চন্দন ভট্টাচার্য এর সকল পোস্ট

গল্প : নেট প্র্যাকটিসের পর

গল্প : নেট প্র্যাকটিসের পর

সকালে দেবার্ক ফোন করেছিল। এই ক্যালানে, বিরাট কোহলিকে বল করবি?
— তুই কর। একটা রেস্টের দিন, ঘুমোতে দে শালা। আতা কোথাকার!

কাল মধ্যমগ্রাম সুহৃদ সংঘের “দিনরাত্রিব্যাপী” ছিল, ফাইনালে লং লেগে ডাইভ মারতে গিয়ে বাঁ হাতের কনুইটা ছ’ড়েছে। মোবাইল দেখলাম, সাতটা চৌতিরিশ। সুইচ অফ করে কম্বল টেনে নেওয়া যাক মাথার ওপর।
কিন্তু কপাল খারাপ হলে যা হয়, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাবা ঢুকে এলো। দেবুদা ফোন করেছিল, আধ ঘন্টার মধ্যে ইডেনের পাঁচ নম্বর গেটের সামনে হাজির হতে বলছে। যা যা, বিরাট রোহিতদের ঠ্যাঙানি খেয়ে আয়।

বাবা চায় না আমি ক্রিকেট খেলি, আমিও কি চাই! স্রেফ মার জেদাজেদি আর সেজদার মারের ভয়ে মাঠটা টেনে যেতে হচ্ছে। নিজেকে বুঝিয়েছি: রঞ্জি খেললে চাকরি পেতে সুবিধে, সামনের চার-পাঁচ বছরের মধ্যে একটা চান্স লাগল তো লাগল, না হলে বাবার চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি ফার্ম জিন্দাবাদ।

দুই
দেবুকাকু পিঠে আধা-চাপড় আধা-কিল গোছের কিছু একটা দিল, চাপড় টনিক আর কিলটুকু দেরি করার জন্যে। মাঠে ঢুকে দেখি, পাশাপাশি দুটো নেটের মুখে দুটো জটলা, সিএবি-র ফার্স্ট আর সেকেন্ড ডিভিশান মিলে প্রায় কুড়িখানা ছেলে — উত্তর পাড়ার বাবুন, বেহালা ইউথের রাজীব সামন্ত যার গ্রাউন্ড ফিল্ডিং আমাদের মালি পিচ্চাইদার ভাষায় “ব্যাংকর”, তারপর এবার অন্ধ্রা থেকে বাংলায় আসা স্টিফেন — কে নেই! রণদেব বাসুর লম্বা মাথাটাও দেখতে পেলাম। যাই হোক, বাঁদিকে নেট করবে ব্যাটসম্যানরা আর ডান দিকে বোলার সম্প্রদায়। আমার মতো কমজোরি দশটা ছেলেকে বোলারদের জন্যে বেছে তার থেকে ছ’জনকে মাঠে ডাকা হল। বাকি চারজন ইনক্লুডিং মি এক এক বোতল জল হাতে সাইড লাইনে।

পনেরোই ডিসেম্বরের কলকাতা যেমন হয়, আজকের মাঠ তেমন সুখীসুখী নয় কিন্তু। ঠান্ডা নেই, হাওয়া নেই, কুজ্ঝটিকাও। আমি হাফহাতা সোয়েটার খুলতেই যথারীতি অবাক হয়ে তাকাল পাশের ছেলেটা। হাইট পাঁচ ফুট সাড়ে নয়, ওজন মায়ের সপ্তাহে চোদ্দ বেলা অন্ডা-চিকেন কারির সৌজন্যেও ষাট কেজি ছোঁয়নি, হাওয়ার উল্টোদিকে দাঁড়ালে নিখুঁত ফার্স্ট ব্রাকেট হয়ে যাই। আমাকে সবাই চোখ হাঁ করে দেখে এবং বিনা দ্বিধায় বাতিল করে দেয়।

দু’বছর আগে অনিমেষ ডাক্তারের মেয়ে অনুশ্রী যেচে এসে আলাপ করলো এই ইডেনে; আন্ডার সেভেনটিনের কোয়ার্টার ফাইনাল ছিল; আমি শেষ ওভারে কী করে কে জানে তিনটে ছয় মেরে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ! দুদিন সিসিডি-তে বসা হল, একদিন হাফ টাইম পর্যন্ত নন্দন-এ দেবের সেই বক্সিংয়ের সিনেমা… তারপর থেকে মেসেজ পাঠাই, উত্তর আসে না। দুমাস বাদে নীলিমা ফোন করেছিলঃ কষ্ট পেয়ো না, অরিনদা। তুমি রোগা ব’লে নয়, আসলে তোমার কোনও উচ্চাশা না থাকাটা আমার বন্ধু মেনে নিতে পারেনি।

তিন
ভুবনেশ্বর কুমারের স্ট্রেট ড্রাইভ ছুটে এল আমারই দিকে। সরল মনে কুড়িয়ে ফেরত পাঠাবো, দেখি একটা মোটা কালো লোক, মাছওয়ালার মতো চেহারা, ইশারায় ডাকছে। এই রে! বেশ ঘুমঘুম পাচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত গাধার খাটুনিই নাচছে কপালে। বাবা বলে, ইলেকশান ডিউটিতে রিজার্ভ আর ক্রিকেট মাঠে স্ট্যান্ড বাই, সবচেয়ে বাজে দুটো ভূমিকা।

