ট্যাগ আর্কাইভঃ সাঈদ এর অণুগল্প

হীরক রাণীর দেশে

হীরক রাণী: গবেষক, করো কি? খাও কি শুধু ঘাস!
প্রজারা আমার পশ্চাদ্দেশে ঢুকাচ্ছে বাঁশ।
আহারে! বাঁশের ব্যাথা সে কি বুঝিতে পারে
কভু পশ্চাতে আইক্কা বাঁশে দংশেনি যারে।

গবেষক: মহারাণী, বুঝছি সব স্পষ্ট
ইশ! কত বেদনা! কত কষ্ট!
পশ্চাতে ঢুকলে আইক্কা বাঁশ
নিশ্চয় বন্ধ হয়ে আসে শ্বাস?

হীরক রাণী: গবেষক করো কি মশকরা!
ইচ্ছা তোমার বুঙ্গা খেয়ে মরা?

গবেষক: মহারাণী, আমি ক্ষমা চাই, ক্ষমা চাই
নিচের গরম মাথায় তুলতে নাই।
প্রজারা কেনো দিচ্ছে বাঁশ শোনান তাই
ভুলে কুকুরদের কি দিয়েছেন লাই!!

হীরক রাণী: দেশরে ভরে দিছি উন্নয়ন দিয়া,
তবু প্রজারা যায় সাগরে ভাসিয়া,
এ রাজ্য থেকে কি উন্নত মালেশিয়া?

গবেষক: মহারাণীর দুই নয়ন
হীরকরাজ্যের উন্নয়ন,
মহারাণীর শাসন কাল
দশ টাকায় ১কেজি চাল,
মহারাণীর স্বপন ভরে
চাকরী দিছেন ঘরে ঘরে,
তারপরেও সাগর দিয়া
যেতেই হবে মালয়েশিয়া!
প্রজারা অকৃতজ্ঞ কাঙ্গাল
উন্নয়ন বুঝেনা মূর্খ বাঙ্গাল।

হীরক রাণী: গবেষক, এসবই ষরযন্ত্র
পেটের ক্ষিধায় ভুলে গেছে মন্ত্র-
ভাত নাই? মোরগ পোলাও খাও,
চাকুরী নাই? ব্যাবসা করো ফাও,
খামাখা কেনো মালয়েশিয়া যাও?

গবেষক: মহারাণীর পশ্চাদ্দেশ- সহজ কথা নয় তো,
বাঁশ ঢুকানোর আগে সেটা বুঝে নাই হয় তো,
মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলা ছলাকলাময় তো,
দিতে হবে কঠিন শাস্তি জীবনভরা ভয় তো।

হীরক রাণী: যারা ক্ষুন্ন করছে হীরক রাজ্যের মান
ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাদের নিতে হবে জান,
হীরক রাজ্যে গরীবের নাই কোন ঠাঁই
মাঝ সাগরে তাদের ডুবিয়ে দেয়া চাই,
উন্নয়ন জোয়ারে ভাসছে হীরক রাজ্য
অসম্মান অপমান করা হবেনা গ্রাহ্য।

গবেষক: মহারাণী, সাধু সাধু সাধু
সমাধান ঠিক যেন জাদু।

কোরাস: যায় যদি যাক প্রাণ
হীরকের রাণী ভগবান।

লাড়ালাড়ি

বদরুদ্দীন চৌধুরী সাহসী লোক। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় বিভাগের কর্মকর্তা। দায়িত্বের দায়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছুটে বেড়ান। এবার রাজশাহী বিভাগের এক জেলায় এসেছেন। অফিসের বন্দোবস্ত করা অভিজাত হোটেলে উঠেছেন।

বদরুদ্দীন সাহেব একা ঘুমোতে পারেন না। সমস্যা হয়। তার মনে হয় হোটেলের রুমে আরো কেউ আছে। সে মাঝরাতে ঘুম ভাংগিয়ে সেলসের আপডেট জানতে চাইবে-প্রডাক্টের কোয়ালিটি আর কমিশনের ব্যাপারে প্রশ্ন করবে।

রাতের খাবার খেয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলেন। প্রতিবারের মত এবারও ঘুমানোর আগে এটাচড বাথরুম চেক করে ছিটকনি লাগালেন। কার্নিশে কেউ আছে কি না দেখে জানালা লক করলেন। ওয়াল ওয়ারড্রোবের ভিতরে কেউ লুকিয়ে নেই- এটা নিশ্চিত হয়ে লক করলেন। সবশেষে খাটের তলায় আর সাইড টেবিলের তলায় কেউ নাই দেখে নিশ্চিন্ত হলেন। এক গ্লাস পানি খেলেন। সুইচবোর্ড থেকে লাইট বন্ধ করলেন। খাটের পাশের টেবিলে রাখা টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালালেন। বিছানায় উঠতে গিয়েই থমকে গেলেন; বিছানার ঠিক মাঝখানে এক আলুঝালু পাগল বসে আছে। দুজন মুখোমুখি। শিতল কণ্ঠে পাগল বলল,’মামুর বেটা, কাকে লাড়তে কাকে লেড়েছিষ, বিবেক পাগলারে জাগিয়ে তুলেছিষ। ষেলষের আপডেট কি! আয় তোদের ভেজাল প্রডাক্ট লিয়ে লাপাক-ঝাপাক লাপাক-ঝাপাক লাড়ালাড়ি খেলা খেলি।’

