আবু মকসুদ এর সকল পোস্ট

আরেকবার যাওয়া যায়

কবরের পাশে শ্মশানের পোড়া
গন্ধ এসেছিল, গন্ধ শুঁকে কবর
বুঝে ফেলেছিল এ নির্ঘাত নিতাই।

শ্মশানের নিতাই আর কবরের
বজলু একে অপরের গন্ধ ভালই
জানে, তারা হরিহর আত্মা ছিল।

গঞ্জের ওইসব ঘরে টাকার বিনিময়ে
মালতিবালাকে ভাগে ভোগ করেছে;
অন্যদিন সায়রা খাতুনও খোশ
করেছিল বেশ। পালদের মেয়ে
বজলুর প্রেমে পড়েছিল, নিতাই
চিঠি বাহকের কাজে গাফলতি করেনি।
যদিও পালদের দেশ ত্যাগে মহৎ প্রেম
পূর্ণতা লাভ করতে পারেনি।

নিতাইয়ের কনে দেখায় বজলু অগ্রে
ছিল, তার পছন্দ নিতাইয়ের পছন্দ
কনেপক্ষের বুঝতে অসুবিধা হয়নি।
নিতাইয়ের পত্নীর সাক্ষাৎ দাদার
চেয়ে বজলু দাদা প্রিয় ছিল, বজলু
বোনের মর্যাদা সব সময় অক্ষুন্ন রেখেছে।

হনুমানের কোলে কোরান নিতাই রাখেনি
এত অধঃপতন তার হয়নি, তবু এই
দোষে তাকেই যখন আক্রমণ করা হয়
বজলু সামনে দাঁড়ায়, চোখের সামনে
বোনের শ্লীলতাহানি সহ্য করতে পারে
কোন ভাই! মালাউনের প্রতি অতিরিক্ত
দরদের কারণে বজলু মারা যায়।

গতকাল তাকে দাফন করা হয়েছিল
আহত নিতাই যে আজ চিতায় চড়েছে
পোড়া গন্ধ তারই বার্তা ছড়াচ্ছে।

গত পরশু রাধাপদের দোকানে এক
কাপ চা ভাগে খেতে খেতে তারা
মালতিবালার পরিকল্পনা করছিল
আরেকবার গঞ্জে গেলে মন্দ হয় না!

দ্বন্দ্ব সমাস

আমাদের বন্ধু অতনু বিজ্ঞান ক্লাসে
কান ধরে বেঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকতো
কিংবা ক্লাসের বাইরে নীলডাউন।
সম অপরাধে আমরা মাফ পেয়ে
যেতাম, শুধু শাষাণ হত; শাস্তি
তেমন ভোগ করতে হত না।
আমাদের শিক্ষক সনাতন পন্থি;
অর্থাৎ হিন্দু, অতনুও হিন্দু
তবু তার প্রতি পক্ষপাতিত্ব ছিল না।

বড় পণ্ডিত বাংলা দ্বিতীয় পত্র
অর্থাৎ ব্যাকরণ পড়াতেন
ব্যাকরণ আমাদের বিভীষিকা
কানধরা, নীলডাউন ছাড়া
কোনদিন পার পেতাম না।

ছোট মৌলানা ধর্মের পাশাপাশি
অর্থনীতি। টাকাপয়সার ব্যাপারে
তখনো কাঁচা ছিলাম এখনো কাঁচা
অতনু মৌলানার প্রিয় ছাত্র ছিল
মুসলমান হিসাবে আমরা মৌলানার
অতিরিক্ত আনুকূল্য পাইনি।
মৌলানার দোয়ায় অতনু বিরাট
অর্থনীতিবীদ, আমরা তারই অধীনস্থ।

তখনকার দিনে শিক্ষকেরা ছাত্রে
ছাত্র দেখতেন; ধর্ম দেখতেন না।
এখন কি অবস্থা জানি না,
বড় পণ্ডিতের দ্বন্দ্ব সমাসে
নীলডাউন হইনি বহুদিন!

