আবু সাঈদ আহমেদ এর সকল পোস্ট

অকবিতা : সে এক অসহ্য বয়স ছিলো আমাদের

সে এক অসহ্য বয়স ছিলো আমাদের- শরতে কাশফুল নয়, প্রিয় ছিলো পূজোর ছুটি। মণ্ডপে মণ্ডপে ঘোরা, প্রতীমা দর্শন। অনিন্দ্য সুন্দরী কত দেবী, আহা জীবন্ত। বুকের ভেতর মোচর, মনের আকাশ জুড়ে প্রেমমেঘ, শর্তহীন সমর্পণের আরতি পাঠ।

সে এক অসহ্য বয়স ছিলো আমাদের- ঈদের নামাজ শেষে কদমবুসি। এরপর কোনো এক শাদা দোতালা বাড়ি বা হলুদ দালানের পাশে ঈদ। যদি তারে দেখা যায় জানলায় এক পলক। যদি দুপুরের কড়া রোদে হেসে ওঠে চাঁদ। “আজ ভুলে যা তোর দোস্ত দুশমন/হাত মেলা হাতে” দর্শনে অপার বিশ্বাস ও আস্থা এনে তার হাত স্পর্শের গাঢ় প্রতিজ্ঞা আমাদেরই। প্রতিজ্ঞার মুখোমুখি সব দুষমন প্রেমিকার ছোটো বড় সব ভাই- আমাদেরই সম্ভাব্য শালা-সমুন্দী সকল।

সে এক অসহ্য বয়স ছিলো আমাদের- পৃথিবীর যত প্রেম, পৃথিবীর যত বিরহ, পৃথিবীর যত বিচ্ছেদ, যত নিদ্রা ও নিদ্রাহীনতা, যত জীবনানন্দ দাশ আর কারো নয়, শুধু আমাদের। পরীক্ষার ফল দেখে যত উচ্ছাস ও হতাশা সব আমাদের। সরল অঙ্ক, ইংরেজী ব্যাকরণ আর জ্যামিতির যত বিরক্তি সেও আমাদেরই।

সে এক অসহ্য বয়স ছিলো আমাদের- শোক আর দ্রোহ মিলেমিশে একাকার। “আমার ভাই মরলো কেনো, খুনী এরশাদ জবাব চাই” শ্লোগানে শ্লোগানে, “এরশাদ তুই স্বৈরাচার, এই মুহুর্তে গদি ছাড়” দাবীতে দাবীতে, “স্বৈরাচারের কালো হাত, ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও”, মিছিলে মিছিলে মুষ্টিবদ্ধ সব হাত আমাদের, রাজপথে অক্লান্ত সব পদছাপ আমাদের।

সে এক অসহ্য বয়স ছিলো আমাদের- পুলিশের লাঠির বাড়ি খেয়ে দু’দিনের অসহ্য যন্ত্রণা সয়ে ফের মিছিলে মিছিলে যত মুখ সব আমাদের, যত কণ্ঠ সব আমাদের। সব ক্রোধ ও জেদ নিম্নচাপের মত ঘণীভূত – “স্বৈরাচারের আস্তানা ভেঙে দাও, গুড়িয়ে দাও” এবং একদিন পৃথিবীর আয়ুর সমান উল্লাস জুড়ে “এইমাত্র খবর এলো, খুনী এরশাদ পালিয়ে গেলো”।

সে এক অসহ্য বয়স ছিলো আমাদের- শরীরে ধরেছে জরা, মনে ভয়, মগজে গুণগুণায় আতঙ্ক- শামুকের মত ঢুকে পরো খোলসে, নিরাপদে থাকো। শুধু বয়সটাই বাড়লো না- অসহ্য বয়স, আমাদেরই অসহ্য বয়স।

অকবিতা ২

আমাদের এই নিস্তরঙ্গ জীবন হতে চলো পালাই, চলো ফের লং ড্রাইভে যাই। আলমারিতে রেখে যাই সকল উত্তাপহীন স্পর্শ, বিমর্ষ চুম্বন, মেয়াদত্তীর্ণ আলিঙ্গন। আলমারিতে রেখে যাই- স্মৃতি ও বিস্মৃতি, প্রণয় ও বিভ্রম, পিতার ওম ওম চাদর এবং মায়ের শাসন।

এক্সেলেটারে চাপ, স্পিডমিটারে উদ্দাম কাটা- ৮০.. ১০০… ১২০..১৪০.. ১৬০..। আমাদের সব ‘দুজনে দেখা হলো মধুযামিনীতে”… আমাদের সব “জানি জানি তুমি এসেছো এ পথে মনেরও ভুলে”… আমাদের ক্রন্দন জুড়ে ‘আর তো হলো না দেখা জগতে দোহে একা…।”

পথ যায়না কোথাও, পথ স্থির। বৃক্ষ বেড়ে ওঠে একা, সাবলীল। শুধু আমাদের চাই পেরুনোর পথ, পথের শেষ। আমাদের চাই বেড়ে ওঠা, বড় হবার তাগিদ। আমাদের চাই প্রতিদিন নতুন রোদ, জোছনার আস্তরণ। সব চাওয়া জুড়ে সময় বাজায় হাহাকার।

আমাদের এই নিস্তরঙ্গ জীবন হতে চলো পালাই, চলো ফের লং ড্রাইভে যাই, যদিও জানি আলমারির তালা ভেঙে ছায়ার মত সাথে সাথে আসবে সব, আসুক। পালানো যখন মূল লক্ষ্য- চলো সম্মিলিতভাবে পালাই। আলগোছে রেখে যাই সংঘাত, রাষ্ট্রের সকল অসভ্যতা ও সন্ত্রাস।

