চন্দন ভট্টাচার্য এর সকল পোস্ট

বাগীশ্বরী

এক

শিল্পপ্রবন্ধাবলী সবাই পড়েছে, কে পেয়েছে বাগীশ্বরী?

বাঁধের সুধন্য জল, ডিপ লাল বিকেলবেলার সিঁড়ি, ঘটের স্বস্তি থেকে চোঁয়ানো সিঁদূর — এইসব বাধাসম্পদ ছুঁয়ে ছুঁয়ে সে আসে, মিষ্টি কোলকুঁজো।
সোনার দোকানের আলো ফুটপাথে, পা পড়ছে তার ওপর;
একমাত্র তুমি পায়ে আলো চেপে রাখতে পারো।

দূরে মাঠে উঁচু আবছা মহাগ্রন্থ খোলা পড়ে আছে
তার সব পাতা ফাঁকা ব’লে আমার ডানহাত চিরে সেতার
উঠেছে। সেও, গলায় রুদ্রাক্ষ আর স্তনের বিস্মিত ছাঁচে চিরকাল যেমন গৌতমী — হেঁটে এল ঘরের নানা অজস্রের দিকে।
শিউলিগাছ পথ হাঁটলে শিউলি ছড়াবেই…

আড়চোখে তাকিয়ে দেখছি, মহাগ্রন্থের সিঁথি ওল্টাচ্ছে বাতাস, শেষ পাতায় পৌঁছোতে এখনও হাজার পৃষ্ঠা মানে
এক হাজার বছর বাকি মানে একশো মুহূর্ত শূন্যের মাথায় ডোরা টেনে রেখার ওপর চৈতন্যের জন্ম হল, ঝরে যাচ্ছেন বিপ্রদাস পিপিলাই।

আর বাগীশ্বরী উচ্চারণ করছে একবাক্যে সংলাপখাতা:
দ্যাখো, তোমার বুকের মধ্যে কেমন পুরোটা ধরে যাই!

(১৯৮০ সালে লেখা) অ্যাসাইলাম সিরিজের কবিতা

কনস্টানটিনোপল বহুদিন চুপ করে আছে
ভরাট টিনের মতো নাম কনস্টানটি…
কবে মুখফোঁড় ননদ ছিলেন

কবে ক্ষার ঋতুগন্ধা। দুই বিনুনি
পাক দিয়ে মেঝেয় নেমেছে
জোড়া বুক স্ফীত, মোটা, আলো লেগে বরফসৌধ
মূর্তি নিচু করলেও প্রচ্ছায়ার ভূমিকা হয় না
ওর হাতে একটা কমলালেবু দাও
নব ঘুরিয়ে সূর্যাস্ত উপশম করো

বদ্ধতার পুরনো অমৃত ছিল
গলে গলে বিষ, ক্ষয় হয়নি
বদ্ধতার পুরনো গরল
সেও অনুদান পাবে না

এই রাজধানী
তেতলার একমাত্র মনে হয়।
শেতলপাটির মতো গোটানো কার্নিশ
ভগ্নাংশ হারেম, খোজা প্রহরীকে আঘাত করার সামান্য ক্ষমতা
পাওয়া ফিরে পাওয়া যাক…
কনস্টানটিনো শহর কোনওদিনও কথা বলবে না

ধরিত্রীফুলগাছ

সৌন্দর্য, আমাকে স্নিগ্ধ চোখে চোখে রাখো

বাতাস শান্তিপীড়িত, বাতাস কীটবাসস্থান
আর প্রেমিক-প্রেমিকা ফোঁড় আছে অন্ধকারে
সিক্ত-অভিসিক্ত দুই পাখি
গালে ছোট ছোট সুশ্রী চাঁদের কারখানা

ওই যে ষোল শাখার ধরিত্রীফুলগাছ
কিছু না কিছু পাপড়ি সবার মাথায় —
আমি সেখানে লেখা কুড়োতে যাই
দেখি রোগা একটা আহারে ইঁদুর, তার দিন শুরু হল
আলো এসে বসেছেন ঝিঙেক্ষেতে স্বয়মাগতা
তারপর আজ রাতে যতবার শরীরে গিয়েছি
ছোট্ট সোঁতায় শুধু মাছ চমকে ওঠার শব্দ

তুমি আর বিবাহ করো না
আমার শান্ত পোতাশ্রয় হয়ে যাও!

ভালোবাসার জলকামান দুজনে ঘুরিয়ে দেব পৃথিবীর দিকে…

কম্বাইন অ্যান্ড নো রুল?

এক পেটুক সহকর্মী ছিলেন আমার, কোথাও নেমন্তন্ন পেলেই তাকে ছুটতে হবে, আবার সফরের একাকিত্ব কাটাতে সঙ্গে একে-তাকে ধরে নিয়ে যাওয়াও চাই। আমাকে পাকড়াও করার চেষ্টা করলে বলতাম, সুস্থ শরীরের বারোটা বাজাব কেন মিছিমিছি? তিনি যে সমাধান দিতেন তা ঐতিহাসিক! “আরে, শরীর-টরীর কিচ্ছু খারাপ হবে না। প্রাণ ভরে খেয়ে দুটো হজমের ট্যাবলেট গিলে শুয়ে পড়ুন। পেটের মধ্যে ওরা-ওরা মারামারি করবে, আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমোবেন”।