মন গাছ

মন বৃক্ষের নিচে একদিন ভয়ানক কান্ড ঘটে গেল, এই কাণ্ডের রেশ দীর্ঘ দিন আমাদের তাড়া করেছে।

শীলা নামের যে মেয়েটা মৃদুল কে ভালোবাসতো এক ভোরে তাকে দেখা গেল মন গাছে ঝুলে আছে।

ধরাধরি করে তার লাশ যখন নামানো হলো, আমরা তাকাতে পারিনি, তার জিব্বা মুখ থেকে অনেকখানি বেরিয়ে আছে। তাকে বীভৎস দেখাচ্ছে, যে স্নিগ্ধ মুখ আমাদের উৎপীড়িত করত সে মুখের এমন বীভৎস রূপ আমরা সহ্য করতে পারিনি।

অথচ তাকে প্রেমিকা ভাবার কোন কারন নাই, সে বিশ পেরিয়েছে আমরা টিনএজ বয়সও ছুঁতে পারিনি। তবু তাকে প্রেমিকা ভাবতাম, তার আশেপাশে ভিড় করে থাকতাম। শীলা আমাদের প্রশ্রয় দিত, বোনের আদরে গালে চিমটি কাটতো। তার একটুখানি আদরে আমরা দিশেহারা হয়ে যেতাম।

মন গাছের পাশ দিয়ে যে সরু রাস্তা পাড়ায় ঢুকেছে সেই সরু রাস্তায় একদিন মৃদুল কে দেখা গেল বর বেশে বধু নিয়ে আসছে।

তার বধু শীলার মতই স্নিগ্ধ, অথচ তাকে আমরা ডাইনি ভাবতাম। সে ডাইনি ছিল না, আমাদের মন পাবার জন্য সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করত। আমরা তাকে ঘৃণা করতাম বলতাম ‘ডাইনি তুই মর’।
একদিন তাকেও ডাইনির মত মন গাছে ঝুলতে দেখলাম, মৃদুল আরেক ডাইনিকে বিয়ে করে নিয়ে এলো।

সফেদা

আকাশে সফেদ মেঘ দেখলে
সফেদার কথা মনে হয়,
দুধ ধবধবে দাঁতের কামড়।

শরতের আকাশে মেঘ উড়ে যায়
সফেদ মেঘ, আমি তড়পাই;
সফেদায় কামড়ের পরে
ধবধবে দাঁতের হাসি আর দেখি না
তুমি এখন অন্য আকাশ।

মকাইশা দিন

কখনো কখনো দুপুরকে অসহ্য মনে হয়। মনে হয় বিলুপ্ত ফড়িংয়ের প্রতি যদি আরেকটু মায়া দেখানো যেত, ভয়ে লুক্কায়িত শালিকের প্রতি আরেকটু মানবিক হাত বাড়ানো যেত; তাহলে দুপুরগুলো এত অসহ্য হতো না।

আমাদের রাজত্বে সবারই নাভিশ্বাস। কুদালি ছড়ার তীর ঘেঁষে যে জনপদ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে; আমরা তার একচ্ছত্র সম্রাট। আমাদের অনুমতি ব্যতিরেকে কেউ শ্বাস ফেলতে পারে না। এই যে দুপুরের খাবার খেতে মতিউর শিকদার আসছেন; আমরা তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো। আমাদের অতিক্রম করতে হলে দু টাকার চকলেট তাকে দিতেই হবে। আমাদের চাহিদার বিপরীতে তিনি অসহায়, পাড়ার বুক চিরে যে রাস্তা তাকে বাসায় পৌঁছায় সেই রাস্তার মহারাজারা দাঁড়িয়ে আছে। রাজাদের সেলামি পরিশোধ না করলে দুপুরের খাবার অসমাপ্ত থেকে যাবে।

এমন না যে প্রতিদিনই আমরা রাজাগীরি ফলাতে যাই বরং অধিকাংশ দিন রাস্তার কিংবা জনপদের দখলত্ব আমরা ভুলে যাই। আমরা ব্যস্ত থাকি ফড়িং দিনে, কিংবা গুগলির নিশানায় শালিক দিনে।