ভেজাল পণ্যের তথ্যটা গোপন রাখবে এই শর্তে অসীম সাহসী বদরুদ্দীন চৌধুরী আলুঝালু পাগলের সাথে লাড়ালাড়ি খেলা খেলতে শুরু করলেন- রাত যত বাড়ছে, খেলা ততই জমে উঠছে।

দোয়েলের মন

: তারপর?
: তারপর দোয়েল পাখিটা উড়তে উড়তে চলে গেছে নীলপরীর দেশে। গিয়ে দেখে নীলপরী রানীর কাপড়ে নীল দিচ্ছে আর ফুলের সুবাস মাখাচ্ছে।
: তারপর?
: এদিকে হয়েছে কি লালপরীতো নীলপরীকে দাওয়াত দিয়েছে। কিন্তু পোলাও মাংস কোপ্তা কবাব সর্ষে ইলিশ রান্না করবে কিভাবে! সব জিনিসের যা দাম!
: তারপর?
: তখন সাদা প্রজাপতি বলল ‘শুটকি মাছের ঝাল ভর্তা বানাও, আলুর দম রান্না কর, আম ডাল হলে বেশ হয়, সাথে কাচা মরিচ আর পেয়াজ কুচি তো আছেই। রোজ রোজ মধু খেতে একটুও ভালো লাগে না।’
: তারপর?
: এই না শুনে রাজা বললেন -খাবে তো খাও বেগুন ভাজা আর কাচকলা। বেগুন ভাজার কথা শুনে রানীমা মন খারাপ করলেন। উনার আবার বেগুনে এলার্জি। খুব চুলকানি হয়। কাচকলা খেতে হবে বলে রাজপুত্র কান্না শুরু করে দিল। কান্নার ভ্যা ভ্যা শব্দে মন্ত্রীর মুখের লেবেঞ্চুষ ধপাস করে মাটিতে পরে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। তাই না দেখে সেনাপতি খুকখুক করে হেসে দিলেন।
: তারপর?
: রাজা বললেন, ‘তাই’তো বলি মন্ত্রীর দাতে পোকা কেন! সেনাপতি, তুমি এক্ষুনি মন্ত্রীর দাতের পোকাগুলোর মাথা কেটে ফেল।’
: তারপর?
: সেনাপতি বলল -মন্ত্রীর মুখে গন্ধ। সামনেই যাওয়া যায় না। লেবেঞ্চুস খেয়ে তিনি দাত মাজেন না। তাই শুনে রাজা বললেন, ‘তবে আগে নিজের নাক কাটো। তারপর মন্ত্রীর মুখের পোকার মাথা কাটতে হবেই হবে।’
: তারপর?
: দোয়েল বলল, ‘সবাই দেখি নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত। টোনা আর টুনি মজা করে পিঠা খাচ্ছে। রাজপুত্র রাজকণ্যাকে বিয়ে করবে বলে দৈত্য মারতে যাচ্ছে। রাজা আর তার লোকেরা কাটাকাটি করছে, রাজ্যের প্রজাদের লুটপুটে খাচ্ছে, অত্যাচার করছে। দুয়োরানী বিউটি পারলারে ফেসিয়াল করছে, সুয়োরানী হার্বাল উপটান মাখছে। বাঘের গলায় হাড় ফুটলে বক তা বের করে দিচ্ছে। কিন্তু আমার যে বেশী করে কিশমিশ দেয়া পায়েস খেতে খুব ইচ্ছে করছে সেটা নিয়ে কারো একটুও চিন্তা নেই। আমি কি তোমাদের কেউ নই! আমি কি তোমাদের কিছু হই না!’
: তারপর?
: ছাতা হারিয়ে ব্যাংয়ের মন ভালো নেই। বৃষ্টিতে ভিজে সর্দি লেগেছে। দোয়েলের কথা শুনে সে বলল, ‘ তেপান্তরের মাঠ পেরুলে দুধের সাগর। সেই সাগর পেরুলে মাখনের পাহাড়। নরম নরম মাখনের পাহাড় পার হলে তবেই রূপকথার দেশ। সে রূপকথার দেশেই পোলাও পাওয়া যায়, কোর্মা কোপ্তা পাওয়া যায়, ইলিশ ভাজা আর রুই মাছ ভুনা পাওয়া যায়। পায়েস পাওয়া যায়। ব্যাংয়ের হারানো সিল্কের ছাতাও পাওয়া যায়, ব্যাংয়ের সর্দির ওষুধও পাওয়া যায়।’
: তারপর?
: দোয়েল বলল – আমি যাব রূপকথার দেশে। পায়েস খাবো। লালপরী নীলপরীর জন্য পোলাও কর্মা আনবো, ব্যাংয়ের জন্য সিল্কের ছাতা আর সর্দির ওষুধও আনবো।
: তারপর?
: জলদস্যু বলে ‘তবে এই নাও রূপকথার দেশে যাবার মানচিত্র, কাঠের জাহাজ আর দূরবীন।’ দোয়েল পাখি মানচিত্র খুলে দূরবীনে চোখ লাগাতেই আম্মু তাকে ডাকতে শুরু করেন, বলেন ‘তারাতারি উঠে পরো। সেই কখন সকাল হয়েছে। কাজে যেতে হবে। উঠে পরো, উঠে পরো।’
: তারপর?
: তারপর দোয়েল পাখিটা সকাল সকাল কাজে যায়। হোটেল ঝাড়ু দেয়, বেঞ্চ আর টেবিলগুলো মুছে। জগে পানি ভরে। নাস্তা করতে আসা লোকগুলোর টেবিলে টেবিলে পরোটা আর সাথে ভাজি, হালুয়া বা ডিম ভাজা দেয়।
: তারপর?
: আম্মুর মত এই লোকগুলোও বুঝতে পারেন না দোয়েলের মন প্রতিটা মুহূর্তে রূপকথার দেশে যাবার জন্য ভীষণ ছটফট করে। টেবিলে বিছানো প্লাস্টিকের কভারকে তার মনে হয় রূপকথার দেশে যাবার মানচিত্র, বেঞ্চকে জাহাজ আর গ্লাসগুলোকে দূরবীন।

