আবু মকসুদ এর সকল পোস্ট

শ্রীলেখা

2409

শ্রীলেখা উনচল্লিশেও অবিবাহিত
দুবার বিবাহের সম্ভাবনা জেগেছিল
একবার তেইশে; ছেলের পছন্দ হওয়ায়
শ্রীলেখার বাবা-মা হাফ-ছেড়ে বেঁচে ছিল,
শ্রীলেখার পছন্দ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি;
শেষ পর্যন্ত হলো না। কোন বড় ব্যাপারে
বিয়ে ভাঙ্গেনি; খুবই মামুলি ব্যাপার।

বরপক্ষের তেমন কোন আবদার ছিল না
শুধুমাত্র একটা স্কুটার। কৃষি কর্মকর্তা ছেলে
মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে হয়, মাঝে মাঝে
এখানে সেখানে যেতে হয়; একটা স্কুটার
হলে ব্যাপক সুবিধা। মেয়ে অসুন্দর
ব্যাপার না, স্কুটার এই কমতি পুষিয়ে দেবে।

মেয়ের রূপের মত বাবাও বর্ণহীন;
অর্থাৎ দরিদ্র, স্কুটারের টাকা জোগাড় করা
সম্ভব না। স্কুটার বিহীন কন্যায় বরের পোষাবে
না; বিয়ে হলো না। পরেরবার একত্রিশে,

বিপত্নীক বর; পানের বরজ আছে
আয়-রোজগার মন্দ না। বিয়ের সব কথা পাকা,
স্কুটারের বায়না নেই শুধু ঘরের কাজকাম
জানা হলেই ছেলের চলবে। শ্রীলেখা কাজেকামে দক্ষ,
ঘরের সমস্ত কাজ এক হাতেই সেরে ফেলতে পারে।

এ বিয়েও শেষ পর্যন্ত বিয়েতে গড়াল না। বিপত্নীক
মত বদলে ফেলল। কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেল
আরেকটু কম বয়সী সুশ্রী পাত্রী পেয়ে গেছে।

বিয়ের সম্ভাবনা মিটে যাওয়ার শ্রীলেখা ঘরের
কাজের অতিরিক্ত অন্য আজে মনোযোগ দিতে
চেষ্টা করল, মাটি দিয়ে বানানো পুতুল
মানুষের শোকেসের শোভাবর্ধন করতে লাগল।

বছর খানেকের মধ্যে স্কুটারের টাকা জমা
করে ফেলল। স্নো পাউডার অন্যান্য প্রসাধনী
ব্যবহারের ফলে শ্রীলেখার শ্রীহীন রূপে শ্রী ফিরতে
শুরু করল। পাঁচ বছরের মধ্যে আপাত শ্রীহীন শ্রীলেখা
আকর্ষণীয় নারী হিসাবে রূপান্তরিত হল।

ততদিনে বয়স এবং অভিজ্ঞতায় শ্রীলেখা
বুঝতে পারল বিয়েই নারীর জীবনের লক্ষ্য নয়।
উনচল্লিশের শ্রীলেখা আজ একজন সফল নারী
কয়েক ডজন স্কুটার তার উঠানে হাঁটু গেড়ে থাকে,
অসংখ্য সুদর্শন তরুণ আজ তার পাণিপ্রার্থী।

কাজ শেষে প্রতিদিন শ্রীলেখা ঘরে ফিরে, ঘষে ঘষে
মুখ থেকে ফাউন্ডেশন তুলে। আয়নায় নিজেকে
পরখ করে, পুরনো শ্রীলেখা কে খুঁজে;
একটা স্কুটারের অভাবে যার বিয়ে হয়নি।

