রবীন্দ্রনাথের গান: কখন ‘জাগে’, কখন ‘জাগে’ না
তিন
সসুর ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় লাং (Langue) আর প্যারোল (Parole) -এর কথা বলেছিলেন। লাং হচ্ছে ভাষার মূল কাঠামো, তার নীতিনিয়ম, যা ভাষাব্যবহারকারীর আগে থেকেই রয়েছে। আর প্যারোল ব্যক্তিমানুষের মুখের বা লেখার ভাষা, যা লাং-এর নীতিসূত্রকে কাজে লাগিয়ে অর্থপূর্ণ কথা তৈরি করে। সসুর উদাহরণ দিয়েছিলেন দাবা খেলার। ধরুন, দাবার নিয়মকানুন হচ্ছে লাং, আর খেলতে বসে একজন খেলোয়াড় যে চাল দিলেন সেটা প্যারোল।
ভাষার জায়গায় গানকে রেখে ভাবতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, প্রত্যেক গানই এক নিজস্ব মহাসংগীতের অংশ যেখান থেকে ওই গানের সাইন-নির্ভর কথা-সুরের কাঠামো বা লাং তৈরি হল। ধারণা, এখানে যাকে “কথা” ডাকবো, আর ধ্বনি যেটা গানের বেলায় “সুর” — দুইয়ে মিশে তৈরি সেই লাং-কে গায়ক তার ব্যক্তিগত গায়ন বা প্যারোল দিয়ে ফুটিয়ে তুলছেন। একটা দাবা ম্যাচ দেখে আপনি যেমন দাবাখেলার সব নিয়মগুলো বুঝতে পারবেন না, তেমনি কারও গলায় কোনও সংগীত শুনে (প্যারোল) আমরা ওই গানটা নিয়ে কোনও বিশ্বজনীন ধারণাতেও (লাং) কিন্তু পৌঁছোতে পারি না।
সসুরের কথা ছিল, ভাষার প্রয়োগের দিক মানে প্যারোল নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু দেরিদা জানালেন, জটিলতা আসলে এখানেই। প্যারোলকে তিনি বললেন পারসোনালাইজড ফোনো-লোগোসেন্ট্রিক ব্যাপারস্যাপার। দেরিদার মতকে গুরুত্ব দিলে,যাতে সসুরও কালে-কালে হ্যাঁ দিয়েছেন, আমরা আরও বুঝতে পারব, মূল গানের সঙ্গে গায়কের উপস্থাপনার মধ্যে সেভাবে কোনও প্রাকৃতিক যোগসূত্র (Natural Bonding) কিন্তু নেই। কাজেই একটা বিশেষ গানকে শুধু অনেকের কাছে শুনেই জেনে ফেলার ধারণাতে আমাদের প্রচুর ভুল থেকে গেল।
চার
উপরোক্ত আলোচনার আলোয় বা অন্ধকারে বেছে নিচ্ছি শুনে শুনে ছ্যাদলা-ধরা — “আকাশভরা সূর্যতারা”।
আমার সব সময় মনে হয়েছে, কোনও কবিতার সুন্দরতা যতটা তার বোধে, তার অনেক বেশি থাকে আশ্চর্য হওয়ার ক্ষমতায়। অবাক থেকেই কবিতার বাক আসে, আসে জোরশক্তি, টাটকাপন।
আর কে না জানে যে-জন জানে না সে-ই আশ্চর্য হয়? বিস্ময়ের সঙ্গে সহবাস সরলতার, আর ইনোসেন্স ইকুয়ালস টু জ্ঞানের অভাব। তাই বাচ্চাদের হাতেই কবিতা খুলবে, আদতে সব সৃষ্টিই; ঢ্যামনা বয়েসে কেউ আর বিয়োতে পারে না। বুড়োরা তখন স্থিতির খেলায় নামে, নিজের চারদিকে ইঁটবালিচুনসুরকিলোহাঝান্ডাপ্রচারফলোয়ার… ।
কিন্তু “আকাশভরা সূর্যতারা”-র মধ্যে আলপিন-প্রমাণ একটা ব্যতিক্রম রয়ে গেছে যে সে জ্ঞান থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময়! অসীমকালের জোয়ারভাঁটার সঙ্গে আমার নাড়ির যোগ আমি জেনে গেছি — তাই বিস্ময়। প্রকৃতির আনন্দের দানগুলো অনুভব করেছি, জানার ভেতর দিয়ে অজানাকে খুঁজেছি আমি — তাই বিস্ময়। এই যে ব্যতিক্রম, মানে প্রুভস দা ল’, নিজের বোধের এভারেস্টে উঠে একমুঠো জ্ঞানী অবাকের ঝরোখা — এ-গানকে সবার চেয়ে আলাদা করল।
এবার পাঠ থেকে শ্রবণে সরে যাই।
সা রে গা মা পা, ২০১৬-তে দুর্নিবার সাহার গলায় শুনেছিলাম… ‘জোয়ার-ভাঁটায় ভুবন দোলে’তে “ধনি -র্সনি –ধনি ধপা(‘ধা’ স্পর্শ স্বর)” এই স্বরগুচ্ছ ছেলেটা যে অলস খুশিতে গলায় তুলে আনল সেটা শীতের রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে দোতলার ছাদে বসা বনেদি বাড়ির মেয়ের সৌন্দর্য।
কিন্তু ওখানটায় কী করলে তুমি, ভাই? সঞ্চারী থেকে আভোগে সঞ্চারিত হওয়ার মুখে ‘বিস্ময়ে তাই জাগে’-র ‘জাগে’-তে?
