আবু সাঈদ আহমেদ এর সকল পোস্ট

রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হতেই হবে

রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হতেই হবে

রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে অনেকেই নেতিবাচক ধারনা পোষণ করছেন। তাদের বলছি থিং পজেটিভ অর্থাৎ ইতিবাচক ভাবে ভেবে দেখুন।

রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৬৬০ মেগাওয়াটের ২টি ইউনিট থাকবে। আশা করা যায় সবকিছু ঠিক থাকলে ২০১৮ সালে প্রথম ইউনিট থেকে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব হবে। তবে দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৩ সাল নাগাদ বিদ্যুত উৎপাদনে সক্ষম হবে। তখন ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৪২ টন সালফার ডাই-অক্সাইড ও ৮৫ টন নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে। এই বিষাক্ত গ্যাস শুধু মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয়, পরিবেশ এবং পশুপাখির জন্যও সমান ক্ষতিকর। বিদ্যুত কেন্দ্রের চিমনি থেকে অনবরত তাপ এবং আর্সেনিক, পারদ, সীসা, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, ব্যারেলিয়াম, ব্যারিয়াম, ক্যাডমিয়াম, রেডিয়াম ইত্যাদি বিষাক্ত রাসায়নিক নির্গত হয়ে বাতাসে মিশে সুন্দরবনের পরিবেশ ধ্বংস করবে।

রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র বাস্তবায়নের জন্য ১৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে যার ৯৫%ই কৃষি জমি। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে মাত্র ৬০০জনের কর্মসংস্থান হলেও জমি অধিগ্রহণের কারণে উচ্ছেদ হবে প্রায় আট হাজার পরিবার।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভয়াবহ দূষণ ঘটায়। তাই বিশ্বের কোথাও সংরক্ষিত বনভূমি ও বসতির ১৫-২০ কিলোমিটারের মধ্যে নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়না। কিন্তু রামপাল থেকে প্রায় ৯ মতান্তরে ১৪ কিলোমিটার দূরে সুন্দরবনের অবস্থান হলেও দেশপ্রেমিক ও প্রকৃতিপ্রেমিক সরকার এবং সরকারের এলাহী উপদেষ্টা রামপালে বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে। কারণ, সরকারের কাছে সবার আগে সুন্দরবন।

একটু গভীরভাবে চিন্তা করুন। বিদ্যুত কেন্দ্র বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবন কি আসলে ধ্বংস হবে? দেশপ্রেমিক সরকার কি সুন্দরবনকে ধ্বংস করার মত প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে? উত্তর হল সুন্দরবন ধ্বংস হবেনা, সরকার সুন্দরবন ধ্বংস করার মত কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেনা। একমাত্র সুন্দরবনকে রক্ষার জন্যই রামপালে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।

রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হলে-
-সুন্দরবনে বিদ্যুত সুবিধা পৌঁছে যাবে। সুন্দরবনের প্রতিটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বিশাল স্ক্রীনের এলসিডি মনিটর লাগিয়ে দেওয়া হবে। সেই এলসিডি মনিটরে হরিণেরা হিন্দী সিরিয়াল দেখে দেখে খুনসুটি করবে। বানর’রা ডিসকভারী আর এনিমেল প্ল্যানেট দেখে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে। শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান দেখে বানরকূল সভ্য হবে, শান্ত হবে। বাঘ সমাজ ধর্মীয় চ্যানেল আর সামাজিক অনুষ্ঠান দেখে দেখে মানবিক হয়ে উঠবে। তারা মাংসের বদলে ভেজিটেবল স্যুপ আর পটেটো নুডুলস খেতে শিখবে। হরিন,বানর আর বাঘ শিশুরা একসাথে বসে কার্টুন চ্যানেল দেখবে। প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময় সকল পশুপাখী আবহাওয়া বার্তা শুনে সতর্ক হবে।

রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হলে-
শেয়াল পন্ডিতের পাঠশালা আবার নতুন করে জেগে উঠবে। পাঠশালাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তর করা হবে। নাইট শিফটে ছাত্র পড়ানো হবে। শিয়াল পণ্ডিত আর রাতের বেলা টক’শো দেখে দেখে সচেতন হওয়া কুমীর সন্তানদের খেতে পারবেনা। সকাল বেলা বাঘ-হরিণ-মোষ-বানর-কুমির শিশুরা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ইশকুলে যাবে। পশু-পাখীদের সন্তানরাও জিপিএ-5 পেয়ে বাবা-মার মুখ উজ্জল করবে। শিক্ষাকে জঙ্গল পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হবে।

রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হলে-
সুন্দরবনকে ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হবে। বনের প্রতিটি প্রানীর ঘরে ঘরে ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছে দেওয়া হবে। যুবক হরিণেরা যুবতী হরিণের সাথে অসভ্যের মত বন-বাঁদাড়ে না ঘুরে-ফিরে ঘরে বসে বসে ফেসবুকে চ্যাট করবে। বানর রমনী তার বানর প্রেমিকের বিষয়ে স্ট্যাটাস দিবে। পুরো পশুকুল বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করবে। সুন্দরবনের স্মার্ট বাঘের সাথে ফেসবুকে প্রেম হয়ে যেতে পারে কোন আফ্রিকান সুন্দরী সিংহীর। বাঘ বিপন্ন প্রানী বলে তাদের গলায় গলায় জিপিএস লাগিয়ে দেওয়া হবে। ফলে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।

রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হলে-
অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবার সম্ভবনা প্রচুর। সুন্দরবন সভ্য হয়ে উঠলে সুন্দরবনের পশুদের মাঝে রং ফর্সা করা ক্রীম, হরলিক্স, চুলের কলপ, টুথপেস্ট, শ্যাম্পু, সুগন্ধী হার্বাল সাবান বিক্রি করার একটা বিশাল বাজার সৃষ্টি হবে। এছাড়া টিভি, ফ্রীজ, চেইন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, কর্পোরেট হসপিটাল, ফ্রাঞ্চাইজি রেস্টুরেন্ট নির্মাণ করে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিশাল ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে।

রামপালে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ হলে-
সুন্দরবনের পশুদের জন্য নিরাপদ বাসস্থান সম্ভব হবে। বিদ্যুতের তার এবং পশুদের বিনোদন কেন্দ্র ছাড়া বাকী গাছগুলো কেটে কেটে পশুদের জন্য পাকা বাড়ি/ফ্ল্যাট বানিয়ে দেওয়া হবে। ফলে ঝড়-বৃষ্টি অথবা অন্য কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগে পশুরা থাকবে নিরাপদ। ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌছে দেওয়ার ফলে গরমে পশুরা এসির বাতাসে শীতল হতে পারবে আর শীতে হিটারের গরমে উষ্ণ হবে। এখন কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন পাখিদের কি হবে? পশুদের পাকা বাড়ীর ভেনটিলেটারে পাখিদের জন্য আরামদায়ক আবাসন তৈরী হবে।

রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান হলে-
সুন্দরবন আরো সুন্দর হয়ে উঠবে। সুন্দরবনের ভিতরে পৌঁছে যাবে সভ্যতার আলো। যারা সকলের জন্য সভ্যতা চায়না, যারা চায়না বৈষম্য কমে আসুক তারাই রামপালে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের বিরোধিতা করতে পারে, তারা সবাই অসভ্য।

রামপালে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ হলে-
সুন্দরবন দিনে দিনে সভ্য হয়ে উঠবে। সুন্দরবন হবে পৃথিবীর প্রথম সভ্য জঙ্গল। আমাদের একজন সভ্য ইলাহী সাহেব আছেন। তিনি তার নিজ তৌফিকে সুন্দরবনে সভ্যতার আলো পৌঁছে দিবেন। সভ্যতার খাঁটি ডিজিটাল বৈদ্যুতিক আলো। ভবিষ্যতে ভোটার লিস্টে সভ্য সুন্দরবনের শিক্ষিত প্রাপ্তবয়স্ক পশুদের নাম উঠবে। আর সেই পশুরা রামপালে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের মাধ্যমে সুন্দরবনকে সভ্য করে গড়ে তোলার স্বপ্নদ্রষ্টা ও মহান কারিগর এলাহী সাহেবের দলকেই ভোট দিবে।

শেষ কথা হল রামপালে বিদ্যুতে কেন্দ্র হতেই হবে। যাদের একজন তৌফিক-ই-এলাহী আছেন তাদের সুন্দরবনের প্রয়োজন কি!!

______________
২৫শে আগস্ট, ২০১৩

টার্গেট কিলিং

বাবা, সালাম নিও।
কাল থেকে তোমাদের অবর্ণনীয় কষ্টের দিন শুরু হবে। সবাই তোমাদের দিকে আঙ্গুল তুলবে। ঘৃণার চোখে তাকাবে। বিশ্বাস করো বাবা, আমি কোনো ভুল করি নাই।

আমার পথ যদি ভুল হয়, তবে সাড়ে তিনশ আসনে বসে থাকা দাঁতাল শুয়োরগুলোর পথ মহাভুল। বাঘ ঘাড় মটকে একবারে রক্তমাংস খায়। কিন্তু এই শুয়োররাজের পাল ছারপোকার আর জোঁকের মত প্রতিদিন আমাদের রক্ত খায়। হাড্ডি-মাংস খায়, মগজ খায়, মন খায়, আশা স্বপ্ন ভবিষ্যত খায়।

সবার থালায় দুইবেলা উঠবে জুঁই ফুলের মত শাদা ভাত। মাছ বা মাংসের সালুন আর ডাল। কোনো শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগবে না, দেশের সব শিশু স্কুলে যাবে একই পোশাকে। পড়া শেষে প্রতিটি যুবক চাকরী পাবে। আর একটাও বিচার বহির্ভূত হত্যা হবেনা। ধর্ষিত হবেনা কেউ। কৃষক পাবে ফসলের ন্যায্য দাম। শ্রমিক আর দিনমজুর মমাথা গোঁজার জন্য পাবে আপন দালান ঘর, গার্মেন্টসের সেলাই দিদিমনির শোবার ঘরে গরমের রাতে হাওয়া দিবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র। বিনা চিকিতসায় কষ্ট পাবেনা কেউ। দেশের দরিদ্রতম মানুষটিরও দুটো ওমওম স্যুয়েটার থাকবে আর বর্ষায় ব্যবহারের জন্য একটা বর্ষাতি। শুয়োরের পাল পার্সেন্টেজের আবর্জনা খাওয়া ছেড়ে মানুষ হবে। নিজের স্বার্থে ছাত্র যুবকদের হাতে অস্ত্র তুলে দিবেনা, উগ্র জাতীয়তাবাদ ও অন্ধ ধর্মীয় মৌলবাদের বৃক্ষের চারা ঘরে ঘরে পৌছে দিবেনা। দেশে চিরদিনের জন্য রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে। রাজনীতির পরিবর্তে সংবিধানে স্থান পাবে প্রজানীতি। এসব চাওয়া কি অপরাধ!

বাবা, আমি মানুষ রাজ্যে শুয়োরপ্রধানের পদত্যাগ দাবী করছি। কাদা খোঁচানের তালে তালে সংঘবদ্ধ হয়ে তারা কতটা লুটপাট করছে তার হিসাব দাবী করছি। জনতার রক্তমাংসে তাদের ভোগ দেবার প্রথা অস্বীকার করছি। আমার কোনো দল নেই, আমি সশস্ত্র নই, কোনো দাঁতাল শুয়োর আমার মামা-চাচা বা পলিটিক্যাল বড় ভাই নয়, আমার পরিবারের কেউ পত্রিকার নামজাদা সম্পাদকের সাথে মদের আড্ডায় তুবড়ি ফুটায় না। আমি শুয়োরপ্রধানের পায়ে আত্নাহুতি দিতে প্রস্তুত নই, আমি শুয়োর সাম্রাজ্যের পতন চাই– এগুলোই আমার সব থেকে বড় অপরাধ।

বাবা, খুব কষ্টে একটুকরো কাগজ আর কলম জোগাড় করেছি। মা’র চোখের ছানির অপারেশন তারাতারি করিও। খুব দূরে কোথাও ঘুরতে যাবো বলে টাকা জমাচ্ছিলাম। অন্তুকে বোলো– ও বের করে দিবে। অন্তুকে কামলা হিসেবে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে দিও। নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়ে হলেও এই ইতরের দেশ থেকে পালাক — সেখানে দাশের মত মারা গেলেও অন্তত একটা সান্ত্বনা পাবে। তোমার প্রেশার ও সুগারের দিকে খেয়াল রেখো। যে এই চিঠি তোমার হাতে পৌছে দিচ্ছে তাকে পাঁচ হাজার টাকা দিতে ভুলো না- সে একজন কনস্টেবল। টাকা না দিলে ৫০হাজার টাকা আদায় করে ছাড়বে। তারপরে থানার সেকন্ড অফিসার আর ওসিকে লেলিয়ে দিবে। তখন লাখ টাকার কাফফারা গুনতে হবে।

কাল সকালে পেপার পড়োনা, বাবা। অস্ত্র উদ্ধারে গিয়ে ক্রস ফায়ারে জঙ্গী নিহত হবার নাটকের ভিলেনের চরিত্রে আদরের ছেলের নাম সহ্য করতে পারবেনা।

বাবা, তোমরা ভালো থেকো। ভালো থাকার জন্য মুখ আর চোখ বন্ধ রেখো– সমগ্র সংবিধান জুড়ে এখন এই ধারা ছাড়া আর কোনো ধারা নেই, উপধারা নেই।