যখন আমাদের কোনো কাজ থাকে না, যখন দুপুরগুলো কচ্ছপে পরিণত হয় তখন আমরা সম্রাট আওরঙ্গজেবের মত গর্দান খসাতে থাকি। আমরা চরম স্বৈরাচারী হয়ে উঠি।

গ্রীষ্মের দীর্ঘ ছুটিতে কোন কোন দুপুর আমাদের জন্য আতঙ্ক হয়ে দেখা দেয়। আমরা চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দুপুরের নিরানন্দ জংলা পাড়ি দেয়া। আমরা স্কুলে ফিরে যেতে মরিয়া হয়ে উঠি, অথচ স্কুল আমাদের পছন্দ নয়। স্কুলে আমাদের রাজত্ব চলে না; পাঁচ দিনের মধ্যে তিনদিনই ক্লাসের বাইরে নীলডাউন করে ঘণ্টা পার করতে হয়। তবুও বন্ধ্যা দুপুরের আতঙ্ক থেকে বাঁচতে স্কুলের জন্য প্রাণ আনচান করে।

স্বৈরাচারীত্ব মনে জ্বালা ধরাচ্ছে, বিনা প্রশ্নে আদেশ মেনে নিচ্ছে, উঠতে-বসতে সবাই সেলাম ঠুকছে। এসবই ফিকে লাগছে। সবাই যখন আমাদের তোষামোদিতে ব্যস্ত আমরা তখন মৃত ফড়িং কে ঘিরে কান্না করছি। তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। লুকিয়ে থাকা শালিকের কাছে মিনতি করছি অভিশাপ ফিরিয়ে নেয়ার। নিজেদের রাজত্বের বিনিময়ে আতঙ্কের দুপুর থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য কান্না করছি।

আমাদের প্রার্থনা যখন বিলাপে পরিণত হচ্ছে, কাকুতি শোনার গরজ দেখাচ্ছে না কেউ তখন ত্রাতা হয়ে সামনে আসে ‘মকাইশা’ দিন। আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে, মনে হয় আমরা শীঘ্র পৌঁছাব।

‘মকাইশা’ দিনের জন্য নিজেদের বিক্রি করতে রাজি ছিলাম তার কাছে রাজত্ব বা রাজমুকুট তুচ্ছ। আমাদের রাজত্বে সাকুল্যে পাঁচটি চাপকল ছিল, প্রতিটি চাপকলের জন্য বরাদ্দ ছিল বিশ মিনিট। ‘মকাইশা’ মাথায় তারা অর্ঘ্য দিত। প্রথম চাপকল থেকে পরবর্তী চাপকলে যেতে সময় লাগত দশ মিনিট, এই দশমিনিট আমরা তার শিষ্য। সেনাপতির পিছনে সারিবদ্ধ সৈনিক দল, যুদ্ধ জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা।

একটু আগেই দুপুরের আতঙ্ক যে কান্না করছিলাম, নিমিষে কান্না উধাও। অনিন্দ্য সুখ ধারায় আমাদের মন প্রফুল্ল, সুখী নৃপতির মত পালকের আসনে বসে উপভোগ করতে থাকি কাঙ্ক্ষিত ‘মকাইশা’ দিন। ‘মকাইশা’ আনন্দের ফল্গুধারা, আতঙ্কের দুপুরে সুউচ্চ পাহাড় ফুড়ে প্রবাহিত মুক্ত ঝর্ণা।

(সত্তর আশির দশকে ‘মকাইশা’ নামে একজন লোক মৌলভীবাজারে ছিলেন, শহরের বিভিন্ন পাড়ায় হঠাৎ দেখা দিতেন। তার অদ্ভুত এক ব্যাতিক ছিল, চাপকল দেখলেই মাথে নীচু করে পানি ঢালতেন। শৈশবে তার মাথায় পানি ঢালার চেয়ে আনন্দের আর কিছুই ছিল না। তাকে কেউ বলত পীর কেউ পাগল। আমাদের কাছে তিনি ছিলেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা)।