ব্রিটিশ শাসকদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি আর কি। হিন্দুু-মুসলিমে ধুন্ধুমার বাধিয়ে দিতে পারলে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ ওদের স্থায়িত্বের আনন্দে বদলে যাবে।

সাধারণভাবে ভারতে সেই “বিভাজন-প্রশাসন” নীতিই শাসকেরা মেনে চলে। শুধু ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার “ওরা-ওরা” স্বাধীন ভারতে এসে “আমরা-ওরা” হল। ইংরেজ আমলে রাষ্ট্র ছিল থার্ড পার্টি, বাইনারির বাইরের লোক, আর স্বাধীন ভারতে শাসকই “আমরা”, স্বয়ং সুবিধেভোগী।

কাজেই প্রশাসনের একটা চলন তৈরি হয়ে গেল, নির্দিষ্ট রাগের যেমন থাকে। ঘটনা যাই হোক, বাদী আর বিবাদী স্বর পাল্টাবে না। একটা অপরাধের স্থানাংক আর মূল্যবিচার, তার বিরুদ্ধে কী পদ্ধতিগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সব এই বিভাজন-প্রশাসন তত্বের ওপর দাঁড়িয়ে।

যা বলেছি এতক্ষণ, নতুন কিচ্ছু নয়। এও সবার জানা যে, গণতন্ত্রে রাষ্ট্র জনতাকে একবারই সক্রিয় করে তোলে যখন তাকে লাইন ক’রে ইলেকশান বুথের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হবে। কর্তৃত্বের যে শাসনের অধিকার, তাতে তখন আইনি শিলমোহর লাগানো দরকার। পরের পাঁচ বছর জনগণ নয় ঘুমিয়ে পড়ুক।

এই ঘুম নিশ্চিত করার জন্যেই আইন শৃঙ্খলা। পার্টির নজরদারিও। ক্ষমতায় থাকা দল আর বিরোধীর গুন্ডা/অ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যে লড়াই চলতে থাকে, কিন্তু সেখানে লেজটি পেতে না দিলে সাধারণ মানুষ অস্পৃষ্ট থেকে যায়। লেজ না বাড়ানো মানে মাথা নিচু করে ক্ষেতে, অফিসে, দোকানে যাওয়া, দিনশেষে বাড়ি ফিরে আসা মাথা নিচু করে। উল্টো দিকে, কালো টাকার সমান্তরাল অর্থনীতির মতো ক্ষমতার লড়াইয়ের আদত চেহারাটা আন্ডারগ্রাউন্ড গোষ্ঠীজীবনের আদলে গড়িয়ে যেতে থাকে, কখনও সেটা পৃথিবীর ভূত্বকের ওপরে উঠে এলে সাধারণ নাগরিক ভয়ে সিঁটিয়ে যায় (ওয়েলসের “টাইম মেশিন” মনে করুন)।

কিন্তু এখনকার পশ্চিমবঙ্গে একটা নতুন প্রতিবেশ তৈরি হয়েছে যে বিরোধীরা, ভয়ে-ভক্তিতে সরকারি রাজনৈতিক দলের দিকে পা বাড়াচ্ছে আর গৃহীত হয়ে যাচ্ছে। মানে, ডিভাইডের জায়গায় কম্বাইন শব্দটা এসে বসল। এমন চলতে থাকলে “দুইখান কথা” জন্ম নেয়।

ধরুন, ক্ষমতায় যেতে চাওয়া দলগুলোর লড়াই ওজোনস্তর নির্মাণ করে রেখেছিল আর প্রাথমিক শোষণ হল আল্ট্রা-ভায়োলেট রশ্মি। “প্রাথমিক বা প্রত্যক্ষ শোষণ” কী? খুন, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, আগুন লাগানো এইসব — আইন-শৃঙ্খলার জাগ্রত অবস্থা যাকে সফল ভাবে প্রতিহত করতে পারে। কিন্তু “কম্বাইন” করার নতুন পরিস্থিতিতে ওই ওজোনমণ্ডলের অস্তিত্ব আর নেই। এবং যেহেতু আমাদের রাজ্যে উৎপাদনের অবস্থা খুব রমরম করছে এমন নয়, রোজগারের সুযোগ সীমিত, সেক্ষেত্রে স্লোগানটা এখানে এসে দাঁড়ায় যে ‘জনগণই অর্থনীতির উৎস’। খুব বিচ্ছিরি অর্থে এও মানব সম্পদের ব্যবহার। তাহলে চ্যাপলিনের ফিলমের দৃশ্যের মতো কামানের নল কি নিজের পাবলিকের দিকেই ঘুরে গেল! ‘আমরা’ হলাম গোটা রাজনৈতিক শক্তিবর্গ আর ‘ওরা’ ঠাওরালাম সাধারণ নাগরিককে?

