চন্দন ভট্টাচার্য এর সকল পোস্ট

নি –সা-রে-গা

নি –সা-রে-গা

ভোর সাতটার জামরুলতলা, কী খুঁজছে দুধ-খরগোশ!
জবাব যে জানে রাত করে শোয়, ডেকে দি’ দাঁড়া — নিসর্গ?

ধূপকাঠি-ছেলে, জিয়ল মাছের ঝোল খাক রোজ দুপুরে
কান্না থামবে, তবেই না খাওয়া! ছেড়ে এসো মাছ পুকুরে…

মাঠপথে হাঁটি ঘাস না মাড়িয়ে — কাঁহাতক বলো পারা যায়?
“দেখে দেখে চলো বাবা, ওরা ছোট, চিৎকার ক’রে মারা যায়”

রেজাল্ট বেরলো, নিচু নাম্বার, সান্ত্বনা দেব — তৈরি।
একগাল হেসে: “ফার্স্ট কে, শুনেছ? ভীষণ বন্ধু গৈরিক!”

এখন জোফার, রিফ্যামপিসিন, পেনিসিলিনের বদলে
ওকে প্লেটো-হিনি-জয়েস-দেরিদা পাহারা দিচ্ছে সদলে

আয়ু-খরগোশ লাফিয়ে উঠল ডাল থেকে পাতা — বৃক্ষের,
নি-সা-রে-গা — তুই আখরের সুর, তোর আলো করি ভিক্ষে…

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত
এগারো

কিশোর কুমারের তিরিশ বছরের তিথি (১৯৫৫-১৯৮৫) পার করে আরও তিনদশ অব্দ পরে ২০১৫-য় অরিজিৎসিংগীত উঠে এসেছে। এই মাঝ সময়ে হিন্দি সিনেমার প্রেমের গানে ভাবের জ্যামিতি আস্তে ক’রে ঘুরে যাচ্ছিল। ‘তূ মেরী হ্যায়’ থেকে ‘ম্যায় তেরা হুঁ’ সেই বিবর্তন; যা পুরুষের নিজের বিরুদ্ধে এক বিপজ্জনক কিন্তু ওভারডিউ বিদ্রোহ। নিজের ক্ষমতাসীন আইডেনটিটি ধ্বংস করে এই যে প্রিয় নারীর সামনে হাঁটু নামিয়ে বসা, তাকে ঈশ্বরী মেনে আত্মসমর্পণ — এই দর্শনক্রিয়ার হুইসেল ব্লোয়ার না হলেও প্রধান অগ্নিহোত্রী নিশ্চয়ই অরিজিৎসিংগীত।

এইভাবে এখনকার হিন্দি সিনেমার গানে অহংশূন্য হল পুরুষসত্তা, ভালোবাসার যা প্রথম নিধি। নিশিতানি বলেছিলেন না, আধুনিক মানুষের নিজেকে জানা বিষয়টা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজের ইগো-কে জানা? অবশ্য জাপানের অধ্যাপকের কিছুটা আগে দাঁড়িয়ে আছেন সন্ত কবীর:

পীয়া চাহৈ প্রেম রস, রাখা চাহৈ মান
দোয়ে খড়্গ এক ম্যায়ন মে, দেখা শুনা না কান

[হয় তুমি প্রেমের রস পান করো, অথবা নিজের অহংকারকে বাঁচিয়ে রাখো। দুটো খড়্গ একই খাপের মধ্যে বসে আছে — এমন ঘটনা চোখ কখনও দেখেনি, শোনেনি কানও]।

গুছি গুছি উদাহরণ হরণ করে আনা যেতে পারে, কিন্তু আলোচনার সুবিধের জন্যে সুনিধি চৌহান-অরিজিতের ‘দরখাস্ত’ গানটাই আমি বাছব। শুরুতেই সুনিধি বলল: এসো, আমাকে এতোটাই ভালোবাসবে যা আমি কখনো ভুলে যেতে পারব না। উত্তরে অরিজিৎ: অনুরোধ (দরখাস্ত) এই যে, আমার দুবাহুর মধ্যে এসে তুমি বাকি পৃথিবীকে ভুলে যাও।

দেখুন, এখানে নায়িকার নির্দেশমূলক অনুরোধের বদলে নায়ক একটা প্রস্তাবমূলক অনুরোধ পাঠাচ্ছে। সে তৎক্ষণাত “তো আ যা মেরি বাহোঁমে” বলে কিশোর-ভঙ্গিতে নায়িকার চার্জ নিয়ে বসেনি। ‘গুজারিশ জান হ্যায় ইয়ে” ব’লে প্রার্থনা জানাচ্ছে — জীবনে যতটুকু সময় অর্জন করতে পেরেছ, সব আমার নামে লিখে দিও তুমি!

দ্বিতীয়ত, এই গানে যৌনসম্পর্কের মেটাফর — এসো আমরা একে অন্যের শরীরে এমন ক’রে স্পর্শের আলপনা আঁকি যা কোনও বৃষ্টি মুছে দিতে পারবে না — নায়িকা গাইছে, নায়ক নয়। সত্যি বলতে, এই কামনাসিক্ত গানটায় অরিজিতের লিরিকে যৌনতার লেশমাত্র নেই।

তিন নম্বর ব্যাপার: নায়িকা এখানে পরিযায়ী আর ছেলেটি স্থানবন্দী, অপেক্ষারত। সুনিধি বলল,
তুঝসে তো হুঁ ম্যায় ইয়ুঁ বহোত মুতাসির
পর ক্যা করুঁ ম্যায় হুঁ এক মুসাফির
[তুমি তো আমাকে খুবই প্রভাবিত করেছ; কিন্তু কী করি বলো, আমি যে একজন পর্যটক]।

মানে, নায়িকাকে চলে যেতে হবে ভালোবাসার বাঁধন কেটে। ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারোঁ ব’লে কিশোরযুগে ঘুরে বেড়াতে আমরা তো স্বয়ং হিরোকেই দেখতাম। এবং কালাপাত্থর-এর ‘এক রাস্তা হ্যায় জিন্দগি’ গানে (যেখানে হয়তো হিরো হন্ডাও ছিল) দরখাস্ত-এর ঠিক উলটো কাহিনি। বাইক-আরোহীকে লতা ডাক দিয়েছেন,
ও জাতে রাহী ও বাঁকে রাহী, মেরে বাহোঁ কো ইন রাহোঁ কো
তূ ছোড়কে না জা, তূ ওয়াপস আ জা

জবাবে খানিকটা আজকের সুনিধির মতো কিশোর বলেছিলেন,
রূপসৌন্দর্যের দৃশ্যই হোক বা বাসনাময় প্রেমের ডাক
স্বাধীন পাখির উড়ানকে এসব কিছুই থামাতে পারে না।

যদিও দরখাস্ত-এর একদম শেষ স্তবকে নায়ক-নায়িকা একই সমে এসে মিলছে, তবু সাহির লুধায়ানভি-র ১৯৭৯ সালে লেখা মুক্তপুরুষের গানখানা ২০১৬-তে সয়ীদ কাদরি-তে এসে দুই সমকোণ ঘুরে এক মুক্তমনা নারীর সংলাপ হয়ে উঠল। অরিজিৎ শুধু বারবার ‘তু মেরি বাহোঁমে দুনিয়া ভুলা দে’-র গুজারিশকে মধ্যসপ্তকের বীজতলায় একটু নাড়াচাড়া করে একলাফে তারা-র দ্বিগুণ অক্টেভে নিয়ে ফেলতে লাগল; আর ততই আর্তির রক্ত ছিটকে লাগল আমাদের চোখেমুখে!

নারী-পুরুষ সম্পর্কের মধ্যে এই রোল রিভার্সাল অরিজিৎযুগের এক মৌলিক পহচান।

(লেখাটা শেষ হতে ভুলে গেছে)

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত
দশ

আমি এই গদ্যের শুরুতে বলেছিলাম ওরে গৃহবাসী গানটার গণসংগীত হয়ে ওঠার দারুণ সম্ভাবনা ছিল; হাতে পেলে কবীর সুমনই বানিয়ে ফেলতেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আসল-মা কড়ি-মা সব কায়দামতো লাগিয়ে এমন ব্যাপার করে বসলেন যে সঞ্চারী আসতে আসতেই দেখি বসন্তের উদাস হাওয়ার ভেতর মধুর মতো কান্নাবিন্দু জমে গেছে।

বিধির বিধান কাটবে তুমি বা সংকোচের বিহ্বলতা-ও সেই ভাষাগত দক্ষতা নিয়ে জন্মেছিল যা কম্পোজারকে লোভ দেখায় হুকুমের সুর বসাতে। সুরের যে আদিগন্ত মাঠ পড়ে আছে, সেখানে বর্ষার নতুন চারা-জলে আপনি ঘুনসি পাতার মতো এক-ছেলে এক-মেয়ে পাশাপাশি রেখে দিলেন। ফলে যা হল তাকে প্রেমের গান বলে বিশ্বসুদ্ধ সবাই। আবার হতে পারে সন্ধেচাঁদের কেরামতি ফুটতেই ওই মাঠে লম্বা ঘাসের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সাঁজোয়া গাড়ি আর সৈন্যেরা লাফিয়ে প’ড়ে কুঁজো হয়ে দৌড়ে গেল, পোজিশান নিচ্ছে, গুলি ছুঁড়ল, আবার ছুট। পেছন থেকে হাত-মাইকে ভেসে আসছে সুরকার কম্যান্ডারের নির্দেশ।

গানকে যুদ্ধ হিসেবে নেওয়া এই গণসংগীত স্বরের বিশেষ ওঠাপড়ায় যাবে না, নৌকো বাঁধবে না মন্দ্র সপ্তকে। রাগ সংগীতের কিছু অংশ, রবীন্দ্রনাথ যাকে তিতিবিরক্ত হয়ে বলেছিলেন ওস্তাদি গান, সেখানেও প্রভূত সমরসজ্জা দেখি, সেই সঙ্গে ফটাস, দুড়ুম, গলগল… বোঝা যায় গণসংগীতের সঙ্গে এদের আসন-সমঝোতার সম্ভাবনা কতটা উজ্জ্বল হয়ে আছে।

আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথের কোথাও এমন গণগানের সুর কি ভেসে বেড়ায়, ‘একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে’ যেমন? বা, ‘জয় তব বিচিত্র আনন্দ হে কবি’!

আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন লিখেছেন, ‘জয় প্রবল বেগবতি সুরেশ্বরি জয়তি জয় গঙ্গে’ গানটা যদুভট্ট রঙ্গনাথ ছদ্মনামে লেখা তার সঙ্গীতমঞ্জরী বইতে নিয়েছিলেন। সেই গঙ্গাস্তোত্রকে রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরোপাসনামন্ত্রে পালটে দিলেন; রাগ বৃন্দাবনী সারং, তাল তেওড়া বহাল থাকল।

এই গানের সুরের খাড়া ধাক্কাগুলো আর পর্বতারোহী ভঙ্গি শুরুতে শ্রোতাকে অপ্রস্তুত করতে থাকে কিন্তু বেশিক্ষণ আঘাত করতে পারে না, কেননা রবি ঠাকুরের শ্লোক এসে শুনিয়ের পিঠে হাত রেখেছে — জয় অমৃত তব, জয় মৃত্যু তব, জয় শোক তব, জয় সান্ত্বনা। কথাগুলো যেন সুরের একমুখী অগ্রগতির সম্বিত ফেরাতে তার কানে কানে বলছে: পেছনে তাকিয়ে একবার দ্যাখো, আমি বিনাশেরও জয়ধ্বনি দিয়েছি, সাপোর্ট করেছি সন্তাপকেও। তাই তুমি শমতায়, সাম্যে থাকো। এইভাবে পূজা পর্যায়ের গানটার সুরে যে নিরাশ্রয়তা, তাকে কথা আরও একবার ক্ষতিপূরণ দেয় যখন সে পুজোর শঙ্খশব্দের মধ্যে ভালোবাসার একগুছি ধূপকাঠি জ্বালালো — ‘জয় প্রেমমধুময় মিলন তব’ এবং তার পরেই আবার অনাসক্ত প্রমাময় করে তুলল সেই অনুভবকে: ‘জয় অসহ বিচ্ছেদবেদনা’।

শুনতে শুনতে মনে পড়ে সনমজিৎ তলওয়ার-এর লেখা ডিশকিয়ায়োঁ (Dishkiyaoon) সিনেমার একটা ডুয়েট, পলক মুছাল অরিজিৎ সিং-এর।

প্রথম স্তবক (অরিজিৎ গাইছে)
তূ হী হ্যায় আশিকী তূ হী আওয়ারগী
তূ হী হ্যায় জিন্দগী তূ হী জুদা
[তুই প্রেম, তুই স্বেচ্ছাচারিতা, তুই জীবন, তুই বিচ্ছেদ]।

দ্বিতীয় স্তবক (অরিজিৎ গাইছে)

তূ ইবতেদা মেরী/ তূ ইন্‌তেহা মেরী/ তূ হী মেরা জাহাঁ/ তূ হী জুদা
[তুই আমার শুরু/ তুই আমার অন্তিম/ তুই আমার পৃথিবী/ তুই বিচ্ছেদ]।

প্রায় কাছাকাছি অর্থের আরও এক পিস অরিজিৎসংগীত “আজ ফির তুম পে-র চতুর্থ স্তবক:

তূ হী মেরী আওয়ারগী/ তূ হী দুয়া হর শাম কী
তূ খামখা তূ লাজমি/ তূ হী রজা, তূ হী কমি
অর তূ হী ওহ ফিরাক হ্যায় জিসকো
হ্যায় সিলসিলোঁনে মেরে পাশ লায়া
[তুই আমার স্বেচ্ছাচারিতা, তুই-ই আমার প্রতি সন্ধ্যার প্রার্থনা। তুই আমার অকারণ, তুই-ই আমার অবশ্যম্ভাবী। তুই আমার ইচ্ছে (Willingness), তুই আমার অসম্পূর্ণতা। আবার তুই সেই বিরহ যাকে ঘটনাক্রম আমার কাছে এনে ফেলেছে]।
এই গানের লেখক আজিজ কাইসি আর অর্কপ্রভ মুখার্জি। শুধু দুটো শব্দের অন্য গভীরতর অর্থের দিকে আমি পাঠকের মুখ ফেরাতে চাইবো। একই নারী থেকে পরিচর্যা পাওয়া দুটো বাচ্চার মধ্যে যে বন্ডিং থাকে, ‘রজা’ হল তাই। আর ‘কমি’ — জাপানি শিন্টো ধর্ম অনুযায়ী দিব্য অস্তিত্ব, ঈশ্বর।

তাহলে ‘জয় তব বিচিত্র আনন্দে’ ছিল ঈশ্বরের সমগ্রতার কথা। উপনিষদের সর্বেশ্বরবাদ মানলে ঈশ্বর বিশ্বের মধ্যেই ক্রিয়াশীল এবং বিশ্বকে ব্যাপ্ত করে আছেন। এই ব্রহ্মই ভুবনের উপাদান, বসুমতীর বিভিন্ন রূপও তিনি, ধরিত্রীর নিমিত্তও সেই ঈশ্বর, আবার পৃথিবীর উদ্দেশ্য কারণও স্বয়ং ব্রহ্মা। এই জগতের প্রতিটি ক্রিয়া তাঁরই অপরিহার্য কাজ। সুতরাং তথাকথিত ভালোটুকু ঈশ্বরের দেওয়া আর তথাকথিত মন্দের দায়িত্ব অন্য কারও এমনটা তো হতে পারে না! তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টি আর তাঁর প্রলয় দুইয়েরই জয়পতাকা ওড়ালেন। অরিজিৎসংগীতেও নীতিগতভাবে ওই কাজটাই করা হল ঈশ্বরকে প্রেমিকা দিয়ে রিপ্লেস করে — যে ভাবমর্ম, আমরা জানি, মানুষের মনে কম প্রাচীনতা লাভ করেনি।

(আরও বাকি)

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত
সাত

আমার মনে হয়, গড় বাঙালি পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর পরমায়ু থেকে স্বেচ্ছায় রবীন্দ্রসংগীতের দিকে ঝোঁকে। তার আগে শ্রোতাজন্মের গু-মুত কেটে, খাইয়েপরিয়ে তাকে উপযুক্ত ক’রে তোলে যে মা-বাবাসকল তারা হিন্দি সিনেমার গান, বাংলা আধুনিক, পাশ্চাত্যের কিছু পপুলার মিউজিকও। তো, “ছোট” ঘর থেকে এসেছে বলে পুরনো ফ্যামিলির সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রাখে না সদ্যবিবাহিত, অনেকে আরেক ধাপ জীবনসঙ্গী পালটে রবীন্দ্র থেকে দেশি-বেদেশি মার্গসংগীতের ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়। এই জন্যেই অভিজাত সংগীততন্ত্র নিয়ে যেমন গবেষণা বা গভীর চর্চা হয়েছে, হিন্দি-বাংলা সিনেমার গান নিয়ে হয়নি — যেহেতু অনুধ্যান করার বয়েসে বা বোধে পৌঁছনোর আগেই সবাই এই স্রোতগুলো ছেড়ে ওইসব অবিকল্প দির্ঘীকায় সরে গেছে, যেহেতু জাতপাতের চেয়ে মানুষের শিল্পরুচি অনেক জটিল অন্তর্বিভাজনের জায়গা।

অথচ চিরকাল ক্রিকেটের কোচিং সেন্টারগুলোর মতো ‘বড়’ গানের লেভেলে শ্রোতা সাপ্লাই করে চলে এই হিন্দিগানের নার্সারি। সতেরো বছরের ছেলে-মেয়েকে ভোলানোর ক্ষমতা নেই ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের; কেননা যৌবন মূলত লৌকিক, পতিত, বিদ্রোহী, শ্রেণীহীন। শুধু দুঃখের কথাটা হল সেই সতেরো সাঁইত্রিশে পৌঁছে তার প্রাইমারি টিচারকে রাস্তায় দেখলে শরীর ভাঁজ করে না কিন্তু, চিনতে পারিনি ভাব দেখিয়ে পাশ কাটায়।

আট
হিন্দি ফিল্মি গানে কিশোরকুমারের যুগ ১৯৫৫ থেকে ১৯৮৫, তিরিশ বছর। তখন প্রেমিক-প্রেমিকা পরাধীন, সমাজ তাদের এক হতে দিচ্ছে না (উঁচি উঁচি দিওয়ারোঁ সি ইস দুনিয়া কি রসমেঁ — জুলি), এমনকি একবার দ্যাখা করতেই কালঘাম ছুটে যায়। ‘অচ্ছা তো হম চলতে হ্যায়’ গানে (আন মিলো সজনা): তোমাকে এখানে আসতে দ্যাখেনি তো কেউ? না না, আমি “ছুপতে-ছুপাতে” চলে এসেছি। আচ্ছা, ফির কব মিলোগি? যব তুমকো হোগি — পরিষ্কার কথা, ভাই। আর চাপ নেওয়া যাচ্ছে না।

সুতরাং কিশোরযুগে নায়কের প্রধান মাথাব্যথা প্রেম করা নয়, এগেইনস্ট অল অডস প্রেমিকাকে হস্তগত করা। যতদিন সেটা না হচ্ছে, নায়িকা দাঁতে দাঁত চেপে ভিলেন বাপের কাছে পড়ে থাকবে আর দেবে প্রেমের সচ্চাইয়ের দুটি পরীক্ষা — গৃহবন্দি ও খানা-বন্‌ধ। একটু কড়া লিকার-চা ক’রে বললে, মেয়েদের প্রেম মানে হোস্টাইল পুরুষতন্ত্রের খপ্পর থেকে বেরিয়ে ফের এক দয়াবান পুরুষের অধীনস্থ হওয়া। তাই কিশোরের সময়ে প্রেম ঠিক ওয়ান ইজ টু ওয়ান ব্যাপার নয়, একটা সোশ্যাল ইস্যু, এমনকি সামাজিক সমস্যাও। তখনকার প্রেমের গান প্রেমের গল্পও কিছুটা, মাঝেসাঝে যেখানে সসুরা হাজিরা দেবে, কখনও বোন বা ননদ — মানে, গোটা বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বসানো হচ্ছে সম্পর্ককে। আজকের দিনে “অ্যায় খুদা অ্যায় খুদা অ্যায়সা ম্যায় ক্যা কিয়া” (কিশোর: উল্টাসিধা, ১৯৮৫) বলে একটা গান শুরু হোক, আপনি সুফি ঘরানার বিরহগীত শুনবেন ব’লে গুছিয়ে বসেছেন, হঠাৎ অন্তরায় “বাচ্চা তড়পে জখমি রোয়ে মমতা” — পুরো রাজ্য-রাজনীতির দিকে বিষয়টা ঘুরে গেল! এখন নিতে পারবেন না, তখন দস্তুর ছিল দস্তুরমতো।

অতএব, কিশোর-সময়ের প্রেমের গানে বহুবচন জেগে আছে, সম্বোধন করা হচ্ছে একটা প্লুরালিটিকে। তুমি অপূর্ব রূপসী, আমাকে দিওয়ানা বানিয়েছ; তোমায় ছাড়া বাঁচবো না, বস; এবং চলে এসো তোমার আঁচল ভালোবাসায় ভরিয়ে দিচ্ছি — এই তিনচারটে মেসেজে ধরা পড়ল প্রেমের তাপমান। গানের বাকি অংশটুকু মাটি ফেলে ভরাট করার জন্যে থাকছে জীবন বিষয়ে নানা পর্যবেক্ষণ, অনেক দার্শনিকতা — যদি আনন্দ বক্সি বা মজরুহ সুলতানপুরিকে আপনি দার্শনিক বলতে রাজি থাকেন। আমরাও দেখেছি, কিশোর আর ‘জিন্দগি’ এক লিথাল কম্বিনেশান; অমিতকুমারের পাপা-র গান শুরুর লাইনে একটা ‘জীবন’ বা ‘জিন্দগি’ পেয়ে গেছে মানে ক্রিস গেইলও আইপিএল ম্যাচের প্রথম ওভারেই ছক্কা মারল, আজ ফাটিয়ে খেলবে।