বাঁচাও

সৈয়দ আবিদ আনোয়ার। এনজিওর প্রকল্প পরামর্শক। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এক নামে চেনে। খ্যাতি, প্রভাব, প্রতিপত্তি, অর্থ-যশ সবই অর্জন করেছেন। ইদানিং অবসর নিবার কথা ভাবছেন।

তিনি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন। এগারো তলার ফ্ল্যাটের দখিনমুখী বারান্দায় ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে ইন্সট্রুমেন্টাল আর রাগপ্রধান গান শুনেন। পনেরো দিন আগে লক্ষ্য করলেন এক সুঠাম যুবক কাচুমাচু হয়ে ইজিচেয়ারের বাম পাশে দাড়িয়ে আছে-
: কি চাই?
: স্যার, একটা প্রকল্পের ব্যাপারে এসেছি।
: কি প্রকল্প?
: পরিবেশ বিষয়ক।
: ও আচ্ছা! পরে শুনবো।
তিনি চোখ বন্ধ করে গান শোনায় মন দিলেন।

গত পনেরো রাত ধরে যুবক এসে অপেক্ষা করে। আজ আবেদ সাহেবের মন বেশ ফুরফুরে। ইয়ান্নির পিয়ানো শুনছেন। চোখ বন্ধ রেখেই যুবককে পাশের চেয়ারে বসার ইংগীত করলেন-
: বসো। তোমার প্রকল্পের বিষয়টা কি!
: স্যার, পরিবেশ দূষণে আমাদের বংশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। রক্ষা করুন।
: নাটকের ডায়লগ না দিয়ে- সহজ করে খুলে বলো।
: স্যার, আমরা বৃক্ষচারী প্রাণী। গাছ কেটে কেটে আমাদের বাসস্থান ধ্বংস করা হচ্ছে।
: দু:খজনক, তারপর?
: বাতাসে সীসার পরিমাণ বাড়ার ফলে চলাফেরা করতে পারিনা। চামড়ায় এবং হৃদপিন্ডে নিরাময় অযোগ্য ইনফেকশনের মহামারিতে মরে মরে সব শেষ।
: পরিকল্পিত গণহত্যা! মর্মান্তিক। বলে যাও-
: স্যার, পরিবেশ দূষণ আর প্রযুক্তির পরিকল্পনাহীন অবাধ বিস্তারে আমরা এখন মহাবিপন্ন জাতি। ইতোমধ্যে আমাদের বিভিন্ন প্রজাতি হারিয়ে গেছে। অল্প কয়েকজন বাংলাদেশ-বার্মা সীমান্তে আর দূর্গম পার্বত্য অঞ্চলে কোনমতে বেঁচে আছি।
: হৃদয়বিদারক- বলে যাও!
: স্যার, ফরমালিন গ্রহন করা লাশগুলো দ্রুত না পঁচায় আর শ্মসানগুলোকে ইলেক্ট্রিক করায় কেউ জন্মাচ্ছে না। অন্যদিকে সবাই প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। টেস্টটিউব আর হারবাল চিকিতসাতেও কাজ হচ্ছে না।
: ক্রাইম এগেইনস্ট সিভিলাইজেসন- আর কিছু বলার আছে?
: স্যার, গোদের উপরে বিষ ফোড়ার মত এফএম রেডিওর ভুল অনুষ্ঠান আমাদের সামাজিক শৃংখলা ভেংগে দিচ্ছে, ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।
: সাংস্কৃতিক অগ্রাসন- সবইতো শুনলাম। তা বাবা তুমি কে?
: স্যার, আমি ‘নিখিল বাংলাদেশ ভুতাধিকার আদায় ও বাস্তবায়ন পরিষদ’-এর বিপ্লবী সভাপতি। এছাড়া ভুত বাঁচাও আন্দোলনের সম্মানীত আহ্ববায়ক।
: গ্লাড ট্যু মিট উইথ ইউ।
: স্যার, এনজিওর মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষার কার্যকর কিছু প্রকল্প নিন- মহাবিপন্ন বাংগালী ভুত জাতিকে রক্ষায় বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তুলুন।
: কার্যকর কিছু করার জন্য অনেক সময় লাগবে। প্রজেক্ট প্রোপজালের জন্য প্রচুর পেপার ওয়ার্ক করতে হবে। অনেক অনেক কাজ।
: স্যার, ভাববেন না। আমি সব তৈরী করে এনেছি। স্যার, এই নিন পৌনে ছয়শো পাতার ডকুমেন্ট।
: বলো কি!
: স্যার, এখনে কনসেপ্ট পেপার, রিসার্চ রিপোর্ট, ডিটেইলস প্রজেক্ট প্রোপোজাল, বাজেট, প্ল্যান এন্ড ইমপ্লিমেন্ট স্ট্রাটেজি, তথ্য উপাত্তসহ দরকারি সবকিছু আছে।

সকাল দশটায় আবেদ সাহেবের ঘুম ভাঙল। রাতের কথা চিন্তা করে হাসলেন। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সারলেন। প্রতিদিনের মত এক মগ গরম ব্ল্যাক কফি নিয়ে কাজের টেবিলে বসলেন। দৈনিক পত্রিকাটা হাতে নিতেই পত্রিকার নিচে টেবিলে দেখলেন বাইন্ডিং করা মোটা এক ফাইল, কভার পেইজে নীল অক্ষরে বড় করে লিখা-
ভুত বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে।

SAVE VOOT SAVE BANGLADESH.