রাষ্ট্রের মৃত্যুতে শোক করার ঢের লোক আছে, আমাদের কেউ নেই, চলো পালাই।

শরমিন্দা

নান্টু মিয়া যে কারণে ফের লুঙ্গি পরতে শুরু করলো, তা সরল হলেও বিশ্বাসযোগ্য নয়।

ঝলমলে এই রাজধানীতে নান্টু মিয়ার পদার্পণ দুই দশক আগে। তখন তার ঘরবাড়ি নেই, আত্মীয় পরিজন নেই। বউ পালিয়েছে মামাতো ভায়ের সাথে। সংসারের প্রতি আগ্রহ নেই, মানুষের প্রতি আস্থা হারিয়েছে এরও আগে। সে জানেনা এখানে মানুষ মানেই শহর।

একটা মাত্র ছেড়া গেঞ্জি আর তাপ্পি মারা লুঙ্গি সম্বল করে শহরে আসা, মরার আগে শেষবারের মত বাঁচাতে শুরু করা। বাস্তবতা ও পরিস্থিতির মত দ্রুত শিক্ষণ পদ্ধতি আর নেই। দশ দিনের সময়কালেই নান্টু শিখেছিলো বিনা পূঁজিতে ভিক্ষার প্রাথমিক জ্ঞান। পরবর্তী বিশ দিনের ভেতর শিখে নিয়েছিলো ভিক্ষাবিদ্যার ছলাকলা আর আয় বৃদ্ধির কৌশল।

শহরবাসীর হৃদয় যতটা লাজহীন চোখ ততটা নয়। যে ভিক্ষা দেয়না, যে ভিক্ষার বদলে শুধু উপদেশ দেয়, সেও ন্যাংটো ফকিরের একটি লুঙ্গি কেনার আহাজারিতে সাড়া দেয়। একটি লুঙ্গি দানের সামর্থ্য না থাকার গ্লানিতে জর্জরিত মানুষ অনায়াসে দশ/বিশ টাকা ভিক্ষা দেয়। এ শহরের মানুষ একে অপরকে কাপড় খুলে নগ্ন করতে ভালোবাসে বটে, তবে আক্ষরিক অর্থেই কাউকে নগ্ন দেখলে সহ্য করতে পারে না। লজ্জায় কাবু হয়, অপরাধ বোধে ভোগে। মাত্র একমাসের অভিজ্ঞতায় এসব জেনেছে নান্টু।

নান্টুর এ জগতে কেউ নেই, তার উদোম হবার প্রতিবন্ধকতা শুধু আত্মলজ্জা আর সংস্কারের দাসত্ববোধ। কিন্তু পেট যখন ক্ষুধামগ্ন, শূন্যহাত যখন ভিক্ষা পাবার আশায় মেলে দেওয়া, যখন সমান খাটুনিতে তিনগুণ আয়ের হাতছানি তখন ন্যাংটো হওয়ার জন্য সাহসের প্রয়োজন হয়না, প্রয়োজন হয় পেশা ও পেটের প্রতি দায়বদ্ধতা। পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে নান্টুর ঘাটতি নেই, ছিলো না।

প্রতিদিন সকালে সচিবরা যেমন করে ড্রেসকোড মেনে স্যুট পরে অফিসে যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ব্যাজ লাগিয়ে দায়িত্ব পালন করে, নার্সরা শাদা থান পরে হাসপাতালে সেবা বিক্রি করে তেমনই নান্টু কাপড় খুলে গায়ে কিছু মাটি মেখে পেশাগত দায়িত্বপালনে বেরিয়ে পরে। তার নগদ আয় রোজগার ভালোই হয়। রোজই কেউ না কেউ লুঙ্গি কিনে দেয়। সৌভাগ্যের এক একদিন তো পাঁচ’ছটা লুঙ্গিও জুটে যায়। দোকানে ওইসব লুঙ্গি অর্ধেক দামে বিক্রি করলে নগদ ভিক্ষার সাথে বোনাস লাভ মিলেমিশে একাকার।

প্রথম ক’টা দিন নান্টুর খুব লজ্জা করছিলো। মনে হতো কোটি কোটি চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখগুলো হাসছে, টিটকারি মারছে। অবশ্য দিনে দিনে লজ্জা কেটে গেছে। ক্যাশ টাকা, মফস্বলে ছয় শতাংশ জমির ওপর টিনশেড বাড়ি, তিন তিনটে স্ত্রী, চায়ের টং দোকান – এসবই ন্যাংটো হবার অবদান। ন্যাংটো হয়ে হাত পাততে শেখার দিন থেকেই উন্নয়নের শুরু।

দুই দশক ধরে ন্যাংটো থাকায় অভ্যস্ত নান্টুর দিনের আলোয় লুঙ্গি পরতে খুব অস্বস্তি হচ্ছে; যেনো দুনিয়ার সকল লোক লুঙ্গির দিকে তাকিয়ে আছে। সে গুটিসুটি মেরে নুরুর চায়ের দোকানে বসে। চা বানাতে বানাতে নুরু বারবার নান্টুর চেহারার দিকে তাকায়, লুঙ্গির দিকেও তাকায়। নান্টু সঙ্কোচে মূহ্যমান, নুরুর ঠোঁটে কৌতূহলের হাসি।

“কাঙ্গালের পো, তুই লুঙ্গি পিনছোছ ক্যান- নুরুর এমন প্রশ্নে নান্টু বিব্রত হয়। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে, “আমার চক্ষুটা মনে লয় বালা নাই, চাইরদিকে খালি ল্যাংটা মানুষ দেহি। শহরের সব মানুষরে ল্যাংটা দেহি। আমার শরম করে।”

নান্টুর স্বীকারোক্তি সরল হলেও বিশ্বাসযোগ্য নয়, ও যে ফের লুঙ্গি পরতে শুরু করেছে!

