আবু সাঈদ আহমেদ এর সকল পোস্ট

মজার গল্প

আকিল আকতাব গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। কথা বলেন কম, তবে গুছিয়ে এবং মোটামুটি যুক্তি দিয়ে কথা বলেন। ইদানিং তার মাঝে পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। তিনি সবকিছুতেই মজা পান। কথা শুরু করেন ‘মজার একটা কথা শোনেন” বলে। গতকাল বিকেলে পাশে এসে বসলেন-
: ভাই, মজার একটা কথা শোনেন।
: বলেন।
: এমদাদিয়া হোটেলে লাঞ্চ করতে গেছি, মাছের তরকারীতে তিন তিনটা চুল, হা: হা: হা:
: এখানে মজা কোথায়?
: মজাটা ধরতে পারছেন না! বাবুর্চির চুল এভাবে ঝরলে তিন মাসে পুরো টাক। তারপর এমদাদিয়া হোটেলের তরকারীতে আর চুল পাওয়া যাবেনা হা: হা: হা:

তিন মাস আগের আকতাব সাহেবের সাথে এই আকতাব সাহেবের মিল খুঁজে পাইনা। আজ মুখে কষ্ট চেপে হাসি এনে বললেন-
: মজার কথা শোনেন, ব্যাথায় মাথা পুরো ছিড়ে যাচ্ছে।
: ওষুধ খান, মজার কথা পরে শোনান।
: আরে শোনেন না, ব্যাথা তো মাথাকে ছিড়ে ফেলতে চাইছে। কিন্তু গলা শক্ত দড়ির মত আটকে রেখেছে, যা ফাইটিং হচ্ছে পুরো একশন মুভি হা: হা: হা:

মন উসখুশ করে। সবকিছুতে মজা পাওয়া সুস্থতার লক্ষণ নয়। লোকটাকে খুব পছন্দ করি। অফিস ছুটির পরে তাকে পাকড়াও করে এক নিরিবিলি রেস্টুরেন্টে বসলাম:-
: আকতাব ভাই, বলেন তো আপনার সমস্যা কি?
: ধ্যাত, সমস্যা কোথায়! পুরোটাই সুবিধা হা: হা: হা:
: সুবিধাটাই বলেন- কোন কিছু না লুকিয়ে বলেন।

উনার মুখে এক মূর্হুতের জন্য বিষাদ খেলা করে। পরক্ষণেই হাসি মুখে হালিম আর নান খেতে খেতে বলতে শুরু করেন-
: আমার খুব বাজে ধরনের মাথাব্যাথা আছে, জানেন তো?
: হুম, মাইগ্রেনের ব্যাথা। ব্যাথা উঠলে আপনাকে চেনা যায়না।
: শাহেদ আর মুস্তফিজকে চেনেন তো! আমার বন্ধু।
: হ্যা, বেশ চিনি। খুব ভালো এবং দায়িত্বশীল ডাক্টার।
: কিছু শারিরীক সমস্যা দেখা দেয়ায় তাদের কথামত সব টেস্ট করিয়েছিলাম। কিছু টেস্ট তিনবার করালো।
: তারপর?
: মজার কথা শোনেন, শালারা টেস্ট শেষে জানালো নিয়ম কানুন মেনে চললে হাতে বড়জোড় দশবছর সময় আছে।
: মানে?
: মানে বাংলা ছবিতে নায়কদের যেমন ক্যান্সার হয়, তেমন। মজার ব্যাপার তাদের ক্যান্সার ধরা পরে ফাইনাল স্টেজে, আমারটা ধরা পরেছে আগে আগে হা: হা: হা:
: কি বলছেন? সত্যি?
: হ্যা, ভাই, সত্যি। এখন নিয়ম কানুন মেনে চলছি- ক্লাশের ফার্স্ট বয়ের মত।
: বাসায় জানে?
: বাসায় পরে জানানো যাবে। তারা সহজভাবে থাকতে পারবেনা। দশটা বছর ভুগবে। আমি চলে যাবার পরেও ভুগবে। ওদের এডভান্স ভোগানোর কি দরকার! হা: হা: হা:
: বাসায় জানানো দরকার!
: সময় হলে শাহেদ আর মুস্তাফিজই জানাবে।
: নিজের দু:খ আড়াল করতে মজা পাবার অভিনয় করেন কেন! সবাই ভুল বুঝে।

আকতাব সাহেব সশব্দে হেসে উঠে বলতে শুরু করলেন-
: ভাই, মজার কথা শোনেন, দশ বছর অনেক সময়। দশ বছরের পরের যাত্রার জন্য বাক্সপেটরা গোছানোর ঝামেলা নেই। তবে সংসারের কিছু জিনিস ঠিক ঠিক দ্রুত গুঁছিয়ে দিতে হবে- আমি না থাকলেও প্রিয়মানুষেরা যেন ডালভাত খেয়ে সম্মানের সাথে টিকে থাকতে পারে।
: এখন স্বাভাবিকভাবে কথা বলছেন- ভালো লাগছে। এটা তো আর মজার কথা না?
: মজার কথা নয় তো কি। দায়িত্ব আরো আছে, দশবছরের মধ্যে বিশটা কালজয়ী কবিতা লিখতে হবে। একজনকে নীরবে শর্তহীনভাবে ভালোবাসতে হবে- ভালোবাসা ছাড়া কবিতা লেখা যায় না কি! হা: হা: হা:
: বেশ, মজার কথা শুনে মজা পাচ্ছিনা-
: তবে সিরিয়াস কথা বলি, যাদের ভালোবাসি তাদের সবাইকে বলতে হবে – ‘আইলাভ্যু’ হা: হা: হা:। দশ বছর অনেক সময়, এই সময়ের মধ্যে কাজগুলো সারতে হবে।
: দশ বছর মোটেও বেশী সময় নয়।
: ভাই, ফর্মূলা জানলে দশ বছর অনেক সময়। মজার ফর্মূলাটা শুনবেন?
: বলেন, শুনি।
: দশ বছরকে বিশ বছর বানিয়ে ফেলেছি হা: হা: হা:
: অসম্ভব! কিভাবে?
: আগে রাতে ঘুমোতাম, এখন জেগে থাকি হা: হা: হা:। রাতগুলোকে দিন ধরে নিলে হিসাবে বিশ বছর হয়, তাই না!
: টেনশনে কি ঘুমান না?
: টেনশন নেই বলেই জেগে থাকি। তবে আসা-যাওয়ার পথে যানজটে বসে বসে ঘুমোই, রাতে একঘন্টা গাঢ় ঘুম দেই। ঘুম অভিমান করেছে, এখন আর আমার কাছে সহজে আসে না হা: হা: হা:

কথা খুঁজে পাই না। হালিম আর নান শেষ করে রেস্টুরেন্ট হতে বের হই। দিনের ব্যস্ত দিলখুশা এখন প্রায় নির্জন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাদের উপরে মস্ত চাঁদ উঠেছে। আগামীকাল পূর্ণিমা। কিছুটা হেটে রিকশায় উঠি, আকতাব সাহেব সাথে আসেন। কোথায় যাবো জিজ্ঞেস না করেই চালক রিকশা চালাতে শুরু করেন। চারদিকে এত মজা- তবু কেমন বিস্বাদ লাগে। আকতাব সাহেব চাঁদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন। জোছনায় বা অশ্রুতে তার চোখ চিকচিক করছে। হঠাৎ সমস্ত আবেগ দিয়ে গাইতে শুরু করেন-
তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমানিশীথিনী-সম।।

মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন
তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম।।

জাগিবে একাকী তব করুণ আঁখি,
তব অঞ্চলছায়া মোরে রহিবে ঢাকি।

মম দুঃখবেদন মম সফল স্বপন
তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম।।

ইরেজারের ঘ্রাণ

মাঝদুপুর। অফিসে ব্যস্ততার মাঝে কিছুটা অলস সময়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র অফিসঘরে মাঘমাসকে ডেকে এনেছে। জানলার পর্দা সরাতেই একফালি রোদ ঢুকে পরলো। রোদের সাথে সাথে ঢুকে পরেছে ইশকুলে যাবার ছেলেবেলার ভোর।

এক আত্নভোলা শিশু ইশকুলে যাবে। মায়ের হাত ধরে। গুটিশুটি পায়ে। নীল-শাদা বরফিকাটা সোয়েটারে সঞ্চারিত ফুপুমার স্নেহের ওম। সে বুক ভরে শ্বাস নেয়। হাতে পাকা লেবু রঙা ঢেউঢেউ ইরেজার। অপার বিষ্ময়ে ইরেজারের সুঘ্রাণ নেয়- আহ কত মিষ্টি! ঘ্রাণ যেন হারিয়ে না যায়- শক্ত মুঠোর ভিতরে ইরেজার ধরে রাখে।

অলস দুপুরের একফালি কমলা রোদ বলে-

: যাবে না কি সেই ইরেজারের ঘ্রাণের দেশে?
: সেখানে যাওয়া যায় না কি!
: যাবেনা কেন! অবশ্যই যায়।
: যাবো, একটু দাঁড়াও, হাতের অল্প ক’টা কাজ ঝট করে শেষ করে নেই।
: হাহাহাহাহাহাহাহাহাহাহাহাহা
: এতে হাসির কি হলো!
: ঘ্রাণের দেশে তোমার যাওয়া হবেনা কোনদিন হাহাহাহাহা।
: কেন?
: তোমার অল্প একটু কাজ থেকেই যাবে। সে কাজ শেষ করতে দেরী হয়ে যাবে। এদিকে একটু একটু করে ঘ্রাণের জগত অনেক দূরে সরে যাবে।

