চন্দন ভট্টাচার্য এর সকল পোস্ট

তরুজা

প্রত্যেক মেয়ের মুণ্ড মাটিতে সমাধি
প্রতিটি মেয়েলি ধড় মাটির ওপরে বিকশিত
কিছুদূর উঠে দু’পা চরম বিভক্ত হয়ে
ভেতরে আকাশ ডেকে আনে
আকাশের তারাকণা, শস্যদানা, মেঘগয়না মিলে
যে জন্মায় তাকে তোমরা পাখি ব’লে ডাকো
সে ওই শূন্যতা-সন্ধিতে ব’সে ঠোঁট মারে
ঘন ঘন মাংসের চোকলা ফেটে ফাটল তৈরি হ’লে
সেখানেই ভিতু নাড়ি জড়িয়ে রাখে ডিম
পৃথিবীরঙের
পাখির নীড়ের মতো যোনি জন্ম নেয়

হাস্নুহানা

যখন সূর্যাস্তের এক কোনে হাওয়া-মিঠাইয়ের মতো মেঘ
যখন ইলেকট্রিক তারে থেমে আছে বৃষ্টিফোঁটার রোপওয়ে
যখন খোয়া-ওঠা রাস্তায় ঝাঁকাভর্তি ডিম যাচ্ছে
কী হয় কী হয় সাইকেলে
যখন পাখি নিজেকেই ছয় মেরে মাঠ টপকে চলে যায়
যখন এখান থেকে ওখানে তুলে পোঁতা, তবু
নতুন বউয়ের মতো বেঁচেও তো যায় ফুলগাছ!
যখন ভয় থেকে জন্ম নেওয়া অন্ধকার এবং
মোমবাতি তাকে পুড়িয়ে দিয়ে সাহসিকতা
যখন বিনা শব্দে উটের মতো শূন্যে মাথা ঘোরাচ্ছে বাতাস এবার
যখন খুনের ফলে বন্‌ধের ফলে খুনের ফলে খুন…
তবু যখন সাপের চেয়েও জনবিরল রাস্তার লেজে পা দিয়ে
দাঁড়ানো তালগাছ আর ফনায় চেপে বসা দেহাতি পাহাড়
যখন জিন্দগি এক সফর হাস্নুহানা।

কাঁঠালগাছ

সবে ছোট্ট বড় হওয়া, সবে শাড়ি শেখা, সদ্য লজ্জায়
চুলের ফাঁকে সিঁদুর লুকোনোকে দেখি রোজ ভোরে উঠি যখন
রোজ রাজ্যভ্রমণে। তার মাত্র কয়েকশো সন্তান চকচকে, তার
শুধু একটা কোল খালি হবে, একটা বাচ্চা মুরঝানো, সমস্ত গা
লাল — বলছে, আমাকে যেতে দে মা, কেন কান্না করছিস!

আশ্চর্য থাকতে থাকতে উড়ে নামতে দে, তোর পায়ের নিচে
প্রথম দেহ হই। কিছু বলব কি, মা’র ভয়-চোখের পিছু পিছু
তাকিয়ে দেখি ফাঁকা মাঠ দিয়ে ক্ষীরসাদা বাতাস উড়ে আসছে
আর দাঁতে দাঁতে চেপে আছে মা, একটা শাখাও যেন না দোলে
ওই আয়ুফুরনো সন্তানে কোনও দোকা না পৌঁছোয়।

তবু বাতাস এসে সে চিন্তা ফাটিয়ে দেয় আর বাসি বাচ্চাটাক
হাসিমুখে পড়তে থাকে ছলছল মুখেও, মা কেঁদে গড়িয়ে পড়ে…
আমি কি আর দেখতে পারি এইসব! পাতাটাকে তুলে
আবার ডালে লাগিয়ে দিই, হাত বুলিয়ে পিঠে ওর রঙ এনে দিয়ে
গাছের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলি, চুপ! যেন কেউ জানতে না পারে
যা তথাগতও সাহস পাননি আমি যে সেই বিদ্যা, একথা
না ছড়ায় — ব’লে হাতকাটা গেঞ্জি আর চপ্পল পায়ে
রাজ্যভ্রমণে নেমে আসি।

কবিতা : সপ্লিন্টার

এক
সুখী পরিবার মানে মা-মেয়ের একসঙ্গে পিরিয়ড হয়
হিজড়ে করছে হিজড়ের চরিত্রে অভিনয়

তিনি বহুচেরা দেবী আমি সহজ — এই স্তোত্র নির্মাণ করেছি
চেষ্টা যদি সৎ, তবে প্রতিষ্ঠা পরাজয় ছাড়া আর কী!