ব্রয়লার

সাজ্জাদ হোসেন একটা কর্পোরেট হাসপাতালে চাকুরী করেন, একাউন্টস বিভাগের জুনিয়র এক্সিকিউটিভ। ভালো বেতন পান, ওভারটাইমও পান- তাই ডিউটি টাইম আর সাপ্তাহিক ছুটির ঠিকঠিকানা নাই।

বাড়ির বাজার সাজ্জাদকেই করতে হয়। তিন মাস আগে বাজার করতে গিয়ে ব্যাপারটা প্রথম ঘটে। সে তিন কেজি ফার্মের মুরগি কিনেছে। দোকানী মুরগী জবাই করে ড্রেসিং করছে। অন্য মুরগিগুলো নির্বিকার। সাজ্জাদের মনে হচ্ছে এগুলো মুরগি নয়, কর্পোরেট হাসপাতালের সাদা বিছানায় সাদা চাদর গায়ে জড়িয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষমান রুগি। যারা প্রতিদিন মৃত্যু দেখে দেখে প্রতিক্রিয়াহীন, নিজে বেঁচে আছে এই আনন্দেই ককক্ক..ক্ক..ক..ক..ক।

সাজ্জাদ রোগীদের মুরগি ভেবে প্রথম ক’দিন খুব মজা পেয়েছিল। কিন্ত সময়ের সাথে সাথে সমস্যা প্রকট হয়েছে। একমাস যাবত সে মুরগির মাংস খেতে পারেনা। মনে হয় কর্পোরেট হাসপাতালের রোগীদের মাংস খাচ্ছে- নাড়িভুড়ি উল্টে বমি আসে। আবার হাসপাতালে মুরগীর ফার্মের বিশ্রী গন্ধটা পায়। নিজের গায়ে পায় ড্রেসিং করা মুরগির গন্ধ। বহুকষ্টে বমি আটকায়। তার মনে হয় হাসপাতাল একটা আদম-মুরগির খামার। এমডি স্যার খামারের মালিক। রোগিরা মুরগি আর ডাক্তাররা মালিকের নির্দেশে তাদের পরিচর্যা করছে জবাইয়ের জন্য। জবাই শেষে কেউ বাড়ি ফিরে যাবে, কেউ গোড়ে।

সাজ্জাদ প্রতিদিন ভাবে হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের প্রখ্যাত কোন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হবে। কিন্তু ফার্মের ব্রয়লার মুরগিতে পরিণত হয়ে যাবার আতংকে দোতলার একাউন্টস সেকশন থেকে তিন তলায় বিশেষজ্ঞের চেম্বারে যাচ্ছি যাচ্ছি করে যাওয়া হয় না- শরীরে মুরগির বোটকা গন্ধটা প্রতিদিন বেড়ে যায়।

সেবা

শয়তান হাজার হাজার বছর ধরে প্রচন্ড প্রতাপে শয়তানি করেছে। কিন্তু দিন কি আর এক যায়! শয়তানি করতে করতে তার ফাকফোকড় মানুষজন ধরতে শিখে গেল। শয়তানের রমরমা শয়তানি ব্যাবসা বন্ধ হবার যোগাড়। পৃথিবীতে শয়তানের দূর্দিন নেমে এলো।

শয়তানের শয়তানি না করলে চলবে কেন! সে কাজ খুজতে লাগল। সে এখানে সেখানে ঘুরে ঘুরে আবিষ্কার করল তার যোগ্য শিষ্যরা এক একটা মহাশয়তানে পরিণত হয়েছে। তারা বেশীরভাগ রাজনীতির খোলস এটে সাধুসন্যাসী আর ভালো মানুষ সেজে জনসেবার নামে দিব্যি শয়তানি করছে। অনেকেই তাদের কৌশল বুঝেও ভয়ে কেউ কিছু বলেনা। তাদের জন্য জান দিতে পারে এমন অনুসারীর সংখ্যাও কম নয়। অথচ, এরাই নিরীহ শয়তানকে দেখলে মারমার কাটকাট করে হামলা করতো। শয়তানের পশ্চাদ্দেশে বাঁশ নয়, পুরো বাঁশ বাগান ঢুকিয়ে দিত।

শয়তান গণ্ডমূর্খ সেজে শিষ্যদের দাসগিরি শুরু করল। দিনে দিনে রাজনীতি শিখে শয়তান তার শিষ্যদের ব্যাবসা দখল করে নিজেই রাজনীতি শুরু করল। গুরু কিনা গুরু, তাই শয়তানের শিষ্যরা রাজনীতির এজেন্সী নিয়ে আবার আদি গুরুর দাসগিরিতে মগ্ন হলো।