পরিমণির বৃষ্টি

2374

পরিমণি বৃষ্টিতে ভিজেছিল…
এই ভেজা কাল হয়েছে

অন্য সবাই বৃষ্টিতে হুটোপুটি খায়;
সার্টের বোতাম খুলে

ভিজে জবজব হয়;
তাদের ঘরে বৃষ্টি ছিটেফোঁটা মিলে না।

পরিমণি সুন্দরী; বৃষ্টিতে
মানায় না। ঘোমটা টানা অবলা
নারীর মত ঘরের আসবাব
যদি প্রিয় হত, স্বামীর অবসরে
হাতপাখার বাতাস যদি
প্রিয় হত, ঘরের দেয়ালে
মহৎ সূচীকর্ম যদি
প্রিয় হত, বাথরুমে স্বামীর
আন্ডারপ্যান্ট কাছা যদি প্রিয় হত;
তৃতীয় রিমান্ডের প্রয়োজন
হত না। বৃষ্টিতে স্নাত না হলে
হয়তো নিরাপদ থাকতো।

বৃষ্টি পরিমণির অভিশাপ, না ভিজলেও
জীবন কেটে যেত। পরিমণি হতভাগা
বৃষ্টির জন্য কিছুটা লালায়িত ছিল।

তারা নিয়মিত বৃষ্টিতে স্নান করে,
তাদের জন্য অবশ্য কোন রিমান্ড নেই।

টিকর বাড়ির টিলা কিংবা জিন্দাপীর

‘টিকর বাড়ির টিলা’য় জিন্দা পীরের
মাজার আছে; জাগ্রত পীর। মানতের মহারাজা;
তেত্রিশ বছরের বাজ নারী পীরের
দয়ায় পেয়েছিল মাতৃত্বের স্বাদ।

উনচল্লিশের নপুংসক দ্বিতীয় বিবাহের পরে
তৃতীয় সঙ্গমেও তৃপ্ত, অতৃপ্তির কানাঘুষা
বিবাহের তৃতীয় বছরেও শোনা যায়নি।
সবই পীরের কারসাজি, আঠারো টাকার
মোমবাতি নপুংসক কে পুরোদস্তুর মানবে
রূপান্তরিত করে ফেলেছে।

তালেবুল এলেম পরকীয়ার ফাঁদে পড়েছিল
ধরা পড়ে প্রায় গায়েব হওয়ার যোগার।
পীরের মানতে পরকীয়ার স্বামী খালাস,
‘টিকর বাড়ির টিলা’র কবরে তালেবুল
ঢেলে ছিল শপথের মাটি; প্রেমিকা কে এবার
স্ত্রীর মর্যাদা দিতে ভুল করবে না।

এক বছর আগে যে অন্যের রিক্সায়
ভাড়া খাটত, আজ সে চারখানা রিকশার
মালিক। টং দোকানদার মার্কেটে দোকানের
স্বপ্ন দেখছে। আব্বাস গরু চোর হিসাবে
এলাকায় খ্যাত ছিল; পীরের মহিমায়
সে আজ নির্বাচিত। সবাই সমীহে
আব্বাস মেম্বারের নাম নেয়।

পীরের খ্যাতি দিনদিন বর্ধিত হচ্ছে, শত শত
মানুষ মানতের আশায় মাজারে ধর্না দিচ্ছে।

‘টিকর বাড়ির টিলা’র পীরের মালিক ধনী থেকে
ধনশালী হচ্ছে, এখনই একজোড়া পাজেরোর মালিক।

নতুন লালসালুতে আতর ছড়ানো শেষ হলে
একজোড়া খাসি, সাতটা মোরগ, আড়াই জোড়া
হাঁস, কয়েক ডজন লাউ, কুমড়া, পেপে,
দুইখানা শাড়ি একখানা লুঙী, নগদ উনিশ হাজার
সাইত্রিশ টাকা পাজেরোর উদর ভর্তি করে
পীরের মহিমা গাইতে গাইতে ফিরে যায়।
পীরের আশীর্বাদে তার রোজকার আয় মন্দ না।

কয়েক বছর আগে জিন্দা পীরের অস্তিত্ব ছিল না
স্বপ্নে স্থাপিত পীর এখন ‘টিকর বাড়ির টিলা’র পরিচয়।

‘টিকর বাড়ির টিলা’র জিন্দাপীর, মানতের মহারাজা
‘কেউ ফিরে না খালি হাতে’ বিফলে মূল্য ফেরত।