আমার পাশের সেই অবাককুমার প্রথম ডেলিভারি দিল ভুবিকে, ভালো পেস, ভালো ক্যারি। হাত তুলে ছেড়ে দিল সে, তারপর পাশের নেটে শিখর ধাওয়ানের দিকে কী একটা ইশারা করে দুজনেই হাসতে হাসতে ছুটলো ড্রেসিং রুমের দিকে। নেটে এসে দাঁড়িয়েছে উমেশ যাদব।

আমি উমেশের ফ্যান, বোলিং তো বটেই ওর চেহারাও কম কিছু যায় না। গাভাসকার ভিভিয়ান রিচার্ডসকে নিয়ে লিখেছিলেন, ভিভ যখন শার্ট খুলে দাঁড়ায়, মনে হবে পেশিগুলো আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। উমেশও চেহারায় গায়ের রঙে পুরো ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান। আমার প্রথম বলটা গুড লেন্থে পড়ল, কত আর — একশো বাইশ-ফাইশ হবে। প্রথম বল বলেই বোধ হয় ব্লক করলো ব্যাটসম্যান, আমি ফলো থ্রু-তে কুড়োতে গিয়ে বললামঃ ইন্ডিয়া মেঁ সিরফ আপ হি জেনুইন ফাস্ট বোলার হো স্যার, ম্যায় আপকা বহোত কদর করতা হুঁ।
— ভাগ সালা! আয়া হ্যায় কদর করনে।

খেলোয়াড়দের মুখ ভালো হয় না, চরিত্রও নয়, কিন্তু মনটা জেনুইন। এই চার বছরে কতো যে খিস্তি শিখেছি। বোলিং রান আপে ফিরতে ফিরতে শুনলাম, কেউ চিৎকার করে বলছে ছোটা ফেঁকো। মনে হয়, মাছওয়ালাই।

পিচে প্রচুর সবুজ, থ্রি কোয়ার্টার লেন্থে মারতেই দুব্বোর গোড়ায় পড়ে লাফালো, সাঁই শব্দ শুনলাম যাদবের ব্যাটে, বল স্কোয়্যার লেগ বাউন্ডারি টপকে চলে গেছে।

পর পর পাঁচটা ডেলিভারির এক দশা। অবাককুমারের বলগুলো ব্লক করছে, আমারগুলো ওড়াচ্ছে। ভালো বলতে গিয়ে কি শত্রুতা করে বসলাম রে বাবা! খুব আশা করছি, মোটা লোকটা এবার আমায় অব্যাহতি দেবে। কোথায় কী! পঞ্চম ছয় মাঠ টপকে গ্যালারিতে চলে গেল আর এদিকে বল কুড়োতে বসে থাকা দুটো বাচ্চা র্যা ম্পে উঠতে দোনোমনো করছে। যাদবভাই এগিয়ে এলো ব্যাটটা আমার দিকে বাড়িয়ে। ক্যা রে খজুর, কৌন ওয়াপস লায়েগা গেঁদ, তেরা বাপ?

চার
গ্যালারির নিচেটা কেমন শান্তমতো; ছেঁড়া পোস্টার, সিগারেটের খালি প্যাকেট, চায়ের কাপ — উৎসব শেষের চিহ্ন সব। আর প্রভূত নামধাম লেখা কংক্রিটের গায়ে — শীলা প্লাস অমিত, দুর্জয় প্লাস রেহানা, মাহি (পাশে লাভ সাইন)। ভাগ্যিস অনুর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, নইলে আজকের এই ক্যালানি খাওয়াটা নির্ঘাত খবর হয়ে যেত। অনু প্রেম করছে রাজর্ষির সঙ্গে, আমার চেয়ে দু’বছরের সিনিয়ার, মোহনবাগানের প্রথম পনেরোয় থাকে। একই দেহে রাজা এবং ঋষি, নিশ্চয়ই ওর মধ্যে উচ্চাশার কোনও অভাব পায়নি মেয়েটা।

বল নিয়ে ফেরার সময় চোখে পড়ল ড্রেসিং রুম থেকে বেরিয়ে দুলকি চালে মাঠে পদার্পণ করছেন নীল টি-শার্ট সাদা শর্টস ভুঁড়িযুক্ত সুদূর লম্বা রবি শাস্ত্রী। কেননা প্রথম নেটটায় ঢুকেছে রাহানে, এই মুহূর্তে ফর্ম হাতড়ানো একমাত্র ভারতীয় ব্যাটসম্যান। সঞ্জয় বাঙ্গার বল ছুঁড়ে দিল অ্যালবার্ট স্টিফেনকে।

রাগ মানুষকে দিয়ে কতো ভালো ভালো কাজ করিয়ে নেয়, অথচ আমার রাগটাই হয় না। তবে পরের বলগুলোর একটাতেও ছক্কা খেলে চলবে না। বোলিং মার্কে ফিরতে গিয়ে দেখে নিয়েছি লং অফ গ্যালারির থামের আড়ালে একটা চেনামুখ উঁকি দিচ্ছে — দেবুকাকু।

