আবু মকসুদ এর সকল পোস্ট

যতদিন পৃথিবীতে বৃষ্টি হবে

যতদিন পৃথিবীতে বৃষ্টি হবে
প্যাচপ্যাচে কাদা পায়ে লাগবে,
যতদিন পৃথিবীতে বৃষ্টি হবে
ট্রেনের কাঁচ নামিয়ে কিশোরী
শরীরে নেবে জলের ছোঁয়া।

যতদিন পৃথিবীতে বৃষ্টি হবে
অন্ধ বাউল গাইবে মেঘমল্লার,
যতদিন পৃথিবীতে বৃষ্টি হবে
অপেক্ষার প্রেমিকের চোখের
জলে সিক্ত হবে মাটির পৃথিবী।

যতদিন পৃথিবীতে বৃষ্টি হবে
গৃহিণী রোদে শুকাতে দেওয়া
কাপড়ের জন্য করবে অভিসম্পাত,
যতদিন পৃথিবীতে বৃষ্টি হবে
ছাতার আড়ালে বৃদ্ধ মুখে পুড়বে
খয়ের পান, টকটকে লাল পিক
জলে মিশে বর্ণিল হবে।

যতদিন পৃথিবীতে বৃষ্টি হবে
ব্যাগভর্তি বাজারে বিড়ম্বিত গেরস্ত
বলবে ‘ইস একেবারে ভিজে গেছি’,
যতদিন পৃথিবীতে বৃষ্টি হবে
গৃহিণী অযাচিত বাহানায়
রাঁধবে খিচুড়ি, স্বামীর ভেজা চুল
মুছতে এগিয়ে দেবে মায়ার গামছা।

যতদিন পৃথিবীতে বৃষ্টি হবে
যৌথ ভেজার ইচ্ছা জাগ্রত থাকবে,
যতদিন পৃথিবীতে বৃষ্টি হবে
প্রেমিক ডাকবে প্রেমিকাকে
যতদিন পৃথিবীতে বৃষ্টি হবে
প্রেমিক-প্রেমিকা ভিজবে,
পূর্ণ হবে ভালোবাসার অবয়ব।

সবাই ঝিনুক নয়

নিরব ব্যথা সবসময় মুক্তো হয় না।
সবাই ঝিনুক নয়, ব্যাধি যুদ্ধে অনেকে
পরাস্ত হয়, চিহ্ন মুছে যায়। শুধু
গাছের বাকলে লেখা কষ্টকথা
অন্যের কষ্ট বাড়ায়। সবাই ঝিনুক নয়।

ক্যারোলিনা

আমি ঘরে ঘরে খাদ্য পৌঁছানোর কাজ করি; ফুড ডেলিভারি ড্রাইভার। আমাকে রেস্টুরেন্ট এবং ক্রেতার সংযোগ ভাবতে পারেন। কাঁচা বাংলায় দালাল। গরু বাজারে, পাসপোর্ট অফিসে, হাসপাতালে এমনকি সচিবালয়ে আমার প্রজাতিকে পাবেন। তবে তাদের সাথে আমার ব্যবধান হচ্ছে আমি স্বীকৃতি প্রাপ্ত অর্থাৎ সব ধরনের আইন কানুন মেনে দালালি করি। দালালি থেকে আয়কৃত টাকা থেকে সরকারকে নিয়মিত কর পরিশোধ করি। বিনিময়ে কাজে থাকাকালীন সময়ে এবং কাজ বিহীন সময়ে সরকার আমার সুরক্ষা নিশ্চিত করে। আমাদের প্রজাতিকে লোকে ভাল চোখে দেখে না তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, অথচ বিপদে আমাদের স্মরণাপন্ন হওয়া ছাড়া অনেকের কোন গতি থাকে না।

তবে আজকের গল্প দালালির নয় স্বীকৃত কাজের পুরস্কার এবং প্রসংসার। নামীদামী চেইন রেস্টুরেন্ট যেমন ম্যাকডোনাল্ড, কে এফ সি, বার্গার কিং, নানদোজ, সাবওয়ে, পিৎজা হাট, পিৎজা এক্সপ্রেস, কস্টা, স্টারবাকস, ক্যাফে নিরো ইত্যাদি আমাদের ক্লায়েন্ট, দিনে কয়েকবার এসব রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার সংগ্রহ করতে হয়।