শয়তান আর তার শিষ্যদের ছেলেপেলেদের রাজনীতি ব্যাবসা পছন্দ নয়। এ ব্যাবসা এখন ব্যাকডেটেড, ক্রিয়েটিভিটি নাই। তাই তারা কর্পোরেট কোম্পানীর রং ফর্সাকারী ক্রিম, চুল ঝলমলানী শ্যাম্পু ও মল্ট ড্রিংকের মিনি প্যাকে আর টিভির ডেইলী সিরিয়ালে সওয়ার হয়ে মানুষের ঘরে ঘরে শয়তানি সেবাদানের আপডেটেড ক্রিয়েটিভ ব্যাবসা করছে।

লেবেঞ্চুস

এ পথ যে কোথায় গেছে জানেনা উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম। বয়াতীর হাড্ডিসার শরীর লেপ্টে রাখে ঘামে ভেজা জবজবে পলিস্টারের পাঞ্জাবী। সেই কবে বালকের হাত থেকে লেবেঞ্চুস ধুলায় পরেছিল আর হাওয়ায় উড়ে গিয়েছিল বর্ণিল মোড়ক। তারপর তিস্তা শুকিয়ে বয়াতীর শরীর, পদ্মা পলিস্টারের পাঞ্জাবী। বাবা মরেছে পিপাসায় আর মা অভাবে। খা খা রাক্ষুসী রোদে বালকের চাষা বাবা ও উর্বরা মায়ের লাশ চিবিয়ে খেয়েছে বিরান বালুচর। বালকের কপালে না লেবেঞ্চুস না মোড়ক, না বাবা না মা, শুধু লিলুয়া বাতাসের হুহু বিলাপ।

এই পথ যে কোথায় গেছে কেউ জানেনা। তবু কোমড়ে পিস্তল গুজে আর মনে বারুদ ঠেসে বালকের দল এ পথ ধরেই হেটে যায়। কে যেন তাদের বলেছে এ পথটাই শহরে গেছে, এ পথটাই সোজা ঢুকে গেছে রাজার বাড়ির উঠোনে… রানীর ড্রেসিং টেবিলে…রাজপুত্রের ড্রইং রুমে… রাজকন্যার ওয়ারড্রোবে… রাজপরিষদের ডাইনিং রুমে কিচেনে, ডিনার সেটের থালা বাসুনে…কাপ পিরিচে…

ইশতেহার

পৃথিবীর শেষতম মুরগিগুলোকে রাষ্ট্রের খামারে ভরে রাজা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন- রাজপরিবার ছাড়া সকল শেয়ালরা শুধু নিরামিষ খাবে। শেয়ালরাজ্যে আমিষ নিষিদ্ধ।

নিরামিষ খেতে খেতে শেয়ালদের শিকড় গজায়। দেহ থেকে বের হয় মলিন পাতা, শুকনো ডালপালা। শেয়ালেরা নিরামিষে পরিণত হবার পরে রাজা ধরে ধরে আস্ত নিরামিষ খেতে শুরু করলেন। কিন্তু রাজার নিরামিষ হতে রক্ত ঝরে, ডাল চিবুলে বেরোয় হাড় চিবানোর শব্দ।

খুব গোপনে শস্যদানার খোসার ভিতরে জমা হতে থাকে নিযুত হাহাকার। জোনাকির আলোয় বিবর্ণ ফসলের মাঠ ঘুড়ির গায়ে লিখে যায় গোপন ইশতেহার।

এক একটা রোদেলা দিনে শরীরে ইশতেহার নিয়ে উড়ে যায় ঘুড়ি। শুকনো পাতা আর মলিন ডালে নতজানু শেয়ালের পাল বহু আগেই গর্দান সোজা করে আকাশে তাকাতে ভুলে গেছে। ঘুড়ি তাদের চোখে পড়ে না। তবে আকাশের দিকে তাকিয়ে উদোম শরীরে ঘুড়ির পিছু পিছু প্রাণপণে দৌড়ে যায় ক্ষুধার্ত হাড় লিকলিকে শেয়ালশিশুর দল।

লেজ

মন্তাজ মেম্বার জাদরেল লোক। আপদমস্তক জনসেবক। জনসেবার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন রাজনীতি। তার ইউনিয়নের মানুষদের কল্যণ এবং উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনে যে কোন ব্যক্তিকে নিজের কোলে, কাঁধে বা মাথায় তুলতে পারেন। দু:খে সুখে পাশে এসে দাড়াতে দ্বিধা করেননা। আবার উন্নয়ন আর কল্যাণের রাজনীতির জন্যই মানুষকে খুন করতে পারেন। ভিটি ছাড়া করতে পারেন। মন্তাজ মেম্বার এতটা জাদরেল যে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও তার কথার অবাধ্য হবার তাগদ রাখেন না। ইউনিয়নের সবাই জানেন এই মেম্বারকে সমীহ করে চলাতেই সকলের মঙ্গল।

দুলু মিয়া ৭০ বছরের বৃদ্ধ। মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি। গায়ের বসন এলোমেলো। জিজ্ঞাসাময় দৃষ্টি। কিছুদিন হল মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। বৃদ্ধ দুলু মিয়াকে নিয়ে মন্তাজ মেম্বার বিশাল সমস্যায় জর্জরিত। এই বৃদ্ধ মন্তাজ মেম্বারের কষ্টার্জিত ইজ্জত হুমকীর মুখে ফেলে দিয়েছেন। কিন্তু বৃদ্ধকে তিনি খরচ করে ফেলতে পারছেন না। কারন বৃদ্ধ দুলু মিয়া হলেন মন্তাজ মেম্বারের পিতা।