দুই
আমার লেজের নিচে জ্বলন্ত লাইটার রাখল তারা —
নিজের বমি দেখাবো না মিডিয়াকে, বলেছি তো?
বিতৃষ্ণার ভেতরে আছে একফোঁটা ইচ্ছে, যা থেকে
জন্মাবে বিতৃষ্ণাধারা
হা-হা কাপালিক রোদ, বোঁটাখসা স্তনের মতো ভীত।
চোখ কোটরের মধ্যে উল্টোদিকে ঘুরে গেছে, ফিরবে কীভাবে?
ফিরে পাওয়া আগের থাকে না।
আমাদের ও-পজিটিভ মিথ্যে যে-কোনও শিরায় মিশে যাবে
তবু জুঁইফুলের শোক কলাবতীতে ঢাকে না

তিন
উন্নত মঙ্গলকাব্যের দিকে কিছুক্ষণ বাইক চালানোর পর
পেছনে তাকিয়ে দেখি আরোহিণী নেই!
অথচ চাঁদ করেছিলাম কত আস্তে, সবচেয়ে নরম সম্মান দিয়ে ধরেছিলাম
দুটো থানাপুলিশ। আমি ভালোবাসার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লিখে নিচে
সই করতেই সেটা পুরসভার ডেথ সার্টিফিকেট হয়ে যাচ্ছে। এইভাবে
শবের সুস্থতা পেয়ে যাবো, শ্মশানবন্ধুর দু:খ থেকে জেগে পা-ছড়ানো লাশের আরাম…

চার
অকালসঙ্গম থেকে উঠে কিশোর ভোরবেলা চণ্ডীপাঠের ভেতরে বসেছে
গাছে গাছে কাকফল, আমাদের ওয়েট শুকোয় সারাক্ষণ।
পুকুরের একটা দিক দিলদরিয়া, পায়ের একটা ভাগ সর্পদংশন
তিনকাঠা গোধূলিতে অন্ধকার আবাসন প্রকল্প তুলবে
ঝানু অডিটর যে-কুকুর রাস্তা শুঁকে শুঁকে চলে যায়
সহর্ষ পালটি খাওয়া শালপাতায়
মেলা ফুরনোর চিহ্ন, সে বলছে:
আবেগ অন্তর্বাসের মতো, নানারকম সাইজে পাবে, মন।

পাঁচ
কবিতার সপ্লিন্টার খেয়ে সুবীভৎস জ্বর এল ঘিলুর ভেতরে
পিঠে দানা দানা মরচে শিশির, নিরস্ত্র ভোরে
পেচ্ছাপে বুক ফেটে যায়। যন্ত্রণার জরা নেই, তথাগত জানো?
কিছুক্ষণ পর সেই ঝিলমিল মাথা কশাইয়ের কাঁধে ঝুলছে,
চোখদুটো একদৃষ্টে পেছনে তাকানো

ধন্যবাদ, বলিহারি, কাজ হাসিল…

সান্ধ্য বুলেটিন

মন পরাস্ত আছে। আজি সন্ধ্যার সমরসংবাদ এই উড়ন্ত মৃত
দুই কবুতর, আমিষবর্ণ। স্নানকালে শিরস্ত্রাণ খুলিবার ভুল
একবারই করিয়াছিলাম। তারপর হইতে শুধু শিরস্ত্রাণ রহিয়াছে।

তবু কিছু স্বপ্ন মাখা এই লৌহজালিকায়। ফর্ম্যালিনে ভেজানো শতাব্দীটি
খুঁড়িয়া দেখিলে মেঘের বুককেসে বৃষ্টিমোহর, বাগানটি সবুজ অশ্বমেধ, আলো সুবর্ণরেখা।
শুধু ভেতরে শূন্যতার এক রথযাত্রা চলিয়াছে।
শুধু এক আলোকবর্ষ জীবনের পরে ভাষা বলিয়া কিছু নাই
বলিবার কথা শিশুর নুংকুর মতো
সে দ্যাখে — দশমীপূজার আবীরবর্ণ ঢেউ উঠিল নদীতে
খোলা চুল, উৎসুক স্তন

গোঙানি কি শুধু অয়দিপাউসের?

পুরনো কবিতা : জগন্নাথ

যিনি আমাদের জন্ম দিলেন
এবং তার চেয়েও চিরজীবী মৃত্যু দিতে সব সময় প্রস্তুত
সেই অপাপবিদ্ধকে প্রণাম
যিনি আমাদের চালেডালে মিশিয়ে খাওয়ালেন
আর দুমুহূর্তের মধ্যে আদেশ দিলেন কালান্তক ভেদবমি
সেই যমগন্ধবাহী উদ্দীপনাকে প্রণাম

যে আচার্য গরমকালে থোকা থোকা কারখানা বসিয়ে
বৃষ্টিকালে সেখানে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে
এই শরতে তালা খুলে বাস্তুকারকে দেখাচ্ছেন
মেশিনের পেটে পাক দিয়ে ওঠা কাশফুল,
সেই হালকা বাতাস ও উপজাতি নৃত্যকে প্রণাম