ইচ্ছা

শৈশবে গাছ হওয়ার ইচ্ছা ছিল। রবী-ঠাকুরের বলাই পড়ে এমন বৃক্ষপ্রেম জেগেছিল যে মনে হত গাছ জীবনই সার্থক। আমাদের পাড়ার এক কোনে মন গাছ ছিল; প্রতিদিন তার নিচে বসে থাকতাম। তার সাথে আলাপ করার চেষ্টা করতাম; জানতে চাইতাম কিভাবে সে বৃক্ষ হল। তার কি কোন দুঃখ ছিল, কোন অপ্রাপ্তি থেকে কি সে বৃক্ষ হয়েছে। এ ব্যাপারে সে কিছুই বলতো না, ব্যক্তিগত প্রশ্নে সে নিশ্চুপ। তার কাছ থেকে স্পষ্ট কোন ধারণা না পেয়ে আমার গাছে রূপান্তর হল না। সে ভাসা ভাসা যা বলেছিল সেটা যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি, তার কথা হচ্ছে গাছে রূপান্তরের প্রাথমিক প্রক্রিয়া হচ্ছে প্রচুর বসে থাকা, এবং বৃক্ষ সংগে থাকা। তার ছায়ায় যদি দিনে কয়েক ঘন্টা বসে থাকি তবেই ধীরে ধীরে শিকড় গজাবে। প্রথম প্রথম তার কথা সত্য মনে করে তাই করেছি, দিনের অধিকাংশ সময় মন বৃক্ষের নীচে বসে থেকেছি। কয়েক মাসেও যখন শিকড়ের কোন আলামত দেখা গেল না তখন সন্দেহ হল, এভাবে কি সত্যি বৃক্ষ হওয়া যায়। বুঝলাম মন আমাকে মিথ্যা বলছে, বসে থেকে শিকড় গজানোর সম্ভাবনা নেই। বুঝলাম মন আসলে নিঃসঙ্গ, সঙ্গের কাঙাল। আমার সঙ্গের লোভে মিথ্যা বুঝিয়েছে। ধীরে ধীরে বৃক্ষ প্রেম ফিকে হতে থাকল, তবু মনের মায়া ত্যাগ করতে পারলাম না। সময় পেলেই তার সাথে খাজুরে আলাপে মেতে উঠতাম।

কৈশোরে সহপাঠিনীর ওড়না হতে চাইতাম। লাজুক হিসাবে আমার খ্যাতি ছিল। তোৎলামি আমার স্বভাবে ছিল না কিন্তু কোন সহপাঠিনী দশ সেকেন্ডের কথাবার্তায় আমাকে তোৎলা ঠাওর করতো। সহজ প্রশ্নের সহজ উত্তর আমি দিতে পারতাম না, তাই কোন সহপাঠিনীর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেনি। আমার কোন মেয়ে বন্ধু হবে না নিশ্চিত হলে আমি তাদের ওড়না হয়ে গলায় ঝুলে থাকতে চাইতাম।

যৌবনে পেয়ে বসেছিল পাহাড় প্রেম, দিগন্তে হারিয়ে যেতে ভাল লাগতো। আমাদের পাড়া থেকে নিকটবর্তী পাহাড় দুই মাইল দূরত্বে, প্রতিদিন একবার পাহাড় মাড়াতে না পারলে দিন পূর্ণাঙ্গ হত না। এখন ফিরে গেলে দেখি পাহাড় প্রেমের অন্য কারণ বিদ্যমান। পাহাড়ের পাদদেশে সাদামাটা এক কুঠির ছিল, কুঠিরে সাদামাটা এক তরুণী ছিল। কৈশোরের তোৎলামি অসুখ যখন ধীরে ধীরে সুস্থতায় রূপান্তরিত হচ্ছে তখন টিয়া রঙের এক তরুণী সামনে এসে হাজির। কলেজের কৃষ্ণচূড়ায় একঝাঁক টিয়া আস্তানা গেড়েছে; তাদের কিচিরমিচির, হট্টগোলের মাঝে টিয়া রঙের ওড়না মন কেড়ে নিল। পরবর্তী কালে কলেজের পাশের ক্যাফেতে পাশাপাশি চেয়ারে টিয়া রঙের উৎস জানতে চাইলে তরুণী আমাকে পাহাড়ের পাদদেশে আমন্ত্রণ জানায়। সেই থেকে আমার পাহাড় প্রেম।