ইতি-
মর্তুজা।

পুনশ্চ: আলু মটরশুটি আর শিংমাছ দিয়ে মা’র হাতে রান্না করা তরকারি মাখিয়ে গরম ভাত খেতে খুব ইচ্ছে করছে। যত দামই হোক, আমার টিউশনির জমানো টাকা দিয়ে বড় সাইজের দেশী শিং মাছ এনো তো বাবা। সাধ্যে কুলোয় না বলে কতদিন খাওয়া হয়নি। দেখো, মা’র রান্নার ঘ্রাণ পেলে কবর ফুরে ভাত খেতে হাজির হয়ে যাবো।

অকবিতা

স্বপ্নের কোনো দায় নেই, মৃতচোখে ঘোলা সম্মোহন। দুনিয়ায় এখনো রোদের রং শাদা, ঘামের রং লাল। পোস্টম্যান, খাঁকি ঝোলায় ভরে যে দিন আনো- ফসলের ঘ্রাণহীন, জলপাই বনে ইউনিফর্মের মার্চপাস্ট।

শিশুর দেহে কাঁটা দাগ, মৃতত্বকে ব্যাধি দগদগে। আরোগ্য নেই মহাকাল- সঙ্ঘবদ্ধ অসুখ এখন। পোস্টম্যান, তোমার জুতোর নিচে হেটে যায় যে সড়ক- আধারের পাকস্থলী, ফুটপাতে ঘুমোয় অশেষ ক্ষুধার অর্গাজম।

শাটল ট্রেন চলে যায়, আত্নায় অমোঘ শীতঋতু। পায়রার ডানায় বরফকুচি, পালকে রক্তের দাগ। পোস্টম্যান, বেয়ারিং খামে ভরে যে রোদ আনো- কাফনের ভাজেভাজে, উষ্ণতার মিছিলে কুয়াশাস্নাত প্ল্যাকার্ড।

নক্ষত্র শান্ত হও ঘাতে, দহনে জমে ভস্মের সঞ্চয়। পিছুটান তরল মাদক, মেঘেরা আমৃত্যু উদ্বাস্তু। পোস্টম্যান, এক একটা দিন আপন ঠিকানায় পৌছে দিও প্রাচীন পোস্টকার্ড- দুঃসময়ে উথলে ওঠা প্রেম, চুমোর ক্যালকুলাস।

__________________________________
#অকবিতাগ্রন্থঃ পোস্টম্যান থামো/আবু সাঈদ আহমেদ।

একা হয়ে যাও

একা হয়ে যাও, এতোটাই একা
নিজের সাথেও যেনো হয়না কো দেখা।
.
সরলরেখা কেবলই বেঁকে যায়
রৌদ্রস্নানে এসে নিজের বৃষ্টিতে ভিজে যায় মানুষ।
.
মানুষ ভাঙে সম্পর্ক, সম্পর্কের শেষ সীমা
জানলায় টুকরো টুকরো অথৈ নীলিমা।
.
যাবে যাও, নিজেকে যেওনা রেখে, নিজেকে রেখে যেতে নাই
নিজের ভেতরে রেখোনা অগুন্তি মুখ, পাবেনা নিজের ঠাঁই।

ছন্নছাড়া অকবিতা

একা হয়ে যাও, এতোটাই একা
নিজের সাথেও যেনো হয়না কো দেখা।
.
প্রেম মানেই গোলাপ এবং নোখের আঁচড়
ঠোঁটবন্দী ঠোঁটে ঠোঁটে মুক্তি লাভের ঘোর।
.
যাও, পালাও পালাও, যতটা দূরে যাবে যাও
পথের বাঁকে বাঁকে আমার ঘ্রাণ হতে নিজেকে বাঁচাও…।

ডেটিং

দ্রুত সব কাজ গুছিয়ে নিচ্ছি। হিসেব-নিকেশ, দেনা-পাওনা, স্বপ্ন-স্বপ্নহীনতা– সব। টেনশন নিয়ে ডেটিংয়ে যাবার কোনো অর্থ হয়না।

জানালার বাইরে নীলাকাশ। কোথাও ফুটেছে কাশ। বাতাসে কাঁঠালচাঁপা ফুলের ঘ্রাণ। জানালার গ্রীলে দুটো চড়ুই। টেবিলে একফালি রোদ– রোদের রং এত মায়াবী! উত্তাপে এতো আনন্দ! সবকিছু ভীষণ অন্যরকম- সুন্দর, অনাবিল, খুব বেশী মায়াময়।

কাজে মন দেই। দেড় মাসের মধ্যে সব শেষ করতে হবে। নিশ্চিন্ত হবার মত শেপে নিয়ে আসতে হবে। তারপর ডেটিংয়ের প্রস্তুতি আরো দেড়মাস।

ঠিক তিনমাস পরের যে কোনো একদিন সে আসবে– জড়াবে ভালোবাসায়, বিভোর আলিঙ্গনে, প্রিয়তমা মৃত্যু আমার। অথবা আমিই যাবো তার কাছে।

কিছু কিছু কথা রাখতে হয়, কিছু কিছু প্রতিজ্ঞা ভাঙতে নেই।

ব্রেক

ইন দ্য ইয়ার অফ নাইটিন নাইনটি ট্যু, রাতের বেলা রিয়াজের ফোন-

: হ্যালো, দোস্ত, সকাল দশটায় তুই আর মিঠু একটু কলেজে আয়, প্লিজ দোস্ত।
: কেনো?
: কাল তানজিনার সাথে ডেট। বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাবো। তুই আর মিঠু ছাড়া ভরসা পাই না।

ভালোবাসার পবিত্রকাজে সাহায্য কইরা সোয়াব হাসিলের জন্য সকাল দশটায় মটর সাইকেল নিয়া কলেজের পিছনে হাজির হইয়া বেআক্কেল বইনা গেলাম। দেখি আরো বারোটা মটর সাইকেল, রিয়াজ তানজিনা ছাড়া সব মিলায়া আমরা ত্রিশজন রিয়াজের ডেটিং সহায়তা সৈনিক।

রিয়াজ বুদ্ধিমান সাবধানী পোলা। মগজ চুরি হওয়ার ডরে সব বুদ্ধি হাটুতে লুকায়া রাখে। সে রিস্ক নেয় নাই– কেউ যদি আসতে মিস করে তাই সাবস্টিউট রাখছে। মাগার কেউ মিস করে নাই।

বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাত্রা করলাম। রিয়াজ আর তানজিনা অটোরিক্সায়। অটোরিক্সাকে গার্ড দিতাছে বারো মটর সাইকেল। পুরা বরযাত্রী বরযাত্রী আমেজ।

২.
বোটানিক্যাল গার্ডেনের ফাঁকা জায়গায় বইসা রিয়াজ আর তানজিনা কথা কইতাছে। আমরা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়ায়া গার্ড দিতাছি। হঠাত রিয়াজ ইশারা করলো। কাছে যাইতেই কইলো–
: দোস্ত, তোরা ওর সাথে একটু গল্প কর, আমি যামু আর আমু।