কেননা, তিনি ভিক্ষুককে ভিখারি হতে আশীর্বাদ করেন
বোবাকে দেখান জিভ টেনে উপড়ে নেওয়ার ভয়
তারই দয়ায় হৃৎপাত্রে ভালোবাসা-অবিশ্বাস সমান সমান
মৃৎপাত্রে অশ্রুকণা-পায়েসান্ন সমান সমান
তাই জগন্নাথ হাতদুটিতে এক লক্ষ নমস্কার রাখি যদি
তো প্রশান্ত দুপায়ে সমকক্ষ ধিক্কার প্রণাম।

একটা করে কয়েন ২

চার
জানো সোনা, কবে থেকে আমার রাত্তির নেই!
মাথায়, পিঠে, নাভির ওপর শুধু চৈত্য, মঠ, শুধু সাহারা
বিছানায় একটা এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা পেতে শোয়া আমার
বালি বালি শক্ত দানার অন্ধকার, তাকে টেস্ট টিউবের নিচে থেকে তুলে বলি ওড়ো
তুলো ভাসাও প্লিজ, আমি ঘুমবো
বিশ্বাস করো সোনা, তপ্তকাঞ্চন কোনও নিশ্বাস নেই পাশে
ঢেঁকুচকুচ ওই পিঠেপায়েসের বৌটা নেই যার কাঁধে শীত কিন্তু পায়ের পাতায় বসন্ত
তুমি জানো আমার প্রেম নিশীথ দেখেনি
তোমার স্তনবোঁটা সবেদা হয়ে গেছে রোদে
আর আমার আদর শক্তিশালী চাইনিজ টর্চের মতো
শুধু স্বপ্নে আসে বাবলগামের স্ফীত চুমু
কোমরে কোমর মিশে যাওয়া

ঘুমের ভেতর ভয় পেলে গলার ঘাম, হাতের ঢলঢলে চুড়ি, কোনও মা নেই…

পাঁচ
পীপল-পোড়া দিন এসেছে
পুড়িয়ে দেওয়া মাটির বুড়ো অবিবাহিত পাথর
ত্রাহি, চোখে ধুঁধুল দেখি গো

দেখি ধূলিধূষরিত এক মাঠের দেবতা আছে
যে রোদের মধ্যে তোমাকে সর্বাঙ্গ ঘুম দেয়
তারপর সরসর করে শুকনো পাতার
ওপর দিয়ে বিকেলবেলা…
পাখি-পড়া হয়ে ছিল যে মাঠখানা
সেখানে এক-গুঁড়ি দু-গুঁড়ি বৃষ্টি
যেমন তোমার শরীর-পথে যেতে যেতে
স্পিডব্রেকারের মতো স্তন
লঘু হিম-জমা বাঁশের কোমরে দা-এর ভরন্ত কোপ
আর গোড়ালির কাপড় একটু উঁচু করে ছুটে আসছে বর্ষা

এই ছপ শব্দ মহীয়ান

ছয়
আমার সমস্ত কবিতার কোথাও তো বলেছি ভালোবাসা?
আমি কি খুব বেশি নরম খেলাইনি শব্দে শব্দে
যাতে বৃষ্টি থামার পরেও কিছুটা জলের ধৃতি হয়?
আমি হয়তো পানপাতা করে তুলিনি সমস্ত অক্ষরের চোখ
আমার তীক্ষ্ণ নৌকো বোধ হয় ভেঙে উল্টে
পড়ে থাকল অশ্লীল দীঘায়
এই যে সকাল সাতটা, আপনি শিওর যে মনোরথে চেপে খুব কাছে আসতে পারিনি অনন্তের?
তাহলে এটাও বলি গভীরতা, আপনার নেক্সট কাব্যগ্রন্থের দিকে কিন্তু আমার নজর থাকবে।

একটা করে কয়েন ১

এক
যদি প্রেমকে নিজের আত্মা বলে নিই
টেবিলে মুখোমুখি কনুইয়ের ভরে বসি আমি আর নোনা পৃথিবী
যদি ছবিকার মেরে দিয়ে সারা গায়ে ছবি মেখে ফেলি
নত করি পুরুষাঙ্গ, মৃদু করি মাথার নি:শ্বাস
উঁচুভাবে মণ্ড তুলে নিজেকে গভীর করে এতটা খাওয়াই
তবে ভাই
তোমাদের পেটে পেটে সূর্যোদয় হবে

দুই
পরিশিষ্টে এসেছি, যাব শীতলযাত্রায়
(যা:, প্রথমেই সব ফেচকে দিলাম)
শন শন ক’রে বিভীষণ ওজনের দু’চাকা
কুল-ভাঙা স্টার্ট নিয়ে বে-জায়গায় বন্ধ হয়ে যায়
টেক্কা এসে ঘেঁটি ধরে তুলে নিচ্ছে চিঁড়ের গোলাম

জাগরণ চোখের আড়ালে, তার মৃত্যু নাম
এই ব’লে লেজ খাড়া তুলে রাখো বিশ্বাস
আর ভাবো, পরিশিষ্টে কী নতুন বাঁক নিতে পারে কিসসা…