মানবিক মৃত্যু

পলে পলে মৃত্যুমুখে ধাবিত হচ্ছি;
শরীরের চামড়া ছিলে ফেলছে,
কোটরগত চোখ উপড়ে ফেলছে,
আঙুলের নখ থেঁতলে দিচ্ছে।
বুকের যেখানে হৃদপিণ্ড, সেখানে
আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করছে।

যারা আমাকে অত্যাচার করছে
তারা খুব মানবিক, চাপাতি দিয়ে
কোপাতে কোপাতে আওড়ে যাচ্ছে
মানবিক কবিতা। বিধাতার কাব্য
দিয়ে ন্যায্যতা দিচ্ছে মৃত্যুর।

আমার অপরাধ অতি সামান্য, নিজের
কাছে অপরাধ মনে হয় না।
অতিক্ষুদ্র অপরাধ তাদের
কাছে অসামান্য হয়ে দেখা দিয়েছে।

আমি নিতান্ত ছা-পোষা মানুষ;
কারো সাতে পাঁচে থাকি না। মুখ গুঁজে
নিজ কর্ম করে যাই। প্রতিবেশী আমাকে
ভালো মানুষ হিসেবে জানে। যেচে
কোনদিন ঝগড়া করিনি। তবে কিছুটা
একরোখা, মত প্রকাশে আপসহীন।

আমার অপরাধ খুব গুরুতর নয়;
শুধু মানুষ এবং বিধাতার দ্বন্দ্বে
আমি সবসময় মানুষের পক্ষে দাঁড়াই।

টিকর বাড়ির টিলা কিংবা নিয়তি

জলজ্যান্ত মানুষ ‘টিকর বাড়ির টিলা’য়
গেলে মরে যায়, এ এক অলীক রহস্য।

গতকাল যে ভবিষ্যতের স্বপ্নে ঘরের
বায়না করছে, আজ তার নিথর দেহ
আনা হয়েছে ‘টিকর বাড়ির টিলা’য়।

সতেরোর যুবক বুকের বোতাম খুলে
দাঁড়িয়েছিল হাওয়ার বিপরীতে। প্রেমের
কারণে সমস্ত সমাজ যখন তাকে হত্যা
করতে উদ্যত; তখন সমাজপতিদের
বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সময় করায়ত্ত করেছিল।

সাতাশে দুই সন্তানের জনক। তৃতীয়
সন্তান চলে আসবে মাসখানেক পরে।
অনাগত সন্তানের জন্য উদায়াস্ত পরিশ্রম;
তবু প্রশান্তি নিয়ে ফিরে প্রতিদিনের প্রেমগৃহে।

তার চিন্তায় ‘টিকর বাড়ির টিলা’ থাকার
কথা না তবু আজ তাকে এ টিলায়
সমাহিত করা হয়। ‘টিকর বাড়ির টিলা’
মানুষ শুষে নেয়। তার ছায়া মাড়ালে
সোমত্ত যুবতীর জীবনে নেমে আসে
অকাল বৈধব্য। এ টিলাকে সবাই উপেক্ষা
করে, অস্বীকার করে। কিন্তু এ টিলা
নিয়তির মত কোন নিস্তার নেই।

জীবনের যত বাহাদুরি, যতই ঊর্ধ্ব গমনের
কাঙ্ক্ষা সবকিছুর যবনিকা ‘টিকর বাড়ির টিলায়’।

টিকর বাড়ির টিলা কিংবা আভিজাত্য

‘টিকর বাড়ির টিলা’র গণকবরে
একদিন নিজের কবর দেখেছিলাম;
অনাদরে পড়ে থাকা কবর।

মিউনিসিপাল কর্মী বছরে একবার
সংস্কারের জন্য আসে; বেছে বেছে
মোটাতাজা কবরগুলো মোটাতাজা
করে যায়। জীবিতকালেও দীন ছিলাম।
মৃত্যুর পরেও দরিদ্র রয়ে গেলাম।