দেখেছি, দুর্নিবারের মতো অনেকের কাছে দুর্নিরীক্ষ্য লাগে এই জায়গাটা।
“আকাশভরা”-তে ‘জাগে’ রয়েছে মোট চারবার, স্তবকের শেষে ধুয়োর মতো। আর, সুরে প্রত্যেকবার রিপিট করা হয়েছে ব’লে চার গুণ দুই, এইট টাইমস। আমি স্বরলিপিতে ‘জাগে’-র প্রথম উচ্চারণগুলো ধরে বলছি: তিনটে জায়গায় “মা -পা –ধপা পমা(পা স্পর্শ স্বর)”। কিন্তু ওই তৃতীয় মানে সঞ্চারীর ‘জাগে’-টা ? ৩০ নম্বর স্বরবিতান খুলে দ্যাখো, সে জেগে আছে অন্যভাবে — “গা -মা –পধা পমা”।
কেন আছে?
কারণ একটা হতে পারে, রবীন্দ্র মহাশয় খুব সুবিধের লোক ছিলেন না। আমি সোজা সুর করি, সব্বাই গাইতে পারবে — ব’লে গায়ে-ফুঁ-লাগানো বাঙালিকে ডেকে-ডুকে গান তো ধরিয়ে দিলেন। তারপর একই কথার সুরের চলনেই এখানে-ওখানে উলটো প্যাঁচ মেরে আমাদের প্যাঁচে ফেলার ব্যবস্থাও সেরে রাখলেন সুন্দর রকম। আহা, সে পয়জার কঠিন কিছু নয়। কেননা, মরাল অফ দ্য স্টোরি এইটুকু, জলবৎ করে দিয়েছি মানে এই নয় তোরা আমার গানটা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গাইবি। বাঙালি হ’ল বেসিক্যালি কীর্তন-প্রজাতি, একই ঝোঁকে চোখ বন্ধ করে ধুয়ো টেনে যেতে ভালোবাসে।
তাই আনমনা ড্রাইভারের জন্যে রাস্তায় ছোট্ট ক’রে দু’একটা স্পিডব্রেকার ফেলে রাখলাম, ব্যাস্।
কিন্তু এটা আমাদের পর্যালোচনা। রবীন্দ্রনাথকে জিগেস করলে উনি কি সহমত হবেন? চান্স খুব কম। আচ্ছা, সুরের গুরু কী বলতে পারেন?