সবাই গল্প করতাছে। মাগার রিয়াজ আর আসেনা। দেড় ঘণ্টা পরে আমি আর মিঠু খুঁজতে বাইরালাম। দুই ঘণ্টা পরে তারে পাওয়া গেলো মালির ঘরে– ছয় ফিট দুই ইঞ্চি লম্বা রিয়াজ কানে ধইরা দাঁড়িয়া আছে। ফুল ছিড়ার শাস্তি ভোগ করতাছে। শাস্তি দাতা মালি সাড়ে চার ফুট উচ্চতার তালপাতার সেপাই, তুমুল ভাব নিয়া রেডিও শুনতাছে। মালিকে ধমকে রিয়াজরে ছাড়িয়া আনলাম। রিয়াজ আর স্বাভাবিক হইতে পারলো না। ডেটের বদলে সবাই মিলা আড্ডা দিলাম কতক্ষণ।

৩.
এবার ফিরার পালা। কিন্তু অটো নাই। তানজিনারে সাড়ে চারটার মধ্যে বান্ধবীর বাড়িতে পৌছায়া দেবার দায়িত্ব পড়লো আমার উপর। দেড় ঘণ্টার রাস্তা। মোটর সাইকেলে দিলাম টান। এদিকে ব্রেকে সমস্যা– সাইকেলের ব্রেক না, আমার ব্রেক। বারবার খালি ব্রেক ধরি। ব্রেক ধরতে ধরতে ভয়াবহ এক্সিডেণ্ট ঘইটা গেলো। দুইজনে টানা সাত বছর ভুগলাম– ‘তাই না তানজিনা! জান্টুশ! একটু চা বানাও, চুমায়া চুমায়া খাই..’

: অসভ্য, ইতর! দুই বাচ্চার বাপ হয়ে গেছো, এখনো এমনি করে কথা বলা যায়না!

ভক্তির চুনকামেও দেবতুল্য ভাবমূর্তি রক্ষা করা যায় না

শ্রদ্ধার আস্তর ও ভক্তির চুনকাম করেও দেবতুল্য ভাবমূর্তি আর রক্ষা করা যাচ্ছেনা…

গত চার দশকে আমাদের নমস্য বুদ্ধিজীবীরা যে তৈল মর্দন ভিত্তিক বুদ্ধিজীবীতা প্রতিষ্ঠা করেছেন, অনেক ভালো কাজ করেছেন বলে চামচাকে চামচা বলো না, লুচ্চাকে লুইচ্চা বলো না- ঘারাণার শ্রদ্ধার চর্চা ছড়িয়ে দিয়েছেন, বুদ্ধিজীবীতার দোকান খুলেছেন বলে তার অযৌক্তিক ও অপকর্মের বিরুদ্ধে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবেনা কেন্দ্রিক সভ্য আচরণের দীক্ষা দিয়েছেন, দেশ জাতির প্রতিটা ন্যায় সংগত দাবির আন্দোলনের সময়ে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার নয়তো বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার পাঠ শিখিয়েছেন, প্রজন্মকে আত্নকেন্দ্রিক করে গড়ে তুলেছেন, বহুমূখী বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন, এইসব বুদ্ধিজীবীদের রমরমা বাণিজ্যে ধ্বস নেমেছে।

এইসব বুদ্ধিজীবী এবং এদের তল্পিবাহকদের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় অত্যন্ত সাধারণ মানুষটিও আজ স্পষ্ট অবস্থান নিচ্ছেন, নিজের বক্তব্য জানাচ্ছেন। অনেকেই তথ্য আর যুক্তি দিয়ে নির্মোহ বিশ্লেষণ করছেন। ফলে ভক্তিতে গদগদ সাম্রাজ্যে ফাটল ধরেছে। এতোদিন আলোর কারবার করে আসা বুদ্ধিজীবীদের অন্ধকার দিকটিও প্রবলভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। শ্রদ্ধার আস্তর ও ভক্তির চুনকাম করেও দেবতুল্য ভাবমূর্তি আর রক্ষা করা যাচ্ছেনা।

এসব ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়েই গড়ে উঠছে দেশের নতুন বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজ। এই নতুন বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজ প্রশ্ন তুলতে জানে, জনতার ন্যায়সংগত দাবির পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো ছলচাতুরী ছাড়াই স্পষ্ট অবস্থান নিতে পারে। এরা যৌক্তিক আলোচনায় যুক্তি দিয়ে প্রমিত বাংলায় কথা বলতে পারে, অযৌক্তিক আবেগ আর চামচামির জবাবে সহি বাংলা গালি সম্ভার হতে যথাযথ গালিগালাজাস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারে। এসব গালিও বাংলা ভাষার সম্পদ ও সম্পত্তি, যথাস্থানে প্রয়োগযোগ্য বিশেষণ।

বুদ্ধিজীবীরা ব্যক্তিগত জীবনে যতই গালিবান্ধব হন না কেনো, তাদের পরম যত্নে গড়া বুদ্ধিজীবীতার কাঁচের ঘরে গালিগালাজ ছিলো অচ্ছুৎ, ছোটোলোকি আচরণ। আশার কথা এই যে, বাবুগিরির সীমানা ভেঙে সাধারণ মানুষ, নতুন বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ এখন প্রমিত বাংলার মত অপ্রমিত বাংলা বলতে শিখছে। তারা এখন অনায়াসে ভালো কে ভালো, আলোকে আলো, চামচাকে শুয়ার আর বোকাচোদাকে বোকাচোদা বলতে পারে।

রূপকথা সব চুপকথা

রূপকথা সব চুপকথা

১.
রূপকথা আসলে রূপকথা নয়। রূপকথা তবে কি? রূপকথা হল চুপকথা, অর্থাৎ যে কথা চুপিচুপি বলতে হয়। চুপিচুপি বলার থেকে চুপ থাকা আরো ভালো। কিন্তু মানুষ চুপ থাকবে কেন! সে কথা বলবেই। সে চুপ না থেকে কথাটি বলবে চুপিচুপি। তবে কতক্ষণ আর চুপিচুপি কথাটি ইশারায় ফিসফিসিয়ে বলে মন ভরে! এদিকে যে প্রকাশ্যে বলাও হিতে বিপরীত হতে পারে।

চুপ থাকার অভ্যাস মানুষের চরিত্রে নেই। তাই সে চুপিচুপি বলার কথাটা প্রকাশ্যে বলে, ভিন্নভাবে ও ভিন্নরূপে বলে। গল্প বানিয়ে ছড়িয়ে দেয় মুখে মুখে। মানুষের চুপ না থাকার স্বভাবই চুপকথাকে রূপকথায় রূপান্তর করেছে।