রোদের কথা শুনে বিষন্ন হই। বিরক্তও হই সামান্য। মুহুর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার কথা শুরু করি-
: তুমি ঠিকানা দিয়ে যাও- নিজেই খুঁজে নেবো ইরেজারের ঘ্রাণের জগত।
: তাহলে সোজা চলে যাও মনসুখিয়া।
: মনসুখিয়াই তাহলে ইরেজারের ঘ্রাণের জগত!
: না, মনসুখিয়া ইরেজারের ঘ্রাণের জগত নয়। মনসুখিয়ার রাজকন্যার চুলে ইরেজারের ঘ্রাণ আছে।
: রাজকন্যার চুলের ঘ্রাণ দিয়ে আমি কি করবো?
: আররে বোকা, রাজকন্যার চুলের ঘ্রাণে ইরেজারের দেশে পৌছানোর গোপন নকশা আছে।
: তাই না কি! রাজকন্যা কি আর আমাকে পাত্তা টাত্তা দিবে।
: দিবেনা কেন! সোনাকাঠি আর রূপোকাঠি আছে কি করতে!
: আমি গরীব অফিস মজুর। আমার কি আর সোনাকাঠি রূপোকাঠি আছে!
: সবার ভিতরেই একটা করে সোনাকাঠি আর রূপোকাঠি আছে। সবার ছায়াতেই একটা করে ডাইনিবুড়ি আছে। সে ডাইনিবুড়ি রাজকন্যাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে।
: তাই না কি!
: হ্যা, ডাইনি বুড়ির প্রাণভোমরা থাকে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে চিনিফুলের বন পেরিয়ে সাতসমুদ্দুরের মাঝখানে এক পাথরের কৌটায়। সোনাকাঠি আর রূপোকাঠি দিয়ে রাজকন্যাকে জাগিয়ে ছুটতে হয় ডাইনিবুড়ির প্রাণভোমড়ার পাখা ভেঙে দিতে।
: তারপর?
: তারপর আর কি! রাজকন্যার চুলে শুকে নিবে ছেলেবেলার ইরেজারের ঘ্রাণ, ইশকুলের চারকোনা রোদমাখা মাঠ, নীলশাদা বরফিকাটা সোয়েটার। কে জানে- হয়তো রাজকন্যাই ইরেজারের ঘ্রাণের দেশ হয়ে যাবে তোমার স্পর্শে।
: হা: হা: হা: তুমি আমার মত বুড়োকে রূপকথা শোনাচ্ছো!

রোদ তীব্র প্রতিবাদ করে ওঠে-
: রূপকথা শোনাবো কেন! আমার কি দায় পরেছে! একবার মনসুখিয়ায় ঘুরে এলেই পারো।

রোদ অভিমানে একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। পর্দা টেনে দিলে এখনি চলে যাবে। পর্দা না টেনে বসে থাকি, এই রোদ সামান্য নয়। ছেলেবেলার ঘুড়ি ওড়ানোর দুপুর থেকে পালিয়ে এসেছে আমাকে দেখবে বলে, মনসুখিয়ার রাজকন্যার চুলে ইরেজারের ঘ্রাণের দেশে পৌছানোর নকশা আছে জানাতে।

সবাই তো চলে যায়, রোদও যাবে, যাবার আগে ডুবে থাকি, নিজেকে ডুবিয়ে রাখি রোদের কণায় কণায় কিছুটা সময়।

ভবিতব্য

: বিশাল নদী দেখলে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে।
: তাই?
: হুম। স্রোতের ভিতরে এত সন্তর্পণে ডুবতে ইচ্ছে করে যেন…
: যেন! কি?
: যেন স্রোতও বুঝতে না পারে ডুবে যাচ্ছি, হারিয়ে যাচ্ছি চিরদিনের জন্য।
: অদ্ভুত! শুধু এসব ভাবনা মনে আসে?
: না। অন্য ভাবনাও মনে আসে।
: যেমন?
: যেমন– তোমাকে মনে হয় প্রমত্তা যমুনা..
: যমুনায় ডুবে যেতে ইচ্ছে করে?
: নাহ, ভেসে থাকতে ইচ্ছে করে।

কারো মুখে কথা নেই। ডুবগ্রস্থ উন্মাদ জানে বহু আগে নদী দখল হয়ে গেছে। নদীর নরম মন, ভীষন করুণা হয়, মায়ায় বোঝায়-
: যমুনা নেই তো কি হয়েছে! তোমাকে ভেসে থাকতে হবে পদ্মায়.. সুরমায়.. কাবেরীতে..
হেসে ওঠে উন্মাদ-
: ডুবে যাওয়া যখন ভবিতব্য, তখন ডুবা’ও একধরণের ভাসা।

রেলব্রিজের নিচে বয়ে চলে ভৈরব। ছলাত ছলাত নামতা পড়ে- টাইম এন্ড টাইড ওয়েট ফর নান… টাইম এন্ড টাইড ওয়েট ফর নান… টাইম এন্ড টাইড…।

রবিঠাকুরের লেজ

দুটো গলি পেরোতেই দেখি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আছি। উঠোনে সকালের রোদে রবিঠাকুর বসে আছেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন সুকুমার রায়। রবি ঠাকুর হাতির দাঁতের চিরুনী দিয়ে লেজ প্রান্তের চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলছেন-
: কেনো যে এমন লেজ গঁজালো, ভেবেই পাচ্ছিনা।

সুকুমার রায় তার বেড়াল থেকে হয়ে যাওয়া রুমালে শুকনো কপাল মুছে বললেন-
: নোবেল পুরষ্কার পেলে লেজ না হয় শিং গজাবেই গজাবে, হু।
: বলো কি সুকুমার! তাই না কি!
: লেজ বা শিংই যদি না গঁজালো তবে নোবেল পেয়ে লাভ কি!
: তবে তো শিং গঁজানোই ভালো ছিলো হে…..

সুকুমার রায় পকেটে রুমালটা ঢুকিয়ে খুব গম্ভীর হয়ে বললেন-
: আপনি বিশ্বমানবতার কথা বলেন, আপনার কেনো শিং গজাবে! শিং গজাচ্ছে ইউনুসের। আপনার গঁজাবে মায়ামায়া লেজ।

রবিঠাকুর হাতির দাঁতের চিরুনী চোখের সামনে আনতেই দেখলেন লেজের অনেকগুলো চুল তাতে জড়িয়ে আছে। তিনি খুব হতাশ হয়ে বললেন-
: বুঝলে সুকুমার, প্রতিদিন লেজের চুল শ্যাম্পু করছি, কন্ডিশনার মাখছি। সেদিন জেন্টস পার্লারে গিয়ে লেজের চুলে হেয়ার ট্রিটমেন্ট করালাম। রাতে লেজের চুলে নন-স্টিকি কদুর তেল মাখছি— তারপরেও চুল ঝরে যাচ্ছে—
: হায়! হায়! কবিগুরু, আপনি লেজের চুলে কদুর তেল মাখেন!!! চুল তো ঝরবেই…

কবিগুরু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
: কদুর তেলে সমস্যা কি!
: বিশ্ব মানবতার কথা বলতে বলতে স্থান-কাল-পাত্র ভেদটাও ভুলেছেন! আনন্দ পুরস্কার পেলে কদুর তেল মাখতে হয়- দুটোই দেশি জিনিস। আর নোবেল পেলে লেজের চুলে মাখতে হয় আপেলের তেল।
: ধ্যাত! আপেলের আবার তেল হয় না কি!
: শেয়ালের তেল হয়, টিকটিকির তেল হয়, ষান্ডার তেল হয়, আর আপেলের তেল হবেনা!!
: আগে বলবে তো, কদুর তেল মেখে মেখে লেজে তো রীতিমত টাক পড়ে যাচ্ছে-
: জ্ঞানী লোকের টাক লেজেই তো পড়বে, মাথায় পড়বে না কি!

রবিঠাকুর হঠাৎ উদাস হয়ে গেলেন। হাতির দাঁতের চিরুনীতে আটকে থাকা লেজের চুলগুলো একটা একটা করে মাটিতে ফেলতে লাগলেন। আর ম্যাজিকের মত প্রতিটা চুল থেকেই এক একজন রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ বের হয়ে আসতে শুরু করলো। তারা ভয়ানক ভঙ্গিতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে আর চেঁচিয়ে বলছে- ‘রবিঠাকুরকে নিয়ে ফাজলামি, দেখাচ্ছি মজা।’

নিজের প্রাণ বাঁচাতে রবীন্দ্রনাথের লেজে পড়ে বললাম, ‘কবিগুরু, আমাকে বাঁচান।’ রবিঠাকুর লেজ সরিয়ে নিয়ে বিরক্তির সাথে ধমকে উঠলেন, ‘ধুরবাল…! আমি নিজের লেজের ঝরে পড়া চুল দিয়ে আঁটি বাধতে পারছিনা। প্রতিটা চুল ঝরতে না ঝরতেই এক একটা বিশাল রবীন্দ্র গবেষক ও রবীন্দ্রপ্রেমী হয়ে যাচ্ছে, আর আমি বাঁচাবো তোকে!!’

লেজোবর্জ্য রবীন্দ্র গবেষক এবং রবীন্দ্রপ্রেমীরা ততোধিক আক্রোশে আমাকে ঘিরে ধরতেই প্রাণপণে আবার বরিঠাকুরের লেজে পড়ে বললাম, ‘কবিগুরু, আমাকে বাঁচান, প্লিজ ওদের থামান।’
রবিঠাকুর অসহায় কণ্ঠে বললেন, ‘ওরে বোকাচোদা, ওরা কি আর আমার কথা শুনে!! ওরা এখন আমার থেকেও বড় রবীন্দ্রনাথ। এত কিছু জানিস এটা জানিস না…!!’