দালাল হিসেবে এসব রেস্টুরেন্টে আমাদের কিছু অধিকার থাকে যেমন লকডাউন এর কারণে অন্য কেউ রেস্টুরেন্ট বাথরুম ব্যবহার করতে না পারলেও আমরা যখন ইচ্ছা ব্যবহার করতে পারি। করোনার কারণে কাস্টমার ভিতরে ঢুকতে পারে না কিন্তু আমাদের ঢুকতে কোনো বাধা নেই। আমাদের বসার জন্য আলাদা জায়গা আছে। আমাদের নিরাপত্তার জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার ছাড়াও অন্যান্য সুরক্ষা উপাদান আছে। তাছাড়া আমরা চাইলেই বিনামূল্যে যেকোন ড্রিংকস খেতে পারি। কফি, জুস, কোকোকোলা আমরা চাইলেই রেস্টুরেন্ট দিতে বাধ্য।

আমি সাধারণত যে ম্যাকডোনাল্ড থেকে খাবার সংগ্রহ করি তারা মোটামুটি পরিচিত হয়ে গেছে, হাই হ্যালোর পরেও দুচার বাক্যলাপ আমার এবং স্টাফের মধ্যে হয়। ষাট বছরের এক বৃদ্ধাকে গার্লফ্রেন্ড ডাকি নাম মিস ক্যারোলিনা, সেও আমাকে হানি বলে ডাকে। আমার বয়সের তিন সন্তানের মা। অন্যান্য স্টাফ তাকে এবং আমাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। আমি ক্যারোলিনাকে বলি ‘ইয়াং লেডি আই ওয়ান্ট টু ম্যারি ইউ’, সে সম্মতির হাসি হাসে।

গতমাসে একদিন ম্যাকডোনাল্ডে গেলে দেখলাম আমার গার্লফ্রেন্ডের মন খারাপ; কেন জিজ্ঞেস করলে জানাল সে অসুস্থ বোধ করছে, বললাম চলে যাচ্ছ না কেন? সর্ট স্টাফ; ম্যানেজারকে বলতে ভয় পাচ্ছি। ম্যানেজার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল আমি অনুদার হয়ে গার্লফেন্ডের অসুস্থতার কথা বললাম, কি ভেবে ম্যানেজার ছুটি দিতে রাজী হয়ে গেল।

আমার অর্ডার রেডি হতে কয়েক মিনিট বাকী আমার গার্লফেন্ড রেডি হয়ে এল, আমি বললাম যাবে কিভাবে। বললো বাসে চলে যাবে। বাসে যেতে প্রায় ৪৫ মিনিট লাগে। আমি বললাম চল তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। বললো আরে নাহ, তোমার কাজ। আমার অর্ডার ক্যান্সেল করে দিলাম।

অনেকটা জোর করে তাকে গাড়িতে উঠালাম। কিছুদূর যাওয়ার পরে ক্যারোলিনা বললো সে বেশ অসুস্থ বোধ করছে তাকে হাসপাতালে নামিয়ে দিতে, দেখলাম বেশ জোরে জোরে শ্বাস ছাড়ছে। আমি বললাম আচ্ছা। হাসপাতাল বেশি দূরে নয় কয়েক মিনিটে পৌঁছে গেলাম, দেখলাম সে তখনো জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। হাসপাতালে ফটকে সে নামল বললাম সাথে আসবো নাকি। ক্যারোলিনা বলল; লাগবে না কিছুটা ভালো বোধ করছে। কাউকে ফোন করতে হবে কিনা জিজ্ঞেস করলে জানালো ছেলেকে টেক্সট করে জানিয়ে দিয়েছে।

তাকে নামিয়ে দিয়ে আমি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পরের এক সপ্তাহ ওদিকে যাওয়া হল না। ক্যারোলিনার খোঁজ খবর নেওয়া হলো না। এক সপ্তাহ পরে হঠাৎ সেই ম্যাকডোনাল্ড থেকে অর্ডার আসলো। আমি ম্যাকডোনাল্ডে গিয়ে পৌঁছালে যে স্টাফ যেখানে ছিল ছুটে এল। সবাই আমাকে ধন্যবাদ দিতে থাকলো।

