চন্দন ভট্টাচার্য এর সকল পোস্ট

নোটস ফ্রম জ্বরের বিছানা

চুপ করে শুয়ে থাকতে থাকতে একটা প্রশ্ন মাথায় এল। আচ্ছা, আমরা “রিভিলিং ক্লোদস” কথাটা বলি কেন?

এক
পোশাক শরীরকে আচ্ছাদন দেয় — যে-পরিমানে প্রতিটা মানুষ নিজেকে নিজের মতো করে নগ্নতা আর প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে আড়াল করে। [সেই সঙ্গে নিশ্চয়ই ঢেকে রাখার ধরণটা যতখানি সম্ভব সুন্দর করে তুলতে চায়। তাই বোরখাতেও নানা রঙ আর সুতোর কারুকাজ]। অবাক লাগল ভেবে যে “প্রকাশকারী” আর “জামাকাপড়” এই দুটো শব্দের যাত্রা তো একে অন্যের উলটো দিকে, কাজেই ক্লোদস-এর আগে রিভিলিং বসালে সেটা অক্‌জিমোরোন-এর উদাহরণ হয়ে উঠবে শুধু!

শব্দার্থ আরেকটু খুঁটিয়ে জানার জন্যে ডিকশনারির সাহায্য নেওয়া যাক। অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধান খোলাখুলি লিখেছে, রিভিলিং জামাকাপড় তাই, যা পরিধানকারীর দেহের অনেকখানি দেখিয়ে দেওয়াকে অনুমোদন দিচ্ছে। কেমব্রিজ ইংরেজি অভিধান বলল, যা প্রথার (usual) চেয়ে বেশি শরীর দেখায়, তাই রিভিলিং। এমন কিছু উন্মোচন করে যেটা আগে জানা বা দেখা ছিল না।

কাজেই, দ্বিতীয়বার আরও বড় করে অবাক হওয়ার সুযোগ সামনে এসেছে! কিছু ড্রেস তাহলে শরীর ঢাকে না মোটেই, বরং উন্মুক্ত করে? রিভিলিং অঙ্গবাস জানলার মতো, নিজেই দেখায়! তার কাজই হচ্ছে…না নিজেকে দেখানো নয়। গোটা অঙ্গকে? উঁহু, তাও নয়। শরীরের শুধু আ-ঢাকা অংশ, অথবা, যা আবৃত হয়েও অনাবরণকে ফুটিয়ে তুলছে — তাকে দেখাবে [এখানে লেখা উচিত ‘না-ঢাকা’ — মানে যা ইচ্ছে করেই অপ্রকাশ রাখা হয়নি]।

খুব অদ্ভুত লাগে শুনতে, না? সাধারণ ভাবনায় মনে আসে, জামাকাপড় দেহের না-ঢাকা অংশ দেখাবে কেমন করে? যেটুকুতে আড়াল থাকবে না, তা তো আপনা থেকেই দৃশ্যমান! সুতরাং, অঙ্গবাসের নিজের ভূমিকাকে এখানে উলটে দেওয়া হয়েছে। যে সান্ত্রী, সে-ই গোপনে সিন্দুক খুলছে! অথচ দেখুন, কম্পিউটার আমাদের কতকিছু দেখিয়েছে, শিখিয়েছে; তবু রিভিলিং কম্পিউটার তো বলি না কেউ!

মজার কথা হল, প্রায় একই ধরণে একটা “সেন্স রিভার্সাল” হয়েছে “রিভিলিং” শব্দের গঠনেও।
“রিভিল” ইংরেজিতে এল ওল্ড ফ্রেঞ্চ reveler বা ল্যাটিন revelare থেকে। শব্দটার দুই অংশ: re মানে আবার, আর velum বলতে veil। সুতরাং, রিভিল-এর মূল অর্থ: পুনরায় আবরণ পরানো বা পুনর্গোপন করা। কিন্তু “re” উপসর্গ এখানে বিপরীত মানেতে ব্যবহার করা হয়েছে — “আবার”-এর বদলে “কখনও নয়” অর্থে। অনেক ভাষাতেই এমন উদাহরণ পাই, বাংলায় যেমন “অপ” একটা নেগেটিভ উপসর্গ। অপ আসছে অপগত থেকে যার মানে বিগত, পলায়িত, প্রস্থিত, দূরীভূত, মৃত, রহিত। তাহলে যার রূপ নেই সে-ই তো অপরূপ হওয়ার কথা? এদিকে আমাদের ভাষায় “অপরূপ” মানে অপূর্ব বা অতুলনীয় সৌন্দর্য, যার সামনে পড়ে কবিদেরও বিশেষণ হাতড়ে বেড়াতে হয়!

[দেরিদা The Animal That Therefore I Am লেখাতে মানুষ আর পশুর প্রতিতুলনায় নগ্ন (naked/nude) আর সজ্জিত (clothed) নিয়ে কথা বলেছেন। ওঁর নজর নিশ্চয়ই রিভিলিং শব্দটায় পড়েনি। তাহলে হয়তো আর একটা প্রবন্ধ পেতাম যেখানে মানুষজাতির মধ্যে আলোচনা সীমিত রেখে দেরিদা বলতেন, কোনও কিছুকেই উন্মোচিত করা যায় না, দেখানোর অর্থ আসলে নতুন করে তাকে ঢেকে দেওয়া। আর এইভাবে নগ্ন-সজ্জিত বাইনারির মধ্যের তফাতটাকে দিতেন অস্পষ্ট করে]।

দুই
বেশ, তাহলে বসন জীবিত এক অস্তিত্ব। সে সক্রিয় কর্তা। পোশাকের এই রকম এক নির্ণায়ক ভূমিকার কথাই পেলাম ওপরের আলোচনায়। কিন্তু কাহিনি এখানেই শেষ হচ্ছে না।