সংসারে প্রবেশের মুখে নদী আমাকে মাতিয়ে রেখেছিল, স্ত্রীর নাম নদী তার শখ ছিল নদী ভ্রমণের। তাকে নিয়ে নৌকায় ঘুরে বেড়িয়েছি অনেক, নদী প্রেম এখনো আমাকে জড়িয়ে রেখেছে। টিয়া রঙের উৎস শেষ পর্যন্ত জানতে পারনি। অন্য জেলার শালিক টিয়া কে উড়িয়ে নিয়ে গেছে, কিছুদিনের জন্য তোৎলামি ফিরে এসেছিল কিন্তু নদীসঙ্গে তা পুরোপুরি মিটে গেছে।

এখন আমার ইচ্ছা সমুদ্রে মিলানোর। আমি আর নদী হাত ধরাধরি করে ছুঁয়ে দিচ্ছি সাগরের জল। ঢেউ এসে টলোমলো পায়ের আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আমি হাবুডুবু খাচ্ছি। নদী আমাকে টেনে তুলছে, মুমূর্ষু আমাকে দিচ্ছে সঞ্জীবনী চুম্বন।

কাক ও আকাশ

আমার এক চিলতে জানালায় চোখ রাখলে আকাশ দেখা যায়। দৃষ্টি আকাশে পৌঁছানোর আগে গোটা কয়েক শিমুলের ডাল। শীতের প্রস্তুতি চলছে, ডালগুলো পাতাশূন্য হতে শুরু করেছে। মাসখানেকের মধ্যে মরুভূমি বৃক্ষে পরিণত হবে। আজ আকাশের মতিগতি ভাল না, রাগের আভরণে নিজেকে অন্ধকার করে রেখেছে।

প্রতিদিন সকালে আমি আকাশের দিকে বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করি। মন খারাপ থাকলে ভালো করার চেষ্টা করি, একটু ঠাট্টা তামাশা। বাজার চলতি কৌতুক গুলো তাকে শোনানোর চেষ্টা করি। আকাশের রসবোধ ঠিক উচ্চাঙ্গের নয়, প্রায়শই সে হাসে না। মুখ গোমরা করে রাখে। নিজ পরিবেশিত কৌতুক শুনে; নিজেই হেসে লুটোপুটি খাই। কখনো কখনো আনন্দের আতিশয্যে চোখে জল এসে যায়।

আজ বন্ধুর মন খারাপ। গতকাল ইন্টারনেট ঘেঁটে ঘুঁটে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি, শোনানোর মত মজার কোন কৌতুক আজ ছিল না। তবু যা ছিল তা শোনাতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম, আমার কৌতুক শুনে আকাশ আরো অন্ধকারে ছেয়ে গেল।

শিমুল ডালের দিকে চেয়ে পুনরায় চেষ্টা করতে গেলাম, দেখলাম এক কাক এসে বসেছে। অহেতুক কা-কা আওয়াজে বিষণ্ন সকালকে বিষণ্ন্নতর করে তুলছে। আকাশকে বাদ দিয়ে আমি কাকের প্রতি মনোযোগী হলাম। তাকে যদি খুশি করা যায়, আমার কৌতুক শুনে তার কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে আগের মত কা-কা আওয়াজ ছাড়তে থাকলো। সেটা আনন্দের আতিশয্যে না গভীর বিরক্তিতে বুঝতে না পেরে বিভ্রান্ত হলাম। বস্তা পঁচা অন্যান্য কৌতুক একে একে শুনিয়ো কোন ফায়দা হলো না, কাক কাকের মতই ব্যবহার করতে থাকলো।

শেফিল্ডের আজকের সকাল অন্ধকারাচ্ছন্ন, কাকান্ধকারে ছেয়ে আছে। ডাকঘরের অমলের মত দইওয়ালা কে ডাকছি, আমার ঘরের জানালায় এসে উঁকি দেবে। দই ওয়ালা এলেই পাখা গজাবে; আকাশে উড়বো, চাই কি; কাককেও উড়বার সাথী করে নেব।

