আবু সাঈদ আহমেদ এর সকল পোস্ট

রূপান্তরিত লাশ

পৃথিবী এক ফাঁদ চক্র- কারো মুক্তি নেই। মৃত্যু কিছু নয়, রূপান্তর প্রণালীসম্মত বিজ্ঞান। প্রতিটি জন্ম পৃথিবীকে মুখর করে, মৃত্যু উর্বর করে। শরীরের সব রস শুষে পুষ্ট হয় মৃত্তিকার প্রাণ, বেড়ে ওঠে বৃক্ষ, পুষ্পে ও পত্রে, শস্যে শস্যে।

মাটির রস বাষ্প হয়, মিশে হাওয়ায় হাওয়ায়। আকাশে জমে মেঘ- মেঘে মেঘে গর্জায় বজ্রসর্প, বৃষ্টি ঝরে টাপুর টুপুর, বৃষ্টি ঝরে ইলশেগুঁড়ি, বৃষ্টি ঝরে মুষলধারায়- নদী ও সমুদ্রে, ঢেউ হতে ঢেউয়ে, সমতল হতে পাহাড়ে পাহাডে। বৃষ্টিতে অঙ্কুরিত শ্যামলে সবুজ। বর্ষণে উদ্দীপিত স্রোতে প্লাবিত ভূমি- পললে পললে শস্যের সুপ্ত উদ্ভাস।

ফাঁদ চক্রে বন্দী মানুষ আত্নায় শোনে আকাশের ডাক, সমুদ্রের আহ্বান, শস্যের গান, অনুভব করে নদীর চোরাটান ও নক্ষত্রের সুর- মূলত এসব নিয়েই মানুষ।

প্রিয় রাপুনজেল, এসব কথা থাক, তোমার চুলের উজ্জ্বলতায় যে হাওয়া দোল খায়, সবুজ পাতায় মর্মরিত হয়, ভোরের প্রথম আলোয় শিশিরের বিষন্নতা নিয়ে জেগে ওঠে ঘাস, জেনো ওতে মিশে আছি আমি, আমার সকল জন্মের রূপান্তরিত লাশ।

#অকবিতা

ক্যামোফ্লাজ

নিজেকে ভস্ম করার আগে
আত্মাকে দিও ছুটি
আত্মায় যে আছে তার যেনো না লাগে আঁচ।

যে হারিয়ে যাবে
তাকে হারাতে দাও
তার পালকে লেগে আছে পিছুটানের অভিশাপ।

গোপন ষড়যন্ত্রের মত
নিজের ভেতর গড়ে উঠছে যে প্রাচীর
তার ইটে ইটে এইমাত্র লিখে এলাম-
প্রজাপতি পাখার কারুকাজ বস্তুত ক্যামোফ্লাজ।

#অকবিতা

বিজ্ঞান মাত্রই ভালো নয়

প্রিয় হৃদি, চলো আজ কিছু বিজ্ঞান শিখি।

রাতের জঠরে ধীরে ধীরে কিভাবে জন্মায় প্রতিটি ভোর
যদি জানতে চাও আকাশে তাকাও, তাকিয়েই থাকো
শেষ তারাটি মুছে যাওয়ার ক্ষণ পর্যন্ত।
প্রাচীন নাবিকের মত তুমিও দেখবে
ধলপহর গিলে আদম-সুরত, কম্পাসের কাটায় ভোর।
ভোরের খোলস থেকে বেরোয় দুপুর
দুপুরের দীর্ঘশ্বাসের বিস্তার সন্ধ্যাবাতির বুকে পড়তেই
জেগে ওঠেন বুড়ো নিউটন,
‘প্রতিটি ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে’
আওড়াতে আওড়াতে সন্ধ্যার শেষ বাঁকে দিনকে খুন করে নির্বিকার রাত,
প্রতিটি মুহুর্তই মরে যায় পরবর্তী মুহুর্তের ঘায়ে-
একে বলে সময়ের খুন-চক্র।

প্রিয় হৃদি, তুমি কি জানো বিজ্ঞান আজ বড় অসহায়
যে পুরোহিত না জানে ধর্ম, না জানে বিজ্ঞান-
সে’ই বিজ্ঞানের পাতায় পাতায় খুঁজে পায় ধর্ম
ধর্মের আয়াতে আয়াতে বিজ্ঞান
যে কবি না জানে কাব্য, না জানে কবিতা-
সে’ই লেখে কবিতার বিজ্ঞান, কাব্যের ফরমুলা
যে প্রেমিক না জানে বিভ্রম, না জানে মোহ-
সে’ই জানে প্রেম মানে বিজ্ঞান, প্রণয় মানেই বায়োলজি
এ হচ্ছে বিজ্ঞানের হীনমন্যতাচক্র–
যার যেখানে আত্মসংকট ও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি
সেখানেই টেনে আনে স্বাক্ষীগোপাল বিজ্ঞান।

প্রিয় হৃদি, বিজ্ঞান মাত্রই ভালো নয়
বিজ্ঞানের সকল খুনচক্র ও হীনমন্যতাচক্র
কেন্দ্র করে ঘুরেন নিউটন-
শক্তির রূপান্তর আছে, বিনাশ নেই
সকল খুনের রূপান্তর আছে, বিনাশ নেই
সকল হীনমন্যতার রূপান্তর আছে, বিনাশ নেই
প্রেমও শক্তি – প্রেমের রূপান্তর আছে, বিনাশ নেই।

এই বিনাশহীন রূপান্তর চক্রকে অস্বীকার করে
এক নগণ্য অন্ধকবি-
স্বপ্নে তোমায় ভালোবাসে, চুমো খায়, আলিঙ্গনে জড়ায়-
সেখানে কোনো খুনচক্র ও হীনমন্যতা নেই
ভালোবাসার প্রতিদ্বন্ধী সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া নেই
প্রিয় হৃদি, বিশ্বাস করো – সেখানে জীবন হতে বড় কোনো বিজ্ঞান নেই।

.
অকবিতা

জলাতঙ্ক-১

তখনও মোবাইল ফোনের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি, ল্যান্ড ফোনের কানেকশনও সহজলভ্য হয়নি। বাড়ির ল্যান্ড ফোনসেট আমার ঘরে ছিলো। মাঝরাতে প্রায়শই ফোন বেজে উঠত, প্রবাসী আত্মীয় স্বজন কল করতেন, আবার পাড়া প্রতিবেশীদের কলও আসতো, মাঝরাতে তাদের ডেকে দিতে হত। এই অভিজ্ঞতা সম্ভবত ওই সময়ের ল্যান্ড ফোন ব্যবহারকারীদের প্রায় সকলেরই রয়েছে। সেদিন ফোন বেজে উঠলো রাত প্রায় তিন’টার দিকে, ফোন রিসিভ করতেই ওপাশে উদ্বিগ্ন কণ্ঠ,
– সাঈদ?
– হ্যা।
– তুই এক্ষণি বাসায় আয়, এক্ষণি, দেরী করিস না।
হালকা ঘুম থেকে জেগে বুঝতে পারছিলাম না কে কল করেছে, কৌশলে জানতে চাইলাম,
– কি হয়েছে?
– রোমেল কিছু একটা খেয়েছে, ওকে মেডিক্যালে নিয়ে যেতে হবে। জলদি আয়।
বাড়িতে ম্যানেজ করে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বের হলাম, এরপর আঞ্জুমান থেকে এম্বুলেন্স নিয়ে সোজা রোমেলের বাড়ি। রোমেলের বাড়িতে কান্নার মৃদু আওয়াজ। রোমেলের বড় ভাই, আমি আর আরেক বন্ধু (বিখ্যাত এক অভিনেতার পুত্র) মিলে অচেতন রোমেলকে পাঁজাকোলা করে স্ট্রেচারে শোয়ালাম। রাতের নিরবতাকে ফালি ফালি করে এম্বুলেন্স ছুটলো ঢাকা মেডিক্যালের জরুরী বিভাগে।
রোমেল ঘুমের ওষুধ খেয়েছে ডিউটি ডাক্তারকে জানাতেই জরুরী বিভাগের দু’জন ওয়ার্ডবয় তাকে নিয়ে একটা বেডে শুইয়ে দিল। এরপর মাঝারি সাইজের প্লাস্টিকের একটা ফানেলের নল প্রায় পুরোটা মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। রোমেল সাড়াহীন। বড় ভাই কান্না করছে। আমরা দুই বন্ধু ঘটনা দেখে যাচ্ছি। ফানেলের মুখে অনেকখানি সাদা পাউডার ঢেলে এরপর পানি ঢালা শুরু হলো। একজন ফানেলে পানি ঢালছে, আরেক ওয়ার্ডবয় বেডের ওপর উঠে দাঁড়ালো, এরপর প্রায় সর্বশক্তি দিয়ে রোমেলের পেটে পাড়া দিতে থাকলো। কি আশ্চর্য! এই প্রথম রোমেলের নড়াচড়া দেখলাম, ও বমি করা শুরু করলো। কিন্তু বমি কোথায়, সাবানের ফেনা ফেনা পানি। প্রথমবারের পর দ্বিতীয়বার আবার ফানেল সেটের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে, রোমেল চিঁচিঁ করে ওয়ার্ডবয়দের বললো,
– ভাই, একটু আস্তে হালকা করে করেন, ব্যাথা পাই।