আমাদের এ-কথা না মানারও কোনও কারণ থাকতে পারে না যে সেই ১৯৫৫-৮৫ কালখণ্ডে প্রচুর অসংখ্য প্রেমের গান লেখা হয়েছে যারা নিখুঁত, দশে দশ পাওয়া। কিন্তু তৎসময়ের সমাজ-বাস্তবতায় নায়ককেই যেহেতু প্রেমিকা-উদ্ধারে নামতে হবে, সে-ই বেশি লাফাচ্ছে গানে ও ঢিসুমে, অতএব, এইবেলা লিরিক থেকে মেল ডিওডোরান্ট ভক ক’রে আপনার নাকেমুখে এসে লাগার খুব সুসম্ভাবনা।

ক) ‘আ চল কে তুঝে’ গানে কিশোর বলছে চলো আমি তোমায় খোলা আকাশের নিচে নিয়ে যাই (কারণ, আমি পুরুষ)। ওই গানেই একটু পরে এল ‘ব্যায়ঠে হোঙ্গে রস্তে পে ওহ আঁখ বিছায়ে’… মেয়েদের তো আসা-যাওয়ার পথের ওপর চক্ষু পেতে বসে থাকাই নিয়ম।
খ) ‘পল পল দিল কে পাস’ গানে পুরুষ নিশ্চিন্ত করছে তার নারীকে: তুম সোচোগি কিঁউ ইতনা, আমি তো তোমাকেই ভালোবাসবো।
গ) সিলসিলা ছবিতে লাইল্যাক ফুলের বাগানে লতা গাইছেন ‘মেরে দিল হ্যায় তেরি পনাহোঁ মেঁ’ আর কিশোর ঠিক পরের লাইনে ‘আ ছুপা লুঁ তুঝে ম্যায় বাহোঁ মেঁ’। এই প্রেম এক হিসেবে শরণার্থী আর সরকারি কলোনির।
ঘ) কিন্তু ছেলেদের হাত বা বাহু ব্যাপারটা এত এসেনশিয়াল যে এই দেখুন, কিশোর-কন্ঠ আবার গেয়ে উঠল ‘থামলো তুম মেরি বাহেঁ ম্যায় তুমহে সমহল লুংগা’, সেই সঙ্গে প্যাকেজে বাড়তি প্রতিশ্রুতি, রাস্তার কাঁটাও সব দূর করে দেবো। এ-গানের প্রথম লাইন ‘অ্যায়সে না মুঝে তুম দেখো’।

নায়ক আবারও খুব আন্তরিকভাবে গেয়েছেন ‘ও মেরে হমরাহী মেরী বাহ থামে চল না’ (‘গাতা রহে মেরা দিল’ থেকে)। কিন্তু যদি নায়িকা এত ক্লান্ত যে হাতও ধরতে পারছে না? ‘তুম যো থক গয়ি হো তো বাহোঁ মেঁ উঠালে’।
পুংহস্ত কী না পারে!
ঙ) আঁধি ফিল্মের ‘তেরে বিনা জিন্দগি সে কোই’ গানে কিশোরের সহগায়িকা লতা বলেন, ইচ্ছে করছে তোমার পদক্ষেপ থেকে বেছে আমি জীবনের লক্ষ্য নির্ণয় করি।
এখানে নিজের মন্তব্য বসিয়ে নিন।

নয়
নিশিতানি কেইজি (১৯০০-১৯৯০) জাপানের কিয়োতো স্কুলের দার্শনিক, নিশিদা-র প্রিয়তম ছাত্রদের একজন। নিশিদা দর্শনকে কখনও ধর্ম থেকে আলাদা করতে চাননি এবং এটাই কিয়োতো স্কুলের শিক্ষা। তার ধারণা ছিল পাশ্চাত্য দর্শন ঈশ্বর নামক পরম কেন্দ্রটি হারিয়ে ফেলে নিহিলিজমের পথে হাঁটছে। বৌদ্ধ নিশিতানি এই ভাবনাটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে বলছেন, পশ্চিমি আধুনিক দর্শন অনুযায়ী ওই সব দেশের মানুষের যে আত্মোপলব্ধি তা তাদের অহং-এর অনুভব ছাড়া আর কিছু নয়।

পাশ্চাত্যে মানুষের আত্মানুভব সংস্কৃতির ধর্মনিরপেক্ষতার ভেতর দিয়ে অর্জন করার চেষ্টা হয়েছে, যার ফলে মানুষ তার জীবনের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিযুক্ত হয়ে গেছে। সে হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বাধীন, আত্মকেন্দ্রিক, আত্ম-অনুপ্রাণিত এক স্বশাসিত সত্তা। কিন্তু ,মানুষের এই অটোনমাস অস্তিত্ব ধর্মীয় শেকড় ছাড়াই বাঁচতে চাইছে বলে বিরোধ তৈরি করছে নিজের ভেতরেই। এখানেই থিয়োসেন্ট্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অ্যানথ্রোপোসেন্ট্রিক মনোভাবের তফাত। মানুষ নিজের ধর্মীয় সত্তা থেকে বেরিয়ে এসেছে মানে সে প্রেম থেকেও তফাত হল। নিজেকে বোঝার ক্ষেত্রে প্রেম সবচেয়ে দরকারি উপাদান, অথচ আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনে সেই ধর্মীয় প্রেম (agape) পালটে গিয়ে হল যৌন আকাঙ্খা (eros)।

নিশিতানি আরও বলেছেন, পাশ্চাত্য সভ্যতা মুক্তি চায় না, চায় স্বাধীনতা (লিবার্টি), আর সাম্য বলতে বোঝে সমানাধিকার। প্রেমের উপাদানহীন এই দুই ব্যাপার বড়জোর হিউম্যান রাইটসের মৌজাভুক্ত। আবার এদিকে প্রেমকে যুক্ত করা হল ফরাসি বিপ্লবের ফ্র্যাটারনিটির ধারণার সঙ্গে, লুডভিগ ফয়েরবাখ যাকে লাভ অফ হিউম্যানিটি বলেছেন। আধুনিক আমেরিকায় যেটা স্পিরিট অফ সার্ভিস।

ডঃ নিশিতানি কেইজি-র তত্বের সঙ্গে অনেক জায়গাতেই আমরা একমত হবো না, তবু মনে হয়েছে, কিশোরকুমারের হিন্দি গানে যে প্রেম, তার মকসদ ছিল লিবার্টি, পুরনো পুরুষতন্ত্রের খপ্পর থেকে বেরিয়ে যে আস্তে আস্তে সাম্য আর মানবিক সখ্যতার দিকে যেতে চায়।

(আশা রাখুন, শেষ হবে)

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

চার
গান কিন্তু শুরুতে এমন ছিল না যা সে এখন হয়েছে। গৈ ধাতুর অর্থ বলা, মানে সুর ক’রে পাঠ। গৈ থেকে আসছে গায়ত্রী — একটা ছন্দ, গান নয়। আসছে গীতা, কৃষ্ণার্জুন সংলাপ। ঋকবেদের সূক্তগুলো সুরে আবৃত্তি হবে, ওইটুকুই পারমিশান ছিল।

ক্ষিতিমোহন সেন লিখেছেন, সামস্তোত্রের সুরকাররা ঋকবেদীয় ঋষিদের এই বাধা ডিঙোতে চেষ্টা করে। লৌকিক গান তো আর্য সভ্যতার বহু আগে থেকে বয়ে চলছে, তার চল ছিল নারী আর অন্ত্যজদের মধ্যে। সামবেদীয় গায়কেরা লোকগানের প্রভাবে শ্লোক আবৃত্তির মাঝখানে ধুয়ো টানার মতো হা-হা, হো, হুম, হোয়ি এইসব সুরেলা ধ্বনি করতো — যাকে স্তোভবর্ণ বলা হত সে-সময়ে। আর্য ঋষি ও যজমানেরা তাই সামগান দুচোখে দেখতে পারতো না।

অরিজিৎসিংগীতে এই স্তোভবর্ণের ব্যবহার ভীষণভাবে ফিরে এসেছে। দুটো উদাহরণ দেবো।

হ্যারি মেট সেজাল ছবিতে হাওয়ায়েঁ গানটা। সুর করেছেন প্রীতম।
দ্বিতীয় গান ফির কভি, এম এস ধোনি ছবি থেকে, সুরকার অমল মালিক।

এছাড়া আপনি অরিজিতের যে-কোনও পনেরো মিনিট থেকে আধঘন্টার প্রোগ্রামের রেকর্ডিং শুনুন, সাধারণত মিউজিক অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে যেগুলো হয়, দেখবেন সে ওই অল্প সময়ে অনেকগুলো গানের টুকরো গাইছে আর একগানের সঙ্গে অন্যগানের সেতু তৈরি করছে স্তোভবর্ণের হামিং-এর ভেতর দিয়েই।

‘বেদগান’-এর বাইরে বেরিয়ে এলিটদের প্রথম সংগীত কি? নিশ্চয়ই ধ্রুপদ। এক শ্রেণীর মেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ধ্রুপদ গেয়ে পেট চালাতেন। এটাও ‘ছোটলোক’-এর গান, অতএব পণ্ডিতদের ভয়ানক বিরোধিতার সামনে পড়েছিল। তারপর প্রতিভাবান গায়কেরা এই সংগীতের চালু প্রকরণকে ঘ’ষেমেজে ‘শুদ্ধ’ করে নিলেন, পেলেন সংগীতপ্রেমী রাজাদের সমর্থন। ধ্রুবপদের জাতে ওঠা আর আটকানো যায়নি।

পাঁচ
তো, ফার্দিনান্দ দ্য সসুর ভাষাবিদ্যার চর্চায় Synchrony আর Diachrony ব’লে দুটো পরিভাষা এনেছিলেন। সিনক্রনিক মানে সমকালীন বা সমলয় ভাষাতত্ব কোনও ভাষাকে সময়ের সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বিচার করে, তার গড়ে ওঠার ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামায় না। আবার ডায়াক্রনিক অথবা কালবর্ষীয় ভাষাবাদ একটা ভাষার মূল্যায়ন করে শুধু তার বিবর্তনের ইতিকথা দেখেই।

এলিট আর অন্ত্যজের সংস্কৃতির মধ্যে চিরকাল ঘোর অবনিবনা থাকলেও অভিজাতদের রক্ষণশীল অংশ যেমন ছোটলোকের কালচারকে ঘেন্না করে এসেছে, তাদেরই আরেক দল নিজেদের শিল্পের ঝাঁপি ভরেছে লৌকিক সংস্কৃতির উপাদান নিয়েই। একে বলতে পারেন, গ্রাম বা মফস্বলের ছোট ছোট কারখানা থেকে জুতো কিনে তাতে নিজেদের ব্র্যান্ড নেমের স্টিকার মেরে দ্বিগুণ দামে বাজারে ছেড়ে দেওয়া। সামগান আর ধ্রুপদের বেলায় শুধু না, ভারতীয় সংগীতের গোটা ইতিহাস জুড়েই এমনটা সত্যি।

ছয়
ক্ষিতিমোহন সেন লিখেছেন, বেদাঙ্গে ‘নারদীয় শিক্ষা’ নামে একটা বই রয়েছে। সেখানে এইরকম শ্লোক পাওয়া যায়:

আচার্য্যা সমমিচ্ছন্তি পদচ্ছেদস্তু পণ্ডিতাঃ।
স্ত্রিয়ো মধুরমিচ্ছন্তি বিক্রুষ্টমিতরে জনাঃ।।

