাকার জন্য, দলকে টিকিয়ে রাখার জন্য
কখন অজান্তেই দুর্বলের দল ছেড়ে সবলের দলে যোগ দিয়েছি!
শৈশবের চোখে নিজেকে দেখে বংশ পরম্পরায় চেয়ারম্যান পরিবারের
চেয়ারম্যানদের সাথে নিজের খুব বেশি তফাত পেলাম না
বাঘের বদলে শিয়াল হয়ে বাঘ চরাতে শুরু করেছি!
স্রেফ একটি চাঁদাবাজ এবং গলা কাটার রাজনৈতিক দলের সদস্যে পরিণত হয়েছি!
প্রিয় বাবুটা আজ বলছি তোমায় শোনো
তাত্ত্বিকেরা কেবল টাকাই চিনেছে শুধু
মানুষ চিনেনি কোনো।

মিথিলা বাবু!
তোমার দাদা ভাই খুবই চাপা স্বভাবের ছিলেন
চেয়ারম্যানের সাথে এক গন্ডগোলের পর
বড় দুই ভাই উল্টো ওদের পক্ষ নেয়ার ক্ষোভ- দুঃখ
বাবা কোন দিনই ভুলতে পারেননি।
মনের কষ্টে শেকড় উপড়ে একা একজন মানুষ
এই ইটপাথরের প্রানহীন শহরে এলেন
সম্পূর্ণ নতুন এক জীবন শুরু করলেন।

চিরকালই রাজনীতির শিকার হয়ে সাধারন মানুষেরা
জোতদার ভুমিপতিদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়
তাদের সাথে বিবাদে যাওয়া জলে থেকে কুমিরের সাথে লড়াইয়ের মতই
তাতে জিততে হলে সেই জলের বাইরে এসে আরো বড় কুমির হয়ে ফিরতে হয়।

আমার বাবা একদিন সকালে- শীতের সকাল ছিল সেটা
আমাদেরকে নিয়ে গ্রাম ছাড়লেন।
আজ এই এতোদিন পরে স্মৃতিগুলোও কুয়াশাচ্ছন্ন
অনুভূতিতে বড্ড ঝাপসা মনে হয়।
তবুও মনে পড়ে- আমি, আমার ছোট ভাই মা-বাবার হাত ধরে
আমাদের টিনের দোতলা বাড়িটা ছেড়ে বের হয়ে এসেছি
দুই চাচা তাদের ঘরের ভিতর থেকে ক্ষোভে বেরও হলেন না
চাচীরা অবশ্য কাঁদছিলেন.. আর দাদী?
তিনি পাথরের মত নির্বাক হয়ে ঘরের দরোজায় অটল দাঁড়িয়ে!
তার ভিতরে কি ভাবের আদান-প্রদান চলছিল?
তখন বুঝিনি কিছু.. আজ অনেকটা অনুভব করতে পারছি।

খালের পারে এসে দেখি নৌকা তৈরী
সেখানে আমাদের সাথের মালামাল নিয়ে
আমাদের দূর সম্পর্কের চাচা মেরাফ অপেক্ষা করছেন
আমাদেরকে দেখে স্বভাবসুলভ হাসি হাসলেন
হাসিতে বিষন্নতা
মায়ের চোখ অশ্রুসজল
মাফলারে আর কানটুপিতে আবৃত বাবাকে দেখেও
দাদীর মত ভাবহীন অটল পাথরের কথা সেই শিশু বয়সেও মনে হয়েছিল
আমাদেরকেও কান টুপীতে ঢেকে বাবা হাত ধরে নৌকায় তুলেছিলেন
নৌকা ছেড়ে দিল।

আমার চোখের সামনে দিয়ে আমার পরিচিত গাছপালা
সেই খালের পার, পার থেকে নুয়ে বাঁকা সেই হিজল গাছটি
যার তলায় ছাবি দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরতাম, কত স্মৃতি!
বড় হয়ে বিভূতিভূষনের লিখা পথের পাঁচালি পড়েছিলাম
সেখানে অপুর বোন দুর্গা মারা যাবার পরে
অপু যখন গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছিল
তখন অপুর চোখে যে দৃশ্যগুলো ধরা পরেছিল
তা পড়তে পড়তে আমার সেই দিনটা, সেই দিন দেখা সব কিছু,
সেদিনের শোনা সব শব্দ মনে পড়ছিল।
অপুকে মনে হচ্ছিল আমি
আম আঁটির ভেঁপু’র মত রেলের হুইসেলের মত বেজে ওঠা
লঞ্চের সেই ঘাট ছেড়ে যাবার বাঁশীর শব্দে
ব্যথাভরা মনে তোলপাড় করেছিল শুধু একটা প্রশ্ন, ‘আর কি ফিরবো?’