তিন
রাত্রি যবে না ঘুমায় আমার ভিতরে
যথা বুকের উপরে স্বেদ, ছিদ্র ছিদ্র পড়ে থাকে টিয়ার বাসায়
নিজের মুখের গন্ধে লুপ্ত সোপান খোলে — হা শৈশব
নিজের অসুখ আমাকে পড়তে দেয় দর্শনের শেষ পাতা
ঈশ্বরজয়ের হাততালি

ওরে মন, বীজ ফেলে যাওয়ার আশায় কাপাস তুলোর বেশি ওপরে ওঠোনি…

রাত্রি যবে উপবিষ্ট আমার ভিতরে
টুথপেস্ট-সাদা ভোর হয়
সুফির উল্লাসগান অনামিষ জল থেকে উপরে উৎখাত করে
মাছের পিচ্ছিল
সেখানে চক্ষু রেখে তাড়াতাড়ি শেষ পংক্তি লিখি
অথবা যাহা বা লিখি, শেষ পংক্তি হয়

(ক্রমশিত…)

তছরূপ

আমি যে লিখতেই পারি না এই চাপা সত্যে আরও তিনমুঠ
মাটি ছড়ানোর জন্যে আমি লিখি
আমার এলেম নেই কাউকে কিছু আটকে রাখার
সেই ঢেউ বুঝে আমি একা-শিলা ভেসে যাই
প্রত্যেক জীবন্ত প্রাণ আসলে মানুষ এই গিজগিজ চেতনাসংখ্যা
নোটবুকে পেয়ে আমার চূড়ান্ত ভয় করে
উদ্ভিদ চুম্বন পারে — অভিজ্ঞতা-শেষে আমার যৌনতা
বাগানে বাগানে প্রসারিত

আমি আর শৈশবে ফিরবো না এই ডাঁসামিথ্যে
দাঁতে কামড়ে ছুটতে বেরিয়েছি
আমার মৃত্যু হবে কি হবে না সেই সন্দেহ-অভাজন —
মাথার পেছনে দু’হাত — আমাকে একটা চিন্তাশীল পোজে রেখে দেয়
আর শেষে আজকের সাঁঝ যে তিনবছর আগের
সায়ং থেকে টুকে মেরে দেওয়া, সেই তছরূপ হাতেনাতে ধরবো বলে
আমি ভাই তেতলার ব্যালকনি থেকে ঝাঁপিয়ে দিলাম।

মেমোরিয়াল

সন্ধের বিনয়ী আলো এসে পড়েছে সন্ধের ওপরে

ডুবে যাওয়া দ্বীপের চুড়োয় উঁচু উঁচু মহাকাশের পাহারাদার।
আর গোলাপি পাথরের তোরণের গায়ে এক সন্ন্যাসিনী;
ঠান্ডা কপাল টান করে বাঁধা, গায়ের পোষাক
হাওয়া-লাগা পুকুরের পদ্মপাতার মতো নানান ফ্রিলের গরীয়সী

মাঠের নিচ-পাতাল দিয়ে মাঝে মাঝে সমগ্র ময়াল হেঁটে যায়
সেই শঙ্কা লেগে মাটির ওপরে ঘাস ঝলসানো।
জলাশয় আছে, কিন্তু জল কী প্রকার জিগ্যেস করো না,
বরং সহর্ষ মালাইচাকি দেখানো ওই
সেনাপতিমূর্তির কথা জানি
ভেবেছিল দখলের চারপাশে পাঁচিল তুললেই — মধ্যে দুচারটি ফোয়ারা — নুড়িপাথরের স্রোতে শ্লথ হয়ে যাবে অশ্বারোহী।
নিজে দুর্গ হয়ে জনতাকে কেটেকুটে বানাবে পরিখা, আর
এইভাবে ইতিহাসপুরুষ হবে
ভুল সে ভাবেনি!
পুরনো দ্বীপ ডুবে গেছে; গীর্জার বটগাছ বা বটগাছের গীর্জার পাশে সারসার লোহার স্থবির বেঞ্চে আমপাতা কিশোরকিশোরি — মাথায় পাখির দাগ, পোষাকে শ্যাওলা নিয়ে পরস্পর জড়িয়ে শিলীভূত।
শুধু একক আসনে এক যুবা — বুকে কান পাতলে
অসামান্য ধুকধুকি শোনা যেত
রক্তশুকনো ঠোঁট নড়ে উঠতো আলগোছে…
“আমি তোমাকে ছোঁব, নভতল”

কবিতা : পোস্টাবিসযাত্রা

দিবার উপরিভাগ ধীরে তপ্ত। মাঝে ফাটলসম প্রচ্ছায়া নামে। সম্মুখে ডোবা, তাহার পৈঠায় ডানপদ জলে নামাইয়া, বামটি তীরে, এক বামা সবেধন বস্ত্র ধোয়। বিড়াল কৃষ্ণবাদামি, ভীত রাজমহিষীর মতো পথ ঘেঁষিয়া দাঁড়ায় ও মাথার উপর কাক উড়িলে পলায়ন করে।

ন’টা কুড়ি বাজিতেছে — অর্থ লোকাল ছুটিল। দূরে নাইটিপরা স্ত্রীলোক ও তাহার কন্যা, শুধু জাঙিয়া। এই উঠিব-উঠিব বেলায় বড় মনে হয়, হে বিশ্ববিধাতৃ, কেন বক্ষ হইতে হৃদপিণ্ডসম স্মৃতি কাড়িলে, ওষ্ঠ হইতে নতুন শব্দের স্ফোটগুলি? হে মায়াবি, পাগল শুনাইলে বারবার, অথচ শিরায় রাখিলে অ্যালুমিনিয়াম-স্থিরতা!