কখনো কখনো মনে বিষণ্ন্নতা ভিড়; করে উদার আকাশও সে বিষণ্নতা দূর করতে পারে না। কোন কারন ছাড়াই আজ বিষণ্ন মন।

মুক্ত পাখি

আহা, সুলেখা তোমাকেই খুঁজছিলাম
চারপাশে এত বেশি ইতর
দু’দণ্ড কথা বলার জন্য
প্রাণ ধরফর করছিল।

সুলেখা, ওই যে পাখি দেখছো
মুক্ত আকাশকে ঘর বানিয়ে নিয়েছে
ইতরের পাল্লায় পড়লে
পাগলা গারদে বন্দী জীবন কাটাতো।

সুলেখা, পাখির কি কোন দল হয়; না থাকা উচিত
ডানায় কি আনুগত্যের ছাপ মারা থাকবে
যদি সেও পোষা তোতা হয়ে যায়
আকাশকে ঘর ভাবার অধিকার কি থাকবে!

নিন্দিত ইতর কিছুই বুঝে না
তারা চায় পোষা তোতা, নিজেদের খাঁচা জীবনে
সবাই বন্দী হউক এটাই তাদের চাওয়া
খাঁচাকে তারা বিশ্ব ভাবে, এত ক্ষুদ্র তাদের জীবন।

সুলেখা, তুমি পাখি হয়ে থেকো, মুক্ত পাখি
ইতর সম্প্রদায় যতই নিন্দা ছড়াক
নিজেকে মুক্ত রেখ, তোমার জন্য ফুলের সুবাস
নিজেদের মলে ইতরের খাঁচাবন্দি জীবন।

শেফালি

শেফালিকে আমি চিনি
এক সময় চিনতাম

ওই পাড়ায় থাকে
সন্ধ্যার পরে অতি অতি
অভিজাত যে পাড়ায়
ভীড় করে।

এক দুপুরে এক কাপ
চা ভাগ করে খাওয়ার
সুযোগ হয়েছিল।

চা খেতে খেতে ভবিষ্যৎ মুখী
কিছু কথা
কিছু আশা, কিছু স্বপ্ন।

শেফালি চৌদ্দ’র ছিল
এখন চব্বিশ, যৌথ স্বপ্নের
প্রথমে পিতৃবিয়োগ
পরে মাতৃ।

মামাশ্রিত গঞ্জনা অসহ্য হলে
বিদ্রোহী শেফালি;
ফলাফল বাস্তুচ্যুত।

পিতামাতার ছায়া আমার
মাথায় এখনও বিদ্যমান
তাদের আশির্বাদে
আমি অভিজাত হয়েছি।

মাঝেমধ্যে ওই পাড়ায়
যৌথ স্বপ্ন দেখতে যাই
মন্দ লাগে না।

অস্থায়ী

বৃক্ষের পাতা ঝরা দিন আসে;
নদী একদিন মরে যায়,
চকচকে পিচের রাস্তা, ক্ষয়ে গেলে
আস্তানা গাড়ে ছাল ওঠা সারমেয়।
যৌবনে বুকের বোতাম খুলে
যে যেত শীত পাড়ায়
আজ সে জুবুথুবু, অতিরিক্ত
বস্ত্রে শীত আটকে না।

চৌকশ খেলোয়াড়; পায়ের
ঘূর্ণি তুলে যে মাড়াত
প্রতিপক্ষের জাল, ক্রাচের
সাহায্য ছাড়া পা ফেলতে
পারে না। ক্যারিয়ারের তুঙ্গে
সিঁড়ি মাড়ানো সেই যুবক
আজ উঠানের সামান্য
সিঁড়ি মাড়াতে পারে না।

তীক্ষ্ণ তীরন্দাজ বইতে পারে না
ধনুকের ভার, সেই তলোয়ার-বাজ
ধুকছে; বুকের হাপরে অক্সিজেনের
অভাব। ছবির মোনালিসার
মন ভুলান হাসি
মৌসুমি প্রেমিক কে সাময়িক
স্বস্তি হয়তো দেয় কিন্তু
রাতের বিছানায় অক্ষম
পুরুষ তার নাগাল পায় না।