২.
দক্ষিণারঞ্জন মিত্র হতে শুরু করে উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী পর্যন্ত প্রায় সকলে যেসব বাংলা রূপকথা সংগ্রহ করেছেন- সেগুলো সাধারণ পাঠে ছেলেভুলানো রূপকথাই মনে হয়। কিন্তু একটু গভীর পাঠে ছেলেভুলানো রূপটি আর থাকেনা। অতি সাধারণ মানুষের সংগ্রাম, দূর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার, দূর্বলের দ্রোহ-জয়-পরাজয়, ভালো শাসকের প্রতি প্রজার আনুগত্য ও মন্দ শাসকের প্রতি ঘৃণা, প্রতিদিনের জীবনযাপন- এসবই রূপকথার উপজীব্য, বর্ণিত আখ্যান। যে কথাগুলো মানুষ সহজে বলতে পারে না তা রূপকের মাধ্যমে গল্পের আকারে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। মুখ থেকে মুখে সমৃদ্ধ হয়েছে। আয়ু লাভ করেছে রূপকথার খোলসে।

৩.
অত্যাচারী রাজা বা জমিদারের বিরুদ্ধে কথা বলার ফলাফল ভালো হবেনা- কিন্তু অত্যাচারীর বিরুদ্ধে কথা বলা যাবেনা তা হতে পারেনা। কথা বলা যাবে গানে-কবিতায় আর গল্পে। তবে সবথেকে মোক্ষম অস্ত্র গল্প, রূপকের আকারের গল্প। এসব গল্প ইশপের নীতিগল্প নয়, ন্যায়ের পক্ষে লড়াইয়ের গল্প। শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের দীর্ঘ সংগ্রাম আর বিজয় বা পরাজয়ের গল্প। এসব গল্পে হাজির থাকে টোনাটুনি, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গামি-, রাক্ষস-খোক্ষস, ডাইনি, সাধু সন্ন্যাসী আর একজন ভালো রাজপুত্র বা সাধারণ ভূমিপুত্র। এই রাজপুত্র বা ভূমিপুত্র সকল প্রতিবন্ধকতা জয় করে রাজসিংহাসনে বসে, প্রজাদের আর কোন দু:খ থাকেনা। সেই অনাদিকাল হতেই প্রজার স্বপ্ন ফুটে ওঠে এসব ছেলেভুলানো রূপকথার আদলে।

দুয়োরানী আর সুয়োরানী, ধুরন্ধর মন্ত্রী বা কোটাল- এরা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রেরই রূপক। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের এই গল্পগুলোতে সত্যের জয় হয়, তবে অনেক ত্যাগ আর তিতিক্ষার পরে। রাজার অযোগ্য পুত্র আর তার কর্মকান্ডও বাদ যায় নাই রূপকথা থেকে। কোন রাজা? ঐ যে তেপান্তর আর সাত সমুদ্রের পাড়ে ছিল একদেশ। সেই দেশের ছিল এক রাজা। আদতে এই দেশটা কিন্তু গল্প কথকেরই দেশ আর রাজাও গল্প কথকের দেশেরই রাজা।

৪.
এক ছিল টোনা আর এক ছিল টুনি। টোনার পিঠে খাবার শখ। টুনি তাকে ধরিয়ে দেয় বাজারের ফর্দ। বাজার করে ফেরার পথে সেধে সেধে দাওয়াত নেয় বিড়াল মাসী থেকে বাঘ মহাশয় পর্যন্ত প্রতাপশালী সব পশুরা। নিরুপায় টোনা বাঘকে না করতে পারেনা। সময়মত পিঠে খেতে টোনার বাসায় বাঘ হাজির। কিন্তু টোনার বাড়ি খালি। পিঠে খেয়ে টোনা তার টুনিকে নিয়ে উড়ে গেছে বহুদূরে। বাঘ বিফল হয়ে রাগে ক্রোধে ফিরে যায়। অতি প্রচলিত রূপকথা।
এ গল্পের ছেলেভোলানো অংশটির গভীরে গেলে দেখা যাবে অন্যচিত্র। টোনাটুনিকে ধরে নেই সাধারণ মানুষের আর বাঘকে শক্তিশালী মানুষের প্রতীক। তবেই কিন্তু রূপকথাটির ভিতরের চুপকথাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গল্পটির মাঝে সেই সময়ের সাধারণ মানুষের অবস্থার যে চিত্র ফুঁটে ওঠে-
ক) সাধারণ মানুষের কাছে পিঠা একটা বিলাসী খাদ্য, যা সবসময় খাবার সামর্থ্য তাদের নেই
খ) শক্তিশালী বা ক্ষমতাবান মানুষের ইচ্ছের কাছে সাধারণ মানুষ নতজানু
গ) সাধারণ মানুষ ক্ষমতাবানের কাছ থেকে নিজেদের খাদ্য এবং জীবন বাঁচাতে ভিটেমাটি ছেড়ে যায়, পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

শিয়াল পন্ডিত কুমিরের সাত ছানার মধ্যে ছয়টাকে খেয়ে বাকী একটাকেই সাতবার দেখায়- এখানে বাবু বা জমিদার গোষ্ঠীর ধুরন্ধর চরিত্র রূপকের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। রাজার বাড়ির পাশে ছোট গাছে টুনির বাড়ি। রাজা বারান্দায় তার টাকশালের টাকা শুকো দিয়েছেন। টুনি একটা টাকা বাসায় নিয়ে গিয়ে গান গাইছে – রাজার ঘরে যে ধন আছে/আমার ঘরে সে ধন আছে। তারপর রাজা এই টুনির কাছ থেকে পয়সা ফিরিয়ে নেয়। টুনি প্রতিবাদ করলে টুনিকে হত্যা করার চেষ্টা করে। টুনিকে হত্য করতে গিয়ে রাজা তার সাতরাণীর আর নিজের নাক বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়। এই গল্পটিও এক অত্যাচারী রাজার বিরুদ্ধে একজন সাধারণ যোদ্ধার উপখ্যান। যে যোদ্ধা বাঁচার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় রাজার কাছ থেকে নিজের ন্যায্য পাওনা আদায় করে নেবার মন্ত্রে উজ্জিবীত হয়ে লড়াই করে যায়। রাজা প্রবল শক্তিশালী হয়েও পরাজিত হয়। সাত রানীর নাক কাটার সাথে সাথে নিজের নাকটাও বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়।

পাঠক, প্রচলিত প্রতিটা রূপকথা গভীরভাবে পাঠ করলেই গল্পের ভিতরের চুপকথাটি অনুভব করতে পারবেন।