দ্বিতীয় কথাটা প্রশাসন নিয়ে। তার রাগের চলন এখন স্তিমিত, যেহেতু সবই বাদী স্বর এবং বারোটা স্বর নিয়েই (সবক’টা শুদ্ধ!) গান গাওয়ার চ্যালেঞ্জ। প্রশাসন তবে কার পক্ষ নেয় আর কাকে বঞ্চিত করে? যদি সে মিলিত রাজনৈতিক শক্তির দিকে থাকে তবে তার এতদিনের “ডিভাইড অ্যান্ড রুল” নীতিতে চলার অভ্যেসে একটা বড় বদল আসবে। কেননা সে রঙ দেখে অ্যাকশান নিতে পারছে না, প্রত্যেক অপরাধের ঘটনায় অপেক্ষা করে থাকবে শেষ পর্যন্ত, রাজনীতির কী নির্দেশ? কাজেই নতুন যে পরিস্থিতির উদ্ভব হল তাতে প্রশাসনের এফিকেসি আরও অনেক মার খেতে পারে, সে ভীষণ শ্লথ হয়ে যেতে পারে এবং সাধারণ নাগরিক, যারা প্রত্যক্ষ/প্রাথমিক শোষণের শিকার বা শ্রোতা-দর্শক, তাদের মনে হবে একটা এমন একটা রাজ্যশাসনে এসে পড়লাম যার মূলনীতি “কম্বাইন অ্যান্ড নো রুল”।

তবে যেভাবে অসুখের সংজ্ঞা আর তার চিকিৎসা একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল, যেভাবে কোনও সিনেমাতেই কাঁচি না চললে সেন্সর বোর্ড মুমূর্ষু হয়ে পড়বে, ঠিক তেমনি আইন সব সময় চায় একটা ‘অস্থিতিশীল ভারসাম্য’ (পরিভাষা ইটালো ক্যালভিনো-র, “ইফ অন এ উইন্টার’স নাইট এ ট্র‍্যাভলার”) যেখানে সে শাসনের কারণ তৈরি করতে পারে, যেহেতু ল’ একমাত্র টিঁকে থাকে নিজেকে প্রয়োগ করার ভেতর দিয়েই। সুতরাং আমার আশা যে নতুন সাফলিং হবে, কোনও নতুন বিভাজন বা চিড়-সূত্র — যাতে প্রাথমিক বা প্রত্যক্ষ শোষণ-বিরোধী কামানের নল জনতার উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়।

একজন দার্শনিক হিসেবে বলছিঃ ৬

যে-সাবেক সমকালের গা ছুঁয়ে আছে সে-ই ভালোবাসা। অথচ আজ আর গতআজ পরস্পরকে ধ্বংস করে বলেই আমরা জানি। প্রেম থেকে প্রেমে সবকিছু বদলে যায়, এমন ঘোষণাও রয়েছে। যেভাবে মঞ্চ এক রেখে আলোর গরিমা দর্শককে আলাদা দেশলোকে নিয়ে যেতে পারে।

নতুন প্রেম রেনেসাঁসের মতো।

আসলে ভালোবাসার ইতিহাসকে সেই সব জাহাজই পরিচালনা করে যারা অনেকগুলো এপিসোড বেঁচে গেছে, প্রচুর ঝড় নিতে পেরেছে বুকে। মহৎ প্রেমিকেরা এক হিসেবে প্রেম নয়, সভ্যতা সৃষ্টি করছে যা পৃথিবীর মান্য ধর্মগুলো তৈরির চেয়ে কিছু কম কঠিন বলা যাবে না।

আবার, প্রতিটা বিচ্ছেদকে তুমি বলতে পারো ১৮১৭ থেকে ১৮৫২ সাল, যখন ফরাসি বিপ্লবের পর মন্দা চলছিল ইউরোপ জুড়ে। অর্থনীতির মতো প্রেমেরও একটা নিজস্ব স্পন্দন আছে। তাকে ‘চন্দনের শতাব্দী’ বা ‘সুদীপ্তার এরা’ বলতে অনায়াসে চিহ্নিত করা যায়।

বিচ্ছেদ আসলে সম্পর্কের যোগ্যতাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, যেমন জীবনের পরিণত হয়ে ওঠার প্রমাণ থাকে মৃত্যুতে। যেভাবে কখনও মরে-যেতে-না-পারা মৃত্যুর সমান হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি চলে যাওয়ার ব্যর্থতাই বিচ্ছিন্নতা নিয়ে আসবে। বিচ্ছেদ একটা গুণগত মান যার মধ্যে মার্কশীটে খুব উঁচু নম্বর পাওয়া সম্পর্ককে বোঝার চেষ্টা ধরা পড়ছে।

সবচেয়ে বড় প্রেমের নামই তো বিচ্ছেদ।

আমি দেখেছি, কী যত্নে তুমি আমার বিপরীতকে ধারণ করে আছ। একা হ’লে তার ভেতরে কোনও ছিদ্র নেই সুতো পরানোর। তুমি ঠিক উলটো রকম ছিলে বলেই আমার পরিচয় এত নিখুঁতভাবে তৈরি হল। তোমার সামনে থাকা মানে লজ্জিত মুদ্রিত ভালো থাকা। ক্রমাগত নিজেকে হারাতে হারাতে দূরে যাওয়ার সুযোগে অসীম পর্যন্ত বড় হলাম। আজ ধর্মনিরপেক্ষভাবে দেখি, মানুষও যা হতে চায় তাই হয়েছে — রক্তমাখা, বিচ্ছিন্ন।