তুচ্ছ

“প্রিয় ছোটমামা,
ফাগুন মাস আসতে আরো দুদিন বাকী। আমার মেসের পাশে মাঠ। সেই মাঠে এক ঝাকড়া বটগাছ। গাঢ় ভোরে কোকিল ডাকতে শুরু করেছে।

আজ সকালের নাশতায় পরোটা আর মাংসের ঝাল ঝোল হলে বেশ হত। কিন্তু কপালে আছে এক কাপ চা আর একটা দুই টাকা দামের বিস্কুট। শক্ত বিস্কুট চায়ে ডুবাতেই নরম, আহ্লাদে গদগদ।

শীতে ছুটির দুপুরে মা টমেটু-ধনেপাতা কুচি আর সরষা তেল দিয়ে গরম ভাত মাখিয়ে দিতেন। মাঝে মাঝে ঘি চিনি দিয়ে। মেসের টানাটানির জীবনে সরষা তেল আর ঘি চিনিরা হারিয়ে গেছে। বেকারের কপালে মায়ের দোয়া থাকে, সাধ্যের অক্ষমতায় আদর পালায়। মা আদরকে ধরার চেষ্টা করে যান। ফজরের ওয়াক্তে ঘুম ভেংগে গেলে আজও আব্বার কোরান পাঠের সুর শুনতে পাই। সেই কবে সকল পাঠের দায় চুকিয়ে আব্বা ঘুমিয়ে গেছেন। তবু তিনি এই মেসে ফজরের ওয়াক্তে আসেন। মা-বাবারা এতো ভালো হন কেন!

আজ বহুদূর যেতে হবে। বহুদূর। শেভ করতে হবে। তমা একটা শেভিং কিট দিয়েছিল। দামী ব্রান্ড। সম্পক ভেংগে গেছে, শেভিং কিট ভাংগে নাই। তমার ব্রান্ডটা জানার আগেই তাকে হারিয়ে ফেলেছি, হারিয়ে গেছে। খুব লক্ষী মেয়ে ছিল, মায়াবতী। আজ যাত্রার আগে লম্বা সময় ধরে গোছল করে নিবো।

কাল নতুন সকাল আসবে। চায়ে ভিজানো বিস্কুটের মত নরম, আহ্লাদী। কিন্তু আমি আজই যাবো। বহুদূরের পথ। অবশ্য তেমন তাড়া নেই। কাল গেলও হয়। কিন্তু যেতে যখন হবে, তারাতারি যাওয়াই ভালো।

-সজল হাওলাদার”

মডেল থানার ওসি ক্রসফায়ারে নিহত যুবকের পকেটে চিঠিটা পেয়েছেন। এটাকে দিব্যি সুসাইড নোট হিসাবে চালিয়ে দেয়া যায়। ছেলেটা দোষী কি নির্দোষ তা প্রমানের ঝক্কি নাই। কিন্তু তিনি বারবার চিঠিটা পড়ে গভীর কষ্টে নিমজ্জিত হচ্ছেন। বহুদিন পরে একটা আকূল কান্না দলা পাকিয়ে তার গলার কাছে এসে আটকে যাচ্ছে। অজ্ঞাত লাশের বিবর্ণ চেহারার দিকে তাকালেই ভেসে উঠছে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নিজের ছেলের অভিমানমিশ্রিত আত্নভোলা আদুরে মুখ।

এক একটা এমন ছন্নছাড়া দিনে ওসির ইউনিফর্মের ভিতরে সবকিছু তুচ্ছ করে জেগে উঠেন সার্বজনীন পিতা।

সাধশাস্ত্র

একদিন সব প্রজাপতি সাদা ছিলো। তারা সাদা ফুলের মধু খেত। সাদা ফুলের বাগানে ঘুরে বেড়াত। তাদের জীবন ছিলো সাদায় সাদায় ভরপুর।

একবার একদল সাধারণ প্রজাপতি রাজদরবারে পণ্ডিতদের মুখোমুখি হলো-
: আমরা নীল রংয়ের ফুলের মধু পান করিনা কেনো?
: শাস্ত্রে নিষেধ আছে, নীল কষ্টের রং।
: আমরা হলুদ রংয়ের ফুলের মধু পান করিনা কেনো?
: শাস্ত্রে নিষেধ আছে, হলুদ জীর্ণতার রং।
: আমরা লাল রংয়ের ফুলের মধু পান করিনা কেনো?
: শাস্ত্রে নিষেধ আছে, লাল বিদ্রোহ আর রক্তের রং।
: আমরা বেগুনী, গোলাপী, আকাশী রংয়ের ফুলের মধু পান করিনা কেনো?
: শাস্ত্রে নিষেধ আছে। আমাদের প্রপিতারা পান করেন নাই। আমাদের পিতারা পান করেন নাই। আমরা পান করি নাই। তোমরাও করবে না, করবেনা, করবেনা।

কিছুদিন পরে রাজ্যে দূর্যোগের ঘনঘটা দেখা দিল। তরুন প্রজাপতির দল শাস্ত্র অমান্য করে রংগীন ফুলের মধু পান করেছে। তাদের সাদা সাদা পাখায় দেখা দিয়েছে লাল, নীল, হলুদ, গোলাপী, বেগুনী নানা বর্ণের ছটা। শাস্ত্র লংঘনের শাস্তি কখনো সামান্য হয় না। শাস্ত্রের অন্ধ অভিশাপে সকল প্রজাপতি কুৎসিত শুয়োপোকা হয়ে যায়।