দুলু মিয়া ধীর পায়ে হাটেন। একা একা সমগ্র ইউনিয়নে ঘুরে বেড়ান। খুব মন দিয়ে হারিয়ে যাওয়া ল্যাঞ্জা (লেজ) অনুসন্ধান করেন। তার শখের লেজটা হারিয়ে গেছে। এই লেজটাকে খুঁজে পেতে হবে। তিনি সারা দিন হারিয়ে যাওয়া লেজের বিরহে কাতর হয়ে থাকেন। মানুষ জনকে প্রশ্ন করেন, “আমার যে ল্যাঞ্জাটা (লেজটা) আছিল, হেইডা কেডা নিছে?” সবাই দুলু মিয়ার এই অনুসন্ধানে নির্দোষ আনন্দ পেলেও মন্তাজ মেম্বার বিব্রত হন। মাঝে মাঝে ভাবেন দড়ি দিয়ে পিতাকে বেঁধে রাখবেন। কিন্তু নিজের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হওয়ার ভয়ে সেই পথে যাননা।

ইউনিয়ন পরিষদের সভা চলছে। সরকারী কাজের ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সভা। স্থানীয় এমপি নিজে এসেছেন। মন্তাজ মেম্বার এমপির পাশ ঘেষে বসেছেন। ভাগ বাটোয়ারার জটিল আলোচনার মাঝে আচমকা দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন দুলু মিয়া। মন্তাজ মেম্বারের মানসিক ভারসাম্যহীন পিতা। মন্তাজ মেম্বার রাগান্বিত এবং সংকোচিত। কিন্তু মুখে স্মিত হাসি এনে বললেন, “আব্বা, আপনি বাসায় যান। আরাম কইরা ঘুমান। ” কিন্তু দুলু মিয়া স্থির। তিনি অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে সকলের চোখের দিকে তাকালেন। তারপর সরাসরি এমপির চোখে রোখ রেখে বললেন, “আমার ল্যাঞ্জাটা কে য্যান চুরি কইরা লয়া গেছে। আমার ল্যাঞ্জাটা পাইতাছি না।”

এমপি: আপনার ল্যাঞ্জা ছিলো না কি?

দুলু মিয়া: আছিল’তো। কুত্তার মতন একটা ল্যাঞ্জা আছিল।

এমপি: চাচা! মানুষের ল্যাঞ্জা থাকেনা। আপনারও ছিলোনা।

দুলু মিয়া: আমার আছিল’তো। কুত্তার মতন একটা ল্যাঞ্জা আছিল।

এমপি: কিভাবে জানলেন যে আপনার ল্যাঞ্জা আছিল?

দুলু মিয়া : ল্যাঞ্জা না থাকলে মন্তাজের মতন কুত্তার বাচ্চারে পয়দা করলাম কেমনে!! তোমার বাবারে জিগাও। তারও একটা ল্যাঞ্জা আছিল।”

এমপি নির্বাক। মন্তাজ মেম্বার মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। সভায় উপস্থিত সকলের চোখের সামনে পিতাদের মুখচ্ছবি ভেসে উঠছে। সত্যিই কি পিতাদের একটা করে ল্যাঞ্জা ছিল!! কুকুরের মত ল্যাঞ্জা!!

আদমামিষ

: জব্বার, গরুর গোশত কেজি কত?
: মাস্টর সাব, ৪০০ টাকা।
: খাসীর কেজি?
: ৬০০টাকা। কোনটা দিমু?
: জব্বার, এত দাম দিয়া গোশত খাওয়ার সামর্থ্য কি আমগো আছে!
: মাস্টর সাব, তয় মানুষের গোস্ত লয়া যান।
: জব্বার, এইটা তুমি কি কও!
: লয়া যান, কঁচি মানুষের গোস্ত মাত্র ৭০টাকা কেজি আর এমনেটা ৫০টাকা। ভুনা কইরা পরোটা দিয়া খাইবেন।
: মানুষের গোশত পাইলা কই?
: মাস্টর সাব, গবমেন্ট কইছে চাইর বছর পরে দ্যাশে আর গরীব মানুষ থাকবো না। গরীবগো কাইট্যা কাইট্যা বেঁচতাছি। গরীবরা থাইক্যা গেলে গবমেন্টের ইজ্জত পাংচার অয়া যাইবো না!
: জব্বার, আমি আর তুমি কি বড়লোক?
: মাস্টর সাব, আমরা গরীব। আমগোও গলা কাইট্যা চামড়া ছাড়ায়া পিস পিস কইরা ঝুলায়া ঝুলায়া কেজি দরে বেঁচবো। মরনের আগে খায়া-দায়া লন।

মোক্তার মাস্টারের মনে হতে থাকে জব্বারের দোকানে তার মাংসই ঝুলছে। তিনি জানেন গরীব মানুষের কোন দাম নাই। তাই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না ৫০টাকা কেজি দরে নিজের মাংস কেনা ঠিক হবে কি না।

আতঙ্ক

আকীল আকতাব অনলাইন এক্টিভিস্ট ও লেখক। জেনারেল ডাইরি অর্থাৎ জিডি করার উদ্দেশ্যে তিনি কাশীপুর সদর থানায় হাজির হয়েছেন। একটু অপেক্ষার পরে সেকন্ড অফিসার রুহুল আমিনের মুখোমুখি হলেন-