ক্ষিতিমোহনের অনুবাদে: গানে আচার্যগণ চাহেন সমতা, পণ্ডিতেরা চাহেন পদচ্ছেদ, নারীরা চাহেন মাধুর্য, ইতরজন চাহে বিক্রুষ্ট অর্থাৎ স্বরবৈচিত্র্য।

আমার মনে হয়, গানে অভিজাত শ্রেণীর কনট্রিবিউশানও ওইটুকুই, সমতা আর পদচ্ছেদ। এই লেখার প্রথম অংশে আমি যে লুপ-এর ধারণা এনেছিলাম, সেটা এই সমতা-র আইডিয়ার সঙ্গে মিলছে। আর পদচ্ছেদ বলতে ধ্রুপদকে নিজেদের সংগীতগোষ্ঠীতে টেনে পণ্ডিতেরা কথার শরীর চারটে পর্বে ভাগ করে দিলেন — স্থায়ি অন্তরা সঞ্চারী আভোগ।

মেয়েদের মনে প্রচুর আবেগ, যা গানের প্রাণবস্তু; আর খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে লড়াই, বিপদ, নানা পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই উচ্চবর্ণের নাগরিকের চেয়ে অনেক বেশি। কাজেই তাদের গানে স্বরের বিচিত্র গতি থাকতো। তার মানে শুধু গানের স্ট্রাকচার তৈরি করে দিয়েছেন অভিজাতরা, কাঠামোর ভেতরে যা মালমশলা সবই অন্ত্যজের অবদান।

[সমাজপতিদের সাহায্য পেয়ে ক্ল্যাসিকাল গানের বিবর্তন আর উন্নতি হয়েছে খুব তাড়াতাড়ি, সেই তুলনায় মূল লোকগান লটকন ফুলের মতো একটা সীমাতেই আটকে আছে]।

তাহলে গানের ডায়াক্রনিক বিচার করতে গেলে বোঝা যাবে, ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে এলিট-অন্ত্যজ বা বড়লোক-গরীব বাইনারিটা খুব প্রধান ব্যাপার, বিষয় বদলালেও সংঘাতের চরিত্র পালটায়নি। ধরুন, ধ্রুপদের পরে এল খেয়াল, তারপর লঘু রাগসংগীত, তারপঢ় রামপ্রসাদ, তারপর রবি ঠাকুরের গান। তারপর জানা গেল লালনকে, তারপরের সৃষ্টি বামপন্থীদের গণসংগীত — এই রকম। প্রত্যেকবার পণ্ডিতেরা রে রে করে উঠলেন, প্রত্যেক দফাতেই আস্তে আস্তে বিরোধ-সমন্বয়ের ভেতর দিয়ে সেই গান হয়ে উঠল অভিজাতেরই সম্পত্তি। তার মানে, এই মুহূর্তে যে শ্রোতা টপ্পা বা গজল ভালোবাসেন, কিন্তু এখনকার হিন্দী সিনেমার গান একেবারে সহ্য করতে পারেন না — হতে পারে তিনি গানের ডায়াক্রনিক অ্যাসেসমেন্টের ফসল। সুতরাং গানের ইতিহাসে যেটা মতভেদ-মুক্ত হয়ে অফ ফেমে চলে গেছে, তাকেই পছন্দ করবেন। যে এখনও এলিট-বিচারে গৃহীত নয় (এখানে হিন্দি সিনেমার গান), সেই সংগীতে তার আস্থা থাকবে না।

আর সিনক্রনিক বিচার ঠিক কেমন? ধরা যাক,আমার অল্প বয়েসে মহম্মদ রফির ফিল্মি গান শুনতাম, তাই আমার কে এল সায়গল ভালো লাগে না, কুমার শানুও অপছন্দ। আমার দাদা শ্রোতা ছিল সুমিত্রা সেনের রবীন্দ্রগানের, তাই সে সাহানা দেবীতেও নাক কোঁচকায়, স্বাগতালক্ষ্মীতেও। অর্থাৎ আমরা যে সময়বিন্দুতে শ্রোতা হিসেবে জন্ম নিই, শুধু সেই স্থানাংই আমাদের কাছে সত্যি। সামনে-পেছনের কালখণ্ডের সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্ট করতে পারি না।

গণসংগীত রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত নিয়ে গানের যে নিরক্ষরেখা টানার চেষ্টা হয়েছে এই লেখায়, সেটা সিনক্রোনিক বা ডায়াক্রোনিক কোনও এলাকার ওপর দিয়েই যায় না, যেহেতু গণসংগীত অরিজিৎযুগে অস্তিত্বহীন বলে সমকালীন (Synchronic) বিচারে এই তিন ধাঁচের গানকে এক সঙ্গে বুকে জড়ানো প্রায় অসম্ভব। আবার যেহেতু অরিজিৎ সিং-এর গান এখনও অভিজাতশ্রেণীভুক্ত হয়নি, তাই কালবর্ষীয় (Diachronic) বিচারেও সে কল্কে পাবে না।

অরিজিত সিং-এর গান কি থেকে যাবে, যেমন স্থায়ি হয়েছেন কিশোরকুমার গাংগুলি?
আমার হ্যাঁ-এর বাজি নিয়ে শেষ কিস্তিতে আসবো।

স্মরণার্থী

স্মরণার্থী

এক
কাল রাত্তিরে বাড়ির বাথরুমে ঢুকছি, ফটাস করে হাওয়াই চপ্পলের ফিতে গেল ছিঁড়ে। আর প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় এক মাইক্রো সেকেন্ডের মধ্যে আমার মাথা প্রশ্ন করল, সেফটিপিন?

চৌকাঠে ঝিম হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম দু’তিন মিনিট। মাটির ১২০ ফুট নিচে থেকে ভেসে উঠেছে “নিরাপত্তাকাঁটা” শব্দটা, আর মন কাঁকরবালি খুঁড়তে খুঁড়তে হু হু করে নেমে যাচ্ছে আরও অন্তত ২৬০ ফুট, আর্সেনিকহীন দ্বিতীয় স্তরের জলে — যেখানে শালুকপাতার মতো থাক-থাক সাজানো আমার শৈশব, স্কুলের পেতলের থালাঘন্টা, আমার আধপেটা রাতগুলো।

হাওয়াই চপ্পলের সঙ্গে শরণার্থী জীবনের সম্পর্ক নিয়ে কোনো না কোনো দিন প্রেমের এপিক লেখা হবে আমি জানি। মনে পড়ছে সদ্য চাকরি পেয়ে অডিট টিমে পোস্টিং হয়েছে, সবাই শিয়ালদায় একসাথ হই, তারপর গাড়ি নিয়ে অকুস্থলে রওনা। তো একদিন স্টেশানের “অনুসন্ধান-এ পৌঁছোতেই সিনিয়ার কোলিগ বললেন, ঠিক বুঝেছিলাম, এই যে ভিড়ের ঝাঁকটা বেরলো, এ চন্দনের ট্রেন না হয়েই যায় না।
— কী করে বুঝলেন!
— আমি তো প্যাসেঞ্জারের পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। এইট্টি পার্সেন্ট হাওয়াই চটি মানেই বনগাঁ লোকাল।

দুই
আমরা রাবারের চপ্পল ফটফটিয়ে কলেজে বা সিনেমায় যেতাম; বিয়েবাড়ির ড্রেস হল ডেকরনের প্যান্টে টেরিলিনের ফুলহাতা শার্ট ইন করা এবং পায়ে বল-সাবানে মাজা হাওয়াই চপ্পল। আর ঝিঁঝিঁব্যাঙল্যাটামাছশামুককেঁচোখচিত ছোটবেলার সেই বিমানবিধ্বংসী বর্ষাকালে সবুজ শ্যাওলা অবুঝ এঁটেলমাটির ওপর দিয়ে আমরা যেভাবে আছাড়বিমুক্ত ছুটে যেতে পেরেছি পায়ে প্লেন চটি, ততটা স্বচ্ছন্দ ডোবায় জলে জলঢোঁড়া হয়ে দেখাক তো!

কিন্তু কখনও কখনও ওই এঁটুলি মাটিই চটির আত্মাকে ছাড়তে চাইতো না, তখন তাকে খিঁচকে সরাতে গেলেই উৎপটাং ব্যাপার। পা বেরিয়ে এসেছে, নগ্ন-একপদ বুদ্ধদেব চেঁচিয়ে উঠল:

— মা? ও মা! চটি ছিঁড়ে গেছে। সেপ্টিপিন নিয়ে আসো।

হন্তদন্ত এক ঘোরশ্যামা অনেকখানি লম্বা হেতু রান্নাঘর থেকে ঘেঁটি-নিচু বেরিয়ে আসে। দুহাতের শাঁখাপলা-সমৃদ্ধ কবজি হাতড়ায়।

—না রে মনা, সেপটিপিন তো নেই!

— ধুস, তোমরা যে কী করো না! এখন কী ক’রে ইশকুলি যাবো?

দাঁড়া দেখতিছি, ব’লে মা আমার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে বাড়ির দক্ষিণে লিচুগাছের ওপর বসা দোয়েলপাখির দিকে তাকায়, ওপরটি দিয়ে নিচের ঠোঁট আস্তে চেপে ধরে। আর বুকের শাড়ির নিচে চালান করে দেয় হাতদুটো।

এমন কতোবারই হয়েছে, কিন্তু তখন তো আমি ক্লাস এইট ছিলাম না, সমঝদার ছিলাম না। ঝটকা দিয়ে মুণ্ডু ঘোরাই।
— লাগবে না। তুমি বরং আমারে পাঁচ নয়া দাও, ইশকুল ছুটির পরে চটিসারা-র কাছ থেকে সেলাই ক’রে নিয়ে আসবানে।

মা প্রথমে বিমূঢ় হয়, তারপর তার মু্খের সাগরতীরে “আচ্ছা, বুঝেছি”-র গোলাপি সূর্য উঠতে থাকে! নিজের শিশুসন্তান পরিণত ও যত্নবান পুরুষে বদলে যাচ্ছে টের পেলে আনন্দ আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিজের নারীসত্তার দিকেও কি আর একবার ফিরে তাকায় সেই মা?

— অ মিনু, তোর কাছে সেপটিপিন থাকলি অ্যাট্টা নিয়ে আয় তো!