আমি কোন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না, পিছন থেকে ম্যানেজার এসে হ্যান্ডসেইক করে একটা কাগজ আমার হাতে তুলে দিল। দেখলাম তাতে লেখা ‘থ্যাঙ্ক ইউ মাই ফ্রেন্ড ইউ সেইভড মাই মাদার্স লাইফ’। এরপরেও কিছু না বুঝলে ম্যানেজার বললো এ চিঠি ক্যারোলিনার ছেলে লিখেছে। কাজে থাকতেই ক্যারোলিনার স্ট্রোক হয়েছিল সময়মতো হাসপাতলে পৌঁছায় এ যাত্রা বেঁচে গেছে।

ম্যাকডোনাল্ডে আমার মূল্য অনেক বেড়ে গেছে, স্টাফ ম্যানেজার সবাই আমার খোঁজখবর রাখে যখন তখন ড্রিঙ্ক অফার করে। ম্যানেজার বলেছে যতদিন সে এখানে আছে আমি যা ইচ্ছা খাবার খেতে পারবো।

গত সপ্তাহ ক্যারোলিনা কাজে ফিরেছে আমাকে দেখেই দৌড়ে এল। আমার কপালে চুমু খেয়ে বলল ‘আই এম রেডি ফর দি ম্যারেজ’। বলেই সে কি লাজুক হাসি! আমি বললাম ‘ইফ মাই ওয়াইফ লেট মি ম্যারি এগেইন, আই উইল ম্যারি ইউ’। ওকে হানি বলে পুনরায় আমার কপালে চুমু। তার মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি, চোখে স্নেহ উপছে পড়ছে ।

থ্রিডি আয়না

আমার সামনে থ্রিডি আয়না
ওপারের আমিকে খুব জীবন্ত লাগছে
অথচ জানি; আমি মরে গেছি
স্থবির হৃদয়ে ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই।

আয়নায় যা প্রতিফলিত সর্বদা সত্য নয়,
অনেক মুমূর্ষ আয়নার বদৌলতে
প্রাণবন্ত হতে পারে; অন্তরে অন্য খোঁজ।
মৃতবৎ মেকাপের জোরে
স্বল্পসময়ের জৌলুসে ফিরতে পারে,
সময় ফুরালে কফিনে ঢুকে পড়তেই হয়।

থ্রিডি আয়নায় সত্য প্রতিফলিত হয় না
সত্যের মাপকাঠি ভিন্ন।

ইচ্ছা

মেঘের সাথে উড়াল দিতে চাইলেই হল;
আদিখ্যেতা বাদ দাও,
তুমি পাখি না যে ফুরুত করে উড়ে যাবে।

নিজেকে পাখি ভাবো! ঠিকাছে!
তবে ডানাকাটা
উড়বার চেষ্টা করলেই মুখ থুবরে পড়বে।
তারচে শাওয়ারের নীচে
প্রবাহিত হও।

ইচ্ছা থাকলেই হল;
যে ইচ্ছার আগামাথা নেই
তাকে ঝেড়ে ফেল।

কোন একদিন বৃষ্টি হবে হয়তো
তুমিও ভিজবে,
পাখির পালক নয়
সিক্ত হবে মানবীয় শরীর
এইটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকো।

প্রয়োজন ফুরালে

একদিন এই মাঠে মেলা বসতো;
দূরদূরান্ত থেকে দোকানি পসরা সাজাত।
একদিন এই মাঠ কিশোরের পায়ের ভারে
দেবে যেত, কিশোরীর গোল্লাছুট
দৌড়ে নাগাল পেত না। একদিন এই
মাঠের পাশে দেখা যেত ফুল ফুটেছে।
একদিন সযত্ন মালি দূরে ফেলে দিত
অযাচিত আগাছা। একদিন এই মাঠে
হত ষাড়ের লড়াই। বিছাল যুদ্ধ দেখতে
লাখো মানুষ জড়ো হত, ধারালো শিঙের
ঘর্ষণে উত্তেজনা যখন চরমে; পরাজিত
ষাড়ের সাথে মানুষের অলিম্পিক দৌড়।
একদিন এই মাঠ বুকের কাছাকাছি ছিল,
আজ সে একা; অভিশাপগ্রস্ত মনে
নিঃসঙ্গতার হাহাকার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