নদীর কিনারের সাথে গ্রামটা যখন ধীরে ধীরে চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছিল
সেই সময়ে আমার শিশু মনে গুমরে কাঁদছিলো
বড়দের বিরুদ্ধে নিস্ফল – নি:শব্দ অভিযোগ
‘ কেন ওরা কেউ কারো সাথে একটু ভালো হয়ে থাকতে পারলো না?’
হু হু কান্নায় বুক ভেংগে যাচ্ছিলো
নিরবে চোখের পানি বয়ে যাচ্ছিলো নদীর চেয়ে তুমুল স্রোতে
মূহুর্তে মূহুর্তে ভেসে উঠছিল প্রিয় মুখগুলি,
আমার চিরপরিচিত গ্রাম, প্রতিদিনের খেলার সাথীরা
সরু খাল, খালের উপর সাঁকো, খেলার জায়গাগুলো,
প্রিয় পথঘাট, স্কুল, দোকানপাট
যা কিছুই চোখে পড়ছিলো তাকেই মন বলছিলো,
‘বিদায় বন্ধু! আবার দেখা হবে।‘
কিছু দেখছিলাম চোখে.. কিছু দেখছিলাম মনে মনে।
যা কিছুই মনে পড়ছিলো তাকেই মন বলছিলো,
‘বিদায় বন্ধু! বড় হয়ে ফিরে আসবো! ‘

ছেড়ে যাবার সেই অসীম ব্যথা বহুদিন বুকে টনটন করে উঠেছে
ফিরে যাবার সেই আশাও রয়ে গিয়েছিল অনেক বছর
কতদিন বুকে হাত রেখে ভেবেছি,
‘বড় হই! বড় হয়ে যখন ফিরবো
কেউ আমাদেরকে কিছুতেই গ্রাম থেকে বের করে দিতে পারবে না। ‘

সেই পুরনো স্মৃতি!
আমাদের নৌকা যখন ছাড়ে
বৈঠার ওঠা নামার তালে তাল মিলিয়ে
ছলকে ছলকে উঠতে নামতে থাকা পানির সাথে
ছোট্ট বুকটাতে ছলকে উঠছিলো অচেনা কষ্ট!
নদীর পাড় বেয়ে মাঝির গুণ টেনে যাওয়া দেখে মনে হচ্ছিলো
সে যেন টেনে টেনে আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে!
যখন লঞ্চে উঠলাম, লঞ্চ ঘাট ছেড়ে যাবার সময়
মেরাফ চাচা বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লে মনে হচ্ছিল
আমার হৃদয়ে কিছু একটা যেন ভাঙ্গাচুরা হচ্ছে।
শুধু কি একটা গ্রাম ছেড়ে এসেছিলাম সেদিন ?
সে তো ছিলো নিজের জীবনের সাথে বিচ্ছেদ ।

সেদিনের আগে নদীটাকে দেখলেই কতদিন ভেবেছি,
‘জানতে পারতাম – এই নদী কোথায় যায়!’
জানার দিন যেদিন এলো সেদিন সেই নদীকে মনে হলো শত্রু
মনে হলো, ‘কেন নদী এতদূরে বইলো?
নইলে কি এই লঞ্চটা এভাবে আমাদেরকে সবার কাছ থেকে এত দূরে নিয়ে যেতে পারতো?’
আজ হাসি.. যার যেতেই হতো।
নদী হোক না হোক, তাকে তো পথ খুঁজে নিতেই হতো।

গ্রামে চেয়ারম্যানদের থেকে পেয়েছিলাম প্রথম দফায়
শহরে এসেও শ্রেণীবৈষম্য আমার মনে দ্বিতীয় দফায় দাগা দিয়ে গেল
কী ছেড়ে এলাম! কেন সব ছেড়ে এই অচেনা শহরে এলাম?
গ্রামের চেয়ে শহর কিসে আলাদা হলো?
শহুরে সমাজের শ্রেনী বিভেদ আমাকে হতাশ করলো।
মিথিলা বাবু!
আমরা তোমাদেরকে শোষণ মুক্ত একটি সমাজ দিয়ে যেতে পারি নাই
কিন্তু আমরা যে ভুল করেছি, সেগুলো দেখিয়ে দিয়ে যেতে চাই
তোমরা আমাদের মত এই ভুল পথে পা বাড়াবে না
এখন বড় হয়েছো। ভালো মন্দ বুঝতে পারছো
তোমাকে আমাদের সময়টা দিলাম
এতে মিশে যাও
এ থেকে নিজের মত করে যা ভালো নিয়ে নিজেকে পুর্ণ করে নাও
এ এক আয়নাও
এতে দেখতে কি নিজেকে তোমার অন্যরকম লাগছে?

সেই দেশ এখনো আছে
আমরা বড় হয়েছিলাম
কি করে যেতে পারলাম জানিনা
তোমরা কি আমাদেরকে দোষী ভাবছো?
ব্যর্থ ভাবছো? যথেষ্ট চেষ্টা করিনি ভাবছো?
তোমাদের সময়টা কি আমাদের সময়ের চেয়ে অনেক সামনে চলে গেছে?
হয়তো পিছনের মানুষ আমরা
তবু তোমাদের পথের শুরুটা আমাদের এলোমেলো পায়ে চলা থেকেই
তুমি কি এভাবে ভাবো মিথিলা বাবু?
তোমাদের রাজপথের পিচের নিচে আমাদের কাঁচা মাটির পথ এখনো আছে
তার ধুলোমাটির ঘ্রাণ পাও?

এখন যদিও চরম বৈরী সময়
দুঃস্বপ্নগুলি সময়ের বুকে আঁকা
সুসময়গুলোকে কেড়ে নিয়ে এসো
এখন এভাবেই ভালো থাকা।
.
বাবুটা আমার প্রিয় মিথিলা তুমি
গল্প বলছি শোনো
জীবনবোধের পাতায় জড়ানো গল্পটা মোর
সব বাবাদেরই জেনো।।

___________
প্রচ্ছদঃ চারু পিন্টু

বাবা! তুমি কাঁদছ কেনো? : মামুনের কবিতা

গুনগুন সুরে মন ক্ষণে ক্ষণে অণুক্ষণ
বিষণ্ণ করে তুলে হয়ে ওঠে আনমনা যেনো-
বাবা! তুমি কাঁদছ কেনো?
.