এইরূপে ভাঙিয়া পড়িলাম — হতাশা-গর্বিত। রোদ যখন দ্বিপ্রহরের বুকে শান বাঁধাইতেছেন, ময়লা পাঞ্জাবির পুন: পুন: পোস্টাবিসযাত্রার মধ্য দিয়া আমার নির্ঘন্ট পুরিয়া সদগতি আসিল। এক মুহূর্তের চোখমুখ-অন্ধকার — এজীবনে সঞ্চিত জ্ঞানের আভা মাটি হইতে জাগিয়া গোলাপরজনীদলে ঘিরিল শরীর। শেষ হইলাম — ভস্ম-গর্বিত; কেন না
ইচ্ছাগুলি আজও ইরেকটেড।

হতাম যদি তোতাপাখি… ৩

(তৃতীয় টুকরো)

বড়দিনের আগে এই অ্যানেকডোট দিয়েই শুরু করা যাক:

রোমের গির্জার সামনে হঠাৎ এক উন্মাদের উদয় হয়েছে। দাড়িভর্তি মুখের খেতে না পাওয়া চেহারা, এক টুকরো কাপড় শুধু কোমরে জড়ানো। সে বলছে: আমি যিশু! কথা দিয়েছিলাম না, দ্বিতীয়বার আসবো? স্বাভাবিকভাবেই লোকজন খুব আমোদ পাচ্ছে, কিন্তু আওয়াজ শুনেও চার্চের ভেতর থেকে কেউ বেরলো-টেরলো না।

বাচ্চা ছেলেমেয়েরা একটা খেলা ভেবেই শেষে তাকে ঢিল ছুঁড়তে শুরু করল; পাগল তখনও বলছে আমিই খ্রিস্ট, বিশ্বাস করো একবর্ণ মিথ্যে বলছি না। সন্ধে নামল এক সময়, রক্তমাখা অভুক্ত লোকটা বরফগুঁড়োর মধ্যে একা পড়ে থাকল উপাসনাস্থানের সামনেই।

রাত যখন প্রায় দুটো, গির্জার ফটক খুলে প্রধান যাজক পা টিপে বেরিয়ে এসেছেন, এদিক-ওদিক দেখে তিনি সেই আধমরা পাগলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। নিচু হয়ে ফিসফিস করে বললেন, চলো ভেতরে, কথা আছে।

ঘরে নিয়ে তাকে একটা ফারের কোট আর একবাটি গরম স্যুপে কমফোর্ট করতেই শুরু হল পুরনো ঘ্যানঘ্যানানি: আমি জিসাস ক্রাইস্ট, তুমি তো ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ সেবক, তাও ঈশ্বরের ছেলেকে চিনতে অসুবিধে!

পাদ্রি এক ধমক দিয়ে বললেন, কে বললো তোমাকে চিনতে পারিনি? না হলে কি আরও অনেক আগেই দয়া দেখাতাম না? কিন্তু তুমি হঠাৎ ফিরে এলে যে বড়!

— ফিরে আসব না, কী বলছো! সেই রকমই তো কথা দিয়েছিলাম। তবে কিনা একটু দেরি হয়ে গেল, অপেক্ষা করিয়ে রাখার জন্যে যারপরনাই দু:খিত।

— না না, কেউ ওয়েট-ফোয়েট করছিল না। একগাদা পুরনো ধারণা নিয়ে বসে থেকো না প্লিজ! এটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও যে খ্রিস্টকে আমরা চাই না, খ্রিস্টধর্মকে চাই, চাই গির্জাকে। তোমার কাজ সেরে তুমি ঠিক সময়ে রওনা হয়ে গেছ, এবার আমাদের শান্তিমতো দায়িত্বটা পালন করতে দাও।