একদিন এই পুকুর ভর্তি জল ছিল,
শৈশবের ডুবসাঁতার নিমিষেই ওপারে
ভেসে উঠতো। একদিন এই পুকুর মা মাসিদের
খোশ গল্পে সরব হত। পুকুরের বাঁধানো ঘাটে
বিরহী প্রেমিক অনন্তকাল বসে থাকতো।
পুকুরের পাড় ঘেঁষে নির্লজ্জ নেবু গাছ
খিদে বাড়িয়ে দিলে দক্ষিনে দেখা
যেত প্রেমিকার মুখ। বিরহী কোকিলের কণ্ঠে
ধ্বনিত হতো বসন্তের আগমনী গান।
মা, মাসীদের আড্ডা পুকুর নিশ্চিহ্ন হয়েছে।
বিলীন হয়েছে প্রতীক্ষার বাঁধানো ঘাট।
বিরহী বসন্তের গান শুনতে
প্রেমিক আর আসেনা পুকুরের ঘাটে।

এই বাড়ি একদিন একান্নবর্তী ছিল;
চাচাদের সাথে চাচিদের বিয়ে সম্পন্ন হলে
পাক ঘরের মেঝেতে থালার পরিধি
ব্যাপ্ত হত। একদিন এই বাড়ির উঠোনে
ধান মাড়াই হত, হুঁকোর নল মুখে নিয়ে
ক্লান্ত দাদা আরামে চোখ বুজে ফেলতেন।
একদিন এই বাড়ির ছেলের সুন্নতে খৎনায়
হাজার মানুষ দাওয়াত খেতে আসতো।
গ্রামের শালিসে, চেয়ারম্যানের ভোটে
এই বাড়ির উঠোন উন্মুক্ত ছিল। একদিন
এই বাড়ি দাদা দাদী মা বাবা চাচা চাচী
ফুফুতে মুখরিত ছিল, আজ শুনশান।
বাড়ির চারিদিকে আজ কবরের নিরবতা।
একদার সরব উঠোন নির্যাস মুছে যাওয়া
বিধবার মত একা দাঁড়িয়ে আছে।

এই বাজার একদিন জুলেখা বিবির
চায়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। আসতুম মোল্লার
পান, হরিপদ সান্যালের রসমালাই, নজু শেখের
পাতিল, উত্তম কর্মকারের জুতা-কর্মের জন্য
বিখ্যাত ছিল। গৌতম শীলের সেলুনে
দীর্ঘ অপেক্ষায় মানুষ বিরক্ত হত না।
তার রসসিক্ত আলাপে পাশের দোকানের
রমিজ উল্লার সেলাই কাজে ব্যাঘাত ঘটলে
ঝগড়া বাঁধার উপক্রম হত। হাটবারে
তাজা মাছ, সবজির সাথে পাওয়া যেত ছাতা,
নিষিদ্ধ বিড়ি, ছিকরমাটি। আব্দাল খানের
দোকানের পিছনে জমে উঠতো জুয়ার আড্ডা।
মাঝেমধ্যে পুলিশের সামান্য বিড়ম্বনা ছাড়া
প্রাণবন্ত ছিল এই বাজার। আজ জনশূন্য,
লাওয়ারিশ কুকুরে অতিষ্ঠ বাজারে
আজ কোন কুকুরেরও দেখা মেলে না।

একদিন এই পথ দিয়ে লোক চলাচল
করতো। হাজার হাজার পা ছাপ রেখে পৌঁছে
যেত নিজস্ব গন্তব্যে। প্রিয়জনের জন্য
অপেক্ষমাণ চোখে যখন অস্থির চিন্তা দানা
বাঁধছে পথের মোড়ে দেখা যেত বিশ্বস্ত চাঁদ।
বিপরীত মানুষকে নাক বরাবর হাঁটাতে এই
পথের জুড়ি ছিল না। কত শ্লোগানে, মিছিলে
উত্তপ্ত হয়েছে পথ। কত অভাগা পথের
চাকায় পিষ্ট হয়ে ছেড়ে গেছে ধরাধাম।
কত বেভুল পথিক নিরুদ্দেশ শেষে ফিরেছে।
সংসার ত্যাগী বৈরাগ্য ভুলে জপেছে আরোগ্য মন্ত্র।
অসংখ্য মানুষের পায়ের ছাপে মুখরিত
পথও আজ ধূলি বর্জিত। ভুলেও কেউ
এই পথ মাড়ায় না, একাকিত্বের বেদনা
নিয়ে এই পথ দাঁড়িয়ে রয়েছে একা, একা।