এক ওয়ার্ডবয় চেঁচিয়ে উঠলো,
– আস্তে করুম ক্যান। আরও জোড়ে জোড়ে করুম, মরতে যাওনের সময় খেয়াল আছিলো না।
দু:খজনক সত্য হলো, দ্বিতীয়বারের ওয়াশটা হলো মর্মান্তিক। ওয়াশ তো নয় যেনো থার্ড ডিগ্রী রিমান্ড। এরপরের তিন থেকে চার মাস রোমেল পানি খেতেই ভয় পেত। আর আমি! ওই পরিবেশে রোমেলসহ আরও দু তিনজনকে ওয়াশ দিতে দেখে এবং ক্রমাগর তাদের বমি করতে দেখে ট্রমায় চলে গিয়েছিলাম, পানি খেতে নিলেই ওসব দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠতো, পেট উগরে আসতো বহুদিন। এক চুমুকে পানি খেতে পারতাম না, যেনো পেট উগরে বমি না আসে তাই ছোট ছোট চুমুকে পানি পান করতাম। পানির অপর নাম জীবন হলেও তখন পানি ছিলো সাক্ষাৎ আতঙ্ক।

আজ আর বমি আসেনা, তবে ওই ছোট ছোট চুমুকে পানি খাওয়ার অভ্যেস এখনও রয়ে গেছে।

বরফাচ্ছন্ন

ক’দিন ধরে শীত খুব বেড়েছে। রাত বাড়ে, শীতের আক্রমণ তীব্র হয়। লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়েছি। লাল রংয়ের লেপ, শাদা কভার। মিঠে ওম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো, দেওয়াল ঘড়িতে রাত সাড়ে তিনটা। ভীষণ সুনসান। ক’টা কুকুর বিলাপ করছে,
ভীষণ মর্মান্তিক সে বিলাপ!
কুকুরের বিলাপ থামছেই না। বিলাপের সাথে যেনো মিশে রয়েছে ভয়। পায়ের কাছের জানালা খুললেই রাস্তাটা দেখা যায়, ভয়ের কারণ খোঁজা যায়, বিভ্রান্তি দূর করা যায়। কিন্তু ওমের মায়া কাটিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না।
বিলাপ রূপ নিয়েছে গাঢ় কান্নায়। আর সহ্য হলো না, গা থেকে লেপ সরিয়ে উঠলাম। লাইট জ্বালাতে গিয়ে বুঝলাম ইলেক্ট্রিসিটি নেই। শব্দ না করেই জানলা খুললাম, এক ঝটকা বরফ হাওয়া হাঁড় কাপিয়ে ঘরে ঢুকলো। বাইরে ঘন কুয়াশা আর জোছনায় মাখামাখি, তিনটা কুকুর রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে, একই দিকে তাকিয়ে বিলাপ করছে।

কুকুরের দৃষ্টি লক্ষ্য করে ওই গলির দিকে তাকালাম। দো’তলার জানলা দিয়ে গলির অনেকখানিই দেখা যায়। কুয়াশা ও জোছনার আবছায়াতে কাউকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু কুকুরের কান্না থেমে গেলো। আরও কিছুক্ষণ জানলা খুলে রাস্তায় থাকিয়ে রইলাম। সব স্বাভাবিক।
লেপের ওম ডাকছে, লেপ মুড়ি দিয়ে শুতেই আবার কুকুরের ভয় পাওয়া করুণ বিলাপ শুরু। শুনশান মাঝরাত এ বিলাপ কৌতূহল রহস্য আর ভয়ের দোলাচালে অসহনীয় অস্থির। বিছানা থেকে উঠে দু’ঢোক পানি খেলাম। এরপর খুব কায়দা করে নিঃশব্দে জানালাটা অল্প একটু ফাঁক করলাম, সাথে সাথেই কুকুরগুলো আমার দিকে মুখ ঘোরালো- অকস্মাৎ এ কাণ্ড দেখে মূহুর্তের জন্য জমে পাথর হয়ে গেলাম, সে ওই মুহুর্তের জন্যই। একটা কুকুর একটু সামনে এগিয়ে এলো, কুর্নিশের ভঙ্গিতে দুই পা সামনে মেলে দিয়ে ফের উঠে দাঁড়ালো, তার কণ্ঠে আতংক,
– একটু নেমে আসো, দয়া করে একটু নেমে আসো।
– কেনো?
– এলেই দেখবে, তোমাকে বিপদে পরেই ডাকছি, দয়া করো..
– আগে বলো, শুনে নেই।
কুকুরের কণ্ঠে আঁকুতি-
– জীবন মরণ সমস্যা, তুমি তো মানুষ, আমরা বিপদে মানুষের কাছেই এসেছি।
নিজের প্রতি রাগ হলো, কেনো যে জানালা খুলতে গেলাম। কুকুরগুলো জানেনা পৃথিবীতে কোন বিপদকে এড়িয়ে যাওয়া সহজ নয়, মানুষের মানুষ হয়ে ওঠাও জটিলতম প্রক্রিয়া। আমাকে দেখে তারা বিভ্রান্ত, তাদের জানা নেই অবয়ব আর ঘ্রাণ এক হলেই সবাই মানুষ নয়। এর মাঝেই কুকুরটা ডেকে উঠলো,
– মানুষ, একটু নেমে আসো এখানে, করুণা করো।
ঘ্রাণ আর অবয়বের দায় মেটাতে এখন নামতে হবে। মানুষদের বিরক্ত হতে নেই, নকল হয়েও আসল মানুষের অভিনয় করছি, তাই বিরক্তি গোপন করে মোলায়েম স্বরে বললাম,
– অপেক্ষা করো, আসছি।
আভিজাত্যের চোরাটানে যদিও বলি দো’তলায় থাকি, আসলে এটা দেড়তলা। একটা মাত্র বড় ঘর, ঘর খুললেই বিশাল ছাদ। ছাদ পেরুলেই সিঁড়ি। ঘরের দরজা খুলতেই বিরক্তি দূর হয়ে গেলো- তীব্র ঠাণ্ডা আর ঘণ কুয়াশাতেও ঝকঝকে জোছনা, রোদের মত তীব্র নয়, প্রখর মসৃণ। সিড়ি দিয়ে সন্তর্পণে নেমে এলাম- শব্দহীন। কাঠের দরজা খুলে রাস্তায় বেরুতে যাবো, নিচের ঘর থেকে ভেসে এলো আব্বার কণ্ঠ,
– দরজা খুলেছে কে?
– আব্বা, আমি।
– ও। এতো রাতে দরজা খুললে যে! এই রাতেও কি মিছিল হয়!
– না, কুকুরগুলো কান্না করছে, একটু তাড়িয়ে দিয়ে আসি।
আব্বার কণ্ঠে প্রশ্রয়-
– যাও, কুকুর তাড়িয়ে এখনই চলে আসবে। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী মিছিলে যাও বলে ভেবো না বড় হয়ে গেছো। মনে রেখ – তুমি এখনো স্কুলের গণ্ডি পার হওনি।
আব্বাকে কিভাবে বলি, মিছিলের সব হাত সমান, সব কণ্ঠ সমান। বলতে হলো না, আব্বা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, আমি সদর দরজা দিয়ে পথে বের হতেই দরজায় খিল দিলেন। জানি, না ফেরা পর্যন্ত ঘুমাবেন না, এই ঠাণ্ডায় ছাদে পাইচারি করবেন, আকাশ দেখবেন। একটু পর আব্বাকে ডাকতে মা ছাদে উঠবেন, কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকবেন, এরপর না ডেকে নিচে নেমে আসবেন। রান্নাঘরে চা বানাবেন, আব্বার সাথে আমিও ভাগ পাবো, ফ্লাস্কে চা থাকবে।