হট্টগোলের শব্দ শুরু হতেই আপেলের তেল আনবার বাহানা দিয়ে সুকুমার রায় সরে পড়েছেন। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ আর প্রেমীরা আমার উপর ঝাপিয়ে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেলো। ঘড়িতে দেখলাম রাত সাড়ে তিনটা বাজে—শেষ রাতের স্বপ্ন না কি সত্য হয়!! খুব ভয়ে ভয়ে আছি।

সাইরেন

পুরান ঢাকার ঘিঞ্জিপাড়া কাগজীটোলা। এক বাড়ীর লগে আরেক বাড়ির দেয়াল। আজিব ব্যাপার হইলো মোসলেম মিয়ার চাইরতলা বাড়ির পিছনে চাইর ফুট পুরা ফাকা। মাগার ছাদে রেলিং নাই। দুইদিনের টানা বৃষ্টিতে ছাদ পিছলা হয়া আছে।

মোসলেম মিঞার মেজো পোলা তোফাজ্জল। দুপুরে বেহুদাকামে ছাদে উঠছিলো। পা পিছলায়া ছাদের পিছনে পইরা গেছে। মাথায় যখম পাইছে। ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করাইছে।

সন্ধ্যার থেকা বৃষ্টির বেগ বাড়তাছে। তোফাজ্জল ডেড। ময়নাতদন্ত শেষে এম্বুলেন্স সাইরেন বাজাইতে বাজাইতে লাশ লিয়া মহল্লায় ফিরতাছে।

কাগজীটোলার তিন’শ গজ দূরে শিংটোলার মান্নান হাজীর বাড়িতে মৌ মৌ কাচ্চির ঘ্রাণ। হাই ভলিউমে ঝামাকঝাল্লো হিন্দী গান বাজতাছে। ছোট মাইয়া রোজীর গায়ে হলুদ। ইচিকদানা বিচিকদানা গানের রিমিক্স ভেদ কইরা এম্বুলেন্সের প্যাপুউউউ..প্যাপুউউউউ সাইরেন রোজীর কানে ঢুইকা বাজতে চাইতাছে, মাগার পারতাছেনা। এদিকে বেহুদা বেহুদা বৃষ্টির বেগ বাড়তাছে।

যমজিয়া

– কি চাও?
– শর্তহীন প্রণয়।
– প্রণয় কি শর্তহীন হয়?
– প্রণয় আমূল শর্তহীন। মানুষ শর্তযুক্ত করে করে প্রণয়কে পরিণয়ে পরিণত করে।
– পরিণয় কি প্রণয়ের গন্তব্য নয়?
– না। পরিণয় হলো প্রণয়ের মৃতদেহ। প্রণয় দুর্নিবার হাওয়া- শুধু তোমার কাছে যাওয়া।
– বেশ! আমার মাঝে কি যে পেয়েছ তুমি!
– কিছুই পাইনি, আপদমস্তক তোমাকে ছাড়া।
– তারপরেও শর্তহীন প্রণয় চাও?
– চাই, ভালোবাসিবার চাই অধিকার।
– তবে ভালবাসো, শর্ত একটাই- আমি এসবে নেই।
– বেশ, তবে আমিই ভালবেসে যাই–

ছেলেটি ভালবাসে। মেয়েটি পাগলামি দেখে হাসে, বিরক্ত হয়। প্রণয়ের দিন যায় যমজ ভাবনায়- কে কাকে গ্রাস করে! কে কাকে জড়ায় আপন ছায়ায়!

ক্যান্সার

মাঝরাত। লোডশেডিং। আরেকটা নির্ঘুম রাত। শোভন সন্তর্পণে জানলা খুলে। একরাশ হিমহাওয়া ঘরে ঢুকে পরে। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। একটানা ঝিঝিম শব্দ।

সে জানালার পাশে বসে। বৃষ্টির হালকা ছাট তাকে ভিজিয়ে দেয়। সে সরে না, বসে থাকে। জীবন সুন্দর, বেঁচে থাকা মায়াময়। শোভনের জন্য এই সুন্দর মায়াময়তার বৃত্তসীমা দশ বছর। সেখান থেকে তিরানব্বই দিন খরচ হয়ে গেছে। দিন যায়, ওষুধের ডোজ, মাথার ব্যাথা বাড়ে, শুধু আয়ুবৃত্ত ছোট হয়ে আসে।

একটানা বৃষ্টি ঝরছে। দ্যুতি ছড়ানো হাসির এক কোমল মুখ মনে পড়ে- পাখিজীবনের মত সরল। সে কি জেগে আছে? কে জানে! কারো তো জেগে থাকার কথা ছিলো না, কথা নেই। বিনা কারণেই শোভনের চোখ ভিজে ওঠে।

রাত বাড়ে। বৃষ্টির শব্দ ছাড়া অন্য শব্দ নেই। কখন যেন ঘুম ভেঙে পাশে এসে বসেছে রুনা- শোভনের স্ত্রী, ঘরের মানুষ। শোভনের হাত মুঠোয় নিয়ে শক্ত করে ধরে রাখে। কারো মুখে কোনো কথা নেই।

অন্ধকার জানে দুজন মানুষ ভেসে যায় আলাদা কান্নায়- গাঢ় অশ্রুপাতের কোনো শব্দ হয়না, হতে নেই।

অগ্রযাত্রা

মা আজ জিডিপি’র গ্রোথ রেটের সাথে মাথাপিছু আয়ের ভুনা রান্না করেছেন। ফ্রিজে একটু স্যাটেলাইট ভাজি ও সাবমেরিন ভর্তা ছিলো। মা উন্নয়নের আঁচে ওসব গরম করেছেন। আহ, কি ঘ্রাণ!

ভুনা, ভাজি আর ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে খেতে মনটা চিন্তায় আচ্ছন্ন হলো। বাইরে বৃষ্টি নেমেছে, তুমুল বৃষ্টি। চিন্তা হচ্ছে পদ্মা সেতুর স্প্যানটা ঠিক সময়মত বসবে তো! প্রকৃতিও দেখি ষড়যন্ত্র শুরু করেছে।

টকশোর চাটনি দিয়ে পত্রিকার কলামের সালাদ মাখাতে মাখাতে মা বললেন, ষড়যন্ত্র কে করছে তা বোঝা যাচ্ছেনা, তবে ষড়যন্ত্র যে হচ্ছে এটা বোঝা যাচ্ছে। আম্মুর কথায় বাধা দিয়ে চাচ্চু বললেন, ভাবী মিক্সড সালাদে ক’চামচ বিটিভি প্রতিবেদন মাখাতে ভুলো না, খুব টেশ।

সালাদে বিটিভি প্রতিবেদন মাখাতে মাখাতে মা বললেন, বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহর লেক সিটি হয়ে যায়, ষড়যন্ত্রকারীরা বলে জলাবদ্ধতা। কারো জ্বর হলেই বলে ডেঙ্গু। ভাবা যায়!

বাবা শোনালেন আরও ভয়ের কথা, দেশে না কি অনেক গরীব ঢুকে পরেছে। রোহিঙ্গাদের তো তবু চেনা যায়, গরীবদের আলাদা করে চেনা যায়না। এরা এদেশের মানুষের মত, এদের বাপ-দাদারা না কি এদেশে ছিলো। এদের আলাদা করা খুব কঠিন। এরা ডায়েট করে, অথচ বদনাম রটায় যে খেতে পায়না।

চাচ্চু খুব আয়েশ করে একটুকরো উন্নয়ন চিবুতে চিবুতে বললেন, অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় আমরা ওদের নেবো না। ওরা আমেরিকাগামী ল্যাপটপ রপ্তানীর জাহাজে হাহাকার ভরে দেবে। ওরা আমাদের টেমসের পানি দূষিত করে দেবে। ওরা আমাদের লাসভেগাস গড়তে দেবেনা।

‘দেশে কোনো গরীব নেই’ মার্কা ঘড়ির নিচে দু’টো টিকটিকি বিভ্রান্ত, তারা রোহিঙ্গা না গরীব বুঝতে পারেনা, তাদের ঠাণ্ডা রক্ত আরও ঠাণ্ডা হয়ে আসে।

ভুতের আছড়

: মামা, একটা ভুতের গল্প বল।
: আমাদের বাড়ি পুরানো ঢাকায়। দোতলা পুরাণ বাড়ি। রাতে আমরা কেউ ছাদে যাই না। সন্ধ্যার পরেই ছাদের গেটে তালা দিয়ে দেয়া হয়। মাঝরাতে ছাদে কারা যেন মার্বেল খেলে, প্রতি অমাবস্যার রাতে একজন মহিলা নাঁকি সুরে বিলাপ করে কান্না করেন। ভুতরে বাড়িতে থাকলেও কখনো ভুত দেখি নাই। তবে দিনের আলোতে অনেকবার একটা পরী দেখেছি।
: মামা, তুমি পরী দেখেছো!! কোথায়?
: হ্যা, পরী দেখেছি। সেই পরীকে দেখার জন্য কতদিন হলিক্রস গার্লস কলেজের সামনে দাড়িয়ে থেকেছি।
: ধুত্তরী! মামী জানে?
: ধুত্তরী। বউকে ভুতের গল্প বলতে হয়, পরীর গল্প না। পরীর গল্প বললেই আছড় হয়।
: কি আছড় হয়?
: বউয়ের ঘাড়ে ভুতের আছড় হয়। কোনো ওঝা সেই ভুত ছাড়াতে পারেনা, বড্ড ভয়ানক ভুত। এত ভয়ানক যে…