রান আপের শুরু পিছিয়ে দিলাম পাঁচ পা। যাদবভাই আমাকে দেখিয়ে মাছওলাকে কিছু বলছে এবং দুজনে হাসছে যৌথ উদ্যোগে। আমি বিড়বিড় করে বললাম, কাকে বললাম কোনও আইডিয়া নেই — একটা একশো চল্লিশ দিও, ওয়ান ফট্টি, কেমন? আর শুরু করলাম দৌড়।

পুল মারবে বলে আগে থেকেই শরীর বাঁদিকে মুড়ে নেওয়ায় ডান হাত এক্সপোজড হয়ে গেছিল যাদবের। ফটাস করে শুধু একটা আওয়াজ শুনলাম, আর্ম গার্ডের ঠিক নিচে লেগেছে বলটা, ওই কাল আমার যেখানে ছেলে গেছিল। মুখ দিয়ে কাতরোক্তি বের হল, হুড়মুড় করে উইকেটের ওপর ভেঙে পড়ল ভারতীয় ফাস্ট বোলার।

(চলবে)

অপূরণীয় আলো

অপূরণীয় আলো

রোদ মুখের ওপর পড়ে জ্যোৎস্না হয়ে গেছে
আমার হাতের আঙুলেও লেগে প্রতিমানির্মাণ।
ভাবছি, যদি কোনোদিন তোমাকে রাজি করাতে পারি মহাপীঠ পর্যন্ত
দুজনকে মুখোমুখি বসিয়ে দেখবো — আসলে কে নীলোৎপল, মণিকর্ণিকা…

বাইরে অপূরণীয় আলো
গাছের টেবিলে পাখিদের কফিহাউজ ভোরবেলা
দেখে মনে হবে দুঃখ কোথাও একজিস্ট করে না

সব ছেড়ে দিলে যে সম্পদ আসে
প্রেম থেকে নিজেকে পরিত্যক্ত ক’রে তোলার ফান্ডা আছে যার
মৃত্যু সামনে দেখে আত্মহত্যা যে দেশব্রতীরা করেছে তাদের আদলে
ভেবেছিলাম, একান্ন হাত দুর্গামূর্তির মতো আলোয়
এই নিবৃষ্টির দেশে তুমি-মেঘ রেখে যাবো

আজ লোভ হল, দুজনে এক-হাঁড়িতে সুখ ফুটিয়ে খাই
নিজের পথের মাঝখান থেকে নিজেকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে দেখি
রোদ তোমার মুখে পড়ে জ্যোৎস্না হয়ে আছে

জ্যোৎস্নাতিরিক্ত তুমি…

শীতের তৃতীয় শীত

শীতের তৃতীয় শীত

এক
প্রত্যেক ডিসেম্বরে হলুদ লজেন্সের ভেতরে কবর দেওয়া হয় আমাকে
আর প্রতি মার্চে সমাধি ফাটিয়ে কমলারঙ মধু গড়িয়ে যায়

দুই
সব রোদ বোরখাপরা, সব ধানের গুছি মুসলমান
শুধু সূর্য নয়, কাঠের ফার্নিচারের দোকানও আলো দেয়
এই শীত কোনও প্রবেশমূল্য রাখেনি…এখানে-ওখানে
বিড়ি বিভাগের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দেশলাই সম্প্রদায়

সব শীতের মতো এবারও মায়ের চেয়ে দিদাকে এগিয়ে রেখেছি

তিন
কে একা চেনার সহজ উপায় আদুরে হাতে শুধু একটা নখ পচে যাচ্ছে
কে প্রতারিত — পানের পিক ধরা দেয়ালে ঠেসান দিয়ে
দাঁড়িয়ে সাদা সোয়েটার

মাফলার খুলে মৃত তারার থুতনি ঢেকে দিয়েছি
ঠোঁটে গুঁজে দিলাম আধখাওয়া সিগারেটটা
সাইকেলে চেপে বলো তো সেই কবে থেকে ঘুরছি মহাকাশ
নিচে ধর্ষক বাইকের আলো প্রদীপ দেখাচ্ছে মাঠগুলোতে
বাঘ যেমন সিংহের মতো ঘুমোয়, হৃদয়ের রোমের ভেতরে
ধানের গাদি উপুড় হয়ে আছে

চার
ঘোষণা রাখলাম সারা বাংলা ঝরাপাতা কমিটির পক্ষ থেকে। আজ হিমানী সংঘের অস্থায়ি মঞ্চে শীতের স্থানীয় ও বহিরাগত শিল্পী সমন্বয়ে এক…

আসলে হিমঘরের দেশবিদেশ হয় না, তাই শীতলতার প্রতি আপনার নৈতিক দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসুন। আগামীকাল সংঘ আয়োজিত কুহেলি প্রতিযোগিতায় আপনাদের সহযোগিতা কমিটির প্রত্যেকটা শিশিরবিন্দু একান্তভাবে কামনা করে। ক-বিভাগে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত ছোট ছোট টিকটিকি লাল পিঁপড়ে আর গংগাফড়িংয়ের জন্যে বিষয়: যেমন খুশি ধুলোকণা। খ-বিভাগে রয়েছে…

আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে স্বেচ্ছায় তুষারদান শিবির। বরফদান এক মহৎ দান। বন্ধু, মনে রাখবেন শীত মানুষের শিরায় থাকে, কোনও কারখানায় তৈরি হয় না

শীতের প্রথম শীত

শীতের প্রথম শীত

শীতের আরম্ভ-শ্বাস দুলে ওঠে কঙ্কাল-তারায়
উৎপন্ন হয়েছে হিম ভোরপাত্রে, শালিখে, দূর্বায়।
পিপারমেন্টের জিভ ছুঁয়ে আছে বাতাস-ধমনী
শীতের প্রথম মোর্চা, জমায়েত আমার পাড়ায়।

কুয়াশা শীতের: তাকে কেন কেউ সু-আশা বলোনি?
খাদে জিপ গড়াবে না যদি জেনে রাখো সুবচনী।
নারকোল-ডাঁটি জুড়ে সেতারের পুরু ঘাট কাটা
কাঁচা পাঁউরুটি-রোদ, জেলি নেই, গরীব কলোনি।

শীতের জলসা — তার বাষ্পমাঠে একা তবলাটা
বাজে… বাজে… শুয়ে আছে কপালে গানের কুশ গাঁথা
যে-গায়ক। শীতের পায়ের জল লেগে মুখে, গা-য়।
ওর নাড়িনক্ষত্রকে ছিঁড়ে, হিম, আকাশেই পাঠা।

ছবি “শীত” — শিশির ও কুয়াশা সাহসী ভূমিকায়!
শীতের আরম্ভ-বোল ফুটে ওঠে আমার খাতায়

শীতের দ্বিতীয় শীত

শীতের দ্বিতীয় শীত

ট্রেনের হর্নের গায়ে মাকড়সা-ঝুল লেগে আছে
পঞ্চায়েতে দু’মাসের কাজ পেল আকাশি মেয়েরা:
পায়ে-চলা জ্যোৎস্না দেবে বিলের মাটিতে, বিষধর —
ঝাঁপির পার্বণী পেয়ে হবে গোল সুখিত বেড়াল

বৃদ্ধ দাঁতাল পাখি — ধান কাটতে গিয়ে ক্ষেতওলা
কোলে নেয়, মরাইতে রাখে। ঝরা পোকা, ঝরা ভিড়,
হিমের মশারি…। এই যে দাঁতনফল, আমার ফোকলা
আয়ু মুঠো ক’রে এতদূর ছুটলে, বাবুজি!

মুরগির পিঠ থেকে মায়া ছিঁড়ে নিচ্ছে পিকনিক
সেখানে গাছের মেধা, সেখানে মেঘের পরিষেবা
ধরবো বলে বসে আছি। এ-মহা কন্ডাকটেড ট্যুর
পাহাড়কে ভাঁজ ক’রে পৌঁছে দেবে, মুস্‌কান, তোমায়।

কুয়াশার তৃপ্তি নামছে; আর কেউ ফিরবে? জানি না
শীতের সনেট লিখলে শীত তাকে সঙ্গে নিয়ে যায়…

বাগীশ্বরী: দুই

বাগীশ্বরী: দুই

জানি না কোন ঘন পাড়াগাঁয় বিলের ধানজমি থেকে
উঠেছে তোমার শরীরের ছড়া
কার্তিকের কৃষ্ণা তেরোদশী গোধূলিতে শীতবৃষ্টি প’ড়ে
হাতের আঙুলগুলো তৈরি হয় কিনা
জানি না বৈষ্ণবী, গেরুয়া পাঞ্জাবির নিচে কী লুকোও
জপমালা নাকি পাঞ্চজন্য স্তনদুটো
সন্ধে থেকে দুএকটা মশা ঘরে ঢোকার মতো
তোমারও কি রাগ শরীরের নর্দমাকে মা বলে ডেকেছে?
তুমি যদি তুমি হও, সেই শুদ্ধ সারং আমি চিনি
অতিরিক্ত মর্মন্তুদ হয়ে যাবে প্রথম সাক্ষাৎ, বুঝতে পারিনি
প্রার্থনার শেষে দেখি ঘরে একটা শিল্পবীজ নেই
চক্ষুধারা নেই চোখে…
এই নাভিতে আগুন দাও কর্পূরের
সেই তেজে ঘুরুক জাহাজ অন্ধকার সমুদ্রের খাঁজে
ফুরিয়ে গিয়েছি ব’লে ফেলে এসো না টেলিফোনহীন নক্ষত্রজংগলে
রোজ ভোরে নতুন ফয়েল ছিঁড়ে একটা ক’রে তুমি,
যতদিন বেঁচে থাকবেন…

সার্জারি নাট্যশালা

সার্জারি নাট্যশালা

২৯ জানুয়ারি, ২০১৬, সকাল ১০/৩০
হাসপাতালে ভর্তি না হওয়ার শেষ আবেদন
খারিজ হয়ে গেল ওপিডি আউটডোরে। ফাইলে সই করে
কলমের নিবটি ভেঙে ফেললেন সিনিয়র সার্জেন ফ্রান্সিস জেকব
কিছু হতাশ ও বিচলিত দেখাচ্ছিল অপরাধীকে