: একটা জিডি করতে চাই?
: সমস্যাডা কি?
: অচেনা ফোন নম্বর থেকে গত দুই মাস ধরে মেরে ফেলার হুমকী দেয়া হচ্ছে।
: কারে মাইরা ফেলার হুমকী?
: আমাকে।
: খামাখা খামাখা হুমকী দিবো কেন? আপনে অগো কি করছেন?
: জানিনা। আমি অপ রাজনীতি, দূর্ণীতি আর ধর্ম ব্যাবসার বিরুদ্ধে লিখি, এবং…
: ও বুঝছি, আপনে নাস্তিক, খোঁচাখোঁচি করলে তো কোপানি খাইবেনই।
: আমি নাস্তিক না, তবে নাস্তিকদের কোপানো কি আইনসম্মত! নাস্তিকরা কি এই দেশের নাগরিক…
: আরে থামেন, থামেন, সরকারের বিরুদ্ধে লিখেন না তো?
: কিছু লেখা তো সরকারের বিরুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই যায়। সরকারের আকাম-কুকামের বিষয়ে লিখি।
: এই কাজ করার দায়িত্ব আপনারে কে দিছে?
: রাষ্ট্রের সংবিধান দিয়েছে।
: তবে পকেটে সংবিধান নিয়া ঘুরবেন। হামলা হইলে সংবিধান আপনারে রক্ষা করবো হো: হো: হো:, হামলাকারীগো সংবিধান দেখায়া কইবেন হামলা সংবিধানসম্মত না হো: হো: হো: হো:
: এখানে হাসার মত কি হলো?
: ভাই, একটা কথা কই- মন দিয়া শুনবেন। জিডি কোন নিরাপত্তা দিবোনা।
: মানে?
: আপনি যে নিরাপত্তাহীনতায় আছেন জিডি তার রেকর্ড মাত্র। আপনারে আমরা বড়জোড় এই থানা এলাকায় এক সপ্তাহের নিরাপত্তা দিতে পারুম। তার বেশী না। আপনি তো আর ভি আই পি না। এছাড়া আরো সমস্যা আছে।
: কি সমস্যা?
: আপনে সরকারের বিরুদ্ধেও লিখেন। আপনারে নিরাপত্তা দেয়া কি ঠিক হইবো!
: তবে কি ঠিক হবে?
: আপনারে তো এখনই তথ্য আইনের ৫৭ ধারায় গ্রেফতার কইরা রিমান্ডে নেয়া উচিত।
: ভয় দেখাচ্ছেন?
: না, ভয় দেখাই না। বাস্তব অবস্থা বুঝানোর চেষ্টা করছি।
: এখন করনীয় কি?
: তোওবা তিল্লা করেন। লেখালিখি বন্ধ কইরা দেন।
: লেখা বন্ধ করলেই আমি নিরাপদ?
: না, একবার যখন লিস্টে নাম উঠছে তখন কখনই নিরাপদ না। আল্লাহর কাছে সাহায্য চান।
: তার মানে আপনাদের করার কিছু নাই?
: ভাই, চা আনাই, চা খান। নিজের ভাই হিসেবে বলছি- বিদেশে চইলা যান। যত দ্রুত যাইবেন তত ভালো।
: ভাই হিসেবে এই উপদেশ!
: ভাই, আমি আপনারে চিনি। গত ছয়মাস ধইরা ফেসবুক স্ট্যাটাস, ব্লগ আর নিউজ সাইটে আপনার প্রত্যেকটা লেখা ফলো করি।
: তাই না কি? ফলো করেন কেন?
: আপনে থানার লিস্টে আছেন। যে কোন দিন আটক করা হবে। আমি চাইনা কোন ঝামেলায় পরেন।
: আমার প্রতি এত দরদ?
: আপনি যা লিখেন তা সবাই জানে। কিন্তু সবাই বলার সাহস পায় না। আপনার সাহস আছে- এটারে সম্মান করি। তাড়াতাড়ি বিদেশে ভাগেন।
: ভিসা কি এতই সহজ?
: আপনাদের জন্য তো জার্মানী আর আমেরিকা ভিসা নিয়া বইসা আছে হো: হো: হো: হো: হো:
: তাই?
: রসিকতা করলাম। দেশ ছাড়তে না পারলে পার্টির ক্যাডাররা আপনারে খরচ কইরা ফেলব, তা না হইলে পুলিশ রিমান্ডে নিয়া বারোটা বাজায়া দিব।

আকীল আকতাবের আর জিডি করা হয়না। তিনি থানা থেকে বেরিয়ে আসেন। বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে থাকেন। পা টলে। শরীর ভিজে ওঠে ঘামে। মনে হতে থাকে ঘাতকের দল অনুসরণ করছে। যে কোন মুহুর্তে ঘাড়ে পরবে চাপাটির কোপ, পিঠ বিদ্ধ করে চলে যাবে ঘাতক বুলেট।

মজদুর

: বাজান, কাইল কি তুমার ছুটি? আমারে বেড়াইতে লয়া যাইবা?
: কাইল কারখানা বন্ধ। কিন্তু কাম আছে। লিডার কনটাক নিছে।
: কিয়ের কনটাক বাজান?
: মিছিলের কনটাক। কাইল তিনটা মিছিল আছে। দুইশো ট্যাকা কইরা দিবো, সারাদিন খালি হাটতে অইবো আর চিল্লাইতে অইবো।
: তোমার পাও টিপ্যা দেই?
: না মা, লাগবো না। কাইল মিছিল শ্যাষে দুইট্যা ব্যাথার ট্যাবলেট খায়া লমু।