অভিশপ্ত শুয়োপোকাদের সাধ জাগে বর্ণিল পাখার একটা প্রজাপতি জীবনের। সাধ পুরণের দূর্বার আকাংখায় তারা ঝাপিয়ে পরে দীর্ঘ সংগ্রামে। একদিন ঠিক ঠিক শিখে নেয় প্রজাপতির রংগীন জীবন লাভের বিদ্যা। সেই থেকে অভিশাপকে পরাজিত করে প্রতিটা শুয়োপোকাই হয়ে উঠে প্রজাপতি, বাতাসে মেলে দেয় বর্ণিল পাখা।

ধাবমান

‘জংশন পড়ে থাকে জংশনে, ট্রেন চলে যায়’- এটা গল্পের শেষ লাইন। আসিফ কিছুতেই গল্পের শুরুর লাইনটা খুজে পাচ্ছে না। এক অসহ্য অস্বস্তিকর অবস্থা।

লিলুয়াপুর রেলস্টেশনে তাজুল মিয়া বাদাম বেচে। ট্রেন এসে থামলেই লাফিয়ে উঠে। বগি থেকে বগিতে ভীড় ঠেলে ঠেলে ‘এই বাদাম এই বাদাম’ বলে হেটে যায়। ট্রেন ছাড়বার আগেই নেমে পড়ে। স্টেশনের একপাশে বসে জিরোয়। বিড়ি ফুকে। নদীতে ভেঙ্গে যাওয়া বসত ভিটার স্মৃতি চিবায়।

বৃদ্ধ নুর আলী গত পনেরো বছর ধরে প্রতিদিন ভোরে স্টেশনের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় দাড়িয়ে ছলোছলো চোখে কোরান পাঠ করেন। বিশ বছরের জোয়ান ছেলে আত্নহত্যা করেছিল কেনো তিনি জানেন না। কি অভিমান পুষে রেখেছিল বিশ বছরের সুঠাম বুকে আর কখনো জানা হবেনা।

স্টেশনের বারান্দায় রমিজা বানুর পিঠার দোকান। সকাল ছয়টা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত ক্লান্তিহীন পিঠা বানান আর বেচেন। স্বামী ট্রেনের কুলি, আরেকটা বিয়ে করেছে। তবু এক একটা উথাল পাথাল দীঘল মাঝরাতে রমিজার ঘরে হানা দেয়।

সোহেল মেধাবী ছাত্র ছিল। সেই কবেকার কথা। এখন স্টেশনে মাদকের দালাল। বাপ-মা তাকে নিত্য অভিশাপ দেয়, আর সে বাজার না করলে না খেয়ে থাকেন। ফেন্‌সি খেলে তার মাথার ভিতরে স্কুলের আফজাল স্যার বেত নিয়ে তাড়া করেন আর বলেন, ‘অংকটা ঠিক মতন করতে না পারলে মইরা যাওন ভালো।’ তার দৌড় দেখে মাথার ভিতরেই ক্লাশ নাইনের শ্যামলী খিলখিল করে হাসে।

তাজুল মিয়া, নুর আলি, রমিজা বানু, সোহেল, আফজাল স্যার, শ্যামলী-যে কাউকে নিয়েই গল্পটা লেখা যায়। কিন্তু সে প্রথম লাইনটা লিখতে পারছেনা। ফাগুনের মায়াময় রোদ, নরম বাতাস আর গল্পের শেষ লাইন তাকে আচ্ছন্ন করে, গ্রাস করে, এক ঘোরের জগতে নিয়ে যায়। দূর থেকে ধেয়ে আসা ট্রেনের হুইসেলের শব্দ তার আচ্ছন্নতা কাটাতে পারছেনা। অথচ আচ্ছন্নতা কাটাটা খুব জরুরী। আসিফের অনেকগুলো গল্প লেখা বাকী, অনেকগুলো আচ্ছন্নতা বাকী, অনেকগুলো নিমজ্জন ও সন্তরন বাকী। প্রতিদিনের মত তার মা দুপুরে একসাথে খাবেন বলে অপেক্ষায় আছেন, উনার অপেক্ষার অবসান হওয়া বাকী।

রোদতলী জংশন ধরে আচ্ছন্ন আসিফ হাটছে। পিছন থেকে ধেয়ে আসছে ট্রেন। তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে হুইসেলের শব্দ কু…উ…উ…উ…উ… কুউউউউ…উ…উ…উ…উ।

অকবিতা

তোমার দুচোখে মেঘের জমাট খুব
বৃষ্টি নামবে বুঝি!
স্মৃতির ভিটায় একলা ঘুঘুর ডুব
তৃষ্ণার জল খুঁজি।

মাথার ভিতর একটা গীর্জা আছে
ঘণ্টা বাজে উদাস,
গহন দহন পুড়ছে বুকের কাছে
দাবানলের ফাঁস,
তোমার দুচোখে মেঘরা জমেছে ঘণ
বৃষ্টি নামুক খুব,
বিরাণ ভিটায় একলা ঘুঘুর মন
তোমাতে দিক ডুব।

শ্রাবণ নামুক তোমার দুচোখে আজ
নিপাট কারুকাজে,
জমাট মেঘের গভীর চুমুর ভাঁজ
ভাঙুক চারুলাজে।
মেঘের দুচোখে তোমার সরল মন
দিচ্ছে গভীর ডুব,
আমার মনের ভিটায় গাঢ় প্লাবন
বৃষ্টি নেমেছে খুব।