একদিন ক্ষয়ে যেতে হয়
একদিন মুছে যেতে হয়।
জগতে কিছু চিরস্থায়ী নয়
জগত চিরস্থায়ী নয়।

তোমরা ভুলে গেছ মল্লিকাদির নাম

দিদির নাম মল্লিকা ছিল না কিংবা
মল্লিকা-ই, নামের হেরফেরে ঘটনা বদলায় না

কাজল পড়া গাঁয়ের বধুর সৌভাগ্যটুকু
জোটেনি তার ভাগ্যে, দূর আকাশের

তারাও মনে রাখেনি, মুছে গেছে;
নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে আমাদের মল্লিকাদি।

এক চিলতে বারান্দার কোনে
ইজেলে এক মনে ছবি আঁকত দিদি।

নিজের জীবন ভাল করে বুঝে উঠার
আগেই ইজেলের মলিন ক্যানভাসে

সেঁটে গেল তার ছবি, সময়ের কষাঘাতে
মরে গেল ইজেলের রঙ। বিবর্ণ

কাঠ ক্ষয়ে ক্ষয়ে উনুনের আগুন হল;
পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করল মল্লিকাদির জীবন।

সাড়ে দশ খুব বেশি রাত নয়;
মফস্বল শহরের জন্য অবশ্য একটু বেশি।

শহরের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা
আবৃত্তি শেষে একাই ফিরছিল। সাড়ে

বারোটায় ঘর থেকে উনপঞ্চাশ ফুট দূরত্বে
আহত অবস্থায় পাওয়া গেল, হাসপাতালে

ডাক্তার বলল ধর্ষিত। ভাল ঘরের মেয়ে
এত রাত বাইরে! প্রতিউত্তরে নিশ্চুপ

মুখ। ডুমুর গাছের ডালে মল্লিকাদি
যখন ঝুলছিল; হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম।

এখন রঙচঙ বড় শহরে থাকি। মফস্বল
ছেড়েছি কয়েকজন্ম আগে। পরিবারের

লজ্জা। মল্লিকা নামে আমাদের পরিবারে
কেউ ছিল না। আমার দিদির নাম মল্লিকা নয়।

তাকে আমরা ভুলিনি। মফস্বল ছাড়ার পূর্বে
ডুমুরের গাছ আমরা কেটে ফেলে ছিলাম।

অভিশাপ

আমার বুকে কান্না বৃষ্টি হয় না
আমি কী তবে সীমার হয়ে যাচ্ছি!
কষ্টে কাতরাতে থাকে মানুষ
মায়া জাগে না, আমি কি তবে
পাষাণ হয়ে যাচ্ছি!

চারিদিকে নিদারুণ কাল, গ্রহণের সূর্য
ছড়াচ্ছে উত্তাপ, আমি দিব্যি
সঙ্গম শেষে চুমুক দিচ্ছি
আয়েশের চা’য়ে।

কিছু কী করার কথা ছিল, ব্যতিক্রমী
কিছু! জানি না, মানুষের মত আচরণ
প্রলুব্ধ করে না, আমি কী তবে
অমানুষ হয়ে গেছি!

ক্রমেই খারিজ হচ্ছি, রূপান্তরিত
হচ্ছি! সম্মুখে ডুবন্ত প্রাণ,
মানুষ শিকড় ছেড়ে পালাচ্ছে,
দূরত্বে রোদ চশমায়
নিজকে আড়াল করছি।

আমি ত্যাজিত হয়েছি, মনুষ্যত্ব ছেড়ে গেছে
তাদের একজন নই, আমি অধমের অধম।

নগরের দরজায় আমাকে ঝুলানো হোক
ঘৃণায় ভস্ম করা হোক,
ছাই থেকে যদি উত্থিত হই, মানুষ হয়ে যদি
জন্মাই। মানুষের কষ্টে বুক যেন ব্যথিত হয়!