অভিধান একটা উদাহরণ এনেছে “রিভিলিং” শব্দটার ছবি মনে ভালোভাবে গেঁথে দেওয়ার জন্যে — “একজন মানুষ সত্যি সত্যি কী ভাবছে সে-ব্যাপারটা খুব রিভিলিং হয়ে উঠতে পারে তার বলা একটা জোকসের ভেতর দিয়ে”।

তাহলে বোঝা গেল, স্পিচ যেভাবে জীবিত সত্তার বৈশিষ্ট্য, বেশবাস সেরকম তো বটেই। তার ওপর, ঠিক যেমন কথ্য বা লিখিত শব্দের চেতনা আছে, পোশাকও নিজস্ব বোধ বহন করে চলে।

কনজিউমার সংস্কৃতিতে এই ব্যাপারটা আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। জীবের অধিগমন চলছিল জড়ের দিকে এবং উল্টোটাও। মনের যাত্রা হচ্ছে শরীর-পানে আবার বিপরীত স্রোতও মিথ্যে নয়। সেই একই “রোল রিভার্সাল” বা ভূমিকা বদলের গল্প। কেননা, যদি কেউ মনকে কমিয়ে শরীরের মাপে এনে ফেলতে চায়, তাহলে তাকে জড়বস্তুতে সজীবের মহিমা আরোপ করতেই হবে। উদাহরণ হিসেবে পোশাক-ব্যবসাকেই নেওয়া যাক। “অনেস্ট শার্ট” — এই বিখ্যাত ব্র্যান্ডে সততা যেন শার্টের সুতো, রঙ আর ডিজাইনের গায়ে লেগে আছে। স্থানান্তরিত বিশেষণের উদাহরণ, আমরা স্কুলে পড়তাম। অর্থাৎ সততা আপনার ভেতর-সত্তা থেকে “উভর কে” শার্টের শরীরে চলে এসেছে। যে লোকটা জানে সে সৎ নয়, সে-ও (ফলত সকলেই) ওই ব্র্যান্ডের একটা জামা পরে নিতে উদ্বুদ্ধ হবে। একইভাবে “দ্য কমপ্লিট ম্যান”-এ ট্যাগ লাইনটা বোঝায়, রেমন্ডস-এর কাপড়ের সুতোয় বোনা আছে একজন দায়িত্ববান বাবা, যত্নবান সন্তান, আবেগময় প্রেমিক — এক কথায় সম্পূর্ণ পুরুষ সত্তা।

তিন
এই পর্যন্ত এসে আমার নিজের কাছে যে প্রশ্নটা দাঁড়ায়: “প্রকাশকারী পোশাক” (revealing clothes) এই পরিভাষা একটা নারীবাদী পাঠ দাবী করছে কি না।

প্রথমত, “রিভিলিং ক্লোদস” শব্দদুটো এখনও পৃথিবী জুড়ে শুধু মেয়েদের সজ্জার বেলাতেই ব্যবহার করা হয়।
দ্বিতীয়ত, মেয়েদের মন থেকে তার শরীর আরও দূরবর্তী হয়ে গেল মাঝখানে “ড্রেস” নামের “তৃতীয়” ঢুকে পড়ায়। মনের এজেন্ট, মুখপত্র যেন সে — এই অঙ্গাবরণ। তারপর ভোগবাদের মহিমায় নারীর চেয়ে তার পরিচ্ছদ বেশি সক্রিয় হয়ে উঠল। ধরুন, আপনি একটা মেয়েকে সান্ধ্য পার্টিতে নেমন্তন্ন করেছেন। তার মানে আপনি আসতে বলেছেন তিনজনকে: তার ড্রেস, তার শরীর আর সবশেষে সে নিজে।

তৃতীয়ত, যখন সৎ শার্ট বা সম্পূর্ণ পুরুষের কথা বলা হচ্ছে, পরিচ্ছদের চেতনা আর পরিধানকারীর চেতনা পরস্পরের হাত ধরে আছে, বিদ্যুতের সার্কিটে একটা “সিরিজ”-এ যুক্ত হয়ে থাকার মতো। ফলত পুরুষের সত্তার নেট লাভ হচ্ছে এ-থেকে; যদিও আবেশিত (induced), উদ্ভাস আসছে তার সত্তায়। কিন্তু “রিভিলিং ক্লোদস”-এর চেতনা মেয়েটার মানসিক গুণাবলীর সঙ্গে “প্যারালাল” সার্কিট তৈরি করে আছে, তার দীপ্তি কমিয়ে দিচ্ছে। তাই সত্তা অন্ধকার, তিনের মধ্যে তৃতীয়, মঞ্চে না উঠতে পেয়ে সাজঘরে দাঁড়িয়ে। সমাবেশে যাচ্ছে তার সজ্জা আর সজ্জা কর্তৃক রিভিলড গতরটি। কারণ, এখনও পর্যন্ত আপনি একই সঙ্গে মাইন্ড আর বডিকে সমান উচ্চতায় ধরে রাখতে পারেন না, কেননা সমাজমননে এখনও এ-দুটো বিপরীতগামী বলে কথিত, একে অন্যের আলো নিভিয়ে দেয়, তাই কনজিউমারিজম দুটোর কোনও একটা পক্ষ বেছে নিয়েছে। পুরুষের বেলায় সে মূলত তাদের অর্জিত গুণকে আন্ডারলাইন করে যার মধ্যে অবশ্যই অর্থসম্পদ পড়ছে — আর নারীর ক্ষেত্রে এখনও অনেক সহজ তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া শরীরী সম্পদের ঘোষণায় ব্যস্ত থাকা।