যদি বিচ্ছিন্নতা তোমার লোহিতকণা ধ্বংস না করে, তাকে বিশ্বাস ক’রো না।

শরতের তালা

এই শরতের প্রথম কথা সবাই জানে হলুদ বেড়ে ওঠো
আলোর ছোট ছোট স্তনের ওপর চায়ের গরম ফোঁটা,
আঙুলের ডগায় রক্ত তুলে নারকোলপাতার শীর্ষাসন।
সময় আসার আগে বুঝতে পারছি সময় আসবে
মাইক থেমে গিয়ে গান হচ্ছে কলতলাতে, রেললাইনে, পাখির মাথায়
সকালে উঠিয়া আমি শার্ট পরে তার ওপর গরম লাগছে
শ্বেতপাথরের মন্দির, অষ্টভোগ শ্বেতপাথরের
সময় চলে যাওয়ার পর বুঝতে পারছি সময় চলে গেল
কতদিন পর চিলেকোঠায় উঠলাম শরতের তালা খুলবো বলে
নিচে কথা নিজেকে বলতে বলতে যাচ্ছে
যেমন পুজোর সতরঞ্চি এসে পড়ে দিনের মধ্যিখানে;
ভাঙা থাকতেও জোড় খেয়ে যাচ্ছে নতুন ঘোমটা, অর্থাৎ চিল কখনও
শকুন হবে না
যদিও সময়ে বুঝতে পারিনি সময় চলছে
বারুদকে খুশি করতে ফেটে পড়েছে শব্দ
শরতের শেষ-কথা তাহলে ফিরে আসবে কিন্তু রিস্কি হয়ে যায়
জানি, এ-ক’টা লাইনে জীবন খুশি হয় না

দুজন ধার্মিক

প্রজাপতির পেছনে ঠিক একটা বাচ্চা থেকে যায়

অনেক শৈশব ভেঙে পায়ে জল, কাদা;
অনেক তারা-দূরত্ব থেকে পেটে কিছু পড়েনি বাচ্চার।
এদিকে প্রজাপতি ছুটতে ছুটতে বোনের বাড়ি কিছুটা বসে গেল
দুটো প্রজাপতির গলাও শোনা যাচ্ছে — বাচ্চা এত চুপ!

একবার এমনও হয়েছে, বিছানায় অসুস্থ প্রজাপতি
আর বাচ্চাটা উড়ছে, উড়ে উড়ে দরকারি কাজ
সেরে দিচ্ছে তার
নিজেকে কী ভাবছে সে? সেই হাসি চেপে রাখা কিন্নর?
তার শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে হালকা উদাস রামধনু-রেখা চলে গেছে

এখন ঘুরে ঘুরে বাতাসে পাহাড় আঁকে আর্টিস্ট প্রজাপতি, বাচ্চা-পা
পা টিপে উঠতে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে
সত্যি দুটো সেলাই পড়েছে মাথায়, এত জ্বালাস তুই — ব’লে
একটা ঠাস পড়েছে গালে
তারপর তো তুমি খুঁজেই পাবে না সামনের ছুট আর পেছনের
মিসিং ডায়েরি নম্বর বাইশ
হয়তো লম্বা পৃথিবী থেকে পা পিছলে গেছে
মুছে গেছে দুজন ধার্মিক
তবু প্রজাপতির পেছনে শেষ পর্যন্ত আর তার পরেও
ঠিক সেই সেই বাচ্চা থেকে গেছে…

(পুরনো লেখা) অগ্নিরথ

ভালোবাসা আছে কিনা এটা কোনো প্রশ্নই নয়
জিজ্ঞাসা হল, হৃদয় রয়েছে তো? না হলে তাকে
আবিষ্কার করো। টেবিলফ্যানের হালকা হাওয়ার
মধ্যে, পাগলা হাতির পুরো গ্রাম দুরমুশ করে
একটা শিশুকে অক্ষত রাখার মধ্যে তাকে চিহ্নিত
করো আর এই লব্ধপ্রতিষ্ঠ মন নিয়ে বেরিয়ে পড়ো পথে
কিন্তু যদি আমার সঙ্গে দেখা হয়, ভেবো না
কখনই নিষ্কণ্টক পথ চেয়ে বসবো, বরং
দাবী করবো একজোড়া চোখ; যেভাবে আমি
কোনওদিন মাথা ঘামাইনি আগুন নিয়ে
কিন্তু প্রার্থনা করেছি শীতকাল, কেন না
সনির্বন্ধ শীতই বয়ে আনতে পারে অগ্নিরথ…

পুরনো কবিতা : তরুজা

প্রত্যেক মেয়ের মুণ্ড মাটিতে সমাধি
প্রতিটা মেয়েলি ধড় মাটির ওপরে বিকশিত
কিছুদূর উঠে দু’পা চরম বিভক্ত হয়ে
ভেতরে আকাশ ডেকে আনে
আকাশের তারাকণা, শস্যদানা, মেঘগয়না মিলে
যে জন্মায় তাকে তোমরা পাখি বলে ডাকো
সে ওই শূন্যতা-সন্ধিতে বসে ঠোঁট মারে
ঘন ঘন মাংসের চোকলা উঠে ফাটল তৈরি হলে
সেখানেই ভিতু নাড়ি জড়িয়ে রাখে ডিম,
পৃথিবী-রঙের…

পাখির নীড়ের মতো যোনি জন্ম নেয়।

হে আমার সন্ন্যাসীরা…

তুমি পাত্রে জল ঢালো
আর পাত্রে জল জমা হয়
আর আধার পূর্ণ হয়ে ওঠে
থাকা আর পূর্ণ হয়ে থাকা সম্পূর্ণ আলাদা
তাহলে কে ভ’রে দেয় — হে আমার সাধকেরা
এই প্রশ্ন রাখি

তুমি পদক্ষেপ করো
ও তোমার অগ্রগতি হয়
এ-পর্যন্ত বুঝতে পারি বেশ
তাছাড়াও গন্তব্য নিকটে চলে আসে
তাকে কে এনেছে সামনে
সে কোন তৃতীয়পক্ষ, বলো!