৫.
মানুষের সীমাবদ্ধতা এই যে- সে অর্থহীনভাবে কিছুই সৃষ্টি করতে পারেনা। তার চরম কাল্পনিক ভাবনার ভিত্তিও বাস্তবতার গভীরে প্রোথিত। মানুষ যখন পঙ্খিরাজ ঘোড়া কল্পনা করে তখন সে আসলে ঈগল বা চিলের উড়বার ক্ষমতার সাথে ঘোড়ার তীব্র গতির দৌড়ের মিশ্রণ ঘটায়- তাই পঙ্খিরাজ ঘোড়া সকল বাধা পেরিয়ে দৌড়ে বা উড়ে যায়। ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গামি হলো সাধারণের জৌতিষ, কালজ্ঞ। রাক্ষস-খোক্ষস-ডাইনি- অশুভ অজানা শক্তি আর অত্যাচারী রাজা জমিদার বা শক্তিমানের প্রতীক। অর্থাৎ রূপকথার চরিত্রগুলো বাস্তব চরিত্রের রূপান্তর, নিছক কল্পনা বিলাস নয়। সাধারণ মানুষ আনন্দে বা কষ্টে নিরেট বাস্তবকে কল্পনা ও রূপকের মিশেল দিয়ে গল্প রচনা করেছে, সেই গল্প মুখে মুখে ফিরে ফিরে সমৃদ্ধ হয়েছে। যুগে যুগে সাধারণ মানুষ রূপকথাকে আপন করে নিয়েছে কারণ অবচেতনভাবে রূপকথায় সে নিজেকে আর নিজের সময়কেই খুঁজে পেয়েছে।

৬.
প্রতিটি রূপকথাই চুপকথা। প্রতিটি রূপকথার ভিতরে চুপ করে আছে যাপিত জীবন আর সময়ের উপখ্যান। রূপকথার গভীরে ঘুমিয়ে থাকা চুপকথাগুলো কখনই জেগে উঠবেনা, আমরা যদি জাগিয়ে না তুলি!

#রূপকথা

ভোকাট্টা

ঘুড্ডিটা ভাকাট্টা হয়ি গেসে। আউলা বাতাসে পাক খাতি খাতি ভাসি ভাসি যাসসে। কুথায় গিয়ে গোত্তা মারি পরিবে কে জানে! সে নিজেও জানেনে। তার কাজ হচ্ছি ভাসি যাওয়া, এক সুতা ছিড়ে অন্য সুতার গিট্টুতে আটকে যাওয়া। গাছের ডালে পাতায় লটকি থাকা’- মাজেদ বয়াতি কথাগুলো বলে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। রফিকের চায়ের দোকানে উদাস দুপুরে এক ভোকাট্টা ঘুরির সাথে সকল কাস্টমার নিজেদের মিল খুজে পায়। সবাই যেন বারবার ভোকাট্টা হওয়া ঘুরি। শুধু ভেসে যাওয়া, নতুন গিট্টুতে আটকে থাকা, আবার ভেসে যাওয়া, সংসারের মায়ার লতায় পাতায় লটকে আছে। মাজেদ বয়াতি চিনাবার আগে নিজেদের নিজেরাই চিনতো না।

রফিকের চায়ের দোকানের টুলে বসেই দোতারা বাজিয়ে বয়াতি গেয়ে ওঠেন-
উত্তরে বয় দখিন দিকের হাওয়া
এবার হবে যাওয়া আমার যাওয়া,
এক জীবনে সব হবেনা পাওয়া
পরাণ পাখি জানে শুধু ভেসে যাওয়া…’
মাজেদ বয়াতীর দরাজ সুরে প্রকাশ্য দুপুরে নিস্তেজ হাট খুন হয়ে যায়। তাকে ঘিরে ভীড় জমে ওঠে, কারো কোথাও যাওয়া হয়না। শুধু ভোকাট্টা ঘুরিটা মাজেদ বয়াতীর গান আর ভীড়কে তুচ্ছ করে ভেসে যেতে থাকে..দূরে..বহুদূরে…।

সুপারম্যানের আন্ডারওয়্যার

মাসুদ রানা, শার্লক হোমস, ওয়াটসন, কিরীটি রায়, বোমক্যাশ, ফেলুদা, টেনিদা, দস্যু বনহুর ব্যাস্ত মানুষ। কিছুটা সময় বের করেছেন। জংগলে দল বেধে কাটাবেন। রাতে হৈ চৈ করবেন। একটু অবসর উপভোগ করবেন। চিন্তা নেই, তাদের শিষ্যরা আজকাল অপরাধের আগেই অপরাধী ধরে ফেলছে।

রাতে তাবুর নিচে ঘুমোতে গিয়ে ফেলু মিত্তির প্রথম বুঝতে পারলেন তার লাল আন্ডারওয়ারটা নেই। মহামূল্যবান আন্ডারওয়্যার। সুপারম্যানের কমোডের ফ্ল্যাশ রহস্য সমাধান করার জন্য গিফট পেয়েছিলেন। সেই আন্ডারওয়্যারে নিকোবর দ্বীপপূঞ্জে জলদস্যূ জলি রোজার্সের গুপ্তধনের সাংকেতিক নকশা আছে। ডায়মন্ডের দুইটা বোতাম দিয়ে বিভিন্ন সংকেত অাঁকা আছে। এঞ্জেলিনা জুলির অরিজিন্যাল অটোগ্রাফ আছে।

এখানে যারা আছে তারা কেউই ফেলুদার আন্ডারওয়ার চুরি করবেনা। তবু তদন্তের স্বার্থে সবাইকে সন্দেহ করতে হচ্ছে। তারা সবাই ভালো ভাবে অনুসন্ধান চালালেন। নিজের নিজের প্যান্ট খুলে চেক করলেন। শুধু ওয়াটসনের প্যান্টের জিপার জ্যাম হওয়াতে খোলা যায় নাই। জিপারে জ্যাম লাগার ব্যাপারটা খুব রহস্য ও সন্দেহ জনক।

তদন্তের ফলাফল শুন্য। অথচ এই আন্ডারওয়ারটাই ফেলুদার সবেধন নীলমনি, অমূল্য সম্পদ।

মাসুদ রানা হোমসের কাছ থেকে একটা হাভানা চুরুট নিয়ে জ্বালালেন। তারপর ফেলুদাকে বললেন-
: আপনি শেষ কবে আন্ডারওয়ারটা পরেছিলেন?
: আজ সকালে।
: তারপর খুলে রেখেছিলেন কোথায়?
: রানা ভাই, আমি সেটাই মনে করতে পারছিনা।
: ফেলু বাবু, আপনি সুপারম্যানের মত আন্ডারওয়ারটা প্যান্টের উপরে পরেছিলেন?
: হ্যা, কিন্তু আপনি জানলেন কিভাবে?
: কারণ, এখনো লাল প্যান্টের উপরে আপনি লাল আন্ডারওয়ার পরে আছেন। স্কীন টাইট বলে বোঝা যাচ্ছেনা।
: আপনি বুঝলেন কিভাবে?
: যখন চুরুট জ্বালালাম, তখন আপনার আন্ডারওয়ারের ডায়মন্ডগুলো চিকচিক করে উঠেছিল।

সবাই স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে খুলে ফেলা নিজের নিজের প্যান্ট পরে নিলেন। ফেলুদা প্যান্টের উপর থেকে লাল আন্ডারওয়্যার খুলে বাক্সে লক করে রাখলেন। রানা মনে মনে বললেন, আজ সুপারম্যানের আন্ডারওয়্যারের নামে কেমন সবার প্যান্ট খুলিয়ে ছাড়লাম। শুধু বোকা ওয়াটসনই প্যান্ট না খুলে অর্ধেক জিপার খুলেছিল। এখন জিপার লাগাতেও ভুলে গেছে। ও ওভাবেই থাক।