একবার বন্যায় সারা শহর তলিয়ে
গেলেও ‘টিকর বাড়ির টিলা’ তার
মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেছিল। শহরের
সবচেয়ে উঁচু টিবির গৌরবে সেদিন
অগুনতি শরীর তার মাটিতে স্থান
দিয়েছিল। বানভাসি অসহায় লাশের
সারিতে আহসান উল্লাকে আবিষ্কার করে
অবাক হয়েছিলাম। ‘টিকর বাড়ির টিলা’
তার জায়গা নয়। সুগন্ধিযুক্ত অভিজাত
পোশাকে সে যখন শহরের রাস্তা দিয়ে
হেঁটে যেত, লোকজন সমীহে সরে দাঁড়াত।

জীবিতকালে কোনদিন তার সারিতে
দাঁড়াতে পারেনি; মৃত্যু তাকে গণকবরে
নিয়ে এলো। আমার কবর দিনদিন শ্রীহীন
হচ্ছে, মিউনিসিপাল কর্মী যথেষ্ট মনোযোগ
দিচ্ছে না। মৃত্যুর পরেও মনোকষ্ট আমাকে
ছেড়ে যাচ্ছে না, আহসান উল্লার মনের খবর
জানতে ইচ্ছে করছে। আমার সারিতে তার কবরেও
উল্লেখযোগ্য উন্নতি নেই, তার কবরও আমার
জীবিত জীবনের মতো শ্রীহীন।

জীবিত কালে সাম্যের গান গেয়েছিলাম;
কিন্তু কোনদিনই সমতায় দাঁড়াতে পারিনি। মৃত্যু
সমান অধিকারের স্বপ্ন মুছে দিয়েছে
ভেবে হাপিত্যেশ করেছি; কিন্তু না,
মাটির নিচে আভিজাত্য কাজে আসে না
মাটির নিচে আমি এবং আহসান উল্লাহ
এক সমতায় শুয়ে থাকি।

আধুনিক প্রেস

আমাদের শহরে এক আধুনিক প্রেস ছিল
অনাধুনিক আমরা অকারণ উঁকিঝুঁকি দিতাম।

আমাদের কপালে তখন অক্ষর ফুটতে শুরু করেছে;
জন্ম-দাগের মত অক্ষর গুলো
মোছার হাজার চেষ্টা করেও ব্যর্থ,
ব্যর্থতা ঢাকতে নিয়তি
কাগজে উৎকীর্ণ করতে প্রয়াস করি।

ডাকযোগে অক্ষরে লেখা ছড়া অমনোনীত হয়ে
ফিরে আসে; মনোক্ষুণ্ন আমরা
নিজেদের স্বাক্ষর নিজেরাই রাখবো, ভেবে
আধুনিক প্রেসে উঁকিঝুঁকি মারি।

প্রেসে লিফলেট ছাপা হয়, হ্যান্ডবিল ছাপা হয়।
অগ্রজ এক কবির আড়াই ফর্মার
কবিতার বই ছাপা হচ্ছে দেখে; আমরা নিজেদের
ছাপতে সচেষ্ট হই। অমনোনীত কতিপয় ছড়া

এর ওর কাছ থেকে চেয়ে নেয়া ছড়া নিয়ে
আমাদের পরিকল্পনা পেশ করলে, আধুনিকের

ম্যানেজার তাড়িয়ে দেয় না;
বরং কিভাবে কি করতে হবে
পরামর্শ দিয়ে আমাদের স্বপ্নকে
বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে।

একদিন আধুনিক প্রেসে আমরা স্বপ্ন গ্রন্থিত
করেছিলাম; ক্রমে এ স্বপ্ন বর্ধিত হয়েছে।

আমাদের স্বপ্নে এক ম্যানেজার পেয়েছিলাম
যে অমনোনীত আমাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করে
সম্ভাবনার কিছুটা ছায়া দেখেছিল।

দুইশত সত্তর এর সত্তর কোনদিন পরিশোধ করতে পারিনি
তবু আধুনিকের ম্যানেজার আমাদের সম্ভাবনাকে
উস্কে দিতে দ্বিধা করেনি। ম্যানেজার আমাদের মাঝে
রবীন্দ্রনাথ দেখেছিল, নজরুল দেখেছিল।

রবীন্দ্র-নজরুল হয়তো হতে পারিনি কিন্তু আধুনিকের
ম্যানেজারের আশীর্বাদ আমাদের অমানুষ হতে দেয়নি।