তবে বদল তো আসছেই। মেয়েদের পোশাকের বিজ্ঞাপনকে একদিন অক্‌জিমোরোন-মুক্ত হতে বাধ্য করবে মেয়েরা। রিভিলিং মাইন্ড কথাটা সেখানে বাজবে বাঁশির মতো।

ডায়েরি : পথিক প্রজাপতি

তোরা তো শুধুমুখে বড় হয়ে গেলি!
আতাগাছ থেকে পড়ে কনুই ভাঙল না ক্লাস ফাইভে, সাঁতার শেখানোর নামে পাড়ার টিকাশদা কলপুকুরে ছেড়ে দিল আর প্রাণ বাঁচাতে জলে হাঁচোড় পাঁচোড় করে ভাসনশিক্ষা ও জীবনের ব্রহ্মজ্ঞান – দুইয়ের কোনটাই হল না তোদের। মাঝরাতে পাতিশেয়ালের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে মাকে জড়িয়ে ধরলি না, জংগলে ছক্কা-খাওয়া বল খুঁজতে গিয়ে আলকুশিতে ঢোল হল না পায়ের ডিম, টিউশানি পড়ে ফেরার পথে গাছের চুলে হলুদ ক্লিপের মতো জোনাক দেখলি না, দিদিমার কিশমিশ বুক মুখে পুরলি কই মায়ের জোর করে দুধ ছাড়ানোর সান্ত্বনায়?

ভোরবেলার শিউলি-কুড়নো ক্লাসে নাম লেখালি না তো, সন্ধেবেলার অষ্টোত্তর শতনাম ক্লাসে! দশ পয়সার লাল কাঠি-আইসক্রিম খেয়ে বোনকে দেখাসনি মাকালী, তাছাড়া মাটির পুতুলের মুণ্ডু ভেঙ্গে যাওয়ার যে কান্না, সেই অতুলনীয় জলেভাসা চোখও বা কোথায় হারালি, বল! কচুরিপানার ঢিবির ওপর ছুটতে গিয়ে গোড়ালিতে পেরেক ফুটল কি একটাও, আর সেখানে রাতভর প্রদীপের পলতে পুড়িয়ে স্যাঁকা? এই “সত্যি কাহিনি”ও শুনতে পেলি না যে স্কুলের স্যার একটা ছেলেকে চুলের মুঠো ধরে টানতেই ডানহাতে খুলির কর্তাল উঠে এসেছে — ভেতরে গিজগিজ কেন্নোর বাচ্চা!

সন্ধের মুখে আকাশের এপাশ থেকে ওপাশ টিয়ার ঝাঁক চলে যেত, ধরো এক একটাতে একশো-দেড়শো টিয়া আর জমি ছিল আপামর ফাঁকা… তার নয়ানজুলিতে তিনচোখো, ল্যাটামাছ, কই তোদের ছিপ হাতে বসিয়ে দিল না যে-কোনও শ্রাবণে। পকেটে চল্লিশ টাকা, সিনেমা দেখতে বেরিয়ে একা রওনা দিলি না দুদিন দুরাত হাজারদুয়ারি…

গুটির মধ্যেই চুপচাপ তোরা পায়েচলা প্রজাপতি হয়ে গেলি রে, বাবান!

প্রাইভেট ফার্মে এটা হবে

১.
আমার ভালোবাসার সামনের দুটো দাঁত ফাঁকা

ভালোবাসলে বীভৎস দেখায়

২.
ইরানি ট্রফির প্রথম পনেরোতেও যেদিন আস্তানা দিলে না
তবে থেকে ঘুমের হসসোউকার খুলে হাওয়া
আজ অবসর ঘোষণার পর যন্ত্রণায় দাঁড়ি পেল মুটিয়া মন

শুধু ভারি চোখদুটো
শুক্রথলি ভারি হয়ে আছে

৩.
আমার লাইফ রজনীকান্ত্‌
একমুখ দাড়ি কেটে চুলটা একটু ফুলিয়ে নিলেই ছাপ্পান্ন সপ্তাহ
কিন্তু আসলে ফাঁকা বাড়িতে একা খালি পেটে শুয়ে থাকে রজনীকান্ত্‌
তাকে কেউ ভালোবাসে (“না”-টা ইকো হবে)

জ্বলন্ত সিগারেট ডিগবাজি খেয়ে নামছে পেট্রোল সাগরে

৪.
যতই বলুক তৃষ্ণা
ওকে জল কিছুতে দিস না

৫.
তুমি হাই প্রোফাইলের কাছে গেছ
এই সপ্রতিভ যাওয়া তোমাকে জীবনের
“কভি গম” অংশটুকু দেবে না
তুমি আকর্ষণীয় চোখ, দারুন পি.আর.
আর দিনে পঞ্চাশটা পুশ আপ-এর কাছে …. একটা জব
হাতে থাকতে বেটার অপশানে চলে গেছ

প্রাইভেট ফার্ম বলেছে কেন, বস !

৬.
কবিপ্রেম অনেক ঝামেলা
তবে মিনিটে মিনিটে ঘর খালি — এমন ভাড়াটে পাবি না

শেষে ভয়াবহ লাগে কিরায়া! গদগদ ক’রে এতো দেবে
মুন্ডু খুলে যমুনায় পিছলে যাবে তোর ……

৭.
ও-জানোয়ার তোকে বিখ্যাত ক’রে গেল বুঝতে পারছিস না?
রেসিপি খসছে না হৃদয় থেকে?
এই সুযোগ, দুর্দান্ত সব আইটেম নামা, চন্দন!
ফুসফুসে আইসক্রিম জমিয়ে শিরায় গাজরের স্টু সাজাবি
আর হ্যাঁ, কাঁদতে কাঁদতেই ব্যালাডের সুরে ঠোঁটের স্যালাড কুচিয়ে নে

কতদিন দুটো পেটভরা দিসনে আমাকে, বাবুজান !