খোপের পড়ার ঘর থেকে বাড়ানো-হাত দিদি নেমে আসে, তার দিকে মা এক অসীম রহস্যভরা মুখে তাকায়।
— আমারে না, ভাইরে দাও। উনি আমার সেপটিপিন নেলেন না।

হাঁটু গেড়ে বসে চটির ফিতেয় রিফুকর্ম শুরু করি আর বেশ বুঝতে পারি অন্ধকার আকাশে তরোয়াল ছুটে যাওয়ার মতো দুই নারীর সংকেতময় চোখ আমার এলোমেলো মাথার চুলে অনেক নরম তারা ঝরিয়ে দিচ্ছে।

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত
তিন

গণসংগীত যে বিশেষ উদ্দেশ্যে ডাক পাঠায় মানুষকে, তাতে ধুন কখনও পড়তির দিকে যাবে না। গান মানে মিউচুয়াল ফান্ডের টাকা; জমা দিয়ে বসে থাকলাম, গেলাম ভুলে, ইউনিটের দাম আজ বাড়ে তো কাল কমে করতে করতে অন্তিমে লাভই লাভ — এই সুরার্থনীতিতে তার বিশ্বাস নেই।

গণসংগীত তৈরির পেছনে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা আর পরিকাঠামো থাকে। মানুষকে জাগাতে গেলে ফুলের তোড়ার বদলে তরোয়ালের খোঁচা দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কাজেই জনগণের গানবাজনার সুর খাড়া হয়ে থাকবে, দিল্লি যাওয়ার ডাকের সঙ্গে নেতাজির ডানহাতের আঙুলটা যেমন, আর সেভাবেই এক শৃঙ্গ থেকে আরেক চুড়োর দিকে এক-বিঘত লাফে এগিয়ে যাওয়া। উদাহরণ তুলে নিন: “এসো মুক্ত করো” কিম্বা “শত শহীদের রক্তে রাঙা পতাকা”। গানের সুর শুরু থেকেই মোটামুটি প্রত্যেক লাইনের শেষে গিয়ে উঁচু নোট হিট ক’রে দাঁড়িয়ে পড়ে; যেহেতু এখানে গানের ভেতর দিয়ে নির্দেশ যাচ্ছে, একটা যুদ্ধ প্রবাহিত।

গণসংগীত নিজেকে সম্বোধন করে না কখনও। সে অপর-এর জন্যে তৈরি; সমূহ অপর (collective other) নয়, তবে তার বেশিরভাগটা। জনতার গানের সড়ক দিয়ে সুরের গাড়ি কথা বয়ে ছুটে যায় নিজের শীর্ষবিন্দুতে দাঁড়াবে ব’লে, ফিরে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করে না — যেহেতু এই গানের কোথাও একক শিল্পীসত্তা নেই। সমগ্রের তো কোনও অন্তর্মুখ হয় না। কেউ হয়তো জনতার গানের অ্যাড হক চরিত্রের কথা মনে করাতে পারেন, কিন্তু তাহলে রবীন্দ্রনাথও প্রচুর উপলক্ষ্যগীতি তৈরি করেছেন!

ওরে গৃহবাসী-তে ঘরে থাকা মানুষকে বাইরে ডাকা হচ্ছে, সেই হিসেবে এটা গণসংগীতের চেয়ে খুব দূরে দাঁড়িয়ে নেই। আবার আছেও, কেন না (ক) এই ডাক সব মানুষকেই, আর (খ) আবাহন মানবসমাজ নয়, প্রকৃতির তরফ থেকে।

সর্বহিতম মানে সব মানুষের মঙ্গল আর সর্বসংগ্রহ মানে গোটা পৃথিবীর ভালো যদি চেয়ে থাকি তবে আমিও বহিরাগত নই সেই যাচনায়।

তাই গানটাতে ঘরকুনো মানুষকে দরজা অনর্গল ক’রে বেরিয়ে আসার যে ডাক তা শুরুতে উচ্চকিত হয়ে শুদ্ধ ধৈবত ছুঁলেও ওই স্থায়িরই শেষবিন্দুতে রবীন্দ্রনাথ “দ্বার খোল দ্বার খোল” বলতে বলতে মাঝ-সপ্তকের ষড়জে নেমে আসছেন। গাইতে গিয়ে মনে হবে গৃহবাসী শুনতে পাবে তো এই আপনমনা ফিসফিস? তারপর আরও খেয়াল করি, কবি ঋতুদেহ বর্ণনা করতে যতটা উচ্ছ্বসিত; দখিন আর দখিনা শব্দের পাশাপাশি ব্যবহারে যে পরিমাণ সুপার স্পেশালিটি; কই, গৃহীকে আদৌ ততো চড়ায় ডাক পাঠাচ্ছেন না তো!

কয়েকবার সুরোচ্চারণের পর অনুভব হয়, আমার বহিরংশ যেমন, ভেতরেও তো তেমনি এক মোকাম। আমি নিজেকেও বেরিয়ে আসতে বলছি সেই আত্মনিকেতন থেকে। তখন আমার আবৃত্তি অস্ফুট, আর এইভাবে নিজের ভেতর দিয়ে ডাকটাকে অন্যের, মানে, ওই কালেকটিভ আদার-এর মনের দিকে বইয়ে দিলাম। বাইরে থেকে নয়, “পারি যদি অন্তরে তার ডাক পাঠাবো”, এ-তো রবীন্দ্রনাথের চিরকালেরই পছন্দ।

আত্ম-পরের এই বন্ধন তৈরি হয় বলেই রবি ঠাকুরের সুরের মধ্যে এত সৌজন্য, এত কনসার্ন, এত স্পর্শ স্বর আর মিড়, এত নতজানুতা। কবিকে আমন্ত্রণের আওতা থেকে কাউকে বাদ দিতে হচ্ছে না, শোষক-শোষিত ভেদ না থাকায় গানের সুর ওপরে-নিচে সমপ্রবাহী। তাই কথার উৎসাহিত আহ্বান শেষে গিয়ে ঠেকছে সুরের অনুনয়ে। আর অনুনয়, রবীন্দ্রনাথের প্রায় সব গানের মতোই, কোথাও মানুষের মনের অধরা অকারণ সৃষ্টিমুখী বেদনাকে ছুঁয়ে দিল।

লিঙ্গপুরাণের সেই শ্লোকটা পড়ে নিতে পারি:

যথা মদো নর স্ত্রীণাং যথা বা মাধবো দৃনিলঃ।
অনুপ্রবিষ্টঃ ক্ষোভায় তথা সৌ যোগ মূর্তিমান্‌।।

সমস্ত শিল্প তৈরি হওয়ার পেছনে একটা ব্যাকুল কষ্ট থাকে। নারী আর পুরুষের মনে এক এক সময়ে যে রসমত্ততা আসে কিম্বা বসন্তের বাতাস পৃথিবীর হৃদয়ে ঢুকে পড়ে জন্ম দেয় যে ব্যথা বা ক্ষোভ, তাই নতুন সৃষ্টির প্রেরণা।

লিঙ্গপুরাণের গল্পে নারদকে গান শিখিয়েছিলেন উলূক, যার নাম ছিল গানবন্ধু। আধুনিক সময়ে আমরা আরেক গানবন্ধুকে পেলাম, এটা কম কথা নয়।

বেড়ে চলল…

“আমি আর প্লক্ষতরুণী” কবিতার আরেকটা অংশ

“আমি আর প্লক্ষতরুণী” কবিতার আরেকটা অংশ

প্লক্ষতরুর পাশে ঝরনা, পাহাড়শ্রেণী তরুণ শিবালিক
যাত্রাকুশল পাঠ করোনি; কালো বেড়াল দেখছি, এক শালিক।
তবুও স্রোত দু’ধারি অসি, নদীগতর কামিন মেয়েছেলে
কুরুপাঞ্চাল, দুর্গসমান এমন তাজা তীর্থ কোথায় পেলে?
জনক ব্রহ্ম আমার তটে যজ্ঞে বসেছিলেন পূর্ণকাম
ভরতবংশ গঠন হল, নাও পৃথিবী তোমারই মোকাম
রাজসন্তান শিখতে আসে গুরুর কাছে ব্রহ্মচারণ যোগ
শ্রুতি আগুন ঝলসে দেবে কিশোরকন্ঠ, ভয়ে বুঁজছি চোখ!
ওমনি শুনি সূর্যসমান অগ্নিভ তার সুরের সংঘারাম
নতুন যে এক দেবতাজন্ম, নতুন শ্লোকে তক্ষুনি বুঝলাম
যদি এখন ইঁট না পাতি, প্রেম-চিঠিতে প্রপোজ করি জোশ-এ
ছোঁ মারবেই প্রবল কোনও দেবী, তুমি দেখিও ব’সে ব’সে
সকালবেলা আমার হিরো আমার জলে শুদ্ধ হতে এলে
তিনচোখো মাছ ঠুকরে দিলাম নরম কোনও কঠিনবজ্র পেলে
শিউরে উঠে হাঁ-মুখ খোলে সবুজলতা দেহ-ব্যালকনির
তিনটে ঘন্টা কাটল সোনা নদীবিছানায়! দুধ-মধু-পনির
খেয়ে এবার পড়ায় লাগো, সূক্তগুলো বাজাও তো একদিনে!
কিন্তু প্রবীণ অশথসম ঋষি, তাদের বুঝতে বাকি নেই
ভারতীস্নান নিষেধ হল। বন্ধ হল শুক্লরক্তপাত?
তিন সহস্র বছর ধরে অশ্বী, অজা, উন্নতা, কুজাত
আমার প্রপাত জেগে উঠলে তোমার শুধু সঙ্গম ধেয়ান
শাস্ত্রপাঠে অনধিকার, জঙ্গলে যা, সমিধ কেটে আন
জেন্দ আবেস্তা গুটিয়ে গেল, দরজা খোলে মিশরসভ্যতা
তুমি কিচ্ছু জানলে না গো, রাখলেও না কথার পিঠে কথা
কেন না পিঠ রক্তভাসি যিশুর মতো নিজের বওয়া ক্রুশে
রাতের বাসা খোলে আকাশ, তখন থেকেই অসুখ ফুসফুসের
গা ঘেঁষে যায় বাঘের রোমশ, পেটের ওপর বিড়ে পাকান সাপ
সারারাত্রি শত্রু তাড়াই, কুণ্ডলিনী এবার জেগে যাক!
মরণকুণ্ড জিকির দিল, আমি তখন আচমকা তন্দ্রায়
ঝুপুস শব্দে আমার পুরুষ, যা হবে হোক, আমার বুকে আয়
কিন্তু এ-যে মরা বাঁশির হাড় ক’খানা, আদুরে বর কই!
মর্তে মানুষ, স্বর্গপতি — বিহানকালে সবার শাপ কুড়োই
“শুষ্ক হবি, লুপ্তধারা, দেবতা নোস, সামান্য কামিনী
মাথা ও পা স্রোতোসিদ্ধ, বাকি শরীর পাতালগামিনী”
মুণ্ড-চরণ প্রবাহ দেবে, বাকি শরীর পাতালগামিনী…

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

এক
রবীন্দ্রসংগীতের মধ্যে আমি সব সময় একটা “প্লিজ”কে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি।

রাতের লোডশেডিংয়ে বিছানা হাতড়ালেই যেমন টর্চ, মটরশুঁটির মধ্যে মটরের দানাগুলো, রবীন্দ্রগানের সবচেয়ে আহামরি অংশ এই “অনুগ্রহপূর্বক”। রবীন্দ্রনাথ অন্যের ধ্বজাকেই নিজের নিশানের ওপরে তুলে ধরেন, সেই অন্য পর-ই হোক, বা পরম (দুটো শব্দ একই মূল থেকে আসছে, দেবদত্ত পট্টনায়ক জানিয়েছিলেন My Gita-য়)।

এক কোটি পুনরাবৃত্তির ছপ্‌টি খেয়ে ধুলোয় গড়াচ্ছে, শুনলে আর কোনও ফিলিংই জাগে না, এমন গান হল “ওরে গৃহবাসী”। যদি আপনি আমার মতো বিধ্বংসী বাঙালি না হন, মানে আবিরপন্থী রবীন্দ্রধার্মিক ক্যাম্প-অ্যাট-শান্তিনিকেতন, গানটা একবার মুখে তুলেই ফেলে দিতে ইচ্ছে করবে। কোথাও তাকে ঠিকভাবে সংরক্ষণ করাই হয়নি, কোথাও বা এন্তারসে রাসায়নিক মিশিয়ে রেমন্ডস বা কেএফসি-র স্টিকার মেরে বাজারে ছেড়ে দিয়েছে।

শুধু আমার মতো অন্ধ-অবুঝের মনে হয়, এখনকার ইলেকট্রনিক জিনিসপত্তরের মতো রবীন্দ্রসংগীতেও অ্যান্টিভাইরাস, স্টেবিলাইজার, অ্যাডপ্টার সব বুদ্ধি ক’রে আগে থেকে ভ’রে দেওয়া হয়েছিল, আর “প্লিজ” সেই রকমই এক ইন-বিল্ট পরিকল্পনা।

গণসংগীতের জন্ম হয়েছে “আমাদের মানুষকে বোঝাতে হবে” — এই দৈব ঘোষণা থেকে। কাজেই গণসংগীতের রেসিপি হল অনুজ্ঞা, অনুশাসন, অণুসিদ্ধান্ত। আর রবীন্দ্রনাথ যে কথাগুলোকে আহ্বানের ঘাটে বেঁধেছিলেন, কবির নিজেরই সুর তাদের ভাসিয়ে নিয়ে দাঁড় করালো আবেদনের কিনারায়। ওরে গৃহবাসী গানটা উদাহরণ নাম্বার ওয়ান।

সৌজন্যে বা কারসাজিতে ওই প্লিজ-ই!