আমাদের শহরে এক আধুনিক প্রেস ছিল
অন্য অনেক কিছুর মত এই প্রেস বিলীন হয়েছে
জানিনা প্রেসের ম্যানেজার কোথায়, কেমন আছে;
সেও বিলীন হয়ে গেছে কিনা, জানিনা।

তবে আমাদের প্রতিটি অক্ষরে সে বেঁচে আছে
আমাদের প্রাণে বেঁচে আছে। সে আমাদের বিশ্বাস করেছিল;
আমরা হয়তো মরে যাব, তার বিশ্বাস বেঁচে থাকবে।
বিশ্বাসের মৃত্যু নেই, ম্যানেজারের মৃত্যু নেই।

বোতল

আজকে গরম দেশ; বোতলে
হাজার লাশের সারি ভূ-তলে।

করোনায় প্রতিদিন লাশ হয়
তবু তারা বোতলের দাস হয়।

চোখের সামনে লাশ হুস নাই
বড় বড় বাবুদের ঘুস চাই।

মাতলামি মদ খেয়ে করে যায়
হুর-পরি বাবুদের ঘরে যায়।

যে কারোরই বিছানায় শুয়ে যায়
লাজ-লজ্জায় মাথা নুয়ে যায়।

তাদের লজ্জা নেই; লজ্জাহীন
মানুষের রূপে তারা মজ্জাহীন।

মানুষের চামড়া নেই শরীলে
তাইতো দুঃখ নেই ধরিলে।

তাদের জন্য কেউ আফসোস করে না
জেলে যাক কিংবা; যাক তারা মরে না!

পৃথিবীর দৃশ্যপট

loe._lorok

এই যে ফড়িং হলদে ফুল ছেড়ে
ঘন রক্তের মতো লাল গোলাপে
গিয়ে বসছে। এই যে শিশু খল খল হাসিতে
সুর ছড়িয়ে পৃথিবীকে মায়ায় বাঁধছে।
এইযে ঝর্ণা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে
সমুদ্রের বুকে গিয়ে মিশছে।
এই যে পাখি আনন্দ আশ্রমে
মন খুলে কিচিরমিচির করছে। এই যে
নাইওরি নৌকার মাঝি নতুন বধুর রূপে
মুগ্ধ হচ্ছে। এই যে খলবল মাছের ঘাই
পুকুরের জলে কাঁপন ধরাচ্ছে।
এই যে সন্ধ্যার সূর্যে মুগ্ধ মানুষ
বুকের বোতাম খুলে বুকে পুড়ছে
পুবাল হাওয়া। এই যে পূর্ণ চাঁদের মহিমা
জোসনার উৎসব হয়ে পৃথিবী পোড়াচ্ছে।

এসব খন্ড খন্ড মুগ্ধতা আছে বলেই পৃথিবী
সুন্দর, নির্জীব পৃথিবীর মাঝে এই দৃশ্যাবলী
বেঁচে থাকার রসদ। এই সুন্দরে পৃথিবী
বেঁচে থাকে; বেঁচে থাকে এই পৃথিবীর মানুষ।

যাওয়া

-19

মানুষ যায়; তাকে যেতে হয়
কেউ পুবে কেউ পশ্চিমে
আমাদের বশীর চাচা
অনেক পাশ দিতে
কালাপানি পাড়ি দিয়ে
বিলেত গিয়েছিল,
মুফাচ্ছিল গিয়েছিল ইজিপ্ট
নীলনদের পথে ফেরাউনদের
আহাজারি শুনবে বলে।

আবুলের আব্বা এতদূর যায়নি
শুধুমাত্র মাছের বাজারে,
জমিরের ছোট মেয়েটি পুকুর পাড়ে
খেলতে গিয়েছিল, পাড়ার সবচেয়ে প্রবীণ
বিড়ির খায়েশে গিয়েছিল
পাড়ার দোকানে, কানাই মাস্টার
গিয়েছিল পাশের শহরে।

প্রাণের বন্ধুর দেখা নেই অনেকদিন
আড্ডার প্রহর তাকে ছাড়া ফাঁকা লাগে
খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম সেও গিয়েছে।