মামী পর্দার আড়াল থেকে গল্প শুনছিলেন। নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না। গল্প শেষ হবার আগেই ঝাড়ু হাতে ঝড়ের গতিতে ঘরে প্রবেশ করলেন। স্পষ্টত: বোঝা যাচ্ছে মামীর ঘাড়ে ভুত আছড় করেছে, ভয়ানক ভুত।

প্রণয়জনিত

১.
ডিসেম্বর, ১৯৯১। কলেজে ছুটি চলছে। শীতের দুপুরগুলো খুব দ্রুত বিকেলে গড়ায়। এমন এক হবো হবো বিকেলে ল্যাণ্ড ফোন বেজে উঠলো, রিসিভার কানে দিতেই প্রিয় কণ্ঠের ফিসফিস-
: হ্যালো, নটরডেম?
: ভিকারুননিসা! এই অসময়ে তুমি!
: সবাই ঘুমোচ্ছে। কোচিং নেই। তাই ফোন দিলাম।
: তাই বলো– একদিন শীত দুপুরে আমরাও এমন ঘুমাবো আর আমাদের মেয়ে..
কথা শেষ করার আগেই ভিকারুননিসার লাজুক কণ্ঠ–
: ইশশ! শোনো নটরডেম, কাল একবার বেইলি রোডে আসবে?
: কেনো গো?
: কতদিন তোমাকে দেখিনা, প্লিজ কাল আসো। তোমাকে না দেখলে ঠিক ঠিক মরে যাবো। আসো প্লিজজজজ…
: আহা রে! কটায় আসবো?
: শার্প সাড়ে তিনটায়। আর শোনো, স্কাই ব্লু জিন্স, হোয়াইট পুলওভার গেঞ্জির সাথে ছাইরঙা ব্লেজারটা পরে আসবে। চুল ভালো করে ব্রাশ করবে– মনে থাকবে!
: মনে থাকবে। কিন্তু শেরোয়ানি পড়ে এলে ভালো হতো, তাই না!
: শখ কত!! ফাজিল একটা। চুপ।
: আচ্ছা চুপ করলাম কিন্তু।
: ঢং কত! নটরডেম, আমি কি পড়ে আসবো বলবে?
: ভিকারুননিসা, তুমি গরু রচনাটা পড়ে এসো, ইংরেজীতে দ্য কাউ।
ঢাকা কলেজের এক সিনিয়র গরু যেভাবে তোমার পিছনে লেগেছে! গরু সম্পর্কে জানা থাকা দরকার..
: হিহিহি, আচ্ছা, তাই করবো। কাল দেরী কোরোনা– এক মিনিট দেরী হলে আমি ঠিক ঠিক মরে যাবো।

২.
বিকাল তিনটা। বেইলি রোড। নটর ডেম অপেক্ষারত। ভিকারুননিসা আসে তিনটা বিশে। ফাস্টফুডশপে মুখোমুখি দুজন–
: ভিকারুননিসা, আকাশী আর শাদা কম্বিনেশনের কার্ডিগানটা বেশ সুন্দর তো! গর্জিয়াস।
: আব্বু আয়ারল্যান্ড ট্যুরের সময় এনেছিলেন। আজ প্রথম পড়লাম। সত্যি সুন্দর?
: হ্যা, সুন্দর।
: আমি কি সুন্দর নই?
: না, তুমি সুন্দর নও।

ভিকারুননিসার মন খারাপ হয়, স্বরে অভিমান এনে বলে-
: তবে কে সুন্দর?
: ‘কে’ সুন্দর জানিনা। ‘কি’ সুন্দর জানি।
: কি সুন্দর বলো নটরডেম?
: আমার বিছানাটা জানালার পাশে। রোজ সকালে একফালি রোদ তেরছাভাবে বিছানার কোনায় লুটিয়ে পড়ে। আর কিছু অংশ ফ্লোরে। সে রোদ সুন্দর।
: ওহ! আর?
: ছাদের রেলিংয়ে পিপড়ার সারি দেখেছো! সারি ছেড়ে দুই একটা পিপড়ার এলোমেলো ছোটাছোটি, তারপর দলে মিশে যাওয়া– পুরো ব্যাপারটাই সুন্দর।
: তাই? আর কি সুন্দর শুনি–
: আবার আকাশের অনেক উঁচুতে চিলের গোল হয়ে উড়া সুন্দর। কাশবনে জোতস্না, নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে গলে যাওয়া চাঁদ, তুমুল বৃষ্টিতে নীরব পথ ধরে হাটা, জোনাকীর আলো, বৃষ্টি ধোয়া সবুজ পাতায় শুঁয়াপোকার অলস চলন, গাছের ডালে ফড়িংয়ের ধ্যান, প্রজাপতির চঞ্চল নাচানাচি, মেঘের চলন, বিকালের মায়াময় ছায়া– সব সুন্দর।
: আর কিছু নেই?
: আছে, এমন কি তোমার কপালে নেমে আসা কয়েকটা অবাধ্য চুল– অবর্ণনীয় সুন্দর।
: এখানেই শেষ?
: চারদিকে সুন্দরের এত ছড়াছড়ি, ক’টার কথা আর বলবো!
: বাহ! বাহ! তোমার কাছে পিপড়া সুন্দর, চিল সুন্দর, কিলবিলে শুঁয়োপোকাও সুন্দর। আর আমি বিশ্রী?

নটরডেমের স্বরে মায়া ঝরে —
: ভিকারুননিসা, তুমি সুন্দর নও। বিশ্রীও নও।
: তবে আমি কি! আজ সত্যটা বলতেই হবে। না বললে ঠিক ঠিক মরে যাবো, হু।
: তুমি সকালের রোদ নও, রোদের উষ্ণতা। শুধু অনুভব করা যায়, ভালোলাগাটা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না।
: ইশশ! আর?
: তুমি বৃষ্টি বা নীরব পথ নও, তুমি বৃষ্টিতে নীরব পথে ভেজার অপার আনন্দ।
: আর কি কি — সব বলো..
: তুমি দলছুট পিপড়ার চঞ্চল ছোটাছুটির মত সুন্দর নও– তার আপন দলে মিশে যাবার আকুল পিছুটানের গভীরতা। তুমি অরণ্যের নির্জনতা, বেলী ফুলের ঘ্রাণের তীব্রতা, ভোরের শিউলি আভার মাদকতা।
: নটর ডেম, এভাবে আমাকে ভাবো! আমাকে খুব ভালোবাসো, তাই না!
: আমরা কেউই কাউকে ভালোবাসি না।
: আমি তোমাকে ভালোবাসি.. বাসি..বাসি।
: না, তুমিও আমাকে ভালোবাসো না।
: তবে?
: আমরা আসলে যুদ্ধ করছি, দুজন দুজনকে জয় করার। আপন করে পাবার। এ এক অন্যরকম যুদ্ধ। এ যুদ্ধে জয় নেই, হয় ড্র না হয় পরাজয়।
: নটর ডেম, আমি এই যুদ্ধে আমি হারবো না, তুমিও হেরোনা প্লিজ। তুমি হারলে আমি ঠিকঠিক মরে যাবো।
: তুমি থেমে যেওনা। যুদ্ধ শেষ হবার আগে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে নিজেকে গুটিয়ে নিওনা। মনে রেখো– সব যুদ্ধ থেমে যাওয়া মানে শান্তি নয়। কিছু কিছু যুদ্ধ থেমে যাওয়া মানে অসহ্য যন্ত্রণা আর অশান্তি।
: আমি যুদ্ধে হারবো না। জানি তুমি আমাকে হারতে দিবে না।
: কেউ হারতে চাইলে কি আর তাকে আটকে রাখা যায়!
: ধ্যাত! বাজে কথা বলোনা। ঐ গানটা একবার গুনগুন করে গাও না প্লিজ-
নটর ডেম গুনগুন করে গাইতে শুরু করে–
You fill up my senses like a night in the forest,
like the mountains in springtime, like a walk in the rain,
like a storm in the desert, like a sleepy blue ocean.
You fill up my senses, come fill me again.
Come let me love you, let me give my life to you,
let me drown in your laughter, let me die in your arms…

৩.
হঠাত সেদিন–

ফেসবুক ইনবক্স।
১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।
নটরডেম, কেমন আছো? ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট না করলেও, প্লিজ ব্লক কোরো না।

১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।
নটরডেম, কথা বলো প্লিজ। তুমি এখনো রেগে আছো?

১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।
নটর ডেম, প্রতিটা ম্যাসেজ সিন হচ্ছে। মানে তুমি পড়ছো। ঠিক করেছো উত্তর দিবেনা!!