ঈশ্বরপুত্র হাঁ করে তাকিয়ে আছে দেখে পাদ্রির বিরক্তি বাড়ল আরও।

আচ্ছা, তুমি কি খবর রাখো না এখন আমরা খ্রিস্টানরা পৃথিবী শাসন করি, আর রাষ্ট্রের সঙ্গে সঠিক বোঝাপড়া করে এগনোর জন্যেই এটা সম্ভব হয়েছে? এই মুহূর্তে চার্চের সম্পদ আর প্রভাব কতখানি তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। গোটা পরিকল্পনার মধ্যে যিশুর সেকেন্ড কামিং-এর কোনও জায়গা নেই। ওয়ান বাইবেল ইজ এনাফ। ওই একটামাত্র বইয়ের ওপরে এই বিশাল সাম্রাজ্য আমরা গড়ে তুলেছি — তাহলে ভেবে দ্যাখো কার কৃতিত্ব বেশি, যিশুর না গির্জার? তারপর তুমি পাগল মানুষ, হয়তো প্রেস বাইট-ই দিয়ে বসলে যে মেরি ম্যাগডালেনের সঙ্গে ঘুমিয়েছ বা এমনকি একটা বাচ্চাও হয়েছিল তোমাদের। কী লেভেলের কেলো হবে আইডিয়া করতে পারছ? তাসের ঘর হয়ে যাবে সবকিছু, এইসব লোককে বাবা একবিন্দু বিশ্বাস নেই!

মূল গল্পটা আছে দস্তয়েভস্কি-র ব্রাদার্স কারামাজোভ উপন্যাসের “দি গ্র‍্যান্ড ইনকুইজিটার” অধ্যায়ে। নিজের মতো করে খানিক মজা জুগিয়ে লিখলাম।

কিন্তু আমি বুঝতে পারি না “এইসব লোক”-এর লিস্টে কে কে পড়বেন? হজরত, বুদ্ধদেব, রবীন্দ্রনাথ, জাঁ পল সার্ত্র…? আচ্ছা, আজ সকালেই যদি মহম্মদ জাগ্রত হয়ে মক্কায় অবতরণ করতে চান, আমরা নিশ্চয়ই আশা করতে পারি, সব সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী নিজ-নিজ কর্মসূচী স্থগিত রেখে একজোট হয়ে তাকে তন্মুহূর্তে উড়িয়ে দেওয়ার পবিত্র ইসলামিক কাজে হাত লাগাবে? অথবা ভাবুন গুগাবাবা-র মতো গৌতমবুদ্ধ ফিরে এল! তিনি তো প্রথম মউ স্বাক্ষর করবেন তালিবান জঙ্গিদের সঙ্গে, “ভাই, তোরা সারা পৃথিবীতে আমার যেখানে যত স্ট্যাচু আছে একটু কষ্ট করে ভেঙে দে না!” কেননা, মৃত্যুর আগে শিষ্যদের নির্দেশ দিয়ে গেছিলেন: যেন কোথাও আমার কোনও প্রতিমূর্তি তৈরি না হয় (এবং সেই জন্যেই বৌদ্ধরা সারা বিশ্বে সব ধর্মগুরুর চেয়ে বেশি বুদ্ধদেবের মূর্তি বসিয়ে তবেই শান্তিলাভ করেছে)।

আমি নৈতিকতা প্রসঙ্গেই এই কথাগুলো ভাবছিলাম। আমার ধারণা, জ্ঞান থেকেই এথিকস উৎসারিত, যে জ্ঞান বিবেকবোধের উপাদান। কিন্তু নৈতিকতার বোধসম্পন্ন জ্ঞান (wisdom বলতে চাই একে) কখনও শক্তিকেন্দ্রের দিকে ধাবিত হয় না। জ্ঞানই শক্তি, কিন্তু সূক্ষ্ম নলেজকে স্থূল পাওয়ারের দিকে বয়ে যাওয়া থেকে আটকায় তার নৈতিকতা।

রবীন্দ্রনাথকে বিচার করতে গিয়ে রাজনৈতিক অস্তিত্বগুলোর যে-ধরণের সমস্যা হয়েছে তার একটা উদাহরণ দিয়েছিলাম আগের অংশে। এরপর জাঁ পল সার্ত্রের অবস্থানের ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানের সংকট নিয়ে আমার সামান্য মাথায় যা এসেছে বলতে চাইবো।

(আরও একটা কি দুটো টুকরো বাকি)

হতাম যদি তোতাপাখি… ২

(দ্বিতীয় অংশ)

তাছাড়া, রাজনৈতিক গুরুরা এও বলে গেছেন যে “নিরপেক্ষতা” একটা ভাঁওতাবাজি, সবার চোখে শ্রেণীস্বার্থ খেলা করছে। কাজেই নিজের দিকে, নিজের মতামতের উদ্দেশ্যে বিশ্লেষকের চোখ নিয়ে, সমালোচকের মনোভাব নিয়ে তাকানোর দায় থাকল না।
অন্যের সঙ্গে সম্পর্কের নৈতিকতা এর ফলে ঝাপসা হয়ে আসে।