৮.
এই প্রেম বারোমাস
এই প্রেম চিরদিনের
আমি বনগাঁ লাইনের সেই দৃষ্টিহীন প্রেমিক
তবে ইশারা করলে দিতে পারবো না
হাত বাড়িয়ে স্পর্শ ক’রে চেয়ে নেবেন

আমিই সে
প্রতিদিনের পরিচিত —-
সোনামুগ ডালে কাঠকয়লার আঁচে তৈরি বাংলার ঝিরিঝিরি নিজস্ব ভালোবাসা

আছি, বলবেন।

যেখানে বল

পাড়ার ক্লাব প্র‍্যাকটিস ডে বিকেল
রুমালি মাঠ বত্রিশ জন কী খেল!
সরু সরু পা গোলালু মুখ লকেট —
বুকে ঝুলছে, শট মারলো— রকেট

“গা ব্যথা হবে ছুটো না বাবা”: পিঙ্কি
কু গাইলি তো? নখ উলটে ফিনকি…
বল কুড়োতে হেবি ক্যাচাল উটকো,
ফ্রিকিক নিলো দুশোটা প্রাণ ফুচকোর

গোল কিপার কম শুনছেন কানে
চলবে, কিন্তু বিকাশ ট্রাকশানে
শিব রাত্তিরে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ, ওমা —
চিনুদাও ডুব? লেখকটাকে নামা

ভাঙের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি ধুতরো,
“ফেয়ার প্লে কাপ” জিতেছি ক্ষুদ্র!
বান্দা কেমন খেললো শুনবেই?
যেখানে বল সেখানে আমি
নেই…

যোগমায়া

আমি এমন ব্যবস্থা রেখেছি
সব তান্ত্রিক নিভে গিয়েও আমার ধুনি জ্বলে!
মেঘের গর্জন শেষে মৃদু হাসি বইতে থাকে — ভোর,
আমি এমন লাইনঘাট করেছি…

যোগ ও মায়া — দুটির একত্র বলে
নিজেকে উদ্ধার করেছি, আমার
রতিমোক্ষ শরীরে হয়েছে
আর মন ধুনুচিধোঁয়ার মতো অনর্গল ভয় তুলে তুলে
ওই দেখো, ভস্মমাখা ছাই
চলাচলই আমার দরোজা, তার বাইরে তাকালে
হৃদস্পন্দনের মতো ছোট পথ,
জলের দুর্দান্ত কাছে পাখি বসে আছে

এতদিন শুকনো নদীর ‘পরে সেতু টেনে গেছি
আজ রাতে ঢেউ এল একান্ত উপায়হীন এলোকেশী ঢেউ, তার
নাভি ঘিরে রক্তগাঁদার মতো আলো

আমি ভালো আছি
আমার ঈশ্বর পথে বসেছে আজ

সংকীর্তন

যেভাবে বুকের মধ্যে বরবউ নামিয়ে খালি রিকশা ফিরে যায়
যেভাবে সাদা সন্দেশ হয়ে অনুরোধের রোদ ফুটে আছে
যেখানে বেড়াল বাচ্চা-পাড়ার জায়গা খুঁজছিল — মাথায় গুলাম আলি খান

সকালবেলার সুর চন্দনসমান

প্রতিদিন দশ মিনিট আকাশের ক্লাস
খবরদার কেউ যদি সূর্য দেখে চোখের পলক ফেলেছিস!
না হলে কী করে হবে পায়েসগাছ রান্নাঘরের পেছনে?
যেদিন বাজারের পয়সা থাকে না, তিনটে পায়েসপাতা
কড়াইতে ফেললেই ঘিভাত, মাংস, পাঁপড়, মিষ্টি পান…

সকালবেলার স্বপ্ন চন্দনসমান

দুটো ইঁটে চারভাঁজ বস্তা পাতা জাজমেন্ট সিট
দু’পায়ের পাতার মধ্যে কালোবজ্র হাতুড়ি পড়ছে
ঘুরে-ফিরে যতবার দ্যাখো, খোয়াভাঙা মিস্তিরি
একটু করে উঠে যাচ্ছে নিজস্ব টিলায় আলিশান

সকালবেলার ঘাম চন্দনসমান

আজ আবার বেহুঁশ জ্বর আপনার বন্ধুর
সারা গা ঝাঁঝরা, কোথা থেকে রক্ত টানে বলুন তো!
মুখে কিছু দিলে বমি, শুয়ে আছে, শুয়েই — যেন বিছানা নক্ষত্রযান

সমস্ত, যে কোনও যাওয়া…

ঐতিহ্য

বউ তখন আনকোরা। কেশবতী কন্যা আর চাবুক হাতের রান্না। শুধু তরকারিতে, মাছের ঝোলে মাথার চুল পড়ে থাকে, বড্ডো ঘেন্নার জিনিস।

বরও টাটকাই তো। তাই গরাস মাখতে গিয়ে ইলেকট্রিক তারে বসা কাকের সারির মতো লম্বা চুলের গায়ে ভাতের দানা ঝুলতে দেখলে বমি পেয়ে যায়। খেতে বসে মনকষাকষি।

আস্তে আস্তে অপছন্দকে ঐতিহ্য হিসেবে মেনে নিল সংসার। তিন-দশ তিরিশ বছর পার করে এখন গিন্নির মাথা কেশবিরল, রান্নার হাতেও পুরনো ম্যাজিক আর নেই।

আজ সকালে বাজারের ফর্দ দেওয়া হচ্ছে কর্তাকে:-
স্টেশান-বাজারে পেলে একটু খলসে মাছ এনো, কাঁচালংকা, কালোজিরে পঞ্চাশ গ্রাম বাসুদার দোকান থেকে, আর আর… সেই জিনিস দুচারটে।
কোন জিনিস?
ওই যে গো, বিউটি পার্লারে গিয়ে বললেই পাবে।

দেখি, রান্নায় পুরনো তার ফিরে আসে কিনা!