এখন খুব ভয়ংকর সময়
মুক্ত স্বদেশে এ কোন দুঃসময়?
বীভৎস দগদগে রাজনৈতিক প্রতিহিংসায়
ছিন্নভিন্ন বাবাদের ছবি হয়ে যাওয়া এ কেমন সময়?
.

মন চলে যায় সুদূর
দুঃসহ ২৬ মে রাত্রির রক্ত রাঙ্গা ডায়রির পাতায়
স্মৃতির বুকে খোদাই হয়ে এদিন
বাবা আমার পাখীর পালক হয়ে ঝরে
যন্ত্রণার দুঃসহ উত্তাপে মাতায়!

.

আগুন…বারুদ… আর্তনাদ…রক্ত…বিচ্ছেদ
মায়ের উৎকণ্ঠিত কণ্ঠস্বরে হাহাকার
অশ্রু … ক্ষোভ … ঘৃণা আর আক্রোশে ফেটে পড়া হায়েনাদের উল্লাসে মাতা
মেঘাচ্ছন্ন সেই বিষাক্ত রাত ছিলো কম্পমান!
ভয়াল নৈঃশব্দকে বুকে নিয়ে মুহুর্তগুলোও শব্দহীন
আমার উদ্বেগক্লান্ত বাবার আর বাড়ি ফেরা হয়নি সেদিন! :(

.

আমার অনুভবে এখন রাত মানেই ঝলসানো মৃত্যু
আগামী অনিশ্চিত ভোরের অপেক্ষায় বিনিদ্র রাত্রি ক্ষেপন
রোদ্রোজ্জ্বল বিকেলগুলো নিশ্চুপ মাঝরাত! এভাবেই কি চলবে জীবন?
সকল কালো মেঘ সরে যাক
সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরা বাবাদের উদ্বেগ মিলিয়ে যাক
বুলেটে ছিন্ন আর কোনো বাবাকে রাস্তায় পড়ে থাকতে হয়না যেনো
বাংলাদেশ! আমার বাবা কাঁদছে কেনো?

#বাবা_তুমি_কাঁদছ_কেনো?

চলো লজ্জাবতী হও


তোমায় যখন বলি শুভসকাল
ঝলমলে হয়ে যায় দিন আমার
তুমিময় সারাবেলা!
তুমি কবিতার সেই স্তবকের মত
ছন্দবিহীন হয়ে ও ছান্দসিক
হেলাফেলায় মায়ার খেলা।

তোমায় না ভাবলে
নি:শ্বাসগুলো নেতিয়ে পড়া পুঁই লতা
লজ্জাবতীদের নেতিয়ে পড়তে দেখেছ কখনো?
আপাদমস্তক লজ্জার ঘোমটায় ঢাকা
এক নির্লজ্জ ঢঙয়ের লাজুক প্রতিচ্ছবি যেন!
তোমায় ছুঁয়ে দিলে ও কি এমনি নুয়ে পড়বে?
পারবে কি অনুভব করাতে আমায়
পুঁই লজ্জাবতীদের লজ্জায় নুয়ে পড়াটা!

মাঝে মাঝে ভাবি নিজে লজ্জাবান হই
এক আকাশ লজ্জায় লজ্জায় হৃদয়গুলোকে নাজুক করে তুলি!
কখনো মনে হয় তুমি লজ্জাবতী হও-
আমি বাতাস হয়ে তোমায় ইচ্ছেমত ছুঁয়ে যাই
লজ্জারা মিছিল করে এসে ভীড় করুক তোমাতে
সাত রঙে রঙিন হও।

চিন্তাভাবনাকে দাও ছুটি
চলো লজ্জাবতী হও!
তোমাতে বয়ে যাওয়া আমি এক মাতাল সমীর
দিকভ্রান্ত এক নাবিক
যে হারিয়েছে দিশা পথের শেষে।

বলো কি হতে চাও!
যাও লজ্জাবতী হও..