▪️
কুকুর ৩টা আগের জায়গাতেই বসে আছে, গলির দিকে তাদের চোখ, যেনো কিছু দেখছে কিন্তু সামনে যেতে সাহস পাচ্ছে না। ধীর পায়ে সামনে যেতে কুকুরদের মধ্যে একটা চঞ্চলতা দেখা গেলো। একটা কুকুর, গায়ের রঙ সাদা-কালোয় মেশানো, হঠাৎ করেই জিভ দিয়ে হাতে চেটে দিলো। বিরক্তিকর, এতো পশুপ্রেমিক এখনও হয়ে উঠিনি, কিন্তু মানুষের মুখোশ মুখে পড়ে আছি বলে কিছু বললাম না। এবার লাল কুকুরটার গলায় আকুতি,
– গলির ভিতরে একটু যাও, নিম গাছের নিচে, করুণা করো, দয়া করো।
প্রাচীন নিম গাছটা নিয়ে বহু গল্প প্রচলিত আছে- অস্বাভাবিক ভয়ের, ভৌতিক। স্বাধারণত, রাতের বেলা কেউ এই গলি দিয়ে যাওয়ার সাহস পায়না। একে নিমগাছের গল্প, সাথে নৈশব্দ নির্জনতা। ঘরের জানলা দিয়ে ওই গলি দেখা যায়, প্রতি রাতেই ওই গলির দিকে চোখ যায়। ল্যাম্প পোস্টে একটা টিউবলাইট টিমটিমিয়ে জ্বলে, চারপাশে অন্ধকার আরও প্রকট হয়ে ওঠে। ওই আবছায়া অন্ধকারে এক মাঝরাতে ধ্বস্তাধস্তি হতে দেখেছি। পুরুষ কণ্ঠের চিৎকারে পুরো পাড়ার ঘুম ভেঙে গেল। কৌতূহলের দায়ে ঘুমের রেশ কাটিয়ে ক’জন হালকা চালে গলিতে পৌছানোর আগেই লোকটি চির বিদায় নিয়েছে। হামলাকারীদের পালাতে সমস্যা হয়নি, যেতে যেতে তিন চারটা ককটেল ফুটিয়েছে, কেউ পিছু নেয়নি। এছাড়া ওই গলি অস্বাভাবিক বা অস্বস্তিকর বা ভৌতিক কিছু দেখিনি বলে ভয় কেটে গেছে। কুকুরের আবেদনে সাড়া দিয়ে গলির দিকে পা বাড়ালাম।

▪️
গলির ভেতর ঢুকতেই গায়ে কাঁটা দিল, শাদা উলের সোয়েটারের বুকে লাল-কালো মিকিমাউজও যেনো কুকড়ে যাচ্ছে, এখানে শীত আরও তীব্র। মিকিমাউজটা ফিসফিসিয়ে বললো, ‘সামনে যেওনা, ঘরে চলো, শীত করছে।’ এমন ন্যাকামিকে সবসময় পাত্তা দিতে হয় না, নিম গাছের দিকে এগিয়ে গেলাম। গাছ পর্যন্ত যেতে হলো না, বিভৎসতা পথ আগলে দাঁড়ালো। দুটো কুকুর ছানা, তুলতুলে, নির্জীব পরে আছে, মাথাগুলো কেউ কেটে নিয়ে গেছে। রক্ত ছড়িয়ে আছে, জমাট বাধছে। কুকুরগুলো পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, কুইকুই করছে।
লাল কুকুরটা এগিয়ে এলো, মৃত কুকুরগুলোর শরীর শুকলো কয়েকবার। এরপর সামনে এগিয়ে আরেকটা সরু গলিতে ঢুকে ডাক দিলো- ‘আসো’। এগিয়ে যেতে দেখলাম আরও তিনটা কুকুরছানা, শীতে আর ভয়ে কাঁপছে। ছানাগুলোকে ঘাড়ে ধরে তুললাম, কুকুরগুলো কিছুই বললো না। যেনো এমনই কথা ছিলো। গলি থেকে বেরিয়ে এসে বাড়ির পেছনে গেলাম, ওখানে ভাঙাচোরা আসবাবের নিচে ছানাগুলোকে নামিয়ে রাখলাম, বাতিল ন্যাকরা আর তয়লা দিয়ে ওমের ব্যবস্থা করা হলো। লাল কুকুরটা এদের মা, বাইরে বসে রইলো পাহারাদারের যেন। অন্য কুকুর দুটো এ পর্যন্ত আসেনি।

▪️
টোকা দেবার আগেই বাবা দরজা খুলে দিলেন। মা ঘরে ঢুকতে দিলেন না, চুলোয় গরম পানি বসিয়েছেন, গোছল করে তবেই ঘরে ঢুকতে হবে। সোয়েটারের মিকিমাউজ আৎকে উঠলো,
– এত শীতে গোছল করবে! ঠাণ্ডায় জমেই যাবো।
বিরক্তি নিয়ে বললাম,
– মনে হচ্ছে তুমিই এখন গোছল করতে যাবে। এমন ন্যাকামি করলে কিন্তু ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ভিজিয়ে রেখে আসবো, হু।
– সর‍্যি। আমি কি আর আমার জন্য বলি, তোমার জন্যই তো বলি।
– এত চিন্তা তোমাকে করতে হবেনা, এত চিন্তা করা ভালো না।
মিকিমাউজের কণ্ঠে খুব কষ্ট,
– সাধে কি আর চিন্তা করি! বছরের সাত মাস তো বন্দী করেই রাখো, ওই সাত মাস কত চিন্তা মাথায় আসে।
– বলো কি! তারপর!
– কিন্তু মুক্তির দিন গুনতে গুনতে আয়েশ করে চিন্তাটাও করতে পারিনা, এখন শান্তিমত একটু চিন্তা করা প্র‍্যাক্টিস করছি, তুমি শুধু ‘ন্যাকামি’ বলে ধমকাচ্ছো।
কথা বাড়ালাম না।
গোছল শেষে বের হতেই মা ভিজে মাথা মুছে দিলেন, দোয়া পড়ে বুকে ফু দিলেন। বাতাসে আলু আর সিম দিয়ে ইলিশের তরকারির হালকা পোড়া ঘ্রাণ। মা একটু ভাত খেয়ে নিতে বললেন। সাদা ভাত, টমেটোর ডাল থেকে ধোয়া উঠছে, ঘণ তরকারির ঘ্রাণে বুঝতে পারলাম প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে। মা ভাত বেড়ে দিলেন, তরকারি মাখিয়ে খাচ্ছি, বাবা পাশে বসে চা খাচ্ছেন। বাড়ির বাকীরা গাঢ় ঘুমে অচেতন, আমরা তিন নিশাচর জেগে থাকি, আমাদের ঘুম আসেনা অথবা আমরা ঘুমের কাছে যেতে পারিনা, যাওয়ার জন্য কাতরও হই না।
খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে ফিরলাম, হাতে ফ্লাস্ক ভর্তি চা। রাত ফুরোতে আর দেড়’ঘণ্টা লাগবে, এই সময়টা জেগে জেগেই কাটিয়ে দেওয়া যায়। একটা গাড়ি খুব ধীরে ধীরে চলে গেলো, সম্ভবত টহল পুলিশের গাড়ি। গাড়ির শব্দের রেশ না কাটতেই কুকুরের চিৎকার কানে এলো। জানালা খুললাম- আগের দুটো কুকুরই গলির দিকে তাকিয়ে ভয়ঙ্কর আক্রোশে ঘেউ ঘেউ করছে। টেবিলের ড্রয়ারে রাখা আছে ফুটবল খেলার রেফারির হুইসেল বাঁশি, ওটা বের করে খুব জোড়ে বাজালাম। রাতের নির্জনতা ভেদ করে হুইসেল কতদূর গেছে জানিনা, তবে পুলিশ আর নাইট গার্ডরা হুইসেলের জবাবে হুইসেল বাজিয়ে যাচ্ছে।
জানালাটা আর বন্ধ করলাম না, ঘরে কিছু বরফহিম হাওয়া ঢুকুক। ছাদে এলাম, জোছনা ম্লান হয়ে এসেছে। তেলের পুরানো ড্রামে লাগানো গাছ থেকে শিউলি ঝরছে। শেষ রাতের আশকারায় শীত বাড়ছে।। জ্যাকেট খুলে ছাদের মাঝখানে দাঁড়ালাম, ঠকঠক করে কাঁপুনি শুরু হলো, এতেই না কুয়াশা স্নানের আনন্দ। শীত বাড়ছে… বাড়ছে… বাড়ছে…। একটা শিউলি ফুল ব্যাথাতুর স্বরে জানতে চাইলো,
– ঝরবে না কি আমাদের মত।
– জানিনা, ফুল।
– ক্লাশ টেইনকে জানো!
– কোন ক্লাশ টেইন?
– যে একদিন তোমাকে কিছু বলতে চেয়েছিলো, বলতে না পেরে চলে গিয়েছিলো।
– না, জানিনা। সে কি বলতে চেয়েছিলো!
– বাহ! বুঝোনি তুমি?
– না বললে বুঝবো কেমন করে!
শিউলি ফুলের বুক ফুড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো,
– এ এমন কথা যা না বলেও বলা যায়, যে বুঝে সে বুঝে, যে বুঝতে পারেনা, এ কথা তার জন্য নয়।
– ওহ! কি জানি কিসের কথা বলছো!
শীতে জমে যাচ্ছি, জমতে জমতে বরফ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে- ধবধবে শাদা গাঢ় জমাট বাধা বরফ, যে বরফের গলে যাওয়া নেই, যে বরফ গলেনা কখনো ক্লাশ টেইনের মায়াবী উষ্ণতায়।