পোকা পোকা

এক

আলো তোমার মুখের পর্ব ও পর্বমধ্যে পড়ে ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছিল, না মুখটাকে শুধরে দিচ্ছিল আলো — আমি বুঝতে পারিনি। যেভাবে মূর্তিকার প্রতিমার কানের লতির বাড়তি মাটিটুকু ঝরিয়ে দেয়, হাতের নরুন আধাবৃত্ত ঘুরিয়ে ফুটিয়ে তোলে নাকের পাটা, আলো কি এভাবে সংরক্ষণ করতে চাইছিল তোমাকে!

তোমার ভঙ্গি বিন্যস্ত, যেমন প’রে থাকা ফিরোজা-রঙ তসরের ভাঁজের পর ভাঁজ কোমরে, থাকের পর থাক বুকের কাছটায়।

তার আগে তুমি ব্যস্তসমস্ত ছিলে — যখন আবির্ভাব। ব্যাঁকাচোরা ভিড়ের গলি ঠেলে এগিয়ে আসছ, কানে মোবাইল এবং লরজদার তানের মতো জমজমাট দুলও, যা শুধু ফোন সরে যাবার পরে দৃশ্যমান হবে। আর যে দাঁড়িয়ে আছে থতমত, লন টেনিসের দর্শক — ডানদিক-বাঁদিক ঘাড় ঘোরাচ্ছে কখন সেই ম্যাচ পয়েন্টের দেখা; কখন নায়িকার মঞ্চে প্রবেশ, উইংসের এদিক না ওদিক দিয়ে; কেননা মঞ্চ হল নাগের বাজারে বাটার দোকানের ফুটপাথ, প্রচুর ধাক্কা ও সরি-বিশিষ্ট।

[ঠিক আছে, এতগুলো সরি যখন হজম করেছে, আরেকটাও পারবে। আমি তো আধঘন্টা আগেই এসে পড়েছিলাম। তারপর দুএকটা কাজ সেরে ফিরে খেয়াল হল, সে-ও পূর্বাহ্নে পৌঁছে দাঁড়িয়ে। তো, দেখলাম। ফেসবুকে, হোয়াটস্যাপে ছবি রাখেনি, এমন তো নয়। তবু এক পলকের একটু কিশোরকুমারের কী দরকার ছিল! আসলে সে চেয়েছে, আমিও ভাবলাম, আজ সময় বের করা যেতে পারে। আচ্ছা, চাওয়া মানে আকাঙ্খা করা, আবার তাকানোও। কথাটা আগে মনে হয়নি!]

তুমি অপাঙ্গে দেখলে বাঁচোখের কোন দিয়ে। কটাক্ষ নয়, হুড়মুড় করে দেখা। যেন এভাবে কত-কত দিন মিট করে আমরা পত্রিকার বিজ্ঞাপনের জন্যে দিকবিদিক দৌড়ে গেছি, অথবা আমাদের গীতিনাট্যের ফাইনাল রিহার্সালে আজ অলরেডি দশ মিনিট লেট!

আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নকল অন্যমনস্কতা মিশিয়ে তার আড়ালে বুকের ধুকপুকুনি চাপা দিয়ে রেখেছ? হয়তো সব পুরুষই এভাবে ভাবতে ভালোবাসে। তুমি উঠে গেছ পরিচিত দোকানের কাউন্টারে দুটো কফি ব’লে আসতে। তার আগে উলটো দিকের চেয়ার থেকে আমার খুব সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলে। শরীরে বৃষ্টি ভ’রে নেওয়া মাটি, বা এক-ফুট দেওয়া ভাতের পাত্র থেকে যেমন একটা ভাপ বেরোয়, তোমার দাঁড়ানো থেকে বিকিরণ উৎপন্ন হয়ে আমার ভেতরে যাচ্ছিল। কিছু জিগেস করছিলে আর প্রত্যেকটা প্রশ্নের সঙ্গে তোমার মাথা ঝুঁকে আসছিল আমার দিকে — সবুজ ডাঁটির মাথায় চন্দ্রমল্লিকা! খয়েরি চশমার পেছনে তোমার চোখ, কপালে দোলনা-চাপা চুলের পেছনে তোমার চোখ, টানটান গালের ছোট লাল বিজকুড়ির পেছনে তোমার চোখ — এত পুঞ্জাক্ষি সবাই গণসঙ্গীতের মতো একযোগে কিন্তু হারমনির মতো নানারকম স্বরে কথা বলছিল কেন! একজন: এ-মা, তুমি এই শ্যামলা মেয়েকে শুকতারা বলে ডাকো!
আর একজন: এই বৃষ্টিতে বোলপুরে যাবে? বাঁদরলাঠি ফুলে ছাওয়া মাঠের পাশে রাস্তায় দুজনে হাত ধরে হাঁটব…।

আমার বুকের মধ্যে অগাধ পায়রা উড়ছিল…।

[যত জিগেস করি, চা না কফি কোনটা পছন্দ, ততবার — আপনি যা নেবেন তাই। এত বাধ্য ছেলে যে হাসি পেয়ে যাচ্ছে! মুখ তুলে রেখেছে এমন, যেন স্বাতী তারা খুঁজবে রেস্তোরাঁর ছাদে। ইচ্ছে করে, থুতনি ধরে নাড়িয়ে দিই; না, নাকটা বেশ ক’রে; নাকি…!]