দুই
ভি-ওয়ান টাইপ বাসের পেছনের সিটগুলো উঁচুতে থাকে। সেই উচ্চতার আবার দুই ধাপ: মাধ্যমিক, হায়ার সেকেন্ডারি। হঠাৎ চিৎকার শুনে দেখি হাতদুয়েক দূরে একটা মেয়ে আমাকে আঙুল তুলে হিন্দি ভাষায় শাসাচ্ছে — কী হল, পেছনে অতোটা খালি জায়গা রেখে দাঁড়িয়ে আছেন, আর আমরা এখানে চাপ খেয়ে মরছি। এগোন ওপাশে!

অপমানিতের হাসি হেসে বললাম, ম্যাডাম ওই জায়গাটা উঁচু, দাঁড়াতে গেলে মাথায় আটকাবে, আপনিও পারবেন না।
— আপনি বুঝি সবজান্তা?
— তাহলে এসে দেখতে হয়।
— আপনার ঘাড়ের পর দিয়ে যাব নাকি? জায়গা দিন।
এই রে! পেছনে পেছন ঠেকিয়ে দুসারি লোক দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনেই আবার এক ভদ্রমহিলা ব’সে যার গণতান্ত্রিক অধিকারের দিকে আমাকে সব সময় সতর্ক নজর রাখতে হচ্ছে। তবু নৌলিমুদ্রা মনে ক’রে পেটে খাবোল দিয়ে ধনুক হলাম, সবাইকে গুঁতিয়ে আমার পেছন দিয়ে সেই বৃহত্তর গণতন্ত্র বোমারু বিমানের মতো পার হয়ে গেল। তার সঙ্গে সর্বভারতীয় মিডিয়ার কাছে “বুড়োগুলো ভয়ানক ধান্দাবাজ, নিজেরা একগাদা জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, অন্যকে এগোনোর সুযোগটুকু পর্যন্ত দেবে না, কত্তোবড়ো অসভ্য!” — এইরকম প্রেস রিলিজ।

কিন্তু উচ্চতর মাধ্যমিকের সিলেবাস দেখেই ফেল করল মেয়েটা, থেমে গেল সেই নিচের ধাপে, মানে আমার ঘাড়ের ওপর। প্রায় বেকেলাইটে তৈরি তার বগল-ব্যাগ শঙ্খ ঘোষের কবিতার পাঠক নিশ্চয়ই, আমার পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ না তুলে ছাড়বে না।

— ম্যাডাম, আপনি যে আমার জায়গাটায় দাঁড়িয়ে পড়লেন!
— ‘আমার জায়গা’ মানে??? ইয়ে আপকা খরিদাহুয়া জগা হ্যায় ক্যা???

মুগ্ধ হয়ে গেলাম! চোখের ওপর গাঢ় হল ন’-হাজার ফুট ওপরের সূর্যাস্ত, যেখান থেকে একের পর এক কুয়াশার ফিতে নেমে পাইনবনের মাথা জড়িয়ে ধরছে…। ওই প্রকৃতির যেমন কোনও ব্যাখ্যা চলে না, তেমন এই যুক্তিরও। ডোকরা শিল্প অথবা পটের ছবির মতো বিরল হয়ে ওঠা জটিল মেয়েলিপনার চিহ্ন পেয়ে আমি ভালো ক’রে তাকিয়ে দেখি গনগন করছে তার নাকের পাটা, গোল তরোয়ালের মতো ঝলসাচ্ছে হাতের কব্জি।

কয়েক নিঃঝুম মুহূর্ত পার হয়।

অচ্ছা চলতা হুঁ দুয়ায়োঁ মে ইয়াদ রখনা
মেরে জিক্‌র কা জুবাঁ পে সুয়াদ রখনা

প্রথমে বাসের কেউ কিছু খেয়াল করে না, ইনক্লুডিং মাইসেলফ।

দিলকে সন্দুকো মেঁ মেরে অচ্ছে কাম রখনা
চিট্‌ঠি-তারোঁ মেঁ ভি মেরা তু সলাম রখনা

তারপর দু’একজন কান থেকে হেডফোনের রিসিভার খুলে আমার দিকে বিচিত্র চোখে তাকায়। তখন বুঝতে পারি, গান গাইতে শুরু করেছি! সর্বনাশ! এই বাসেই আমার চার-পাঁচজন কোলিগ, অফিসে রাষ্ট্র হলে…? নিজের আবেগকে দ মানে দমন করো, কিন্তু গান ততক্ষণে আমাকে চিৎ করে বুকের ওপর চেপে বসেছে।

সুতরাং একদিকে “সন্দুকোঁমেঁ” শব্দে তার-ষড়জ থেকে লোলেগাঁওয়ের দড়ির সেতুর মতো এক ঝুলন্ত মিড়ে কোমল নিষাদে গিয়ে দাঁড়াই, অন্যদিকে আমার মন বিড় বিড় করতে থাকে: এই নাও, কথাসুরের করুণা পান করো। কেন এত রাগ তোমার জানি না। নির্যাতিত শিশু, বাড়িতে স্বাধীনতা না পাওয়া, অফিসে হয়রানি নাকি প্রেমিক উধাও? অথবা তুমি এই রকমই এক কোপে মুন্ডু নামানোয় বিশ্বাসী! যে হও সে হও, দ্যাখো শুধু তোমারই জন্যে কেউ লিখে গেছে, কেউ গেয়ে রেখেছে…

অন্ধেরা তেরা ম্যায়নে লে লিয়া
মেরা উজলা সিতারা তেরে নাম কিয়া

শোনো গান আরও বলছে কতবার তার সকালকে তোমার উঠোনে বসে বসে সন্ধে করেছে সে। গুনেগেঁথে নাও গানের “ও পিয়া” ডাকের ভেতর যত লক্ষ প্লিজ-প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়!

মেয়েটার চোখে খুব আস্তে আস্তে জ্যোৎস্না ফুটছে দেখতে পাই। চিবুকের সব খর-রেখা মরে যাচ্ছে, দুটো ঠোঁট মুখের মধ্যে মুড়ে নিয়ে বাসের ছাদে কল্পিত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে…।

(স্টপেজ আসেনি)

রবীন্দ্রনাথের গান: কখন ‘জাগে’, কখন ‘জাগে’ না
রবীন্দ্রনাথের গান: কখন ‘জাগে’, কখন ‘জাগে’ না (শেষাংশ)
উপরের লেখা দুটো পড়ে দেখতে পারেন।

পুরনো লেখা : মৃত্যুকবিতা

পুরনো লেখা : মৃত্যুকবিতা


প্রতিটা সময় বউ অথবা গোলাপবাচ্চার সাথে কাটানো উচিত।
আলো নেই, আসবে সেই রাতে খাওয়ার পরে।
সব দেশেই দার্শনিকের চেয়ে ডাক্তারের বেশি রোজগার।
কাদা-রাস্তায়, উঁচু পাথরে পিছিয়ে যাচ্ছে বাড়িফেরা।
যে কোনও ব্যথাই মৃত্যুর দিকে বাঁক ফিরে যায়।
এইসব ফালতু কথায় আমার অবস্থা বোঝাতে পারছি না
মহৎ হবো ব’লে দোতলার ঘরে উঠেছিলাম।
শুধু নিচে নামতে পারি, অসামান্য নিচে নেমে, মনোরম
নিচে নেমে উচ্চমুখ নিচে নেমে যাই
অন্য সবাই তালা দিয়ে খুলুক দরোজা


এখন আপনার উচিত ঈশ্বরে বিশ্বাস।
এখন আপনার ভালো ডঃ বাগচির কথা শুনে চলা।
এমনও সময় আসে, ডুস দিয়ে কাজ হয় না।
গ্লোবালাইজেশন হলে ওষুধটা এখুনি পাওয়া যেত।
আমি কতো বলেছি ওভাবে ওড়াস না টাকা।
যা নিজে বুঝবে করবে চিরটাকাল এই স্বভাব।
জীবন আপনার, মৃত্যুও তাই, আমরা শুধু পাড়াপ্রতিবেশি
আমরা কেবল সুস্থ প্রশাসন আর পাঁচ মিনিটে রেডি শববাহকেরা


ছোট্ট, তোমার কষ্ট পাওয়ার ক্ষমতা কেড়ে নিলাম
একদিন মানুষ-হারানো বাড়ির সিঁড়িতে ব’সে কাঁদছিলে
নিজের বাহু নিজে জড়িয়ে ধরে
একদিন টুকি খেলেছিলাম বলে বিজ্ঞানমেলায়
কি রাগ, কি নাকের জল চোখের জল!
ছোট্ট, আজ থেকে তুমি কাঁদবে না,
মরা মুখের দিব্যি দিয়েছি
ও.টি. রুমে ঢুকে বাপির অবশ গায়ে চিমটি কেটে দেবে
বিপুল হাসি হবে ক্যারাম বোর্ডে
আর মায়ের সিকি মার আধুলি মার
‘সে তো আমার লাগেই না’!
আমরা যারা চিতাবাঘের পিঠে চেপেছি উল্টোমুখে
তাদের সবাইকে ‘বাই’ করে দাও
তাদের ‘তাড়াতাড়ি ফিরবে কিন্তু’ বলতে গিয়ে
জিভে কামড়, রক্তকাণ্ড হল?
হোক, তবু ছবি-আঁকা বন্ধ কিছুতে নয়
বেড়ালের সঙ্গে কথা বলা
আর, স্নান ক’রে মন দিয়ে মাথা মুছবি তো?
ছোট্ট, যেন সবটা টিফিন খেতে দেখি…।

রবীন্দ্রনাথের গান: কখন ‘জাগে’, কখন ‘জাগে’ না (শেষাংশ)