২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।
শোনো নটর ডেম, এ মাসের লাস্ট উইকে দেশে ফিরছি। অক্টোবরের চার তারিখে বিকাল চারটা থেকে সাতটা পর্যন্ত বেইলি রোডের সুইসে অপেক্ষা করবো। জানি তুমি আসবেনা, তবুও অপেক্ষা করবো। যদি হঠাত তোমার ইচ্ছা হয়, যদি আসো।

২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।
নটরডেম, তোমার কন্টাক্ট নাম্বারটা দিবে! আমার সেল নাম্বার ০১৭৫*******। ৪তারিখের কথা ভুলে যেওনা প্লিজ।

০৩ অক্টোবর, ২০১৬
কাল বিকেল চারটায় সুইসে থাকবো। আমার কন্টাক্ট নাম্বার আবার দিলাম ০১৭৫*******।
প্লিজ, এসো, ৭টা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো।

৪.
৪অক্টোবর, মধ্যরাত, ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার।
: নটর ডেম, শেষ পর্যন্ত এলেই না। অথচ একদিন এক পলক দেখার জন্য কত ছটফটানি ছিলো।
: কে বললো আসিনি!
: এসেছিলে?? সত্যি!
: হুম। জামদানি শাড়িতে তোমাকে বেশ সুন্দর লাগছিলো। তোমার বয়স ততটা বাড়েনি।
: ক’টা পর্যন্ত ছিলে?
: তুমি আমার সামনে দিয়েই সাড়ে সাতটায় মুখ কালো করে চলে গেলে। আমি আরো আধঘণ্টা ছিলাম।
: দেখা করলে না কেনো?
: তুমি দেখা করার কথা বলোনি, শুধু আসতে বলেছিলে।
: ধ্যাত! এটা কি আলাদা করে বলতে হবে?
: অবশ্য বললেও দেখা করতাম না।
: কেনো? জানতে পারি?
: না, পারো না।
: ও। আচ্ছা। এতোটা কাছে– তবু দেখা না করে থাকতে পারলে?
: হাহাহাহাহা
: কান্না পাচ্ছে। তুমি হাসছো কেনো– এটা জানতে চাইতে পারি?
: হ্যা পারো-
: বলো।
: মাত্র তিন বছর না যেতেই তুমি খুঁজে পেলে রাজপুত্র। হঠাত করে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলে। কোনো কিছু জানাওনি। একবার দেখা করে বললে আমি তোমাকে আটকাতাম না। তীব্র কষ্ট পেতাম, সে কষ্ট আড়াল করে হাসিমুখে মেনে নিতাম।
: সর‍্যি, এক্সট্রিমলি সর‍্যি..
: ফোনেও কোনো কথা বলোনি, আমার স্বর শুনলেই লাইন কেটে দিয়েছো। এক একটা দীর্ঘ দিন আর দীর্ঘতম রাত কেটে গেছে শুধু এটুকু আশা করে যে তুমি একবার ফোন দিবে, একবার অন্তত বলবে তুমি আর আমার নও। একবার শুধু তোমার গলার স্বর শুনবার ছছটফটানি। সেই তুমি দুই যুগ পরে জিজ্ঞেস করছো ‘দেখা না করে থাকতে পারলাম!!’ হাহাহাহা, কোয়াইট ফানি!
: সর‍্যি, নটরডেম। এভাবে বলো না।
আমি ঠিক ঠিক মরে যাবো।
: ‘সর‍্যি’ হবার মত কিছু আর আজ অবশিষ্ট নেই। তুমিময় একটা ডাইরি ছিলো, সেটা তো দু’বছর আগেই ফিরিয়ে দিয়েছি।
: তুমি এখনো রাগ পুষে আছো?
: নাহ! মনসুখিয়ার যাত্রীকে রাগ পুষে রাখতে নেই। রাগ পুষে রাখলে অভ্রজোনাক পথ ভুলিয়ে দেয়, দূরে সরে সরে যায়।
মনসুখিয়ায় অভ্রজোনাকের কাছে পৌছতেই হবে– এ আমার একার যুদ্ধ।
: মনসুখিয়া কোথায়– জানতে চাইতে পারি?
: হ্যা পারো।
: মনসুখিয়া কোথায়?
: বলতে ইচ্ছে করছেনা।
: ওহ! অভ্রজোনাক কে?
: বলবো না।
: অভ্রজোনাক কি আমি?
: নো, নেভার। তুমি এখন যে কোনো একটা নাম– এর বেশী কিছু নও।
: তবু একবার, শুধু একবার তোমার সাথে দেখা করতে চাই। উত্তর দাও প্লিজ..
: আমি আর কোনো উত্তর দিবোনা। গুড বাই। ভালো থেকো। আর সাবধান– ডানহাতের বুড়ো আঙুলে ব্যাথা পাওয়া কাজের কথা নয়।
: এই ব্যান্ডেজও খেয়াল করেছো?

নটরডেম আর কোনো উত্তর দেয়না। রাত গভীর হয়, হাভানা সিগারের গাঢ় ধোয়া পাক খেয়ে খেয়ে হাওয়ায় মিলায়।

৫.
মনসুখিয়ায় যাবার পথ নটর ডেমের চেনা নেই, অভ্রজোনাকের মনের ঠিকানাও অজানা। দিনের শেষে রাত আসে, ফের দিন। একদিন রাতশেষে দিন আর আসবেনা— ইশ! তার আগেই যদি যাওয়া যেত মনসুখিয়ায়–হীরকফুলের আলোয় আলোয়, অভ্রজোনাকের কাছে অভ্রজোনাকের পাশে।

মনসুখিয়ায় যাবার আগেই যদি ফুরোয় দিন; ওগো রাতের হাওয়া, নটরডেমের হয়ে অভ্রজোনাকের কানেকানে বলে দিও–
Hell is living without your love
Ain’t nothing without your
Touch me
Heaven would be like hell
Is living without you…

.
__________
#মনসুখিয়া/২৬

অকবিতা ২

রাতের বয়স বাড়ার সাথে সাথে শাদা হতে থাকে চাঁদ, আজও হবে। সিগারেটের ধোয়া গন্ধ ছড়িয়ে মিশে যাবে হাওয়ায়। গাছের পাতায় পাতায় জোছনা, গাছের নিচে নিবিড় অন্ধকার। পাতা ফুড়ে জোছনা নামেনি সেখানে। জোছনার বিদ্ধ করার ক্ষমতা নেই, তবু কি এক আশ্চর্য কৌশলে এফোঁড় ওফোঁড় করে গেছে আমায়।

জোছনায় মগ্ন রাত, অথচ আজ চাঁদই ওঠেনি। আজ সকাল হতেই আষাঢ় বৃষ্টি বিরতিহীন। কদম গাছের শাখায় শাখায় হলুদাভ নক্ষত্রের বিলাসী স্নান।

আকাশ ভরা মেঘ, বৃষ্টি ঝরছে অবিরাম। পানি চুয়ে চুয়ে ঢুকছে কবরে, ভিজে যাচ্ছে আমার কাফন।

টান

মোয়াজ্জেন মোহম্মদ তোবারক হোসেন কখনও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন নাই। বাইশ বছর যাবত লাশ গোছল করান। গোছল শেষে যত্ন করে কাফন পরিয়ে দেন। অনাবৃত চেহারায় কর্পূর লোবান ছড়িয়ে চোখে সুরমা পরিয়ে দেন।

মোতালেব মিঞা স্ট্রোকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েছিলেন। অচল অবস্থায় দশ বছর শয্যাশায়ী ছিলেন। ভোরে মারা গেছেন। মোয়াজ্জেন তোবারক হোসেন লাশকে গোছল করানোর জন্য ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেন। শরীরে পানি ঢালতেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত মোতালেব মিঞা জড়ানো স্বরে বিরবির করে উঠলেন-
: তোবারক রে, কব্বরে যাইতে ইচ্ছা করেনা।
নিজেকে সামলে নিয়ে তোবারক একবার সূরা ইয়াসিন আর তিনবার সূরা নাস পাঠ করে। বুকে সাহস ফিরে আসে-
: কাকা, কব্বরে না গেলে যাইবেন কই?
: ফ্রিজে ভইরা রাখতে ক। দুনিয়াটা বড় টানে রে..।
: কাকা, আপনেরে কিন্তু কব্বরে যাইতে হইবোই।
: ক্যান?
: আপনে তো মইরা গেছেন, কব্বর ছাড়া গতি নাই।
মোতালেব মিঞা হিমশীতল হাসি দিয়ে হিসহিসিয়ে ওঠেন–
: তোবারক, তুই বাইচ্চা আছোস! তোরা বাইচ্চা আছোস!

মোয়াজ্জন তোবারক হোসেন উত্তর খুঁজে পান না। লাশের গায়ে পানি ঢালার সাহসও হয়না। সময় বয়ে যায় জোহরের দিকে।

উইশ

১.
মাঝরাত হতে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে কমে আসছে, কিন্তু থামছে না। অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে। বৃষ্টির তালের সাথে আজানের সুর মিশে এক মোহনীয় সিম্ফনি ভেসে আসছে- খায়রুন মিনান নাউম… খায়রুন মিনান নাউম…।

আড়মোড়া ভেঙ্গে বারান্দায় যাই। সারারাত আন্ধকার দূর করা ক্লান্ত বাতিটাকে নিভিয়ে গ্রীলের পাশে দাঁড়াই। একটা সিগারেট ধরাতেই কথা বলে ওঠে খাঁচায় পোষা ঘুঘু দম্পতির বউটি-
: সক্কাল সক্কাল সিগারেট! খুব খারাপ। খুউউব খারাপ।

বউটির কথার প্রতিবাদ করে স্বামী ঘুঘুটি বলে, ‘খাক না একটা সিগারেট। হয়তো টেনশনে আছে, দেখলে না সারারাত ঘুমোয়নি।

কথা শেষ হতে না হতে ঘুঘুবউটি চোখ পাকিয়ে এমনভাবে স্বামীর দিকে তাকালো যে বেচারা করুণ সুরে ডাকতে লাগলো। আমি হেসে উঠতেই ঘুঘুবউ ধমক লাগালো-
: হাসছো যে খুব! এখখনি সিগারেট ফেলো। আজ বারান্দায় কোনো সিগারেট খাওয়া চলবে না। ইট ইজ এন অর্ডার, পুরো ৫৭ ধারা।