একদিন বিভুর সনে

বিভু! আপনি তো কিছুদিন
সুন্দরবন এলাকায় ছিলেন
খুলনা আপনার তাই ভাল-ই দেখা আছে।
আপনার অবস্থানের সময় শিল্পাঞ্চলের ভরা যৌবন!
মানুষ-যন্ত্রের মিলিত রসায়নে
আনন্দে ভারী এক বাতাসে ভেসেছেন আপনি।
.
আমার শৈশবে গিয়ে দেখে আসি চলুন
হৃদয়গুলির রক্তাক্ত হয়ে ওঠার ইতিহাস
একটা জনপদের ইতিহাসের আগেই লেখা হয়ে যায়।
হৃদয় আর জনপদের রক্তক্ষরণের
বীজ কিন্তু বিভু
পেছনের সেই কাঁচা রাস্তার মাথায়-ই লুকোনো ছিল।
.
ছিমছাম এক মহল্লা
ছবির মত সাজানো এক গ্রাম!
আসলে জায়গাটা ছিল
বিভাগীয় শহরের অন্যতম কেন্দ্র বিন্দু।
ইটের সলিং বিছানো প্রসস্ত রাস্তার পাশ দিয়ে
চওড়া ড্রেণের কাজ শুরু হবে বলে শুনছিলাম।
আমি তখন কলাপাতার ঘোড়ায় চড়ে
ইটের রাস্তা দাবড়িয়ে বেড়ানো বালক
আত্মহারা.. নিঝুম নিমগ্ন সুখে!
নিতান্ত-ই এক বালকের আলোয় ঝলমলে বাল্য জীবন!
.
কিন্তু কি জানেন বিভু?
শত আনন্দ মাঝেও
নিরানন্দ ঠিক-ই আনন্দের হাত ধরে ধরে হেঁটে চলে
বিষন্ন করে তোলে মন!
আমাদের ঐ জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে
খেলার ছলে দেখার মত করেই
আচমকা একদিন
সামনে এসে হাজির হয় পরিবারতন্ত্র!
নেতৃত্ব দিচ্ছে মানুষের খোলসে কিছু অমানুষ!!
তখন আমাদের মানুষ-ই বুঝে আসত না বিভু
অমানুষ বুঝব কিভাবে!
.
শেষে মানুষ- অমানুষে মিলানো
এক বিচিত্র সমাজে বড় হয়ে উঠতে লাগলাম।
যখন বুঝলাম একটু, শিখলাম ঢের বেশী
পেতে হলে ছিনিয়ে নাও, অন্যের নেবার আগে।
কোনোকিছুই কারোর একার নয়
অপেক্ষায় ও থাকবে না চীরকাল’।
.
আপনার কি মনে আছে বিভূ
দেশে পলিমার দানা ইম্পোর্টের কথা?
একটা দেশের প্রধান নির্বাহীর অদূরদর্শিতায়
কিভাবে একের পর এক
পাটকলগুলি বন্ধ হয়ে যেতে লাগল!
আদিগন্ত বিস্তৃত ইমারতগুলির নি:সঙ্গ ছায়ারা
কায়া হারিয়ে নির্বাক মৌণতার মৃতপুরীতে পরিণত হল।
সেখানে আরেক আধাঁরের জগতে
কিছু নব্য ইম্পোর্টারদের নগ্ন উল্লাস
এখন কারো চেতনায় একটুও কি নাড়া দেয়, বিভু?
.
মিলগুলির শ্রমিকদের পাওনা টাকা বুঝে নেবার সময় এলো
কেউ পুরো কেউ আংশিক পেলো
অনেকেই পেল না কিছুই!
পাশের অন্য আরো অনেকগুলো পরিবারের মত
আমরাও পথে বসে গেলাম বিভু!
এক মৃত শিল্পাঞ্চলের হাহাকারের শব্দে
অনেক রাতে আমার ঘুম ভেংগে গেছে!
শব্দ শুনেছি কেবল.. কানে বেজেছে শব্দহীন আর্তনাদ
কিছুই করতে পারিনি তখন
সে এক দু:সহ সময় ছিল বিভু।
.
এরকম অনেকগুলি পরিবার
তাদের হাহাকারগুলো নিয়ে এক হল একদিন
বাঁচতে হবে বাঁচাতে হবে, প্রয়োজনে ছিনিয়ে নিতে হবে
না খেয়ে থাকা বড্ড কষ্ট বিভু!
তাই দিনবদলের কিংবা পরিবর্তনের নি:শব্দ শ্লোগানে, রাতের ঘুম ভেংগে গেলে
এই পরিবারগুলোর কোমল যুবকেরা, হিংস্র হয়ে উঠতে থাকে।
ব্যবহারকারীরা ওদের ইচ্ছেমত ব্যবহার করে
যুবকদের চরিত্রগুলি ক্রমশ: মিথে পরিণত হয়।

এক সিনেম্যাটিক জীবন পর্দার বাইরে
ক্ষমতাধর অন্য পুরুষে রুপান্তরিত করে যুবকদের!
‘ফাইট না সাইড’ আহবানে নীরবে সরে যাওয়া
ঐ সময়ের প্রশাসনের নত মুখ
যুবকদেরকে আরো উদ্ধত..অহংকারী করে তুলেছিল।
কিন্তু একটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে
কখনো বিচ্ছিন্নভাবে টিকে থাকা যায় না
বুঝে আসেনি কারো।
.
তারপর.. বিভু?
কেবল-ই ইতিহাস! বলির.. খুনের..ক্রোধের!
না পাওয়ার বঞ্চনায় অক্ষম ক্রোধে তাড়িত হয়ে
অন্য এক সমাজের বাসিন্দা হয়েও দেখেছি বিভু!
কোথায়ও সত্য শিব সুন্দরের মূল্য নেই।
.
অনেক কথা বলে ফেললাম কি বিভু?
যাবার আগে তবে আরেকটু বলে যাই
প্রতিটি সময়ে এক রক্তাক্ত জনপদে
নীলচে স্বয়ংক্রিয় ধাতব ক্ষমতাবান যুবকেরা
একের পর এক বাতাসে মিলিয়ে যেতেই অন্যরা হিংস্র হয়ে উঠেছে।
একসময় ওরাও যখন হারিয়েছে সুদূরে
তখন আরো একদল জায়গা দখল করেছে নিরবে।
মারে আর মরে.. আবার জন্মায়!
এ ভাবে জড় থেকেই যায়!

বিপ্লবীরা কখনো-ই মরে না
তাই না, বিভু?