রবীন্দ্রনাথের গান: কখন ‘জাগে’, কখন ‘জাগে’ না

তিন
সসুর ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় লাং (Langue) আর প্যারোল (Parole) -এর কথা বলেছিলেন। লাং হচ্ছে ভাষার মূল কাঠামো, তার নীতিনিয়ম, যা ভাষাব্যবহারকারীর আগে থেকেই রয়েছে। আর প্যারোল ব্যক্তিমানুষের মুখের বা লেখার ভাষা, যা লাং-এর নীতিসূত্রকে কাজে লাগিয়ে অর্থপূর্ণ কথা তৈরি করে। সসুর উদাহরণ দিয়েছিলেন দাবা খেলার। ধরুন, দাবার নিয়মকানুন হচ্ছে লাং, আর খেলতে বসে একজন খেলোয়াড় যে চাল দিলেন সেটা প্যারোল।

ভাষার জায়গায় গানকে রেখে ভাবতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, প্রত্যেক গানই এক নিজস্ব মহাসংগীতের অংশ যেখান থেকে ওই গানের সাইন-নির্ভর কথা-সুরের কাঠামো বা লাং তৈরি হল। ধারণা, এখানে যাকে “কথা” ডাকবো, আর ধ্বনি যেটা গানের বেলায় “সুর” — দুইয়ে মিশে তৈরি সেই লাং-কে গায়ক তার ব্যক্তিগত গায়ন বা প্যারোল দিয়ে ফুটিয়ে তুলছেন। একটা দাবা ম্যাচ দেখে আপনি যেমন দাবাখেলার সব নিয়মগুলো বুঝতে পারবেন না, তেমনি কারও গলায় কোনও সংগীত শুনে (প্যারোল) আমরা ওই গানটা নিয়ে কোনও বিশ্বজনীন ধারণাতেও (লাং) কিন্তু পৌঁছোতে পারি না।

সসুরের কথা ছিল, ভাষার প্রয়োগের দিক মানে প্যারোল নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু দেরিদা জানালেন, জটিলতা আসলে এখানেই। প্যারোলকে তিনি বললেন পারসোনালাইজড ফোনো-লোগোসেন্ট্রিক ব্যাপারস্যাপার। দেরিদার মতকে গুরুত্ব দিলে,যাতে সসুরও কালে-কালে হ্যাঁ দিয়েছেন, আমরা আরও বুঝতে পারব, মূল গানের সঙ্গে গায়কের উপস্থাপনার মধ্যে সেভাবে কোনও প্রাকৃতিক যোগসূত্র (Natural Bonding) কিন্তু নেই। কাজেই একটা বিশেষ গানকে শুধু অনেকের কাছে শুনেই জেনে ফেলার ধারণাতে আমাদের প্রচুর ভুল থেকে গেল।

চার
উপরোক্ত আলোচনার আলোয় বা অন্ধকারে বেছে নিচ্ছি শুনে শুনে ছ্যাদলা-ধরা — “আকাশভরা সূর্যতারা”।

আমার সব সময় মনে হয়েছে, কোনও কবিতার সুন্দরতা যতটা তার বোধে, তার অনেক বেশি থাকে আশ্চর্য হওয়ার ক্ষমতায়। অবাক থেকেই কবিতার বাক আসে, আসে জোরশক্তি, টাটকাপন।

আর কে না জানে যে-জন জানে না সে-ই আশ্চর্য হয়? বিস্ময়ের সঙ্গে সহবাস সরলতার, আর ইনোসেন্স ইকুয়ালস টু জ্ঞানের অভাব। তাই বাচ্চাদের হাতেই কবিতা খুলবে, আদতে সব সৃষ্টিই; ঢ্যামনা বয়েসে কেউ আর বিয়োতে পারে না। বুড়োরা তখন স্থিতির খেলায় নামে, নিজের চারদিকে ইঁটবালিচুনসুরকিলোহাঝান্ডাপ্রচারফলোয়ার… ।

কিন্তু “আকাশভরা সূর্যতারা”-র মধ্যে আলপিন-প্রমাণ একটা ব্যতিক্রম রয়ে গেছে যে সে জ্ঞান থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময়! অসীমকালের জোয়ারভাঁটার সঙ্গে আমার নাড়ির যোগ আমি জেনে গেছি — তাই বিস্ময়। প্রকৃতির আনন্দের দানগুলো অনুভব করেছি, জানার ভেতর দিয়ে অজানাকে খুঁজেছি আমি — তাই বিস্ময়। এই যে ব্যতিক্রম, মানে প্রুভস দা ল’, নিজের বোধের এভারেস্টে উঠে একমুঠো জ্ঞানী অবাকের ঝরোখা — এ-গানকে সবার চেয়ে আলাদা করল।

এবার পাঠ থেকে শ্রবণে সরে যাই।

সা রে গা মা পা, ২০১৬-তে দুর্নিবার সাহার গলায় শুনেছিলাম… ‘জোয়ার-ভাঁটায় ভুবন দোলে’তে “ধনি -র্সনি –ধনি ধপা(‘ধা’ স্পর্শ স্বর)” এই স্বরগুচ্ছ ছেলেটা যে অলস খুশিতে গলায় তুলে আনল সেটা শীতের রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে দোতলার ছাদে বসা বনেদি বাড়ির মেয়ের সৌন্দর্য।

কিন্তু ওখানটায় কী করলে তুমি, ভাই? সঞ্চারী থেকে আভোগে সঞ্চারিত হওয়ার মুখে ‘বিস্ময়ে তাই জাগে’-র ‘জাগে’-তে?

দেখেছি, দুর্নিবারের মতো অনেকের কাছে দুর্নিরীক্ষ্য লাগে এই জায়গাটা।

“আকাশভরা”-তে ‘জাগে’ রয়েছে মোট চারবার, স্তবকের শেষে ধুয়োর মতো। আর, সুরে প্রত্যেকবার রিপিট করা হয়েছে ব’লে চার গুণ দুই, এইট টাইমস। আমি স্বরলিপিতে ‘জাগে’-র প্রথম উচ্চারণগুলো ধরে বলছি: তিনটে জায়গায় “মা -পা –ধপা পমা(পা স্পর্শ স্বর)”। কিন্তু ওই তৃতীয় মানে সঞ্চারীর ‘জাগে’-টা ? ৩০ নম্বর স্বরবিতান খুলে দ্যাখো, সে জেগে আছে অন্যভাবে — “গা -মা –পধা পমা”।

কেন আছে?

কারণ একটা হতে পারে, রবীন্দ্র মহাশয় খুব সুবিধের লোক ছিলেন না। আমি সোজা সুর করি, সব্বাই গাইতে পারবে — ব’লে গায়ে-ফুঁ-লাগানো বাঙালিকে ডেকে-ডুকে গান তো ধরিয়ে দিলেন। তারপর একই কথার সুরের চলনেই এখানে-ওখানে উলটো প্যাঁচ মেরে আমাদের প্যাঁচে ফেলার ব্যবস্থাও সেরে রাখলেন সুন্দর রকম। আহা, সে পয়জার কঠিন কিছু নয়। কেননা, মরাল অফ দ্য স্টোরি এইটুকু, জলবৎ করে দিয়েছি মানে এই নয় তোরা আমার গানটা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গাইবি। বাঙালি হ’ল বেসিক্যালি কীর্তন-প্রজাতি, একই ঝোঁকে চোখ বন্ধ করে ধুয়ো টেনে যেতে ভালোবাসে।
তাই আনমনা ড্রাইভারের জন্যে রাস্তায় ছোট্ট ক’রে দু’একটা স্পিডব্রেকার ফেলে রাখলাম, ব্যাস্‌।

কিন্তু এটা আমাদের পর্যালোচনা। রবীন্দ্রনাথকে জিগেস করলে উনি কি সহমত হবেন? চান্স খুব কম। আচ্ছা, সুরের গুরু কী বলতে পারেন?

গানটা প্রথম থেকে লক্ষ করো। আকাশ, সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ, অসীম কালের জোয়ার-ভাঁটা — এদের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে আমার গান সবিস্ময়ে জেগে উঠছে। এই আশ্চর্যতাও আকারে উদাত্ত, কিং সাইজ। সেই জন্যে মাঝ সপ্তকের পঞ্চম থেকে “জাগে” শব্দটা নির্দ্বিধায় ওপরে উঠে যাচ্ছে স্কেল বেয়ে; ঝটকা দিয়ে নেমেও আসছে — পঞ্চমকে সিকি ছুঁয়ে মধ্যমে দাঁড়িয়ে পড়াটা ভাবো। কিন্তু যখন এই গানেরই সঞ্চারীতে ঘাসে ঘাসে পা ফেলার কথা বললাম, বনের পথ আর ফুলের গন্ধের ছবি এল, তখন ওই ম্যাক্রোকসমস-এ ছড়িয়ে নেই আমি আর, ছোট সূক্ষ্ম কোয়ান্টাম পৃথিবীর প্রতি অণুতে পা রেখে হাঁটতে চাইছি। সেখান থেকে উত্থিত আমার গানের যে অবাকপনা, সেটা কোজি, স্পর্শকাতর, মায়ামাখানো। তাই পঞ্চমের উচ্চতা নয়, গান্ধারের প্লুতস্বরকে শুরুর পৈঠা করছে সে। ফিরে আসতে গিয়ে ওই পঞ্চমেরই অর্ধেককে আঠালো পিছুটান মাখিয়ে রেখে এল। এই রহস্যময় মন্দ্রতা — যেন কোনও বয়সিনী মেয়ে — দিয়ে আমি আঁকতে চেয়েছি ভুবন-সঞ্জাত গানের জেগে ওঠাকে।

আবার দ্যাখো, গানটা ধাপে ধাপে উঠে ঘরের মায়া ছেড়ে ফের বৃহতের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে — যেখানে সে ধরিত্রী-র সঙ্গে একাত্ম হওয়ার পরে জানার ভেতর দিয়ে আবার অজানাকে পেতে চাইল, মানে মাটির বারান্দায় একপাক ঘুরে ফের এসে পড়ল আকাশ, নক্ষত্র, বিশ্বজগতের ভেতর। সেখানে বিস্ময় জেগে উঠেছে আবার প্রথমবারের মতো সাহসী, অতিব্যাপক।

পাঁচ
লেখা শেষ করার আগে মনে পড়ল বলা হয়নি বহু-শোনা গানকে জাগানোর চোক্ষম (চরম + মোক্ষম) উপায়ের কথা। সেটা পারে শুধু প্রতিভার অকারণ কল্পবিজ্ঞান। যা বহু গানে দেবব্রত করে দেখিয়েছেন, যা দেখালেন “আকাশভরা সূর্যতারা”-য় সাগর সেন।

এই গানের প্রাক-অন্তিম লাইন “জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান” থেকে শুধু “অজানারে” নেবো আমি। স্বরলিপি এই রকম:

র্সা র্সা –নর্সা ।। নর্সা –ধা –ণা ।। ধপা – – ।। -রা – –
অ জা ০০ না০ ০ ০ রে ০ ০ ০ ০ ০