▪️
#মনসুখিয়া

ভগ্নাংশ

গতকাল মধ্যরাতে মান্না দে’র গানের মত জোছনা ছিলো, প্রেম আর বিরহে বেসামাল ও উদভ্রান্ত। মফস্বল নীরব, ঝিঁঝিঁর ডাক, গাছের পাতায় হাওয়ার খসখস ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। না, না শব্দ ছিলো। সংঘবদ্ধ নীরবতাকে অধিকতর নীরবতা দানের জন্যই ডেকে উঠছিলো রাত জাগা কোনো পাখি। ছাদে যাবো, ঘরের দরজা খুলতেই পোষা পায়রাগুলোর বাকবাকুম শুরু, খাঁচার সামনে দাঁড়াতে তাদের সুর ধীর হয়ে আসে। একটা গিরিবাজ জানতে চায়,
– ভালো আছো তো?
– হ্যা। তোমরা?
– ভালো আছি, খাঁচার জীবন খুব একটা খারাপ নয়, সকাল বিকাল পাখা মেলে উড়বার সুযোগ পাই, খাদ্য খানা নিয়ে ঝামেলা নেই। সমস্যা শুধু তোমার।
বিস্মিত হয়ে জানতে চাই,
– সমস্যা শুধু আমারই হবে কেনো?
– তোমারই হবে। এই যে আমাদের খেয়াল রাখা, ছাদে পাখিদের জন্য দুই বেলা শস্য দানা দেওয়া, খরগোশের জন্য ঘাসের যোগার করা, পথের বিড়াল আর কুকুরের জন্য খাবার দেওয়া- এসব তো বহু ঝামেলার কাজ, সবাই তাই বলে।
-ওহ! আমি ভাবলাম কি না কি ঝামেলা!
গররা পায়রাটার কণ্ঠে বেশ ঝাঁঝ,
– কোথাকার কোন লোক, তাকে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছো, এদিকে নিজের পায়ের ব্যাথাটাকে পুষছো, রাতদিন খুড়িয়ে হাঁটছো, এটা ঝামেলা নয়!
এই পৃথিবীতে উত্তরের তুলনায় প্রশ্ন ও বিস্ময়ের সংখ্যা বেশী। তাই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়না, সকল বিস্ময়ের অবসান ঘটাতে নেই। পায়রাদের বাকবাকুমে খরগোশ দম্পতির ঘুম ভেঙেছে, ছাদের দিকে পা বাড়াতেই খরগোশদের একজন কান নেড়ে জানালো, তাদের সংসারে নতুন অতিথি আসছে।

২.
ছাদ জুড়ে জোছনা আর আবছায়ার যুগলবন্দী শয়ান। ছাদের প্রতিবেশী কদম আর পেয়ারা গাছের পাতায় পাতায় জোছনার নরম ঝলকানি। যেখানে জোছনা পৌছতে পারেনি সেখানে আধো আধো অন্ধকার। শ্রাবণ মাস শেষ হয়েছে বেশ ক’দিন আগে, গাছে এখনও বেশুমার কদম ফুল। ছাদে দাঁড়িয়ে একটা ফুলে হাত বুলাতেই ফিসফিসিয়ে ওঠে কদম,
– এতো রাতে ধ্যান ভাঙালে কেনো?
চমকে উঠি, নিজেকে সামলে নিয়ে ফিসফিসিয়ে জানতে চাই,
– ধ্যানে ছিলে বুঝি!! কিসের ধ্যান?
– সে তুমি বুঝবে না, স্থবিরতার ধ্যান।
– ও.. হো। তবে থাক..
– থাকবে কেনো! ধ্যান যখন ভাঙালেই এসো একটু গল্প করি..
হাওয়া বয়ে যায়, হিম হিম। দুপুরে প্রচণ্ড গরম ছিলো, ভাদ্র মাসের তালপাকা তাপ। হাওয়ার শিরশিরানি গায়ে মেখে প্রশ্ন করি-
– কদম, তোমার সহস্র সহস্র বছর আগের স্মৃতি মনে আছে?
– আমাদের কোনো ক্যালেন্ডার নেই, বছরের হিসেব যে জানিনা..
– স্মৃতিও কি জমা রাখো না?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে কদম,
– চাইলেই কি স্মৃতি ভুলা যায়! আমাদের স্মৃতি জমা করে রাখি বীজে, আমাদের জন্ম হয় বিগত সকল জন্মের প্রতিটি মুহুর্তের স্মৃতি নিয়ে।
– তাই!
– তাই না তো কি! সেই কবেকার কথা, আমার ছায়াতেই দুরন্ত এক প্রেমিক বাঁশী বাজাতো। বাঁশীর সুরে সুরে আকুল আহ্বান, বিধিনিষেধের দেওয়াল টপকে আসতো তার প্রেমিকা বৃষভানু নন্দিনী। তারপর একদিন..
– তারপর একদিন কি?
– এক গাঢ় জোছনা রাত, ঘোষ বাড়ির কর্তা এলো কুঞ্জবনে, গোপনে। নিজ চোখেই দেখলো সব। তার প্রিয়তমা স্ত্রী বৃষভানু নন্দিনী পরম প্রেমে ধারণ করে আছে সচ্চিদানন্দকে। দু’জনের মুগ্ধ প্রেম আর কানাকানি কথায় ক্রোধে ফেটে পরেনি আয়ান ঘোষ। সে বুঝেছিল প্রেমে যে ডুবে গেছে তার ডুবে যাওয়াতেই আনন্দ, ডুবে থাকাতেই বেঁচে থাকা।
বিস্মিত হই, বাড়ির পাশের এক কদম গাছ নিজের ভেতর এতো স্মৃতি জমা করে রেখেছে। তার কাছে জানতে চাই,
– সচ্চিদানন্দ আর বৃষভানু নন্দিনী কে?
– তুমি চিনো না বলছো!
– সত্যিই চিনি না, এটা জানি যে সচ্চিদানন্দ সেই কৃষ্ণ, যে বৃষভানু নন্দিনী সেই রাধা।
– শুধু এটুকুই জানো?
– আর যা জানি তা বিস্ময়, পদ্মপুরাণ ও ভাগবতের মতে কৃষ্ণের বাম পাশ থেকেই রাধার জন্ম।
– হ্যা। তো?
– মথুরা থেকে লক্ষ যোজন দূরে তারও আগে জন্ম নিয়েছিলো সেমেটিক ধর্ম, ওই ধর্মে বাবা আদমের বুকের বাম পাশের পাঁজরের হাড় থেকেই বিবি হাওয়ার জন্ম। কি অদ্ভুত মিল, তাই না। আরও আছে…
কথা শেষ করতে না দিয়েই কদম ফিসফিসিয়ে ওঠে,
– চুপ! একদম চুপ। ওসব নিয়ে কথা বলবে না। কৃষ্ণের গায়ের রঙ কেনো কালো, ক্ষৌরকর্ম ধর্মবিরুদ্ধ, কিন্তু কেনো তিনি ক্ষৌরকর্ম করতেন, কৃষ্ণ আর্যদের দেবতা ছিলেন না এই মাটির ব্রাত্যজনদের দেবতা – এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তো মরেছ। দুই পক্ষই তোমাকে মারবে, কেউ ছাড় দিবে না।
কদমের সতর্ক বাণীতে মনে মনে হেসে উঠি, কিছুটা বিমর্ষও হই। যে জীবন হওয়ার কথা ছিলো ক্ষুধার মত সরল, খাদ্যের মত আনন্দময়, বিশ্রাম ও প্রেমের মত মুখর, তার পরতে পরতে ছড়িয়ে দিয়েছি প্রশ্ন আর প্রশ্ন। একটা মাত্র জীবন, প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়ে, প্রশ্নের উত্তর খুঁজে খুঁজে এই জীবনটা কাটিয়ে দেওয়ার কোনো অর্থ নেই জেনেও প্রশ্নের চক্রে ঘুরছি সবাই।