দুঃখমতি

আমার নাম দুঃখমতি
জন্মের পর দুঃখ লেপ্টে আছে।
মাথা, কোমর, হাটু, গোড়ালি
দুঃখে ভরপুর! শুধু মধ্যাংশ কিছু পরিমাণ
সুখদ, পেট দেখে যেকেউ
সুখী ভেবে নেয়। পেটের জন্য
দুঃখবাদী জীবন পাত্তা পায় না।

শরীরের গাঁটে গাঁটে ব্যথা
বসে পড়লে উঠতে পারিনা
কোনরকম দাঁড়ালে পুনরায় বসতে
কষ্ট হয়। কষ্ট সহ্য করে বসে গেলেই
সুখ। আমার সমস্ত সুখ খাবারে,
দাঁড়িয়ে খাবারে যুথ পাই না
পেটের ভারে শ্বাস কষ্ট হয়;
বসে গেলেই আরাম, প্রচুর খাবার।

দুঃখ কাউকে বুঝাতে পারিনা
‘ঘরের কর্তী রুদ্র মূর্তি’; ছেলেমেয়েরা
হেসে মরে। বন্ধুদের কাছেও
আজকাল দুঃখ বিকায় না।
দুঃখের আলাপে মুখ বন্ধ করে
দিতে আসে, অথবা পাত্তা দেয় না।

জানতাম খাবারে অনিহা
থাকলে দুঃখ জেঁকে বসে কিন্তু
আমার ক্ষেত্রে বিপরীত,
প্রচুর খাই; তবু দুঃখ তাড়াতে পারিনা।

দুঃখ কে কেউ দুঃখ ভাবে না,
অথচ আমি প্রচণ্ড পরিমাণ দুঃখী;
কারো কাছে মন খুলে দুঃখের
গল্প করতে পারি না, ঠেকায় পড়ে
আপনাদের জানালাম একটু সমব্যথী হবেন!

পাপ

কার্পেটের নীচে যে পাপ
চাপা দিয়ে রেখেছি,
মাঝে মাঝে মাথা চাড়া দেয়।

ঝকঝকে জুতো; গলদ রয়ে
গেছে, একটা পিন
সবসময় অস্তিত্ব জানান দেয়।

আমি যতই সফেদ হতে
চাই না কেন
মলিন দাগ পিছু ছাড়ে না।

বর্ধিত চুম্বন

জগৎসংসার একপেশে লাগছে;
যে সবুজ বৃক্ষ একসময়
সুখ নিদ্রায় ছায়া হয়ে থাকতো;
বিবর্ণ হয়ে গেছে;
পাশে গেলে আগের সজীবতা
অনুভূত হয় না। প্রবাহিত নদী
গেছে শুকিয়ে, দুর্বার যৌবন
ভাটা পড়েছে। প্রতিটি দিন ছিল
সম্ভাবনার, প্রতিটি ভোরে দিগন্তের
ডাকে উড়াল দিতাম।
দিগন্ত এখন ধূসর। উড়ালপুরের ডাক
আগের মত আলোড়ন তুলে না।

মরে গেছে জীবনের রঙ; ফ্যাকাসে
দিনের পরে আসে নির্জীব রাত।
থেমে গেছে কোলাহল, থমকে
গেছে চলার ইচ্ছা। জীবনকে আর
গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে পারছি না।

জলের কাছাকাছি থাকবো বলে
একদিন পরিখা খুঁড়েছিলাম।
জলমগ্ন সময় শেষে
অসংখ্যবার পায়রা উড়িয়েছি।
স্বাধীন সত্ত্বার কাছে ভিড়তে
দেইনি অন্য কিছুকে। জীবনকে
জীবনের মত উপভোগ করতে
রঙের বাজারে দোকান খুলেছিলাম।

দোকান ঠিকই আছে; মরে গেছে
ভিতরের রঙ। পুনরায় রাঙাবো
উৎসাহ জাগে না। বিধ্বংসী চিন্তা
মাথায় ভর করে। আত্মবিনাশে
উপশম হতে পারে।