সম্পর্ক ডাউনলোডেড

বেঙ্গালুরু থেকে আলোদ্যুতি লিখে পাঠিয়েছে:-

“বাসে মেয়েটার পাশের সিটে একটা ছেলে এসে বসল। প্রথমে তো মেয়েটা শরীর গুটিয়েটুটিয়ে সরে গেছে জানলার দিকে, মুখে কোঁচকানো বিরক্তি। আর পুরুষ মনে মনে অপ্রস্তুত। কিছুক্ষণ যায়, বাসের আচারমাখা ঝাঁকুনিতে ঢিলে হয়ে আসে বিভাজন, মেয়েটার শ্লথ হাত এসে পড়ল ছেলের কোমরের কাছে।

ছেলেটার মনে বেড়ালের গুড়গুড়ুনি শুরু এবার। নিশ্চয়ই ইশারা দিচ্ছে ওপক্ষ, চাইছে আমি সক্রিয় হই — ভেবে যেই একটু তেমন-কিছু-না করতে গেছে, মানে দুটো পায়ের মধ্যে অ্যাঙ্গেলটা কুড়ি ডিগ্রি মতো বাড়িয়ে ডানহাতের কনুই সাইড ওয়াইজ ছ’ইঞ্চি ওপরে তোলা, মেয়েটা ধড়ফড় করে আবার “প্যারেড সাবধান” হয়ে গেল, হল পুনর্কুঞ্চিত ভ্রূ।

সে তো ভয়ে ভয়ে সরেই বসেছিল, পাশের খালি চেয়ারে দাড়িগোঁফ উদিত হোক কি মসৃণকামানো গাল, বিরক্ত তাকে করবেই। তারপর যখন দেখা যায়, ছেলেটা ভদ্রমুখ, মোবাইলব্যস্ত, নিশ্চিন্ত হয়ে নিজেকে একটু কমফোর্ট দিতে চেয়েছে। ব্যস, ওমনি ভুল অনুবাদ, গলত উদ্ধৃতি। আবার তড়াক করে সিয়াচেন গ্লেসিয়ারে রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে পড়তে হল মেয়েটাকে”।

আমার মনে পড়ল কোন হিন্দি সিনেমায় যেন বোমান ইরানি অল্প পরিচিত বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে এইরকম এক আশায় জামাপ্যান্ট খুলে শুধু অন্তর্বাসে সোফায় বসে পড়েছিল।

আলোদ্যুতিকে লিখলাম, ছেলেদের এই আচরণের পেছনে শুধু যে পুরুষতন্ত্র কাজ করছে, এমন তো নয়; তার যৌন-মনস্তত্বও তাকে ভাবাচ্ছে এভাবে। স্পিসিস হিসেবে প্রকৃতিতে তার ভূমিকাই হল রক্তদানের চেয়ে অনেক স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুক্রানুদানের জন্যে তৈরি থাকা। সেখানে গ্রহীতার মান কেমন তা বিবেচনাতেই আসছে না। তার ওপর যদি সে মনে মনে পুরুষতন্ত্রের শক্তপোক্ত ধারক হয়ে থাকে, তবে গ্রহীতার অনিচ্ছেকেও এক চুটকিতে উড়িয়ে দেবে। শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের অবির্ভাব হচ্ছে এখানে। পুরুষের যৌন-আচরণের এই দুটো ভাগকে (প্রকৃতিনির্দিষ্ট ভূমিকা আর অত্যাচারী ভূমিকা) আলাদা করে না বুঝলে সমস্যাটাকে মেটানো সহজ নয়। দ্যাখো, এখানে মেয়েটার রিল্যাক্সড হয়ে বসার একটা গলত মানে করেছে ছেলেটা। কেন? কারণ, সে নিজে ইচ্ছুক বলে ভাবছে অপরপক্ষও ইচ্ছে করবে। এটা কিন্তু জেন্ডার নির্বিশেষে সাধারণ মনস্তত্ব। আমরা প্রত্যেকেই ধারণা আর আশা করি, বাকি মানুষেরা আমার মতো হবে। না হলে বিরক্ত হই, তাকে ভুল প্রমাণ করি, পাল্টাতে চাই।

আলোদ্যুতি আমার ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত হল: হ্যাঁ, এটাই প্রাইমরডাল পুরুষ। তার বলপ্রয়োগ আটকাতে গেলে তাকে যে শিক্ষা দিতে হবে সেটা মানবিকতা আর সিভিল রাইটসের। কিন্তু পুরুষের দাতাকর্ণভাব থামাতে তার মাথায় এই কথাটা গজাল-পোঁতা করা দরকার যে তুমি যেভাবে যৌনতাকে দ্যাখো, উঠল বাই তো কটক যাই, সেভাবে একটা মেয়ে ভাবে না। কাজেই নারীর যৌন-উদ্দীপকে সাড়া দেওয়ার এই মনগড়া কাহিনিগুলোকে ফেলে না দিলে পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গাটাই শুধু নষ্ট হবে।