বিভ্রম

১.
ফাগুন মাইস্যা রইদ্দের মইদ্যে কেমুন কেমুন আউলা ঝাউলা ফূর্তি ফূর্তি একটা ভাব আছে। মনের ভিতরে ডাইকা ওঠে কোকিল আর লিলুয়া হাওয়ায় প্রেমপিরিতির ডাক। কিন্তুক আঠারো বছরের এহছানের বমি আইতাছে। আইজ তিন তালার ছাদ ঢালাই। এহছান মালের টুকরি লইয়া উঠতাছে ঠিকই, ওর পা টলটলাইতাছে।

দুপ্পুরবেলা হারুন কণ্ট্রাক্টর এহছানের পিঠে থাবড়া মাইরা কয়-
: আব্বে হালায়! গাঞ্জা খাইছোস না কেউ তর গোয়া মারছে? এমুন কাপতাছোস কেলা! চোখ লাল কেলা! তর হইছেটা কি?

এহছান জবাব দেয়না। ফ্যালফ্যালায়া চায়া থাকে। হারুন কণ্ট্রাক্টর থাবড়া মারতে গিয়া থাইমা যায়, কপালে হাত রাইখা চিল্লায়া ওঠে- “মামদার পো, জ্বরে তর গা পুইড়া যাইতাছে। হালায় ময়মনসিংগা খাচ্চর, তুই আমার লগে কাম চোদাছ!”

২.
কন্ট্রাক্টর এসিস্টেন্টরে কাম বুঝায়া দেয়। ইঞ্জিনিয়ার ছাদ ঢালাই শেষ হওন পর্যন্ত থাকতে কইছিলো, ও জবাব দিছে ‘আমার লেবার মইরা যায়, ঢালাই শ্যাষ হওনের মায়রে চুদি।” ঢালাই বন্ধ হওনের ডরে ইঞ্জিনিয়ার আর কিছু কওনের সাহস পায় নাই।

অজ্ঞান এহছানরে লয়া কণ্ট্রাক্টর হাসপাতালে ছুটে। এমার্জেন্সিতে কি এক ইঞ্জেকশন আর স্যালাইন দেয়। আধাঘণ্টা পরে এহছান বিড়বিড়ায়া কি জানি কয়। কন্ট্রাক্টর হাফ ছাইড়া বাঁচে। এহছানরে হাসপাতালে ভর্তি করায়া ওর বাপরে খবর দেয়।

৩.
এহছানের জ্বর কমতাছে না। মাঝেমইদ্যে জ্ঞান ফিরতাছে। ঘোর লাগা চোখে এদিক ওদিক চায়া কি জানি কি কয়, কারে যানি খুজে, আবার চোখ বন্ধ কইরা অজ্ঞানের মতন পইড়া থাকে।

এহছান বুঝবার পারে ওর আম্মায় কপালে পানিপট্টি দিতাছে। ঘোরের মদ্যেই দুই তিনবার চোখ খুইল্যা আম্মারে দেখে। এহছানের মনে অয় আম্মার হাতটা শক্ত কইরা ধরলেই জ্বর কইমা যাইবো। ও আম্মার হাতটা শক্ত কইরা ধরে। কিন্তুক আম্মায় হাত ছাড়ানির লেগা পাছড়াপাছড়ি শুরু করে। আম্মায় যত পাছড়াপাছড়ি করে ও ততই পোলাপানগো রকম শক্ত কইরা চাইপ্যা ধরে।

জ্বরের ঘোরে এহছানের মনেই পড়েনা আম্মায় গেছে, আষ্ট বচ্ছর আগে আম্মায় এক্কেবারে মইরা গেছে।

অণুগল্প : পীতনগর

পীতনগর

রাজধানী শহরে বিজয় দিবস উদযাপন শেষে শফিক বাড়ি ফিরছে। ডিসেম্বরের শীত শীত রাতে কুয়াশা কেটে কেটে কুড়িগ্রামের দিকে ছুটছে বাস।

পুরো বাসে নেমে এসেছে ঘুম, শফিকের ঘুম আসছেনা। ওর মনের ভিতর মার্চ পাস্ট করে যাচ্ছে প্যারেড গ্রাউন্ডের কুচকাওয়াজ, যুদ্ধ বিমানের হাওয়ায় ডাইভ দিয়ে উর্ধ্বমুখী উড়াল, টিএসসি’র কনসার্ট আর বাসে ওঠার সময় কণার জলে ভেজা চোখ।

বাস ছুটছে, আবার ফিরবে বলেই ভার্সিটির ছুটিতে বাড়ি ফিরছে শফিক। শীতের হবো হবো ভোরে পলাশবাড়ি পেরুতেই কিছু একটা হলো, খুব জোড়ে ধাক্কা খেয়ে মহাসড়কের পাশের জলাশয়ে ছিটকে পড়লো বাস- শফিকের স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু ও কিছুতেই তা মেলাতে পারছে না। কারণ, ওর জ্ঞান ফিরতেই অচেনা এলাকায় আবিষ্কার করে নিজেকে।

এক ব্যস্ত শহরের পথে পথে হাটছে শফিক। রোদের নরম রোদে জাগছে শহর। শিশুরা ব্যাগ কাঁধে ছুটছে স্কুলে, বড়রা অফিসে। দোকানপাট খুলছে ধীরে ধীরে। বাসের হেল্পার ‘সিট খালি.. সিট খালি’ বলে চেঁচাচ্ছে। সাই সাই করে পাশ কেটে যাচ্ছে ঝকঝকে গাড়ি। ফুটপাতে যারা একটু আগেও শুয়ে ছিলো, তারা দিব্যি জাদুর মত নাই হয়ে গেছে। সূর্য যত উপরে উঠছে, শহর তত ব্যস্ত হচ্ছে। কারো দিকে তাকাবার সময় কারো পর্যন্ত নেই।

শফিকের ক্ষিধে পাচ্ছে, প্রচণ্ড ক্ষিধে। ও একটা হোটেলে ঢুকে নাস্তা সারে। তারপর আবার হাটতে শুরু করে, এ এক আজব শহর বা দেশ। কত উঁচুউঁচু দালানের সারি, রঙচঙ কত বিলবোর্ড। দু তিন মোর পার হতে না হতেই মাথার ওপর ফ্লাইওভার। এ শহরও সেজেছে বিজয় দিবসের জৌলুস সাজে, হলুদ নিশান আর হলুদ ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ডে।

এমন এক ফ্লাইওভারের নিচেই একটা বাস থেতলে দিয়ে গেছে কারো মাথা- সেখানেও মিডিয়ার লোকজন ছাড়া আর কারো কোনো শোক- কৌতূহল বা হা-হুতাশ নেই।কোনো একটা বাহিনীর সদস্যরা কারো চোখ বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে প্রকাশ্য দিবালোকে- কারো কোনো প্রশ্ন নেই। মিছিলে আটকে আছে সম্ভবত শহরের ব্যস্ততম শহর কারো কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।