যখন নিভে গেছে রঙ, রাত্রি ছেয়ে
আসছে, পাণ্ডুলিপির প্রয়োজনীয়তা
ফুরিয়ে। যখন স্থবির সময়কে বর্ধিত করার
ইচ্ছা জাগছে না; তুমি এসে দাঁড়ালে।

বর্ধিত চুমু জীবন চাগিয়ে দিল
আত্মহননের চিন্তা পুনঃ বিবেচনায় বাধ্য করল।
এই যাত্রা বেঁচে গেলাম, একটি চুম্বন
মৃত্যুর চেয়ে শক্তিশালী হয়ে দেখা দিল।

ব্যতিক্রমী মানুষের গল্প

কিছু মানুষ ব্যতিক্রমী
কিছু মানুষ অনতিক্রম্য
আমাদের প্রদেশে একবার এক ব্যতিক্রমী
অনতিক্রম্য মানুষের দেখা মিলেছিল,
তাঁর বর্ধিত ছায়া এখনো
ঝড় ঝঞ্ঝা মোকাবেলা করে
প্রদেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখে।

অন্যরা মাটিতে পা রাখতে ভয় পায়
এক গোলামের বাচ্চা পাকিদের
পাছায় খুঁজেছিল সুখ।

আরেক গোলাম ঠেকে কিয়ৎক্ষণ সুবোধ
সেজেছিল; কিন্তু সুযোগ পেয়ে সদ্ব্যবহার
করতে এক মুহূর্ত দেরি করেনি।

গোলাম গং পর্দার ওপারে
চলে গেলেও ছোট ছোট গোলাম
মাঝেমধ্যে পর্দা সরিয়ে উঁকি দেয়।

গোলামদের উঁকিঝুঁকি কিছুটা
দুর্গন্ধের কারণ হয় বটে
কিন্তু ব্যতিক্রমী মানুষের
সাহসী তর্জনীর নীচে
মানুষের আস্তা জাগরূক থাকে,
মানুষের বিশ্বাস জাগরূক থাকে।

অনতিক্রম্য মানুষের জমিনে
গোলাম বর্ধিত হয় না
এই বোধটুকু গোলামদের হয় না
বলেই তারা গোলাম।

মধ্যস্বত্বভোগী

খরিদ্দার খাবারের অপেক্ষায়;
আমি মধ্যস্বত্বভোগী, দুই পক্ষের সংযোগ
হোটেল এবং খরিদ্দারের মাঝে
আমার মুনাফা সাড়ে তেত্রিশ।

মুনাফার জন্য পদে পদে অপমানিত;
কেউ মুখের সামনে দরজা লাগিয়ে দেয়,
কেউ কুকুর লেলিয়ে দেয়,
কেউ ভিক্ষুকের মতো ছুঁড়ে দেয় ধাতব মুদ্রা।

সব অপমান হজম করি, মুনাফার সাড়ে
তেত্রিশ অপমানে উপশম হয়।

মাথার ঘাম পায়ের জুতো ভিজিয়ে দেয়,
কনকনে শীতে গায়ে ফোসকা পড়ে যায়,
বন্যা কিংবা মারি দমাতে পারে না,
বেড়াল ভেজা বৃষ্টি কাধ চুইয়ে
ঢুকে যায় বুকের খন্দকে, পেঁচা
চোখ তবু দরজায় সংখ্যা খোঁজে।

সবাই আমাকে দালাল বলে, কায়িক
শ্রম ছাড়া সিন্দুক ভরে ফেলেছি
আমার বুকের উঠান কেউ ছুঁয়ে দেখে না,
চোখে দেখেনা সাড়ে তেত্রিশ কান্না।

যাত্রা_২

শরীরের ছায়া ক্রমে খাটো হচ্ছে
একদার উজ্জ্বল দৃষ্টি আজ ম্রিয়মাণ
চাইলেই দৃশ্যান্তর হচ্ছে না;
চাইলেই পাখি মেলাতে পারছে না ডানা,
ডাকছে ঘুম, শুনতে পাচ্ছি দীর্ঘ ঘুমের ডাক।

দীর্ঘ ঘুমে গেলে এতকাল যারা
খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দোষ খুঁজে বেড়াত
তারা ক্ষান্ত দিবে।