আমি প্রশ্ন করলাম, তোমার কি মনে হয় না মেয়েরাও নিজের প্রাচীন চরিত্রগত কারণে একইভাবে ছেলেদের বুঝতে ভুল করে? যদি তা না ভাবো, বলতে বাধ্য হব যে নারীবাদ মেয়েদের ‘ফার্স্ট সেক্স’ প্রমাণ করার চেষ্টায় আছে।

আলোদ্যুতি হাসিমুখের ইমোটিকন পাঠালো: আরে দাঁড়াও দাঁড়াও, কথা এখনও শেষ হয়নি। মেয়েরা যেহেতু গ্রহণকারী, তাকে নিষিক্ত ডিম্বানুটাকে বহন করে সন্তানের জন্ম দিতে হবে, বাঁচিয়ে রাখতে হবে, বড় করতে হবে, তাই তার পক্ষে নির্বিচারে শুক্রানু আহ্বান করা সম্ভব নয়। নারী এমন পুরুষই খুঁজবে যে তার সংসার আর সন্তানকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা আর রিসোর্স যোগাতে পারে। কাজেই তার পক্ষে পূর্বরাগ খুব দরকারি ব্যাপার। এই সময়টাতে আসলে সে গুগল সার্চ করে বুঝে নিতে চাইছে, এই পুরুষ তার সন্তানের বাবা হওয়ার যোগ্য কতটা। কাজেই নারীর পক্ষে সমস্ত বিবেচনা শেষ হওয়ার পর, অন্য সব সিদ্ধান্ত মোটামুটি পাকা হয়ে গেলে যৌনতার অবির্ভাব হয়। এই প্রবণতা থেকে মেয়েরাও ছেলেদের ‘সেক্স ফার্স্ট’-এর মনোভাবকে দেহসর্বস্ব ও ধান্দাবাজির ঘটনা বলে মনে করে। মজার ব্যাপার হল, দু’দলেরই প্রবণতাগুলো এত গাঢ় মনস্তাত্বিক যে, যেখানে যৌনসম্পর্কের লক্ষ্য সন্তান উৎপাদন নয়, সেখানেও একই অধিনিয়ম লাগু থাকবে।

আমি জানালাম: ঠিকই বলেছ। কোনও সফটঅয়্যার ডাউনলোড করার সময় যেমন নেক্সট লেখা তীরচিহ্ন দ্যাখায়, তেমনি ছেলেদের বেলাতে পদ্ধতি হচ্ছে প্রেম থেকে যৌনতা, বা যৌনতা থেকে প্রেম থেকে যৌনতা। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রেম থেকে যৌনতা থেকে সংসার থেকে সন্তান থেকে সংসার। আমি এই চেইনের শেষ মানে “ফিনিশড” অবস্থানটাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, যা ছেলেদের বেলায় যৌনতা আর মেয়েদের জন্যে সংসার।
— সংসার মানে কি ফ্যামিলি?
— হুঁ, পরিবার শব্দটাও বসানো যেতে পারে।
— আমার মতে যৌনতা ফিনিশিং পয়েন্ট নয় পুরুষের। সে এসে থামে সম্পত্তির ধারণায়। যৌনতা থেকে প্রেম থেকে সম্পত্তি।

আমি বললাম, প্রচুর ধন্যবাদ। মনে হচ্ছে, একদম ঠিক বলেছ। এবার এই ভাবনাগুলোকে প্রয়োগ করার জন্যে আমরা বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের ভাঙন নিয়ে এগোতে পারি। চিড় খাওয়া বিবাহজ সম্পর্কের উদাহরণ নেব না কারণ সেখানে রাষ্ট্র আর সমাজের চাপ আর অন্যান্য নানা কারণ ভাঙা হাড়ে প্লাস্টারের কাজ করে।

তুমি দেখবে, দুটো বিবাহিত মানুষের মধ্যেকার প্রেম ভেঙে যাওয়ার একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে। মেয়েটা কিছুদিন পরেই অনুভব করবে, তার প্রেমিক আসলে ভালোবাসে নিজের স্ত্রীকেই। তার কাছে বউই প্রায়োরিটি, প্রেমিকাকে শুধু যৌনসঙ্গী হিসেবে বা অন্য কোনও উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। আমার ধারণা, একটা মেয়ে বিশ্বাসই করতে পারে না কোনও পুরুষ নিজের সংসারে বাস করেও মানসিকভাবে বিযুক্ত থাকতে পারে, যেহেতু সেটা সে নিজে খুব কম পারে।

আলোদ্যুতি লিখল, একই ভাবে কোনও ছেলে বিবাহিত মেয়ের সঙ্গে প্রেম শুরু করলে কিছুদিন পরই তাকে প্রমিসকিউয়াস ভাবতে শুরু করবে। পুরুষের কাছে যেহেতু এন্ড পয়েন্ট হল মেয়েটিকে নিজের সম্পত্তির বানিয়ে ফেলা যার মূলে তার যৌন-সতীত্বের ধারণা কাজ করছে, সেখানে বিবাহিত মেয়েকে নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া খুব মুশকিল। ছেলেটা প্রথমে ভাবে, মহিলা মিথ্যে বলছে, হাজব্যান্ডের সঙ্গে সব রকম সম্পর্কই আছে এর। তারপর আবিষ্কার করে মেয়েটি একই সঙ্গে আরও নানা পুরুষে আকৃষ্ট, মানে আপামাথা ‘চরিত্রহীন’।