৩.
কদম আর কোনো কথা বললো না। নীরবতায় কেটে গেলো কয়েক মিনিট, সম্ভবত সে ফের ধ্যানে মগ্ন হয়েছে। ছাদের কার্নিশে প্রাচীন তপস্বীর মত বসে আছে এক বিড়াল, কোমল দৃষ্টি। চোখে চোখ রাখতেই বলে,
– মানুষ মাত্রই ভগ্নাংশ, ভাগশেষে শূন্য।
– মানে?
– মানুষ একটা ভাগশীল প্রাণী, নিজেকে ভাগ করে দেয়। একটা মানুষের ষোল আনা ভাগ হয়ে যায় বহু বহু ভগ্নাংশে।
কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করি-
– যেমন?
– খুব সহজ, ধরো একজন মানুষ সমস্তটা মিলে ষোলো আনা। এর এক আনা দিলো পাখিদের, এক আনা খরগোশদের, এক আনা করে কুকুর আর বিড়ালকে। এরপর চার আনা দিলো পাকস্থলির অন্ন যোগানোর দায়ে, এক আনা দিলো বন্ধুদের, এক আনা দিলে সোসাইটিকে, এক আনা দিলে আত্নীয়দের। যে কয় আনা বাকী রইলো তা সমান ভাগে ভাগ করে দিলো সংসার আর প্রিয়তম মানুষদের মাঝে।
– তো?
– সব ভাগ করে দেবার পর সে বুঝতে পারলো আরও ক’টা আনা থাকলে ভালো হতো। নিজেকে ভাগ করে দেওয়া অংশগুলোয় টান পড়ছে, এর থেকে কমিয়ে দিতে হচ্ছে ওকে, ওর ভাগেরটা দিতে হচ্ছে একে।
দম নেয় বিড়াল, সামনের পা দিয়ে মুখ ঘষে, তারপর গাঢ় বিষন্ন কণ্ঠে বলে,
– এসব ভাগাভাগি করতে করতে ধরো কোনো এক দিন, অথবা এমন চাঁদগ্রস্ত কোনো রাতে অকস্মাৎ বুঝতে পারে, নিজেকে ভাগ করে দিতে দিতে নিজের জন্য কিছুই রাখেনি সে।।ভাগশেষে নিজের জন্য অবশিষ্ট আছে শুধু শূন্য।
বিড়ালের অঙ্ক নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করেনা। আকাশের দিকে তাকাই, জানি আকাশ বলে কিছু নেই, শুধু অথৈ শূন্যতা।

৪.
কদম কি ধ্যানে মগ্ন হবার আগে মাথার ভেতর বপন করে গেছে বীজ! অঙ্কুরোদগম ঘটছে, খলবলাচ্ছে স্মৃতি। শত সহস্র বছর আগের কথা। সেদিন সকাল থেকেই ভীষণ বৃষ্টি। সূর্য ডোবার আগে বৃষ্টি থামলো। আধো আলো আধো ছায়াতে দাঁড়িয়ে থাকা এক হরিণকে বর্শায় গেথে নিলাম। ক্ষুধার অন্নে প্রস্ফুটিত হবে হরিণের সকল সৌন্দর্য্য।
আগুন জ্বালছে, হরিণের মাংস ঝলসানো হচ্ছে। গোল হয়ে বসে আছি আমরা ক’জন। আমার কাঁধে ভর দিয়ে আছে যে নারী, তার ঘামের ঘ্রাণ ঝলসানো মাংসের চাইতেও তীব্র সুন্দর। তাকে রেখে উঠে দাঁড়াই, পাশের ঝোপ থেকে ক’টা জোনাকি পোকা এনে গুঁজে দেই কানের ভাঁজে। সে হেসে ওঠে, তার হাসি মেঘের দিনের ঝর্ণা, উচ্ছল দুর্বার। তার হাসির সরল তীক্ষ্মতা বারবার বিদ্ধ করে যায়।
মাঝরাত। সবাই ঘুম। সে আর আমি জেগে আছি। শুয়ে আছি ঘাসে, সে আমার বামপাশে। খুব কাছ থেকে ভেসে আসছে বাঘের ডাক, ভ্রুক্ষেপ নেই। মাথার ওপর বিশাল চাঁদ। দু’জনেই তাকিয়ে আছি চাঁদের দিকে। পরস্পরের মাঝে কোনো কথা নেই, ওই আদিম আমাদের কোনো ভাষা জানা নেই, কবিতা জানা নেই, গান জানা নেই। বেঁচে থাকার জন্য ভাষা তখনও অপরিহার্য হয়ে ওঠেনি, পৃথিবীর সকল প্রেম নীরবতায় বোঝাতে কোনো সমস্যা হয়নি।
রাত বাড়ে, চাঁদ নেমে আসে মাথার ওপর। তার চুলে তখনও জ্বলছে কয়েকটা জোনাক পোকা। জোনাক পোকাদেরও কোনো ভাষা নেই, আলোর কারুকাজ ছাড়া। সে আলতো করে আমার বুকে হাত ধরে, তার জট বাঁধা আঠালো চুলে বিলি কেটে দেই। সে জানে বা জানেনা, সেই পাবে আমার সর্বস্ব, আমার বর্শা ও শিকারের সব ভাগ। দাঁতাল বাঘের আক্রোশ থেকে বাঁচার জন্য আমার বুনো কালো শরীরই তার নিরাপত্তার দেয়াল।
সে ঘুমোয়, আমি জেগে থাকি, পাহারা দেই, যতক্ষণ না আসে নতুন সকাল।

৫.
ধ্যান ভেঙে ফের কথা বলে কদম,
– ঘরে যাও, একটু ঘুমোও। ভোর হতে দেরী নেই।
– এখন আর ঘুমাবো না। একটু পরেই ফজরের আযান দিবে, ভীষণ ভালো লাগে, খায়রুন মিনান নাউম… খায়রুন মিনান নাউম…
কদম খুব মোলায়েম স্বরে প্রশ্ন করে,
– মনসুখিয়ায় যাচ্ছো কবে?
– জানিনা, ডাকলেই যাবো।
– আমায় নিবে?
– শত সহস্র বিগত জীবনের স্মৃতি নিয়ে যে মনসুখিয়ায় যেতে নেই। মনসুখিয়ায় যেতে হয় নিজেকে নিয়ে, নিজের ষোলো আনা নিয়ে…
হাওয়া বয়ে যায়, হাওয়ায় হাওয়ায় তীব্র স্বরে হেসে ওঠে কদম,
– তোমার ষোলো আনাই তো হারিয়ে ফেলেছো, নিজের কাছে এক কানা আনাও নেই, মনসুখিয়া তোমায় নেবে!
কদমের বিস্ময় ভাঙাতে ইচ্ছে করে না। মনসুখিয়া হতে ভেসে আসছে অভ্রবকুলের ঘ্রাণ, সে ডাকছে আমায়, ডাকে সাড়া দিতে আমারই শুধু দেরী হয়ে যায়, দেরী হয়ে যায়।