মানুষ রিক্সায় চড়ে, গাড়িতে চড়ে
প্লেনে, ট্রেনে, জাহাজে
চড়ে যায়। মানুষ হেঁটে
যায়, দাঁড়িয়ে যায়, ঘুমিয়েও যায়
মানুষ যায়; তাকে যেতে হয়।

আমাকেও যেতে হবে; সহযাত্রী
হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই
ডাকছে শেষ স্টেশন
ডাকছে অন্ধকার কবর।

প্রেমিক

আমাকে যেতে হবে
গতকালের অবদারে অনেক ধকল গেল,
চাঁদ পেড়ে আনা চাট্টি খানি কথা নয়;
শেষ পর্যন্ত সক্ষম হয়েছি।

এর আগে হৃদয়ের খণ্ডাংশ
কেটে দিয়েছি, রক্তে যখন মেঝে ভিজে
যাচ্ছে তুমি লাল পদ্মের জেদ ধরলে
সাপের সাথে যুদ্ধ তাও এনে দিয়েছি।

বলেছিলে প্রেমের জন্য পাহাড় থেকে
ঝাঁপ দিতে পারবো কিনা,
তাই প্রমাণ করতে চললাম
ঝাঁপ দেয়া কোন ব্যাপার না;
সন্দেহ জাগছে; ঝাঁপের
অপর পারে তুমি কী দাঁড়িয়ে থাকবে!

দ্বৈরথ

প্রদর্শনীর অপর পিঠে
যখন পর্দা নামে;
মঞ্চের নর্তকী মুখের
ময়দা ধুয়ে ফিরে
নিজস্ব অবয়বে;
মঞ্চের ভাড়া উসুল করতে
রিং মাস্টার যখন হিসেবে মত্ত

তখন প্রতিকাশে একটি
তারা খসে পড়ার খবর আসে।
একটু আগেই নর্তকীর
দেহবল্লরী আগন্তুকের মনে
কাঁপন ধরিয়েছিল;
সঙ্গমের সুখানুভূতি
নিয়ে ঘরে ফিরে যাচ্ছিল।

প্রতিকাশের অন্য ইচ্ছায়
পরাস্ত আগন্তুক ঘরে পৌঁছাবার পূর্বেই
অন্য কোথাও পৌঁছে গেল,
এই তার শেষ যাত্রা।
এরপরে পর্দা উঠলে
অন্যকোন নতুন নর্তকী
গাইবে যৌবনের গান;
তার দেহবল্লরী
অন্য আগন্তুকের শরীরে
আগুন ধরাবে, একদিন সেও
যাবে শেষ যাত্রায়।

প্রতিকাশের ইচ্ছার বিপরীতে
জীবনের ধারাবাহিতা
চলতে থাকবে, চলতে থাকবে
আগন্তুক নর্তকীর দ্বৈরথ।

there are many things in heaven and earth

67614n

উনিশ দিন আগে হারিয়েছিল; খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল শূন্য। প্রকৃতির অদ্ভুত লীলা; উনিশ দিন পরে ফিরে এসেছে। এখানে একটু রহস্য আছে; বিরাট রহস্য, কোন কূলকিনারা পাচ্ছিনা। তাই শেক্সপিয়ারের আপ্তবাক্যতে শান্তনা খুঁজছি। there are many things in heaven and earth…

বলছিলাম চশমার কথা। আমাকে সর্ট সাইটেড বলা হয়; দূরবর্তী কিছু ভালো দেখতে পাই না। দূরের নদী, গাছের পাখি, আকাশের ঘুড়ি কিংবা ঈদের নতুন চাঁদ দেখতে আমার চশমা লাগে। চল্লিশ পরবর্তী বয়সে চশমা ছাড়া দৈনন্দিন কাজ করা সম্ভব হয় না। চশমা এবং মোবাইল ছাড়া জীবন অচল, আমি জীবনের অনেক কিছু ভুলে থাকতে পারি কিন্তু চাইলেই চশমা ভুলতে পারি না মোবাইল ভুলতে পারিনা। চোখ চশমা ভুলার অনুমতি দেয় না, কাজ মোবাইল ভুলার অনুমতি দেয় না।