শফিক অবাক হয়ে লক্ষ্য করে এ শহরে মিডিয়া, বাহিনী, ড্রাইভার সবার পোশাক হলুদ, এমন কি শহরবাসির পোশাকেও হলুদ রঙের নাগরিকত্বের ব্যাজ। এ শহরে সবাই ব্যস্ত, একমাত্র ওর কোনো তাড়া নেই। ওর সাথে হাটতে হাটতে সকাল পৌছে গেছে বিকেলে, এখন বিকেলও বলছে যাই যাই। তবু ওর হাঁটা থামেনা।

ব্যস্ত শহরে সন্ধ্যা পেরিয়ে নামছে রাত। শহরবাসীর ফেরার জন্য প্রবল তড়িঘড়ি। এই প্রথম শফিকের গায়ের পশম আতঙ্কে দাঁড়িয়ে যায়, একটার পর একটা শীতল স্রোত মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে আসে, দাঁড়িয়ে থাকার মত জোড় হারায় হাঁটু। ও ফুটপাতে বসে পড়ে, আর দেখে- এ শহরে কোনো বাড়ি নেই, শহরবাসীরা নিজ নিজ কবরের দরজা খুলে ঢুকে পড়ছে। কবরের ভিতরে জ্বলে উঠছে আলো, হাওয়ায় ভেসে আসছে খাওয়ার ঘ্রাণ আর টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের আওয়াজ।

ইলিশতত্ব

কার্তিক মাস। ইলিশের মৌসুম শেষ হইয়া আসিয়াছে। এইবার জ্বালে খুব ইলিশ পড়িয়াছিলো। তথাপি জ্বেলে পাড়ার অসিত, বাসেত, মঙ্গল, কুদ্দুসের ঘরের অভাবে সুখ হাসিয়া উঠে নাই।

ইলিশ মৌসুম শেষ হইবার পূর্বেই তাহারা মহাজন করিম মোল্লা ও সিধু পোদ্দারের নিকট হইতে আগাম মৌসুমের জন্য দাদন লইয়াছে। দাদন না লইয়া কি করিবে! চলতি মৌসুমের দাদনের টাকা লাভসমেত পরিশোধ করিবার পরে তাহাদের ঘরে অন্নের সংস্থান নাই। এই দাদনচক্রে আটকা পড়িলে বাহির হইবার পথ নাই, মৃত্যু পর্যন্ত ডাঙ্গায় তোলা ইলিশের মতন তড়পানি সার।

কার্তিক মাসের মধ্যভাগে অবিরাম বর্ষণ। সাগরে চার নাম্বার বিপদ সংকেত। বর্ষণে আর ঝড়ের হাওয়ায় পদ্মা উত্তাল। এই অবসরে হরেনের ঘরের দাওয়ায় অসিত, বাসেত, দুগগা, কুদ্দুস, মোখলেস, নরেন আড্ডারত। তাহারা একই নৌকায় ইলিশ শিকার করে। আকস্মাত অসিত বায়না ধরিয়া বসে-
: বাসেত কাহা, চলো ক’টা মাছ মারি লইয়ে আসি..
: কি রে অসিত! পাগল হইয়েছিস! এই উথালপাথাল পদ্মায় মাছ মারিবো কিবায়!
: ক্যানে! সমিস্যা কি!!
: একে সিগনিল, তাইর মইদ্যে মাছ তো গাঙের নিচে চইলে গেছে..
: চলো কাহা, মন কইছে মাছ আজ পাবোই, ঘরের মানুষগুলানরে আইজ পরাণভরি ইলিশ খাওবো, বুইঝলে!
: হ রে অসিত, এবার এত্তো ইলিশ ধইরলাম, বাড়ির গ্যাদা ছাওয়াল-পাওয়ালগো খাওয়াতি পাইরলাম না। কি কপাল নিয়া যে জন্মাইলাম!

কপালের চিন্তায় মেঘময় আকাশের সকল বিষন্নতা যেন তাহাদের মুখ চাপিয়া ধরে, আড্ডা জুড়িয়া নিখাদ নীরবতা নামিয়া আসে।

২.
ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পদ্মার প্রমত্ত ঢেউয়ে হারাণের নৌকা দুলিতেছে। জাল ফেলা হইয়াছে। বৃদ্ধ হারাণ বৃষ্টিকে আড়াল করিয়া বিড়ি ধরায়, লম্বা একটা সুখটান দিয়া অট্টহাসিতে ফাটিয়া পড়ে–
: হোহোহোহোহো! ভাইবে দেইখলাম আমরাও ইলিশ মাছ। মহাজনের দাদনের জাল আমাগের টাইনে টাইনে তুলে…

বাসেত হাসিয়া বলে-
: তা যা কইয়েছো কাহা! তুমি দেইখছি পণ্ডিত হইয়ে গেছো–

হারাণ উন্মাদের মতন হাসিতে হাসিতে চিৎকার করিয়া কহে-
: পণ্ডিতির দেইখিছিস কি! আমি জানিনা ভাইবেছিস! দুইন্যাতে জাত হইলো দুইটা- মহাজন আর হরিজন, ইলিশ আর ইলিশ শিকারী.. আর কুনু জাত নাই, পাত নাই, ধম্ম নাই…

হারাণের কথায় নৌকায় হাসির হুল্লোড় পরিয়া যায়। তাহারা লক্ষ্য করেনা হারাণের ইলিশ তত্বের কথা শুনিয়া পদ্মার প্রমত্ত ঢেউগুলি লজ্জায়-ক্রোধে- আক্রোশে এক একটা নতুন ঢেউয়ের নিচে ডুবিয়া যায়, মুখ লুকায়।

(খসড়া)

হৃদিগ্রস্থ

কোনো এক চন্দ্রাচ্ছন্ন রাতে
তোমার বাড়ির পথে
সাইকেল চালাতে চালাতে
পৌছে যাবো চাঁদে-

হাওয়ায় রয়ে যাবে-
বেলের টুংটাং
চাকার দাগ
ঘামের ঘ্রাণ
স্পর্শের রং

এরপর প্রতিটা চন্দ্রাচ্ছন্ন রাতে
টুংটাং বেল বাজিয়ে ঘামের ঘ্রাণ
এরপর প্রতিটা চন্দ্রাচ্ছন্ন রাতে
চাকার দাগ এঁকে স্পর্শের রং
গ্রাস করবে তোমায়।

কোনো চন্দ্রাচ্ছন্ন রাতে
তোমার বাড়ির পথে
সাইকেল চালাতে চালাতে
পৌছে যাবো চাঁদে-

এখনই থামাও তুমি
উচ্চতাভীতি আমার আজন্ম অসুখ
মগজ খুলে দেখো, শুকে দেখো বুক।

#হৃদিগ্রস্থ