নিষেধ অমান্য করে কিশোরী জোবেদা বাবার পা টিপতে শুরু করে। বেড়াতে নিয়ে যেতে চাইলেও সে যেত পারতো না। সে বাসাবাড়িতে ছুটা বুয়ার কাজ করে। কাল তার ছুটি নাই। তবু তার খুব ইচ্ছা করে বাবার সাথে গিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে তুলে গলা ফাটিয়ে শ্রমিক দিবসের মিছিলে ফ্রি শ্লোগান দিতে “দুনিয়ার মজদুর এক হও…লড়াই করো…”

ভয়

ওসি আফজল তখন ফুলপুর থানার সেকন্ড অফিসার। উত্তরপাড়ার হারিসুদ্দীনের দশম শ্রেনীতে পড়ুয়া ছেলেটা আত্নহত্যা করেছিল। গাছ থেকে লাশ নামানোর পরে পকেটে একটা চিঠি পাওয়া গিয়েছিল, গোঁটা গোঁটা অক্ষরে লেখা- “ওসি সাহেব, সালাম নিবেন। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। আমার মেট্রিক পরীক্ষার ফিসের জন্য ফসলী জমিটা বন্ধক দিলে দুইবোনের বিয়ে দিবে কিভাবে! বাবার দিনমজুরীর টাকায় কি আর সংসার চলবে! ওসি সাহেব, পোস্টমর্টেম ছাড়া আমার লাশ দাফনের অনুমতি দিয়েন। আমরা খুব গরীব, দয়া কইরেন। সবাই পারলে আমারে মাফ কইরেন, বাবারে সান্ত্বনা দিয়েন।

ইতি, ফজলউদ্দীন।

সেকন্ড অফিসার আফজল এই ঘটনার তদন্ত অফিসার। পুলিশের চাকরীতে এমন চিঠিকে পাত্তা দিলে লস। আত্নহত্যা, খুন জমি দখলের মামলা মানেই ধান্দা। পার্টির কাছ থেকে দফায় দফায় টাকা আদায়ের সুযোগ। তার আর থানার পেট ভরাতে এবং তদন্তের জন্য সদর হাসপাতালে লাশ নিতে ও ফেরত আনতে হারিসুদ্দীনের যে টাকা ব্যায় করতে হয়েছিল তা দিয়ে দুইবার মেট্রিক পরীক্ষার ফিস পরিশোধ করা যেত।

তিন দিন পরে আফজলের নাইট ডিউটি। ঝুম বৃষ্টি। নীরব থানা। তিনি চেয়ারে বসেই ঘুমোচ্ছেন। কি এক অস্বস্তিতে ঘুম ভেংগে যেতেই দেখলেন সামনের চেয়ারে ভয়ার্ত মুখে একজন বসে আছে।
: কি চাই?
: স্যার, ময়নাতদন্ত ছাড়া যদি লাশটা দাফনের সুযোগ দিতেন?
: কোন লাশ! কার লাশ?
: স্যার, আমার লাশ, হারিসুদ্দীনের ছেলে ফজলউদ্দীনের। কাটাকাটিরে খুব ডরাই।
আফজল এবার ছেলেটাকে চিনতে পারলেন এবং জ্ঞান হারালেন।

সেকেন্ড অফিসার আফজল এখন জাদরেল ওসি। বিভিন্ন এলাকায় পোস্টিং নিয়েছেন, কাজ করেছেন। ফজলউদ্দীন তার পিছু ছাড়ে নাই। নাইট ডিউটিতে সে প্রায়ই আসে- ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ দাফনের অাঁকুতি নিয়ে। আহা, ছেলেটা সত্যিই শরীরের কাটাছেড়া ভয় পেত, খুব ভয় পায়।

খোয়া

এক একটা দিন। রোদ, কি যে নরম! ঠাথ…ঠাথ…ঠাথ ইট ভাংগে মহিলার দল। রোদ পোড়া ত্বক, অবিন্যাস্ত বেশ। কড়া ঘ্রানের জর্দা দিয়ে পান চিবুয় কন্ট্রাক্টর। ফাঁকে ফাঁকে গোল্ডলিফ ফুঁকে।

এমন এক একটা দিনের এক একটা ছেলেবেলা ছিলো। উদোম শরীর। মাঠ পেরুলেই নদী। হাটুজলে সন্তরণ। মাথার উপরে দুপুর। সাদা ভাত, কলাই শাক খেসারীর ডাল। খোসা ছাড়া পেঁয়াজ। সরষা তেলের ঝাঁঝ।

হাটবার এক একটা দিন। শনপাপড়ি এক একটা দিন। লেবেঞ্চুস এক একটা দিন। মাথায় করে টুকরীতে বয়ে নিয়ে যাওয়া সবুজ লাউ বিক্রির এক একটা দিন। এক একটা দিন বায়োস্কোপ ঢাকা শহর ছয় আনা…তাজমহল ছয় আনা… লালবাগ ছয় আনা…

এই শহরে দালান ওঠে। প্রতিদিন। মায়ের সাথে হাত লাগায় শিশু। ইট ভাংগে। শৈশব ভেংগে ভেংগে ইটের খোয়া জমে। নয় বছরের জমিলা বুঝে মায়ের পিঠের ব্যাথাটা বেড়েছে, সে একাই দ্রুত হাত চালায় ঠাথ…ঠাথ…ঠাথ। কড়া ঘ্রানের জর্দ্দা দিয়ে পান চিবুয় কন্ট্রাক্টর।