এই চশমা উনিশ দিন আগে হারিয়ে গেল, তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোন হদিস পাওয়া গেল না। কাজ থেকে ফিরে ড্রয়ারে চশমা রেখে বাথরুমে ফ্রেস হতে গিয়েছি। প্রতিদিনের অভ্যাস ভুল হওয়ার কথা নয়। মোবাইল এবং চশমা ড্রয়ারে রেখে ফ্রেশ হয়ে, নামাজ পড়ে পুনরায় চোখে চশমা পড়ি এবং হাতে মোবাইল নেই।

প্রতিদিনের রুটিনে সেদিন ব্যতিক্রম ঘটলো, মোবাইল জায়গা মতই আছে কিন্তু চশমার কোন হদিস নেই। ঘরের সম্ভব-অসম্ভব সব জায়গায় খোঁজা হলো, ড্রয়ারের অন্যান্য জিনিসপত্র এক এক করে সরিয়ে বারবার তালাশ করেও চশমার কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। আমি সহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও খুঁজতে খুঁজতে গলদঘর্ম।

সবাই আমাকে দোষারোপ করলো, আমাকে আসামী সাব্যস্ত করা হলো। আমি ভুলে অন্য কোথাও ফেলে এসেছি। হয়ত রাস্তায়, গাড়িতে না হয় কাজের কারণে যে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া হয় বেখেয়ালে হয়তো সেসব কোন জায়গায় ফেলে এসেছি। তাদের বোঝানো গেল না যে চশমা ছাড়া আমি অচল কোথাও যদি ফেলে থাকি, তাহলে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে আমি ঘরে ফেরার কথা না। কেউ যদি হাত ধরে পৌঁছে না দেয় তাহলে চশমা বিহীন আমার পক্ষে গাড়ি চালিয়ে ফিরা সম্ভব না।

চশমার জন্য মন খারাপ হলো বটে কিন্তু শোক বেশিক্ষণ ধরে রাখা গেল না। নতুন চশমা পুরাতনের জায়গা দখল করে ফেলল, প্রকৃতির এই ব্যাপারটা আমার বেশ ভালো লাগে কোন কিছুকে শূন্য থাকতে দেয় না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শূন্যস্থান পূরণ করে ফেলে।

দু তিনদিন পরে চশমা হারানোর শোক ফিকে হয়ে গেল, জীবন পুনরায় স্বাভাবিক গতি ফিরে পেল। উনিশ দিন পরে আজ রুটিন মোতাবেক ড্রয়ারে চশমা, মোবাইল রেখে ফ্রেস হয়ে, নামাজ পড়ে যখন ড্রয়ার খুলেছি নতুন চশমার পাশে পুরনো চশমা পাওয়া গেল।

এই চশমা এতদিন কোথায় ছিল; কিভাবে ফিরে এলো কোন ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না। এবার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের আসামি ভেবে কঠোর জেরা করা হলো, তবু চশমা রহস্যের কোন সুরাহা হল না। তাদের ব্যাখ্যা অবিশ্বাসের কোন কারণ খুঁজে পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত অমীমাংসিত রহস্যের জন্য হ্যামলেটের আশ্রয় নিতে হল, শেক্সপিয়ারে শান্তনা খুঁজতে হল।

মিছিল

মিছিলের শব্দে দাঁড়িয়ে গেলে
পিছনে পড়ে রয় অতিক্রান্ত সময়
পাড়ি দিতে হবে, অনুভব করি
মিছিল ছুঁয়ে দিচ্ছে আমার সত্ত্বা

অগ্রে এক তরুণ যুবা যার কাছে ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা
একটি সবুজ শিশু দুরন্তপনা তার কাছে হার মেনেছে
একটি কোমল কিশোরী যার চোখে ভিড় করেছে তাবৎ শ্যামলিমা
একজন ন্যুব্জ বৃদ্ধা সংসারের ভার বহনে এখনো সক্ষম