গানটা প্রথম থেকে লক্ষ করো। আকাশ, সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ, অসীম কালের জোয়ার-ভাঁটা — এদের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে আমার গান সবিস্ময়ে জেগে উঠছে। এই আশ্চর্যতাও আকারে উদাত্ত, কিং সাইজ। সেই জন্যে মাঝ সপ্তকের পঞ্চম থেকে “জাগে” শব্দটা নির্দ্বিধায় ওপরে উঠে যাচ্ছে স্কেল বেয়ে; ঝটকা দিয়ে নেমেও আসছে — পঞ্চমকে সিকি ছুঁয়ে মধ্যমে দাঁড়িয়ে পড়াটা ভাবো। কিন্তু যখন এই গানেরই সঞ্চারীতে ঘাসে ঘাসে পা ফেলার কথা বললাম, বনের পথ আর ফুলের গন্ধের ছবি এল, তখন ওই ম্যাক্রোকসমস-এ ছড়িয়ে নেই আমি আর, ছোট সূক্ষ্ম কোয়ান্টাম পৃথিবীর প্রতি অণুতে পা রেখে হাঁটতে চাইছি। সেখান থেকে উত্থিত আমার গানের যে অবাকপনা, সেটা কোজি, স্পর্শকাতর, মায়ামাখানো। তাই পঞ্চমের উচ্চতা নয়, গান্ধারের প্লুতস্বরকে শুরুর পৈঠা করছে সে। ফিরে আসতে গিয়ে ওই পঞ্চমেরই অর্ধেককে আঠালো পিছুটান মাখিয়ে রেখে এল। এই রহস্যময় মন্দ্রতা — যেন কোনও বয়সিনী মেয়ে — দিয়ে আমি আঁকতে চেয়েছি ভুবন-সঞ্জাত গানের জেগে ওঠাকে।
আবার দ্যাখো, গানটা ধাপে ধাপে উঠে ঘরের মায়া ছেড়ে ফের বৃহতের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে — যেখানে সে ধরিত্রী-র সঙ্গে একাত্ম হওয়ার পরে জানার ভেতর দিয়ে আবার অজানাকে পেতে চাইল, মানে মাটির বারান্দায় একপাক ঘুরে ফের এসে পড়ল আকাশ, নক্ষত্র, বিশ্বজগতের ভেতর। সেখানে বিস্ময় জেগে উঠেছে আবার প্রথমবারের মতো সাহসী, অতিব্যাপক।
পাঁচ
লেখা শেষ করার আগে মনে পড়ল বলা হয়নি বহু-শোনা গানকে জাগানোর চোক্ষম (চরম + মোক্ষম) উপায়ের কথা। সেটা পারে শুধু প্রতিভার অকারণ কল্পবিজ্ঞান। যা বহু গানে দেবব্রত করে দেখিয়েছেন, যা দেখালেন “আকাশভরা সূর্যতারা”-য় সাগর সেন।
এই গানের প্রাক-অন্তিম লাইন “জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান” থেকে শুধু “অজানারে” নেবো আমি। স্বরলিপি এই রকম:
র্সা র্সা –নর্সা ।। নর্সা –ধা –ণা ।। ধপা – – ।। -রা – –
অ জা ০০ না০ ০ ০ রে ০ ০ ০ ০ ০
(ধপা-তে ধা স্পর্শ সুর, নয়-দশ মাত্রার মধ্যে মিড় রয়েছে)।
মানে সে অন্তরার লাস্ট বাট ওয়ান লাইনে “অজানারে”-র প্রতিরূপ “রক্তধারায়”-এর মতো [র্সা –না রর্সা ।। র্সা –না -ধা ।। পা – -।। -রা – – (রর্সা-র রা তার সপ্তকের। আর নবম ও দশম মাত্রার মধ্যে মিড় রয়েছে)] সোজা নামল না। আর এখানেই রবীন্দ্রনাথের বাড়ানো থ্রু কাজে লাগিয়ে সাগর সেন পরিচয় দিলেন চরম মুন্সিয়ারির। প্রথম “নর্সা” অর্ধস্বরদুটো স্বাভাবিকভাবে গেয়ে পরের “নর্সা”-য়, মানে অজানারে-র না-তে লাগালেন ধাক্কা, গলা নিষাদ থেকে তার-ষড়জের উতরাই ঠেলে উঠে মুন্সিয়ারির আইসক্যাপ দেখিয়ে দিল! এমন অপ্রত্যাশিত নাটকীয়তা, লুপের পুঁটুলি ছিঁড়ে ছড়িয়ে পড়ছে আবেগময় সন্ন্যাস…।
আমাদের গানের কোনও জাঁক দেরিদা থাকলে হয়তো একে বলতেন ইন্ডিভিজুয়ালাইজড ফোনো-লোগোসেন্ট্রিক পাঠের বিস্ফোরণ; যাতে এক মুহূর্তে নতুন হয়ে ওঠে গানের ভুবনখানি।
(শেষ)