সাঈদের তিনটা অকবিতা… আজ প্রথম ভাগ

বিস্তার

দিনগুলো দীর্ঘ আর রাতগুলো দীর্ঘতম — তুমিহীন। পাবো না জেনেই কী প্রবলভাবে তোমাকে চাইছি — আত্না আর হৃদপিণ্ডের বিনিময়ে ! কিলবিল শুয়োপোকা যতটা চায় প্রজাপতি জীবন, অাষ্টেপৃষ্ঠে স্বেচ্ছাবন্দী শক্ত খোলসের ভিতর ঘুমঘুম মৃত্যুতে – মরে আছি। আর, মুক্তো ! সে তো ঝিনুকের অনারোগ্য ব্যাধি– আমিও আরোগ্যহীন। পাঁজরে একটা মুক্তো বড় হচ্ছে – তোমার নখ রঙা কোমল রঙিন।

প্রজাপতি ডানায় মুক্তোর কারুচিঠি পাঠাবো তোমায়। পাবোনা জেনেও তোমাকেই শুধু চাই। যদি পাই, তবে মাস্তুলে পাল; ঝলসানো চাঁদের রাতে যৌথ সমুদ্রযাত্রা। আর, যদি না পাই, তবে পাথরজীবন।

তুমি জানবে না কখনো পাথর জলের সন্তান অশ্রুর পুত্র। জানবে না — তোমার প্রতি যে ভালোবাসা, তার শুরু নেই, শেষ নেই, শুধুই অনন্ত বিস্তার।

আকাংখা

স্কুলে ক্লাশ শুরুর ঘন্টা বাজছে। দ্বিজেন স্যার আসছেন। নানাবাড়ির উঠোন শিউলে ফুলে সাদা। আব্বা প্রখর রোদে ঘামে ভিজে ঘরে ফিরেছেন। বৃষ্টি হচ্ছে। টিনের চাল বেয়ে পানির ঢল। বারান্দার হাঠু পানিতে তিনটা পাতি হাস প্যাক… প্যাক… প্যাক। হলুদ ঘুরিটা ভোকাট্টা হয়ে গেলো। আদিগন্ত সবুজ মাঠ। সরষে ক্ষেতের আইল। ফজরের নামাজ শেষে দোয়া পড়ে মা বুকে ফু দিয়ে দিচ্ছেন। নরম নরম রোদ। কলাই শাকের বাগান। ড্রইং খাতায় নীল রংগের পাখি। পঞ্চাশ পয়সার ছয়টা কয়েন। একমুঠ মারবেল। বেনী দুলিয়ে হাসছে এক কিশোরী, তার নাম যেন কি! -বুকের ভিতরে ঘাই। লাইন সুপার ভাইজার বকছেন। ট্রাকসেলে চালের কেজি ২৮টাকা। মেশিন চলছে ঘটঘটঘটঘট। লাট্টুটা ঝিম ধরে ঘুরছে… ঘুরছে… ঘুরছে। একটা এপেন্ডিকসের অপারেশনের খরচ চার মাসের বেতনের সমান। জানালার গ্রীলে দুইটা চড়ুই কিচিরমিচির… কিচিরমিচির। কাচামরিচ নুন দিয়ে মাখানো হলুদ কামরাংগা। কুচো চিংড়ি দিয়ে করল্লা ভাজি। ঢিল ছুড়তেই পুকুরের জলে আলোড়ন, বৃত্ত বড় হচ্ছে… বড় হচ্ছে… বড় হচ্ছে….

এনেস্থেসিয়া দেয়া হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে অপারেশন শুরু হবে। আসলাম এই এনেস্থেসিয়ার ঘোরেই কাটিয়ে দিতে চাইছে বাকিটা জীবন। সে জানে না বেচে থাকা ছাড়া কোনো নেশাই স্থায়ী নয়, মৃত্যু ছাড়া কোনো ঘোরই দীর্ঘ নয়।

অণুগল্প : রুই

মাইকে ঘোষণাটি শুরু হতেই মুহুর্তেরও কম সময়ের জন্য নীরবতা নেমে এসে মিলিয়ে গেলো, সবার মনযোগ কেন্দ্রীভূত হলো কানে।

ফজল দাঁড়িয়ে আছে রফিকের সব্জীর দোকানে। ছেলেবেলার বন্ধু, তবে বহু আগেই দু’জনার দু’টি পথ গেছে বেঁকে। ফজল এক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। বেতনের থেকে ভাব বেশী। রফিকের স্বাধীন ব্যবসা, ভাব থেকে আয় বেশী, চিন্তাও বেশী।

আজকাল জ্যান্ত রুই বিক্রি হয় মাছ বাজারে। মাছগুলো হাঁপানি রোগীর মত শ্বাস টানে। মাঝে মাঝে লেজ ঝাপটায়। এক একবার শরীরের সকল শক্তি একত্রিত করে জলে ছুটে যাবার জন্য লাফিয়ে ওঠে। জলে যাওয়া হয়না, মাছওয়ালার এলুমিনিয়ামের থালাতেই ফের আছড়ে পরে। মাছদের জানা নেই মৃত্যু অমোঘ, মৃত্যু অনিবার্য সত্য, মৃত্যুই চিরমুক্তি হোক তা জলে বা ডাঙায়। ফজল এমনই এক জ্যান্ত রুই কিনেছে। ফজলের ভোজ, রুইয়ের চিরমুক্তি।

আলু, বেগুন আর টমেটো কেনার জন্যই রফিকের দোকানে আসা। রুই দিয়ে আলু, বেগুন, টমেটোর তরকারি যেনো অমৃত। তবে ফজল বিভ্রান্ত। আশ্বিনের শুরুতেই বাজারে উঠেছে শীতের সবজি- সতেজ সিম, ছোটো ফুলকপি, মাঝারি বাঁধাকপি, টসটসে টমেটো। রুই মাছ দিয়ে আলু- ফুলকপি না আলু-সিম- টমেটো দিয়ে রান্না হবে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।