দুই
আবার আলো ফুঁ দিচ্ছে তোমার চোখের তারায়, নাকের বাঁশিতে, কানের লতির সারিন্দায়, আর সুর বেজে উঠতে দেখছি। তুমি পাহাড়-চোঁয়ানো জলঝারির শব্দে কথা বলে যাচ্ছো … যে, কোন গান কোন স্টুডিওতে রেকর্ড করলে এই বছর; যে, তোমার ছেলে কত ভালো স্প্যানিশ গিটার শিখছে, তার সঙ্গে স্প্যানিশ ভাষাও; তোমার বরেতে তুমিতে মিলে কতখানি বিপদসংকুল বোলেরো চালিয়ে পাহাড়ের মাথায় উঠে যেতে পার। শোনো, এখানে আমি একটু গলা খাঁখারি দিয়ে বললাম: আমিও কিন্তু খুব ভালো হিন্দি শিখেছি। উদাহরণ হিসেবে, লতা মঙ্গেশকারের যে গানটা বাজছে রেস্তোরাঁয়, দো নয়নোঁ মেঁ আসুঁ ভরে, এর বাংলা হল, তোমাতে আমাতে দেখা হয়েছিল। বা, উলটো দিকে ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’-র হিন্দি অনুবাদ কী যদি আমাকে প্রশ্ন করো, দেখবে তৎক্ষণাত উত্তর দিচ্ছি, কঁহী দূর যব দিন ঢল যায়েঁ। শুনে তুমি কফির কাপ টেবিলে নামিয়ে চেয়ারে পিঠ, হাসতে লাগলে। দুহাত উঠে এল মাথার পেছনে খোঁপা ঠিক করার মুদ্রায়, যা আসলে একটা বে-দম ‘আর পারছি না গো’ ভঙ্গি, আর আমি দেখলাম বাঁ দিকের শাড়ি সরে গিয়ে মুখ বাড়িয়েছে খাঁচার পাখি — তোমার বুক। ঠোঁটটেপা হাসি তার মুখেও।

[তারপর জোর করতে লাগল, যেন স্যান্ডউইচ থেকে একটুখানি খাই। এড়িয়ে যাচ্ছিলাম, আয়্যাম ফুল টু দ্য ব্রিম ব’লে। বলে কি, হুঁ হুঁ বাবু, আমি ইংরাজিও জানি। স্যান্ডউইচের বাংলা কী শুনবে? বালির ডাইনি!
তারপর আর কিচ্ছু বুঝতে না দিয়ে ওই একই নিঃশ্বাসে, আমাকে ভালোবাসো, শুকতারা?
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, পোকা পোকা।
ঠিক এইভাবে মহম্মদ রফি ফাঁসিয়েছিলেন লতা মঙ্গেসকারকে। বাগোঁ মেঁ বহার হ্যায় গানটাতে নানা আগডুম বাগডুম প্রশ্ন করতে করতে হঠাৎ তুমকো মুঝসে প্যার হ্যায়?

দেবত্র, আমার ছেলে বলে, স্প্যানিশে পোকা মানে — একটু। আমি কি একটু বড়ই ভুল করে ফেললাম? কিন্তু এখন শোধরাতে যাওয়াটা বোকা-বোকা হয়ে যাবে। অসুবিধে নেই, সন্ধেবেলা মেসেজে জানিয়ে দেব, ওটা জাস্ট ইয়ারকি ছিল। আমি যদি এ-জীবনে কাউকে ভালোবেসে থাকি, সে ধৃতিমান, আমার হাবি।]

আর হয়তো দশ মিনিট বসব আমরা, তোমার ডান হাতের কব্জি বলছে। কিন্তু তোমার করতল কী ভাবছে মনে মনে, এখনও জানা হয়নি! ওহ, এ আর এমন কি ব্যাপার — ব’লে তুমি দুহাত কোরকের মতো ছড়িয়ে দিলে টেবিলের ওপর, যেভাবে হাঁটু মুড়ে বসে মুখ দেখে নামাজি। আমিও ঝুঁকে পড়ে দেখতে পেলাম প্রচুর ইতিহাস, নানা সৌধ ও তার ভাঙন, উটের পিঠে মসলিন চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ার বাণিজ্যপথ, বল্লম-ত্রিশূলে ঘেরা যুদ্ধশিবির…অথচ তার পরেও বেঁচে থাকা অনামিকার নিচে মসৃন টিলা, বুড়ো আঙুলের পাশে আর্ত ঘাসজমি।