★বিভু: বড় ভাই/ সাঁওতাল দের দেবতাকে ও এই নামে ডাকা হয়।

_____________________________________________

‘একদিন বিভুর সনে’ কবিতাটি আবৃত্তি করেছে ছোট ভাই Aseef Rezwan​ ।
অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭ তে ‘এক রঙ্গা এক ঘুড়ি’ প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘শেষ তৈলচিত্র’। কবিতাটি এই কাব্যগ্রন্থের। প্রচ্ছদ করেছেন মহান শিল্পী Charu Pintu​

এখনো ভুলিনি তোমায়

সমুদ্র আকাশের অশ্রুজল
সমুদ্র কি আমার চেনা পৃথিবীর শেষ প্রান্ত ও নয়?
যদি এমন হয়
আমি পৃথিবীর শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি-
উপরে নির্ভার নীলাকাশ নিচে আমি
আরো একবার ভিজতে চাইবো আমি সেই অশ্রুজলে।
হৃদয়ের পরতে পরতে জমে থাকা আমার দু:খগুলি
সেই জলে ধুয়ে ধুয়ে সুখ হতে থাকবে।

পাহাড় পৃথিবীর পেরেক কিংবা ভারসাম্য রক্ষাকারী
পাহাড় কি আমার চেনা ভূ-খন্ডের সর্বোচ্চ স্থান ও নয়?
যদি এমন হয়
আমি পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় দাঁড়ানো-
অনেক নিচে নীলসাগর আর উপরে দুরন্ত মেঘমালা
মেঘমালাদের দুরন্তপনায় মাথার চুল আমার এলোমেলো!
অবশিষ্ট দু:খগুলো এখানে এসে হারিয়ে যাক অবশেষে
কষ্টেরা হারাক আকাশের নীলে বাতাসে ভেসে ভেসে।

নদীর কাছে গেলে আমার নারীর কথা মনে হয়
দু’জনেই আজন্ম মেঘবতী আর নতজানু! জল থেকে জলে..
আসলেই কি তারা নয়?
যদি এমন হয়
কোনো এক মধ্যরাতে মাঝ নদীতে ভেসে যাচ্ছি আমি জোছনায় ভিজে ভিজে-
চাঁদেরকণায় ছুঁয়ে যাওয়া রুপালী স্রোত
আমার অণুকষ্টগুলিকে নি:শেষ করে টেনে চলে মোহনার পানে ধেয়ে।

আমি যখন আমার সব দু:খ-কষ্টগুলি
সমুদ্র পাহাড় আর নদীর কাছে বিলিয়ে দিয়ে নি:স্ব হয়ে ফিরে আসি
তখন আমার তোমার কথা মনে পড়ে!
ছুটে আসি আমি তোমার কাছে
দু:খ শূণ্য হৃদয় নিয়ে অনুভূতিহীন নির্বাক
তাই বলা ও হয়না আমার মনের কথা তোমাকে
‘জানো কি মেয়ে? অনেক অনেক ভালবাসি তোমায়!’
তুমি তখন আমার পানে চেয়ে
বললে হেসে আরেকটু পাশ ঘেষে
‘এত সুখ ভাল লাগছে না আর আমার
পারোতো কষ্টগুলোকে ফিরিয়ে আনো আবার।’

আবারো সেই ক্লান্তিকর পদযাত্রা আমার
নদীর জলে ভেসে ভেসে আবারো পাহাড়চূড়ায় আরোহন
আরো একবার সেই সমুদ্রপাড়ে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর শেষ প্রান্তের যুবক হওয়া আমার!
কুহকী প্রহর জুড়ে থাকা শূণ্যতায় ডুবে ডুবে যাই আমি
আকাশের নীল থেকে আমার কষ্টগুলিকে ফিরিয়ে আনতে আরো একবার মেঘবালক হই!

প্রথম দফায় ব্যর্থ হই আমি..

কষ্টগুলি একবার হারালে কেন জানি ফিরতে চায় না আর
ঠিক তোমারই মতন!
অবশেষে হেসে হেসে
দু:খ-কষ্টের পাহাড় নিয়ে আমি ফিরে আসি যখন লোকালয়ে
শুনি তখন আর তুমি নেই আমার
অন্য কারও হাত ধরে নাকি সুখ খুঁজতে বেরিয়েছ!

এমন কেন তুমি!?

এখনো আমি পৃথিবীর শেষ প্রান্তের যুবক হই
এখনো পাহাড়চূড়ার দুরন্ত মেঘমালারা আমার চুলকে এলোমেলো করে যায় পরম মমতায়
মধ্যরাতের নদীর শব্দে ভেসে যায় আমার হৃদয়ের হাহাকার।
এখনো প্রতিটি জায়গায় গিয়ে আমি তোমাকেই খুঁজি মেয়ে
চীতকার করে করে বলি, ‘মেয়ে! এখনো ভালবাসি তোমায়!’

মেয়ে! তুমি কি শুনতে পাও?

উল্লাসমূখর আরো একটি সন্ধ্যা তোমার সাথে কাটাবো বলেই
এখনো ঘুরে বেড়াই পাহাড় সমুদ্র আর নদীর মাঝে..