মানুষ আসলে সেই ধরণের প্রাণী যারা একে অন্যের সঙ্গে মানবিক সম্পর্কে যাওয়ার জন্যে আর সেইসাথে মানুষের একটা পূর্ণ সংজ্ঞাতে পৌঁছনোর মানসে চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু একজন মানুষকে নিজের হয়ে-ওঠা এবং অপরের সঙ্গে সম্পর্কে আসা — এই দুটোকেই অর্জন করতে গেলে তার চেতনার মধ্যে এমনভাবে একটা নৈতিকতার মাত্রা স্থাপন করতে হবে যাতে ওই মর‍্যালিটি সত্যিকারের সামাজিক লক্ষ্য পায়। একে নৈতিকতার বাধ্যবাধকতা বলতে পারি। প্রত্যেক চেতনার মধ্যেই এই নীতিবোধের মাত্রা আছে, কিন্তু তাকে অন্য চেতনাগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করার কাজটাই হল আসল। আসল, কিন্তু অসম্ভব কঠিন নয় — কারণ আমাদের চেতনা অপরিহার্যভাবে অন্যের উপস্থিতির সঙ্গে জুড়ে থাকে। এইরকম চেতনাকে বলতে পারি স্বরূপ; যে নিজেকে অপরের স্বরূপ বলে মনে করছে। আর, অন্যের সঙ্গে যার সম্পর্ক থাকে সেই বাস্তবকেই তো নৈতিক চেতনা বলা যায়।

কিন্তু আমরা দেখছি, আমি-ও-আমার-দল অথবা আমি-ও-আমার-মতবাদ হচ্ছে ইউনিট “আমি”, এর বাইরে যা — সেই অন্যের সঙ্গে আমার যোগাযোগ শুধু বিয়োগকেন্দ্রিক। এখানেই একজন মহৎ ভাবনার মানুষকে চাইছে আমাদের সময়। ধরা যাক, রবি ঠাকুরকে চাইছে, যার উপন্যাসের পরাধীন-ভারতীয় প্রোটাগনিস্ট “বিদেশি বর্জন” আন্দোলনের বিরোধিতা করে যেহেতু গরীব মানুষের কেনা সস্তা আর টেঁকসই ব্রিটেনের মিলের কাপড় আন্দোলনকারীরা পুড়িয়ে ফেলছে তাদের জন্যে বিকল্প ব্যবস্থা না রেখেই। ফলত, চরমপন্থী আর সন্ত্রাসবাদীদের কাছে রবীন্দ্রনাথ “ইংরেজের দালাল” হয়ে পড়েন। এদিকে অসংখ্য মানুষ তার গানে লেখায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়েও তো পড়ছে। তাই, “দালাল” রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের চরও ঘুরে বেড়ায় সব সময়।

আজ পর্যন্ত যে আশি-নব্বই জন মানুষ মারা গেলেন টাকা তোলার লাইনে দাঁড়িয়ে, তাদের মৃত্যুর দায়িত্ব কে নেবে — এই প্রশ্ন করেছেন তো; ক্যাশ অর্থনীতির ভগ্নদশা জিডিপি-র দুয়ের তিন অংশের উৎপাদনের ওপর খুব খারাপ প্রভাব ফেলতে চলেছে — এমন আশঙ্কার কথা বলতে চেয়েছেন তো আপনি হয়ে যাবেন “কালো টাকার মালিক” এবং “দেশদ্রোহী”; আর যদি ফলিত অর্থনীতির যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করা যায় বিমুদ্রাকরণ কালো টাকা, হাওয়ালা ও জাল নোটের ব্যবসাকে আঘাত করার একটা তাৎক্ষণিক ও কার্যকরী উপায়? তাহলে আপনার জন্যে তোলা আছে বাকি দুটো বিশেষণ — “স্বৈরাচারী” আর “সাম্প্রদায়িক”।

বেশ, এবার দুটো কাজই করুন একসঙ্গে! নির্ঘাত আপনি সাপ আর ব্যাঙ দুজনের গালে চুমু খাওয়া চরিত্রহীন জীব, না না, একটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক চরিত্র। কেননা, আপনার জন্যে রাজনৈতিক মননে কোনও পরিসর ছেড়ে রাখা নেই। আপনি আছেন নো ম্যানস ল্যান্ডে যেখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে নৈতিক চেতনা আর দেশের সাধারণ নাগরিক।

(আর অল্প একটু বলবো)

হতাম যদি তোতাপাখি… ১

আমাদের দেশ দুর্দশার মধ্যে আছে। আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়তো নয়, কিন্তু চলছে চরম উত্তাপময় একটা দশা। কেউ নিচু বা স্বাভাবিক স্বরে কথা বলছে না; “কালো টাকার মালিক”, “স্বৈরাচারী”, “সাম্প্রদায়িক” আর “দেশদ্রোহী” — মূলত এই চার বিশেষণ প্রত্যেকে প্রত্যেকের দিকে ছুঁড়ে মারছে।

শুধু ওই চারটে শব্দই বা বলি কেন; রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া — মানে সাধারণ মানুষ বাদ দিয়ে সবাই “মোরা এক ভাষাতেই করি গান”। প্রত্যেকে খুব অসহিষ্ণু হয়ে অন্যকে ধান্দাবাজ সন্দেহে বকাবকি করছে। বোঝা যায়, উষ্ণায়ন প্রকৃতিতে নয়, বাসা বাঁধে আমাদের মাথার ভেতরে।