মেঘের নরম ভোরে তর্কে যেতে ইচ্ছে করলো না। সিগারেটটি প্যাকেটে ভরে ঘুঘুবউকে জিজ্ঞেস করলাম-
: বারান্দায় ৫৭ধারা জারী হলো কবে?
: আজ, এবং এখন।
: বাহ! জারী করলেন কে?
: কে আবার জারী করবে! আমিই করেছি।
: মহামান্য আদালত, কতদিনের জন্য বারান্দায় ৫৭ ধারা জারী থাকবে?
: ২৪ঘণ্টার জন্য।
: মাত্র ২৪ ঘণ্টার জন্য! কেনো?
: কারণ, আজ আমাদের বাবুর প্রথম জন্মদিন। ওর জন্মের দিনে বারান্দায় কাউকে বাজে কাজ করতে দিবো না।

দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললাম-
: বেশ! আজ বারান্দায় কোনো বাজে কাজ হবেনা। যাই, একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি।

২.
বারান্দা হতে ঘরে ফিরি। খুব সাবধানে শব্দ না করে দরজা খুলি। সিড়ি ভেঙে একতলার চিলেকোঠায় দাঁড়াই। এলোমেলোভাবে কাকের কা কা শব্দ ভেসে আসছে। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে সিগারেট ধরিয়ে টান দিতেই টিকটিক করে ওঠে এক টিকটিকি-
: ধুত্তোরি! সারা রাত সিগারেট খেয়েছো, আবার ভোরেও শুরু করেছো?
: হুম, আজ বড়ো সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে। তৃষ্ণা মিটছে না।
: মানুষ! তোমার যে কি হয় এক একটা দিন! কিসের কিসের যে তৃষ্ণা পায়! সিগারেটের তৃষ্ণা, চায়ের তৃষ্ণা, গানের তৃষ্ণা, স্মৃতির তৃষ্ণা, শিমুল তুলো ওড়ানোর তৃষ্ণা, তারা গোনার তৃষ্ণা, গজলের তৃষ্ণা, কবিতার তৃষ্ণা, অভ্রবকুলের তৃষ্ণা, হারালো যে জন অন্ধকা….

কথা শেষ হবার আগেই ওকে থামিয়ে দিয়ে বলি-
: সব মুখস্থ করে রেখেছো দেখছি! আর কোনো কাজ নেই তোমার!
: দেখে দেখে মুখস্থ হয়ে গেছে।
: বাহ! বাহ। তুমি দেখি এক্কেবারে জিপিএ ফাইভ।
: জিপিএ ফাইভ না ছাই! তবে আজ বেশ কষ্ট পেয়েছি। তাই বারান্দা থেকে তোমার পিছুপিছু এলাম।

নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলাম-
: কে তোমাকে কষ্ট দিলো টিকটিমনি!
: কে আবার দিবে! তুমিই দিয়েছো, মানুষ।
: কখন কষ্ট দিলাম!
: ঘুঘুবউটি বললো আজ তাদের বাবুর জন্মদিন, আর তুমি একটু উইশও করলে না! আমার ভীষণ কষ্ট লেগেছে। মানুষ, তুমি এমন কেনো!
: এজন্য এতো কষ্ট!
: হু
: কিন্তু এ কষ্ট যে অর্থহীন।
: অর্থহীন! কেনো বলো তো!
: শোনো টিকটিমনি, উইশের ফিতায় কি মাপা যায় জন্মের পরিধি!
: কি যে বলো! কিছুই বুঝিনা।
: কিছু বোঝার দরকার নেই। মনে রেখো প্রতিটা দিনই জন্মদিন। প্রতিটা দিনই নতুন করে জন্মায় তার আগের দিনের স্মৃতি ও বিস্মৃতি নিয়ে, সাথে সাথে আমরাও জন্মাই প্রতিদিন। তবে এমন একটা দিন আসে, আমরা আর জেগে উঠিনা, সেখানে জম্মের শেষ।

টিকটিমনি একটা লম্বা হাই তুলে বললো-
: তাই না কি, মানুষ! তোমার কথা শুনে ঘুম পাচ্ছে।

টিকটিকির কথার উত্তর দেইনা। নিজের অজান্তেই দীর্ঘতম কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে, ছড়িয়ে পরে ভেজা হাওয়ায়। তুমুল বৃষ্টির একটানা শব্দকে কাঁপিয়ে তারস্বরে শিস দিয়ে যাচ্ছে দুটো দোয়েল, কে জানে এই সকালে কোন কারণে এমনতর কান্না!

৩.
আজ বৃষ্টি আর থামবে না। অপাকস্থালীর জীবন আকুতি জানায়- ‘আজ নিজের ভেতরে সাঁতার কাটো, তালদুপুরে মনপুকুরে দাও ডুব।’ কিন্তু খেঁকিয়ে ওঠে পাকস্থলীর জীবন, ‘সকাল সকালই আকাজের উস্কানি দিচ্ছো যে! কাজ না করলে খাবে কি! পেটে ক্ষিধে থাকলে তখন দেখা যাবে কোথায় থাকে তালদুপুর আর খালপুকুর, হু।’ যে জীবন পাকস্থলীর সে জীবন বোঝেনা পাখির ভাষা, পতঙ্গের আহ্লাদ, বৃষ্টির রোদন। সে জীবন জানে শুধু কামলার ব্যকরণে দীর্ঘশ্বাস গোপনের সকল কৌশল।

রাস্তায় জমে আছে ছিপছিপে পানি। হাটতে হাটতে রাস্তার মোড়ে যাই। সব রিকশা এখনো বের হয়নি, তাদেরও হয়তো উস্কানি দিয়েছে অপাকস্থলীর জীবন। স্বল্প পরিচিত এক রিকশাওয়ালা এগিয়ে আসেন-
: ভাই, ওঠেন।
: কোথায় যাবো জানেন?
: হ, জানি।

রিকশায় উঠে বসি। বৃষ্টির বেগ আবার বেড়েছে। তিনি প্লাস্টিকের পর্দাটা ভালো করে খুলে দেন, হুডেও গুজে দেন কিছু অংশ। রিকশা চালাতে শুরু করেন। রিকশা চলছে, পথে পথে অলস সকালের ঘুম ভাঙছে, পাকস্থলীর টানে ছুটেছে কামলা কামলাগিরির জেলে। রিকশাওয়ালা নীরবতা ভেঙে জানতে চান-
: এমুন আকাইল্যা বাদলা দেখছেন!
: এখন সব কালই আকাল। এই যে অপনি রিকশা চালাইতাছেন, আমি অফিসে যাইতাছি তার কারণও আকাল।
: কন কি ভাই! আকাল হইবো ক্যান!
: অকাল না হইলে তো ঘরে বইসা গপসপ করতাম, পেঁয়াজ কাঁচামরিচ আর চাইল ভাজা সরষা ত্যালে মাখায়া কুচুরমুচুর কইরা খাইতাম। দুপুরে বেগুন ভাজা, ইলশা ভাজা, মিষ্টি কুমড়া দিয়া গোশতের ঝাল তরকারি মাখায়া খিচুরী খাইতাম। আকাল বইলাই এই বাদলার মধ্যে আপনে প্যাডেল মারেন আর আমি কলম মারতে যাইতাছি।

রিকশাওয়ালা হেসে ওঠেন। তারপর বলেন-
: আইজ মাসের ২১তারিক, বাড়ির ভাড়া দিতে দেরী হইছে। জ্বরের লেগা ৭দিন গাড়ি চালাই নাই। আইজ ভাড়া না দিলে বাড়িওয়ালা পিডাইবো কইছে হাহাহাহাহাহাহা…. আকাইল্যাই তো..

মাথার ভিতর ঘুরতে থাকে আজ ২১তারিখ… আজ ২১মে… আজ ২১মে… আজ ২১মে। মাত্র চারটা ২১মে, ছোটো ছোটো কত যে স্মৃতি, আহ ২১শে মে…।

৪.
তুমুল রোদের দিন ছিলো সেদিন। বেইলি রোডের ফাস্টফুড শপে কলেজ ফাঁকি দিয়ে মুখোমুখি দুজন। ভিকারুন্নেসা আহ্লাদি গলায় বলে ওঠে-
: নটরডেম, আজ আমার জন্মদিন। খুব সুন্দর একটা উইশ করো, তা না হলে ঠিক ঠিক মরে যাবো।
: একটা উইশ না পেয়ে জন্মদিনের দিন ঠিক ঠিক মরে যাওয়া কাজের কথা না।
: এহহহ! অবশ্যই কাজের কথা। তোমার সুন্দর উইশ না পেলে ঠিক ঠিক মরে যাবো, তখন দেখো, হু।

ভিকারুন্নেসার মুখে মেঘ জমতে শুরু করে। বাইরে ঝাঝালো রোদ। নটরডেম কাঁপা হাতে ভিকারুন্নেসার কপালে নেমে আসা অবাধ্য এক গোছা চুল কানের পাশে সরিয়ে দিয়ে বলে-
: শুভ জন্মদিন, প্রিয় ভিকারুন্নেসা। মানুষ হয়ে ওঠো প্রতিদিন।

তীব্র অভিমান ভিকারুন্নেসার কণ্ঠে-
: আমি মানুষ নই! তোমার সাথে আজ আমার প্রথম জন্মদিন, আর তুমি এভাবে বলতে পারলে! নটরডেম, তুমি এভাবে
বললে!