২৯ জানুয়ারি, দুপুর ১/০০
অসুস্থের পরিবারকে জানানো হল, জরিমানার দেড় লাখ টাকা
জমা দিতে হবে। ইম্মেডিয়েটলি

২৯ জানুয়ারি, বিকেল ৫/৫০
হাউজ স্টাফ সঞ্জয় হেলথ চেক আপ করলেন
শেষবারের মতো। যেখানে আঘাত করা হবে,
শরীরের সেই সন্ধিস্থান চিহ্নিত করে রাখা হল কম্পিউটারে
জানালেন রাত বারোটার পর থেকে এক চামচ জলও নয়, আর
শাস্তি কার্যকর করতে অসুবিধে হলে কর্তৃপক্ষকে দায়ি করা যাবে না।
অসুস্থ জানালো তার শেষ ইচ্ছে, একবার ছেলের বান্ধবীর সঙ্গে
কথা বলতে চায়

৩০ জানুয়ারি, ভোর ৩/০০
ঘুম থেকে তোলা হল অসুস্থকে। সে হাসপাতালের পুরোহিতের সামনে
১৫ মিনিট বিড়বিড় করে পড়ল দস্তয়েভস্কির নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড
একজন ওয়ার্ডেন তাকে বাথরুমে নিয়ে ক্ষুর টেনে
শরীরের সব কুন্তল ঝরিয়ে দিলেন
আয়নাখসা দেয়ালে প্রতিচ্ছবির আশায় তাকিয়ে থাকল জন্মমুহূর্ত

৩০ জানুয়ারি, ভোর ৩/৪০
কার্বলিক অ্যাসিড সাবানে শরীরের সমস্ত ত্বক আর ছিদ্র ধুয়ে বেরিয়ে এলে
সুপারিনটেন্ডেন্ট জানালেন, সে এতদিন শুধু অসুস্থ ছিল।
আজ থেকে অসুস্থ ও নগ্ন…

৩০ জানুয়ারি, ভোর ৪/১০
একজন মহিলা বিবশক, যে-কোনও দক্ষিণী মেয়ের
মতোই সুন্দরী, কোমরে তিনটে ইঞ্জেকশান করেন। অর্ধেক অসাড়
অসুস্থকে নিয়ে যাওয়া হয় ওটি-র ডাইনিং টেবিলে
জানা গেছে, ওই অবস্থাতে সে
অ্যানাসথেটিস্টের দিকে ফিরে বলে,
গিম্মি এ স্মাইল, ডিয়ার
তারপর ট্রলি থেকে গড়িয়ে পড়ে যায়

৩০ জানুয়ারি, ২০১৬, বেলা ১১/০০
নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে অস্ত্রোপচার সুসম্পন্ন হল
আটজন ডিআইজি পদমর্যাদার চিকিৎসকের সাহায্যে
সময় সাড়ে ছ’ঘন্টার কিছু বেশি
হাসপাতালের গেটে দাঁড়িয়ে অপরাধীর স্ত্রী
জনগণের কাছে শান্তি ও সাম্প্রদায়িক ভাইচারা
বজায় রাখার আবেদন করেছেন

২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ভর সন্ধে
ওটি রুমের পেছনের দরজা কখনও খোলা হয় না। বাইরে ঝোপজঙ্গল,
মর্গের সিঁড়ি, আলকাতরার বড় ড্রামগুলো।
একটা ওবি ভ্যান সেখানে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মনে পড়ছে, অপরাধী তার শেষ কবিতায় লিখেছিল
নরকের যে-কোনও ঝুলবারান্দা থেকে কলকাতার ট্রামের শব্দ শোনা যায়…

চাঁদের তৃতীয় পিঠ

চাঁদের তৃতীয় পিঠ

আমি তখন ছিলাম চাঁদের অন্ধকার পিঠে
সামান্য রাগ হলে বাসন ছুঁড়তাম, পা-ই কথা বলত ক্যানিজিয়া।
সবচেয়ে বাড়ির ছোট ভ্রমর, ছোট্ট ডানাদুটো উড়তে উড়তে
মাটিতে ‘ধপাস’ পর্যন্ত হাত মুঠো করে রাখত সবাই

আমি খুব কথা চালাতাম, অসম্ভব কথা
চাঁদও অবাক হতো — কোন নক্ষত্র থেকে এসব পোকা
এসেছে মগজে!
কিন্তু হিংসায় একটা উচিত মোমও জ্বালিয়ে দিত না
তাই যে-সব রাতপাখি পৃথিবী থেকে এ-পর্যন্ত ডেইলি প্যাসেঞ্জার
ওদের ডানায় আন্দাজে আন্দাজে লিখতাম
ওরা সাঁই করে নেমে যেত মাটিতে আর পরের দিন
খবর দিত — বাবু, তোমার তিনটে কবিতার চোখ ফুটেছে
তিনটেই মিষ্টি বেড়ালছানা; বাবু, তোমার একটা লেখা
কাঁঠালগাছ হবে