#মনসুখিয়া/দ্বিতীয়_খণ্ড।

পৃথিবী

বাদল। আট বছরের বালক। বাড়ি সিরাজগঞ্জ। বাবা-মার সাথে টংগীতে এসেছে। বাবা ভ্যান চালায়, মা আর বাদল কার্টন বক্স বানানোর কারখানায় চাকুরী পায়। শুরু হয় নতুন জীবন, সুদিনের সংগ্রাম।

হরতাল চলছে। ভ্যান চালানো বন্ধ। কার্টনের কারখানায় কাজের চাপ। রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। একরাতে ঘটে যায় দূর্ঘটনা। বাদলের ছোট পা কারখানার বড় ফ্যানে আটকে যায়। হাটুর নিচের মাংস থেতলে যায় আর হাড় ভেংগে যায় কয়েক টুকরায়। কারখানার মালিক আর বাদলের মা মিলে বাদলকে নিয়ে আসেন ঢাকার পংগু হসপিটালে। বাদলকে হসপিটালে ভর্তি করিয়েই মালিক কেটে পড়েন। অবশ্য তার আগে বাদলের মায়ের হাতে দিয়ে যান কয়েক দিন কাজ করার মজুরী বাবদ পাঁচশো টাকা।

হসপিটালের দ্বিতীয় দিন। সকাল থেকেই বাদল বাবাকে দেখতে চাইছে। বাবা এলেন শেষ বিকেলে, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত বিধ্বস্ত। টংগী থেকে হেটে হেটে আগারগাওয়ে এসেছেন। হাতে একটা মাত্র উজ্বল কমলা লেবু। হরতালে ভ্যান চালাতে পারেন নাই, কূলির কাজ করে সামান্য যা পেয়েছেন তাতে এর বেশী কিছু সাধ্যে কূলায়নি। ভূগোল বইয়ে আছে পৃথিবীর আকার কমলা লেবুর মত, বাদলের বাবার হাতের কমলা লেবুটাই যেন পৃথিবী হয়ে ওঠে।

(গল্প নয় সত্যি)

লংকা কিন্তু জ্বলছেনা

হনুমান ল্যাজে আগুন জ্বালিয়ে বসে আছেন। টিকেট কনফার্ম করা হয় নাই। অনেক আগেই লংকার ফ্লাইট চলে গেছে। আগুনের আঁচ গায়ে লাগতেই স্টেশন ম্যানেজার বললেন ‘কতদিন আলুপোড়া খাই না! এই আগুনে বার-বি-কিউ বেশ হত। অকাল কুষ্মান্ড দিয়ে অমাবস্যার চাঁদের চচ্চরি খেতে খেতে জিহ্বায় নির্ঘাত আলসার হয়ে গেছে, আলজিহবার জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যাথা।’

দরবেশ বাবা বগলে দুই ইট নিয়ে শেখ ফরিদের নাম জপছিলেন। তার জপের তেজে শেয়ার বাজার পুড়ে ছাই। ছাই চাপা দিতেই বগলের ইট কারুকার্যময় হলো হীরা-চুনি-পান্নায়। ইট থেকে দুটি হীরা সাদা পায়রা হয়ে পদ্মা সেতুর দক্ষিণে উড়ে গেল। নবাব সিরাজদৌলা বললেন, ‘কে দিবে এর জবাব? শুধুই কি তোমাদের নবাব!’ পলাশীর আম্রকাননের আমে ফরমালিন মিশাতে মিশাতে মোহনলাল বললেন ‘ধুত্তরি, টিভির রিমোট কমোডে পরে গেছে। বিটিভি দেখিছি, এনিমেল প্ল্যানেট দেখি নাই।’

তলোয়ার উচিয়ে চেঙ্গিস খান জিজ্ঞেস করলেন, ‘আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের হেড অফিসটা কোথায়?’ মাদার তেরেসা জানালেন তার হোমেই যুদ্ধ শিশুরা নিরাপদ। তৌমুর লং-এর খোড়া পায়ের চিকিৎসার কোন সমস্যা হবেনা। এ কথা শুনে চুরুটের বদলে ডিনামাইট ফুঁকতে ফুঁকতে আলফ্রেড নোবেল পাশ ফিরে শুলেন। সানি লিওন মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, ‘মিনসের ঢং দেখে আর বাঁচিনা। ভায়গ্রা কেনার টাকা নাই আবার ডিনামাইট ফুঁকে।’

চানক্য পন্ডিতের হিসেব কিছুতেই মিলছেনা। তেল মাখা বাঁশে পিছলে যাচ্ছে সুগ্রীব আর বিভীষণ। ড. ইউনুস বললেন বাঁশ, তেল এবং বানরের উচ্চাকাংখার উদ্যম নিয়ে জমজমাট সামাজিক ব্যাবসা হবে। তেল আর বাঁশের ব্রান্ডিংটা ঠিকমত করতে হবে।’ চানক্য বললেন ‘বিএসটিআই ম্যাগি নুডুলসে সীসা পায় নাই। লাইনঘাট জানা থাকলে তেল আর বাঁশও হবে আন্তর্জাতিক মানের। তবুও তো হিসেব মিলছে না, হনুমানের লেজ জ্বলছে – লংকা কিন্তু জ্বলছেনা।’

স্বপ্ন অথবা ঘোর

লম্বা বেঞ্চে বসে আছে ফয়সাল। নিজের সংগে কথা বলছে। খারাপ লাগছে না। মনে মনে চলছে নিবিড় কথোপকথন।

: তারপর?
: মেসের দুই মাসের ভাড়া বাকী। এক লাখ টাকা থেকে ভাড়া দিব। তিনমাসের ভাড়া অগ্রীম দিব। মাসে মাসে ভাড়ার চিন্তা ভাল লাগেনা। দিন যে কিভাবে যায়! মাস শুরু হতে না হতে আগামী মাস এসে হাজির।
: তারপর?
: চাকরী কপালে নাই। ছোট টং দোকান দিব। একটা পিচ্চি রেখে নিব। বেশী পরিশ্রম সহ্য হবেনা। এক লাখ টাকা থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরো আলাদা করে রাখতে হবে। পঞ্চাশ হাজারে জমপেশ টং দোকান হয়ে যাবে। ঢাকা শহরে বসবাস করা তখন কঠিন হবেনা।
: তারপর?
: ছোট বোনটাকে কিছুই দেয়া হয় নাই। শ্বশুর বাড়িতে সে ভালো আছে। একটা মাত্র ছেলে। সেই ছেলে মামা ভক্ত। ভাগ্নেকে একটা খেলনা গাড়ী দিতে হবে। পাঁচশো টাকার মধ্যে সুন্দর চায়না গাড়ী পাওয়া যাবে। এক লাখ টাকার মধ্যে পাঁচশো টাকা মানে ০.৫% ভাগ্নের জন্য বরাদ্দ।
: তারপর?
: তারপর টুকটাক খরচ আছে। টাকা পেয়ে মাথা নস্ট করলে চলবে না। একলাখ টাকা অনেক টাকা। খুব হিসাব করে, আচ্ছা দাড়াও পরে আলাপ করছি। আগে দেখি উনি কি বলেন।

পিয়ন এসে বলে- আপনি ভিতরে যান। ফয়সাল ভিতরে যায়। আরেফীন সাহেবের সামনে বসে।

আরেফীন সাহেব: ফয়সাল সাহেব, আপনাদের বয়সের ব্যবধান কিছুটা বেশী। মাস খানেক অপেক্ষা করুন। কাছাকাছি বয়সের পাওয়া না গেলে আপনি ছাড়া আর কোন বিকল্প নাই। নিন চা খান।”

ফয়সাল চা খায়। বের হয়ে আবার বেঞ্চে বসে। আবার নিজের সাথে কথোপকথন শুরু হয়।

: তারপর?
: বয়সের ব্যবধান বেশী। কাছাকাছি বয়সের না পেলে আমাকে ছাড়া বিকল্প নাই। হা: হা: হা:
: তারপর?
: আমাকে ছাড়া সত্যিই কোন বিকল্প নাই। কোন বিকল্পই নাই।
: কেন?
: বিকল্প কোথায় পাবে ! আজকাল মাত্র একলাখ টাকায় কে কিডনী বিক্রি করবে!

নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বের হয়ে আসে ফয়সাল। একমাস। ত্রিশ দিন। দেখতে দেখতে চলে যাবে। একলাখ টাকা খুব কি কম!! হিসেব করে খরচ করতে হবে। আচ্ছা একলাখ টাকা কত টাকা! একলাখ টাকার স্বপ্ন তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

ঘুম ভেঙে গেলে স্বপ্নরা জেগে থাকে। স্বপ্নরা ঘুমকে জাগিয়ে রাখে।

মধ্যবিত্ত কর্তাবাবু

মধ্যবিত্ত কর্তাবাবু

টানাটানির মধ্যবিত্ত সংসারের চালক কর্তাটি বিজ্ঞানের বিস্ময়, অর্থশাস্ত্রের রহস্যময় গণিত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি একমাত্র তিনিই পরস্পরবিরোধী তত্ব ‘সার্ভাইভাল ফর দ্য ফিটেস্ট’ আর ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’র প্রকৃষ্ট উদাহরণ, দেওয়ানবাগী আর মার্ক্সবাদীর সুষম সমন্বয়।

সংসারের চাকা টানতে টানতে কর্তাটি স্বৈরাচারের মত শিখে ফেলেন কোথায় চুপ থাকতে হয়, কোথায় সরব, কোথায় চালতে হয় গুটির চাল। মাছ বাজারে দরদামে যতটা উচ্চকণ্ঠ ও আপোষহীন, বাকীর খাতা খোলা মহল্লার দোকানে তিনি ততটাই ম্রিয়মান, বিনয়ের সাক্ষাৎ অবতার। পাতে পরা মাছের টুকরোটি পালা করে সন্তানদের পাতে তুলে দেবার চালে তার দক্ষতা প্রশ্নাতীত। মাসের কত তারিখে বেতন না পেলে দুনিয়া নরক হয়ে যাবে তা মনে রাখলেও দুনিয়া বদলে দেবার লালিত স্বপ্ন ভুলে গেছেন ঘাড়ে জোয়াল পরার দিনে। দৌড়বিদ বা ছানিচোখের বৃদ্ধের মত, যখন যেভাবে প্রয়োজন- এড়িয়ে যান ডাস্টবিন ও দাবির মিছিল। তিনি দারুণ উন্নাসিক। এই উন্নাসিকতা অভিজাত, যেনো নিশিকাণ্ডে নির্বাচিত সাংসদ এড়িয়ে যাচ্ছেন দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা।

মধ্যবিত্তের টানাটানির সংসারের দঁড়িতে হাঁটতে হাঁটতে কর্তাটি শিখে যান অত্যাবশ্যকীয় যোগ ব্যায়াম, প্রণায়াম। ঘাড় উঁচু করে পত্রিকার পাতা, সন্তানের পরীক্ষার রিপোর্টকার্ড, পুরানো শার্টের কলারের দাগ চোখের সামনে ধরে দেখেন, ওই উঁচু ঘাড়টিই বুক পকেটে গুঁজে নেন বাসের ভেতর, বসের সামনে, সকল অক্ষমতার মুখোমুখি বসে। সংসারের, পোষ্যদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে তার মত মন্ত্রবিদ আর নেই– তিনি জানেন কোন খাবার সস্তা হলেও পুষ্টিকর, অধিক খাদ্যে কতটা স্বাস্থ্যক্ষয়, কোন রোগে কোন ওষুধ। টানাটানির সংসারের কর্তা নন, মন্ত্রী এক, কে না জানে মন্ত্রী মাত্রই সর্বজ্ঞ, সর্বজ্ঞানের পাইকারি ও খুচরা আড়ত।

ম্যাজিশিয়ান জানেন না- কিভাবে দু’টো শার্ট আর তিনটা প্যান্টে পার করে দিতে হয় পাঁচ ছ’বছর, শুক্রবারের জুম্মার জামাতে কিভাবে লুকোতে পাঞ্জাবীর বোগলের নিচে সেলায়ের দাগ, এক জোড়া জুতোয় কাটাতে হয় বছরের পর বছর। এসব ম্যাজিক মোটেই সহজ নয়, অথচ হাততালির প্রত্যাশা না করেই কি অবলীলায় দেখিয়ে যান কর্তা। মাসিক ১০টাকা আয় দিয়ে কিভাবে চালাতে হয় ১০০টাকার সংসার- এই মন্ত্র তিনি ছাড়া আর কেই বা জানেন!

এক একটা দিনে, এক একটা রাতে, এক একটা দিনের বা রাতের এক একটা মুহুর্তে আপন দীর্ঘশ্বাস গিলে কর্তা ভাবেন- আর তো লাগেনা ভালো এই ম্যাজিশিয়ানের জীবন, যোগ-ব্যায়ামের কৌশল। মরার আগে এ জীবনে আসুক সুদিন। আহা শরীরে জমুক কিছুটা মেদ, রক্তে বাড়ুক কোলেস্টেরল।

অপঘাত

: ইন দ্য ইয়ার অফ ১৯৪২, আমাদের এই মিরপুরের শ্যাওড়া পাড়ার ঘটনা। অণুগল্পকার মোখলেস খন্দকার গভীর রাতে অণুগল্প লিখছিলেন।
: শফিক চাচা, তারপরে কি হলো?
: তিনি গল্প লিখে শেষ করার আগেই স্ট্রোকে মারা যান। তার সাথে অসমাপ্ত গল্পটারও অপমৃত্যু ঘটে।
: গল্পও মারা যায়!
: মারা গেলে ভালোই হত, কিন্তু গল্পটা পুরোপুরি মারা যায় না। আফটার অল অপমৃত্যুতো।
: তবে?
: ধর্মীয় নিয়মে মোখলেস খন্দকারের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। কিন্তু অপঘাতে মৃত্যু আর শেষ কৃত্য সম্পন্ন না হওয়ায় অসমাপ্ত অণুগল্পটা ভুতে পরিনত হয়। বাড়ির দক্ষিণ দিকের তমাল গাছে আশ্রয় নেয়। একা একাই থাকত। ঝামেলা করতো না।
: তারপর?
: একদিন সন্ধ্যায় এক প্রখ্যাত অণুগল্পকার গল্পের প্লট ভাবতে ভাবতে দাড়িয়ে দাড়িয়ে তমাল গাছের পাশের দেয়ালে হিসু করছিলো। সেই হিসুর ছিটা গল্পভুতকে ভিজিয়ে দেয়। ভুতের ভিতরের ভুতোত্ব জেগে ওঠে।
: তারপর?
: অতৃপ্ত আত্নার মত অসমাপ্ত অণুগল্প ঐ অণুগল্পকারের কাধে সওয়ার হয়।
: তারপর?
: তারপরের অবস্থা ভয়াবহ। প্রায় সারাক্ষণ অণুগল্পের ভুত লেখকের কাধে আসর করে থাকে। সে অস্থির হয়ে ওঠে। কখনও কখনও ফেরোসাস, ভায়োলেন্ট। নিজে লিখে, সামনে যাকে পায় তাকে দিয়েই অণুগল্প লেখাতে চায়। না লিখলেই দায়ের কোপ।
: বলেন কি!
: কিছুদিন আগে পাংগাস মাছের ফেরিওয়ালাকে অণুগল্প লেখার জন্য রাম দা নিয়ে তাড়া করেছিল। সেই থেকে এই গলিতে ফেরিওয়ালারা ঢুকে না।
: তাই না কি! ভুতের গল্পের নামে আজগুবি কি এক গল্প শোনালেন। ভয় নেই, থ্রিল নেই, সাসপেন্স নেই। বানোয়াট গল্প, দূর্বল কাহিনী।
: ইয়ংম্যান, জানতাম, আপনি বিশ্বাস করবেন না। সোজা তিন তলায় উঠে কলিং বেল বাজান। সাসপেন্স, থ্রিলার আর ভূতের ভয় আপনার শরীরের প্রতিটি রোমকূপে অনুভব করবেন।
: তবে তিন তলাতেই যাই, ভুত দেখে আসি।

সেলিম সাহেব মুক্তমনা লোক। দ্রুত সিড়ি ভেংগে তিনতলায় উঠে গেলেন। পাঁচ মিনিট পরে বিশাল শোরগোল। সেলিম সাহেব ‘বাঁচাও…বাঁচাও’ বলে প্রাণপনে সিড়ি দিয়ে নেমে রাস্তায় দৌড়াচ্ছেন, তার পিছনে পিছনে ‘তুই অণুগল্প লিখবিনা! তোর বাপ লিখবে… তোর দাদা লিখবে… তোর চাচামামাখালুফুপা লিখবে.. ফোরটিন্ত দুগুনে টুয়েন্টিএইট গুষ্টি লিখবে…: বলে চেচাতে চেচাতে দুই হাতে শান দেয়া দুই রামদা নিয়ে প্রখ্যাত অণুগল্পকার বেলাল দৌড়াচ্ছেন। অণুগল্পের ভুত আজ একটু বেশীই ক্ষেপেছে, চৌদ্দগোষ্ঠীর সীমাকে অপঘাতে ঘায়েল করে আটাশগোষ্ঠীতে পৌছে গেছে।