ভিকারুন্নেসার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে, নটরডেমের বুকে কেনো যে ব্যাথা লাগে! ব্যাথা চেপে সে বলে-
: ভিকারুন্নেসা, উইশে ‘মানুষ হয়ে ওঠো’ থেকে গভীর কিছু আর খুঁজে পাই না যে। এর থেকে দামী উইশ কি আছে!
: এটা দামী উইশ!
: অবশ্যই দামী উইশ। কেনো অমূল্য তা কি শুনতে চাও?
: হ্যা, চাই। শোনার পরে যদি দামী মনে না হবে তবে কিন্তু ঠিকঠিক মরে যাবো, জেনে রাখো, নটর ডেম।

নটর ডেম বলতে শুরু করে-
: প্রতিজন মানুষ জন্মায় মানুষ হয়ে। তারপর একদিন মানুষ হতে না পেরে মরে যায়।
: যাহ! মানুষ তো মানুষ হয়েই মরে।
: না, ভিকারুন্নেসা। প্রতিজন মৃত মানুষই আসলে মানুষ হতে না পারা একজন মানুষ।
: কি যে বলো না, নটরডেম!
: জন্মানোর পরে মানুষকে মানুষ করে তুলতে শুরু করে পরিবার। তাকে শুধু মানুষ হলেই চলবেনা- তাকে হতে হবে সভ্য মানুষ, সফল মানুষ, শিক্ষিত মানুষ।
: তা তো হতে হবেই।
: ভিকারুন্নেসা, সেখানেই তো সমস্যা, মানুষের আর মানুষ হয়ে ওঠা হয়না।
: ধ্যাত! এর অর্থ কি!
: জন্মানোর পরেই বাবা-মা মানুষ করে তোলার অভিযানে নামেন। এই অভিযানে যোগ দেন আত্মীয়স্বজন আর পাড়া প্রতিবেশী। স্কুল-কলেজের স্যাররাও নামেন মানুষ গড়ার কাজে, তারা সেই মানুষ গড়ে তুলতে চান যে মানুষ তারা হতে চেয়েছিলেন কিন্তু হতে পারেননি। কবি সাহিত্যিক ডাক্তার মোক্তার সবাই মানুষকে মানুষ বানাতে চায়। নিজের নিজের ছায়ার মাপের মানুষ, নিজের নিজের এইম ইন লাইফের মানুষ, নিজের নিজের বৃত্তভাঙার মানুষ।
: একটু থামো, নটরডেম। দম নাও। কিছুটা বুঝতে পারছি।
: গুড। তারপর কি হয় বুঝতে পারছো!
: কি হয়!
: অন্যদের মাপে মানুষ হতে হতে একটা সময় মানুষ নিজের মুখোমুখি দাঁড়ায়। সে বুঝতে পারে যে মানুষটি সে হতে হয়েছিলো সে মানুষটি সে হতে পারেনি। তার দিন কেটে গেছে অকারণ অর্থহীন এক মানুষ হবার মোহে। তার আর মানুষ হয়ে ওঠা হয় না, বেলা ফুরোয়, খেলা ফুরোয়, মানুষ হতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে জীবনও ফুরোয়।

গভীর বিস্ময় নিয়ে নটরডেমের দিকে তাকিয়ে থাকে ভিকারুন্নেসা। টেবিলের উপরে রাখা হাতটা শক্ত করে ধরে জানতে চায়-
: আমি কেমন মানুষ হবো- বলে দাও।
: ভিকারুন্নেসা, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পৌছানোর যাত্রাটাই হলো মানুষ হবার জার্নি। প্রতিদিন নিজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন কোরো ‘কতটা মানুষ হবার পথে এগোলাম, কতটা পিছিয়ে পরলাম।’ প্রতিদিন একটু একটু মানুষ হয়ে ওঠো, নিজের মত মানুষ, যে মানুষটি তুমি হতে চাও অবিকল সে মানুষ।
: থ্যাংক ইউ নটর ডেম।

কিছুটা বিরতি দিয়ে ভিকারুন্নেসা আবেগঘণ স্বরে বলে-
: যতই মানুষ হয়ে উঠি না কেনো! তোমাকে না পেলে ঠিকঠিক মরে যাবো, হু।
: কথায় কথায় মরতে হবেনা, মনে রেখো– জীবন অনেক বড়। এক একটা জীবন জীবন থেকেও বড়, দীর্ঘতর আর দীর্ঘতম।
: এতোকিছু জানিনা নটরডেম। মানুষ হবার জার্নিতে যেনো কখনোই তোমাকে না হারাই।

হাসতে হাসতে নটর ডেম বলে-
: ভিকারুন্নেসা, এই একটা মাত্র জীবনে তুমি আমার বামপাশে থেকো, হারিয়ে যেওনা।

পৃথিবীতে আর কোনো শব্দ নেই, দুজন মুখোমুখি বসে থাকে, দুজনের চোখ মিনতি করে যায়- হারিয়ে যেওনা… হারিয়ে যেওনা… হারিয়ে যেওনা…

৫.
বৃষ্টির আজ কি যে হলো! বৃষ্টি বাড়ছে তো বাড়ছেই। ভাবনা হয়- বৃষ্টির ছাটে কি ভিজে যাচ্ছে ঘুঘুদম্পতির খাঁচা! ভিজুক, আজ তাদের কষ্টের দিন। ঠিক আজকের দিনেই ডিমফুটে বের হওয়া তাদের প্রথম বাবুকে পিপড়ার দল কামড়ে কামড়ে মেরে ফেলেছিলো। তার আর ঘুঘু হয়ে ওঠা হয়নি। মানুষ হবার জার্নিতে আজ কতটা এগিয়েছে ভিকারুন্নেসা জানা নেই, সে থাকেনি বামপাশে।

রিকশা ছুটেছে তাই ছপছপ শব্দ হচ্ছে পথে, কামলা ছুটেছে রিকশার পিঠে চেপে। জানি, এ রিকশা মনসুখিয়ায় যাবেনা, সে চিনেনা মনসুখিয়ার পথ। হঠাৎ, বাতাসে কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণ ভেসে আসে, তাকে ফিসফিসিয়ে বলি, ‘প্রতিদিন মনসুখিয়ার দিকে ছুটে চলেছি আমি। অভ্রবকুল নিবে তো আমায়! আমার যে আর কোথায় যাওয়ার নেই!’ কোনো উত্তর পাইনা, শুধু কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণ তীব্রতর হয়ে ওঠে, বাতাসে বিষাদ ছড়িয়ে একটা দোয়েল মাথার ভিতরে গেয়ে চলে-
‘চল মন মনসুখিয়ার কাছে
তার গভীরে জোছনা রঙা রৌদ্রনদী আছে…’

_______________________
গ্রন্থঃ মনসুখিয়া/আবু সাঈদ আহমেদ।

মদাঞ্জলী

মদাঞ্জলী

১.
বহুবছর পর বালক বারে ফিরেছে। একটা সময় এই বার ছিলো প্রতি দিনের গন্তব্য। কতশত বিবর্ণ বিকেল ডান কোনার টেবিলে নিদ্রাহীন রাতের কাছে খুন হয়েছে। গ্লাসের বাইরে জমে থাকা ঘামের প্রতি বিন্দুর একাকীত্ব গুনে গুনে কেটেছে সময়। চুমুকে চুমুকে জেগেছে বিষাদের ঘোর।

সব দরজা বন্ধ হয়। বারের দরজাও বন্ধ হত। শহরে মধ্যরাতের নির্জনতা ভেঙে রিকশায় ঘুরতে ঘুরতে বাড়ি ফেরা। সোডিয়াম আলোয় বিষণ্ন সড়ক। মাথার ভিতরে গানের আসর। নিস্পৃহ বুকের ভিতরে ডি এল রায় গুনগুনাতেন “মনরে কৃষি কাজ জানোনা/এমন মানব জমিন রইলো পতিত আবাদ করলে ফলতো সোনা..।” সবাই কি আর সোনা হয়! আবাদ করেও কেউ কেউ পতিত জমিই রয়ে যায়।

২.
বালক বারে ঢুকে কাউন্টারে দাঁড়ায়। আধো আলো আধো অন্ধকারে ম্যানেজার বিষ্ময়পূর্ণ হাসি দিয়ে উচ্ছসিত–
: আরে এতো বছর পরে তুই! এতোদিন কোথায় ছিলি?
: রুবেল ভাই, কোথাও ছিলাম না।
: হাহাহা, আবার হেঁয়ালিভরা কথা বলছিস! কত বছর পরে এলি বলতো?
: এগারো বছর হবে। ভাই, আমি কি কর্নার টেবিলে বসতে পারবো!
: কর্নার টেবিলের মায়া এখনো ছাড়তে পারিসনি! টানা তিন বছর প্রতিটা দিন ঐ টেবিলে বসেছিস। সবার জানা হয়ে গিয়েছিলো– কেউ বসতো না।
: আজ বসা যাবে?
: গেস্ট আছে। একটু ওয়েট কর। ব্যবস্থা করছি। (তিনি পাশে বসা ক্যাশিয়ারকে ইশারা দিলেন)। এত দিন পরে কি মনে করে এলি?
: বলতে ইচ্ছে করছেনা। তোমার কাছে সিগারেট আছে!
: সিগারেট ধরলি কবে? হাতে নিয়ে বসতে দেখেছি, কখনো তো টানতে দেখিনি।
: ধরি নাই। আজ প্রবল তৃষ্ণা পাচ্ছে। ধোঁয়ার তৃষ্ণা, পানির তৃষ্ণা।
: কোনো কারণে মন খারাপ! চাপে আছিস! কষ্ট ভুলতে চাইছিস!
: মদ খেয়ে কষ্ট ভুলে কোন পাগলে!! বরঞ্চ কষ্ট আর যন্ত্রণা উপভোগ করা যায়।
: কষ্ট আর যন্ত্রণা উপভোগের জিনিস!! আর ইউ ক্রেজি!
: পুরো জীবনটাই উপভোগ্য। তীব্র কষ্ট, অসহ্য যন্ত্রণা, গভীর বিষাদও জীবনের অংশ। তারাও উপভোগ্য, তীব্রতরভাবে তাদের উপভোগ করতে হয়।
: তোর সাথে কথা বললে মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। এই এগারো বছরে কি একটুও ড্রিংক করিস নাই!
: করেছি, খুব বেশী হলে সাত আটবার– কখনোই পাঁচ পেগের বেশী নয়।
: বলিস কি! এত কম! তোর লিমিট তো নয় পেগ।
: হাহাহাহাহা তোমার মনে আছে!
: হ্যা, ভুলা যায়! তুই তো ভোলার মত ক্যারেক্টার না।
: হাহাহাহা, মানুষ দিব্যি ভুলে যায়, ভুলে গেছে, ভুলে আছে।
: না রে, মানতে পারলাম না। তোকে এড়িয়ে চলা সহজ, ভোলা অসম্ভব।
: তাই! কেনো?
: যারা এড়িয়ে চলে তারাও বোঝে তুই তাদের কতটা ভালবাসিস। কতটা মায়া করিস।
: হাহাহাহা, যতই ভাবের কথা বলো আজ থেকে আমার লিমিট হলো বারো পেগ এবস্যুলেট ভদকা আর বারোটা বেনসন রেগুলার।
: হাহাহাহা আচ্ছা। প্রসঙ্গ ঘোরানোর অভ্যসটা আগের মতই আছে। আজ প্রথম তিন পেগ তোকে গিফট করলাম।