এই করতে করতে খড়খড় করে চাঁদ ঘুরে বসল একদিন
আমিও এসে গেলাম আলোকধারায় তাই না হারায়
এসে গেলাম লিটল ম্যাগাজিনে আর বইমেলায় দু’তিন দিন
আগে তো ভাবিনি, এখন বলতে ভয় করে
আমার ফুলগুলো সবাই যে ক্ষীণজীবী
আমার এই অর্ধেক-ফকির ফড়িংপ্রজাতি, খরগোশসন্তান
কে এদের বাঁচিয়ে রাখবে আর কে আদর দেবে
আজ যখন চাঁদের তৃতীয় পিঠে রওনা হয়ে যাই

ডায়েরি : চিকিৎসালয়শালা

ডায়েরি
চিকিৎসালয়শালা

এক
নগ্ন হও নগ্ন হও — এই শুধু স্লোগান
যেন পোষাকেই সব অসুখ লেগে আছে
“দেখি দেখি” বলে বারবার দেখার নিচে
চলে যাচ্ছে হাঁস-নার্সেরা
যত বলি, লজ্জাই আমার একমাত্র প্রেমিকা,
“না, ভিজিটিং আওয়ার্স ছাড়া কেউ কাছে থাকতে পারবে না।”

দুই
সিডাকটিভ সাদা জোব্বা-পরা আমি
হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম
তরুণীর পায়ের সিঁড়িতে
বললাম, বহু কষ্টে চেতনা পেয়েছি
মাঝামাঝি স্পিডে এবার চালাতে চাই শান্তিজীবন
আমার কাতরোক্তি গির্জার সমবেত সংগীত ছাড়িয়ে উঠছে দেখে
দরজা ঠেলে যাজক ঢুকলেন, দেখতে খ্রিস্টের অপোজিট…
ভেবেছিলাম প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকে আমার মহৎ সূক্তগুলো
আবৃত্তি করি
বলি যে আর একবার জ্ঞান হারালেই আব্বুলিশ, আবার
অন্ধকার গর্ভ থেকে টর্চ হাতে উঠে আসতে হবে…

আমি যত ভেঙে পড়ি, চোখে চোখে ছুরি-বিনিময় করে তারা
ইউরেনিয়ামের অনুরোধ পাঠায় চতুর্দোলায় উঠে আসতে
জোব্বার ফাঁকে বিষণ্ণ পুরুষাঙ্গ দোল খায়, দেখি
তার দিকে চিকিৎসার দুই বাচ্চা
থমথমে সূর্যাস্ত মুখে তাকিয়ে রয়েছে

তিন
আমি অ্যান্টিবায়োটিকের সন্তান
আর ব্যাধি ব্রহ্মস্বাদময়
নকুলদানার ভেতরে সরষেবিন্দু যেন।
নিজের বিগ্রহশরীর বয়ে এনেছি হড়হড় বমির আদলে
মাথার ওপর পিছলে যাচ্ছে ছাদের উজ্জ্বল চামড়া
আমি কি এই ইস্তিরি করা পিচে
রক্ষণাত্মক ব্যাট তুলবো অ্যান্ড ইট ড্রপড ডেড ইন ফ্রন্ট
অফ হিম?
না না, এ-বাদাম সে-বাদাম নয়

চার
নিজের মৃত্যুকে শ্রদ্ধা করি
তাই তাকে কোনও আলোচনায় আনব না
পিওন মানিঅর্ডার, তাছাড়া অন্য কারও কাছে
নেবো কেন সোয়ামির নাম?
তোমাদেরও মান্য করি — জমদগ্নি ছেলেমেয়ে,
ডাল ঝুঁকিয়ে নিচু করা থেকে
আঁকশিগুলো খুব ধারালো থেকে
রেডি ওয়ান টু থ্রি-র ঝাঁকুনিতে
আমার সমস্ত শিউলি ঝরে পড়ল তোমাদের কাঁটাচামচ উপচে
স্যুপ বোলের ফাঁকায়…

পাঁচ
ছিনিয়ে নিলে, আমার জঠর থেকে আমার দেহকে…

বানানো করুণায় ভেসে যায় সার্জারির নাট্যশালা
শরীরেরও একটা শরীর থাকে যে জেগে উঠেছে দৃষ্টি-অপমানে
আমিও অবাক দেখি, এই দেহ আসলে কোরাল-দ্বীপ!
নীল মাংসস্রোতের নিচে মাথা ঝুঁকিয়ে দেখছে পাঁচ-ছ’জন ট্যুরিস্ট
তারপর নিষেধাজ্ঞার ভেতরে হাত ডুবিয়ে মুচড়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে, আহ্‌,
দেহের মুকুল!