ফজলের বিভ্রান্তি দূর হবার আগেই ঘোষণাটি শুরু হলো। পুরো বাজারে মুহুর্তেরও কম সময়ের জন্য নীরবতা নেমে এসে মিলিয়ে গেলো, সবার মনযোগ কেন্দ্রীভূত হলো কানে। মহল্লার মসজিদের মাইক হতে ভেসে আসছে মোয়াজ্জিনের কণ্ঠ- “একটি শোক সংবাদ। একটি শোক সংবাদ। আমাদের মহল্লার মরহুম রমজান হাজির মেঝো ছেলে ফজলুল হক ফজল আজ সকালে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজেউন। মরহুমের নামাজে জানাজা আজ বাদ আসর বায়তুল আকবর জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হবে। একটি শোক সংবাদ.. একটি শোক সংবাদ.. আমাদের মহল্লার….।

রফিক অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফজলের দিকে। শুধু রফিক নয়, মহল্লার বাজার বলেই বহু পরিচিত চোখ ফজলের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ফজলের খুব অস্বস্তি হচ্ছে। লজ্জায় মাথা নিচু করে রেখেছে। বেঁচে থাকার জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে, একছুটে পালিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু পা নড়ছে না। রফিক দোকান ছেড়ে বাইরে এসে ফজলকে রিকশায় তুলে দিয়ে বলে, “জলদি বাড়িতে যা, দেখ ঘটনাটা কি। জলদি যা।”

রিকশায় মাথা নিচু করে বসে আছে ফজল। অস্বস্তি হচ্ছে- কেউ না থাকে জীবন্ত অবস্থায় দেখে ফেলে। মহল্লার সীমানা হতে বেরিয়ে এসে সংকোচে মাথা তুলে তাকায়- না, এখানে পরিচিত কেউ নেই। রিকশা বদলে নতুন রিকশায় উঠে বলে- ‘চলো, সামনে যেতে থাকো।’

কোথায় যাবে জানেনা, বাড়িতে ফেরা যাবেনা। সত্যিই যদি সে মরে গিয়ে থাকে তবে তার লাশের পাশে বসে কান্না করছেন মা। রুমু নিশ্চয় জ্ঞান হারাচ্ছে বারবার। আত্মীয় স্বজনরা আসতে শুরু করেছে। ছোটো ভাই বিষাদভরা মুখে দাফনের দায়দায়িত্ব আর আত্মীয়দের আপ্যায়ন তদারকি করছে। ইতোমধ্যে সে কতটা ভালো ছিলো বা ছিলোনা- ওই আলোচনা আর স্মৃতিরোমন্থন চলছে। নাজিয়া কি খবর পেয়েছে-! কি যে প্রেম ছিলো। বেকারের সাথে বিয়ে দেবে না বলে ডেটল খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলো। এখন সুখে টইটুম্বুর। ওর চোখেও হয়তো জল- ব্যর্থ প্রেমিকের জন্য নয়, প্রেমের জন্য। অথবা সবাই প্রতিক্রিয়াহীন। এখন জীবন্ত অবস্থায় হাজির হলে সবাইকে কি বিতিকিচ্ছিরি একটা অবস্থা ফেলা হবে- ভাবতেই তার লজ্জা লাগছে।

রিকশা ছুটছে। কোথায় যাবে জানেনা ফজল। বাজারের থলিতে ঘাই মারছে রুই।

আদমপোড়া

রুনুর মা সাধারণ মানুষ। অতি সাধারণ। বাড়ি উত্তরবঙ্গে। জীবন ফেরাতে ঢাকায় এসেছিলেন। গৃহকর্মীর কাজ করতেন। দিনমজুর স্বামী, শিশুপুত্র আর কিশোরী কন্যাকে নিয়ে শহরের এক ঝুপড়ি বস্তিতে প্রশ্নহীন ভালো ছিলেন। শস্তা স্কুলে পড়ুয়া ছেলে মেয়েকে ঘিরে দিনবদলের দামী স্বপ্ন দেখেছিলেন।

আমাদের দেশপ্রেমিক নেতারা সর্দি হলেও চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর আমেরিকায় যান। তিনি ঢাকা শহরের সাধারণ হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যায় চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। তাই উপজেলার এনজিওর এক হাসপাতালে গিয়েছিলেন। যদিও উন্নয়নের জোয়ারে নেতার মত তারও বার্ষিক গড় আয় সরকারি হিসাবে হাজার ডলার।

রুটিরুজির জীবন ঢাকায় বাঁধা। তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ঢাকায় যাত্রা করেছিলেন। সাথে দিনমজুর স্বামী আর পুত্র কন্যা। মেহনতী মানুষের গাদাগাদি ভীড়ে বাসের পেট ভরে গিয়েছিল। ৬০টা অতি সাধারণ নিম্নবিত্ত পরিবারের স্বপ্ন, আশা, দ্রোহ, লড়াই, প্রেম, ভালোবাসা, ক্ষোভ আর সব কিছুকে তুচ্ছ করে বেচে থাকার প্রতিদিনের লড়াইকে বোঝাই করে ছুটেছিলো ৫২ সিটের বাস।