(ধপা-তে ধা স্পর্শ সুর, নয়-দশ মাত্রার মধ্যে মিড় রয়েছে)।

মানে সে অন্তরার লাস্ট বাট ওয়ান লাইনে “অজানারে”-র প্রতিরূপ “রক্তধারায়”-এর মতো [র্সা –না রর্সা ।। র্সা –না -ধা ।। পা – -।। -রা – – (রর্সা-র রা তার সপ্তকের। আর নবম ও দশম মাত্রার মধ্যে মিড় রয়েছে)] সোজা নামল না। আর এখানেই রবীন্দ্রনাথের বাড়ানো থ্রু কাজে লাগিয়ে সাগর সেন পরিচয় দিলেন চরম মুন্সিয়ারির। প্রথম “নর্সা” অর্ধস্বরদুটো স্বাভাবিকভাবে গেয়ে পরের “নর্সা”-য়, মানে অজানারে-র না-তে লাগালেন ধাক্কা, গলা নিষাদ থেকে তার-ষড়জের উতরাই ঠেলে উঠে মুন্সিয়ারির আইসক্যাপ দেখিয়ে দিল! এমন অপ্রত্যাশিত নাটকীয়তা, লুপের পুঁটুলি ছিঁড়ে ছড়িয়ে পড়ছে আবেগময় সন্ন্যাস…।

আমাদের গানের কোনও জাঁক দেরিদা থাকলে হয়তো একে বলতেন ইন্ডিভিজুয়ালাইজড ফোনো-লোগোসেন্ট্রিক পাঠের বিস্ফোরণ; যাতে এক মুহূর্তে নতুন হয়ে ওঠে গানের ভুবনখানি।

(শেষ)

পদ্য : মুক্তজবা

পদ্য : মুক্তজবা

কবিতার চুরমার অ্যাশট্রে ছাড়া আমি আর কীই বা, বলো তো!
পালিয়ে এসেছি তারা-বারান্দায়, মানুষের গন্ধে থতমত
কতবার ফাল্গুনের টিকা চোখে নিয়েছি যে, ভালোবাসাটিকা
গোঘাট-সুবর্ণপুর পারাপারে ব্যস্ত সব মধুমক্ষিকা
জানলা বন্ধ করো , অথবা গলায় ফোটে মৌমাছিপালক
আত্মা-উপুড় দিয়ে শেষ লিখছে একটুতেই মরে যাওয়া লোক!
তবুও অন্ধ-আমি পা-হারা প্রেমের কাঁধে উঠে যাই রোজ একবার
দুজনে কীভাবে যেন পার হবো গিরিখাত… মুক্তজবার

রবীন্দ্রনাথের গান: কখন ‘জাগে’, কখন ‘জাগে’ না

রবীন্দ্রনাথের গান: কখন ‘জাগে’, কখন ‘জাগে’ না

এক
কিশোরকালে যখন বলপূর্বক রবীন্দ্রনাথ শোনানো শুরু হয়, তিন টুকরো করে কেটেছিলাম ওই সংগীতকেক। প্রথম ভাগে গেয়ে গেয়ে পচে ওঠা, গেয়ে গেয়ে গভীরতা খুইয়ে শিশুদের দখলে চলে যাওয়া গানগুলো। যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তাহলে যা হবে আর কি। তার পেছনে ওঠানামার বিদ্যুতহীন একঘেয়ে অনেক দিয়েছ নাথ ধর্মসংগীত। আর শেষ ছোট অংশটা আনকোরা চমকলাগা। কোনও কোনও গোধূলিতে রবি ঠাকুর তুমি সন্ধ্যার মেঘমালার আড়াল থেকে বেশ আধুনিক এক্সাইটিং ব্যাপার-স্যাপার পাঠিয়ে দিতে!

পয়লা আর দোসরা গুচ্ছের গানগুলো গলায় তুলতে ইচ্ছেই করতো না। মা উচ্ছেভাজা দিলে যেমন ভাতের ঢিবিতে লুকিয়ে রেখে “খেলাম তো”, গুরুজিও টের পেতেন আমি কী জিনিস গুরু!

আসলে, গান শেখার জন্যে যতটা বড় হতে হয়, গান শোনার জন্যে অপেক্ষা করতে হয় অনেক বেশি। মানে দাঁড়াল, গাইয়ে বাচ্চেলোগ আর শুনিয়ে সিনিয়ার সিটিজেন। তাই ভালো গায়ক তুমি পাবে, তৈরি শ্রোতা পাবে না।

এর চেয়েও গভীর উপভোগের একটা সাম্রাজ্য আছে। সেখানে গায়ক আর শ্রোতা দুই মিলেই পরিপূর্ণ সংগীতসত্তা। তাই যে গাইতে নাচার, সে পুরোপুরি শুনতেও শেখেনি; এবং পালটা সরগমও সত্যি।

দুই
এবার শ্রোতার যত বোঝার বয়েস বাড়ে, সে তার গায়কসত্তাকে কাজে লাগিয়ে টের পায় হাজার-লক্ষবার গলাদলিত গানগুলোর শরীরে এখনও বহু বহু এরোজেনাস জোন, কেউ ছুঁয়েই দ্যাখেনি!

পঞ্চাশ বয়েসের গ্রীষ্মসন্ধেবেলা এমনি কচুকাটা এক রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে মেঝেয় বাবু হয়ে বসুন দেখি, সামনে সুমনকে ডিফাই ক’রে খাতার পাতা উড়ছে, বাঁহাত হারমোনিয়ামের ওপর ছড়ানো — আস্তে আস্তে সেই গান প্রেমিকা থেকে বউ হওয়ার মতো কোল ঘেঁষে বসবে আপনার।
শ্রোতা সব সময়ই অন্য গায়কের চশমা কিছুটা প’রে থাকে, নিজের পাওয়ার-এর সঙ্গে পুরো ম্যাচ করুক চাই না করুক। কিন্তু শুনিয়েবাবু, আপনি গাইয়েবাবা হয়ে এখন নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন তো গানটার কাঁধের গোলাপি তিল, পায়ের বুড়ো আঙুলের বাঁক, কনুইয়ের কালো দাগও — যেসব এতদিনের চেনাশোনা সত্ত্বেও কোনও সাগর সেন জর্জ বিশ্বাস আপনার কানে তোলেনি?

আরও একভাবে এই ক্লিশে হয়ে ওঠা গানগুলোর পুনরুজ্জীবন হয়। ভারতীয় সংগীত তো মেলোডিনির্ভর, নির্দিষ্ট অক্টেভের ওপর দাঁড়ানো। রাগ-রাগিনীতে আবার বারো থেকে বেছে মাত্র পাঁচ-সাত স্বর নিয়ে কারুকার্য। কাজেই একটা লুপ তৈরিই থাকে সুরের কাঠামোয় আর গায়কদের স্টেজে বসেই তাই শ’য়ে শ’য়ে হাতে-গরম সরগম সাপ্লাই দেওয়া সম্ভব হয়!

লুপ বলতে আবর্তন। শুধু রাগসংগীত নয়, যে-কোনও ঠিকঠাক গানেই সুরের চলনকে মন দিয়ে অনুসরণ করলে তার প্যাটার্ন আবিষ্কার করা যাবে। চোখে দ্যাখা যাবে সুরের গোটা মানচিত্রের মধ্যে কীভাবে গানটা বসানো। এর সঙ্গে কথার অর্থ মিলিয়ে নিলে গায়কির অর্ধেক গড়ে উঠল। বাকি অর্ধেকটা গাইয়ের গলা, উচ্চারণের ঢং এইসব নানাখানা দিয়ে তৈরি।

লুপ মানে অন্তঃস্পন্দন, রবীন্দ্রগানের চার স্তবককে জুড়ে দিচ্ছে আত্মীয়তায়, ফুলের ভেতর দিয়ে সুতো গিয়ে যেমন মালার জন্ম। কাজেই যতই বহুশ্রুত হোক সেই সংগীত, তার সুরের দোলনকে এই লুপ-চেনা-আলোয় নতুন ক’রে পাওয়া যাবে। আরও আকর্ষণীয় বিষয় হল, আবর্তনে সাড়া দেওয়ার ধরণ প্রত্যেক গায়কের বেলায় হবে আলাদা, তার নিজের স্বভাব অনুযায়ী।

গানকে নিঃশেষ করে গাওয়া চাই — রাতভ’র বৃষ্টির পরে দেহ যেমন; পলকা, ধবল, কাগজের মতো। হাফ নোট, সিকি নোট, মিড়, পাশাপাশি দুমাত্রাকে দেড় আর আধা-তে ভাগাভাগি — যে-কোনও গানের মতোই রবীন্দ্রসংগীতের প্রত্যেক সুরবৈশিষ্ট্যকে সাবাড় ক’রে গাইতে হবে — যেভাবে আপনি স্ট্র ডুবিয়ে ডাবের চূড়ান্ত জল টেনে নেন।

(আর এতটাই বাকি)

পুরনো কবিতা : সমুদ্রফোঁটা

পুরনো কবিতা : সমুদ্রফোঁটা

যেবার প্রজ্ঞা এল মাথার ওপরে
অনেকগুলো নরম খড়িবক থেকে সুন্দরতমটি
গলার মধ্যে ডেকে উঠল আকাশকালীন,
সেদিন পৃথিবী খুব সুবাধ্য ছিল না
কালো ফুলকপিভার মেঘ, হাওয়ার শনশনাৎকার ছিল
বাঁশবাগানের গোড়া ঠেকে চন্দ্রবোড়া উঠে আসার
হাতেকলম এই পরিবেশে দুশ্চিন্তাকে এক অপরিসীম পংক্তি
উপহার দেওয়ার মতো ভাষা ছিল দুঃস্থময়
যেদিন পোড়া নচ্ছার এই কপালে সম্বোধি নেমে এল বৃষ্টিরোমে মিশ্রিত
স্বাধীনতা হল তোমাদের সবরকম মেয়েরা
শাসনক্ষমতা মুছে গেল সমস্ত ইতর
কুয়াশায়-শহীদ সাইকেলের পিঠটাকে
আমি অনুপুঙ্খ মুছতে লাগলাম, কিন্তু রাতের সা-কঠিন টুকরো
ছুটছিল নাকে ধাক্কা লাগিয়ে
সময় ছাইরঙ দৃশ্যের চারকোনে আঠামাখা জিভ বুলিয়ে
একটা খামে ভরে নিচ্ছিল শরীর আমার
শিশিরফোঁটা টলতে টলতে একা
ঝরে মিশে মিলিয়ে
যাচ্ছিল
সমুদ্রে
জ্বর আসছিল। ধ্বংসজাগরণ

ছড়া : নতুন বছর

নতুন বছর

আগে ছিল দু’পায় হাঁটা, এখন মোটোরেবল —
পথের কথা বলছি; এবং তার হয়েছে কেবল

শ্বশুর ছিল টাইপ মেশিন, ল্যাপটপ জামাতা
আগে যারা সিঁধ কাটতো, তাসে ‘শাবল’দাতা

তখন স্বাস্থ্য রাখতো লোকে, এখন চামড়া, ফিনিশ
বাথরুমে সব পেঁপে, আঙুর — গায়ে মাখার জিনিস!

তবুও ঘুড়ি, নিমগাছে রোদ সোজাউল্টো বোনা…
শীতের আদরগুলো আমি বদলাতে দেবো না

নতুন বছর একটা খবর জেলেপাড়ায় ভাসছে
তোপসে তো খুব টেস্টি, এবার ফেলুদামাছ আসছে!