এ-কায়াভাণ্ডার ফতুর করে ভোরের কুয়াশামুখী প্লেনে চেপে
চলে যাচ্ছে ওরা…

ছয়
হলুদ ভিজিটিং কার্ড হাতে গলি ফুরোচ্ছি…কোনায় কোনায় প্রহরী।
শীতলী প্রাণায়ামের ছায়া পড়েছে নার্সের হেঁটে আসায়,
প্রভুর সেগুন কাঠের ঝকাস গ্যালারিতে।
নিজের অসুখ একটা পুঁটলিতে ফুলগিঁট দিয়ে
মুখে লাঠি পরিয়েছি, কাঁধে ফেলে উঠে যাব ওপরতলায়
তার আগে দেয়ালের অনৈতিক দিক থেকে নিরাপত্তা এসে
চিনিয়ে দিল দূরের পুরনো ব্লক,
ভেঙে পড়া কিন্তু নির্মীয়মান

ছাদবিশিষ্ট পরাধীন রাস্তায় লম্বা ইস্পাতের শেকল থেকে ঝুলছে
সোনালি বল আর ছুটে এসে মারল কপালের মাঝমধ্যিখানে
লিফটে শোয়ানো সাদা ট্রলি তার পোঁদ-ওলটানো স্যালাইন জানালো সিঁড়ি দিয়ে ওঠো, অথচ শেষ সিঁড়িটা এখনও তৈরিই হয়নি, দুজন মিস্তিরি
তাড়াহুড়ো করে পাটায় মিক্সচার ঢালতে গিয়ে
নিজেদের গলায় ঢেলে দিচ্ছে আর বলছে দশ মিনিটে হয়ে যাবে

নিজেকে ভিজিট করতে সময়ের দশ মিনিট আগে চলে এসেছি যে…

কী এক পৃথিবী ছিল

কী এক পৃথিবী ছিল

কী এক পৃথিবী ছিল তোমার স্বরের টুকরো বসে থাকতো ছাতিমপাতায়
শ্বাসপথ দিয়ে ফুসফুস পর্যন্ত টানা মোরাম ছিল রোদ্দুরের,
হাঁটা যেত দুইবাহু দোকানে দোকানে
একটা বিমান আবছা আকাশে থেমে থেকে
শুকতারা পালন করতো

কী এক সকাল তার লিপিড প্রোফাইল থেকে
চোখ সরানো যেত না
প্রথম শ্রেণীর লিভারের মতো হিন্দু কলাগাছ
যে-মাটিতে জানলা খোলো — ঝিঙেলতার ওপর পাতা রেললাইন;
মাধবীফুলের বারোতলা ছাদে শিশির নামে একফোঁটা
ছেলেটা ঝুলে আছে, সুইসাইড করবে

মহাজগৎ সেই নিচে-চাকা-লাগানো আইসক্রিম
যাকে তুমি-আমি গলে যেতে দেখেছি কী এক হোটেলে!
অত ভোরে শুধু মাকড়সাশাবকের স্কুল খুলে যায়, আর
অনেক সময় পা অবশ হলেও তো আমরা কোল থেকে বাচ্চা নামাই না
আজ সেই রকম বিবেচনা আশা করছে ভোরে-না-ওঠা চায়ের কাপ
তোমার শাড়ির ফুলদানিতে জল পাঠাতে রাজি পুরসভা
কেহ নাহি জানে কার ইচ্ছেয় হলিডে ইন হয়ে উঠছে পৃথিবী…

প্রেমের পদ্য ৩

প্রেমের পদ্য ৩

“আমি তোমাকে ছোঁব, নভতল”

যদি তুমি ছোঁও আমাকে
বদ্রিলার ভেঙে পড়বে, পেনরোজ ভুল প্রমাণিত
অস্ট্রেলিয়া ভাসতে ভাসতে এসে বলিভিয়ার গায়ে লেগে যাবে
এই প্রথম দ্যাখা যাবে বাতাসদিগকে — হলুদ, বেগুনি, ভাসমান ওড়নার দল
আর, এমন স্পর্শের উপমা কোনও শব্দে নেই বলে কবিতার বই স্তূপ করে জ্বালিয়ে দেবে কাশ্মীরের লোক

তুমি আমাকে ছুঁলে রিজওয়ান, রাখালছেলে, খুব খুশি হবে
আমি কবিতায় সবক’টা কারেকশান মেনে নেব গোস্বামীজির
এই যে বহুতল খুলে গিয়ে মাছরাঙা-গন্ধের মাঠ, তোমার চুলের থমথমে
ধানগুছির কাছে এসে সেধে বলছি: একবার ছুঁয়েই দ্যাখো না —
সমুদ্রের সব মাছ উঠে এসে এ-চোখের ভিজে মুছিয়ে দেবে
সোনার গৌরাঙ্গ আমি ষোলো আনা প্রণামীতে ভক্তের মাথায় ঘুরব বাকিটা জীবন…

প্রেমের পদ্য ২

প্রেমের পদ্য ২

প্রেম এক অসমাপ্ত ব্রেন সার্জারি।
সমস্ত পরীক্ষা শেষে যেদিন একশো চুয়াল্লিশটা কার্ফু জারি
তুমি ভোরে স্নান-সারা, মাথা মসৃণ, উপোষি পেট
টাল খাচ্ছে,
তবু বমি করবে না
উন্মাদ চেতনা —
বুঝে রূপসী প্রফেট
অভিলাষ-হেতু তোমার মস্তিষ্কফুল ও টি রুমে খুলে রেখে
আরও উপুড়, নিঃস্ব কোনও খুলি থেকে
এক কাপ চা খেতে চলে গেছে…

আনন্দনির্ভর

আনন্দনির্ভর

ভূমিতে পা রাখা আলতো সেবা হয়ে ওঠে
স্মিত ও টাটকা চপ্পল
জমির প্রতিটা তন্বী অণুর ওপরে
সুষমা উন্মুক্ত হয়ে যায়