এদিকে তাকাও, ডান হাত পাতো — হালকা ধমক কানে এল। আমিও মন্ত্রপিপাসিত, হাত চিৎ করেছি টেবিলে, আর ওমনি, যা অবিস্মরণীয় তাই ঘটল; অথবা, যা ঘটল, তাকে আমরা অনপেক্ষিত শিরোপা দিই। তোমার বাঁহাত উপুড় করে রাখলে আমার ডানহাতে। সেই স্পর্শে এসে স্পর্শ শব্দ থেমে গেল। পাঁচটা ইন্দ্রিয় থেকে কানের সোনার মতো অন্যমনস্ক খসে পড়ল ছোঁয়ার অনুভূতি। দেখলাম, দুধসাদা বেড়ালের শরীরের মতো; চিরহরিৎ জঙ্গলের পায়ের কাছে পদাতিক মেঘ জমে তৈরি হওয়া ঘাসের মতো; দোয়েল, পাপিয়া, টিয়া, মৌটুসি, তিতির — পাঁচ আঙুল-পাখির নখরহীন উড়ে বসার মতো তোমার হাত। তার নিচে তাকিয়ে নিজের করতলের দেখা পেলাম কই! সেখানে বালি-রঙের, কানায় গেরুয়া রেখা-টানা একখানি মাটির সরা রয়েছে। ভেতরে তুমি — জ্বলন্ত কর্পূর, সাদা, স্বচ্ছ, নিধূম, সহনশীল আগুন। আমার উচিত এই বিরল বহ্নিকে হাতের আড়াল দেওয়া ভেবে আরেকটা মাটির সরা, যা আসলে আমার বাঁ হাত, ওর ওপর উজাড় করলাম।

রাধিকা-সুতোর কাজ

পৃথিবীর মাথায় এক কোকিল বসেছে
দেখছে, অনন্তের কাছে আমরা ক’টা গরীব চিঠি লিখি

শাড়ির শীকর এসে অস্নাতের চোখেমুখে লাগে
যদিও তার দুপুরের গোগ্রাসের অস্পষ্ট ঠিকানা
মন দিয়ে মাথা মুছে পরিপাটি চুল আঁচড়েছে

তুমি নিজের ছায়াই শরীরে ঘুরিয়ে এনে রাত্রি চাও কেন?
পুতুলের মুন্ডু ছিঁড়ে যে সামান্য রক্তপাত, মানো তাকে
মেনে নাও বন্যা হলে কোনও ঘাটে লাশদেহ, কোনও চরে খিচুড়ি-সৎকার।
এ-জীবন ঘাসে ঢেকে আছে, ছোট জল আদরের মতো;
প্রতিটা গোঙানির মাথায় আকাশের সত্যি তুমি অস্বীকার করতে পারো না

যদি রক্ত আর কম্বল রেখে আসো সমস্ত ঋতুর
হাতেপায়ে —- যারা পদ্মপাতা, মেঘ কিম্বা করবীজংশন;
হাওয়ার পাঁজর কেটে ওই চিরকালব্যাপ্তিকে যদি
মানুষের ভেতরে নামাও ধুম লম্বা বিদ্যুৎশিখায়,
তবে প্রেম প্রতিষ্ঠিত হবে

জগতের মাথায় একটা কোকিল
বসেছে অপেক্ষা মুড়ে পিঠের ওপরে।
আকাশের অস্তনীল পাঞ্জাবিতে রাধিকা-সুতোর কাজ করা…

সমস্ত ব্ল্যাকবক্সকে

বাবার অসুখ বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই, তাই তুমি ভেঙে পড়তে চাইছো। ছেলের সঙ্গে যোগাযোগের সুতো ছিঁড়তে বসেছে, সুতরাং চিকিৎসা থামিয়েছ নিজের। তোমার হাজব্যান্ডের ব্যবহার অপমানজনক ব’লে একবেলা খাওয়া বন্ধ করলে।

পরিস্থিতি লড়াই দাবি করছে, কিন্তু তুমি হয়তো যুদ্ধের এই মাঠগুলোকে চেনো না। শুধু অন্যের জন্যে গলা উঁচু করতে শিখেছ; সেই কবে থেকে একটা দর্শনের সঙ্গে এক-ছাদের নিচে বাস — ইউনিভার্সিটির উঁচু কড়িবরগার অধীনস্থ বইয়ের পুরনো আলমারি আর পুলিশের গুলি খাওয়া ক্লাসমেট তোমাকে প্রতি পায়ে সাহায্য করে সেখানে; অথচ নিজের মানুষের মুছে যাওয়া বা আপনজনের কাছে নিজেকে “বাড়ন্ত” দেখে ফেলার ভয় তোমার সত্তায় বৃশ্চিক হয়ে দেখা দিল।

ইচ্ছে করে, এক পাখিজাগা হেমন্তের ভোরে তোমাকে হাত ধরে একটা অশথগাছের বেদিতে বসাই; কাঁধের কাছে চাদরটা টেনে দিয়ে বলি, চোখ বুঁজে ভাবো তো, কোন কোন জীবউপাদান জড়উপাদানে তৈরি তুমি? ঈশ্বর বা নাস্তিকতা, সৃষ্টি না সাফল্য, প্রেম-যৌনতা, ঘেন্নার অবসাদ, অত্যাচার অথবা মুক্তিকামনা?

এই যে খুঁজতে শুরু করলে, এ সারাক্ষণ আমারও হাতড়ে বেড়ানো। কখনও মনে হয়, সব কিছুই একটু একটু মিশেছে এসে নিজের মধ্যে। তারপর ভাবি, ভেতরে মেশেনি, ওপরে জমা হল — গুহার গায়ে খনিজ লবণ।

পরমাণুর যেমন কেন্দ্র, আমাদের সত্তাও তো ভারি হয়ে আছে শূন্যতায়, যার তড়িৎআধান সব সময় ধনাত্মক। ওজনদার তাই স্থির, শূন্য তাই উড়তে পারে। জন্মের মধ্যে দিয়ে এসে জীবনের ওপর একচক্র কেটে মৃত্যুর দিকে পাখসাট বাড়াবে।

সব সম্পর্ক, সব কাজ শুধু আমার অবয়বের সংজ্ঞা তুলে দেয় পৃথিবীর হাতে। আর আমাকে কী দিল সে — জরা থেকে অভিবাসন? দুঃখ থেকে ছুটকারা? আঘাত থেকে চন্দ্রাতপ? উঁহু! নিঃসঙ্গতা মোছে, কিন্তু কেউ এসে একাকিত্ব ছুঁতে পারে কই — বোধ, ভারসাম্য যেখানে সোনার কৌটোয় মুড়ে রাখা!