সমুদ্র পাহাড় আর নদী
এখনো আমাকে তোমার কথাই মনে করিয়ে দেয়।।

শেষ তৈলচিত্র

FB_IMG_1485341895880

সাদাকালো অরণ্য- পাহাড়- নদী পার হয়ে
মরুর ধুলো উড়িয়ে দুরন্ত ছুটে চলা ভাবনার
লাগামহীন এক পাগলাঘোড়ায় সওয়ার হয়ে
নিশ্চুপ বসে আছি।

দুর্দান্ত গতিময় স্বপ্ন – স্থবির বাস্তব – অর্থহীন -সম্ভাবনাহীন।
অথবা কি সম্ভাবনাময়?
কী রং তাদের?
.
এক হঠাৎ বর্ণান্ধ শিল্পী।
যা কিছুই আঁকি – যে রং এ আঁকি – কিছুই দেখিনা।
আঁকার অসহ্য তাড়না ছবির পর ছবি আঁকিয়ে নেয় আমাকে দিয়ে।
অথচ নিজেই দেখিনা কী আঁকি!
.
জীবনের ক্যানভাসে আঁকা ছবিটায় ও কোন রং নেই।
ছবি জুড়ে শুন্যতা। শুন্যতা যেন হঠাৎ সারা পৃথিবীতে।
অনুভূতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে –
“আমি একা! বড্ড একা!”

আমাকে নি:সংগ করে রং গুলো সব
বারান্দার চড়ুইগুলির মতো পালিয়েছে।
.
আমার আকাশে ইচ্ছে ঘুড়িগুলোর কোনো রঙ নেই।
আকাশটা জানি নীল।
সেখানে কষ্টের বিষাক্ত নীলাভ আভা নিয়ে
দুঃখগুলো সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে বেড়ায়।

জানি পৃথিবী রঙে রঙে ভরা।
হরেক রঙের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি- বর্নান্ধ শিল্পী।
.
যে দূরে চলে গেছে, তবু এত কাছে,
তবু দূরে – অন্য কারো।
তার মুখ ক্যানভাসে আঁকি।
শেষ তৈলচিত্রে আঁকি
হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা – ভালো লাগা দিয়ে সেই হাসিমুখ।

এ কি ভালোবাসা! এ কি ভালোলাগা!
কেন অনুভুতি বলে না আমাকে!
তীব্র কষ্ট যেন হিমাংকের বহু নিচে নিয়ে যায় আংগুলগুলোকে।

তুলি এঁকে যায়।
সে কি ভুল রেখা ভুল রঙে আনন্দ আঁকে!
.
দিশেহারা লাগে।
আনন্দ নেই!
ক্যানভাসে শুধুই সাদাকালো কষ্টের ছাপ – তার মুখচ্ছবি!
একজন রঙ বিশেষজ্ঞের জীবনের শেষ ছবিটি – অজানা রঙে আঁকা।
.
অতিপরিচিত একদার আনন্দে উদ্ভাসিত হাসিমুখ
সে আজ কষ্টের তীব্রতায় বিবর্ণ, পাংশুটে।
রং নেই। রেখাগুলি কথা শুনবে না!

ক্যানভাসে আঁকি যেন তার কষ্টভরা মুখ নয়,
এক অহংকারী শিল্পীর ব্যর্থতার ছবি!
মূর্ত উপহাস!

শেষ কবিতা শিশু

15203184_1817209741898463_5309121730885109714_n(1)

ছোট্ট একটি খাকি কাগজের শপিং ব্যাগ
আর হেডবিহীন একটি বল পয়েন্ট পেন
একদিন দীর্ঘক্ষণ পাশাপাশি-
গল্পকারের আসার অপেক্ষায় ছিল তারা।

গল্পকার আসবেন
শপিং ব্যাগটির বুক চিরবেন
বল পেনের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ অক্ষরে অক্ষরে ছেয়ে দেবে নীরব আকাশটিকে!
এমনই ভাবছিলো ওরা..

গল্পকার তখন অন্য ভুবনে একা একা
বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত-বিবর্ণ-বিরক্ত বীতশ্রদ্ধ অনুভবে
এক একটি ভুবন পরিক্রম করে চলেছিলেন নিজের মনে।

বিধ্বস্ত গল্পের কাঠামো দেখে তিনি বিপর্যস্ত
চরিত্রগুলির ক্রমশ: রঙ বদলানো দেখে বিবর্ণ
তার নিজ আকাশে আজ আর কোনো রঙ নেই
অক্ষরের উল্লাসের উৎসমূল মরে যাওয়ায় বিরক্ত তিনি
একটি কবিতাও কেউ আবৃত্তি করতে চায়নি তার
বীতশ্রদ্ধ এজন্যই তিনি নিজের ‘পর।
গল্পকারকে কে কবি হিসেবে মানতে চায় বলুন..

তারপর ও..
খাকি শপিং ব্যাগ হৃদয় উন্মুক্ত করে রাখে সরবে
বল পয়েন্ট পেনটি হেড হারাবার ব্যথা লুকোয় নীরবে
গল্পকার কবিকে লুকান সন্তর্পণে
ফেলুক কবি দীর্ঘশ্বাসগুলো গোপনে।

একদিন গল্পকার কবিকে সাথে নিয়ে ফিরলেন
তখন শপিং ব্যাগটি ধুলায় মিশে গেছে
বল পয়েন্ট পেন তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ হারিয়ে কালিবিহীন শূণ্যতায় নি:শেষ
কোথায়ও কিছু নেই
সব নিশ্চুপ নিঝুম নিমগ্ন সুখে..