দেখি বাতাসের রোমকুয়োয় ধূপকাঠি গোঁজা
আর শুকনো পাতার নিচে ব্যবহার না হওয়া নিঃশ্বাস
জ’মে থেকে মরে গেছে
মুছে যাওয়া আনন্দনির্ভর…
রাস্তার পাশের বাড়ি কড়াই-ছাত্র আর উনুন-মাস্টার মিলে
পড়াশোনাগন্ধের “সিরাজ”
চলৎশক্তি হেঁটে গেল, গতিশক্তি সাইকেলে, সুভাষিত বলো
নুড়িপাথরেরা

উঠি ইচ্ছে আমারও যে! গানের মাঝখান থেকে
গল্পের উপকারিতা থেকে, এমনকি পায়েসের কিশমিশ থেকেও
লাফ দিয়ে উঠে সবাইকে গোটো করে তুলতে চাইছি
হকারের জামায় স্টেশনারি দোকান যেমন
কবে থেকে গুটিয়ে শিরোধার্য করে রাখা মন আমাদের
বিছিয়ে দিলে সেগুন কলোনির ভেতর এই
অনন্ত ঘুরকাটা লাল সুরকির পথ হতো…

হরিণ … মৃত্যুর পর

হরিণ — মৃত্যুর পর

বসুন্ধরায় দুধ পাতা আছে লিচুর শাঁসের মতো
তাতে হাত কোশ ক’রে যে যার নিজের শৈলী তুলে নেয়
গাছ তোলা আছে — পৃথিবীর সলতে-প্রমাণ,
সবুজেরা পাতার অক্ষর হলে ডালপালা আলদা আলাদা বাঁক
দামিনী-ঘরানা

হাঁসের নৌকো চিনি — শুধু পারিজাত হাঁসদের,
পুকুরের স্তন অবধি জল
প্রত্যেকে নিজের তোতা হাতের বাজুতে রেখে বাতাসে ওড়ায়
এক দিব্য ঝুঁটিতে কেউ চুল সমস্তটা বাঁধতে পারেনি
ঝুরো খসে, রাত্রি তাকে তুলে
ঠোঁটের ছাইরক্তে মেখে নেবে

কাজ তবে দৌড়ের শুরুরেখায় দাঁড়ানো
হরিণ — মৃত্যুর পর। ভাসন্ত ছুট যে পর্যটন
তা নগ্ন, অতিসরল বুঝে

শুধু শৈলী ফেলে যাচ্ছেন লেখক,
সমস্ত কলম থেকে সুরের জড়োয়া…

আমি উন্মাদ আত্মজীবনীতে

আমি উন্মাদ আত্মজীবনীতে

কাল বিকেলবেলা পাড়ার গলিতে পৌঁছে তোকে
ছুঁড়ে ফেলেছি রাস্তায়, কনুইভাঙা বডি আস্তে সোজা
হচ্ছে — একটা পিঁপড়ে ভয় পেল। আমি হাঁটলাম বাড়ির দিকে,
তোকে চাপা দিচ্ছে খড়ম জুতো শ্রীখাদিম। পাড়ার দোকান থেকে
টুথব্রাশ কিনছি, বোতলের বাঁচা জল আহ তোর গায়ে উপুড়
করল টিউশানি-ফেরত ছাত্র। আমি স্নানগেঞ্জিপাজামা —
টিভি নিয়ে বসলেই তোর পেটের ওপর উঠে দাঁড়াবে শেয়ার ট্যাক্সি
হরিদেবপুর একজন হরিদেবপুর; একজন যে আপনার চাকার নিচে
আলুপোস্ত তা তো দেখছো না! দেখছিলাম ডিসকাভারিতে আটলান্টিকের
ভেতরে সমুদ্রমাছ আমি ডাইনিং টেবিলে বসে, এক মাতাল খক করে কফ
ফেলছে, একটুর জন্যে তোর গায়ে লাগল; হাওয়া দিল এখানে,
ওখানেও, দেশি মুরগির বাচ্চা হয়ে উড়লি নর্দমার কোলে কোলে।
তারপর আমিও আলো নিভিয়ে বিছানায় বসেছি, চোখ বন্ধ,
ওমনি শিরদাঁড়ার ওপর-পিঠে ফটাশ করে খুলছে সবুজাক্ষি,
সবুজ জ্যোতিষ্ক-আলো ঘরদরজা, শিউলিগাছ পার হয়ে টেলিফোনবুথ
রিকশামোড় স্ট্যাচু করে এক দৌড়ে গিয়ে পেছন থেকে জাপটে
ধরেছে তোকে…… আস্তে করে ধুলোমাখা মুখ ভেসে উঠল
সোনি-র পর্দায়, কাগজের খসখসে গলায় বলছিস রক্তাক্ত
সন্ধেবেলাটার অপমান, আগামিকাল তোর কপালে কী আছে
আগামি পরশু মরে আবার কাঠ হয়ে যাওয়ার আগে —
বলতে বলতে হা হা করে কেঁদে উঠছিস রে সোনা, আমার
বারোর সি বাই দুই বাসের টিকিট