বালক বিষ্ময় গোপন করে। এতো ভালোবাসা, এতো স্নেহ জমা হয়ে আছে! ওহ মাই আঈভ (আল্লাহ ঈশ্বর ভগবান)!

৩.
কর্নার টেবিল। আলো আলো অন্ধকার। খয়েরি কাঁচের বিশাল দেয়াল। এখান থেকে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা আর সন্ধ্যভুক রাত্রি দেখা খুব প্রিয়। বাইরে ব্যস্ত সড়ক। ট্রাফিক সিগন্যালে থেমে যাচ্ছে গাড়ির সারি। আবার চলছে। সন্ধ্যায় জ্বলে উঠবে হেড লাইট– আলোর মালা।

বিয়ারের বড় গ্লাস। অর্ধেক বরফের মিহি কুঁচিতে ভরা। বাকী অর্ধেকে ভদকা আর টমেটুজুসের মিশ্রণ ঢেলে নেড়ে নেয় বালক। গ্লাসের গায়ে ঘাম জমে। ঘামের প্রতিবিন্দুতে আপন প্রতিবিম্ব। অস্পষ্ট। প্রতিটা প্রতিবিম্বই কি ভীষণ একা! নিঃসঙ্গ! গ্লাসের গা বেয়ে নামতে নামতে রিনরিনিয়ে ওঠে-
: কর্নার টেবিলে আবার ফিরে এলে?
: কর্নার টেবিলে ফিরিনি তো। নিজের কাছে ফিরেছি।
: এ কেমন ফেরা?
: একজন মানুষ অসংখ্যবার অসংখ্যভাবে নিজের কাছে ফেরে। সরল ফেরা।
: কি জানি! এত জটিল কথা বুঝতে পারিনা। তোমার ছাদে এখনো শালিখের দল দুপুরে ভাতদানা খেতে আসে?
: আসে। হররোজ আসে।
: খোঁড়া শালিখটা আসে?
: না, বহুবছর হলো আসেনা।
: আহা রে, কোথায় চলে গেছে কে জানে!
: হয়তো মানুষের মত সেও ফিরে গেছে নিজের কাছে।
: কি জানি! তুমিও আবার চলে যাবে। আর কখনোই ফিরবেনা। কতদিন তোমার পথ চেয়ে ছিলাম।
: স্ট্রেঞ্জ!! আমার পথ চেয়ে ছিলে!
: বা রে! তিন বছর প্রতিটা দিন এসেছো। কতদিন পুরো বারে তুমি একা। আমি নীরবে দেখে গেছি। হঠাত আসা বন্ধ করে দিলে– পথ চেয়ে থাকবো না?
: আমরা সবসময় ভুল জনের জন্য পথ চেয়ে থাকি; আত্না দিয়ে ভুল জনকে ভালোবাসি। তাই বলে তুমিও!
: সে সব কথা থাক! এবার যাবার আগে বলে যেও।
: তোমাকেই বলে যাবো ‘যাই, গ্লাসের প্রিয় ঘাম’ ..হাহাহাহা। খুশি?
: হুম। তোমার প্রিয় একটা কবিতা শুনবে?
: প্রিয় কবিতাও মনে রেখেছো!! শোনাও তবে–
: যে নক্ষত্র দেখ নাই কোনোদিন, দাঁড়ায়েছি আজ তার তলে!
সারাদিন হাঁটিয়াছি আমি পায়ে পায়ে
বালকের মতো এক — তারপর, গিয়েছি হারায়ে
সমুদ্রের জলে,
নক্ষত্রের তলে!
রাত্রে, অন্ধকারে!
তোমার পায়ের শব্দ শুনিব না তবু আজ — জানি আমি,
আজ তবু আসিবে না খুঁজিতে আমারে!

৪.
চুমুকে চুমুকে গ্লাস শেষ হয়ে আসে। নতুন গ্লাস ভরে ওঠে। সিগারেটের ধোঁয়া আলো আঁধারে মিশে যায়। গ্লাসের মিহি বরফকুচি গলে যেতে যেতে ফিসফিসিয়ে বলে–
: মানুষ, তোমার কি হয়েছে?
: জানিনা, সত্যিই জানিনা।
: ইচ্ছে করে সবাই মিলে তোমাকে একদিন মাতাল বানিয়ে দেই। চিৎকার করে মনখুলে সব বলো। চারদিক লণ্ডভণ্ড করে দাও। ক্লান্ত হয়ে বাচ্চাদের মত হুহু করে কাঁদো। তারপরে বেঘোরে ঘুমোও। শান্তির ঘুম– লাশের মত।
: প্লিজ, মাতাল বানিয়ে দাও। মনসুখিয়ার কাছে যাবার আগে একবার মাতাল হতে চাই। আপদমস্তক মাতাল।
: তোমাকে মাতাল বানাবার সাধ্য কারো নেই। তুমি রক্তে মাংসে আত্নায় মনসুখিয়ায় মাতাল হয়ে আছো। মনসুখিয়ার ডাক শোনার জন্য কান পেতে আছো।
: আলো আধারির দোহাই– শুধু একবার মাতাল করে দাও। একবার ঘুমোতে দাও মৃত্যুর মত গাঢ় আর প্রত্যাখ্যানের মত গভীর ঘুমে।
: সম্ভব নয়। তীব্র কষ্টে মাতাল হতে চাইছো মনসুখিয়ায় পৌছানোর পথ পাচ্ছোনা বলে.. অভ্রজোনাক তোমায় ডাকছেনা বলে। একবার ডাকলে সব ছেড়ে সবাইকে ছেড়ে ছুটে যাবে মনসুখিয়ায়, অভ্রজোনাকের কাছে।
: হবে হয়তো! অথচ দিনশেষে এ জীবন অর্থহীন আর মৃত্যুরও কোনো অজুহাত নেই, তাই না!
: হুম। গন্তব্যের পথ চেনো না। এদিকে ঘরের ঠিকানাও হারিয়ে ফেলেছো। সবাইকে কোথাও না কোথাও যেতে হয়– তুমি যে কোথায় যাবে?

উত্তর খুঁজে পাইনা। পুড়ে যেতে যেতে সিগারেটের ধোঁয়া খলবলায়-
: নিজের ভিতরে গুমরে গুমরে মরাই তোমার নিয়তি। তোমার ভবিতব্য। গোপন কান্নাই অমোঘ নিদান।

৫.
হঠাত কোথা হতে বহু বছর আগের দুপুরবেলার খোঁড়া শালিকটা উড়ে আসে। আলো আধারির কর্নার টেবিলে বসে। মুখোমুখি। তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক। বালকের খোঁড়ামনে দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর হয়ে পাক খায়। কোনো কারণ ছাড়াই চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে। কি আশ্চর্য! শালিখও কাঁদছে না কি? আহা রে!

_______________________
গ্রন্থঃ মনসুখিয়া/আবু সাঈদ আহমেদ।

পুনরুজ্জীবন

গনগনে রোদের দুপুর। হাওয়া নেই। আজিজ মাস্টার নৌকা বানাচ্ছেন। গরমে তালু ফাটার জোগাড়, গা পুড়ে আবলুস কাঠ– কুচকুচে কালো। তবু বিরাম নেই।

মাস্টার পাগল হয়ে গেছেন। বদ্ধ পাগল। লোকে এমনই ভাবেন। হাসাহাসি করেন। ক্ষ্যাপান। তিনি নির্বিকার। নৌকা বানিয়ে চলেন।

পৃথিবী পঁচে গেছে। অসহ্য বদ গন্ধ। মাস্টারের দম নিতে কষ্ট হয়। নাড়িভুঁড়ি উগরে বমি আসে। গজব ধেয়ে আসছে।

নূহ নবী নেই, আসন্ন মহাপ্লাবনে আজিজ মাস্টারই সবাইকে নিয়ে ভেসে পরবেন দরিয়ায়– এক অমল পুনরুজ্জীবনের আশায়।