গুণগ্রাহী যারা ছিল,
যাদের উচ্চাশা ছিল পর্বত পরিমাণ,
ক্ষনিকের মনঃক্ষুণ্ণতা ভুলে তারাও
অন্য কোন উচ্চাশায় মনঃসংযোগ করবে।

যারা আমার নিজের ছিল, শ্বাসের বিনিময়
যাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি;
কয়েক পলকের বিষণ্নতা শেষে তারাও
ফিরে যাবে নিজেদের স্বাভাবিক শ্বাসে।

কোলাহল ঘাট থেমে গেলে
কেউ মনে রাখবে না,
মানুষ মরে গেলে আগ্রহ মরে যায়।

যাত্রা

এই মুহূর্তে যে পাখি আকাশে উড়ছে
তার ডানা একদিন শিথিল হবে।
হঠাৎ ঝুম বৃষ্টিতে ভিজছে যে তরুণী;
খুঁজে নিচ্ছে প্রেমিকের আলিঙ্গনের ছোঁয়া,
তার মনের বৃষ্টি একদিন থেমে যাবে।

খলখল হাসিতে যে শিশু পিতা-মাতার
দাম্পত্যের পরিধি বাড়াচ্ছে;
তার আদুল গাল একদিন চুপসে যাবে।

বৃক্ষের যৌবন দেখে আত্মহারা যুবক
অনুভব করে নিজের যৌবন
হাতের মুঠোয় অনায়াসে
ধরা দেয় বিলাসী স্বপ্ন
তাকে একদিন থুত্থুরে বুড়ো হতে দেখি।

কবিতায় যে গায় দুর্দান্ত জীবনের গান
ঝর্ণার উচ্ছলতায় যার কলম
কাগজের বুকে সিঁথি আঁকে
তার কলম থেমে যাবে, দীর্ঘ অপেক্ষার পর
অভুক্ত কাগজ চলে যাবে বাতিল বাক্সে।

একে একে ঝরে গেলে; পাতাশূন্য বৃক্ষ
একলা মাঠে বিলাপ করে,
তার বিলাপে সাড়া দেয় না মানুষ,
সাড়া দেয় না আকাশের পাখি।
চলৎশক্তিহীন পাখি, অথর্ব মানুষ
কবর আঞ্জামে ব্যস্ত, গাছের কান্না
তাদের কানে পৌঁছায় না।
শেষ যাত্রায় তারাও একলা
আশেপাশে কাউকেই খুঁজে পায়না।

জীবনের পতাকা

উনচল্লিশে আটকা পড়েছিলাম
এই বুঝি রাস্তার শেষ।
কোথাও কোন আলো ছিল না,
পাশে ছিল না কোনো খড়কুটো;
সব সম্ভাবনা তিরোহিত হওয়ার পরে;
যখন চিরকালের ডুব দেওয়ার
প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন ভেতর থেকে
শেষবারের মতো ভেসে উঠার
আওয়াজ আসছিল। মৃত্যু প্রবল
বিক্রমে টানছে জীবন তবু শেষ চেষ্টার
গান শোনাচ্ছে, হাল না ছাড়ার
প্রণোদনা দিচ্ছে।

এখন একান্ন’র রাস্তায়।
উনচল্লিশে জয়ী হয়ে
রাস্তার পরিধি বাড়িয়েছি।
জীবনের গানে আস্থা
আরো মজবুত হয়েছে।
পরাজয় সহজ, সহজ
আত্মসমর্পণ। জীবন আপোষের
মৃত্যুর চেয়ে অনেকগুণ মূল্যবান,
জীবনের মূল্য জ্ঞাত হতে হবে।

হাল ছেড়ে দিলে মানুষ
মরে যায়, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত
মানুষকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে
জীবনের পতাকা।

কবর

হ্যারিকেনের সলতে শুকিয়ে গেছে
তলানিতে যতটুকু কেরাসিন ছিল
ফুরিয়ে গেছে।

দপ করে জ্বলে ওঠা সুদূর অতীত
অবশিষ্টাংশ শুধুই ছাই
সব ফুরিয়ে গেলে যেমন
শূন্যতা ছেয়ে আসে

তেমনি শূন্য শরীর নিয়ে
অপেক্ষায় আছি, শীঘ্র কবরে ঢুকব।