এলবেন ডিএস

শেফা ফার্মেসী। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আড্ডা জমে। এলাকার বিভিন্ন বয়সী কয়েকজন নিয়মিত আড্ডা মারতে আসেন। ফার্মেসীর মালিক মজনুও যোগ দেয়। ফার্মেসী সামলায় রনি। রনির বয়স কম। ভীষণ করিতকর্মা। প্রাণবন্ত রসিক।

আড্ডার সদস্যরা ছোটখাটো স্বাস্থ্য সমস্যায় রনির শরণাপন্ন হন। রনির দেয়া ওষুধ খান। এক সকালে বিধ্বস্ত অবস্থায় শাহজাহান চাচা হাজির-
: রনি, মাথা ব্যাথায় মইরা যাইতাছি, বাবা রে বাচা।
: চাচা, নাস্তা খাইছেন?
: হ, বাবা।
: তেইলে টুলে বইসা এই ট্যাবলেটটা চুইসা চুইসা খান। দশ মিনিটে মাথাব্যাথা কইমা যাইবো।

শাহজাহান চাচা টুলে বসে চোখ বন্ধ করে ওষুধ চুষতে লাগলেন। দশ মিনিটের আগেই ব্যাথা কমে গেল। তিনি কৃতজ্ঞতার সুরে রনির কাছে জানতে চাইলেন-
: বাবা, এই ওষুধের নাম কি?
: চাচা, এইটা এলবেন ডিএস।
: মাথা ব্যাথার খুব ভালা ওষুধ।
: হে: হে: হে: এইটা মাথা ব্যাথার ওষুধ না।
: তবে কিয়ের ওষুধ?
: কৃমির ওষুধ হে: হে: হে:
: হারামজাদা, তুই আমারে কৃমির ওষুধ খাওইয়া মশকরা করস, ***বাচ্চা…
: চাচা, চ্যাতেন ক্যান! আপনার সমস্যাতো মাথায় না, সমস্যা অইলো কৃমিতে। প্যাটের কৃমি আশকারা পায়া পায়া মাথায় উইঠা গেছিল হে: হে: হে: তাগো নামায়া দিলাম হে: হে: হে:

শাহজাহান চাচা হঠাত শান্ত হয়ে যান। টুলে বসেন। রনিকে চা আনাতে বলেন। দৈনিক পত্রিকাটা হাতে নেন। হেডিংগুলো পড়তে পড়তে রনির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন,’বাবা, তুইতো আমার মাথা থেকা কৃমি নামায়া দিলি। যে কৃমিরগুষ্ঠীরে আমরা দ্যাশের মাথায় তুইলা দিছি তাগো নামানের লেগা এলবেন ডিএস খাওয়াইবো কেডা!’

সনোলোজিস্ট

রাতের খোলস থেকে কিভাবে বের হয় একটা সতেজ ভোর! জানালা দিয়ে ঝিরিঝিরি বাতাস। ফজরের আজানে মোয়াজ্জিনের কণ্ঠে এত সুর কোথা থেকে আসে! ডাক্তার কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন। খেলে কিছুটা সময়ের জন্য ঘুম আসে, তারপর কেমন এক অস্বস্তি আকড়ে ধরে। না ঘুম, না তন্দ্রা, না জাগরণ। কোনো ভুডু ওঝা যেন মন্ত্র পড়ে আমাকে জীবন্মৃত করে রেখেছে। তবু বাতাসের ঝিরিঝিরি শব্দ পাই, নরম শীতলতা পাই, রাতের কলি হতে একটা নতুন সকাল ফুটে ওঠার আভাস পাই, ঘোর অথবা জাগরণে ঘাস ও মাটির সোদা গন্ধ মিশানো সকালের দৃশ্যকল্প দেখি।

কোন এক কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে উপমা আমাকে দশটা গাঢ় লাল গোলাপ দিয়েছিল। বিন্দু বিন্দু শিশিরকণায় পাপড়িগুলো সিক্ত ছিল। সেই কবেকার কথা! বাস্তবিকই আমি তখন গোলাপের অর্থ বুঝতাম না। উপমা এখন নামজাদা আল্ট্রাসনোলোজিস্ট। আচ্ছা, গোলাপের কি আল্ট্রাসনোগ্রাফ করা যায়! মানুষের মত মৃত্যুর আগে কি প্রতিটা গোলাপ অন্তত একবার বেঁচে ওঠে! বাঁচার মত ক্ষণিকের জন্য বেঁচে ওঠা।

নোমিনেশন

: ফজু, একটা নমিনেশিন পেপার যে কিনতি হয়!
: বড় ভাই কি ইলাকশন করিবেন!
: না রে ফজু, বাণিজ্যি করিবো।
: নমিনেশিন পেপার কিনিবেন ক্যানে!
: বাণিজ্যি করিবো, নমিনেশিন পেপার লাগিবে না! নমিনেশিন পেপার কিনিবার পরে বড় বড় কইরে দুইটা মিছিল করিবো, পুস্টার সাটাইবো, জনসংযোগ করিবো, ইনভেস্টমেন্ট, বুঝিছিস!
: না, বড় ভাই। সব করিবেন, ইলাকশন করিবেন না! ক্যামন ঝাইপসা ঝাইপসা লাগে।
: নির্বাচন করিলে ফেল মারিবো। তাই বাণিজ্যি করিবো।
: মানে?
: মানে অইলো ফাইট করিবার মত আমাগো তিন ক্যান্ডোডট আছে, তাগো কাছ থেকি ৫লাখ টাকা করি নিয়ি বইসে পরিবো।
: এব্যা বুঝিছি, বাণিজ্যি বুঝিছি।
: ফজু, পরশু নমিনেশিন কিনিতে যাবো, লোকজন রেডি কর, ট্যাক্যার জন্যি চিন্তা করিস না। তুই আমার ম্যানেজর, সব দায়িত্বি তোর।

ফজু লোকজন যোগাড়ের বায়নার টাকা নিয়ে বেরিয়ে পরে। তার মনের ভিতর খচখচ করে- আহা, ইনভেস্ট করার মত টাকা থাকলে একটা নোমিনেশন পেপার কেনা যেত! বহুদিন পরে সে বড় ভায়ের শত্রু আনিস মাদবরের আড়তের উদ্দেশ্যে হাটা দেয়।

অকবিতা ৬

পথভ্রষ্ট বা ধর্মভ্রষ্ট-
আপেল খাওয়ার পাপে
রিজিক তালাশ করতে করতে
থেমেছি এসে তোমার অতল ঠোঁটে
অথবা, রিজিকই এনেছে টেনে।

হে পাঁজরের হাড়
হে প্রিয় হাওয়া-
ফসলের মাঠ ছুঁয়েছে আকাশ
ডাগর শিষ প্রলোভনে দেয় ডাক-
বেশী নয়, চাই আয়ু পরিমাণ শস্যদানার ভাগ
আর অভিশাপে জরো জরো ক্ষণে
আকড়ে ধরার খড়কুটোর সঞ্চয়।

হে দেহাংশ
হে জ্ঞান সংহিতা-
উস্কানি দাও, বাঁচাও আবার
রিজিক তালাশে অগ্নিকুণ্ডে তুষারপুঞ্জে নক্ষত্রপতনে
চরকির মত ঘুরতে ঘুরতে যেজন ক্লান্ত বহুকাল
আমিই সে প্রণয়গ্রস্থ অভিশাপ
নিক্ষিপ্ত হবার দিনে তোমার প্রিয় ডাকনাম।

হে পাঁজরের স্বতন্ত্র সত্ত্বা
হে আপেল পানের মিতা,
ততদিন পাশে থাকো ততদিনই পাশে রাখো
যতদিন এ দেহ ভস্ম না হয়
যতদিন এ দেহ ধূলোয় না মিশে
যতদিন ভস্ম ও ধূলো হতে ফের না জন্মায় তোমার রিজিক।