অস্তিত্বের সেই কোর সেক্টরকে তুমি একবার আলাপ করিয়ে দিও আকাশের সঙ্গে। দেখবে, যত অন্ধকারের শব্দ নুরানি হয়ে যাচ্ছে…।

চুম্বিত হতে হতেও ভুলে যেও না ভালোবাসা আসলে ভ্যানিশিং-ইংক; আয়নার দিকে তাকিয়ে পড়ে নিও বয়েসের নুপূরশব্দ; তবু মনে রেখো, শেষ যুদ্ধটা বাদে বাকি সব লড়াই কিন্তু মানুষই জেতে — সত্তার সৈনিকেরা। হাসপাতাল থেকে বারবার সার্থকভাবে বাড়ি ফেরার অ্যাম্বুলেন্সে বসাই বডদাকে, নির্দিষ্ট সন্ধেয় বের করে ফেলি কবিতার বই, বাপমায়ের দোষ মিথ্যে করে সন্তান নিজের সাহসেই নাভি পর্যন্ত হেসে ওঠে।

তাই আমার দুহাতের অনুনয়, বাইরের ভেঙে পড়াকে কুড়িয়ে এনো না তোমার স্থির আগুন ঢেকে দেবে বলে। যা নিয়েছ, তাকে বাইরের ঘরে রেখো —- যে ঘর হাসিমুখে সব ফিরিয়ে দিতে তৈরি। ওষুধের জোর কতটুকু, যদি সাড়া না দাও? অন্য সবাই সাহায্যকারী, কেবল তুমিই তোমার নবী হতে পারো। জীবনই একমাত্র ধর্মমত যাকে আজ প্রতিষ্ঠা করে যাওয়া চাই।

জেনো, যতদিন বেঁচে আছি, আমরা মৃত্যুহীন। অমরত্বের চারপাশে গুলঞ্চের বেড়া দেওয়া বলেই এত তীব্র এই পরমায়ু! জীবনের যে কোনও রুপোলি ডানা লুফথানসা অথবা লুপ্তহংস বিমানের মতো পাহাড়ের মাথাতেই ভেঙে পড়ুক আর তলিয়ে যাক প্রশান্ত মহাসাগরে, তোমার সত্তা সেই ব্ল্যাকবক্স — তুষারঝড়ের ঠোক্কর খেতে খেতে, সামুদ্রিক শ্যাওলায় জড়িয়ে গিয়েও আলো পাঠাচ্ছে, বিপ-বিপ শব্দে গুনগুন করছে, কই কিছু শুনতে পাচ্ছো না?

তুফান তো আনা হ্যায়
আ কর চলে জানা হ্যায়
বাদল হ্যায় ইয়ে কুছ পল কা
ছা কর ঢল জানা হ্যায়
পরছাঈয়াঁ রহ জাতী
রহ জাতী নিশানী হ্যায়…

(২৫ বছর আগের লেখা) আমার প্রলাপ

দৈব আদেশ পেয়ে তোমাকে ক্ষীর দিয়ে বানাই
কালো একটা তিল বসাই রোগা সাহসটাতে
তোমাকে উপার্জন করার ক্ষমতা
ওই তিল তিল মৃত্যুর মধ্যে আসে
তোমাকে মৃগয়া করি এমন লম্পট জুন মাস
হাত থেকে কেড়ে নেয় একজোড়া ডাহুক-ডাহুকী
বৃষ্টির বুকের কাছে উঠে এসে দেখি
ওপরের ঠোঁট আকাশ, নিচেরটা সমুদ্র
ভেসে যেতে যেতে তোমারই ওষ্ঠমূলে তোমাকে উৎসর্গ করে দিই।

পুরনো কবিতা : সূর্যসহকারী

আমার প্রথম পংক্তি সূর্যশ্লোকে ভরা
মাটিকে অচ্ছুত করে গাজর রশ্মিরা
উঠে যায় আকাশের সবজিগুদামে
আমার দ্বিতীয় পংক্তি ঘিরে রাত্রি নামে

সবুজ গাছের মাথা মেঘ-সহোদর
মস্তিষ্ক দুফাঁক হয়ে শোণিতশেকড়
টেনে নেয় বোমা গুলি বৃষ্টিদুধ গাঢ়
আমার আহারপাত্রে মৃত্যু বসতে পারো

নিচে বিশ্ব, যুদ্ধে যাবে বিকলাঙ্গ সেনা
কিছু খেতচাষি, কিছু নোনতা কারখানা
বিশুদ্ধ প্রণয় তবু বিরুদ্ধ শিবিরে
স্ত্রীধমনী তার, সুপুরুষ টোকা পড়ে!

আমার অন্তিম ভাষা স্নেহ-উচ্চারণ
আকাশ সুরেলা করা সে কবি চারণ
মুছে যায়, চক্রাকারে ফিরে আসে তারই
প্রথম জাগ্রত শ্লোক, সূর্যসহকারী।