কবির মৃত্যু হল আজ
গল্পকার কবির মৃত কবিতা শিশুর লাশ আগলে বসে রইলেন দীর্ঘক্ষণ!!

সকল বর্ডার খুলে দাও

আমি একাত্তুর দেখিনি
গল্প শুনেছি
বাবার কাছে, আমার মায়ের কাছে!
আমি মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে শুনে বেড়ে উঠেছিলাম।

আমাদের সেই সময়ের বসার ঘরে, বঙ্গবন্ধুর এক বিশাল পোর্ট্রেইট ছিলো
বাবা আমাদের সব ভাইদেরকে অনুভব করিয়েছিলেন-
পোর্ট্রেইটের মানুষটা-ই একটা দেশ!
বাবারা কখনো মিথ্যে বলেন না বাবুদের কাছে
তাই পাইপ হাতের মানুষটিকে এক আলাদা ভূখন্ড বলে মনে করা শুরু করেছিলাম।

পনেরই আগস্ট, তিন নভেম্বর কিংবা একাশি’র সার্কিট হাউসের নৃশংসতা
আমার বালক বেলায় সেভাবে অনুভবে আসেনি
তবুও বুঝেছিলাম নিশ্চয়ই ভুল হচ্ছে কোথায়ও।

মৃত্যু আমার কাছে সাদা কাফনে মোড়ানো
আগরবাতি আর লোবানের ঘ্রাণে প্রকম্পিত কিছু বিষন্ন প্রহর বলে মনে হতো!
তাই বুলেটে ছিন্ন জনকের দেহ কিংবা সবুজ বিপ্লবের কর্ণধরের ঝাঁঝরা হৃদয়
মৃত্যুর কোনো সংজ্ঞায়-ই পড়তো না আমার কাছে।

আমি একাত্তুর দেখিনি
নুর হোসেনকে দেখেছিলাম হৃদয়ে বাংলাদেশ আর গণতন্ত্রের মুক্তির বারতা নিয়ে
স্বৈরাচারীর উদ্যত বুলেটকে সামনে থেকে হৃদয়ে টেনে নিতে
তখন আমার অনুভবে মৃত্যু একটু একটু বুঝে আসছিলো কেবল!

আমি একাত্তুর দেখিনি
তবে কানসাট দেখেছিলাম
ততদিনে আমি পূর্ণ অনুভবে অনেক কিছুই বুঝতে শিখে গেছি
আমি কৃষকের ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে মৃত্যুর যন্ত্রণা অনুভব করতে চেয়েছি।
একুশে আগস্ট দেখেছি
রমনা বটমূলের ছিন্নভিন্ন অংগপ্রত্যংগ আমাকে চিৎকার করে করে মৃত্যুর কথা বলেছে!
সারাদেশে একযোগে বোমা হামলা কিংবা চার্চ গুড়িয়ে দেয়া বোমার বীভৎসতা
আমাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে!

আমি একাত্তুর দেখিনি
পিলখানার নারকীয় হত্যাকান্ড কিংবা হলি আর্টিজানে রক্তাক্ত মানুষ দেখেছি
আমি একাত্তুর দেখিনি
তবে ইদানিং রোহিঙ্গা জেনোসাইড দেখছি
সেখানের লাশের স্তুপ আমার ভিতরে কোনো অনুভূতির সঞ্চার করছে না
মৃত্যু দেখে দেখে কি আমি নির্বোধ হয়ে গেছি?

একাত্তুরে দাদারা বর্ডার খুলে দিয়েছিলেন বলেই আজ আমি লিখতে পারছি
হে বাংলাদেশ!
তোমার জন্মের কথা স্মরণ করে হলেও রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াও
আজকের রোহিঙ্গা শিশুকেও আমার মতো অনুভবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করো।
আর, মৃত্যু!
তুমি আসবেই যখন ওদের জন্য আরো একটু শান্তিপ্রদ হও!

বাংলাদেশ!! তোমার
সকল বর্ডার খুলে দাও।।FB_IMG_1484501876968

নিষিদ্ধ নগরী …

এখনো বেঁচে আছি
অন্ধকারকে বুকে নিয়ে এই শহরে!
অবাক হই! যখন
নিজেই শুনি লাশকাটা ঘরে নিজের হৃদস্পন্দন!
জীবিত হাজারো লাশেদের ভিড়ে আজো আছি আমি
অবাহ্নিত এক নগরে।

স্বপ্নের তন্দ্রালু সোপান বেয়ে নেমে আসা প্রতিটি সন্ধ্যা
বিবর্ণ বিষন্ন বিরক্ত বিবশ অনুভবে রিক্ত!
রাতের আঁধার থেকে কিছু অন্ধকার চুরি করে
আজো পথ হাঁটি আমি এই স্বৈরিণী জনপদে।

নষ্ট সময়ের নিঃশ্বাসে বিশ্বাসে
এক মৌন প্রজাপতির নির্মোহ কঠোরতায়
আজো জেগে আছি এই ধর্ষিত পরবাসে।

এখনো বেঁচে থাকা
আঁধারের বুক চিরে ধুমকেতু হবো বলে
নতুন একটি দিনের সূচনা সংগীতের কম্পমান লহরী হতে চেয়ে
এখনো বেঁচে আছি
কুহকী উর্ণনাভ জালের এই নিষিদ্ধ নগরে।।

তারা গুনি আকাশে আকাশে …

বন্ধুরা! কেমন আছিস সবাই?
এখনো কি ক্ষ্যাপা চত্বরে আড্ডা দিস
শহীদুলের চা’র দোকানে
নেড়ে শফিক কি সেই আগের মতই উচ্ছল-
ছল ছল নদীর মত এখনো কি বয়ে চলে সে
হৃদয় থেকে হৃদয়ে..সারাটাক্ষণ?