আমার শেষ মন্তব্য ছিল: তাহলে আলোচনার বাইরের দরজায় পৌঁছে আমরা বলতে পারি — নারী বা পুরুষের জৈব-বাস্তবতা বা বায়োলজিক্যাল রিয়ালিটি থেকেই প্রাথমিকভাবে তার দেহ-মনস্তত্ব গড়ে ওঠে। আর সেই দেহ-মনস্তত্বই তার যৌন-আচরণকে গড়ে দেয়। এর ওপর সামাজিক শক্তিগুলোর প্রভাব থাকে ভীষণ রকম। এইভাবে বুঝতে পারলে ছেলে বা মেয়ে কাউকেই তার সেক্সুয়াল বিহেভিয়ারের জন্যে অতিরিক্ত দায়ি করার দরকার পড়বে না। জেন্ডার-স্পেসিফিক শোষণগুলো থেকে মেয়েরা মুক্তি পেলে সামাজিক চাপের কারণে দুজনের আচরণের যে তফাত, সেটা ঘুচে যাবে। তারপরেও থাকবে দেহ-মনস্তত্বের পার্থক্যটুকু।

আলোদ্যুতি লিখল: কোনওদিন মেয়েদের গর্ভে বাচ্চা নেওয়ার প্রথা বন্ধ হলে দেহকেন্দ্রিক মনোভাবের বিভিন্নতাও অনেকখানি ঘুচে যাওয়ার কথা। তখন এক-আধটা ছুটকো ঘটনা নয়, পুরুষকর্তৃক মেয়েদের ছেড়খানি করার কমপ্লেইনের মতোই ভুরি ভুরি আদম-টিজিংয়ের অভিযোগে উপচে পড়বে থানাগুলো।

— হুঁ, সাম্য আসা মানেই নৈতিক হয়ে ওঠা নয়। কাজেই, সমতার পরিবেশ শোষণও বন্ধ করে না। তবু সেটাই প্রথম পদক্ষেপ। তার সঙ্গে মিথ-মিথ্যে-কুসংস্কার সরিয়ে নারী-পুরুষের একে অন্যকে চিনতে পারা, যেটা তথ্যের কাজ, জ্ঞানের কাজ।

— আর একদিন এই দিকটা নিয়ে নয় কথা বলব আমরা।

চন্দ্রলেখা

আবার আকাশ কালো। কালো ঘোর। লেখাতে।
হাতে-পায়ে এত লেখা জমে আছে দেখে
আল কেটে দিই, হু হু করে ঝিনুক ভরে ওঠে।
আমি ধমনী-কলম দিয়ে পথ করে সেই লেখা
তুলে নিয়ে যাই কখনও কচুপাতায় এই পড়ে যাব ভয়ে ভয়ে
তো কখনও দশম মান বিনুনির ভেতর;
বিষ-দুপুরে বিধবার গোগ্রাসে, তো
ছোটবেলার রাস্তায় একটু গড়িয়েই লেখা শেষ
মুখ ফিরিয়ে দেখি আমার জীবিত মৃতদেহ
হাড়ে লেখার ঘাস গজিয়েছে
হাত থেকে ছিটকে গেছে খাতা, তাতে
সারা জন্মের ভার, তাতে নুড়িপাথরের ব্রতকথা।

চোখের দো-তারা

চোখের দোতারে এক পাখি বসে আছে
আমার সমস্ত শিরা দোলনার গুন
জীবন কোথাও যদি কম করে বাঁচে
জন্মদিন-পাতা খুলে আবার নতুন

দুই-এ ঘোরা তানপুরা-পাখা সিলিংয়ের
বাংলাভাষার চুমু — অ, আ থেকে খিও
রোদের নরম ছাঁট, ভোরসেনাপতি
সবাই ঠিকানালেখা চিরকুট নিও

ঘিরে ব’সো তাকে ওই পাখির পালক
যত জল মেঘদায়ী, আশাবরী লোক
বলো: এ কবিতা-চাঁদ যতটুকু পোড়ে
তোমার আদরে, শুধু তোমার আদরে…

নতুন বছর

ঝিনুকসাদা পরীক্ষার খাতা।
একলা ঘরে আমাকে বসালে;
দেখে দেখে আঁকব ভেবেছিলাম
তোমার চোখ তোমারই মশালে!

যেমন দেখি: গায়ে পোশাক নেই
বেরিয়ে গেছি রাস্তায়, আন্‌মনা…
স্বপ্ন — তবু লজ্জা করে জেনে
পৃথিবী এক বাথরুম-কারখানা!

পাথর-চাপা হলুদ পাঞ্জাবির
ছুটে এসেও গ্রুপ-ফটোতে লেট…
নতুন হরিণ আমার উঠোনে
পকেটে নেই আধখানা বুলেট

আজ থেকে সব আসল হবে, দেখো
তোমার আঙুল, জীবনবীণার তার
কিন্তু কবির বদলে যাওয়া বাড়ি
হাসপাতাল, না সংশোধনাগার?

(গত বছরের পদ্য)

চন্দ্রকোষ

অটো-সবুজ গাছপালা
মেঘ ভেসে যাওয়ার শব্দে
গৃহে যে শ্যামলী থাকে, চার পা, ডাকছে

যেখানেই জল, সেটি পৃথিবীর শিরা
ফাঁকা মাঠে শস্যের কীর্তন শুরু হল
মিঠে ও শমিত এই বোলে
একদিন, স্তন নিচু, আমাকে কুড়িয়েছিলে, ফুল!