সবাই ঘটনার প্রতিক্রিয়া (reaction) দেখাচ্ছে, সাড়া (response) পাচ্ছি না একটাও। কিছু লোক বলছে, দেশের ভবিষ্যৎ অতিরিক্ত সূর্যকরোজ্জ্বল, কিছু লোক জনমৃত্যু আর দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় মশগুল হয়ে আছে। এই রকমটাই হয়, ক্ষমতায় যে থাকে তার ভাষা দক্ষিণপন্থী আর ক্ষমতার বাইরে এলে ওই দলের বাক্যই বামমার্গী হয়ে পড়বে। আবহমান কাল ধরে, সে গণতান্ত্রিক হোক বা বিপ্লবী রাষ্ট্র, মসনদে থেকে যাওয়ার কলকাঠি মানেই হল দক্ষিণ আর মসনদে পৌঁছনোর কৌশলটি বাম।

সাধারণ নাগরিক ছাড়া পৃথিবীতে একা দাঁড়িয়ে থাকে না প্রায় কেউ। প্রত্যেকের দল আছে। যে দলে ফিট হতে চায়নি বা পারেনি, তার জন্যে থাকল “ব্রাহ্মণের জন্যে আনা সন্দেশ” — মানে মতবাদ। সমাজে বাস করা মানুষ কোনও কালেই খুব নিশ্চিন্ত ছিল না, নানা রকম সামাজিক শক্তি তাকে শোষণ করে গেছে। তাই সে নিজেকে বাঁচাতে জাতি বা ধর্ম বা সম্প্রদায় ভিত্তিক উপ-সমাজ গঠন করে নিতো মূল ইলেকট্রিক সার্কিটের মধ্যে লোকাল সেলের মতো করে। রাষ্ট্রের চরিত্র রাজনৈতিক হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এগুলো ভেঙে রাজনৈতিক দলভিত্তিক গোষ্ঠী তৈরি হল। আমি কোন দল বেছে নেব তার পেছনে নিশ্চয়ই আমার স্বার্থ বা বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত কাজ করেছে, এবং ওই দুটো জিনিসের ওপর ভিত্তি করে আমি যে ভবিষ্যতে দল পালটাবো না এমনও বলা যায় না; তবে যতক্ষণ যেখানে আছি, সেটাই আমার পরিচয়, দাঁতে-নখে তাকে সমর্থন দিয়ে যেতে হবে। মতাদর্শের বেলায় অবস্থা আরও একটু সঙ্গীন। দল বদল হতে পারে, কিন্তু মতাদর্শে কোনও পরিবর্তন আনা খুব অসম্ভব। আমার দল, কিন্তু ইজম-এর আমি। মোটের ওপর কোনও মানুষই নিজের নয়। তাই একমাত্র দুভাবে সে হেরে যেতে পারে। নিজের দল বা মতবাদ হেরে গেল, নয়তো বিরুদ্ধ দল বা মতবাদ জয়ী হল। যার আত্মপরিচয়ের অভাব রয়েছে, হেরে যাওয়ার চেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন তার কাছে কিছু নেই।

(আরেকটু বাকি)

সহ্যকে যন্ত্রণা করি

প্রেম আঁকতে গিয়ে আমি পেনসিলের চেয়ে বেশি ইরেজার

বুঝিনি ভোরের মাখন আড়ামোড়া ভাঙার ভেতরে গলে যায়
ষোলশো কিলোমিটার বিনা-ঝাঁকুনি ছুটে এসেছে ট্রেন
শুধু কথা পালটি খেয়ে গেল, ইঞ্জিন রিপ্লেস হল খাঁচার ভেতরে।
ছুঁড়ে ফেলা পুরনো ফাইলে এত সারসের ডানা!
ওমনি মনে পড়ে, যতবার নোটশিটের কানে যত্ন করে
গুঁজি-সুতো পরিয়ে দিয়েছি, তুমি শিউরে “বাবি বাবি” ডেকে উঠতে না?

মন থেকে খুলে পড়া মন তক্ষক হয়েছে
পথহাঁটাগুলো ভাবো বরখুরদার, যার শেষে তিনশো পৃষ্ঠা বই-বিভাজিকায়
থুতনি নেমে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
তোমার পিলারে বেশি লোড দিয়ে ফেলেছিল টুকে-পাশ ইঞ্জিনিয়ার!
সেই থেকে সহ্যকে যন্ত্রণা করি। বিকেলও প্র‍্যাকটিস করে সিঙাড়ায় — তুমি এক কামড় আমি এক কামড়ের পালটা সরগম।
লিকার চায়ে কদমের রেণু উড়ে আসে।

সব একরকমই আছে
নাদালের ফেডেরারকে হারানো, বর্ষাদুপুরের বশীকরণ
আমারও সাড়া দেওয়ার গলা পালটায়নি গো….

শুধু এ-শহরে একটাও নর্দমা নেই কেন চোখের জল বেরিয়ে যাওয়ার?