আকাশের বিদেশ যাবার কি হলো
জানাস তো
পপির সাথে ওর কি এখনো যুদ্ধ চলে
সম্পর্কটা কি টিকে আছে ওদের?

বাতেন স্যার এখন কেমন আছেন রে
আগের মতন এখনো কি কবিতা লেখেন?
একটা বই বের করতে চেয়েছিলেন..

আচ্ছা বলতো, আমরা এতগুলি ছাত্র থাকতে
স্যারের এই ইচ্ছেটা পূর্ণ হল না কেন?
তোরা না জানালে ও
খবর রেখেছিলাম আমি.. একজন ফোনে জানিয়েছিল আমায়
সেই রাতে স্যারের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে অনেক কেঁদেছিলাম!

আমাদের মত এমন কুলাংগার ছাত্র স্যার রেখে গেলেন কেন বলতে পারিস?

সেই হোটেল আল সালাদিয়া’র কথা মনে পড়ে
গলার কাছে কিছু একটা আটকে আসে আমার
ওটার ভেংগে পড়ার আর কত দেরী জানাস তো।
অনেক স্মৃতি আছে আমাদের ওটাকে ঘিরে
ওর ভগ্নপ্রায় প্রতিটি ইটের বুকে জমে থাকা
আমাদের বেকার জীবনের কষ্টকর মুহুর্তগুলিকে
ছুঁয়ে আসতে ইচ্ছে করে এখনো!
আমাদের কষ্টগুলি মুখ থুবরে পড়ত ওর বুকে
আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল ভবনটি পরম মমতায়।
তোরা কি কখনও কখনও যাস ওখানে
আড্ডা জমাস এখনো!
এখনও কি সেই আগের মত.. সব চলে?

আমাদের ইরফান গার্মেন্টস মালিক হয়েছে শুনেছিস বোধহয়
একবার বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম চাকরি চাইতে
আমাকে সমাদর করেছিল বেশ
লাল চা খাইয়ে অনেক কথা বার্তা ও বলেছিল।
ওদের পিওন ছেলেটা অসাধারণ চা বানায়!

চাকরিটা হয় নাই আমার
সিভিটা হয়ত পড়েছিল ওর ওয়েস্টবিনের তলায় অবহেলায়..
কণার সাথে সম্পর্কটা ও তাই পোক্ত হলনা আর।

খালেককে শেষবার দেখেছিলাম বাজারের ফুটপাথে
ওর সব্জির দোকানে সে বসে আছে
দাড়ি রেখেছে তাই প্রথমটায় চিনতে পারিনি আমি-
শেষে যখন হাসল
চিনলাম আমি তাকে
ঐ হাসি কি ভুলা যায়?

এই, তোরা কি এখনও প্রাণ খুলে হাসিস!
আমি পারি না..
আমার আকাশ জুড়ে এখন বেদনার নীল
তীব্র ইলেক্ট্রিক ব্লু আমার চারপাশে..

কাছের মানুষেরা সবাই চাদা তুলে এই দূর পরবাসে পাঠিয়েছে আমায়
শেষ সময়ে আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে কত মরীয়া তারা এখন!
অথচ সবাই মিলে সম্পর্কের সূচনাতে যদি একটু আধটু করত..

আচ্ছা বলতে পারিস
সম্পর্কগুলি কেন এভাবে দু:স্বপ্ন মাঝে বিলীন হয়ে আবারো কাছে আসতে চায়?

আমার বেড জুড়ে নি:সীম নি:সংগতায় ছুঁয়ে থাকি আমি একা
ভুল বললাম, একা নই-
আমি আর আমার দেহে বাসা বানানো সেই ব্যাধি একসাথে পাশাপাশি
শেষ কথা বলে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা..

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমার পরিচিত আকাশ দেখতে পাই না
এখানে মানুষগুলি ও বড্ড অপরিচিত
কিছু-ই বুঝে আসে না আমার
আমি আমার দেশের একচিলতে আকাশ দেখতে চাই
মার্কেটের ছাদের আড্ডার ঘনিষ্ট মুহুর্তগুলি উপভোগ করতে চাই!

স্কুল মাঠে পড়ন্ত বিকেলে শওকত ভাইয়ের সাথে
এক ইটে ফুটবল খেলতে চাই
কলোনীর পানির ট্যাংকের নিচে বসে থাকা
কিংবা শ্মশান ঘাটে মধ্যরাতে গোল হয়ে বসে থাকার মুহুর্তগুলি এখনো ডাকে আমায়!

আমি আসতে চাই
ফিরতে গিয়েও পদে পদে বাধা পাই
সময়ের বড্ড অভাব এখন
তাই চাইলে ও ফিরতে পারিনা আমি :(

আমার সময় কম
তাই আসতে পারলাম না আমি
একসাথে থাকিস সবাই
বন্ধুরা.. ভাল থাকিস
মনে রাখিস!!

#কাব্যগ্রন্থ: শেষ তৈলচিত্রFB_IMG_1484288000675