পাখি

জানালার বাইরে যে বৃক্ষ
তার ডালে পাখি,
এইমাত্র দেখলাম উড়ে গেল।

বৃষ্টি শুরু হয়েছে
কাঁপছে গাছের পাতা;
কাঁপছে জানালার পর্দা।

পাখি ফিরেছে, গোটানো ডানা
ভিজে জড়সড়;
তবু অবারিত আকাশে
উড়তে কোন বাঁধা নেই।

পাখির অবাধ স্বাধীনতা
চাইলেই পারে অন্য আকাশে উড়তে।

আমার স্বাধীনতাটুকু বিছানা
বন্দী হয়ে আছে! গোটানো পর্দার ওপাশে
বৃক্ষ; পেছনে একটুকুন মাঠ।

আড়াই বছর বিছানা বন্দী;
বৃক্ষের সাথেই যাবতীয় সখ্যতা।

পাখি আমাকে চিনে না
অর্থব, পঙ্গু কাউকে
চেনার দায় তার নেই।

একদিন পাখি হয়ে
উড়তে চেয়েছিলাম;
সেই চাওয়াই হয়েছিল কাল।

এখন কোন পাখি আমাকে চেনে না
কেউ চিনতে চায় না
অথর্ব, পঙ্গু ডানা ভাঙ্গা পাখির মত
বিছানায় পড়ে থাকি।

মুক্তি

দ্বিতীয়বার যখন কতলের জন্য নিয়ে গেল
কোন অজুহাত দেখাতে পারলাম না

প্রথমবারের অপরাধও অত্যন্ত গুরুতর ছিল
চাইলে তারা প্রথমেই কতল করে ফেলতে পারতো,
কিন্তু তাদের দয়া শরীর; সতর্ক করে
মাফ করে দিল। দ্বিতীয়বার মাফ পাব না জানতাম

কিন্তু অভ্যাস; অনেক চেষ্টার পরেও নিজের বিশ্বাস থেকে
সরে আসতে পারলাম না। সমঝোতা করতে পারলে

হয়তো বেঁচে যেতাম। বন্দি খাঁচায় তোতা পাখির জীবন
আমাকে বাঁচিয়ে রাখত; কিন্তু যে পাখি ওড়া শিখেছে
সেকি বন্দিত্ব মেনে নিতে পারে। মুক্ত আকাশের

ইচ্ছা আজ আমাকে অন্তে পৌঁছাচ্ছে। আফসোস!
না হচ্ছে না। পুনরায় ছেড়ে দিলেও
মানুষের মুক্তির কথা বলা বন্ধ করব না।

বিকিনি পাড়া

রোদে আইসক্রিম গলে গেল;
খাব খাব করেও খাওয়া হল না।

বিচে অর্ধনগ্ন নরনারী। রোদ খোলস
খুলেছে। যারা এতদিন ঘোমটায় ছিল;
বিকিনি মল ঘুরে তারা রোদের সাথে
সঙ্গমে মেতেছে। গতকালের মনখারাপের
আকাশ রোদের তীব্র নেশায় মাতাল
হয়েছে। সমুদ্রের জলে সাঁতার কাটছে হাঁস।

সি-গল মধ্য সমুদ্র থেকে নোনা বাতাস
বয়ে এনে বিকিনিদের মনে জাগাচ্ছে
লবনস্বাদ। অর্ধনগ্ন পুরুষ মেতেছে সমুদ্র
মন্থনে, জল থেকে উর্বশীর পুনরুত্থান
অবশ্যম্ভাবী। অমৃত পানে পূর্ণ যৌবন
ফিরে পাবে পুঙ্গব প্রজাতি; এই আশায়

সমুদ্র খুঁড়ে যাওয়া। কিছুক্ষণ সমুদ্র
বাতাসে প্রাণ জুড়াব ভেবে সমুদ্র বিলাস।

তপ্ত রোদে তৃষ্ণা জেগে উঠলে জলের
খোঁজে উঠেছিলাম। আইসক্রিমের
হাতছানিতে জল গৌণ হয়ে গেল। সামনে
বিকিনি পাড়া; আমি এক মুগ্ধ দর্শক।

আইসক্রিম রোদে গলে গেল, আমিও;
বিকিনির তাপে পুরোপুরি গলে গেলাম।