হঠাৎ বাসের ভিতরে পেট্রোল বোমা। দাউদাউ আগুন। চিৎকার, আহাজারী, কাতরানি। ঝলসে যাচ্ছিল সব। পুড়ে যাচ্ছিল সব। শীতের বাতাসে হুহু করে ছড়িয়ে পড়ছিলো মানুষের মাংস পোড়ার গন্ধ। বাসের ভিতরে পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিলেন রুনুর মা আর তার শিশু পুত্র। রুনু মারা যায় পরের দিন বিকালে। দিনমজুর স্বামী বেচে থাকার জন্য মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছিলেন কিনা জানিনা। তবে চারদিন পরে মৃত্যু তাকে স্ত্রী পুত্রকন্যার কাছে পৌছে দিয়েছিল।

এসকল মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। তারা বেঁচে থাকতে পারে নাই এটা তাদের ব্যর্থতা। হয়তো তারা কখনোই বেচে ছিলোনা।

একা

দুটি অণুগল্প শাহবাগ থেকে বইমেলার দিকে হেটে যাচ্ছিলো। তাদের পিছনে পিছনে একটা পরাজিত অণুশব্দ। তিনজনে পাবলিক লাইব্রেরির গেটে থামে। ভাপা পিঠা আর চা খায়। তারপর কথা বলতে বলতে বইমেলার দিকে ছুটে যায়।

বইমেলায় দুই অণুগল্পের সাথে আরো অনেক অনুগল্প যোগ হয়। অণুগল্পরা যোগ হতে হতে ঢাউস উপন্যাসে পরিনত হয়। তারপর উপন্যাসের অধ্যায়গুলো পরস্পর আড্ডা দেয়। হেসে উঠে। রসিকতা করে। স্টলে স্টলে ঘুরে বেড়ায়। বৈ নেড়েচেড়ে দেখে। বই কিনে। নতুন বইয়ের গন্ধ শুকে। পরাজিত অণুশব্দ নিজেকে উপন্যাসের অধ্যায়গুলোর ছায়ায় ছায়ায় আড়াল করে রাখে।

মেলা ভাংগার আগেই উপন্যাসের অধ্যায়গুলো অস্থির সময়ের আতংক আর দীর্ঘশ্বাস গোপন করে যে যার পথে চলে যেতে শুরু করে। অণুশব্দ যায়না কোথাও, স্থির বসে থাকে। কারন সে জানে দিনশেষে প্রতিটা অণুগল্পই পড়ে ফেলা উপন্যাসের মত একা।

তথ্যবাবা

একদেশে এক দেশ ছিলো। সে দেশের মাননীয় তথ্য মন্ত্রী মহোদয়ের অসম্ভব কাজের চাপ। রাজ্যের সব তথ্য নিয়ে তার কারবার। বিশ্রামের ফুরসত নাই। দুপুরে বিশ্রামের জন্য অফিসেই চোখ মুদেছেন। এক সাংবাদিক দম্পতি উপস্থিত-
: স্যার, আমাদের হত্যাকান্ডের তদন্ত কি কোনো দিন শেষ হবে? -এ তথ্যটা দিন।
: হবে, হবে।
: স্যার, কবে হবে?

মন্ত্রী মহোদয় উত্তর দিবার আগেই রক্তাক্ত অবস্থায় এক সদ্য যুবক উপস্থিত-
:স্যার, আমাকে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে মারার বিচার উচ্চাদালতে কবে শেষ হবে? এই তথ্যটা চাই।

মন্ত্রী উত্তর দিবার আগেই এক কিশোর কাদতে কাদতে হাজির-
: স্যার, আপনার ছাত্র সংগঠনের ছেলারা গুলি করে আমাকে মেরে ফেলেছিলো, তাদের ধরা হয় নাই কেনো? এই তথ্যটা দিতে হবে।

মন্ত্রী উত্তজেতি হয় বললেন-
: আমি জনগনের কাছে তথ্য দিবো, তোমরা কে যে তোমাদের বলতে হবে?

মন্ত্রী মহোদয়ের রুমে গত ছয় বছরে নিহত হওয়া মানুষেরা, দলীয় কোন্দলে নিহত হওয়া কর্মীরা, তাজরিনের পোড়া শ্রমিকেরা, পেট্রোল বোমায় ঝলসানো মানুষেরা, রানা প্লাজায় চাপা পড়া সেলাই শ্রমিকের দল, শেয়ার বাজারে নিঃস্ব হয়ে বেচে থেকে মরে যাওয়া মানুষেরা হাজির হয়ে হাজার হাজার কণ্ঠে শ্লোগান দিতে লাগলো – ‘আমরাই জনগণ আমাদের তথ্য দিতে হবে… আমরাই জনগণ আমাদের তথ্য চাই…. আমরাই জনগণ আমাদের তথ্য দিন….’ জাদরেল মন্ত্রী রেগে ধমকে ওঠার পরিবর্তে ভয়ে কান্না করতে শুরু করলেন। হাপুশ কান্নায় তার গাল, নাক, সাদা পাঞ্জাবী পায়জামা সব ভিজে একাকার।

হঠাত মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতেই মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের তন্দ্রা ছুটে যায়। চোখ মেলে অনুভব করেন এসির ঠান্ডাতেও ঘামে ভিজে জবজব করছেন। সবথেকে ভয়াবহ ব্যাপার হলো দুঃস্বপ্নটা দেখে আজও তিনি পায়জামা ভিজিয়ে ফেলেছেন। ভেজা পায়জামার গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে।

মন্ত্রী মহোদয় পায়জামা শুকাবার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ভাবছেন ইদানিং পায়জামা খুব ঘনঘন ভিজছে- এই ভেজার পিছনে কোনো ষড়যন্ত্র আছে কিনা এই তথ্য তিনি কার কাছে চাইবেন!!