একজন শিক্ষক তার পঠন পদ্ধতি আওড়াতে আওড়াতে
একজন মাওলানা মিসওয়াকের মহিমা বর্ণনায়
একজন বর্গা চাষি ভরা ক্ষেত আমনের নির্ভরতায়
একজন মুচি জুতো পড়া পাগুলি অবলোকন করে করে
একজন পণ্ডিত হরি সংকীর্তন করতে করতে
একজন ডোম শ্মশানের গন্ধ ঢাকতে ঢাকতে
একজন ফকির ছেঁড়া জামার পকেটে নিশ্চিত নোটের তৃপ্তিতে
একজন ছাতু ব্যবসায়ী পরিজের স্বপ্নে বিভোর
একজন নাপিত উত্তম ছাট চুলের জনপ্রিয়তায়
একজন মেথর সভ্য শহর প্রান্তে ফিরে যাওয়ার প্রতীক্ষায়

একজন ডাক্তার সদ্য বিলাত ফেরত
একজন চাকরিজীবী সদ্য পদোন্নতি প্রাপ্ত
একজন গৃহিণী স্বামী কর্তৃক নিগৃহীত
একজন স্বামী দ্বিতীয়বার পাগড়ি পরিহিত
একজন আমলা ক্ষমতার দাপটে
একজন মন্ত্রী প্রধান কর্তৃক উপেক্ষিত
একজন পাওনাদার সুকতলা ক্ষয়ের বেদনায়
একজন রাজনীতিবিদ ওয়াদাবদ্ধ রাজনীতির অঙ্গিকারে

একে একে মিছিল ছাড়িয়ে যায়
আমি দাঁড়িয়ে থাকি একাকী মিছিল হয়ে…

আমি থাকবো না

এই যে ফলের বাজার; সাজানো ফল
এই যে লোভাতুর চোখ
এই যে সাধ্য হাত থলে ভরে বাড়িমুখো
এই যে অক্ষম হৃদয়; পীড়িত
পিতার জন্য কাঁদে।

এই যে ফুলের বাগান, ফুটে থাকা বসন্ত
এই যে প্রজাপতির ওড়াউড়ি
এই যে মধুকুঞ্জ; প্রেমিকের চোখে চোখ
এই যে অপার প্রেম,
এই যে একলাবাসি উদাস হৃদয়।

এই যে নদীঘাট; খেয়ার মাঝি
এই যে চৌকো নৌকায় দূর পাড়ি দেয়া
এই যে শশব্যস্ত উমেদার
এই যে সবুজ বালিকা
এই যে নদীর ওপারে দাঁড়ানো সবুজ বালক।

এই যে দিগন্ত; ঢেউ খেলানো ধান
এই যে বুক ভরা নিঃশ্বাস
এই যে আলবাধে শুয়ে থাকা বাছুর
এই যে সর্ষেক্ষেতের হলুদ পৃথিবী
এই যে রোদে ভেজা তপ্ত মাঠ।

এই যে সংসার; কাচের দেয়াল
এই যে মেরামতের আপ্রাণ চেষ্টা
এই যে টেবিলে ফুলের ভাজ
এই যে অংকের খাতা
এই যে টিভিতে সাদাকালো ছবি।

এই যে টেবিলে ফাইলের স্তূপ
এই যে কাজ না করা রোগ
এই যে টুপাইস কামানো
এই যে টেবিলের নিচে লেনদেন
এই যে ক্যান্টিনে অযথা সময়।

এই যে অনির্ধারিত আড্ডা
এই যে রাজনীতি, রাজা উজির মারা
এই যে অতিরিক্ত দুই পেগ
এই যে লাল চোখ; দরজায় টোকা
এই যে মায়া মায়া ক্রোধিত মুখ।

এই যে অহোরাত্র কবিতার বেদনা
এই যে সাদা কাগজের বুকে কলমের সঙ্গম
এই যে রাত্রি জাগরণ
এই যে আহলাদী অসুখী বসন্ত
এই যে হঠাৎ মন খারাপের বৃষ্টি।

এই যে দৃশ্যপট, দৃশ্যান্তর
এই যে ইলিশ, ইলিশ রোদ
এই যে নির্ভেজাল হাসি
সবকিছু পড়ে থাকবে, আমি থাকবে না
একদিন কোনকিছু আমার স্পর্শ পাবে না।