নিজের দীপ্তি নিভে সবচেয়ে শান্ত এই সন্ধে হয়ে যাওয়া,
যখন একটু গলা টানতেই মুখে অস্তিত্ব উঠে আসছে।
রাত দু’ইঞ্চির বেশি অগভীর দেখে
সিঁদূর-ধুতির ছাপে তখনও আকাশ মা-কালী!
এই ক্ষণে কতবার পুব থেকে দক্ষিনপ্রবাসী হল যে সৌমিক

আমার পরেও কত চাঁদ চিরকাল মেঘে লুকোবে…

আকাশপত্রিকা

আকাশ ভরে পংক্তিগুলো লিখি
জীবনের এই প্রথম আকাশ, লম্বা শোভন পাখিদাগ দেওয়া
আমি আজ ছুটি থেকে ফিরেছি — যেখানটায়
আকাশের সাদা সোমবার সবুজ ঝাঁক বেঁধে সাঁতার কাটছে

একতলা ছোট ছোট ঘর আকাশের, হালকা-য় সময়ভর্তি করা।
আমি ঘুমিয়ে পড়লে এমন আকাশ মাথার বালিশ হয়ে দেখা দিয়েছিল

এক এক দিন হয় কি, মেঘের নিচে ডোবানো পিয়ানোয়
আমার সহস্রগুলো আঙুল বাজাই
দেখি তুমুলের তুমুল ঝড়ে চারকোন খুলে গিয়ে আকাশ
উড়ে যাচ্ছে, আর পতাকার মতো নিচে নামতে থাকা তারামণ্ডল
চার-পাঁচটা চাঁদও পুরো উলটে গিয়ে মধু-জলে ছাই-পুষ্পে শূন্য মাখামাখি

তবু কথার বেশি সুরের বেশি এগিয়ে অনন্তের বেশি
আকাশের পা তো চলে না!
আমিও আকাশপত্রিকা লেখা থামাতে পারিনি
দুঃখে দুঃখে আত্মহারা এক ওরেব্বাবা নীল চেপে গেছে আঙুলে
আমার তো খালাস-মুহূর্তটা আসবে
কার কাছে কোন পদবাচ্যের বুকে এই আকাশসমগ্র ছেড়ে দিয়ে যাব…

একজন দার্শনিক হিসেবে বলছি…

ও ডোরিন, চায়নার চাইনিজ মেয়ে, তুমি অবিভাজ্য এ-কথাই সবাই বলেছে। তোমাকে কি ছোট ছোট রক্তমাখা পিরিয়ডে ভাগ করা খুব মুশকিল?

তুমি ফর্সা, আবার এশিয়ারমণী; কমিউনিস্ট, কিন্তু মঠে যাচ্ছ প্রতিদিন। মায়ের রহস্য, বাবার সংশয়, ভাইয়ের বিদ্রোহ আর কাকার তথাস্তু মিশে তোমার চোখের সমস্ত ভুরু পর্ণমোচী। হাতে পামটপ নিয়ে তুমি বাড়ির সুইমিং পুলের প্রাচীন ধর্মীয় জলে সাঁতার কাটছিলে।

সেই কবে থেকে শানবাঁধানো হয়েছ গ্রিস বা রোমের মতো; আমি তো জানি না তোমার ভাষার হায়ারোগ্লিফিক আসলে এক একজন দেবতা — এইভাবে গোটা পলিটব্যুরো আর তার শ্রেষ্ঠ যিনি, হলুদ নদীর কাছে তার প্রসাদ ন’টা অন্ধকারে তৈরি! তোমার আত্মা এই পৃথিবীতে কার কাছে রাখা আছে আমি নিশ্চিত নই। মৃত্যুর পরেও তার সঙ্গেই বিচরণ করবে কি?

আপাতত ছবিতে যে গাছটার নিচে বসে আছো তার ফুলগুলো পলিইউরিথিন। বাথটব থেকে উঠে এলে — তোমার ছোট সোজা চুল থেকে জল ঝরছে, কিন্তু যোনি পাঁপড়ের মতো শুকনো। একবার তাকালাম, কোনওদিন পূর্ণিমা না-দেখা তোমার দু’স্তনের মাঝখানে ঝুলছে অলিম্পিক মেডেলগুলো।

তুমিও কি আমার দিকে হেসেছিলে, নাকি পট থেকে কাপে ঢালা কালচে-লাল চায়ের সূক্ষ্ম স্রোতকে তোমার মুচকি ভেবেছি? খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ থেকে তিন শতাব্দীর কষ্ট তোমার চোখে লেগে আছে। একজন দার্শনিক হিসেবে এই কবিতায় আমি কোনও বীজবাক্য রাখিনি, তবু লেখাটা লুকিয়ে ফেলার আগে মনে হল তুমি সূর্যগ্রহণ, বন্যা আর ভূমিকম্প, বিপ্লব ও দুর্ভিক্ষ থেকে অধঃক্ষিপ্ত হয়েছ পৃথিবীতে। একটা লাওৎ সা একটা লাওৎ সা, একটা হান রাজা একটা হান রাজা, একটা লালসেনা একটা লালসেনা আর…
একজন ডোরিন একজন ডোরিন

সাদাগেরুয়া

এই যে আমাদের শিউলিকুঞ্জ
নিচে সাদাগেরুয়া বেড়াল বসে আছে
যাহ, বেড়াল উঠে হাঁটন দিল…

ছেলেপেটানো হুহুংকার পাশের বাড়িতে
বাড়ির পরিধি সুপুরিগাছ, বৃত্তচাপ নারকোল
আর মা ফলেষু হচ্ছে দামড়া পেঁপেউদ্ভিদ, কাতমারা
নিচে ভিখিরি দাঁড়িয়েছে — অত্যন্ত খারাপ গায়কি
কোচিংক্লাস ছোটবড় নারীছাত্র ঢেলে দিল রাস্তায়
ভেতর দিয়ে সুরুৎ করে হিরো সাইকেল

আমি ঠিক করলাম কচুগাছই হবো
নড়ানড়ি করবো বৃষ্টি-হিসুতে
গোড়ায় কোপ দাও গো কুট্টিদিদুন
গঙ্গাজলের তিনছিটে দিয়ে আমায় শিলনোড়ায় তোলো