রাষ্ট্রদ্রোহী

: পুলিস বাপু, বুদ্দার বাপকে ছাড়িয়া দে। বাপু, মাতাল মানুষটারে মাফ কারিয়া দে।

: ছাইড়া দিমু? মাফ করুম! হারামজাদার নামে রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা হইবো। নিশ্চিত চৌদ্দ বছরের জেল।

: পুলিস বাপু, দয়া কর। কি কাহিতে কি কাহিছে, মাতালের কি হুশ আছে?

: হুশ নাই! বাইনচোতের বাচ্চা জাতে মাতাল তালে ঠিক। পিটায়া হারামজাদার মুখ বন্দ করাইতে পারলাম না।

: বাপু! হামি এক হাজার টেকা আনছি। তুহারা চা সিরগেট খাবি। ছাড়িয়া দে বাপু।

: এক হাজার টাকা দিয়া কি বাল ছিড়ুম! রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা। পাচ হাজার টাকার কমে ছাড়ন যাইবো না।

: বাপু, হামরা গারীব মানুষ। সারাদিন গান্ধা সাফ করি। এত্তো টেকা কুথায় পাবো রে!

: মদ গিলার টাকা পাও, পুলিশরে দিবার টাকা নাই!

: পুলিস বাপু, তুই হামার বাপ লাগিস। দয়া কর। বুড়া মানুষটারে ছাড়িয়া দে।

: আমিতো ছাড়তেই চাই। টাকা আন ছাইড়া দেই। বুইড়ারে সারা রাইত কনস্টবল আর দারোগা মিলা পিটাইলে সকালে কি জিন্দা থাকবো!

: কি কাহিস বাপু! মারিসনা রে বাপু, দোহাই মারিস না।

: জিন্দা থাকলে কাইল কোর্টে তুলুম। কোর্টে পাচশো টাকা দিয়া উকিল ধরিছ। দেখি উকিলের কোন বাপ চৌদ্দ বছরের জেল ঠেকায়!

বুদ্ধার মা থানার বারান্দার গিয়ে বসেন। উপায়হীনতায় বিমর্ষ। চোখ ছলছল। দশ বিশ টাকা করে জমানো একহাজার টাকা মুঠোর ভিতর শক্ত করে চেপে রাখেন। বয়সী চামড়ার ভাঁজগুলো টানটান হয় আর শীর্ণ হাতের শিরা উপশিরাগুলো ফুলে ওঠে। পাচ হাজার টাকা যোগাড়ের কঠিন হিসাব মিলাতে মগ্ন হন।

লকআপে মার খাওয়া বুদ্দার বাপ মাতাল স্বরে চেচিয়ে চেঁচিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতা করেই যাচ্ছেন, “তুহারা টিভিতে মিনিস্টর দেখিস! মিনিস্টর কুথায়? হামিতো খালি মেনহোল দেখি রে, গান্ধা ভড়া মেনহোল দেখি। মেনহোলের ঢাকনি ফাইটা গান্ধা বাইড়ায়। মাগার হামি মিনিস্টরগো মুখ চোখ নাক কান দিয়া উপসায়া উপসায়া হাজার হাজার মেনহোলের গান্ধা বাইড়াতে দেখি। তাগো সারা শরীর দিয়া গলগল কারিয়া বায়া বায়া গান্ধা পড়ে। হামি হামার সাত্তুর বছরে এতো গান্ধা দেখি নাই। মাগার, পুলিস বাপুগো মুখে গান্ধা নাই, তাগো দাতে মানুষের গোশতো লাইগা আছে, কাচা কাচা গোস্তের টুকরা আর কালা কালা জামাট খুন লাইগা আছে। তুহারা মিনিস্টর দেখিস, মিনস্টর কুথায়? হামি মেনহোল দেখি… মিনিসটারগো চোখে মুখে নাকে কানে মাগজে আর দিলে হাজার হাজার মেনহল দেখি …. গান্ধা ভরা হাজার হাজার মেনহল….”

পদক

মোরশেদকে আটক করেছে পুলিশ। অভিযোগ গাড়িতে ঢিল ছুড়েছে। সে স্বীকার করছে না। এক দফা পিটানো হয়েছে। এখন পুলিশ যা বলছে তাই স্বীকার করে নিচ্ছে।

সন্ধ্যায় ওসি সাহেব ১৫ বছর বয়সী মোরশেদকে নিজের রুমে ডেকে নিলেন। মমতা ভরা গলায় সব জানতে চাইলেন। মোরশেদ জানালো সে মটর পার্টসের দোকানে চাকুরি করে। দুপুরে ম্যানেজারের জন্য হোটেলে ভাত আনতে গিয়েছিলো। সেখান থেকেই পুলিশ তাকে ধরে এনেছে। সে ঢিল ছুড়ে নাই। সে পঙ্গু মা আর ছোট বোনকে নিয়ে বস্তিতে থাকে। বাবা নাই। ওসি সাহেব সব শুনলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। সারাদিন কিছু না খাওয়া মোরশেদকে পাশের হোটেল থেকে কিনে এনে মোরগ পোলাও খাওয়ালেন। রাত এগারোটায় মোরশেদকে বাবার কাছে পৌছে দিতে বেড় হলেন।

পরেরদিন জাতি পত্রিকা আর টিভির কল্যাণে পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে ভয়ংকর পেট্রোল বোমাবাজ মোটর মোরশেদের নিহত হবার সংবাদ জেনেছিল। কিন্তু ক্রাইম রিপোর্টাররা জাতিকে এটা জানালেন না ভালো পোস্টিং আর পদক পাওয়ার ক্ষেত্রে ওসি সাহেব অন্য প্রতিদ্বন্দ্বিদের তুলনায় কতটা এগিয়ে গেলেন।

জাতিকে সবকিছু জানতে নাই, জাতিকে সবকিছু জানাতে নাই।